জিন্দা লাশ
জমিদার ত্রিদেব নারায়ণের শত বছরের পুরানো প্রাসাদ বাড়িটিকে দূর থেকে অবিকল মনে হলো পাহাড়ের ওপর একটা মুকুট কেটে বসিয়ে রেখেছে কে যেন। অবশ্য ওটাকে এখন জমিদার বাড়ি না বলে হানা বাড়ি বা ‘পোড়ো বাড়ি’ নাম দিলে মানায় ভাল। জমিদারি জৌলুস কালের আবর্তে ক্ষয়ে গেছে কবে, পলেস্তরা খসা ভৌতিক কাঠামোটা কোন মতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড় চূড়োয়। প্রাসাদটার ঠিক নিচে একটা গুহা। গুহা মুখে ঢুকতেই দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেল ওদের। কয়েকজন মুখ- টুখ বিকৃত করে, হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে হোঁচট খেতে খেতে এমনভাবে সামনে এগোতে লাগল যেন কবর থেকে উঠে এসেছে সব ক’জন, জিন্দালাশ বনে গেছে। ভয় দেখাতে শুরু করল দলের অন্যান্য সদস্যদেরকে। কৃত্রিম ভয়ে আঁতকে উঠল কেউ কেউ, পরক্ষণে হেসে গড়িয়ে পড়ল ও এর গায়ে। দৃশ্যটা দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল শাহানার। বেশ মজায় আছে ওরা। এত স্ফূর্তি ভাল না। এদিকে আসতে চায়নি শাহানা। ছাত্রীদের চাপে পড়ে আসতে হয়েছে। ভিকারুন্নেসা গার্লস স্কুলে, ক্লাস এইটে পড়ে ওরা। প্রতি বছর শীতে, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে এক্সকারশনে বের হয় একেক ক্লাসের মেয়েরা। এবার শিকে ছিঁড়েছে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীদের। জুনিয়র টীচার শাহানা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার মমতাজ বেগম দলটাকে নিয়ে এসেছেন রাঙামাটিতে। পাঁচ দিনের সফর। রাঙামাটির দ্রষ্টব্য প্রায় সমস্ত জায়গা দেখা হয়ে গেছে এ ক’দিনে। বাকি ছিল ত্রিদেব নারায়ণের জমিদার বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িটিকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। একটা সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে ‘এখানে প্রবেশ বিপজ্জনক’ বলে। বিপজ্জনক এই কারণে যে, বাড়িটি যে কোন সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। মাঝে মাঝেই ছাদ থেকে ঝুপঝুপ করে বালি খসে পড়ছে, সেই সাথে দু’একটা ইঁট- পাথরও।
কিন্তু মেয়েরা ধরে বসল প্রাসাদে ঢুকতে না দেয়া হোক তারা অন্তত গুহাটা দেখে যেতে চায়। কারণ এমন রহস্যময় গুহা তারা শুধু হরর ছবিতেই দেখেছে। কাজেই এর ভেতরে ঢুকতে না পারলে তাদের জীবনই বৃথা হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েদের জেদের কাছে হার মানতে হলো শাহানা এবং মমতাজ বেগমকে। অবশ্য বাইরে থেকে দেখে গুহাটাকে মজবুতই মনে হয়। কিন্তু কোন ঝুঁকি নিতে চাইলেন না মমতাজ বেগম। গাইড ছাড়া ও গুহায় ঢোকা যাবে না, সাফ বলে দিলেন তিনি। একটু খোঁজ করতে গাইডেরও সন্ধান মিলল। লোকটা জমিদার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে। আবাসস্থলের মতই জীর্ণ চেহারা তার। শাহানা লোকটার বয়স অনুমান করতে ব্যর্থ হলো। আশি হতে পারে আবার নব্বুই ছাড়ানোও বিচিত্র নয়। গাল ভর্তি ধবধবে দাড়ি, গুহা মানবের মত বড় বড় নখ হাতে, হয়তো নখকাটার কথা ভুলেই গেছে। তার চাউনিতে কোন অভিব্যক্তি নেই, কোটরে ঢোকা চোখ দুটোয় মরা মানুষের দৃষ্টি। যেন কিছুই দেখছে না। শাহানার দিকে তাকালও না বুড়ো। নির্নিমেষ চেয়ে থাকল গুহার প্রবেশ পথের দিকে। ‘আপনার কথা বলেছে রেস্ট হাউজের কেয়ার টেকার বদরুদ্দীন,’ বুড়োকে বলল শাহানা। ‘তবে একটা অনুরোধ-প্রাসাদটাকে নিয়ে যেসব ভূতুড়ে গল্প আছে সেগুলো দয়া করে আমার ছাত্রীদের শোনাবেন না।’
শূন্য চোখ দুটি ফেরাল বুড়ো শাহানার দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকল। যেন কিছুই বুঝছে না বা শুনছে না। অথবা না বোঝার ভড়ং ধরেছে।
‘কিসের ইঙ্গিত করছি আপনার না বোঝার কথা নয়,’ একটু বিরক্তই হলো শাহানা, রাগও লাগল। বিরক্ত হচ্ছে বুড়োর ওপর। রাগ লাগছে মমতাজ ম্যাডামের ওপর। ওরা যে রেস্ট হাউজে উঠেছে সেখানকার কেয়ার টেকার বদরুদ্দীন এই বুড়োর সন্ধান বাতলে দিয়েছে। বুড়ো নাকি গাইড হিসেবে কাজ করে। মমতাজ বেগম শাহানাকে পাঠিয়েছেন ঘাটের মড়ার কাছে। নিজে আসতে পারেননি অজ্ঞাত কারণে প্রেশার বেড়ে যাবার কারণে। বদরুদ্দীন রাস্তা চিনিয়েই খালাস। তার জামাই এসেছে দুবাই থেকে। জামাইকে ‘জামাই আদর’ করতে ছুটেছে বাড়িতে। তবে যাবার আগে ত্রিদেব নারায়ণের প্রাসাদ সম্পর্কে এমন একখানা গল্প শুনিয়ে গেছে শাহানাকে যে তার হাত পা ঠাণ্ডা বরফ!
শাহানা বলল, ‘জমিদারের প্রাসাদ নিয়ে যে গল্পটা আছে তার কথা বলছি। শুনলাম জমিদার নাকি খুব অত্যাচারী ছিলেন। প্রেত চর্চাও করতেন। কবর থেকে লাশ তুলে তাদের ‘জোম্বি’ বা ‘জিন্দা লাশ’ বানিয়ে নিজের কাজ করে দিতে বাধ্য করতেন। ওই গুহা নাকি ছিল জিন্দা লাশদের আস্তানা। একদিন কেউ একজন জমিদারকে খুন করে দেয়াল তুলে লাশগুলোকে আবার কবর দিয়ে দেয়। গল্পটা আমি বিশ্বাস করিনি সঙ্গত কারণেই। তবে বাচ্চাদের বলার দরকার নেই। ওরা ভয় পেতে পারে।’ শেষের দিকে গলা কেঁপে গেল শাহানার।
কোন কথা বলল না বুড়ো, শাহানাকে ইশারা করে হাঁটা দিল গুহার উদ্দেশে। তার লম্বা হাত দুটো হাঁটু ছাড়িয়ে ঝুলতে লাগল, হাঁটার তালে ঝাঁকি খাচ্ছে। বুড়ো কথা না বললেই ভাল, ভাবল শাহানা। মেয়েগুলোকে আতঙ্কিত দেখতে চায় না সে। বদরুদ্দীন বলেছে গুহা-টুহা দেখা শেষ হলে বুড়োকে একশো টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই চলবে। গাইড হিসেবে এটাই নাকি লোকটার রেট।
বুড়ো গুহা পর্যন্ত পৌঁছুতে হাঁপিয়ে উঠল। এই এক কিলোমিটার রাস্তায় সে শাহানার সাথে একটা কথাও বলেনি। গুহায়ও ঢুকে পড়ল কারও দিকে না তাকিয়ে। ভেতরে অন্ধকার। তবে অসুবিধে নেই, মশাল আছে গাইডের হাতে। শাহানাও জোগাড় করেছে একটা। বুড়োকে দেখিয়ে সে বলল, ‘ইনি তোমাদের গাইড। ইনিই গুহা ঘুরিয়ে দেখাবেন। তবে খবরদার, কেউ লাইন ভাঙার চেষ্টা করবে না। আমি পেছনে আছি।’
ফচকে কয়েকটা মেয়ে বুড়োকে দেখে ‘হাই দাদু’ ‘হ্যালো দাদু’ বলে ভাব জমাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ওদের পাত্তা দিল না সে। মশালটা জ্বালিয়ে নিয়েছে আগেই। এবার হাঁটা দিল। মেয়েদের দলটা মশালের আলোয় পিছু নিল তার।
গুহার প্রবেশ মুখটা বেশ চওড়া, তবে খানিক এগোতে বাঁকের মুখে ওটা সরু আকার ধারণ করেছে। শাহানা একবার পেছন ফিরে তাকাল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এখান থেকে বোঝার কোনই উপায় নেই বাইরে এখনও দিনের আলো ফকফক করছে। বুড়োর মশালের আলো পাথরের দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে, ভৌতিক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে নানা আকারের। মেয়েগুলোর চেহারায় ভয় ভয় ভাব। শাহানা কড়ি কাঠের দিকে তাকাল। মাথার ওপর হাজার হাজার টন পাথর নিয়ে ঝুলে আছে ছাদ। শত বছরের পুরানো এই ছাদ যদি কোন কারণে এ মুহূর্তে ভেঙে পড়ে তাহলে কি হবে ভাবতেই শিউরে উঠল সে।
শাহানা লক্ষ করল গুহার মধ্যে ঢোকার পরে বুড়োর পায়ে যেন পাখা গজিয়েছে, রীতিমত হনহন করে এগিয়ে চলছে সে। তার সাথে তাল সামলে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে অন্যদেরকে। যেন নিজের বাড়িতে এসেছে বুড়ো হাবড়া, মনে মনে রেগে গেল শাহানা। ‘একটু আস্তে যান না, দাদু,’ পেছন থেকে গলা চড়িয়ে ডাকল সে। শুনল লাইনের সামনে ডোরিন বুড়োকে বলছে, ‘দাদু, আপনাকে আস্তে যেতে বলছেন, ম্যাডাম।’
বুড়োর মশালের আলো গিয়ে পড়েছে ছাদের একটা ঝুলন্ত, চওড়া পাথরের ওপর। মনে হচ্ছে এখুনি ওটা আছড়ে পড়বে মাথার ওপর। শাহানার স্যান্ডেলের নিচে পিছলে যেতে লাগল নরম মাটি। সম্ভবত আমরা পাহাড়ের আরেক দিকে এসে পড়েছি, ভাবল সে।
জেমি গুহায় ঢোকার আগে জোম্বি সেজে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল ডোরিনদেরকে। সে এবার লাইন থেকে পিছিয়ে এল শাহানার কাছে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওই লোকটাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।’
‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল শাহানা।
‘লোকটা নোংরা,’ বলল জেমি। ‘কানের মধ্যে মাটি ঢুকে আছে।’
‘তাতে কি হয়েছে? দেখছ না এদিকটা কাদা মাটিতে বোঝাই। কেমন স্যাঁতসেঁতে।’ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করল শাহানা।
কিন্তু ব্যাখ্যাটা মনঃপুত হলো না জেমির। সে বিড়বিড় করে কি যেন বলে চুপ হয়ে গেল।
পা পিছলে যেতে চাইছে শাহানার কাদা মাটিতে। অথচ বুড়ো এর মধ্যেও কি স্বচ্ছন্দে এগোচ্ছে। মেয়েরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাল মেলাতে। কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলল বুড়োকে আস্তে হাঁটতে। বুড়ো কানে কম শোনে কিনা কে জানে। চলার গতি মন্থর হলো না তার। প্রায় হোঁচট খেতে খেতে এগোতে হলো ওদেরকে বুড়োর পেছন পেছন।
গুহার দু’পাশের দেয়াল এদিকে ক্রমশ খাড়া হয়ে উঠেছে। হঠাৎ কে যেন শাহানার জামা ধরে টান দিল। ভয়ে আঁতকে উঠল ও। পরক্ষণে আবিষ্কার করল অমসৃণ দেয়াল থেকে পেরেকের মত ছুঁচাল পাথর বেরিয়ে ছিল, তাতে টান খেয়েছে সে। শাহানা লক্ষ করল এরকম প্রচুর গজাল বেরিয়ে আছে দেয়ালের গা ফুঁড়ে, যেন একসাথে অসংখ্য পেরেক গেঁথে দেয়া হয়েছিল এখানে। সামনে গুহাটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। মেয়েরা মশালের কাঁপা আলো অনুসরণ করে বাঁ হাতি প্যাসেজটাতে ঢুকে পড়ল। প্যাসেজটা এত নিচু যে ওদের কুঁজো হতে হলো হাঁটার সময়। ডোরিন ঢুকতে ইতস্তত করছিল। ওকে অভয় দিল শাহানা। ‘যাও। কোন অসুবিধে হবে না।’ তবে মনে মনে বুড়োকে একটা গাল দিল। প্যাসেজটার শেষ মাথায় কি আছে জানে না শাহানা। যদি দরজা বা বেড়া-টেড়া থাকে তাহলে ওটাকে আবার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। শাহানা দেখল মেয়েদের ছায়াগুলো দেয়ালে কেন্নোর মত লাগছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ডোরিন। ‘কে যেন আছে এখানে,’ বলল সে।
হঠাৎ চুপ হয়ে গেল গোটা দল। শাহানা নিজেও শুনতে পেল শব্দটা। গুহার ভেতরে, অনেক ভেতরে যেন অনেকগুলো মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে। ‘মনে হয় মানুষজন কাজ করছে এখানে কোথাও,’ উঁচু গলায় বলল শাহানা। ব্যাখ্যাটা নিজের কাছেই হাস্যকর শোনাল। পরিত্যক্ত এই গুহায় মানুষ কাজ করতে আসবে কোত্থেকে। হয়তো পাহাড়ের ওপরে কেউ উঠেছে, বাড়ি সংস্করণের কাজে নেমে পড়েছে। শাহানা শুনেছে জমিদার বাড়িটিকে আবার পুনঃসংস্করণ করা হবে। তাহলে কি কেউ জরিপ করতে এল? পায়ের শব্দ যেভাবে শোনা গিয়েছিল সেভাবে হঠাৎ থেমে গেল।
পায়ের আওয়াজ পেয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়েছিল শাহানা। আলকাতরার মত কালো আঁধার। কিচ্ছু দেখা যায় না। সে দেয়াল ধরে ধরে এগোল।
দলটাকে নিয়ে বুড়ো গাইড হাঁ করা একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। শাহানা বুড়োর দিকে এগোতে সে পকেট থেকে কি যেন বের করে ছুঁড়ল। জিনিসটা শাহানার পেছনে গিয়ে পড়ল।
ডোরিন কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিল বুড়োকে। হাত তুলে ওকে থামাল শাহানা। ওদেরকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। ঘুরল শাহানা। বুড়োর ছুঁড়ে দেয়া জিনিসটা মশালের আলোয় দেখা গেল। এক দলা কাদা। বুড়ো কাদা ছুঁড়ে মারল কেন বুঝতে পারল না শাহানা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল গুহা থেকে বেরুবার পরে বুড়োকে এ জন্যে জবাবদিহি করতে হবে।
শাহানা বুড়োর দিকে পা বাড়াল। একটা সাইড টানেলের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে, স্থির চোখে দেখছে শাহানাকে। হাতের মশাল দিয়ে মূল প্যাসেজের আরও ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করছে। মেয়েদের দলটা আরও রোমাঞ্চ আস্বাদনের আশায় হুড়মুড়িয়ে ছুটল ওদিকে। তাল সামলাতে না পেরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল শাহানা বুড়োর গায়ে। বুড়ো সাঁৎ করে সাইড টানেলের প্রবেশ পথের কাছ থেকে সরে এল। শাহানা দেখল মেয়েরা ছুটে যাচ্ছে খাঁজকাটা, অমসৃণ একটা গুহার ভেতরে। মশালের আলোয় যতদূর চোখ গেল শাহানার, দেখতে পেল গুহার দেয়ালে কাদা মাখা বড় বড় গজালের মত পাথরের পেরেক বের হয়ে আছে। সে ওদেরকে ওদিকে যেতে নিষেধ করার জন্য মাত্র মুখ খুলেছে, খপ করে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল বুড়ো, শাহানার ঠোঁট থেঁতলে গেল, প্রবল ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ল সাইড টানেলের ভেতরে।
বুড়ো শাহানার মুখ চেপে ধরে আছে ভয়ানক শক্তিতে। বুড়ো হাড়ে এত জোর কল্পনা করা যায় না। পচা মাটির গন্ধ আসছে বরফ ঠাণ্ডা হাত থেকে, ধস্তাধস্তির চেষ্টা করল শাহানা। কিন্তু বুড়ো ইস্পাত কঠিন হাতে ওকে মাটির সাথে চেপে ধরে থাকল, নড়াচড়ার জো রইল না। শাহানা শুনতে পেল ডোরিন জিজ্ঞেস করছে, ‘শাহানা ম্যাডাম কোথায় গেলেন?’ জবাবে বুড়ো তার মশাল উঁচিয়ে ধরল মাথার ওপর। বুড়ো বিরাট লম্বা হাত দিয়ে ধরে আছে শাহানাকে, অন্য হাত দিয়ে দলটাকে সামনে এগোতে ইশারা করতে তার কোনই সমস্যা হলো না। ওরা অদৃশ্য হয়ে গেলে বুড়ো গুহার আরও ভেতরে ঠেলে নিয়ে গেল শাহানাকে। প্রাণপণে লাথি কষাল শাহানা বুড়োর হাঁটুতে। ফস্কে গেল লাথি। ঠিক এই সময় রক্ত হিম করা চিৎকার শুনল শাহানা।
চিৎকার করছে মেয়েরা। প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করছে সবাই। এক মুহূর্ত পরে আবার সব চুপ। মরিয়া হয়ে লোকটার হাতে কামড় বসাল শাহানা, কিন্তু বুড়ো তাকে ঠেলতে ঠেলতে আবার গুহা মুখের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে চলল বিন্দুমাত্র অচঞ্চল না হয়ে। শাহানা দেখল ওর মশালটা ছাদের দিকে চিৎপটাং হয়ে মেইন প্যাসেজের ধারে একভাবে জ্বলেই চলেছে। বুড়োর মশালের আয়ুও ফুরিয়ে এসেছে। আলো প্রতিফলিত হচ্ছে দেয়ালে, যেন ভেংচি কাটছে শাহানাকে।
বুড়ো এবার গুহার মেঝের সাথে ঠেসে ধরল শাহানাকে। শাহানার চোখে পড়ল মাথার পাশে মাটির একটা মস্ত ঢেলা। বুড়ো মাটির নরম ঢেলাটার মধ্যে শাহানার মাথা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল শাহানা, বুড়োর মাংসের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল দাঁত। ঠিক তখন ওদেরকে দেখতে পেল সে চিৎ হয়ে জ্বলতে থাকা মশালের আলোতে। আসছে মেয়েরা।
শাহানা চালাকি করে জ্ঞান হারানোর ভান করল, বুড়ো বোধহয় হাতের বাঁধন একটু আলগা করেছিল, প্রবল ঝটকায় তাকে ফেলে দিল ও। এক লাফে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু বুড়ো একটা পা চেপে ধরল শাহানার। উত্তেজনায় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে লোকটার। বিকট লাগছে দেখতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ করছে না। মুক্ত পা-টা দিয়ে মারাত্মক এক লাথি কষাল শাহানা বুড়োকে। লোকটা আবার ছিটকে পড়ে গেল। এবার টলতে টলতে মশালের দিকে এগোল শাহানা। ওটা হাতে নিয়ে দিল ছুট। নিচু ছাদের গুহায় দৌড়াতে গিয়ে শাহানার মনে হলো যেন প্রবল উজানের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে এগোতে হচ্ছে। পেছনে থপথপ শব্দ শুনে বুঝল বুড়ো ওকে ধরার জন্যে ছুটে আসছে।
মেয়েদেরকে টানেলের শেষ মাথায় দেখতে পেয়ে আনন্দে ফুঁপিয়ে উঠল শাহানা। ওদের সারা গায়ে কাদা; খেলা করছে। আবার জোম্বি সেজেছে ওরা। সবার সামনে জেমি। নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসছে গোটা দলকে। ‘জলদি,’ হাঁপিয়ে উঠল শাহানা, ‘এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।’
কিন্তু ওর কথায় কেউ কান দিল না। আগের মতই খেলা করতে লাগল। হাত দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, নখগুলো বাঁকানো, টলতে টলতে এগিয়ে আসছে সবাই। সবার চোখে শূন্য দৃষ্টি। এই সময় ব্যাপারটা লক্ষ করল শাহানা। ওদের সবার কান আর হাঁ করা মুখ থেকে গলে গলে মাটি পড়ছে। ঠিক তখন শাহানা বুঝতে পারল নিছক খেলা করছে না কেউ।