জিনের বাদশাহ্

জিনের বাদশাহ্ 

টুনি তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাদের ক্লাসের একজনের জন্য জন্মদিনের উপহার কিনতে এসেছিল। অনেক তর্ক বিতর্ক ঝগড়া-ঝাঁটি করে শেষ পর্যন্ত তার জন্য কয়েকটা সুন্দর বই আর একটা ক্যাকটাস কিনেছে। একজন ক্যাকটাসটা তার বাসায় নিয়ে গেছে, জন্মদিনের দিন স্কুলে নিয়ে আসবে, বইগুলো টুনির ব্যাকপ্যাকে। সেও সেগুলো রঙিন কাগজে মুড়িয়ে জন্মদিনের দিন স্কুলে নিয়ে যাবে। সবাই যে যার বাসায় চলে গেছে, টুনি আবিষ্কার করল সে ছোটাচ্চুর দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির খুব কাছে, কাজেই সে ঠিক করল সে বাসায় না গিয়ে ছোটাচ্চুর এজেন্সিতে চলে যাবে। অনেকদিন তার অফিসে যাওয়া হয়নি, ছোটাচ্চু কী করছে দেখে তার সাথেই বাসায় যাবে। ছোটাচ্চু তার ‘অনেক কাজ,’ ‘খুব ব্যস্ত’, ‘বাসায় যেতে দেরি আছে’ এইসব কথা বলে তার গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবে কিন্তু সেটাকে কে আর গুরুত্ব দেয়। 

টুনি যখন ছোটাচ্চুর অফিসের কাছাকাছি এসেছে, তখন দেখল অফিসের সামনে একটা মোটরসাইকেল থেমেছে, একজন মোটরসাইকেলের সামনে আরেকজন পিছনে। সামনে বসে থাকা লোকটা বলল, “এই যে ডিটিকটিভ অফিস।” 

মানুষটা ঠিকভাবে ডিটেকটিভ উচ্চারণ করতে পারে না। 

পিছনের লোকটা মোটরসাইকেল থেকে নামতে নামতে বলল, “কী তাজ্জব! আসলেই ডিটেকটিভের অফিস! জীবনেও ভাবি নাই এই দেশে ডিটেকটিভের অফিস থাকবে!” 

“জে! ঠিকই বলছেন।”

“তয় খুঁজে বের করতে একটু সমস্যা হইছে।” 

সামনে বসে থাকা লোকটা বলল, “আসলে ভুল আমাগো। ভুল রাস্তায় খুঁজতাছিলাম।” 

“ঠিক আছে তুই আশেপাশে থাকিস। বের হয়ে একটা মিসকল দিমু।” 

“ঠিক আছে বস।” 

সামনে বসে থাকা মানুষটা মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেল। পিছনের লোকটা ছোটাচ্চুর অফিসের দিকে যায়। টুনি মানুষটাকে লক্ষ করতে করতে তার পিছনে পিছনে গেল। 

যেকোনো মানুষকে প্রথমবার দেখলে টুনি মানুষটা কীরকম, তার নাম কী, কী করে, এসব অনুমান করার চেষ্টা করে। কাজেই আজকেও সেটা করার চেষ্টা করল। 

টুনির মনে হল মানুষটার নাম হওয়া উচিত তালেব আলী। যেটুকু কথাবার্তা শুনেছে, সেটা শুনে মনে হয়েছে লেখাপড়া খুব বেশি নাই। সামনের মানুষটা তাকে বস ডাকছে, কাজেই তালেব আলী হালকা মাস্তান ধরনের হতে পারে। ডিটেকটিভ এজেন্সিতে তার কাজটি সম্ভবত কারো বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করা সংক্রান্ত কাজ। চুল যেভাবে কেটেছে সেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে মানুষটার রুচি খুব সুবিধার নয়। নিশ্চয়ই প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখে আর একটু পরে পরে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের সেলফি তুলে। 

মানুষটা ছোটাচ্চুর অফিসের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। টুনি দরজায় কান পেতে শুনল, মানুষটা রিসেপশনিস্ট নীলিমা আপুকে জিজ্ঞেস করছে “ডিটেকটিভ সাহেব আছেন।” 

নীলিমা আপু বলল, “জি আছেন। 

“তার সাথে কি দেখা করা যায়?” 

“হ্যাঁ যায়। কী দরকার সেটা বলেন।”

মানুষটা বলল, “এ্যাঁ এ্যাঁ।” 

“যদি বলতে না চান, তাহলে এই ফরমটাতে লিখেন—” 

মানুষটা আবার বলল, “এ্যা এ্যা…” 

নীলিমা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে দেখা করে আসেন—যদি আপনার কেসটা নেওয়া হয়, তখন না হয় ফরম ফিলআপ করে যাবেন।” 

“ঠিক আছে।” 

টুনি বুঝতে পারল নীলিমা আপু মানুষটাকে ছোটাচ্চুর অফিসে নিয়ে গেল। টুনি তখন ভিতরে ঢুকল। নীলিমা আপু মানুষটাকে ছোটাচ্চুর অফিসে রেখে বের হয়ে টুনিকে দেখে খুশি হয়ে উঠল, বলল, “আরে টুনি, অনেক দিন তোমাকে দেখি না!” 

“অনেক ব্যস্ত তাই এদিকে আসা হয় না।”

“যাও তোমার ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করে এসো—তোমাকে দেখলে খুশি হবে!” 

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু মোটেও খুশি হবে না, বিরক্ত হবে!” 

‘উহুঁ! বিরক্ত হবার ভান করবে কিন্তু আসলে খুশি হবে। যাও।” 

টুনি ছোটাচ্চুর অফিসের কাছাকাছি যেতেই যে মানুষটার নাম সে তালেব আলী দিয়েছে তার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। মানুষটা বলছে, “আমি এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি একটা সাইনবোর্ড! সাইনবোর্ডে লেখা ডিটেকটিভ এজেন্সি! কী আচানক ব্যাপার।” 

মানুষটা পরিষ্কার মিথ্যা বলছে, সে মোটেও হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর অফিসের সাইনবোর্ড দেখে নাই। এই অফিসের ঠিকানা জেনে খুঁজে খুঁজে অফিসটা বের করেছে। টুনি নিজের কানে শুনেছে। কিন্তু মানুষটা মিথ্যা কথা বলছে কেন? 

টুনি ভিতরে না ঢুকে একটু সরে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করল। মানুষটার কথা শেষ হওয়ার পর ছোটাচ্চু বলল, “ও আচ্ছা! আচ্ছা!” 

মানুষটা বলল, “জে, তখন ভাবলাম ভিতরে ঢুকে একবার দেখে আসি, ডিটেকটিভদের চেহারা কেমন হয়। হে হে হে…।” 

ছোটাচ্চু বলল, “তাহলে আপনার কোনো কেস নেই শুধু আমাদের চেহারা দেখতে এসেছেন?” 

“জে মনে করেন সেটাও আছে আবার মনে করেন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা কেস নিয়ে আলোচনাও করা যায়।” 

“শুধু আলোচনা?” 

“আলোচনা দিয়ে শুরু করা যায়। তারপর মনে করেন আপনার উপদেশ নিতে পারি।”

“কীসের উপর উপদেশ নিতে চান!”

“মনে করেন জিনের বাদশাহ্।” 

ছোটাচ্চুর গলার স্বরে এবারে বিস্ময়, “কীসের বাদশাহ্?” 

“জিনের বাদশাহ্!” 

“জিনের বাদশাহ্ নিয়ে কী উপদেশ চান?” 

“মনে করেন জিনের বাদশাকে ধরা কি কঠিন নাকি সোজা?” 

ছোটাচ্চু একটা হাসির মত শব্দ করল, তারপর বলল, “সেটা নির্ভর করে জিনের দেশটা কোথায়, তাদের সাথে আমাদের দেশের ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক আছে কি না—তাদের বাদশাকে ধরে আনলে তারা বাধা দিবে কি না—”

টুনির তালেব আলী নাম দেওয়া মানুষটা বলল, “আমি আসলে সত্যিকার জিনের বাদশাহের কথা বলছিলাম না, নকল বাদশাহ্ কথা বলছিলাম। মনে করেন তাকে ধরা কি সোজা?” 

“আমরা যেহেতু তাকে ধরার চেষ্টা করি নাই—কাজেই এখনও জানি না। যদি কেউ আমাদের কাছে সেটা নিয়ে আসে, আমরা যদি সেই কেসটা নিই তাহলে বুঝতে পারব।” 

“মনে করেন আমি আসলাম!” 

“মনে করেন বললে হবে না। আপনাকে সত্যি সত্যি আসতে হবে। জিনের বাদশা কী করেছে আমাদের জানতে হবে, আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দিতে হবে।” 

তালেব আলী বলল, “মনে করেন জিনের বাদশাহ্ বিজনেসটা খুব ভালো।” 

“এটা বিজনেস?” 

তালেব আলী বলল, “মানে সত্যিকারের বিজনেস না। কিন্তু মনে করেন এক ধরনের বিজনেস।” 

“কীভাবে হয় বিজনেসটা?” 

“মনে করেন প্রথমে একজনকে টার্গেট করা হয়। মেয়ে লোক হলে ভালো—বাচ্চার অসুখ হলে সবচেয়ে ভালো, তারপর মনে করেন জিনের বাদশাহ্ তারে ফোন করে ভয়ভীতি দেখায়। তারে বলে যদি জিনের বাদশার কাছে টাকা না পাঠায় তাহলে বাচ্চা মরে যাবে। মেয়ে লোক তখন ভয়ে টাকা পাঠায়।” 

“বুঝতে পারছি। আর কী করে জিনের বাদশাহ্?” 

“আরও অনেক কিছু করে। মনে করেন যাদের সন্তান হয় না তাদের তাবিজ দেয়—মনে করেন স্বর্ণের গয়না দ্বিগুণ করে দেয়—”

“ছোটাচ্চু বলল, তাহলে আপনি বলছেন আমাকে এই বিজনেস করছে যে জিনের বাদশাহ্ তাকে ধরে দিতে হবে?” 

“এ্যাঁ এ্যাঁ… ঠিক সেইটা বলি নাই।” 

“তাহলে কী বলেছেন?” 

“মনে করেন বলেছি এই জিনের বাদশাকে ধরে ফেলা সোজা নাকি কঠিন, খালি এইটা বের করে দিবেন।” 

“হ্যাঁ, এই নিয়ে আপনি তিন বার এইটা বললেন! আমিও তিনবার একই উত্তর দিচ্ছি—ব্যাপারটা নির্ভর করে এই জিনের বাদশাহ্ সম্পর্কে আমি কতটুকু জানি এবং তাকে ধরার ব্যাপারে আপনি কতটুকু সিরিয়াস—” 

“মনে করেন টেলিফোন নাম্বার—” 

“খুবই বোকা টাইপের জিনের বাদশাহ্ হলে টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বের করা সম্ভব। কিন্তু যারা এইরকম ভুয়া কাজ কারবার করে, তারা নিজের টেলিফোন নম্বর ব্যবহার করে না—মার্কেটে আউল ফাউল সিম কার্ড পাওয়া যায়।” 

“জে জে। মনে করেন আপনি ঠিকই বলেছেন—আউল ফাউল নম্বর পাওয়া যায়। মনে করেন দাম বেশি কিন্তু পাইতে সমস্যা নাই—”

টুনি দরজার কাছ থেকে সরে এলো। ছোটাচ্চু জিনের বাদশাহ্ নিয়ে কথা বলছে তাই তাকে আর বিরক্ত করল না। সে নীলিমা আপুর কাছে গিয়ে বসল, বলল, “ছোটাচ্চু এতদিন মানুষ ক্রিমিনাল ধরেছে। এখন জিন-ভূত- ক্রিমিনাল ধরবে!” 

“তাই নাকি?” 

হ্যাঁ। ভিতরের মানুষটা জিনের বাদশাহ্ ধরে দেওয়ার জন্য এসেছে!” 

নীলিমা আপু হি হি করে হেসে বলল, “আমি এখানে জয়েন না করলে জানতেই পারতাম না পৃথিবীতে কত রকম আজব মানুষ আছে!” 

টুনি বলল, “ছোটাচ্চুর অফিসে মনে হয় আজব আজব মানুষই বেশি আসে! তাই না?” 

“মনে হয়। যখন কোনো কাজ থাকে না তখন এই মনিটরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি—বাইরে যে মানুষগুলো যাচ্ছে আসছে সবাই এই অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়! উঁকিঝুঁকি মারে! 

টুনিও মনিটরের দিকে তাকাল। তার অফিসে সিসি টিভি লাগানোর পর ছোটাচ্চুর ভাবভঙ্গি বদলে গেছে! টুনি সিসি টিভির মনিটরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ সামনের রাস্তার মানুষজনকে দেখল, সত্যি সত্যি সবাই এই অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। ডিটেকটিভ নিয়ে সবার মাঝে কৌতূহল। 

নীলিমা আপু টুনিকে বলল, “কী খাবে টুনি?” 

“কিছু খাব না।” 

“কোল্ড ড্রিংকস, চিপস, আইসক্রিম, চকলেট—”

“ঠিক আছে। আইসক্রিম খেতে পারি।” 

“চল।” বলে টুনিকে নিয়ে নীলিমা আপু কিচেনে ঢুকে গেল। 

যখন দুজন খুবই তৃপ্তি করে চা নাশতা আইসক্রিম খাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চুর অফিস থেকে টুনির তালেব আলী বের হয়ে চলে গেল। ছোটাচ্চু তার পিছু পিছু বের হয়ে টুনিকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলল, “টুনি! তুই কোথা থেকে এসেছিস?” 

“আমাদের বন্ধুর জন্য গিফ্‌ট কিনতে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম তোমার অফিস থেকে আইসক্রিম খেয়ে যাই।” 

“খেয়েছিস আইসক্রিম?” 

“খাচ্ছি। খেয়ে তোমার সাথে বাসায় যাব।”

ছোটাচ্চু তখন নিজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করল, মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কখন বাসায় যাব, এত কাজের চাপ!” 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন এত কাজের চাপ ছোটাচ্চু?” 

“তার কি ঠিক আছে? এইমাত্র একটা লোক এসেছিল জিনের বাদশাকে ধরে দিতে!” 

“মানুষটার নাম কী তালেব আলী?” 

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তালেব আলী? তালেব আলী কেন হবে?” 

“আমার মনে হল মানুষটার নাম হতে পারে তালেব আলী। চেহারার মাঝে একটা তালেব আলী তালেব আলী ভাব!” 

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “টুনি! তোর মাথার ঠিক নাই। একজনের চেহারা দেখে কখনও তার নাম আন্দাজ করা যায় না!” 

“সেটা ঠিক। কিন্তু চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নাই। কোনো একদিন তো মিলে যেতেও পারে!” 

ছোটাচ্চু হাতের কাগজটা দেখে বলল, “মানুষটার নাম আরিফ মিয়া।” 

টুনি বলল, “নাহ, আরিফ মিয়া নামটা মিলল না!” হাতের আইসক্রিমে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “তুমি জিনের বাদশাকে কেমন করে ধরবে ছোটাচ্চু?” 

“দেখি। কী করা যায়। মানুষটার কাছে নাকি জিনের বাদশাহ্ কথা রেকর্ড করা আছে। দিতে বলেছি। সাথে জিনের বাদশাহ্র টেলিফোন নাম্বার। টেলিফোন নাম্বার অবশ্য সবসময়েই ভুয়া হয়, ক্লোন করা হয়—তারপরেও।” 

টুনি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ মানুষটার কথাবার্তা শুনেছে কিন্তু সেটা এখন ছোটাচ্চুকে জানাল না। বলল, “মানুষটাকে তোমার কীরকম মনে হয়?” 

“খুবই সহজ সরল! তার কিছু হয় নাই—তারপরও জিনের বাদশাহ্ পিছনে লেগেছে। তবে—” 

“তবে কী?” 

“জিনের বাদশাহকে ধরার ব্যাপারে তার আগ্রহ নাই। তাকে ধরা যাবে কি না সেটা নিয়ে তার আগ্রহ—কারণটা বুঝতে পারছি না।”

হঠাৎ করে টুনির একটা বিচিত্র সম্ভাবনার কথা মনে হল—কিন্তু সে মুখ ফুটে সেটা ছোটাচ্চুকে বলার সাহস পেল না। ব্যাপারটা আরেকটু দেখা যাক। টুনি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে করতে আইসক্রিম খেতে থাকে। 

.

পরদিন ছোটাচ্চু বাসায় এসে সবাইকে ডেকে বলল, “তোরা কে কে জিনের বাদশার কথা শুনতে চাস, এখানে চলে আয়!” 

“জিনের বাদশাহ্!” বাচ্চারা যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে আসে। এর মাঝে সবাই টুনির মুখে জিনের বাদশা কথা শুনে ফেলেছে, তাই কাউকে আর কিছু বোঝাতে হল না। ছোটাচ্চু তার ফোন বের করে টিপাটিপি করে সামনে ধরল, তখন প্রথমে টেলিফোনের একটা খসখসে শব্দ, তার পরে খুট করে একটা শব্দ করে একজন মহিলা ফোন ধরে বলল, “হ্যালো—”

টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে একটা বিকট হাসির শব্দ শোনা যায়। ভূতের সিনেমাতে দানবেরা এরকম শব্দ করে হাসে। যে মহিলাটি ফোন ধরেছিল সে ভয়ে ভয়ে বলল,”কে? আপনি কে?” 

কেউ একজন একটা ভয়ংকর থমথমে গলায় বলল, “আমি কে তুমি জান না?” 

মহিলাটি বলল, “না! আমি জানি না!” 

“আমি জিনের বাদশাহ্ গালিম” কথা শেষ করে আবার বিকট হাসি। “জিনের বাদশাহ্? জি-জি-জিনের বাদশাহ্?” 

“হ্যাঁ। আমি জিনের বাদশাহ্—তোর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য আমি তোর কাছে এসেছি, মনে কর তোর কপাল ভালো—” 

“না হুজুর আমার কপাল ভালো না—” 

“জানি জানি জানি। তোর পুতের জীবন নিয়ে টানাটানি—তোর খাওয়া নাই ঘুম নাই—”

“জি হুজুর। আপনি দয়া করেন। আমার পুতের জীবনটা রক্ষা করেন—” 

“মনে কর—”

ঠিক এরকম সময় দাদি (কিংবা নানি) ছোটাচ্চুকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, “তুই এসব কী শোনাচ্ছিস বাচ্চাকাচ্চাদের। ছিঃ! বন্ধ কর—” 

ছোটাচ্চু একটু অপ্রস্তুত হয়ে ফোনটা বন্ধ করল। বাচ্চারা আপত্তি করে বলল, “না ছোটাচ্চু শুনতে চাই, শুনতে চাই জিনের বাদশাহ্ কী বলে।” 

দাদি এবারে বাচ্চাদের ধমক দিলেন, “কী সব আজেবাজে কথা শুনতে চাইছিস? একটা খারাপ মানুষ একটা মা’কে ভয় দেখিয়ে টাকা কামাই করতে চাইছে আর তোরা এই খারাপ মানুষের খারাপ খারাপ কথা শুনতে চাইছিস? ছিঃ! তোদের হয়েছে কী?” 

বাচ্চারা ধমক খেয়ে চুপ করে গেল। দাদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এরা কীরকম মানুষ? একটা মা’কে তার বাচ্চার অসুখের সময় ভয় দেখিয়ে টাকা কামাই করে! ছিঃ।” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ মা।” 

দাদি বললেন, “দেখি তুই কত বড় ডিটেকটিভ হয়েছিস। দেখি তুই এই পাজিটাকে ধরতে পারিস কি না?” 

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, এই জিনের বাদশাকে ধরার কতদূর?” 

ছোটাচ্চু তার টেলিফোনটা পকেটে রেখে বলল, “এখনও বলা যাচ্ছে না, এই ফোনটা যে নম্বর থেকে করা হয়েছে সেটা পাওয়া গেছে। সেখান থেকে যদি কিছু একটা করা যায়। দেখা যাক!” 

দুইদিন পর ছোটাচ্চু মুখে একটা রাজ্যজয়ের ভঙ্গি করে বাসায় এসেছে, চেয়ারে বসতে বসতে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেজর ব্রেক থু!” 

বাচ্চারা এগিয়ে এসে বলল, “ধরেছ? ধরেছ জিনের বাদশাকে?” ছোটাচ্চু নাটকের ভঙ্গিতে বলল, “এখনও ধরি নাই, কিন্তু ধরার পথে এগিয়ে যাচ্ছি!” 

“কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছ ছোটাচ্চু?”

“অত্যন্ত জটিল বুদ্ধির খেলা দিয়ে!”

“বল না ছোটাচ্চু কী বুদ্ধির খেলা।” 

ছোটাচ্চু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, “মনে আছে তোদের বলেছিলাম জিনের বাদশাহ্ যে নম্বর থেকে ফোন করেছে সেই নম্বরটা আমরা পেয়েছি!” 

“হ্যাঁ মনে আছে।” 

“প্রথমে বের করেছি নম্বরটা এখন কার নামে রেজিস্ট্রি করানো আছে। সেইটা অবশ্য আমি নিজে করতে পারি নাই—সেজন্য আমার বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার বন্ধুর সাহায্য নিতে হয়েছে। আমার এই পুলিশ অফিসার বন্ধুকে আমি অনেকবার জটিল জটিল কেস সলভ করতে সাহায্য করেছি, সেইজন্য সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ! আমি বলা মাত্র সে তার এন আই ডি কার্ডের নম্বর বের করে দিয়েছে। সেখান থেকে আমরা তার নামে রেজিস্ট্রি করা অন্য আরেকটা নম্বর পেয়েছি। সেখানে ফোন করার পর দেখতে পেলাম—” ছোটাচ্চু হঠাৎ কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল। 

বাচ্চারা জিজ্ঞেস করল, “কী দেখতে পেলে?” 

“দেখতে পেলাম নাম্বারটা একজন গার্মেন্টে কাজ করে সেরকম মেয়ের। খুবই সহজ সরল মেয়ে, সে জানেই না তার নামে আরেকটা নম্বর আছে, যে নম্বর থেকে জীনের বাদশাহ্ ফোন করে। যখন তাকে সেটা বলা হল, সেই মেয়ে ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল।” 

ছোটাচ্চু আবার থেমে গেল। বাচ্চারা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হল?” 

“আমি মেয়েটাকে অভয় দিলাম, বললাম তোমার কোনো ভয় নাই। শুধু আমাকে বল তুমি কোথা থেকে তোমার সিম কিনেছ। মেয়েটা বলল, তার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির কাছে রাস্তার মোড়ে একজন মানুষ বসে সিম বিক্রি করে। তার কাছ থেকে কিনেছে। তার আঙুলের ছাপ নিয়ে এই আইডি কার্ডের নম্বর নিয়ে তাকে সিম বিক্রি করেছে। এবং—” 

ছোটাচ্চু আবার থেমে গেল। বাচ্চারা জিজ্ঞেস করল, “এবং কী?” 

“যে মানুষটা তাকে সিম বিক্রি করেছে সে বলেছে মেয়েটার আঙুলের ছাপ নাকি অস্পষ্ট, সেইজন্য কয়েকবার চেষ্টা করে তার ছাপ নিতে হয়েছে।” ছোটাচ্চু তখন হা হা শব্দ করে হাসল। বাচ্চারা বুঝতে পারল না এর মাঝে হাসির কী আছে। 

একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি হাসছ কেন? এর মাঝে হাসির কী আছে?” 

ছোটাচ্চু তার হাসি থামিয়ে বলল, “বুঝতে পারছিস না কেন হাসছি? এই সহজ জিনিসটাও বুঝতে পারছিস না? তোদের মাথায় কি ঘিলু নাকি হালুয়া?” 

বাচ্চারা মাথায় ঘিলুর বদলে হালুয়া থাকার অপমানটা সহ্য করে ছোটাচ্চুর দিকে বাকি অংশটুকু শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত আবার বলতে শুরু করে, “আসলে মেয়েটার আঙুলের ছাপ মোটেই অস্পষ্ট নয়! তাকে বলে আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট, তারপর ঠিক করে ছাপ নেওয়ার ভান করে কয়েকবার মেয়েটার আঙুলের ছাপ নিয়ে প্রত্যেকবার একটা করে নতুন সিম কার্ড এই মেয়েটার নামে ইস্যু করেছে! মেয়েটাকে একটা সিম কার্ড দিয়ে অন্যগুলো রেখে দিয়েছে। তার একটা বিক্রি করেছে জিনের বাদশাকে!” 

বাচ্চারা মাথায় হাত দিল, একজন বলল, “কী বুদ্ধি!” আরেকজন বলল, “মোটেও বুদ্ধি না। এটা হচ্ছে কুবুদ্ধি!” 

টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “এটা কেমন করে বের করেছ?”

“আমার বন্ধু পুলিশ অফিসার আরও কয়েকজন পুলিশ নিয়ে যখন সিমওয়ালার দোকান রেইড করেছে, তখন মানুষটা সব স্বীকার করেছে!” 

“তারপর সেই সিমওয়ালা জিনের বাদশাহ্র ঠিকানা দিয়েছে? তাকে ধরেছ?” 

ছোটাচ্চু এবারে একটু মনমরা হয়ে গেল। মাথা চুলকে বলল, “সেটাই হয়েছে মুশকিল! সিমওয়ালা বলেছে সে যার কাছে বিক্রি করেছে তার নাম ঠিকানা জানে না। খালি চেহারাটা মনে আছে।” 

“চেহারাটা কীরকম বলেছে?” 

“সেইটা বলেছে, তাতে লাভ কী? সবার চেহারা এক রকম। নাক মুখ চোখ কান, ছোট করে কাটা চুল—সেই চেহারার বর্ণনা দিয়ে কী লাভ?” 

“তাহলে?” 

“আমার পুলিশ অফিসার বন্ধু একটা প্ল্যান করেছে, দেখা যাক সেটা কাজ করে কি না।”

“কী প্ল্যান?” 

“কালকে বিকেলে সে সিমওয়ালাকে নিয়ে আমার অফিসে আসবে। আর পুলিশের সোর্সদের বলেছে এই এলাকার যত ফ্রড, ভুয়া, প্রতারক, চোর ছ্যাচড় আছে, তাদের ছবি আর ভিডিও নিয়ে আসতে, সেগুলো এই সিমওয়ালাকে দেখানো হবে। দেখা যাক সে কাউকে চিনতে পারে কি না।” 

“যদি চিনতে না পারে তাহলে জিনের বাদশাকে ধরা যাবে না!” 

ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “এখনই ধরা যাবে না, কিন্তু ক্রিমিনাল সবসময় কোনো না কোনো ভুল করে। কাজেই জিনের বাদশাহ্ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে।” 

টুনি ছোটাচ্চুকে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সবার সামনে সেটা বলা যাবে না, নিরিবিলি বলতে হবে। 

ছোটাচ্চুকে নিরিবিলি পেতে টুনির আজকে বেশ সমস্যা হল। শেষ পর্যন্ত তাকে যখন নিরিবিলি পাওয়া গেল তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। টুনিকে দেখে ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার টুনি? এত রাতে?” 

“তোমাকে একটা জিনিস বলতে এসেছি।”

“তাড়াতাড়ি বলে ফেল—আমার অনেক ঝামেলা আজ।” 

“তুমি কালকে সেই সিমওয়ালাকে অনেক মানুষের ছবি আর ভিডিও দেখাবে, তাই না?” 

“হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?” 

“তুমি কি সিমওয়ালাকে ঐ মানুষটাকেও দেখাবে?” 

“কোন মানুষটাকে?” 

“যে মানুষটা তোমাকে প্রথম জিনের বাদশাহর খোঁজ দিয়েছে। সেই  তালেব আলী—” টুনি তাড়াতাড়ি ঠিক করে বলল, “আরিফ মিয়া নামের মানুষটা?” 

ছোটাচ্চুর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে। তারপর অবাক হয়ে বলল, “তাকে কেন দেখাব? দেখানো হবে এলাকার যত ফ্রড, যত ক্রিমিনাল বদমাইশ প্রতারক তাদের ছবি! ঐ মানুষটা তো এসেছেই জিনের বাদশাকে ধরিয়ে দেবার জন্য।” 

“উহুঁ।” টুনি মাথা নাড়ল, “মানুষটা মোটেও জিনের বাদশাকে ধরিয়ে দেবার জন্য আসে নাই। মানুষটা এসেছে জিনের বাদশাকে ধরা সোজা না কঠিন সেটা জানতে—” 

“একই কথা! সোজা না হলে সে তাকে ধরার জন্য পয়সাকড়ি খরচ করবে—” 

“উহুঁ ছোটাচ্চু।” 

ছোটাচ্চু রেগে উঠল, বলল, “উহুঁ আবার কী?” 

“ছোটাচ্চু! সে তোমার কাছ জানতে চেয়েছে জিনের বাদশাহ্ ধরা পড়ার বিপদ আছে কি না! যদি বেশি বিপদ থাকে, তাহলে সে জিনের বাদশাহ্ না হয়ে অন্য কিছু করবে।” 

ছোটাচ্চু আরও বেশি রেগে উঠল, “দেখ টুনি, তুই মনে হয় বেশি ডিটেকটিভ বই পড়ে তোর মাথাটা আউলাঝাউলা করে ফেলেছিস। সবকিছুতে সন্দেহ! সব মানুষকে সন্দেহ। তুই জানিস কবিগুরু কী বলেছেন, মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ, জানিস?” 

টুনি থতমত খেয়ে গেল, এই ছোটখাটো জিনিসে একেবারে কবিগুরুকে টানাটানি করা হলে তো বিপদ। আমতা আমতা করে বলল, “আমি তো সব মানুষকে সন্দেহ করতে বলছি না, যেই মানুষটা একটু উল্টাপাল্টা—” 

“এই সহজ সরল মানুষটা কী সন্দেহের কাজ করেছে?” 

“আমি দুইটা বলতে পারি। এক, মানুষটা মিথ্যা কথা বলেছে। সে মোটেও হঠাৎ করে তোমার অফিসের সাইনবোর্ড দেখে তোমার কাছে আসে নাই— খোঁজখবর করে এসেছে।” 

“তুই কেমন করে জানিস?” 

“আমি বাইরে তাকে কথা বলতে শুনেছি। তা ছাড়া লোকটা প্রত্যেক কথায় বলে, “মনে করেন”— জিনের বাদশাহ্ও বলে “মনে কর—” 

ছোটাচ্চু সরু চোখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “কিন্তু লোকটা আমার সাথে কী কথা বলেছে তুই সেটা কেমন করে জানিস?” 

“তোমার অফিসে শুনেছি—” 

“লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছিস?” 

টুনি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “তোমার অফিসে ঢুকতে যাচ্ছিলাম শেষ পর্যন্ত ঢুকি নাই— তোমরা জোরে জোরে কথা বলছিলে, সেই রাস্তা থেকে শোনা যায়। আগে বহুবার তোমার অফিসে বসে শুনেছি—সমস্যা কী?” 

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “সমস্যা আছে। মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। প্রাইভেসি নিয়ে রবার্ট ব্রাউনিং কী বলেছেন জানিস?” 

টুনি রবার্ট ব্রাউনিং কে জানে না, কেন মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ সেটাও জানে না। জিজ্ঞেস করল, “কী বলেছেন?” 

ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, তারপর বলল, “এখন মনে নাই। যাই হোক খুব ইম্পরট্যান্ট কথা বলেছিলেন। বুঝেছিস?” 

টুনি মাথা নাড়ল, মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আজকে ছোটাচ্চু বড় বড় মানুষ ছাড়া কথাই বলছে না, তার কথার কী দাম দেবে? মুখে বলল, “বুঝেছি, ছোটাচ্চু।” 

“যা তাহলে। ঘুমা। রাত হয়েছে।”

“তুমি তাহলে আরিফ মিয়াকে ডাকবে না?” 

“না। তোকে বুঝতে হবে কোথায় লাইন টানতে হবে। মাত্রা জ্ঞান খুবই ইম্পরট্যান্ট।” 

টুনি ভাবল ছোটাচ্চু এখন মাত্রা জ্ঞান নিয়ে বিখ্যাত কোনো মানুষের একটা কোটেশন বলবে, শেষ পর্যন্ত বলল না। 

পরদিন ছুটির দিন। টুনির অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা কিন্তু তার বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। তার মাথার মাঝে জিনের বাদশাহ্ বিষয়টা কুটুর কুটুর করছে। সে যতই চিন্তা করে, তার ততই মনে হতে থাকে এই লোকটাই জিনের বাদশাহ্। যদি শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সে আসলেই সহজ সরল নিরপরাধ গোবেচারা মানুষ, তারপরও তাকে একবার সিমওয়ালাকে দেখিয়ে নিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে? 

টুনি শেষ পর্যন্ত ঠিক করল সে আবার চেষ্টা করবে। যেহেতু এক নম্বুরী উপায় কাজ করে নাই, এবারে হালকা দুই নম্বুরী উপায় দিয়ে চেষ্টা করবে। সে শাহানাপুর কাছ থেকে তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে ছোটাচ্চুর দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ফোন করল। দুটো রিং হওয়ার পরই নীলিমা আপু ফোন ধরল, বলল, “হ্যালো, দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বলছি। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” 

টুনি বলল, “নীলিমা আপু, আশেপাশে ছোটাচ্চু থাকলে আমার নাম উচ্চারণ করো না—আমি টুনি।” 

“না নাই।” নীলিমা আপু একটু অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার? এত সিক্রেট কল!” 

“নীলিমা আপু তুমি কি একটা ষড়যন্ত্রে অংশ নেবে? প্লিজ!”

“কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র?” 

“ছোটাচ্চুর বিরুদ্ধে।” 

“তার মানে আমার চাকরিটা যাবে তাই তো?” 

“না নীলিমা আপু তোমার চাকরি যাবে না। একটু বললেই বুঝতে পারবে।” 

“ঠিক আছে বল।” 

“মনে আছে সেদিন একটা লোক এসেছিল জিনের বাদশাহ্র খোঁজ নেওয়ার জন্য। নাম আরিফ মিয়া।” 

“হ্যাঁ। মনে আছে।” 

“তাকে তুমি কালকে বিকালে পাঁচ মিনিটের জন্য অফিসে আনতে পারবে? ছোটাচ্চু যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে আমি তোমাকে আনতে বলেছি।” 

নীলিমা আপু বলল, “সেটা দেখা যেতে পারে, কিন্তু হঠাৎ করে তাকে কেন অফিসে আনতে হবে?” 

“আমার মনে হয় এই লোকটাই জিনের বাদশা সেজে লোকজনদের ফোন করে টাকা পয়সা আদায় করে।” 

“কেন তোমার এই ধারণা?” 

টুনি বলল, “যখন তোমার সাথে দেখা হবে তখন তোমাকে বলব—এখন তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর প্লিজ!” 

“ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম।” 

“কাল বিকালে ছোটাচ্চুর অফিসে আরেক জনকে আনা হবে যে জিনের বাদশাহ্র কাছে ভুয়া সিম বিক্রি করেছে। আমি জিনের বাদশাকে তার সামনে পাঠাতে চাই, তাকে চিনতে পারে কি না দেখার জন্য।” 

নীলিমা আপু বলল, “তুমি আগে তোমার ছোটাচ্চুর জন্য কতগুলো কেস সলভ করেছ! তাকে বললেই তো সে ব্যবস্থা করে দেবে!” 

“উহুঁ নীলিমা আপু। আমি চেষ্টা করেছিলাম, রাজি হয় নাই। উল্টো আমাকে বিশাল লেকচার!” 

নীলিমা আপু চিন্তিত গলায় বলল, “হুম। তোমার ছোটাচ্চুর লেকচারগুলো খুবই কঠিন। বুঝতে পারছি।” 

টুনি অনুনয় করে বলল, “পারবে নীলিমা আপু? প্লিজ!” 

নীলিমা আপু বলল, “দাঁড়াও মানুষটার ফরমটা বের করি।” 

কিছুক্ষণ পর নীলিমা আপু বলল, “মনে হয় করা যাবে। ফরমে স্থায়ী ঠিকানা পূরণ করে নাই—বলব বিকেলে এসে পূরণ করে দিতে!” তোমার ছোটাচ্চু সন্দেহ করবে না—আগেও একবার দুইবার এরকম করতে হয়েছে।” 

“থ্যাংকু থ্যাংকু থ্যাংকু নীলিমা আপু। থ্যাংকু থ্যাংকু থ্যাংকু।” 

“তুমি একটু পর ফোন করে জেনে নিও মানুষটা আসতে রাজি হয়েছে কি না।” 

“ঠিক আছে নীলিমা আপু। ফোন করব।” 

আধাঘণ্টা পর টুনি আবার ফোন করে জেনে নিল যে, লোকটা আসতে রাজি হয়েছে। 

টুনির এখন আর একটা কাজ বাকি। ঠিক সময়টাতে ছোটাচ্চুর অফিসে থাকা। একা একা তাকে কেউ ছোটাচ্চুর অফিসে যেতে দিবে না। তাই সে দ্বিতীয় দুই নম্বুরী কাজটা শুরু করল। 

প্রথমে আশেপাশে যখন আর কেউ নেই তখন শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া, বিকেলে সবাই ছোটাচ্চুর অফিসে যাচ্ছে, তুমি যাবে?” 

“কেন সবাই যাচ্ছে?” 

“সেটা জানি না। তুমি যাবে?” 

“সবাই গেলে একশ বার যাব।” 

“ঠিক আছে।” 

তারপর প্রমির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “প্রমি আপু, সবাই বিকেলে ছোটাচ্চুর অফিসে যাচ্ছে। তুমি যাবে?” 

“কেন যাচ্ছে?” 

“জানি না, আমাকে বলছে না। তুমি যাবে?” 

“সবাই গেলে যাব।”

এভাবে টুনি সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করল, “অন্য সবাই যাচ্ছে তুমি কি যাবে?” 

সবাই রাজি হলে তখন টুনির কাজ শেষ। একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে সবাই দেখল আসলেই সবাই যাচ্ছে, কাজেই কারও কোনো সন্দেহ হল না। 

.

কাজেই বিকাল বেলা সবাই মিলে ছোটাচ্চুর অফিসে হাজির হল। ছোটাচ্চুর অফিসে তখন ছোটাচ্চু আর তার পুলিশ অফিসার বন্ধু একটা ল্যাপটপে এই এলাকার নানা ভণ্ড প্রতারক সন্দেহজনক পাজি বদমাইশ মানুষের ছবি সিমওয়ালা মানুষটাকে দেখাচ্ছে। মানুষটা শুকনো মুখে তার ভেতর থেকে জিনের বাদশাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এরকম সময় নীলিমা আপু অফিসে ঢুকে বলল, “শাহরিয়ার ভাই! আপনার অফিসে সব বাচ্চারা এসেছে।” 

ছোটাচ্চু আকাশ থেকে পড়ল, “কেন?” 

“তাতো জানি না। আপনি নাকি আসতে বলেছেন।” 

“আমি? আমি কেন আসতে বলব?” 

নীলিমা আপু হাসি গোপন করে বলল, “সেটা জানি না।” 

“আমি এখানে ব্যস্ত। তুমি ওদেরকে এখানে আসতে দিও না। পারলে দেখ বিদায় করতে পার কি না।” 

“আপনার সাথে দেখা না করে মনে হয় যাবে না। ঠিক আছে আমি ওদের ব্যস্ত রাখি।” 

ঠিক এরকম সময় জিনের বাদশা খোঁজে আসা মানুষটি যার নাম টুনির মনে হয়েছে তালেব আলী কিন্তু যার আসল নাম আরিফ মিয়া এবং টুনি যাকে আসল জিনের বাদশাহ্ হিসেবে সন্দেহ করছে, সে এসে হাজির হল। 

টুনি তাকে দেখেই চিনতে পারল এবং তাকে দেখা মাত্র তার বুকের কাঁপুনী বেড়ে যায়। টুনি নীলিমা আপুর দিকে তাকাল এবং নীলিমা আপুও টুনির দিকে তাকাল। নীলিমা আপু টুনির দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে চোখ টিপল, যার অর্থ, “আমি কি লোকটাকে ছোটাচ্চুর কাছে পাঠাব?” 

টুনি মাথা নাড়ল, যার অর্থ, “হ্যাঁ পাঠাও!” 

নীলিমা আপু তখন খুবই স্বাভাবিক গলায় মানুষটাকে বলল, “ও! আপনি এসেছেন? ভেরি গুড! আপনি চট করে অফিসে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করে আসেন। আমি আপনার ফরমটা বের করি।” 

মানুষটা বলল, “ঠিক আছে।” তারপর অফিসের দিকে হেঁটে যায়। 

টুনিও নিঃশব্দে মানুষটার পিছনে পিছনে গেল। মানুষটা ভিতরে ঢুকে অন্য মানুষদের দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডিটেকটিভ সাহেব! আপনি আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলেন?” 

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল, কিছু একটা বলার জন্য মাত্র মুখ খুলেছে, ঠিক তক্ষুণি সিমওয়ালা মানুষটা চিৎকার করে বলল, “এই তো! আমি এর কাছে ভুয়া সিম বিক্রি করেছি!” 

জিনের বাদশাহ মানুষটার কয়েক সেকেন্ড লাগে বুঝতে ঠিক কী হচ্ছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে, তখন সাথে সাথে ঝট করে ঘুরে টুনিকে ধাক্কা দিয়ে দরজা দিয়ে ছিটকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। টুনি চিলের মত চিৎকার করে বলল, “শান্ত ভাইয়া ধর—”

কাকে ধরতে হবে, কেন ধরতে হবে, কীভাবে ধরতে হবে শান্ত তার কোনোকিছু নিয়ে মাথা ঘামাল না। ছুটন্ত মানুষটার পায়ের মাঝে নিজের পা-টা বাড়িয়ে দিল এবং মানুষটা তাল সামলাতে না পেরে ধড়াম করে মেঝেতে পড়ল। 

সাথে সাথে ঘরের ভেতর যতজন আছে সবাই মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মানুষটা ঝটকা দিয়ে সবাইকে ফেলে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার এক দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই ছোটাচ্চুর বন্ধু পুলিশ অফিসার লাফ দিয়ে বের হয়ে এসেছে। হাতে পিস্তল নিয়ে মানুষটার দিকে তাক করে চিৎকার করে বলল, “খবরদার! হ্যান্ডস আপ!” 

মানুষটা দৌড়াতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর দুই হাত আস্তে আস্তে উপরে তুলে এদিক সেদিক তাকাল। 

শান্ত তার পা ধরে যন্ত্রণায় আউ আউ করে লাফাতে লাগল আর মুনিয়া হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইশ! একেবারে সিনেমার মত!” 

.

ছোটাচ্চু অফিস থেকে বাইরে এসে সবার দিকে তাকাল। জিনের বাদশাহ্ দিকে তাকাল, নীলিমার দিকে তাকাল, সব শেষে টুনির দিকে তাকাল, তারপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সব তোর প্ল্যান। তাই তো?” 

টুনি বলল, “ঠিক প্ল্যান না—” 

“তাহলে কী?” 

টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “ষড়যন্ত্র!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *