জিনার দিনকাল

জিনার দিনকাল

—জিনা-আ-, জিনা-আ—উগ্রমেজাজি চিৎকারটা মাঝের দরজা দিয়ে ঢুকে ফাটা বোমার ধোঁয়ার মতো ঘরে ঘরে ঢুকে যায়, সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে নীচে নামতে থাকে। মাম্পি ঝুম্পার দিকে চায়, ঝুম্পা ছুটে বেরিয়ে যায়। তার হ্যান্ডলুমের কাফতান পায়ের ওপর কড়া ঝাপটা মারে। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ডাকে—কাকি-ই, ও কাকিমা! তারপর তরতর করে নীচে নেমে যায়, ঝংকার দিয়ে ওঠে—উঃ কাকিমা, ওদিকে যে পারা ক্রমে চড়ছে। শুনতে পাচ্ছ না! কতবার বলেছি না, কাকা থাকলে এদিকে আসবে না!

জিনা ধীরেসুস্থে বেরিয়ে, হঠাৎ দুপদাপ করে সিঁড়ি ভাঙতে থাকল। পেছন ফিরে ফিক করে হেসে বলল—দেখেছিস? হনুমতী। চিলিম্পা।

দরজা পার হবার সময়ে তার গতিবেগ প্রায় মেল-ট্রেনের সমান হয়ে যাচ্ছে দেখা গেল। ঝুম্পা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে অর্ধেক-রাগ অর্ধেক-মজায় বলল, উঃ কাকিমাটা পারেও। তারপরে সুর পালটে বলল, রোজ রোজ ভাল লাগে না। তোমরা না…

মল্লিকা বলল, আমি কিন্তু ওকে ডাকিনি। ও-ই চেতল মাছের গাদা নিয়ে এসে বসল। ছাড়িয়ে দাও। আমি কাঁটা ছাড়াতে পারি না, করিনি কখনও…।

—আর সময় পায় না?

—আহা মাছটা তো সকালেই আসে, তোর ওই কাকাই তো শখ করে এনেছে।

হন্তদন্ত হয়ে জিনা ঘরে ঢুকতে তোয়ালে পরা নিখিল ফেটে পড়ে—আমি বলে অফিস বেরোচ্ছি, এখন তোমার গালগপ্পো মারবার সময়?

—গালগল্পের চিতলমৎস্য কে এনেছে? কাঁটা ছাড়াচ্ছিলুম! কণ্টক!

—গুষ্টির পিণ্ডি!

—রাতে যখন পড়বে পাতে তখন বলো পিণ্ডি না মন্ডা!

—আমার রুমাল?

—এই তো।

—গ্রে মোজা-জোড়া?

—জুতোর সঙ্গে রেখেছি, নীচে।

—শার্ট? প্যান্ট?

—কী আশ্চর্য! এই তো সামনে রেখেছি, দেখতে পাচ্ছ না?

—তুমি যা রাখবে তাই পরতে হবে? পিন-স্ট্রাইপটা দাও, সাদার ওপর নীল। ঝট করে আলমারি খুলে ফট করে ইপ্সিত শার্ট বার করে দেয় জিনা।

—আর কিছু?

—কেন? ও বাড়ির রান্নাঘরে মন পড়ে আছে নাকি দ্রৌপদী মহারানির।

জিনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসে। আর কী-ই বা সে করতে পারে! কারও রাগী মেজাজের সামনে মুখে মুখে তর্ক করতে নেই, জবাব দিতে নেই। দমদমের বাড়িতে দেখেছে জেঠু রেগে তুলকালাম করলে জেঠিমা এক্কেবারে চুপ। আবার জেঠিমা রাগলে মা-কাকিমারা চুপ। এ ওর দিকে আড়ে আড়ে চায়। কেউ কান্না চাপছে, কেউ হাসি চাপছে। কিন্তু ভুলেও একটি কথা না।

নিখিলবাবু শার্ট বদলালেন, তোয়ালের ভেতর দিয়ে প্যান্টফ্যান্ট গলালেন। একটু যে বে-আব্রু হলেন না তা নয়, সে সময়ে জিনা চট করে কড়িকাঠের দিকে চোখ ফেরাল। চুলে একবার ব্রাশ চালালেন। গরগর করে বললেন, টাইটা তো বউরাই বেঁধে দেয় জানি।

—বউরা গলায় গামছা বাঁধে, আর নাকে দড়ি। টাইটা আজ নিজেই বাঁধতে হবে আজ্ঞে—সাতসকালের তুলকালামের জন্য জিনা তার বরকে এইটুকু দণ্ড বিধান করে।

—ও—আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সটাসট টাইটা বেঁধে ফেলতে লাগলেন নিখিলচন্দ্র। বাঁধতে বাঁধতে মুরুব্বি স্টাইলে বললেন, ভাসুরঠাকুরের টিফিন তৈরি করার জন্যে তোমায় আনা হয়নি। শ্বশুরঠাকুরকে ফুলতুলসী দেবার জন্যেও না। আনা হয়েছে এই নিখিলচন্দ্রের জন্যে, নিখিলচন্দ্রের সুখসুবিধের জন্যে।

জিনা বলল, যা বাব্বা, আমি তো ভেবেছিলুম আসছি আমার নিজেরই সুখসুবিধের জন্যে। কাটবার জন্যে বেশ ভারী একটা পকেট পাব, ঠোনা মারবার একটা গাল পাব, চাপবার একটা কান পাব, তেমন দরকার পড়লে ঘাড়টা মটকাতেও পারি—

নিখিলচন্দ্রের মুখে একটু হাসি ফুটব ফুটব করেও শেষ পর্যন্ত ফুটল না। বললে, ও বাড়ির দরজাটা কি সিল করে দেব?

—কেন জানতে পারি?

—সেই কথায় আছে না, ভূতের ভয়ে উঠলাম গাছে, ভূত বলে তোরে পেলাম কাছে।

—ভূতটা কে? দাদা? দিদিভাই? ওদের ওপর তোমার এত রাগ কেন বলো তো? নিজেরই তো দাদা-বউদি! তোমার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে?

—এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি অনবরত জিনিস চলে যাচ্ছে। এই চেতল না পেতল সেটাও যাবে।

—যাবেই তো। দিদিভাই কদিন আগেই তো কচুরশাক দিয়ে গেল। খাওনি? বিদ্রূপ ফুটে ওঠে নিখিলচন্দ্রের মুখে—কচুরশাক? কচুরশাক মাঠেঘাটে ফলে থাকে জিনুরানি, আর চেতল মাছ নগদ আড়াইশো টাকা কিলো দরে বাজার ঢুঁড়ে কিনে আনতে হয়। উপরন্তু এপারে মাত্র দুজন, ওপারে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পাঁচজন।

জিনা ছি ছি করে ওঠে। বলে, তুমি এইসব মেয়েদের ব্যাপারে নাক গলাবে না তো! আমার ঘেন্না করে। যা দিচ্ছ তাইতে আমি চালাতে পারলেই তো হল? বেশি চেয়েছি তোমার কাছ থেকে? ইন ফ্যাক্ট তুমি এগজ্যাক্ট কত মাইনে পাও তা পর্যন্ত আমি জানি না। জানি?

উত্তরে নিখিল বলল, হুঃ!

নিখিল বেরিয়ে গেলে জিনা চটপট রান্না সেরে ফেলল। এরপর খাওয়া ছাড়া সত্যি কথা বলতে কি তার আর কোনও কাজ নেই। চানটা সে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে করে। চানের আগে পরে, যোগাসন, হাত-পা ঘষা, চুলের পরিচর্যা অনেক রকম আছে তার। নতুন বাথরুমটা ভাল বানিয়েছে তার বর। একটা ছোটখাটো ঘরই। বাথটব বসেছে একটা। ডুবে চান করার মজা এই যে উঠতে মনে থাকে না। জলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবনা আসে। শুধু চানই বা কেন, কোনও কাজই তার বহতা চিন্তাস্রোতকে বন্ধ করতে পারে না। আশাবাদী, ইতিবাচক চরিত্রের মানুষ সে। অথচ খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়। এটা তাদের পরিবারেরই চরিত্র। মুশকিল হচ্ছে আশাবাদ-এর ‘আশা’ আর ইতিবাচকের ‘ইতি’টুকু যদি জীবনে একটা কথার কথা মাত্র না হতে হয়, তা হলে সেগুলোর ওপর তার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ দরকার। কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। জিনার ‘কিছু-না-মনে-করা’ ‘আচ্ছা-বাবা-ঠিক-আছে’ ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’.. আনুগত্য, রসবোধ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে অনেক কিছু মেনে নেয় বটে, কিন্তু সেটা বোকা বলে নয়, অলস বলেও নয়। ভাল পাসটাস করেছে, গান শিখেছে, অথচ কোনও কেরিয়ারে তার মন নেই। অবশ্য, পাশের বাড়ির মিতালিদির মতো গোল্ড মেডালিস্ট হলে, কিংবা বন্ধু সুনন্দিনীর মতো স্বর্ণকণ্ঠী হলে কী হত বলা যায় না। সে যতটুকু ভাল, তাতে করে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে তাকে অনেক লড়াই করতে হবে—এই তার ধারণা। জিনা জানে না, সব ব্যাপারেই ‘ভাগ্যং ফলতে’ বলে একটা কথা আছে। হয়তো মিতালিদির কিছু হল না, সুনন্দিনীর কিছু হল না অথচ জিনারই হয়ে গেল, এরকমটা ঘটতেই পারত। কিন্তু সে চেষ্টার পথে সে যায়ইনি। নাগ-বাড়ির বেশির ভাগ মেয়ের ক্ষেত্রেই কুড়ি-একুশ বড় জোর বাইশ হলেই পিতৃব্য-মহলে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। যা খুশি করো, কিন্তু আগে আমাদের দায় থেকে মুক্ত করো—এই তাঁদের বুলি। জিনার এক দিদি বিয়ের পর এম ফিল করে কলেজে পড়াচ্ছে, আর এক দিদি স্বামীর সহায়তায় আর্ট-স্কুল খুলেছে। কিন্তু বেশির ভাগই বিশুদ্ধ গৃহিণী। কারওই সে নিয়ে খেদ নেই। বেশ আছে। কাজেই জিনার যখন অতি সহজেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এগজিকিউটিভ বর জুটে গেল, ঘর পছন্দ, দু পক্ষে চমৎকার মনের মিল তখন কেউই দ্বিধা করেনি। জিনাই একমাত্র এত বড় বর বিয়ে করতে চায়নি। এগারো-বারো বছরের বড়? ওরে বাবা, সে তো একটা লোক! নাগ-বাড়িতে সব রকমের নজিরই আছে। ছোট কাকা নিজেই একটি কেস। বললে—বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হবার এমন চান্স আর পাবি না। নিয়ে নে। সারা জীবন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারবি, তোর কাকি যেমন আমায় ঘোরাচ্ছে।

এখন, কে কাকে ঘোরাচ্ছে ছোট কাকাকে ডেকে এনে দেখাতে ইচ্ছে যায়। এইজন্যেই জিনার ধেড়ে কার্তিক লোককে বিয়ে করতে অনিচ্ছে ছিল। সব বিষয়ে কর্তাত্বি ফলাবে। সব সময়ে একটা হামবড়া আদেশের ভাব। ধুত। ঝুম্পা-মাম্পি-দিদিভাইকে নিয়ে কী চমৎকার একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিল তাদের, উপদেষ্টার ভূমিকায় দাদা আর বাবা। এই বেরসিক লোকটা সব ভেস্তে দিল। কেন রে বাবা? সে কী সুন্দর মাম্পিকে স্কুল থেকে আনতে যেত এক এক দিন। ওই ছুতোয় একটু বেরোনো আর কি। পায়ে যে মরচে পড়ে গেল! তা ফট করে একদিন হবি তো হ, সাদা মাতিজের সামনে। মাতিজে স্টিয়ারিং ধরে নিখিলচন্দ্র। একেবারে ক্যাচ, কট, কট। তক্ষুনি দুজনকে গাড়িতে তুলে নিল, পৌঁছে দিয়ে ডাঁটের মাথায় সাঁ করে চলে গেল, তারপর রাতে বাড়ি ফিরে সে কী তুলকালাম! আমার বউ কারও দাসী-বাঁদি নয়, মেয়ে-আনুনি ঝিগিরি তাকে দিয়ে করানো চলবে না। জিনা যত বলে আমি নিজে গেছি, কেউ আমাকে বলেনি, ততই সে ঝটকা মারে। জিনা বলল—আমি তবে করবটা কী? চুপচাপ বসে থাকব? উত্তর হল—বসে থাকতে না পার তো শুয়ে থেকো।…কী লজ্জার কথা! কী দুঃখের কথা! বাবা বাড়ি ছিলেন। তাঁর মুখের ওপর সুদ্ধু চোপা করল। তারপরই বাবা দু ভাইকে আলাদা করে দিলেন।

কেন? এটাই জিনা অবাক হয়ে ভাবে। জিনার জন্যে ভেবে ভেবে ঘুম হচ্ছে না, কী বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকতে পছন্দ করছে এমনটা তো নয়। কতটুকু থাকে বাড়িতে? নটায় বেরিয়ে আবার নটায় ফেরা। বেশির ভাগ দিনই আরও রাত হয়। অফিসের পর ক্লাবে যায় নাকি এক এক দিন, ক্লায়েন্টফ্লায়েন্টের সঙ্গে নাকি সর্বক্ষণই দরকার তার। শনি-রবিবারে অবশ্য প্রায়ই তাকেও ক্লাবে নিয়ে যায়। কিন্তু এই যে এতক্ষণের অনুপস্থিতি এতে জিনার খারাপ লাগছে কি না, সে কেমন ছিল এ নিয়ে তো ভদ্রলোকের কোনও মাথাব্যথা নেই? দমদমে, কি কোনও বন্ধুর বাড়িটাড়ি যেতে চাইলে কোনও আপত্তি নেই। খালি নিজের দাদা-বউদিদি আর তাদের পরিবারকেই সে একেবারে দেখতে পারে না। তার বিয়ের আগে কোনও টেনশন ছিল না। দুই ভাইয়ের সম্পর্ক অবশ্য কোনওদিনই খুব স্বাভাবিক নয়। দাদা এমনিতেই খুব কম কথা বলেন। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বয়সের তফাতও অনেকটা। কিন্তু মাত্র দুটি ভাই, তাদের মধ্যে কোনও আদানপ্রদান নেই এটা তার কেমন অদ্ভুত লাগে। কিন্তু এরা এইরকমই। বড় হয়ে যাবার পর যে-যার নিজের জগতে বাস করে। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে কোনও মনোমালিন্য ছিল বলে তার মনে হত না। দাদা হয়তো কোনওদিন খেতে বসে বললেন, অমলকে তোমার মনে আছে?

ভাই বলল, কোন অমল?

—ফুটবলের। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। তোমার কথা খুব জিজ্ঞেস করছিল।

—আচ্ছা! আজকাল আছে কোথায়?

—জে সি টি-তে আছে বলেই তো জানি।

ব্যাস।

আবার কোনওদিন ছোট ভাই উবাচ—

—তোমাদের ক্লাবের শিবেন ব্যানার্জি কেমন লোক, জান?

—কেন? মানে কী সেন্সে!

—এই অনেস্ট কি না।

—খুব একটা মনে হয় না। কেমন একটু সিক্রেটিভ টাইপ৷ কেন?

—আমাদের অফিসে একটা টেন্ডার ধরেছিল, খুব ঢুকতে চাইছে, ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে।

—ওহ্‌।

অর্থাৎ মনোমালিন্য থেকে কথা বন্ধ এমনটা নয়। দুজনের জগৎ, বন্ধুবান্ধব, ভাল লাগার জিনিস সবই এত আলাদা যে কোনও বিষয় নেই ওদের কথা বলার। জিনাদের ভাইয়েরা একত্র হলেই ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে তাদের উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। রাগারাগিও হয়ে যায়। হাতাহাতির ঠিক আগেটায় জেঠিমা কি মা কি কাকিমা প্রত্যেকের মাথায় একটা কেটলি করে একটু একটু জল ঢেলে দিয়ে যান।

—এটা কী হল?।

—এ হেহে আমার নতুন পাঞ্জাবিটা…

—কী হল কাকিমা, মোস্ট আনপার্লামেন্টারি। এই শীতে মাথায় হঠাৎ ঠান্ডা জল…

—তা হলে কি গরম জল দেব বলছিস?

—তাই বলে কথা বলব না?

—কথা বলতে কেউ বারণ করেনি বাবা, মারমুখো হতে শাপশাপান্ত করতে বারণ করা হচ্ছে…

—মারমুখো? কে মারমুখো হল?

—শাপশাপান্ত? সে আবার কী?

পাঁচ-ছয়জন নানা বয়সের ‘ইয়াং ম্যান’ আকাশ থেকে পড়ে।

কোনও তর্কের মধ্যে আর মাতৃকুল ঢুকতে চান না। মারমুখো কে, শাপশাপান্ত কী, এসব অব্যাখ্যাত থেকে যায়।

শ্লেষের হাসি হাসতে হাসতে ‘ইয়াং’রা খাওয়া শেষ করে। সকলেই একমত এই ওল্ড ‘জেনারেশন’কে নিয়ে আর পারা গেল না। একটা ‘ফ্রেন্ডলি’ হচ্ছিল, বুঝল না।

আমাদের ইডিয়ম তোমরা বুড়ো-বুড়িরা বুঝবে না…

ছোট কাকিমা আস্তে করে ফুট কাটবে—ইডিয়টের আবার ইডিয়ম—পেছন থেকে, নিরাপদ দূরত্ব ও আড়াল থেকে।

ব্যস, আর যায় কোথায়। বিরোধীরা সব এককাট্টা। —কে বললে? কেন বললে? তাকে সারেন্ডার করা হোক। না হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে…আসলে ওদের ধারণা বোনেরা কেউ বলেছে। জিনার ওপরেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ। বাতাবরণ ঘোরালো হতে জেঠিমা তাঁর চওড়া ভোমরা পাড় দাঁতালো শাড়ি আর জমজমে গলা নিয়ে ফ্রন্ট লাইনে এগিয়ে আসবেন—এই নে, আমি বলেছি বেশ করেছি, করছি সারেন্ডার। কী করবি কর। শেষ পাতে আলুবখরার চাটনি ছিল, পাবি না।

জিনা এইরকম সম্পর্ক দেখেছে। হুল্লোড়, মজা, এসব না-ই থাক। সম্পর্কটা তো থাকবে? সে নিখিলকে জেরা করতে ছাড়ে না।

—প্রথম প্রথম তো দেখেছি একসঙ্গে খেতে বসা হচ্ছে। মাঝে মাঝে কথাও বলছ পরস্পর। ক্রমশ কী হল?

—ধান্দাবাজি আমার ভাল লাগে না।

—ধান্দাবাজি কার?—জিনা আকাশ থেকে পড়ে।

—ওই তো। রান্না করছ, পরিবেশন করছ, বাসন মাজছ, সবই তো আস্তে আস্তে মিসেস নিখিলের কাঁধে উঠে আসছে।

—ওমা! বাসন মাজলাম কোথায়? সেদিন আমার নিজের বোনচায়নার ডিনার সেট আমি নিজে পরিষ্কার করে নিয়েছি। ডলিকে দিলে যদি ভেঙে যায়? ঝুম্পাকেও হাত লাগাতে দিইনি। আর রান্না? ও তো সবই দিদিভাই করছে, আমি একটু সাহায্য করি শুধু, পরিবেশনটা আমিই করি তাই বাড়িতেও করতুম, ভাল লাগে আমার।

—ও-ই করো! স্টেটাস যে বোঝে না, তাকে কী বোঝাব?

—স্টেটাস? সেদিন কোথায় পড়ছিলাম ইন্দিরা গান্ধী সুদ্ধু রাতে ডিনারের সময়ে টেবিলে বসে ছেলেদের এটা-সেটা পরিবেশন করতেন। এসব কেউ আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। ছিঃ ছিঃ!

—এখন কি তুমি আমায় ম্যানার্স শেখাবে না কি?

জিনা দুঃখিত গলায় বলেছিল, বিয়ের পর স্বামীদের অভদ্রতার দায় বউয়েদের ওপরেই পড়ে, এটা অন্তত মনে রেখো।

—কেন, দিনরাত যে সব্বাইকে তেল মারছ?

জিনা মনে মনে হাসে। মনে মনেই বলে তোমাকেও কম তেল মারি না বাবা। ফল হচ্ছে না কেন কে জানে!

অথচ সে বিয়েটাতে প্রায় এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল একটু বেশি স্বাধীনতার জন্যে। তাদের দমদমের বাড়িতে কতকগুলো অদৃশ্য, অকথিত নিয়ম আছে। সেগুলো মেনে চলতে হয়। কেউ জবরদস্তি করে না, কিন্তু সবাই-ই মানে। নিয়মগুলো বলাই বাহুল্য মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রয়োগ হয়। যেমন বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও রাত কাটানো চলবে না, অর্থাৎ এক্সকার্শন—নো। দেশান্তরে, প্রদেশান্তরে, বাড়ি ছেড়ে একা একা পড়াশোনা কাজকর্ম করতে যাওয়া চলবে না। তার পিসতুত দিদি ইয়েল য়ুনিভার্সিটি থেকে ডাক পেয়েছিল, ভাল স্কলারশিপ, উপরন্তু পার্ট টাইম কাজ ক্যাম্পাসের মধ্যে। শুনতে পেয়ে জেঠু গোটা পঁচিশ যুবকের ছবি বায়োডেটা সহ নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলেন। ক্ষমতা আছে বটে মানুষটার। দিন দশেকের মধ্যে বিদেশ যাবে পাত্রী খুঁজছে এমন পঁচিশটা কেস জোগাড় করেছেন।

বললেন—নাও পছন্দ করো।

—কী ব্যাপার? কাকে পছন্দ? কেন পছন্দ!

—রুমা বিলেত যেতে চায়, এই তো কথা! তা যাক, এইসব সোনার চাঁদেদের খবর এনেছি। এদের কারও সঙ্গে সিদুঁরটিঁদুর পরে একেবারে যাক।

—সে কী? ইয়েল-এ যে…পিসেমশাই হতবাক।

—আচ্ছা সুবীর, তোমারও যা বয়েস আমারও তাই বয়স, আমিও য’ টাকা মাইনে পাই তুমিও ত’ টাকা মাইনে পাও। মাথায় গ্রে ম্যাটার এত কম হয়ে গেল কী করে। রুমু একা একা ইয়েলে যাবে, তারপর কোনও সাতঘাটের জল খাওয়া সায়েব ওকে পাকড়াও করলে? জান, ওরা দাঁত মাজে না!

—সে কী! ওরা কোনকালে দাঁত মাজা চান করা সব শিখে গেছে।

—তুমি আর ‘সে কী’ ‘সে কী’ করো না। কথায় কথায় আকাশ থেকে পড়া তোমার একটা রোগ। টিভি দেখ? যে কোনও সায়েব হাসলেই দাঁতগুলো খেয়াল করে দেখো…আমাদের যেমন বাঁধা গোয়ালা, ওদের তেমনি বাঁধা ডেনটিস্ট।

—তা যদি বলেন বাঁধা গোয়ালা ওই আপনাদের নাগ বাড়িতেই এখনও টিকে আছে, এখন কেউ বাঁধা…

চুলোয় গেল ইয়েল, চুলোয় গেল রুমাদির ভাল রেজাল্ট, স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাবার আশা। কটা বাড়িতে এখনও গোরুর দুধ খায়, তার পরিসংখ্যান নিয়ে দুজনে ধুন্ধুমার তর্ক লেগে গেল।

অবশেষে কাঁদো কাঁদো মুখে রুমুদি একটা ছবি তুলে নিয়ে বলে বড় মামু এইটে পছন্দ, ঠিক যেন শাড়ি পছন্দ করছে।

অতঃপর সেই সানাই, সেই পাঁচশো লোক, লুচি থেকে আইসক্রিম, সেই তত্ত্ব। এখন রুমু জামাইবাবু স্টেট য়ুনিভার্সিটি অফ মিনেসোটায়। রুমুদিদি রুম্যানি বীক্ষ্য করছে।

মেয়েদের বাড়ি-ফেরা নিয়ে জেঠু এত বাতিকগ্রস্ত যে পাশের বাড়ির মিতালিদি পর্যন্ত যতক্ষণ না বাড়ি ফেরে জেঠু ঘরবার করে। মিতালিদি ফিজিক্সের মেয়ে, পি এইচ ডি করছে, স্বভাবতই তার ফিরতে দেরি হয়। এক এক দিন তো বেশ দেরি। তার নিজের বাড়ির লোকের মাথাব্যথা নেই, জেঠু ঠায় সদরে দাঁড়িয়ে থাকবে। গলির মোড়ে মিতালিদির হিলের খুটখুট শোনা যাবে, তবে জেঠুর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়বে।

—মিতু এলে মা? খবর সব ভাল তো?

—হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, খবর খারাপ হবে কেন?

—না। রাস্তাঘাটে বিপদআপদ আজকাল লেগেই আছে কি না!

—একটু জ্যাম ছিল, আর কিছু না।

জেঠিমা রাগ করে বলেন, তোমার খবরদারির কী দরকার বলো তো! মেয়েটা কী মনে করে কে জানে!

—কী আবার মনে করবে? আমি একটা পিতৃতুল্য মানুষ। মেয়েটার ভাল-মন্দর জন্যে চিন্তা-ভাবনা করছি। এতে আবার মনে করার কী আছে? রাত দশটা পর্যন্ত ঘরের মেয়ে বাইরে থাকলে ভাবনা হয় না? দিনকাল জান? যেখানে-সেখানে মেয়েগুলোকে মুখে কাপড় বেঁধে আরবে চালান করে দিচ্ছে। জান না তো আর…

—হ্যাঁ, অমনি চালান করে দিলেই হল। দুনিয়ার মেয়ে তা হলে দোরে খিল এঁটে কাজকর্ম বিসর্জন দিয়ে বসে থাক!

—কাজকর্মটা কী শুনি? কী? মাদাম কুরি হবে?

হয় মাদাম কুরি নয় হাতা বেড়ি। এই দুটোই জেঠুর কাছে একমাত্র গ্রহণীয় বিকল্প। এইটে নাগ-বাড়ির জীবনদর্শনের অন্ধকার দিক। তাই একটা সময়ের পরে মুক্তির জন্যে প্রাণটা একটু আঁকুপাঁকু করে বই কী! জিনার ধারণা ছিল বিয়ে মানে সেই মুক্তি। বিয়ে মানেই তুমি একটা গোটা লেডি হয়ে গেলে। তোমার মাথায় সিঁদুর, সুতরাং সম্ভাব্য সব অনাকাঙিক্ষত ক্যানডিডেটরা জানবে এ কেস খতম। এ দিকে আর নজর দিয়ে লাভ নেই। দ্বিতীয়ত, তুমি গৃহিণী। মানে কর্তৃকারক। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে, নিজের মতামত দেবে, নিজের বিদ্যাবুদ্ধির ওপর নির্ভর করে চলবে এখন থেকে।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ভালই ছিল। সব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি জোড়ে নেমন্তন্ন সারতে সারতেই বছর পার। প্রত্যেক রবিবার বা ছুটির দিন নতুন নতুন শাড়িটাড়ি পরে সাজগোজ করে বরের সঙ্গে বেরোনো। ফুরফুরে মেজাজ, হাসি, রসিকতা, বরের বন্ধুদের মনোযোগ আর বরের তো কথাই নেই। চক্ষে হারাচ্ছে। দুঃখের বিষয় এ সবই জীবনে বাসি হয়ে যায়। পাটভাঙা, ধোপদুরস্ত অবস্থায় যতটা আকর্ষক থাকে, পরে কিছুতেই আর ততটা থাকে না। শুধু তাই নয়। আগের হাসি আনন্দ তামাশার মধ্যে থেকেও অনেক খুঁত বেরোতে থাকে। অনেকটাই যেন ঠকে যাওয়া, ফাঁকি। যেটাকে প্রশংসা বলে মনে হয়েছিল সেটা ঈর্ষা, স্নেহটা স্নেহ নয়— তোষামোদ, অন্তরঙ্গতাটা আসলে হাঁড়ির খবর জেনে নেবার কৌশল। এইরকম। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির গণ্ডির মধ্যে তার তেমন খেদের কোনও কারণ ছিল না। মল্লিকার সঙ্গে তার খুব পটে গেছে। যদিও মল্লিকার কিছু কিছু দোষ আছে। সে বাইরের জগতের কোনও খোঁজ রাখে না। ভয়ানক ভিতু, অকপট নয়, নিজের সব কথা জিনা যেমন উজাড় করে বলে দেয়, মল্লিকা তেমন নয়, কিন্তু এগুলোর কোনও গুরুত্বই থাকে না, তার গুণের পরিচয় একবার পেলে। এত স্নেহ, এত আন্তরিক মনোযোগী ভালবাসা আর কোথাও পেয়েছে বলে জিনা মনে করতে পারে না। দিদিভাইয়ের কোনও ইগো-প্রবলেম নেই। জিনাকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। জিনা এই পারে, জিনা ওই পারে। সে নিজে যে হোটেলের শেফদের হার মানিয়ে দেবে অনেক রান্নায় সে কথা কে বলে! জিনার গুণপনায় তার চোখ কপালে উঠেই আছে। মল্লিকার ধারণা তার বুদ্ধি বলে কিছু নেই। তাই সে সব ভুলে যায়। এলোমেলো করে ফেলে। জিনা দেখেছে বুদ্ধি না থাকার কথাটা ঠিক নয়। কোনও একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে মল্লিকার ভুলের। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় নিরাপত্তার অভাববোধ? শাশুড়ি কি খুব দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিলেন? দাদার শীতলতাও একটা কারণ হতে পারে। মেয়েদুটো বুদ্ধিমতী, কাকিমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবার জন্য এক পায়ে খাড়া। ওদেরও খুব ভালবাসে জিনা। আর শ্বশুরমশাই? একটু চুপচাপ, ভাবুক ধরনের। কত যে পড়েন, কত যে জানেন, কত রকমের আগ্রহ, ওঁকে এখনও জিনা বুঝতে আরম্ভ করতেই পারেনি। তবে একটু দূরের মানুষ, নিঃসন্দেহে। বাড়ির দুই ছেলে অর্থাৎ তার ভাসুর এবং তার পতিদেব— এরা দুজনেই তাকে নিরাশ করেছে। দাদা তো দিদিভাইয়ের উপযুক্ত বর বলেই তার মনে হয় না। এ আবার কী! যার এমন সুন্দরী গুণী স্ত্রী, এত সুন্দর প্রাণোচ্ছল দুটো মেয়ে, তিনি এরকম তাসে-সমর্পিত-প্রাণ হয়ে থাকতে পারেন কী করে? কী ভীষণ চুপচাপ, ঠান্ডা প্রকৃতির! প্রথম প্রথম জিনা তার স্বভাবমতো ওঁকে ঠেলাঠেলি করতে ছাড়েনি। উনিও কদিনের জন্য নড়েচড়ে বসেছিলেন। কিন্তু কদিন। ক’মাস। ব্যস আবার যে কে সেই। আর নিখিল? নিখিল এক হিসেবে দাদার উলটো। সব সময়ে তপ্ত লোহা, ছ্যাঁক করে উঠলেই হল। নিখিলের সব কাজকর্ম কথাবার্তার কার্য-কারণ সে সত্যিই বুঝতে পারে না। সে নিজেকে সবটা দিতে চায়। পারে না। কোথাও নিখিলের মধ্যে একটা লৌহকপাট আটকানো আছে। তা ছাড়া ভীষণ গোঁয়ার। অহমিকা সাঙ্ঘাতিক। যদি একবার বুঝতে পারল কোনও জিনিস তার মতে হচ্ছে না, জিনার মতটাই জিতে গেল, অমনি বেঁকে বসবে। অমন বাবার ছেলে, জীবনে কোনও কিছুর অভাব হয়নি, বাইরে পালিশ আছে, সবই ঠিক। কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা ভীষণ রূঢ় অমার্জিত মানুষ বাস করে যাকে জিনা চেনে না, স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু আশা ছাড়ে না, একদিন না একদিন তাকে সে বুঝবেই, পোষ মানাবেই।

ইতিমধ্যে সে ধৈর্য ধরে আছে। সুতো ছাড়ছে। সময় দিচ্ছে। যাদের জীবনটা সম্পূর্ণ স্বামী-নির্ভর সে তো সে জাতীয় নয়ও। আরও তো আছে। অনেক অনে-ক রকম আছে। তাদেরও তো দুর্ধর্ষ লাগে তার! ঝুম্পার সঙ্গে ওয়ার্ড-মেকিং, মাম্পির সঙ্গে সাপলুডো, দিদিভাইকে নিয়ে একজনদের জন্মদিনের আর একজনদের অন্নপ্রাশনের উপহার কিনতে যাওয়া। টিভি সিরিয়াল নিয়ে ফোনে মায়ের সঙ্গে তুমুল তর্ক। হঠাৎ কলেজ-জীবনের তিন-চার জন বন্ধু বাড়িতে হাজির। একেবারে অপ্রত্যাশিত। তার ওপরে সে উপন্যাসের পোকা, বিশেষ করে থ্রিলার। ‘হরি হে, তুমি আমার সকল হবে কবে!’ জাতীয় মন নিয়ে বরের মুখ চেয়ে থাকতে তার বয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *