জিদ-ওয়াইল্ড্
আঁদ্রে জিদের বই এবং বিশেষ করে তার জুর্নালগুলো (ডায়েরি) বিশ্ববিখ্যাত। আর পাঁচজনের মতো আমিও সেগুলো পড়েছি, তাঁর পরলোকগমনের পর ফ্রান্স দেশে তাঁর সম্বন্ধে যেসব লেখা বেরিয়েছে তারও কিছু কিছু নেড়েচেড়ে দেখেছি, কিন্তু তবু মেনে নিতেই হল যে, ঠিক ঠিক হদিসটি পেলুম না-জিদকে ফেলি কোন পর্যায়ে, কপালে টিকিট সাঁটি কোন রঙের? অথচ গুরুর আদেশ জিদ সম্বন্ধে লিখতে হবে-উপায় কি?
একটা উপায় আছে, সেটি হচ্ছে জিদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আলোচনা করা। এই ধরুন না, অস্কার ওয়াইলাড়ু। জিদ তাকে বিলক্ষণ চিনতেন এবং ওয়াইলড়ও তাকে স্নেহ করতেন। ওয়াইলড়। তখন খ্যাতনামা পুরুষ, প্যারিসে এলে তাঁর পিছনে ফেউ লেগে যেত; তার উপর ওয়াইলন্ডু বলতে পারতেন খাসা ফরাসী। জিদই তার চটি বই ‘অস্কার ওয়াইলডের স্মরণেতে লিখেছেন, ‘ওয়াইলডু অত্যুৎকৃষ্ট ফরাসী জানতেন তবু মাঝে মাঝে ভান করতেন যেন জুতসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না-অবশ্য তখন তাঁর মতলব হত। ঐ কথাগুলোর উপর বিশেষ করে জোর দেবার। উচ্চারণে তাঁর প্রায় কোনো ভুলই ছিল নাশুধু ইচ্ছে করে দুটো একটা শব্দ এমনভাবে উচ্চারণ করতেন যাতে করে সেগুলো ভারি নূতন ধরনের চমক দিয়ে দিত। প্রথম যে সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সেদিন তিনি একটানা আমাদের গল্প শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কেমন যেন খাপছাড়া, আর সে সন্ধ্যার গল্পগুলো তার সবচেয়ে ভালো গল্প বলেও ধরে নেওয়া যায় না। হয়তো ওয়াইলাড়ু আমাদের চিনতেন না বলে আমাদের গ্রহণ করার ক্ষমতা পরখ করে নিচ্ছিলেন। ঐ ছিল তাঁর স্বভাব-তা সে বুদ্ধিমানের হোক আর বোকারই হোক-যে লোক যে জিনিসের রস বুঝতে পারবে না। তাকে চিনি সে জিনিস ককখনো পরিবেশন করতেন না। যার সে রকম রুচি তাকে ঠিক সেই রকমেরই মাল দিতেন। তিনি। যারা তার কাছ থেকে কোনো জিনিসের প্রত্যাশা করত না তারা পেতও না কিছু-কিংবা হয়ত পেত সামান্য একটুখানি গোঁজলা। আর সবচেয়ে তিনি পছন্দ করতেন। খুশগল্প বলে পাঁচজনকে খুশ করে রাখতে, তাই অনেকেই যাঁরা ভেবে নিয়েছেন যে, তাঁরা ওয়াইলাড়ুকে চিনতে পেরেছেন, তারা শুধু তাকে চিনেছেন খুশি দেনেওয়ালা হিসেবে (amuseur = amuser)।
জিদ এখানে একটুখানি ইঙ্গিত করেছেন যে, বেশির ভাগ লোকই ওয়াইলড়কে চিনেছে কেমন যেন একটু ‘ভাঁড়’ ‘ভাঁড়’ রূপে এবং সেইটিই তাঁর আসল রূপ ছিল না।
মনে হচ্ছে এর থেকে জিদ কিঞ্চিৎ শিখে নিয়েছিলেন। কারণ পূর্বেই তিনি বলেছিলেন, ‘ঐ ছিল তার স্বভাব–তা সে বুদ্ধিমানের হোক, আর বোকারই হোক–সবাইকে আপন রুচি অনুযায়ী পরিবেশন করার।’ তাই বোধ করি; জিদ সেই প্রথম যৌবনেই মনস্থির করে ফেলেছিলেন যে, ওটা বোকারই কর্ম, আর তিনি অন্য কারোর রুচির বিলকুল তোয়াক্কা না করে। টক-টক হক কথা বলে যাবেন।
সে না হয় বুঝলুম। অপরকে টক কথা শুনিয়ে দেওয়া খুব কঠিন কর্ম নয়—আমরা সবাই জানা-অজানাতে হরদম কয়ে থাকি-কিন্তু প্রশ্ন, নিজের সম্বন্ধে টক কথা পাঁচজনকে শুনিয়ে বলতে পারে কটা লোক? জিদ। পারতেন। কি না?
ওয়াইলডু কোন অপরাধে জেলে গিয়েছিলেন সে-কথা সকলেই জানেন। জেল থেকে বেরিয়ে ওয়াইলডু দেখেন লন্ডন-সমাজ তার তাবৎ দরজা দড়াম করে তাঁর মুখের উপর বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি তখন গেলেন ফ্রান্স। প্যারিসেও গোড়ার দিকে ঐ একই অবস্থা হতে পারে ভেবে তিনি গেলেন একটি ছোট নির্জন শহরে। খবর পেয়ে জিদ। তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে গিয়ে জখমী ওয়াইলডের বিস্তর তত্ত্বতাবাশ করলেন। জিন্দ তাঁর অতি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন উপযুক্ত চটি বইয়ে। পাঁচজনে কি বলবে না বলবে তার তোয়াক্কা জিদ। তখন করেন নি; সে কথাটা তিনি না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়।
তারপর ওয়াইলডু ফিরে এলেন প্যারিসে। জিদের সঙ্গে তাঁর দুচার বার দেখাসাক্ষাৎ হল। ক্রমে ক্ৰমে দেখা গেল, প্যারিসও যে শুধু ওয়াইলডের ইকো-নাপিতই বন্ধ করেছে তা নয়, তার বন্ধুবান্ধবের অনেকেও তাকে কুণ্ঠরোগীর মতো বর্জন করতে আরম্ভ করেছেন। জিদ লিখেছেন, ‘ওয়াইলন্ডু যখন দেখতে পেলেন দু-চারখানা দরজা তাঁর জন্য বন্ধ তখন তিনি আর কোনো দরজাতেই কড়া নাড়লেন না–ছন্নের মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
এমন সময় একদিন জিদ দেখতে পেলেন, ওয়াইলডু এক কাফের বারান্দায় বসে আছেন। স্বীকার করি, ও রকম জায়গায় হঠাৎ মোলাকত হয়ে যাওয়াতে আমি একটুখানি অস্বস্তি অনুভব করলুম-চতুর্দিকে ভিড়। বন্ধু ‘জি-’ ও আমার জন্য ওয়াইলন্ডু দুটো ককটেল অর্ডার দিলেন। আমি তাঁর মুখোমুখি হয়ে বসতে যাচ্ছিলুম যাতে করে লোকজনের দিকে পিঠ ফিরানো থাকে। কিন্তু ওয়াইলাড়ু ভাবলেন, আমি পাশে বসতে বোকার মতো নিরর্থক লজ্জা পাচ্ছি (হায়, ওয়াইলডু সম্পূর্ণ ভুল করেন নি) তাই পাশের চৌকি দেখিয়ে বললেন, আঃ, আমার পাশে এসে বসে না; আমি আজকাল বড্ড একলা পড়ে গিয়েছি।’
তারপর দুজনাতে কি কথাবার্তা হল সে কথা আরেক দিন হবে। উপস্থিত লক্ষ্য করার বস্তু যে, জিদও জনমতের ঠেলায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন। এবং যে ব্যবহার করলেন তাকে সুব, ক্যাডের আচরণ বলা যেতে পারে। বাঙলা কথায় একদম ছোটলোকোমি করলেন।
একদিন জিদ নিৰ্ভয়ে যেচে গিয়ে ওয়াইলডের সঙ্গে দেখা করেছিলেন লোকনিন্দার পরোয়া না করে, এবং আশ্চর্য তাই নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র গর্ব করেন নি এবং আরো যখন অন্যায় আচরণ করলেন তখনও সেটা লুকোলেন না। শুধু তাই নয়, পাঠক যাতে অতি নির্মমভাবেই তাঁর মাথায় ঘোল ঢালতে পারে তাই কোনো প্রকারের অজুহাত বা আত্মনিন্দাও পেশ করলেন না।
কি উপন্যাস, কি ছোট গল্প, কি জুর্নাল, সর্বত্রই জিদ। এই আশ্চর্য সাধুতা দেখিয়েছেন।*
——-
* Andre Gide : Oscar Wilde. In memoriam, Paris, Mercure de France.