জাহাজ
আমরা জলের দেশের লোক। আমাদের ছোট শহরের চারপাশে নদী-নালা, খাল-বিল। জল আর জল। কাছেই দু’দিকে একটু এগিয়ে পিছিয়ে দুটো স্টিমার ঘাট, চারাবাড়ি আর পোড়াবাড়ি।
সামনে দক্ষিণ দিকে ধলেশ্বরী নদী দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এলাসিন, স্টিমারের জংশন স্টেশন। চারাবাড়ি পোড়াবাড়িতে স্টিমার আসে সিরাজগঞ্জ থেকে আর এলাসিনে সিরাজগঞ্জের স্টিমার ছাড়াও ঢাকার স্টিমার আসে, যায়।
এলাসিন আমার গ্রাম, আমার জন্মভূমি। এখনও সেখানে গৃহদেবতা আছেন, ভদ্রাসন আছে।
আমাদের এই জলভূমিতে রেলগাড়ি পৌঁছায়নি। শেষতম রেলপথ ছিল পঞ্চাশ মাইল দূরে। একটা নড়বড়ে বাসরাস্তা ছিল জেলা সদর পর্যন্ত কিন্তু সে পথও বর্ষাবাদলে খুব সচল থাকত না।
যাতায়াতের জন্য আমাদের প্রধান ভরসা ছিল জলপথ, নৌকো ও স্টিমার।
আমাদের অঞ্চলে স্টিমারকে বলা হত জাহাজ। প্রাচীন গ্রামবৃদ্ধেরা কেউ কেউ বলতেন কলের নৌকো বা কলের জাহাজ।
জাহাজ বাংলা শব্দ নয়। মূল আরবি শব্দটি হল জহাজ। বহুকাল আগে আরব সাগর বেয়ে এই শব্দটি বঙ্গোপসাগরে ভেসে এসেছে।
জাহাজ প্যাটার্ন বাড়ি, জাহাজ মার্কা বিড়ি। জাহাজ বাঙালির খুব নিজের শব্দ হয়ে গেছে। সংস্কৃত অর্ণবপোত টেঁকেনি। এমনকী বাংলা প্রবাদে ঢুকে এই আরবি শব্দটি বুদ্ধির জাহাজ হয়ে গেছে।
সে যা হোক, জাহাজের দিন কবে শেষ হয়ে গিয়েছে। মালবাহী জাহাজ এখনও আছে, যাত্রীবাহী জাহাজ বিরল। তার জায়গা নিয়েছে উড়োজাহাজ।
কলকাতা বন্দর থেকে একদা দেশ-দেশান্তরে যাত্রীবাহী জাহাজ যেত। এখন শুধুই কালেভদ্রে আন্দামান যাওয়ার জাহাজ ছাড়ে।
জাহাজ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক গল্পকাহিনী, ভ্রমণকাহিনী আছে। মনসামঙ্গল থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে অন্নদাশংকর রায় পর্যন্ত সে কাহিনীর বিস্তার।
জাহাজযুগের অবসানে একটা পুরনো দিনের কাহিনী স্মরণ করি।
বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই) বন্দর থেকে শেষ বিলেতগামী জাহাজ ছেড়েছিল ষাটের দশকের গোড়ায়। সেই জাহাজে কলকাতার তখনকার প্রবীণ ব্যবহারজীবী ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন গিয়েছিলেন। বর্তমান গল্পটি তিনিই আমাকে বলেছিলেন। গল্পের খাতিরে ব্যারিস্টার সাহেবকে মি. চৌধুরী বলে অভিহিত করছি।
জাহাজের ডাইনিং হলে প্রথম দিন রাতে ডিনারের সময়ে মি. চৌধুরীর সঙ্গে এক ফরাসি সাহেবের পরিচয় হয়। নিতান্ত মুখ পরিচয়, কারণ মি. চৌধুরী ফরাসি ভাষা জানেন না। ওদিকে ফরাসি সাহেবও ইংরেজিতে সড়গড় নন, বিশেষ বলার চেষ্টাও করেন না।
ফরাসি সাহেব ডাইনিং টেবিলে ফরাসি কেতায় অভিনন্দন জানালেন, ‘Bon Appetit’। মি. চৌধুরী ভাবলেন ভদ্রলোক নিজের নাম বলে আত্মপরিচয় দিচ্ছেন, সেটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং বিনিময়ে তিনিও বললেন, ‘এইচ. এস. চৌধুরী।’ কিন্তু মনে খটকা রয়ে গেল।
এই রকম বেশ কয়েকদিন চলল। এর মধ্যে মি. চৌধুরীর জাহাজেই এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল যিনি ভাল ফরাসি জানেন। তাঁকে মি. চৌধুরী নিজের সমস্যাটা বললেন।
ভদ্রলোক মি. চৌধুরিকে বললেন, ‘Bon appetit’ ভদ্রলোকের নাম নয়। ‘Bon Voyage’ যেমন ‘যাত্রা মধুর হোক’, তেমনি ‘Bon Appetit’ একটা শুভেচ্ছা, ‘আহার মধুর হোক।’
এর পরের ঘটনা অবশ্য অতীব হাস্যকর। এই জ্ঞান লাভ করার পরে ডাইনিং টেবিলে সেই ফরাসি সাহেবকে তাঁরই কেতায় মি. চৌধুরী শুভেচ্ছা জানালেন, ‘Bon Appetit’।
এই শুনে ফরাসি ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘এইচ. এস. চৌধুরী।’ কারণ এতদিনে ওই ভদ্রলোক ধরে নিয়েছেন এইচ. এস. চৌধুরী হল কোনও ভারতীয় ভাষায় শুভেচ্ছা, ভোজন শুভেচ্ছা।
পুনশ্চ:
জাহাজ কাহিনীর শেষে একটা জাহাজডুবির গল্প।
জাহাজ নিয়ে যত গল্প জাহাজডুবি নিয়ে গল্পের সংখ্যাও তার চেয়ে কম নয়। জাহাজডুবি নিয়ে, বিশেষত ইংরেজি তথা ইউরোপীয় ভাষায় রচিত রোমাঞ্চকর স্মরণীয় কাহিনীর সংখ্যা অনেক।
এ গল্পটা অবশ্য রোমাঞ্চকর নয় বরং বলা চলে নীতিমূলক।
জাহাজডুবির পর সমুদ্র সাঁতরিয়ে এক নাবিক এক নির্জন দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কোথাও মানুষজন, জনপদ, সভ্যতার চিহ্ন কিছু নেই।
এই শূন্য দ্বীপে নাবিকটির মাস কয়েক কাটল। হঠাৎ একদিন একটা জাহাজ দেখা গেল। নাবিকটি উল্লসিত হয়ে দৌড়ে সমুদ্রতীরে গিয়ে নিজের জামা খুলে একটা গাছের ডালের মাথায় পতাকার মতো উড়িয়ে জাহাজটির দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
জাহাজটি তীরে এসে দাঁড়াতে ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন ডেকে এসে দাঁড়িয়ে নাবিকটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এখানে কতদিন আছেন?’
নাবিকটি বলল, ‘মাস কয়েক হবে।’
ডেক থেকে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ভালই তো আছেন মনে হচ্ছে।’
নাবিকটি চুপ করে রইল।
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমি জাহাজ থেকে গত ছয় মাসের কিছু কিছু খবরের কাগজ আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি। পড়ে দেখুন, তারপরে বলুন পৃথিবীতে ফিরতে ইচ্ছে করে কি না।’
এই গল্পটা এই পর্যন্তই জানি। এর পরে ঠিক কী হয়েছিল বলতে পারব না।