জালোজায়ির রোদনভরা দৃশ্য
প্রথম যে জিনিসটা আমার খুব দরকার ছিল, তা হলো ইংরেজি জানা একজন ড্রাইভার। আমি লবিতে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জানাতেই সে দ্রুত আমার জন্য ইংরেজি জানা একজন ড্রাইভার ডেকে দিল এবং আমরা বেরিয়ে পড়লাম। খানিক বাদেই আবিষ্কার করলাম, তার ইংরেজির ভাণ্ডারে শুধু ‘ওকে’ শব্দটাই রয়েছে। হায় খোদা, আমাকে অন্ধ করে দাও! আমার মনে হতে লাগল, ভাগ্য আমাকে নিয়ে খেলছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি হোটেল লবিতে ফিরে এলাম এবং বিনয়ের সঙ্গে একজন প্রকৃত ইংরেজি জানা ড্রাইভার খুঁজে পেতে সাহায্য চাইলাম। পাকিস্তানিদের আমার খুব ভালো লাগে। তারা খুবই সাহায্যপ্রবণ। কেউ কোনো সাহায্য চাইলে তারা অপারগতা প্রকাশ না করে কিছু একটা করার চেষ্টা করে।
যা-ই হোক, ক্রাউন প্লাজার কর্মীরা এবার আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করল। মিনিট পাঁচেক পরই পাশার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ৩০ মিনিটের মধ্যেই ওকে আমার নতুন বন্ধুর তালিকায় যোগ করে ফেললাম।
পাশা অনর্গল ইংরেজি বলে। ও সারা দুনিয়ায় ঘুরে ঘুরে কাজ করেছে। এবং খুব হাসিখুশি ও আন্তরিক। আমি যা চাইতাম ও তাই জোগাড় করার চেষ্টা করত। সহজ, সরল, অসাধারণ পাশা।
পাশার বাদামি চোখ দুটো খুব মায়াবী। ওর গোলগাল মুখের চিবুকটাতে এক গোছা দাড়ি। ওর মাথার ঘন কালো চুলের ঘনত্ব কমে আসছিল এবং মনে হলো ও সদ্য চল্লিশের ঘরে পা দিয়েছে। হাসলে ওর মুক্তোর মতো সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ত। সামনের দিকে দাঁতের মাঝে একটু ফাঁকা ছিল। যদিও অত বেশি লম্বা নয়, তবে কয়েক দিন আগে নাকি বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। এখন ক’দিন তাই খেলা বন্ধ। পরের দিকে মাঝেমধ্যে ওর হাঁটা দেখে বুঝতে পারতাম যে ওর পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। কিন্তু পাশা কোনো দিনই এ নিয়ে অভিযোগ করেনি।
আমার লক্ষ্য ছিল কয়েকজন রেস্তোরাঁর মালিকের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে ঘটে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কথা বলা এবং পাকিস্তানের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে, তা জানতে চাওয়া।
আমরা কাছেই ছোট একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম এবং সেখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। চা খেতে খেতে গল্প জমে উঠল, এক ঘণ্টা ধরে গল্প চলতেই লাগল । ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি আমার ওই দিনের প্রতিবেদনের যাবতীয় তথ্য পেয়ে গেলাম। অফিসে জানানোর জন্য হোটেলে ফিরে এলাম।
সাংবাদিকতার মাপকাঠিতে এটা খুব বড়সড় কাজ ছিল না। তবে এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে খবরের পাতায় বড় আকারের শিরোনাম দেওয়ার মওকা সৃষ্টি হলো : ইভন রিডলি ইসলামাবাদে!
খবরের জগতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় খাপছাড়া এবং আমরা খুব আনন্দিত হলাম যখন জানতে পারলাম, মেইল অন সানডের প্রতিবেদক আবুধাবি বিমানবন্দরে ফ্লাইট বিলম্বের কারণে আটকা পড়েছে এবং তখনো কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
এরই মধ্যে ডেইলি এক্সপ্রেস-এর কোনো বিভীষণ মেইল অন সানডেকে জানিয়ে দিয়েছে, আমি ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদে পৌছে গেছি। তাই আমার পিছু পিছু তারাও কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাল ছাড়তে কেউই রাজি নয়।
আমাকে জানানো হয়েছিল, মেইল অন সানডে আমার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু ইভান গোলাঘ্যারকে পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। যদিও আমি ওর সঙ্গ দারুণ পছন্দ করি, তবু পেশাদারির খাতিরে চাইছিলাম ও অন্য কোনো হোটেলে উঠুক। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বোধ করি, ইভান পেশোয়ারে অবতরণ করে এবং পার্ল কন্টিনেন্টালে ঘাঁটি গাড়ে।
রোববার আমরা একটা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণে গেলাম। পাশার মতে এটা ছিল কোনো একটা মাদরাসা বা ইসলামি বিদ্যালয় ধরনের এবং মুসলিম বিশ্বে এর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাকে স্থানীয় পোশাক ও মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধতে অনুরোধ করল। তাই আমরা রাওয়ালপিন্ডির একটা বাজারে ঢু মারলাম। একটা পাশমিনা শাল খুব পছন্দ হলো। আমি পাশাকে নিয়মিত সাংস্কৃতিক ও স্থানীয় রীতিনীতি সম্বন্ধে ধারণা দিতে অনুরোধ করি। এ-ও বলে দিই, আমি যদি কখনো ওর সঙ্গে অথবা অন্য কারও সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করি, তাহলে ও যেন আমাকে অবশ্যই জানিয়ে দেয়। এই দেশে আমি এর আগে কোনোদিন আসিনি। স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।
একটা লম্বা কালোমতো পোশাক গায়ে জড়ালাম এবং আরামদায়ক চামড়ার জুতা জোড়া পায়ে গলিয়ে দিলাম ।
অবশেষে উত্তর প্রদেশের নওশারাতে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছে গেলাম। যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে একটা খুবই সাধারণ সাদা রং করা ছোট গম্বুজবিশিষ্ট একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, এটা কি মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান।
জানতে পারলাম, প্রতিবছর বাদামি চামড়ার শ্মশ্রুমণ্ডিত হাজার হাজার তরুণ এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং এদের ৯০ শতাংশই তাদের স্বপ্নের নায়ক উসামা বিন লাদেন ও তালেবানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আফগানিস্তানে চলে যায়। বিন লাদেনকে এই আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক একটা ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা একে জামিয়া হাক্কানিয়া বলে ডাকে।
আমি নিশ্চিত, আমেরিকানরা একে সন্ত্রাসের সূতিকাগার বলে অভিহিত করবে। তবে যত দিন পর্যন্ত এখানকার শিক্ষকেরা সচেতন থাকবেন, তত দিন এটি হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের মতোই একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আট বছরের শিক্ষাজীবনে ছাত্রদের ইসলামি জ্ঞানের প্রতিটি দিক সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মুসলিম যুবক এখানে পড়তে আসেন। মাওলানা (অধ্যাপক) সামিউল হক প্রতিষ্ঠানটি চালানোর দায়িত্বে আছেন। তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের তকালীন চেয়ারম্যান ও খুবই সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন।
আমরা যেদিন গেলাম, সেদিন তিনি লাহোরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মুসলিম পণ্ডিতদের সঙ্গে একটা বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। একই রাতে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আমাকে একটা ছোট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বসে অপেক্ষা করতে বলা হলো। দুজন অল্পবয়সী ছেলে বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন। একটু পরই মাওলানার ছেলে হামিদুল হক এলেন এবং আমরা সবাই পায়ের ওপর পা তুলে বসে কথা বলতে লাগলাম।
হামিদ, যিনি নিজেও একজন মাওলানা, আমাকে নিশ্চিত করলেন, প্রতিষ্ঠানের অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বেশ কয়েকবার বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁরা সবাই তাঁকে একজন সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে বর্ণনা করলেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, লাদেন একজন ধার্মিক মানুষ, যিনি পাশ্চাত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না, জর্জ বুশ অথবা টনি ব্লেয়ার উনার কথার সঙ্গে একমত হবেন কি না। তবে আমি এই উৎসাহী তরুণ ব্যক্তির কথা শুনতে লাগলাম।
তিনি জানান, আমেরিকার প্রতিশোধের কথা শুনে তিনি বিরক্ত হয়েছেন। এই মাদরাসায় কোনো উগ্রবাদী অথবা হবু জঙ্গিদের আস্তানা রয়েছে, এমন কথায় তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বেশ দৃঢ়চিত্তেই বললেন, এখানে সবকিছুই শৃঙ্খলার গণ্ডিতে আবদ্ধ এবং কোনো অস্ত্র তো দূরে থাক, একটা বোমাও সেখানে নেই। আমেরিকানরা যে হামলার পেছনে বিন লাদেনই কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ করছে, তা নাকচ করে দিলেন তিনি। এই ঘটনাকে তিনি একটি দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করলেন। পশ্চিমাদের কাছে যতই অশোভন মনে হোক না কেন, পাকিস্তানে আমি যার সঙ্গেই কথা বলেছি, অধিকাংশ ব্যক্তি এই পাশবিকতাকে খুব সুন্দর করে একটি দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করেছে।
হামিদ বললেন, উসামা বিন লাদেন যখন আমেরিকার টাকায় রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তখন তিনি ছিলেন আমেরিকার নায়ক। এখন তারাই আবার তাঁকে শত্রু বানিয়েছে। এই কথার লড়াই চলতে থাকলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে। এর ফলে অসংখ্য মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি মারা যাবে বলে হামিদ ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
এই কথা বলার সময় হামিদ খুব শান্ত, ধীরস্থির ছিলেন এবং তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাটা বলেন; যা শুনে আমার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো আতঙ্কে দাঁড়িয়ে গেল।
চলে আসার সময় আমি পাশার বক্তব্য শুনতে চাইলাম। পাশা তার স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়েই বেশি চিন্তিত এবং তাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আসার চিন্তা করছে বলে জানায়। পাকিস্তানের আট কোটি মধ্যমপন্থী মুসলমানের মতো সেও যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার শঙ্কায় ছিল। কথা শুনে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পরিণতি নিয়ে সে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে বলে মনে হলো।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোশাররফের আবেগপূর্ণ বক্তব্যের আগেই এত সব ঘটেছিল। তিনি জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং জনগণের সমর্থন কামনা করেন। লোকটা শাখের করাতের নিচে আটকা পড়ে ছিল। তবে টিভিতে তাঁকে বেশ মর্যাদাসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নই মনে হলো।
তালেবানরা ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে যুদ্ধে কোনোরূপ সাহায্য না করার জন্য সতর্ক করে দিয়ে এর পরিণতি পাকিস্তানের জন্য ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এর কিছুদিন পরই জানতে পারি, খাইবার পাসের সন্নিকটে তোরখাম সীমান্তে চারটা স্কাড মিসাইল আমাদের দিকে তাক করে মোতায়েন করা হয়েছে।
আমি বন্ধু সামরিক উপদেষ্টা পল বিভারকে ফোন করে স্কাড নিয়ে মতামত জানতে চাইলাম। জবাবে ও ভয়ের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে জানাল, এসব পুরোনো প্রযুক্তির স্কাড কখনোই ইসলামাবাদে আঘাত হানতে পারবে না। তবে সে একই সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ার থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিল। আমি লন্ডনের খবরাখবর জানতে চাইলাম এবং বাড়ি ফেরার জন্য উদাস হয়ে গেলাম।
আমি পাশাকে জানালাম, আমি আফগানিস্তান যেতে চাই। সে অনুযায়ী প্রথম সোমবার আমরা দূতাবাসে ভিসা সংগ্রহের জন্য গেলাম। তবে ডেইলি এক্সপ্রেস-এর বার্তা প্রতিবেদক ডেভিড লেভ আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিল। তার মতে, আমি ভিসা পেয়ে যেতে পারি কিন্তু আফগানিস্তান থেকে সব সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তে আমাকে উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনের উপদেশ দেয়।
আমি ওর কথায় থোড়াই কেয়ার করলাম। পাশাকে আমার ডেইলি মেইল ও সানডের দুই পুরুষ বসের ব্যাপারে গল্প শোনালাম। ও আমার বকবক শুনে দারুণ মজা পেল। ম্যাডামের কথায় (ও আমাকে এভাবেই ডাকে) ও হাসতে লাগল।
আমার তখনো শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা ভেবে নিজেকে ধন্য মনে হলো। সবকিছু সত্ত্বেও এই পুরুষ বার্তা প্রতিবেদক সত্যিকারের ভালো সাংবাদিক। আমি তখনো একটুও বিচলিত হইনি এবং সামনের দিনগুলো নিয়ে আমার খুব বেশি উদ্বেগ হয়নি।
তবে ডেভিড গল্প বিক্রি করতে বেশ উস্তাদ। সম্পাদকদের যেকোনো বৈঠক, যেখানে পরবর্তী ইস্যু নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়, সেখানেও ডেভিড তার প্রতি আকর্ষণ ধরে রাখতে চেষ্টা করে। কনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে সে অনেক ভালো ও সহযোগিতামূলক আচরণ করে।
ডেভিডের আগের জন ছিল একেবারেই অন্য রকম। তার সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক ছিল তত দিন, যত দিন ওই ব্যাটা পদোন্নতি পায়নি। এরপর তার মাঝে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। তাকে একদমই সহ্য করা যেত না। সে চলে যাওয়ার পরে মনে হয় না আমার থেকে বেশি কেউ খুশি হয়েছে। কারণ, তত দিনে আমি আবার মনোযোগ কেড়ে নিয়ে প্রথম পাতায় চলে এসেছি। আহ্ কী শান্তি!
পাশার সঙ্গে পরনিন্দা করতে করতে একসময় পেশোয়ারের উদ্বাস্তু শিবিরে পৌছে গেলাম। এখানকার অবস্থা সত্যিই করুণ। কিছু কিছু দৃশ্য ছিল দারুণ বেদনাদায়ক। বাস্তবতার এই নির্মম পরিহাস দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারে বদলে দেয়। অফিসের নোংরা রাজনীতি ভুলে গিয়ে আমি মানবতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছি।
আমাদের সঙ্গে পেশোয়ারে এক আফগান আলোকচিত্রী গাফফার বেগের পরিচয় হলো। সেও আমাদের সঙ্গে এখানে চলে আসে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি প্রায়ই মশা মারতে কামান দাগার মতো হয়ে দাঁড়ায়। ডন গ্রুপের পত্রিকার সাংবাদিক গাফফারের সহকর্মী মোহাম্মদ রিয়াজও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
মোহাম্মদ ১৯৯৯ সালে কিছুদিন লন্ডনে গার্ডিয়ান ও অবজারভার পত্রিকায় কাজ করেছে ফারিঙ্গটন রোডে। উদ্বাস্তু শিবিরের কর্মকর্তাদের ওপর ওর বেশ প্রভাব ছিল। ওর কারণে আমার শিবিরে কাজ করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা পোহাতে হয়নি।
শিবিরের রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে আমার নিজেকে বংশীবাদক মনে হতে লাগল। আমার সঙ্গে গাফফার, মোহাম্মদ, ওখানকার কর্মকর্তা হাঁটছিল। পেছন পেছন আসছিল একদল উৎসাহী বাচ্চাকাচ্চা। এদের বাদেও আরও অনেকেই উৎসুক হয়ে আমাকে দেখছিল। আমার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা হাঁটছিল। আমি থেমে গেলে ওরাও থেমে যেত। আমার মনে হলো, কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এখানকার উদ্বাস্তুরা প্রকৃত চিত্র তুলে না-ও ধরতে পারে। আমি বারবার বারণ করলেও কর্মকর্তারা আমাকে একলা পায়চারি করার অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানালেন।
আমি মোহাম্মদকে বললাম, এদের সঙ্গে আমি কথা বলতে আগ্রহী নই। আমার সঙ্গে যারা কথা বলছিল, তারা ৫ থেকে ১০ বছর ধরে এখানেই পড়ে আছে। আমি চাচ্ছিলাম অল্প কিছুদিন আগে এসেছে এমন উদ্বাস্তুদের থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে।
কথা শুনে পাশা, গাফফার ও মোহাম্মদ তিনজনই আমাকে পার্শ্ববর্তী এক ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইল। তবে সেখানে ঢুকতে অনুমতির প্রয়োজন হবে। ওদের বললাম, আগে অনুমতি চাইলে ওরা না-ও করে দিতে পারে। তবে যদি আমরা প্রবেশ করেই ফেলি, সে ক্ষেত্রে ওরা না করতে পারবে না। আমার বুদ্ধি ওদের পছন্দ হলেও এর জন্য বিপদে পড়তে পারি বলে ওরা সতর্ক করে দেয়।
মোহাম্মদ ভ্রমণ-সংক্রান্ত কিছু কাগজ সংগ্রহ করার জন্য চলে যায়। তবে ও খুব দৃঢ়ভাবেই বলে গেল, আফগানিস্তান যাওয়ার ভিসা ও সংগ্রহ করবেই। আমিও ওকে উৎসাহ দিলাম।
যা-ই হোক, আমরা পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির জালোজায়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওখানকার অবস্থা ছিল আরও করুণ, মর্মান্তিক। এই রকম দারিদ্র্যপীড়িত ননাংরা পরিবেশে অনেক আফগান ছিল, যারা ২০ বছর আগে যখন প্রথম আফগানে যুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠে, তখন থেকেই এই শিবিরে বসবাস করছে।
বাড়িগুলো ইট ও মাটি দিয়ে তৈরি। নতুন আসা উদ্বাস্তুরা জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা কাপড়ের তাঁবুতে অবস্থান করছিল। পুরুষেরা অকারণে অলসভাবে বসে গল্প করছিল আর বাচ্চারা খেলছিল। কোথাও কোনো নারী চোখে পড়ল না। অবশ্য পুরুষশাসিত এই সমাজে এমন দৃশ্য বিরল নয়।
কখনো ঘরের বাইরে বের হলে তারা আপাদমস্তক নীল কাপড়ের একটা পোশাক পরে, যাকে বোরকা বলা হয়। এটা দেখতেই গরম লাগে এবং খুব অস্বস্তিকর। আমি মরে গেলেও এমন কিছু গায়ে তুলব না। যদিও আমাদের পাশ্চাত্য সমাজে পুরুষেরা এখনো অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তবু আমরা মেয়েরা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো আছি ।
আমি খেয়াল করলাম, নারীরা দিনের আলো কমে আসার আগে একদম ঘর থেকে বেরোয় না। সন্ধ্যার দিকে তারা পাবলিক টয়লেট ও গোসলখানায় যায়। কাউকে যদি দিনের বেলা রাস্তায় দেখা যায়, তবে তা দৃষ্টিকটু ব্যাপার।
আমি সত্যিই দুঃখ পেলাম। পুরুষদের মতো সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে কেন এখনো মেয়েদের অপেক্ষা করতে হবে? পূর্ব অথবা পশ্চিম যেখানেই হোক, একবার ভেবে দেখুন, মেয়েদের বলা হলো- তোমরা সন্ধ্যার আগে টয়লেট ব্যবহার করতে পারবে না! এই রকম কথা বললে কত ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে ভাবা যায়? আমার চোখে তখন লিঙ্গবৈষম্য নাটকের মূল অঙ্ক দৃশ্যমান হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আমি পুরুষদের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারি। তাই শিবিরের মেয়েদের দুরবস্থার প্রসঙ্গটা কীভাবে জুতসই ভঙ্গিতে তোলা যায়, এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার চোখ আটকে গেল এক দিকে। শিবিরের এক কোনায় খোলা জায়গায় কেটলিতে গরম পানি ফুটছিল। ছোট একটা মেয়ে কেটলিতে লাঠি দিয়ে টুংটাং শব্দ করছিল। মেয়েটা হাঁটু গেড়ে বসে ছিল। ধুলায় মলিন ওর পা দুটো। উজ্জ্বল বাদামি রঙের চাপা মুখ। বাদামি চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। অবহেলিত কোঁকড়া চুলগুলো জট পেকে আছে। কেটলির আগুনের ধোঁয়ায় মেয়েটির গায়ে কালি জমে গেছে।
মেয়েটির মলিন দশাই এই শিবিরে তারা কতটা ভালো আছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। তবে মেয়েটির করুণ দশা দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসেনি। এটা তো আমার ডেইজিও হতে পারত। দেখতে ঠিক এই মেয়ের মতোই। লক্ষ করলাম, আমার চোখের কোণে জল জমে গেছে এবং গলা ধরে আসছে।
আমার মেয়েটা হয়তো এখন পরিষ্কার ভাঁজ করা ড্রেস পরে স্কুলে তার সহপাঠীদের সঙ্গে বসে আছে। ওর স্কুলটা লেক ডিস্ট্রিক্টের এক পাশে পাহাড়ের ওপর। সামনে থেকে তাকালে বিয়েট্রিক্স পটার প্রদেশের উইভারমায়ার লেক দেখা যায়। প্রতি রাতেই ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলা শেষে গরম পানি দিয়ে গোসল করে। তারপর হয়তো বালিশযুদ্ধ শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে নাশতা করে। ডেইজি আধা ফিলিস্তিনি। অন্য ফিলিস্তিনি বাচ্চাদের চেয়ে ওর কপাল হাজার গুণ ভালো।
অথচ এই ছোট আফগান মেয়েটা একটা মলিন ছেড়া জামা পরে বসে আছে। ওর শৈশব আনন্দে কাটছে বলে মনে হয় না। ওর কোনো শিক্ষা নেই, খেলনা নেই, নিশ্চিত কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই মুহূর্তে গরম পানির কেটলি, যেখান থেকে পানি উপচে পড়ে, যেকোনো মুহূর্তে ওর বাদামি পা ঝলসে দিতে পারে। মেয়েটা পরের বেলায় কী খাবে, তা-ই জানে না। নরকযন্ত্রণার উদ্বাস্তু শিবিরে ও বিপজ্জনক ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।
জীবন বড়ই পক্ষপাতী। এই মেয়েটার কী অপরাধ, যার জন্য ওকে এই নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে যে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাটি নড়ে উঠবে। এই ভয়ানক নিষ্ঠুর দৃশ্য আমাকে অনেক দিন ভোগাবে।
আমি এত দিন যাবৎ অনেক পেশাদার আচরণ করে আসছিলাম। হঠাৎ এই দৃশ্যের অবতারণা মনে করিয়ে দিল আমিও একজন মা। এখনো আমার গলা আটকে যায়, যখন ওই করুণ সুন্দর মেয়েটার কথা মনে পড়ে।
উদ্বাস্তু শিবিরে সবার সঙ্গেই আমরা গাফফারের মাধ্যমে কথা বলছিলাম। সবাই আফগানিস্তানের ভাষা পশতুতে কথা বলছিল। গাফফার সেটা উর্দুতে ভাষান্তরিত করছিল। আর পাশা সেটা শুনে আমাকে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। তিন ভাষার বাধা পেরিয়ে আমি ওদের অভিব্যক্তি বুঝতে পারছিলাম। আমরা ছিলাম দুর্দান্ত একটা অনুসন্ধানী দল। আফগানি ও পাকিস্তানি লোক সঙ্গে থাকায় আমরা একটা সুন্দর আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের দল গঠন করতে সক্ষম হই।
ওই দিনও সকালে আমরা জানতে পারি, বিবিসির একজন কর্মীকে এক উদ্বাস্তু শিবিরে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল ওদের দেশে বিমান হামলার জবাবে। আর দুজন পশ্চিমা সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, উদ্বাস্তুরা নিজেদের চিড়িয়াখানার প্রাণীর মতো দর্শনীয় বস্তু মনে করতে শুরু করে। গণমাধ্যমের অনুপ্রবেশ নিয়ে ওদের অভিযোগের শেষ ছিল না। সত্যিই আমি ওদের খুব একটা দোষ দিতে পারি না।
আমি লক্ষ করলাম, সাহায্যকারী সংস্থার কেউ উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে নেই এবং তাদের কার্যালয়গুলো খালি পড়ে আছে। পরে জানতে পারলাম, সব সাহায্যকারী সংস্থাকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বলা হয়েছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আফগান মাটিতে আমেরিকা ও ব্রিটিশদের বোমা আঘাত হানতে শুরু করলে উদ্বাস্তুরা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছিল, শিবিরগুলোতে লুকিয়ে লুকিয়ে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ জমা করা হয়েছে পুনরায় যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে।
আফগান জনগণ জন্ম থেকেই যোদ্ধা প্রকৃতির। টিনএজ পার হতে না হতেই তাদের ঘাড়ে সেমি অটোমেটিক অথবা কালাশনিকভ রাইফেল ঝুলতে থাকে। যুদ্ধবিগ্রহ তাদের সময় কাটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা নিজেদের মধ্যেই অথবা তাদের মাটিতে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। পরে জানতে পারি, আফগান নারীরা আরও অধিক কঠোর মানসিকতার অধিকারী।
পাকিস্তানে লাখ লাখ আফগান উদ্বাস্তু বাস করে। পেশোয়ারকে একরকম আফগানিস্তানের অংশ হিসেবেই ধরা হয়। এই অঞ্চলে আমেরিকান ব্রিটিশ হামলার পক্ষে কথা বলতে যাওয়া মানে উনুনে ঘি ছড়ানো।
আফগানিরা খুব ঘাড়ত্যাড়া ধরনের এবং কারও অধীনে থাকতে রাজি নয়, এটা সর্বজনগৃহীত সত্য। এদের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মিল রয়েছে। সেখানে কেউই সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলে না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না।
এক্সপ্রেস-এর বিদেশ প্রতিনিধি আমাকে ফোন করে ছাপানোর জন্য একটা আবেগময় বর্ণিল শিরোনাম বানিয়ে দিতে অনুরোধ করে। আমি নিজেও এমন এক শিরোনামের সন্ধানে ছিলাম। তবে বাস্তবতা হলো, ছাপাখানায় পৌছানোর আগেই কেউ একজন এই শিরোনাম বদলে একটা নিরস কঠিন শিরোনাম জুড়ে দেবে, আমাদের জন্য যা দারুণ হতাশার।
পরদিন পাশাকে নিয়ে ভিসাপ্রাপ্তির খবর জানতে আফগান দূতাবাসে গেলাম। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে হলে একটা চত্বর পেরোতে হয়। সেখানে বেশ কিছু মানুষ চুপচাপ বসে ছিল। তাদের কেমন জানি ভাবলেশহীন দেখাচ্ছিল। আমি মাথায় একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিয়েছি এবং মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েই বের হয়েছি। আমি সেই আরামদায়ক চামড়ার জুতাটাই পায়ে গলিয়েছি। জুতার ফাঁক দিয়ে আমার উজ্বল পালিশ করা নখ দেখা যাচ্ছিল।
আমি ওদের সংস্কৃতির প্রতি যতই শ্রদ্ধাশীল ভাব দেখাই না কেন, তাতে করে ভিসা অফিসের কর্মকর্তার মন একটুও গলল না। তিনি অন্য দশজনের আবেদনপত্রের সঙ্গে আমার আবেদনপত্রটাও ছুড়ে মারলেন। তার কথার এক বিন্দুও আমি ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। তবে এইটা বুঝলাম, পরদিন সকাল নয়টার মধ্যে আমি ভিসা পেয়ে যাব।
পাশা জানাল, ভিসা পেয়ে গেলে সেও আমার সঙ্গে আফগানিস্তান যাবে। তার ভাষ্য হলো, আমাকে সে একা সেখানে যেতে দিতে পারে না। আমাকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই কারও দরকার আছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে একটা গ্রামে যাওয়ার। এই গ্রামটা নানা অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির জন্য কুখ্যাত। ছোট ঘোট কারখানায় নানা রকম মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি হয়। আট বছরের বাচ্চারাও নাকি অস্ত্র বানাতে জানে। নিজ চোখে দেখার জন্য আমার আর তর সইছিল না।
আমরা আদম খলিলের ডেরায় পৌছে গেলাম। এটা এক ঘোড়ার ছোট শহর, যেন কোন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের দৃশ্যপট।
পাশা ও আমি মূল সড়ক ছেড়ে একটা ছোট গলি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ছোট ছোট খোলা অনেকগুলো গ্যারেজ। ভেতরে ৮০ বছরের পুরোনো লেদ মেশিনে ঘটঘটর শব্দে তৈরি হচ্ছে নানা রকম অস্ত্র। ছেলে-বুড়ো সবাই কাজ করছে। পাশা ওদের কাছে আমার আগমনের উদ্দেশ্য খুলে বলতেই সবাই ফিক করে হেসে দিল। কারখানার মালিকমতো এক লোক এসে আমাকে স্বাগত জানিয়ে ভেতরে বসতে বলল। পাশার মাধ্যমে কথা বলতে শুরু করলাম।
এসব অস্ত্রের কারিগরেরা যেকোনো চাহিদা মোতাবেক অস্ত্র বানাতে পারবে। অবাক হয়ে দেখলাম, তারা চায়নিজ পিস্তলের হুবহু কপি তৈরি করছে। এমনকি বিখ্যাত অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি নরিনকোর লোগো ব্যবহার করে তারা। কত উদ্ধত ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। আমাকেও ৬০ ডলারের বিনিময়ে একটা অস্ত্র কিনতে বলা হলো। আমি অস্বীকার করায় কারখানার মালিক একটু হতাশই হলেন। কালোবাজারের কল্যাণে মার্কিন ডলার পাকিস্তানের দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক মুদ্রা।
এক ফাঁকে পিস্তল না কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পাশা আমাকে সাধুবাদ জানাল। ও জানাল, এগুলো মোটেই মানসম্মত নয়। ৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়ার পরই অচল হয়ে যাবে। কেনই-বা আমি পিস্তল কিনতে যাব আর কেনই-বা আমি এক রাউন্ড গুলি ছুড়তে যাব, তা আমার ধারণাতেও এলো না। পাশা কী ভেবেছে কে জানে! কল্পনায় দেখলাম, হিথর
ো বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের একজন শুকনামুখের কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, কোনো বিশেষ পণ্য আছে কি না? আমি বললাম, হ্যা। একটা পিস্তল। কোনো সমস্যা অফিসার?
কৌতুকটা সহজভাবে গ্রহণ করুন। কখন যে কোন ঘটনায় কী মনে পড়ে যায়!
খানিক বাদেই আমি চলে গেলাম বৈরুত বিমানবন্দরে। সেদিন ছিল ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আমি লেবাননে অবস্থান করছিলাম। খুব চমৎকার জায়গা। সব সময়ের মতোই ফিরে যেতে দেরি করে ফেলি। আমি হাতব্যাগ ও একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বিমানবন্দরে ঢুকে পড়ি। আমি অধৈর্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামনের যাত্রীরা নিরাপত্তা ফটক দিয়ে তাদের ব্যাগ এক্স-রে মেশিনে পরীক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমার পালা এলে আমিও আমার ব্যাগ এক্স-রে মেশিনে চেক করে বের করে আনি।
যখন আমি নিরাপত্তা ফটক পেরিয়ে অপর পাশে চলে আসি, তখনই একজন লেবানিজ কর্মকর্তা ছুটে আসেন। তাঁর হাতে আমার হাতব্যাগ ধরে রাখা। তিনি ব্যাগখানা আমার কি না জানতে চাইলেন। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ব্যাগটা নিতে হাত বাড়ালাম। কর্মকর্তা আমাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি ব্যাগটা চিনতে পেরেছি কি না? ততক্ষণে উনি আমার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা পিস্তল বের করে আনলেন। পিস্তলটা তিনি বিপজ্জনকভাবে হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমার চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে যায়। আমি দৃঢ়কণ্ঠে অস্বীকার করে এই পিস্তলটা জীবনে চোখেও দেখিনি বলে জানাই। কেউ নিশ্চয় আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তখনই আমার মনে হলো, ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা একই কথা আরও অনেকবার শুনেছে হয়তো। পরিণতি মনে করে শিউরে উঠলাম। আমি বৈরুতের জেলে বাকি জীবন কাটাতে যাচ্ছি কারও ষড়যন্ত্রের জালে বন্দী হয়ে।
বন্ধুরা কী ভাববে আমায়? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, মা কী মনে করবে? তারা নিশ্চয়ই ভাববে, আমি সাংবাদিকতার খুঁটির জোর দেখাতে গিয়ে উল্টো ধরা খেয়ে গেছি।
এমন সময় এক নারীর চিৎকারে সংবিৎ ফিরে পাই। শব্দের উৎসের দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, এক নারী আমার দিকে আঙুল তুলে তারস্বরে চিৎকার করছেন। তাঁর সঙ্গের ছছাট বাচ্চাটাও জানি কেমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। নিরাপত্তা প্রহরী তাঁর দিকে কিছু একটা ছুড়ে মারল।
তিনি আমাকে ব্যাগটা ফেরত দিয়ে অগ্রাহ্যমূলক দৃষ্টিতে তাকালেন। নিজেকে এতটাই ভারমুক্ত মনে হলো যে আমি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ না দেখেই এক দৌড়ে সেখান থেকে সরে এলাম। এবং সৌভাগ্যবশত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানে উঠে গেলাম।
বিমানে ওঠার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি আমার পেছনেই ছিলেন এবং পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি জানালেন, বাচ্চা ছেলেটা মজা করার ছলে আমার ব্যাগে লুকিয়ে তার মায়ের পিস্তলটা রেখে দেয়। কর্মকর্তার হাতে সেটা দেখতে পেয়ে আমি ওটা চুরি করেছি ভেবে তিনি চিৎকার করেন। চিন্তা করে কোনো কূলকিনারা পেলাম না। ওই নারী পিস্তল নিয়ে বিমানবন্দরে কী করছিলেন? তবে সেদিন একটা চরম শিক্ষা পেলাম। কোনো অবস্থাতেই খোলা পোটলা অথবা হাতব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে নেই।
পাশা আমাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিল। দ্রুতই আমি বৈরুত থেকে পাকিস্তানি বন্দুকের দোকানে ফিরে এলাম। হেঁটে বেড়ানোর সময় জানতে পারি, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের জাহাজভাঙার লোহালক্কড় থেকে এসব কারখানার ধাতব কাঁচামালের জোগান আসে। এখানে আসার পর ধাতু গলিয়ে ছাঁচে ফেলে বন্দুক বা অস্ত্রের গড়ন দেওয়া হয়। এরপর ছেলে বুড়োরা মিলে হাতে খেটে খুটে ও লেদ মেশিনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অস্ত্র তৈরির কাজ শেষ করে।
কয়েকটি ছবি তোলার অনুমতি চাইলে কারখানার মালিক ছোট বাচ্চাদের সরিয়ে দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে বুক ফুলিয়ে ছবি তোলার পোজ দিলেন। যখনই আমি ছবির ফ্রেমে বাচ্চাদের আনতে চাইলাম, তখনই মালিকের চেহারা বদলে গেল। পাশা তখনই সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিল।
পাশা বলল, কারখানার লোকজন আমাকে খ্রিষ্টান মিশনারি সাহায্য সংস্থার লোক ভেবেছে। তারা সাধারণত স্থানীয় শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কী অদ্ভুত! আমি ভাবতাম, একজন সাংবাদিককে দেখে একজন সাহায্যকর্মীর চেয়েও সহজে চেনা যায়। চলে যাওয়ার প্রাক্কালে একজন লোক আমার হাতে ধরে রাস্তার অপর পাশে তার কারখানা পরিদর্শন করতে অনুরোধ জানাল।
আমরা তার কারখানাতেও গেলাম। প্রবেশপথ থেকে একটা ভারী মোটা ছাগলকে সরিয়ে দিল, যাতে আমরা কারখানায় ঢুকতে পারি। সেখানে থরে থরে সেমি অটোমেটিক অস্ত্র সাজাননা। কালশনিকভ ও অন্যান্য অস্ত্রও ছিল । সব অস্ত্রই নকল, তবে মানুষ মারার জন্য দারুণ উপযোগী। লোকটা আমাকে খুবই হালকা ধরনের একটা অস্ত্র দেখাল। এটা ছিল দেখতে ঠিক সিগারেটের লাইটারের মতো। তবে এর একটা বুলেট ছোড়াই যথেষ্ট।
পাশার সহায়তায় সে জানাল, এটা শুধুই একটা খেলনা অস্ত্র এবং খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কারও দিকে তাক না করলে এটার কাউকেই হত্যা করার ক্ষমতা নেই। আমরা কথা বলছিলাম, এমন সময় বাতাসে সেমি অটোমেটিক অস্ত্রের ফায়ার করার শব্দ ভেসে এল। আমি শঙ্কিত হয়ে শব্দের উৎসের দিকে কান পাতলাম। পাশা অট্টহাসি দিল এবং কারখানার মালিক এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি সদ্যই মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে এসেছি।
তারা দুজন কথা বলছিল এবং আবার হাসতে লাগল। এরই মধ্যে আবার গুলির শব্দ ভেসে এল। আমি জানতে চাইলাম, কী হচ্ছে সেখানে? যা। বুঝলাম তা হলো, এটা এখানকার খুবই স্বাভাবিক গোত্রীয় সংঘাত। এই জেলায় বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা পরস্পরের মধ্যে গোলাগুলি করছে, যা নিত্যদিনের কাহিনি। এক কথায় এটা হলো ডাকাতের দেশ।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই এসব সংঘাত চলে আসছে এবং সামান্য ঘটনা নিয়েই এসব শুরু হয়। এখানে একটা কথা প্রচলিত আছে, তোমার হাত যদি তোমার আত্মীয় হয়, তাহলে তা কাটা পড়বেই। পাশা বিজ্ঞের মতোই গড়গড় করে আমাকে এত তথ্য দিয়ে গেল। আমি ওর কথা শুনে মাথা নাড়লেও অনেক কিছুই তখনো সয়ে উঠতে পারিনি।
বাইরের পারিবারিক গোলাগুলি থেমে এলে আমরাও বাইরে বেরিয়ে আসি। চোখে কতগুলো রুপালি কাগজ চোখে পড়ল। রোদ পড়ে কেমন চকচক করছে। পাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ও আমাকে দ্রুত দরজার বাইরে নিয়ে এল। চকচকে কাগজগুলোয় হেরোইন সাজিয়ে রাখা ছিল এবং যে কেউ চাইলেই তা কিনতে পারত। পাশা আমাকে একদম জোর করেই ঠেলে গাড়িতে উঠিয়ে চলতে শুরু করল। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। চলতে চলতে পাশা বলল, মাঝেমধ্যে আমি নিজের অজান্তেই বিপজ্জনক বিষয়ে নাক গলিয়ে ফেললে ওর দায়িত্ব হচ্ছে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা।
আমি ওকে জানালাম, স্বয়ং খোদা আমার সঙ্গে আছেন। আমার মতো বিচ্ছুকে নিজের মতো চলতে দেওয়াই ভালো। কথা শুনে পাশা হেসে দিল। তবে আমি হেরোইন নিয়ে গল্প লিখতে চাইলে ও কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। এই কথায় আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই। কারণ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল ঘেঁষে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হেরোইন উৎপন্ন হয়।
যদিও তালেবানরা এটা জোর গলায় অস্বীকার করে আসছে, তবু তাদের অস্ত্রভান্ডার সজ্জিত হয় হেরোইন বিক্রির বিশাল টাকা দিয়ে। এসব ড্রাগ বিদেশে পাচার হয় এবং নষ্ট পশ্চিমাদের হাতে পৌছায়। সম্ভবত, নেতারা এ কথা ভেবেই হেরোইন ব্যবসাকে বৈধ করার চেষ্টা করেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, হেরোইনের জগৎকে ঘিরেই পরবর্তী প্রতিবেদন তৈরি করব।
ওই দিন রাতে ক্রাউন প্লাজায় ফিরে জিমকে আমার প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিলাম। তোলা ছবিগুলোর ফিল্ম থেকে স্থানীয় এক দোকানে ছবি বের করে আনলাম। কিছু চমৎকার ছবি ওঠায় ইন্টারনেটযুক্ত এক জায়গায় ছবিগুলো স্ক্যান করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিলাম।
আদর্শ পৃথিবীতে হয়তো আমাদের সঙ্গে ডিজিটাল ক্যামেরা থাকত এবং ছবিগুলো সরাসরিই পাঠিয়ে দেওয়া যেত। তবে এটা কোনো আদর্শ স্থান নয়। রয়ে সয়ে কাজ করতে হয়। তা ছাড়া লন্ডনে থাকা আমার চিত্রগ্রাহক বন্ধুরা আমার ওপর রুষ্ট হতে পারে। কিন্তু আমার একা কাজ করতেই ভালো লাগে। কারোর দায়িত্ব নিয়ে কথা শোেনা আমার পছন্দ নয়।
অনেক চমত্তার প্রতিবেদক ও দক্ষ চিত্রগ্রাহকেরাও কোনো ছাপানো গল্প বা প্রতিবেদনের ভুলত্রুটি নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করার ঘটনা আমাদের ওখানে হরহামেশাই ঘটে। বিশেষ করে, টনি বার্থোলমোর কথা মনে পড়লেই এখনো বিরক্ত লাগে। ১৯৯০ সালে নর্দার্ন ইকোতে কাজ করার সময় ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আবাসিক পদাতিক বাহিনী গ্রিন হাওয়ার্ডসের সঙ্গে কাজ করছিলাম। টনিকে আমার চিত্রগ্রাহক বলে পরিচয় করিয়ে দিই।
অথচ টনি আমার চিত্রগ্রাহক নয় বলে ঘেঁক করে উঠল। ভাবলাম, ও হয়তো একটু খ্যাপাটে স্বভাবের। কিন্তু কদিন পরে ও আমাকেই তার ছবির ক্যাপশন লেখক বলে সবার কাছে বলে বেড়াতে লাগল। ব্যাপারটা আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। কূপমণ্ডুক টনি।
আরেকবার ১৯৯১ সালে টাইন্সাইড দাঙ্গার সংবাদ নিতে গিয়েছিলাম। তখন আমি সানডে সান-এ কাজ করি। স্কটসউডের এক রাস্তার একদিকে দাঙ্গাপুলিশ বর্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অপরদিকে কয়েক হাজার লোক বিপজ্জনকভাবে স্লোগান দিচ্ছিল।
দুই পক্ষই অবিশ্বাসের সঙ্গে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। আমি তখন অফিসের গাড়িতে বসে পুরো ঘটনা অবলোকন করছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল একজন নতুন চিত্রগ্রাহক, যে এর আগে ফ্যাশনের দুনিয়া ও বন্য প্রকৃতিতে ছবি তুলে বেড়াত। খবরের জগতে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। আমার বস ক্রিস কেউ একজন পেট্রল বোমা ছুড়ে মারছে এমন একটি দৃশ্য খুব কাছ থেকে তুলতে নির্দেশ দিয়েছেন। ক্রিস যা চায় তা না পেলে খুব মেজাজ দেখায়।
নতুন চিত্রগ্রাহক আমাদের চাহিদা বুঝতে পেরেছে বলে জানায়। তাই ওকে সঙ্গে করে বিক্ষোভরত জনগণের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওকে অভয় দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বললাম। আমার লক্ষ্য ছিল ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা এবং ধীরস্থিরভাবে হেঁটে যাওয়া। সবশেষে মওকা মতো একটা ছবি তুলে জনগণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সটকে পড়তে চেয়েছিলাম।
এত কিছুর পরও ওর ভয় কাটেনি। আমি ওকে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিতে বারণ করলাম। এর ফলে ও বিক্ষোভরত জনতার লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। সবকিছু এতক্ষণ শান্ত থাকলেও হঠাৎ চারদিকে বৃষ্টির মতো ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল।
আমি ঘুরে ওকে দৌড় দিতে না করব, এমন সময় দেখি ও নেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ির দিকে ছুটছে এবং কয়েকজন ওকে ধাওয়া করেছে। আমি জনতার দিকে একনজর তাকিয়ে ওখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি হালকাভাবে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই একটা ভাঙা ইটের টুকরা বনেটে বাড়ি খেয়ে আমার মুখে আঘাত করল। এরপর গাড়িতে আমাদের কী মধুর আলাপ হয়েছিল, তা আপনারা ভেবে নিন।
ছবি ভোলা একটা বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক বিষয়। বছরের পর বছর যারা ভালো ছবি তোলার কলাকৌশল রপ্ত করেছেন, তাদের চেয়ে আমি ভালো ছবি তুলতে সক্ষম হব-তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি না। তবে আমার প্রতিবেদন লেখার জন্য ডেভিড বেইলির মতো দক্ষতার প্রয়োজন পড়বে না।
আমার পক্ষে অবশ্যই ফ্যাশন জগতের মডেলদের ছবি তোলা, দাঙ্গা বিক্ষোভের মোক্ষম সময়টাকে ধরে রাখা কিংবা কোনো খেলার মাঠ থেকে অসাধারণ কিছুর ছবি তোলা সম্ভব নয়। চিত্রগ্রাহকেরা বন্দিবহনকারীদের গাড়ি থেকে ভেতরের বন্দীর ছবি তোলার জন্য যে পরিশ্রম করেন, তা আমার সাধ্যের বাইরে।
যা-ই হোক, আফগান মাটিতে ছবি তুলে যেহেতু চিত্রগ্রাহকদের খ্যাতি নষ্ট করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি, সুতরাং থামার প্রশ্ন আসে না।
অবৈধ অস্ত্র কারখানার প্রতিবেদন পেয়ে আমার বস জিম মুরে দারুণ খুশি হয়। পরদিন আমাকে পেশোয়ারে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। জঙ্গিদের বিক্ষোভ ও হম্বিতম্বি প্রদর্শনের ঘটনাগুলো পেশোয়ারেই বেশি ঘটছিল। আমি ক্রাউন প্লাজায় আমার কক্ষটা ছেড়ে দিতে চাইছিলাম না। গণমাধ্যমকর্মীদের দৌরাত্মে হোটেল ফাকা পাওয়া মুরগির দাঁতের মতোই দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে তত দিনে।
পেশোয়রের পথে রাওয়ালপিন্ডির সন্নিকটে একটা বড়সড় সরকারি বাড়ির সামনে থামলাম। এটা পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক হামিদ গুলের বাসভবন। পাশার পরিচিত কারও ভাইয়ের বয় ছিল জেনারেল শুলের খালার শ্বশুরবাড়ির ভাতিজি। আমি নিজেও সম্পর্কটা বুঝে উঠতে পারিনি এবং বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে গুল নিজেই বেরিয়ে এসে আমাকে বসতে আমন্ত্রণ জানালেন।
তিনি তালেবানদের ব্যাপারে ব্যাপক উচ্ছাস দেখালেন। ক’দিন আগেই আফগানিস্তানে তালেবানদের সামরিক মহড়া প্রদর্শনে তিনি অতিথি হয়ে গেছেন বলে জানান। শক্তির জানান দিতে তিন ঘন্টা ধরে তালেবানরা মহড়াতে প্যারেড করেছে বলে তিনি জানান।
হামিদ তালেবানদের শক্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে ওদের ট্যাঙ্ক, মিসাইল ও অস্ত্রসজ্জার কথা বলে গেলেন। আমেরিকান ও ব্রিটিশ সৈন্যরা আফগানিস্তান আক্রমণ করবে বলে আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় তরুণ তালেবান সৈন্যরা হাতের তা ঘষে আগুন জ্বালাচ্ছে। তার মতে, আফগানরা অসাধারণ যোদ্ধা। গত শতাব্দীতে তারা দুবার ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ানদের ১০ বছর ধরে ভুগিয়েছে।
মনে হচ্ছিল, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫-এর মহাপরিচালক স্টেলা রিমিংটনের সামনে বসেই কথা বলছি। তবে গুলের চেয়ে তিনি অনেক নরম সুরে কথা বলেন।
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তান ইন্টালিজেন্স আইএসআইয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর। ব্যাপারটা তারা বারবার অস্বীকার করে এলেও তালেবানরা আইএসআইয়ের কাছ থেকে সব রকম সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। বের হয়ে আসার আগে আমি আফগান দূতাবাসে যে বাধার সম্মুখীন হয়েছি, সে ব্যাপারে গুলকে অবহিত করলাম। তিনি কিছু একটা করবেন বলে আমাকে ওয়াদা করলেন। প্রয়োজনে তিনি তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন এবং আমার হয়ে উকালতি করবেন বলে জানান। আগুনের গোলা অথবা বানের জল ভেসে আসুক, আমি সীমান্ত অতিক্রম করবই।
পেশোয়ারে এসে কোনো হোটেলেই ফাঁকা পেলাম না। শুধু তাই নয়, হোটেল ভাড়া ও খাওয়ার খরচ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, নিউ ইয়র্কে পর্যটকদের আনাগোনা শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও পাকিস্তান পৰ্যকদের ভিড়ে রমরমা।
পেশোয়ারের ভালো হোটেলগুলোর মধ্যে পার্ল কন্টিনেন্টাল অন্যতম। একজনের সহায়তায় এখানেই একটা কক্ষে উঠতে সক্ষম হলাম। হোটেলের সঙ্গেই একটা ছোট গলি রয়েছে। একদিকে একটা বইয়ের দোকানও দেখতে পেলাম। রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই শহরটাকে এক খণ্ড আফগানিস্তান বলে প্রতীয়মান হয়। তাই আমি আরও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বইয়ের দোকানে রাশভারী ধরনের লম্বা এক লোক এসে খপ করে একটা বই ছিনিয়ে নিল। এই বইটা আমিও নিতে চেয়েছিলাম। লোকটা প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা হবে। চলে যাওয়ার পর দেখি, লোকটা বইটার শেষ কপিটাই নিয়ে গেছে। উনি ছিলেন বিবিসির বিখ্যাত কর্মী জন সিম্পসন, আফগান যুদ্ধে যাঁর লেখনী পৃথিবীজুড়ে লাখ লাখ লোকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। জন আমার কাছ থেকে সুযোগ ছিনিয়ে নেওয়ার এটাই শেষ নয়।
আমি যতই আত্মশ্লাঘায় ভুগি না কেন, যুগ্ম চিত্র সম্পাদক শন রাসেল আমার ছবির মানে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আমি নিজেকে যথেষ্ট স্বাবলম্বী মনে করলেও স্ক্যান করা ছবিগুলো একদম বাজে বলে শন জানায়। এর মধ্যেই আবার গাফফারের সঙ্গে দেখা হলে ও খুশিমনেই ছবিগুলো নতুন করে লন্ডন পাঠানোর দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
সেই রাতে একটু আয়েশ করতে পার্লের পঞ্চম তলার বারে চলে যাই। ওখানে আগে থেকেই পুরোনো বন্ধু ইভান গ্যালাঘার ও মেইল অন সানডের একজন চিত্রগ্রাহক অবস্থান করছিল। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ইভানকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। আমি ইভানকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলি। গত কয়েক সপ্তাহে এই প্রথম কোনো দেশি মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। এর মাঝেই কয়েকজন শোরগোল করতে করতে এগিয়ে এল। এরা চেক টেলিভিশনের কর্মী, যাদের সঙ্গে লাহোর বিমানবন্দরে নেমেই কথা হয়েছিল।
আফগানিস্তানে ঢুকতে পেরেছে কি না জানতে চাইলে তাদের একজন হাত নেড়ে চোখ উল্টিয়ে না-বোধক জবাব দিল। তবে তারা এখনো চেষ্টা করছে বলে জানায়। আমি ওদের থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে ইভানের কাছে চলে এলাম এবং আমাকে সেদিন রাতে খাওয়ানোর জন্য বললাম।
অল্প একটু মদ খেতে চাইলেও এখানে পুরো বোতল কিনতে হবে। কী অদ্ভুত নিয়ম, জেরিতে এই নিয়ম চালু থাকলে লাভে রমরমা ব্যবসা চলত। যা-ই হোক, আমি এক বোতল বিয়ারেই সন্তুষ্ট রইলাম।
এর মধ্যেই সান-এর আরও কয়েকজন প্রতিবেদক জমায়েত হয়েছেন। সবাই মিলে একসঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে লাল পানীয় গোগ্রাসে গিললাম। আলাপ জমে উঠল আজ পাকিস্তানের চালচিত্র নিয়ে। সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান হলেও আনন্দমুখর পরিবেশটা হালকাই লাগল। তবে এত খোলাখুলি আলাপের পরও আমি সাংবাদিকতার গোপনীয়তার নিয়ম মেনে অস্ত্র কারখানায় ভ্রমণের ব্যাপারে টু শব্দও উচ্চারণ করিনি।
২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পেশোয়ারে বড়সড় এক উত্তেজক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পাশার সঙ্গে মিছিল দেখতে গেলাম। আমি এর আগেও অনেক বড়সড় জমায়েতের প্রতিবেদন করেছি, তবে এই মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ছিল খুবই উত্তেজিত। বাতাসে কেমন যেন অশনিসংকেত উড়ে বেড়াচ্ছে। শুক্রবার সাধারণত মুসলমানরা ভাবগাম্ভীর্যতাপূর্ণ ছুটির দিন হিসেবে পালন করে। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতার ডাকে অনেক মানুষ এই মিছিলে অংশ নেয়।
উত্তেজিত জনতা কুদ্ধ স্বরে চিল্কার করে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ও পাশা পুলিশের সঙ্গে দাড়িয়ে ছিলাম। একদম সমস্ত শরীর আবৃত করে বেরিয়েছিলাম। আমার পোশাক কারও চোখে দৃষ্টিকটু মনে না হলেও যথেষ্ট ভয় লাগছিল। কানে কানে পাশা বলল, আমাদের চলে যাওয়া উচিত। গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে পাশার বিচারবুদ্ধিকে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
রুমে ফিরেই আমি জিমের সঙ্গে আজকের বিষয়ে আলাপ করলাম। আজকের অবস্থা দেখে আর কোনো মিছিলের সংবাদ সংগ্রহ করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে ওকে জানাই। আমার উপস্থিতি সেখানে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কারণ, আমি একজন নারী আর এসব মিছিল উন্ন পুরুষবাদিতার প্রদর্শনী। মার খাওয়ার জন্য এটা মোটেই যথোপযুক্ত সংবাদ নয়। জিম কোনো প্রশ্ন না করেই শ্রদ্ধা রেখে আমার কথায় রাজি হলো।
এমন সময় হোটেলের একজন ব্যবস্থাপক আমাকে রুম খালি করে দিতে নির্দেশ দেন। অন্য কেউ একজন আমার আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছে। রুম ছেড়ে দিলেও আমি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রেই অবস্থান করছিলাম। নতুন কোনো থাকার জায়গা না পেলেও ওই দিনের কর্মসূচি তৈরি করতে হচ্ছিল। পাশা আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে বলে একদম চিন্তা করতে না করে। লোকটা ধীরে ধীরে আমার প্রবাস-সাংবাদিকতার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ছোটখাটো বিষয়গুলো নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে ভারমুক্ত থাকতে সাহায্য করছে।
ইতিমধ্যেই এক অসাধারণ আইরিশ প্রতিবেদক মিরিয়ামের সঙ্গে পরিচয় হলো। ও নাকি কদিন আগেই খাইবার পাস ঘুরে এসেছে। ও ছিল ডাবলিনভিত্তিক আইরিশ টাইমস-এর এশিয়া প্রতিনিধি। বেইজিংয়ের অফিস থেকে সে পেশোয়ারে বর্তমান সংকট, যা যেকোনো সময়ে সংঘাত বা যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, এর সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছে।
আমার খাইবার পাস যাওয়ার অভিপ্রায় জানতে পেরে ওদিকে সব গণমাধ্যমকর্মীর যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে মিরিয়াম জানায়। তবে ও আমাকে সেখানকার কিছু সংবাদ ও ছবি উপহার দিতে চাইলে জবাবে আমার মেইল ঠিকানা দিয়ে আসি। যত কিছুই হোক, অন্য সব সাংবাদিকের মতোই আমিও খাইবার পাস নিজ চোখে দেখার ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষে রাখি।
এমন সময় অফিসের ফোন বেজে উঠলে মিরিয়াম ফোন ধরে কাগজে দ্রুত কী সব লিখতে থাকে। কলম্বিয়ার বোগোটার এক রেডিও স্টেশন থেকে ফোনটা এসেছে। আমি কথা বলব কি না ও জানতে চায়। আমি ফোন কানে দিতেই ও প্রান্তের প্রতিবেদক আমার পরিচয় জানতে চায়। কেন এসেছি, ১১ তারিখের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমার মতামত, সব নিয়েই কথা হয়।
যদিও আমি নিজস্ব মতামত অন্যত্র খুব কমই প্রকাশ করি, তবু মাঝেমধ্যে আন্তরিক সহকর্মীদের সাহায্য করতে মন্দ লাগে না। রেডিওর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথায় আমি মোড়লিপনা করে প্রেসিডেন্ট বুশের ব্যাপারে মন্তব্য করতে শুরু করি। উসামা বিন লাদেনকে ধরতে হবে, জীবিত অথবা মৃত-এ ধরনের বাগাড়ম্বর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিকে মানায় না। ছোট শহরের শেরিফরাই কেবল এভাবে কথা বলতে পারে।
আমি বললাম, আমেরিকা কি রাতারাতি তাদের সংবিধানের অমিয় বাণী- সবাই নির্দোষ হিসেবে গণ্য হবে যতক্ষণ না তারা দোষী সাব্যস্ত হয়’ ভুলে গেল? প্রেসিডেন্ট বুশ কিন্তু বিন লাদেনের অনুপস্থিতিতে কোনো বিচারকাজও পরিচালনা করেননি।
মূলত আমি আমেরিকাকে শাপশাপান্ত করে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি। ভদ্রলোক শাখের করাতে আটকা পড়েছেন। আট কোটি মধ্যমপন্থী মুসলমানের দেশ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তিনি। যে দেশের অধিকাংশ লোক আফগানিস্তানে যেকোনো ধরনের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
পরিস্থিতি গরম উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট মোশাররফকে আমেরিকা ও ব্রিটেন সহযোগী সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করছে বলে মন্তব্য করলাম। এটি মোশাররফের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত, এমনকি এর ফলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনও শেষ হয়ে যেতে পারে।
আমি বলেই চললাম, ১১ তারিখের নারকীয় ঘটনার জন্য সবাই শোকাহত। কিন্তু এর পেছনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। মানুষ এখনো দুর্ঘটনার আকস্মিক ঘোর কাটিয়ে উঠতেই পারেনি। অনেকে এখনো শোকে মুহ্যমান। কারও কারও স্বজনদের দেহাবশেষ হয়তো আর পাওয়াই যাবে না। এই সময় যুদ্ধ অথবা ক্রুসেডের কথা বলা সমীচীন নয়। আমি পেছনে স্প্যানিশ ভাষায় কাউকে কথা বলতে শুনলাম। ব্যস্ত বার্তাকক্ষে কোনো একজন পুরুষ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
প্রতিবেদক আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বললেন। খানিক পরই তিনি জানালেন, আমার বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। হায় খোদা, আমি ভেবেছিলাম, কোনো একজন সহকর্মীর সঙ্গে গল্পচ্ছলে কথা বলছিলাম। অথচ মাত্রই দক্ষিণ আমেরিকার লাখ লাখ শ্রোতা আমার বক্তব্য শুনে ফেলেছেন।
মিরিয়ামকে জানাতেই ও হেসে দিল। ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে অবজারভার-এর প্রধান প্রতিবেদক জ্যাসন বুর্কের সঙ্গে দেখা হলো। বহু বছর পরে দেখা হওয়ায় আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। এখন অবজারভার-এর হয়ে নিয়মিত দৈনন্দিন নিয়ম মেনে চাকরি করলেও জ্যাসন প্রায় দুই বছর লন্ডনে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করে বেড়িয়েছে। পরে অবজারভার থেকে তাকে এশিয়ার প্রধান প্রতিবেদকের পদে নিযুক্ত করা হয়। সানডে টাইমস-এর অনুসন্ধানী দলে আমরা একই সঙ্গে কাজ করতাম। খবরের সন্ধানে এখানে-ওখানে চষে বেড়িয়েছি। ও বিদেশ চলে যাওয়ার পরও আমাদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ই-মেইলে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
অনেক দিন পর এই বিদেশ বিভূঁইয়ে সাক্ষাৎ হওয়ায় ভালোই লাগল। জ্যাসন সানডে টেলিগ্রাফ-এর ক্রিস্টিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। একটা কাজে জ্যাসন কোথাও চলে গেলে আমি আর ক্রিস্টিনা একই সঙ্গে রাতের খাবার সারি। আমার কাছে সামান্য পরিমাণ পাকিস্তানি রুপি ছিল। তাই ক্রিস্টিনা বিল দিতে চাইলে আমি অস্বীকার না করে পরের বেলায় আমিই খাওয়াব বলে কথা দিলাম। ক্রেডিট কার্ড থাকলেও সম্ভব হলে রুপিতেই বিল পরিশোধ করতাম। (এই বইটা লেখার সময়ও ক্রিস্টিনাকে এক বেলা খাওয়াতে আমি হন্যে হয়ে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।)
কয়েক সপ্তাহ পরে ক্রিস্টিনা নিজেই খবরের শিরোনাম হয়ে যায়। ও আর ওর চিত্রগ্রাহক জাস্টিনকে কোয়েটা পুলিশ সেরেনা হোটেলের রুম থেকে ধরে নিয়ে যায়। শুনেছি, ক্রিস্টিনা উসামা বিন লাদেন নামটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ একটা ফ্লাইটে বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নভেম্বরের দিকে ক্রিস্টিনাকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে এক স্থানীয় পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে দাবি করে, তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। সে শুধু কোয়েটা থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সযোগে একটা ফ্লাইট বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
আমরা সেদিন রাতে খেতে খেতে খুব আপন মানুষের মতোই মিশে গিয়েছিলাম। দুজন সাংবাদিকের মধ্যে প্রেম ও এর পরিণতি নিয়ে আমরা চুটিয়ে গল্প করেছি। বার্তা কক্ষগুলো সব সময়ই এসব রসালো গল্পের জন্য কান পেতে থাকে। যদিও আমি আগেই বলেছি, একজন সাংবাদিকের জন্য সাংবাদিক ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তবু আমি পেশাগত জীবনে এ ধরনের সম্পর্ক থেকে নিজেকে সযতনে দূরে সরিয়ে রাখতাম। কারণ, সাংবাদিকেরা অনেক অসতর্ক ও অবিবেচক হয়ে থাকে। সাংবাদিকদের যেকোনো খবর আগেভাগে প্রচার করার প্রবণতা কখনো কখনো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।
গল্পের ফাঁকে জন সিম্পসনের খবরে আমাদের মনোযোগ ছুটে গেল। এই দণ্ডায়মান পর্বত বোরকার আড়ালে এক গোপন মিশনে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছেন। এক খোলা ওয়াগনে সবার শেষে নিচু হয়ে নারীদের মতো সাজপোশাকে তিনি আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছেন।
এটা ছিল নীতিবহির্ভূত হাস্যকর সংবাদ। তিনি কাজের প্রতি চরম নিষ্ঠাবান এবং কখনোই হাল ছাড়েন না। তার পরও আমি এসবের পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। হয়তো এর পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কারণটি আমার চোখে ধরা পড়েনি। তবে বোরকা পরে জন সিম্পসনের খবর সংগ্রহের জন্য অবৈধভাবে ছদ্মবেশে আফগানিস্তানে ঢোকার সংবাদ হাস্যকর মনে হলো। আমি ও ক্রিস্টিনা দুজনই হেসে দিলাম। কিছুটা প্রশংসায় এবং কিছুটা বিষয়টি হাস্য রসাত্মক হওয়ায়।
তবে এর মাধ্যমে মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে গেল। বোরকা’ ও ‘অদৃশ্য শব্দদ্বয় মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে এবং তখন থেকেই একটা দুঃসাহসী ইচ্ছার উদ্রেক ঘটে।
সেই রাতে আমি পঞ্চম তলার বারে আবার গেলাম, যেখানে শুধু বিদেশি মেহমানদের জন্য মদ সরবরাহ করা হয়। চারদিকে সব পুরোনো মুখেরা ভিড় করে আছে। ইভান গ্যালাঘারও সেখানে ছিল, কিন্তু দ্রুতই সে বিদায় নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছিল। বিষয়টা সন্দেহজনক। ইভান নিশ্চিত অন্য কোনো ধান্দা করছে। আমার জিজ্ঞাসু মন আরও একবার উৎসুক হয়ে উঠল। কোথাও সন্দেহের গন্ধ পেলেই সেটা নিয়ে ঔৎসুক্য প্রদর্শন সাংবাদিকদের সহজাত স্বভাব।
তবে বিষয়টা খুব একটা পাত্তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বরং স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত নিউ ইয়র্কের এক চিত্রগ্রাহকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। ও মাত্রই ইসরায়েলে তার কিছু আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। সে বাড়ি যেতে চায় বলে আকুতি প্রকাশ করে। লম্বা টুইন টাওয়ার ব্যতীত নিউ ইয়র্ক কেমন অদ্ভুত ভুতুড়ে দেখাবে, এ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।
একই সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ডেইলি ও নিউজ ডের হয়ে ছবি তোলে স্প্যানিশ এই চিত্রগ্রাহক। বাইরে খুব হাসিমুখে কথা বললেও বুঝতে পারি, ওর ভেতরটা ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। বান্ধবীর সঙ্গেও তার ঝগড়া চলছে। বেচারার এই সময়ে বান্ধবীর সঙ্গে দূরে কোথাও ছুটি কাটানোর কথা। অথচ এখন তাকে পেশোয়ারের উদ্বিগ্ন শহরে ছবি তুলতে হচ্ছে। আমি তাকে সমবেদনা জানিয়ে বোঝাই কী কঠিন এক পেশায় আমরা সবাই নিয়োজিত। এ পেশার অন্দরে না ঢুকলে এর সত্যিকার পরিস্থিতি কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
কথা শুনে ওর বান্ধবীও ওর মতোই চিত্রগ্রাহক বলে ও হাসাহাসিতে ফেটে পড়ল। এই ফাঁকে এক লেবানিজ টেলিভিশনের এক কর্মী আমাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে এল। হাসিমুখে আমরা পরিচিত হলাম। লেবানিজ সংবাদ সংস্থার কর্মী তানিয়া মেহান্না দেখতে ভীষণ সুন্দরী। শান্ত, সৌম্য চেহারার মেয়েটা যে এত চটুল মজা করতে পারে, কে বলবে ওকে দেখে? দ্রুতই ওকে আমার ভালো লেগে যায়। সকালে আমরা একই মিছিলের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। হাতে ধরা বোতলটা খালি হয়ে যাওয়ায় আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি।
মেয়েটিকে নাকি লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে উত্তেজিত জনতা। এ ছাড়া একজন ফ্রেঞ্চ সাংবাদিকের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা হয়েছে। তাহলে পাশার ধারণাই সত্যি হলো। গল্পে গল্পে রাত গভীর হতে থাকলে বিয়ারের স্বাদও পানসে হয়ে এল। আমরা তিনজনই রাতটাকে আরও বেশি উপভোগ করার জন্য হুইস্কির মতো দেখতে নতুন একটা পানীয় নিলাম। এরপর সারা রাত দিল খুলে আড্ডার সঙ্গে কোক ও হুইস্কির স্বাদে দেহমন চনমনে হয়ে উঠল।
মনে পড়ে, কেউ একজন বলছিল- হুইস্কির স্বাদ কখনো নষ্ট হয় না। তবে পাঁচতলার বারের এই বোতলটা ছিল খুব কড়া। এর স্বাদ অনেকটা পুরোনো আইরিশ পটিনের মতো। নিউক্যাসল জার্নাল-এ একবার সারা রাত কাজের পরে পটিন খেয়ে মাতাল হয়েছিলাম। সারা রাত কাজ করলেও তা খুব একটা ফলদায়ক হয় না। একঘেয়েমি কাটাতে শব্দজট মেলাতে মেলাতে পটিনে গলা ভেজানো ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটিন।
সময় ভুলে গিয়ে টাইমস-এর পাতায় শব্দজট মেলাতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পটিনের কড়া স্বাদ রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। একসময় আমরা শব্দজটের সমাধান জানতে টাইমস-এর অফিসে ফোন দিই। তখন ভোর পাঁচটা। ও পাশ থেকে আমাদের সমাধান জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সকালবেলা পত্রিকাটি কিনে সমাধান দেখে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হঠাৎ আমার দ্বিতীয় স্বামীর কথা মনে পড়লে একটা ট্যাক্সি ডেকে দ্রুত বাসায় ফিরি। পুলিশ স্বামী আমাকে পরকীয়ার দায়ে অভিযুক্ত করে। কী সাহস! এমন একজন পরকীয়ার অভিযোগ করছে যে একসময় অন্য এক নারীর জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
যত কিছুই হোক, মদের গন্ধ মুখে নিয়ে বাসায় ফেরা মোটেই সমীচীন কাজ নয়। আমি আমতা আমতা করে কাজ থেকে ফিরেছি বললেও উনি বিশ্বাস করছিলেন না। সবাইকে নিজের পাল্লায় মাপা উচিত নয় বলে চিঙ্কার দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালবেলা উঠে নিজেকে খালি ঘরে একলা আবিষ্কার করি।
যাকগে, তখন ইসলামাবাদ নগরী মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন। আমরা তখনো ঢকঢক করে কোক ও হুইস্কির গ্লাস খালি করে যাচ্ছি। আমরা এতই আপন হয়ে যাই যে, সারা জীবন যোগাযোগ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি। বিচিত্র জায়গা থেকে এক পেশার বিচিত্র মানুষ আমরা। সবার জন্য একজন, একজনের জন্য সবাই জান দিয়ে দেব।
আমি হেলেদুলে লিফটে গিয়ে নিচতলায় নেমে আসি, যেখানে পাশা আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে ছিল। আমি সোজা হয়ে হাঁটার চেষ্টা করছিলাম। মুসলমান সমাজে মদ্যপান এখনো অশোভনীয় ও অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য।
পাশার রংচঙা হলুদ ক্যাবে উঠে ও যেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে, সেখানে চলে যাই। আমার শুধু এতটুকুই মনে পড়ে, আমি পা টেনে টেনে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছি। চোখের সামনে হাজার হাজার তারা নাচছে। একটা ছিমছাম কক্ষ, একটা টেলিভিশন, সঙ্গেই বাথরুম। বিছানায় টলে পড়ি। এরপর সকাল ছয়টা পর্যন্ত আমার আর কিছু মনে নেই।
বিকট শব্দে নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া জঙ্গিবিমানের কানফাটানো শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। একটার পর একটা উড়েই যাচ্ছিল। অবশেষে রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো আমি শুয়ে শুয়ে সময় নষ্ট করছি।
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠেই আমি গায়ে আগের দিনের কাপড় জড়িয়ে নিই। খালি পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়েই সামনে একটা সিড়ি দেখতে পেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করি। ঊর্ধ্বশ্বাসে ওপরে উঠে দ্রুত ছাদে চলে আসি। অবাক হয়ে লক্ষ করি, ছাদ থেকে বিমানবন্দর দেখা যাচ্ছে। পাশা বিমানবন্দরের পাশেই আমার থাকার জায়গা ঠিক করেছে। শুয়ে শুয়ে আমি সকালবেলার কতগুলো বিমান উড্ডয়নের শব্দ শুনেছি। এতই বোকা আমি, তবে আগের রাতের বেশভূষায় খালি পায়ে মাতাল রিডলিকে তখন শূন্য ছাদে কেউ দেখতে পায়নি। শয়নকক্ষে ফিরে এসে আমি কাপড়চোপড় বদলে ভদ্ৰ সাজ ধারণ করি।
নাশতা খেতে খেতে পাশাকে খাইবার পাস যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। বিদেশি সাংবাদিকদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি না থাকায় এটা নিতান্তই অসম্ভব বলে পাশা জানায়।
আমি কখন না-বোধক উত্তর গ্রহণ করি না। তাই আমাকে যেতেই হবে। আমার তীব্র সংকল্প বুঝতে পেরে পাশা হেসে দিল। একসময় ও চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে জানায়, ওখানে কেউ যেতে পারলে একমাত্র আমার পক্ষেই সম্ভব।
গাফফারের সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক অফিসে চলে যাই। সেখানে বিরস গোমড়ামুখো সরকারি এক চাকুরে সব সাংবাদিকের অনুরোধ উপেক্ষা করে যাচ্ছিল। ছোটখাটো একটা জাতিসংঘের মতো- জার্মান, ফ্রেঞ্চ, জাপানি, চেক প্রজাতন্ত্র, আমেরিকান, স্প্যানিশ ও আমি।
খুব অমায়িকভাবে আমি লোকটাকে খাইবার পাস হয়ে ভ্রমণের একটা ট্র্যাভেল কাগজ প্রদানের অনুরোধ জানাই।
কোনো সাংবাদিক পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে যেতে পারবে না বলে লোকটা সোজাসাপ্টা বলে দেয়। অনেক সাংবাদিক হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে গেছে। আবার অনেকেই আরও একবার না শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
‘কেন?’ কণ্ঠস্বর উঁচু করে একটু জোরেই প্রশ্নটা করে বসি। ইতিমধ্যে লোকটা উঠে কোথাও চলে যাচ্ছিল। আমার প্রশ্ন শুনে সে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমি সেখানে যেতে পারব না। অযথাই আমরা তার সময় নষ্ট করছি।
একটু উত্তেজিত হয়ে যাই। লোকটা সিদ্ধান্ত প্রদানের কেউ নয়, তা বোঝাই যাচ্ছে। আমি সরাসরি তার বসের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মুখ থেকেই নিষেধাজ্ঞার কথা শুনতে চাই বলে দাবি তুলি।
লোকটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এরপর পাশাকে কিছু একটা বলতেই ও রেগে তার জবাব দিতে শুরু করে। বুঝতে পারলাম, এই সরকারি চাকুরে খারাপ কিছুই বলেছে। কারণ, পাশাকে এত বেশি রাগতে আমি আগে কখনোই দেখিনি।
‘ম্যাডাম, আমি এই অঞ্চলের অধিবাসী নই বলে লোকটা আমাকে অশিক্ষিত ভেবেছে। আপনার কথায় সে অনেক রেগে আছে এবং তার বসের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে। লোকটা রেগে গেছে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে দম নেয় পাশা।
আমি পাশাকে বললাম, নিউক্যাসলের অধিবাসী আর আটপৌড়ে বাচনভঙ্গি অনেক উন্নাসিক লোকের হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লোকটা কী বুঝল কে জানে, তবে মুখ টিপে হাসতে লাগল।
কাগুজে কেরানি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেল। ফিরে এসে এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি ওর পায়ে লেগে থাকা বিশ্রী ময়লা। একটা দরজা দেখিয়ে সেখানে যেতে বলায় আমি ও পাশা সেদিকে এগিয়ে গেলাম। ভেতরে বিশাল টেবিলের পেছনে বসে ছিলেন শাহজাদা জিয়াউদ্দিন আলি। দুপাশে উর্দিপরা চাপরাশিরা দাঁড়ানো। পেশোয়ারের নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি চিফ।
তিনি আমার খাইবার পাস যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সবিনয়ে আমি এটা আমার বসের নির্দেশ বলে জানাই। এ-ও বলি যে, আমি একজন সাংবাদিক এবং এই ঐতিহাসিক উপত্যকা নিয়ে একটা প্রতিবেদন করতে চাই। আমি আপনার অসুবিধা বুঝতে পারছি। আপনি একজন সমঝদার লোক হলেও আমার বস খুবই একরোখা। আমি যেতে পারিনি বললে তিনি বিশ্বাস না করে আমাকে অলস ভাববেন।
আমি খাইবার পাসের ওপর দুটি বই কেনার কথা উল্লেখ করি। দয়া করে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন। আপনার দেশের সৌন্দর্যের সুবিচার যেন নিজ হাতের লেখনীতে প্রকাশ করতে পারি।
তিনি কঠোর ভঙ্গিমায় টেবিলের ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর একটা মৃদু হাসি দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে বলে জানান। তবে একদমই ছবি তোলা যাবে না বলে বারণ করেন। একই সঙ্গে আমাকে সশস্ত্র পাহারায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং আমি গাড়ি থেকে নামতে পারব না বলে অবহিত করেন।
আমি তাকে উষ্ণ ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে চলে আসি। সেখানে তখনো বিদেশি সাংবাদিকেরা বিরস বদনে অপেক্ষা করছিল। লোকটা অবশেষে হা বলেছে বলে আমি আনন্দে চিল্কার করতে থাকি। আমার কথায় অনেকেই ক্ষোভে শূন্যে ঘুষি ছুড়ল। কিছুক্ষণ পরই সেই কেরানির সামনে পাসপোর্টের পাহাড় জমে গেল।
লোকটি যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, যদি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে মানুষ খুন করা সম্ভব হতো, তাহলে আজ আমি এই বই লিখতে পারতাম না।
পাশা তো আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ- ‘ম্যাডাম, আপনি কী জাদু জানেন, তা জানি না। মাঝেমধ্যে আপনি এত কঠোর হয়ে যান যে আমারও ভয় হতে থাকে। তবে আপনি সত্যিই অনেক অমায়িক।
একজন জার্মান টেলিভিশন কর্মী ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছিলেন। আমি তাকে গিয়ে ছবি তোলার অনুমতি মিলবে না বলে জানাই। তিনি ক্যামেরা রেখে কোথাও যেতে পারবেন না বলে হেসে ফেলেন। পরে আমরা একই সঙ্গে রওনা দিই।
আমরা হাসাহাসি করতে করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
এক ঘণ্টা পর সব কাগজপত্র তিনবার করে পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়। আমাদের শহরের অপর প্রান্তে আরেকটা অফিসেও যেতে ক্রুদের সবার প্রস্তুতি শেষে যখন আমরা রওনা দিতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটল। একজন পোলিশ ব্যক্তি ভারী একটা জাপানি মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে এলেন। আমাদের গাড়িতে তাঁর মোটরসাইকেলটা ওঠানো হলো।
আমি আফগান চিত্রগ্রাহক গাফফারের কাছে লোকটার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। গাফফার বোতলের জিনের মতো হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, আবার চলে আসে। সে পাশাকে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, লোকটা একজন পর্যটক এবং তিনি খাইবার পাস হয়ে আফগানিস্তান ভ্রমণের ভিসা পেয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি একজন পর্যটক হিসেবে এক সপ্তাহ কাবুলে থাকার অনুমতি চেয়ে আফগান দূতাবাসে আবেদন করব বলে মনস্থির করি।
যাত্রা শুরুর আগ মুহূর্তে সুঠাম দেহের অধিকারী খাইবার রাইফেল রেজিমেন্টের একজন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। পাশা আমাকে ট্যাক্সির সামনের আসনে বসার প্রস্তাব দিলে কোনো অস্ত্রে সজ্জিত ব্যক্তি আমার পেছনে বসতে পারবে না বলে সামনে বসার প্রস্তাব নাকচ করে দিই। প্রয়োজনে ওই সৈন্য সামনের আসনে বসবেন।
সম্ভবত ওই সৈন্যকে আমাকে চোখে চোখে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাই আমরা দুজনই পেছনের আসনে বসি এবং আমাদের যাত্রা শুরু হয়। খাইবারের আগে এক চেকপোস্টে সব কাগজপত্র পুত্থানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছিল। তাই আমি বাইরে বের হয়ে পায়চারি করতে লাগলাম।
রাস্তার এক ধারে বড় বড় করে লেখা ছিল, এর সামনে কোনো বিদেশি যেতে পারবেন না। গাফফার একটা ছবি তুলতে চায় বলে চিৎকার করলে আমি নির্দেশকটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিই। একটা বাচ্চাছেলে হতবুদ্ধির মতো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এই ছবিটা পারিবারিক অ্যালবামে রাখা যেতে পারে। একটু পরই ভাবলাম, সাত দিন পরে ছবিটা পৃথিবীকে চমকে দিতে পারে।
আবার খাইবারের দিকে যাত্রা শুরু হয়। একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম যিনি খবর সংগ্রহের জন্য হোয়াইট হলের সামনে ঘুরঘুর করেন। তিনি আমাকে পাহাড়ি খাদের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি বলে তিনি জানান।
দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাসের পাতায় আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে ঐতিহাসিক এই খাইবার পাস। এই পর্বতসংকুল দুর্গম জায়গা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে পুনরায় আলোচনায় উঠে এসেছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা আসন্ন যুদ্ধে এ জায়গার কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছেন।
বিশাল বিশাল সামরিক বাহিনী ও শিকারি ডাকাতের দল এই পাসের গভীর গিরিখাদ ও পর্বতচূড়া পেরিয়ে গেছে। মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাচালানিদের কাছেও নিরাপদ পথ হিসেবে এ জায়গা ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও কয়েক দিনের মধ্যে এখানকার ৫২ কিলোমিটার বন্ধুর পথ অতিক্রম করবে। প্রতিকূল ও দুর্গম হিন্দুকুশ পর্বতমালাকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলে সফেদ কোহ পর্বতমালার পাদদেশে কাবুল ও পেশোয়ারের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হচ্ছে খাইবার পাস। স্থানভেদে এখানকার পর্বতের উচ্চতা ১০ মিটার থেকে ৪৫০ মিটার পর্যন্ত।
সামরিক কৌশল হিসেবে এই পাসের গুরুত্ব সুয়েজ খাল অথবা জিব্রাল্টারের চেয়ে কম নয়। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল ও কাবুলের মধ্যে একমাত্র সংযোগ। ভীত তালেবান গোষ্ঠী ও উসামা বিন লাদেন এখানকার প্রতিটা খাদ ও ফাটল সম্পর্কে অবগত। কিন্তু অনভিজ্ঞদের জন্য এটি একটি নতুন স্থান, যার প্রতিটা ইঞ্চি মাটিতে গোপনে বিপদ অপেক্ষা করছে। সেই সঙ্গে রয়েছে হিমশীতল আতঙ্ক। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চল আক্রমণে বিদেশি শক্তি বারবার এই পাসকে পথ হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং কখনো কখনো এখানে দীর্ঘমেয়াদি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতেও দেখা গেছে।
খাইবার পাস মূলত পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিবেশী আফগানিস্তানে আমেরিকার সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে এ অঞ্চলে সব বিদেশি ও গণমাধ্যমকর্মীদের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অনিশ্চয়তায় ভরা তিন মিটারের উঁচু পাহাড়ি পথে পৌছে দেখি, ল্যান্ড ক্রুজারের জানালা দিয়ে জার্মান টেলিভিশন কর্মীর হাত ঝুলছে। বিশাল ক্যামেরা তাক করে আমাদের ভ্রমণের প্রতিটা পদক্ষেপ সে ক্যামেরায় ধারণ করে চলছে। দুই পাশের পাহাড়চূড়ার দিকে তাকালে এগুলোকে অলঙ্ঘনীয় বলে মনে হয়। যদিও পাহাড়ের খাড়া পাদদেশ ধরে শত বছর ধরে তৈরি হওয়া হালকা পদচিহ্ন চোখে পড়ে।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তের তিন কিলোমিটারের ভেতরেই পাহাড়টির সর্বোচ্চ চূড়া অবস্থিত। এখানেই আমাদের গাড়ি থেমে যায় ও আমরা নেমে পড়ি। নিচের দিকে তাকিয়ে তোরখাম দেখা যায়। এই ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখার পরে ছবি না তোলাটা অপরাধ বলে মনে হলো।
এক নিমেষে সবাই ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং এখানকার সৌন্দর্য ধারণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমি গাফফারকে ডাকতেই খেয়াল করলাম স্বভাবসিদ্ধভাবেই ও কোথাও চলে গেছে। একটু রেগে গিয়ে পাশাকে জিজ্ঞেস করতেই ও গাফফারকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।
খাইবার রাইফেলসের একজন সদস্য জানায়, আমাদের চোখের সামনের পাহাড়ের অভ্যন্তরের ফাঁকা জায়গা দিয়েই খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ শতকে মহাবীর আলেকজান্ডার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন।
এ বিষয়ে পরে মারিয়ামের লেখা পড়ে আরও অনেক কিছুই জানতে পারি। যতটুকু মনে পড়ে, ও লিখেছিল- তাতার, পার্সি ও মঙ্গোলিয়ানরা ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এই খাইবার অতিক্রম করেছে। এক শতক পরে ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের দ্বারা অধিকৃত হলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এখানে পাহারা দিয়েছে।
আফগান যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে ভারতীয় ব্রিটিশ সৈন্য ও আফগানদের মধ্যে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধটি হয় ১৮৪২ সালের জানুয়ারিতে। এটি ছিল পরপর তিনটি যুদ্ধের প্রথম যুদ্ধের শেষ মাস। এ লড়াইয়ে প্রায় ১৬ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য ও ভারতীয় যোদ্ধা নিহত হয়।
১৮৭৯ সালে ব্রিটিশরা খাইবার পাসের ভেতর দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করে। পরে ১৯২০ সালে এটিকে মহাসড়কে রূপান্তর করা হয়। একই সময় একটি রেলপথও নির্মাণ করা হয়। তবে রেললাইনের আফগানিস্তান অংশটুকু মেরামত ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই রেলে ভ্রমণ হতে পারত পৃথিবীর অন্যতম শ্বাসরুদ্ধকর ও উত্তেজনাপূর্ণ ভ্রমণ। অনর্থক যুদ্ধ, অনর্থক সংঘর্ষ, অনর্থক দারিদ্র। বোমা বানানোর পেছনে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় না করে উচিত ছিল ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া এবং এসব ঐতিহাসিক সড়ক ও রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা।
অনেক পাথরে খোদাই করা অবস্থায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্টের প্রতীক জ্বলজ্বল করছিল। দৃশ্যটা অনেক আবেগ ও সম্মানের।
এমন সময় দৃশ্যপটে ঝড়ের বেগে গাফফার হাজির। আমি ওর সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার আগমুহূর্তেই পাশা আমার পায়ে পাড়া দিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করে। গাফফার এতক্ষণ খাইবার রাইফেলসে ওর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিল। ফিরতি যাত্রা শুরু হলে সবাই যখন ডানে চলে যাবে, আমাদের তখন বাঁয়ে মোড় নিয়ে তোরখাম পৌছে সীমান্ত অতিক্রম করার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সত্যিকার অর্থে গাফফার খুবই হতাশাজনক ব্যক্তি। তবে হঠাৎ হঠাৎ ওর করিঙ্কৰ্মা দেখে ওকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করে। একজন সৈনিকের সেমি অটোমেটিক হাতে নিয়ে পোজ দিলে গাফফার আমার ছবি তুলে দেয়। আমার নাইকন ক্যামেরাটি ওর হাতে তুলে দিই। আফগান সীমান্তের দিকে তাকিয়ে সেমি অটোমেটিক হাতে নিয়ে গভীর চাহনিতে পোজ দিলে গাফফার বেশ কয়েকবার মুহর্তগুলোকে ফিলাবন্দী করে। এই ছবিটা আমি পরে আর কখনোই দেখতে পাইনি। তবে তখন এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই হয়নি।
আমি অস্ত্র ধরায় এতটাই আনাড়ি ছিলাম যে, স্কার্ফে লেগে নিরাপত্তা পিন প্রায় খুলে যেতে বসছিল। নায়কোচিত এক নির্ভীক খাইবার সৈন্য সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে আমার সামনে চলে এল। এরা টাকা পেলে যে কারও জন্য জান দিয়ে দিতে পারে। সৈন্যটি শূন্যে অস্ত্রটি ঘুরিয়ে আমার স্কার্ফ ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল।
আমি কী ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি, বুঝতে পেরে আমার হাত-পা ঠান্ডায় অবশ হয়ে গেল। এক সাহসী সৈন্য আমার কাছ থেকে ঝটকা মেরে নিরাপদে অস্ত্রটি সরিয়ে নিলে আমি সংবিৎ ফিরে পাই।
সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে দেখছিল আর হাসছিল। স্বীকার করি, এই রকম অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছিল। আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরে প্রাথমিক ও বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সময় কয়েকবার এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। খাইবার পাসে অস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়ার এমন হাস্যকর অভিজ্ঞতার মাত্র সাত দিন পরই যে আমার আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে কাজ করার প্রশিক্ষণ কী দারুণভাবে কাজে দেবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
১৯৯০ সালে ডার্লিংটনে থাকার সময় নর্দার্ন ইকোতে কাজ করতাম। তখন একরকম বাজি ধরেই আমি আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। তবে প্রশিক্ষণ চলাকালীন আমার দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং অনেক অনেক অসাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এক রাতে আমি আর জিম ম্যাকিন্টোশ কয়েকজন বন্ধুকে রাতে খাইয়েছিলাম। তাদের একজন ছিল সান্দারল্যান্ডে অবস্থিত নাম্বিয়া পুলিশ বাহিনীর সদস্য। সেখানেই আমাকে বাজিটা ধরতে হয়। আমাদের আলোচনা ছিল প্রাণবন্ত ও গল্পগুলো শুনতে আকর্ষণীয় লাগছিল। ওই দিন বুঝতে পারি, বাস্তব জীবনের চেয়ে মজার আর কিছু হতে পারে না। একদল পুলিশ সদস্যের গল্প সব সময়ই আবেগপ্রবণ, দুঃখ ভারাক্রান্ত, হাস্যরসে ভরপুর ও আবেদনময়ী। খাওয়া শেষে আমরা লাউঞ্জে গিয়ে বসি। এক পাশে টিভি চলছিল। আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ টিভি দেখলাম। হুইস্কি আর ব্র্যান্ডির বোতল হাতে আমরা ভাবতে শুরু করলাম বর্তমান পরিস্থিতিতে না থাকলে আমরা কে কী করতাম। সব পুলিশ সদস্যই পুনরায় একই দায়িত্ব পালন করতে পারলে খুশি হতো বলে জানায়। মেয়েরা নাকি নার্সিং পেশা বেছে নিত। কারণ, তাদের কাছে। ইতিমধ্যেই জীবন বাঁচানোর সব উপকরণ আছে এবং লাল রক্ত দেখে তারা কেউই এখন আর ভীত নয়। এমন সময়, এক নির্ভীক পুলিশ সদস্য, মার্গি রোল্যান্ড, আমি কী করতাম জানতে চেয়ে বসে। মার্গিকে পরে এক মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্য পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর নিতে হয়।
আমি অনেক সময় নিয়ে ভাবতেই লাগলাম। আমার নীরবতা ছিল কানে অসহ্যকর। জিম খোঁচা মেরে বলে উঠল, সংবাদ লেখার খাতা আর কলম ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। আমি রেগে যেতেই আর্মিতে যোগদানের একটা বিজ্ঞাপন আমার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিই, আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতাম। আমার কথায় সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
জিম ব্যঙ্গ করে বলল, আমি নাকি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার গ্রুপেই চাকরি পাব না। এত অপমানে আমি তিতিবিরক্ত হলেও মনের ভাব লুকিয়ে রাখতে আমি সিদ্ধহস্ত। তাই কেউ আমার মনের ভাব
পাইওনিয়ার গ্রুপেই ভাব বুঝতেই পারল না। আমি বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত ০৮০০ নাম্বারে ফোন দিয়ে আমার নাম ও ঠিকানা জমা দিই।
এক সপ্তাহ পরে একজন মধুকণ্ঠী আর্মি অফিসার আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে ফোন দেন। ওই সময় সত্যিই আমার খুব বিব্রতকর লাগছিল। তত দিনে আমার সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছাও উবে গেছে। যা-ই হোক, উর্দিপরা ভদ্রলোকের কথা ছিল খুবই চিত্তহরণকারী। অবশেষে আমি ডারহাম সিটিতে অবস্থিত আর্মি নিয়োগ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা করার জন্য রাজি হই।
আমি ফিরোজা রঙের একটা স্যুট পরে হাজির হই। এটা আমার খুব প্রিয় ছিল। তবে একজন বলল আমাকে নাকি ব্যাংকের চাকরিজীবীর মতো
লাগছে। যা-ই হোক, নিজেকে বোঝাই জিম যতই আমাকে অস্তিত্বহীন বলুক না কেন, আমার কোনো গুরুত্ব না থাকলে সেনাবাহিনীর লোকজন আমাকে ডাকত না। পরে শুনতে পারি, আমি সাংবাদিক বলেই নাকি আমাকে সেনাবাহিনীতে ডাকা হয়। জানতে পেরে খুবই অবাক হয়ে যাই।
খাকি রঙের উর্দি গায়ে চড়ানো কর্মকর্তা আমাকে আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অফিসে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান। এই পদে চাকরিরতরা অফিসার পদমর্যাদার অধিকারী হন।
তাই নাকি? আমার পাইওনিয়ার গ্রুপের বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী হওয়ারও যোগ্যতা নেই? সত্যিই তাই? ওহে ম্যাকিন্টোশ, প্রথম পাঠ কখনো রিডলিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ো না। পরে আমি উইল্টশায়ারে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের স্থলবাহিনীর সদর দপ্তরে নির্বাচক বোর্ডের কাছে পরীক্ষা দিতে যাই। পরীক্ষার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়-ধরানো। আমাকে ন্যাটো বাহিনীতে ৫০টি জিনিসের নাম লিখতে বলা হয়। নারী সৈন্যদের উদ্দেশে একটি জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতে হয়। এ ছাড়া কতগুলো তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদনও লিখতে হয়। প্রথম পরীক্ষার উত্তরগুলো নিউক্যাসল গণপাঠাগারে প্রতিরক্ষার ওপর লেখা বই পড়তে গিয়ে শিখেছিলাম। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা ছিল গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। আর তৃতীয় পরীক্ষা ছিল পানিভাত।
একদিন বাসার চিঠির বাক্সে বাদামি রঙের খামে রাজকীয় বাহিনীতে যোগদানের নিমন্ত্রণ পেলাম। প্রথমে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়। রাজকীয় বাহিনীর মিডলক্ট্রতে আমাকে যুক্ত করা হয় এবং যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়।
আমি অফিসে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে জিমের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও এতে একটুও খুশি হয়নি। ওর মতে মানুষ কেবল প্রেম করতেই আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।
আমি জোরে হেসে দিলাম। এই লোকটাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। যা-ই হোক, আমি বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে সব প্রয়োজনীয় সরাম গুছিয়ে আমার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করে দিলাম। স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে নয় সপ্তাহে দ্রুত প্রশিক্ষণ সমাপ্তের একটা সুযোগ থাকলেও সেদিকে পা বাড়ালাম না।
কীভাবে অস্ত্র ধরতে হয়, অস্ত্রের বিভিন্ন অংশ খুলতে হয়, পরিষ্কার করতে হয়, পুনরায় সাজাতে হয় এবং সর্বোপরি কীভাবে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, এসব ছিল প্রাথমিক প্রশিক্ষণের অংশ। ভুলভাবে অস্ত্র ধরা বা ব্যবহার করলে কী হতে পারে, তার ওপর আমাদের একটা ভিডিও দেখানো হয়। কতগুলো আঘাত দেখে আমি ভয়ে নীল হয়ে গেলাম।
প্রথম যখন আমার হাতে পিস্তল দেওয়া হয়, তখন ভয়ে আমার হাত কাঁপতে থাকে। একটা মাঠে নিয়ে আমাকে লক্ষ্যের দিকে গুলি করতে বলা হয়। কোনো সমস্যা হলে একজন প্রশিক্ষক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন। আমি কাঁপতে কাঁপতে দুবার গুলি করার পরই পিস্তল জ্যাম হয়ে যায়। ফলে হাত উঁচু করে সবার দিকে ঘুরে তাকাই।
হঠাৎ সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং একজন প্রশিক্ষক অশ্রাব্য ভাষায় খুবই বাজে গালি ব্যবহার করে আমাকে পিস্তলটা মাটিতে নামাতে বলেন। পিস্তলটা মাটিতে ফেলে দিই। প্রশিক্ষকের কাছ থেকে জীবনের তরে একটা শিক্ষা গ্রহণ করি।
কখনোই শক্র ব্যতীত কারও দিকে অস্ত্র তাক করতে নেই। অস্ত্র থেকে গুলি বেরিয়ে গিয়ে যে কাউকে খুন করে ফেলতে পারে। একদম আমার নাকের ডগায় এসে তিনি আমাকে ভৎসনা করে গেলেন।
আমার মনে হচ্ছিল, মাটি ফেড়ে যাক আর আমি এর মধ্যে লুকিয়ে যাই। প্রশিক্ষককে মাথা নেড়ে এরূপ আর জীবনেও না করার সম্মতি জ্ঞাপন করি।
ইতিহাস খুব অদ্ভুতভাবে ফিরে আসে। আজ আমি খাইবার পাসে দাঁড়িয়ে আছি আর একজন সৈন্য আত্মরক্ষায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমি খুব ব্রিত বোধ করলাম এবং ঘটনাস্থল থেকে সরে গিয়ে সড়কের ধারে চলে এলাম। মুখে একটা কঠিন ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। আমি অল্পতেই গলে যাই না, এটা বোঝানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখলাম না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম কখন আমি, পাশা ও গাফফার তোরখাম সীমান্ত অতিক্রম করার সময় পাব।
কদিন আগেও এ পথে হাজার হাজার আফগান শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায় ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সীমান্ত সিলগালা করে দিয়ে শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিয়েছে। গাফফার একজন চালকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। এই চালকই আমাদের সীমান্ত পার করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। চালকটি জানাল, সব শরণার্থী ফিরে গেছে। চারদিকে এখন পিনপতন নীরবতা। সবাই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আশঙ্কায় সময় কাটাচ্ছে।
আমাদের গাড়িগুলো রাস্তায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমি আর পাশা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। গাফফারকে দেখলাম এক সৈন্যের সঙ্গে তর্ক করছে। আমাদের কাছে এসে জানাল, সৈন্যরা আমাদের যেতে দেবে না। আরেকবার আমার আফগান সীমান্ত অতিক্রম করার পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ল। তবে ঐতিহাসিক খাইবার পাস দেখেছি, এ-ও বা কম কী। আনন্দ মনেই ফিরে এলাম।
আমি পার্ল কন্টিনেন্টালে ঢু মেরে পাঁচতলার বারে চলে এলাম। সেখানে তখন ইভান ও তার চিত্রগ্রাহক বসে ছিল। আমাদের সময়সীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় বসে কথা বলতে কোনো বাধা ছিল না। তাই ওদের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। তারা নাকি পাকিস্তানিদের মতো পোশাক পরে ডেরা আদম খলিলের অস্ত্র কারখানা ঘুরে এসেছে।
আমিও সেখান থেকে ঘুরে এসেছি বলে জানালাম। তবে ইভানদের দুই দিন আগে। আমরা দুজনই আমাদের প্রতিবেদন পড়ে দেখলাম ও বিভিন্ন তথ্য তুলনা করলাম। সময়টা হাস্যরসে কাটলেও আমি দ্রুত বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। বাইরে এসেই জিমকে ফোন করলাম।
মেইল অন সানডেও যে অস্ত্র কারখানা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপছে, তা জিমকে জানালাম। ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও সম্ভবত আমাদের অফিসের কেউ ডেভ ডিলনকে মেইল অন সানডের তথ্য কর্মকর্তা) আমার সব তথ্য আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে কারও সঙ্গেই এ ব্যাপারে কথা বলিনি বলে উল্লেখ করি। তাই তথ্য পাচার লন্ডন থেকেই হচ্ছে বলে জিমকে জানাই। আমার মনে হয়, আমি চলে আসার পর জিমও একই কাজ করেছে।
পরদিন আমার সহকর্মী ডেইলি এক্সপ্রেস-এর ডেভিড স্মিথের ইসলামাবাদ আসার কথা। ওর জন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা ও বিমানবন্দরে গাড়ি প্রস্তুত রাখতে হবে। তাই সন্ধ্যায় আমি ও পাশা ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা দিই। পাশাকে বলে রাখি সব ব্যবস্থা করে ফেলতে।
আমার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করলে ডেভিডকে কিছু টুথপেস্ট নিয়ে আসতে বলি। আসার সময় ব্যাগ থেকে টুথপেস্ট চুরি হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি টুথপেস্ট ব্যবহার করছি। এগুলো বেশ নোনতা ও বিস্বাদ।
ডেভিডের আসার কথায় উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম। ও টুথপেস্ট নিয়ে আসবে শুধু এ জন্য নয়, ও এলে আমি এক দিন ছুটি পাব, যেদিন শুধু শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেব। কোনো কাজ করা লাগবে না আমার। হোটেল রুমে ফিরে এলাম। এতই বিধ্বস্ত ছিলাম যে, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে হঁচড়ে টেনে নিয়ে গেছে। অভ্যর্থনা বিভাগের কর্মীরা আমাকে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে সম্ভাষণ জানায়। ক্লান্ত অবস্থায় অসময়ে বের হতে ও ফিরতে দেখতে ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
পরদিন নাশতা করতে গিয়ে বুফে খাবার জায়গায় একবার চোখ বুলিয়ে আসি। মসলাদার খাবারে অভ্যস্ত না হলেও এক বাটি হালকা মসলার মাংসের তরকারি ও দুটো ডিম ভাজি আমার পেটে সয়ে যাবে। মাংসের ঝাঁজ কমাতেই ডিম ভাজি খেতে হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে বেশ ফুর্তি লাগে। দুই সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানে আছি অথচ এখনো কোনো বড়সড় অসুখ হয়নি।
১৯৯২ সালে দামেস্কে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি এবং আমার শরীর মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তখন ডেইজি আমার পেটে সাত মাস ধরে। সাইপ্রাস পৌছার পরে তিন দিন বিছানায় শুয়ে ঘড়ি ধরে ওষুধ খেতে হচ্ছিল। আমাকে সিরিয়া যেতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু বহুদিন ধরেই আমি আহমেদ জিব্রিলের সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। অবশেষে যখন জিব্রিলের মধ্যস্থতাকারী আমাকে সম্মতি জানায়,
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাকে তখন যাওয়া না যাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছিল। এটা ছিল একটা সুযোগ লুফে নেওয়ার মুহূর্ত।
আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আহমেদ জিব্রিলের নাম ছিল। তাই সাক্ষাঙ্কারটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পরে অন্য কাউকে লকারবি বোমা হামলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় । লকারবির দুর্ঘটনার দিন রাতে আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম এবং আমি স্বচক্ষে সেদিনের ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী। এই ঘটনার কুপ্রভাব আমার ওপর পড়ে এবং দীর্ঘদিন ধরে এই ক্ষত আমাকে বয়ে বেড়াতে হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ফ্লাইটটি নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিল লন্ডন হয়ে। তখনই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। সব মিলিয়ে ২৭০ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হন।
সেদিন আমি নিউক্যাসল জার্নাল-এর প্রধান অফিসে দিনের বেলায় কাজ করছিলাম। সন্ধ্যা ছয়টায় আমার কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমি অফিস থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় রাতে কাজ করার জন্য ওয়েন হ্যাল্টন হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির হয়। ও অস্থিরচিত্তে পুলিশ, অগ্নিনির্বাপণ বিভাগ ও অ্যাম্বুলেন্স অফিসে ফোন করছিল। ও প্রায় চিল্কার করে বার্তা সম্পাদক টম প্যাটারসনকে জানায় যে সীমান্তে কোথাও বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো নিচদিয়ে উড়ে যাওয়া হালকা ধরনের কোনো বিমান হবে।
যা-ই হোক, আমি আরও কিছুক্ষণ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণ পরই বোঝা গেল দুর্ঘটনাটি বড়ই মর্মান্তিক, ছোটখাটো কিছু নয়। সঙ্গে সঙ্গেই আমি নিজেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাই এবং আমি আর ওয়েন প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি নিয়ে লকারবির দিকে রওনা দিই। সেদিন ছিল ১৯৮৮ সালের ২১ ডিসেম্বর, সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট। আমি ফ্লোরবোর্ডে পা নাচাচ্ছিলাম। লকারবি ছিল উত্তর পশ্চিম দিকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে। কিন্তু সড়ক ধরে রওনা দেওয়ায় আমরা জ্যামে আটকা পড়ি। সাত মাইল ধরে ছিল থমকে যাওয়া যানবাহনের দীর্ঘ সারি। তাই আমরা এ৬৯ মহাসড়ক ছেড়ে গ্রেটনা গ্রিনের দিকে ঘুরে যাই। সংবাদ পৌছানোর সময়সীমা দ্রুত কমে আসছিল। একটুও বিচলিত না হয়ে তাই একরকম ঝড়ের বেগে গাড়ি নিয়ে প্রায় উড়ে চলি। রাস্তার সব কটা পুলিশ চেক পয়েন্ট এক নিমেষেই পাড়ি দিতে সক্ষম হই। একসময় শহরের মাঝখানে পৌছে যাই, যেখানে বোমা বিস্ফোরণে পড়ে বিমানটি আছড়ে পড়ে।
সবকিছু কেমন থমকে গিয়েছিল সেদিন। বাতাসে বিমানের জ্বালানি পোড়া গন্ধ ভাসছিল। পরিবেশটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। আমার দৃষ্টি বারবার আটকে যাচ্ছিল।
রাস্তার ওপর টনকে টন লোহা, নাট-বল্ট ও ভাঙা ধাতব টুকরা পড়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ একটা বড়সড় ভাঙাড়ির দোকানের সব লোহালক্কড় রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। শহরের অধিবাসীদের মুখে কোনো কথা ছিল না। বিস্ফারিত নয়নে তারা এদিক-ওদিক দেখছিল। ঘড়ির কাঁটাটাই যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাস্থলে গিয়ে ওয়েন ও আমি দুদিকে চলে যাই। কতিপয় স্কটিশ প্রতিবেদক বাদে আমরাই প্রথম সাংবাদিক দল হিসেবে সেখানে পৌছাই। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত তথ্য একত্র করার চেষ্টা করি। একটা লোকাল লাইন ব্যবহার করে অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ লাইন তখন বিচ্ছিন্ন। সে সময় স্থানীয় সংবাদ পত্রিকার স্বল্প বাজেটে মুঠোফোন ব্যবহারের কথা চিন্তাই করা যেত না। ফোনগুলোও সে সময় ছিল একেকটা ইটের আকৃতির। দামও ছিল আকাশছোঁয়া। এখনকার পাতলা স্মার্টফোনের যুগ তখনো শুরু হয়নি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে একজন লরিচালককে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ছাদভর্তি অ্যানটেনা। জানতে চাই যোগাযোগের কোনো মাধ্যম আছে কি না। দ্রুতই নিজের পরিচয় দিয়ে অফিসে সংবাদের প্রথম অংশ পাঠাতে হবে বলে ব্যাখ্যা করলে তিনি আমাকে লরির ভেতরে যেতে বলেন। চমৎকার, আমার পত্রিকা মুফতে এখন একটি ভ্রাম্যমাণ অফিস পেয়ে গেল ফোন সংযোেগসহ। আমি দ্রুতই আমার প্রতিবেদন অফিসে পাঠিয়ে দিই।
আমি যখন ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নকল লেখকের কাছে প্রতিবেদনটি শ্রুতিলেখন করাচ্ছিলাম, সে সময় স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে শোনা এক রহস্যময় পরিচালকের কথা উল্লেখ করি। সেই রহস্যময় চালক নায়কের মতো সড়কের মাঝে তার লরি দাঁড় করিয়ে দুর্ঘটনাস্থলগামী সব গাড়ি থামিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে চালকের আসন থেকে একটু আগেই যে চালক আমাকে তার লরির সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, সে লাফিয়ে ওঠে, আরে আমিই সেই ব্যক্তি, মানুষ আমাকে সত্যি সত্যি নায়ক বলতে শুরু করেছে? যেকোনো চালকই এই দুরবস্থার সময় এই রকমই করত। চিঙ্কার শুনে আমি নকল লেখককে বললাম, রহস্যময় চালকের কথা কেটে দাও। আমি এক্ষুনি চালকের নাম, ঠিকানা ও ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাঠাচ্ছি।
হ্যা, ওই দিন আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। মাঝেমধ্যে এ রকম নাটকীয়তার প্রয়োজন পড়ে।
আমি দ্রুত ওয়েনকে নিয়ে লরির ভ্রাম্যমাণ অফিসে চলে আসি। ওয়েনও তার প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়। আমাদের আগে আর কোনো সাংবাদিক দুর্ঘটনার খবর তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। টম প্যাটারসন খুব খুশি হয় এবং রাত তিনটার প্রথম সংস্করণের আগ পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাই। পড়তে পড়তে এই খাটাখাটনিকে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু একজন সাংবাদিককে সব সময়ই সব দিক থেকে খবর ও তথ্য সংগ্রহের জন্য চৌকান্না থাকতে হয়। কারণ, পাঠকেরা পরদিন ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য এমনভাবে মুখিয়ে থাকে, যেন তারা নিজেরাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। কখনোই ভেঙে পড়া যাবে না এবং আবেগকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। চোখের পানির বাঁধ পড়েও নিভৃতে ছেড়ে দেওয়া যাবে।
অনেকক্ষণ পরে নিউক্যাসল ভিত্তিক সাংবাদিকদের দলকে ভিড় করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে বিখ্যাত ডেইলি মিরর-এর ক্লিভ ক্রিকমায়ার ও সান-এর ডগ ওয়াটসনও সদলবলে হাজির হয়েছিলেন। ওয়াটসন তখন আর্নডেলে ক্রিসমাসের শপিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পেয়েই তিনি সুদূর ম্যানচেস্টার থেকে দৌড়ে চলে আসেন। ডেইলি মেইল-এর রজার স্কট ও ডেইলি এক্সপ্রেস-এর অ্যালান বেক্সটার, যারা সান্ডারল্যান্ডে একটা খুনের ঘটনায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাও সব ফেলে ছুটে আসেন। হিথরো থেকে গ্লাসগোগামী ফ্লাইটে আনন্দ করতে করতে উড়ে আসে ক্রিস বুফে। ক্রিস ডেইলি স্টার-এর বড়দিনের পার্টিতে নাচতে গিয়েছিল। মদ্যপানের পরেও মাতাল না হওয়ার জন্য ক্রিস বিখ্যাত। এ রকম পার্টির পরে একমাত্র ক্রিসের পক্ষেই বিমানভ্রমণ করা সম্ভব ছিল। আমি আর ওয়েন একরকম নিজেদের লুকিয়ে রাখি। কারণ, মহারথী সাংবাদিক দলের সবার বড় বড় মোবাইল ফোনগুলোর চার্জ ফুরিয়ে আসছিল। আমরা তখনো আমাদের লরির ভেতর গোপন জেলা অফিস পাহারা দিচ্ছিলাম।
তখনকার দিনে ঘটনার পরের কয়েক দিনে ঘটনার ভয়াবহতা ও শোক অনুভব হতে শুরু করত। সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের কখনো কখনো মানসিক পরামর্শের প্রয়োজন পড়ত। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি আমার অনুভূতি হেসে উড়িয়ে দেন। পুলিশ বাহিনী নাকি এর থেকেও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। আমি জানি না, কিসের ভিত্তিতে তিনি এমন দাবি করেছেন। তবে এর পর থেকে আমি ওঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা করিনি।
সত্য বলতে এর পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি কোনো বড়দিনেই বেশি আনন্দ করতে পারিনি। লকারবির দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভেসে ওঠে। খোদাই জানেন, স্বয়ং লকারবির বাসিন্দারা কীভাবে এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে আছেন? মাঝেমধ্যে এসব তথাকথিত উৎসবের মাসে আমার মন চলে যায় সেই সীমান্তঘেঁষা শহরে, যে শহর এখনো বুকে দগদগে ঘা বয়ে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে, আমি দুজন বাবা-মায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যারা তখন টেলিভিশনে এটাই আমার জীবন শীর্ষক সিনেমা দেখছিলেন। তাঁদের দুটি সন্তান তখন বাইরে বিশাল ক্রিসমাস ট্রিয়ের নিচে খেলছিল, যখন এই ভয়াবহ বিস্ফোরণে তাঁদের বাড়ি কেঁপে ওঠে। নড়েচড়ে ওঠার আগেই কয়েক সারি বিমানের আসন তাদের জানালা ভেঙে ঘরে আছড়ে পড়ে। পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া যাত্রীদের মৃতদেহ তখনো আসনগুলোতে বসা ছিল।
এই অকল্পনীয় দৃশ্যের কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। তারা কীভাবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজেদের? কীভাবে সন্তানদের বুঝিয়েছেন? পুরো অভিজ্ঞতা এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিশ্চিতভাবেই আমি দুর্ঘটনা-পরবর্তী মানসিক অবসাদজনিত সমস্যায় ভুগছিলাম। তবে শক্তসমর্থ সংবাদকর্মীরা কখনোই এসব আবেগতাড়িত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না। তারা শুধু চালিয়েই যান।
এসব কারণেই জিব্রিলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তাঁকে দোষারোপ করতে চেয়েছিলাম। ঘটনার দিনটাকে তার চোখের সামনে তুলে ধরাটা জরুরি ছিল। তাই আমি দামেস্কে গিয়েছিলাম। তবে জিব্রিলের কাছ থেকে অনুতাপ বা অপরাধের স্বীকারোক্তি পাব, এমন আশা আমি কখনোই করিনি।
তাঁকে কিছুটা অর্ধসভ্য মানুষ বলে মনে হলো। আমি তাঁকে পাশের বাড়ির বয়স্ক চাচার মতোই বিবরণ দেব। তাঁর চেহারায় মায়া লুকানো ছিল।
গভীর বাদামি চোখ দুটো যেন অনেক দুঃখ-বেদনা সয়ে বেঁচে আছে। দোভাষীদের মাধ্যমে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ পর্ব চলে এবং তিনি সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। আমি তিনবার ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রসঙ্গটা তুললেও প্রতিবার তিনি একই উত্তর দেন। তবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দেহরক্ষী দ্বারা পরিবেষ্টিত একজনকে তো আর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সরাসরি প্রশ্ন করা সম্ভব নয়।
আমি একটা ভিন্ন কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিই। লকারবিতে সেদিন আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করি। যা যা দেখেছি, পাথরের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ, ছাদের ওপর পড়ে থাকা একটি শিশুর মৃতদেই, একজন শহরের অধিবাসী যার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই ছিল না, তিনি কীভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন-এসব ঘটনার বিবরণ দিই। আমিও যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম, তা-ও উল্লেখ করি।
হঠাৎ করে বাদামি চোখ দুটো কুঁচকে যায় ও তার চেহারা শক্ত হয়ে যায়। তিনি ক্ষোভে বলে ওঠেন, আমাদের প্রতিদিনই ধ্বংসস্তুপ থেকে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে মৃত শিশুদের নিথর দেহ কুড়াতে হয়। এখন তোমরাও কিছুটা আঁচ করতে পারবে আমাদের কেমন লাগে এবং প্রতিনিয়ত আমরা কী বীভৎস ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি।
খুব শক্ত ও দৃঢ় কথা। বক্তব্যের খুব গভীরে ঘৃণা ও বেদনা লুকানো ছিল। সেখানে তখন এতই বেদনা ও কষ্ট বিরাজ করছিল যে আমি হতাশ হয়ে গেলাম। পরে তিনি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে লকারবি তদন্ত দলের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। তবে নিউক্যাসল থেকে প্রকাশিত সানডে সান ও আমাদেরই আরেকটা প্রকাশনা স্কটল্যান্ড সান-এ উল্লেখিত জিব্রিলের প্রস্তাবের প্রতি কেউই সাড়া দেয়নি।
আমি তার সঙ্গে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করলাম। সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে আমার পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব হয় এবং তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরে ব্যথাটা কমে আসে। আমি সত্যিই জানি না কীভাবে আমি সেখান থেকে হোটেল রুম পর্যন্ত ফেরত আসি। ব্যথায় আমার নাড়িভুড়ি ছিড়ে আসতে চাচ্ছিল।
আমি বুঝতে পারিনি কী কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, দামেস্কে আমি খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করেছি। সালাদ-জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেছি। বোতলজাত পানি দিয়ে দাঁত মেজেছি। পানীয়তে কোনো প্রকার বরফ মেশাইনি। এক দিন পুরোটা আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। কিছুটা ভালো অনুভূত হলে কোনোমতে বিমানবন্দর পৌছে সোজা সাইপ্রাস চলে আসি। আমার সন্তানের বাবা দাউদ জারোজার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে নিকোশিয়ার একটি ক্লিনিকে নিয়ে আসেন।
কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার গত কয়েক দিনের খাদ্যতালিকা যাচাই করে দেখেন। আমার মনে পড়ে, স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি আইসক্রিম খেয়েছিলাম, যা দেখতে ছিল খুবই সুস্বাদু। নিজেকে তখন মনে হচ্ছিল আস্ত একটা গর্দভ। আইসক্রিমের পুরোটাই যে পানি দিয়ে তৈরি, তা কখন ভুলে গেছি।
আইসক্রিমের অর্ধেকের বেশি উপাদান যে পানি, তা আমার মনে পড়েনি। স্থানীয় বাজার থেকে বোকামি করে এক গ্লাস পানি খাইনি, এই তো বেশি।
দামেস্কের অভিজ্ঞতার পর থেকে দেশের বাইরে গেলে খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমি বেশ সতর্ক থাকি। ইসলামাবাদে এসেও অনেক বাছবিচার করে খাবার বেছে নিচ্ছি। সকালবেলা দুটো ডিমভাজি, ব্যস এর থেকে বেশি কিছুর দরকার পড়ে না। যদিও আমার হোটেলের সব ব্যবস্থা আধুনিক, তবে প্রান্তিক অঞ্চলে শৌচাগারের অবস্থা খুবই করুণ। কোথাও কোথাও হয়তো চার দেয়ালঘেরা শৌচাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই। খোদা না করুক, যদি কখনো কোনো উন্মুক্ত জলাধারে খোলা জায়গায় বসে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে হয়, কী শোচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হব, তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমার নাশতার পর্ব শেষ হতেই ডেভিড এসে হাজির। চেহারায় দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির ছাপ ছিল স্পষ্ট। দুই টিউব টুথপেস্ট নিয়ে এসেছে সে। গতকাল সে রাত চারটার পরে অবতরণ করে। পাশা তখনো ওকে গ্রহণ করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। পাশাকে দেখে ডেভিডের মন ভালো হয়ে যায় বলে জানায়। দূর পরবাসে পরিচিত মানুষের সাক্ষাৎ মনে কী যে আনন্দের সঞ্চার করে, তা বলে বোঝানো কঠিন।
গল্প করার জন্য বেশি সময় পাওয়া গেল না। ওকে এক্ষুনি পেশোয়ারের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে।
আমি সংগ্রহে থাকা খাইবার পাসের ওপর একটি বই ডেভিডের হাতে তুলে দিলাম। ওকে বললাম, পাকিস্তান এলে একবার খাইবার পাসের অসাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা নেওয়া উচিত। ডেভিড বয়সে এখনো যথেষ্ট তরুণ। অত্যন্ত চমত্তার পুরুষ মানুষ। মাথায় হাজার কাজের চাপ থাকলেও খুব আয়েশি ভঙ্গিতে কাজ করতে সিদ্ধহস্ত। ওর এই ধীরস্থির ভাবের জন্য ওর পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ ডালভাতের ব্যাপার। সারা দিনই ও অফিসের ডেস্কে বসে থাকে। হয় ওর কোনো আপনজন নেই অথবা ও খুব কাজপাগল। সারা দিন ডেভিডের অফিসে কাটানোর বিষয়টা আমি ভালো করেই জানি। কারণ, আমি নিজেও একই কাজ করি।
পাশাকে এক দিনের ছুটি দিতে চাইলাম। তবে ও স্বেচ্ছায় ডেভিডকে নিয়ে আশপাশে ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নিল। ডেভিড নিজের মানুষ খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মাঝেমধ্যে পাশাকে পাঠিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে ওর প্রতি আমার অগাধ আস্থা। অন্তত এখন পর্যন্ত ফ্লিট সড়কের ছিদ্রান্বেষী সাংবাদিক দলের কুপ্রভাব ডেভিডের ওপর পড়েনি।
অনেক দিন পরে শুয়ে-বসে অলস সময় কাটালাম। আমার অল্প কয়েকটা পরিধেয় নতুন বস্ত্র ব্যাগে গোছানো ছিল। অধিকাংশ কাপড় হোটেলের লন্ড্রিতে। তাই গাফফারের দেওয়া উসামা বিন লাদেন লেখা একটা টি-শার্ট পরে দিনটা পার করে দিলাম।
প্রায় সারা দিন ধরে এক লোেক আমার দরজায় নক করে বিরক্ত করল। কোনো কিছু লাগবে কি না, আমি হোটেল কর্তৃপক্ষের সেবায় সম্ভষ্ট কি না, এসব হাবিজাবি ব্যাপার। পুরুষ মানুষ যদি আরেকটু সোজাসাপটা কথা বলতে শিখত, ওদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে যেত। হোটেল বয়টা চাইলে আমার কোনো পানীয় লাগবে কি না জানতে চাইত এবং একটা চুরুট চাইতে পারত। সরাসরি বললেও আমি রাজি হতাম না, তবে বিরক্তির পরিমাণটা একটু হলেও কমত।
যা-ই হোক, কয়েক ঘণ্টা পরে দরজায় ঠোকাঠকি একদম বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা আরও একবার বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত করলে দরজা খুলে আমি একই বক্তব্য শুনতে পাই, আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে। কি না। একটু রাগী স্বরে বললাম, হ্যা দরকার আছে। এক ব্যাগ স্যানিটারি ন্যাপকিন এনে দাও। আমার মাসিক শুরু হয়েছে। ব্যস! ওই বয় ভুলেও আর আমার দরজামুখখা হয়নি।
ইসলামাবাদ ছেড়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। মানুষটাকে নিয়ে কেন যেন উৎসাহী হয়ে ওঠি। সপ্তাহজুড়ে আমরা মুঠোফোনে খুদে বার্তা চালাচালি করি। আমার বিশ্রাম নেওয়ার দিনে একটা বার্তা পেলাম ওর কাছ থেকে। দিনকাল কেমন কাটছে? ব্যস, এতটুকুই।
জবাবে সানডে টাইমস-এ আমার প্রকাশিত নিবন্ধের ব্যাপারে ওর মতামত জানতে চাই। ভেতরে ভেতরে ওর কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা করলেও সত্যিই নিবন্ধটার ব্যাপারে ওর মতামত জানতে চাই। জবাব দেখে আমি ভিরমি খাই। সুন্দর করে লিখেছে, পত্রিকা কেনার প্রয়োজনবোধ করিনি। ব্যাটার ভাগ্য ভালো যে আমি ইসলামাবাদে ছিলাম এবং ফোন ধরে ঝগড়া বা তর্ক করার ইচ্ছা জাগেনি। শুধু বড় ভুল করেছ’ লিখে দিলাম।
বাড়িতে ফেরত আসার পরও ও আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। কথা চালিয়ে যেতে আমি খুব আগ্রহ পাইনি। তার কিছু বোঝার ক্ষমতা ছিল না, ঠিক যেমন অধিকাংশ পুরুষের থাকে না। পত্রিকা একরকম জীবনের মতো। ডেইজি আসার আগ পর্যন্ত পত্রিকাই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের, বিশ্বস্ত সঙ্গী। প্রেমিক ও স্বামীরা এসেছে এবং চলেও গেছে। কিন্তু তাদের কারোরই সাধ্য ছিল না আমার জীবনে পত্রিকার গুরুত্বের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার।
পত্রিকার কাজ আমার জন্য বেশ ভালো একটা উপার্জনের পথ। এখানে সহমর্মিতা আছে, উত্তেজনা, আতঙ্ক, শিহরণ, ভালো খাবারদাবার-সবকিছুই হাত ধরাধরি করে চলে। কাজের সুবাদে আমি বড়সড় একটা বন্ধুমহল ও পরিজন পেয়েছি। ডেইজিকে আমি নিঃশর্তভাবে ভালোবাসি। তাই সকালবেলা সুন্দর একটা নাশতা, একটু আদর ও সঙ্গীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর মুহূর্তগুলোর অভাব অনুভূত হচ্ছে প্রতিদিন।
পুরুষদের চিন্তাধারা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ওদের বোঝার চেষ্টা বন্ধ করেছি, সে-ও অনেক আগের কথা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে রমণীমোহন পুরুষ হওয়াটা অনেক কঠিন একটা কাজ। মেয়েরা যেমন ভিতুদের পছন্দ করে না, তেমনি বখাটে ছেলেরাও তাদের দুই চোখের বিষ।
তিনবার সংসার করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি নিতান্তই একজন সাংবাদিক ও মমতাময়ী মা হয়ে বাঁচতে চাই। এদের মধ্যে সমন্বয় করে চলতে হবে, যতটুক আমার পক্ষে সম্ভব। সম্প্রতি আমার খুব ভালো বন্ধু বেরি আটওয়ানের সঙ্গে একই সঙ্গে ডিনার সেরেছি। বেরি লন্ডনভিত্তিক আরবি দৈনিক আল কুদস-এ চাকরি করে। খেতে খেতে আমার সাবেক সঙ্গীদের প্রসঙ্গও উঠে আসে। আমার মনে হয়, মধ্যস্থতা করে বিয়ে করা যে খারাপ জিনিস নয়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমি। বেরি কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে খুব সাধারণভাবে তাকিয়ে থেকে মুখটা সোজা রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। পরমুহূর্তেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে যে কজন সাংবাদিকের, তাদের মধ্যে বেরি একজন। তাই এ বিষয়ে ওকে নিয়মিত মন্তব্য করে বেড়াতে হয়। ১১ তারিখের পর থেকে কোনো না কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় বেরিকে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। এই কুখ্যাত ব্যক্তির বিখ্যাত সাক্ষাৎকার নেওয়ার কয়েক মাস পরই ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্য গণমাধ্যমকর্মীদের মতোই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রতিবেদন করতে চেয়েছিলাম আমি। তবে ভেতরে ভেতরে বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার একটা ইচ্ছা পোষণ করে রেখেছি। আসার আগে কয়েক দফা বেরির থেকে পরামর্শও নিয়েছি। বেরির ভাষ্যমতে বিন লাদেন একজন খুবই সাবধানী মানুষ। তাঁর কাছে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস এমনকি হাতঘড়ি পরে যাওয়াও বারণ। আফগানিস্তানে অনেক লোকই আমাকে বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে পারবে বলে বেরি জানায়। তবে এসব মধ্যস্থতাকারীর অধিকাংশই কেবল ফাঁকা বুলি আওড়াবে। তাই এই বিপজ্জনক কাজ করার আগে আমাকে খুব সতর্ক থাকতে উপদেশ দেয় বেরি।
বুঝলাম, সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। আহমেদ জিব্রিলই আমাকে এক বছর ধরনা দেওয়ার পরে সম্মুখ সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিন লাদেন আরও বেশি সময় নিতে পারেন। তবে যত কিছুই হোক, ধীরেসুস্থে এগোলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব।
ধৈর্য ধারণের এক বিরল প্রতিভা আমার রয়েছে। জানি না এটা কতটুকু ভালো অথবা মন্দ, তবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা থাকলে আমি কখনোই হতাশ হই না অথবা সাহস হারাই না। অথচ যদি আগেই বুঝতে পারি যে কাজটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে সময় থাকতে থাকতে কেটে পড়ি আগেভাগেই।
ব্যর্থতা আমার পছন্দ নয়। কোনো বিষয় সম্পর্কে সহজেই আমি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি না। নেতিবাচক কাজও আমার কর্ম নয়। হতাশ আর ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটা দারুণ খেলায় মগ্ন হয়ে যাই। হায়েল মিলসের করা ১৯৬০ সালের বিখ্যাত ছবি পলিএনাতে প্রথম এ খেলাটার ব্যাপারে ধারণা পাই। যাঁরা এ বিষয়ে অবগত নন, তাঁদের বলছি, পলিএনা ছিল একটা এতিম বাচ্চা। কখনো মন খারাপ হলে ও আনন্দ আনন্দ খেলত। অর্থাৎ আনন্দের কিছু মনে করে দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করত। খারাপ কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেও ও মনে মনে আনন্দদায়ক কিছু চিন্তা করে বেড়াত-আমার মন খারাপের বিষয়গুলো ভুলিয়ে দাও। মাঝেমধ্যে ভাবি, তিনটা ব্যর্থ বিয়ে ও অসংখ্য স্বল্পমেয়াদি সম্পর্কের ইতিহাস থাকলে পলিএনা এসব ভুলে যেতে কী নিয়ে ভাবত? যা-ই হোক, এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে প্রবেশ করার ব্যাপারে ও সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কে জানে, হয়তো উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার গোপন ইচ্ছাটা পূরণও হয়ে যেতে পারে।