জালিয়াত

জালিয়াত

হায়, পল্লীর দুলালী, সে আজ কলিকাতার বধূ! বোধ হয় ভাবে—

হায় রে রাজধানী পাষাণ-কায়া।
বিরাট মুঠিতলে          চাপিতে দৃঢ়বলে,
ব্যাকুল বালিকারে নাহিকো মায়া।

প্রাণ তাহার কাঁদে–  

কোথা সে খোলা মাঠ          উদার পথঘাট
পাখির গান কই, বনের ছায়া!

কিন্তু ওই পর্যন্ত, ইহার বেশি আর কবিবরের মানসী-প্রতিমার সঙ্গে এই মেয়েটির কিছু মিলে না। তাহার কারণ বোধ হয় এই যে, প্রত্যেক ব্যাপারেই ইহার নিজস্ব মতামত খুব দৃঢ় এবং স্পষ্ট। যাহা ভাল লাগে তাহা চাইই; যাহা লাগে না, তাহা চাই না। সিঁদূরে আমের লোভে যেদিন গাছের মগডালে উঠিয়া জীবন সঙ্কটাপন্ন করিয়াছিল, সেদিনও ছিল এই কথা; আর আজ, ভাল না লাগার দরুন, কলিকাতা ছাড়া চাই বলিয়া যেসব ফন্দি-ফিকির মনে মনে আঁটিতেছে, তাহারও মূলে সেই একই কথা।

মেয়েটির নাম চপলা। নাম যখন রাখা হইয়াছিল, সে সময় সকলের দৃষ্টি ছিল ওর মায়ের কাঁচা সোনার রঙটির দিকে; এবং কাহারও আর সন্দেহ ছিল না যে, এমন মায়ের মেয়ের দেহলতাটির মধ্যে একদিন বিদ্যুতের চপলদীপ্তি শান্তশ্রীতে ফুটিয়া উঠিবে। মেয়েটি যেন তাহার স্বভাবসিদ্ধ অবাধ্যতার বশেই সবাইকে এই দিক দিয়া নিরাশ করিয়া দিল। কিন্তু তবু নামটা রহিল সার্থক। আকাশের বিদ্যুৎ কেমন করিয়া সত্যই যেন ওর শ্যাম দেহটুকুর মধ্যে আটক পড়িয়া গিয়াছে; তাই ওর মিহি ভ্রু দুইটি কথায় কথায় বিদ্যুৎস্ফুরণের মতো অত কুঞ্চিত হইয়া উঠে, কালো চোখের তারা অত চঞ্চল এবং ঠোঁটের কোণে আচমকা হাসি ফুটিয়া একটু রেশ না রাখিয়াই অমন হঠাৎ মিলাইয়া যায়।

কনে দেখানোর সময় বাপ পরিচয় দিয়াছিলেন, বড় শান্ত লক্ষ্মী মেয়ে আমার—এ কিছু বড়াই করে বলছি না। বাড়ির বাইরে পা দিতে জানে না, কলকাতায় বিয়ে হবার জন্যে যেন তোয়ের হয়ে জন্মেছে।

আগাগোড়া বানানো কথা। ওর বাড়ি ছিল সদর-রাস্তা, বন-বাদাড়, দীঘির ধার। এখন সেখান হইতে তাহারা সর্বদাই ওকে যেন কান্নার সুরে ডাকিতে থাকে।

আদুরে দুষ্টু মেয়ের মত অত্যাচারের দাগ স্নেহের পরতে পরতে আঁকা, আসন্ন বিচ্ছেদের সময় সেগুলো রাঙাইয়া উঠে। তবুও মেয়ের বাপ, তাঁহাকে বলিতেই হয়, “বুঝেছেন কিনা, আমার মা’র মতন শান্ত মেয়ে দুটি পাবেন না, এ কিছু নিজের মেয়ে বলেই যে বলছি তা নয়।”

প্রবঞ্চনা ধরা পড়িতে অবশ্য দেরি লাগে নাই। শ্বশুর আপিস হইতে ফিরিয়া বাড়ির চৌকাঠ ডিঙাইয়া সঙ্গে সঙ্গেই ডাকেন, “কই গো, আমার শান্তশিষ্ট মা-টি কোথায় গেলে?”

চপলা যেমন ভাবে যেখানেই থাকুক, লঘুগতিতে আসিয়া হাজির হয়। লঘুগতি কথাটা মোলায়েম ভাবেই বলা গেল, আসলে শ্বশুরের এই ডাকটিতে কলিকাতার অষ্টাবক্র বাড়িখানি হঠাৎ চপলার পক্ষে ঋজু সরল হইয়া যায়, কঠিন বিলাতী মাটির মেঝে বেলপুকুরের মাটির মতো পায়ের নীচে পরম স্নিগ্ধ মিঠা হইয়া উঠে। সে এক রকম গোটাকতক লাফেই শ্বশুরের নিকট আসিয়া পৌঁছায়, আবদারের ভর্ৎসনায় চক্ষের তারকা নাচিতে থাকে, চাবির গোছাসুদ্ধ আঁচলটা মাটি হইতে তুলিতে তুলিতে বলে, “না বাবা, আজ আপনি বড্ড দেরি করেছেন, তা বলে দিচ্ছি, হ্যাঁ।”

দেরি যে রোজ হয়ই এমন নয়; তবে এই মিলনটুকুর মূল্য অনেক; তাই উৎকণ্ঠার বশে পুত্রবধূর রোজই মনে হয়, বড় দেরি হইয়া গিয়াছে। তাহারই রোজ অনুযোগ।

শ্বশুর রোয়াকে নির্দিষ্ট ইজি-চেয়ারটিতে দেহখানা এলাইয়া দেন। বধূ পাখা আনিয়া হাওয়া করে, পায়ের কাছে বসিয়া জুতার ফিতা খুলিয়া পা দুইখানি খড়মের উপর বসাইয়া দেয়, চাদর খুলিয়া জামা নামাইয়া ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া রাখে।

ধীরে ধীরে এই সব চলে আর গল্প হয়, “ঠিক হল বাবা? বড্ড যেন দেরি হয়ে যাচ্ছে; আমার আর মোটেই ভাল লাগছে না আপনার এই কলকাতা, হ্যাঁ।”

“আর দেরি নেই মা, একটা বাড়ি ঠিক হয়েছে, খালি হলেই আমরা উঠে যাব।”

শ্বশুর-বউয়ের পরামর্শ পাকা হইয়া গিয়াছে, কলিকাতায় আর থাকা হইবে না। কলিকাতার বাইরে বেশ পাড়াগাঁ দেখিয়া বাড়ি দেখা হইতেছে, ঠিক হইলেই সব উঠিয়া যাইবে।

বধূকে শ্বশুর কোলের কাছে টানিয়া লন, মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলান, করতল হইতে স্নিগ্ধ আশীর্বাদ ঝরিতে থাকে। বাৎসল্যের প্রবঞ্চনায় মুখে শান্ত হাসি ফুটে, ভাবেন, এই দীর্ঘায়িত আশার মধ্য দিয়া পাড়াগাঁয়ের স্বপন কাটিবে, ক্রমে এই বাড়িরই ইটকাঠের সঙ্গে মনটা মায়ায় মায়ায় গাঁথিয়া যাইবে।

স্বপ্ন কিন্তু কাটে না, বরং মনটা এদিকে বিরূপ হইয়া সেই স্বপ্নকেই মায়ার পাকে পাকে জড়াইয়া ধরে।

অনামধেয় একটা জায়গা; কিন্তু কেমন করিয়া যেন মনের পটে তাহার একটা স্পষ্ট ছবি আঁকিয়া গিয়াছে। বেলপুকুরের সঙ্গে অনেকটা মিলে, ভিজে ভিজে কালচে মাটি, এখানে ওখানে গাছপালার ঘন সবুজ দিয়া ঢাকা, উপরের আকাশের নীল আস্তরণখানি উবুড় হইয়া পড়িয়াছে, পাশাপাশি দুইটি কোঠাঘর, সামনে পাকা রোয়াক, বিকালের পড়ন্ত রোদটি সেখানে জ্বলজ্বল করিতে থাকে। ওদিক পানে রান্নাঘর, সকাল-সন্ধ্যায় তাহার গোলপাতার ছাউনি ফুঁড়িয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে। পাকা ঘরের পাশ দিয়া রাস্তা। সেটা সদরদুয়ারের চৌকাঠ ডিঙাইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে, ডাইনে জামরুল গাছের নীচে দিয়া। বাঁয়ে কাহাদের পুকুর, তাহার পুরানো ঘাটের শেষ রানায় কাহাদের ঘোমটা-টানা বউ বাসন মাজে, তাহার শাড়ির রাঙা পাড়ে আর ছোট রাঙা ঠোটের মাঝখানে নোলকটি দুলদুল করে। কে সমবয়সী আসিল, বউ হাতের উলটা দিক দিয়া ঘোমটা উঁচু করিয়া হাসিয়া কথা কয়।

আর কিছু দূরে লতা-জড়ানো পুরানো আমগাছের দুই পাশ দিয়া রাস্তাটা ফিরিয়া দুই দিক দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে, আমগাছের শিকড়ের কাছে ইট নুড়ি খোলামকুচি রাংচিতের পাতার ছড়াছড়ি, তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট পায়ের দাগ। মনটি এইখানেই আটকাইয়া যায়, যেন নিজেকেই দেখা যায়, গাছের তলায় লুব্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে।

অন্যমস্কতা হইতে হঠাৎ সজাগ হইয়া বধূ হাসিয়া বলে, “তা বলে আপনি যেন ভাববেন না বাবা, আমি কচি মেয়েদের মতো পাড়ায় পাড়ায় খেলাঘর রচে কাটাব—সে ভয় আপনার একটুও নেই বলে দিচ্ছি। কিন্তু দেরি করলে হবে না, হ্যাঁ।”

মন ভুলাইবার দিকে স্বামীর চেষ্টারও ত্রুটি নাই। ছোট বোন ক্ষান্তমণির উপর হঠাৎ অত্যধিক স্নেহপ্রবণ হইয়া পড়িয়াছে। বলে, “ক্ষেন্তী, চিড়িয়াখানায় একটা নতুন জন্তু এসেছে, যাবি নাকি দেখতে?”

ক্ষান্তমণি উৎসাহের সহিত বলে, “হ্যাঁ, যাব!” তারপর হঠাৎ একটু সঙ্কুচিত হইয়া মিনতি করে, “একটা কথা রাখবে দাদা?”

“কি কথা আবার?”

“বউদিকেও—।” আর শেষ করিতে সাহস করে না।

“হ্যাঁ, অত লোকের ঝক্কি বওয়া—সে আমার কুষ্টিতে লেখে নি।”

এই করিয়া চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হইয়া গিয়াছে! রাত্রে স্বামী উৎসাহভরে বলে, “এইবার কি দেখবে বল—ডালহৌসী স্কোয়ার, হাওড়া স্টেশন?”

বধূ নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া বলে, “কিছু না।”—বলিয়া ফিরিয়া শোয়।

অনেক সাধাসাধি চলে, “কলকাতায় এত দেখবার জিনিস রয়েছে, দেশ-বিদেশ থেকে লোক আসছে দেখতে—গড়ের মাঠ, গঙ্গার জাহাজ, কত বড় বড় বাড়ি, ওপরে চাইতে গেলে ঘাড় উলটে পড়ে—”

“পড়ুক গিয়ে ঘাড় উলটে যার সাধ আছে, আমার কলকাতার কিচ্ছু ভাল লাগে না; আমায় বাড়ি দিয়ে এস।”

“কলকাতার কিছুই ভাল লাগে না। আমরাও তো কলকাতার—আমি তো—”

ঝাঁজিয়া উত্তর হয়, “তোমাদের কাউকেও ভাল লাগে না; যারা কলকাতা ভালবাসে, তাদের দু চক্ষে দেখতে পারি না।”

দারুণ নিরাশার কথা।

পরের দিন ভগ্নীস্নেহে আবার জোয়ার আসে। প্রশ্ন হয়, “কই রে ক্ষেন্তী, শিবপুরে রামরাজাতলার মেলা ফুরিয়ে এল, একদিনও তো গেলি নি? দিব্যি পাড়াগেঁয়ে পাড়াগেঁয়ে জায়গাটি, আমার তো বড্ড ভাল লাগে।”

আজ তিন বৎসর দাদার খোশামোদ করিয়া ফল হয় নাই; বলিলেই ‘অজ পাড়াগাঁ, এঁদো ডোবা’ বলিয়া নাক সিঁটকাইয়াছে। আজ বিধি অত অনুকূল!

ক্ষান্তমণি হাতের কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া হাজির হয়, “হ্যাঁ দাদা, যাব। আর একটি কথা দাদা শুনবে? বউদিদিকেও নিয়ে চল দাদা, আমার দিব্যি। আহা, বেচারী গো, পাড়াগাঁয়ের কথা বলতে বলতে আত্মহারা হয়ে ওঠে।”

দাদা রাগিয়া বলে, “ওঃ–ই, আপনি পায় না, আবার শঙ্করাকে ডাকে! ওইজন্য কোথাও তোকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না।”

—রামরাজা কি বাতাই-চণ্ডীতলা হইতে ফিরিয়া ফল হয় উলটা। পিঁজরার পাখি একবার ছাড়া পাইয়া আবার পিঁজরায় বন্ধ হইলে যেমন অতিষ্ঠ হইয়া উঠে, মেয়েটির অবস্থা হয় সেই রকম। প্রাণটা আইঢাই করে। প্রতিমুহূর্তে বেলপুকুরের কোনো না কোনো একটা ছিন্ন দৃশ্য চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে; কথায় কথায় ভুল হয়, ঝিকে ডাকিতে বাপের বাড়ির দাসী পদীপিসির নাম মুখে আসিয়া পড়ে; ননদকে ডাকিতে বাহির হইয়া পড়ে, ‘সই!’

ননদ দুই-একবার ভুলটা ভুলের হিসাবেই ধরে, শেষে ‘এই যে আসি সই’ বলিয়া হাসিতে হাসিতে সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। বলে, “মরণ! বলি তোমার হয়েছে কি আজ? দাদা এলেই বলব, তোমার বুনো হরিণকে বনে ছেড়ে দিয়ে এস।”

বন্য মৃগ নিজেই সে ব্যবস্থায় তৎপর হইয়া উঠে; কলিকাতায় থাকা চলিবে না, কোনমতেই নয়।

শ্বশুরকে বলে, “আমি বলছিলাম বাবা—”

“হ্যাঁ মা, বল।”

“এই বলছিলাম, মাস তিনেক পরেই তো আপনি কাজ নিয়ে কমাসের জন্যে ঢাকা চলে যাবেন! এর মধ্যে আমাদের আর নতুন বাসা করে কাজ নেই। আপনারও অসুবিধে বাবা, আর বাসা-বদলির একটা হিড়িকও তো কম নয়, খরচও এতগুলি, এই মাগি-গণ্ডার দিন—”

শ্বশুর নিজের চিকিৎসার এ রকম আশু সাফল্যে উল্লসিত হইয়া উঠেন, শুধু পাড়াগাঁয়ের নেশা কাটিয়া যাওয়া নয়, সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণীপনার গাম্ভীর্য আসিয়া পড়া একেবারে। বধূর মাথাটি নিজের বুকে চাপিয়া বলেন, “ঠিকই তো মা। দেখ তো, কথাটা আমার মাথায়ই ঢোকে নি। আর বুড়ো হতে চললাম, এইবার মা-ই আমাদের বুদ্ধি দেবে কিনা। আমি তা হলে ওদের খোঁজাখুঁজি করতে বারণ করে দোব। ঢাকা থেকে ফিরে আসি, তখন বরং একটা পাকা রকম ব্যবস্থা করা যাবে, কি বল?”

“হ্যাঁ।”—বলিয়া শ্বশুরের বুকে মাথাটি আরও গুঁজিয়া দেয়। ক্ষণেকের জন্য বোধ হয় একটু দ্বিধা আসে, সেটুকু কাটাইয়া ধীরে ধীরে আরম্ভ করে, “তাই বলছিলাম বাবা—”

“হ্যাঁ মা, বল—বল।”

“এই বলছিলাম, ততদিন না হয় আমাকে একবার বেলপুকুরেই রেখে আসুন না।”

রোগটা মজ্জাগত; অমন ভাবে নিরাশ হইয়া চিকিৎসক হাসিবেন, কি কাঁদিবেন, স্থির করিতে পারেন না। চিকিৎসার নূতন প্রণালী আবিষ্কার করিতে হয়। এই করিয়া দিন চলে। শ্বশুরের পাঠানোর যে সেরকম গা নাই—এ কথাটা ক্রমেই স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইয়া উঠে।

শাশুড়ির কাছে চালাকি করিতে সাহস করে না; কারণ শাশুড়ি ব্যাটা ছেলে নয়, এবং সেইজন্য, তাহার মতে, বোকা নয়! সোজাই কথাটা পাড়ে—বাপ, মা, ভাই, ছোট বোনটি এদের অনেক দিন দেখে নাই, তাই—”

শাশুড়ি চোখ কপালে তুলিয়া বলেন, “ওমা, অমন কথা বলো না বউমা। এই তো মোটে কটা মাস এসেছ, আমি সেই মোটে ন বছরের মেয়েটি শ্বশুরঘর করতে এলাম, আর ঝাড়া তিনটি বছর কাটিয়ে—”  

চপলারও আশ্চর্যের সীমা থাকে না। বলে, “এই কলকাতায় মা?”

“পোড়া কপাল! কলকাতা কোথা? তা হলে তো বাঁচতাম। শ্বশুর থাকতেন ডাহা পাড়াগাঁয়—মাঝেরপাড়া! নাইবে? সেই আধ কোশ ভেঙে ইচ্ছেমতী। খাবার জল চাই? সেই আধ কোশ ভেঙে ইচ্ছেমতী! গা ধোবে? সেই আধ কোশ—”

বধূ আর প্রাণ ধরিয়া শুনিতে পারে না। “ওইঃ বেড়ালটা বুঝি কি ফেললে গো!” বলিয়া হয়তো হঠাৎ সে স্থানত্যাগ করে।

স্বামীর উপর উপদ্রব হয়! সে বেচারী জর্জরিত হইয়া অভিমান করিয়া বলে, “বেশ তো, বাবাকে মাকে রাজী করাও; আমার রেখে আসতে কি? আমায় যখন ভালই বাস না, মিছিমিছি এখানে থেকে কষ্ট পাও কেন?”

অবাধে মিথ্যা বলে, একেবারে নির্জলা মিথ্যা, “বাবা মা তো খুবই রাজী। বাবা বললেন, আমার তো ছুটি নেই; অজিতকে বললেই বলবে, পড়ার ক্ষতি হবে, না হয়, আসুক না রেখে। মা বলেন, আমার আর কি অমত মা; আহা, এতদিন এসেছ, তবে আজকাল হয়েছে ছেলের মত আগে। তা তুমি ঠিক এই রকম করে মাকে বল তো। বল, মা, অত ঘ্যানঘ্যান করছে যখন, রেখেই আসি নয় দিন কতকের জন্যে; বাবাকে বলে দিও আমার কলেজের ক্ষতি হবে না।”

স্বামী অতটা বোকা নয়, এ ফন্দি খাটে না।

কয়েক দিন আবার মুখ অন্ধকার হইয়া থাকে; কথাবার্তা বন্ধ। যত সব বেয়াড়া আবদার ভাবিয়া স্বামীও কয়েক দিন বেপরোয়া ভাবাটা জাগাইয়া রাখে, তাহার পর তাহাকেই মাথা নোয়াইতে হয়। বলে, “যা হবার নয়, তাই ধরে বসে থাকলে চলবে কেন? বরং চল, দক্ষিণেশ্বর দেখিয়ে নিয়ে আসি, পাড়াগাঁকে পাড়াগাঁও, কলকাতা থেকে অনেক দূরও; বালি হয়ে গেলে বরং নৌকোও চড়া হবে; রাজী?” পরামর্শ আঁটা হয়; দুপুরে ক্ষান্ত যখন স্কুলে থাকিবে, চপলা গিয়া শাশুড়ির আদেশ চাহিয়া লইবে মিউজিয়াম দেখিবার নাম করিয়া।

বধূ জিজ্ঞাসা করে, “তোমারও তো কলেজ আছে?”

“আমার ঘণ্টাখানেক মাথা ধরবে, তারপর ক্ষেন্তী চলে গেলে ভাল হয়ে যাবে।”

কথাটা বুঝিতে একটু দেরি হয়, চপলা স্বামীর মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকে, শুধু ভূ-জোড়াটি অল্প অল্প স্ফুরিত হইতে থাকে। তাহার পর হঠাৎ খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠে, বলে “ও, বুঝেছি। বাব্বাঃ, তোমার দুষ্টু বুদ্ধ কম নয় তো!”

.

প্রশস্ত শান্ত গঙ্গায় নৌকা চড়িয়াই চপলার মনটা প্রসারিত হইয়া পড়ে। ও-পারে প্রকাণ্ড ঘাটের নীচে গিয়া নৌকা লাগে। নামিয়াই একহাঁটু করিয়া কাদা, এত বড় বিলাসিতা অনেকদিন তাহার ভাগ্যে জুটে নাই। পা টানিয়া টানিয়া চলিতে স্বামীর হাতটা চাপিয়া ধরে। বলে, “উঃ, বড্ড মজা, না?”

সিঁড়ি বাহিয়া সুবিস্তীর্ণ চত্বর, যে দিকটা ইচ্ছা হনহন করিয়া অনেকটা চলিয়া যায়, পায় পায় কতদিনের শৃঙ্খল যেন খসিয়া পড়িতেছে। মন্দিরে উঠে, সুগঠিত সৌম্য মূর্তির সামনে মাথা নোয়াইয়া থাকে অনেকক্ষণ; কিছুই প্রার্থনা করে না, পড়িয়া থাকার মুক্ত অবসর, তাই পড়িয়া থাকে। গঙ্গার ধারে ধারে পরিষ্কার চওড়া রাস্তা, ঘন আমগাছের মস্ত বাগান, পাতার গাঢ় সবুজে সবুজে যেন অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, পিছনে আয়ত পুষ্করিণী, বেলপুকুরের দীঘির মতো, একটু ছোট এই যা! ক্রমাগত ঘোরে, একটি মুক্ত বেগচঞ্চল প্রাণ প্রতি মুহূর্তে দেহতটে আসিয়া উচ্ছলিত হইয়া পড়ে—চপল অঙ্গবিক্ষেপে, প্রগল্ভ হাসিতে, কথার অসংযত স্বরে; মাঝে মাঝে পিছন ফিরিয়া চাহিয়া বলিয়া উঠে, “কই গো! ওমা, এখনও ওখানে। পুরুষের পা না?”

পুকুরের ঘাটে আসিয়া বসিল। পা দুলাইতে দুলাইতে পাশের লতাগুল্মের সঙ্গে স্বামীকে পরিচিত করিয়া দিতে লাগিল, “ওটা ঘেঁটু, ঘেঁটুফুল মহাদেব খুব ভালবাসেন, সত্যিকারের মহাদেব নয়- খেলাঘরের মহাদেব। আচ্ছা, এর মধ্যে অমূললতার গাছ কোথায় দেখাও দিকিন, কত বুদ্ধিমান দেখি! পারলে না তো? ওই দেখ, কলকে ফুলের গাছটার মাথার ওপর ওই হলদে হলদে—ভয়ঙ্কর বিষ মশাই। একটু যদি গেল পেটে তো বাড়তে বাড়তে—ওগো, কুচকম্বলের চারা—নিশ্চয়ই এক্কেবারে। নিয়ে আসি তুলে।”

উৎসাহের সঙ্গে নামিয়া ক্ষিপ্রগতিতে পুকুরপারে জঙ্গলের দিকে চলিল। ঝিরঝিরে- পাতা ছোট চারাগাছটি, হাওয়ায় নধর ডগাটি একটু একটু দুলিতেছে। কাছে গেল তুলিবার জন্য, ঝুঁকিয়া কি ভাবিয়া থামিয়া গেল, তাহার পর ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া আবার শানের বেঞ্চিটার উপর বসিয়া পড়িল।

স্বামী হাসিয়া বলিল, “কি হল আবার? খেয়ালী মেয়ে!”

“নাঃ, থাক্; কলকাতায় সেই মাটির টবে তো? আমার মতন দুর্দশা হবে বেচারীর।”

দুইজনেই খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। একটু পরে চপলা স্বামীর হাতটা নিজের কোলে লইয়া বলিল, “এক কাজ করলে হয় না? বলছিলাম—বলছিলাম, আমায় এই দিক থেকেই বেলপুকুরে রেখে আসবে?”

অজিত হাসিয়া দুষ্টুমির সহিত বলিল, “বেশ তো। টাকা?”

“আমার দু হাতের দুগাছা চুড়ি দিচ্ছি।”

স্বামী কি ভাবিয়া আবার একটু চুপ করিয়া রহিল; তাহার পর বলিল, “সে মন্দ কথা নয়; মাকে কিন্তু কি বলব?”

“সে আমি ভেবে রেখেছি, বলবে—নাইতে গিয়ে ডুবে গিয়েছে।”

আবার একটু চুপচাপ। চপলা তাগাদা দিল, “কই, কি বলছ?”

স্বামীর হঠাৎ একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল; কিন্তু মনের ভাবটা গোপন করিয়া হাসিয়া বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলিল, “উঃ, খাসা হয়; কিন্তু তারপর?”

“তারপর অনেক দূর গিয়ে ভেসে উঠব, আমায় একজন মাঝি তুলবে, একটু চোখ খুলে বেলপুকুরের নাম করব—নভেলে যেমন হয় গো—”

“নভেলে মিউজিয়ামের কোঠাবাড়িতে কেউ ডুবে মরে না। চল, ওঠ, বেলা পড়ে এল।” বলিয়া স্বামী উঠিয়া পড়িল।

শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী—সবাইকে বোঝা যায়। চপলা মনে মনে বলে, খুব চালাক সব; আচ্ছা, আমিও কম সেয়ানা নয়, দেখি!

বাবার কাছে গোপনে পত্র যায়—কাঁদুনিতে, মিথ্যা কথায় ভরা; এরা সব মারে-ধরে, চাবি দিয়ে রাখে—দু চক্ষের বিষ হয়ে আছি। কখনও কখনও এমন থাকে। পাড়ার মেয়েদের কাছে আমার আর মুখ দেখাবার জো নেই; যে-ই দেখে, বলে, ওমা, কেমন পাষাণ বাপ-মা গো! এতদিন হল মেয়েকে পাঠিয়েছে, একবার নিয়ে যাবার নাম করে না! ওই দুধের মেয়ে—

চিঠি যা আসে, তাহাতে এ সবের উত্তর হিসাবে কিছুই থাকে না; একরাশ উপদেশ থাকে মাত্র! চপলা মনে মনে বলে, চপীর ভাগ্যে সব সমান। আচ্ছা, বেশ।

গ্রীষ্মের দুপুরবেলা। শ্বশুর আপিসে, স্বামী কলেজে, ননদ স্কুলে! চপলা শাশুড়ি আর পিসশাশুড়িকে রামায়ণ পড়িয়া শুনাইতেছিল, তাঁহারা একে একে ঘুমাইয়া পড়িলেন। একটু পরে বই বন্ধ করিয়া বাহিরে আসিল। রামায়ণে তিনজন আসিয়া পঞ্চবটী বনে বাসা বাঁধিয়াছেন। ঠিক এই জায়গাটিতে শাশুড়িরা ঘুমাইয়া পড়িলেও চপলা বিন্ধ্যকাননের সেই অপূর্ব বর্ণনা শেষ না করিয়া উঠিতে পারে নাই। অযোধ্যার রামচন্দ্রর চেয়ে পঞ্চবটীর রামচন্দ্রকে বেশি ভাল লাগে। কাননচারিণী সীতার উপর একটা ঈর্ষামিশ্রিত সহানুভূতি জাগিয়া উঠিয়া মনটাকে তৃপ্তি আর অস্বস্তি—দুইয়েই ভরিয়া তোলে।

বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। চাওয়া যায় না। মনে হয়, সারা কলিকাতাটায় যেন আগুন লাগিয়াছে, উঁচু নীচু লক্ষ বাড়ির দেওয়াল বাহিয়া ছাত কুঁড়িয়া শিখা লকলক করিয়া উঠিতেছে—কি এক রকম সাদাটে নীল আগুন, যাহাতে একটু ধোঁয়ার স্নিগ্ধতা নাই। এই সময়ে বেলপুকুরের কথা বেশি করিয়া মনে পড়ে, দীঘির পাড়ে সেই অন্ধকার সপ্তপর্ণীগাছের তলা, কালো জলের উপর তরতরে ঢেউ।

“চিঠি আছে।” সঙ্গে সঙ্গে সদর-দরজায় পিয়নের মুঠির ঘা পড়িল। চপলা তাড়াতাড়ি নামিয়া যাইতে যাইতে দরজার ফাঁক বাহিয়া একখানি পোস্টকার্ড উঠানে আসিয়া পড়িল। বাবার চিঠি-শ্বশুরকে লেখা।

পড়িল। মামুলী চিঠি, তাহার বিশেষ উল্লেখও নাই। ‘আশা করি, বাড়ির সর্বাঙ্গীণ কুশল’-এর মধ্যে আর মামুলী আশীর্বাদে সে যতটুকু আসিয়া পড়ে।

স্বামীর পড়িবার ঘরে গিয়া বসিল। এটা সেটা লইয়া খানিকটা নাড়াচাড়া করিয়া আবার বাবার চিঠিটা লইয়া পড়িল। বাবার চমৎকার লেখা। এদের বাড়িতে কাহারও লেখা এমন নয়। বলিতে নাই—গুরুজন, কিন্তু শ্বশুরের লেখা তো একেবারে বিশ্রী! স্বামীর লেখাটা অত খারাপ নয় বটে, তবুও বাবার লেখার সামনে ঘেঁষিতে পারে না।

স্বামীর গানের খাতাটা টানিয়া লইয়া তুলনা করিতে লাগিল।—কিসে আর কিসে! ডাগর ডাগর ছাপার মতো অক্ষর, ওপরে ঢেউখেলানো মাত্রা, এ এক জিনিসই; স্বামী বলে, একটু কাঁচা লেখা। কি সব পাকা লেখা যে নিজেদের!

লেখার দিকে বাবার ঝোঁক ছিল বড্ড; চপলাকে লইয়াও অনেকটা চেষ্টা করিয়াছিলেন। একেবারে বাবার মতো লেখা হওয়া বরাতের কথা, তাহা হইলেও স্বামীকে সে খুবই হারাইয়া দিতে পারে।

লেখার কথাতেও বেলপুকুর আসিয়া পড়ে। বাবা-মায়ের মধ্যে তর্ক হইতেছে। বাবা বলিতেছেন, চপীর লেখা দেখেই তো ওর শ্বশুর পছন্দ করে ফেললে।

মা বলিতেছেন, আর ওর অমন চোখ মুখ গড়ন বুঝি কিছুই নয়?

আজকাল শ্বশুরবাড়িতে নানা মুখে প্রশংসা শুনিয়া মায়ের গুমরের চোখ মুখ গড়ন সম্বন্ধে একটা কৌতূহল হইয়াছে, একটা সজ্ঞানতা আসিয়া পড়িয়াছে। টেবিলের উপর হইতে হাত-আরশিটা তুলিয়া লইয়া প্রতিচ্ছায়ার দিকে চাহিল—হাসি-হাসি সলজ্জ, যেন অন্য কাহার চোখ। বাপের বাড়ির আরশিতে এ রকম ছায়া পড়িত না; যত চায়, চোখ দুইটা যেন লজ্জায় ভরিয়া আসে।

“ছাই চোখ মুখ, ছাই গড়ন।” বলিয়া আরশিটা রাখিয়া দিল। অন্যমনস্ক হইয়া কলমটা লইয়া পোস্টকার্ড লিখিতে লাগিল,—”অনেকদিন যাবৎ আপনাদের কোনো সংবাদ না পাইয়া”–ঘাড় নাড়িয়া নাড়িয়া মিলাইতে লাগিল। বেশ একটু আদল আসে বাবার লেখার মতো। তবুও অনেক দিন অভ্যাস ছাড়িয়া গিয়াছে।

কি রকম একটা ঝোঁকের বশে লিখিতে লাগিল, অনেকদিন যাবৎ, অনেকদিন যাবৎ, দুই বার, চার বার, আট বার—দশ বারেরটা অনেকটা মেলে। এখনও আছে তফাৎ, তবে বাপের মেয়ের লেখা বলিয়া দিব্য চেনা যায় বটে। হঠাৎ কথাটা যেন মাথায় পাক দিয়া ঘুরিতে লাগিল, বাপের মেয়ের লেখা—বাপের মেয়ের লেখা—

চপলা আস্ত আস্তে কলমটা রাখিয়া দিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া দাঁতে নখ খুঁটিতে লাগিল। দৃষ্টি স্থির, ভ্রু দুইটি কুঞ্চিত হইয়া খয়েরের টিপটির কাছে একসঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে। ক্রমে তাহার বুকের ঢিপঢিপানিটা বাড়িয়া গেল, সমস্ত মুখটা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল এবং ঠোঁটের কোণে নিতান্ত অল্প একটু হাসির আভাস ফুটিয়া উঠিল। বাপের মেয়ের লেখা, আর যদি ওটুকু তফাতও মিটাইয়া ফেলা যায়!

মাথার মধ্যে একটি মতলব জাঁকিয়া উঠিতেছে, চপলা একমনে সেটিকে বেশ ভাল করিয়া পরিস্ফুট করিয়া তুলিল। একবার উঠিয়া একটু ঘুরিয়া আসিল। শাশুড়িরা অকাতরে ঘুমাইতেছেন। ঘড়িতে মোটে একটা বাজিয়াছে। স্বামীর কলেজ বোধ হয় আজ চারটা পর্যন্ত। এখনও ঢের সময়।

ঘরে আসিয়া পোস্টকার্ডটি সামনে, বইয়ের তাড়ার গায়ে হেলান দিয়া রাখিল, তাহার পর কতকগুলো কাগজ লইয়া ইস্তক শ্ৰীশ্রীদুর্গা সহায় হইতে শ্রী অখিলচন্দ্র দেবশর্মণঃ পর্যন্ত সমস্তখানি নকল করিতে লাগিয়া গেল।

দুইটা বাজিয়া গেল, আড়াইটা, তিনটা। কপালের ঘাম মুছিয়া মুছিয়া আঁচলখানি ভিজিয়া গিয়াছে। তা যাক; ওদিকে প্রত্যেক অক্ষরের বাঁক, কোনকান, মাত্রা একেবারে বাবার লেখার মতো হইয়া দাঁড়াইয়াছে, মেয়ে লিখিয়াছে বলিয়া চিনুক দেখি কে চিনবে!

তাহার পর আসল কাজ, যাহার জন্য এত মেহনত। বাপের চিঠি হইতে অক্ষর বাছিয়া একটা আলাদা কাগজে সন্তর্পণে লিখিল—”

পুনশ্চ। আর বৈবাহিক মহাশয়, আপনার বেহান কদিন থেকে একেবারে শয্যাধরা। একবার চপুকে দেখিবার জন্য বড়ই ব্যাকুল হইয়াছেন। শ্রীমান অজিত বাবাজীবনের সহিত অতি সত্বর পাঠাইয়া দেন তো ভাল হয়। ইতি—শ্রীঅখিলচন্দ্র দেবশর্মণঃ

কাগজখানি পোস্টকার্ডের পাশে একেবারে সাঁটিয়া ধরিল। অবিকল বাবার লেখা। চপলা লেখাটুকু আরও আট-দশ বার ভাল করিয়া মক্‌শ করিয়া লইল, তাহার পর সর্বসিদ্ধিদাত্রী দুর্গাকে স্মরণ করিয়া সমস্তটুকু বাবার পোস্টকার্ডে ঠিকানা লেখার দিকে খালি জায়গাটুকুতে সাবধানে লিখিয়া ফেলিল।

লিখিয়াই তাহার মুখটা শুকাইয়া গেল, কলমটা রাখিয়া বলিল, “ওই যাঃ!”

ঠিকানার কালির সঙ্গে এ কালির মোটেই মিশ খায় না। উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দুই পিঠ তুলনা করিতে লাগিল। না, স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে, আজকের সদ্য লেখা। এ চিঠি দিলেই তো সর্বনাশ! আবার না দেওয়াও বিপজ্জনক! এখন উপায়!

ভাবিতে ভাবিতে সে নিতান্তই বিচলিত হইয়া উঠিল এবং তাহার কাজটা ক্রমে একটা অপরাধের আকারেই তাহার মনে প্রতীয়মান হইয়া উঠিতে লাগিল। ব্যাকুল হইয়া বলিল, “এ কি করলে মা দুর্গা? তা হলে লেখাতে গেলে কেন অত করে মা?”

চপলার এখন বিশ্বাস, মা দুর্গা নিজের অন্যায়টুকু বুঝিতে পারিয়া হঠাৎ তাহার মাথায় আর একটু বুদ্ধি আনিয়া দিলেন। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়া বাক্স খুলিয়া একটি চিঠি বাহির করিল, কাল দুপুরে বসিয়া সইকে খানিকটা লিখিয়াছিল, এখনও শেষ হয় নাই! কম্পিত বক্ষে চিঠিটার ভাঁজ খুলিয়া পোস্টকার্ডে বাবার লেখার পাশে ধরিল, এক্কেবারে এক কালি। আশ্বস্ত হইয়া নিজের মনে বলিল, “মা যে বলেন, ভাল কাজে বিঘ্নি অনেক’, তা মিছে নয়। যাক, কেটে গেল।”

বিকেলে আসিয়া শ্বশুর অভ্যাসমতো জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কোনো চিঠি-ফিটি এসেছিল গা শান্ত মা?”

চপলা একটুও দ্বিধা না করিয়া উত্তর দিল, “কই, না তো বাবা।”“

একটু পুরানো হইয়া দুই রকমের কালির গরমিল মিটাইয়া চিঠিটা আসিল তাহার পরদিন; উঠানের এক পাশেই পড়িয়া ছিল, শাশুড়ি তোলেন। শ্বশুর বালিশের নীচে আপিসের চাবি রাখিতে গিয়া আপনিই পাইলেন। চপলা সেদিন বাড়িতে ছিল না তখন

পাশের বাড়ির হইতে বেড়াইয়া আসিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। কেমন যেন শ্বশুরের সামনে আসিতে পা উঠিতেছে না, বুকটা ধড়াস ধড়াস করিতেছে।

ডাক পড়িল—”কই গো, চঞ্চলা মাকে আজ দেখতে পাচ্ছি না কেন?”

যতটা সম্ভব সহজভাবেই আসিয়া দাঁড়াইল। “কি বাবা?”—বলিয়া মুখ তুলিতেই চোখের পাতা কিন্তু নামিয়া আসিল।

“অমন শুকনো কেন মা? আজ ঘুমোও নি, না? এঃ-ই, দেখেছ দুষ্টু পাড়া-বেড়ানী মেয়ের কাণ্ড!” কাছে টানিয়া লইলেন, “অসুখ করবে যে। বাবার চিঠি এসেছে, দেখেছ?”

“কই, না।”—চোখ তুলিতেই আবার সঙ্গে সঙ্গে নামিয়া পড়িল। মুখটাও একটু রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। শ্বশুর দেখিলেন, পাগলী মেয়ে বাপ লইয়া যান না বলিয়া চিঠির নামেই অভিমান; কটা দিনই বা সে আসিয়াছে, তাহা তো হিসাব করিয়া দেখিবে না।

বলিলেন, “এসেছে। আর তোমায় একবার যেতে লিখেছেন বেয়াই মশাই।” আসল কথাটি জানাইবেন কি না ভাবিতে লাগিলেন; কদিন থেকে শয্যাধরা, বেশ ভাবনায় কথা। বলিলেন, বেয়ান-ঠাকরুণের একটু অসুখ লিখেছেন। কিন্তু কেমন যেন একটু খাপছাড়া খাপছাড়া, হঠাৎ শেষের দিকে পুনশ্চ দিয়ে একটু লেখা। আর, এই সেদিন চিঠি এল, কিছু তো লেখেন নি! যাই হোক, অজিত গিয়ে একবার তোমায় রেখে আসুক।”

সফলতার আনন্দে শরীর-মনের সঙ্কোচটা কাটিয়া যাইতেছে; বুদ্ধিও খুলিতেছে। চপলা বলিল, “খাপছাড়া যে বলছেন বাবা, বোধ হয় মনটা সুস্থির নেই, তাই আগে লেখেন নি।”

বাপের অসঙ্গতির জন্য কন্যার দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করিয়া এবং অদ্ভুত জবাবদিহি শুনিয়া শ্বশুর হাসিয়া উঠিলেন; বলিলেন, “বাপ নিশ্চয় গাঁজাটাজা খায়, উল্টো-সোজা জ্ঞানগম্যি নেই।”

যাক, কথাটা চপলা পূর্বে অত খেয়াল করে নাই। বাবার গাঁজাখুরির অপবাদে যদি আপাতত ওটা চাপা পড়ে তো তাহার আপত্তি নাই।’

মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, “যান, ঠাট্টা করছেন আপনি।”

মনে পড়িল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয় নাই, যাহা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। প্রশ্ন করিল, “মার কি খুব অসুখ নাকি বাবা? আমার তো ভয়ে হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ যেতে বলা কেন বাপু!”—মুখটা বিমর্ষ করিবার চেষ্টা করিল! সরল আনন্দকে কৃত্রিম বিষাদে চাপা দিতে পারিল না। সেটুকু শ্বশুরের লক্ষ্য এড়াইল না, তবে বাৎসল্য নাকি নিজেকেই নিজে প্রবঞ্চিত করে, তাই ভাবিলেন, আহা, বড় ছেলেমানুষ, বাড়ি যাওয়ায় আহ্লাদেই ও এখন আত্মবিস্মৃত; ভালই, যত ভুলিয়া থাকে।

উত্তর দিলেন, “না, এই সামান্য একটু জ্বর। তবে দেখতে চাইছেন, দেখে এস একবার।”—মুখে সহজ প্রফুল্লতার ভাব টানিয়া রাখিবার চেষ্টা

বধূরও লক্ষ্য এড়াইল না। শ্বশুরকে প্রবঞ্চনা করার জন্য একটু অনুতাপও বোধ হয় হইল, আহা, বুড়া মানুষ, তায় গুরুজন। কিন্তু তখনই মনে পড়িল, আরও একটু প্রবঞ্চনা করা দরকার, উচিত হিসাবেও আবার ওই গোলমেলে চিঠিটা হস্তক্ষেপ করিয়া ফেলিবার জন্যও। বলিল, “কই, চিঠিটা তো দেখলাম না বাবা; কি লিখেছেন, দেখি না একবার। আমি যেন কিছু বুঝতে পারছি না বাপু।”

শ্বশুর বলিলেন, “হ্যাঁ, এই যে।”

এ পকেট সে পকেট খুঁজিলেন। বলিলেন, “কোথায় যে রাখলাম। দোব’খন খুঁজে। ভালই আছেন, এমন কিছু নয়! যাও, একবার পাঁজিটা নিয়ে এস দিকিন।”

ভাবিলেন, একেবারে ‘শয্যাধরা’ লেখা রহিয়াছে, চিঠিটা দেখানো ঠিক নয়। আহা, নিতান্ত ছেলেমানুষ এ ক্ষেত্রে একটু প্রবঞ্চনা করাই ভাল। করিলেনও।

বাক্সপত্র গুছাইতে গুছাইতে আবার হঠাৎ একটা কথা মনে উদয় হইয়া চপলার সর্বশরীর যেন শিথিল করিয়া দিল, শ্বশুর যে বাবাকে চিঠির উত্তর দিবেন। তাহা হইলেই তো সব কথা ফাঁস হইয়া যাইবে। আর তাহার পর যে লাঞ্ছনা, যে কেলেঙ্কারি, তাহা ভাবিতেও যে গা শিহরিয়া উঠে।

এমনই অসহায় অবস্থা যে, মা দুর্গাকে খোশামোদ করিলেও কোনো সুরাহা হইবার নয়। মরীয়া হইয়া ধিক্কার দিল, “এই ছিল তোমার মনে মা শেষকালে? তোমারও বাপের বাড়ি আছে, পাগলের মতো ছুটে আসতে হয়!”

যুক্তিটা নিশ্চয় মা দুর্গার মর্মে লাগিল। প্রথম ঘোরটা কাটিয়া গিয়া চপলার মাথাটা একটু পরিষ্কার হইল। শ্বশুরের কাছে গিয়া বলিল, “বাবা, বলছিলাম যে—”

“হ্যাঁ মা, বল।”

“এই বলছিলাম, আপনি বাবাকে চিঠিটা লিখে আমায় দিয়ে দেবেন, আমিও তার ওপর দুটো কথা লিখে ডাকে—”

“চিঠি লিখে তো কোনো ফল হবে না মা, তোমরা তো কাল সকালেই যাচ্ছ। তাই ভাবছি—”  

“হ্যাঁ বাবা, থাক্।”—একটি স্বস্তির নিশ্বাস পড়িয়া বুকটা হালকা হইল।

“তাই ভাবছিলাম, একটা না হয় টেলিগ্রাম—”

সর্বনাশ! চপলা একেবারে কপালে চোখ তুলিয়া বলিল, “টেলিগ্রাম!”

“হ্যাঁ মা, তাই ভাবছিলাম; কিন্তু হিসেব করে দেখছি, সেও তোমাদের গাঁয়ে তোমাদের আগে পৌঁছবে না।”

আর একটি স্বস্তির নিশ্বাস। বাবা, ফাঁড়া যেন কাটিয়াও কাটে না।

তাড়াতাড়ি বলিল, “হ্যাঁ, মিছিমিছি পয়সা খরচও, এই মাগি গণ্ডার দিন।”

বুদ্ধির জোয়ার নামিয়াছে। একটু থামিয়া বলিল, “আর এও তো ভেবে দেখতে হবে বাবা, মা’র অমন অসুখ, এর মধ্যে খবর করে বাড়িতে এক টেলিগ্রাম! শেষকালে কি হতে কি হয়ে পড়বে; আপনিই বলুন না? তার চেয়ে আমার হাতে বরং ভাল করে চিঠি লিখে দেবেন, আমি গিয়েই বাবাকে দিয়ে দোব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *