জালিম সিংহ – ফটিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
সে অনেক দিনের কথা৷ মুর্শিদাবাদ তখন বাংলা দেশের রাজধানী ছিল৷ মুর্শিদাবাদের মতো এত সৌভাগ্য সম্পদ তখন আর কোনো স্থানেই ছিল না-বাংলা দেশ যেমন ভারতের রাজলক্ষ্মী ছিল, মুর্শিদাবাদও সে সময় তেমনি দেশের রাজলক্ষ্মীর মতো ছিল৷ সরফরাজ খাঁ তখন ছিলেন মুর্শিদাবাদের রাজ-সিংহাসনে৷
আমাদের দেশের প্রধান চারিটি জাতির মধ্যে একটি জাতি ক্ষত্রিয়-ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ-বিগ্রহ করা-ভারতবর্ষের এমন একটা গৌরবের যুগ ছিল যখন এই ক্ষত্রিয়েরা তাহাদের বাহুবলে এবং সাহসে সমস্ত জগতেরই রাজা হইতে পারিয়াছেন৷ রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি কাহিনিতে এই সকল ক্ষত্রিয় বীরের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে৷
রাজপুতরা ছিলেন জাতিতে ক্ষত্রিয়৷ এমন বীর ও সাহসী জাতি জগতের আর কোথাও নাই!-দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এই রাজপুতরা হাসিতে হাসিতে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিত৷ আত্মসম্মানকে ইহারা সকলের চেয়ে বেশি বলিয়া মনে করিত৷ ইহাদের ছেলে-মেয়ে সকলেরই মন দেশপ্রেমে পূর্ণ ছিল! তাই একদিন রাজপুত জাতি ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল! কিন্তু দিন সকলের সমান থাকে না, এত বীর রাজপুতদের একসময়ে পতন হইল-কিন্তু তাহাতে মনের সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মসম্মান বোধ তাহাদের এতটুকু কমে নাই!
নবাব সরফরাজ খাঁর একজন সেনাপতি ছিলেন৷ তাঁর নাম বিজয় সিংহ৷ তিনি ছিলেন জাতিতে রাজপুত৷ তাঁর পূর্বপুরুষদের অনেকেই তাঁহাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়াছিলেন-তাঁহাদের পবিত্র রক্ত বীর বিজয় সিংহের দেহে প্রবাহিত ছিল৷
বিজয় সিংহ বিজয়ী সিংহের মতোই ছিলেন-যুদ্ধক্ষেত্রে কেহ তাঁহার মতো বীরত্ব দেখাইতে পারিত না৷ প্রভুভক্তি রাজপুত জাতির আর একটি প্রধান গুণ৷ বিজয় সিংহের বীরত্ব বলেই নবাব অনেকবার যুদ্ধক্ষেত্র হইতে জীবন লইয়া ফিরিয়াছেন৷
বিজয় সিংহের একটি পুত্র ছিল, সে স্বর্গের দেবশিশুর মতোই সুন্দর অথচ বজ্রভরা নবীন মেঘের মতো উজ্জ্বল-সাহসে তাহার মুখখানি ভরা-কালো বড়ো বড়ো চোখ দু-টি তাহার করুণায় ভরা, কিন্তু অপমান বোধে সে চোখ আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিত৷ বড়োই দুঃখের সময় তাহার জন্ম হইয়াছিল৷
গৃহহারা আশ্রয়শূন্য ভাবে তখন বিজয় সিংহ পথের ভিখারি হইয়াছিলেন৷ পরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করিলে হয়তো তখন তাঁহার দুঃখ দূর হইত; তিনি আবার সুখে থাকিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তাহা চাহিলেন না৷ মনে মনে ভাবিলেন, পথের ভিখারি হইয়া উপবাসে মরিব, তবুও পরের কাছে এ মাথা নীচু করিব না৷ অপরের পায়ে পেটের দায়ে মাথা নোয়াইয়া মান বিক্রয় করা অপেক্ষা মৃত্যুই রাজপুতদিগের নিকট বড়ো ছিল৷ চির-জনমের সঙ্গিনী তাঁহার ঘরের লক্ষ্মীকে লইয়া রাজপুত বীর সহস্র দুঃখ-বিপদভরা জগতে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন৷
দুই দিন এক মুঠা আহার তাঁহার জুটে নাই৷ একটি পাহাড়ের উপর ঝরনার ধারে বিজয় সিংহ বসিয়াছিলেন, কোলে মাথা দিয়া শুইয়াছিলেন তাঁহার চির-জনমের সুখ-দুঃখের সাথি তাঁহার সহধর্মিণী৷ কাল-রোগ তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছিল৷ জীবনের মধ্যে সেইদিন বিজয় সিংহ মনের দুঃখে কাঁদিলেন৷ আবার পাছে তাঁর স্ত্রী মনে কষ্ট পান এই ভয়ে তখনই চোখের জল মুছিয়া ফেলিলেন৷ মুক্তার মতো সে দু-ফোঁটা জল বুঝি বনে দু-টি সুন্দর ফুল হইয়া ফুটিয়া রহিল৷
সে কাল-রোগ সারিল না৷ সতী নারী তাঁর বুকের রত্নটিকে স্বামীর কোলে দিয়া সেই গভীর অরণ্যের ভিতরেই চিরদিনের জন্য চক্ষু মুদিলেন৷
পুত্রটির মুখের দিকে চাহিয়া বিজয়কে সমস্ত দুঃখ ভুলিতে হইল৷ সুকুমার বনফুলের মতো সুন্দর সে শিশুটি৷ বিজয় বলিলেন-দেবতা! আমার এই দুঃখের দিনে এই স্বর্গ-শিশুকে তুমি আমার কাছে পাঠাইলে কেন? নিষ্ঠুর পৃথিবীর দুঃখ-দৈন্য এ কি সহিতে পারিবে?
বন হইতে কাষ্ঠ আনিয়া বিজয় সহধর্মিণীর দেহ চিতায় তুলিয়া দিলেন৷ চিতা যখন জ্বলিয়া উঠিল তিনি তখন ছেলেটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া একদৃষ্টে সেই চিতার দিকে চাহিয়া রহিলেন৷ স্ত্রীকে তিনি প্রাণ ভরিয়া ভালোবাসিতেন৷ চিতা জ্বলিয়া ছাই হইয়া গেল; কিন্তু বিজয়ের মনের ভিতর হইতে তাঁহার পুণ্যময়ী সহধর্মিণীর স্মৃতি এতটুকু মলিন হইল না-বিজয় সিংহ ছেলেটির নাম রাখিলেন জালিম সিংহ৷
শিশু জালিমকে লইয়া বিজয় দেশে দেশে ফিরিতে লাগিলেন৷-অনেক দুঃখও সহিলেন৷ সেই দুঃখের ভিতরেই পিতার অসীম স্নেহভরা বুকে থাকিয়া জালিম মানুষ হইতে লাগিল৷ অতি শৈশবেই বিজয় তাহার কানে জাতীয় মন্ত্র দিলেন-মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন৷ সে মন্ত্র শিশুর কোমল হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়া গেল৷ অতি শৈশবেই সে তাহার দেশকে ভালোবাসিতে শিখিল৷ সে জানিল, তাহারা রাজপুত; বীরত্বই তাহাদের ধর্ম৷
বিজয় সিংহের ভাগ্য আর প্রসন্ন হইল না৷ দুঃখ-যন্ত্রনা সহিতে সহিতে পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি অবশেষে নবাবের সেনাপতিত্ব গ্রহণ করিলেন; কিন্তু আত্মসম্মানকে এতটুকু নীচু হইতে দিলেন না৷
একদিন গভীর রাত্রে জালিমকে করুণ ও দৃঢ়কন্ঠে বলিলেন-এক মুহূর্তের জন্যও আত্ম অপমান হইলে সে যেন বীরের ধর্ম পালন করিয়া জীবন বিসর্জন করে৷ হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দেশের দেবতা ক্ষেত্রপালের উদ্দেশে প্রণাম করিয়া সেই নিবিড় অন্ধকারভরা গভীর রাত্রে জালিম পিতার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইল৷
এই সময়ে দেশে যুদ্ধের বাজনা বাজিয়া উঠিল-পাটনার নবাব আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করিবার জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হইলেন!-নবাবের আদেশে নবাব-সৈন্যরা তাহাদের বাধা দিতে চলিল৷ দেশে বিষম হুলুস্থুল পড়িয়া গেল৷ কেহ-বা সাহসে নির্ভর করিয়া অস্ত্র হাতে লইয়া রণক্ষেত্রে চলিল-যুদ্ধে মরিয়া অমর হইবে বলিয়া-কেহ-বা ভীরু কাপুরুষের মতো প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিল৷ জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত জালিম সকল সময় পিতার সঙ্গে থাকিত৷ যুদ্ধক্ষেত্রেও সে পিতার সহিত যুদ্ধ করিতে যাইত৷ বিপুল আনন্দে বুকের ছাতি ফুলাইয়া ছোটো তরবারিখানি দোলাইতে দোলাইতে অশ্বপৃষ্ঠে জালিম পিতার সহিত এবারও যুদ্ধক্ষেত্রে চলিল-যাইবার আগে বিজয় তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন৷ যুদ্ধের পর হয়তো পিতা পুত্রে আর সাক্ষাৎ হইবে না৷ হয়তো বিজয় সিংহ চিরদিনের জন্য সেই পবিত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই ঘুমাইয়া পড়িবেন-জালিমের দুই চোখে জল আসিল-মুহূর্তে সে আপনাকে সামলাইয়া লইয়া পিতাকে প্রণাম করিল-তাহার পর সে তাহার তরবারিখানি দোলাইতে দোলাইতে গান গাহিতে লাগিল৷
যুদ্ধের ভেরি উঠিছে বাজিয়া সমরে যাইতে হবে-
দেশের পুত্র কে আছ তোমরা ছুটে এসো আজ সবে৷
আকাশে ফুটেছে অরুণ আলোক বাতাস যেতেছে বহি৷
দেশের লাগিয়া সমরে যাইব মোরা কভু হীন নহি৷৷
সোনার স্বদেশ স্বর্গ মোদের তার বাড়া কিছু নয়৷
দেশের লাগিয়া আহ্বান এল আর নাহি সময়৷৷
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন এই তো মোদের পণ৷
সমর-ক্ষেত্রে চলে ছুটে সব অসি বাজাইয়া ঝনঝন৷৷
জালিমের গান শুনিয়া সকলের মন উৎসাহে নাচিয়া উঠিল৷ সাহসে অসি ঝনঝন করিয়া সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে চলিল৷
গিরিয়ার সীমাহীন মাঠে-দুই পক্ষের সৈন্য যুদ্ধের জন্য সামনা-সামনি হইল৷ উপরে অনন্ত সুনীল আকাশ, নীচে দিগন্তহারা শ্যামল মাঠ৷ প্রান্তরের মাঝখান দিয়া গঙ্গা বহিয়া গিয়াছে৷ তীরে তীরে শীতল ছায়াভরা বনবীথি-সেখানে কত পাখি মনের সুখে গান করিতেছে৷ এমন শোভা বুঝি আর কোথাও নাই৷ এমন সুন্দর স্থানেই মানুষ মানুষকে হিংসা করিয়া মারামারি কাটাকাটি রক্তারক্তি করিয়া মরিবে!
যুদ্ধ আরম্ভ হইল৷ জালিম তাহার পিতার সঙ্গে সঙ্গেই সব সময় রহিল৷ কতবার বিপক্ষের হাত হইতে সে তাহার পিতার জীবন রক্ষা করিল৷ এই শিশু বীরের বীরত্ব দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইয়া রহিল৷ সৈন্যদের উদ্যম আরও বাড়িয়া গেল৷
বিজয় সিংহ নিজেও বুঝি জানিতেন না, এই তাঁর শেষ যুদ্ধ৷ তিনি ছিলেন অসমসাহসী, বীরপুরুষ৷ তাঁহার আশা ছিল এই যুদ্ধে তাঁহাদেরই জয় হইবে৷ কিন্তু বিপক্ষ সেনারা ছিল অধিকতর শিক্ষিত৷ তাহাদের পরাজয় করা ক্রমেই অসাধ্য হইয়া উঠিল৷ সে পক্ষে ছিলেন নবাব আলিবর্দি৷ তাঁহার মতো বীর এবং সহৃদয় নবাব আর কখনোই হন নাই৷
জালিমও বুঝিতে পারিল, পিতাকে সে আজ আর সমরক্ষেত্র হইতে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে পারিবে না৷ বুকখানা তাহার একবার কাঁপিয়া উঠিল৷ কিন্তু বীরের সন্তান সে৷ পরমুহূর্তেই সাহসের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল৷
বিজয় সিংহ বলিলেন, ‘দেখো জালিম, আমার দেহ যেন বিধর্মীরা নষ্ট না করে৷’ এই দারুণ নিষ্ঠুর যুদ্ধক্ষেত্রেও জালিমের চক্ষে জল আসিল৷
সূর্য তখন পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িয়াছেন৷ রাঙা আলোয় আকাশ বাতাস ছাইয়া গিয়াছে৷ মানুষের রাঙা রক্তও মাটির উপর দিয়া বহিয়া চলিয়াছে কোনো অজানিত মহাসাগরের দিকে৷ এমন সময় শত্রুর তরবারির আঘাতে অচেতন হইয়া বিজয় সিংহ মাটিতে পড়িয়া গেলেন৷ যুদ্ধে এমন বীরত্ব সেদিন আর কেহ দেখাইতে পারে নাই৷ মুহূর্ত মধ্যে জালিমের মনে পড়িল, পিতার সেই অনুরোধের কথা, চকিতে আসিয়া সে পিতার মৃতদেহের পাশে দাঁড়াইল-তাহার ক্ষুদ্র তরবারিখানি উন্মুক্ত করিয়া৷ দলে দলে সৈন্য আসিয়া তাহার উপর পড়িতে লাগিল৷ শিশু-বীর অসীম সাহসের সহিত তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে লাগিল৷
বীর আলিবর্দি বীরত্বের সম্মান করিতে জানিতেন৷ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে এই ব্যাপার দেখিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটিয়া আসিলেন৷ আদর করিয়া এই শিশু-বীরকে অশ্বের উপর তুলিয়া লইয়া তাহাকে অভিবাদন করিলেন, আদেশ দিলেন কেহ যেন বিজয় সিংহের মৃতদেহ স্পর্শ না করে৷
গঙ্গার তীরে চন্দন কাঠের চিতা জ্বালাইয়া চারিজন ব্রাহ্মণের সাহায্যে জালিম পিতার মৃতদেহের সৎকার করিল৷ চিতা জ্বলিতে আরম্ভ করিলে সে একদৃষ্টে সেই অগ্নিশিখার দিকে চাহিয়া রহিল৷ দেখিল যে তাহার বীর পিতা জ্যোতির্ময় রথে চড়িয়া, বীরের স্থান অক্ষয় স্বর্গে চলিয়া গেলেন৷ পিতার পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে প্রণাম করিয়া, জালিম কর্ম-কোলাহল-মুখর জগতের মধ্যে কোথায় মিশিয়া গেল৷ আজ সে জগতে একা-
জালিমও পিতার মন্ত্র লইয়াছিল, সে কখনো কাহারও নিকট মাথা অবনত করে নাই৷ তাহার দেশকে সে প্রাণ ভরিয়া ভালোবাসিত৷ পরের অনুগ্রহের নিকট আপনার আত্মসম্মান বিক্রয় করিয়া সে সুখের সন্ধান করে নাই৷ দেহে, মনে সে ছিল রাজপুতের সন্তান৷
জালিমের বীরত্ব কেহই ভুলে নাই৷ একদিন গিরিয়ার সমরক্ষেত্রে সে যে বীরত্ব দেখাইয়াছিল, আজিও তাহার কীর্তিগাথা লোকের মুখে মুখে গীত হইতেছে, সেই মাঠটিকে এখনও লোকে বলে-জালিম সিংহের মাঠ৷ এখনও গঙ্গা সেখান দিয়া বহিয়া যাইতেছেন, তীরে তীরে কুঞ্জ উপবনে পাখিরা এখনও গান গাহিতেছে৷ ধু-ধু মাঠে আকুল উদাস হাওয়া ‘হা-হা’ শব্দে বহিয়া যাইতেছে৷ সবই আছে, নাই কেবল সেই জালিম৷ কিন্তু চিরদিনের জন্য রহিয়াছে সেই রাজপুতের অসীম সাহস ও বীরত্ব৷