জায়োনিস্টরাই কি আর্মাগেডনের জন্ম দেবে

জায়োনিস্টরাই কি আর্মাগেডনের জন্ম দেবে

আর্মাগেডন একটি হিব্রু শব্দ, যা দ্বারা পৃথিবীর শেষ সময়ে ভয়ংকর একটি যুদ্ধের কথা বোঝানো হয়েছে। এই যুদ্ধে সৃষ্টিকর্তার সৈন্যবাহিনী এবং শয়তানের বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হবে। অনেক পণ্ডিত ও গবেষকের ধারণা অনুযায়ী—এই যুদ্ধের সমাপ্তি হবে মেগিড্ডো পাহাড়ের কাছাকাছি কোনো স্থানে, যা বর্তমানে ইজরাইলের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর প্রতিটি বড়ো বড়ো ধর্মে এই যুদ্ধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় পণ্ডিতগণ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবেন।

খ্রিষ্টান ধর্মে নিউ টেস্টামেন্টের বুক অব রেভালেশনের (১৬ : ১৬)-এ বলা হয়েছে—

‘অতঃপর তারা সবাই সে স্থানে একত্রিত হবে, যাকে হিব্রুতে বলা হয় আর্মাগেডন।’

কারা এই যুদ্ধে মুখোমুখি হবে, সে প্রসঙ্গে বুক অব রেভালেশনের ১৯ : ১১-১৬ তে বলা আছে, সাদা ঘোড়ার বাহনে চড়ে স্বর্গ হতে কোনো ব্যক্তি নেমে আসবেন, যিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শয়তানের সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হবেন এবং যুদ্ধে বিজয়ী হবেন। বাইবেলের লুক, মার্ক ও ম্যাথুর বিভিন্ন শ্লোকের পূর্বাভাষ থেকে বোঝা যায়—উল্লেখিত ব্যক্তিই হবেন যীশুখ্রিষ্ট।

ইসলাম ধর্মে পবিত্র কুরআনের সূরা আল কাহাফ ও বনি ইজরাইলসহ অসংখ্য হাদিসে পৃথিবীর শেষ সময় এবং আর্মাগেডনের কথা বলা হয়েছে। নবি ঈসা সাদা দুই মেঘের (ফেরেস্তাদের কাঁধের) ওপর ভর করে ধরণিতে নেমে আসবেন। অতঃপর ইজরাইলে পৌঁছে দজ্জাল বাহিনীকে সমূলে পরাজিত করবেন।

কিন্তু ইহুদি ধর্মে এমন কোনো যুদ্ধের নাম বলা হয়নি, যা আর্মাগেডন হতে পারে। তবে তালমুদে মসিহের কথা বলা হয়েছে, যিনি নতুন জন্ম নেওয়া ইজরাইলের বাদশাহ হিসেবে পৃথিবীতে আসবেন। তিনি আসার পর ইজরাইল সামরিক শক্তির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাবে এবং পুরো পৃথিবী শাসন করবে। বাইবেলের ভাষায়—ইহুদিদের এই মসিকে বলা হয়েছে অ্যান্টি-ক্রাইস্ট এবং ইসলামিক পরিভাষায় দাজ্জাল। এই যুদ্ধ কখন শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট করে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে পৃথিবীর শেষ সময়ে বহু নিদর্শনের কথা প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে ব্যক্ত করা হয়েছে।

এই আর্মাগেডন এমনই এক যুদ্ধ, যাতে জলবায়ুর ওপর ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসবে। পুরো আকাশ দীর্ঘ সময়ের জন্য ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে। সূর্যালোক দেখা যাবে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষের কারণে প্রচুর মানুষ মারা পড়বে। ধরণির জনসংখ্যা গত দুশো বছরে যেভাবে বেড়েছে, ঠিক সেভাবেই তা হঠাৎ করে কমে যাবে। ইজরাইলের পুনঃপ্রতিষ্ঠালাভ এই যুদ্ধের সময়কাল ঘনিয়ে আসার এক বড়ো ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অনেকে হয়তো বিভ্রান্ত হতে পারেন যে, এখানে কোন ইজরাইলের কথা বলা হচ্ছে? কারণ, সেই যে খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে তাদের ১০টি গোত্র অ্যাসিরিয়ানদের আক্রমণে হারিয়ে গেছে, তাদের তো কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি। আর বর্তমান ইজরাইলে যারা বসবাস করছে, তারা তো জুদাহ রাজ্যের কেবল দুটি গোত্রের উত্তরসূরি। তাহলে বাকিরা এ ভূমিতে কবে ফিরে আসবে?

মূলত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জানে না বা তার খবরও রাখে না—বাকি গোত্রের অধিবাসীদের খুঁজে বের করার কাজ নব গঠিত ইজরাইল খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে নিরন্তরভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। গত অর্ধ শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে এমন কিছু গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা নিজেদের ইজরাইলের হারিয়ে যাওয়া গোত্রের অধিবাসী বলে দাবি করেছে।

Simcha Jacobovici হলেন এ বিষয়ের ওপর একজন বিশেষজ্ঞ। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপরও তার রয়েছে অসামান্য জ্ঞান। ২০০৩ সালে Quest for the Lost Tribes শিরোনামে তিনি একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেন, সেখানে এ জাতীয় কিছু গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরেছেন। যেমন : তাদের পাওয়া গিয়েছে ইথিওপিয়ার সিমিয়ে পর্বতমালায়; ভারতের মনিপুর ও মুম্বাই; ইরানের ইস্পাহান ও মাশহাদে; সমরকন্দে। তবে আদৌ তারা হারিয়ে যাওয়া গোত্রদের প্রকৃত উত্তরসূরি কি না, তা নিয়ে খোদ ইজরাইলি প্রশাসনের মনেও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের একেবারে ফেলে দিতে পারেনি। বিগত কয়েক দশকে এমন প্রচুরসংখ্যক অধিবাসীকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইজরাইলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তাদের কে কোন গোত্রের সদস্য, তা যেহেতু এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তাই ইজরাইলি প্রশাসন আপাতত তাদের সবাইকে ইহুদি বলে নথিভুক্ত করছে এবং তাদের বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য নিয়মিত প্যালেস্টাইনিয়ানদের ভূমি দখলের প্রচেষ্টা চলেছে।

বেলফোর ঘোষণা

জেরুজালেম দখল জায়োনিস্টদের জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা। ১১ ডিসেম্বর, ১৯১৭ ব্রিটিশ কমান্ডার Edmund Allenby যখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শহরটিতে প্রবেশ করেন, তখন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা নিশ্চিত হয়ে যায়, তারা আবারও প্রাচীন ভূমিতে ফিরে যাচ্ছে। এই নব্য ইজরাইলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এক প্রতিশ্রুতি পত্রের মধ্য দিয়ে। ২ নভেম্বর, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব Arthur Balfour আমেরিকায় অবস্থানরত Baron Rothschild-এর নিকট একটি প্রতিশ্রুতিপত্র লিখেন—গ্রেট ব্রিটেন যেকোনো মূল্যেই প্যালেস্টাইনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। এই চিঠি পেয়ে তাদের সদস্যগণ রাস্তায় নেমে নাচ-গান করতে শুরু করে।

২ নভেম্বর, ১৯১৭

প্রিয় লর্ড রথসচাইল্ড,

আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে মহামান্য সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নবর্ণিত ঘোষণাটির কথা জানাচ্ছি। এটি ইহুদি ও জায়োনিস্টদের প্রত্যাশার সাথে সহানুভূতিস্বরূপ মন্ত্রীপরিষদে উত্থাপিত ও গৃহীত হয়েছে।

মহামান্য সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য জাতীয় স্বদেশভূমি সৃষ্টির বিষয়টি সহানুভূতির সাথে দেখছে। তাই লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। স্পষ্টত এই ঘোষণা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অইহুদি সম্প্রদায়গুলোর নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের বিরুদ্ধে কোনো পক্ষপাতিত্ব করছে না। অনুরূপভাবে এটি অন্যান্য দেশে ইহুদিরা যে আইনগত ও রাজনৈতিক অবস্থায় আছে, তার ওপরও কোনো প্রভাব ফেলবে না।

আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব, যদি দয়া করে এই ঘোষণাটি জায়োনিস্ট ফেডারেশনকে জানিয়ে দেন।

Atlantic Monthly পত্রিকার সম্পাদক Professor Albert T. Clay আমাদের সতর্ক করে বলেন—

‘প্যালেস্টাইন যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকান পত্রিকাগুলোতে যে সংবাদ ছাপানো হচ্ছে, তার প্রায় সবই জায়োনিস্টদের বানানো সংবাদ। প্যালেস্টাইনিদের বিশাল এক জনগোষ্ঠী মুসলিম ও খ্রিষ্টান। তারা প্রায় ২ হাজার বছর ধরে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। নিজ ভূমি রক্ষার্থে তারা ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি তারা বিকৃত করে বলছে, সেখানে নাকি মুসলিমরা হাজার হাজার নিরীহ ইহুদিকে হত্যা করছে।’

এর আগে ১৯০২ সালে জায়োনিস্টরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে Anglo-Palestine Bank প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের হাজার বছরের পুরোনো ‘সুদ-বাণিজ্য’ শুরু করে। ৬.৫ শতাংশ সুদের বিনিময়ে পাঁচ বছর মেয়াদে তারা প্যালেস্টাইনি কৃষকদের ঋণ দিতে শুরু করে, কিন্তু অধিকাংশ কৃষক এই অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের আবাদি জমিগুলো জায়োনিস্ট ব্যাংকটির সম্পত্তি হয়ে যায়। ব্রিটিশ কমান্ডারের নেতৃত্বে তারা এই ভূমিগুলো দখল করতে শুরু করে। সে সময় অনেক ইহুদিও জেরুজালেমে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল; যদিও তারা সংখ্যায় অনেক কম ছিল

১৮৪২ সালে Dr. Murray M’Cheyne জেরুজালেমে বসবাসরত ইহুদিদের ওপর এক অনুসন্ধান চালান। আন্তর্জাতিক ইহুদি সংগঠনগুলো জেরুজালেমে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর জন্য বাৎসরিক ভাতার ব্যবস্থা করে। ফলে কাজ না করলেও তাদের জীবিকা ও রুজির অভাব ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতিও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। অন্যদিকে, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক এগিয়ে ছিল। তাই ইহুদিরা নিজেদের সন্তানদের খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে শুরু করে।

জায়োনিস্টরা এই শহর দখল করে নিলে শহরের পুরো রূপ রাতারাতি পালটে যায়। The Council of Jerusalem Jews একটি হিব্রু পত্রিকায় ইহুদি অভিভাবকদের সতর্ক করে কলাম প্রকাশ করে। কলামটিতে তাদের প্রতি কিছু আজ্ঞা প্রকাশ করা হয়—

• যদি কোনো অভিভাবক সন্তানদের খ্রিষ্টান-মুসলিম পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে না আনে, তবে তাদের বাৎসরিক ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

• তাদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

• তাদের নাম ব্লাকলিস্টে রাখা হবে এবং মোজেসের অনুসারী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না।

• সকল প্রকার ব্যবসায়িক মুনাফা ভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।

• তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বয়কট করা হবে।

• সকল অফিস-আদালত থেকে ছাঁটাই করা হবে।

• যারা এসব নির্দেশ অমান্য করবে, তাদের নাম শহরের প্রধান ফটকের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হবে।

• বিশেষ এক ব্যাজ পরতে হবে, যেন সহজে তাদের সনাক্ত করা যায়।

• জাতীয় পর্যায়ে তাদের কলঙ্কিত করা হবে।

• যদি কোনো রাবাই এ নির্দেশ অমান্য করে, তবে তাকে দায়িত্বচ্যুত করা হবে।

ইহুদিদের কাছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয়তাবাদ। তারা খুব ভালো করেই জানে, জেরুজালেমের অধিকার খ্রিষ্টানরাও ছাড়তে রাজি নয়। বিশ্বযুদ্ধের ফাঁদে পড়ে ব্রিটেন এই শহরকে ইহুদিদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তারা যে আজীবন জায়োনিস্টদের কথামতো কাজ করে না, তারা তা ভালো করে জানে। বেথেলহাম যীশুখ্রিষ্টের জন্মভূমি। ধর্মপ্রচার করতে তিনি জেরুজালেমে এসেছিলেন। প্যালেস্টাইন তাদের হাতে চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে—খ্রিষ্টানরা শহরটির ওপর অধিকার হারাবে। বলশেভিক বিপ্লবে ইহুদিরা যেভাবে রাশিয়ার গির্জাগুলো ধ্বংস করেছে, সেভাবে প্যালেস্টাইনের গির্জা ও মসজিদগুলোতেও আঘাত হানছে।

জেরুজালেম দখলের পরপরই Sir H. Samuel-এর নেতৃত্বে প্যালেস্টাইনে এক ইহুদি সরকার গঠনের কাজ শুরু হয়। একই সঙ্গে জায়োনিস্টরা সুয়েজ খাল দখলের এক ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে। তিনি বলেন—

‘সামরিক শক্তিতে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এত বড়ো প্রজেক্টে হাত দেওয়া উচিত নয়। এখন প্রয়োজন ইজরাইলের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন জোগানো। যেরূপ বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রের নবজন্ম ঘটেছে, খুব শীঘ্ৰ তেমন আরেকটি যুদ্ধ ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের উচিত, এই যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে ইজরাইল রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বৈধ্যতা অর্জন করা।’

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনটি বিশেষ কারণে প্যালেস্টাইন ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

১. বলশেভিকদের প্যালেস্টাইন অভিমুখে যাত্ৰা।

২. খতরনাক জায়োনিস্টদের জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা।

৩. বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্যালেস্টাইনের আবির্ভাব।

১৯২০ সালে জেরুজালেমের বিশপ Dr. Mclnnis এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— ‘যে আগন্তুকরা আজ জেরুজালেম দখল করেছে—তাদের অধিকাংশই রাশিয়ান, পোলিশ ও রোমানিয়ান ইহুদি; কিছুদিন আগেও তাদের বলশেভিক বিপ্লব করতে দেখা গেছে। তারা এই ভূমি দখলের পর লিওন ট্রটস্কি সাহেবের প্রতি সম্মান জানাতে ভোলেনি। তিনিই তো তাদের ‘Kingdom of Heaven’ তথা এই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।’

১৯২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্যালেস্টাইনের বর্তমান অধিবাসীরা প্রায় ২ হাজার বছর যাবৎ এই ভূমিতে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ৫ লাখ মুসলিম, ১ লাখ খ্রিষ্টান ও ৬৫ হাজার ইহুদি। পুরো জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ মুসলিম, ১৫ ভাগ খ্রিষ্টান ও ১০ ইহুদি। তাদের জীবিকা অর্জনের প্রধান উপায় কৃষিকাজ। তারা যে এই অঞ্চলের প্রকৃত স্থায়ী বাসিন্দা, তা আশা করি খোদ ইউরোপিয়ান পর্যন্ত অস্বীকার করবে না। এই ভূমিকে জায়োনিস্টদের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ হলো—বেলজিয়ামকে মেক্সিকোর হাতে তুলে দেওয়া।

General Allenby প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি স্থানীয়দের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করবেন। বেলফোর ঘোষণা, সান রেমিও সম্মেলন ও প্রেসিডেন্ট উইলসন সবাই এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু জায়োনিস্টরা বলল—’তাদের বের করে দাও!’

Isreal Zangwill বললেন—

‘তাদের বের করে দাও! আমরা খুব ভদ্রভাবে বলছি, তারা যেন এই ভূমি ছেড়ে চলে যায়! তাদের জন্য লাখ লাখ বর্গ মাইলের আরব ভূমি পড়ে আছে। ইজরাইলে এক বর্গ ইঞ্চি জায়গাও যে এখন অবশিষ্ট নেই। তাঁবু গুটিয়ে বেদুইনদের মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করা তো তাদের জন্মগত অভ্যাস। এবার তারা তা প্রমাণ করে দেখাক।

ইহুদিরা “আরব” শব্দটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের মগজে আরবদের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়াতে ইহুদিরা যথেচ্ছা মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে থাকে। আমেরিকা তো স্বাধীন হয়েছে মাত্র ১৭৭৬ সালে। সামান্য দেড়শো-দুশো বছরের ব্যবধানে আমরা যদি নিজেদের এই ভূমির স্থায়ী বাসিন্দা বলে দাবি করতে পারি, তাহলে যারা প্যালেস্টাইনে দুই হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে, তারা কেন নিজেদের স্থায়ী অধিবাসী বলে দাবি করতে পারবে না! বিশ্বের নিরপেক্ষ সকল পণ্ডিত আজ নব গঠিত ইজরাইল নিয়ে ভীষণ সঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কারণ, তাদের নব আবির্ভাব মানবজাতি তথা এই ধরণির ভবিষ্যতের প্রতি ভয়ংকর খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।’

ইহুদিরা যেভাবে জেরুজালেম দখল করে

১৯২১ সালের জুলাই মাসে ইউনিভার্সিটি অব দ্যা সাউথ ‘Zionism and the Jewish Problem’ শিরোনামে ২৯ পৃষ্ঠার একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। আর্টিকেলটির লেখক Dr. John P. Peters দীর্ঘদিন সেন্ট জন দ্যা ডিভাইন ও সেন্ট মাইকেল চার্চের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন—

‘যে জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে জায়োনিজম গড়ে উঠেছে, তার সাথে ধর্মীয় গ্রন্থের তেমন কোনো সাদৃশ্য নেই। এই রাজনৈতিক দলটির মূল ক্ষমতাভার যাদের হাতে, তাদের কেউ মূল ধর্মে বিশ্বাসী নয়। ইহুদিদের জাতীয়তাবাদ আমেরিকাসহ পৃথিবীর যেসব অংশে প্রবেশ করেছে, সেখানে তারা আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে।

Dr. Peters জায়োনিস্টদের বিভিন্ন কার্যক্রমের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তার প্রকাশিত আর্টিকেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ এখানে উপস্থান করা হলো—

জায়োনিস্টরা যে প্যালেস্টাইন দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তা বর্ণনা করা অনাবশ্যক। তাদের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯০২ সালে। সেবার আমি দ্বিতীয় মেয়াদে প্যালেস্টাইন সফরে যাই। ১৮৯০ সালে যখন প্রথম মেয়াদে প্যালেস্টাইন সফর করি, তখন সামান্য কিছু সেফার্ডিক ইহুদি জেরুজালেমে বসবাস করত। তখন অবধি তা প্রাচীন শহরের রূপেই ছিল। শহরটির মূল প্রাচীরের বাইরে তখনও কোনো ঘরবাড়ি গড়ে ওঠেনি। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সবেমাত্র শুরু হয়ছে। রাশিয়ার নিপীড়িত ইহুদিরা প্যালেস্টাইন উপকূলীয় শহর শ্যারনে নিজেদের কলনি প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে কায়িক শ্রমে অনভ্যস্ত ছিল বলে তারা কৃষিকাজ করতে পারত না। তাই সিরিয়ান শ্রমিকদের ভাড়া করে নিজেদের কাজ করিয়ে নিত। আর ইহুদিরা ছাতার নিচে বসে কাজ তদারকি করত এবং প্রখর রোদ থেকে নিজেদের চামড়া রক্ষা করত।

১৯০২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্যালেস্টাইন গিয়ে দেখি, তাদের কলনিগুলো কৃষিকাজে ভীষণ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। আরও লক্ষ করলাম, জেরুজালেমের বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় ইহুদিরা ঘড়বাড়ি গড়ে তুলতে শুরু করেছে। এই প্রথম শহরটির প্রধান প্রাচীরের বাইরে সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। তারা নিজ উদ্যোগে কৃষিকাজ, কায়িক শ্রম এবং বিভিন্ন শিল্পের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেন নিজ চোখে সেসব কেন্দ্র একবার হলেও দেখে যাই। এটা দেখে আমি এতটাই অবাক হই যে, সেখানে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদেই নেই। ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান সব গোত্রের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষিকাজ করে যাচ্ছে। আমি বলব, এটা আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর একটি। সেখানে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না। সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছিল তাদের সকল কাজের মূল উদ্দীপনা। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে সুন্দর এক সমাজব্যবস্থা।

দেশে ফিরে আসার পর ওপর থেকে আমাকে চাপ দেওয়া হয়, যেন এ বিষয়টি কোনো পত্রিকায় প্রকাশ না করি। খুব দুঃখ নিয়ে বলতে চাই, এই বল প্রয়োগ আসে আমেরিকার বিশেষ একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে। ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান শান্তিতে বসবাস করুক, তা তারা মেনে নিতে পারে না। তাদের অভিযোগ, মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সংস্পর্শে ইহুদি সম্প্রদায় সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। তারা চায়—ইহুদিদের জন্য পৃথক একটি সমাজব্যবস্থা থাকবে। ভূমি দখলের প্রতিযোগিতায় তাদের দ্বিতীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে যখন পুনরায় প্যালেস্টাইন সফরে যাই, তখন দেখি—ইহুদিরা ভীষণ সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। তাদের মাথায় ভূমি দখলের ভূত আগাগোড়া চেপে বসেছে।

দেখলাম, কৃষিকাজে তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছে। ফল, ফসল ও শরাব উৎপাদন তাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। উৎপাদন কাজ ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন প্রযুক্তির সংযোজন করেছে। কিন্তু যেসব ভূমি অধিগ্রহণ করে ইহুদিরা কৃষিকাজ করছে, তা কখনোই তাদের ভূমি ছিল না। শ্যারন প্লেইন, এসড্রাইলোন প্লেন ও জর্ডান ভ্যালি হলো প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে উর্বর ভূ-অঞ্চল; বর্তমানে যা জায়োনিস্টদের দখলে। এই ভূমিগুলো তাদের শস্য-সম্পদে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। ততদিনে জেরুজালেমে ইহুদিদের জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের একদল পরজীবী ছত্রাকের ন্যায় অন্যের ঘাড়ে চেপে বসেছে, আর সামান্য কিছু বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত আছে।

শহরটি এখন সাম্প্রদায়িক জায়োনিস্টদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। বলশেভিজমের চেতনা পুরো প্যালেস্টাইনকে পেয়ে বসেছে। হিব্রু প্রতিষ্ঠানগুলো গির্জা ও মসজিদ নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইচ্ছা করে খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মগজে সাম্প্রদায়িকতার আগুন প্রজ্বলিত করছে। আমার সৌভাগ্য যে, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের বিভিন্ন ক্যাম্প সফর করার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু ভাষাগত জটিলতার দরুন তাদের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারিনি। আরব-ইজরাইল সংঘাত ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল বলে আরও অনেক জায়গায় যেতে পারিনি। পরে না জানি আরবরা আমাকে জায়োনিস্ট গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে!

এটা বহু আগে থেকেই জানা ছিল যে, জায়োনিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্যালেস্টাইনের ইহুদিদের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করত। তারা যেন খ্রিষ্টান বা মুসলিমদের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পারে, সেজন্যই মূলত এই ভাতার ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক খ্রিষ্টান তার সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জায়োনিস্টদের পক্ষে কলাম ছাপতে শুরু করেছে। এই বিশ্বাসঘাতকতাই সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।

তারা যেন জেরুজালেমসহ প্রতিটি পবিত্র শহরে (যেমন : হেবরন, টাইবেরিয়াস, সাফেদ ইত্যাদি) ফিরে যাওয়ার পথে বিশ্ববাসীর সমর্থন পায়, সেজন্য খ্রিষ্টান সংগঠনগুলোকে বড়ো অঙ্কের উপঢৌকন প্রদান করে যাচ্ছে। খ্রিষ্টান গির্জাগুলো তাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রার্থনায় রত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্যাথলিক গির্জা এই পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছে। জায়োনিস্ট কমিটি প্যালেস্টাইনের গির্জাগুলোতে আন্তর্জাতিক মহলের বাৎসরিক চাঁদা পাঠানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছে।’

কিছুদিন আগে জায়োনিস্ট প্রতিষ্ঠান Hebrew Edition একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘Malignant Leprosy’। আর্টিকেলটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ায় সেখানে কী প্রকাশ করা হয়। তা জানা যায় : ইহুদি অভিভাবকরা যেন অতি সত্বর তাদের সন্তানদের জ্যান্টাইল পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে আনে, সে বিষয়ে আদেশ- নিষেধ জারি করা হয়। যদিও সেসব প্রতিষ্ঠানে খ্রিষ্টান বা ইসলাম ধর্মের কোনো কিছু শেখানো হয় না, তারপরও ইহুদিরা চায় তাদের সন্তানরা বিধর্মীয় সংস্কৃতির সকল সংস্পর্শ থেকে মুক্ত থাকুক। যদি কোনো অভিভাবক এই নির্দেশ অমান্য করে, তবে তাদের ওপর যে শাস্তি নেমে আসবে, তার ফল শেষ প্রজন্মকে পর্যন্ত ভোগ করতে হবে।

এক মাস পর Hebrew Edition দ্বিতীয় আর্টিকেলটি প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘Fight and Win’। যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের জ্যান্টাইল পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে আনেনি, তাদের সকল সুযোগ শেষ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। নিচে লক্ষ করুন—

‘সতর্কবাণী পাওয়ার পরও যে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের জ্যান্টাইল পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরিয়ে আনেননি, তাদের প্রত্যেকের নাম রাস্তার মুখে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। প্রতিটি পত্রিকায় বড়ো বড়ো করে ছাপানো হবে। রাস্তায় রাস্তায় প্লাকার্ড করে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। বিশ্বাসঘাতক ও সীমালঙ্ঘনকারী বলে তাদের অভিহিত করা হবে। তাদের নাম প্রতিটি হাসপাতাল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ইহুদি ডাক্তারদের কাছে তারা আর সেবা পাবে না। তাদের নাম ব্লাকলিস্ট করে American Jewish Relief Fund-এর নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাদের জন্য ভবিষ্যতে আর কোনো ভাতার ব্যবস্থা করা হবে না। আমরা সবাই তাদের এড়িয়ে চলব। তাদের সন্তানদের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের বিয়ে হবে না। তাদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। জাতিগতভাবে আমরা তাদের বর্জন করছি। তাদের জন্য দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই। সকল দয়া-মায়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সম্প্রদায়ের একটা শিক্ষা হওয়া উচিত। যদি আমাদের কেউ তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতিও প্রদর্শন করে, তবে তাকেও এই কাতারে ফেলা হবে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের মধ্য হতে কেউ যদি এমন কাজ করে, তবে তার ওপরও একই শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হবে।’

১৯২০ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেরুজালেমে তখন ২৮ হাজার ইহুদি, ১৬ হাজার খ্রিষ্টান এবং ১৫ হাজার মুসলিম বসবাস করত। ইংলিশ সরকারের পাহারায় ইহুদিরা নিরাপদে এই শহরে আসতে থাকে। এতে তাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালে ইস্টার সানডে এবং ইহুদিদের পাসওভার একই দিনে পড়ে।

তার সঙ্গে যোগ হয় মুসলমানদের নবি ‘মুসা উৎসব’, যা সাত দিন পর্যন্ত পালিত হয়। প্রথমে তারা এক ধর্মীয় বক্তব্য শোনার জন্য হারাম-আস-শরিফে জড়ো হয়। দ্বিতীয় অংশে, মৃত সাগরের পাশে নবি দাউদ -এর কাল্পনিক কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে তারা সাত দিনব্যাপী বাৎসরিক উৎসব সম্পন্ন করে। অটোম্যানরা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রতিটি সম্প্রদায় যেন নিজেদের ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হতো, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এখানে ব্যর্থ হয়েছে।

যেহেতু ইহুদিরা এখন জেরুজালেমের রাজা, তাই তারা অন্যান্য সম্প্রদায়কে নিজেদের উৎসব পালনে ঘৃণ্য উপায়ে বাধা দিতে শুরু করে। এ কারণে উৎসবের দিন দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টানদের অনেকেই সেদিন ঘরে বসে ছিল, কিছু লোক গির্জায় উপস্থিত ছিল। তারা রাস্তায় নেমে উৎসব করার সাহস পাচ্ছিল না। কারণ, জায়োনিস্টরা ততদিনে সামরিক শক্তিতে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে প্রচুর অস্ত্র ছিল।

কিন্তু মুসলিমরা ঘরে বসে ছিল না। হেবরন থেকে একদল মুসলিম প্লাকার্ড হাতে জাফা শহরের প্রধান ফটকের সামনে হাজির হতে শুরু করে। প্লাকার্ডগুলোতে ধর্মীয় অসিষ্ণুতার বিরুদ্ধে স্লোগান লেখা ছিল। ব্রিটিশ সৈনিকের অনেকে সেদিন সামনে এগিয়ে আসেনি। কারণ, তাদের সবাই ছিল খ্রিষ্টান। কিছুদিন আগেই তারা দেখেছে—ইহুদিরা কীভাবে অকথ্য ভাষায় যীশুকে অপমান করেছে। তা ছাড়া তাদের অনেকে গির্জায় প্রার্থনা করছিল। এমতাবস্থায় ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ইহুদিদের কাছে আধুনিক অস্ত্র থাকলেও তারা যুদ্ধ করতে জানত না। অপর দিকে মুসলিমরা ছিল সংখ্যায় অল্প। তাদের হাতে ছুরি-তরবারি ছাড়া কিছুই ছিল না। তারপরও মুসলিমরা যুদ্ধে অসম্ভব পারদর্শী ছিল।

কারণ, আরব জাতটাই এমন। শহরের ভেতরে প্রাচীন সেফার্ডিক বস্তিগুলোতে কিছু স্থানীয় ইহুদি বসবাস করত। শেষে তারাই বলির পাঠা হলো। জায়োনিস্ট ইহুদিরা আলিশান বাড়ি করে একই শহরে থাকত। মুসলিমরা শহরের ঢোকা মাত্রই ওপর থেকে গুলি ছোড়া শুরু হয়। নিরীহ সেফার্ডিকরা আতঙ্কে এদিক-সেদিক দৌড়াতে শুরু করে। অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী—এই দাঙ্গায় দুজন মারা যায়। ইংলিশ বিচারবিভাগ মুসলিম ও ইহুদিদের সমানভাবে অভিযুক্ত করে শাস্তি ভাগ করে দেয়, যদিও তদন্ত প্রতিবেদনে ইহুদিরাই ছিল মূল খলনায়ক। এই পারস্পরিক সংঘাত আদৌ কখনো বন্ধ হবে কি না বলা অসম্ভব।

জায়োনিস্ট কমিটি Sir H. Samuel-কে প্যালেস্টাইনের গভর্নর করে পাঠায়। তার এই আগমন পুরো প্যালেস্টাইনে নতুন সংঘাতের জন্ম দেয়। তিনি জেরুজালেমে প্রবেশের আগেই তার মাথা উড়িয়ে দেওয়া হবে এবং মুসলমানদের শহর নেবলাসে কোনো ইহুদিকে ঢুকতে দেওয়া হবে না মর্মে কিছু হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। তাই H. Samuel পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে জাফায় প্রথম প্রবেশ করে। আমি নিজে দেখেছি, তার সামনে-পিছে মেশিনগান হাতে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। একই পদ্ধতিতে তিনি নেবলাস হয়ে জেরুজালেমে প্রবেশ করেন। শহরে প্রবেশ করেই তিনি নতুন আজ্ঞা জারি করেন। যদিও সেই দাঙ্গায় খ্রিষ্টানরা জড়িত ছিল না, কিন্তু তারপরও মুসলিমদের প্রতি তাদের মৌন সমর্থন ছিল। তাই উভয়কেই একই অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। তা ছাড়া ব্রিটিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকায় তাদের এই শহর দেখাশোনায় অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। এতটুকু দেখার পর আমি প্যালেস্টাইন ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে আসি। যতদিন সেখানে ছিলাম, চেষ্টা করেছি সঠিক তথ্যটি সংগ্রহ করতে; যদিও তা সহজ ছিল না।

প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে, তা এত শীঘ্রই বলা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া ব্রিটিশ সরকার যে কতদিন তাদের নিরাপত্তা দিয়ে রাখবে, তাও বিতর্কের বিষয়। সত্যি-ই যদি ব্রিটিশ সরকার সাম্য, সৌহার্দ্য ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্যালেস্টাইন শাসন করতে শুরু করে, তবে এই দেশ এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। কিন্তু জায়োনিস্টরা এটা মেনে নেবে না। জায়োনিস্টদের অত্যাচারে পুরো প্যালেস্টাইন এখন একটি করদরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। হয়তো জায়োনিস্টদের চাপে ব্রিটিশ সরকার একদিন তার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। তখন নতুন এক পরিস্থিতির জন্ম হবে। ইরাক, সিরিয়া ও মিশর থেকে দলে দলে মুসলিম বাহিনী এই ভূমি স্বাধীন করতে এগিয়ে আসবে। ব্রিটিশ সরকার ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছে, বিশ্বব্যাপী তার উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ভিত কেপে উঠছে। মিশরে ইতোমধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জোরদার হয়েছে। ভারত থেকে যে মুসলিম সৈন্যদের তিনি ইহুদিদের নিরাপত্তার তাগিদে নিয়ে এসেছেন, তারাও কিছুদিন পর বেঁকে বসবে। কারণ, নিজ মুসলমান ভাইদের ওপর তারা কখনো বুলেট চালাবে না। এখন এটা সময়ের ব্যাপার যে, সামনে কী হতে যাচ্ছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *