6 of 8

জামাইষষ্ঠী

জামাইষষ্ঠী

কয়েকদিন আগে জামাইষষ্ঠী গেছে। কোনও পঞ্জিকা বা নতুন বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার না দেখেই সেটা আমরা টের পেয়েছি। বিশেষ করে আমাদের মতো ঘরগৃহস্থী-করা গৃহকর্তারা, যারা বাড়ির বাজার এখনও নিজের হাতেই করি, প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও জামাইষষ্ঠীর ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

আমার নিজের কোনও কন্যা নেই। সুতরাং জামাতাও নেই। কিন্তু জামাতার মূল্য মোক্ষম অনুভব করি এই জষ্টি-ষষ্ঠীতে। কাটা পোনা একশো, মাংস সোয়াশে, ইলিশ দেড়শো। বেগুন-পটল পনেরো। আম-লিচু পঞ্চাশ। সামান্য তালশাঁস তিনটে পাঁচ টাকা।

এসব জিনিস আজকাল আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। তবু জামাইষষ্ঠীর অব্যবহিত পরে রাস্তাঘাটে, অফিস কাছারিতে যখনই কোনও তাঁতের ধুতি, নতুন পাঞ্জাবিপরা যুবক-বয়েসিকে দেখি, বুঝতে পারি, সেদিনের মূল্যবৃদ্ধির জন্যে ইনিই দায়ি।

একদা, বেশ বহুকাল আগে, এই শতকের অনেকদিন পর্যন্ত কলকাতার অফিস আদালত জামাইষষ্ঠীতে ছুটি থাকত। আমার আমলে দেখেছি, সেও প্রায় চার দশক হয়ে গেল। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। জামাইষষ্ঠীর দিন অফিস খোলা, কিন্তু যারা শ্বশুরবাড়িতে ষষ্ঠীর নেমন্তন্নে যাবে তারা অফিসে একবার এসে হাজিরা খাতায় সই করে যে-কোনও সময় চলে যেতে পারবে।

(লিখে রাখি পরে খেয়াল থাকবে না, তা ছাড়া আর কেউ লিখবে এমন ভরসা দেখছি না। শিবরাত্রির সময়েও ঠিক এইরকম হত। যারা উপোস করেছে তাদের এসেই ছুটি। শিবরাত্রির দিন ছুটি থাকত না, ছুটি থাকত পরের দিন, তার নাম ছিল বোধহয় পারণ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এসব বিধি বছর পঁচিশ আগেও চালু ছিল। বাংলা ও ইংরেজি বর্ষশেষ এবং বর্ষারম্ভ দু’দিন করে ছুটি, এমনকী দশহরাতেও ছুটি থাকত। দুর্গাপুজোয় তো লম্বা ছুটি। আরও দুটো লম্বা ছুটি ইস্টার, গুডফ্রাইডে, বাংলা নতুন বছর ইত্যাদি মিলিয়ে এবং বড়দিন ও ইংরেজি নতুন বছর জুড়ে। কালীপুজো, সরস্বতীপুজো এইসব বড় বড় পুজোর পরদিন হাফ ডে বিসর্জন উপলক্ষে।

অনেক খোঁজখবর নিয়ে পুরনো নথিপত্র, খবরের কাগজ ঘেঁটে পরিশ্রম করে লেখার বিষয় এটা। পুরনো ছুটির দিনের এই নির্ঘন্টের মধ্যে, ক্রমশ পরিবর্তনের মধ্যে দশহরার স্থলে পয়লা মে, চৈত্র সংক্রান্তির স্থলে পচিশে বৈশাখ, একটা সমাজ-চিত্র ফুটে উঠবে। কেউ চান এ বিষয়ে ডক্টরেট করতে পারেন।)

সে যা হোক, আবার জামাইষষ্ঠীতে ফিরে আসি। তার আগে জামাতা বাবাজিদের সামাজিক অবস্থানটা একটু বিবেচনা করি।

প্রথমে সেই পুরনো গ্রাম্য শ্লোকটি স্মরণ করি,

‘যম জামাই ভাগনা

কেউ নয় আপনা।’

অতি বিপজ্জনক বক্তব্য এই শ্লোকের। এত আদরের কন্যা, তার বর—যতই স্নেহের পাএ সে হোক, সে কখনও আপনজন নয়।

এই আপনত্বের বাধা ঘোচাতে একদা ঘরজামাই প্রথা চালু হয়েছিল। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বর সমেত নিজের বাড়িতেই রেখে দেওয়া।

একালে এর নমুনা অবশ্য ঘরে ঘরে। নতুন যুগের উদাহরণটি এইরকম:

এক গৃহিণী তাঁর প্রতিবেশিনীর কাছে বললেন, ‘ছেলের বিয়েটা ভাল হয়নি, ছেলেটা বউয়ের কথায় ওঠে-বসে, প্রত্যেক শনি-রবিবার বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। এখন যত টান শ্বশুরবাড়ির দিকে। তবে মেয়ের বিয়ে খুব ভাল হয়েছে। জামাই মেয়ের অতি অনুগত, তারই কথায় ওঠে-বসে। প্রত্যেক শনিবার-রবিবার মেয়েকে নিয়ে এখানে চলে আসে। বড় ভাল জামাই।’

জামাইষষ্ঠী মোটামুটিভাবে পশ্চিমবঙ্গীয় অনুষ্ঠান। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা এলাকায় এই ষষ্ঠী পালিত হয়।

গ্রীষ্মকালে শুক্লপক্ষে দশহরার তিনদিন আগের এই তিথিটি। যাঁরা পঞ্জিকা মানেন, তাঁদের কাছে খুবই পবিত্র দিন। নববস্ত্র পরিধান থেকে ধান্যরোপণ পর্যন্ত সবকিছু সামাজিক অনুষ্ঠানের পক্ষে প্রশস্ত।

আমাদের ছোটবেলায় পূর্ববঙ্গের যে অঞ্চলে আমরা বড় হয়েছি, দেখেছি এই তিথিটি আমষষ্ঠী বা অশোকষষ্ঠী রূপে পালিত হত। কিন্তু সেই অর্থে জামাইষষ্ঠীর কোনও ব্যাপার ছিল না।

বিবাহঘটিত সামাজিক দেয়াথোয়া, তত্ত্বতালাশ খুব একটা ছিল না সেই কৃষিসমাজে। এখন যেমন নববিবাহিত কন্যাদের অভিভাবকদের একটা দায় হয়ে দাড়িয়েছে জামাইষষ্ঠী কিংবা পুজোর তত্ত্ব পাঠানো, সেটা আমার বাল্যকালে আমার পরিমণ্ডলে দেখিনি।

‘জামাই-আদর’ বলে একটা প্রচলিত কথা আছে। এ সম্পর্কে শিশু বয়সে আমরা একটা শ্লোক শুনেছিলাম, যার শেষ অংশটি সকলেই জানেন।

এই শেষ অংশটি হল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। পুরো শ্লোকটি হল—

হবির্বিনা হরি যাতি

বিনা পীঠেন মাধবঃ

কদন্নেঃ পুণ্ডরীকাক্ষ

প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ।

বলাবাহুল্য, এই শ্লোকটির সঙ্গে একটি কাহিনী জড়িত। যে কাহিনীটির নামকরণ করা যেতে পারে ‘চার জামাতার গল্প।

চার জামাতা শ্বশুরবাড়ি এসেছেন। খুব সম্ভব জামাইষষ্ঠী উপলক্ষেই এসেছেন। জামাইষষ্ঠীতে যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন হয়েছে তাঁদের। কিন্তু তারপরে আর তারা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে কিছুতেই যান না।

জামাতা বাবাজীবনদের নাম যথাক্রমে হরি, মাধব, পুণ্ডরীকাক্ষ এবং ধনঞ্জয়। এঁদের কারও কোনও চক্ষুলজ্জা নেই। চমৎকার পায়ের ওপর পা তুলে, আয়েস করে শ্বশুরবাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন।

অবশেষে শ্বশুরালয়ের লোকেরা এঁদের বিতাড়নের বন্দোবস্ত করল। প্রথমে অনাদর শুরু হল। ভাত খাওয়ার পাতে ঘি দেওয়া হল না। অপমানিত বোধ করে বড় জামাতা হরি চলে গেলেন।

এরপরে খাওয়ার সময়ে পিঁড়ি দেওয়া বন্ধ হল। মেজো জামাতা শ্রীমান মাধবও বিদায় নিলেন। তখনও দু’ জামাই রয়েছেন। খাওয়ার সময় তাঁদের পচা-গলা ভাত দেওয়া হল। এবার তৃতীয় জামাতা পুন্ডরীকাক্ষ শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করলেন।

কিন্তু কনিষ্ঠ জামাতা ধনঞ্জয় আর কিছুতেই যান না। তখন তাকে পিটিয়ে তাড়ানো হল— ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’।

কাহিনীটি চিত্তাকর্ষক এবং উপদেশাত্মক। এই সঙ্গে অন্য একটি কাহিনী বলছি, সেটি এত নির্মম নয়।

জামাইষষ্ঠীতে জামাই শ্বশুরবাড়ি এসেছেন। বাইরের ঘরে বসে পূজনীয় শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। শ্বশুরমশায় শৌখিন মানুষ। তাঁর পায়ে একজোড়া দামি এবং খুব সুন্দর চপ্পল।।

জামাইকেও ধুতি-পাঞ্জাবি ইত্যাদির সঙ্গে একজোড়া জুতো দেওয়া হয়েছে। সেটা কিনতে গিয়েই শ্বশুরমশায় নিজের চটিজোড়াও কিনে এনেছেন।

শ্বশুরমশাইয়ের চটিজোড়া দেখে জামাইবাবাজি মুগ্ধ। ঘুরে ফিরে চটি জোড়ার প্রশংসা করছেন। অবশেষে শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তোমার যদি চটিজোড়া এতই ভাল লেগে থাকে তুমি এ জোড়া নিয়ে নাও।’

জামাই প্রলোভন সম্বরণ করতে পারছিলেন না, তবু মুখে বললেন, ‘কিন্তু যদি লোকে জিজ্ঞাসা করে আপনার নতুন চটিজোড়া কী হল, তা হলে কী বলবেন?’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘কী আর বলব, বলব কুকুরে নিয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *