জাপানী কৈমাছ

জাপানী কৈমাছ

বৎসরের শুরুতে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধনবান ব্যক্তিদের একটা তালিকা প্রস্তুত হয়। সংবাদ সংস্থাগুলি সেই তালিকার খবর দিকে দিকে পাঠিয়ে দেয়। খবরের কাগজগুলি আগ্রহ করে সেই খবর ছাপায়। আমরা মুগ্ধবিস্ময় নিয়ে সেই খবর পড়ি। অন্যদের পড়ে শোনাই। পৃথিবীর সেরা ধনীদের খবর জানতে আমাদের ভাল লাগে। আমাদের ঈর্ষাবোধ হয় না। বাড়ির কাছে মোটামুটি ধনীদের আমার ঈর্ষা করি, সেরা ধনীদের করি না। পৃথিবীর প্রথম দশজন বিত্তশালীর তালিকা প্রস্তুত হলেও সবচে দরিদ্র দশজনের তালিকা আমরা প্রস্তুত করি না। প্রথমত কাজটা অসম্ভব। একজন ধনীর উপরে। আরেকজন ধনী হতে পারে, কিন্তু নিঃস্বের নিচে নিঃস্ব নেই, এবং এদের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি। এক কোটি মানুষের তালিকা তৈরির প্রয়োজন কি?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সত্যি সত্যি যদি নিঃস্বদের তালিকা তৈরি হত তাহলে দেখা যেত পৃথিবীর বেশিরভাগ ধর্মপ্রচারকদের নাম সেই তালিকায় আছে। এই খবরে জগতের নিঃস্বরা কোন মানসিক শান্তি লাভ করেন না। মহাপুরুষরা তাদের সঙ্গে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? তারা তো খেতে পারছে না। পূর্ণিমার চাঁদ তাদের কাছে ঝলসানো রুটি, যে রুটি আখের গুড় দিয়ে খেতে পারলে পেট শান্ত হত।

হঠাৎ করে ধনী-নিঃস্ব নিয়ে লিখতে বসলাম কেন সেই ব্যাপারটা বলে নেই। এ দেশের জনৈক ধনবান ব্যক্তির বাসায় যাবার দুর্লভ (!) সৌভাগ্য আমার সম্প্রতি হয়েছিল। বাড়িতে ঢুকে ঝিম মেরে গেলাম। যা দেখছি তাতেই চোখ স্থির হয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক মিউজিয়ামের কিউরেটরের ভঙ্গিতে তার বাড়ির প্রতিটি দুর্লভ সামগ্রীর বাংলাদেশী টাকায় মূল্য এবং ডলারের মূল্য বলে যাচ্ছেন। জিনিসটি কোন জায়গা থেকে কেনা হল সেই ইতিহাস বলছেন। তিনি বলে আরাম পাচ্ছেন, আমিও শুনে স্তম্ভিত হচ্ছি। তিনি এক পর্যায়ে বললেন, আসুন আসুন, আমার মাছের একোরিয়াম দেখুন। মজা পাবেন।

মজা পাবার উদ্দেশ্যে মাছের একোরিয়ামের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একোরিয়াম বলা ঠিক হবে না। চৌবাচ্চা জাতীয় জিনিস। চারপাশে চেয়ার বসানো। চেয়ারে বসে মাছের খেলা দেখতে হয়। ভেবেছিলাম, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য জাতীয় মাছ দেখব, মৎস্যকন্যা টাইপ কিছু। তেমন দেখলাম না। দেখলাম বিশাল কৈ মাছ। শ্বেতী রোগ হলে গা যেমন শাদা হয়ে যায় তেমন শাদা, মাঝে মাঝে সোনালী ছোপ। এরচে সুন্দর মাছ মধ্যবিত্তদের একোরিয়ামে সবসময়ই দেখা যায়।

ভদ্রলোক আগ্রহের সাঙ্গে বললনে, কেমন দেখলেন?

আমি শুকনো গলায় বললাম, ভাল। ইন্টারেস্টিং কৈ মাছ।

শুধু ইন্টারেস্টিং কৈ মাছ বলে শেষ করবেন না। এগুলি জাপানী কৈ, চারশ বছর বাঁচে।

আমি এই খবরেও তেমন অভিভূত হলাম না। চারশ বছর বেঁচে থেকে এরা আমাদের তেমন কোন উপকার করছে না। কচ্ছপও চারশ বছর বাঁচে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে এদের একোরিয়ামে রাখতে হলে কচ্ছপও রাখতে হয়।

মাছগুলির দাম কত আন্দাজ করুন তো?

আন্দাজ করতে পারছি না। বুঝতে পারছি আকাশ-পাতাল কিছু হবে।

তবু আন্দাজ করুন।

আমি আমার কল্পনাকে যতদূর সম্ভব প্রশ্রয় দিয়ে বললাম, প্রতিটি মাছ কুড়ি হাজার টাকা।

আমার অজ্ঞতায় ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, গিনেস বুক অব ওয়ার্লড রেকর্ডে এই মাছ সম্পর্কে একটা তথ্য আছে। তথ্যটা হচ্ছে–পৃথিবীর সবচে বেশি দামে বিক্রি হওয়া মাছ হল জাপানী কৈ মাছ। এরকম একটা মাছ বিক্রি হয়েছিল দু মিলিয়ন ইউএস ডলারে। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় কুড়ি লক্ষ টাকা।

আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, কে কিনেছে? আপনি?

না, আমি কিনিনি। আমার কাছে সবচে দামী যেটা আছে সেটা ৪০ হাজার ইউএস ডলার।

কোন মাছটা বলুন তো, আমি একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি।

হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে না। মানুষের স্পর্শ এরা পছন্দ করে না।

এমন দামী মাছ মানুষের মত মূল্যহীন প্রাণীর স্পর্শ পছন্দ করার কোন কারণ নেই। আমি ভদ্রলোককে এই অমূল্য প্রাণী দেখতে পাবার সৌভাগ্যের জন্যে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, আসল জিনিস তো এখনো দেখেননি।

আসল জিনিস কি?

আমার কুকুর। রাত বারোটার পর ছাড়া হয়। আসুন দেখবেন।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ইউএস ডলারে আপনার কুকুরের দাম কত?

ঠাট্টা করছেন নাকি ভাই?

জ্বি না, ঠাট্টা করছি না। সত্যি জানতে চাচ্ছি।

দামটা তো কোন ব্যাপার না। জিনিসটা কেমন সেটা হল কথা। আসুন আমার সঙ্গে।

একদিনে বেশি হয়ে যাচ্ছে, আরেক দিন এসে দেখে যাব।

কুকুর না দেখেই আমি চলে এলাম।

এইসব বিপুল বিত্তের অধিকারীদের সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। এরা তাদের বিপুল বিত্তের অংশবিশেষ খরচ করবে, আমরা দেখে মুগ্ধ হব এই তো স্বাভাবিক। তবুও কোথায় যেন একটা ছোট্ট কাঁটা বিঁধে থাকে–। কি যেন খচ খচ করে। একজনের একলক্ষ টাকা দামের পোষা মাছ থাকবে, আরেকজনের ঘরে অবোধ শিশু খেলনার জন্যে, ভাতের জন্যে কাঁদবে?

শুনেছি এই পৃথিবীতে যত খাদ্যশস্য হয় তা দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষ শুধু যে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে তাই না, অনেক উদ্বৃত্তও থাকে। তবুও কেন এই গ্রহের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রাতের বেলা অভুক্ত অবস্থায় ঘুমুতে যায়? আমি নিজে ক্ষুধার কষ্টের স্বরূপ জানি না, কিন্তু তীব্র অভাবে দিশেহারা মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে।

কুড়ি বছর আগের কথা। আমি তখন বাবর রোডে থাকি। আমাদের বাসার সামনে ছোট্ট দুকামরার একটা টিনের ঘর। স্বামী-স্ত্রী এবং ছোট ছোট দুটি বাচ্চার সংসার। একদিন শুনলাম, ভদ্রলোকের চাকরি চলে গেছে। কিছুদিন পর দেখা গেল, তারা তাদের সিলিং ফ্যান বিক্রি করে দিচ্ছে। তারপর খাট-পালং। একদিন মেয়েটি রুমালে বেঁধে তার বিয়ের চুড়ি আমাদের কাছে রেখে কিছু টাকা ধার করতে এল। সে কাঁদো কাঁদো গলায় আমার মাকে বলল, হারটা আমার মার স্মৃতিচিহ্ন। এই জন্যে বিক্রি করতে পারছি না। আপনি হারটা রেখে আমাকে পঁচিশ টাকা দিন। যখন আমাদের টাকা হবে তখন টাকা দিয়ে হার ফেরত নেব। আমার মা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে। বললেন, হার রাখতে হবে না। তুমি টাকা নিয়ে যাও আর মনে সাহস রাখো। খুব যখন অসুবিধেয় পড়বে আমার কাছে আসবে।

আমাদের নিজেদের অবস্থাও তখন শোচনীয়। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। মেয়েটি প্রায়ই আসে। শেষের দিকে আর টাকা চাইতে আসতো না। ছোট্ট একটা বাটি নিয়ে রাত করে আসতো। মাটির দিকে তাকিয়ে বলতো, খালাম্মা, বাটিটাতে একটু ভাত আর ডাল দিন আমার মেয়ে দুটির জন্যে।

এক সকালবেলা বাড়িওয়ালা তাদের বের করে দিল। আমি সকালবেলা বারান্দায় দাঁত মাজতে এসে দেখি, স্বামী-স্ত্রী তাদের পুরোনো বাসার গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ানো। বাচ্চা দুটি খুব কাঁদছে।

পৃথিবী নামক এই গ্রহের সবচে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। কি প্রচণ্ড তার ক্ষমতা! একদিন সে জয় করবে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, কিন্তু আজ তার একি পরাজয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *