জানোয়ার
বহু বছর আগের কথা সেবার কেন যেন আমি একটু বেশি অসুখ-বিসুখে ভুগছিলাম। তেমন মারাত্মক কিছু নয়, এই একটু জ্বরজাটি, অল্পস্বল্প পেটের গোলমাল। তা হলেও মাঝে মধ্যেই আমাকে দু’-চারদিন শয্যাশায়ী থাকতে হত।
সেইসময় আমার এক প্রাণের বন্ধু, আমার অসুখের খবর পেয়ে একদিন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। বন্ধুটি সুরসিক। আসার সময় ফুটপাথ থেকে তখনকার দু’টাকা দামের একটা চটি বই আমার জন্য কিনে এনেছেন। বইটির নাম, ‘সচিত্র পশুচিকিৎসা’। পুস্তিকাটি বন্ধুবর আমাকে উপহার দিয়ে বললেন, ‘তোমার যেমন হামেশায় অসুখ-বিসুখ হচ্ছে, এত ডাক্তার-বৈদ্যের খরচ জোগাবে কোথা থেকে, তাই এই বইটি কিনে নিয়ে এলাম। এখন থেকে নিজের চিকিৎসা নিজে করবে।’
এই অপমানজনক দুঃখের গল্পটি এতদিন পরেও ভুলিনি। পুরনো বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ ওই ‘সচিত্র পশুচিকিৎসা’ বইটি হাতে এল। পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। এদিকে এর মধ্যেই একটি সাময়িক পত্রিকায় পশুর অসুখ বিষয়ে সম্প্রতি একটি নিবন্ধ পাঠ করলাম। সেই রচনা পড়ে যা জানলাম সে খুবই চমকপ্রদ। বানরদের মধ্যে গোষ্ঠীপ্রীতি এবং সামাজিক চেতনা এতই প্রবল যে যদি কোনও কারণে কোনও বানর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, খাদ্য সংগ্রহে অপারগ হয়ে পড়ে, তখন অন্য বানরেরা নিজেরা খাবার না খেয়ে সেই অসুস্থ সঙ্গীকে খাবার জোগায়।
স্বতঃপ্রবৃত্ত অনুরূপ আচরণ মানুষের কাছে সবসময় আশা করা যায় না। তবে এ-বিষয়ে বিশদ আলোচনা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়, বোধহয় নিরাপদ নয়।
হঠাৎ কোনও একদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে আমরা আবিষ্কার করলাম যে বিছানায় আমাদের লেজ খসে পড়ে রয়েছে। আমরা বানর থেকে মানুষ হয়েছি— ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়। বানর থেকে মানুষ বনতে আমাদের হাজার লক্ষ বছর লেগেছে। তবু এখনও বানরেরা অনেক সময় মানুষের মতো আচরণও করে। আবার মানুষও বহু সময়ে বানর বা তার থেকে নিকৃষ্টতম পশুর মতো আচরণ করে। শুধু বানরই বা কেন, প্রায় সব জন্তু জানোয়ারের মধ্যে মানুষের মতো কিছু কিছু প্রবণতা দেখা যায়। তাদের আচার-আচরণ আমরা মানুষের মাপকাঠিতেই বিচার করি। সামান্য যে পিঁপড়ে, সেই যে কবি অমিয় চক্রবর্তীর, ‘আহা পিঁপড়ে, ছোট পিঁপড়ে ঘুরুক, দেখুক, থাকুক’, সেই পিঁপড়েও মানুষের মতোই গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। তারও সমাজ সংসার আছে, তারও আচার-ব্যবহার-আচরণ সবই নিয়ম নির্দিষ্ট।
কিন্তু শুধু তাই নয়, সম্প্রতি এক পিঁপড়ে গবেষক জানিয়েছেন যে পিঁপড়েরা ঘুম থেকে উঠে অবিকল মানুষের মতোই আচরণ করে। ঘুম থেকে জেগে উঠে তারা প্রথমে ঠিক আমাদের মতো আড়মোড়া ভাঙে, তারপর হাই তোলে। পিঁপড়ের ঘুমই এক আশ্চর্য, অকল্পনীয় ব্যাপার, তারপর সেই ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙা এবং হাই তোলা— সত্যি ভাবা যায় না।
অতঃপর প্রসঙ্গান্তরে যাই। এই আলোচনায় এই প্রসঙ্গ যথাযথ হচ্ছে না কিন্তু পরে ভুলে যেতে পারি এই আশঙ্কায় পাঠকদের জানিয়ে রাখছি। কেউ কেউ হয়তো পত্রান্তরে খবরটি ইতিমধ্যেই পাঠ করেছেন।
বিষয়টি হল, পশুখাদ্য নিয়ে। এখানে অবশ্য পশু মানে সবরকম জানোয়ার নয়। গবাদি পশু। গবাদি পশুর খাদ্য সমস্যা চিরকালই রয়েছে। বিশেষত খরা অঞ্চলে যেখানে সাধারণ মানুষের খাদ্যই জোটে না, সেখানে আবার পশুখাদ্য? শুধু খড়ের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়, তাও সহজলভ্য নয়।
সম্প্রতি এ-ব্যাপারে আশার আলো দেখিয়েছেন গুজরাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর হলেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিস্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, গবাদি পশুকে কাগজ খাইয়ে তার শরীর ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায়। দৈনিক খাবারের সাতভাগের একভাগ যদি ফেলে দেওয়া, ব্যবহৃত পুরনো কাগজ দেওয়া হয় তা হলে গোরুমোষের পক্ষে ওই খাবার হজম করে প্রয়োজনীয় শক্তি বা ক্যালোরি সংগ্রহ করা সম্ভব। ওই গবেষণায় নাকি এটাও জানা গেছে যে ছাপা কাগজ যদি হয় তবে ওই ছাপার কালির জন্যে কাগজের শক্তিমাত্রা আরও বেড়ে যায় এবং সেটা গোরুদের পক্ষে খুবই উপযোগী।
এ পর্যন্ত বোঝা গেল। কিন্তু গোরুরা কাগজ খাবে কি না, না খেলে তাদের কীভাবে কাগজ খাওয়ানো যাবে, গবেষণাকারীরা সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। তবে মুদ্রিত কাগজের আর একটি ভাল ব্যবহার জানা গেল সেটাও কম কথা নয়।
এই জাতীয় গবেষণালব্ধ বক্তব্যে আস্থা রাখা খুব কঠিন। তার চেয়ে একটি কাল্পনিক সরস কাহিনীতে শেষ করি।
বানরের কাণ্ডকারখানাই সবচেয়ে মজার। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের এক সিদ্ধির শরবতের দোকানে একবার একটা বানর গিয়েছিল শরবত খাবার জন্যে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যাবেলা, ফুর ফুর করে দক্ষিণের বাতাস বইছে, এমন সময় শরবতের দোকানের সামনের কাঠের বেঞ্চিতে এসে একটি বানর বসল। সেও আরও দশজনের মতো শরবত পান করতে এসেছে। কিন্তু মুখ ভেংচিয়ে, দাঁত-নখ দেখিয়ে দোকানদারকে ভয় পাইয়ে মুফতে শরবত খেতে সে আসেনি।
তার হাতে করকরে একটা দশটাকার নোট। পরপর দু’ গেলাস ঠান্ডা শরবত খাওয়ার পর নোটটা দোকানদারকে দিয়ে সে একটু দাঁড়িয়ে রইল খুচরো পাওয়ার আশায়। তখন দোকানদার বলল, ‘ওই পুরো দশটাকাই দাম, একেক গেলাস পাঁচটাকা করে।’
এই শুনে বানরটা ফিরে যাচ্ছিল, তখন দোকানদার বলল, ‘দ্যাখো, আরেকটা কথা বলছি, আজ পঁচিশ বছর শরবতের দোকান করেছি, কোনওদিন কোনও বানরকে শরবত কিনে খেতে দেখিনি।’
এর জবাবে বানরটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আর কোনও দিন দেখবেও না। শরবতের যা দাম, বানরদের সাধ্য কী যে শরবত কিনে খাবে ?’