জানোয়ার পোষা
শান্তিনিকেতনে এক শিল্পী ছিল, তার নাম প্রশান্ত রায়। তার স্ত্রীর নাম গীতা। তারা বড়ই জন্তুজানোয়ার ভালবাসত। তাই বলে বড় বড় বিলিতি কুকুর, কিংবা রংচং তোতাপাখি নয়। সেসব ওরা শান্তিনিকেতনে কোথায় পাবে?
একবার ঘোর গ্রীষ্মকালে বাইরে থেকে তেতে পুড়ে ওদের ঘরে এসে বসতেই, প্রশান্ত বলল, ‘ইস গরমে মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু পাখা তো চালানো যাবে না, এই হল মুশ্কিল!’
বললাম, ‘চলছে না বুঝি? একাদশীকে ডেকে পাঠাওনি?’ বলল, ‘না না, খারাপ হয়নি।’ তবে বুঝি কারেন্ট নেই? কলকাতাতেও আমাদের ওই এক জ্বালা!’ ‘কারেন্ট আছে বইকী। নইলে রেডিয়ো চলছে কী করে?’ ‘তবে?’
‘কী আবার তবে? পাখার হাঁড়িতে চড়াই পাখি ডিম পেড়েছে। পাখা চালালে ডিম ভেঙে যাবে না? ডিম ফুটে ছানা বেরোক, তার ডানা গজাক— তার আগে পাখা চালাই কী করে?’
আরেকবার ওই গরমেই বাইরে আগুনের হল্কা ছুটছে। দেখি সকলের বাড়ির সব দরজা-জানলা এঁটে বন্ধ, খালি আমার বন্ধু প্রশান্তর বাড়ির একটা জানলা হাট করে খোলা। সেখান দিয়ে আগুনে হাওয়া হু-হু করে ঘরে ঢুকছে! এবার কী ব্যাপার? না, ঘুলঘুলিতে কাঠবেড়ালি কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সংসার পেতেছে। সব জানলা বন্ধ করলে তাদের আসা-যাওয়ার অসুবিধা হবে। শান্তিনিকেতনের জানলায় তো আর খড়খড়ি নেই।
শেষবার ওই বাড়িতে গেলে, গীতা বলল, ‘চটি খুলে পা গুটিয়ে বস।’ আমি আপত্তি করতে লাগলাম, ‘তা কেন? ওতে আমার অসুবিধে লাগে।’ গীতা আমার পা থেকে চটি টেনে খুলে ফেলে, যত্ন করে ঠ্যাং দুটো তক্তপোশের ওপর তুলে দিয়ে বলল, ‘যদি গিনিপিগের ছানাদের না দেখে মাড়িয়ে দাও?’
সব জন্তুজানোয়ার, পাখি, পোকামাকড়কে ওরা ভালবাসত। বোলতাদের অসুবিধা হবে বলে ঘরের কোণের ফুটবলের মতো বোলতার চাক ভাঙত না। ছেলেপুলেদের হুল ফোটালেও না। উলটে বলত, ‘দেখলে ছেলেপুলেগুলো কী অসাবধান? একটা প্রাণীহত্যা করাল! শুনেছি হুল ফোটালে সে বোলতাটা বাঁচে না!’
অবনীন্দ্রনাথের গড়া শিল্পী প্রশান্ত রায়। আশ্চর্য সুন্দর সব ছবি এঁকে রেখে গেছে। যেমন পরিকল্পনা, তেমনি কারিগরি। দুঃখের বিষয়, খুব বেশিদিন বাঁচল না দুজনার মধ্যে কেউ। ষাট পেরুতে না পেরুতে স্বর্গে গেল।
অবিশ্যি অন্য লোকেও জন্তুজানোয়ার ভালবাসে। যেমন আমার নবুকাকা। অবিশ্যি নবুকাকা তাঁর আসল নাম নয়। কিছু সত্যিকার কাকাও নন আমার। থাকতেন শান্তিনিকেতনের কাছে একটা ছোট শহরে। তার গা ঘেঁষে শালবন। আগে নাকি সেখানে বাঘের বাস ছিল। বনের পথ দিয়ে আসা-যাওয়া ছিল বিপজ্জনক।
তবে যখনকার কথা বলছি, তখন শিকারিদের, আর যারা বন কেটে বাড়িঘর বানিয়ে শহরের বিস্তার বানায়, তাদের জ্বালায় বাঘের বংশ প্রায় নির্বংশ। যে-কটি বাকি ছিল, তারাও অন্য ঘন বনে চলে গেছিল। অন্য ছোট জানোয়ার ছিল, শেয়াল, কুকুর, বনবেড়াল, বেজি, ভাম। আমি নিজের চোখে একটা রোগা লম্বা লোমশ ল্যাজওয়ালা চকচকে ছাই রঙের শেয়ালকে ছুটে পালাতে দেখেছি।
একদিন সন্ধ্যায়, বসন্তকালে যখন শালগাছের ফুল ঝরে চারদিক সুগন্ধে ভুরভুর করছে, তখন নকুড় বলে বাস-ড্রাইভার, পকেট থেকে এই এত্তটুকু একটা জানোয়ার বের করে, নবুকাকার হাতে দিয়ে বলল, ‘মা-টি বোধহয় চাপাটাপা পড়েছে। এখন একে দেখে কে? পথের পাশে কেঁদে সারা হচ্ছিল। বুনোকুকুরের ছানা, দাদা। ভাবলাম বউদির ছেলেপুলে বড় হয়ে গেছে, একে পেলে খুশি হবেন।’
রয়ে গেল বুনোকুকুরের ছানা। নাম হল শিরোমণি। প্রথম প্রথম ঝুড়িতে খড়ের গাদায় শুত, পলতে করে দুধ খেত। একটু পরে বড় হলে, তক্তাপোশের তলায় চুপটি করে শুয়ে থাকত। বাড়িতে যা রান্না হত, চেটেপুটে তাই খেয়ে নিত। কোনও উপদ্রব ছিল না। সাড়াশব্দ দিত না। শিরোমণি বলে ডাক দিলেই বেরিয়ে আসত, খেয়েদেয়ে আবার খাটের নীচে। দিনে বড় একটা বাড়ির বার হত না। বনের জানোয়ারের ছানা, নেড়িকুত্তাকে বড় ভয়। রাতে জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে একবার টহল দিয়ে আসত। কোনও উপদ্রব করত না।
পাড়াপড়শিরা গোড়ায় উদ্ভট চেহারার ছানা দেখে নানা মন্তব্য করতেন। পরে তাঁরাও চুপ করে গেলেন। কারণ তাঁদের লালু ভুলু বাঘা পপিদের চেয়ে শিরোমণি ঢের বেশি ভদ্র ছিল।
সবচেয়ে আপত্তি ছিল পাশের বাড়ির মুকুন্দবাবুর স্ত্রী, অগত্যা তিনিও থামলেন। তারপরে একদিন হঠাৎ মহা চ্যাঁচামেচি, ‘কে আমাদের শুকনো পাটকাঠি রোজ-রোজ সরায়?’ ভদ্রমহিলা এইরকম বলেন আর আড়চোখে বারেবারে নবুকাকার বাড়ির দিকে তাকান। শেষটা আর থাকতে না পেরে কাকিমা বললেন, ‘বাছা, শিরোমণি কি উনুন ধরাবে যে তোমার পাটকাঠি নেবে? অন্য জায়গায় দেখো৷’
মাঝে কয়েকদিন গেল। তারপর আবার একদিন ‘পাটকাঠি ফের কে নিল!’ বলে চিৎকার! কাকিমা ওদিকের জানলা বন্ধ করলেন। ওদের সঙ্গে কথাবার্তাও।
সাত দিন বাদে পাশের বাড়িতে ফের চিৎকার— ‘কোথায় গেল অত বড় আম তেলের শিশিটা? এখানে তো টেকা দায় হয়ে উঠল দেখছি! কিছু রাখার জো নেই! না পাটকাঠি, না আম তেল!’
এইরকম বাঁকা কথা শুনে রাগে নবুকাকার কান লাল হয়ে উঠল। এক মনে গড়গড়া টানতে টানতে, হঠাৎ নলটা নামিয়ে কাকিমাকে ডেকে বললেন, ‘একবার খাটের তলাটা ভাল করে দেখো তো ছোটবউ।’
অনেক কষ্টে বেতো হাঁটু মুড়ে বসে কাকিমা ওই নিচু তক্তপোশের তলায় উঁকি মারলেন। উঁকি মেরেই চক্ষুস্থির! খাটের নীচে রাশি রাশি পাটকাঠির মধ্যিখানে আম তেলের শিশির উপর থাবা রেখে, সগর্বে বসে আছে শিরোমণি! কাকিমার মুখে কথা নেই!
সেই রাতে সবাই ঘুমোলে পর, গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে নবুকাকা এক রাশি পাটকাঠি আর এক শিশি আম তেল গভীর শালবনে রেখে এলেন। শিরোমণির গলায় দিনের বেলায় চেন পড়ল। সে কোনও আপত্তি করল না।
কিন্তু আরও কিছুদিন পরে যখন রাতে উঠে, দরজার দিকে মুখ করে পহরে পহরে ক্যা-হুয়া ক্যা-হুয়া রাজা-হুয়া বলে ডাকা ধরল, তখন তাকেও বনে ছেড়ে আসা ছাড়া উপায় রইল না। সেখানে সে সুখেই থাকত। ফিরবার চেষ্টা করেনি।