জানি তুমি আসবে – ৯

কালকিনির বসির মোল্লা এ বছর ইলেকসনে জিতে এম.পি. হয়েছেন। ওনার একমাত্র ছেলে জুলহাস গত বছর বি.এ. পাশ করে মাস্তানী করে বেড়াচ্ছিল। এ বছর বাবা এম.পি. হবার পর মাস্তানী আরও বেড়ে গেছে। দু’জন বন্ধুকে হুডায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বাজারে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। স্কুল কলেজের সেয়ানা মেয়েদের দেখলে টিজ করে। হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করার প্রস্তাব দেয়। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটাইনি।

একদিন সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা যখন কলেজ থেকে ফিরছিল তখন জুলহাস তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পথ আগলে তার নাম ও পরিচয় জিজ্ঞেস করল।

অনেকের গায়ের রং কালো হলেও মুখের চেহারা ভালো হয়; কিন্তু জুলহাসের গায়ের রং যেমন কালো, মুখের চেহারাও তেমনি কুতসিৎ। তাই তাকে দেখে রাহেলা চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, আপনি কে যে, নাম পরিচয় বলতে হবে?

জুলহাস ঘেঁতো হাসি হেসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, এবার আপনারটা নিশ্চয় বলবেন?

তাদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য রাহেলা নাম পরিচয় বলে হাঁটতে শুরু করল।

জুলহাস তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে নিতম্বের উত্থান পতন দেখতে দেখতে বন্ধুদের বলল, এই মেয়েকে বিয়ে করতেই হবে। তারপর ঘরে এসে মাকে রাহেলার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তুমি বাবাকে ব্যবস্থা করতে বল।

বশির মোল্লার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তিনি সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানকে চেনেন। ইলেকশানের সময় লোকটা তার হয়ে অনেক কাজ করেছেন। ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় স্ত্রীর কাছে শুনে একজন ঘটককে ডেকে পাঠালেন। ঘটক আসার পর সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের ও তার মেয়ের খোঁজ খবর নিতে বললেন।

ঘটক বলল, ওনাকে খুব ভালো করে চিনি। আর্থিক অবস্থা ভালো। ওনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ঢাকায় ফুপুর বাসায় থেকে ভার্সিটিতে পড়ছে। মেয়ে ঘরে থেকে গ্রামের কলেজে পড়ছে। অপূর্ব সুন্দরী, সচরাচর এত সুন্দরী মেয়ে দেখা যায় না। যেমন গায়ের রং তেমনি চেহারা। চেয়ারম্যান যে ভালো লোক, তা আপনিও জানেন। ওনার মেয়ে আপনার পূত্রবধু হওয়ারই যোগ্য।

বশির মোল্লা বললেন, তাই যদি হয়, তা হলে আপনি আজই গিয়ে প্রস্তাব দিন। তারপর তাকে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তোমাকে খুশি করে দেব।

ঘটক সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে ঐ দিন বিকেলে সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেল।

চেয়ারম্যান ঘটককে চেনেন। তাকে দেখে বললেন, কী ঘটক মিয়া, কী খবর?

ঘটক সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আমাদের এম.পি. সাহেব পাঠিয়েছেন।

তাই না কী? কেন পাঠিয়েছেন বলুন।

উনি আপনার মেয়েকে একমাত্র পুত্রের বৌ করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছেন।

চেয়ারম্যান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে উনি জানলেন কেমন করে? আপনি নিশ্চয় বলেছেন?

ঘটক বলল, আমি কিছুই বলিনি। ওনার ছেলে একদিন আপনার মেয়েকে কলেজ থেকে ঘরে ফেরার পথে দেখে পছন্দ করেছে। সেকথা জেনে এম.পি. সাহেব আমাকে প্রস্তাব নিয়ে পাঠালেন। আপনারা রাজি থাকলে কথাবার্তা বলার জন্য উনি আসবেন।

ইলেকসানের ব্যাপারে বসির মোল্লা ছেলে জুলহাসসহ বেশ কয়েকবার চেয়ারম্যানের কাছে এসেছেন। জুলহাস স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত হলেও গায়ের রং কালো, মুখের শ্রীও ভালো নয়। অচেনা কেউ হঠাৎ দেখলে ভয় পাবে।

সেই ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে শুনে চেয়ারম্যান ঘটকের উপর খুব রেগে গেলেও তা বাইরে প্রকাশ করলেন না। মুখের উপর না করে ঘটককে ফিরিয়ে দিলে এম.পি সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন। তাই নাস্তা করিয়ে বিদায় দেয়ার সময় বললেন, বিয়ে সাদির ব্যাপারে ভেবে চিন্তে কাজ করতে হয়। তা ছাড়া মেয়ে কলেজে পড়ছে, তারও মতামত নিতে হবে। যাই হোক, সপ্তাহখানেক পরে আসবেন তখন মতামত জানাব।

ঘটক ফিরে এসে এম.পি. সাহেবকে চেয়ারম্যানের কথা জানাল।

এম.পি. সাহেব বললেন, চেয়ারম্যান ভালো কথা বলেছেন। আপনি সপ্তাহখানেক পরে গিয়ে খবর নিয়ে আসবেন।

এক সপ্তাহ পরে ঘটক এলে চেয়ারম্যান বললেন, এম.পি. সাহেবকে বলবেন, ওনার প্রস্তাব পেয়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু মেয়ে এখন পড়ছে বিয়েতে একদম রাজি নয়। শিক্ষিত বয়স্কা মেয়েকে তো আর জোর করে বিয়ে দেয়া যায় না। তারপর ঘটককে বিদায় করে দিলেন।

ঘটক ফিরে এসে চেয়ারম্যান এম.পি. সাহেবকে যা কিছু বলতে বলেছেন বললেন।

নিজের ছেলে দেখতে খারাপ বলে এম.পি. সাহেব প্রায় তার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করেন। কোনো উচ্চ বংশের মেয়ের বাবা তার ছেলেকে দেখলে জামাই করতে চাইবেন না। তাই যেদিন স্ত্রীর মুখে চেয়ারম্যানের মেয়েকে ছেলে পছন্দ করেছে শুনেছেন তখনই ভেবেছেন, চেয়ারম্যান রাজি হবেন না। কারণ তিনি জুলহাসকে দেখেছেন। তবু ছেলের মন রাখার জন্য ঘটককে ডেকে পাঠান। ঘটকের মুখে মেয়ে অপূর্ব সুন্দরী জেনেও ঐ একই কারণে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখন ঘটকের কথা শুনে বললেন, হু, যা বোঝার বুঝে গেছি। আপনি অন্য মেয়ের খোঁজ করুন। শুনুন, মেয়ের বাবাকে বলবেন, আমাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই। পাত্রী শিক্ষিত ও সুন্দরী হলে আমরা নিজেদের খরচে সবকিছু দিয়ে বৌ করে নিয়ে আসব।

ঠিক আছে সাহেব, তাই হবে বলে ঘটক বিদায় নিয়ে চলে এল। বড় রাস্তায় এসে দেখল, এম.পি. সাহেবের ছেলে ও তার দু’জন বন্ধু হুন্ডার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

কাছে এলে জুলহাস সালাম বিনিময় করে বলল, এই যে ঘটক চাচা, কি খবর বলুন।

ঘটক বলল, চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, মেয়ে এখন বিয়ে করবে না পড়াশোনা করবে।

জুলহাসও জানে কোনো মেয়ের বাবা তাকে দেখলে যেমন জামাই করতে চাইবে না, তেমনি মেয়েও তাকে দেখলে বিয়ে করতে চাইবে না। তবে তার টাকার অহংকার আছে। ভাবে টাকা থাকলে যদি বাঘের চোখ পাওয়া যায়। তা হলে সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যাবে না কেন? এখন ঘটকের কথা শুনে রাহেলার উপর প্রচণ্ড রেগে গেল। তাকে বিদায় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তোর রূপসূধা পান করে মুখে এ্যাসিড দিয়ে যদি পুড়িয়ে না দিই তো আমি বাপের বেটা নই।

এরপর থেকে রাহেলাকে ধরার জন্য দু’বন্ধুকে হুন্ডায় নিয়ে কলেজে। যাতায়াতের রাস্তায় আড্ডা দিতে লাগল।

কলেজ পনের দিন বন্ধ থাকায় রাহেলা কলেজে যাইনি। আজ কলেজ খুলতে ক্লাস করতে এসেছিল। প্রথম দিন বলে দুপুর একটায় ছুটি হয়ে যায়।

কলেজে যাতায়াতের পথে রাস্তার পাশে একটা বেশ বড় বিল আছে। বিলের পাড়ে কাশবন। বিলটা লোকালয় থেকে বেশ দূরে মাঠের মাঝখানে। তখন গ্রীষ্মকাল হওয়ায় দুপুরের পর লোকজনের যাতায়াত কম। কলেজ ছুটির পর রাহেলা ফেরার পথে বিলের কাছে এসে দেখল, সেদিনের সেই তিনটে ছেলে রাস্তার ধারে হুন্ডার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলা না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে আসছিল, ওড়নায় টান পড়তে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কাল কুচকুচে ছেলেটা, সেদিন যে এম.পি. সাহেবের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিল, তার হাতে ওড়নাটা।

রাহেলা খুব স্মার্ট মেয়ে স্বাস্থ্যও ভালো, ভয় ডর কাউকে করে না। তার উপর বাবা চেয়ারম্যান। তাই একটু বেপরোয়া স্বাভাবের। ওড়নাটা ঝাঁপটা মেরে টান দিয়ে বলল ছাড়ন। এম.পি. সাহেবের ছেলের কাছ থেকে এরকম আশা করিনি। তারপর অন্য দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের ঘরে কী মা বোন নেই?

বন্ধুরা কিছু বলার আগে জুলহাস বলল, মা-বোন সবার ঘরেই থাকে। রাস্তার মেয়েরা তো মা বোন নয়। তারপর ধরা ওড়নাটা জোরে টান দিতে রাহেলা ছিটকে এসে জুলহাসের গায়ের উপর পড়ল। আর বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।

জুলহাস তাকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুদেরকে বলল, চল কাশবনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ফুর্তি করব। তারপর এসিড ঢেলে মুখ পুড়িয়ে দেব। শালিকে বিয়ে করব বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। শালীর বাপ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপর তিনজনে মিলে রাহেলাকে কাশবনে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করতে লাগল।

.

শফি পরের দিন সকালে বন্ধু রবিউলের কাছে গিয়ে মাতব্বর দাদুর চাকরির প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বলল, তুই কী বলিস?

।রবিউল খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, কোনো দ্বিমত

করে রাজি হয়ে যা। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর দাদিকে বলেছিস?

বলেছি।

 উনি কী বললেন?

উনিও শুনে খুশি হয়ে বললেন, মাতব্বর খুব ভালো কথা বলেছেন। তুই ঢাকায় চাকরি করতে না গিয়ে এই চাকরি কর।

ঢাকায় চাকরি করার ইরাদা করেছিলি না কি?

না, করিনি। চাচা একদিন কি করব না করব জিজ্ঞেস করেছিলেন। ওনার মন বোঝার জন্য দাদির সামনে কথাটা বলেছিলাম। দাদি সেই কথাটা সত্য মনে করেছেন।

রবিউল বলল, দেরি না করে আজকেই মাতব্বরকে তোর মতামত জানিয়ে দে।

ঠিক আছে তাই দেব বলে শফি তার কাছে বিদায় নিয়ে মাতব্বরের কাছে গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করে মাদ্রাসায় চাকরি করার মত প্রকাশ করল।

মাতব্বর খুশি হয়ে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলেন, তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। আর দেরি করে কাজ নেই, কালকেই দরখাস্ত লিখে দিয়ে এস। আমি ভাইসপ্রিন্সিপালকে দেয়ার জন্য একটা চিঠি লিখে রাখব। যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে যেও।

শফি জিজ্ঞেস করল, উনি কি খুব বয়স্ক লোক?

মাতব্বর বললেন, হ্যাঁ, উনি প্রায় বিশ বাইশ বছর ঐ পদে আছেন।

শফি বলল, আমি ছেলে মানুষ। তা ছাড়া প্রিন্সীপাল হওয়ার জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার, তা আমার নেই। তাই বলছিলাম ভাইস প্রিন্সিপালকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ করুন আর আমাকে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে। উনি যখন রিটায়ার্ড করবেন তখন না হয় আমাকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ করবেন।

মাতব্বর সাহেব বললেন, কমিটির তরফ থেকে ওনাকে আমি কথাটা জানিয়েছিলাম। বললেন, আমার বয়স হয়েছে ঐ দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি তোমাকেই প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ দিতে চাই। তবে উনি যেন তোমাকে প্রিন্সিপালের কাজ-কর্ম বুঝিয়ে দেন, সেই ভাবেই আমি চিঠি লিখে ওনাকে ব্যবস্থা করতে বলব।

আজ শফি বেলা এগারটার সময় মাদ্রাসায় গিয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, চরদৌলতখানের মাতব্বর সূরুজমিয়া আমাকে পাঠিয়েছেন।

ভাইস প্রিন্সিপালের বয়স পঁয়ষীর মতো। চুল দাড়ি সব পেকে সাদা। হয়ে গেছে। ইসলামের বিধি নিষেধ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। শফির আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বসতে বলে বললেন, আপনি আসবেন মাতব্বর সাহেব কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েছেন। তারপর বললেন, কই, দরখাস্ত দিন।

শফি মাতব্বর দাদুর চিঠিসহ দরখাস্তটা ওনার হাতে দিল।

মাতব্বর ফোন করে ভাইস প্রিন্সিপালকে শুধু জানিয়েছে “একটা জিনিয়াস ছেলেকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। কথাটা ঠিক বলেছি কিনা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন।” তাই প্রথমে দরখাস্থের উপর একবার চোখ বুলিয়ে মাতব্বরের চিঠি পড়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে শফির দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তা করলেন, যে ছেলের এতগুলো ডিগ্রী, তাকে আবার কী পরীক্ষা করবেন? বললেন, আপনি এখানে কাজ করতে চান জেনে খুব খুশি হয়েছি। সামনের শুক্রবার কমিটির মিটিং বসবে। আরও অনেক দরখাস্থ পেয়েছি। ঐদিন তাদেরকে আসার জন্য খবর দেয়া হয়েছে। আপনিও আসবেন। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন।

ফেরার পথে শফি যখন বিলের কাছে এল তখন কাশবনের দিক থেকে মেয়েলী কণ্ঠ শুনতে পেল, “কে কোথায় আছ আমাকে এই পশুদের হাত থেকে বাঁচাও।” ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব দ্রুত সেদিকে এগোল। একটু পরেই দেখতে পেল, চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলাকে তিনটে ছেলে উলঙ্গ করার চেষ্টা করছে। রাহেলা প্রাণপণে ইজ্জৎ বাঁচাবার জন্য তাদের সাথে ধস্তাধস্তী করছে আর ঐ কথা বলে চিৎকার করছে।

শফি ছুটে এসে একজনের গর্দানে প্রচন্ড জোরে ক্যারাটের চাপ মারল।

ছেলেটা বাবারে বলে রাহেলাকে ছেড়ে দিয়ে ঘাড় ধরে লুঠিয়ে পড়ে জ্ঞান হারাল।

ততক্ষণে শফি আর একজনের তলপেটের নিচে অণ্ডকোষে প্রচন্ড জোরে লাথি মেরে তৃতীয়জনকে ধরে মাটিতে কয়েকটা আছাড় মেরে ছেড়ে দিল। যার অণ্ডকোষে লাথি মেরেছিল সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল। শফি জুলহাসকে কয়েকটা আছাড় মারার ফলে তার নাখ মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইল।

রাহেলার গায়ের কামিজের অধিকাংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শফি ওদেরকে আক্রমণ করতে সুযোগ পেয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল আর তার চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। সেই অবস্থায়। শফিকে চিনতে পেরে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার কার্যকলাপ দেখছিল।

তিনজনকে অজ্ঞান করে শফি যখন রাহেলার কাছে এল তখন রাহেলা কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারল না। শুধু ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে থেমে গেল। তবে একইভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে চোখের। পানি ফেলতে লাগল। তার মনে হল স্বপ্ন দেখছে। কয়েকদিন আগে বাবার মুখে কীভাবে লেঠেল সর্দার মোবারকের একটা হাত ভেঙ্গে দিয়ে এবং যেসব কথা বলে পুরস্কারের দশ হাজার টাকা তাকে দিয়েছে, সেসব শুনে খুব অবাক হয়ে ভেবেছে, শফি মানুষ না ফেরেশতা। আজ আবার তিনজনকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেরে অজ্ঞান করতে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল, সত্যিই শফি মানুষ না ফেরেশতা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাহেলা এসব ভাবছিল।

রাহেলার কাপড়ের অবস্থা দেখে শফি নিজের পাঞ্জাবী খুলে তার কাঁধে রেখে বলল, এটা পরে ওড়না গায়ে জড়ান। কথা শেষ করে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আর ভয় নেই। আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই বলে হাঁটতে শুরু করল।

তার কথা শুনে রাহেলা তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে সারা শরীরে ওড়না জড়িয়ে তার পিছু নিল। একটু দ্রুত হেঁটে এসে পাশাপাশি যেতে যেতে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপনি এসে না পড়লে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। এই কথা বলে যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

শফি জানে কাঁদলে মানুষের মন কিছু হালকা হয়। তাই কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বলল, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যে যা থাকবে তা কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে মানুষ যদি সাবধান হয়ে ও চিন্তা ভাবনা করে কাজ করে, তা হলে অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দ.) মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে বেরোবার সময় পর্দা করে বেরোতে বলেছেন। আজকাল মুসলমান ঘরের মেয়েরা জেনে ও না জেনে বিধর্মীদের মতো বেপর্দা হয়ে পথে ঘাটে চলাফেরা করছে। তাইতো এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে।

ততক্ষণে তারা বড় রাস্তায় হুন্ডার কাছে চলে এল। বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে দেখে শফি সেগুলো কুড়িয়ে রাহেলার হাতে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, ওদের আপনি চেনেন?

রাহেলা বলল, কালো কুচকুচে ছেলেটা এম.পি. বশির মোল্লার ছেলে। বাকি দু’জনকে চিনি না।

শফি আর কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

ঘরের কাছে এসে রাহেলা বলল, আপনি বৈঠকখানায় একটু বসুন, আমি আসছি। তারপর ঘরে ঢুকে মায়ের সামনে পড়ে গেল।

মেয়ের অবস্থা দেখে আখতার বানু আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কী হয়েছে?

রাহেলা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

আখতার বানু মেয়েকে কখনও কোনো ব্যাপারেই কাঁদতে দেখেন নি। বড় শক্ত মেয়ে তার। সেই মেয়েকে কাঁদতে দেখে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে বললেন, কাঁদছিস কেন কি হয়েছে বলবি তো?

রাহেলা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা ঘরে নেই?

আখতার বানু বললেন, না, একটু আগে বেরিয়ে গেল। কী হয়েছে বলছিস না কেন?

সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে রাহেলা বলল, চরদৌলতখানের যে ছেলেটাকে বাবা মোবারক লেঠেলের দ্বারা মেরে হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে নিয়ে এসেছে। তারপর ওড়না সরিয়ে পাঞ্জাবীটা দেখিয়ে বলল, এটা ঐ ছেলেটার। তারপর কান্না জড়িতস্বরে বলল, ঠিক সময় মতো যদি ছেলেটা এসে না পড়ত, তা হলে বদমাসগুলো আমার ইজ্জৎ লুটে নিয়ে এসিড দিয়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দিত।

আখতার বানু খুব অবাক হয়ে ভয়ার্তস্বরে বললেন, কী সর্বনাশের কথা, ছেলেগুলোকে চিনিস?

মাকে ছেড়ে দিয়ে রাহেলা বলল, একজনকে চিনি। সে কালকিনির এম.পির ছেলে জুলহাস। তার বাবা নাকি আমাকে ছেলের বৌ করার জন্য ঘটককে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন?

আখতার বানু বললেন, হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে তোর বাবার মুখে শুনেছি। সে তো না করে দিয়েছে।

রাহেলা বলল, কই, আমাকে তো তোমরা কিছু জানাওনি।

আখতার বানু বললেন, তোর বাবা হয়তো তোকে জানাবার দরকার মনে করেনি। অথবা না করে দিয়েছে বলেও হয়তো জানাইনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেই ছেলেটা চলে গেছে।

রাহেলা বলল, যাহ্, ওনার কথা ভুলেই গেছি। বৈঠকখানায় বসতে বলেছিলাম। তুমি ওনার নাস্তার ব্যবস্থা কর বলে নিজের রুমে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টাল। তারপর শফির পাঞ্জাবী একটা খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কাজের বুয়াকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দাও। আমি। বৈঠখানায় যাচ্ছি।

রাহেলা বৈঠকখানায় এসে শফিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল, সরি, অনেক দেরি করে ফেললাম, সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। তারপর কাগজে মোড়া পাঞ্জাবীটা ফেরত দিয়ে বলল, আর একটু বসুন নাস্তা খেয়ে যাবেন।

শফি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আজ আর দেরি করতে পারব না। আবার যেদিন আসব সেদিন খাব। একটা অনুরোধ করছি, বোরখা পরে কলেজে যাবেন আর একা যাবেন না, সঙ্গে একজনকে নেবেন। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে সেখান থেকে চলে এল।

রাহেলা তার দিকে চেয়ে চিন্তা করল, ঐ একহারা ছেলেটার গায়ে এত শক্তি প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতাম না। শফি আড়াল হয়ে যাওয়ার পরও কতক্ষণ সেদিকে চেয়েছিল খেয়াল নেই। কাজের বুয়া নাস্তা নিয়ে এসে যখন বলল, আপা, মেহমান কই? তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, মেহমান চলে গেছেন, এগুলো নিয়ে যাও।

চেয়ারম্যান রাতে ঘরে ফিরে স্ত্রীর কাছে মেয়ের দুর্ঘটনার কথা শুনে তাকে ডেকে পাঠালেন।

রাহেলা এসে মায়ের কাছে বসল।

চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, তোর মায়ের কাছে যা শুনলাম তা কি সত্য?

রাহেলা ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, হ্যাঁ বাবা, সত্য। তুমি এম.পি সাহেবকে ঘটনা জানিয়ে বিচার চাইবে।

চেয়ারম্যান বললেন, আমি তো ভাবতেই পারছি না ঘটককে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে এম.পি সাহেবের ছেলে এরকম জঘন্য কাজ করবে?

রাহেলা রাগের সঙ্গে বলল, এম.পি. সাহেব ঘটককে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেকথা আমাকে জানাওনি কেন?

জানাবার প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ ওনার ছেলেকে কয়েকবার দেখেছি। কালো কুৎসিত এবং মুখের শ্রীও ভালো না। তাই তোকে না। জানিয়ে ঘটকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি।

তবু আমাকে জানানো উচিত ছিল। তুমি কিন্তু এম.পি. সাহেবকে ঘটনা জানিয়ে বিচার চাইতে ভুলবে না।

পুরো ঘটনাটা বলতে শুনি।

রাহেলা পুরো ঘটনা জানিয়ে ছলছল চোখে বলল, শফি যদি ঐ সময়ে এসে না পড়তেন, তা হলে তোমরা আমার লাশ সেখান থেকে নিয়ে আসতে। তারপর চোখ মুছে আবার বলল, আমার একটা কথা রাখতেই হবে। বল রাখবে?

রাখব, বল কী কথা।

ভবিষ্যতে আর কখনও শফির এতটুকু ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। মনে রাখবে, তিনি তোমাদের মেয়ের শুধু ইজ্জৎ রক্ষা করেন নি, পুনর্জন্মও দিয়েছেন। ভাইয়াকেও ফোন করে ঘটনা জানিয়ে বলে দিও, সেও যেন। শফির এতটুকু ক্ষতি করার চেষ্টা না করে। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।

চেয়ারম্যান স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ের কথা শুনে কিছু বুঝতে পারলে?

আখতার বানু বললেন, না বোঝার কী আছে? শফি মহসিনকে দু’বার অপমান করেছিল? তাই তোমরা তাকে মারধর করে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিলে। তবু শফি আজ আমাদের মেয়েকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তাই রাহেলা তার ক্ষতি করতে নিষেধ করল।

চেয়ারম্যান মৃদু হেসে বললেন, একেই বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি।

আখতার বানু মুখ ভার করে বললেন বুদ্ধি আবার বুঝতে কী দোষ করল?

চেয়ারম্যান বললেন, যা শুনলে তা মেয়ের মুখের কথা, অন্তরের কথা হল, রাহেলা শফিকে ভালবেসে ফেলেছে।

তোমার যেমন কথা বলে আখতার বানু রাগে গরগর করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলেন।

রাত্রে ঘুমাবার সময় রাহেলা চোখের পাতা এক করতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই দূর্ঘটনার কথা মনে পড়তে লাগল। সেই সাথে উদ্ধারকর্তা শফি কীভাবে বদমাস তিনজনকে অজ্ঞান করে তাকে বাঁচাল। তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা মনের পাতায় ভেসে উঠতে লাগল। হঠাৎ ডালিয়ার কথা মনে পড়তে ফোন করল।

.

ডালিয়া কয়েকদিন শফির কথা চিন্তা করে করে ঘুমাতে পারছে না। সেদিনের পর প্রায় প্রতি রাতে তাকে ফোন করে। রিং হয়ে হয়ে লাইন কেটে যায়, তবু শফি ফোন ধরে না। আজও রাত এগারটার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করছিল; কিন্তু শফি ফোন না ধরায় মনে কষ্ট পেলেও তার উপর রাগ করতে পারছে না। কারণ তার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে শফির কথা মনে পড়ে। তাকে এক দন্ডের জন্যও ভুলতে পারছে না। রাত বারটার সময় হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠতে তার বুকটা আনন্দে ছলকে উঠল। ভাবল নিশ্চয় শফি ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করার সময় আনন্দের চুটে নাম্বার না দেখেই উফুল্ল কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

রাহেলা খুব অবাক হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কীরে, মনে হচ্ছে খুব আপনজনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলি?

রাহেলার গলা চিনতে পেরে ডালিয়া সামলে নিয়ে বলল, আমার কথা বাদ দে। এত রাতে ফোন করেছিস কেন বল?

তাতো বলবই, তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।

তুই ঠিকই ধরেছিস, একজনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। এবার তোরটা বল।

সেই একজনটা কে বলবি তো?

কী বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ডালিয়া বলল, সে কথা পরে শুনিস। এতরাতে ফোন করার কারণটা বলে ফেল। আমার তো মনে হচ্ছে। এ সময়ে ফোন করার বিশেষ কোনো কারণ ঘটেছে?

রাহেলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তুইও ঠিক ধরেছিস।

ডালিয়া ব্যাগ্র কণ্ঠে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি কারণটা বলে ফেল।

বাবা লেঠেল সর্দার মোবারক চাচাকে দিয়ে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু….

কথাটা শুনে ডালিয়ার বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলল, মোবারক লেঠেল কি তাই করেছে?

আরে না, বরং উল্টো শফি মোবারক চাচার একটা হাত ভেঙ্গে একটা পাও ভেঙ্গে দিতে যাচ্ছিল। মোবারক চাচা স্যারেন্ডার করাতে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পুরস্কারের দশ হাজার টাকা দিয়ে হাতের চিকিৎসা। করাতে ও লেঠেলগীরি ছেড়ে দিয়ে সম্ভাবে জীবন যাপন করতে বলেছে।

এতক্ষণে ডালিয়ার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। বলল, পুরস্কারের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

রাহেলা চরদৌলতখানের মাতব্বরের লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা করার কথা বলে বলল, আমি প্রতিযোগীতা দেখতে যাইনি। বাবা ও ভাইয়া গিয়েছিল। বাবা ফিরে এসে বলল, শফি মানুষ না জ্বিন অথবা ফেরেশতা।

পুরো ঘটনা শুনে ডালিয়ারও শফিকে তাই মনে হল। এখন বুঝতে পারল যখন ফোনে মোবারক লেঠেলের কথা বলে শফিকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম তখন কেন সে হেসে উঠেছিল। জিজ্ঞেস করল, এটা কতদিন আগের ঘটনা?

প্রায় পঁচিশ দিন আগের হবে।

এতদিন না জানিয়ে আজ জানালি কেন?

মনে করেছিলাম ভাইয়া তোকে বলেছে।

মহসিন ভাই তো আমাদের এখানে আর থাকে না।

রাহেলা অবাক হয়ে বলল, কই, সেকথা তো জানি না।

তারপর জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাকে তা হলে?

তার এক বন্ধুর বাসায় পেয়িং গেষ্ট হিসাবে থাকে।

কবে থেকে বলতো?

এবারে ঢাকায় ফিরে এসে মাত্র দু’তিন দিন আমাদের বাসায় ছিল। তারপর চলে গেছে।

ফুপা ফুপু বাধা দেন নি?

তা আবার দেয়নি। তাদের কথা শুনেনি।

চলে যাওয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে?

তা আছে।

কারণটা বলতে শুনি।

কারণটা আমি। তোর কারণে ভাইয়া অন্য জায়গায় চলে গেল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, খুলে বল।

ডালিয়া বলল, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। আগের মতো এখন আর হুন্ডায় চড়ে কোথাও যাই না। বোরখাপরে সব জায়গায় যাতায়ত করি। ভার্সিটিতেও বোরখা পরে যাই। মহসিন ভাই বাড়ি থেকে এসে সব কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে আমাকে এসব পাগলামী ছাড়তে বলল। তার কাছে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলা নাকী পাগলামী। যাই হোক, আমি ঐ সব ছাড়তে রাজি না হতে খুব তর্ক বিতর্ক করে শেষে আমার উপর রাগ করে দু’তিন দিন পর বন্ধুর বাসায় চলে গেছে।

তুই যেতে দিলি কেন? আফটার অল কয়েকমাস পরে তোদের যখন বিয়ে হচ্ছে।

কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। তা ছাড়া সে তো ছোট না, যে তাকে জোর করে ধরে রাখব।

ফুপাফুপি ভাইয়ার চলে যাওয়ার কারণ জানেন?

জানে।

ওনারা তোকে কিছু বলেন নি?

তা আবার বলেন নি। বাবা অল্প রাগারাগি করলেও মা ভীষণ রাগারাগি করেছে।

তা তোর ঘাড়ে এরকম ভূত চাপলো কেন?

ভূত চাপেনি। বললাম না, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন?

তোর পাগলামী দেখে ফুপাফুপি কিছু বলেননি?

বাবা কিছু বলেনি। রাগারাগী করে বলল, এসব বুড়ো বয়সের ব্যাপার এখন কার কথায় এরকম পাগলামী করছিস? তা ছাড়া মহসিন যখন এসব পছন্দ করে না তখন এসব করা ঠিক নয়। হাজার হোক কিছুদিনের মধ্যে তার সঙ্গে তোর বিয়ে হবে। তার কথা তোর মেনে চলাই উচিত। বললাম…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাহেলা বলে উঠল, ফুফু তো ঠিক কথা বলেছেন।

ডালিয়া বলল, যারা কুরআন হাসিদের ব্যাখ্যা পড়েনি তাদের কাছে ঠিক। কারণ শুধু স্বামী কেন, মা বাবাও যদি ইসলামের পরিপন্থি কোনো কাজ করতে বলে, তবু মানা চলবে না। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে বলেছেন। তুই তো কুরআন হাদিস পড়িসনি, এসব কথা জানবি কী করে? জেনে রাখ, জান গেলেও এপথ থেকে কেউ আমাকে ফেরাতে পারবে না।

রাহেলা বলল, এ পথ থেকে না ফিরলে ভাইয়া যদি তোকে বিয়ে করতে চায় না, তবু ফিরবি না?

ডালিয়া দৃঢ়স্বরে বলল, না, ফিরব না। এবার আমার কথা শোন, তোর ভাইয়া যদি আমি যে পথে চলেছি সেই পথে না চলে, তা হলে আমিও তাকে বিয়ে করব না। কারণ ধার্মিক ছেলে মেয়ের সঙ্গে ধর্ম বিমুখ ছেলে মেয়ের বিয়ে হওয়া যেমন একদম উচিত নয়, তেমনি তাদের দাম্পত্য জীবনও মোটেই সুখের হয় না। বরং দোযখের মতো অশান্তির আগুনে তারা সারাজীবন পুড়তে থাকে।

রাহেলা বলল, তুই যে বললি, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ তোকে হেদায়েত দিয়েছেন, তা সেই একজনটা কে?

এখন বলতে পারব না।

কখন বলতে পারবি?

আল্লাহ যখন বলাবেন তখন বলব। তারপর ডালিয়া বলল, আমার কথা রেখে এবার তোর কথা বল। এতরাতে শুধু মোবারক লেঠেলের হাত ভাঙ্গার ঘটনা বলার জন্য নিশ্চয় ফোন করিসনি?

ভাইয়া ডালিয়াদের বাসা থেকে চলে গেছে শুনে রাহেলার খারাপ লাগছিল।

এখন তার কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেল। বলল, তুই ঠিক বলেছিস। আজ একটা দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমার মনে যে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।

তাই না কী? তা হলে তো দুর্ঘটনা ও বিপ্লবের কাহিনী শুনতেই হয়।

বলছি শোন, বলে রাহেলা এম.পি. সাহেবের ছেলে জুলহাসের সঙ্গে প্রথম দিনের সাক্ষাৎ থেকে আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে যা কিছু ঘটেছে সব বলে ভিজে গলায় বলল, ঐ সময়ে শফি এসে যদি উদ্ধার না করতেন, তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকত না। কথা শেষ করে রাহেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

মোবারক লেঠেলের পরিণতির কথা শুনে শফির প্রতি ডালিয়ার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার শফি তিনজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে লড়াই করে রাহেলার ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে শুনে সেই শ্রদ্ধা হাজারগুণ বেড়ে গেল। সেই সাথে তার প্রতি ভালবাসাও লক্ষগুণ বেড়ে গেল। বলল, তুই কাঁদছিস কেন? আল্লাহ শফির দ্বারা তোকে সাহায্য করেছেন। সেজন্যে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানা।

রাহেলা কান্না থামিয়ে বলল, তাতো জানিয়েছি। তারপর আবার বলল, শুনে তুই কী মনে করবি জানি না; ঐ ঘটনার পর থেকে শফি নাম আমার হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আমাকে সম্পূর্ণ না হলেও প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলেছিল। শফি তাদেরকে অজ্ঞান করে নিজের গায়ের পাঞ্জাবী খুলে আমায় পরতে দিয়েছিল। সে সময় সে আমার শরীরের উপরের অনেক গোপন অংশ দেখেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকেই বিয়ে করব। তাকে পাওয়ার জন্য আমিও তোর মতো জীবনের গতি পাল্টে ফেলব ভেবেছি। শুনেছি শফি খুব ধার্মিক। তাই আমিও ধার্মিক হবার চেষ্টা করব।

তার কথা শুনে ডালিয়ার হার্টবিট বন্ধ হবার উপক্রম হল। কিছু না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলানর চেষ্টা করতে লাগল।

রাহেলা বলল, কীরে, চুপ করে আছিস কেন? আমার সিদ্ধান্ত ঠিক না বেঠিক বলবি তো?

ডালিয়া ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলল, জেনেছি আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করে পয়দা করেছেন তার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শোন, ঘড়ির। দিকে চেয়ে দেখ কটা বেজেছে। আমার মাথা ধরেছে। এখন রাখছি বলে লাইন কেটে দিল।

তারপর ডালিয়া আর ঘুমাতে পারল না। চিন্তা করতে লাগল,রাহেলা প্রেম নিবেদন করলে শফি কী করবে? আবার রাহেলা যখন জানবে তার আগেই আমরা প্রেমে পড়েছি তখন সে কী করবে? এইসব চিন্তা করতে করতে ফজরের আজান হয়ে গেল। বাথরুমের কাজ সেরে অজু করে এসে নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে গুনাহখাতা মাফ চেয়ে শফিকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য দোয়া করল। তারপর কিছুক্ষণ কুরআনের ব্যাখ্যা ও কিছুক্ষণ হাদিস পড়তে পড়তে ঘুম পেতে ঘুমাতে গেল। কিন্তু চোখে ঘুম এল না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকে চিন্তা করতে লাগল, শফি এতদিন ফোন করেনি কেন? তাকে ফোন করলেও ধরেনি কেন? এখন ফোন করে দেখা যাক কী হয় ভেবে ফোন করল।

শফি মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে এসে প্রতিদিনের মতো আজও কুরআন তেলাওয়াত করছিল। মোবাইল বেজে উঠতে কুরআন বন্ধ করল। তারপর নাম্বার দেখে বুঝতে পারল, ডালিয়া ফোন করেছে। এর আগে যতবার করেছে ততবার শফি ইচ্ছা করে ধরেনি। কারণ শহরের বড় লোকের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছে। তারা অনেকের সঙ্গে প্রেম করে। এখন মোবাইল চালু হওয়ার পরে তাদের প্রেমিক প্রেমিকার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। অবশ্য ডালিয়া সেরকম মেয়ে নয় বুঝতে পারলেও মহসিনের সঙ্গে তার বিয়ের কথা এক রকম পাকা হয়েই আছে সেকথা সে জানে। তাই তার প্রেমের গভীরতা ও সত্য মিখ্যা যাচাই করার জন্য ফোন রিসিভ করেনি। আজ রিসিভ করে সালাম দিল।

শফিকে ফোন রিসিভ করে সালাম দিতে শুনে আনন্দে ডালিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। এতদিন ফোন রিসিভ না করার ফলে তার প্রতি ডালিয়ার যত রাগ অভিমান ছিল, সেসব গলে পানি হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে তবু ফুঁপিয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শফি বলল, কান্না মানুষের মনের ময়লা দূর করে দেয়।

ডালিয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পান তাই না?

তাই বুঝি আপনার মনে হয়?

এতদিন অসংখ্যবার ফোন করেছি, রিং হয়ে হয়ে কেটে গেছে, এটাই কী তার প্রমাণ নয়?

যা বলব বিশ্বাস করবেন?

এ জগতে কাউকে যদি বিশ্বাস করি, তিনি হলেন আপনি।

আপনি ফোন করলে মোবাইলে যতক্ষণ রিং হতে থাকে ততক্ষণ আমার হৃদয় আনন্দে তড়পাতে থাকে। তখন নিজের সত্ত্বা হারিয়ে ফেলি। তাই ফোন রিসিভ করার কথা মনেই থাকে না।

শফির কথা শুনে ডালিয়ার হৃদয়ে আনন্দের তুফান দেড়শ দুশ মাইল বেগে বইতে শুরু করল। কোনো রকমে সুবহান আল্লাহ বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

চুপ করে আছেন কেন? কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না?

ডালিয়া অনেক কষ্টে তুফানের বেগ সামলে নিয়ে বলল, এক্ষুনি কী বললাম মনে নেই বুঝি? আবার বলছি “এ জগতে কাউকে যদি বিশ্বাস করি, তিনি হলেন আপনি।” তারপর আবার বলল, আপনার কথা শুনে হৃদয়ে আনন্দের যে তুফান উঠেছিল, তা সামলাবার জন্য কথা বলতে পারিনি।

তোমার ভালো নাম কী? শাকেরা সাবিহা।

বাহ- খুব সুন্দর নাম। নামের অর্থ জান?

আগে জানতাম না, কয়েকদিন আগে একটা নামের বই কিনে এনে জেনেছি।

শফি বলল, আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলছি। কারণ এখন আর আপনি করে বলা ঠিক নয়। তুমিও তাই বলবে।

না বাবা না, আমি পারব না।

কেন পারবে না।

আপনি সব বিষয়ে আমার থেকে অনেক বড়। তা ছাড়া আপনি কত মহৎ। মহৎ ব্যক্তিকে ছোটর তুমি করে বলা কি উচিত?

না, উচিত নয়, তোমার আমার সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে আপনি করে বলা মানে প্রেমকে অপমান করা। এবার তুমি করে বলবে নিশ্চয়? তবু যখন ডালিয়া চুপ করে রইল তখন বলল, তুমি করে না বললে লাইন কেটে দেব। পরে রিং করলেও রিসিভ করব না।

তোমার দীল খুব শক্ত তাইতো শুধু আমাকে কাঁদাও।

তুমি করে বলছ যখন তখন আর কাদাব না।

প্ৰমিশ?

প্রমিশ। এবার খুশিতে কৃতজ্ঞতা স্বীকার কারিনী বালিকা?

আমি বুঝি এখনও বালিকা?

তাতো বলিনি, তোমার নামের অর্থ বলেছি।

তোমার নামের অর্থ কি?

শফি অর্থ অনুস্বরণকারি।

নামের আগে পরে কিছু নেই?

পুরো নাম মুহাম্মদ শফি। মুহাম্মদের অর্থ হল প্রশংসিত।

তোমার নামটা আমার নামের থেকে ভালো। একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে।

ইচ্ছা যখন করছে তখন দেরি না করে বলেই ফেল।

তুমি মাইন্ড করবে না বল?

না, করব না।

তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

এই ইচ্ছাও পূরণ হবে।

কী করে?

সেটা তোমার ব্যাপার। কী করে করবে সে উপায় তুমি বের কর।

যদি তোমাকে আসতে বলি?

বলেই দেখ না।

সত্যি বলছ?

কিছুক্ষণ আগে তুমিই তো বললে, নিজের থেকে বেশি আমাকে বিশ্বাস কর। এখন আবার সত্য মিথ্যার প্রশ্ন আসছে কেন?

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মাফ করে দাও।

আমারও মুখ দিয়ে হঠাৎ যদি কখন কিছু বেরিয়ে যায়, তা হলে মাফ করে দেবে তো?

অফকোর্স।

তা হলে আমিও এখন তোমাকে মাফ করে দিলাম।

কবে আসছ?

তুমি বললে এক্ষুনি রওয়ানা দেব।

ডালিয়া মুখ থেকে আবার সত্য বলছ তো কথাটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে বলল, এক্ষুনি রওয়ানা দিলে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করব।

আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না?

সেকথা আমার চেয়ে তুমি ভালো জান।

জমিলা খাতুনও ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তেলাওয়াত শেষ করে ইসরাকের নামায পড়ে বেরিয়ে এসে শফিকে ফোনে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

দাদিকে রুম থেকে বেরোতে দেখেই শফি ডালিয়াকে বলল, আল্লাহ রাজি থাকলে এক্ষুনি রওয়ানা দেব। তাই লাইন কেটে দিচ্ছি বলে মোবাইল অফ করে দিল। তারপর দাদিকে বলল, ঢাকা থেকে ফোন এসেছিল, আমাকে এক্ষুনি রওয়ানা দিতে হবে। আপনি নাস্তা রেডি করুন, আমি গোসল করে আসি। জমিলা খাতুন জানেন, শফি নিজের থেকে কিছু না বললে কোনো কথার উত্তর দেয় না। তাই কে এবং কেন ফোন করেছিল জিজ্ঞেস না করে নাস্তার জোগাড়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *