২
মাদারীপুর জেলার চর দৌলতখান গ্রামের মল্লিকদের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। মুহাম্মদ শফি ওরফে শফি এ বংশের আমিনুল ইসলাম মল্লিকের একমাত্র সন্তান। শফি দেখতে খুব সুশ্রী। স্মরণশক্তি প্রখর। দশ বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হয়। সেই সাথে ফাঁইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পায়।
একই গ্রামের দূর সম্পর্কের ভাই রবিউলের সঙ্গে শফির খুব ভাব। একদিন বিকেলে রবিউল ও পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করার সময় শফি হারিয়ে যায়। বাবা আমিনুল ইসলাম ও আত্মীয়রা অনেক খোঁজাখুজি করেও পাইনি। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা সাজেদা খাতুন। খুব কান্নাকাটি করতে থাকেন। বাবা আমিনুল ইসলাম কান্নাকাটি না করলেও বেশ ভেঙ্গে পড়েন এবং বছর খানেকের মধ্যে হঠাৎ একদিন মারা যান।
শফির দাদা কুরআনের হাফেজ ছিলেন। ওনার ছেলে আমিনুল ইসলামকেও হাফেজ করার জন্য হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে খুব কঠিন অসুখ হয়ে আমিনুল ইসলামের মেধা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। কোনো রকমে দাখিল পর্যন্ত পড়ে আর পড়াশোনা করেনি। বাবার সঙ্গে জমি-জায়গা দেখাশোনা করতেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার দু’বছর পর আমিনুল ইসলামের বাবা মারা যান। আমিনুল ইসলাম খুব সুপুরুষ ছিলেন। পরিশ্রমীও ছিলেন। বাবা অনেক সম্পত্তি রেখে গেলেও বিভিন্ন কাজ কর্ম করে ও নিজের জমি-জায়গা আবাদ করে আরও অনেক সম্পত্তি বাড়ান।
তিনি মারা যাওয়ার পর ওনার স্ত্রী সাজেদা খাতুন প্রায় তিন বছর শাশুড়ী জমিলা খাতুনের কাছে থাকেন। এর মধ্যে আমিনুল ইসলামের চাচাত ভাই জাকির হোসেনের স্ত্রী-দুই ও চার বছরের দু’টো ছেলে মেয়ে রেখে মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ায় ছেলেমেয়ে দুটোর কষ্ট দেখে আবার। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য চাচি জামিলা খাতুনের কাছে প্রস্তাব দেন।
সাজেদা খাতুন সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। শফি তার একমাত্র সন্তান। শফি হারিয়ে যাওয়ার পর কেঁদে কেঁদে ও ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল। ইদানিং আবার আগের মতো স্বাস্থ্য ফিরে এসেছে।
সাজেদার বাবার অবস্থাও স্বচ্ছল। জামাই মারা যাওয়ার কিছুদিন পর একদিন এসে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা জমিলা খাতুনকে বললেন।
জমিলা খাতুন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস আল্লাহ চাহে তো শফি একদিন ফিরে আসবে। তবু বলব আপনারা মেয়েকে বলে দেখুন, সে যদি যেতে চায়, আমার আপত্তি নেই।
বাবাকে শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে সাজেদা খাতুন আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাশুড়ীর কথা শুনে সামনে এসে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, শাশুড়ীর মতো আমারও বিশ্বাস, শফি একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরে আসবে।
সাজেদা খাতুনের বাবা অনেক বুঝিয়েও মেয়েকে রাজি করাতে পারলেন না। এরপর তিন বছর পার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবতী ও রূপবতী বৌকে কোননা পুরুষহীন ঘরে আগলে রাখা যে খুব কঠিন। তা জামিলা খাতুন এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। তাই চাচাত দেবরের ছেলে জাকিরের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যখন সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিল তখন অমত করলেন না। বললেন, সাজেদার মতামত নিয়ে তোমাকে জানাব।
জমিলা খাতুন সাজেদার মা বাবাকে ডেকে পাঠালেন। ওনারা আসার পর সুবিধে অসুবিধের কথা জানিয়ে দেবরের ছেলে জাকিরের প্রস্তাব দেয়ার কথা জানালেন।
সাজেদার মা বাবা বললেন, এটা খুব ভালো কথা। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ কাজ হলে বরং খুশি হব।
জমিলা খাতুন সাজেদাকে ডেকে ওনাদের সামনে সবকিছু বলে মতামত জানতে চাইলেন।
সাজেদা প্রথমে অনেক কান্নাকাটি করে অমত প্রকাশ করলেও মা বাবা ও শাশুড়ীর বোঝনর ফলে রাজি হলেন।
এর দশ পনের দিনের মধ্যে জাকির হোসেন সাজেদাকে বিয়ে করেন। তারপর থেকে জাকির হোসেন চাচির সংসার ও চাষাবাদ দেখা শোনা। করেন।
প্রায় বিশ বছর পর শফি ঘরে ফিরে এলে দাদি জমিলা খাতুন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
সাজেদা খাতুনও ছেলের ফিরে আসার কথা শুনে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে স্বামীকে বললেন, আমি শফির সঙ্গে দেখা করতে যাব।
জাকির হোসেন বললেন, নিশ্চয় দেখা করবে। যাও, এক্ষুনি যাও।
শফি বাবা মারা গেছেন জেনে দুঃখ পেলেও মা আবার বিয়ে করেছে শুনে দুঃখ পাইনি। বরং খুশি হয়েছে।
সাজেদা খাতুন যখন এলেন তখন শফি দাদির সঙ্গে কথা বলছিল।
শফি অল্পক্ষণ ওনার দিকে চেয়ে থেকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর মা বলে জড়িয়ে ধরল।
সালামের উত্তর দিয়ে সাজেদা খাতুন ছেলের মাথায় চুমোখেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তোকে একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরিয়ে দেবেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? একটা চিঠি দিয়েও এই হতভাগী মাকে খবর দিতে পারতিস? আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশি হত।
শফিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, বিশেষ কারণে চিঠি দিতে পারিনি। তবু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও মা বলে দু’পা জড়িয়ে ধরল।
মা ও ছেলেকে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করতে দেখে জমিলা খাতুন বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৌমা, এবার কান্নাকাটি থামাও। আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করেছেন, সেজন্য তার শুকরিয়া আদায় করে সবর কর।
সাজেদা খাতুন কান্না থামিয়ে শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুখ মুছে ছেলের মুখ মুছে দেয়ার সময় বললেন, এতদিন কোথায় ছিলি বললি না যে?
শফি বলল, ওসব কথা এখন থাক, পরে এক সময় বলব।
সাজেদা খাতুন বললেন, আবার চলে যাবি না তো?
শফি বলল, না মা যাব না।
সাজেদা খাতুন বললেন, এখন যাই, পরে আসব বলে চলে গেলেন।
এরপর থেকে সাজেদা খাতুন বর্তমান স্বামীর সংসার করলেও প্রতিদিন এবাড়িতে শফির সঙ্গে দেখা করতে এসে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যান। একদিন তিনি সুযোগ মতো শফিকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কারণে তুই কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিস?
শফি বলল, আমার ব্যবহারে সেরকম কিছু কি তুমি দেখতে পেয়েছ?
সাজেদা খাতুন বললেন, না, তা পাইনি। তবু জিজ্ঞেস করলাম।
শফি বলল, আল্লাহ যদি মেহেরবানী করে ধর্মের জ্ঞান না দিতেন, তা :হলে হয়তো তোমার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারতাম না। ধর্মীয় জ্ঞান থাকার ফলে তোমার প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি অন্যের স্ত্রী হলেও আমার মা। ছেলের কাছে মা কী জিনিস সে জ্ঞানও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তুমি দোয়া করো মা, “আল্লাহ যেন সেই জ্ঞান মোতাবেক তোমার সেবা যত্ন করার তওফিক আমাকে দেন”।
ছেলের কথা শুনে সাজেদা খাতুনের কলিজা জুড়িয়ে গেল। ভিজে গলায় বললেন, আল্লাহ তোকে আরও ধর্মীয় জ্ঞান দিক, তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুক। দু’চার দিন পরে তোর নানাদের বাড়িতে গিয়ে সবাইকে দেখা দিয়ে আয়। তোকে দেখে সবাই খুশি হবে। এখন যাই, পরে আবার আসব, হাতের কাজ ফেলে এসেছি বলে চলে গেলেন।