১০
চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন একদিন মেয়ের উপর হামলাকারী তিনজনের খোঁজ নিতে শামসের নামে একজন চামচাকে কালকিনি পাঠালেন।
শামসের ফিরে এসে জানাল, এমপি সাহেবের ছেলে জুলহাসের কোমর ভেঙ্গে গেছে। সে কুঁজো হয়ে চলাফেরা করে।
যে তলপেটে আঘাত পেয়েছিল, তার একটা কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে। আর যে ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিল, তার ঘাড় বসে গেছে। জীবনে কোনোদিন আর ঘাড় ঘোরাতে পারবে না।
চেয়ারম্যান তিনজনের পরিণতির কথা মেয়েকে জানিয়ে বললেন, বিচার আল্লাহই করে দিয়েছেন। আর কিছু করার দরকার নেই। করতে গেলে এমপি সাহেব শফির কথা জানতে পারবেন। তখন আবার শফিকে নিয়ে টানাটানি পড়বে। ক্ষমতার জোরে আইনের প্যাঁচে ফেলে তাকে জেলে পাঠাতে পারেন অথবা তার অন্য কোনো ক্ষতি করতে পারেন। তুই তো আবার শফির কোনো ক্ষতি হোক চাস না।
রাহেলা বলল, আল্লাহ যখন বিচার করে দিয়েছেন তখন আর কিছু করার দরকার নেই। আচ্ছা বাবা, এমপি সাহেব যদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কে আপনার মেয়েকে তিনজন সন্ত্রাসীর হাত থেকে উদ্ধার করেছে? তখন কী বলবে?
ওসব নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। বলব, আমি তাকে দেখিনি।
কিন্তু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলেটাকে চিনি কিনা?
বলবি, ছেলেটাকে ঔদিনের আগে কখনও দেখিনি, আর পরেও দেখিনি।
কী জানো বাবা, আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে। তুমি বোরখা কিনে দেবে। বোরখা পরে কলেজে যাব। আর একা যাব না। সঙ্গে একজন লোক দেবে।
চেয়ারম্যান বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। আর শোন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যাদেরকে ভয় পাওয়ার কথা তারা তো একরকম পঙ্গু হয়ে গেছে। তা ছাড়া আমার সাহায্যে বসির মোল্লা ভোটে জিতে এমপি হয়েছেন। ইলেকসানের সময় নানাভাবে সাহায্য করেছি। যখন জানবেন, তার ছেলে বন্ধুদের নিয়ে আমার মেয়ের ইজ্জৎ নষ্ট করতে চেয়েছিল তখন এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন বলে মনে হয় না। শুনেছি, ওদের প্রত্যেকের। বুক পকেটে একটা করে চিরকুট পাওয়া গেছে। সেগুলোতে লেখা ছিল, কি জন্যে তাদেরকে এরকম শাস্তি দেয়া হল।
বাবার কথা শুনে রাহেলা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, একেই বলে আল্লাহর বিচার। তুমি কিন্তু বোরখা কিনে না আনা পর্যন্ত আমি কলেজে যাব না।
এতদিন শফির ভালোমন্দ চিন্তা করে রাহেলা তার ফোন নাম্বার জানা সত্ত্বেও ফোন করেনি। আজ বাবার কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে রাত সাড়ে ন’টার সময় ফোন করল।
শফি সবেমাত্র খেয়ে নিজের রুমে এসেছে। মোবাইল বেজে উঠতে অচেনা নাম্বার দেখে ভাবল, কেউ দুষ্টুমী করে মিস কল দিয়েছে, নচেৎ রং নাম্বারে ফোন করেছে। তাই লাইন কেটে দিল। একটু পরে আবার মোবাইল বেজে উঠতে একই নাম্বার দেখে নিশ্চিত হল কেউ দুষ্টুমী করছে। তাই এবারও লাইন কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে দিল। বলাবাহুল্য সে রাহেলার মোবাইল নাম্বার জানে না।
রাহেলা আবার ফোন করে বুঝতে পারল, শফি মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়েছে। তবু কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিতে লাগল।
আজ শফিকে ফোন করার পালা ডালিয়ার। তাই সাড়ে দশটা বেজেছে দেখে শফি মোবাইলের সুইচ অন করে বালিশে মাথা রাখল। ডালিয়াও সে সময়ে প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে ফোনে আলাপ করে। আজ বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে মোবাইল বেজে উঠতে নাম্বার দেখে বুঝতে পারল, সাড়ে নটার সময় যে ফোন করেছিল তারই নাম্বার। ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, আপনি প্রায় একঘণ্টা আগে থেকে ফোন করছেন কেন? কে আপনি?
রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছেন? চিনতে পারছেন?
শফির স্মরণশক্তি খুব প্রখর। একবার কাউকে দেখলে অথবা কারও সঙ্গে আলাপ করলে বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে। তাই চিনতে পেরে বলল, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। আপনি চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সাহেবের মেয়ে রাহেলা। কিছু মনে নেবেন না, আপনার মোবাইল নাম্বার জানা ছিল না। তাই দুষ্টুমি করে কেউ মিসকল দিচ্ছে ভেবে প্রথমে রিসিভ করিনি। পরে বার বার রিং হতে সুইচ অফ করে দিয়েছি।
রাহেলা বলল, না, কিছু মনে করিনি।
তা ফোন করেছেন কেন? এনি প্রবলেম? সে
কথা পরে, আগে বলুন কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো আছি। তবে- বলে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে মনের কথা বলবে।
ডালিয়া নিশ্চয় বারবার ফোন করছে, এঞ্জেজ জেনে কী মনে করছে ভেবে শফি অস্থিরতা অনুভব করল। তাই রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কেন ফোন করেছেন বলবেন তো?
রাহেলা কিছু বলতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠল।
শফি বলল, কাঁদছেন কেন? ওরা কি আবার পিছনে লেগেছে?
রাহেলা সামলে নিয়ে বলল, ওরা আমার পিছনে আবার লাগবে কী, আপনার হাতে ধোলাই খেয়ে সবাই পঙ্গু হয়ে গেছে।
তা হলে কাঁদছিলেন কেন?
বললে বিশ্বাস করবেন?
শফির মন তাকে সাবধান করে দিল। রাহেলার কথার টোনে বুঝতে পারল, সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বলল, বিশ্বাস করার মতো হলে সবাই বিশ্বাস করবে।
আমি তো সবার কথা বলিনি, বলেছি আপনার কথা।
দেখুন, এমন কথা বলবেন না যা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হবে।
কঠিন না সহজ জানি না, যা সত্য তাই বলছি, আমি আপনাকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। বলুন আমাকে ফেরাবেন না?
কথাটা শুনে শফির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, কৌতুকেরও একটা সীমা আছে।
রাহেলা ভিজে গলায় বলল, মোটেই কৌতুক করছি না। বিশ্বাস করুণ আর নাই করুণ সত্যি কথাই বলছি।
এ রকম পাগলামী মথায় এল কেন? আপনার বাবা ও ভাইয়া আমাকে কি নজরে দেখেন তা জানেন; কিন্তু ওনারা যে আমাকে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিতে চান তা জানেন না। আর আপনিও তাদের দলে ছিলেন। কিছুদিন আগে নরপশুদের হাত থেকে আপনার ইজ্জত বাঁচিয়েছি বলে হয়তো আপনার মনের পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে এখন যা বললেন, তা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।
আমার মনের পরিবর্তনের কথা যা বললেন তা ঠিক। আর এটাও ঠিক, তারা আমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলবে তবু আমার ভালোবাসাকে মেনে নেবে না।
তাই যদি জানেন, তা হলে মাথায় ঢোকা ভালোবাসার ভূতকে হত্যা করে ফেলুন।
আপনি বোধ হয় জানেন না, যার মাথায় একবার ভালোবাসার ভূত। ঢুকে, তাকে হত্যা করাতো দূরের কথা, মাথা থেকে তাড়াতেও পারে না।
শফি বলল, মানুষের জীবনে হবে না, পারবে না বলে এমন কিছু নেই। চেষ্টা করলে মানুষ কি না করতে পারে। চেষ্টার দ্বারা মানুষ পানিতে, আকাশে ভ্রমণ করছে। এমনকি বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে যাচ্ছে। আর এতো সামান্য…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাহেলা বলে উঠল, নীতিকথা শোনার জন্য আপনাকে ফোন করিনি, করেছি ভালোবাসার অর্ঘ আপনার পায়ে দিতে, গ্রহণ করবেন কি না বলুন।
শফি বলল, নীতিবাক্য নাই শুনলেন, এবার যা বলছি মন দিয়ে শুনুন-আমার হৃদয় শূন্য আছে, না কেউ সেই আসনে ঢুকে পড়েছে, তা না জেনে ভালোবাসার অর্থ দেয়া আপনার উচিত হয়নি। আপনাকে অপমান করার জন্য কথাটা বলছি না অথবা মিথ্যে করেও বলছি না। আমি একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি। আর সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাদের বিয়ের কথাও একরকম পাকা হয়ে গেছে। এখন আপনিই বলুন, আমার কী করা উচিত। আমাকে ভালোবেসেছেন জেনে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে; কিন্তু সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছি না বলে খুব দুঃখ লাগছে। আমার মনে হয় ভালোবাসা যখন অন্তরের ব্যাপার এবং সেই ভালোবাসার সফলতার পথও বন্ধ তখন তা প্রকাশ না করে অন্তরেই চেপে রেখে বাস্তবকে মেনে নেয়াই উচিত। আমাকে যদি আপনি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন, তা হলে যা বলব, মেনে নেবেন বলুন।
রাহেলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বলুন।
আমাদের মিলনের পথ যখন বন্ধ তখন আমরা ভাইবোন সম্পর্ক করে আজীবন ভালোবাসাকে ধরে রাখতে পারি। এটা ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।
তার কথা শুনে এবারে আরও বেশিক্ষণ চুপ করে থেকে রাহেলা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল অন্য কোনো পথ যখন ভোলা নেই তখন আপনার কথা মেনে নিলাম।
শফি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বুলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় না। আজ অনেক রাত হয়েছে। পরে এক সময় বলব। কথা শেষ করে সালাম দিয়ে লাইন কেটে দিল। রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে মোবাইল অফ করে চিন্তা করল, কে সেই ভাগ্যবতী, যে নাকী শফির মন জয় করেছে। পরে শফিকে ফোন করে জানতে হবে।