জানি, তুমি অনন্য
(এক)
রাতে ঝমঝম করে বেজে ওঠা ফোনের শব্দে বিছানার উপর উঠে বসল অনির্বাণ৷ এমনিতে পেশাগত কারণে রাতবিরেতে ওর কাছে ফোন আসা আশ্চর্যের কিছু নয়৷ অন্যদিন হলে রিসিভই করত, কিন্তু আজ মেজাজটা একেবারেই ভালো নেই৷ সারাদিন চেম্বারে বিস্তর খাটনি গেছে৷ কারও সঙ্গে কথা বলতে আর ভালো লাগছে না৷
ফোনটা কেটে দেবেই ভাবছিল৷ হঠাৎ কলার আইডিতে ভেসে ওঠা নামটা দেখে থেমে গেল৷ ওর কোনও পেশেন্ট কিংবা তার বাড়ির লোক নয়৷ সেখানে জেগে আছে অনিকেতের নাম৷
অনিকেত ওর কলেজ জীবনের বন্ধু৷ একটা সময় হূদ্যতা ছিল দু-জনের৷ অনির্বাণ চিরকালই একটু ডাকাবুকো গোছের৷ অনিকেত ঠিক উল্টো৷ কোথাও কিছু গন্ডগোল হলেই ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকত৷ টেনশনে হাত-পা গুটিয়ে আসত৷ ওর চরিত্রের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্যই ছিল ওইটা, টেনশন৷
কলেজ শেষ হওয়ার পর দু-জনের যোগাযোগ একেবারেই কমে এসেছিল৷ কিছুদিন আগে অনিকেত নিজেই ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়৷ সেই সূত্রেই অনির্বাণ জানতে পারে বছর তিনেক হল একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে অনিকেত৷ একটা আইটি কোম্পানিতে দু-জনেই চাকরি করছে৷ মাঝে মাঝে মেয়েটার সঙ্গে ছবি আপলোড করে৷ অনির্বাণ তাতে লাভ রিঅ্যাক্ট দেয়৷
কিন্তু এখন রাত প্রায় আড়াইটা বাজে৷ এই সময়ে পুরনো বন্ধুকে তো কেউ গল্পগুজব করার জন্য ফোন করে না৷ কোনও বিপদ হল নাকি? অবশ্য অকারণে যেরকম টেনশন করত ছেলেটা… একরকম উৎকণ্ঠা নিয়েই ফোনটা ধরে অনির্বাণ,
—বল ভাই, এত রাতে…
—আমি একটা ঝামেলায় পড়েছি ভাই৷
—সে তো তোর গলা শুনেই বুঝতে পারছি৷ কী ব্যাপার, কোনও বিপদ-আপদ হয়েছে কারও?
—কারও নয়, আমার৷
—তোর! কী হয়েছে?
—আমার মনে হয় মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷
এই উত্তরটা অনির্বাণের কাছে নতুন নয়৷ ওর অনেক পেশেন্টেরই থেকে থেকে এরকম একটা সন্দেহ জাগে মনে৷ সত্যি কথা বলতে মাথাখারাপ মানুষ মাত্রই অল্পবিস্তর থাকে৷ তারা নিজেরা যদি সেটা বুঝতে পারে সেটা আরেক ধরনের ছিটলামো৷
—সাডেনলি এরকম ভাবছিস! কিছু ঘটেছে?
—তুই সঞ্চারীর কথা তো জানিস?
—হ্যাঁ…
—ওর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে৷
—দেখ ছেলেদের মাথাটা বিয়ের পর খারাপ হয়, আগে নয়৷
—আমি ইয়ার্কি মারছি না ভাই৷ আমার মনে হচ্ছে আমার এই বিয়েটা করা উচিত নয়৷
—উচিত নয়! কেন?
—
পরের কথাগুলো একটু সময় নিয়ে বলে অনিকেত৷ অনির্বাণ বুঝতে পারে কথাগুলো প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি জোর দিয়ে বলছে সে, ‘দেখ, আমার প্রেমটা তিন বছরের৷ বুঝতেই পারছিস প্রথম প্রেমের উষ্ণ ছোঁয়া-ফোয়া যেগুলো হয় সেসব আমার মধ্যে নেই৷ ব্যাপারটা ডাল-ভাত-গামছা-সাবানের মতো হয়ে গেছে…’
‘তো?’
‘তো জানি না কেন একটা ভাবনা দিনদিন আমার মাথার ভিতর চেপে বসছে৷ আমার কেবল মনে হচ্ছে সঞ্চারীর মতো মেয়ে আর এ দুনিয়াতে নেই…’
অনির্বাণ উত্তর দিতে গিয়ে এবার হেসে ফেলে, ‘এতে পাগলামির কী আছে? কাউকে ভালোবাসলে এসব মনে হতে পারে৷ যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়… রাত হয়েছে…’
বিরক্ত গলায় ধমকে ওঠে অনিকেত, ‘আঃ, আমার কথাটা শোন৷ ব্যাপারটা অত সহজ না৷ তুই আমাকে এরকম যাত্রাপালা টাইপের ডায়ালগ দিতে শুনেছিস আগে? আমার কেবলই মনে হচ্ছে সঞ্চারী এই পৃথিবীর অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা৷ কিন্তু কোথায় আলাদা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না… কিছুতেই আইডিয়াটা থেকে বেরতে পারছি না…’
অনিকেত ছেলে ছোট থেকেই এরকম পাগলাটে৷ ফলে অনির্বাণ খুব একটা অবাক হয় না, একবার হাঁই তুলে বলে, ‘এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা ভাই৷ তুই, আমি, সবাই… যাই হোক, শুধু এটাই না আরও কিছু?’
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে, ‘শুধু এটা হলে তো চিন্তা ছিল না৷ কিন্তু… তুই তো জানিস আমি ছোট থেকেই নার্ভাস৷ সেটা যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছে৷ কিছু একটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হলেই বাড়ির লোককে জ্বালিয়ে মারি৷ ইদানীং ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর র্যাপিডলি বেড়ে যাচ্ছে… একটা জিনিস আমার মনে হচ্ছে, বুঝলি?’
‘কী মনে হচ্ছে?’
‘এই টেনশন করার ব্যাপারটা আমার বাতিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম এটাকে তোদের ভাষায় ওসিডি বলে৷ আর সেটা হলে আমাকে বিয়ে করে ওর লাইফটা হেল হয়ে যাবে ভাই…’
অনির্বাণের মেজাজ গরম হয়ে ওঠে, এই ফালতু বকার জন্য মাঝরাতে ফোন করেছে? রেগে মেগেই বলে, ‘আগে ইন্টারনেটে ডাক্তারি ফলানোটা বন্ধ কর৷ ওসিডি কি জ্বর-সর্দি-কাশি নাকি যে হুট করে সেট ইন করবে?’
‘না, হেরিডিটারি, আমার দাদুর ছিল৷ ঠাকুমা কিছুটা ওনার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের জন্যই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে… মানসিক রোগ অনেক সময়ই তো হেরিডিটারি হয়…’
আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল তো৷ অনির্বাণের মাথাটা আরও কয়েক পরত গরম হয়, ‘তা হতে পারে৷ এমনকী অন্য কোনও মানসিক সমস্যাও থাকতে পারে৷ আপাতত তোর কেবল এটা মনে হচ্ছে যে সঞ্চারীর মতো মেয়ে আর হয় না৷ কিন্তু তার জন্য…’
‘আমি চাই না সঞ্চারীর অবস্থা আমার ঠাকুমার মতো হোক… তুই আমায় একটু টাইম দিতে পারবি?
অনির্বাণ বিছানার উপর উঠে বসে একবার মাথায় হাত ঘষে, ‘বেশ, তোর পয়সা খসানোর ইচ্ছা হয়েছে যখন আমি বারণ করার কে? টাইম করে চলে আয়… আর আপাতত ঘুম না এলে একটা কাজ কর…’
‘কী কাজ?’
‘যে যে কারণে তোর মনে হচ্ছে ব্যামোটা তোর মাথায় চেপেছে সেগুলো লিখে রাখ…’
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে অনির্বাণ৷ মাথাটা গরম করে দিল রাতবিরেতে৷
এক্ষুনি আর ঘুম আসবে না৷ আড়মোড়া ভেঙে ফেসবুকটা স্ক্রল করতে থাকে অন্যমনস্কভাবে৷ অনিকেতের প্রোফাইলটা হাতের কাছে আসে৷ ওর কয়েকটা ছবি আর ভিডিও প্রোফাইলে পরপর উঠে আসতে থাকে৷ সেগুলো মন দিয়ে দেখতে থাকে অনির্বাণ৷ দু-জনের একসঙ্গে ছবি, আলাদা আলাদা সেলফি হাই তুলতে তুলতে সেসব দেখতে থাকে অনির্বাণ৷ হুট করে এক জায়গায় ওর চোখ আটকে যায়…
(দুই)
মিউজিক স্কুলে ঢুকে সবার আগে অনিকেতের মনে হয়েছিল এসব ওর জন্য না৷ মিউজিক শেখার খুব যে একটা আগ্রহ আগে ছিল তাও না৷ তবে কলেজ শেষ করা আর পুরোদমে চাকরি শুরু করার মাঝের সময়টা একটা ক্রিয়েটিভ কিছু না করলেই নয়৷ কিন্তু ব্যাজার মুখে ক-দিন কন্টিনিউ করতেই সুরের প্রেমে পড়ে যায় অনিকেত৷ ওর অস্থির মনটাকে, মনের ভিতর চলা সর্বক্ষণের টেনশনটাকে, একমাত্র মিউজিকই শান্ত করতে পারে৷
অল্পবিস্তর গিটার আগে বাজাতে পারত অনিকেত৷ ছেলেবেলায় মহব্বতে দেখে ভায়োলিন বাজানোর শখ জেগেছিল৷ কিন্তু দু-বার ছড় টানতেই শেয়ালের চিৎকারের মতো আওয়াজ হতে বুঝেছে ও জিনিস ওর জন্য না৷
সেদিন সবে বাজনার ক্লাস শেষ হয়েছে৷ ক্লাস শেষ করে কমন রুমে বসে যন্ত্রপাতি গোছাচ্ছিল৷ ঘরে ও ছাড়া আর একটা মাত্র মেয়ে বসে৷ নতুন ভর্তি হয়েছে মেয়েটা৷ একটা একুস্টিক গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং শব্দে টিউন করার চেষ্টা করছে৷ সম্ভবত এখনও ঠিক করে টিউন করতে শেখেনি৷ মাঝে মাঝেই বিকট শব্দ করে আর্তনাদ করছে গিটারটা৷ না চাওয়া সত্ত্বেও একবার সেই আওয়াজ শুনে হেসে ফেলেছিল অনিকেত৷ মেয়েটা আড় চোখে সেটা দেখে মনে মনে খেপেছে৷
মেয়েটাকে এমন আহামরি কিছু দেখতে নয়৷ মাঝারি রং, রোগাটে গড়ন, চোখে একটা পাতলা ফ্রেমের চশমা, মুখের উপর বিন্দুবিন্দু ঘাম জমেছে৷ এতক্ষণেও যন্ত্রটা টিউন না হওয়ায় যথেষ্ট অসহায় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে৷ অনিকেতের খারাপ লাগল৷ উঠে গিয়ে একবার সরি বলবে কি? বললে কি আরও রেগে যাবে? বলবে? ভিতরে ভিতরে অস্থির লাগল অনিকেতের…
‘ইয়ে, ম্যাডাম, একটা কথা বলব?’
কান মুচড়ানো থামিয়ে মুখ তোলে মেয়েটা, তারপর আবার নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ বলুন…’
কিন্তু অনিকেত তখন আর বলার অবস্থায় নেই৷ মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই যেটা বলার ছিল সেটা বেমালুম গুলিয়ে গেল৷ সব তালগোল পাকিয়ে যেটা বলতে চাইছিল না সেটাই বলে ফেলল, ‘বলছিলাম, ইয়ে… আপনার লিপস্টিকটা একটু ঘেঁটে আছে৷ মানে ডানদিকটা ঠিকই আছে৷ বাঁদিকেরটা একটু কেমন উঠে মতো গেছে…’
কথাগুলো আশা করেনি মেয়েটা৷ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পিঠের ব্যাগ টেনে চেন খুলতে থাকে সে৷
অনিকেত একটু ইতস্তত করে বলে, ‘আসলে অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ করছিলাম, কিন্তু আপনি কী মনে করবেন ভেবে…’ ও বুঝতে পারে কথাগুলো নিজে বলছে না৷ ভিতরে জমাট বাঁধা টেনশন ওকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে আর পরিস্থিতি একটু একটু করে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে৷
‘না না, এতে মনে করার কী আছে,’
‘না, মানে যদি ভাবেন আমার নজরের দোষ…’
‘ওটা মনে করছি না৷ বুঝতে পারছি…’
এক ধাক্কায় মাথাটা টং করে জ্বলে ওঠে অনিকেতের, ‘অদ্ভুত বেইমান তো আপনি! বলতে কী চাইছেন?’
‘যেটা আপনি বলে ফেললেন…’
টেবিলের উপর একটা চাপড় মারে অনিকেত, ‘এই জন্য বলে আজকের যুগে কারও ভালো করতে নেই৷ এরকম লিপস্টিক ওঠা ঠোঁট নিয়ে বাড়ি যেতেন তারপর বাড়ির লোক ভাবত বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চুম্মাচাটি করে ফিরেছেন, সেটাই ভালো হত, তাই না?’
‘হুহ…’ মেয়েটা ঠোঁট বাঁকায়, ‘আমার বাড়ির লোক ভালো করে জানে ওসব বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড আমার নেই…’
‘শুধু বাড়ির লোক কেন, আপনার এই বিলিতি আমের মতো থোবড়া দেখে আর এই ট্যাঙস ট্যাঙস চোপা শুনে যে কেউ ওটা বলে দিতে পারবে…’
‘আর নিজের চোপাটা দেখেছেন? গায়ে পড়ে জ্ঞান দিয়ে আবার কথা শোনাচ্ছেন! আপনার সঙ্গে বেশিদিন থাকতে গেলে তো যে কেউ উন্মাদ হয়ে যাবে…’
‘কই আপনি তো বেশিদিন আমার সঙ্গে থাকেননি…’
মেয়েটার মুখ এতক্ষণে লাল হয়ে উঠেছে৷ টেবিলের উপর পড়ে থাকা পেপারওয়েটটা শক্ত করে ধরে বলে, ‘দেখুন, আমাকে রাগাবেন না, রাগলে আমার ভিতর থেকে একটা পশু…’
‘আরে রাখুন আপনার পশু, খাটাল থেকে শুধু গরু আর গরুর গু-মুত বেরয়…’
মেয়েটা এবার পেপারওয়েট হাতে নিয়েই এগিয়ে আসে, ‘বড় বুকনি মারছেন যে, আপনি জানেন আমার বাবা কে?’
‘এমন কেউ যাকে একটা দিনের ভুলের মাশুল দিনের পর দিন গুনতে হচ্ছে… যত সব পাগল শালা…’
অনিকেত ফিরে আসছিল, মেয়েটা সিংহবাহিনী হয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসে, ‘আমি পাগল, না? আপনাদের মতো কুৎসিত পুরুষদের আমার চেনা আছে৷ সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাদের পাবেন না জেনে হিংসা হয় আপনাদের৷ তাই তাদের বোকা নির্বোধ, মাথা খারাপ এইসব বলে নিজেদের হতাশা বের করেন…’
‘আপনার যদি নিজেকে সুন্দরী মনে হয় তাহলে শুধু মাথা কেন আপনার চোখের দৃষ্টি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার…’
কপালের শিরা ফুলিয়ে এবার গর্জে ওঠে মেয়েটা, ‘আপনি আর একটা অপমান করলে আমি কিন্তু এবার চিৎকার করব…’
‘সেকি! এতক্ষণ কি তাহলে চিৎকার করছিলেন না?’
এবার আর রাগ সামলাতে পারে না মেয়েটা৷ হাতের পেপারওয়েটটা সজোরে অনিকেতের কপাল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে৷ ঠং করে একটা শব্দ করেই মাটিতে পড়ে ভেঙে যায় সেটা৷ অনিকেতের দুনিয়া দুলে ওঠে৷ ওর মনে হয় ওর মাথাটাও অমন করেই মাটিতে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷ কপাল বেয়ে নামা তরলের অনুভূতি চোখ ঢাকতে সে বুঝতে পারে মেয়েটা উদ্ধত ভঙ্গিতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে…
অনিকেতের চোখ যখন খুলল তখন সে হসপিটালের বেডে শুয়ে৷ মাথায় ঝনঝনে একটা ব্যথা৷ সেটার উপরে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসতেই সামনে ঝুঁকে পড়া একটা লোকের মুখ দেখতে পেল৷ লোকটার গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম৷ সম্ভবত জরুরি তলবে কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন৷ ওকে চোখ খুলতে দেখে লোকটার মুখের উদ্বিগ্ন ভাব খানিকটা কমে এল মনে হয়৷
‘কেমন লাগছে শরীর? ব্যথা আছে?’
অনিকেত মাথা নাড়ায়৷ কিছু বলে না৷
‘ডাক্তার বলল আপনার চোট খুব একটা গুরুতর নয়৷ একটু রক্তও বেরিয়েছে৷ নরমের উপর দিয়েই গেছে…’
‘আপনি…’
‘আমি সঞ্চারীর বাবা৷ তোমার বাড়ির লোককে আমিই খবর দিয়েছি… একটু পরেই চলে আসবেন৷’
নামটা কানে যেতেই অনিকেতের কান আবার গরম হয়ে উঠল৷ কপালে পেপারওয়েট মেরে আবার বাবাকে পাঠানো হয়েছে ক্ষমা চাইতে৷ সে ঘড়ির দিকে তাকাল৷ মাঝে দেড় ঘণ্টা কেটে গেছে৷
‘দেখ৷ কিছু মনে কোরো না৷ তুমি তো আমার ছেলের মতোই৷ আসলে আমার মেয়ের মাথাটা একটু গরম…’
‘একটু!’ অনিকেত গর্জে ওঠে, ‘আরেকটু বেশি গরম হলে আমার বডিটাই এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে যেত…’
‘আমি বুঝতে পারছি৷ তোমার চিকিৎসার জন্য যা দরকার হয়…’
‘আগে আপনার মেয়ের একটু ভালো করে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করুন৷ মাথার ডাক্তার দেখাননি ওকে?’
উপরে নিচে মাথা নাড়েন ভদ্রলোক, ‘দেখিয়েছি…’
‘তাতে ফল হয়নি কিছু?’
‘হয়েছে, ডাস্টার…’
‘ডাস্টার? মানে?’
‘মানে তোমাকে পেপারওয়েট মেরেছে, ওঁকে ডাস্টার…’
অনিকেত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ ভদ্রলোক কপালটা একবার ঘষে নিয়ে বলেন, ‘যাই হোক, আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি ভাই৷ শুধু আমি কেন, ও নিজেও বাইরেই আছে৷ এক্ষুনি…’
অনিকেত আঁতকে ওঠে, ‘না, না তার আবার কী দরকার…’
কে শোনে কার কথা? ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে ঢুকে আসে সঞ্চারী৷ ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে ওর বিছানার পাশে দাঁড়ায়৷ মাটির দিকে চেয়ে কঠিন অথচ শান্ত গলায় বলে, ‘বাবা বলেছেন আপনাকে সরি বলতে…’
‘কিন্তু আপনি বলবেন না, তাই তো?
হঠাৎ করেই মুখ তোলে মেয়েটা, অনিকেত বুঝতে পারে তার মুখে অপরাধবোধ স্পষ্ট, খানিকটা কান্নাকাটি করেছে কি?
আচমকাই বিছানায় কাছে এগিয়ে এসে অনিকেতের হাত চেপে ধরে সে, ‘আমার সত্যি আপনাকে অত জোরে মারা উচিত হয়নি…’
‘অত জোরে মানে? ওর থেকে একটু কম জোরে মারাও উচিত ছিল না…’
‘আপনি গিটার টিউন করা দেখে হাসলেন কেন? তাতেই তো আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল৷ কেউ কিছু না পারলে না হেসে তাকে সেটা শিখিয়ে দিতে হয়…’
‘বেশ, সুস্থ হলেই আপনাকে শিখিয়ে দেব…’
মেয়েটা খুশি হয়ে বলে, ‘ডিল, আপনি আমাকে গিটারের কান মুলে টিউন করা শিখিয়ে দিন, আমি আপনার কান মুলে আপনাকে টিউন করে দেব…’
অনিকেত হেসে ফেলে, মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘হাসছেন যে বড়! আপনার ভয় করছে না আমাকে?
অনিকেত টেবিলের উপর পড়ে থাকা ওষুধের শিশিটা এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে বলে, ‘না না, ভয়ের কী আছে!’
এবার দু-জনেই হেসে ফেলে৷
খানিক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটা৷ অনিকেত মনটা অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করে৷ কপালের ব্যথাটা আগের থেকে একটু কমেছে৷ বাড়ির লোক কি এতক্ষণে এসে পড়েছে? ওরা কি দুশ্চিন্তা করছিল এতক্ষণ?
হাবিজাবি কথা ভাবতে গিয়েও লাভ হয় না৷ কিছুক্ষণ পরে পরেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে ওর মনটা৷ মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠছে বারবার৷ একটা খয়েরি সালোয়ার কামিজ পরেছিল বোধহয়৷ চোখে একটা পাতলা ফ্রেমের চশমা৷ গালের একপাশে একটা তিল আছে৷ মাথার ভিতর যে এত রাগ গিজগিজ করছে সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই৷ সব মিলিয়ে ভারি সাধারণ একটা মুখ৷ কিন্তু সেই মুখটাকেই কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না অনিকেত৷
আচ্ছা মেয়েটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েই ওকে ভুলে যাবে না তো? যাবার আগে আবার দেখা হবে জাতীয় কিছু বলে তো গেল না৷ ফোন নম্বরটা অবধি… পরদিন মিউজিক ক্লাসে আবার দেখা হলে কি অপরিচিতর মতোই আচরণ করবে?
নিজের মাথার মধ্যে ভিড় করা চিন্তাভাবনাগুলোয় নিজেই অবাক হয়ে ওঠে অনিকেত৷
(তিন)
‘দেখ আমার কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে তুই ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিস৷ মানসিক রোগ কারও এরকম হুট করে হতে পারে না…’
অনির্বাণের চেম্বারের জানলাগুলো বিশাল৷ স্বচ্ছ কাচ লাগানো তাতে৷ ফলে বাইরের অনেকটাই দেখা যায়৷ বাইরে শীতের রোদ ঝলমল করছে৷ প্রায় জানলার কাছ অবধি উঠে আসা নারকেল গাছের পাতা সে রোদে স্নান করছে যেন৷ এ দৃশ্য একবার দেখলেই মন হালকা হয়ে যায়৷
আজ বেশ কয়েকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল অনির্বাণের৷ তাও এই সময়টুকু কেবল বন্ধুর জন্যই রেখেছিল৷ ঠিক দুটো বাজার পাঁচ মিনিট আগেই এসে উপস্থিত হয়েছে অনিকেত৷ ওর হাত পায়ে একটা উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট৷ বোঝাই যাচ্ছে ভালোমতো টেনশনে রয়েছে৷ মুখের দিকে তাকালে মায়া লাগে৷
চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ওর কাঁধে একটা হাত রাখে অনির্বাণ৷ একটু আগের কথাটা অনিকেতের কানে যায়নি৷ সে নারকেল গাছের দুলন্ত পাতার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘তুই বল আমার যদি সত্যিই ওরকম কিছু হয় তাহলে আমাদের ফিউচারটা কেমন হতে পারে?’
অনির্বাণ একটু সময় নিয়ে ভেবে বলে, ‘সেটা ডিপেন্ড করছে সিভিয়ারিটি কতটা হচ্ছে তার উপর৷ অল্পবিস্তর ওসিডি প্রায় সবার মধ্যেই আছে৷ যেমন ধর কারও শুচিবাইগ্রস্থতা থাকে৷ তাদের সারাক্ষণ মনে হয় হাতে নোংরা লেগে আছে, পাঁচ মিনিট অন্তর তারা হাত ধুতে থাকে৷ কারও কারও সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার বাই থাকে, একটু এদিক ওদিক হলেই তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ কেউ একটু দুশ্চিন্তা হলেই মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে, ছিঁড়তে ছিঁড়তে টাক পড়ে যায়৷ তবে এগুলো সবই প্রাথমিক স্তর৷ এটা বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে ব্যাপারটা নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে পড়ে… তখন গোটা ব্যাপারটা পারসোনালিটি ডিসর্ডারের মধ্যে চলে যায়…’
‘দাদুর যেমন হয়েছিল… ছোট থেকে অল্পসল্প অবসেশন ছিল৷ বিয়ের পর থেকে সেটা বাড়তে থাকে৷ পান থেকে চুন খসলে টেনশন, সেখান থেকে চিৎকার চেঁচামেচি৷ দিনের পর দিন যেতে যেতে সেটা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে পরিণত হয়৷ বাবা মাঝে মাঝেই দেখত ঠাকুমার সাড়া গায়ে মারের দাগ… একদিন সেই অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে… ঠাকুমা মারা যাওয়ার পরও দাদুর রোগটা সারেনি৷ মাঝে মাঝেই দেওয়ালে মাথা ঠুকত… একদিন আমি নিজেই দেখেছিলাম… গোটা কপাল জুড়ে রক্ত… উফফফ…’
‘সম্ভবত ব্যাপারটা পারসোনালিটি ডিসর্ডারের জায়গায় গেছিল৷ আমি নিজে এমন পেশেন্ট কম দেখিনি…’
‘এর কোনও কিওর নেই?’
দু-পাশে মাথা নাড়ায় অনির্বাণ, ‘এখনও অবধি না৷ সিম্পটমগুলো কোনওভাবে কন্ট্রোলে রাখা যায় বটে কিন্তু পুরোপুরি সারিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব!’
‘জোর করে রোগটা চেপে রাখা যায় না? মানে ধর রোগটা আমার আছে জেনে কেবল ওর সামনে বিহেভিয়ারগুলো প্রকাশ করলাম না…’
মিহি হেসে মাথা নাড়ায় অনির্বাণ, ‘মানসিক রোগ, বিশেষ করে অবসেশন চেপে রাখা যায় না৷ ঘণ্টাখানেক চাইলে করা যেতে পারে৷ কিন্তু কারও সঙ্গে দিনের পর দিন থেকে…’
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে অনিকেত, মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলে, ‘আমি সঞ্চারীর সঙ্গে জেনে বুঝে এটা হতে দিতে পারি না…’
ওর কাঁধে একটা ধাক্কা দেয় অনির্বাণ, ‘অকারণে বেশি ভাবছিস৷ আপাতত তোর শুধু মনে হচ্ছে যে সঞ্চারীর মতো মেয়ে আর হয় না৷ এবং সেই ভাবনার কারণ না জানাটা তোকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলছে৷ এছাড়া আর কিছু ছোটখাটো কারণ…’
‘কারণগুলো মোটেই ছোটখাটো নয়…’ চেয়ার থেকে উঠে কাছের জানলার দিকে এগিয়ে যায় অনিকেত, ‘দেখ ছ-মাস পরে আমাদের বিয়ে৷ তারপর আর পিছিয়ে আসার জায়গা নেই৷ আমি নিজের সুখের জন্য ওর জীবনটা হেল করতে চাই না৷ যদি জিনিসটা অল্পের উপর থাকে তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না, কিন্তু যদি এমন করে বাড়তে থাকে…’
অনির্বাণের গলা অনেকটা খাদে নেমে আসে এবার, নরম শান্ত স্বরে সে বলে, ‘বেশ, আমি তো আছিই৷ আমার কাছে আয় ক-দিন৷ যা জিজ্ঞেস করছি খুলে বল৷ তারপর দেখছি সত্যি তোর ওসিডি আছে, নাকি সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছে… ভালো কথা, সঞ্চারীকে জানিয়েছিস?’
‘বলেছি, ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি…’
হাত বাড়িয়ে একটা ভঙ্গি করে অনির্বাণ, ‘মেয়েটা তোকে ভালোবাসে অনি, ফালতু টেনশন করছিস…’
‘ভালোবাসে বলেই ওর লাইফটা নিয়ে ছেলেখেলা হতে দিতে পারি না…’
কথাটা বলে পড়ে অনিকেত৷ দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘তুই কবে কবে ফাঁকা আছিস জানিয়ে দিস৷ আমি নিজেই আসব৷ আজ চলি…’
ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অনিকেত৷ অনির্বাণ কিছুক্ষণ নিজের চেয়ারেই গুম হয়ে বসে থাকে৷ একটা অদ্ভুত ভাবনা ওর মাথার কোণে ক্রমাগত উঁকি দিয়ে যাচ্ছে৷ সত্যি ছেলেটা একটু পাগলাটে… কিন্তু তাই বলে…
* * *
গঙ্গার ধারে বসেছিল দু-জনে৷ সাধারণত প্রতি শুক্রবার সন্ধের দিকে গঙ্গার ঘাটে এসে বসে ওরা৷ শীতের বিকেলে শহরের খুদে খুদে বাড়ি ঘরগুলোর পেছনে সূর্যটাকে ডুবতে দেখতে ভারি আদুরে লাগে৷ সঞ্চারী লেবু চা খেতে ভালোবাসে৷ এখানে আসার সময় মোড়ের দোকান থেকে চিনেবাদাম কিনে আনে৷ সেটা ছাড়িয়ে কিছু নিজে খায়, কিছু অনিকেতের গালে ঢুকিয়ে দেয়৷ আজ অনিকেতের লেবু চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে৷ সূর্যটাও যেন ডুবতে একটু বেশি সময় নিচ্ছে আজকে৷
চায়ের দিক থেকে চোখে তুলে অনিকেতের ভাবুক মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চারী জিজ্ঞেস করে, ‘তুই আজকাল কী এত ভাবিস বল তো? অফিসে কিছু হয়েছে?’
হুট করে আসা প্রশ্নটায় অনিকেতের চটকা ভাঙে, অল্প হেসে মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা তোর কখনও আমাকে সাফোকেটিং মনে হয় না?’
‘মানে?’
‘মানে ধর আমি কোনওকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি৷ ফোনের পর ফোন করছি৷ কিংবা তুই বাড়ি ফিরতে দেরি করলে একটু বেশি দুশ্চিন্তা করছি…’
‘তো নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা হবে না তো কি পাশের বাড়ির বউদিকে নিয়ে হবে? কী যে বলিস বুঝি না… নে চা খা…’
অনিকেত একবার চায়ে চুমুক দেয়৷ তারপর গোঁজ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে৷ একবার গাল চুলকে নিয়ে বলে, ‘কিন্তু ধর যদি কখনও বাড়াবাড়ি রকমের হতে থাকে…’
‘বাড়াবাড়ি রকমের বলতে?’
‘মানে তুই ফোন না ধরলে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল৷ কিংবা তোর উপর রেগে গিয়ে নিজের বা তোর কোনও ক্ষতি করে বসলাম৷ দাদুর কথা তো বলেইছি তোকে৷ অতিরিক্ত ভালোবাসার প্রকাশ মানুষের দমবন্ধ করে দেয়… তোর মনে হয় না আমি তোর দমবন্ধ করে দিচ্ছি?’
সঞ্চারী সামনে বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকটা দেখিয়ে বলে, ‘তুই সাঁতরে গঙ্গা পেরোতে পারবি?’
‘মানে? এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল?’
‘আহা বলই না… পারবি?
‘না…’
‘আমি পারি৷’
‘তাতে কী হয়েছে?’
‘আমি সাঁতার কাটতে পারি…’
‘তাতেই বা কী হয়েছে?’
হাত বাড়িয়ে একবার অনিকেতের গাল টিপে দেয় সঞ্চারী, ‘আমি অনেকক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারি, অনি৷ অত সহজে আমার দমবন্ধ হবে না…’
বিকেলের গলন্ত সূর্যের আলো সঞ্চারীর সারাদিন অফিস করা ক্লান্ত মুখের উপরে এসে পড়ে৷ সেই আলোয় মুখটা অবাস্তব দেখায়৷ চোখদুটো আরও রহস্যময় দেখায়৷ গঙ্গার ঘোলাটে জলের মতো তার গভীরে কী আছে তাও যেন বোঝা সম্ভব নয় কোনওভাবে৷ একমাত্র প্রাণের মায়া ভুলে ভরা জোয়ারে ঝাঁপ না দিলে তার তল পাওয়া যায় না৷
‘আমার ইদানীং একটা জিনিস মনে হয় জানিস?’ অনিকেত ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকেই প্রশ্ন করে৷
‘কী?’
‘তোর মতো আর কোথাও কেউ নেই৷ না এই গঙ্গার ঘাটে, না এই শহরে, আমার চেনা অচেনা কোনও মানুষ তোর মতো নয়… আমার অবচেতন মন সারাক্ষণ বলে চলে কথাটা অথচ কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারি না…’
নাটকীয় ভঙ্গিতে এক গোছা চুল সরিয়ে কানের পাশে রাখে সঞ্চারী, ‘আমি প্রথম দিন থেকে বলে আসছি তোকে আমার মতো সুন্দরী আর হয় না…’
‘উঁহু, রূপটা নয়৷ অন্য কিছু একটা৷ এমন কিছু একটা যেটা আমার অবচেতন মন জানে, অথচ আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না…’
ওর কাঁধে একটা হাত রাখে সঞ্চারী, ‘সব কিছু বুঝতে নেই বোকা৷ বুঝে গেলে সবকিছু আর আগের মতো সুন্দর থাকে না৷’
‘আমার খুব ভয় করে তোর জন্য…’
‘কেন?’
‘জানি না আমার মাথার ভিতরে কী আছে…’
‘আমি আছি এটুকু তো জানি৷ বাদবাকি যদি কিছু থেকেও থাকে ও আমি লড়ে নেব৷ তুই নিশ্চিন্তে থাক…’ কথাটা বলে ওর কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয় সঞ্চারী৷
‘তোর লাগে না ভয়?’
দু-দিকে মাথা নাড়ায় সঞ্চারী, অনিকেতের মনে হয় ওর গলার স্বর বহু দূর থেকে ভেসে আসছে, ধীর প্রায় মিলিয়ে আসা কণ্ঠে সে বলতে থাকে, ‘আমি অত মাথা ঘামাই না৷ এই নদীটা কোথা থেকে কোথায় বইছে, কারা এই ঘাটে এসে বসে, কোন লোকটার থেকে আজ লেবু চা খেলাম, সূর্যটা ঠিক কোন অ্যাঙ্গেলে ডুবছে, কাল ডুববে কি না… আমি শুধু জানি তোর সঙ্গে কাটানো এই বিকেলগুলো সুন্দর… আর…’
‘আর?’
‘আর জীবনের সব ক-টা শুক্রবার বিকেল আমি তোর সঙ্গে এই ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখতে চাই৷ আমি শুধু ওইটুকু বুঝি…’
অনিকেত জানে এই মেয়েটার মধ্যে অন্য কিছু আছে৷ এই মেয়েটা অনন্য৷ কিন্তু ঠিক কোথায়? কাঁধে ঝুঁকে পড়া মাথাটা ভারি হালকা লাগে ওর৷ বুকের ভিতরে জমে ওঠা আশঙ্কার মেঘটা ততটাই ভারী হয়…
(চার)
অটো থেকে নেমে তড়িঘড়ি মোবাইল ফোনটা বের করতেই সঞ্চারীর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ প্রায় বিয়াল্লিশখানা মিসড কল৷ এতক্ষণে মাথা খারাপ হয়ে গেছে ছেলেটার৷ একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভিড়ের মধ্যে অনিকেতকে দেখতে পেল সে৷ একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷
দ্রুত সেদিকে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এই, কিছু মনে করিস না৷ একটু দেরি হয়ে গেল…’
‘দেরি হয়ে গেল? ফোনটা ধরতে কী হয় তোর?’
‘আরে অটোর সামনের সিটে বসেছিলাম৷ ফোন ছিল পকেটে, কী করে ধরব বল?’
‘সামনের সিটে বসেছিলি? কতবার বারণ করেছি তোকে… দুম করে পড়ে গেলে? এত রিস্ক নিতে কে বলে তোকে?’
‘আরে ওখানে বসলে বেশি হাওয়া পাওয়া যায়…’
‘হ্যাঁ, তুই হাওয়া খা আর আমি এদিকে টেনশন মরে যাই… কতদিন বলেছি অকারণে টেনশন দিবি না আমায়…’
‘তুই এত টেনশন করিস কেন বলতো? আমি কি বাচ্চা খুকি?’
‘নাঃ অনেক বড় হয়ে গেছিস৷ এবার একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব… চল…’
ওদের প্রথম দেখা হবার পর প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে৷ এর মাঝে আইটি সেক্টরে চাকরি পেয়েছে দু-জনে৷ অফিস একই জায়গায় হলেও একই কোম্পানিতে নয়৷ ওরা দু-জনে নিউ টাউনের মোড়ে দেখা করে সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে অফিসে যায়৷ রোদ বা বৃষ্টির দিনে অনিকেতই ছাতা নিয়ে আসে৷ রোদ বৃষ্টি আটকানো ছাড়াও সে ছাতার আর একটা কাজ আছে৷
সঞ্চারীর কোন মামা নাকি এইদিকেই একটা অফিসে চাকরি করে৷ অনিকেতের ভয় তিনি যে কোনওদিন ওদের রাস্তায় দেখে ফেলতে পারেন৷ তাই মুখ বাঁচাতে ছাতার আশ্রয়৷ সঞ্চারী কয়েকবার বলেছে ওদের ব্যাপারটার কথা বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া উচিত৷ নয় নয় করে তো প্রায় দু-বছর হতে চলল৷ কিন্তু অনিকেত কিছুতেই রাজি নয়৷
‘সবে দু-মাস হল চাকরি পেয়েছি, এখন তোর বাপ কিচাইন করলে?’
‘করলে আর কী, মেয়ে নিয়ে ভেগে যাবি…’
‘ওঃ! তারপর তোর পুলিশ বাপ আমাকে খুঁজে পেতে ডান্ডা দিয়ে সোঁটালে?’
‘ডান্ডা খেতে খেতে চিৎকার করবি, পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো…’
‘রাখ তোর একশো বারো৷ ঘুষের টাকা খেয়ে ভুঁড়ি বাগিয়েছে মালটা…’
‘এই, আমার বাপ ঘুষ খায় তোকে কে বলেছে?’
‘দেখ ভাই – প্রেমিকরা চুমু, নেতারা কাটমানি আর পুলিশ ঘুষ সুযোগ পেলেই খায়৷ কিন্তু কেউ স্বীকার করতে চায় না…’
‘বটে! তুই কবে চুমু খেয়েছিস?’
অনিকেত একটু ভেবে বলে, ‘তা নাহলেও ছ-মাস আগে হবে৷’
‘তা এতদিন খাসনি কেন?’
‘কারণ আমার প্রেমিকা চিংড়ি মাছ খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়৷ আরে উপন্যাস টুপন্যাস পড় ভাই৷ প্রেমিকাকে চুমু খেলে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দেয়, গা শিরশির করে, মৌরি লজেন্সের গন্ধ আসে৷ আরে লটে, খোলসে চচ্চড়ি খাওয়া প্রেমিকাকে কি আর চুমু খাওয়া যায়?’
‘তাই নাকি?’
‘তাই না? আরে প্রেমিকা হবে বাল বিখরে হুয়ে, গাল নিখরে হুয়ে…’
আচমকাই হাতের ফাইলটা তুলে নিয়ে অনিকেতকে তাড়া করে সঞ্চারী, ‘দাঁড়া শুয়োরের বাচ্চা তোর সব ক-টা বিখড়ানো বাল যদি যদি টেনে টেনে না তুলেছি তাহলে…’
ব্যাপারটার জন্য তৈরি ছিল অনিকেত৷ ছুট লাগিয়েছে আগেই৷ ফাঁকা রাস্তায় দু-জনের চিৎকারই ছড়িয়ে পড়ে৷ খানিকটা ছোটাছুটির পর একরকম অনিকেতকে ধরেই ফেলেছিল সঞ্চারী৷ এমন সময় সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ তার হাতে এক ফোঁটা শীতল জলের স্পর্শ লেগেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে বলে, ‘বৃষ্টি আসছে অনি, ভিজবি?’
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে, ‘তাহলে আর অফিসে ঢুকতে দেবে না…’
‘উপন্যাসের হিরোরা অফিসের চিন্তা করে না…’
অনিকেত একটা ছাতা খোলার উপক্রম করেছিল৷ এগিয়ে গিয়ে সেটা একরকম কেড়েই সরিয়ে নেয় সঞ্চারী৷ বৃষ্টির বেগ বেড়ে ওঠে৷ শুনশান ফাঁকা রাস্তায় ওদের শরীর ভিজিয়ে দিতে থাকে বৃষ্টির ফোঁটা৷ দুটো শরীর ঘন হয়ে আসে৷
কাছেই বাজ পড়ে কোথাও৷ অনিকেতের কানে তালা লেগে যায়৷ ঘন বৃষ্টির ফোঁটা দু-জনেরই চশমার কাচ ভিজিয়ে দিয়েছে, চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে গেছে তাতে৷ একটা একটা করে অনুভূতি বুজে আসতে থাকে ওদের৷ কেবল অবিশ্রান্ত জলধারার স্পর্শ লেগে থাকে ওদের সারা গায়ে৷
একসময় অনিকেত অনুভব করে ওর চোখ থেকে ঝাপসা চশমাটা খুলে নিচ্ছে সঞ্চারী৷
চোখ থেকে জলের পর্দাটা সরে যেতেই অনিকেত দেখতে পায় ওদের থেকে মিটার দশেক দূরেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ সেটা আশ্চর্যের কিছু না৷ কিন্তু গাড়ির জানলা থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে৷
‘মামা…’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে অনিকেত৷ সঞ্চারী জলমাখা মুখেই সেদিকে ফিরে তাকায়, ‘কোথায়?’
‘ওটা তোর মামার গাড়ি না?’
দু-জনে সেদিকে ফিরে তাকাতেই দ্রুত গতি নেয় গাড়িটা৷ শব্দ করে বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায়৷
সঞ্চারী অনিকেতের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখ থমথমে হয়ে গেছে৷ এগিয়ে গিয়ে মুখ থেকে বৃষ্টির জল সরিয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘হলটা কী তোর?’
‘এবার কী হবে?’
‘কী আবার হবে? তুই ভয় পাস নাকি?’
‘যদি গন্ডগোল হয় কিছু?’
‘আশ্চর্য বোকা ছেলে তো তুই…’
‘আমি বোকা? তোকে ছাতাটা সরাতে কে বলেছিল?’
আর একটু কাছে এগিয়ে এসে ওর জামার বুকের কাছটা খামচে ধরে সঞ্চারী, ‘সারাজীবন ছাতা দিয়ে মুখ ঢেকে বেঁচে থাকা যায় না অনি, কোনও প্রবলেম হলে সেটার সামনে দাঁড়িয়ে সেটা ফেস করতে হয়…’
‘আমি পারব না ফেস করতে, টেনশন হলে আমার শরীর খারাপ করে…’
‘তোকে আমি কিছু ফেস করতে বলেছি? বলছি তো আমার উপর ছেড়ে দে সবটা…’
‘আমি বিশ্বাস করি না তোকে…’
নিজের কথায় অনিকেতের নিজেরই অবাক লাগে৷ ও বুঝতে পারে ভিতরে চাপা টেনশনটা ওকে আবার গ্রাস করছে৷
‘বিশ্বাস করিস না মানেটা কী?’ সঞ্চারীর গলায় এখনও রুক্ষ ভাব আসেনি, ‘দেখ আমি জানি এই অকারণে নার্ভাস হওয়াটা তোর একটা রোগ৷ একটু সময় দেখ, এক্ষুনি এটা নিয়ে এত মাথা ঘামাস না…’
অনিকেত বুঝতে পারে ওর মাথার শিরাগুলো দপদপ করতে শুরু করেছে৷ হাত-পায়ে একটা অবশ ভাব৷ সঞ্চারীর মুখটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না৷ কেন ছাতাটা সরিয়ে নিতে গেল? ইচ্ছা করল ওকে ঠেলে রাস্তার উপরে ফেলে দিতে…
নিজেকে সামলাতেই দু-পা পিছিয়ে এল অনিকেত, খুব ধীরে ধীরে কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল, ‘আমার আর তোর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই… তুই চলে যা আমার সামনে থেকে…’
অনিকেত জানে ও এই কথাটা বলতে চায়নি৷ ওর মাথায় কি রোগ আছে কিছু? টেনশন হলে আর মাথার ঠিক থাকে না৷ যা বলতে চায় না তাই বলে ফেলে৷
ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে সঞ্চারী৷ ওর চোখে জল এসেছে কি না বোঝা যায় না৷ বৃষ্টির ধারা ঢেকে দেয় সমস্ত কিছু৷
কয়েক মুহূর্ত সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে এক ছুটে রাস্তার উল্টোদিকে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সঞ্চারী৷ কমে থাকা জলের উপর ওর পায়ের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে আসে…
* * *
প্রিন্ট করা কাগজগুলো হাতে তুলে নেয় অনির্বাণ৷ লেখাগুলো মেইল করে আগেই ওকে পাঠিয়েছিল অনিকেত৷ সেগুলোর উপর আর একবার চোখ বুলাতে বুলাতে বলে, ‘ঘটনাগুলো অভিনব তাতে সন্দেহ নেই৷ আই মিন তোর থট প্রসেস যে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নয় সেটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তুই ক্রমশ ক্ষতিকর কিছুর দিকে এগোচ্ছিস তা বলা যায় না…’
‘আর এই ক-দিন তুই আমাকে দেখলি, কী মনে হল তোর?’
আজ আর অনির্বাণের চেম্বারে বসেনি ওরা৷ অনিকেতের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েই গল্প করছিল দু-জনে৷ এর মাঝে দু-জনের মোট ছ-টা দিন দেখা হয়েছে৷ অনিকেত মন খুলে সবই বলেছে ওকে৷ অনির্বাণ কেবল মন দিয়ে সমস্ত কথা শুনে গেছে৷ কখনও ইচ্ছা হলে টুকটাক প্রশ্ন করেছে ওকে৷
উত্তর দিতে দিতে কখনও কেঁদে ফেলছে অনিকেত, কখনও থরথর করে কেঁপেছে, কোনও সুখস্মৃতি মনে করতে করতে আবার দু-জনেই হেসে খুন হয়েছে৷ শেষ দু-দিন ধরেই অনির্বাণের মনে হয়েছে ওর কাজ গুটিয়ে এসেছে৷ দু-এক জায়গায় কিছু খোঁজখবর নেওয়ার ছিল৷ সেগুলো হতে সময় লাগছে৷ আজ সকালেই তারা ফোন করে জানিয়েছে কাল সকালে দরকারি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবে মেইল করে৷
‘আশা করি কালকের মধ্যেই ফাইনালি কিছু জানাতে পারব তোকে৷ ভালো কথা, তোর সঞ্চারীর সঙ্গে আবার দেখা হচ্ছে কবে?’
‘কাল তো শুক্রবার৷ অফিস শেষে গঙ্গার ঘাটে দেখা হবে…’
‘আমাকে একটা কথা বল, যদি সত্যি কাল সকালে খবর খারাপ শুনিস তাহলে ওকে গিয়ে বলতে পারবি সিদ্ধান্তের কথা?’
‘আমি জানি না…’ মাথা নাড়ায় অনিকেত, ‘তবে ওর কাছে ব্যাপারটা সহজ হবে হয়তো…’
‘সহজ হবে কী করে?’
‘এই তিন বছরে কম জ্বালাইনি ওকে…’
‘সেই জন্যেই বলছি, একটা মানুষ এত সহ্য করেও তোর সঙ্গে থেকে গেল তাও তাকে গিয়ে এটা বলতে কষ্ট হবে না?’
দূরে ঘনায়মান সন্ধের দিকে চেয়ে একটু হাসে অনিকেত, ‘ও আগে খুব রাগী ছিল জানিস, কথায় কথায় হাত চলত৷ থেকে থেকে রেগে বোম হয় যেত… তারপর…’
‘তারপর?’
‘তারপর আমাকে সামলাতে গিয়ে কবে যেন নিজে নিজেই কমে গেল ওর রাগটা… আমি মাথা খারাপ করে ভুলভাল কিছু বলে ফেললে ও নিজেই সময় নিয়ে বোঝাত আমাকে…’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনির্বাণ, ‘নিজের কোর ক্যারেক্টারিস্টিক প্রিন্সিপালকে ছাপিয়ে কাউকে ভালোবাসা সহজ কথা নয়… প্রাণীজগতে একমাত্র মায়েরা পারে সেটা৷’
অনিকেত দুটো হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখে, ‘কাউকে তেমন করে ভালোবাসলে আমরা সবাই মা হয়ে যাই… আর ওর মতো করে আমাকে ভালোবাসেনি কেউ…’
ওর দিকে ফিরে তাকায় অনির্বাণ, ‘সেই জন্যেই ওকে অনন্য মনে হয় তোর?’
মাথা নেড়ে আপত্তি জানায় অনিকেত, ‘নাহ, এত সহজ কিছু না৷ আরও কঠিন, আরও অসম্ভব কিছু…’
ছাদের একদিকের পাঁচিলে হেলান দেয় অনির্বাণ, ‘কারণটা তোর সাবকন্সাস জানে, কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না৷ মানুষের মাথা কী অদ্ভুতভাবে কাজ করে, তাই না? বাদ দে, কাল অফিস ফেরত চলে আসিস আমার চেম্বারে… কথা হচ্ছে, এখন চলি…’
অনির্বাণ চলে যেতে নিচে চলে এল অনিকেত৷ ও জানে কাল বিকেল অবধি অন্য কিছুতেই মন বসবে না ওর৷ সারাক্ষণ এই একটাই চিন্তা কুরে কুরে খাবে ওকে৷ আচ্ছা সঞ্চারীকে সব খুলে বললে ও কি হাসিমুখে মেনে নেবে ব্যাপারটা? নাকি ঝগড়া করবে?
নিচে নেমে একটু ভেবেচিন্তে সঞ্চারীকে একটা ফোন করল অনিকেত৷ ওপাশ থেকে সারাদিন অফিসে কাজের পর ক্লান্ত গলা কানে এল, ‘বল রে, আজ অসময়ে ফোন?’
‘কাল দেখা হচ্ছে তাহলে…’
‘সে তো প্রতি সপ্তাহেই হয়…’
‘যদি না হয়?’
‘মানে, হবে না কেন?’
‘মানে ধর আমি যদি আর না আসি, তোর কষ্ট হবে খুব?’
ওপাশের মানুষটাকে কয়েক সেকেন্ডের একটা নীরবতা গ্রাস করে, ‘তোর কী মনে হয়?’
‘কী জানি, অন্তত আমার যতটা হবে তোর ততটা হবে না…’
আবার একটা নীরবতা৷ কী ভাবছে এত সঞ্চারী, একটু পরে জবাব আসে, ‘তোর এত কষ্ট হবে যখন এসব ভাবছিসই বা কেন?’
অনিকেত করুণ হাসে, ‘জানিস তো আমি ওভার থিঙ্ক করি৷ আচ্ছা বাদ দে, একটা শেষ প্রশ্নের উত্তর দে…’
‘কী?’
‘আমার কেন মনে হয় তুই সবার থেকে আলাদা? তোর মতো আর কেউ নেই…’
‘আমাকে ভালো করে চিনিস বলে…’
‘কিন্তু আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না কেন মনে হচ্ছে… তুই জানিস যখন বলে দে…’
ওপাশ থেকে এবার একটা হাসির আওয়াজ ভেসে আসে, সেই হাসি মেখেই উত্তরটা শোনা যায়, ‘আমার তোর সঙ্গে বসে সানসেট দেখতে ভালো লাগে বলে…’
‘সে তো আমারও লাগে…’
‘হতে পারে, কিন্তু আমার মতো লাগে না… তোর জন্য যত কষ্ট আমি পেতে পারি আর কেউ পেতে পারে না৷’
‘কিন্তু কষ্ট পাইয়ে কী লাভ?’ অসহায় গলায় প্রশ্ন করে অনিকেত৷ কিন্তু আর কোনও উত্তর আসে না৷ ওপাশ থেকে কেটে যায় ফোনটা৷
(ছয়)
পরদিন অফিসের কাজে কিছুতেই মন বসে না অনিকেতের৷ সারাদিন মাথার ভিতরটা ধরে থাকে৷ কানের পর্দায় একটা ক্রমাগত গুনগুন আওয়াজ৷ হাতের আঙুলগুলো কী বোর্ডের উপরে কিছুতেই স্থির হচ্ছে না৷ এর মধ্যে অন্তত বারতিরিশেক ফোন করে ফেলেছে অনির্বাণকে৷ সে হয় ফোন ধরেনি, নাহয় ধরে বলেছে চেম্বারে ছাড়া সে কিছু বলতেই রাজি নয়৷
অফিস ছুটি হতে একরকম পড়ি কি মরি করেই দৌড়েছে অনির্বাণের চেম্বারে৷ ততক্ষণে ওর শরীর রীতিমতো ঝিমিয়ে আসতে শুরু করেছে৷ বুকের ভিতরে একটা বিশাল হাতুড়িকে যেন ক্রমাগত পিটিয়ে চলেছে কেউ৷
আজ অফিস থেকে বেরোতেও একটু দেরি হয়ে গেছে৷ এতক্ষণে হয়তো গঙ্গার ঘাটে এসে বসেছে সঞ্চারী৷ একবার ফোন বের করে অনিকেত দেখল ওর নম্বর থেকে একটা মিসড কল এসেছিল৷ কিন্তু আজ আর কল ব্যাক করার মতো মানসিক অবস্থা নেই ওর৷ একটু অপেক্ষা করুক নাহয়…
অনির্বাণ চেম্বারে নিজের টেবিলের পেছনে একাই বসে ছিল৷ মন দিয়ে একতাড়া কাগজ গুছিয়ে রাখছিল৷ অনিকেত একরকম ছুটেই ওর ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল৷
‘আরে, এত মাথা খারাপ করিস না৷ আমি তোর ফাঁসির আদেশ শোনাব না, বোস আগে…’
অনিকেত টেবিলের উপর একটা চাপড় মারে, ‘বসার নিকুচি করেছে, আমার খবর বল আগে…’
‘একটা ভালো খবর আছে, একটা খারাপ… কোনটা আগে শুনতে চাস?’
অনিকেতের মুখ বুকের উপর নেমে আসে৷ থমথমে গলায় বলে, ‘খারাপটা গেস করতে পারছি৷ ওসিডি আছে, তাই তো?’
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় অনির্বাণ, ‘শুধু আছে না, ভয়ানক রকমের আছে৷ দিনদিন সেটা বেড়েই চলেছে…’
দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে অনিকেত৷ কপালের শিরাগুলো ফুলে ওঠে ওর৷ মুখের উপর একটু একটু করে লালচে রং লাগে৷ আচমকা মুখ তুলে নিজের হাতের উপর একটা ঘুসি মারে অনিকেত, ‘আমি জানতাম৷ কী করি এখন? ওকে গিয়ে বলব? বাড়িতে বলব? নাকি…’
‘সে আমি কী করে বলব?’ অনির্বাণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে কী যেন দেখতে থাকে৷
‘আমাকে কোনও ওষুধপত্র দিয়ে ঠিক করা যাবে না?’
অনির্বাণ হাসে৷ অন্যমনস্কভাবেই বলে, ‘ওষুধপত্র দিয়ে রোগ ঠিক করা যায় অনিকেত৷ আর তোর কোনও রোগ নেই৷ অন্তত মানসিক রোগ নেই৷ তুই জাস্ট ভয়ঙ্কর রকমের নার্ভাস৷ ছোটবেলার কিছু ট্রমাটিক এক্সপেরিয়েন্স কাজ করে, সেই সঙ্গে অ্যাংজাইটি ইসু আছে৷ তাও চাইলে কমিয়ে ফেলা যায়৷ ভয় পাওয়ার মতো কিছু না…’
‘কিন্তু এই যে বললি আমার ওসিডি আছে…’
‘বলেছি৷ কিন্তু তোর আছে সেটা তো বলিনি…’
ফোনটা আবার বেজে উঠছে বুঝতে পারে অনিকেত৷ কিন্তু সেদিকে আর চোখ যায় না তার৷ হাতের কাগজগুলো ওর সামনে ফেলে দেয় অনির্বাণ৷ তারপর কাগজের একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘ওসিপিডি, আই মিন তুই নিজের যেটা আছে বলে ভয় পাচ্ছিলি, সেটা তোর নয়, আছে সঞ্চারীর৷ এবং আজ থেকে নয়, বিগত ছ’বছর ধরে এই ব্যাপারটায় ভুগছে ও৷ এই যে পাশে দেখছিস৷ এটা ওর রিপোর্ট, আর ডক্টরের নাম…’
অবিশ্বাসের চোখে কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজটা তুলে নিজের চোখের সামনে ধরে অনিকেত৷ তারপর বলে, ‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আমিই তো সবকিছু নিয়ে মাথা খারাপ করতাম ও তো ভীষণ ঠান্ডা মাথার মেয়ে…’
অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরায়৷ তারপর এগিয়ে গিয়ে জানলার একটা কাচ সরিয়ে দিয়ে অন্য কাচে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, ‘তোর মধ্যে যে কোনও মানসিক রোগ নেই তা আমি প্রথম থেকেই জানতাম৷ সেদিন রাতে অন্যমনস্কভাবে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে আমার সঞ্চারীর কিছু সেলফি চোখে পড়ে৷ নিজের ঘরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেজেগুজে নানান পোজে নিজের ছবি তুলেছে৷ সেগুলো দেখতে গিয়েই একটা জিনিস লক্ষ করি আমি৷ প্রায় সব ক-টা ছবিতে ওর পেছনে একটা ড্রেসিং টেবিলে কিছু সাজগোজের জিনিসপত্র রাখা৷ এবং আশ্চর্যের ব্যাপার সব ছবিতে সেগুলো একদম একই অর্ডারে সাজানো৷ টেবিলের ঠিক যেখানে যা রাখা ছিল সব ছড়িয়ে সেখানে তাই রাখা আছে৷ ব্যাপারটা অড, না? বারবার সাজগোজ করছে, ছবি তুলছে৷ একটু তো আলাদা অর্ডারে সাজানো হবেই৷ সেটা হচ্ছে না মানে ও বারবার মন দিয়ে সাজাচ্ছে…’
অনিকেত হাঁ হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, বিড়বিড় করে বলল, ‘ও চিরকালই টিপটপ, কিন্তু আমি এইভাবে কখনও…’
‘প্রথমদিন যখন ওর সঙ্গে তোর দেখা হয় তখন ও তোকে পেপারওয়েট ছুঁড়ে মারে৷ কেউ হুট করে এসে লিপস্টিক ঘেঁটে গেছে বললে কারও এতটা রাগ হওয়ার কথা নয়, এমনকী একটা অচেনা লোক হেসেছে বলেও না৷ ওর মূল রাগ হয়েছিল গিটারের তারগুলোকে সাজাতে না পেরে৷ সেই রাগটাই তোর উপর দিয়ে বেরিয়ে আসে৷ তোর আগে যে সাইকায়াট্রিস্টকে ডাস্টার ছুঁড়ে মারে সেটারও কারণ একই৷ ওসিডি আছে কি না টেস্ট করার জন্য অনেক সময় পেশেন্টের সামনে ইচ্ছা করেই ওলটপালট করে জিনিস রাখি আমরা৷ তারপর তাদের কিছুতেই সাজিয়ে রাখতে দিই না৷ তাতে যদি পেশেন্ট হঠাৎ রেগে যায় তাহলে বোঝা যায় তার ওসিডি আছে৷ ডাক্তার ভদ্রলোক হয়তো সেই টেস্ট করতে গিয়েই ডাস্টারের ঘা খান…’ অনিকেতের কাছে এগিয়ে এসে ওর দিকে অন্য একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরে অনির্বাণ, ‘সন্দেহ হতে সঞ্চারীর প্রোফাইলে আবার ভিজিট করি আমি৷ আমার এক মনোবিদ বন্ধু দেখলাম মিউচুয়াল ফ্রেন্ডে আছে৷ তাকে যোগাযোগ করে দু-একটা খোঁজখবর করতেই সঞ্চারীর চিকিৎসার কাগজপত্র আমার হাতে আসে… দুশ্চিন্তা, অ্যাংজাইটি, অল্পতে ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ানকরকম মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়া, বাড়ির লোকের জীবন হেল করে দেওয়া, আই মিন যেগুলোর ভয় তুই পাচ্ছিলি সেগুলোতে আজ পাঁচ বছর ধরে ভুগে আসছে সঞ্চারী…’
‘কিন্তু আমি এসব কিছুই জানতাম না…’
অনির্বাণ একটা বাঁকা হাসি হাসে, ‘জানতিস, অবচেতনে৷ যবে থেকে এই ওসিডির ভয় তোর মাথায় ঢুকেছে তবে থেকেই এই সব নিয়ে পড়াশোনা করিস তুই৷ ও যতই চেপে রাখার চেষ্টা করুক তোর অবচেতন মন কিছু কিছু সিম্পটমে মিল পায়৷ ভেবে দেখ দাদুকে দেখার পর থেকে ওসিডি জিনিসটা তোর কাছে একটা ট্রমার মতো কাজ করে৷ ফলে তুই ডিনাইয়ালে চলে যাস…’
সমস্ত ব্যাপারটা এখনও স্পষ্ট হয়নি অনিকেতের মাথার ভিতরে, ও বিড়বিড় করে বলে, ‘কিন্তু সঞ্চারী ভীষণ ঠান্ডা মাথার মেয়ে৷ এই তিন বছরে আমিই পাগলামি করেছি, ওকে জ্বালিয়ে মেরেছি, কতবার সামান্য কারণে ওকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছি… ওর যদি এই রোগ থেকে থাকে… তুই যে বলেছিলি এই রোগের সিম্পটম চেপে রাখা অসম্ভব?’
জানলা দিয়ে বাইরে ধীরে ধীরে নামতে থাকা বিকেলের দিকে চোখ মেলে দেয় অনির্বাণ, ‘তাই তো জানতাম৷ কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওসিডির থেকে বড় একটা মেন্টাল ডিসর্ডার বাসা বেঁধেছে সঞ্চারীর মাথায়… তোকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা!’
‘মানে?’
হাত নাড়ায় অনির্বাণ, ‘ও তোকে ভালোবাসে অনি, তোর সঙ্গে থাকতে চায়৷ তোকে হারাতে চায় না৷ তাই নিজের রোগটাকে তোর কাছে লুকিয়ে ফেলতে পারে৷ মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সম্ভব নয় সেটা৷ যতটা দুশ্চিন্তা তোর হয়, যতটা ওভারথিঙ্ক তুই করিস তার থেকে কয়েকশো গুণ ওর হয়৷ কিন্তু ও কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় সেটা লুকিয়ে ফেলতে পারে— যাতে একদিন তোর ওকে অসহ্য মনে না হয়৷ সমস্যার সমাধান তোর কাছে ছিল ছেড়ে চলে আসা, ওর সে ক্ষমতাটা ছিল না৷ ও অসম্ভব পথটাকেই সম্ভব করে নিয়েছে…’
অনিকেতের হঠাৎ খেয়াল হয় ওর ফোনটা এই নিয়ে তৃতীয়বার বাজছে৷ প্রায় একঘণ্টা লেট করে ফেলেছে ও৷ একঘণ্টায় মোট তিনবার ফোন৷ এতক্ষণে কি ডুবে গেছে সূর্যটা?
ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে দৌড় লাগায় অনিকেত৷ অনির্বাণ পেছন থেকে একবার ডেকে ওঠে, ‘আরে সব কথা শেষ হয়নি, চললি কোথায়?’
কান দেয় না অনিকেত৷ এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে নিচে৷
ট্যাক্সি থেকে নেমে যখন শোভাবাজার গঙ্গার ঘাটে এসে পৌঁছয় অনিকেত তখন চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে৷ সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে৷ আজ ঘাটে বেশি ভিড় নেই৷ সমাজের নানা শ্রেণির নানা বয়সের লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে৷ কতগুলো ছিপছিপে চেহারার লোক ঘাটের একদম শেষ সিঁড়িতে ঘষে ঘষে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট কাচছে৷
হাঁপাতে হাঁপাতেই ওদের বসার জায়গাটার দিকে এগিয়ে আসে অনিকেত৷ একমনে জলের দিকে চেয়ে কী যেন দেখছে সঞ্চারী৷ জলের উপর ভেসে আসা বুনো লতা ভেসে যাচ্ছে৷ মৃদুমন্দ ঢেউ যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের৷
পেছনে ঘন নিশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় সঞ্চারী৷ মুখে উদাস ভাব কেটে গিয়ে একটা নরম হাসি ফোটে, ‘আয় বস, লেবু চা খাবি?’
অনিকেত নিঃশব্দে বসে পড়ে ওর পাশে, তারপর থমথমে গলায় বলে, ‘আজ সানসেট দেখা হল না…’
সঞ্চারী কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার জলের দিকে তাকায়, ‘আমি সূর্য ডুবে যাওয়ার অনেক পর অবধি বসে থাকতে পারি তোর জন্য…’
‘তোর দুশ্চিন্তা হয়নি? এই যে আমি দেরি করে এলাম?’
‘সময় পেলাম কই৷ ভাবতে ভাবতেই তো কেটে গেল…’
‘কী ভাবলি?’
‘তুই এখানে এসে সবার আগে কী বলবি? তুই বলবি আজ সূর্যাস্ত দেখা হল না, আর আমি বলব আমি অন্ধকার নামার অনেক পড়ে অবধি অপেক্ষা করব তোর জন্য…’
হঠাৎই ওর দিকে চোখ পড়তে ভুরু কুঁচকে যায় সঞ্চারীর, ব্যাগের চেন টেনে চিরুনি বের করতে করতে বলে, ‘চুলটা আঁচড়ে বেরোসনি আজকে? গোটা অফিস এই চুলে কাটালি? আর শার্টের কলারটা ঢুকে আছে ভিতরে… উফ, তোকে নিয়ে কী যে করি…’
হঠাৎ করেই নিজের জায়গা থেকে উঠে সঞ্চারীকে জড়িয়ে ধরে অনিকেত৷ ওর বুক কেঁপে ওঠে৷ চোখ থেকে অজান্তেই কয়েকটা বিশ্বাসঘাতক জলের রেখা বেরিয়ে আসে৷
সঞ্চারী হেসে ফেলে, ‘কাল যে আর আসবি না বলছিলি৷ আজ আবার পিডিএ!’
‘তোর মতো আর কেউ নেই৷ কোথাও কেউ নেই তোর মতো… আমি তোর মতো করে কোনদিন ভালোবাসতে পারব না…’
‘বাসতে হবে না…’ সঞ্চারীর গলা ফিসফিসে হয়, ‘শুধু একটা কথা মনে রাখবি?’
‘কী কথা?’
‘কাউকে ভালোবাসলে তার জন্য সূর্যাস্তের অনেক পরেও বসে থাকতে হয়৷ আকাশ অন্ধকার হয়ে গেলে, সব লেবু চাওয়ালা, ঘটিগরমওয়ালারা বাড়ি চলে গেলেও অপেক্ষা করতে হয়… তুই করবি তো অপেক্ষা আমার জন্য?’
অনিকেত মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সঞ্চারীর দিকে৷ চাঁদের আলোও কি পৃথিবীতে এসে পড়ে? সেই আলো কি সঞ্চারীর মুখটাকে স্বপ্নের মতো রুপোলি করে তুলেছে?
ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ও বুঝতে পারে এই গঙ্গার ঘাট, নদী, সূর্য, আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা লোকগুলো, দূরে ভেসে যাওয়া লঞ্চ, সবকিছু কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে৷ শুধু জেগে আছে ওর সামনে বসা এক অলীক মানবী৷
যার মতো আর কেউ কোথাও নেই…