জানলার ওপাশে – অশেষ চট্টোপাধ্যায়
বাপন জানে রাত্তিরে এই সময়টা বাবা একলা থাকতে ভালোবাসেন। একটা সময় ছিল যখন আকাশের দিকে তাকালে বাড়তি কিছু দেখতেন। যা মনে হত লিখে রাখতেন ডায়েরির পাতায়। পরের জীবনটা এই সময়ের সঙ্গে জোড়ে মিলল না। ডায়েরিগুলো হারিয়ে গেছে কবে।
এখন বাবা অফিসে বসেন এয়ার—কন্ডিশান্ড ঘরে। আগেকার আমিকে মনে পড়ে না। আকাশের দিকে তাকাবার ফুরসত কই। ফাঁক পেলে রাত্তিরে খাবার আগে দশ তলার এই ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন বাবা। তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। পুরোনো সেই লেখালেখির কাজই করেন বোধহয়। তবে কাগজে—কলমে নয়, মনে মনে।
এই সময়টা কথাবার্তার বাইরে রাখতে চান। টেলিফোন ধরেন না। বাবা এমনিতেই একটু দূরের মানুষ। কতটুকু সময়ই বা বাপন কাছে পায়। আবার মাকেও কথাটা জিজ্ঞেস করার নামেই অস্বস্তি। মা আগে কলেজে অঙ্ক কষাতেন। বাপনের জন্মদিনে বিজ্ঞানের বই উপহার দেন। মাকে বললে হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবেন। উলটো বিপত্তিও হতে পারে। হয়তো শোনাতে বসবেন পনেরো বছর বয়েসে কোন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের কী প্রতিভার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল তার গল্প। অথচ বন্ধু টুকাইয়ের সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক হয়ে গেছে বিকেলে: ভূত আছে, না নেই? বাপন মায়ের কথাগুলো নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিল—ভূতটুত কিছু নেই। আসলে বহু বছরের সংস্কার, অজ্ঞতা আর ভয়ের সঙ্গে পরিবেশের কিছু অস্বাভাবিকতা মিলে হ্যালিউসিনেশানের সৃষ্টি করে। টুকাই কিন্তু মেনে নিল না বাপনের যুক্তি। ওর ছোটোমামা নাকি নিজের চোখে এক মৃত বন্ধুকে দেখেছেন শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পর। ছোটোমামাও আগে কিছু জানতেন না। এই অভিজ্ঞতার পর থেকে স্পিরিচুয়ালিজম নিয়ে মেলাই পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছেন।
নিজের সঙ্গে খানিকক্ষণ যুদ্ধ করল বাপন। তারপর নিয়ম ভেঙে বাবার এই সময়ের নিজস্ব সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ার কথা ভাবল। দশতলার ওপর থেকে কলকাতাকে চির—দেওয়ালির শহর বলে মনে হয়। ওপরে তারার শলমা—চুমকি বসানো মস্ত চাঁদোয়া। এখান থেকে দেখলে আকাশের চেহারা অন্যরকম।
বাবার সঙ্গে সব সময় থাকে স্টেট এক্সপ্রেসের প্যাকেট আর গ্যাস লাইটার। নিজে খান খুব কম, অন্যকে বিলোন বেশি। তবে এই সময়টাতে জ্বলন্ত সিগারেট বাবার আঙুলে ধরা থাকে। আজও ছিল।
‘বাবা’, বাপন একটু দোনোমোনো করে নীচু গলায় ডাকল।
‘কী রে, কিছু বলবি?’ বাবা যে তারাদের রাজ্যপাট ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে ফিরে আসবেন বুঝতে পারেনি বাপন। তাই কথাগুলো সাজিয়ে নিতে একটু সময় লাগল। বাবা কিন্তু তাকিয়ে আছেন বাপনের দিকে। আবছা আলোতেও বাবার মুখে একটা আলগা হাসি। এ—রকম হাসি ভেতরের কথা টেনে আনে।
বাপন চোখ—কান বুজে দুদ্দাড়িয়ে বলে ফেলল। বাবা কিন্তু হাসিটাকে টেনে বাড়ালেন না। তেমনই তাকিয়ে রইলেন বাপনের দিকে। ‘পরশুরামের লেখা মহেশের মহাযাত্রা পড়েছিস?’ বাবার প্রশ্নটা বাপনের কাছে মনে হল একটা ধাঁধা। বলতেই হল, এরকম কোনো লেখা সে পড়েনি।
‘এই জন্যেই আমি সোকলড ইংলিশ—মিডিয়াম স্কুলগুলো দুচক্ষে দেখতে পারি না,’ বললেন ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশানের প্রাক্তন ছাত্র, ‘রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথ, সে, খাপছাড়া, অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলা, আলোর ফুলকি, সুকুমার রায়ের বানানো একটা আশ্চর্য নেভার—নেভার ল্যান্ড—এ সবই চিরদিন নাগালের বাইরে থাকবে। পরশুরাম তো অনেক দূরের কথা।’
বাপন কিন্তু বাবাকে নতুন করে চিনছে। মস্ত বড়ো মাল্টিন্যাশনালের ব্যস্ত সিনিয়র একজিকিউটিভ নন। বেশ আটপৌরে ঘরোয়া গোছের বাবা। যিনি বাড়িতে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে মেঝের ওপর বসে ছেলের হালচালের খোঁজখবর নেন। ‘পরশুরামের গল্পে মহেশ আর হরিনাথ দুই বন্ধুর মধ্যে এই একই প্রশ্ন নিয়ে হাতাহাতির অবস্থা,’ বাবা বলে চললেন, ‘তবে আমার নিজের কাছে ব্যাপারটা একটা বর্ডার লাইন কেস হয়ে আছে। মানে, ইট ক্যান বি এক্সপ্লেন্ড আইদর ওয়ে। মহেশ মৃত্যুর পরে হরিনাথকে বলে গিয়েছিলেন, আছে, আছে, সব আছে, সব সত্যি, বিশ্বাসীরা হয়তো তাই বলবে। আবার যদি বল হ্যালিউসিনেশান উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা, তাহলেও প্রতিবাদ করব না। সেভাবে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করা যায়।’
‘তার মানে, তুমি বলতে চাও তোমার নিজেরই সুপার ন্যাচারাল এক্সপিরিয়ান্স আছে।’ বাপন তার রাশভারী বাবার কথা শুনে তাজ্জব।
‘ইয়েস স্যার, যদি শুনতে চাও তো ঘর থেকে একটা ফোল্ডিং চেয়ার এখানে নিয়ে এসো।’
বাপনকে আর বলতে হল না। ডিনারের মেনুতে আজ রেশমি কাবাব আছে। মা জনার্দনকে নিয়ে কিচেনে ব্যস্ত। বাবা এর মধ্যে আবার নতুন করে সিগারেট ধরিয়েছেন।
বাবা মানে চোখা ইংরিজি উচ্চারণ, স্যুট—টাই—পরা একটি জলজ্যান্ত ব্যস্ততা। গল্প যারা বলে বলে তাদের চালচলনের সঙ্গে মেলে না। অথচ একই মানুষের মধ্যে থাকে এমন একজন যে কখনো চেনা, কখনো অচেনা। সেই অচেনা মানুষটাই গল্পের বঁড়শি দিয়ে টেনে নিল বাপনকে।
‘যত দিন যাচ্ছে,’ বাবা বললেন, ‘মানুষ ততই সরে যাচ্ছে প্রকৃতির কাছ থেকে। আমাদের ছোটোবেলাতেও কলকাতায় কত বেশি গাছ ছিল। বছর দশ—বারো আগেও বাকসা ডুয়ার্সের জঙ্গলে দেখেছি দিনদুপুরে সন্ধেবেলার আলো—আঁধারি। আমার ঠাকুরদা একটা ছোটো ব্যবসা থেকে তিন—চারটে বড় ব্যবসা বানাতে পেরেছিলেন। আদতে কিন্তু গ্রামের লোক। গাছপালা ভালোবাসতেন। মাঝেসাঝে তাঁর ইচ্ছে হত ব্যবসা—বাণিজ্য, হিসেবনিকেশ দিন—কয়েকের জন্যে ভুলে যেতে। দু—চোখ ভাব আকাশের নীল আর গাছের সবুজ দেখে আবার নতুন উৎসাহে কাজে লেগে পড়া। তাই কলকাতার নাগাল ছাড়িয়ে পেল্লায় এক বাড়ি করেছিলেন মধুপুরে। সেকালে অনেক সচ্ছল অবস্থার বাঙালিই বাড়ি করতেন এইরকম ফাঁকফর্দা জায়গায়। কতকটা হলিডে রিসর্ট গোছের। একটু গাছপালা, নির্জনতা, পাখির ডাক, মনটাকে তরতাজা করে দিত। এখনও সেসব বাড়ি পড়ে আছে নানান জায়গায়। কিন্তু তাদের হালের মালিকরা ওদিক মাড়ানো মানে সময়ের অপব্যয় বলে মনে করে।’
‘তুমি যে বাড়িটার কথা বললে সেটা এখনও আছে?’ বাবা একটু থামতেই বাপন জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ আছে, আমি শেষবার গেছি বছর—কুড়ি আগে।’ বলতে বলতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন বাবা বললেন, ‘কিন্তু আর যাইনি, যাবও না বোধহয় কোনোদিন।’
‘কেন বাবা?’ বাবার তৈরি সাসপেন্সের চতুর্দোলা থেকে নামবার জন্যে বাপন জিজ্ঞেস করল।
‘সেইটেই আমার গল্প,’ বাবা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘আর তার মধ্যেই তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর।’
‘তুমি যেমন আমার এক ছেলে,’ বাবা নতুন করে খেই ধরলেন, ‘আমিও আমার বাবার এক ছেলে এটুকু তুমি জানো। আমার ঠাকুরদা ডালপালা ছড়িয়েছিলেন অনেকগুলো। সবসুদ্ধ বোধহয় জনা—চোদ্দো ছিল। আমার বাবা তো শেষের দিকের ছেলে। আমার জ্ঞান হয়ে আমি তিন জ্যাঠা আর দুই পিসিকে দেখেছি। তাও এক জ্যাঠা, তিনি আবার বিয়ে—থা করেননি, সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক সময় পুজো কি গরমের ছুটিতে দাদু, ঠাকুমা, জ্যাঠতুতো আর পিসতুতো ভাইবোনেরা গিয়ে জমায়েত হত মধুপুরের সেই বাড়িটাতে। সবাই যে সব সময় যেত তা নয়। তাহলেও বাড়িটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠত। ছোটোবেলাতেই মাকে হারিয়েছি, তাই জ্যাঠাইমা আর পিসিমাদের একটু বাড়তি আদর পেতাম। আরেকজনের স্নেহ—ভালোবাসার সিংহভাগ তোলা ছিল আমার জন্যে। সে হল মেজো জ্যাঠার ছোটো মেয়ে শিপ্রাদি। আমার চেয়ে সাত বছরের বড়ো। তাকে শেষ দেখি আমার দশবছর বয়সে। সেও আজ পঁচিশ বছর হয়ে গেল। তাকে দেখি মানে তার জলে ভেজা দেহটা দেখি। ওই মধুপুরের বাড়িতেই কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কী করে বলতে পারব না। আমি ছোটো, তাই হয়তো ব্যাপারটা কেউ আমার সামনে আলোচনা করেনি। তবে সেই বয়েসেই জানতাম শিপ্রাদির মধ্যে একটা অ্যাবনরমালিটি আছে। ছোটোবেলায় একবার মেনিনজাইটিস হয়েছিল। সেকালে এসব রোগের চিকিৎসা প্রায় ছিল না কিছু। তবু কী করে যেন বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তাররা বলেছিলেন ওর দ্বারা লেখাপড়া আর হবে না। কোনোরকম বাড়তি মানসিক চাপ ওর জখম মস্তিষ্ক নিতে পারবে না। তাই পড়াশোনার জন্যে কেউ জোরাজোরি করেনি ওকে। মেজো জ্যাঠাইমা শিপ্রাদিকে নিয়ে অনেক সময় থাকতেন মধুপুরের বাড়িতে। প্রকাণ্ড আম, জাম, পেয়ারা, কাঁঠাল আর ফুলের বাগান। তার মধ্যেই শিপ্রাদি কতকটা কপালকুণ্ডলার মতো বড়ো হয়ে উঠেছিল।
‘কেন জানি না আমাকে অসম্ভব ভালোবাসত। প্রায়ই আমাকে বলত, অভি, আমি যখন থাকব না, তখন মনে রাখবি তো আমাকে? আমি বলতাম, কেন, তুমি আবার কোথায় যাবে। শিপ্রাদি বলত, দেখিস একদিন আমি হারিয়ে যাব, আর দেখতে পাবি না আমাকে। তুই কিন্তু আমার কথা ভুলিস না। কথাগুলো বলতে বলতে শিপ্রাদির চোখ জলে ভরে উঠত। তাই দেখে আমারও কান্না পেত। ও চোখের জল মুখে বলত, ভুলে যদি যাস, তাহলে আমিই তোকে মনে করিয়ে দেব। তখন ওর কথাগুলোর মানে বুঝিনি।
‘সুন্দর মাটির পুতুল বানাত শিপ্রাদি। নিজেই সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে রং করত। সে পুতুলের দাবিদার ছিল অনেক। কিন্তু সেরা পুতুলগুলো আমার কপালেই জুটত। এই নিয়ে আবার ভাইবোনেদের মধ্যে নানান মান—অভিমানের পালা চলত। যা হোক, একটা সালিশি করে দিত ওই শিপ্রাদিই। সবাইকে কাছে টানত, গল্প বলত বানিয়ে বানিয়ে। গল্পগুলো ঠিক মনে নেই এতদিন পরে। তবে এটুকু খেয়াল আছে সেগুলোর চরিত্র বা পরিবেশ কোনোটাই ঠিক চেনাজানার মধ্যে পড়ে না। আবার এক এক সময় কী রকম যেন একা হয়ে যেত সকলের মধ্যে থেকেও। কথা বললেও জবাবা দিত না তখন। কাউকে দেখেও দেখত না। মুখে ফুটে উঠত এক অদ্ভুত হাসি। সে হাসির সঙ্গে কোনো কিছুর মিল দেওয়া যায় না। তখন কেন জানি আমার মনে হত শিপ্রাদি ঠিক আমাদের মতো মানুষ নয়। আমাদের সঙ্গে চিরদিন থাকার জন্যে আসেনি। কোনো প্রিয়জন যেন বেড়াতে এসে থেকে গেছে কিছুদিনের জন্যে। আবার যেদিন ঘরের কথা মনে পড়বে, সেদিনই চলে যাবে। মাঝে—মাঝে ঘণ্টা—কয়েকের জন্যে বেপাত্তা হয়ে যেত। হাজার খুঁজেও ওর নাগাল পাওয়া যেত না। আবার নিজে নিজেই চলে আসত। কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করলে হাসত শুধু, জবাব দিত না।
‘শিপ্রাদির জীবনের শেষ দিনটার কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। পুজোর ছুটির সময়। আমরা সবাই মিলে গাইতাম, আজি ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা। শিপ্রাদি ওর ঝামর চুল উড়িয়ে নিজের মতো করে নাচত আমাদের গানের সঙ্গে। গায়ের রং ফরসা হতে গিয়েও হয়নি। কিন্তু চোখমুখ ছিল দেবীপ্রতিমার মতো, আর ছিল মস্ত এক ঢাল চুল যা কখনো খোঁপা বা বিনুনির চেহারা নেয়নি। ওর মতো চুলের গোছ আজ পর্যন্ত আমার নজরে পড়েনি।
‘দুপুরে খাওয়ার আগে শিপ্রাদিকে পাওয়া গেল না সেদিন। খোঁজাখুঁজি ঠিকই হল। তবে বড়োরা কেউ ভীষণরকম তোলপাড় কিছু করল না। এ—রকম ডুব মারাটা নতুন কিছু নয়। শুধু আমার মনটা কেন জানি ছ্যাঁত করে উঠল। সেদিনই সকালে আমাকে বলেছিল, জানিস অভি, ওরা সব সময় আমাকে ডাকছে। খালি বলছে, চলে আয়, চলে আয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা তোমাকে ডাকে এমন করে! আমার কথা যেন শুনতেই পেল না। নিজের মনে বলল, ওরা তো মাঝে—মাঝেই আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। নিজেই আবার জোর করে ছাড়িয়ে চলে আসি। কিন্তু এবারে বোধহয় আমার যাবার সময় হল। গেলে আর আসব না। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কী রে, আর যদি না আসি, মনে রাখবি তো আমাকে। আমার বুক ঠেলে কান্না আসচিল। জোর করে ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়েছিলাম। জীবিত অবস্থায় সেই ওকে শেষ দেখি।’
বাবা আবার নতুন করে সিগারেট ধরালেন। পর পর তিনটে সিগারেট কখনো খান না। বাপন অবাক হতে ভুলে গিয়েছিল। এক মনে শুনছিল বাবার কথাগুলো।
‘বিকেলের দিকে একটা হইচই শুনলাম। তার সঙ্গে সেজো জ্যাঠাইমার আছাড়িপিছাড়ি কান্না। আমি যখন গেলাম, কুয়ো থেকে তোলা হয়েছে শিপ্রাদিকে। ভিজে কাপড়ে, এক ঢাল ভিজে চুলের ফ্রেমে বাঁধানো মুখে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো ছাপ নেই। চোখ বোজা। মুখে সেই হাসিটার আভাস। যে হাসির মানে বোঝা যেত না। ও নিজেও কখনো বোঝাত না। আমি ভাবতেই পারছিলাম না শিপ্রাদি আর বেঁচে নেই। কে যেন আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল কুয়োতলা থেকে।
‘শিপ্রাদির মারা যাবার পরেই ও বাড়ির আনন্দের হাট ভেঙে গেল। এক বছর আগুপিছু করে আমাদের দাদু আর ঠাকুমা বলে ডাকার কেউ থাকল না। বাড়িটার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েই চলল। বাবা—জ্যাঠা—পিসিদেরও ওদিক পানে যাবার ইচ্ছেয় ভাঁটার টান। অথচ সকলেই জানে বাড়িটা ঠিকই আছে; আছে ওখানকার সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে নায়েবগোছের একজন। তা ছাড়াও আছে কাজের লোক, দরোয়ান। এমনি করে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। আমি লেখাপড়া শেষ করে একটা কোম্পানিতে সেলসের কাজে ঢুকলাম। পাটনায় আমাদের মতো ফেরিওয়ালাদের জন্যে একটা অফিস থেকে কনফারেন্স ডেকেছিল। সেখান থেকে ট্রেনে ফিরছিলাম কলকাতায়। শীত পড়ি—পড়ি করছে তখন। দুপুর নাগাদ ট্রেন পৌঁছল মধুপুর। আগেও বহুবার এপথে এসেছি, গেছি। স্টেশনটা বোধহয় ঘুমের মধ্যে পার হয়ে গেছি অনেক রাতে। কিন্তু দিনের আলোয় জায়গার নামটা থিতিয়ে পড়া অনেক স্মৃতিকে তোলপাড় করে তুলল। সেইসব স্মৃতির হাত ধরে মনটা চলে যেতে চাইল ছোটোবেলায়। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে হাল আমলে ফেরাতে পারলাম না। বাড়িটা চুম্বক হয়ে টানতে লাগল আমাকে। সুখে—দুঃখে একাকার বাড়িটার স্মৃতি আমাকে বের করে আনল ট্রেনের কামরা থেকে। সেই প্রচণ্ড টানকে ততক্ষণে আরও জোরদার করেছে আমার নিজের হঠাৎ চাগিয়ে ওঠা কৌতূহল। দেখিই না কেমন আছে বাড়িটা। আবার কাল সকালেই তো কলকাতা ফেরার পালা। একটা রাত না হয় নাড়াচাড়া করব ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো নিয়ে।
‘নায়েববাবু আরও বুড়িয়ে গেছেন। তবু আমাকে চিনলেন ঠিকই। খুব খুশি আমাকে দেখে। আগের দিনের কথা মনে করে অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেউ আর এদিক মাড়ায় না বলে দুঃখের শেষ নেই তাঁর। এই বিশাল বাড়ি যক্ষের মতো আগলে বসে আছেন। উনি চোখ বুজলে এই মস্ত সম্পত্তি পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খাবে।
‘বাড়িটার তিনতলায় ঘর ছিল কুল্যে একখানা। কেন জানি না ওই ঘরটাতেই রাত কাটানোর ইচ্ছে হল আমার। নায়েববাবু একটু খুঁতখুঁত করলেন। নীচের ঘরগুলো সাফসুতরো করাই আছে। খাট—বিছানারও অভাব নেই। আমি তবু তিনতলার ঘরটাতে থাকবার জন্যে জেদ করলাম। সারা বিকেল, সন্ধে এলোমেলো ঘুরে ছোটোবেলার সঙ্গী—সাথীদের খুঁজলাম। বিশেষ কাউকে পেলাম না। যে ক—জন আছে, তারাও নিজের নিজের রুটিরুজির ধান্ধায় ব্যস্ত। ছোটোবেলার স্মৃতিচারণের ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই তাদের।
‘খবর দিয়ে আসিনি। তাহলেও দুবেলা খাওয়াদাওয়া ভালোই হল। রাত্তিরের খাবার পাট চুকিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। পরের দিন ভোরঘেঁষা সকালে ফেরার ট্রেন। তিনতলার ঘরটায় ঢুকে আলো জ্বালতেই চার দেওয়াল, চারটে হাত হয়ে আপনজনের মতো টেনে নিল আমাকে। বইয়ের র্যাক থেকে ধুলো ঝেড়ে বের করলাম যোগীন সরকারের বনে—জঙ্গলে, ছবি ও গল্প। ছোটোবেলায় কী ভালই না লাগত বইগুলো। মনে হল খুব কাছের লোকের সঙ্গে দেখা। এই নতুন করে দেখার আগে অনেকগুলো বছর ঢুকে গেছে। আলাপ—পরিচয় তাই ঠিক আগের মতো ঝালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন সুর কেটে গেছে। তখন আমার বয়েস ছিল দশ, এখন পঁচিশ। পনেরোটা বছর অনেকখানি সময়। একটা মানুষকে আগাগোড়া বদলে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। পঁচিশ বছর বয়েসে দশ বছর বয়েসের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়; নাগাল পাওয়া যায় না ছোটোবেলার সেই মনটার। চেষ্টা করলাম নিজেকে হারিয়ে খোঁজার। কিছু পেলাম, ভাঙাচোরা টুকরো—টাকরা। বুঝলাম নেহাতই ঝোঁকের মাথায় এসে পড়েছি। এখানে সময় পনেরো বছর ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনোদিন, সেখানে ফিরতে পারব না।
‘আগেই বলেছি শীত জাঁকিয়ে বসার কাছাকাছি সময়। ঘরের প্রায় সবগুলো জানলা বন্ধ। খোলা শুধু একটা। পরিপাটি বিছানা পাতা। কাল ভোরে ওঠার কথা মনে করে শুয়ে পড়লাম। ঘুমোবার আগে বইয়ে চোখ বোলানো অভ্যেস। সঙ্গে ছিল পাটনা স্টেশনে হুইলারের স্টল থেকে কেনা ইংরিজি ডিটেকটিভ উপন্যাস। ভালো ঘুমপাড়ানি ওষুধ। ভেবেছিলাম চোখে টান ধরলেই বেড সুইচ টিপে বাতি নিবিয়ে দেব। পাতা উলটে গেলাম বেশ কয়েকটা। কিন্তু ঘুমের নাগাল পেলাম না। বইয়ের অক্ষরগুলো মানেটানেসুদ্ধ পিছলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। পড়ছি, কিন্তু মনে কিছুই দাগ কাটছে না। বইটা রেখে উঠে পড়লাম। দাঁড়ালাম ঘরের একটিমাত্র খোলা জানলার ধারে। বাইরে চাঁদের আলো অন্ধকারকে বাড়তে দেয়নি। সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান। তারপরেই একটা কুয়ো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অমনি মনের মধ্যে একটা ছায়া পড়ল। ভিজে এক ঢাল চুলের ফ্রেমে বাঁধানো মুখে একটা বেমানান হাসি নিয়ে শুয়ে ছিল একজন। পুরোনো অ্যালবাম থেকে একটা ছবি আলাদা হয়ে খুলে এল। সময়ের ঘষায় এতটুকু অস্পষ্ট হয়নি। মন থেকে মুখে ফেলতে চাইলাম ছবিটা। পারলাম না। কেমন একটা অস্বস্তি একটু—একটু করে পেয়ে বসছে আমাকে। জ্যোৎস্নায় ধোওয়া। সেই কুয়োতলা থেকে কিছুতে চোখ সরাতে পারছি না। হালকা হাওয়ায় গাছপালা মাথা দোলাচ্ছে। আলো আর অন্ধকার জায়গা বদলাবদলি করছে সমানে। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া অন্য শব্দ নেই। মনে হল সারা বাগান, ওই কুয়োতলা হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।
‘দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম জানলাটা। আবার এসে বসলাম বিছানায়। গরম নেই ঘরের মধ্যে। তবু টের পেলাম কপালে বিন্দু—বিন্দু ঘাম জমে গেছে। আমি পঁচিশ বছরের সুস্থ সবল মানুষ একজন। ছাত্রজীবনে কবিতা লিখেছি, ছাপাও হয়েছে। কিন্তু কল্পনা কখনো এ—রকম লাগামছাড়া হয়নি। ট্যুরের চাকরি। অজস্রবার অচেনা অজানা বাংলোতে রাত কাটিয়েছি। চোর—ডাকাত ছাড়া অন্য কোনো কারণে এ—ধরনের ছমছমে অস্বস্তি বোধ করিনি। অথচ এই ঘর আমার চেনা, কত স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে। বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে যেটা অস্বস্তি, যে—কোনো সময় সেটাই ভয়ের চেহারা নিতে পারে। যুক্তিবাদী মনটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সব কিছুর মানে খুঁজে বের করার। একটা সময় তাকে হার মানতেই হবে। আর ঠিক তখনই জেঁকে বসবে ভয়।
‘বিছানায় শুয়েও শয্যাকণ্টকী। বই সামনে ধরলেও চোখের নজর যায় পিছলে। ছাপার অক্ষর টপকে চলে যায় বন্ধ জানলাটার ওপর। অমনি মনের আয়নায় দেখতে পাই জ্যোৎস্নায় নিকোনো কুয়োতলাটা। অনেক চেষ্টা করেও এই ছবিটা অন্য চিন্তা দিয়ে আড়াল করা গেল না। উলটে একটা বাড়তি ভাবনা পেয়ে বসল আমাকে। যাকে ভেবে মন বারবার ছুটে যাচ্ছে কুয়োতলায়, সে নিজেই এসে দাঁড়িয়েছে, বন্ধ জানলার ওপাশে। হাজার যুক্তির ঝাড়ু চালিয়েও কথাটা তাড়াতে পারলাম না। এমন সময়,’ বলে বাবা থামলেন একটু।
‘এমন সময় কী?’ বাপনের গলাটা একটু চড়ে গেল। বাবার গল্পের মধ্যে কতখানি ঢুকে গেছে নিজেই বুঝতে পারেনি।
‘বন্ধ জানলার ওপাশ থেকে কাঠের পাল্লার ওপর স্পষ্ট শব্দ হল ঠকঠক। পোকা নয়, মাকড় নয়। পরিষ্কার মানুষের হাতে আঙুলের উলটো দিকের গাঁট দিয়ে ঠোক্কর মারার আওয়াজ। যেন কেউ আমার নজর কাড়ার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে ইলেকট্রিকের আলো। আবার ঠিক মাপা দুটি নৌকা জানলার ওপর। শব্দটা আমার মন থেকে যুক্তিটুক্তিতে ভাগিয়ে আমাকে ফেলে দিল ভয়ের গর্তে। সে গর্তের আবার তলা নেই। একবার তার মধ্যে পড়লে শুধু তলিয়েই যেতে হয়।
‘আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে। বন্ধ জানলাটা থেকে কিছুতে চোখ সরাতে পারছি না। ফের শব্দ হল—ঠক ঠক। সামান্য একটু বাদে আবার ঠক ঠক। আপনা হতেই শব্দগুলো আমার কাছে কথা হয়ে গেল। পরিষ্কার শুনলাম। অভি—এই অভি!
‘এখানে আমাকে এভাবে একজনই ডাকতে পারে। এবং সে—ই ডাকছে আমাকে। কেন একথা মনে হল বলতে পারব না। হয়তো ভয়টাকে আরও পাকাপোক্ত করবার জন্যে আমার মনই চাইছিল এই ধরনের একটা বিশ্বাসের ভিত তৈরি করতে। ভয় আর যুক্তিহীন বিশ্বাস এ ওকে আঁকড়ে ধরল আরও জোরে। বুদ্ধিবৃত্তির শেষ টিমটিমে আলোটা নিবে যেতে সেই অতল ভয়ের মধ্যে এক ধরনের নিশ্চিন্ত ভাবের অবলম্বন পেয়ে গেলাম। আর কোনো সন্দেহ রইল না: শিপ্রাদিই ডাকছে আমাকে জানলার ওপাশ থেকে। বাইরের দেওয়ালে হয়তো টিকটিকি আটকে থাকতে পারে, কিন্তু কোনো মানুষের পায়ের বুড়ো আঙুল আটকাবার মতো জায়গা নেই।
‘আবার এল সেই ডাক। একই ধরনের। অভি, এই অভি। আমার হাত—পা অনেকক্ষণ বরফের চাদরের ওপর শুয়ে থাকলে যা হয় সেই রকম। বুকের মধ্যে ঢাক বাজাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ঘরের টেমপারেচার ফ্রিজিং পয়েন্টে নেমে গেছে। বুঝতে পারছি ঘামে সারা গা ভিজে গেছে বলে ঠান্ডাটা বেশি লাগছে। একবার পঁচিশ বছর বয়সি আমি মরিয়া হয়ে শেষবারের মতো ঘাই মারল একেবারে নেতিয়ে পড়ার আগে। বলল যাও না, জানলাটা খুলেই দেখো না ব্যাপারটা কী! জানলা খোলার কথা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল। অমনি আবার নতুন করে ভয়কে ফিরে পেলাম। যুক্তি লাগসই না হলে একটা সংশয়ের খোঁচ থেকেই যায়। এই ভয় আমাকে সেই অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচল।
‘জানলার ওপাশ থেকে শব্দগুলো আমার কাছে টেলিগ্রাফের টরেটক্কা হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। শিপ্রাদি ডাকছে আমাকে। অভি, এই অভি, ওঠ না, দেখ আমি এসেছি। কখনো বলছে : তুই এতদিন পরে কেন এলি অভি। আমার একা—একা আর ভালো লাগে না।
‘আমি যে কতক্ষণ একটা জ্যান্ত সিমেন্টের চাঙড় হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম খেয়াল নেই। সেই অদ্ভুত একতরফা সংলাপ শুনে যাচ্ছি তো শুনেই যাচ্ছি। নিজেই বুঝিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট ভয় একটা বেপরোয়া সাহসকে খুঁচিয়ে তোলে অনেক সময়। সেই সাহস আচমকা আমাকে ইলেকট্রিকের শক দিল। অনেকটা সময় আমাকে পাকড়ে রাখার পর ভয়ের মুঠোও বোধ হয় একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম। যা—থাকে—কপালে ধরনের একটা খ্যাপামি আমাকে গুলতি থেকে ছিটকে যাওয়া গুলি বানিয়ে দিল। আছড়ে গিয়ে পড়লাম জানলাটার ওপর। শরীরের সবটুকু শক্তি নিংড়ে দিলাম পাল্লাদুটো হাট করে খুলে দেবার চেষ্টায়। তাকালাম খোলা জানলা দিয়ে। দেখলাম—’
‘বাপন, তোমার বাবাকে নিয়ে খেতে এসো। দেরি হলে কাবাব ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ ভেতর থেকে মা ডেকে বললেন।
বাপন শুনেও শুনল না, বলল, ‘জানলার ওপাশে কী দেখলে বাবা?’
‘সেইটেই আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়,’ আস্তে আস্তে বললেন বাবা, ‘মনে হল শিপ্রাদিই, তেমনি চুল খোলা, আলো—অন্ধকারে মিলেমিশে আছে, তবুও পরিষ্কার শিপ্রাদি। তবে এই দেখাটা বোধহয় এক লহমার জন্যে। তবে একটা কথা,’ একটু হাসলেন বাবা, ‘আমার মন তো তাই চাইছিল দেখতে। হয়তো পুরোটাই হ্যালুসিনেশান, যার পেছনে অটো—সাজেশান থাকতেও পারে। তবে একটা কথা। এর ঠিক পরেই বুঝলাম ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো ভয়ও আমার শরীর—মনের চৌহদ্দি ছেড়ে পালিয়েছে। আমি বিছানায় এসে পড়া মাত্র ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলাম।’
‘কিন্তু বাবা, তোমার শিপ্রাদির ঠোঁটের বাঁ কোণের ওপরে কি একটা বড়ো তিল ছিল,’ ধাঁ করে জিজ্ঞাসা করল বাপন।
‘তুই কী করে জানলি!’ এবারে বাবার অবাক হবার পালা।
‘না, এমনি হঠাৎ মনে হল।’
ভেতর থেকে বাপনের মা আবার খেতে ডাকলেন। বাবা মাথায় ঝাঁকি দিয়ে নিজের মনেই বললেন, ‘আশ্চর্য! তোর তো সে—কথা জানার নয়।’