জাদুকর সত্যচরণ ও রোদ চশমা

জাদুকর সত্যচরণের রোদ চশমা

|| ১ ||

ক্যালেন্ডারের পাতায় আষাঢ় মাস পড়ে গেলেও এ বছর বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। হাওয়া অফিস বলে চলেছে দুদিনের মধ্যেই বর্ষা নামবে, কিন্তু বর্ষা নামছে না। হাওয়াঅফিসের কথা নিয়ে হাসাহাসি করল লোকজন। কলকাতা মহানগর সহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে একেবারে হাঁসফাস অবস্থা। রাস্তায় বেরোলেই ছাতা-টুপি বা রোদ চশমা বা সানগ্লাস অপরিহার্য হয়ে উঠছে। তবুও রেহাই নেই, ঘেমে একদম স্নান করে যাচ্ছে মানুষ। চন্দনেরও একই অবস্থা। ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের চাকুরে সে। সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ থেকে পদোন্নতি হয়ে সে এখন মার্কেটিং অফিসার, তবু তাকে রোজই কলকাতার নানা জায়গায় সোম থেকে শনি ছুটতে হয় নানা কাজের জন্য। রবিবার অবশ্য সচরাচর সকালবেলা বাজার করার জন্য কাছেই বাজার যাওয়া ছাড়া বাকি সময়টা সে বাড়িতেই থাকে। তাছাড়া বাইরে যা রোদের তাপ, তাতে আর বেরোতে ইচ্ছা হয় না চন্দনের। সারা সপ্তাহই তো তাকে রোদে ঘুরতে হয়, এই একটা দিনই ভালোমন্দ রান্না করে তা খেয়ে ঘুমিয়ে, বই পড়ে, বিশ্রাম নিয়ে সময় কাটায়। এ রবিবারও সকাল সকাল বাজার গেছিল চন্দন। ভালো ভেটকি মাছ কিনে এনেছিল সে। রান্না শেষ করে বেলা দশটা নাগাদ আরাম করে সোফায় খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল সে। বাইরে সূর্য্যদেব ইতিমধ্যে আগুন ঝরাতে শুরু করেছেন। খবরের কাগজের প্রথম পাতাতেও তাপপ্রবাহের সংবাদ ছাপা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে বেরোতে নিষেধ করেছেন ডাক্তারবাবুরা। লেখা হয়েছে পথচারীরা বাইরে বেরোলে সঙ্গে জলের বোতল এবং ছাতা, টুপি বা রোদ চশমা থাকা আবশ্যক। কাগজের পাতা উলটাতে উলটাতে জাদুকর সত্যচরণের কথা মনে পড়ল চন্দনের। লোকটা একটা বাড়ির চিলেকোঠার ঘুপচি ঘরে থাকেন। এ সময় ছাদের মাথার ঘর গরমে আগুন হয়ে থাকার কথা। সত্যচরণের ঘরে এসি বা এয়ারকুলার নেই। সম্বল বলতে একটা টেবিল ফ্যান, তাতে যতটা না বাতাস হয় তার থেকে শব্দ হয় বেশি। দীর্ঘদিন কথা হয়নি ভদ্রলোকের সঙ্গে। এই গরমে তিনি কেমন আছেন কে জানে! তাঁর কথা মনে পড়াতে তাঁকে ফোন করার জন্য চন্দন টেবিল থেকে মোবাইল ফোনটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। চন্দন উঠে গিয়ে দেখল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যচরণ। তাঁর চোখে চৌকো ফ্রেমের কালো রোদ চশমা বা সানগ্লাস। তার আকৃতি সাধারণ রোদ চশমার থেকে বেশ খানিকটা বড়ো। চশমাটা শুধু চোখ নয়, গালের ওপর থেকে কপালেরও বেশ খানিকটা অংশও আবৃত করে রেখেছে। তাঁকে দেখে চন্দন হেসে বলল, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার, এখনই ভাবছিলাম আপনার একটা খবর নেওয়া দরকার, আর আপনি স্বয়ং চলে এলেন।’ সত্যচরণ একগাল হেসে বললেন, ‘এদিকে একটা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একজন ভদ্রলোক ডেকেছিলেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর নাতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে ম্যাজিক শো করাবেন। কাজ মেটার পর ভাবলাম, আজ রবিবার, আপনি নিশ্চয়ই বাড়িতে আছেন, একবার দেখা করে যাই।’

চন্দন বলল, ‘তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকুন, বাইরে কেমন রোদ দেখেছেন? ‘

ঘরে ঢুকলেন সত্যচরণ। তিনি ঘরে পা রাখতেই চন্দন দরজা বন্ধ করতে করতে তাঁর উদ্দেশে বলল, ‘এসেছেন যখন তখন খেয়ে যেতে হবে কিন্তু। আজ পাঁঠার মাংস বা ইলিশ মাছ নয়, ভেটকি মাছ রেঁধেছি।’ সম্মতিসূচক হেসে সত্যচরণ বললেন, ‘যা গরম পড়েছে তাতে মাংস-ইলিশের মতো রিচ খাবারের থেকে ভেটকি মাছই ভালো।’

দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে সত্যচরণের মুখোমুখি সোফায় বসল চন্দন। সত্যচরণ পকেট থেকে রুমাল বার করলেন গলার ঘাম মোছার জন্য। হ্যাঁ, এই সেই সত্যচরণ – জাদুকর সত্যচরণ। বছর দশেক আগে এক রাতে উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে তাঁর সঙ্গে চন্দনের পরিচয় হয়েছিল। তাঁর ভিজিটিং কার্ডে নিজের নামের পাশে তিনি লেখেন ‘হুডিনি অব ইন্ডিয়া,’ যদিও সত্যচরণ পুতুতুন্ডি হুডিনির মতো পৃথিবীবিখ্যাত জাদুকর নন। অতি সাধারণ একজন মানুষ তিনি। খবরের কাগজে তাঁর নাম ছাপা হয় না। পোষ্টার ছাপিয়ে বড়ো মঞ্চ ভাড়া করে খেলা দেখাবার ক্ষমতাও তাঁর নেই। পাড়ার ছোটোখাটো ফাংশনে বা অফিস ক্লাবের অনুষ্ঠানে, বাচ্চাদের স্কুলে ম্যাজিক দেখিয়ে কোনোরকমে দিন চলে অকৃতদার জাদুকর সত্যচরণের।

তবে আরও একটা গুণ তাঁর আছে – তা হল গল্প বলার। অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলতে পারেন তিনি। সত্যচরণ অবশ্য বলেন সেসব অলৌকিক বা রোমাঞ্চকাহিনী আসলে কোনোটাই বানানো গল্প নয়, তাঁর জীবনেরই অভিজ্ঞতা। বাল্যকালে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। তারপর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন একুশ বছর বয়সে হংসরাজ নামে এক বাজিকর বা স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানের কাছে। তাঁর কাছেই জাদুর খেলা শিখেছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পরবর্তীকালে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেনও দেশের নানান খ্যাত-অখ্যাত জায়গাতে। সাক্ষী হয়েছিলেন নানান বিরল অভিজ্ঞতার। সেসব কাহিনীই সতাচরণ শোনান চন্দনকে। কাহিনীগুলো অন্য কেউ শুনলে হয়তো তা বিশ্বাস না-ই করতে পারে, কিন্তু চন্দনের বেশ লাগে সেসব কাহিনী শুনতে। তার ওপর সত্যচরণ অত্যন্ত সৎ মানুষ। ওই কাহিনীগুলো বলা ও শোনার জন্যই সখ্য গড়ে উঠেছে জাদুকর সত্যচরণ ও চন্দনের মধ্যে। দু-জন মুখোমুখি বসার পর চন্দন তাঁকে বললে, ‘আপনার চলছে কেমন? যা গরম পড়েছে, বাইরে বেরোনোই মুস্কিল হয়ে পড়েছে। চোখ যেন একদম ঝলসে যাচ্ছে।’

সত্যচরণ রুমাল দিয়ে হাত-মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘বাইরে বেরোনো নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নেই যতক্ষণ এই রোদ চশমাটা আছে। চোখে দিলেই চোখ একদম ঠান্ডা হয়ে যায়, তার সঙ্গে শরীর আর মনও। চোখের সঙ্গে শরীর -‌ মনেরও সম্পর্ক আছে কিনা! সমস্যাটা হল রোজগারের। কাজকর্ম তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। গরমের জন্য কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে না। স্কুল-কলেজে বাড়তি ছুটি দিয়েছে। একজনের সুপারিশে অনেক কষ্টে এক মাসে ওই জন্মদিনের একটা অনুষ্ঠানে খেলা দেখাবার বরাত পেলাম।’ এই বলে তিনি চশমাটা খুলে সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রাখলেন।

চন্দনের বেশ খারাপ লাগল সত্যচরণের আর্থিক দুরবস্থার কথা শুনে। তবে সত্যচরণ গরিব জাদুকর হলেও প্রখর আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষ। চন্দন জানে তাঁকে সে অর্থসাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা নেবেন না। এমন কী ধার হিসেবেও নয়।

সত্যচরণ তাকে এরপর পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কেমন আছেন বলুন?’

চন্দন জবাব দিল, ‘অফিসের কাজের জন্য আমাকে তো রোজই বাইরে বেরোতে হচ্ছে। ট্রাম-বাস-মেট্রোতেই যাতায়াত করতে হয়। বাইরে বেরোলে নাজেহাল হয়ে পড়ছি।’ একথা বলে সে চশমাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার চশমাটা বেশ আনকমফর্টেবল তো, এত বড়ো বড়ো কাচ লাগানো সানগ্লাস সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না।’

টেবিলের ওপর রাখা রোদ চশমার দিকে তাকিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘এ ধরনের চশমা কেউ কলকাতার বাজারে পেলে তো পরবে! তাছাড়া এই চশমা জোগাড় করার ক্ষমতা কারও আছে বলে আমার জানা নেই। তবে আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে এ চশমার নকল বেরিয়েছিল বাজারে। ছেলেছোকরারা সে সময় এই চশমা, মানে এর নকল বেশ কিছুদিন চোখে পরে ঘুরত। ওই আসল চশমাটা আমার আগে শুধু একজনই চোখে পরত।’

একথা বলে সত্যচরণ বললেন, ‘ভালো করে দেখুন। তো, এ চশমাটা দেখে কারও কথা মনে পড়ে কি না?’ তাঁর কথা শুনে চন্দন ভালো করে তাকাল টেবিলে রাখা চশমাটার দিকে। এখনকার সাধারণ চশমার কাচের থেকে বড়ো কালো কাচের চশমা। তবে চশমাটা দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরোনো চশমা। ফ্রেম ও ডাটের স্থানে স্থানে সোনালি রং চটে গেছে। তবে চশমাটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ ভালো করে তাকাবার পর চন্দনের যেন মনে হতে লাগল এ চশমা সে কোনো ছবিতে বা কারও চোখে দেখেছে। কিন্তু ব্যাপারটা যেন সে মনে করেও করতে পারছে না।

সত্যচরণ বললেন, ‘আপনি মুম্বাই সিনেমার এককালের বিখ্যাত অভিনেতা আকাশ দুবের নাম শুনেছেন, বা ‘খঞ্জর’ সিনেমাটা দেখেছেন?’

চন্দন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। ক-দিন আগেই তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিবস গেল। সেই উপলক্ষ্যে সংবাদপত্রে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা আর ছবি বেরিয়েছিল। তাতে ওঁর চোখে এইরকম দেখতে একটা চশমা ছিল। আর ‘খঞ্জর’ সিনেমাটাও আমি টেলিভিশনে দেখেছি। সে সিনেমাতেও তিনি এই চশমাটাই পরেছিলেন বলে মনে হয়। বোম্বের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে ছিল সেই অ্যাকশন ফিল্ম।’

সত্যচরণ বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছেন। একসময় তিনি ছিলেন সেদিনের বোম্বে, মানে আজকের মুম্বাই সিনেমার এক নম্বর অ্যাকশন হিরো। দুর্ভাগ্য, বছর পাঁচেক আগে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আজও তার ‘খঞ্জর’ নামের সিনেমাটার কথা একটু বয়স্ক সিনেমাপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। কী অভিনয়! কী অ্যাকশন তাঁর! বিশেষত ফাইটিং-এর দৃশ্যগুলোর জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। ‘

চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনি ওঁর ফ্যান ছিলেন নাকি? সেই জন্য এই চশমাটা কিনেছিলেন?’

সত্যচরণ বললেন, ‘সে সময় ওঁর ফ্যান তো সকলেই ছিল। তবে সত্যিকথা বলতে কী, সিনেমা দেখার সময়-সুযোগ আমার তেমন একটা ছিল না। গুরু হংসরাজের থেকে খেলা শিখে আমি তখন পেটের ধান্দায় দুটো পয়সা রোজগারের জন্য পথে পথে ঘুরে খেলা দেখিয়ে বেড়াই। সিনেমার জন্য খরচ করার মতো পয়সা বা সময় কোনোটাই আমার ছিল না। তবে ওই ‘খঞ্জর’ সিনেমাটা আমি দেখেছিলাম। একটা মেলায় খেলা দেখাতে গেছিলাম। যেখানে পর্দা টাঙিয়ে প্রোজেক্টর দিয়ে বিনাপয়সায় সিনেমাটা দেখানো হচ্ছিল। সেই সুযোগে আমি সিনেমাটা দেখেছিলাম। ‘খঞ্জর’ অর্থাৎ ছোরা। দারুণ লেগেছিল আকাশ দুবের অ্যাক্টিং। তাঁর আর একটা ছবি আমি অবশ্যই দেখতাম। সেটা অবশ্য আমার আর দেখা হয়নি।’ — একথা বলে একটু থামলেন সত্যচরণ। তারপর চশমাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ চশমা আমি কিনিনি। কেনার সাধ্যও আমার কোনোদিন হবে না। এ চশমা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং আকাশ দুবে। এই রোদ চশমাটাই তিনি পরতেন। ‘খঞ্জর’ সিনেমাতেও তিনি এটা পরেই অ্যাকশন হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।’

সত্যচরণের কথা শুনে চন্দন সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বলেন কী মশাই! এটা আকাশ দুবের ব্যবহার করা চশমা? এ তো অমূল্য জিনিস। তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল কোথায়?’

সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘হয়েছিল, হয়েছিল। সে আমার জীবনের এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। শুনবেন?’

চন্দন বুঝতে পারল, আজ নতুন কোনও কাহিনী শোনাতে চলেছেন সত্যচরণ। চন্দন সাগ্রহে বলল, ‘অবশ্যই শুনব। দাঁড়ান, তার আগে একটু চা বানিয়ে আনি?’

সত্যচরণ বললেন, ‘তাহলে তো বেশ হয়।

তিন মিনিটের মধ্যেই চা বানিয়ে আনল চন্দন । চুপচাপ চা পান করতে করতে গল্প বলার জন্য নিজের মনে অতীতের স্মৃতিগুলোকে তিনি সাজিয়ে নিলেন। বরং বলা ভালো, মনের মধ্যে গল্পটাকে বানিয়ে নিলেন। তারপর একটা লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করে কাপটাকে টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, ‘বলি শুনুন-

|| ২ ||

আপনি নিশ্চয়ই মুম্বাইয়ের বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভে গেছেন বা তার নাম শুনেছেন। আরব সাগরের পাড় বরাবর রাস্তা। রোজ বিকাল-সন্ধ্যায় টুরিস্টরা তো বটেই স্থানীয় মানুষরাও সেখানে হাওয়া খেতে আসে বা সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করতে আসে। আশেপাশে বহু ফিল্মস্টারদের বাড়ি। সেসব দেখতেও কেউ কেউ আসে। সব মিলিয়ে জমজমাট রাস্তা বা জায়গা ওই মেরিন ড্রাইভ। আমি যে-সময়ের কথা আপনাকে বলতে যাচ্ছি তা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। নানা গ্রাম শহরে ঘুরতে ঘুরতে আমি সেবার বোম্বে বা মুম্বাই পৌঁছেছি। কী বিশাল শহর, কী বিশাল ঘরবাড়ি! দেখেই তো আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। রেল স্টেশনের বাইরে একটা পাইস হোটেলে খাবার সময় আমার পরিচয় পেয়ে সেই হোটেল মালিক আমাকে পরামর্শ দিল, ‘তুমি মেরিন ড্রাইভে চলে যাও। রোজ বিকালে সমুদ্রের তীরে প্রচুর লোকজন আসে। ছোটখাটো মেলার মতো বসে সেখানে। অনেক গরিব মানুষ নানান ভাবে পেটের ধান্দাও করে সেখানে।’

বোম্বে আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা শহর। কোথায় কী আছে আমার জানা নেই। লোকটার পড়ামর্শে তাই খাবার হোটেল ছেড়ে দুপুরবেলাই পৌঁছে গেলাম মেরিন ড্রাইভে। দুপুর থেকে বিকালের দিকে সময় যত এগোতে লাগল ততই ভিড় বাড়তে লাগল সেখানে। সেই সঙ্গে উপস্থিত হতে লাগল বেলুনওয়ালা, চানাচুর, ঝালমুড়িওয়ালা, বাঁদরখেলা, সাপখেলা, মাদারির খেলা দেখাবার জন্য নানান ধরনের লোক। একজন নিম্বুপানিওয়ালা আমার খেলার সরঞ্জাম দেখে আর আমার পরিচয় জেনে বলল, ‘দু-পয়সা রোজগার চাইলে এখানে কোথাও বসে পড়ো। এ শহর কাউকে ফেরায় না। রোজগার করতেই তো সারাদেশ থেকে এ শহরে মানুষ ছুটে আছেন।

ব্যস, তার কথাতেই আমি ভরসা পেয়ে রাস্তার এক পাশে সতরঞ্চ বিছিয়ে খেলা দেখতে বসে গেলাম। বিকালবেলা সত্যিই যেন মেলার রূপ নিল জায়গাটা। লোকজনের ভিড়, কোলাহল, সমুদ্রর গর্জন-সব মিলিয়ে এক জমজমাট ব্যাপার। আমার খেলা দেখতে চারপাশে লোকজন জমতে শুরু করল। প্রথম দিন বিকালেই খেলা দেখিয়ে পনেরো টাকা আয় করে ফেললাম আমি। সে সময় পনেরো টাকা আয় কম নয়। সে সময় একটা মানুষ পাঁচ টাকায় একটা দিন হেসে খেলে কাটিয়ে দিতে পারত। বুঝলাম এ শহরে থাকলে পয়সা কামাতে পারব। কিন্তু থাকব কোথায়? সে ব্যবস্থাও ওই নিম্বুপানিওয়ালার সাহায্যেই হয়ে গেল। কাছেই ধর্মশালার মতো একটা বাড়ি আছে। তার একতলার বিশাল হল ঘরে সার সার চৌকিতে শোবার ব্যবস্থা আছে। রাত প্রতি এক টাকা অনুদান দিতে হবে। নিম্বুপানিওয়ালা সেখানেই থাকে। আদতে সে বিহারের মানুষ। পেটের ধান্দায় এ শহরে কয়েক বছর আগে এসেছে এবং ওখানেই থাকে। চৌকিগুলো ছারপোকায় পরিপূর্ণ আর তাতে বসলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়, তবু মাথার ওপর ছাদ তো আছে। তাই আমিও সেখানেই আশ্রয় নিলাম। রোজ সকালে আমি স্নান সেরে, আমার ব্যাগটাকে অন্যদেরই মতো চৌকির সঙ্গে চেন-তালা দিয়ে বেঁধে রেখে শহরটা ঘুরে দেখতাম। তারপর বারোটা নাগাদ ফুটপাথের হোটেল থেকে খাওয়া সেরে ঘরে ফিরে সামান্য সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকালের আগেই মেরিন ড্রাইভে গিয়ে খেলা দেখাতে বসে যেতাম। ভালোই রোজগার হচ্ছিল আমার। পনেরো, কুড়ি, পঁচিশ তো হতই। ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বাড়লে এক-একদিন চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকাও রোজগার করলাম আমি। বুঝলাম নিম্বুপানিওয়ালার কথাই ঠিক। এ শহর কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। আমি তাই সেখানেই বসে গেলাম। রাস্তার পাশে বসে দেখতাম মাঝে মাঝে ফিল্মস্টারদের গাড়ি যাচ্ছে। আর সেই গাড়ির পিছনে পিছন পাগলের মতো ছুটছে লোকজন, তাদের ফ্যানের দল। এভাবেই প্রায় একমাস সময় আমার কেটে গেল মুম্বাই নগরীতে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা খেলা দেখাবার পর আমি ঘরে ফেরার জন্য মালপত্র গোছাচ্ছিলাম। মুম্বাইতে সেদিন একটা বড়ো ক্রিকেট ম্যাচ ছিল বলে বিকালে খুব একটা ভিড় হয়নি মেরিন ড্রাইভে। হঠাৎ আমার কিছুটা তফাতে একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামলেন বছর ষাটেকের এক ভদ্রলোক। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে পামশু। তাঁর চেহারা দেখে তাঁকে আমার কেন যেন বাঙালি বলেই মনে হল। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী? কোথায় থাকো?’

আমি ভাঙা ভাঙা হিন্দি মিশিয়ে তাঁকে আমার নামপরিচয় বললাম। আমার কথা বলার ধরন ও নাম শুনে তিনি আবার পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘তুমি বাঙালি! আমিও বাঙালি, ভালোই হল।’

একথা বলে আমাকে তিনি কিছুটা চমকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি সিনেমায় অভিনয় করবে?’ আমি তাঁর কথা শুনে ভাবলাম লোকটা আমার সাথে মজা করছে না তো? আমার চেহারা অতি সাধারণ, নায়কের মতো বা ভিলেনের মতো কোনোটাই দেখতে নই। নাচ-গান বা মারপিট কিছুই পারি না। সবথেকে বড়ো কথা, অভিনয়ের ‘অ’ জানি না ।

আমার মনের ভাব অনুমান করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তোমার খেলা দেখেছি। তুমি যা জানো ওটুকুই আমার সিনেমার জন্য লাগবে। আমি সিনেমা বানাই – ফিল্ম ডিরেক্টর, নাম হারাধন চ্যাটার্জি। এ শহরে সবাই আমাকে চেনে।’

সত্যচরণের কথা এ পর্যন্ত শুনে চন্দন বলল, ‘মানে সেই বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টার হারাধন চ্যাটার্জি? যাঁর সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বোম্বে আর বাংলা ফিল্মস্টাররা মুখিয়ে থাকত? যিনি অনেক বড়ো বড়ো পুরস্কার পেয়েছিলেন? ওঁর ক-টা বাংলা সিনেমা আমি দেখেছি। সেই হারাধন চ্যাটার্জি?’

সত্যচরণ বললেন, ‘ঠিক ধরেছ, সেই হারাধন চ্যাটার্জি। আমি অবশ্য সে সময় তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম কারণ আমি সিনেমা দেখতাম না ।’

চন্দনের প্রশ্নের জবাব দিয়ে সত্যচরণ আবার শুরু করলেন তাঁর কথা, ‘ভদ্রলোক বললেন, ‘শোনো, সিনেমাতে একটা দৃশ্য আছে যেখানে রাজাকে খেলা দেখাবে এক জাদুকর। সে দৃশ্যে তোমাকে কয়েকটা জাদুর খেলা দেখাতে হবে। তুমি কীভাবে কী করবে তা আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। মাত্র দু-তিন দিনের কাজ। তার জন্য তুমি দুশো টাকা পারিশ্রমিকও পাবে।’

তিন দিনে দুশো টাকা রোজগার খারাপ রোজগার নয়। তবুও আমি একটু ইতস্তত করতে লাগলাম হঠাৎ এই প্রস্তাব পেয়ে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি বললেন, ‘কাজটা করলে ভবিষ্যতে কিন্তু তোমার নিজের পেশার ক্ষেত্রেও সুবিধা হবার সম্ভবনা। আমার ছবির মাধ্যমে সারা দেশ তোমাকে দেখবে, জাদুকর হিসাবে চিনবে। তখন বড়ো বড়ো জায়গা থেকে তোমাকে খেলা দেখাবার জন্য লোকজন ডাকতে পারে। এই সিনেমায় অভিনয় করার জন্যই হয়তো একদিন এমন হবে যে তোমাকে আর রাস্তায় বসে খেলা দেখাতে হবে না। বড়ো বড়ো শহরে লোকে শো-হাউসে টিকিট কেটে তোমার খেলা দেখতে আসবে।’

বিখ্যাত আর বড়োলোক হতে কে না চায়! হারাধন চ্যাটার্জির একথা শোনার পর আমি আর ‘না’ বলতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘আমি রাজি।’

ভদ্রলোক এরপর পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই কার্ডটা রাখো। এটা আর তোমার জাদুখেলার সরঞ্জাম নিয়ে তুমি কাল সকালে নন্দনকানন স্টুডিওতে চলে যাবে। আমি গেটে বলে রেখে দেব। এই কার্ড দেখালে ওরা তোমাকে আমার কাছে পৌঁছে দেবে।’ একথা বলে তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

ততদিনে বোম্বাইতে প্রায় একমাস থাকার কারণে নন্দনকানন স্টুডিওর নাম আমি শুনেছি। বিশাল প্রাচীর ঘেরা জায়গাটা কিছুটা দূর থেকে আমি দেখেওছি। সারারাত আমার ঘুম হয়নি পরদিন ওই স্টুডিওতে যাবার উত্তেজনায়, বলা ভালো বিখ্যাত হবার আশায় ।

পরদিন বেলা ঠিক দশটাতে হাজির হলাম সেই স্টুডিওতে।

স্টুডিওর গেটের কাছে বহু মানুষের ভিড়। কেউ অভিনয় করার সুযোগের আশায় ভিড় জমিয়েছে স্টুডিওর গেটে, কেউ-বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখার জন্য। মাঝে মাঝে ফিল্মস্টারদের গাড়ি ঢুকছে স্টুডিওতে। তাদের নামে জয়ধ্বনি হচ্ছে। লোকে হামলে পড়ছে সেই গাড়ির ওপর তাদের পছন্দর নায়ক-নায়িকাকে চর্মচক্ষে এক ঝলক দেখার জন্য । স্টুডিওর বিশাল দরজা মাঝে মাঝে খুলছে, আবার বন্ধ হচ্ছে তাঁদের গাড়ি যাওয়া-আসার জন্য। মাঝে মাঝে দারোয়ানরা উন্মত্ত জনতাকে হটিয়ে দিচ্ছে তাঁদের গাড়ির জন্য পথ করে দেবার উদ্দেশ্যে। আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দেখতে লাগলাম সেসব। এক সময় কাচঢাকা বিশাল একটা গাড়ি এসে উপস্থিত হল স্টুডিওর গেটে। কিছু লোক ‘গুরু গুরু’ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল চারপাশ থেকে সেই গাড়ির ওপর। পারলে তারা যেন গাড়ির চাকার তলাতেও শুয়ে পড়তে রাজি শুনলাম সেটা নাকি বিখ্যাত অভিনেতা আকাশ দুবের গাড়ি। মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর ‘খঞ্জর’ সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছে। এখন খ্যাতির শিখরে তিনি। তাঁকে এক ঝলক চোখে দেখার জন্য মানুষ তখন পাগল। দারোয়ান আর উপস্থিত পুলিশকর্মীরা অতি কষ্টে তাঁর গাড়িটাকে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। আমিও এরপর অতি কষ্টে ভিড় ঠেলে স্টুডিওর দরজার কাছে পৌঁছলাম। দারোয়ানরা প্রথমে আমাকেও হটিয়েই দিচ্ছিল। কিন্তু হারাধন চ্যাটার্জির দেওয়া কার্ডটা দেখাবার পরই কাজ হল। আমাকে শুধু যে স্টুডিওর ভিতর ঢুকতে দেওয়া হল তা-ই নয়, একজন আমাকে নিয়ে চলল তাঁর কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। আগে কোনোদিন সিনেমা স্টুডিওতে যাইনি। সে সময়কার নন্দনকানন স্টুডিও মানে বিশাল ব্যাপার। স্টুডিওর ভিতর কোথাও রয়েছে বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাস, কোথাও আস্ত একটা রেল স্টেশনের সামনে কয়েকটা বগি সমেত স্টিম ইঞ্জিন, কোথাও পুলিশ চৌকি, ডাকঘর, ইস্কুল, হাসপাতাল, দোকানপাট। সব নকল, কিন্তু দেখলে একদম সত্যি মনে হয়। লোকজন সব ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। টিনের ছাদওয়ালা গোডাউনের মতো দেখতে বিশাল কয়েকটা বাড়িও দেখলাম। শুনলাম সেগুলোকে নাকি ‘ফ্লোর’ বলা হয়। তার ভিতর শুটিং হয়। তেমনই এক বাড়ির শুটিং ফ্লোরে নিয়ে গিয়ে হারাধন চ্যাটার্জির হাতে তুলে দেওয়া হল আমাকে। সেই শুটিং ফ্লোর দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা রাজসভা বানানো হয়েছে সেখানে। সেই রাজদরবারে সিংহাসন থেকে শুরু করে গ্রহরী, আমির-ওমরাহ, মন্ত্রী, সেনাপতির পোশাক পরা লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত ক্যামেরা, লাইট, যন্ত্রপাতি। ডিরেক্টর হারাধন চ্যাটার্জি আমাকে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘ওই সিংহাসনটা হল মহারাজা মান সিংহের সিংহাসন। ওখানে তিনি বসে থাকবেন। আজ যে দৃশ্যটা তুলব তা হল, তুমি মহারাজর দরবারে এসে প্রণাম জানাবে। একজন বাজিকরের চরিত্রেই অভিনয় করবে তুমি। সেকালে রাজদরবারে বাজিকর বা ম্যাজিশিয়ানরাও আসত রাজা-মহারাজাদের আনন্দ দেবার জন্য। তুমি মহারাজাকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানিয়ে হাত ঘুরিয়ে শূন্য থেকে একটা গোলাপফুল এনে তাঁকে উপহার দেবে। আজ তোমার কাজ শুধু এটুকুই। কাল আর পরশু তোমার ভোজবাজি খেলার আরও কয়েকটা দৃশ্যও তুলব আমি। সেগুলো প্রয়োজনে ছবির মাঝে গুঁজে দেব। তবে তোমার কাজটা আজ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মান সিংহর চরিত্রে অভিনয় করছেন বিখ্যাত অভিনেতা স্বয়ং আকাশ দুবে। সিংহাসনে বসে থাকবেন তিনি। তাঁরই হাতে ফুল দেবে তুমি। ক্যামেরার একই ফ্রেমে থাকবে তোমরা ।

এরপর ডিরেক্টরের এক সহকারী বেশ কয়েকবার আমাকে মহড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। কতটা এগোতে হবে, কোথায় কখন আসতে হবে সবকিছু। হাত ঘুরিয়ে ফুল বা কিছু আনার কৌশল আমার রপ্তই ছিল। তাতে কোনও সমস্যা নেই আমার। এরপর ফ্লোর সংলগ্ন একটা ঘরে আমার মেকআপ শুরু হল। আমার এখন যুবা বয়স, কিন্তু নকল গোঁফদাড়ি লাগিয়ে আমাকে সাজানো হল এক বৃদ্ধ জাদুকর। সে সময়কার রাজস্থানী পোশাক, পাগড়িও পড়ানো হল। তারপর আমাকে ফ্লোরের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে হাজির করা হল। আমাকে একটা গোলাপফুলও দেওয়া হল। সেটা আমি শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়েও রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লোরে এসে হাজির হলেন আকাশ দুবে। তাঁর পরনে রাজা মান সিংহের ঝলমলে পোশাক, কোমরে তরবারি, শরীরে অলংকার, মাথায় পাগড়ি। নিজের মেকআপ রুম থেকে মেকআপ করে ফ্লোরে এসেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে তাঁর অ্যাসিট্যান্ট, মেকআপম্যান সমেত বেশ কয়েকজন লোক। সেই আমার প্রথম দেখা বিখ্যাত অভিনেতা আকাশ দুবেকে। শুধু মেকআপ বা পোশাকের জন্য নয়, সত্যিই তাঁকে দেখতেও অসাধারণ। অমন সুপুরুষ মানুষ আমি কম । ডিরেক্টার দেখেছি, ছ-ফিট উচ্চতার মেদহীন চেহারা, ফর্সা। এখন তাঁর বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশ হবে। কিন্তু দেখলে মনে হবে আমার মতো কুড়ি-পঁচিশ বছরের যুবক। তখন আমার নিজের বয়স অমনই ছিল। যাই হোক একসময় শুটিং শুরু হল। এ্যাকশন বলাতে আমি এগিয়ে গেলাম সিংহাসনে বসা মান সিংহরূপী আকাশ দুবের দিকে। আমি তাঁর সামনে গিয়ে প্রথমে তাঁর উদ্দেশে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করলাম। তারপর শূন্যে হাত ঘুরিয়ে একটা গোলাপফুল এনে সেটা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তিনি তার গন্ধ শুঁকলেন। এরপরই ডিরেক্টর মাঝে বললেন, ‘কাট্।’

কী বলব মশাই, ‘এক শটেই ওকে।’

|| ৩ ||

আকাশ দুবে আমার ম্যাজিকটা দেখে বেশ খুশি হয়েছিলেন। তিনি এরপর অন্য শট্ দেবেন। সেই শট্ দেবার আগে তাঁর হাতে কিছুটা সময় ছিল। তিনি আমাকে বললেন, ‘আরও কয়েকটা ম্যাজিক দেখাও দেখি!’ আমি তাঁকে বেশ কয়েকটা ম্যাজিক দেখালাম। আরও খুশি হলেন তিনি। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার ছেলে ম্যাজিক দেখতে খুব পছন্দ করে। সময়ের অভাবে আর বিশেষত পাবলিক আমাকে দেখলেই ঘিরে ধরবে, সেই ভয়ে আমি তাকে ম্যাজিক দেখাতে নিয়ে যেতে পারি না। কাল আমি এখানে শুটিং করতে আসার সময় ছেলেকে আনব। তুমি তাকে এক ফাঁকে কিছু ম্যাজিক দেখাবে।’

হারাধন চ্যাটার্জি আমাকে বললেন, ‘কাল তোমাকে এমনিতেই আসতে হবে। কয়েকটা ম্যাজিকের দৃশ্য তুলে রাখব।’

আমি দু-জনের জবাবেই বললাম, ‘যে আজ্ঞে স্যার।’

পরদিন বেলা দশটা নাগাত আমি আবার গিয়ে হাজির হলাম স্টুডিওতে। হারাধন চ্যাটার্জির নির্দেশে আমাকে ঠিক আগের দিনের মতোই মেকআপ করানো হল। হারাধন চ্যাটার্জি আগেই আমার খেলা দেখেছিলেন। তার মধ্যে দুটো খেলা তিনি নির্বাচন করে রেখেছিলেন তাঁর ছবির জন্য। তার মধ্যে একটা হল বাঁশি বাজিয়ে একটা দড়িকে মাটিতে সাপের মতো দাঁড় করানো। অতি প্রাচীনকাল থেকেই সে খেলাটা বাজিকররা দেখিয়ে থাকে। আর অন্য খেলাটা ছিল একটা শূন্য পাত্র থেকে মোহর বার করার খেলা। কয়েকবার রিহার্সাল দেবার পর একসময় আমার খেলার ছবি তোলা হল।

হারাধন চ্যাটার্জি বললেন, ‘এ ছবিতে তোমার কাজ শেষ। এবার তুমি আকাশ দূরের জন্য অপেক্ষা করো। আজ উনি ছেলেকে সঙ্গে করে আনবেন তোমার খেলা দেখাবার জন্য। মনে আছে তো?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার, মনে আছে।’

ফ্লোরের এক কোণে বসে আমি শুটিং-এর কাজকর্ম দেখতে লাগলাম। এই শুটিং ব্যাপারটা বেশ মজার। বিশেষত লড়াইয়ের দৃশ্যগুলো। দেখলে আপনার হাসি পাবে। কিন্তু পর্দায় যখন সে দৃশ্য দেখবেন তখন তা দেখে আপনার সত্যি বলে মনে হবে, রোমাঞ্চ লাগবে। তেমনই এক তরোয়াল যুদ্ধর দৃশ্য তোলা হচ্ছিল। সেটাই আমি দেখতে লাগলাম। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের পর বাইরে শোরগোল শোনা গেল। তারপরই ফ্লোরে প্রবেশ করলেন আকাশ দুবে। নিজস্ব মেকআপম্যানের সাহায্যে মেকআপ সেরে এসেছেন তিনি। আগের দিনের মতোই সঙ্গে তাঁর নিজস্ব কিছু লোকজন আর সাত-আট বছর বয়সী ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলে। একজন বলল, ওর নাম নাকি আনন্দ। আকাশ দুবের একমাত্র সন্তান। যাই হোক আকাশ দুবে তাঁর শুটিং অভিনয়ের কাজ শুরু করলেন আরও কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে। দুঘণ্টার মতো শুটিং হল। আকাশ দুবে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে মেকআপ তুলে ফিরে এলেন। তাঁর চোখে এখন এই বিখ্যাত সানগ্লাস। খেলা দেখাবার ব্যবস্থা করা হল ফ্লোরেই একটা বেদির মতো জায়গায়। তার সামনে চেয়ার পেতে খেলা দেখতে বসলেন সপুত্র আকাশ দুবে, হারাধন চ্যাটার্জি সমেত আরও কিছু লোকজন। বাচ্চা ছেলেদের যেসব মজার খেলা ভালো লাগে, সেসব খেলা দেখাবার জন্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত হয়েই গেছিলাম আমি। পায়রা ভ্যানিশ করলাম, আকাশ সিং-এর হাত থেকে তাঁর সোনার ঘড়িটা চেয়ে নিয়ে হামান দিস্তাতে গুঁড়ো করার পর সেটা আবার হারাধন চ্যাটার্জির পকেট থেকে বার করলাম। লাইটম্যানের অ্যাসিট্যান্ট এক ছোকরার কান থেকে মুরগির ডিম বার করলাম, এছাড়া নানান খেলা। তা দেখে বাচ্চাছেলেটা মজা পেয়ে হাততালি দিতে লাগল। এমন কী আকাশ দুবে, হারাধন চ্যাটার্জিও তারিফ করতে লাগলেন।

খেলা যখন শেষ হল তখন আকাশ দুবে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আমি যেমন শিল্পী, তেমন তুমিও শিল্পী।’ সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে। তারপর তিনি কড়কড়ে একশ টাকার একটা নোট আমার হাতে গুঁজে দিয়ে কালো চশমা পরে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন।

দিন হোক বা রাত, শুটিং ফ্লোর হোক বা বাইরে, এখন তিনি মেক-আপ ছাড়া থাকলে এই কালো চশমাটা চোখে বা কপালের ওপর তুলে রাখতেন। ‘খঞ্জর’ সিনেমাটা তখন মুক্তি পেয়ে সারাদেশে রমরম করে চলছে। চশমাটাই ছিল এখন ওঁর সিগনেচার স্টাইল।

যাই হোক, আমার সব কাজ শেষ। হারাধন চ্যাটার্জি আমার কাছে এসে আমার প্রাপ্য দুশো টাকা বুঝিয়ে দিলেন।

আকাশ দুবেকে নিয়ে আমার গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু তা হল না। আমাকে টাকা দেবার পর হারাধন চ্যাটার্জি বললেন, ‘মেরিন ড্রাইভে ম্যাজিক দেখিয়ে তুমি রোজ কত আয় করো?’

আমি সত্যি কথাই বললাম। তিনি বললেন, ‘শোনো, তোমাকে আমার বেশ মনে ধরেছে। কিছুদিনের জন্য আমার একটা ছেলের প্রয়োজন। বর্ষাকাল তো শুরু হয়ে গেল। গত দুদিন ধরেই তো বিকাল হলেই বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির মধ্যে তো আর সমুদ্রের পাড়ে বসে খেলা দেখাতে পারবে না তুমি। যদি তুমি আমার কাছে কাজ করো, তবে দৈনিক তিরিশ টাকা তোমার বাঁধা। ভারী কোনও কাজ নয়, তুমি সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে, ঘুরবে। আমি যেসব টুকটাক কাজ বলব সেগুলো করে দেবে। করবে তুমি?’

অর্থাৎ হারাধন চ্যাটার্জি যা বললেন সেটা তাঁর ফাইফরমাশ খাটার কাজ। টাকার জন্যই তো পথে পথে ঘুরে বেড়াই আমি। হারাধন ঠিকই বলেছেন, বর্ষায় তো আর খোলা আকাশের নীচে খেলা দেখানো যাবে না। ডিরেক্টার সাহেবের কাছে যে-কদিন কাজ করব সে কদিন অন্তত আয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। তাছাড়া ওই দুই দিনেই আমিও কেমন যেন ‘লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড’ এই কথাগুলোর মোহে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কাজেই আমি বললাম, ‘রাজি।’

পরদিন থেকেই হারাধন চ্যাটার্জির সঙ্গে কাজে লেগে গেলাম আমি। শুধু শুটিং ফ্লোরে নয়, শ্যুটিং শেষ হবার আগে-পরেও তাঁর সঙ্গী হতে লাগলাম আমি। তিনি গাড়ি থেকে ওঠা-নামার সময় গাড়ির দরজা খোলা-বন্ধ করা, তাঁর কাগজপত্র, ব্যাগ বয়ে দেওয়া, দোকান থেকে খাবার আনা, নানান জিনিসপত্র কেনা, কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে সেটা তাঁকে জানানো, কোনও খবর সেই বিশাল স্টুডিওর অন্য কারও কাছে পৌঁছে দেওয়া- এসব ছিল আমার কাজ। আর স্টুডিওর ভিতর সর্বদা তাঁর পিছন পিছন ঘোরা, এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর ফ্ল্যাস্ক থেকে তাঁকে চা দেওয়া, পান দেওয়া, শ্যুটিং-এর সময় নানান কাজে তাকে সাহায্য করাএসব কাজ তো ছিলই। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি তাঁর বিশ্বাসী প্রিয়পাত্র হয়ে গেলাম। রাতে দেরি হলে তাঁর গাড়িই আমাকে আমার আস্তানায় নামিয়ে দিয়ে যেত। টানা শ্যুটিং চলতে লাগল। প্রায় রোজই আকাশ দুবে শ্যুটিং করার জন্য ফ্লোরে আসতেন, আর আমাকে দেখে হেসে বলতেন, ‘তুম বড়িয়া জাদুকর হো। মেরা বেটা বহুত খুশ হুয়া।’ মেক-আপ ছাড়া যখনই তিনি থাকতেন তখনই তাঁর চোখে বা মাথার ওপর তোলা থাকত এই সানগ্লাস। তিনি যখন স্টুডিওতে ঢুকতেন বা স্টুডিও থেকে বেরোতেন তখন একবার তাঁকে দেখার জন্য হামলে পড়ত উন্মত্ত জনতা। তাঁর তখন কী পপুলারিটি তা কেউ বিশ্বাস করবে না। তার গাড়ি যে-রাস্তা দিয়ে বেরোত, সেখানকার ধুলো কৌটোতে ভরে নিয়ে যেত তার ফ্যানেরা। আমিও অবাক হয়ে দেখতাম তাঁকে। এভাবেই আরও আট-দশ দিন সময় কেটে গেল।’

একটানা কথাগুলো বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ। তারপর বললেন, ‘একটু ধুমপান করা যাবে? যদিও ব্যাপারটা খারাপ, কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে পারছি না।’

চন্দন বললে, ‘হ্যাঁ, যাবে।’ উঠে গিয়ে অ্যাশট্রে এনে টেবিলে রাখল চন্দন। সত্যচরণ তাঁর পকেট হাতড়ে একটা আধ খাওয়া সিগারেট বার করে দেশলাই দিয়ে সেটা জ্বালালেন। সিগারেটটা দেখে তাঁর বর্তমান আর্থিক অবস্থা চন্দন অনুমান করতে পারল। ধীরেসুস্থে সত্যচরণ সেই আধপোড়া সিগারেটটা শেষ করলেন। তারপর সেটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘তার পরই শুরু হল, আসল ঘটনা‌ —

|| ৪ ||

সেদিন আমি নির্দিষ্ট সময় স্টুডিওতে গেছি। হারাধন চ্যাটার্জি এসে উপস্থিত হয়েছেন। টেকনিশিয়ানরাও এসে উপস্থিত হয়ে কাজে নেমে পড়েছে। সিনেমার সহ অভিনেতারাও একে এসে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। ঠিক এগারোটায় আকাশ দুবের ফ্লোরে আসার কথা। তাঁকে নিয়ে টানা বিকাল পাঁচটা পর্যান্ত শ্যুটিং হবার কথা। আকাশ দুবের একটা বড়ো গুণ ছিল তিনি খুব পাংচুয়াল, ডিরেক্টর সাহেবের কথামতো কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি মিলিয়ে তিনি ফ্লোরে আসেন। কিন্তু তিনি সেদিন নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লোরে এলেন না। প্রথমে সবাই ভাবল তিনি হয়তো কোনও জরুরি কাজে আটকে গেছেন, একসময় চলে আসবেন। কিন্তু তিনি এলেন না। দু-তিন ঘণ্টা পর অন্য ফ্লোরগুলোতে লোক পাঠানো হল আকাশ দূরে সেখানে আছেন কি না দেখার জন্য। কিন্তু তিনি সেখানেও নেই। তখন হারাধন চ্যাটার্জি টেলিফোন করলেন তাঁর বাড়িতে আর সম্ভাব্য যেসব জায়গায় তাঁকে পাওয়া যেতে পারে সে সব জায়গাতে। তখন তো আর মোবাইল ফোনের যুগ নয়, ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের যুগ। তাঁর বাড়ির ফোন বেজে গেল, আর অন্য জায়গাগুলোতে ফোন করে জানা গেল তিনি সেখানেও নেই। তাঁর জন্য বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল, কিন্তু তিনি এলেন না। কাজেই হারাধন চ্যাটার্জি বললেন ‘প্যাক-আপ।’

কবে, কখন, কোথায় শ্যুটিং হবে, শ্যুটিং-এর শিডিউলে তা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। আমি যখন হারাধন চ্যাটার্জিকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছি, তখন তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা কী হল ঠিক বুঝতে পারছি না। কাল তো সকাল আটটায় আকাশ দুবেকে নিয়ে শ্যুটিং করার কথা। তুমি ঠিক সময় ফ্লোরে চলে এসো।’

তাঁর কথা মতো পরদিন ঠিক সময় স্টুডিওর ফ্লোরে পৌঁছে গেলাম। ডিরেক্টর হারাধন চ্যাটার্জি আর টেকনিশিয়ানরা অপেক্ষা করতে লাগলেন আকাশ দুবের জন্য। ন’টা বাজল, দশটা বাজল, ক্রমে এগারোটাও বাজল, কিন্তু আকাশ দুবের পাত্তা নেই। আবার ফোনা-ফোনি, বিভিন্ন স্টুডিওতে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হল, কিন্তু কোথাও তাঁর কোনও খোঁজ মিলল না। বেলা বারোটা নাগাদ, হারাধন

চ্যাটার্জি বললেন, ‘চলো তো একবার, ওঁর বাড়ি ঘুরে আসি। দেখি ওঁর খবর মেলে কি না।’

ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আমি রওনা হলাম আকাশ দুবের বাড়ির উদ্দেশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ‘বোম্বাইয়ের রাস্তা।’ বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আকাশ দুবের পেল্লায় বাড়ির গেটের সামনে। ওই জায়গায় পর পর বেশ কিছু বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রীদের বাড়ি ছিল সে সময়। দারোয়ান লোকটা চেনে হারাধন চ্যাটার্জিকে। সে একটু ইতস্তত করে জানাল, ‘সাহেব বাড়িতেই আছেন, কিন্তু তিনি কারও সঙ্গে দেখা করছেন না।’

হারাধন চ্যাটার্জি বললেন, ‘তবু তুমি তোমার সাহেবকে একবার খবর দাও, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফটক খুলে গেল। আমরা প্রবেশ করলাম তাঁর বাড়ির কম্পাউন্ডে। বাড়ির সামনে বিশাল লন। একপাশে সার সার দামি গাড়ি গ্যারাজে দাঁড়িয়ে আছে। একজন পরিচারক গোছের লোক বাড়ির বাইরে এসে আমাদের বাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে নিল। সে কী পেল্লায় বাড়ি ! আর হিন্দি সিনেমার সুপার হিট হিরোর বাড়ির বৈভব কেমন হতে পারে তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। সে প্রসঙ্গে আর আমি যাচ্ছি না। ড্রয়িং রুম অতিক্রম করে লোকটা আমাদের নিয়ে হাজির হল একটা প্রাইভেট রুমের সামনে। ভারী পর্দা ঝুলছে ঘরের দরজায়। লোকটা বলল, ‘যান, সাহেব ভিতরে আছেন।’

আমি ঘরে ঢুকব কি না, সে ব্যাপারে ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক হারাধন চ্যাটার্জি চোখের ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য।

ভারী পর্দা আর দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলাম আমরা। যে লোকটা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে এল সে পিছন থেকে দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে দিল। মাঝারি আকৃতির একটা ঘর। তার জানলাগুলোও সব পর্দা দিয়ে ঢাকা। বাতি জ্বলছে ঘরে। ঘরের মাঝখানে কয়েকটা মহার্ঘ সোফা সেট রাখা। তারই একটাতে ড্রেসিং গাউন পরে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন আকাশ দুবে। হারাধন চ্যাটার্জি এগিয়ে গিয়ে তাঁর মুখোমুখি সোফায় বসলেন। আমি সোফার এক পাশে দাঁড়ালাম। হারাধন চ্যাটার্জি বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার? দু-দিন ফ্লোরে গেলেন না। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না আপনাকে। কেউ আপনার খবরও বলতে পারছে না।’

তাঁর কথা শুনে তিনি মুখ তুললেন। হারাধন চ্যাটার্জি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার শরীর খারাপ নাকি?’

আকাশ দুবে জবাবে বললেন, ‘আমার আর কোনোদিনই শ্যুটিং ফ্লোরে যাওয়া হবে না। জানিনা আমার ভাগ্যে কী আছে!’

কথাটা শুনে হারাধন চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন? কী হয়েছে?

একটু চুপ করে থেকে আকাশ দুবে বললেন, ‘আপনি আমার দাদার মতো। দীর্ঘদিনের পরিচয় আপনার সঙ্গে। তাই আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি। আপনার পরামর্শ চাই। কিন্তু একথা বাইরের কারও কানে গেলে আমার বড়ো ক্ষতি হবে। ছেলেটা হয়তো আর বাঁচবে না।’

একথা বলার পর তিনি যা বললেন তাতে হারাধন চ্যাটার্জি আর আমি চমকে উঠলাম। তিনি বললেন, ‘কাল সকালে স্কুল যাবার পথে ড্রাইভারের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। মা-মরা এই একটামাত্র ছেলে আমার। ওর কিছু হয়ে গেলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। ওই ‘খঞ্জর’ ছবিটাই অভিশাপ হয়ে নেমে এল আমার জীবনে।’

আকাশ দুরের কথা শুনে হারাধন চ্যাটার্জি সোফা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘সে কী! কে করল? কারা করল?’ প্রশ্ন শুনে আকাশ দুবে তার গাউনের পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে সেটা হারাধন চ্যাটার্জির হাতে দিয়ে বললেন, ‘ছেলেটাকে নিজেদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবার সময় ওরা আমার ড্রাইভারের হাতে ওই চিঠিটা গুঁজে দিয়ে গেছে। পড়ুন।’ হিন্দিতে টাইপ করা একটা চিঠি। হারাধন চ্যাটার্জি সেটা জোরে জোরেই পড়তে শুরু করলেন। সে চিঠির বাংলা তর্জমা অনেকটা এই রকম- –

‘প্রিয় অভিনেতা আকাশজী,

                     
আশা করি ভালোই আছেন। কারণ, আপনার ‘খঞ্জর’ ছবি এখন সুপার ডুপার হিট। আমিও আপনার ছবির ভক্ত। আপনার প্রতিটা ছবি আমি দেখি। ‘খঞ্জর’ ছবিটাও দেখেছি। আপনার ছবির ভক্ত বলে ইতিপূর্বে আমি আপনাকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু এবার করতে হচ্ছে। কারণ ওই ছবিটা। ছবিতে ডনের ভূমিকায় যাকে দেখানো হয়েছে, যাকে আপনি সে ছবিতে প্রচণ্ড মার মেরে পুলিশকে ধরিয়ে দেন, সেই ডনের চেহারা-পোশাকের সাথে আমার চেহারার আশ্চর্য মিল। আমার অনুমান আপনারা জেনে বুঝেই ব্যাপারটা ঘটিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকেই আমার চেনাজানা আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকেরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। যার ফলে আমি বিড়ম্বনায় পড়েছি। তাই আমার মনে হয়েছে আপনাকে আমার কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে আমাকে নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ মজা করতে না পারে।

তাই আপনার পুত্রকে আমি আমার হেফাজতে রাখছি। দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আপনি আপনার ছেলেকে মুক্ত করতে পারবেন। তবে অন্যদের অপহরণ করে আমি যেমন মুক্তিপণ দাবি করে থাকি, এ ব্যাপারটা ঠিক তেমন ব্যাপার নয়। বলা যেতে পারে এটা আমার সম্মানহানির ক্ষতিপূরণ। আগামী ১৩ তারিখ ঠিক রাত বারোটায় মেরিন ড্রাইভের শেষমাথা থেকে দূরে যে পুরানো শিবমন্দির দেখা যায় সেখানে একজন লোককে লাল সুটকেশে টাকা দিয়ে পাঠাবেন। সে একহাতে টাকা দেবে অন্য হাতে ছেলেকে ফেরত নিয়ে যাবে।

আপনার পুত্রর অপহরণের কথা যদি পুলিশ বা সংবাদমাধ্যম জানতে পারে তবে আর কোনোদিনই আর ছেলের সঙ্গে দেখা হবে না আপনার। পুলিশ আমাকে এত দিন কিছু করতে পারেনি, আজও করতে পারবে না। আপনার টেলিফোন থেকে গাড়ি বাড়ি সবকিছুর ওপর নজর রাখছি আমরা। কাজেই চালাকির চেষ্টা করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আশা করি আমার কথামতো ছেলেকে ঘরে ফেরাবার ব্যবস্থা করবেন।

ইতি —

আপনার গুণমুগ্ধ

জনার্দন।’

চিঠিটা পড়ার পর হারাধন চ্যাটার্জি বললেন, ‘জনার্দন, মানে বোম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিখ্যাত মাফিয়া ডন জনার্দন? আমি তাকে কোনোদিন চোখে না দেখলেও তার সম্পর্কে কানাঘুষো শুনে আসছি। সে নাকি বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের থেকে ভয় দেখিয়ে টাকা তোলে, অপহরণ, খুন, মাদক ব্যবসা, নানান কারবারের সঙ্গে সে যুক্ত।’

আকাশ দুবে বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই জনার্দন। নইলে এত বড়ো সাহস অন্য কারও হত না। আমিও আপনারই মতো তার নাম শুনেছি শুধু। আমি তাকে চোখে দেখিনি। তার চেহারার সঙ্গে ‘খঞ্জর’ সিনেমার ভিলেনের মিলটা নিতান্তই কাকতালীয়। আমি ব্যাপারটা যদি ঘুণাক্ষরে জানতাম তবে কিছুতেই আমি তা ঘটতে দিতাম না, কারণ আমি নির্বিবাদী মানুষ। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কারও সঙ্গে আমার ঝগড়া-ঝামেলা নেই। বাইরের কারও সঙ্গে তো নয়ই। অথচ নিজের অজান্তেই কী ভয়ংকর দুর্যোগ নেমে এসেছে আমার ওপর।’ হারাধন চ্যাটার্জি জানতে চাইলেন, ‘পুলিশকে জানিয়েছেন কিছু?’

আকাশ দুবে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘না, না, একদম না। দেখছেন না, চিঠিতে বলা আছে তা করলে ছেলেকে আর ফেরত পাব না। ওরা নিশ্চয়ই আমার ওপর নজরদারি করছে। ওদের নেটওয়ার্ক খুব বড়ো হয়। পুলিশের মধ্যেও ওদের চর ছড়ানো থাকে।’

একথা বলার পর তিনি বললেন, ‘মুক্তিপণের টাকা দেওয়াটা আমার কাছে বড়ো প্রশ্ন নয়। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিতে পারি। প্রশ্নটা হল, মুক্তিপণ দেবার পর ওরা আমার ছেলেকে ফেরত দেবে তো? নাকি প্রমাণ লোপাটের জন্য…. কথাটা আর শেষ করলেন না আকাশ দুবে। সেই ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা ভেবে কান্নায় গলা ধরে এল তাঁর। আবার মাথা নীচু করলেন তিনি।

পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল, তাতে সন্দেহ নেই। হারাধন চ্যাটার্জিও নির্বাকভাবে ভাবতে লাগলেন ব্যাপারটা নিয়ে কী করা উচিত।

এরপর হঠাৎই আকাশ দুবে মুখ তুলে অসহায়ভাবে বললেন, ‘তুমি তো জাদুকর, শুনেছি জাদুকরদের অনেক আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। তুমি পারো না আমার ছেলেকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে? তার জন্য তুমি যা চাইবে তা-ই আমি দিতে রাজি।’ তাঁর একথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, তেমনই তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চাচ্ছেন। নইলে আমার মতো সাধারণ মানুষকে তিনি এমন কাতর আবেদন জানাতেন না ।

সত্যচরণ এরপর বললেন, ‘সেদিন আমি বুঝতে পারলাম সিনেমার অভিনেতারা পর্দায় যেকোনো কাজ করতে পারলেও বাস্তব জীবনে তাঁরাও সাধারন মানুষ। তাঁরাও সময় সময় সাধারণ মানুষের মতোই অসহায়, তাঁদের কোনও অতিমানবীয় ক্ষমতা নেই। আর আমি তো তাঁর তুলনায় পিপীলিকার মতো মানুষ। আমার কী-ই বা ক্ষমতা আছে। নেহাত গুরুদেব হংসরাজের দয়াতে সামান্য কিছু জিনিস শিখেছিলাম। আর সে বিদ্যা দিয়েই পথে পথে ঘুরে ঘুরে ভোজবাজি-জাদুর খেলা দেখিয়ে দু-চার টাকা রোজগার করি। ঘটনাচক্রে আমি আকাশ দুবের মতো মানুষের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছি। তবে আকাশ দুবের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। না, টাকার লোভে নয়, এত বড়ো গুণী মানুষটার অসহায়তা যেন স্পর্শ করল আমার মনকে। আমি বললাম, ‘তেরো তারিখ, মানে হাতে এখনও দু-দিন সময় আছে। আমি একটু ভেবে দেখি আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যদি কিছু করা যায়।

আমি এরপর আকাশ দুবেকে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হতে পারে আমার। কাজেই টেলিফোনটা তুলবেন। এই তিনদিনের মধ্যে আমি যদি আপনাকে ফোন করি তবে ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় করব। রিং হলে বুঝবেন ওটা আমারই ফোন কল।’

আকাশ দুবে আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু চিঠিতে লেখা হয়েছে ওরা ফোনের ওপরও নজর রাখছে!’ তার পরই মৃদু উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর চোখমুখ। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা টেলিফোন অবশ্য আছে। সেটা আমার প্রয়াত স্ত্রী ব্যবহার করতেন। স্ত্রী মারা যাবার পর পাঁচ বছর ধরে সেটা ব্যবহার করা হয় না। তবে তার স্মৃতি হিসাবে টেলিফোন লাইনটা আমি রেখে দিয়েছি। সেটার নম্বর আমি তোমাকে দিতে পারি।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, ভালোই হয়। জনার্দনের লোকজন যদি সত্যি কোনোভাবে টেলিফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা করে থাকে তবে নিশ্চয়ই পরিচিত নম্বরের ক্ষেত্রেই করবে। এই নম্বরে আড়ি পাতবে না।’

আকাশ দুবে একটা চিরকুটে সেই টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিলেন। বিদায়বেলায় আকাশ দুবে আমার দিকে চেয়ে কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিন্তু অনেক আশা নিয়ে তোমার প্রতীক্ষাতেই থাকব।’

এরপর তাঁর সেই ঘর আর বাংলো ছেড়ে গাড়িতে চেপে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। হারাধন চ্যাটার্জি চিন্তিত মুখে বললেন, ‘শেষপর্যন্ত কী-যে হবে তা বুঝতে পারছি না। এক-একদিন ফ্লোরের ভাড়া অনেক। কাল থেকে আমি অন্যান্য দৃশ্য শ্যুট্ করব। যেসব দৃশ্যে মান সিংহ ওরফে আকাশ দুবে নেই, সেইসব দৃশ্য। তারপর ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে।’

এরপর তিনি বললেন, ‘আজ আর ফ্লোরে বা অন্য কোথাও যাব না। ঘটনাটা শুনে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তোমার আপাততঃ ছুটি। কোথায় তোমাকে নামাতে হবে বলো।’ আমি বললাম, ‘আমাকে তবে মেরিন ড্রাইভে নামিয়ে দিন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই হারাধন চ্যাটার্জি আমাকে মেরিন ড্রাইভে নামিয়ে দিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন, পরদিন সকাল দশটায় আমি যেন শ্যুটিং ফ্লোরে গিয়ে হাজির হই ।

|| ৫ ||

হারাধন চ্যাটার্জির গাড়ি চলে যাবার পর আমি মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো লোহার কাঠামোর গায়ে বিশালাকৃতির সব সিনেমার হোর্ডিং লাগানো আছে। তেমনই একটা হোর্ডিং-এ চোখ আটকে গেল আমার । ‘খঞ্জর’ সিনেমার হোর্ডিং। সেই হোর্ডিং-এ যেমন নায়ক আকাশ দুবের এই বিখ্যাত কালো চশমাপরা ছবি আছে, তেমন ভিলেনের ছবিও আছে। হাতে স্টেনগান ধরা কালো শার্ট-প্যান্ট পরা মোটাসোটা চেহারার মাফিয়া ডন। মাথায় টাক, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সেই ছবি দেখে আমি বুঝতে পারলাম ওই অভিনেতার চেহারা, মেকআপ-এসব নিয়েই যত গণ্ডগোলের উৎপত্তি এবং সত্যিকারের ডন জর্নাদনকেও এমনই দেখতে। ছবিটা মাথার মধ্যে গেঁথে নিলাম আমি। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। বেলা দুটো বাজে। তার ওপর আকাশ মেঘলা। ক-দিন ধরে রোজ বিকালে – সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামছে। আকাশ ধীরে ধীরে বৃষ্টি নামাবার প্রস্তুতি তাই ট্যুরিস্টদের ভিড় বা মেরিন ড্রাইভে যারা বেড়াতে আসে সে ভিড় নেই। শুধু রাস্তা দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমি মেরিন ড্রাইভের একদম শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেলাম। এ দিকটা আমি আগে আসিনি। আর তার পরই আমার চোখে পড়ল বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রর ধারে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা একটা মন্দির। সেই মন্দির, জনার্দনের চিঠিতে যার উল্লেখ আছে। কাছেই একটা প্লাষ্টিকের ছাউনি দেওয়া ডাবওয়ালার দোকান দেখে সেই ছাউনির নীচে গিয়ে আমি বসলাম। একলাই বসে ছিল বুড়ো ডাববিক্রেতা। আমি তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম কাজের খোঁজে সদ্য বোম্বে এসেছি আর মেরিন ড্রাইভ দেখতে দেখতে এ জায়গাটায় চলে এসেছি। আমি তার কাছ থেকে একটা ডাবও কিনলাম। বৃদ্ধ ডাবওয়ালার এই নির্জন দুপুরে কথা বলার লোক ছিল না, খদ্দেরও ছিল না। ডাব কেনাতে কিছুটা খুশি হয়ে যেচে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। কোথায় কোথায় মজুরের কাজ পাবার সম্ভাবনা সে সম্পর্কে সে জানাতে লাগল আমায়। একসময় আমি দূরের মন্দিরটার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ‘ওটা কীসের মন্দির। ওখানে গেলে কি পুজোর প্রসাদ মিলতে পারে?’ বৃদ্ধ ডাবওয়ালা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওখানে তোমার না যাওয়াই ভালো। নতুন লোক, ওখানে গিয়ে বিপদে পড়তে , পারো।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘বিপদে পড়তে পারি কেন? দেখে পুরানো মন্দির মনে হচ্ছে। কেউ ওখানে থাকে না নাকি? সাপ-খোপ আছে?’

বৃদ্ধ ডাবওয়ালা চারপাশে তাকিয়ে সাবধান হয়ে বললে, ‘থাকে, তবে তারা সাপের থেকেও ভয়ংকর সব লোকজন। জনার্দনের লোকজন সব। সেও মাঝে মাঝে রাতের বেলা ওই মন্দিরে যায়।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জনার্দন কে?’

বৃদ্ধ ডাবওয়ালা বলল, ‘তুমি এখানে নতুন এসেছ, তাই জনার্দনের নাম শোনোনি। কদিন থাকলেই ওর নাম জেনে যাবে। জনার্দন হল বড়ো মস্তান ডন। সে ভয় দেখিয়ে টাকা তোলে, খুনজখম সব করে। বোম্বের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী, ফিল্মস্টাররাও ওর নামে কাঁপে। তুমি এ শহরে নতুন লোক । তোমাকে দেখে ভালোমানুষ মনে হচ্ছে, তাই তোমাকে সাবধান করে দিলাম। তবে আমার মুখ থেকে ও কথা শুনেছ বলে আমাকে বিপদে ফেলো না।’একথা বলে বুড়োটা চুপ করে গেল। হয়তো সে মনে মনে ভাবতে লাগল ঝোঁকের মাথায় আমাকে কথাগুলো বলে ঠিক করল কি না। আর আমিও আর কোনও কথা না বলে চেয়ে রইলাম সামনের সমুদ্রর দিকে। ডাবওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আকাশ কালো হয়ে এসেছিল, এর পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। আমি প্লাস্টিকের ছাউনির তলায় বসে ভাবতে লাগলাম, বাচ্চাটাকে কি ওই মন্দিরের ভিতরের লুকিয়ে রাখা আছে? না কি তাকে অন্য কোথাও রেখেছে? কিন্তু সেটা কীভাবে জানা যাবে? সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আর বাচ্চাটাকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা-ই ভাবতে লাগলাম আমি। সময় এগিয়ে চলল। এক সময় খেয়াল করলাম ডাবওয়ালা তার ব্যবসা এদিনের মতো বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। পলিথিনের তাবুর নীচে রাখা তার ঠেলাগাড়িতে ডাবগুলোকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ বৃষ্টি আসলেই এ জায়গা ছেড়ে রওনা হয়ে যাবে। আর বেচাকেনা হবার সম্ভাবনা নেই, তা সে বুঝতে পেরেছে। আমিও বৃষ্টি কমে আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। আরও আধঘন্টা পর বৃষ্টি কমতে শুরু করল। ততক্ষণে বিকাল হয়ে গেছে। একটা প্লাস্টিকের টুলের ওপর আমি বসেছিলাম। সেটা ছেড়ে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক এখনই আমার চোখে পড়ল একটা দৃশ্য। সমুদ্রের ঢেউ থেকে রাস্তাকে রক্ষা করার জন্য বেশ কিছু বড়ো বড়ো বোল্ডার বা পাথরের টুকরো পড়ে আছে ডাবওয়ালার ছাউনি থেকে কয়েক হাত দূরেই। তেমনই একটা পাথরের ওপর একটা জলঢোঁড়ার মতো দেখতে একটা সাপ আর একটা ব্যাঙ। মুখোমুখি তারা। সাপটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ব্যাঙটার দিকে। আমি দেখতে লাগলাম দৃশ্যটা। ব্যাঙটা কিন্তু পালাচ্ছে না। সাপটা এগোচ্ছে তার দিকে। এক সময় সাপটা এসে খপ করে ধরে ফেলল ব্যাঙটাকে। তারপর তাকে গিলতে শুরু করল। কিন্তু ব্যাঙটা সাপটাকে দেখে পালাল না কেন? আর এরপরই শুরু হংসরাজের মুখ থেকে শোনা একটা পুরানো কথা মনে পড়ল আমার। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটাকে মুক্ত করার ব্যাপারে একটা কৌশলের কথা মাথায় এল আমার। কিন্তু এর পরক্ষণেই আমার মনে হল কাজটা কি আমি করতে পারব? আমার বাজিকর জীবনের গুরু, বহু বিদ্যার অধিকারী হংসরাজ সে বিদ্যা আমায় শিখিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বহুদিন আমি তার চর্চা করিনি। আমি স্মরণ করতে লাগলাম আমার গুরুদেবকে।

একসময় ডাবওয়ালার কথাতে আমার সম্বিত ফিরল, সে বলল, ‘আমার ডাবের দাম চার আনা দাও। আমি এখন ফিরব।’

আমি খেয়াল করে দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি ফিরে দাঁড়ালাম ডাবওয়ালার দিকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে পয়সা পাবার অপেক্ষায়। আমিও তার দিকে তাকিয়ে পকেট হাতড়ে একটা আধুলি অর্থাৎ পঞ্চাশ পয়সা বার করে তার হাতে দিলাম। সে পয়সাটা হাতে নিয়ে দেখে তার হাতের ছোটো কাপড়ের থলির মধ্যে রাখল। তারপর সেই থলে হাতড়ে একটা কয়েন বার করে আমার হাতে দিল। সেটা হাতে নিয়ে দেখে আমি বললাম, ‘এ কী! তুমি তো আমাকে চার আনা ফেরত দেবে, কিন্তু এক টাকা দিচ্ছ কেন?’ সে আমার হাতের পয়সাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে ঠিকই তো। এটাতো এক টাকা! ভাগ্যিস তুমি বললে।’

আমি বললাম, ‘তুমি গরিব মানুষ। আর আমিও। তোমাকে আমি ঠকাব কেন?’

বৃদ্ধ ডাবওয়ালা হেসে আমার হাত থেকে কয়েনটা নিয়ে দশ পয়সা পাঁচ পয়সা মিলিয়ে পঁচিশ পয়সা আমাকে ফেরত দিল। আর আমিও সেটা নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

ফেরার পথে আমি ভাবতে লাগলাম, কাজটা সত্যি কি আমি পারব? গুরু হংসরাজের শেখানো বিদ্যা দিয়ে শেষপর্যন্ত কি আমি বাজিমাত করতে পারব? একসময় আমার মন বলল, ‘পারবে। কিন্তু তার জন্য মনঃসংযোগ করতে হবে।’

কিন্তু আমি যেখানে অনেক লোকের মাঝে চৌকি ভাড়া নিয়ে থাকি সেখানে লোকজনের মাঝে তো তা করা সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ল হারাধন চ্যাটার্জির কথা। জুহু বিচের কাছে একটা বহুতলে তাঁর একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট আছে। তাঁর বইপত্র থাকে সেখানে। হারাধন চ্যাটার্জির সাথে আমি সেখানে একদিন গেছি। আমার মনঃসংযোগের জন্য সেই ফ্ল্যাটই আদর্শ। আমি একটা পাবলিক বুথ থেকে তাঁকে ফোন করে বললাম, অন্তত তিনটে রাতের জন্য আমি সেখানে থাকতে চাই। হারাধন সম্ভবত কিছু অনুমান করেছিলেন, তিনি বললেন, ‘আমি কেয়ার টেকারকে বলে দিচ্ছি, তুমি চলে যাও।’

তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর আমি প্রথমে আমার থাকার জায়গায় গেলাম। চৌকিওয়ালাকে বললাম কয়েকদিনের জন্য বাইরে খেলা দেখাতে যাব। তারপর ফিরে আসব। এরপর সে জায়গা ছেড়ে, আমার ঝোলা নিয়ে সেই সন্ধ্যাতেই আমি গিয়ে উঠলাম জুহু বিচের পাশে। দ্বিতীয় দফায় আবার বৃষ্টি শুরু হল। অঝোরে বৃষ্টি, তার সাথে সমুদ্রর দিকে থেকে ভেসে আসা বাতাসের ঝাপটা। দশতলার নির্জন ফ্ল্যাটে দরজা-জানলা বন্ধ করে আমি টেবিলের ওপর একটা বড়ো মোমবাতি জ্বালালাম। তারপর এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে মনঃসংযোগের চেষ্টা করতে লাগলাম। বেশ বড়ো মোমবাতি। তার আলো যখন ফুরাল তখন মাঝরাত। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি চেয়ে রইলাম সোজা মোমবাতির দিকে। বিছানায় শুয়ে ঘুমাবার আগে আমি ঠিক করলাম পরদিন আমি একবার ছদ্মবেশে ওই মন্দিরে হানা দেব।

পরদিন নির্দিষ্ট সময় আমি শ্যুটিং ফ্লোরে গিয়ে হাজির হলাম। হারাধন চ্যাটার্জিও উপস্থিত হলেন। তিনি টেকনিশিয়ান আর অন্য আর্টিস্টদের বললেন, ‘আকাশ দুবে জরুরি প্রয়োজনে ক-দিনের জন্য বোম্বের বাইরে গেছেন। ক-দিন তাঁর শ্যুটিং হবে না। অন্য দৃশ্যের ছবি তোলা হবে, এদিন তোলা হবে মান সিংহর দূতের সাথে মহারানা প্রতাপের সেনাপতির কথোপকথনের দৃশ্য। সেই মতো টেকনিশিয়ানরা আলো, ক্যামেরার প্রস্তুতির কাজ শুরু করলেন। মেকআপ আর্টিস্টরা অভিনেতাদের মেকআপের কাজ শুরু করল। ডিরেক্টার হারাধন চ্যাটার্জির কাছে একটা চামড়ায় বাঁধানো খাতা থাকত। যাতে যে দৃশ্যগুলো তিনি তুলবেন সে ব্যাপারে খুঁটিনাটি লেখা থাকত। তিনি খাতাটা আমার কাছে রেখে, কাজকর্মের তদারকি করতে লাগলেন। আমি খাতাটার পাতা ওলটাতে লাগলাম। তার মধ্যে বিভিন্ন দৃশ্য কী ভাবে তোলা হবে তা সুন্দর করে ভাগে ভাগে লেখা আছে।

একসময় শ্যুটিং-এর প্রস্তুতি শেষ হল। হারাধন চ্যাটার্জি আমাকে বললেন, ‘আজকের যে শ্যুটিং হবে সেই পাতাটা খোলো। একবার চোখ বুলিয়ে নিই।’

আমি খাতার একটা নির্দিষ্ট পাতা খুলে তাঁর দিকে খাতাটা এগিয়ে দিলাম। পাতাটা দেখে স্পষ্টই বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি বললেন, ‘আরে এটা তো মান সিংহর গুপ্তচরের সাথে প্রতাপ সিংহর তলোয়ার লড়াইয়ের দৃশ্য। এটা অনেক পরে শুট করব।’

আমি বললাম, ‘আজ আপনি এই দৃশ্যটাই তুলুন।’

কথাটা শুনে তিনি তাকালেন আমার দিকে। এত বড়ো একজন ডিরেক্টরকে আমার মতো একজন সামান্য লোক উপদেশ দিচ্ছে তিনি কোন দৃশ্য তুলবেন! আমার ধৃষ্টতা দেখে আমার প্রতি ভর্ৎসনার দৃষ্টি ফুটে উঠল তাঁর চোখে। আমিও চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে এল। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি যখন বলছ তখন না-হয় এই দৃশ্যই তুলি।’

নতুন দৃশ্য তোলার জন্য আবার নতুন প্রস্তুতি হল। সেটের সবাই বেশ অবাক হল আগের দৃশ্যের শ্যুটিং শেষমুহূর্তে বাতিল হওয়াতে। যাই হোক তলোয়ার লড়াইয়ের দৃশ্যটা ঠিক মতোই তোলা হল। হারাধন চ্যাটার্জি সেদিনের মতো ‘প্যাক আপ’ ঘোষণা করলেন। আমি তারপর তাঁকে বললাম ‘বিশেষ’ কাজের জন্য আমি জায়গায় যাব। তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। হয়তো তিনি অনুমান করতে পারছিলেন যে আমি গোপন ব্যাপারটা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছি।

ফিল্ম স্টুডিওতে কিছুদিন যাওয়া-আসার সুবাদে আমার বেশ কিছু লোকজনের সাথে পরিচয় গড়ে উঠেছিল। আমি তেমনই একজন মেকআপম্যানকে বললাম আমাকে সন্ন্যাসীর বেশে সাজিয়ে দিতে। তিনি আমাকে আলখাল্লা, নকল চুল, দাড়ি লাগিয়ে এক মাঝবয়সী সন্ন্যাসীর বেশে সাজিয়ে দিলেন। আমার পরনের আলখাল্লাটা একটু মলিন। যাতে দেখে মনে হয় আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই। একটা কমন্ডুলুও তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। একেবারে পাকা মেকআপ ম্যানের কাজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই যেন নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি স্টুডিও ছেড়ে বেরিয়ে রওনা হলাম মেরিন ড্রাইভের দিকে। একটা অটোরিক্সা নিয়েছিলাম আমি। সেটা থেকে মেরিন ড্রাইভের শেষমাথার একটু আগে নেমে পায়ে হেঁটে এগোলাম আমি। আগের দিনের সেই ডাবওয়ালা বুড়ো এদিনও একই জায়গায় বসে। আমি তার সামনে গিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুললাম। সে আমাকে প্রণাম জানিয়ে একটা ‘দু পয়সা’ দিল। আমি বুঝতে পারলাম সে আমাকে চিনতে পারেনি। অর্থাৎ আমাকে সত্যিই সন্ন্যাসী মনে হচ্ছে। এরপর আমি বালুতটে নেমে সোজা এগোলাম মন্দিরের দিকে। বেলা দুটো বাজে। আকাশ আজ এখনও মেঘলা হয়নি। চড়া রোদ। চারপাশে কেউ নেই। মন্দিরে ঢোকার মুখেই একটা বড়ো গাছ আছে। তার নীচে বাঁধানো বেদি। আমি দূর থেকেই দেখতে পেলাম সেখানে দু-জন লোক বসে আছে। আমাকে সেদিকে যেতে দেখেই তারা উঠে দাঁড়াল। আমিও গুরুদেবের নাম স্মরণ করে এগিয়ে চললাম। আমি হাজির হলাম মন্দিরের সামনে। দেখেই বোঝা যায় মন্দিরটা কয়েক-শ বছরের প্রাচীন। তার একটা অংশ ঝুলে পড়েছে। মন্দিরের ভিতরের চত্বরেও কয়েকজন লোক বসে আছে। তাদের চেহারাও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনের মতো শক্ত ও রুক্ষ। মন্দিরের বাইরে থাকা লোক দুজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমিও তাকালাম। তাদের কোমরের কাছে জামার অংশটা যে খোলা, সেটা আমার নজর এড়ালো না। আমি বুঝতে পাড়লাম লোকটার কোমরে পিস্তল ধরনের কোনও অস্ত্র গোঁজা আছে। আমি হাঁক দিলাম, ‘শিব শম্ভু!

কোমরে অস্ত্রগোঁজা লোকটা বলল, ‘ইধার কেয়া মাঙতা? এখানে কী চাও?’

আমি জবাব দিলাম, ‘মন্দিরের ভিতর যাব। মহাদেব দর্শন করব। তাঁর প্রসাদ খাব।’

লোক দু-জনের একজন বলল, ‘মন্দিরের ভিতর ঢোকা যাবে না।’

‘কেন?’ আমি জানতে চাইলাম ।

সে জবাব দিল, ‘মন্দিরের ভিতর শিবলিঙ্গ নেই। একবার সমুদ্রের ঝড়ে মন্দির ডুবে গেছিল। তারপর অন্য মন্দিরে শিবজীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে পুজোআচ্ছা কিছুই হয় না । এখন আমরা এখানে থাকি।

আমি জানতে চাইলাম ‘তোমরা কারা?’

কোমড়ে অস্ত্রধারী লোকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘তা জেনে তোমার দরকার কী? ভাগো ইধারসে।

আমি মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, ‘রোদের মধ্যে এতটা পথ এলাম। দশ মিনিট জিরিয়ে তারপর যাচ্ছি।’ লোকটা বলল, ‘ঠিক দশ মিনিটই বসতে দেব।’

আমি গিয়ে বসলাম গাছের নীচের বেদিতে। লোক দুটো মন্দিরের প্রবেশপথ আটকে আমাকে দেখতে লাগল। সম্ভবত তারা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল আমি সত্যিই সাধু না কি ছদ্মবেশী কেউ।’

মিনিট পাঁচেক পর আমি বলে উঠলাম, ‘আমার বড়ো খিদে পেয়েছে।’

লোক দু-জনের একজন বলল, ‘তোমাকে বললাম না, এখানে প্রসাদ মেলে না? সে আশায় বসে থেকো না।’

আমি বললাম, ‘তবে আমি শিবজীকেই আমাকে প্ৰসাদ দেবার জন্য বলি। তিনিই আমার খাবার ব্যবস্থা করবেন।’

আমার কথা শুনে লোক দু-জনের একজন অপর জনকে বলল, ‘এ লোকটা পাগল মনে হচ্ছে। বলছে শিবজী ওঁর খাবার ব্যবস্থা করবেন!’

আমি এরপর আর কোনও কথা না বলে প্রথমে ধ্যানস্থ হয়ে বসলাম। তারপর চোখ বন্ধ করে খানিক বিড়বিড় করে আমার হাতটা শূন্যে ঘোরালাম। আর তারপরই আমার হাতে শূন্য থেকে চলে এল শিবজীর প্রসাদ একটা পাকা বেল।

সেটা ভেঙে আমি খেতে শুরু করলাম। দেখলাম লোক দুজন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে।

আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একজন একটু ইতস্তত করে শুনতে চাইল, ‘বেলটা কী ভাবে হাতে এল তোমার?’

আমি বললাম, ‘শিবজীর কাছে চাইলাম, তিনি দিলেন।

দেখছ তো, আমার কাছে এই কমণ্ডলু ছাড়া আর কিছু নেই।’ লোক দু-জন এবার আমার সামনে এগিয়ে এল, তারপর তারা বলল, ‘তুমি আর আবার চাইলে আবার শিবজী তোমাকে প্রসাদ দেবেন? দেখি তো কেমন দেয়!’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাদের জন্য তাঁর থেকে প্রসাদ প্রার্থনা করছি।’

কমন্ডুলুর জলে হাতমুখ ধুয়ে আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য ধ্যানস্থ হয়ে আমি মন্ত্রপাঠ শুরু করলাম। তারপর শূন্যে হাত ঘুরিয়ে এক থোকা আঙুর শূন্য থেকে হাজির করলাম। যারা বাজিকর বা ভালো ম্যাজিশিয়ান, তাদের কাছে এ খেলা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু লোক দুটোর চোখ যেন তা দেখে ছানাবড়া হয়ে গেল। এতক্ষণ তাদের আমার পরিচিতি সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও এ ঘটনা দেখে এবার তাদের ধারণা হল যে আমি সত্যিই একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সন্ন্যাসী। আমি তাদের হাতে আঙুরগুলো ভাগ করে দিলাম। তারা সেগুলো মাথায় ঠেকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথায় থাকেন সাধুজী?’

আমি বললাম, ‘আমি আসছি সেই হরিদ্বার-কেদারনাথ থেকে, যেখানে শিবজীর নিবাস। এখানে কিছুদিন থাকব, তারপর ফিরে যাব।’

একথা বলে আমি তাদের দু-জনের উদ্দেশে বললাম, ‘আয়, আমার সামনে বস। কিছু কথা বলি তোদের সঙ্গে। কয়েক মুহূর্ত তারা তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর গাছের নীচের বেদিতে আমার মুখোমুখি বসল। একজন বলল, ‘আপনি আমার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারবেন বাবা?’

আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অপরাধজগতের ব্যক্তিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ অত্যন্ত প্রবল হয়। অপকার্যে নিমজ্জিত হবার কারণে তাদের মনে সবসময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ভয় কাজ করে। এরা মনে করে এই বুঝি আমাদের পুলিশ ধরল, কিংবা আমি হয়তো মারা পড়লাম! এই লোক দুটোর মধ্যেও সেই ভাবনা ছিল। আর সেটাকেই অবলম্বন করে আমি তাদের দু-জনকে ভবিষ্যৎবাণী করলাম। বললাম, ‘একদিন তোমরা এই বোম্বে শহর শাসন করবে। অনেক টাকাপয়সা হবে তোমাদের।’ কী বলব মশাই, পরবর্তীকালে যখনই ব্যাপারটা আমার মনে পড়ে তখনই আমার হাসি পায়। এরপর সেই দুর্বৃত্ত দু-জন আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আমার কমণ্ডলুতে পাঁচটা টাকা প্রণামীও দিল। তাদের আশীর্বাদ জানিয়ে আমি ফেবার পথ ধরলাম। যাতে আমাকে কেউ অনুসরণ করলেও আমার প্রকৃত পরিচয় ধরতে না পারে এ জন্য আমি তারপর এগিয়ে গিয়ে মেরিন ড্রাইভের কয়েকজন দোকানদারের কাছে ভিক্ষাও নিলাম। বিকালের কিছু পরে অন্য দিনের মতোই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল, আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে আমি প্রথমে স্টুডিও গেলাম পোষাক বদলাতে। আমার মন ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, হ্যাঁ, আমি আকাশ দুবেকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে পারব। সেখান থেকে ফ্ল্যাটে ফিরে আমি প্রথমে ঠিক সন্ধ্য ছ’টায় ফোন করলাম আকাশ দুবেকে। ফোন ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় ‘হ্যালো’ বললেন তিনি।

আমি তাঁকে বললাম, আমি সম্ভবত তাঁর ছেলেকে মুক্ত করে আনতে পারব। তবে আমার ওপর ভরসা করে লাল সুটকেসে আমাকে টাকাটা দিতে হবে। আমি পরদিন সন্ধ্যাবেলা টাকাটা নিতে যাব। তিনি সম্মত হলেন আমার প্রস্তাবে। এরপর আমি হারাধন চ্যাটার্জিকে টেলিফোন করে জানিয়ে দিলাম ‘বিশেষ’ কারণে আমি পরদিন স্টুডিওতে যাব ঠিকই, কিন্তু তাঁর সঠিক ফ্লোরে যাব না।

আমার কথা শুনে আমি কী কাজে ব্যাস্ত আছি অনুমান করে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে মনে রেখো তোমার ওপরেই হয়তো আজ আমার ও সিনেমার ভবিষ্যত নির্ভর করছে।’

এরপর খাওয়া সেরে আবারও আগের দিনের মতো অন্ধকার ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার শিখার দিকে তাকিয়ে মনঃসংযোগ করতে বসলাম আমি। কারণ আমাকে পরদিন চূড়ান্ত পরীক্ষায় নামতে হবে। গুরুর শিক্ষাকে সফলভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সেটাই হবে আমার তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। কারণ, আমাকে বিদায় দেবার সময় হংসরাজ বলেছিলেন, ‘আমাকে এখন কোনও গুরুদক্ষিণা দিতে হবে না। ভবিষ্যতে তুই কোনও ভালো কাজ করলে বুঝবি সেটাই আমার প্রতি তোর গুরুদক্ষিণা।’

পরদিন সকালবেলা আমি স্টুডিওতে গিয়ে হাজির হলাম। তবে ফ্লোরে নয়, আমার পরিচিত অন্য লোকজনের কাছে। বৃষ্টি শেষরাতে থামলেও সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আমি একটা অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। ঠিক তখনই বৃষ্টি নামল। আমি মনে মনে ভাবলাম ভালোই হল। কেউ যদি আমাকে অনুসরণ করতে চায় তবে বৃষ্টি তার পক্ষে বাধার কারণ হবে। এরপর কয়েকটা জায়গায় ঘুরে কিছু কাজ সেরে আমি আবার ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম।’ দীর্ঘক্ষণ কথা বলে সত্যচরণ থামলেন। – তারপর বললেন, ‘কিছু যদি মনে না করেন তবে আরেক কাপ চা হবে? গলাটা শুকিয়ে এসেছে। ঘটনার শেষটা তবে একটু আরাম করে বলতে পারি।’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমিও সেইকথাই ভাবছিলাম।’

চন্দন উঠে গিয়ে দু-কাপ চা করে আনল। বেশ আয়েশ করে চা পান করে জাদুকর সত্যচরণ তার কাহিনীর শেষ অংশ বলতে শুরু করলেন —

|| ৬ ||

বৃষ্টির বিরাম নেই। সাড়ে ছটা নাগাদ আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আবারও একটা অটোরিক্সো নিলাম। তারপর রওনা হলাম আকাশ দুবের বাড়ির দিকে। আকাশ দুবে গেটে বলে রেখেছিলেন আমি তাঁর বাড়ি যাব। অটোরিক্সা নিয়েই আমি প্রবেশ করলাম তাঁর বাংলোর ভিতর। একজন লোক আমাকে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল আকাশ দুবের সেই প্রাইভেট চেম্বারে। দেখি আকাশ দুবে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করছেন। তাঁর টেবিলের পাশে একটা ঢাউস লাল সুটকেস রাখা। আমাকে দেখেই তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তুমি না এলে আমি রাতে একাই বেড়িয়ে পরতাম আমি। ওই সুটকেশে সব টাকা রাখা আছে।’

আমি তাঁকে বললাম, ‘এতগুলো টাকা বিশ্বাস করে যে আমার হাতে তুলি দিচ্ছেন সেটা অনেক বড়ো ব্যাপার । আমি আপনার বিশ্বাস রাখার চেষ্টা করব।’

তিনি আমার কাছে এসে আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘এ টাকা আমার কাছে কিছু‍ই না। আমি শুধু আমার ছেলেকে কাল সকালের মধ্যে ফিরে পেতে চাই। নইলে হয়তো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।’

আমি তাঁর হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বললাম, ‘আপনি এত উতলা হবেন না। সত্যি যদি আমি আমার গুরু হংসরাজের শিষ্য হয়ে থাকি তবে তাঁর শিক্ষা মিথ্যা হবে না।’

এরপর আমি তাঁকে বললাম, ‘মেরিন ড্রাইভে যেখানে বড়ো বড়ো হোটেল-রেস্তোরা আছে যেখানে সারারাত লোক সমাগম থাকে। সেখানে ড্রাইভার রাত বারোটার সময় তার সাদা রঙের গাড়িটা নিয়ে যেন পৌঁছে যায়। আমার ফেরার জন্য যেন সে অপেক্ষা করে।’

এরপর সুটকেসটা নিয়ে অটোতে বান্দ্রার বাংলোর দিকে ফ্ল্যাটে ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেলাম আমি।’ পর্যন্ত বলে একটু থামলেন সত্যচরণ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তাঁর।

চন্দন বলল, ‘কী হল?’

সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘ব্যাপারটা একবার ভাবুন। আকাশ দুবের বান্দ্রার বাংলো ছেড়ে বেড়িয়ে আমি যদি কোনও ট্রেনে চেপে বসতাম তবে কী হত? পুলিশ বা আকাশ দুবে-কেউ-ই আর আমার খোঁজ পেত বলে মনে হয় না। বাকি জীবনটা আমি দূরে কোথাও গিয়ে আয়েশে কাটাতে পারতাম।’

চন্দন বলল, ‘তা বটে। তখন তো প্রযুক্তি ইত্যাদি এখনকার মতো উন্নত হয়নি। এত বড়ো দেশে আপনাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল।’

সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, তা করলে মহাপাপ হত। একটা শিশুর জীবন চলে যেত। সবথেকে বড়ো কথা, আমার গুরুর সব শিক্ষা মিথ্যা হত। সেদিন ওপথে যাইনি বলে আজ হয়তো কষ্টে দিন কাটে আমার। কিন্তু টাকাপয়সা না থাকলেও আমার মনে শান্তি আছে, নিজের প্রতি একটা গর্ববোধ আছে।’

একথা বলে তিনি তাঁর কাহিনীর শেষ অংশে প্রবেশ করলেন — ‘টাকাভরতি সুটকেশ নিয়ে আমি জুহুর ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। আর অটোওয়ালাকে আগাম কিছু পয়সা দিয়ে বললাম, সে যেন রাত সাড়ে এগারোটার সময় এসে আমাকে মেরিন ড্রাইভে পৌঁছে দেয়। ফ্ল্যাটে ঢুকে কিছু কাজ সারলাম আমি। তারপর আবার মোমবাতি জ্বালিয়ে শেষবারের মতো মনঃসংযোগ করতে বসলাম। রাত ঠিক সাড়ে এগারোটায় গুরু হংসরাজের নাম নিয়ে সেই লাল সুটকেশ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। ছদ্মবেশ বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয়, তবে আকাশ দুবের কর্মচারীরা যে পোশাক পড়ে সেই পোশাকে। অর্থাৎ সাদা-জামা, নীল প্যান্ট, কালো জুতো। যাতে যেখানে যাচ্ছি সেখানে লোকেরা আমাকে আকাশ দুবের কর্মচারী বলেই মনে করে। অটোরিক্সা চেপে জুহু থেকে আমি রওনা হলাম মেরিন ড্রাইভের দিকে। শুনশান রাস্তা, যানবাহন অত রাতে তেমন একটা নেই। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে চাঁদ নেই। শুধু মেরিন ড্রাইভের এক জায়গায় বড়ো বড়ো হোটেল-রেস্তোরাগুলো যেখানে আছে তার সামনে কিছু লোকজন, গাড়ি আছে। বড়ো বড়ো লোকজনদের খাবারের জন্য ওসব দামি রেস্তরাগুলো প্রায় সারারাতই খোলা থাকে। ওইখানেই আকাশ দুবেকে গাড়ি পাঠাতে বলেছি আমি। সে জায়গা অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভের শেষপ্রান্তে পৌঁছে অটো থেকে সুটকেস নিয়ে আমি নামলাম। অটোওয়ালা তার ভাড়া বুঝে নিয়ে চলে গেল। সেই ভেজা রাতে চারপাশে একটু কুকুর পর্যন্ত নেই। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া কোনও শব্দ নেই। দূরে প্রায় অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটা। সুটকেস কাঁধে করে আমি সমুদ্রের পাড় ধরে সেদিকে এগোলাম।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে গেলাম আমি। মন্দিরের ভিতরে বা বাইরে কোনও আলো দেখলাম না। তারপর অবশ্য খেয়াল করলাম একটা কালো রঙের গাড়ি নীচের বেদির একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল না করলে সেটা ঠাহরই করা যায় না। তা দেখে আমি বুঝতে পারলাম, মন্দিরের ভিতর বা কাছে-পিঠে লোক আত্মগোপন করে আছে।

মন্দিরের প্রবেশপথটা খোলা। আমি প্রবেশ করলাম ভিতরে। সামনে একটা ছোটো চত্বর মতো আছে। সেখানে আমি পা রাখতেই হঠাৎই আমার ঘাড়ে একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। তখনই একজন বলল, ‘তুই কে? কোথা থেকে আসছিস? সত্যি কথা না বললে বা কোনও চালাকির চেষ্টা করলে এখনই তোকে শেষ করে দেব।’

আমি বুঝতে পারলাম আমার ঘাড়ে যে শীতল স্পর্শ অনুভূত হচ্ছে সেটা বন্দুক বা পিস্তলের নলের। আর লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে আমি বুঝলাম গতকাল যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ও লোকটা তাদেরই একজন। আমি জবাব দিলাম, ‘আমার নাম মোতিলাল। আকাশ দুবে সাহেবের কর্মচারী। তিনি আমাকে এখানে টাকা দিতে পাঠিয়েছেন। ‘

এরপর অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল আর একটা ছায়ামূর্তি। প্রথম লোকটার কাছ থেকে সে আমার পরিচয় জানল। তাকেও চিনতে পারলাম আমি। কালকের দু-জন লোকের মধ্যে দ্বিতীয় জন। আমার পরিচয় শোনার পর সে। আমার পকেটে কয়েকটা টাকাপয়সা ছাড়া কিছুই ছিলনা যা তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। এরপর সেই মন্দিরে অন্ধকারের মধ্যে তারা কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে তার সঙ্গীকে বলল, ‘বস বলল, এ লোকটাকে তার কাছে নিয়ে যেতে।’

আমার পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে এরপর তারা আমাকে নিয়ে চলল মন্দিরের ভিতর। চারপাশে সব অন্ধকার। কয়েকটা ঘর বারান্দা অতিক্রম করে তারা একটা দরজা ঠেলে আমাকে নিয়ে একটা প্রাচীন ঘরে প্রবেশ করল। সে ঘরটা হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত। ঘরের মাঝখানে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একজন লোক, তার মাথায় টাক, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ঠিক ‘খঞ্জর’ সিনেমার পোস্টারে দেখা ভিলেনের মতো দেখতে সে। তার পরিচয় বুঝতে আমার অসুবিধা হল না। সে হল মাফিয়া ডন জনার্দন। আর তার দু-পাশে বন্ধুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার আরও দু-জন অনুচর বা দেহরক্ষী।

আমি তার কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে সুটকেসটা নামিয়ে দু-হাত জোড় করে তাকে বললাম, ‘নমস্কার। ‘

জনার্দন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আকাশ দুবে তোকে পাঠিয়েছে? পুরো টাকা এনেছিস তো?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সাহেব।’

‘তুই ‘খঞ্জর’ সিনেমা দেখেছিস?’ প্রশ্ন করল সে।

আমি উত্তর দিলাম, ‘দুবে সাহেবের কাছে অনেকদিন ধরে কাজ করলেও আমি সিনেমা দেখি না, অভ্যাস নেই।’

জনার্দন বলল, ‘ও। তবে নিজের পরিচয় আমি নিজেই দিই। আমি জনার্দন, আমার নাম শুনেছিস?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝুঁকিয়ে আবারও তাকে নমস্কার করে বললাম, ‘হ্যাঁ সাহেব, আমি আপনার নাম শুনেছি। বোম্বাইতে থাকব আর আপনার নাম শুনব না-তা হয়?’

জনার্দন যেন একটু খুশি হয়ে বলল, ‘এ ব্যাপারটা তোর মালিক ভালো করে বুঝতে পারেনি। সে হল ফিল্মের হিরো, আর আমি হলাম সত্যিকারর হিরো। তোর মালিক এখন কী করছে?’

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে হাত জোড় করা অবস্থাতেই বললাম, ‘তিনি খুব ভেঙে পড়েছেন। স্যুটিং শুধু নয়, খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ করে দিয়েছেন। সাহেব আপনি টাকাটা নিয়ে দয়া করে ছেলেটাকে দিন।’

আমার কথা শুনে প্রথমে হেসে উঠল জনার্দন।

তারপর তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘তোরা শোন সিনেমার হিরোর এখন কী অবস্থা! আর তার এই লোকটা আকাশ দুবেকে যেমন সাহেব বলে ডাকে তেমনই আমাকেও এখন মাথা ঝুঁকিয়ে সাহেব বলে সেলাম করছে।’

জনার্দনের কথা শুনে তার সঙ্গীরাও হেসে উঠল।

আমি কাতর স্বরে আবার আবেদন করলাম, ‘দয়া করে টাকাটা নিয়ে বাচ্চাটাকে দিয়ে দিন।’

জনার্দন বলল, ‘টাকা যদি ঠিক থাকে তবে বাচ্চাটাকে তোর হাতে দিয়ে দেব। আমি সিনেমার হিরোর মতো, তোর আকাশ দুবের মতো, মিথ্য ডায়লগ দিই না। আমি মুখে যা বলি কাজেও তা করি। দেখি বাচ্চাটা নিয়ে আয়।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি নিজেই টাকাটা গুনে নিন।’ এই বলে সুটকেসটা নিয়ে আমি তার দিকে এগোলাম আমার গুরুর নাম স্মরণ করে। মনে মনে আমি হংসরাজের উদ্দেশে বললাম, ‘আপনার শিক্ষা যেন ব্যর্থ না হয়। কারণ তার ওপর একজন শিশুর জীবনমরণ নির্ভর করছে।’

সুটকেসটা টেবিলের ওপর রেখে আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম জনার্দানের চোখের দিকে। কয়েক মুহূর্ত তার সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হল। তারপর সে বাক্সটা খুলল। সেখানে থরে থরে রাখা বান্ডিলগুলো গুনল। হিসাব করে সে দেখল পুরো দশ লাখ টাকাই আছে। হাসি ফুটে উঠল জনার্দনের মুখে। বাক্সটা সে এরপর বন্ধ করে একজনকে বলল, ‘যা বাচ্চাটাকে নিয়ে আয়।’ সে গেল বাচ্চাটাকে আনতে ।

জনার্দন তারপর আমার উদ্দেশে বলল, ‘আমি যা বলি তা-ই করি। তাই বাচ্চাটাকে ফেরত দিলাম। আর আজ রাতে টাকা না পেলে ওকে সমুদ্রের জলে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিতাম। তোর মালিককে বলবি এরপর আমাকে নিয়ে যেন সিনেমায় রসিকতা না করে। দু-বার হলে কিন্তু তার আর নিস্তার নেই।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার কথা বলব তাঁকে।’ এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চাটাকে নিয়ে হাজির হল জনার্দনের লোকটা। আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে বাচ্চাটার মুখ। তাকে সে জনার্দনের ইশারায় তুলে দিল আমার হাতে।

জনার্দন বলল, ‘এবার তুই যা, আর এই মন্দিরের ধারেকাছেও কোনোদিন আসবি না।

আমি তাকে আবার প্রণাম জানালাম। তার লোকরাই আমাকে মন্দিরের বাইরে বার করে দিল বাচ্চাটা সমেত। একটু এগিয়েই বাচ্চাটাকে কাঁধে করে ছুটতে শুরু করলাম আমি। এক সময় আমি পৌঁছে গেলাম সেই হোটেলগুলোর কাছে। সেখানে রাখা ছিল আকাশ দুবের গাড়ি। বাচ্চাটাকে নিয়ে সেই গাড়িতে উঠে বসলাম আমি। প্রথমে আমার ফ্ল্যাটে গেলাম। তারপর সেখান থেকে একটা বড়ো ব্যাগ নিয়ে সোজা আকাশ দুবের বাড়ি।

গাড়ি সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। আমি ব্যাগ আর বাচ্চাটাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই আকাশ দুবে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পিতাপুত্রের মিলন হল। অপূর্ব সেই দৃশ্য। বাপ-ব্যাটা বেশ কিছুক্ষণ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রইল বাকরুদ্ধ ভাবে। আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। আমি আকাশ দুবেকে বললাম, ‘ঘরে চলুন। কিছু কথা আছে।’

আমার কথায় সম্বিত ফিরল আকাশ দুরের। ছেলেকে কোলে তুলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ঘরে প্রবেশ করলেন। সে ঘরে ঢোকার পর টেবিলে ব্যাগটা রেখে আমি সেটা দেখিয়ে আকাশ দুবেকে বললাম, ‘শুধু ছেলে নয়, আপনার টাকাও ফেরত এনেছি আমি। শুধু কয়েক হাজার টাকা কাজে লেগেছে। টাকা গুলো দেখে নিন।’ আকাশ দুবে কথাটা শুনে অবাক হয়ে বলল, জনার্দন কি মুক্তিপণ নেয়নি?’

আমি বললাম, ‘নিয়েছে। পুরো গুনে দশ লাখ টাকা।’ তিনি আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তাহলে ব্যাগে টাকা কী ভাবে এল?’

আমি হেসে জবাব দিলাম, ‘ম্যাজিক। আমার গুরুর শেখানো গুপ্তবিদ্যা। এর বেশি কিছু বলা যাবে না।’

আকাশ দুবে বললেন, ‘সেকথা জানতে চাই না। ছেলেকে ফিরে পেয়েছি এটাই যা কথা। টাকা গোনার দরকার নেই।’

এ পর্যন্ত শুনে চন্দন বলল, ‘তাহলে ব্যাপারটা কী হল? টাকাগুলো যদি জনার্দন নিয়ে থাকে তাহলে ফেরত এল কী ভাবে?’

সত্যচরণ বললেন, ‘ সিনেমায় টাকার বান্ডিল দেখেছেন? তার প্রথম আর শেষ নোটটা আসল থাকে, বাকি সব একই মাপের সাদা কাগজ। ঠিক আসল টাকার বান্ডিলের মতো দেখতে। তেমনই টাকার বান্ডিল আমি জনার্দনকে দিয়েছিলাম।

চন্দন বলল, ‘কিন্তু জনার্দন তো তার টাকার বান্ডিলগুলো পরখ করে নিয়েছিল। তাহলে আমার অনুমান কি সত্যি? হিপ্নোটিজম?’

জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার গুরুদেবের শেখানো সেরা শিক্ষা। আমি প্রথমে তা প্রয়োগ করেছিলাম ডাবওয়ালার ওপর। সে কিন্তু আমাকে প্রথমে পঁচিশ পয়সার কয়েনই ফেরত দিয়েছিল। তারপর আমি তা প্রয়োগ করলাম হারাধন চ্যাটার্জির ওপর। স্ক্রিপ্ট বদল করলেন তিনি। এরপর দু-জন লোকের ওপর আমি সেটা এক সঙ্গে প্রয়োগ করলাম। জনার্দনের দুই অনুচর কথা বলতে বলতে জানিয়ে দিল, বাচ্চাটা তাদের হেফাজতেই আছে। জনার্দনের কথার দাম আছে। টাকা পেলে ছেলেটাকে সে ফিরিয়ে দেবে, নইলে মেরে ফেলবে। তারপর সেই রাতে জনার্দনের ডেরায় ঢুকে সবাইকে হিপ্নোটাইজ করলাম আমি। একবার সেই ঘরে সবার সাথে কয়েক মুহুর্ত দৃষ্টি বিনিময় হতেই তারা হল। বান্ডিলের সাদা টুকরোগুলোকেও তারা টাকা বলে ভাবল। বান্ডিলের ওপরের নোটেই শুধু সত্যি টাকা ছিল। অভিনয় করতে গেলে কী পরিমাণ শিক্ষা আর পরিশ্রম লাগে তা ততদিনে আমি দেখেছি। আমি চাইনি আকাশ দুবের পরিশ্রমের টাকা দুর্বৃত্তদের কাছে থাক। সত্যচরণ এরপর কী বলল শুনুন —

পরিচারকদের দিয়ে ছেলেকে এরপর বাড়ির ভিতর নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেবার পর আকাশ দুবে আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার জন্য যা করলে তা চিরজীবন মনে রাখব। তুমি কী চাও বলো। কত টাকা? চাইলে সিনেমাতে ভালো রোল জোগাড় করে দিতে পারি, কোথাও চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। বলো কী চাও? ইচ্ছা করলে এই ব্যাগটাই তুমি নিয়ে যেতে পারো।’

আমাকে শিক্ষাদান শেষে আমার গুরু হংসরাজ যা বলেছিলেন তার মধ্যে মধ্যে একটা কথা হল, ‘আমি তোকে যা শেখালাম তা যদি তুই কোনও ভালো কাজে লাগাস তার বিনিময়ে কোন অর্থ গ্রহণ করবি না। তাহলে তোর সব শিক্ষা নষ্ট হবে। আর আমি স্বাধীন মানুষ, ক-টা পয়সার জন্য পথে পথে ঘুরি ঠিকই, কিন্তু কারও চাকরি বা গোলামি করা দিনের পর দিন আমার পোষাবে না। আর ততদিনে আমি বুঝে গেছি সিনেমায় অভিনয় করাটাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। অভিনেতা হতে গেলে শিক্ষা লাগে, অনুশীলন লাগে। আলেয়ার পিছনে ছুটে ভবিষ্যতে আমার লাভ হবে না ।

আকাশ দুবের প্রশ্নর জবাবে আমি বললাম, ‘টাকা বা অন্য কিছুর জন্য আমি কাজটা করিনি। কাজটা করেছি একটা শিশুর জীবন রক্ষা করার জন্য আর দুষ্কৃতীদের শিক্ষা দেবার জন্য। এর বিনিময়ে আমি কিছু নিলে আমার জাদুশিক্ষা ব্যর্থ হবে, জাদুবিদ্যা ব্যর্থ হবে।

আমার কথা শুনে আকাশ দুবে বিস্মিতভাবে বললেন, ‘সত্যিই তোমার কিছু চাই না?’

আমি দৃঢ় ভাবে ‘না’ বললাম।

‘এক মিনিট দাঁড়িয়ে যাও তুমি’, একথা বলে তিনি অন্য ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। হাতে তাঁর বিখ্যাত এই চশমা। তিনি বললেন, ‘এটা কিন্তু তোমাকে নিতে হবে। এটা আমার ভালোবাসার উপহার। এটা না নিলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।’

খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই কথাগুলো বললেন তিনি। আমি এবার আর তাঁকে না বলতে পারলাম না। হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত হিরো আকাশ দুবে এরপর নিজের হাতে আমার চোখে পরিয়ে দিলেন তাঁর ব্যবহৃত ‘খঞ্জর’ সিনেমার বিখ্যাত এই রোদ চশমা। তাঁকে নমস্কার করে আমি তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। তবে আমি এরপর একদিনও আর বোম্বেতে থাকিনি। কারণ, জনার্দনের লোকেরা নিশ্চয়ই এরপর আমার অনুসন্ধান চালাত। আর আমার খোঁজ পেলে আমার কী ভয়ংকর অবস্থা হত তা বলাই বাহুল্য। ম্যাজিক বলুন, হাত সাফাই বলুন, হিপ্নোটিজম বলুন-এসব দিয়েতো আর নিজেকে সবসময় রক্ষা করা যায় না। তাই হারাধন চ্যাটার্জিকে জানিয়ে সেদিন সকালে ট্রেনে মুম্বাই ছাড়লাম আমি। আমার সঙ্গে রইল আমার খেলা দেখাবার সাজসরঞ্জামের থলে আর আকাশ দুবের চশমাটা। বহু বছর আমার বাক্সর কোনাতে রাখা ছিল ওটা। এবার খুব গরম পড়েছে আর রোদের তাপ প্রচণ্ড বলে চশমাটা পড়ছি। খুব আরাম হয় মশাই চশমাটা পড়লে।’ একথা বলে তাঁর রোদ চশমালাভের বৃত্তান্ত শেষ করলেন জাদুকর সত্যচরণ।

এতক্ষণ প্রায় হিপ্নোটাইজড হয়েই সত্যচরণের গল্প শুনছিল চন্দন। এবার তার খেয়াল হল গল্প শুনতে শুনতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। চন্দন ভাত গরম করে সত্যচরণকে নিয়ে খেতে বসল। বেশ তৃপ্তি করেই ভেটকি মাছ দিয়ে ভাত খেলেন সত্যচরণ। খাওয়ার পর্ব মেটার পর সত্যচরণ টেবিল থেকে চশমাটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘এবার আমি আসি।’

চন্দন দুরজা খুলে দিল তাঁকে যাবার সম্মতি জানিয়ে। সত্যচরণ ঘরের বাইরে পা রাখার সময় চন্দন জানতে চাইল, হারাধন চ্যাটার্জির যে সিনেমাতে আপনি আকাশ দুবের সাথে অভিনয় করেছিলেন তার নামটা কী বলুন তো। ইউটিউবে খুঁজে পেলে আজ বাড়িতে বসে দেখব।’

চন্দনের কথা শুনে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম শেষপর্যন্ত কী একটা কারণ ছবিটা আর রিলিজ করেনি।’ একথা বলে একদা মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফিল্মস্টার আকাশ দুবের দেওয়া চশমাটা চোখে দিয়ে এক গাল হেসে জাদুকর সত্যচরণ চন্দনের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *