জাদুকর সত্যচরণ ও মলমাস তেলের শিশি
|| ১ ||
ওষুধের দোকান থেকে চন্দন তার মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেরিয়েই বুঝতে পারল আকাশের গতিক বড় সুবিধার নয়। বিকাল সবে সাড়ে চারটে, কিন্তু যেন সন্ধ্যা নামতে চলেছে! ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে চন্দনকে তার বাসায় ফিরতে হবে। মিনিট পঁচিশের হাঁটা পথ। অন্য সময় হলে সে হেঁটেই ফিরত। কিন্তু আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, সব থেকে বড় কথা তার পায়ের ব্যথাটা সকাল থেকে শুরু হয়েছে। যে কারণে এখানে আসার সময়ও তাকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আসতে হয়েছে। সে রকমই কোনো ট্যাক্সি, নিদেনপক্ষে যদি কোনো টানা রিকশা পাওয়া যায়, এই ভেবে মৃদু খোঁড়াতে খোঁড়াতে চন্দন এগোল রাস্তার মোড়ের দিকে।
কিন্তু মোড় পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হল না তার। ধুলোঝড় উঠতে শুরু করল। সে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কাছেই একটা চায়ের দোকান দেখে সে তাড়াতাড়ি এগোল সেদিকে। একজনই খদ্দের ঝাঁপের নীচে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে। তার হাতের ছোটো ফ্লাস্কে কেটলি থেকে চা ঢেলে দিচ্ছিল দোকানি। তার পাশে গিয়েই দাঁড়াল চন্দন। লোকটা ফ্লাস্কে চা নিয়ে পিছন ফিরে রাস্তায় নামতে গিয়ে চন্দনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আরে আপনি এখানে !
চন্দন প্রথম মুহূর্তে অবশ্য চিনতে পারেনি লোকটাকে। কারণ, এর আগেরবার লোকটাকে যখন সে দেখেছিল তখন তার পরনে ছিল সাদা প্যান্টের ওপর লাল কোট, গলায় বাঁধা ছিল সিল্কের রুমাল। আর এখন তার পরনে ছাপা লুঙ্গি আর ফতুয়ার মতো খাটো পাঞ্জাবি। যদিও তার হাতের আঙুলে রংচঙে পাথর বসানো আংটিগুলো তখনও ছিল, এখনও আছে। তবে লোকটার প্রশ্ন শুনে ভালো করে তার দিকে তাকাতেই তাকে চিনে ফেলল চন্দন। আরে এ যে যেই জাদুকর সত্যচরণ পুতিতুন্ডি! মাস ছয় আগে শিলিগুড়ি থেকে রাতের ট্রেনে কলকাতা ফেরার পথে যার সাথে চন্দনের পরিচয় হয়েছিল। ভদ্রলোকের সাথে ছিল তার ম্যাজিকের সরঞ্জামের একটা ঢাউস বাক্স। তার থেকে তিনি বার করেছিলেন শিয়ালের চামড়ার একটা দাবার ছক আর মানুষের হাড়ের তৈরি ঘাটি । চন্দনের সাথে সারারাত দাবা খেলতে খেলতে সেই অদ্ভুত দাবার ছক নিয়ে ভয়ংকর এক অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন ভদ্রলোক। নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে চন্দনকে তাঁর বাড়িতে গল্প শুনতে আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন জাদুকর সত্যচরণ। যদিও তাদের দুজনের বাড়ি কলকাতাতেই কিন্তু হঠাৎ এভাবে এই কালবৈশাখীর বিকালে হঠাৎ সত্যচরণের সাথে দেখা হয়ে যাবে তারা ভাবতে পারেনি চন্দন।
সত্যচরণের কথার জবাবে চন্দন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, একটা ওষুধের দোকানে এসেছিলাম ভিজিট করতে। আপনি এখানে!’
জাদুকর সত্যচরণ পাশের একটা গলি দেখিয়ে বললেন, ‘এই গলিতেই তো আমার বাড়ি। মানে, ভাড়া থাকি উনিশ বছর ধরে। আপনাকে তো আসতে বলেছিলাম, আর এলেনই না। তা এখন কী কাজ?’ ঠান্ডা বাতাসের বেগ বাড়ছে। রাস্তা থেকে ধুলো, কাগজের টুকরো উড়ে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে রুমালে মুখ চাপা দিয়ে চন্দন বলল, ‘কাজ আজকের মতো শেষ। বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি বা রিকসা খুঁজছিলাম। কিন্তু যা ঝড় উঠল! কথাটা শুনেই সত্যচরণ বলে উঠলেন, ‘চলুন মশাই, তবে আমার বাড়ি চলুন। এই তো সাত-পা দূরেই আমার বাড়ি। চা খেয়ে একটু গল্পগুজব করে ঝড়বৃষ্টি কমলে বাড়ি ফিরবেন।
প্রস্তাবটা মন্দ নয়, কিন্তু এভাবে হঠাৎ সত্যচরণের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হওয়া ঠিক হবে কিনা তা প্রাথমিক অবস্থাতে বুঝে উঠতে পারল না চন্দন। বিশেষত সত্যচরণের বাড়ির লোক হঠাৎ অতিথির আগমনে অপ্রস্তুত হতে পারেন। তাই প্রস্তাব শুনে ইতস্তত করতে লাগল চন্দন। চন্দনকে চুপ করে থাকতে দেখে জাদুকর সত্যচরণ তাঁর যত্নে লালিত সরু গোঁফের তলায় মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি যে ‘থট রিডিং’ জানি তা আপনি ভুলে গেছেন। কী ভাবছেন? আপনার আকস্মিক আগমনে আমার বৌ-বাচ্চা, বাড়ির লোক কী ভাববে? আরে মশাই আমি একলা মানুষ। বিয়ে-থা কিছুই করিনি। একটা চাকর পর্যন্ত বাড়িতে নেই। দেখছেন না দোকান থেকে চা কিনে নিয়ে যাচ্ছি?’
কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটা আরও বাড়ছে। ধুলোর ঘূর্ণিতে রাস্তার পাতা, কাগজের চায়ের কাপ পাক খাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সত্যচরণ এরপর চন্দনকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘চলুন মশাই। আর দেরি করবেন না। এখনই প্রলয় শুরু হবে। তখন আর এখানে দাঁড়িয়ে ধুলো খাওয়া আর কাকভেজা ছাড়া উপায় থাকবে না। চলুন, চলুন।’ হ্যাঁ, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হল বলে! পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে চন্দন বলল, ‘ঠিক আছে চলুন।’
ধুলোঝড়ের মধ্যেই রাস্তায় নেমে সত্যচরণের পিছু নিল চন্দন। সত্যচরণ গলিতে ঢুকে পড়লেন। পুরোনো কলকাতার গলি। দু-পাশে পুরোনো দিনের দোতলা-তিনতলা বাড়ি। বাইরের পলেস্তারা খসে পড়েছে, কোনো বাড়ির খড়খড়ি দেওয়া জানালার পাল্লা বাতাসের ঝাপটাতে ঝুলছে, কারো বাড়ির কার্নিশে বটগাছের চারা। পাঁচ-সাতটা বাড়ি পেরিয়ে তেমনই একটা বাড়ির দরজা ঠেলে তাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন সত্যচরণ। একটা ছোটো উঠোন ঘিরে চারপাশে অনেক ঘর। দেখে মনে হয় অনেক লোকজন থাকে সেখানে। ঝড়ের জন্য দরজা-জানলা বন্ধ করছে তারা। বাড়ির ভিতর দিয়ে একটা নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি আধো অন্ধকারের মধ্যে ওপর দিকে উঠে গেছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে চন্দনকে নিয়ে ওপরে উঠে সত্যচরণ গিয়ে থামলেন সোজা তিনতলার ঘরের সামনে। আর কোনো ঘর নেই এখানে। কোমর থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে ঘরের আলো জ্বাললেন তিনি। চন্দনের উদ্দেশে বললেন, ‘আসুন, ভিতরে আসুন। এ ঘরটা চিলেকোঠায় ঠিকই, কিন্তু সুবিধা হল এখানে কেউ বিরক্ত করতে আসে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।’
জুতো খুলে ঘরের ভিতর পা রাখল চন্দন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দ শোনা গেল। কালবৈশাখী শুরু হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকাল চন্দন। একটা লোহার ফোল্ডিং খাট, একটা কেঠো টেবিল ছাড়াও রাজ্যের জিনিস রয়েছে ঘরটাতে। যেমন দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা আছে একটা টিনের পুরোনো সাইনবোর্ড। তার গায়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া লেখা—
‘এস পুতিতুন্ডি, দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, অব ইন্ডিয়া।’
সাইনবোর্ডটা নিশ্চয়ই এককালে কোথাও টাঙানো ছিল এখন তা স্থান পেয়েছে এ ঘরে। তাছাড়া নানা ধরনের বাক্স, দড়িদড়া, এমন কি ক্যানভাসের তৈরি একটা পুরোনো তাবুও রয়েছে ঘরের এককোণে। দেওয়ালের গা থেকে ঝুলছে জাদুকর সত্যচরণের ছবি, মুখোশ, পালক লাগানো টুপি এসব জিনিস। ঘরের একপাশে একটু উঁচু মতো জায়গাতে সত্যচরণের সেই জাদুর বাক্সটাও দেখতে পেল চন্দন। কালো রঙের বেশ বড় টিনের বাক্সটার ওপর মানুষের মাথার খুলি আর হাড় আঁকা আছে। টেবিলের গায়ে একটা নড়বড়ে কেঠো চেয়ারে চন্দনকে বসাল সত্যচরণ। চন্দন তার ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রাখল। দুটো চায়ের কাপ আর একটা লেড়ো বিস্কুটের কৌটো টেবিলে এনে রাখলেন তিনি। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বিস্কুট সহযোগে চন্দনকে আপ্যায়ন করে নিজের কাপে চুমুক দিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, এই হল আমার ড্রইংরুম কাম বেডরুম কাম ওয়ার্কশপ। কেমন বুঝছেন ?
চন্দন হেসে জবাব দিল, ‘বেশ ভালো। আমি তো এখন একলাই থাকি।’
চা খেতে খেতে দুজনের বেশ কিছু মামুলি কথাবার্তা হল। তারপর সত্যচরণ বললেন, ‘আপনি একটু খোঁড়াচ্ছেন বলে মনে হল? কী হয়েছে পায়ে ?’
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চন্দন বলল ‘না, তেমন কিছু বড় জিনিস নয়, ওই বাতের ব্যথা। এ ব্যথার জন্য তো আজকাল বয়স লাগে না। আমি নিজে ওষুধ নিয়ে কারবার করি। ওষুধ খেয়ে দেখেছি। তেমন কাজ হয়নি। মাসখানেক পরপর ইদানীং ঘুরেফিরে আসছে ব্যাথাটা। ক-দিন থাকছে, তারপর চলে যাচ্ছে, আবার থামছে।’
চন্দনের কথা শুনে জাদুকর সত্যচরণ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর বললেন, ‘ব্যথা যাচ্ছে না! এক মিনিট অপেক্ষা করুন। একটা জিনিস আছে আমার কাছে।’
চন্দনদের চা পান শেষ হয়ে গেছিল। টেবিল থেকে চায়ের কাপ, ফ্লাস্ক, বিস্কুটের কৌটো ঘরের অন্যত্র সরিয়ে রেখে তাঁর সেই খেলা দেখাবার বাক্সটার সামনে হাজির হলেন জাদুকর সত্যচরণ। বিরাট বাক্সটা খুলে তার ভিতরে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন একটা বার করলেন। তারপর সে জিনিসটা টেবিলের ওপর ঠক করে নামিয়ে রাখলেন। কর্কের ছিপি আঁটা লাল রঙের একটা প্রায় ফাঁকা শিশি। ভালো করে শিশিটার দিকে তাকালে বোঝা যায় যে তলানি হিসাবে অতি সামান্য কিছু তরল অবশিষ্ট আছে শিশিটাতে। লেবেল ছাড়া শিশিটার দিকে তাকিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, এই হল সেই আশ্চর্য জিনিস। মহাঔষধ।’
চন্দন শিশিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী এটা?’
ঠিক সেই সময় ঝড়ের দাপটে জানলার বন্ধ পাল্লা দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। আর আলোটাও নিভে গেল। লোডশেডিং!
সত্যচরণ অবশ্য টেবিলের একপাশে মোমদানিতে রাখা মোমবাতিটা দেশলাই দিয়ে চট করে জ্বালিয়ে ফেললেন। তারপর চন্দনের প্রশ্নর জবাবে বললেন, ‘আপনি ‘মলমাস তেলের’ নাম জানেন?
চন্দন হেসে বলল, ‘মানে যে তেল ট্রেনে হকাররা বাত-ব্যথা-বেদনার উপশমের তেল বলে ফেরি করেন বা গ্রাম্য মেলাতে বিক্রি হয়, সেই মলমাস তেল তো?’
সত্যচরণ বললেন, ‘সে তেলকে মলমাস তেল হিসাবে বিক্রি করা হলেও তা আসল মলমাস তেল হতে পারে না। এই হল আসল মলমাস তেল। এর এক ফোঁটা লাগালে মানুষের বাত তো কোন ছার বেতো হাতিও উঠে দাঁড়ায়, খোঁড়া ঘোড়াও রেসের মাঠে দৌড়ায়। এ শুধু গল্পকথা নয় একেবারে সত্যি। একমাত্র আমার কাছেই কয়েক ফোঁটা আছে।’ চন্দন জানতে চাইল ‘এমন খাঁটি তেল আপনি পেলেন কোথায়? শুধু আপনার কাছেই এ তেল কেন?’ সত্যচরণ বললেন, ‘তাহলে আপনাকে গল্পটা বলি। আর তা শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন এ তেল কীভাবে আমি পেয়েছিলাম, আর কেনই বা এ তেল অন্য কারো কাছে থাকা প্রায় অসম্ভব।’
ঝড়ের সাথে এবার বাইরে একটা ঝমঝম শব্দ শোনা যেতে লাগল। বৃষ্টি শুরু হল বোধহয়। জানলার পাখির ফাঁক দিয়ে ঢোকা বাতাসে মোমবাতির শিখাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে। টেবিলের ওপর রাখা, সত্যচরণের কথা অনুসারে সেই খাঁটি মলমাস তেলের শিশির দিকে তাকিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনি—
|| ২ ||
‘আমি তো খুব অল্প বয়সে ঘর ছেড়েছিলাম, তারপর আমার গুরু বাজিকর হংসরাজের থেকে হাতসাফাই আর ম্যাজিকের খেলা শিখে তাঁরই আশীর্বাদ নিয়ে পথে নেমেছিলাম ম্যাজিক দেখিয়ে ভাগ্যান্বেষণের জন্য। এ ঘটনা কুড়ি বছর আগের। জাদুকর হিসাবে তখন একটু পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছি। মানে, স্কুল, মেলা থেকে মাঝেমধ্যে ডাক পাই। তাতে ডালভাতের ব্যাপারটা মোটামুটি চলে যায় আর রাজাবাজারে কলিমুদ্দিনের ঘর ভাড়ার পঞ্চাশ টাকা মেটানো যায়। হ্যাঁ, তখন সেই টিনের চালঅলা বস্তি অঞ্চলেই থাকতাম আমি। মাথার ওপর একটা ছাউনি আছে তখন সেটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে খেলা দেখাতে যাই, কখনও বা দু-চার দিনের জন্য ভ্যানিশও হয়ে যাই। তারপর ফিরে এসে আশ্রয় নিই কলিমুদ্দিনের বস্তিতে। যেমন চলার তেমনই চলছিল। কিন্তু জানেন তো আমাদের এ লাইনে নতুন নতুন খেলা দেখানোর প্রয়োজন হয়। কারণ, একবার কোনো জায়গাতে শো করে আসার পর দ্বিতীয়বার সে জায়গাতে গেলে লোকজন দ্বিতীয়বার সে খেলা দেখতে চায় না, তা ছাড়া বারবার একই খেলার কৌশল বুঝে ফেলার সম্ভাবনাও থাকে। কাজেই আমাদের নতুন খেলা শিখতে হয়, দেখাতে হয়, আর তার জন্য জিনিসপত্র জোগাড় করতে হয়, যন্ত্রপাতি বানাতে হয়। একটা নতুন খেলা সে সময় কিছুদিন ধরেই ঘুরছিল। কিন্তু তার জন্য যে সরঞ্জাম লাগবে তার দাম অন্তত হাজার তিনেক টাকা। ম্যাজিক দেখিয়ে আমার যা আয় হচ্ছিল তাতে খাওয়া আর ঘর ভাড়া দেবার পর হাতে আর কিছুই থাকছে না। অথচ খেলাটা বানানো দরকার। টাকাটা কীভাবে জোগাড় করা যায় তা নিয়ে রোজ ভাবি। ঠিক এমন সময় একদিন আমাদের বস্তিরই বাসিন্দা ঠেলাওলা শিউচরণ আমাকে কথা প্রসঙ্গে জানালো যে বড়বাজারে এক মাড়োয়ারির কাপড়ের গদিতে সে ঠেলা চালায় সেখানে নাকি একজন হিসাবপত্র জানা লোকের দরকার। আমি স্কুল-কলেজের পরীক্ষাতে তেমন পাশটাশ না করলেও হিসাবের ব্যাপারটা মোটামুটি জানতাম। যদি বাড়তি দু-পয়সা উপার্জন করে নতুন খেলাটা বানানো যায় সে জন্য কপাল ঠুকে শিউচরণের থেকে ঠিকানা নিয়ে পরদিনই হাজির হলাম বড়বাজারে লছমীলালের গদিতে। লছমীলালের বয়স ষাটের বেশি। বিশাল বপু। সামান্য কিছু কথাবার্তার পর কেন জানি আমাকে পছন্দ হয়ে গেল লছমীলাল আগরওয়ালের। ম্যাজিশিয়ানরা তো কথা বেচে খায়, হয়তো বা সে কারণেই আমি বিশ্বাস জাগাতে পেরেছিলাম প্রথম দর্শনেই। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, রোজ বিকাল পাঁচটাতে এসে স্টক মেলাতে হবে। মাসিক বেতন পাঁচশো টাকা। আগে যে লোকটা কাজ করত সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে, জায়গাটা তাই খালি হয়েছে। আমি লছমীলালজিকে জানালাম, আমাকে কিন্তু মাঝে মাঝে দু-এক দিনের জন্য বাইরে যেতে হয়, তবে ফিরে এসে আমি বকেয়া হিসাবের কাজ মিটিয়ে দেব। লছমীলাল ব্যবসায়ী হলেও মানুষ ভালো। আর ওই যে বললাম প্রথম দর্শনেই কেন জানি আমাকে তার ভালো লেগে গেছিল। রাজি হয়ে গেলেন লছমীলাল। তাঁর কাছে কাজে লেগে গেলাম আমি। রোজ বিকাল পাঁচটাতে যাই, কোনো কোনো দিন কাজ না থাকলে আগেও যাই। এক মাস বাদেই লছমীলাল দেখলেন আমাকে কাজে রাখায় তাঁর মু%নাফা আরও বেড়েছে। আগের লোকটা হিসাবের গরমিল করে যে কাপড়ের গাটরি চুরি করত তা স্পষ্ট হয়ে গেল লছমীলালের কাছে। আমার ওপর বিশ্বাস বাড়ল তাঁর। লছমীলালের শরীরে সমস্যা ছিল। একেই তো তার হাতির মতো বিশাল বপু তার ওপর বাতের ব্যথায় তিনি হাঁটতেই পারেন না। ভাগ্য ভালো বাড়িটা তার কাছেই। শিউচরণ তাঁর কাপড়ের গাঁটরি বওয়ার ঠেলাগাড়িতে বালিশের ঠেকনা দিয়ে রোজ সকালে লছমীলালকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। তাকে ধরাধরি করে বাড়ি থেকে আনা হয়, আবার একই ভাবে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। স্ত্রী ছাড়া তাঁর বাড়িতে অন্য কেউ নেই। দিন দিন বাতের ব্যাথায় আরও বেশি বেশি করে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
মাস তিনেক পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আমাকে লছমীলাল বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে বাবু।’
হ্যাঁ, আমাকে তিনি ‘বাবু’ বলেই ডাকতেন। গদিঘরে তখন যে দু-তিনজন মুটে ছিল তাদের বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে তার তক্তপোশের সামনে একটু টুলে বসালেন। আমি তো একটু ঘাবড়েই গেছিলাম প্রথমে। আমার কাজে আগের লোকটার মতো কোনো গলদ ধরা পড়ল নাকি ?
না, সে সব কিছু নয়। লছমীলাল আমাকে প্রথমে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কোনোদিন ‘কাশী’ মানে বারাণসী গেছ?’ আমি জবাব দিলাম, ‘ওদিকে যাওয়া বলতে একবার কানপুর গেছিলাম একটা মেলায় খেলা দেখাতে। তবে আমার গুরু জাদুকর হংসরাজের মুখে কাশীর অনেক গল্প শুনেছি। ওখানকার বহু গঙ্গার ঘাটে তিনি খেলা দেখিয়েছেন। বিশ্বনাথের মন্দির আছে ওখানে। দশাশ্বমেধ ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট এসব।’
লছমীলাল বললেন, ‘বাঃ। তুমি সেখানে না গেলেও জায়গাটা সম্বন্ধে জানো দেখছি। আমি বহু বছর আগে একবার বিশ্বনাথ দর্শনে গেছিলাম সেখানে। আজ আমার সেখানে যাবার অত্যন্ত দরকার। কিন্তু যাবার উপায় নেই ।
এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আমার শরীরের অবস্থা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ। বাতের ব্যথায় আমি হাঁটতে-চলতেই পারি না। আর ক’দিন পর থেকে হয়তো গদিতে আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। কত বিলাত ফেরত ডাক্তার দেখালাম, হোমিওপ্যাথি করলাম। তাবিজ কবচ পরে জলের মতো টাকা খরচ করলাম। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হল না। ক’দিন আগে আমি একটা তেলের খোঁজ পেয়েছি। মলমাস তেল। বাতের যন্ত্রণায় মোক্ষম ওষুধ। মরা মানুষের পায়ে মালিশ করলেও নাকি সে উঠে দাঁড়ায়! ওই কাশীতেই নাকি একমাত্র একজনের কাছে ও তেল পাওয়া যায়।’ এ পর্যন্ত কথা শুনে আমিও আপনারই মতো লছমীলালজিকে হেসে বললাম, ‘মলমাস তেলের জন্য কাশীতে ছুটতে হবে কেন! ও তেল তো এখানেই ফেরিওলাদের কাছে পাওয়া যায়। প্রতি শিশির দাম মাত্র দু-টাকা। আপনার লাগলে আমি কাল আসার পথে কিনে আনতে পারি।’
আমার কথা শুনে লছমীলাল বললেন ‘না, ওসব আজেবাজে তেল আমি বহু মেখে দেখেছি। কোনো কাজ হয় না। আমি যে তেলের কথা বলছি সে মলমাস তেলের একটা ঘেঁটো শিশির দাম কুড়ি হাজার টাকা। বললাম না, সে তেল মালিশ করলে মরা মানুষ দাঁড়িয়ে ওঠে, আমাদের শিউচরণ তার ঠেলা নিয়ে মোটর গাড়ির আগে ছুটতে পারবে।’
তেলের দাম শুনে আমি চমকে উঠে বললাম, ‘এ তেলের এমন গুণ আপনি জানলেন কী ভাবে? এটা কোনো লোক ঠকাবার বিজ্ঞাপনে পড়েননি তো? মিথ্যা কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা নয় তো?’
লছমীলাল বললেন, ‘না, বিজ্ঞাপন দেখে এ খবর আমি পাইনি । -এ কথা বলে তিনি আধশোয়া অবস্থাতেই তাঁর তোশকের নীচ থেকে ডাকে আসা একটা বড় খাম বার করলেন, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা ফোটোগ্রাফ আর একটা চিঠি। ফটোগ্রাফটা তিনি এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ঘোড়ার ওপর বসে আছেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। সাদা গোঁফদাড়ি তাঁর। মাথায় পাগড়ি। ছবিটা দেখে আমি সেটা লছমীলালকে ফিরিয়ে দেবার পর তিনি বললেন, ‘এ ছবির মানুষ হচ্ছেন আমার জ্ঞাতিভাই চম্পকলাল। আসলে আমার থেকে সাত বছরের বড়। রাজস্থানের জয়সলমিরে থাকেন। আমার হাতের চিঠিটা তারই লেখা ।
ছবির লোকটার পরিচয়দান করে তাঁর লেখা চিঠির রচনা তর্জমা আমাকে শোনালেন লছমীলাল। চিঠির বয়ানটা মোটামুটি এমন ছিল —
‘প্রিয় ভাই লছমী,
একটা ভালো খবর দেবার জন্য এই চিঠি। তুমি তো জানো যে গত পনেরো বছর ধরে আমি বাতের রোগী, এবং গত দশ বছর ধরে বাতের যন্ত্রণাতে কাতর হয়ে শয্যাশায়ীও ছিলাম। শেষ যেবার তুমি দেশে এসেছিলে সাত বছর আগে সেবার তুমি নিজের চোখেই আমার করুণ অবস্থা দেখে গেছিলে। কিছুকাল যাবৎ আমি যন্ত্রণাতে নিজের মৃত্যুকামনা করছিলাম। কিন্তু তিন মাস আগে আমার এক গুজরাটি বন্ধু কেশরীচাঁদ কর্মপোলক্ষ্যে জয়সলমিরে এসে আমার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। তাঁর কাছে আমি খবর পাই তিনিও নাকি আমাদের মতো বাত ব্যাধিতে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। রোগ নিরাময়ের জন্য কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পূজা দিতে গিয়ে এক বৈদ্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি চড়া মূল্যের বিনিময় ‘মলমাস তেল’ নামে এক তেল দেন। সেই তেল মর্দন করে একেবারে সুস্থ কেশরীচাঁদ। ছোট এক শিশি তেলের মূল্য কুড়ি হাজার টাকা। তবে একজন মানুষের পক্ষে ওই তেল নাকি কয়েকফোঁটাই যথেষ্ট। বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য জড়িবুটি তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ওই মলমাস তেল প্রস্তুত করা হয়। কেশরীচাঁদের কাছে খবর পেয়ে তাঁর থেকে চিঠি নিয়ে ভাইপো পলমললালকে আমি কাশী পাঠিয়েছিলাম ওই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের কাছে। তিনি আমাকে নিরাশ করেননি। পলমল ওই তেল নিয়ে ফিরে আসার তিন দিনের মধ্যেই বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াই আমি। আর এক মাস মালিশ করার পর এখন ঘোড়ার পিঠে উঠতে পারি। যেন যৌবন ফিরে পেয়েছি। বাতের যন্ত্রণায় তোমার বর্তমান দুরবস্থার কথা আমি জানি। তুমি যদি ওই তেল সংগ্রহ করে একদিন মাত্র ব্যবহার করো তবে তার ফল বুঝতে পারবে। আমি নিশ্চিত তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে কোনো বিশেষ কারণবশত ওই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক বেদনা উপশমকারী এই তেলের বিজ্ঞাপন করেন না। জনসমক্ষ থেকে নিজেকে দূরে রাখেন ও একান্ত পরিচিত ব্যক্তি বা তার সুপারিশ ছাড়া তার তেল বিক্রি করেন না। এক্ষেত্রে তোমার তেল সংগ্রহে কোনো সমস্যা হবে না। আমার এই চিঠি তাঁর কাছে তোমার পরিচয় দান করবে। তুমি যদি আগ্রহী থাকো তবে আমাকে টেলিফোন করো। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের নাম, ঠিকানা আমি জানিয়ে দেব। আমি নিশ্চিত ওই মলমাস তেল মর্দন করলে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবেই। আমার পরিবারের বর্তমান সব ভালোই। মলমাস তেলের প্রভাবে বার্ধক্যে আমি যৌবন ফিরে পাওয়ায় সবাই খুব খুশি।
চিতরেশ্বরী তোমার মঙ্গল করুন, সুস্থ হও।
ইতি
আশীর্বাদক চম্পকলাল,
জয়সলমির।’
চিঠির বক্তব্য আমাকে বাংলাতে তর্জমা করে শোনাবার পর লছমীলাল বললেন, ‘ও চিঠি পাবার পর দাদা চম্পকলালের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি আমাকে ওই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের নাম-ঠিকানা জানিয়েছেন। তবে সেই কবিরাজের কোনো টেলিফোন নম্বর নেই। চম্পকলালের এই চিঠি প্রমাণস্বরূপ নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি রাজি হলে তাঁকে টাকা দিয়ে মলমাস তেল আনতে হবে। আমি চাই, বাবু তুমি বেনারস গিয়ে আমাকে তেল এনে দাও।’
গদিমালিক লছমীলালের শেষ কথাটা শুনে আমি মৃদু বিস্মিতভাবে বললাম, ‘আমাকেই পাঠাতে চাচ্ছেন কেন?’
লছমীলাল নরম স্বরে বললেন, ‘এর পিছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত আমি মানুষ চিনতে পারি। নইলে এই বড়বাজারে রাজস্থান থেকে এসে ব্যবসা করতে পারতাম না। এ কয়েক মাসে তোমাকে যতটুকু দেখেছি তাতে তুমি সৎ ও কর্মঠ বলে বুঝতে পেরেছি। কুড়ি হাজার কাঁচা টাকার ব্যাপার ! অন্য কাউকে দিলাম, সে হয়তো টাকাটা মেরেই দিল। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না আমি জানি। আর, দ্বিতীয় ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। তুমি চালাক-চতুর ছেলে। নানা জায়গাতে ঘোরার অভ্যাস তোমার আছে। অচেনা জায়গাতে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। সব থেকে বড় কথা তুমি ভালো কথা বলতে পারো। ওই আয়ুর্বেদিক যদি কোনো কারণে প্রথম অবস্থায় মলমাস তেল দিতে অস্বীকার করেন তবে সেক্ষেত্রে তুমি তাঁকে তোমার কথার জাদুতে রাজি করাতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
লছমীলালের কথা শুনে আমি ভাবতে লাগলাম কী করব? সামনে যদিও বর্ষাকাল আসছে। এ দু’মাস ম্যাজিক দেখাবার জন্য তেমন ডাক আসে না। এমনিতে সে ব্যাপারে আমি ফাঁকাই আছি। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে ব্যবসায়ী লছমীলাল এরপর একটা মোক্ষম চাল দিলেন। তিনি বললেন, ‘যদিও তোমার অত টাকা লাগবে না। তবুও তোমার যাওয়া-আসা ইত্যাদির খরচ বাবদ তোমাকে আরও দু-হাজর টাকা দেব। আর ওই মলমাস তেল মাখার পর যেদিন আমি বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে গদিতে আসব সেদিন একেবারে নগদ পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেব তোমাকে।’
লছমীলালের কথা শুনে এরপর আর ‘না’ বলার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আমি বললাম, ‘যাব। কবে যেতে হবে বলুন, আর কী ভাবে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে?’
লছমীলাল বললেন, ‘ওই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের নাম ‘সুশ্রুত মহারাজ’। কাশীতে হরিশচন্দ্র ঘাট নামের একটা ঘাট আছে। সেখানেই তাঁর বাড়ি। গিয়ে খুঁজে নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি তুমি বারাণসী যেতে পারো ততই ভালো। কাল রওনা হলেও আমার কোনো আপত্তি নেই।’
পরদিন নয়, ট্রেনের টিকিট ইত্যাদি জোগাড় করতে আর নিজের কিছু কাজ মেটাতে আরও দুটো দিন সময় লাগল। লছমীলালের সঙ্গে কথা বলার ঠিক তিন দিনের মাথায় তাঁর দেওয়া টাকা, সেই চিঠি, আর আমার একটা ছোট বাক্স নিয়ে কাশী বা বারাণসী যাবার ট্রেনে চেপে বসলাম।’
একটানা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ। টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে একটা আধপোড়া চুরুট বার করে সেটা চন্দনকে দেখিয়ে হেসে বললেন, ‘নেশা নয়, কখনও-সখনও খাই। আজ বাদলার দিন। তার ওপর অনেক পুরোনো ঘটনা বলছি তো। তাই বুদ্ধির গোড়াতে একটু ধোঁয়া দিয়ে নিই।’
ঝড়টা কমেছে, তবে বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। দেশলাই দিয়ে চুরুট ধরিয়ে, লম্বা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে টেবিলে রাখা সেই পুরোনো মলমাস তেলের দিকে তাকিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, গল্পের আসল অংশ শুরু হবে এবার—।’
|| ৩ ||
একদিন পর কাশী অর্থাৎ বেনারস বা বারাণসী গিয়ে পৌঁছোলাম। ট্রেন বেশ লেট ছিল পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা বারোটা বেজে গেল। ট্যুরিস্ট, পুণ্যার্থী, ভিখারি, গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে গিজগিজ করছে স্টেশন চত্বর। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম যে ওই হরিশচন্দ্র ঘাটের কাছেই কোনো ছোটোখাটো হোটেল বা ধর্মশালাতে থাকার চেষ্টা করব। তাতে কাজের সুবিধা হবে। প্ল্যাটফর্মের বাইরের ভিড়টা পাতলা হতেই আমি একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম হরিশচন্দ্র ঘাটের দিকে। শহরটা যেমন প্রাচীন তেমনই ঘিঞ্জিও বটে। কত পুরোনো মন্দির, সাধু-সন্ন্যাসী নানা ধরনের লোকজনের বাস। রাস্তার পাশে মন্দির থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে, কোথাও লঙ্গরখানার সামনে দুটো ভাতের আশাতে সার বেঁধে বসে আছে বৃদ্ধা ভিখারিনির দল, কোথাও রাস্তার ধারে বিরাট ভিয়ানে জিলিপি ভাজছে হালুইকরের দল। গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মাইকে বাজছে শিবস্তুতি। কোথাও আবার কোনো গলির মুখ আটকে শুয়ে আছে মহাদেবের বাহন, বিরাট বিরাট ষাঁড়। এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে কখনও বড় রাস্তা আবার কখনও কাশীর বিখ্যাত সরু সরু গলিপথ দিয়ে আমি একসময় পৌঁছে গেলাম হরিশচন্দ্র ঘাটের কাছে। রিকশাওলা জানাল কিছুটা তফাতে একটা গলির মধ্যে একটা ধর্মশালা আছে। গেলাম সেখানে। মাড়োয়ারিদের বেশ বড় একটা ধর্মশালা। তবে লোকজনের ভিড় তেমন একটা ছিল না। কাজেই জায়গা পেয়ে গেলাম। থাকা এবং দুপুরের নিরামিষ ভোজন মাত্র দুটাকার বিনিময়ে। দোতলায় বেশ বড় ঘর। জানলা দিয়ে দূরে গঙ্গা, আর একটা ঘাট দেখা যাচ্ছে। ধর্মশালাতে আসার পথে খেয়াল করেছি বড় বড় ঘাটের পাশেই গঙ্গার পাড় বরাবর অনেক ছোটোখাটো ঘাটও আছে। হরিশচন্দ্র ঘাটের পাশেই ওটা তেমনই কোনো ঘাট হবে। যাই হোক প্ৰথমে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম আমি, তারপর ঘরে ফিরে টানা ঘুম দিলাম।
আমার ঘুম যখন ভাঙল এখন পাঁচটা বেজে গেছে। অনেকক্ষণ আগেই বিকাল হয়ে গেছে। তবে গ্রীষ্মকাল আর এ জায়গাটা উত্তর ভারত বলে অন্ধকার নামতে প্রায় সাতটা হয়। কাজেই ভাবলাম বাইরে গঙ্গার ঘাট থেকে একবার ঘুরে আসা যাক। সুশ্রুত মহারাজের বাড়িটা ঠিক কোথায় সেটাও জেনে নিতে হবে। পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পোশাক বদলে বাইরে যাব বলে নীচে নেমে এলাম। বাইরে বেরোবার আগে ধর্মশালার ম্যানেজার গোছের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম যে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির ঠিকানা জানে কিনা? বলতে পারল না। সে কাশীতে নতুন এসে কাজে ঢুকেছে। ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে সোজা হরিশচন্দ্র ঘাটে গিয়ে হাজির হলাম আমি। দিনের শেষ হলেও প্রচুর লোকের ভিড় সে ঘাটে। যেন ছোটখাটো একটা মেলাই বসে গেছে! সিঁড়ির ধাপগুলোতে লোক দাঁড়ানোর প্রায় জায়গা নেই বললেই চলে। কেউ গঙ্গাতে স্নান করছেন, স্নানের প্রস্তুতি করছেন, কেউ বা সুর্যাস্তের সময় গঙ্গার বুকে প্রদীপ ভাসানো বা সন্ধ্যারতির প্রস্তুতি করছেন। এ ছাড়া, সন্ন্যাসী, ভিখারি,পেঁড়াওলা, বেলুনওলা, পুরোহিত, নানা শ্রেণির নানা ধরনের মানুষ তো আছেই। ঘাটের একপাশে সামনে চাদর বিছিয়ে বলের জাগলিং-এর খেলা দেখাচ্ছে একজন টুপিপরা লোক। তাকে ঘিরে বাচ্চাদের ভিড়। লোকটাকে দেখে আমার গুরু হংসরাজের কথা মনে পড়ে গেল। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান-বাজিকর হংসরাজ। তিনিও তো এখানে এসে খেলা দেখিয়েছেন।
মনে মনে আমার গুরুদেব আর পুণ্যতোয়া গঙ্গা মায়ের উদ্দেশে প্রণাম জানালাম আমি। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর হাঁটতে শুরু করলাম। বিরাট বিরাট পুরোনো দিনের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গঙ্গাপাড়ের রাস্তা ঘেঁষে। গুরুদেবের মুখেই শুনেছিলাম একসময় নাকি রাজা-মহারাজা-জমিদারপয়সাওলা লোকেরা এসে কাশীতে বড় বড় বাড়ি, ধর্মশালা, বৃদ্ধাবাস ইত্যাদি বানাতেন পুণ্যার্জনের জন্য। এসব বাড়িগুলো তাদেরই তৈরি আর ঘাটগুলোও। ছোটো ছোটো ঘাটগুলোতে হরিশচন্দ্র ঘাটের মতো ভিড় না থাকলেও দু-পাঁচজন মানুষ অবশ্যই আছে। কোথাও হয়তো বজরা বা নৌকা থেকে লোক নামছে, কোথাও কোনো সন্ন্যাসী ধ্যানে মগ্ন আবার কোথাও বা ঘাটের সিঁড়িতে বসে লাল শালু জড়ানো পুথি খুলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পুণ্যার্থীদের রাজা হরিশচন্দ্র মাহাত্ম্য শোনাচ্ছেন কথক ঠাকুরেরা। ধুতির ওপর সাদা উড়নি জড়ানো তাদের গায়ে। এসব দেখতে দেখতে গঙ্গার পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হরিশচন্দ্র ঘাট থেকে বেশ কিছুটা তফাতে একটা ঘাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। বেশ নির্জন ঘাট। কোথাও কোনো লোকজন নেই। বিরাট বিরাট প্রাচীন নিস্তব্ধ বাড়ি সেখানে গঙ্গার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। মা গঙ্গার বুকে সূর্য ডুবছে। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে নদীর বুকে। রাস্তা থেকে ধাপে ধাপে চণ্ডা সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর বুকে। মৃদু বাতাসে নদীর জল সিঁড়ির শেষ ধাপ ছুঁয়ে ছলাৎছল শব্দ তুলছে। ভারী মনোরম পরিবেশ। এই অচেনা নির্জন ঘাটটা বেশ পছন্দ হল আমার। সিঁড়ি বেয়ে বেশ কয়েকটা ধাপ নেমে জলের কাছাকাছি একটা ধাপে আমি বসলাম। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে পুরোনো দিনের কথা ভাবতে লাগলাম। সেই কোন ছেলেবেলাতে ঘর ছেড়েছিলাম, তারপর হংসরাজের পিছনে তার ম্যাজিকের থলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, এ সব পুরোনো দিনের কথাই ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ ঘণ্টার টুং টুং শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি কাঁধে একটা টিনের বাক্স কাঁধে এক প্যাঁড়াওলা। এ পথে যাচ্ছিল, আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। শুনেছি কাশীর প্যাঁড়া নাকি খুব বিখ্যাত। ডাকলাম তাকে। চারটে প্যাঁড়া কিনলাম। শালপাতাতে প্যাঁড়া দিয়ে পয়সা নিয়ে চলে গেল সে। একটা প্যাঁড়া ভেঙে সবে মুখে দিয়েছি, ঠিক তখনই আমার চোখ গেল কিছুটা তফাতে ঘাটের শেষ ধাপের এককোণে। আট-দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সেখানে বসে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে আছে আমার দিকে। তার পরনে সস্তা ছিটের জামাপ্যান্ট, খালি পা। তবে বাচ্চার গড়নটা বেশ গোলগাল। তাকে হিন্দিতে প্রশ্ন করলাম, ‘পেঁড়া লেওগে?’
সে কোনো জবাব না দিয়ে সম্ভবত একটু লজ্জা পেয়েই জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি আবার প্যাঁড়া খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। সূর্য ডুবে গেল একসময়। আমাকে এবার উঠতে হবে। ধর্মশালাতে ফেরার আগে স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির ঠিকানা জানতে হবে। ধাপ ছেড়ে আমি উঠতে যাচ্ছি হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে দেখি সিঁড়ি বেয়ে একজন লোক নামছে। মাঝারি উচ্চতার বেশ মোটা একজন লোক। পরনে ধুতি আর ফতুয়ার মতো জামা। সিঁড়ি বেয়ে তার নামার তালে লোকটার ভুঁড়িটা থলথল করে নাচছে। যেন ফতুয়ার নীচ থেকে এখনই তার ভুঁড়ি সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়বে। নামতে নামতেই লোকটার দৃষ্টি পড়ল ধাপে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটার ওপর। ছেলেটার উদ্দেশে স্পষ্ট বাংলাতে লোকটা বলল, ‘বনমালী তুমি এখানে বসে আছ! আমি তোমাকে কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সন্ধ্যা নামতে চলল। এবার ঘরে চলো বাবা।’
বনমালী নামের বাচ্চা ছেলেটা জবাব দিল, ‘না, আমি যাব না। ওখানে থাকতে আমার মোটেও ভালো লাগে না।’ মাঝবয়সি লোকটা আমার পাশ দিয়ে থপথপ করতে করতে নীচে নেমে গিয়ে বাচ্চাটার পাশে বসল। তারপর বাচ্চাটার মাথাতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেন বাবা? আমরা তো এখানে কত কিছু ভালো ভালো জিনিস খাই। দই, মাখন, ঘি, এসব।’
বাচ্চা ছেলেটা বলে উঠল, ‘না, আমার ওসব খেতে আর ভালো লাগছে না। কতদিন হয়ে গেল আমরা এখানে আছি। মা’র জন্য মন খারাপ করছে। আমি বাড়ি যাব। তোমার অসুখ তো কবেই ভালো হয়ে গেছে।
লোকটা তার ছেলের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলল, ‘যাব বাবা, এবার সত্যিই বাড়ি ফিরব।’ ছেলেটা বলল, ‘সে তো তুমি কবে থেকেই বলছ। আমি কিন্তু এবার স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসব।’
কথাটা শুনে লোকটা মৃদু আতঙ্কিত স্বরে বলল, ‘অমন কাজ কখনও করতে যেও না। শেষে বাড়িতেই ফিরতে পারবে না। হারিয়ে যাবে।’ – কথাগুলো বলে লোকটা জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে।
কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল তারা। বনমালীর মনে হয় মান ভাঙল। বাবা-ছেলে উঠে দাঁড়াল ঘরে ফেরার জন্য। এতক্ষণ আমি তাদের কথোপকথন শুনছিলাম। এবার আমিও উঠে দাঁড়ালাম। আমাকেও ফিরতে হবে।
দেখবেন, বিদেশ-বিভুঁয়ে বাঙালি দেখতে পেলে যে কোনো বাঙালির মনেই আনন্দ হয়। তার সঙ্গে দুটো কথা বলতে ইচ্ছা হয়। আমারও তেমনই মনে হল। বাপ-বেটা সিঁড়ি বেয়ে আমার কাছাকাছি উঠে আসতেই আমি তাদের উদ্দেশে বললাম, ‘বাঙালি দেখছি!’
কথাটা শুনে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত দুটো ভুঁড়ির কাছে জড়ো করে বলল, ‘হ্যাঁ, বাঙালি। মাখনলাল চক্রবর্তী। আর এ আমার পুত্র বনমালী। আপনি কোথা থেকে আসছেন? বাবা বিশ্বনাথের দর্শনে এসেছেন?
আমি মাখনলালকে প্রতি-নমস্কার করে নিজের নাম জানিয়ে বললাম, ‘না, ঠিক বিশ্বনাথ দর্শনে নয়। কলকাতা থেকে একটা কাজ নিয়ে আজই এসেছি আমি। উঠেছি ওই চরণদাস মাড়োয়ারি ধর্মশালাতে। আপনি কি এখানকারই বাসিন্দা?’
মাখনলাল জবাব দিল, ‘না, ঠিক এখানকার বাসিন্দা নই। তবে পাঁচ-ছ’মাস ধরে এখানে আছি। আদতে আমি বর্ধমান জেলার লোক। বছর তিনেক হল ভাগ্যান্বেষণে স্ত্রী- -পুত্র নিয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলাম। সেখানেই থাকি। বৃন্দাবন থেকে এখানে এসেছিলাম ব্রাহ্মণগিরি করে দুটো উপার্জনের আশাতে। অনেক বাঙালি আসে তো এখানে। আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম কাশীধাম দর্শন করতে যত লোক এখানে আসেন তার তুলনায় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সংখ্যা সাতগুণ। তার ওপর নিজেদের মধ্যে তাদের নানা দলাদলি আছে। কেউ এ মন্দিরে যেতে পারবে না, কেউ ও ঘাটে বসতে পারবেনা এসব ব্যাপার। আমি নিরীহ মানুষ। সুবিধা করে উঠতে পারলাম না। তবে বিশেষ কারণবশত একজনের আশ্রয়ে থেকে যেতে হয়েছিল আমাকে। এবার কাশী থেকে বাড়ি ফিরে যাব।’ –এই বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল লোকটা। আর আমিও পা মেলালাম তাদের সঙ্গে। রাস্তায় উঠতে হলে বেশ কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ। ধীরে ধীরে শেষ ধাপ অতিক্রম করে ভুঁড়ি চেপে ধরে হাঁফাতে লাগল মাখনলাল। তাদের থেকে এবার বিদায় নেবার আগে আমিও দাঁড়িয়ে পড়ে তাকালাম মাখনলালের ভুঁড়ির দিকে। বুঝতে পারলাম ওই থলথলে ভুঁড়ি নিয়ে লোকটার বিরাট কষ্ট। মাখনলাল সম্ভবত আমার মনের ভাবনা বুঝতে পেরে বলল, ‘আপনি বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার স্বাস্থ্য ভালো হলেও ছ’মাস আগে আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন আমার এমন ভুঁড়ি ছিল না। তিনমাসের মধ্যেই বিশাল ভুঁড়ি গজিয়ে গেল!’
আমি হেসে বললাম, ‘কী আর করা যাবে! শুনেছিলাম বটে কাশীর জল-হাওয়াতে অনেকের নাকি ভুঁড়ি গজায়! এবার তা প্রত্যক্ষ করলাম।’
আমার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটা বলে উঠল, ‘না না, জলবাতাস খেয়ে নয়, বাবার ভুঁড়ি হয়েছে ঘোল খেয়ে ।
কথাটা শুনে হেসে ফেললাম আমি। মাখনলাল কিন্তু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আমি এবার আসি।’
হঠাৎ আমার মনে হল এ লোকটা সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির ঠিকানা জানে কিনা? তাই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘সুশ্রুত মহারাজ এখানে কোথায় থাকে জানেন? আয়ুর্বেদ চিকিৎসক?’
প্রশ্ন শুনে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মাখনলাল বলল, ‘হ্যাঁ, চিনি। কেন বলুন তো?
আমি ব্যাপারটা না ভেঙে বললাম, ‘ওনার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন আছে। কোথায় বাড়িটা?’ মৃদু চুপ করে থেকে মাখনলাল গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘ও বাড়ির দুটো বাড়ি পর সদর দরজার মাথাতে ষাঁড়ের মূর্তি বসানো আছে দেখবেন।’
লোকটার জবাব শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ফেরার পথ ধরলাম আমি।
|| 8 ||
পরদিন সকালবেলা ধর্মশালা ছেড়ে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম আমি । সকাল সাতটা বাজে। হরিশচন্দ্র ঘাটে ইতিমধ্যে ভিড় জমতে শুরু করেছে। গঙ্গাস্নান সেরে ভেজা গামছা জড়িয়ে ঘরে ফিরছে কেউ কেউ। একটা দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে আমি গঙ্গার পাড় বরাবর হাঁটতে শুরু করলাম সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির দিকে। গতকাল বিকালের ঘাটটার কাছে পৌঁছে গেলাম আমি। সেখানে কয়েকজন লোক স্নান করছে তখন। সে ঘাট অতিক্রম করে সেই মাখনলালের দেখানো বাড়িটা টপকে দুটো বাড়ি ছেড়ে তিন নম্বর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়িটা যেমন বিশাল তেমনই পুরোনো। কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি গঙ্গার বাতাস খাবার জন্য বাড়িটা বানিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। অন্য বাড়িগুলোর থেকে কিছুটা তফাতে নদীর কোল ঘেঁষে বাড়িটা দাঁড়িয়ে। সামনেটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তার ভিতর প্রবেশপথে দেউড়ির মতো জায়গাটার মাথায় একটা ষাঁড়ের মূর্তি বসানো আছে, তার গা থেকে পলেস্তরা খসে গেছে, কাঠের ভারী দরজাটাও রংচটা। গুরুদেবের আর বাবা বিশ্বনাথের নাম নিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। শান বাঁধানো উঠোন ঘিরে চারপাশে থামওলা কড়িবরগার বারান্দা। তার গায়ের ঘরগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে
দেখতে না পেয়ে একটু ইতস্তত করে আমি হাঁক দিলাম, ‘কোই হ্যায়? কেউ আছেন?’
বারকয়েক হাঁক দেবার পর দোতলা থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল ‘কৌন হ্যায়? আপনি কে?’
সামনের দোতলার বারান্দাতে এসে দাঁড়াল একজন। বয়স মনে হয় বছর পঞ্চাশ হবে। গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় চেহারা। টিকালো নাক, কালো শশ্রুমণ্ডিত মুখ, কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুল। পরনে লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির মতো করে জড়ানো ধুতি। বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা প্রশ্ন করল, ‘কাকে চাই? কে আপনি?’
আমি জবাব দিলাম, ‘আমার নাম সত্যচরণ। কলকাতার মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী লছমীলালের গদি থেকে আসছি আয়ুর্বেদ চিকিৎসক সুশ্রুত মহারাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
আমার জবাব শুনে লোকটা তীক্ষ্ণ নজরে বেশ কয়েক মুহূর্ত দেখল আমাকে। তারপর বলল, ‘আমিই সুশ্রুত মহারাজ। আপনার ডান দিকের বারান্দাতে সিঁড়ি আছে দেখুন। তা দিয়ে ওপরে উঠে আসুন।’
সুশ্রুত মহারাজের নির্দেশ মতো দোতলাতে উঠে এলাম আমি। ওপরে উঠে বুঝতে পারলাম এ সিঁড়ি আমাকে বাড়ির পিছন অংশে পৌঁছে দিয়েছে। কাঠের রেলিং দিয়ে একপাশ ঘেরা টানা বারান্দা। রেলিং-এর নীচেই গঙ্গা। পুরোনো বাড়িটা যেন হেলে আছে সেদিকেই। বারান্দার একপাশে সার সার বন্ধ ঘর। একটা ঘরের দরজার পাল্লাই শুধু খোলা। সে ঘর থেকে ডাক এল, ‘ভিতরে চলে আসুন।’
আমি এগোলাম সেই ঘরের দিকে। ঘরের ভিতর যখন ঢুকতে যাচ্ছি ঠিক তখনই যেন আসেপাশের কোন একটা ঘর থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ মুহূর্তের জন্য কানে এল আমার। যাই হোক আমি পা রাখলাম ঘরের ভিতর। বেশ বড় একটা ঘর। মাঝখানে একটা টেবিল। নানা ধরনের খাতাপত্তর, লাল শালু জড়ানো পুথি রাখা আছে টেবিলে। ঘরের চারদিকের দেওয়ালে র্যাকের গায়ে রাখা আছে নানা আকারের শিশি-বোতল। নানা ধরনের তরল, জড়িবুটি রাখা আছে সেখানে। কেমন যেন একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরের ভিতর। টেবিলের ও-পাশে একটা গদি-আটা চেয়ারে বসে আছেন সুশ্রুত মহারাজ। ঘরে ঢুকে হাত জোড় করে তাঁকে নমস্কার জানাবার পর তিনি ইশারাতে তার মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসতে বললেন আমাকে। বসলাম আমি। সুশ্রুত আবারও একবার ভালো করে আমাকে দেখে নিয়ে গম্ভীর ভাবে জানতে চাইলেন, ‘বলুন, কেন এসেছেন আমার কাছে?’
আমি সংক্ষেপে আমার সাক্ষাতের কারণটা ব্যক্ত করে চম্পকলালের চিঠিটা এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আমাকে কিছু বলার আগে মুহূর্তের জন্য তিনি একবার তাকালেন ঘরের কোণে রাখা একটা দেরাজের দিকে। তাঁর সেই তাকানোতে আমার কেন জানি মনে হল ওই বন্ধ দেরাজের ভিতরেই হয়তো সে তেল আছে। যাই হোক সুশ্রুত চিঠিটা দেখার পর জানতে চাইলেন, ‘আমার কাছে আপনি কী কারণে এসেছেন সে ব্যাপারে এখানকার কেউ কিছু জানে? কাউকে বলেছেন আপনি?’
আমি বললাম, ‘না, কেউ কিছু জানে না এখানে। কলকাতাতেও আমি আর লছমীলালজি ছাড়া ব্যাপারটা কেউ জানে না।’ সুশ্রুত বললেন, ‘এখানে কাউকে জানাবেন না ব্যাপারটা। বাতের রুগির তো আর অভাব নেই। সবাই এসে উপস্থিত হবে আমার বাড়িতে। অথচ পয়সা দিতে পারবে না। এ তেল বানাতে অনেকে খরচ। চড়া দামে নানা জায়গা থেকে দুষ্প্রাপ্য জড়িবুটি, শেকড় ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হয়। তাই এ তেলের কথা সাধারণ মানুষদের আমি জানাই না ৷ ‘
তার এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বাইরে কোনো একটা ঘর থেকে যেন গোঙানির শব্দ ভেসে এল সুশ্ৰুত মহারাজের ঘরে।
সে শব্দটা শুনে মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলেন সুশ্রুত। তারপর বললেন, ‘সঙ্গে পুরো টাকা এনেছেন তো? আমি কিন্তু বাকিতে এই মলমাস তেল বিক্রি করি না। নগদ কুড়ি হাজার টাকাই চাই। তার এক পয়সা কম নয়। ধারও নয়।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘হ্যাঁ, টাকাটা আমার সঙ্গেই আছে। নগদ কুড়ি হাজার টাকা।’
সুশ্রুত মহারাজ বললেন, ‘টাকাটা তবে দিয়ে দিন। তবে তেল আপনি আজ পাবেন না। আমার কাছে আর মাত্র এক শিশি তেল আছে। তার জন্য আগাম টাকা দিয়ে গেছে একজন। যে কোনো সময় সে তেলটা নিতে আসবে। আপনার জন্য তেল বানাতে হবে আমাকে। তার জন্য সময় দিতে হবে। তিন দিন লাগবে।’
আমি বললাম, ‘তিনদিন! তার আগে হবে না?’
তিনি বললেন, ‘না, হবে না। অনেক সময় অনেককে ছ-মাসও অপেক্ষা করতে হয়েছে তেল তৈরির জিনিস মেলেনি বলে। তবে টাকা যখন নিচ্ছি আর কথা যখন দিচ্ছি তখন আপনি তিনদিন পর ঠিক তেল পাবেন। ‘
ঠিক এই সময় বাইরে থেকে আর্তনাদের শব্দটা আবার ভেসে এল !
একটু ইতস্তত করেই আমি কোমরের ভিতর থেকে লছমীলালজির দেওয়া একশো টাকার নোটের বান্ডিল দুটো বার করে এগিয়ে দিলাম সুশ্রুত মহারাজের দিকে। নোটের বান্ডিল দুটো একবার পরখ করে নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে রাখলেন তিনি। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘কে? কে ওখানে?’
সুশ্রুত মহারাজের কথা শুনে যে ঘরের ভিতর পা রাখল তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। আরে এ যে গতকালের সেই মাখনলাল! সেও দেখল আমাকে। ঘরে ঢুকে একটু জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে মাখন চক্রবর্তী বলল, ‘আজ্ঞে রামদাস কেমন যেন করছে। তাই …।’
মাখনলালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুশ্রুত মহারাজ বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি ওর ঘরে যাও আমি এখনি আসছি।
মাখনলাল বড় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সে চলে যাবার পর সুশ্রুত মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘কিছু গরিব মানুষকে আমি নিজের বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাই। এ তেমনই রোগী। এ বাড়িতেই রয়েছে। এবার তাহলে আপনি আসুন। নিশ্চিন্তে থাকুন। তিন দিন পর মলমাস তেল হাতে পেয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, আমার কাছে আপনি কেন ছুটে এসেছেন তা গোপন রাখবেন সবার কাছে। এ ব্যাপারটা কিন্তু বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখবেন।’
তাঁর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে ‘আচ্ছা’ বলে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তিনদিন পর জিনিসটা পেলেই হল। এ কথা ভেবে নিয়ে সুশ্রুত মহারাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতেই দেখলাম সুশ্রুত মহারাজের ঘরের একটা ঘর পরে একটা ঘরের দরজা খোলা। সে ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ঘরের ভিতর এক ঝলক তাকিয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর একটা তক্তপোশে শুয়ে ছটফট করছে বেশ মোটাসোটা একটা লোক। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাখনলাল। খাটে শোয়া লোকটাই তবে যন্ত্রণাতে মাঝে মাঝে চিৎকার করছে আমি বুঝতে পারলাম। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। নীচের বারান্দা হয়ে শান বাঁধানো চত্বরটা পেরিয়ে আমি বাইরে বেরোতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় আমি দেখতে পেলাম মাখনলালের ছেলে বনমালীকে। উলটো দিকের বারান্দাতে বসে আছে সে। বিষণ্ণ দৃষ্টি। আমি তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হেসে বললাম, ‘তোমরা এ বাড়িতেই থাকো নাকি?’
সে গম্ভীর মুখে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’ তারপর উঠে বারান্দার ভিতর দিকে চলে গেল। আমিও সুশ্রুত মহারাজের বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবলাম মাখনলাল চক্রবর্তী বেশ অদ্ভুত লোক তো! কাল যখন তাকে সুশ্রুতের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম তখন সে তো বলতেই পারত যে, সে একই বাড়িতে থাকে! যাই হোক সুশ্রুত মহারাজের বাড়ি থেকে সোজা ধর্মশালাতে ফিরে এলাম আমি। ভেবেছিলাম টিফিন সেরে বাইরে বেরোব। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন চড়া রোদ উঠল যে আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছা হল না। তা ছাড়া আমার হাতে তিনদিন অফুরন্ত সময় আছে। ধীরেসুস্থে সব দেখা-ঘোরা যাবে।
সারাদিন আমি ধর্মশালাতেই শুয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। বিকালে রোদের তেজ একটু কমলে ধর্মশালা থেকে বাইরে বেরোলাম। একটা দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে কাছেই একটা টেলিফোন বুথে ঢুকলাম। কলকাতায় লছমীলালজিকে খবরটা জানানো দরকার। সুশ্রুত মহারাজের খবরটা শুনে খুব খুশি হলেন লছমীলাল। তিনি বললেন কাশীতে তিনদিন থাকার ব্যাপারে আমি যেন খরচের কার্পণ্য না করি। দরকার হলে আমি কলকাতাতে ফিরে আসার পর আমাকে আরও পয়সা দেবেন। আমি ও খুশি হলাম তাঁর কথা শুনে। টেলিফোন বুথের কাজ মিটিয়ে গঙ্গার পাড়ে বড় রাস্তায় এলাম। জনস্রোতের আনাগোনা হরিশচন্দ্র ঘাটের দিকে। হঠাৎ ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ ধ্বনি শুনে দেখি শববাহকদের একটা ছোট দল আসছে। বাঁশ বাঁধা খাটিয়াতে শব বহন করে আসছে চারজন লোক। কাপড় ঢাকা বেশ মোটাসোটা কোনো পুরুষ মানুষের মৃতদেহ। আর তার পিছনে দু-তিনজন লোক।
আমার পাশ দিয়ে শবযাত্রা ধ্বনি দিতে দিতে যাবার সময় আমি দেখলাম তাদের মধ্যে রয়েছে মাখনলাল। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কে মারা গেছেন?
মাখনলাল জবাব দিল, ‘রামদাস।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘রামদাস মানে সুশ্রুত মহারাজের বাড়িতে যে ছিল? কখন মারা গেল?’
মাখনলাল বলল, ‘হ্যাঁ, সেই। এই বেলা বারোটা নাগাদ। ওর এখানে কেউ নেই। তাই আমি কজনকে জোগাড় করে ওকে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছি।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী হয়েছিল ওর?’
এ প্রশ্নর কোনো জবাব দিল না মাখনলাল। শবযাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে। ভুঁড়ি দুলিয়ে তাদের পিছনে হাঁসফাঁস করে ছুটল মাখনলাল চক্রবর্তী।
তারা চলে যাবার পর আমি হরিশচন্দ্র ঘাটের ভিড়ভাট্টার দিকে না গিয়ে এগোলাম গতকালের সেই ঘাটে যাবার জন্য। ঘাটটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘাটে হাজির হলাম আমি। আগের দিনের মতোই নির্জন ঘাট। সূর্য ডুবছে নদীর বুকে। জল এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘাটের শেষ সিঁড়িটাকে। আগের দিনের মতোই আমি জলের একটু ওপরে একটা ধাপ বেছে নিয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে করতে স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলাম। সূর্য ডুবে গেল একসময়। এবার আমাকে ফিরতে হবে। আমি উঠতে থাকি ঠিক সেই সময় একটা ছোট পাথরখণ্ড কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল একদম আমার সামনেই। আর একটু হলেই সেটা আমার মাথায় এসে পড়ত। কে ছুড়ল পাথরটা? উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে আমি অবশ্য কাউকে দেখতে পেলাম না। সিঁড়ি বেয়ে ঘাট থেকে উঠে ধর্মশালার পথ ধরলাম। কাশীতে দ্বিতীয় দিন আমার এভাবে কেটে গেল।
|| ৫ ||
তৃতীয় দিন সকালে আমি বেরিয়ে পড়লাম কাশী বিশ্বনাথ দর্শনে। তার বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না। শুধু বলি যে মন্দিরের কর্মকাণ্ড এক বিশাল ব্যাপার! কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরে বাবা বিশ্বনাথকে দর্শন করার জন্য কয়েক লক্ষ মানুষ আসেন। ফুল-বেলপাতার পাহাড় তৈরি হয়, টাকাপয়সা, সোনাদানাতে মুহূর্তের মধ্যে উপচে পড়ে প্রণামীর পাত্র। বেলচা দিয়ে পয়সা সরানো হয়। বিশ্বনাথ দর্শন শেষে হরিশচন্দ্র ঘাটের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। রাতের খাবার ধর্মশালা থেকে দেয় না। সঙ্গে করে মুড়ি-বিস্কুট যা এনেছিলাম তা শেষ। ভাবলাম সন্ধ্যাবেলা গরম গরম পুরি, জিলাপি কিনে ধর্মশালাতে ফিরব। এ কথা ভেবে নিয়ে আমি ধর্মশালাতে না গিয়ে চলে গেলাম আমার সেই প্রিয় জায়গা সেই ঘাটে। আগের দিনের মতোই বসলাম সেখানে। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করার পর পা’টা বেশ ব্যথা ব্যথা করছে। অন্য দিনের মতোই সূর্য ডুবছে। মগ্ন হয়ে দেখছি সেই দৃশ্য। হঠাৎই একটা পাথরখণ্ড এসে পড়ল কানের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে দাঁড়ালাম। তবে গতকালের ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। পর পর দু’দিন পাথর এসে পড়তে পারে না। আমাকে লক্ষ্য করেই তবে পাথর ছোড়া হচ্ছে! ঘাটের ধাপ বেয়ে রাস্তায় উঠে এলাম কেউ কোথাও আছে কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আশেপাশে পুরোনো দিনের দোতলা, তিনতলা সব বাড়ি। তবে কি কেউ ছাদ থেকে মজা করার জন্য পাথর ছুড়ছে? বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছাদগুলো খেয়াল করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ছাদেও কাউকে দেখতে পেলাম না। গঙ্গার বুকে সূর্য ডুবল। আমিও ফেরার জন্য পা বাড়ালাম। হরিশচন্দ্র ঘাটের কাছে এসে একটা দোকান থেকে পুরিজিলাপি কিনে আমি যখন ধর্মশালার গেটের মুখে পৌঁছলাম তখন অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে সেটা যখন বন্ধ করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই কপালের কাছে একটা জোর আঘাত পেলাম। পাথরের একটা ছোট টুকরো আমার কপালে লেগে ছিটকে পড়ল মাটিতে। এক হাতে কচুরির ঠোঙা আর অন্য হাতে কপাল চেপে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। আর সেই অবস্থাতেই আমি দেখতে পেলাম একটা বাচ্চা ছেলে গলি থেকে ছুটে বড় রাস্তার দিকে পালাচ্ছে। আধো অন্ধকার হলেও আমি চিনে ফেললাম তাকে। এ যে বনমালী! মাখনলালের ছেলে! যাই হোক এরপর উঠে দাঁড়ালাম আমি। গেট বন্ধ করে এগোতে এগোতে ভাবলাম, ‘ছেলেটা আমার দিকে এমন পাথর ছুড়ছে কেন! আমি তো তাকে কোনো বকাঝকা করিনি। বরং প্যাড়া দিতে চেয়েছিলাম। এটা কি ওর দুষ্টুমি নাকি ওর মাথার গণ্ডগোল আছে? যাই হোক মাখনলালের সঙ্গে দেখা হলে ব্যাপারটা জানাতে হবে। ধর্মশালার ঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। কাশীতে তৃতীয় দিনও কেটে গেল আমার।
চতুর্থ দিন সকালে ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম কাশীর বিখ্যাত ঘাটগুলো দর্শনের জন্য। সুশ্রুত মহারাজের আগামীকাল তেলের শিশি দেবার কথা। সেটা হাতে পেলে ফেরার জন্য রাতের ট্রেন ধরে নেব। নইলে পরদিন সকালের কোনো ট্রেন। কাজেই ঘাটগুলো এদিনই দেখে ফেলতে হবে। সেইমতো আমি বেরিয়ে পড়লাম। দশাশ্বমেধ ঘাট! মণিকর্ণিকা ঘাট! অসি ঘাট! তুলসী ঘাট! কত প্রাচীন সব ঘাট! কত স্থানমাহাত্ম তাদের! কত মানুষের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এ সব ঘাট। কত মানুষ জীবিকা অর্জন করে চলেছে এই ঘাটগুলোকে কেন্দ্র করে। নানা ধরনের দোকানি, ব্যবসায়ী তো আছেই জাগলার, বাজিকর অর্থাৎ আমাদের গোত্রের লোকরাও আছে। সারাটা দিন আমার ঘাট আর মানুষজনকে দেখেই কেটে গেল। দুপুরের খাওয়া বাইরেই খেয়ে নিলাম। বিকাল বেলা এসে নামলাম হরিশচন্দ্র ঘাটের কাছে। এদিন আর সেই শূন্য ঘাটটার দিকে যেতে ইচ্ছা করল না। রাতের খাবার কিনে বিকালেই ধর্মশালাতে ফিরব বলে একটা খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি মাখনলাল আসছে। তার হাতে একটা নতুন লাঠি বা ছড়ি। সম্ভবত বাড়ি ফিরছে সে। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল সে। আমিই তার উদ্দেশে বললাম, ‘মাখনবাবু কোথায় গেছিলেন?
মাখনলাল থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘বাজারে।’
মাখনলালের হাতের পিতলের বাঁটঅলা ছড়িটার গায়ে এখনও দামের স্টিকার লাগানো আছে। তা খেয়াল করে আমি বললাম, ‘ছড়িটা নতুন কিনলেন বুঝি? বেশ সুন্দর ছড়ি।’ সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, নতুন কিনলাম। হাঁটতে কষ্ট হয় তাই।’
এরপর একটু ইতস্তত করে আমি মোলায়েম কণ্ঠে তাকে বললাম, ‘একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। আপনার ছেলে আমার দিকে পাথরের টুকরো ছোড়ে। বাচ্চা ছেলে, হয়তো বা খেলার ছলেই মজা করে ছোড়ে। একটু বুঝিয়ে বলবেন ওকে। পাথর ছুড়লে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
কথাটা শুনে মাখনলাল গম্ভীর ভাবে বলল, ‘না, আমার ছেলে কাউকে পাথর ছোড়ে না। বনমালী তেমন নয়।’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘কাল সন্ধ্যায় আমি তাকে পাথর ছুড়ে পালাতে দেখেছি। এই দেখুন আমার কপালের কাছে এখনও একটু ফুলে আছে।’
আমার কথা শুনে মাখনলাল আমার কপালের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ভুল দেখেছেন।’
এ কথা বলে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভুঁড়ি দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার ব্যবহারে বেশ একটু অবাক হলাম আমি। অতঃপর খাবার কিনে দোকানে ছেড়ে ধর্মশালার দিকে এগোলাম। চতুর্থ দিনটা এভাবেই কেটে গেল।’
— এ পর্যন্ত গল্পটা বলে থেমে গেলেন জাদুকর সত্যচরণ। টেবিলের মোমবাতিটা পুড়তে পুড়তে একবার দপ করে আলো ছড়িয়ে নিভে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। গল্প থামিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘দাঁড়ান, আর একটা মোম জ্বালাই। নইলে আপনার অসুবিধা হবে।’
চন্দন বলল, ‘দরকার নেই। অসুবিধা হবে না। আপনি বরং গল্পটা শেষ করুন।’
চন্দনের কথা শুনে সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, গল্পটা শেষের পথে। তবে শেষ করি।’ এ কথা বলে তাঁর গল্পর শেষ অংশ সত্যচরণ শুরু করলেন-
‘বেশ ভালো ঘুম হয়েছিল রাতে। উঠতে একটু বেলাই হয়েছিল। স্নান সেরে বেলা দশটা নাগাদ আমি তেল আনবার জন্য রওনা হলাম সুশ্রুত মহারাজের বাড়ি। আগের দিনের মতোই দরজা খুলে বারান্দা ঘেরা শান বাঁধানো উঠোনে প্রবেশ করলাম। তবে সেখানে বনমালী, মাখনলাল বা অন্য কোনো লোককে দেখতে পেলাম না। নীচ থেকে আমি হাঁক দেওয়াতে ওপর থেকে সুশ্রুত মহারাজের গলা ভেসে এল, ‘ওপরে উঠে আসুন।’
ওপরে উঠে তাঁর ঘরের কাছে পৌঁছলাম আমি। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’
আমাকে নিয়ে তিনি তাঁর ঘর পেরিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকলেন। সে ঘরে ঢুকেই আমি বুঝতে পারলাম সেটা তাঁর আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুত করার ঘর। সারা দেওয়াল জুড়ে নানা ধরনের শিশিবোতল। ওষুধ তৈরির পাথরের খোল, তামার পাত্র, হামানদিস্তা, এসব নানা জিনিস রাখা আছে। ওষধির তীব্র গন্ধ খেলা করছে ঘরের বাতাসে। আমাকে একটা টেবিলের সামনে দাঁড় করালেন তিনি। সেখানে টেবিলের ওপর একটা স্ট্যান্ডে চোঙাকৃতি ছোট একটা পাত্র বসানো। চোঙের নীচের দিক থেকে একটা ধাতব নল গিয়ে মিশেছে একটা কাচের পাত্রে। স্ট্যান্ডের নীচে বসানো আছে একটা বুনসেন বার্নার। যা দিয়ে চোঙাকৃতি পাত্রটাকে গরম করা হয়। টেবিলে বেশ কয়েকটা ছোট পাত্রে নানা ধরনের শুকনো গাছ-গাছড়া-বীজ এসবও রাখা। সেগুলো দেখিয়ে সুশ্রুত মহারাজ বললেন, এই যে সব ভেষজ উপাদান দেখছেন এসব চোঙার মধ্যে আর একটা জিনিসের সঙ্গে ঢেলে পাত্রটা গরম করলেই তেল বেরিয়ে এসে জমা হবে কাচের পাত্রর মধ্যে। তারপর শিশিতে ভরে সেই আশ্চর্য মলমাস তেল আপনার হাতে দেব।’
তাঁর কথা শুনে আমি বললাম, ‘তেলটা তবে এখনও তৈরি হয়নি! কতক্ষণ লাগবে তৈরি হতে? আমি অপেক্ষা করব?’ সুশ্রুত এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আমার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। শুধু একটা জিনিস সংগ্রহ করা বাকি। সেটাই আসল জিনিস। আশা করি সেটা আজ রাতের মধ্যেই সংগ্রহ করতে পারব। কাল আপনার হাতে তেলের শিশি তুলে দিতে পারব মনে হয়।’ ‘আবারও একটা দিন?’ একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বললাম আমি।
সুশ্রুত বললেন, ‘এ সব জিনিষ চট করে হয় না। আপনাকে ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না। কাল জিনিসটা হয়ে গেলে অথবা যদি আজকেই হয়ে যায় তবে সেটা নিতে আসার জন্য আপনাকে খবর পাঠাব আমি। তখন আসবেন। এবার আপনি আসুন।’ সুশ্রুত মহারাজ এ কথা বলার পর অগত্যা তাঁর বাড়ি থেকে আমি ধর্মশালাতে ফিরে এলাম।
কাশীর দ্রষ্টব্যগুলো মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। কাজেই আর বাইরে ঘোরার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে কয়েক প্যাকেট তাস নিয়ে গেছিলাম। ধর্মশালাতে ফিরে সেগুলো দিয়ে হাত সাফাইয়ের খেলা প্র্যাকটিস করে সময় কাটিয়ে দুপুরের খাওয়া খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার যখন ঘুম ভাঙল সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। ঘুম ভাঙার পর আমার মনে হল লছমীলালজিকে একবার ফোন করা দরকার। মলমাস তেল পেতে যে আরও অন্তত একটা দিন দেরি হবে সেটা তাঁকে জানানো দরকার। অর্থাৎ আমার ফিরতে আরও একটা দিন দেরি হবে।
সন্ধ্যা নাগাদ লছমীলালজিকে ফোন করার জন্য ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে টেলিফোন বুথে গেলাম। তবে এদিন লছমীলালজির বদলে ফোন ধরল লছমীজির গদিরই আমার পরিচিত একজন। তার থেকে ভয়ংকর একটা খবর পেলাম আমি, লছমীলালজি হঠাৎই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে সংজ্ঞাহীন অবস্থা। ডাক্তাররা তিনি আর চোখ মেলবেন কিনা সে ব্যাপারে কোনো কথা দিতে পারছেন না! তবে জ্ঞান হারাবার আগে তিনি বারবার আমার নাম করছিলেন। আমি যেন যথাসম্ভব দ্রুত কলকাতাতে ফিরে আসি। সম্ভব হলে রাতের ট্রেন ধরি!
টেলিফোনে খবরটা পাবার পর ধর্মশালাতে ফিরে এসে ভাবতে লাগলাম আমার কী করা উচিত? তেলটা হাতে পাবার জন্য অপেক্ষা করব? নাকি আজ রাতের গাড়ি ধরেই কলকাতায় রওনা হব? টাইমটেবিলে লেখা আছে রাত বারোটাতে একটা ট্রেন আছে। ভাবতে লাগলাম আমি। ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলল। রাত আটটা নাগাদ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সুশ্রুত মহারাজের বাড়ি যাব। তেলটা যদি বানানো হয়ে থাকে তবে সেটা নিয়ে রাতের গাড়ি ধরব। খুব বেশি দেরি করলে কাল ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করে সকালের প্রথম গাড়ি ধরব। আর সুশ্রুত মহারাজ যদি তেল দিতে না পারেন তবে টাকাটা ফেরত নেবার চেষ্টা করব। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি তিনি। এটা তাঁরই দোষ। আমার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সুটকেসে সব গুছিয়ে নিয়ে ধর্মশালার পাওনা মিটিয়ে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির উদ্দেশে আমি রওনা হলাম ।
|| ৬ ||
রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে তখন। ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করেছে দোকানিরা। সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির দিকের রাস্তা তো আরও নির্জন। একজন লোকও সেদিকের রাস্তায় নেই। শুধু কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলো শুধু ক্ষয়াটে আলো ছড়াচ্ছে। তবে আকাশে চাঁদ উঠেছে। বেশ বড় গোল চাঁদ। সম্ভবত পূর্ণিমা। আমার বাক্সটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে সেই নির্জন ঘাটের কাছে পৌছলাম। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে ঘাটের নিঃসঙ্গ সিঁড়িগুলোতে। ঘাট অতিক্রম করে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির গলিতে ঢুকলাম। বিশাল বিশাল বাড়িগুলো কেমন যেন ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে! কোনো আলো নেই, শব্দ নেই বাড়ির ভিতরগুলোতে। আমি এসে দাঁড়ালাম সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির সামনে। তার বাড়ি থেকেও কোনো শব্দ বা আলো আসছে না। সদর দরজা খুলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কা দিতে দিতে আমি ডাকতে লাগলাম, ‘সুশ্রুত মহারাজ আছেন?’
দরজা ধাক্কাবার শব্দ আর আমার কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল প্রাচীন বাড়িগুলোর গায়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর যেন দরজার ওপাশে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম। আর এরপরই দরজাটা খুললেন সুশ্রুত মহারাজ। আমাকে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এত রাতে কি ব্যাপার?’ চাঁদের আলোতে বেশ অসন্তোষের ভাব তাঁর চোখে-মুখে।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তেলটা কি হয়েছে?’
তিনি এবার স্পষ্টত রুক্ষভাবেই বললেন, ‘বলেছি তো সেটা তৈরি হলে আপনাকে খবর দেব, এ সব জিনিস পেতে হলে এত তাড়াহুড়ো করলে চলে না। এমনও হতে পারে আপনাকে আরও তিনদিন অপেক্ষা করতে হল। এখন আপনি আসুন।’
আমি তাঁর কথা শুনে বললাম, ‘দেখুন আমার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। লছমীলালজী হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমাকে আজ রাতের ট্রেন অথবা কাল ভোরের ট্রেন ধরতেই হবে।’
সুশ্রুত কথাটা শুনে বললেন, ‘তা আমি কি করব?’
আমি বললাম, ‘আমাকে তবে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিন। আমি চলে যাব।’
তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘টাকা ফেরত দেব কেন? আমিতো বলিনি যে আপনাকে তেল দেব না। আপনি অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। টাকা ফেরত হবে না।’
এবার তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমার মেজাজটাও ভিতরে ভিতরে বেশ গরম হয়ে গেল। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বললাম, ‘দেখুন, আপনি নিজেই কথার খেলাপ করেছেন। তেলটা আজকেই আমাকে আপনার দেওয়ার কথা ছিল। সেইমতো আমি লছমীলালজীকে জানিয়েওছিলাম যে তেল নিয়ে আজকের গাড়িতে কলকাতা রওনা হব। কাজেই দোষটা আপনার।’— এ পর্য্যন্ত বলে আমাকে একটু থামতে হল, কারণ রাস্তা দিয়ে একটা ঠকঠক শব্দ কানে এলো। আমি দেখতে পেলাম লাঠি ঠুকতে ঠুকতে পুলিশের একজন পাহারাদার আসছে। আর তাকে দেখেই একটা মোক্ষম বুদ্ধি খেলে গেল আমার মাথাতে। আমি বললাম, ‘দেখুন, আপনি যদি টাকাটা ফেরত না দেন তবে আমি মীমাংসার জন্য লোক ডাকতে বাধ্য হব।’
কথাটা শুনে যেন মৃদু চমকে উঠে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন সুশ্রুত মহারাজ। আমার চোয়ালও তখন কঠিন। আমিও স্থির দৃষ্টিতে তাঁর চোখে চোখ রাখলাম। লাঠির শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ব্যাপারটা সুশ্রুত মহারাজও খেয়াল করলেন। তিনি এবার ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে ভিতরে আসুন। কাল সকালের মধ্যে আপনাকে তেলটা দেবার চেষ্টা করছি।’
ভিতরে ঢুকলাম আমি। সুশ্রুত মহারাজ ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে বললেন, ‘একটু দাঁড়ান আমি আসছি।’
চাঁদের আলোতে শান বাঁধানো উঠানের মধ্যে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি সিড়ির উল্টোদিকে বারান্দার একটা ঘরের তালা চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি সে ঘর থেকে বাইরে এসে বললেন, ‘চলুন, ওপরে চলুন।’
তাঁর কথা শুনে আমি বারান্দাতে উঠে তাঁর পিছন পিছন সিঁড়ির দিকে এগোলাম। সিঁড়ির ঠিক মুখে পৌঁছে সুশ্রুত মহারাজ তখন সিঁড়িতে পা রাখতে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা জিনিস ধরা দিল আমার সতর্ক চোখে। কোথা থেকে যেন ঠিক সেই সময়ই এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছিল সুশ্রুতের গায়ে। সেই আলোতেই সুশ্রুতের কোমরের কাছে পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক মুহূর্তের জন্য একটা জিনিসকে উঁকি দিতে দেখলাম। পকেটে রাখা একটা জিনিসের সামান্য অংশ। অন্য কেউ হলে হয়তো চিনতেই পারত না, কিন্তু আমি ঠিক চিনে ফেললাম। একটা পিস্তলের বাঁট! সুশ্রুত মহারাজের মতলবটা কী? আমার মনে হল এই পিস্তলটা আনার জন্যই তিনি ঘরটাতে ঢুকেছিলেন। সতর্ক হয়ে গেলাম আমি। আমার মন বলল, কিছু যেন একটা ঘটতে চলেছে! অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে সুশ্রুত মহারাজের পিছনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম আমি। দোতলাতে উঠে এলাম। কেউ কোথাও নেই। কোনো আলো জ্বলছে না। তবে চাঁদের আলো খেলা করছে বারান্দাতে। সুশ্রুত তাঁর বসার ঘর পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে দরজা খুলে বাতি জ্বালালেন। ক্ষয়াটে হলদেটে একটা বাতি। দু-একটা চেয়ার রাখা আছে সে ঘরে। তিনি আমাকে বললেন, রাতটা আপনি এ ঘরে কাটান। ভোরবেলা আমি আসব। পুরোনো দিনের বাড়ি। রাতে সাপখোপের আনাগোনা হয় অনেক সময়। বাইরে বেরোবেন না। আর আমি মলমাস তেল তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকব। যা কথা হবে ভোরবেলা হবে। তেল যদি বানাতে না পারি আমার কাছে যে এক শিশি অন্যের জন্য বানানো আছে সেটাই আপনাকে দিয়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’
সুশ্রুত মহারাজ দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। আমি ভাবতে লাগলাম সুশ্রুত মহারাজের আসল মতলবটা কী? তার পকেটে পিস্তল কেন? আমাকে মারার কোনো পরিকল্পনা নেই তো তাঁর? তিনি যে অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে তার বাড়ির ভিতরে আনলেন তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি আমার। তেলটা কি তিনি আমাকে সত্যি দেবেন, নাকি তার অন্য কোনো মতলব আছে? ঘড়িতে দেখলাম রাত ন’টা বাজে। সতর্ক থাকতে হবে। রাতে ঘুমালে চলবে না। সারারাত জেগে কাটাতে হবে আমাকে। পকেট থেকে তাস বার করে তাসের খেলা প্র্যাকটিস করতে লাগলাম।
প্রায় এক ঘণ্টা কাটল এভাবে। হঠাৎ আমার সতর্ক কানে দরজার বাইরে একটা অস্পষ্ট শব্দ ধরা দিল। আমি আড়চোখে তাকালাম সেদিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। সেখানে প্রথমে উদয় হল বনমালীর মুখ। তারপর তার দেহটা। বনমালীর হাতে এবার ছোটো নয়, বেশ বড় একটা পাথর। সেটা ছুঁড়লে নিশ্চয়ই আমার মাথা ফেটে যাবে! ছেলেটা সে কাজ করার জন্যই হাতটা তুলতে যাচ্ছিল। আর ঠিক তখনই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে দরজা ছেড়ে পালাবার জন্য ছুটল। আমি যখন দরজার বাইরে আসলাম তখন দেখতে পেলাম বারান্দা দিয়ে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি বেয়ে সম্ভবত ছাদের দিকে উঠে গেল। ব্যাপারটা কী আমাকে বুঝতে হবে। আমিও বারান্দা দিয়ে এগোলাম ছেলেটাকে যদি ধরা যায় সে জন্য। খেয়াল করলাম সুশ্রুত মহারাজের বসার ঘর আর তার ওষুধ প্রস্তুত করার ঘর, দুটো ঘরের দরজাই বাইরে থেকে বন্ধ। তিনতলার ছাদের দিকে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম আমি। ছাদের মুখে পৌঁছে আমি অস্পষ্ট কথাবার্তার শব্দ পেয়ে ছাদের ঠিক মুখে দরজার পাল্লার আড়ালে থেকে ছাদে তাকালাম। বিরাট ছাদটাতে একটা চিলেকোঠা মতো ঘর আছে আমার সিঁড়ির মুখ থেকে কুড়ি-পঁচিশ হাত তফাতে। তার সামনে চাঁদের আলোতে নিজেদের মধ্যে কিছুটা ব্যবধান রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সুশ্ৰুত মহারাজ ও মাখনলাল। মাখনের হাতে সেই ছড়িটা ধরা। কাঠ, পাথরের টুকরো ইত্যাদি নানা আবর্জনা ছড়িয়ে আছে ছাদময়। মাখনলাল বলল, ‘আমার টাকাটা দিয়ে দিন আমি কালকেই ফিরে যাব। ছেলেটা আর মোটেও থাকতে চাচ্ছে না। আমি সুস্থ হয়ে ওঠার পর ওই টাকাটার জন্য দু-মাস ধরে আটকে আছি।’
সুশ্রুত মহারাজ বললেন, ‘টাকা তো তোমাকে দেবই বলেছি। তার সঙ্গে আরও পাঁচ হাজার দেব এবারের জন্য।’ আমি শুনতে লাগলাম তাদের কথোপকথন।
সুশ্রুতের কথার জবাবে মাখনলাল বলল, ‘কেন আমাকে তিনদিন ধরে চাপ দিচ্ছেন? আমি তো বারবার করে বলছি ব্যাপারটাতে আমি রাজি নই। আমার টাকা মিটিয়ে দিন আমি চলে যাই।’ সুশ্রুত বললেন, ‘আর একবার মাত্র। এক মাসের মধ্যেই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। পুরো টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবে।’
মাখনলাল বলল, ‘যদি রামদাসের মতো আমার অবস্থা হয় তখন? আমি যদি মারা যাই?’
সুশ্রুত বললেন, ‘রামদাস আমার কথা শুনে চলেনি। তাছাড়া ওর মধুমেহ রোগ ছিল সেটা সে আমাকে বলেনি। তুমি তো ঠিক সুস্থ হয়ে উঠেওছিলে, হওনি?’
মাখনলাল বলল, ‘একবার হয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয়বার নাও হতে পারি। আমি আর ব্যাপারটাতে রাজি নই। টাকা মিটিয়ে দিন, বাড়ি ফিরে যাই।’
মাখনলালের কথা শুনে সুশ্রুত বললেন, ‘পাগলামী কোরো না। রাত বয়ে যাচ্ছে। যে তেলটা নিতে এসেছে সে কাল ভোরের পর আর থাকতে রাজি নয়। নইলে অতগুলো টাকা তাকে ফেরত দিতে হবে। তাতে তোমারও ক্ষতি আমারও ক্ষতি। নীচে চলো। আমার অন্য সব প্রস্তুতি সারা। সকালের মধ্যেই তবে তার হাতে তেলের শিশিটা তুলে দিতে পারব।’
মাখনলাল এবার বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘না, আমি আর কিছুতেই রাজি নই। লোকটার সাথে কী বোঝাপড়া করবেন সেটা আপনার ব্যাপার?’
সুশ্রুত মহারাজও উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘যেতে তোমাকে হবেই। নইলে বাপ-ছেলে দুজনের কেউ বাঁচবে না। আজ দুজনকে মেরে গঙ্গাতে ভাসিয়ে দেব।’
মাখনলাল বলল, ‘তাই? দেখি আপনি কাজটা কেমনভাবে করেন। আপনি এমন কিছু করার চেষ্টা করতে পারেন তা আমি আন্দাজ করেছিলাম। তাই এই ছড়িটা এনেছিলাম। এই বলে মাখনলাল ছড়িটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে ছড়ির হাতল ধরে টান দিতেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল হাত দেড়েক লম্বা একটা তীক্ষ্ণ লৌহশলাকা। চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল সেটা। গুপ্তি। লাঠির মধ্যে লুকানো গোপন অস্ত্র।
গুপ্তিটা বাগিয়ে ধরে মাখনলাল বলল, ‘আপনি আমার টাকা এবার মিটিয়ে দিন, আমি এখনই ছেলে নিয়ে চলে যাব। টাকা দিন।’
গুপ্তিটা মাখনলাল বার করতে সুশ্রুত মহারাজ প্রথমে একটু চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু এরপরই তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে মাখনলালের দিকে তাগ করে বললেন, ওটা হাত থেকে ফেলে দাও। নইলে এখনই গুলি করে মারব।’
মাখনলাল গুপ্তিটা বাগিয়ে ধরে বলল, ‘না, ফেলব না।’
সুশ্রুত মহারাজ হিংস্রভাবে বললেন, ‘শেষ বারের মতো বলছি ওটা ফেলবে কি না? ‘
মাখনলাল মৃদু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, ‘না, ফেলব না। আমার টাকা দিয়ে দিন।’
সুশ্রুত আর বাক্যব্যয় করলেন না তার সাথে। মাখনলালকে লক্ষ্য করে পিস্তলের ট্রিগার টেনে দিলেন। খন করে একটা শব্দ হল। কিন্তু গুলি বেরোল না। আবারও মাখনলালকে লক্ষ্য করে পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দিলেন সুশ্রুত। কিন্তু এবারও শুধু ধাতব একটা শব্দ হল। গুলি বেরোল না। মৃদু বিস্মিত ভাব ফুটে উঠল সুশ্রুত মহারাজের মুখে। তবে তিনি দমবার পাত্র নন। চাঁদের আলোতে তার চোখ মুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে তিনি মাটি থেকে একটা টুকরো তুলে নিয়ে এগোলেন মাখনলালের দিকে। মাখনলালের হাতে সেই গুপ্তি আর সুশ্রুত মহারাজের হাতে চেয়ার বা টেবিলের ভাঙা পায়ার মতো কাঠ। পরস্পরের দিকে চোখ রেখে দুজনেই দুজনকে আঘাত হানার জন্য পাক খেতে লাগলেন. তবে সুশ্রুত মহারাজের তুলনায় মোটাসোটা প্রচন্ড ভুঁড়িঅলা মাখনলালের নড়াচড়ার ভঙ্গি অনেকটা শ্লথ। আর সে ব্যাপারটাকেই কাজে লাগালেন সুশ্রুত। হঠাৎই তিনি ক্ষিপ্ৰ গতিতে মাখনলালের পিছনে চলে গিয়ে কাঠের টুকরোটা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করলেন মাখনলালের গুপ্তি ধরা বাহুতে। গুপ্তিটা মাখনলালের হাত থেকে খসে পড়ল। আর সেও তার ভারী শরীরটা নিয়ে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সুশ্ৰুত সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে লৌহ শলাকাটা তুলে নিলেন। তারপর সেটা কিছুটা তফাতে মাটিতে পড়ে থাকা মাখনলালের শরীরে বিঁধিয়ে দেবার জন্য। মাখনলালের কাছে গিয়ে তিনি অস্ত্রটা বাগিয়ে ধরলেন আঘাত হানার জন্য। উত্তেজনার বশে আমি কখন যে দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে ছাদে নেমে পড়েছি তার খেয়াল নেই। সুশ্রুত মহারাজ মাটিতে পড়ে থাকা মাখনলালকে খুন করতে যাচ্ছেন দেখে নিজের অজান্তেই আমার গলা দিয়ে যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। শলাকাটা মাখনলালের শরীরে বিঁধিয়ে দিতে গিয়েও সেই চিৎকার শুনে আমার দিকে ফিরে তাকালেন সুশ্রুত। তার চোখের দৃষ্টি যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠল এবার। তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমাকেও শেষ করব এরপর। তোমাকে ফিরতে দেওয়া যাবে না।’
কথাটা বলে তিনি প্রথমে মাখনলালের ওপর আঘাত হানতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় অন্ধকারের মধ্যে থেকে কী যেন একটা উড়ে এসে প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল সুশ্রুত মহারাজের মাথায়। বেশ জোরে একটা শব্দ হল। আর তারপরই কাটা কলা গাছের মতো মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেলেন। তার স্থির হয়ে যাওয়া দেখে বুঝতে পারলাম তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। রক্ত বেরোচ্ছে তার মাথা থেকে। মাখনলাল এবার হামাগুড়ি দিয়ে এসে মহারাজের হাত থেকে খসে পড়া গুপ্তিটা তুলে নিয়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ছাদের অন্ধকার একটা কোণা থেকে বনমালী ছুটে এসে বাবার পাশে দাঁড়াল। এবার তাদের দু-জনের দৃষ্টি পড়ল আমার ওপর। গুপ্তিটা তুলে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে মাখনলাল আমার উদ্দেশ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘সরে যান। আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে রক্তারক্তি হবে।’
আমি তার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আমি বাধা দেব কেন? আমি তো আপনার শত্রু নই।’ ততক্ষণে যেন আমি সুশ্রুত মহারাজ আর মাখনলালের কথা শুনে তেল তৈরির রহস্যটা আবছা আবছা অনুমান করে ফেলেছি।’
মাখনলাল আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস না করতে পেরে বলল, ‘চালাকি করবেন না। আপনি তো তেল নিতে এসেছেন। ‘
বনমালী মাটি থেকে সেই বড় পাথরের টুকরোটা আবার কুড়িয়ে নিল যা দিয়ে সে আঘাত হেনেছে সুশ্রুত মহারাজের মাথায়। আমি মাখনলালের কথার জবাবে বললাম, ‘না। আমি আপনার শত্রু নই। আমি না থাকলে আপনি এতক্ষণে মারা পড়তেন।’ এই বলে আমি পকেট থেকে পিস্তলের বুলেট দুটো বার করে হাতের তালুতে মেলে ধরলাম। সুশ্রুত মহারাজের পকেটে পিস্তল দেখে আমার মনে হয়েছিল তাঁর মতলব ভালো না। তাই আমার গুরু হংসরাজের শেখানো আমার হাতসাফাই বিদ্যা প্রয়োগ করেছিলাম। ম্যাজিশিয়ান সত্যচরণের হাত। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সুশ্রুত মহারাজের পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে তার থেকে গুলি দুটো বার করে ফাঁকা পিস্তলটা আবার তার পকেটে পুরে দিয়েছিলাম। এ জন্যই গুলি বেরোয়নি পিস্তল থেকে।
গুলি দুটো দেখে এবার মাখনলাল আশ্বস্ত হল। মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন সুশ্রুত মহারাজ। সেদিকে তাকিয়ে মাখনলাল বলল ‘আমাদের এখনই পালাতে হবে। ও জেগে উঠলে সাংঘাতিক কাণ্ড হবে। আর আপনিও পালান। হয়তো আপনাকেও ও ছাড়বে না।
আমি বললাম, ‘তবে একসঙ্গেই স্টেশনে যাই। তার আগে আমার বাক্সটা নিতে হবে।’ ছাদ ছেড়ে সিঁড়ির দিকে এগোলাম আমরা তিনজন। নামতে নামতে আমি মাখনলালকে তেল তৈরির ব্যাপারে আমার অনুমানের কথাটা জানাতেই সে বলল, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যি। বনমালী আপনার আসার কারণটা আন্দাজ করেছিল। আমাকে যাতে দুরবস্থায় পড়তে না হয়, যাতে আমাদের এখানে আর থাকতে না হয় সে জন্য আপনাকেও পাথর ছুড়ে তাড়াবার চেষ্টা করত। আমি অবশ্য কাজটা ওকে করতে বলিনি। আপনি ওকে ক্ষমা করবেন।’
দোতলাতে নেমে আমি যে ঘরে বসেছিলাম সে ঘরে ঢুকে বাক্সটা নিয়ে বেরোবার সময় খেয়াল হল একবার দেখি যে আমার দেওয়া টাকাটা সুশ্রুত মহারাজের টেবিলের ড্রয়ারেই রাখা আছে কিনা ? আমি যখন সে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি তখন সে ঘর থেকে বেরোচ্ছে মাখনলাল আর বনমালী। সে আমাকে বলল, ‘কিছু নেবার থাকলে তাড়াতাড়ি নিন।’
আমি ঘরে ঢুকে টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে টাকাটা পেয়ে গেলাম। ঘর থেকে টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। তারপর নীচে নেমে সুশ্রুত মহারাজের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে তিনজন প্রায় ছুটতে শুরু করলাম স্টেশনের দিকে। এগোতে এগোতে মাখনলাল বলল, ‘এখানে আসার পর টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেছিল। একদিন ওই নির্জন ঘাটটাতে বসে আছি তখনই সুশ্রুত মহারাজের খপ্পরে পড়লাম। তিনি প্রথমে কাছেই তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিলেন। ঘি, মাখন আর বিশেষ ধরনের ঘোল খাইয়ে আমাকে মোটা করলেন। তারপর আসল কথাটা পাড়লেন।
বোঝানো কথা আর টাকার লোভে আমিও রাজি হয়ে গেছিলাম সেই বীভৎস ব্যাপারটাতে। কিন্তু আমি সুস্থ হবার পরও তিনি টাকা মেটাচ্ছিলেন না। কাজেই রয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। কেন আমি রাজি হয়েছিলাম ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয় আমার। আমার অবস্থাও ওই রামদাসের মতো হতে পারত। দ্বিতীয়বারের জন্য আমি তাই কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না।’
কথা বলতে বলতে মণিকর্ণিকা ঘাটের সামনে পৌঁছলাম আমরা। ঘটনাচক্রে সেখানে একটা ট্রেকার পেয়ে গেলাম আমরা। সে গাড়ি ধরে সোজা স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। কোনোরকমে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলাম। মাখনলাল আর তার ছেলের টিকিটও আমিই কেটে দিলাম। প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই দেখি কলকাতা ফেরার ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। আমি জেনারেল কম্পার্টমেন্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে ট্রেনে তুলে দেবার জন্য এল মাখনলাল আর বনমালীও। এবার বিদায় নেবার পালা। মাখনলাল তার পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বার করল। তেল ভর্তি শিশি। সেটা সে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার মলমাস তেল। যেটা অন্য একজনকে দেবে বলে সুশ্রুত মহারাজ বানিয়ে রেখেছিলেন। অনেক আশা নিয়ে আপনি তেলটা নিতে এসেছিলেন। গুলি বার করে আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাই দিলাম। আসার সময় সুশ্ৰুত মহারাজের দেরাজ থেকে বার করে এনেছি।’
শিশিটা হাতে নিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। বুঝলাম এই গরিব বাঙালি ব্রাহ্মণকে ঠকানো উচিত হবে না। আমি লছমীলালের দেওয়া টাকার বান্ডিল দুটো বার করে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। একটু ইতস্তত করে টাকাটা নিয়ে মাখনলাল বলল ‘এ টাকাটা হয়তো রামদাসের প্রাপ্য ছিল। তবে আমার ব্যাপারেও কিন্তু মিথ্যা বলিনি। এই বলে মাখনলাল তার ফতুয়াটা কয়েক মুহূর্তের জন্য ওপরে তুলে ফেলল। আমি তাকালাম সেদিকে। আর ঠিক তখনই মাখনলালের গাড়ির ঘোষণা হল মাইকে। অন্য একটা প্লাটফর্মে তার গাড়ি আসছে। আর সেই ঘোষণা শোনা মাত্রই মাখনলাল ‘চলি’ বলে ছেলের হাত ধরে ভুঁড়ি দুলিয়ে ছুটল টেন ধরার জন্য। আমিও ট্রেনে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ট্রেনও ছাড়ল। একদিন পর আমি কলকাতায় এসে পৌঁছলাম। লছমীলালকে কিন্তু মলমাস তেলের শিশিটা আমার দেওয়া হল না। আমি যেদিন কলকাতা পৌঁছলাম তার আগের দিনই প্রয়াত হয়েছেন লছমীলাল। শিশিটা আমার কাছেই রয়ে গেল।’
গল্প শেষ হল জাদুকর সত্যচরণের। আলোটাও সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। টেবিলের ওপর রাখা শিশিটার দিকে তাকিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘এই হল সেই শিশি। সুশ্ৰুত মহারাজের মলমাস তেলের শিশি। জিনিসটা কিন্তু অব্যর্থ জিনিস মশাই। পরিচিত যাদের দিয়েছি, নিমেষে তাদের ব্যথা যন্ত্রণা ভ্যানিশ হয়েছে।’
শিশিটার দিকে তাকিয়ে চন্দন বলল, ‘আপনার গল্পে একটা জিনিস কিন্তু স্পষ্ট হল না। সুশ্ৰুত মহারাজ কোন ব্যাপারে দ্বিতীয় বারের জন্য মাখনলালকে জোর করে রাজি করবার চেষ্টা করছিলেন।’ প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থেকে সত্যচরণ বললেন, ‘মাখনলাল তার ফতুয়া তুলে আমাকে কি দেখিয়েছিল জানেন? তার থলথলে পেটের একপাশে একটা কাটা দাগ। চর্বি কেটে নেওয়ার দাগ খাঁটি মলমাস তেল তৈরি হয় জ্যান্ত মানুষের টাটকা চর্বি দিয়ে। তার সঙ্গে আরও নানা জিনিস মিশিয়ে আগুনে গলানো যেটা বেরিয়ে আসে সেটাই খাঁটি মলমাস তেল। বাতের ব্যথা-বেদনার অব্যর্থ ওষুধ।’
কথাটা শুনে চন্দন শিশিটার দিকে তাকাল। শিশির নীচে যেটা রয়েছে সেটা তবে গলানো চর্বি! মানুষের তেল। চন্দন যেন কল্পনাতে দেখতে পেল সত্যচরণের দেখা সুশ্রুত মহারাজের সেই তেল বানানোর পাত্রটাকে। বুনসেন বার্নার দিয়ে পাত্রর মধ্যে লালচে একখণ্ড চর্বি গলানো হচ্ছে। মানুষের চর্বি! দৃশ্যটা কল্পনা করতেই চন্দনের শরীরের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল!
জাদুকর সত্যচরণ বললেন ‘নিন, পায়ে কয়েকফোঁটা মলমাস তেল মেখে নিন।’
চেয়ার ছেড়ে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চন্দন বলল, ‘না, থাক। ব্যথাটা এখন অনেক কম মনে হচ্ছে। এবার আমাকে যেতে হবে।’
জাদুকর সত্যচরণ একটু বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘তবে যান। আপনার ফোন নম্বরটা একটু দিয়ে যান। মাঝে মাঝে ফোন করব কিন্তু।’
চন্দন ফোন নম্বরটা বলল, ‘একটা কাগজে যেটা লিখে নিলেন সত্যচরণ।
এরপর সে ঘর থেকে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত চন্দনকে এগিয়ে দিলেন সত্যচরণ। রাস্তায় আলো জ্বলে গেছে। বৃষ্টিও নেই। রাস্তায় পা রেখে চন্দন হেসে বলল, ‘এবার আসছি।’
জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘সাবধানে যাবেন। তবে তেলটা কয়েকফোঁটা লাগিয়ে যেতে পারতেন। মানুষের চর্বির খাঁটি মলমাস তেল। বেতো খোঁড়া এ তেল মেখে রেসের মাঠে নামে। আবার আসবেন। নতুন গল্প শোনাব।’
তার কথা শুনে ‘আচ্ছা’ বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বড় রাস্তার দিকে এগোল চন্দন।