জাদুকর সত্যচরণ ও দাবার ছক
|| ১ ||
রাতের ট্রেনে ঘুম আসে না চন্দনের। একটা বিলাতি পেপারব্যাক পড়ছিল সে। ভূতের গল্পর বই। থ্রি টায়ার কুপেটা পুরো ফাঁকা। আগামীকাল সকাল থেকে কোনো এক রাজনৈতিক দল চব্বিশ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে। ট্রেন ভোরবেলা পৌঁছবে কলকাতাতে। ট্রেন থেকে নেমে হরতালের মুখে পড়তে হবে দেখে অনেকেই ট্রেনের টিকিট ক্যানসেল করেছে। চন্দনের অবশ্য সে সমস্যা নেই। শিয়ালদার কাছে অক্রুর দত্ত লেনের একটা মেসে একলা ভাড়া থাকে সে। বন্ধ-হরতাল যাই হোক না কেন ট্রেন থেকে নেমে টুক করে বাড়ি পৌঁছে যাবে সে। তাই এ ট্রেনে চেপে বসেছে চন্দন।
শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ার পর থেকেই থেমে থেমে ঢিকির ঢিকির করে চলছিল ট্রেন। মালদাতে যখন ট্রেন এসে পৌঁছল তখন রাত দুটো। বইয়ের থেকে মুখ তুলে কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে জানলার বাইরে তাকাল চন্দন। শীতের রাত আর পরদিন হরতাল বলেই সম্ভবত স্টেশনটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। বাইরের দিকে তাকিয়ে চন্দন মনোনিবেশ করল বইয়ের পড়াতে। বেশ অনেকটা সময় পর ট্রেনটা দুলে উঠল। যাক আবার চলতে শুরু করেছে ট্রেন। ঠিক এই সময় কুলির মাথায় বিরাট একটা টিনের বাক্স নিয়ে হুড়মুড় করে কুপের মধ্যে প্রবেশ করলেন এক ভদ্রলোক। কুলির মাথা থেকে টিনের বড়বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে ভদ্রলোকের হাত থেকে টাকা নিয়ে দৌড় লাগাল ট্রেন থেকে নামার জন্য। বাক্সটার ওপর চোখ পড়তে বেশ একটু অবাক হল চন্দন। কালো রঙের বাক্সটার ডালার ওপর সাদা রং দিয়ে একটা খুলি যার আড়াআড়ি ভাবে দুটো হাড় আঁকা আছে! অনেকটা বিপদ চিহ্নর মতো! বাক্সটার মধ্যে বিস্ফোরক বা বিপদজনক কিছু আছে নাকি? মনে মনে ভাবল চন্দন। সে এবার তাকাল তার ঠিক মুখোমুখি বসে থাকা লোকটার দিকে। শ্যামবর্ণ, ঢ্যাঙা-সিড়িঙ্গে চেহারা, তীক্ষ্ণ পাতলা নাকের নীচে যত্নে লালিত সরু গোঁফ। ভদ্রলোকের আঙুল ভর্তি নানা রঙের আংটি। পরনে সাদা ট্রাউজারের ওপর পুরোনো লাল কোট, গলাতে একটা কালো সিল্কের রুমাল বাঁধা। ভদ্রলোকের সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি হেসে বললেন, ‘কী ভাবছেন, আমার ওই বাক্সতে ডিনামাইট বা বিস্ফোরক আছে নাকি?’
চন্দন মৃদু হেসে বলল, ‘কি ভাবে বুঝলেন আমি এ কথা ভাবছি?’
ভদ্রলোক তার মাথার পেতে আঁচড়ানো চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘থট রিডিং মশাই, থট রিডিং। এটা আমার পেশার একটা অঙ্গ। পঁচিশ বছর এ লাইনে কেটে গেল মশাই। চন্দন বলল, ‘এ লাইন মানে?’
ভদ্রলোক চন্দনের প্রশ্ন শুনে কোটের পকেট হাতড়ে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে সেটা এগিয়ে দিলেন চন্দনের দিকে। চন্দন কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে ইংরাজি হরফে লেখা—
‘এস পুতিতুন্ডি
দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান।
হুডিনি অব ইন্ডিয়া।’
কার্ডের পিছনে ভদ্রলোকের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর লেখা। তা দেখে চন্দন বলল, ‘ও আপনি ম্যাজিশিয়ান!’ ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। আসল নাম, সত্যচরণ পুতিতুন্ডি। মালদার এক গ্রামে শো করতে গেছিলাম। শেষ হতে দশটা বাজল। ফেরার পথে গাড়ি পাংচার হল। ভাগ্যিস গাড়িটা লেট ছিল। নইলে মিস করতাম। ওই বাক্সে আমার ম্যাজিকের সাজসরঞ্জাম আছে। তা আপনার পরিচয়টা?’ চন্দন জবাব দিল, ‘চন্দন মজুমদার। মেডিকাল রিপ্রেজেনটেটিভ। শিলিগুড়ি এসেছিলাম, কলকাতা ফিরছি।’ জবাব দিয়ে চন্দন কার্ডটা ফেরত দিতে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন, ‘ওটা আপনার কাছেই থাক।’
‘থ্যাংক্যু’ বলে চন্দন আবার মনোনিবেশ করল বইয়ের পাতাতে। এবার বেশ জোরে ছুটতে শুরু করেছে ট্রেন।
|| ২ ||
বইটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আধঘণ্টার মধ্যে বইয়ের বাকি পাতাগুলো শেষ করে বইটা পাশে রাখল। এবার বাকি রাতটা এমনিই বসে কাটাতে হবে চন্দনকে। সে ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তার মনে হল তিনিও কেমন যেন একটু উসখুস করছেন! এরপর জাদুকর সত্যচরণ চন্দনকে বললেন, বুঝলেন মশাই, ‘আমার এই এক সমস্যা, রাতে ঘুম আসে না।’
চন্দন হেসে বলল, ‘রাতের ট্রেনে আমারও ঘুম আসে না।’
ভদ্রলোক কথাটা শুনে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আপনি দাবা খেলতে পারেন?’
চন্দন বলল, ‘ভালো না খেললেও, খেলাটা জানি।’
সত্যচরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘খেলবেন? তাহলে বাকি রাতটা কেটে যাবে।’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, খেলা যেতে পারে। ভোরের আলো ফুটতে এখনও ঘণ্টা তিনেক বাকি।’ কথাটা শুনে জাদুকর সত্যচরণ পকেট থেকে একগোছা চাবি বার করে বাক্সটার ওপর ঝুঁকে পড়ে তালা খুললেন। তারপর বাক্স হাতড়ে রোল করা একটা মোটা কাগজের মতো জিনিস আর একটা ছোটো কার্ডের বাক্স বার করে চন্দনের বার্থে এসে বসলেন। গোটানো পার্চমেন্ট কাগজের মতো জিনিসটা খুলে তিনি সেটা পাতলেন তাঁদের দুজনের মাঝখানে। সেটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা দাবার ছক। স্থানে স্থানে রং চটে ফেটে গেছে। এরপর কাঠের বাক্স থেকে ঘুঁটিগুলো বার করলেন তিনি। আকারে ছোট ঘুঁটিগুলো কেমন যেন ছিরিছাঁদহীন। মেশিনে নয় সম্ভবত হাতে বানানো। সাদা গুটিগুলো পুরোনো হয়ে হলদেটে হয়ে গেছে, আর কালো গুটিগুলোর রং চটে ভিতরের সাদা অংশ বেরিয়ে পড়েছে। একটা গুটি হাতে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে সেটা একটু অন্যরকম বুঝতে পেরে চন্দন জানতে চাইল, ‘এটা কি দিয়ে বানানো?’ সত্যচরণ জবাব দিলেন, ‘হাড়ের। মানুষের হাড়ের। আর এই যে দাবার ছকটা দেখছেন এটা শিয়ালের চামড়ার তৈরি।’ কথাটা শুনে চন্দন বিস্মিত ভাবে বলল, ‘এই অদ্ভুত জিনিস আপনি পেলেন কোথায়?’
জাদুকর সত্যচরণ রহস্যপূর্ণ ভাবে হেসে বললেন, ‘চলুন সে গল্প আপনাকে খেলতে খেলতে বলি। সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলব। সেবারও আমি প্রথম সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলেছিলাম।’
ঘুঁটি সাজানো হয়ে গেল। দাবার ঘুঁটির প্রথম চালটা দিয়ে সত্যচরণ বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনি—’তখন আমার বছর পঁচিশেক বয়স হবে। আমার গুরু হংসরাজের কাছে বছর তিনেক শিক্ষানবিশ হিসাবে কাটিয়ে তারই নির্দেশে একলা এ পেশায় নেমে পড়েছি। বেড়ে লোক ছিলেন হংসরাজ। তিনি ছিলেন ‘স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান’ ওই যাকে বলে বাজিকর। জানেন তো রাস্তাতে জাদু দেখানো সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। পিঠে একটা ঝোলা নিয়ে সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন তিনি। নেপাল বার্মাতেও গেছিলেন। তাঁর ঝুলিতে যে কত অভিজ্ঞতা ছিল তার ঠিক নেই। আর তেমনই ছিল তাঁর হাতসাফাইয়ের খেল। লোকে বলত, ইচ্ছা করলে তিনি নাকি দু-হাত দিয়ে আস্ত মানুষকে হাপিশ করে দিতে পারতেন। আর অসম্ভব ভালো ‘থট রিডিং’-ও জানতেন হংসরাজ। কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে তিনি গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন, তার মনের কথা। আমার গুরুর কথা বলে নিলাম এ কারণে, যে গল্প বলতে যাচ্ছি তার সাথে আমার গুরুর একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে।’
চন্দন একটা চাল দিল। সত্যচরণ পাল্টা চাল দেবার জন্য একটা ঘুঁটি তুলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা—
‘হ্যাঁ, এবার আসল গল্প শুরু করি। গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে তো আমি পথে নেমে পড়লাম। সম্বল বলতে একটা ছোটো টিনের বাক্স মাত্র। পূজা, পার্বণ, মেলা উপলক্ষে নানা গ্রামগঞ্জে-হাটেবাজারে খেলা দেখিয়ে বেড়াই। সামান্য যা কিছু রোজগার হয় তা পথেই শেষ হয়ে যায়। মাথা গোঁজার আশ্রয় বলতে হয়তো কখনও কোনো ক্লাব ঘর, মন্দিরের চাতাল, স্কুলবাড়ির বারান্দা এসব। এমন কি করবখানাতেও রাত কাটিয়েছি আমি। তা সেবার গেছিলাম শিকারপুর আষাঢ় অমাবস্যার মেলাতে…’
‘শিকারপুরটা কোথায়?’ –একটা চাল দিয়ে জানতে চাইল চন্দন। টপ করে একটা ঘুঁটি খেয়ে সত্যচরণ বললেন—’নদিয়ার শেষ প্রান্তে বাংলাদেশের কাছে। মেলা যে মাঠে বসে তার পাশেই একটা শ্মশান। আসলে সেই শ্মশানকালীর পূজা উপলক্ষেই মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে গ্রামের মানুষরা আসে সেখানে। আমি তার আগে কোনোদিন ও মেলাতে যাইনি। একজনের থেকে খবর পেয়ে সেবারই প্রথম গেছিলাম সে মেলাতে। আমি যখন বেলা দশটা নাগাদ মেলার মাঠে পৌঁছলাম তার আগেই মাঠের আসল জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে অন্য ব্যবসায়ীরা। তাঁবু, ঘেরা এসব বসিয়ে ফেলেছে। মেলার কর্মকর্তাদের ধরাধরি করতে তারা আমাকে একটা স্থান দিল বটে কিন্তু সেটা মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে শ্মশান লাগোয়া একটা জায়গা। আমার পিছনেই কিছুটা তফাতে চিতার পোড়া কাঠ, মেটে হাঁড়ি, মৃতদেহের কাপড় এসব পড়ে আছে। শ্মশানের শেষ প্রান্তে শনের ছাউনি আর দরমার বেড়া দেওয়া একটা ঘর চোখে পড়ল আমার। স্থানীয় একজনের মুখে শুনলাম ও বাড়িতে নাকি এক ‘ভৈরব’ অর্থাৎ শ্মশানচারী তান্ত্রিক থাকেন, কালভৈরব তাঁর নাম। লোকে বলে তিনি নাকি মরা মানুষও বাঁচিয়ে দিতে পারেন !
যাই হোক আমাকে যে জায়গা দেখানো হল সেখানে একটা পাকুড় গাছের নীচে একটা শামিয়ানা টাঙিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে বসলাম। খেলার সরঞ্জাম যখন গোছাচ্ছি তখন দেখলাম একদল লোক একটা মড়া ঘাড়ে করে আনছে মাচানে শুইয়ে। শ্মশান যখন তখন মড়া আসতেই পারে। শববাহী লোকগুলো আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের আমি ‘কার মড়া’ জিজ্ঞেস করতে তারা বলল ওটা নাকি চালকলের মালিক রাধেশ্যাম সাহার ছেলের দেহ। গতকাল দুপুরে চালের গুদামে বস্তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটা খরিশ গোখরা। চালের বস্তা সরাতে যেতেই ছোবল মেরেছে। লোকগুলো পোড়াবার জন্য নয়, কালভৈরবের কাছে ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছে যদি তিনি শেষ পর্যন্ত ছেলেটার জীবন ফেরাতে পারেন সে জন্য। কথাটা শুনে আমি মনে মনে হাসলাম। একবার কেউ মারা গেলে কি তার জীবন ফেরে? তবে কুসংস্কারবশত গ্রামগঞ্জে সাপে কাটা মড়াকে এমনই অনেক সময় ওঝাগুনিন-তান্ত্রিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাণ ফেরানোর জন্য। যদিও আমি মুখে কিছু বললাম না তাদের।’
|| ৩ ||
ট্রেনটা বেশ জোরে ছুটছে। সম্ভবত লেট টাইমটা পুষিয়ে নেবার জন্য। খেলাও চলছে। বেশ কয়েকটা চাল দিয়ে সত্যচরণ আবার বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা—’হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ছেলেটার মড়া কাঁধে লোকগুলো চলে যাবার পর আমি আমার চোঙাটা ফুঁকতে শুরু করলাম। দুপুর হবার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় লোক জমতে শুরু করেছে। চোঙার শব্দে একজন-দুজন করে আমার কাছেও লোক জমতে শুরু করল। আর আমিও খেলা দেখাতে শুরু করলাম। রুমালের খেলা, তাসের খেলা, হাতসাফাইয়ের খেলা। একসময় খেলা বেশ জমে উঠল। বেলা গড়াতে লাগল বিকালের দিকে। কিন্তু বিকাল চারটে নাগাদ হঠাৎই ধীরে ধীরে আকাশ কালো হতে শুরু করল। ভরা বিকালেই যেন নামতে শুরু করল রাত্রির অন্ধকার। খেলা ভেঙে গেল। লোকজন মাঠ ছেড়ে সব ছুটল আসন্ন বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য। আমিও আমার জিনিষপত্র গুটিয়ে কোথাও পালাব ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই বৃষ্টি নেমে গেল। ও সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি আর তার সাথে কান ফাটানো বাজের গর্জন। পৃথিবী যেন রসাতলে যাবে। পাকুড় গাছটার গুঁড়ির নীচে খোদলের মতো এক জায়গাতে কোনোরকমে জিনিসপত্র আগলে ধরে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। এক-ঘণ্টা-দু-ঘণ্টা-তিন-ঘণ্টা! বৃষ্টি থামার বিরাম নেই। অমন বৃষ্টি জীবনে কোনো দিন দেখিনি! সত্যিই অন্ধকার নেমে গেছে তখন আমি গাছের তলাতে বসেই রইলাম। তখন আনুমানিক রাত আটটা বাজে। বৃষ্টিটা মৃদু ধরে এল। আমি ভেবে নিলাম এই সুযোগে আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে। কাছাকাছি গ্রামে কারো বাড়িতে বা মন্দির চাতালে যদি আশ্রয় পাওয়া যায়? আমি ইতিমধ্যে জলের ছাঁটে প্রায় ভিজে গেছি। কর্তব্য স্থির করে আমি উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো একটা লোক। বিদ্যুতের আলোতে আমি দেখলাম তাকে। রক্তাম্বর পরা, জটাজুটধারী একটা লোক। গলায়-হাতে অনেকগুলো তাবিজ-কবচ আছে। একটা কচুপাতা সে নিজের মাথায় হাতার মতো ধরে রেখেছে। আমার উদ্দেশে সে প্রশ্ন করল ‘কোথা থেকে এসেছ তুমি?’
আমি তাকে আমার পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘এখানে রাত কাটাবার জন্য কোনো আশ্রয় আছে?
আমার কথা শুনে লোকটা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, ‘তুমি দাবা খেলতে জান?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ, অল্পস্বল্প জানি। কেন বলুন তো?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আমার নাম কালভৈরব। ওই যে শ্মশানের শেষ মাথায় আমার বাড়ি। আজ রাতে আমি দাবা খেলার জন্য একটা লোক খুঁজছি। আমার ঘরে গিয়ে দু-জনে দাবা খেলে রাতটা কাটানো যেতে পারে। এত রাতে কোথায় আশ্রয় খুঁজতে যাবে? অপরিচিত লোককে হয়তো কেউ আশ্রয় দেবে না। বর্ষার বৃষ্টি আবারও জোর হতে পারে।’ এই তবে সেই শ্মশানচারী কালভৈরব তান্ত্রিক! আমি অবশ্য এদেরকে বিশেষ ভয়টয় পেতাম না। তা ছাড়া সামান্য কিছু খুচরো টাকাপয়সা ছাড়া এমন কিনেই যে সে হাতিয়ে নিতে পারে। লোকটার কথায় বরং হাতে চাঁদ পেয়ে আমি বললাম, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই। চলুন তবে।’
কোথায় যেন একপাল শিয়াল ডেকে উঠল। গাছের তলা ছেড়ে বাক্স কাঁধে শ্মশানের পোড়া কাঠ মাড়িয়ে আমি চললাম কালভৈরবের ডেরার দিকে।’ –এই বলে থেমে গেলেন সত্যচরণ।
জাদুকর সত্যচরণের গল্প শুনতে শুনতে একটু মনোসংযোগ নষ্ট হয়েছিল চন্দনের। একটা ভুল চাল দিয়েছিল সে। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই সত্যচরণ একটা গজ দিয়ে চন্দনের মন্ত্রীটাকে উড়িয়ে দিলেন। উভয় পক্ষকে কিছু সময় ধরে নিশ্চুপভাবে ঘুঁটি চালার পর আবার তাঁর অসমাপ্ত কাহিনি শুরু করলেন সত্যচরণ পুতিতুণ্ডি—
|| 8 ||
‘কালভৈরবের পিছন পিছন তাঁর ডেরাতে গিয়ে ঢুকলাম আমি। একটাই ঘর তবে ঘরের একপাশে দরমার বেড়া দিয়ে একটা পার্টিশান করা আছে। ঘরের মধ্যে একটা তেলের কুপি জ্বলছে, মাটির মেঝেতে একটা তালপাতার মাদুর বিছানো। ঘরের মধ্যে যেন কেমন একটা মৃদু পুতিগন্ধ আছে। মাদুরটা দেখিয়ে তান্ত্রিক আমাকে বললেন, ‘তুমি ওখানে বসো। আমি দাবাটা আনি—এই বলে তিনি দরমার বেড়ার ওপাশে চলে গেলেন। বাক্সটা মেঝেতে নামিয়ে মাদুরে বসলাম আমি। আর তারপরই আমার চোখ পড়ল ঘরের একপাশে মাটিতে শোয়ানো একটা চাদর ঢাকা দেহের ওপর। কাপড়ের তলা থেকে তার পায়ের পাতা দুটো শুধু বেরিয়ে আছে। আর যেই ফোলা পায়ের পাতা দেখে আমার মনে হল ওটা কোনো মৃতদেহই হবে! আমি সাহসী, কিন্তু ওই মৃতদেহটা দেখে বুকটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল। ঠিক এই সময় বেড়ার ওপাশ থেকে দাবার ছক আর গুটির বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এলেন কালভৈরব। সম্ভবত আমার মনের ভাব পাঠ করেই তিনি বললেন, ‘ওটা একটা চোদ্দো বছরের কিশোরের সাপে কাটা দেহ। আমার কাছে দিয়ে গেছে। ওর বাবা বলেছে ওকে যদি বাঁচিয়ে তুলতে পারি তবে এখানে একটা শ্বেতপাথরের মন্দির বানিয়ে দেবে। বাবাকে নাকি বড় ভালোবাসত ছেলেটা।’ বুঝলাম এই সেই দেহটা। সকালে যে দেহ বসে আনতে দেখেছিলাম আমি।
কথাটা জানিয়ে আমার সামনে মাদুরে বসে পড়লেন কালভৈরব। দাবার ছক আর গুটিগুলো দেখে আশ্চর্য হয়ে আমি বললাম, ‘ঘুঁটি আর ছকগুলো খুব অদ্ভুত তো!’
কালভৈরব মৃদু হেসে বললেন, ‘এ হল আমার দাবার ছক। ছকটা দিয়ে ডামরীদের সাথে দাবা খেলি আমি। অর্থাৎ অপদেবীদের সাথে। তবে এখন তোমার সাথে খেলব। ছকটা কালো শিয়ালের চামড়ার। খুঁটিগুলো মানুষের হাড়ের। আমিই বানিয়েছি।’
অপদেবীদের সাথে তান্ত্রিক এ ছকে খেলেন কিনা সে সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ থাকলেও তবে শেয়ালের চামড়ার ছক, মানুষের হাড়ের ঘুঁটি, কিছুটা তফাতে কাপড় ঢাকা ছেলেটার লাশ সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি তৈরি হল আমার মনে। তবে তখন তো আর উঠে আসা যায় না। আর এই দাবার ছকের আর ঘুঁটিগুলোর কথা শুনে আমার যেন মনে হল আমার গুরুদেব হংসরাজ যেন আমাকে কী একটা গল্প করেছিলেন এমন একটা দাবার ছকের ব্যাপারে তবে ততক্ষণাৎ গল্পটা মাথায় এল না আমার। বাইরে আবার প্রবল মেঘ গর্জনের সাথে সাথে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হল। খেলা শুরু করলাম আমরা। ধীর গতিতে চাল দিতে শুরু করলাম দুজনেই।
কিছুক্ষণ পরই আমি বুঝতে পারলাম কালভৈরব পাকা দাবাড়ু। একটার পর একটা ঘুঁটি খাচ্ছেন তিনি। আর তারপরই কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছেন মড়াটার দিকে।
চাল দিতে দিতে আমার মনের ভিতর কেন জানি খালি এ প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগল, হংসরাজ যেন কী বলেছিলেন কী বলেছিলেন আমাকে? খেলা এগিয়ে চলল, বাইরে বেড়ে চলল রাত।
খেলা তখন প্রায় শেষের পথে, আমার অর্ধেক ঘুঁটি খেয়ে কালভৈরব চারপাশ থেকে চেপে ধরেছেন আমাকে। বাইরের শ্মশান থেকে একপাল শেয়াল হঠাৎ করুণ স্বরে ডেকে উঠল। আর তার সাথে সাথেই আমার মনে পড়ে গেল এই দাবার ছকের সম্বন্ধে গুরুদেবের কাছে শোনা কথা। মনের ভিতর চমকে উঠলাম আমি। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল আমার। বুঝতে পারলাম এ খেলাতে যে ভাবেই হোক আমাকে জিততেই হবে। নইলে সমূহ বিপদ! রাজাকে মারার আগে আমার একটা ঘোড়া মেরে যেই না মড়াটার দিকে তাকিয়েছেন, অমনি আমি হাতসাফাই করে দুটো মোক্ষম গুটি সরিয়ে দিলাম। কাজটা আমাকে তখন করতেই হত। এ ছাড়া কোনো পথ ছিলো না। কালভৈরব তন্ত্রসিদ্ধ হতে পারেন, ডামরীদের নিয়ে দাবা খেলতে পারেন ঠিকই, কিন্তু হাতসাফাইয়ে হংসরাজের শিষ্য আমি। হাতসাফাই আমার পেশা। কাজেই কালভৈরব ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। আর এর পরের দানেই দুটো ঘুঁটি সদ্দিয়ে ফেলার সদব্যবহার করে আমি কিস্তিমাত করে দিলাম কালভৈরবকে।
কালভৈরব প্রথমে তাকালেন আমার দিকে। তাঁর দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তিনি যে হেরে গেছেন তা যেন ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছেন না। বিস্ফোরিত তার চোখ। আর এরপরই তিনি নিজের বুকের বাঁ দিকটা খামচে ধরলেন। থরথর করে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল তাঁর শরীর। তার জিভটা যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একপাশে গড়িয়ে পড়লেন তিনি! আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে ওপর ঝুঁকে তাঁর বুকে হাত দিয়ে বলতে লাগলাম ‘কালভৈরব আপনার কী হল? চোখ খুলুন। আর এরপরই তাঁর নাড়ি টিপে আমি বুঝতে পারলাম কালভৈরব তান্ত্রিক আর কোনো দিনই জাগবেন না। মারা গেছেন তিনি।
কালভৈরবের হাতটা আমি মাটিতে নামিয়ে রাখছি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা খড়খড় শব্দ শুনে একপাশে তাকালাম আমি। যা দেখলাম তাতে আমার শরীর রক্তহীন হয়ে গেল। যেন পাথর হয়ে গেলাম আমি। দেখলাম কাপড় সরিয়ে উঠে বসেছে সেই ছেলেটা। বাসি মড়ার মতো তার ফোলাফোলা মুখ। সাপে কাটলে মুখ দিয়ে যে গেঁজা বেরোয় তা শুকিয়ে সাদা হয়ে লেপ্টে আছে ঠোঁটের কোণের দু-পাশে। চোখের মণির দৃষ্টি ফেরেনি তখনও। স্থির ঘোলাটে চোখ তার! দুলতে দুলতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে উঠে দাঁড়াল সেই বীভৎস মূর্তি। যেন অনেক দূরের ঘুমের দেশ থেকে সে ফিরে এসেছে! টলতে টলতে আমাদের পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সেই মূর্তি। বাইরের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘বাবা তুমি কোথায়? আমি তোমার কাছে যাব।’
তার সেই আর্তনাদ যেন কাঁপন ধরিয়ে দিল আমার শরীরে। এ তো কোনো কিশোরের কণ্ঠস্বর নয়! এ তো তান্ত্রিক কালভৈরবের ভরাট গলা! যে আমার সামনে মাটিতে পড়ে আছে! ‘বাবা তুমি কোথায়? তুমি কোথায়?’ বলতে বলতে এরপর প্রবল বর্ষণের মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। বিদ্যুৎ চমকে মাঝে মাঝে দেখা যেতে লাগল তার চলমান দেহটা। তারপর সে হারিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। কালভৈরবের আত্মা নিয়ে প্রাণ ফিরে পেল ছেলেটার দেহ। আমার ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। আর আমিও এরপর সেই ঘরের মধ্যে কালভৈরবের মৃতদেহ ফেলে রেখে আমার বাক্স নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই সোজা ছুটলাম স্টেশনের দিকে। হ্যাঁ, ঘর থেকে বেরোবার আগে আমি বাক্সের মধ্যে ভরে নিয়েছিলাম এই দাবার ছক আর গুটিগুলো। এগুলো তো আর কোনো কাজে আসত না — গল্প শেষ করলেন সত্যচরণ।
চন্দন এতক্ষণ ধরে দাবা খেলতে খেলতে তাঁর এই অদ্ভুত, বিস্ময়কর গল্প শোনার পর বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, ‘কিন্তু আপনাদের দুজনের দাবা খেলার সাথে কালভৈরবের মৃত্যু বা ছেলেটার বেঁচে ওঠার সম্পর্ক কি?’ জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘আছে, আছে। আমার গুরু হংসরাজের মুখ থেকেই আমি প্রথম শুনেছিলাম এই ছকের গল্প। তাঁর বলা এ ছকের গল্প কালভৈরবের সাথে খেলার সময় মনে পড়ে যাওয়াতেই দাবার ঘুঁটি হাতসাফাই করে সে যাত্রায় বেঁচে গেছিলাম আমি। নইলে হয়তো শিকারপুরে কোনো চালের আড়তে অন্যের শরীরে জীবন কাটাতে হত আমাকে। হংসরাজ আমাকে এই ছকের ব্যাপারে যা বলেছিলেন তা হল বিশেষভাবে প্রস্তুত এই দাবার অথবা পাশার ছককে বলে ‘প্রেত ডামরী’ ছক। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে প্রস্তুত এই ছক নিয়ে মৃতদেহের পাশে খেলতে বসতে হয়। খেলাতে যে পরাজিত হয় তার আত্মা প্রবেশ করে মৃতদেহের শরীরে। জীবন ফিরে পায় দেহ। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমাকে নিয়ে কেন দাবা খেলতে বসেছিলেন কালভৈরব।’ — কথাগুলো বলে দাবার শেষ চালে চন্দনকে কিস্তিমাত করে সত্যচরণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগল গল্পটা?’
চন্দন বলল, ‘বেশ ভালো। তবে এমনও তো হতে পারে যে কালভৈরব হার্ট অ্যাটাক করে হঠাৎ মারা গেছিল আর ছেলেটা হয়তো আসলে জীবিতই ছিল? পরে খোঁজ নিয়েছিলেন ছেলেটার?’ ― ছক আর দাবার গুটি গুছিয়ে বাক্সে ভরে জাদুকর সত্যচরণ পুতিতুন্ডি বললেন, ‘পাগল নাকি? জীবনে আর শিকারপুরমুখো হইনি। যদি সে আমাকে চিনে ফেলে? পরে ঘুঁটি সরানোর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে থাকে? — এ ভয়ে সেদিকে যাইনি। – এই বলে চুপ করে গেলেন তিনি।
চন্দন আর কোনো তর্ক করল না তার সাথে। চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। শেষ রাতের দিকে বর্ধমানের কাছে গাড়ি পৌঁছতেই সত্যচরণ উঠে দাঁড়িয়ে বাক্সটা তুলে নিয়ে হেসে বললেন, আমি বর্ধমানে নামব। আগামীকাল একটা শো আছে। কলকাতাতেই তো আমাদের দুজনের বাড়ি। কার্ডে ঠিকানা লেখা আছে। চলে আসুন একদিন আমার বাড়ি। আমার এ বাক্সে আরও এমন অনেক অদ্ভুত গল্প আছে।’
চন্দন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আসব।’
তার জাদুকরী গল্পের বাক্স নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সত্যচরণ পুতিতুন্ডি।