জাদুকর সত্যচরণ ও তোতাপুরি পাঁঠা

জাদুকর সত্যচরণ ও তোতাপুরি পাঁঠা

|| ১ ||

কথায় বলে, রেল স্টেশনের কাছে যাঁদের বাড়ি, তারাই স্টেশনে দেরীতে পৌঁছে ট্রেনে উঠতে পারেনা। চন্দনের অবস্থাও অনেকটা তেমনই হলো। তার অক্রুর দত্ত লেনের মেস বাড়ি থেকে যেখানে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিট। কিন্তু সকাল দশটায় সেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র খুললেও চন্দনের সেখানে পৌঁছতে বেলা এগারোটা বেজে গেল। চন্দন দেখল ইতিমধ্যেই অন্তত দু-আড়াইশ মানুষ উপস্থিত হয়েছে টিকা নেবার জন্য।

আসলে চন্দনের এদিনই ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় টিকা নেবার দিন। চন্দন ঠিক করে রেখেছিল কাজে বেরোবে না। বেলা আটটা পর্যন্ত বিছানাতেই শুয়ে ছিল সে। রান্নার ঠাকুর জগন্নাথ এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। তাই ইদানিং চন্দনকে নিজেই রান্না করে খেতে হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে সে গেছিল বাড়ির কাছেই শিয়ালদার কোলে মার্কেটে। রান্নার ঠাকুর ছুটিতে যাওয়ায় অসুবিধার মধ্যে একটা সুবিধাও হয়েছে চন্দনের। নিজের ইচ্ছে মতো রান্না করে সে খেতে পারছে। মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটা কচি পাঁঠা ঝুলতে দেখে এক কিলো মাংস কিনে ফেলল সে। তারপর পরিচিত এক মাছওলা তাকে একটা বর্ষার ইলিশ গছিয়ে দিল। সারা সপ্তাহর জন্য মাছ-মাংস, আনাজপাতি কিনে বাসায় ফিরতে প্রায় দশটা বেজে গেল তার। তারপর ইলিশ মাছ ভেজে, চাল ধুয়ে রাইস কুকারে চাপাতে, মাংসতে নুন-হলুদ-তেল মাখিয়ে রান্নার জন্য প্রস্তুত করে রাখতে, সব শেষে স্নান সেরে তৈরি হয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে এই বিলম্ব হল তার।

একটা কাউন্টার থেকে নাম রেজিস্ট্রি করে নম্বর লেখা কুপন দেওয়া হচ্ছে। সেই ক্রমিক সংখ্যা অনুসারেই টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত। চন্দন অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করে রেখেছে আগেই। কিন্তু কুপন নিতে হবে বলে সে লাইনে দাঁড়াল। হাতে যে কুপনটা এল তার নম্বর ঠিক দুশো! চন্দন হিসাব করে দেখল, দুশো নম্বর অন্তত তিন ঘণ্টা সময় লাগবে টিকা নেবার ডাক আসতে। ততক্ষণে সে ঘরে ফিরে মাংস রান্না করে তা দিয়ে ধীরে সুস্থে খাওয়া সেরে ফিরে আসতে পারবে। সবে মাত্র তো ইনজেকশন দেওয়া শুরু হয়েছে। এ কথা ভেবে চন্দন পা বাড়াতে যাচ্ছিল তার মেস বাড়িতে ফেরার জন্য। ঠিক সেই সময় তার সামনে এসে দাঁড়াল একজন লোক। পরনে প্যান্টের ওপর ডোরাকাটা টি শার্ট, মাথায় একটা টুপি। সেই টুপি আর মুখে বাঁধা মাস্কের ফাঁক গলে লোকটার মুখমণ্ডলে শুধু তার চোখ দুটোই দৃশ্যমান। তবুও তার ঢ্যাঙা চেহারা আর দুই হাতের আঙুলের রঙিন পাথর বসানো আঙটিগুলো দেখে চন্দন মুহূর্তর মধ্যে লোকটাকে চিনে ফেলল। আরে এ যে জাদুকর সত্যচরণ পতিতুন্ডি! দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ন, হুডিনি অব ইন্ডিয়া।’

লকডাউন ইত্যাদি বিধি নিষেধের কারণে তার সঙ্গে প্রায় এক বছর সাক্ষাৎ হয়নি চন্দনের। শেষবার ফোনে কথা হয়েছিল তার সঙ্গে, তাও মাস তিনেক হয়ে গেছে। এখানে হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে চন্দন বলল, ‘আপনি

এখানে?’

জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘টিকা নিতে এসেছি আপনারই মতো। আমার পাড়ার সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কী কারণে যেন ক-দিন ধরে টিকা দেওয়া বন্ধ আছে। খবর পেলাম এখানে টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাই চলে এলাম। কুপন নিয়ে ওই বারান্দাতে বসছিলাম। হঠাৎই আপনাকে কুপন নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে দেখলাম।’

চন্দন তাঁর কথা শোনার পর মৃদু অনুযোগের স্বরে বলল, ‘আমার পাড়াতে টিকা নিতে আসবেন, আমাকে এ কথাটা জানাননি কেন? আমি এখানে না এলেতো আপনার সঙ্গে দেখাই হত না।’

সত্যচরণ মৃদু চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘হ্যাঁ, উচিত ছিল। আসলে ফোনটা কয়েক দিন হল রিচার্জ করা হয়নি। আপনার কথা আমার মনে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু ফোনে ব্যালান্স না থাকায় ফোনটা করতে পারিনি। যাই হোক একেই মনে হয় বন্ধুত্বের টান বলে! ঠিক দেখা হয়ে গেল আপনার সঙ্গে।’

চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনি আছেন কেমন?’ জবাবে সত্যচরণ বললেন, ‘শরীরের কথা যদি বলেন, তবে বলব এই করোনা কালে এখনও পর্যন্ত শরীর ঠিকই আছে। কিন্তু এক বছর হতে চলল, লকডাউন আর নানা নিয়ম নীতির কারণে স্কুল, কলেজ, আমোদ প্রমোদের অনুষ্ঠান সবই তো বন্ধ। তাই কেউ ডাকছেও না আমাকে। আর এ অবস্থায় যে কোথাও যাব সে উপায়ও নেই। ঘরেই বসে আছি। সামান্য কিছু জমানো টাকা ছিল তাই ভাঙিয়ে ঘর ভাড়া দিচ্ছি আর কোন রকমে খাচ্ছি। জমানো টাকাও শেষ হয়ে এল বলে।’

সতাচরণের কথা শুনে বেশ খারাপ লাগল চন্দনের। করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারী নানান বিধি নিষেধের ফলে অনেকের রুটি-রুজিতে টান পড়েছে। জাদুকর সত্যচরণ তেমনই একজন মানুষ। যতই তিনি তাঁর নামের পিছনে ‘গ্রেট ম্যাজিশিয়ান — হুডিনি অব ইন্ডিয়া’ লিখুন না কেন, আসলে তিনি একজন অতি সাধারণ মানুষ। স্কুল কলেজ, ক্লাবে ম্যাজিক দেখিয়ে পেট চলে তাঁর। কিন্তু আয়ের সে পথ এখন বন্ধ। সত্যচরণের ফোন রিচার্জ না করতে পারার কারণ যেন চন্দন অনুমান করতে পারল। মৃদু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চন্দন বলল, ‘আপনারা জাদুকররা কত কিছু ভ্যানিশ করেন। বড়ো বড়ো জাদুকররা ট্রেনও ভ্যানিশ করেন বলে শুনেছি। আপনারা যদি এই করোনা ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে ভ্যানিশ করে দিতে পারতেন তবে কত ভালো হত!’

সত্যচরণ বললেন, ‘আমরা ম্যাজিশিয়ান হলেও মানুষ। সাধারণ মানুষের কি সে ক্ষমতা আছে? একে একমাত্র ভ্যানিশ করতে পারেন তিনি, যিনি সব চেয়ে বড়ো ম্যাজিশিয়ান, অর্থাৎ ওপরওলা।’ একথা বলে তিনি আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।’

এরপর তিনি চন্দনকে বললেন, ‘আপনার কাজকর্ম চলছে কেমন?’

চন্দন জবাব দিল ‘আমাদের তো ওষুধপত্র নিয়ে কারবার। তাই খুব একটা হেরফের হয়নি। তবে সব মানুষের মতো কিছু সমস্যা আমাকেও ভোগ করতে হচ্ছে।’

জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘আপনার নম্বর কত? আমার একশ আশি।’

চন্দন হেসে বলল, ‘আমার দুশো। যা অবস্থা দেখছি তাতে ঘণ্টা তিনেকের আগে ডাক আসবে বলে মনে হয় না।’

সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমারও তো একই অবস্থা। ভাবছিলাম, এখানেই অপেক্ষা করব, নাকি ঘর থেকে ঘুরে আসব?’

চন্দন বলল, ‘এই রোদের মধ্যে আপনাকে আর্মহাস্ট্র স্ট্রিট যাওয়া আসা করতে হবে না। আমার বাসায় চলুন, জমিয়ে গল্প হবে।’

সত্যচরণ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিন্তু এ অবস্থায় কি সেখানে যাওয়া ঠিক হবে? কোন অধুবিধা হবে না তো?’

চন্দন বলল, ‘না, কোনও অসুবিধাই হবে‌না।‌ আমার থাকার জায়গা তো আপনি দেখেইছেন। নামেই ওটা মেস। আলাদা আলাদা যে যার মতো থাকি। তাছাড়া খাওয়া ব্যাপারটাও এখন যে যার মতো করে নিচ্ছি। আজ খুব ভালো বাজার করেছি। চলুন, দুজনে মিলে দুপুরে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে খাওয়া সেরে তারপর আবার এখানে আসা যাবে।

সত্যচরণ বললেন, ‘সে কী মশাই, আনি গেলে আপনার খাবারে টান পড়বে। এমন হুট করে যাব।’

চন্দন বলল, ‘আমি সারা সপ্তাহের বাজার সেরে রেখেছি। ওসব না ভেবে এখন আমার সঙ্গে চলুন। গিয়েই মাংসটা চাপিয়ে দিয়ে আড্ডায় বসব।

চন্দনের মনে হল সত্যচরণ মুখে যতই সঙ্কোচ ভাব প্রকাশ করুন না কেন, তাঁর চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এরপর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন তবে চলুন। তবে কাছে পিঠে কী কোনও মিষ্টির দোকান আছে? তাহলে দুটো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই?’

চন্দন এবার গম্ভীর ভাবে বলল, ‘দোকান আছে ঠিকই কিন্তু আমার ফ্রিজেও মিষ্টি আছে।’

জাদুকর সত্যচরণ এরপর আর কোনও কথা না বলে চন্দনকে অনুসরণ করলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রর ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে চন্দন, সত্যচরণকে নিয়ে চলল তার মেস বাড়িতে।

|| ২ ||

চন্দন নিজের ঘরে ঢুকে জাদুকর সত্যচরণকে বললেন, ‘নিন, আরাম করে সোফায় বসুন। আমি দশ মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে আসছি।’ বলে সে পাখাটার সুইচ দিয়ে পাশের ঘরটাতে চলে গেল। মাংসটা প্রেশার কুকারেই ছিল। সেটা ওভেনে বসিয়ে, ইলেকট্রিক রাইস কুকারের সুইচ দিয়ে, দু-কাপ চা বানিয়ে ঘরে ফিরতে দশ মিনিটই লাগল। একটা চায়ের কাপ সত্যচরণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাচের টেবিলের উলটো দিকে তাঁর মুখোমুখি বসে বলল, ‘আর কোনও চিন্তা নেই। ভাত, মাংস দুটোই বসিয়ে দিয়ে এলাম। আমরা গল্প করতে করতে রান্না‌ হয়ে  যাবে।’

মুখের মাস্কটা থুতনিতে নামিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে সত্যচরণ জানতে চাইলেন, ‘কীসের মাংস?’

চন্দন বলল, ‘পাঁঠার মাংস। আপনার চলে তো?’

আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠল সত্যচরণের চোখ দুটো। তিনি প্রথমে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সব খাই। এখন পাঁঠার মাংসের যা দাম! অনেক দিন খাওয়া হয়নি।’

তাঁর কথা শুনে চন্দন মনে মনে ভাবল, সত্যচরণের আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। থাক, মাংস ভাত খাইয়ে সে অন্তত কিছুটা তৃপ্তি দিতে পারবে তাঁকে।

এরপর সত্যচরণ বললেন, ‘তবে এক সময় আমি বেশ কয়েক বছর পাঁঠার মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। পাঁঠার মাংসের কথা শুনলেই আমার মনে পড়ত নবাবের কথা। সে ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল।’

চন্দন প্রশ্ন করল, ‘নবাব কে? কোন ঘটনা?’

চন্দনের এ প্রশ্নর জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন সত্যচরণ। তিনি বললেন, ‘তবে সে ঘটনা আপনাকে খুলেই বলি -‘

চন্দনও যেন প্রস্তুত ছিল, জাদুকর সত্যচরণের মুখ থেকে তাঁর বিচিত্র জীবনের কোনও নতুন কাহিনি শোনার জন্য। সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন।’

পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে বেশ আয়েশ করে চায়ের কাপে বেশ কয়েকটা লম্বা চুমুক দিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনি –

‘আপনি ‘হরিহর ছত্র’ মেলার নাম হয়তো শুনে থাকবেন, পোশাকি নাম শোনপুর মেলা। এশিয়ার বৃহত্তম, প্রাচীনতম পশু মেলা। গঙ্গা ও গণ্ডক নদীর সঙ্গমে কার্তিক পূর্ণিমার দিন থেকে সে মেলা এক মাস ব্যাপী চলে। শোনা যায়, সম্রাট অশোকও হাতি কিনতে আসতেন হরিহর ছত্রের মেলাতে। হাতি, ঘোড়া, উট, গরু, ছাগল- নানা রকমের পাখি কী-ই না বিক্রি হয়, নদীর পাড়ে কয়েক মাইল জুড়ে বসা সেই মেলাতে। তাছাড়া মেলাতে সার্কাস, নৌটঙ্কি, নানা ধরণের মনোরঞ্জনের আসরও বসে। সাপুড়ে থেকে বাজিকর, অনেক ধরণের মানুষ পেটের ধান্দায় উপস্থিত হয় সেখানে। দেহাতি মানুষরা ভিড় জমায় সেসব খেলা দেখার জন্য। পাটনা থেকে নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শোনপুর পৌঁছে যাওয়া যায়।

অনেক বছর আগের কথা। অন্তত তিরিশ বছর আগের কথা হবে। আমি তখন আমার গুরু বিখ্যাত বাজিকর হংসরাজের আশীর্বাদ নিয়ে পেটের ধান্দায় পথে নেমেছি। শহরের রাস্তায়, গ্রামে-গঞ্জে, মেলায় আমার খেলা দেখিয়ে বেড়াই। তখন থাকার জন্য নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই আমার। পথই আমার তখন ঘর বাড়ি। রাত কাটাই কখনও রেলস্টেশনে, কখনও মন্দিরের চাতালে, এমন কী কখনও বা গাছের নীচে। যা পাই, তাই খাই। সে সময় কত প্রাণীর মাংস যে খেয়েছি তার খেয়াল নেই। যাই হোক, একদিন কাঁধে ঝোলা নিয়ে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে উপস্থিত হলাম পাটনায়। সেখানে গিয়ে শুনলাম, নদীর ওপারে হরিহর ছত্রের মেলা বসেছে। ওই মেলার নাম আমি আগেই শুনেছিলাম গুরু হংসরাজের মুখে। তিনিও গিয়েছিলেন সেই মেলাতে। কাজেই সেই মেলাতে গেলে দু-পয়সা আয় হতে পারে ভেবে শোনপুরের দিকে রওনা দিলাম আমি।

চার ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিতে হবে বলে বাসের মাথায় চেপে বসলাম। ওখানকার সাধারণ মানুষরা ওভাবেই যাওয়া আসা করে। যাবার পথে ওই বাসের মাথাতেই মাঝবয়সী এক বিহারীর সাথে আলাপ হয়ে গেল। তার নাম বংশী রাম। জাতে সে চর্মকার, মাঝে মাঝে সে কসাই-এর কাজও করে, অর্থাৎ মাংস কাটে। মেলাতে শুধু পশুপাখিই নয়, পশুজাত নানা জিনিসও বিক্রি হয় সেখানে। বংশী রাম মেলাতে চলেছে সাথে নেওয়া এক ব্যাগ গরু-ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে। আমাকে সে বলল, ‘চামড়া বিক্রি করার পর মেলার বাকি সাতটা দিন মেলাতেই থাকবে। সেখানে নানা জায়গা থেকে লোক আসে বলে কাজের নাকি অভাব হয় না। বিশেষত যাঁরা দূর দেশ থেকে মেলাতে হাতি-ঘোড়া বিক্রির জন্য তাবু ফেলে, তাদের নাকি অনেক কাজের লোকের দরকার হয়। বংশীরাম ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার মেলাতে গেছে এবং ওই সব পশু বিক্রেতাদের কাছে জন খাটার কাজ করেছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘মেলাতে থাকার জন্য তাঁবু পাওয়া যায়? অবশ্য কোথাও মাথা গোঁজার জায়গা না পেলে গাছের নীচে থাকতেও আমার অসুবিধা হয় না।’

প্রশ্ন শুনে বংশীরাম বলল, ‘তাঁবু আছে বটে। কিন্তু সেখানে থাকার জন্য ভাড়া গুনতে হয়। তবে আমাদের মতো মানুষরা সেখানে থাকার জন্য অন্য ব্যবস্থা করে নেয়।

আমি জানতে চাইলাম ‘কী ব্যবস্থা?’

বংশীরাম বলল, ‘হাতি, ঘোড়া, গরু, ছাগল ইত্যাদি প্রচুর গবাদি পশু মেলায় আসে বলে তাদের খাবারের জন্য নৌকো বোঝাই করে প্রচুর খড় আনা হয় মেলাতে। এক এক জায়গাতে খড়-বিচুলির পাহাড় জমা থাকে। খুব সামান্য দামে বিক্রি হয় সেগুলো। মেলাতে রোজগার করতে আসা অনেকে খড়-বিচুলি দিয়ে অস্থায়ী ঘর বানায় থাকার জন্য।’

এ কথা বলে সে আমাকে তারপর বলল, ‘তুমি যদি চাও, তবে আমরা দু-জন একসাথে থাকতে পারি অমন একটা খড়ের ঘর বানিয়ে। রাতে কিন্তু বেশ ঠান্ডা পড়ে মেলাতে। খোলা আকাশের নীচে থাকা মুশকিল। তাছাড়া সব মেলার মতো ও মেলাতেও কিছু চোর বদমাস লোকেরা ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলে তারা বাইরের লোকদের থেকে টাকা, জিনিসপত্র চুরি ছিনতাই করে। আমরা দু-জন যদি খড়ের ঘর বানিয়ে সেখানে রাতে একসঙ্গে থাকি তবে সে সব উৎপাতের সম্ভাবনা কম।’

লোকটার কথা শুনে রাতে ঠান্ডার ব্যাপারটা তেমন কোনও চিন্তায় না ফেললেও ওই চুরি-ছিনতাইয়ের ব্যাপারটা আমাকে কিছুটা ভাবিয়ে তুলল। অচেনা জায়গাতে যাচ্ছি। সেখানে যদি কষ্টের উপার্জন কেউ ছিনিয়ে নেয় তবে তো ভারী খারাপ ব্যাপার হবে।

মাঝ বয়সী বংশীরাম পেশায় কসাই হতে পারে। পেট চালাবার জন্য কত মানুষকেই তো কত কাজ করতে হয়। তাছাড়া বংশীরামকে দেখে তার কথা বার্তা শুনে তাকে আমার খারাপ লোক বলেও মনে হচ্ছে না। এক অর্থে সে স্থানীয় লোক। তার সঙ্গে থাকলে আমার সুবিধা হবেই বলে মনে হল।

একটু ভেবে নিয়ে তাকে বললাম, ‘ঠিক আছে আমি রাজি। মেলার ক-টা দিন এক সঙ্গেই থাকব আমরা।’

বংশীরাম হেসে বলল, ‘তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। সারা দিন মেলাতে আমরা যে যার মতো কাজ করব, তারপর রাতে ফিরে একসঙ্গে ভাত রেঁধে খেয়ে কুঁড়ে ঘরে খড়ের বিছানাতে ঘুম দেব।’

নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে আমরা যখন বাস থেকে নেমে মেলাতে প্রবেশ করলাম তখন বেলা দশটা এগারোটা বাজে। আগে বেশ কিছু বড়ো মেলাতে আমি খেলা দেখাতে গেলেও এত বড়ো মেলা আমি তার আগে কোনওদিন দেখিনি। নদীর পাড় বরাবর যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখা যায় মেলার তাঁবু। তার মধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় বিরাট বিরাট সার্কাসের তাঁবু, নৌটঙ্কির তাঁবু, নাচ-গানের তাঁবু। অনেক বড়ো বড়ো গাছ আছে মেলার মাঠে। তার নীচে কোথাও বাঁধা আছে যার যার ঘোড়া, কোথাও রয়েছে শিকল বাঁধা হাতি। লোকজনেরও বেশ ভিড় আছে, বেশ বেচাকেনা চলছে। মাইকে কোথাও বাজছে ভোজপুরী গান কোথাও হয়ে চলছে দেহাতী ভাষায় ঘোষণা। এত বড়ো মেলা, এত লোকজন দেখে তাক লেগে গেল আমার। বুঝলাম, খালি হাতে ফিরতে হবে না আমার।

আমাদের কুঁড়ে বানাবার জন্য যে জায়গাটা পাওয়া গেল, তার এক পাশে ছাগল-ভেড়ার হাট, অন্য পাশে গরুর হাট। এত ছাগল-গরু আমি এক সাথে জীবনে দেখিনি। খড়ের আড়ত থেকে খুব সামান্য পয়সাতে খড় কিনে আনলাম আমরা। মেলাতে বংশীরামের পুরোনো চেনা জানা আছে। কয়েকটা বাঁশ জোগাড় করেও আনল সে। আমরা একটা মাথা গোঁজার মতো ঘর করে ফেললাম। পরদিন থেকেই কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। মেলায় ভিড় জমে দুপুর থেকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত। দেহাতি মানুষদের খুব ভিড় থাকে। মেলাতে অনেক পরিবার বাচ্চা নিয়েও আসে। যাদের টিকিট কেটে সার্কাস বা নৌটঙ্কী তাঁবুতে ঢোকার সামর্থ নেই তারা ভিড় করে সাপুড়ে, মাদারি বা আমাদের মতো স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান বা বাজিকরদের খেলা দেখে। মেলাতে আমার মতো বেশ কিছু বাজিকর ইতিমধ্যে উপস্থিত হলেও আমার অসুবিধা হল না। প্রথম দিনই আমি খেলা দেখিয়ে ষাট টাকা আয় করে ফেললাম। তিরিশ বছর আগে সে টাকার বেশ দাম। দিনের শেষে বংশীরামও ফিরে এসে জানাল তার চামড়াগুলো পরিচিত একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সে এক ঘোড়া ব্যবসায়ীর কাছে ফাই-ফরমাইশ খাটার কাজও পেয়েছে এরপর আমাকে সে আরও জানিয়ে রাখল যে, তার সঙ্গে এখন আর চামড়া নেই। কাজেই সে যে চর্মকার বা কসাই তার সে পরিচয় আমার কাউকে জানাবার দরকার নেই কারণ, ওসব অঞ্চলে এখনও জাত-পাতের সমস্যা টিকে আছে। লোকে তার পরিচয় জানলে তার কাজের সমস্যা হতে পারে। ঘোড়া মালিকের কাজ ছাড়াও মেলায় যে যে কাজ পাবে করবে। মেলার শেষ সাত দিনে যতটা সম্ভব বেশি আয় করে সে ফিরতে চায়।

হরিহর ছত্রের মেলাতে একটা একটা করে দিন কাটতে শুরু করল আমাদের। বংশীরাম কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে যায় সুর্য্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই। ঘোড়া মালিকের কাজ ছাড়াও সে যখন যা কাজ পায় তখন তা-ই করে। আমি কুঁড়ে থেকে বেরোই দুপুর নাগাদ, যখন মেলা জমে ওঠে। তবে আমরা দুজনেই অন্ধকার নামার পর প্রায় একই সময় বাড়ি ফিরতাম। তারপর মাটির হাঁড়িতে ডাল- ভাত ফুটিয়ে খাওয়া সেরে মেলার নানা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তাম। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে যতটুকু অনুমান করলাম, তাতে আমারই মতো তারও ভালোই আয় হচ্ছে মেলাতে।

দেখতে দেখতে মেলার শেষ দিন এগিয়ে এল। মেলা শেষের আগের দিন খেলা দেখিয়ে অন্ধকার নামার পর আমি কুঁড়েতে ফিরে এলাম। আমার মন বেশ প্রফুল্ল। একদিন খেলা দেখিয়ে গড়ে আমার আশি টাকা করে আয় হয়েছে। কিন্তু সেদিন অন্ধকার নামার বেশ অনেকক্ষণ পরে বেশ গম্ভীর মুখে ফিরল বংশীলাল। আমি তাকে দেরী করে ফেরার কারণ জিজ্ঞেস করতে সে বিমর্ষ ভাবে জানালো মেলার এক কোণে যে জুয়ার আড্ডা বসে সেখান থেকে ফিরছে সে। লোভে পড়ে জুয়া খেলতে বসে এ কয়েক দিনের সব রোজগার হারিয়ে বসেছে সে। এমনকী তার আনা চামড়া বিক্রির টাকাও পর্যন্ত! তার কথা শুনে আমারও বেশ খারাপ লাগল। মানুষের এই প্রবৃত্তিগুলো মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। আমি তাকে বললাম, ‘তুমি কী করবে এখন?’

বংশীরাম বলল, ‘আমার এখন আর পাটনা ফেরার উপায় নেই। যার কাছে থেকে চামড়া এনেছিলাম, ফিরে গিয়ে তার চামড়ার দাম মেটাবার কথা। তাছাড়া পাটনাতে বেশ কিছু লোকের কাছে আমার ধার-কর্জ আছে। মেলা থেকে ফিরে তাদেরও ধার মেটাব বলেছিলাম। দেখি কাল মেলায় কোনও লোককে ধরে অন্য কোথাও যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করতে পারি? তবে সেখানে গিয়ে কিছু রোজগার করে তারপর পাটনা ফিরব। মেলা ভাঙলে তুমি বরং তোমার মতো যেখানে যাবার চলে যেও।’

বংশীরামের ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। তাছাড়া এমন মানুষের সঙ্গে আমার পথে নানা সময় পরিচয় হয়। কয়েকদিন এক সঙ্গে হয়তো কাটিয়ে আমরা আবার যে যার পথ ধরি। আমি তাই তাকে বললাম, আমি পাটনা ফিরে যাব, তারপর দেখি কোথায় যাওয়া যায়?’

এরপর অন্য দিনের মতোই খাওয়া সেরে খড়ের বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমরা।

|| ৩ ||

পর দিন মেলার শেষ দিন। ভোর বেলাই বংশীরাম কাজ খুঁজতে বেরিয়ে গেল। তার সাথে আমি তাকে জানিয়ে দিলাম যে সেদিনই আমি রাতের বাস ধরে পাটনা ফিরব। শেষ দিন সকাল থেকেই মেলা ভাঙার প্রস্তুতি শুরু হল। অনেকেই তাদের তাঁবু গুটিয়ে ফেলতে লাগল। পশু বিক্রেতা তাদের বিক্রি না হওয়া পশুদের নিয়ে, কেউ বা মেলা থেকে কেনা পশুদের নিয়ে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করল। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা আসে এ মেলাতে। অনেককেই বহু দূর ফিরতে হবে।

দূর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর মতো এ সব বড়ো মেলা ভেঙে যাবার শেষ দিনও একটা বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে চারপাশে। সে বিষণ্ণতা আমাকেও স্পর্শ করেছিল। একটু বেলার দিকে কাছেই এক গাছ তলায় চুপ করে বসে দেখছিলাম কী ভাবে এক মাস ধরে চলা এত বড়ো মেলা ভাঙতে শুরু করেছে! আমার সামনে দিয়ে গরু-ছাগলের পাল তাড়িয়ে নিয়ে ফিরে চলেছে মানুষেরা। হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন লোক।

লোকটা মাঝবয়সী। পরনে সাদা শার্ট-প্যান্ট, কালো জুতো। কাঁধে একটা দোনালা বন্দুক। যা দেহাতের অনেক অভিজাত মানুষের সঙ্গেই থাকে। তবে আমার লোকটাকে দেখে মনে হল, লোকটার মধ্যে কোথাও যেন একটা শহুরে ছাপও আছে।

লোকটা আমাকে প্রথমে দেহাতি ভাষায় জানতে চাইল, ‘তুমি কি শোনপুরে থাক? না কি বাইরে থেকেএখানে কাজে এসেছ?’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘না, আমি শোনপুরের লোক নই। বাইরে থেকে মেলাতে এসেছিলাম রোজগার করতে।’

লোকটা আমার কথা শুনে অন্য দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে আবার হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করল, তুমি বাঙালি নাকি?’

আমি হিন্দিতে তার কথার জবাব দিলেও আমার কথা বলার মধ্যে বাংলা টান ধরা পড়ার কারণেই সে প্রশ্নটা করেছিল। জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি বাঙালি।

লোকটা এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে পরিস্কার বাংলাতে বললেন, ‘আমিও বাঙালি। তবে আমার তিন পুরুষের বাস এই দেহাতে। তুমি মেলাতে কী কাজ করতে এসেছিলে?’

আমি নিজের পরিচয় জানিয়ে বললাম, ‘আমি জাদুকর, পথে পথে খেলা দেখিয়ে বেড়াই। খেলা দেখাতেই মেলাতে এসেছিলাম।’

শুনে তিনি বললেন, ‘আসলে আমার দু-জন লোকের দরকার। মেলা থেকে কিছু ছাগল কিনেছি। আমার সাথে নৌকাতে সেগুলো আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। তাছাড়া পাঁচ-সাত দিনের কিছু কাজও আছে আমার বাড়িতে। বেড়া বাঁধা, জঙ্গল সাফ করা, ঘর পরিষ্কার করা’ এসব কাজ। খাওয়া দেব, সত্তর টাকা রোজ দেব বললাম কয়েকজন লোককে, তারা রাজি হল না। আসলে এখন সবাই মুফতে পয়সা পেতে চায়।’ — এই বলে তিনি সম্ভবত লোক খোঁজার জন্যই পা বাড়ালেন অন্যদিকে।

হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হল, মেলা তো শেষ। আবার আমাকে পথে পথেই ঘুরতে হবে। সাধারণত আমার রাস্তায় ঘুরে খেলা দেখিয়ে দৈনিক চল্লিশ টাকার বেশি আয় হয় না। তার মধ্যে খাবার খাওয়ার জন্য পাঁচ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। লোকটা যে ধরণের কাজের কথা। বলছে তা খুব ভারী কাজ নয়। মজুরীটাও বেশ। কাজে। কাজটা করাই যেতে পারে। আর আমার বংশীরামের কথাও। মনে পড়ে গেল। তারও কাজের দরকার। দুজনে মিলে তো যাওয়াই যেতে পারে লোকটার সঙ্গে।

তিনি তখন বেশ খানিকটা তফাতে চলে গেছেন। আমি তাঁকে ছুটে গিয়ে ধরলাম। বললাম, ‘আপনার বাড়ি কত দুর?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘খুব বেশি দূর নয়, নদীর তীরেই এক গ্রামে খামার বাড়ি। নৌকাতে যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।’

আমি তাকে বললাম, ‘আমাকে কাজে নেবেন? এও একজন আমার পরিচিত লোক আছে এখানে। শক্তপোক্ত লোক। সে-ও কাজ খুঁজছে। আপনি বললে তাকেও খুঁজে আনার চেষ্টা করতে পারি।’

লোকটা আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখন আমার সদ্য যুবা বয়স, এরকম চেহারা দেখে সম্ভবত তিনি ধারণা করলেন, আমাকে দিয়ে তাঁর প্রয়োজন মিটতে পারে। তিনি বললেন, ‘আমার আপত্তি নেই।’

আমি তাঁকে সে জায়গাতে দাঁড় করিয়ে রেখে খুঁজতে বেরোলাম বংশীরামকে। সৌভাগ্যক্রমে তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও গেলাম। সে তখনও কাজের খোঁজ করছে। আমি বলতেই সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। তাকে আমি ফিরে এলাম সেই লোকের কাছে। তিনি আমাদের নাম জেনে নেবার পর বললেন, ‘আমার নাম, দেবেন্দ্র চৌধুরী, লোকে আমাকে, চৌধুরীসাব বলে ডাকে। তোমরাও আমাকে তাই বলেই ডাকবে।’

চৌধুরীসাবের সঙ্গে এরপর আমরা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলাম, যেখানে তিনি তার ছাগলগুলো কিনে রেখেছেন সেখানে। সাতটা পূর্ণবয়স্ক ছাগী। বংশীরাম কসাই বলে এসব প্রাণীকে কীভাবে বেঁধে নিয়ে যেতে হয় তা তার জানা আছে। সে একটা লম্বা দড়ি ছাগলগুলোর গলার দড়ির ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল, তারপর এক সাথে ছাগলগুলোকে টেনে নিয়ে চলল চৌধুরীসাবের পিছন পিছন। তা দেখে চৌধুরীসাব বেশ খুশি, জানতে চাইলেন, ‘তুমি এভাবে ছাগল নিয়ে যাওয়া শিখলে কী ভাবে?’

বংশীরাম আসল কথা গোপন করে বলল, ‘এক বণিকের কাছে ছাগল চরাবার কাজ করতাম। তাই কী ভাবে ওদের নিয়ে যেতে হয় তা জানি।

আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর চরে। মেলা লোকজন আর ছোট-বড় নৌকোর ভিড় সেখানে। লোকজন মেলা থেকে গরু-ছাগল, নানান ধরণের জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। চৌধুরীসাবের নৌকোটা একটা মাঝারি আকৃতির, তার ছই নেই, গড়নটা অনেকটা ছিপ নৌকোর মতো।

কোমর জলে নেমে ছাগলগুলোকে ধরাধরি করে নৌকোয় তুলে ফেলার পর আমরা তাতে সবাই উঠে বসলাম। একজন বৃদ্ধ মাঝি বৈঠা ধরে বসেছিল। চৌধুরীসাবের সঙ্গে আমাদের নিয়ে সে রওনা হয়ে গেল নির্দিষ্ট দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাটের কোলাহল, মেলার মাইকের চিৎকার সব হারিয়ে গেল। নদীতে ভেসে চলতে লাগলাম আমরা। নদীর দু-পাশে কোথাও জঙ্গল, কোথাও বা ছোটো ছোটো গ্রাম চোখে পড়তে লাগল। গঙ্গা ও গণ্ডকের সঙ্গ ম স্থলে মেলা বসে। আমরা যেদিকে এগোলাম সেটা গণ্ডক। বড়ো নদী হলেও গঙ্গার মতো প্রশস্ত নয় সেটা। নদীর পাড়ে জনবসতিও কম সেদিকে।

সূর্যের তেজ আছে বেশ। ঠিক মাথার ওপরই সূর্য। নৌকোর ঠিক মাঝখানে ছাগলগুলোকে ধরে বসে আছে বংশীরাম। তার দু-দিকে বসে আমি আর চৌধুরীসাব। এক সময় বংশীরাম, চৌধুরীসাবকে বলল, ‘ছাগীগুলো খুব ভালো জাতের কিনেছেন। এদের নিয়ে কী করবেন সাব?’

চৌধুরীসাব জবাব দিলেন, ‘পুষবো। জানোই তো, এদের তাড়াতাড়ি অনেক বাচ্চা জন্মায়। কিছুদিনের মধ্যেই এই সাতটা ছাগল থেকে অনেক বাচ্চা পাওয়া যাবে।’

বংশীরাম পেশায় কসাই, ছাগল-পাঁঠা কাটে সে। নিজের অবচেতন মন থেকেই এরপর হয়তো সে এরপর আবার প্রশ্ন করল, ‘বাচ্চাগুলো কী করবেন? বড় করে মাংসওলার কাছে বিক্রি করবেন? এই জাতের মাংসে ভালো স্বাদ হয়।’

বংশীরামের প্রশ্ন শুনে চৌধুরীসাবের মুখ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি প্রথমে বংশীরামকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি খেয়ে দেখেছ?’

সে জবাব দিলো ‘হ্যাঁ, বাবুসাব।’

চৌধুরীসাব বললেন, ‘এই নিরীহ প্রাণীগুলোকে মেরে খেতে বেশ ভালোই লাগে তাই না? কিন্তু এই প্রাণীগুলো যদি মানুষ মেরে খেত? তোমাকে মেরে খেত, তবে কেমন লাগত?’

চৌধুরীসাহেবের কথা শুনে থতমত খেয়ে চুপ করে গেল বংশীরাম। আমি বুঝতে পারলাম এসব প্রাণীকে মেরে খাওয়াটা ঠিক পছন্দ করেন না চৌধুরীসাব। তবে তিনি এব্যাপারে আর কোনও কথা বললেন না। দুপুর রোদে নৌকা এগিয়ে চলল। ঘণ্টাখানেক চলার পর দূর থেকে নদীর পাড়ে পুরোনো দিনের একটা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। যেটা দেখিয়ে চৌধুরীসাব আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ওই যে ওটাই আমার বাড়ি।’

পুরোনো বাড়ি সংলগ্ন একটা ছোটো ঘাট আছে। সেখানে আমাদের নৌকো গিয়ে ভিড়ল। ছাগলগুলোকে নিয়ে আমরা ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

এপর্যন্ত বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ। চা খাওয়া তাঁর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

এবার চন্দনের অনুমতি নিয়ে একটা বিড়ি ধরালেন তিনি। চুপচাপ কিছুক্ষণ বিড়িতে টান দিয়ে বিড়ির টুকরোটা টেবিলের অ্যাশট্রেতে গুঁজে জাদুকর সত্যচরণ আবার তাঁর কাহিনি শুরু করলেন —

|| ৪ ||

একটা ফাঁকা আয়তাকার জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে থামওলা দোতলা বাড়িটা। তার ওপর-নীচে টানা বারান্দা। বাড়ির একপাশে নদীর পাড় বরাবর ঘন জঙ্গ ল। আর এক পাশ থেকে একটা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে সম্ভবত কোনও গ্রামের দিকে। বাড়ির যে পাশটায় জঙ্গল, সেদিকে বাড়িটার কিছুটা তফাতে ফাঁকা জমির মধ্যে মাথায় টালির ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দেওয়া একটা খোঁয়াড়ের মতো ঘরও আছে। তাছাড়া আমরা যে পথে ওপরে উঠে এলাম তার এক পাশে ডাঁই করা আছে অনেক বাঁশ। সম্ভবত নৌকো বোঝাই করে সেগুলো আনা হয়েছে। সেই বাঁশগুলো দেখিয়ে চৌধুরীসাব প্রথমে হিন্দিতে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই বাঁশগুলো দিয়ে বাড়ি সমেত ফাঁকা জমিটা ঘিরতে হবে তোমাদের। তারপর জাল বসাতে হবে। যাতে ছাগলগুলোকে ঘেরা জমির ভিতর ছেড়ে রাখতে পারি। আর ওই বাঁশ দিয়েই ছাগলগুলোর জন্য চটপট একটা ঘরও বানাতে হবে কালকের মধ্যে। আজ অবশ্য ছাগলগুলোকে ঘরের মধ্যেই রাখতে হবে।’

একথা বলার পর তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার দাদু ছিলেন পাটনা শহরের নামকরা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। একশ বছর আগে তিনি এ বাড়ি বানিয়ে ছিলেন। শহুরে ধুলো-ধোঁয়া ছেড়ে মাঝে মাঝে হাওয়া বদল করতে আসতেন তিনি।’

চৌধুরীসাবের পিছন পিছন আমরা বারান্দায় উঠলাম। সার সার তালাবন্ধ ঘর। বারান্দার এক কোণ থেকে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। অন্য কোণে কাঁঠাল পাতা, আর কিছু বস্তা ডাঁই করে রাখা আছে। চাবি দিয়ে একটা ফাঁকা ঘরের দরজা খুললেন চৌধুরী সাব। সেখানে কিছু কাঁঠাল পাতা আর জলের পাত্র আগে থেকেই রাখা ছিল। ছাগল রাখার জন্য ব্যবস্থা করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন চৌধুরীসাব। তিনি আমাদের নির্দেশ দিলেন ছাগলগুলোকে ঘরে ঢোকাবার জন্য। ছাগীগুলোর গলা থেকে লম্বা দড়িটা খুলে বংশী আর আমি যখন এক এক করে তাদের ঠেলে ঘরে ঢুকাচ্ছি তখন অচেনা পরিশে দেখে কয়েকটা ছাগী ঘরের ভিতর ঢুকতে না চেয়ে মৃদু‌ প্রতিবাদের স্বরে ডেকে উঠল। আর তার প্রত্যুত্তরে অন্য কোথাও থেকে একটা ছাগল ডেকে উঠল। ছাগলের ডাক হলেও সেটা কেমন যেন একটু মোটা ভারী ধরনের ডাক। চৌধুরী সাহেব খোঁয়াড়ের মতো ঘরটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে আর একজন আছে। অমন ছাগল তোমরা দেখেছ কিনা সন্দেহ।’

ছাগলগুলোকে সে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করার পর বারান্দা থেকে নেমে চৌধুরীসাব আমাদের নিয়ে চললেন ছাগলের ডাকটা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। বাখারির বেড়া দিয়ে ঘেরা টালির ছাউনির ঘরটার সামনে পৌঁছে ঘরের ভিতরে তাকাতেই আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ধবধবে সাদা রঙের বিরাট বড়ো পাঁঠা রয়েছে ঘরটার ভিতর। এত বড়ো পাঁঠা আমি জীবনে দেখিনি। তার মাথাটা প্রায় আমার প্রায় বুক সমান। মুখ থেকে লেজের ডগা অন্তত পাঁচ হাত হবে। মাথার সিং ছোটা হলেও কপালটা বেশ চওড়া আর ঢিপির মতো উঁচু। দেখে বোঝা যায় তার মাথাটা বেশ শক্ত ধরনের। বড়ো ঝোলা কানওলা প্রাণীটা তাকিয়ে দেখছে আমাদের। বংশীরামও বিস্মিত ভাবে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর খা অনেক বড় পাটনাই পাঁঠা দেখেছি, কিন্তু এত বড়ো গঠ আমি কোনওদিন দেখিনি। কোন জাতের পাঁঠা এটা?’

তার কথা শুনে আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘না দেখার-ই কথা। দু-বছর আগে তিন মাস বয়সে আমি ওকে শোনপুরের মেলা থেকে কিনে এনেছিলাম। তখনই ওর আকার ছিল সাধারণ পূর্ণবয়স্ক ছাগলের মতো। বড়ো জাতের তোতাপুরী পাঁঠা ওটা।

হরিয়ানায় পাওয়া যায়। এখনও রোজ তিন কিলো করে কাবলি ছোলা খায়, তাছাড়া অন্য খাবার তো আছেই। অর্থাৎ প্রায় একটা ঘোড়ার সমান খাবার। ওর ওজন এখন একশ কেজি ছাড়িয়ে গেছে।’ এ কথাগুলো বলে তিনি বেড়ার কাছে গিয়ে ‘নবাব, নবাব’, বলে ডাক দিতেই পাঁঠাটা এগিয়ে এসে বেড়ার গায়ে সামনের দু-পা তুলে দাঁড়াল। তার মাথাটা তখন প্রায় আমার কাঁধের উচ্চতায়। চৌধুরীসাব তার মাথায় বেশ কয়েক বার হাত বোলালেন বেড়ার ফাঁক দিয়ে। পাঁঠাটা এরপর বেড়ার গা ছেড়ে নেমে পড়ল, আর চৌধুরীসাবও আমাদের নিয়ে আবার বাড়ি বারান্দায় উঠে এলেন। যে ঘরে ছাগলগুলোকে রাখা হয়েছে তার পাশেই একটা ঘর তিনি আমাদের জন্য খুলে দিয়ে বললেন, ‘ঘরে মাদুর আছে। এ ঘরেই থাকবে তোমরা। আমি দোতলায় থাকি। চাল, ডাল, আটা সব দেব। বারান্দাতেই চুলা জ্বালিয়ে খানা পাকাবে। আর রাতে কিন্তু ঘরের বাইরে বেরোবে না। দরজা বন্ধ করে ঘুমোবে।’

যে বুড়ো মাঝিটা আমাদের নৌকো বেয়ে এনেছিল, সে তখনও যায়নি। আমাদের ঘরের কাছেই একটা থাম ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবার চৌধুরীসাবের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমাকে এবার ছেড়ে দিন সাব। বিকাল হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। বলা যায় না, সেই ভেজা খোর পিশাচটা হয়তো অন্ধকার নামার আগেই বেরিয়ে পড়ল!’

‘ভেজা খোর পিশাচ।’ অর্থাৎ কথাটার তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘ঘিলু খাওয়া পিশাচ।’ মাঝির বলা ‘ভেজা খোর পিশাচ’ কথাটা আমার ও বংশীরাম, দুজনের কানেই বাজল। চৌধুরীসাব মাঝির কথা শুনে মৃদু ধমকে উঠে তাকে বললেন, ‘কত বার তোমাদের বলব যে, ভূত-পিশাচ বলে কিছু হয় না। ওটা একটা হায়না। দলছুট হয়ে কোনও ভাবে এদিকের জঙ্গলে চলে এসেছে। হায়না শিকার ধরার পর মাথাটা চিবিয়ে খায়। ও যখন মাথাটা খাচ্ছিল তখন অন্য লোকজন চলে আসাতে ও শুধু মাথাটা খেয়েই পালিয়েছে।’

এ কথা বলার পর তিনি আমাদের দুজনকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা হায়না এখানে কয়েক দিন আগে জঙ্গলের মধ্যে একটা মানুষ খেয়েছে ঠিকই। তবে তোমাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। দিনের বেলা কোন প্রাণী জঙ্গলের বাইরে বেরোয়না, আর রাতে নিশ্চই তোমরা জঙ্গলে ঢুকতে যাবেনা। তবে যতদিন না এ বাড়ির চারপাশটা ঘেরা হচ্ছে ততদিন একটু সাবধানে থাকা ভালো। তাই রাতে তোমাদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ করলাম।’

এ কথা বলার পর তিনি মাঝিকে তার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিলেন। মাঝি চলে যাবার পর চৌধুরীসাব এখনকার মতো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। আর আমরাও আমাদের ঘরে ঢুকে গেলাম।

চৌধুরীসাব পোশাক পালটে কুর্তা-পাজামা পরে আবার নীচে নামলেন ঘণ্টাখানেক বাদে সূর্যাস্তের আগে। তিনি আমাদের পাশের একটা ঘর খুলে রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস আর একটা লণ্ঠন দিলেন। বাড়ির পিছন দিকে একটা কুয়ো আছে সেটাও তিনি দেখিয়ে দিলেন আমাদের জল আনার জন্য। আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে তিনি আবার উপরে চলে যাবার পর আমরা কুয়ো থেকে জল এনে বারান্দাতেই চুলা জ্বেলে রান্না বসালাম। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল। লণ্ঠন জ্বালিয়ে রান্নার বাকি কাজ শেষ করে খাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে দরজা দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর রাত ন’টার সময় লণ্ঠন নিভিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম।

আমার ঘুম খুব পাতলা। ঘণ্টা তিনেক পর আমার ঘুম হঠাৎই ভেঙে গেল। আমার মনে হল, দরজার সামনের বারান্দা দিয়ে কেউ যেন হেঁটে গেল। উঠে বসলাম আমি। গরাদ বসানো খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলোতে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে, পাঁঠার খোঁয়াড়টাও দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম চৌধুরীসাব এগোচ্ছেন সেই খোঁয়াড়ের দিকে। তাঁর কাঁধে বন্দুক হাতে ধরা একটা পাত্র। সম্ভবত নবাবকে খাবার দিতে যাচ্ছেন তিনি। তাকে দেখে আমার হঠাৎই মনে আসল সেই হায়না বা ভেজাখোর পিশাচের কথা। সে যদি এখন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে? চৌধুরীসাব এত রাতে বাইরে বেরোতে গেলেন কেন? পরক্ষণেই আমার মনে হল, তার সঙ্গে বন্দুক আছে। তাই আশঙ্কার কারণ নেই। খোঁয়াড়ের মধ্যে ঘরটার কাছে গিয়ে তার দরজা খুলে প্রবেশ করলেন তিনি। মিনিট পনেরো সে‌ ঘরে থাকার পর‌ বাইরে বেরিয়ে তার ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ির দিকে চৌধুরীসাব ফিরতে শুরু করলেন। চৌধুরীসাবের হাতে ধরা পাত্রটা ওল্টানো অবস্থায় দেখে আমি বুঝতে পারলাম আমার অনুমান ঠিক, তিনি খাবার খাইয়ে এলেন তাঁর আদরের নবাবকে। বাড়িতে ফিরে এলেন চৌধুরীসাব। আমি শুনতে গেলাম তার পায়ের শব্দ আমাদের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। এরপরই আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো বাড়িটা। আর আমিও শুয়ে পড়লাম।

|| ৫ ||

‘পরদিন সকালে থেকেই চৌধুরীসাবের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। যেদিকে নবাবের খোঁয়াড় সেদিকেই তার থেকে কিছুটা দূরে বাঁশের খুঁটি দিয়ে, বাখরি দিয়ে ছাগীগুলোকে রাখার জন্য একটা বড় ঘর তৈরির কাজ শুরু হল। বংশীরাম ওসব কাজে বেশ পটু দেখলাম। মূলত খোঁয়াড় বাঁধার কাজটা সেই করল। আমি তাকে বাঁশ কেটে, গর্ত খুঁড়ে সাহায্য করতে লাগলাম। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করে আমরা বেশ বড়সড় ঘর বা খোঁয়াড় বানিয়ে ফেললাম। তবে সেদিন আর টালিগুলো খোঁয়াড়ের মাথায় চাপানো সম্ভব হল না বলে ছাগীগুলোকে তার মধ্যে রাখা সম্ভব হল না। দিনের শেষে নদী থেকে স্নান সেরে যথারীতি আগের দিনের মতোই রান্না চাপানো হল। সারাদিন পরিশ্রম গেছে। তাই খাওয়া সেরে আগের দিনের থেকে কিছুটা তাড়াতাড়ি আমরা। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সে রাতেও আগের রাতের মতো ঘুম ভেঙে গেল আমার। জানলা দিয়ে আমি দেখলাম। চৌধুরীসাব পাঁঠাটাকে খাবার দিয়ে ফিরে এলেন।

পরদিন দুপুরের আগেই নতুন খোঁয়াড়টার মাথায় আমরা ছাউনি দিয়ে ফেললাম। ছাগীগুলোকে তার মধ্যে পুরে ফেলা হল। চৌধুরীসাহেব আমাদের কাজ দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, সেদিন আর কাজ করার দরকার নেই। পরদিন ভোর থেকে বাড়ির চারপাশ ঘেরার জন্য খুঁটি পোঁতার কাজ শুরু করলেই হবে। তাই একবেলা ছুটি পেয়ে গেলাম আমরা। দুপুরেই সেদিন রান্না হল। আর কোনও কাজ নেই, তাই নিজেদের ঘরে শুয়ে পড়লাম দুজনে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখনও বংশীরাম ঘুমাচ্ছে। বাইরে বেলা শেষের  মনোরম পরিবেশ। আলো নরম হয়ে এসেছে। দিন শেষে মাথার ওপর দিয়ে টিয়া পাখির ঝাঁক ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে। আমি একটু হেঁটে আসার জন্য ঘর থেকে বাইরে বেরোলাম। বাড়ি সংলগ্ন ফাঁকা জমিটাতেই আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম সেই তোতাপুরী পাঁঠাটা কয়েকবার ডাকল। সাধারণত ওর ডাক বিশেষ শোনা যায় না। কৌতূহলবশত আমি গিয়ে ড়ালাম ওর খোঁয়াড়ের গায়ে। ঘরটার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পাঁঠাটা। সেও দেখতে পেল আমাকে। আমরা চেয়ে রইলাম পরস্পরের দিকে। কী ধবধবে সাদা রং তার গায়ে! আর কী বিরাট তার চেহারা! ঠিক যেন একটা ছোটোখাটো টাট্টু ঘোড়ার মতো! আমি বিমোহিত ভাবে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। কিন্তু হঠাৎ সে খোঁয়াড়ের কোণ ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। আর তারপরই সে হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে সজোরে তো মারল আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সে জায়গাতে বেড়ার গায়ে। এত জোরে সে গুঁতো দিল যে পুরো ঘরটাই থরথর করে কেঁপে উঠল! আমিও ছিটকে কয়েক-পা পিছনে সরে এলাম। ঠিক সেই সময় পাশ থেকে একটা কন্ঠস্বর শুনলাম, ‘ও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তেমন পছন্দ করে না।’

চৌধুরীসাব কখন যেন সে জায়গাতে এসে দাঁড়য়েছেন! আমি তাকে বললাম, ‘আমি প্রতি রাতে ওকে খাবার দিতে দেখি আপনাকে। অত রাতে ও খায়‌ কেন?’

চৌধুরী সাব বললেন, ‘আসলে আমাকেও তো কাজে বেরোতে হয়। মজফ্ফরপুরে আমার একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান আছে। ওকে কিনে আনার পর খুব ভোরে আমি খাবার দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতাম, আবার রাতে ফিরে এসে ওই সময় খাবার দিতাম। এখন এটাই ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। আর আমার হাতে ছাড়া খাবার মুখে তোলে না। সামনে দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়াতে হয়।

আমাকে এ কথা বলে তিনি বেড়ার কাছে গিয়ে হাঁক দিলেন — ‘নবাব, নবাব’ বলে। তাকে দেখা মাত্রই পাঁঠাটা শান্ত হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে আগের দিনের মতোই দু-পা তুলে বেড়ার গায়ে উঠে দাঁড়াল। চৌধুরী- সাব তোতাপুরী পাঁঠাটার ঢিবির মতো কপালে হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করলেন। তারপর আমরা দুজনে একসঙ্গে বাড়ির দিকে এগোলাম।

আমি খেয়াল করে দেখেছি, চৌধুরীসাব বংশীরামের সাথে কাজের কথার বাইরে কোনও কথা না বললেও আমি বাঙালি বলেই হয়তো মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে টুকটাক গল্প করেন। বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে তিনি বললেন, ‘জানো, এ বাড়িতে ঠিক এমনই একটা তোতাপুরী পাঁঠা ছিল, কালো রঙের। আমি তার নাম রেখেছিলাম কৃষ্ণ। তখন আমার আট-দশ বছর বয়স। এবাড়িতে তখন কাজের লোক থাকত। তারাই ওর দেখাশোনা করত। দাদুর সঙ্গে আমি পাটনা থেকে আসতাম। খেলা করতাম কৃষ্ণর সাথে। বলতে গেলে আমরা বন্ধু ছিলাম। তারপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল —

এই বলে চুপ করে গেলেন তিনি।

আমি বলে উঠলাম, ‘কী ঘটনা?’

বেশ কয়েক পা চুপচাপ হাঁটার পর বললেন, ‘আমি তখন ছুটিতে দাদুর সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছি। কৃষ্ণকে নিয়ে খেলি। কৃষ্ণ খোলা অবস্থাতেই একতলার বারান্দায় থাকত। একদিন সকালে উঠে দেখা গেল কৃষ্ণকে পাওয়া যাচ্ছে না। দাদু চারপাশে তাকে খুঁজতে লোক পাঠালেন। একটু বেলার দিকে তার খোঁজ মিলল। তবে কৃষ্ণর নয়, তার মাথাটার আর চামড়ার। কারা যেন তাকে মেরে খাবার জন্য মাংসটা নিয়ে গেছে। কাছেই একটা দেহাতি গ্রাম আছে। তাদেরই কেউ বা কারা নিশ্চই কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল। কৃষ্ণর কাটা মাথাটা যখন বাড়িতে আনা হল – তা দেখে দুঃখে, আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফিরলেও কিছুদিনের জন্য মাথার গণ্ডগোল হয়ে গেছিল আমার। কেউ পাঁঠার মাংস খাবে বললে শুনলেই তাকে মারতে যেতাম। অবশ্য সে ইচ্ছা আমার এখনও হয়। আমার জন্যই সে সময় থেকে যে কোনও ধরনের মাংস রান্না বন্ধ হয়ে গেছিল। অবলা প্রাণীদের নিয়ে এই নৃশংস ব্যাপার আমি সহ্য করতে পারি না। যাইহোক আমার দাদু কবিরাজ ছিলেন বলে সে যাত্রায় আমাকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে সুস্থ করে তুলেছিলেন। শুধু আমি নই, কৃষ্ণর মৃত্যুতে দাদু ভিতরে ভিতরে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন।’ একথা বলে একটু অনেকটা স্বগতোক্তির স্বরেই বললেন, ‘দাদু অবশ্য পরে বলেছিলেন, এমন ঘটনা ঘটতে পারে জানলে তিনি আগেই ‘দেষন গাছের’ শিকড় খাওয়াতেন। এ তল্লাটে তো ও গাছ হামেশাই মেলে।’

কথাটা শুনে আমি জানতে চাইলাম, ‘দেষন গাছটা কী? তার শিকড় খেলে কী হয়?’

আমি বুঝতে পারলাম না আমার প্রশ্ন তাঁর কানে গেল কি না। ফাঁকা জমিটা পেরিয়ে আমরা বাড়িটার কাছে চলে এসেছিলাম। আমার কথার জবাব না দিয়ে চৌধুরীসাহেব এরপর বারান্দায় উঠে এগোলেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।

|| ৬ ||

পরদিন সকাল থেকেই বাড়ি সমেত জমি ঘেরার কাজ শুরু করলাম আমরা। শুধু ঘাটের সিঁড়ির অংশ বাদে বাকি অংশটা ঘিরতে হবে আমাদের। ঘাটের দিক দিয়ে ছাগলগুলোর পালাবার উপায় নেই। তাছাড়া সেদিক‌দিয়ে খোলা থাকলে ছাগলগুলো নিজেরাই গিয়ে নদীতে জল খেয়ে আসতে পারবে। তাই সেটুকু অংশ ঘেরা হবে না। প্রথম দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে খুঁটি পোঁতার কাজ অনেকটাই সেরে ফেললাম। দ্বিতীয় দিনে দুপুর থেকে খুঁটির গায়ে লোহার জাল বসানো শুরুর জাল আগেই কিনে বাড়িতে মজুদ করে রেখেছিলেন চৌধুরীসাব। তবে খুঁটির গায়ে পেরেক আর তার দিয়ে মাথা সমান জাল টানটান করে বাঁধা আগের কাজগুলোর তুলনায় একটু ঝকমারির কাজ। জাল সেদিন লাগানো শুরু করলাম, সেদিন ছাড়াও আরো দুটো দিন কাজ‌ শেষ করতে লাগবে বলে আমাদের মনে হল। সেদিন জাল বসাবার কাজ শেষ করে যথারীতি রান্না খাওয়া দাওয়া করে আমরা শুয়ে পড়লাম। ঘুমাবার আগে নানা গল্প করতে করতে একসময় আমাকে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলার আছে আমার। এতদিন একসঙ্গে থেকে আমরা এখন বন্ধু হয়ে গেছি। তাই ভরসা করে কথাটা বলছি তোমাকে। তবে আমার কথা গোপন রাখতে হবে।’

আমি বললাম, ‘রাখব, বলো —’

এরপর সে আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে বলল, আর মাত্র দু-দিনের মতো কাজ বাকি। তারপর তো আমাদের চলে যেতে হবে। একদিন কাজ করে কতই বা আয় হবে। খুব বেশী হলে চার-পাঁচ ‘শ টাকা? তুমি যদি রাজি থাকো তবে একটা কাজ করা যেতে পারে। আমাদের মজুরী বুঝে নেবার পর আমাদের কারও হঠাৎ শরীর খারাপের অছিলাতে একটা রাত এখানে থেকে যাব। তারপর মাঝরাতে ছাগলগুলোকে নৌকায় তুলে নিয়ে পালাব। পাটনাতে অন্তত দু-হাজার টাকায় ছাগলগুলোকে বিক্রি করা যাবে। কেনার লোক আমার জানা আছে। তোমার আর আমার আধা আধি বখরা হবে। তারপর তুমি তোমার পথ ধরবে আর আমার খোঁজও চৌধুরীসাব পাবে না। বলো রাজি কি না?’

বংশীরামের কথা শুনে চমকে উঠে বসলাম। আমি বুঝতে পারলাম লোকটা লোভী এবং অসৎ। নইলে কেউ জুয়া খেলে না, আর চুরির কথাও ভাবে না। আমি তাকে বেশ কড়া সুরেই বললাম, ‘দেখো বংশীরাম, আমি গরীব বাজিকর হতে পারি, পথে পথে ঘুরে বেড়াতে পারি, কিন্তু আমি চোর নই। চৌধুরীসাব বিশ্বাস করে আমাদের কাজে এনেছেন। আমি কিছুতেই একাজ করব না। আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুমি কী করে এভাবে ছাগল চুরির কথা বলছ?’

আমার কথা শুনে বংশীরাম একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল বলে আমি তোমাকে বললাম। ঠিক আছে, তুমি যখন বারণ করছ তখন আর এ কাজের দরকার নেই।’ এ কথা বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল বংশীরাম।

পরদিন সকাল থেকে আবার জাল লাগাবার কাজ শুরু করলাম আমরা। আমি এদিন বংশীরামের সঙ্গে খুব বেশী কথা বললাম না, যাতে সে বুঝতে পারে তার প্রস্তাব শুনে আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি। কাজের মধ্যেই সারাটা দিন কেটে গেল। রাতে শোবার সময় বংশী আমাকে বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি এখনও রেগে আছে। আমিও বুঝতে পারছি ওসব ভাবা উচিত হয়নি।’

সে রাতের পর দিন প্রত্যাশা মতো জাল লাগানো শেষ হল আমাদের। চৌধুরীসাব চারপাশ ঘুরে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘কাল তোমাদের টাকা মিটিয়ে দেব। আমি তোমাদের পথ বলে দেব। ইচ্ছা হলে কালই চলে যেতে পারো, নইলে পরশু ভোরে তোমাদের নৌকো করে শোনপুর পৌঁছে দেব। সেখান থেকে তোমরা যেখানে খুশি যেতে পারবে। কাল অবশ্য যদি তোমরা থেকে আমার বাড়িটা একটু ঝাড়পৌঁছ করে দাও তার জন্য পয়সা দেব।’

তার কথা শুনে আমি বললাম, ‘তবে কাল এখানে থেকে কাজ করে পরশু নৌকাতেই ফিরব।’ চৌধুরী সাহেব এরপর বললেন, ‘জালগুলো বেশ ভালো লাগিয়েছ। নবাব খুব চঞ্চল। কিছু দিন আগেই একবার জঙ্গলের দিকে চলে গেছিল। এবার অন্তত ওকে ছেড়ে রাখতে পারব।’

যেদিন রাতে ঠিক সেই সময় আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার, যখন চৌধুরী সাব নবাবকে খেতে দিতে যান। আমি দেখতাম তিনি নবাবের খোঁয়াড়ে ঢুকলেন তাকে খেতে দিতে। তারপর তিনি নবাবকে খোঁয়াড়ের বাইরে বার করে দিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন। জানলা দিয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখলাম নির্জন রাতে চাঁদের আলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা রঙের বিশালাকৃতির তোতাপুরী পাঁঠাটা। কেমন যেন ভিনগ্রহের জীব মনে হচ্ছে তাকে! কিছুক্ষণ তাকে দেখার পর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

|| ৭ ||

এ দিনই আমাদের চৌধুরী সাবের বাড়িতে শেষ দিন। সকাল বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁতন করতে করতে আমার মনে পড়ল গতকাল রাতের দৃশ্য চাঁদের আলোতে জমিটার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল সাদা রঙের পাঁঠাটা। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেলাম না। তবে তার খোঁয়াড়ের দরজা বন্ধ দেখে আমি অনুমান করলাম, ভোরবেলা খাবার দেবার সময় চৌধুরী সাব আবার নবাবকে তার খোঁয়াড়ে পুরে দিয়েছেন।

বেলা আটটা নাগাদ ওপর থেকে নামলেন চৌধুরী সাব। হাতে তার বিরাট চাবির গোছা। তিনি আমাদের বললেন, ‘ঘরগুলো খুলে দিচ্ছি। একতলার ঘরগুলো বংশী সাফ করুক আর দোতলার ঘরগুলো সত্য তুমি করবে।’

একতলার ঘরগুলো প্রথমে তিনি একে একে খুলে দিলেন। অধিকাংশ ঘর গুলোই ফাঁকা। কোথাও হয়তো সামান্য কিছু জিনিস আছে। তবে দীর্ঘ দিন অব্যবহারের ফলে ঘরের ভিতর ধুলো জমেছে। তিনি একতলার ঘরগুলো বংশী রামকে খুলে দেবার পর ঝাঁটা বালতি ইত্যাদি নিয়ে আমি তার সাথে দোতলায় উঠে এলাম। এর আগে আমি কখনও দোতলায় উঠিনি। দোতলাতেও একতলার মত সার সার ঘর। রেলিং দেওয়া বারান্দায় দাঁড়ালে নদীটা অনেকখানি দেখা যায়। ঘাটের নীচে নৌকাটা বাঁধা আছে দেখতে পেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম যে ঘর তার দরজা খোলা। ভিতরে খাট, আলমারী ইত্যাদি আসবাব দেখা যাচ্ছে। সে ঘরটা দেখিয়ে চৌধুরী সাব বললেন, এ ঘরটা আমার শোবার ঘর, আমি নিজেই পরিষ্কার করি। এ ঘরে ঢোকার দরকার নেই। অন্য দু- তিনটে ঘর পরিষ্কার করলেই চলবে। চাবি দিয়ে এরপর দুটো ঘর খুললেন তিনি। কিছু আসবাব আছে সে ঘর দুটোতে। তিনি বললেন, ‘আগে এ ঘর দুটো পরিষ্কার করে তুমি শেষ ঘরটা ধরবে। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে গিয়ে তিন নম্বর ঘরটা খুললেন। তার দরজা খুলতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। ওষুধের গন্ধের মত গন্ধ। ভিতরে এক ঝলক উঁকি দিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটা টেবিল আর আলমারি রয়েছে ঘরে। তাতে রাখা আছে নানা ধরণের শিশি-বোতল, কাগজপত্র। সে ঘরটা দেখিয়ে চৌধুরী সাব বললেন, ‘ভালো করে পরিষ্কার করবে এ ঘরটা। এটা আমার কাজের ঘর। সাবধানে কাজ করবে। অনেক পুরানো আয়ুর্বেদিক ওষুধের শিশি আর দরকারী কাগজ আছে এখানে। কোন কিছুর যেন ক্ষতি না হয়।’

ঘরটা খুলে দিয়ে এরপর তিনি ফিরে গিয়ে ঢুকলেন তার শয়ন কক্ষে। চৌধুরী সাহেবের নির্দেশ মতো আমিও কাজ শুরু করেছিলাম। প্রথমে তার নির্দেশ মতো তাঁর শয়ন কক্ষ সংলগ্ন দুটো ঘর পরিষ্কার করে আমি গিয়ে ঢুকলাম তাঁর কাজের ঘরে। টেবিল, দেওয়ালের র‍্যাকে শিশি বোতল, কাগজ, খাতা ইত্যাদি সব এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। আমি প্রথমে শিশি বোতল গুলোর গা থেকে সাবধানে ধুলো মুছে সেগুলোকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখলাম। তারপর টেবিল গুলো গোছাতে শুরু করলাম আমি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজ, খাতা, ডায়েরি ইত্যাদি গুছিয়ে রাখছি। হঠাৎই একটা ডায়েরির ভিতর থেকে সুতো ছিঁড়ে যাবার কারণে একটা পাতা খসে‌ পড়ল। সেটা কুড়িয়ে ডায়েরির ভিতর রাখতে যেতেই দেখি, গোটা গোটা বাংলা হরফে লেখা রয়েছে তার মধ্যে। যা বুঝলাম সেটা দিনলিপির খাতা। নিয়মিত দিনলিপি লেখেন চৌধুরী সাব। যদিও অন্য কারো দিনলিপি গোপনে পাঠ করা উচিত নয়, কিন্তু সে বয়সে সে সময় এত কিছু বুঝতাম না আমি। কৌতূহলী হয়ে ডায়েরীর পাতা ওল্টাতে লাগলাম আমি। হঠাৎই একটা পাতায় চোখ আটকে গেল আমার। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আজ মেলা থেকে সাতটা ছাগী কিনে আনলাম। কিছুদিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই নবাবের অনেককটা সন্তান জন্মাবে। দেখতে হবে দেষন টগরের গুণ নবাবের রক্ত থেকে তার সন্তানদের রক্তে প্রবাহিত হয় কি না?’

‘দেষন গাছের শিকড়ের কথাটা দু-দিন আগেই চৌধুরীসাবের মুখ থেকে শুনেছিলাম আমি। সেটা কী জিনিস, তা কোথাও লেখা আছে কি না, তা জানার জন্য আমি ডায়েরির পাতা ঘাঁটতে শুরু করলাম। কয়েক পাতা পিছনে যেতেই আমি দেখলাম- সে দিন লেখা শুরু হয়েছে এ ভাবে- ‘আজ আমি নিশ্চিত যে, দেষন টগরের শিকড় সত্যিই কাজ দেয়!’

লেখাটা আমি সবে পড়তে শুরু করেছি, ঠিক সেই সময় হঠাৎই পায়ের শব্দ শুনলাম। যে লেখাটা আমি পড়তে শুরু করেছিলাম তার মধ্যে এমন কিছু লেখা ছিল যে তা পড়ার আগ্রহ আমাকে একটা কাজে প্ররোচিত করল। আমি হাত সাফাইতে ওস্তাদ লোক। ঠিক যে মুহূর্তে চৌধুরীসাব ঘরে ঢুকলেন, সেই মুহূর্তেই আমি ডায়েরিটা চালান করে দিলাম আমার জামার নীচে কোমরের মধ্যে।

আমি ভেবেছিলাম আমি কেমন কাজ করছি দেখে চৌধুরীসাহেব বাইরে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু তা হল না। বাকি সময় আমি যতক্ষণ কাজ করলাম, ততক্ষণ তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দরজারে তালা দিলেন তিনি। আমার আর তার অবর্তমানে ডায়েরিটা পড়ে সেটা সে ঘরে রেখে আসা হল না। সেটা জামায় তলাতে গোঁজা অবস্থাতেই আমি নীচে নেমে এলাম। বংশীরামের কাজও তখন মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে দুজনে দুপুরে রান্না করে, স্নান খাওয়া সেরে ঘরে চুলে দরজা দিলাম।

বংশীরাম ঘুমিয়ে পড়ার পর সেই ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম। তার রেশ কিছু লেখা পড়ে বিস্মিত ও শিহরিত হয়ে গেলাম আমি! বাইরে নির্জন দুপুর। নবাবের খোঁয়াড়টা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম, এও কি কখনও সম্ভব? নাকি চৌধুরীসাব প্রলাপ বাক্য লিখেছেন তার দিনলিপির পাতাতে!

যাইহোক এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় বিকাল হল। ডায়েরিটা জামার নীচে লুকিয়ে রেখে আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে দোতলাতে ওঠে চৌধুরীসাহেবের কাজের ঘরের জানলা দিয়ে ভিতরে ফেলে দেব। দরজা বন্ধ থাকলেও সে ঘরের জানলাতো খোলাই আছে।

বিকেলবেলা ঘর থেকে বাইরে বেরোলাম আমরা। চৌধুরীসাব দোতলা থেকে নীচে নেমে আমাদের ডাকলেন। আমার বেশ ভয় করছিল, ডায়েরিটা যে ঘরে নেই তা তিনি জেনে গেছেন কি না, বা আমাদের সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন কি না — এই ভেবে? কিন্তু তনি আমাদের কাছে ডেকে আমাদের প্রত্যেকের হাতে বখশিস সহ মজুরীর পাঁচ’শ করে টাকা ধরিয়ে দিয়ে লিলেন, ‘তোমাদের কাজে আমি খুশি হয়েছি তোমরা খুশি তো?’

আমরা দুজনেই বললাম, ‘হ্যাঁ, সাব, আমরা খুশি।’

দোতলায় ফিরে যাবার আগে তিনি আমাদের বলে গেলেন পরদিন ভোরেই তিনি নৌকো নিয়ে বেরোবেন আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য।

বিকালের পর সন্ধ্যা নামল, তারপর রাত। চৌধুরীসাহেবের ডায়েরিতে যে অদ্ভুত কথাগুলো পড়েছি তা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না আবার। বার বার মনের ভতর ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে আমি ঠিক করে নিলাম, মাঝরাতে চৌধুরীসাব যখন নবাবকে খেতে দিতে যাবে সেই ফাঁকে আমি চুপিসাড়ে দো-তলায় উঠে ডায়েরিটা জানলা গলিয়ে ঘরের ভিতর ফেলে দেব। দুপুরেই রাতের রান্নাও সারা ছিল। রাত ন-টা নাগাদ খাওয়া সেরে আমরা দুজন শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি দখলাম বংশীরাম ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, কখন চৌধুরীসাব নবাবকে খাবার দিতে যায় তা দেখার জন্য। বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবতে লাগলাম চৌধুরীসাবের লেখা কথাগুলো!

একটানা এতক্ষণ কাহিনি বলে চলার পর হঠাৎ একটা শব্দ শুনে থেমে গেলেন জাদুকর সত্যচরণ। পাশের ঘর থেকে প্রেসার কুকারের সিটি বেজে উঠেছে। চন্দন হেসে বলল, ‘ওটা প্রেসার কুকারের সিটি। মাংস রান্না শেষ হতে চলেছে।’

সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘শব্দটা হঠাৎ এমন হল যে, আমি চমকে গেছিলাম। তবে আমার গল্পও আর সামান্যই বাকি।’ এ কথা বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনির অন্তিম অংশ —

|| ৮ ||

‘ঠিক রাত বারোটা নাগাদ আমি ঘরের বাইরে চৌধুরীসাবের পায়ের শব্দ পেলাম। আর তার মিনিটখানেকের মধ্যেই আমি দেখলাম তিনি খাবারের পাত্র নিয়ে এগোচ্ছেন নবাবের খোঁয়াড়ের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম আমি। বংশীরাম ঘুমোচ্ছে। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। তারপর বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলাম। আমি ওপরে উঠে একবার তাকালাম নদীর দিকে। চাঁদের আলোতে ঘাটে বাঁধা নিঃসঙ্গ নৌকোটাও আমার চোখে পড়ল। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জানলা দিয়ে ডায়েরিটা বার করে জানলা দিয়ে ঘরের ভিতর টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। ডায়েরিটা যথাস্থানে রেখে ঘরে ফিরতে খুব বেশী হলে আমার দু- মিনিট সময় লাগল। ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে বসে জানলার বাইরে তাকালাম আমি। কিছু সময় পর নবাবকে নিয়ে খোঁয়াড়ের বাইরে বেরোলেন চৌধুরীসাব। প্রাণীটার পিঠে আদর করে একটা চাপড় মেরে তাকে মুক্ত করে দিয়ে বাড়ির দিকে এগোলেন চৌধুরীসাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি শুনতে পেলাম তার দোতলায় উঠে যাবার শব্দ। আমি আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। চাঁদের আলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল তোতাপুরী পাঁঠাটা। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ডায়েরিতে যা লেখা আছে তাকি কখনও সত্যি হতে পারে? নবাব এক সময় ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পিছনে আমার চোখের আড়ালে চলে গেল। আর আমিও শুয়ে পড়লাম। ঘুম নেমে এল আমার চোখে।’

আবারও একটা সিটি পড়ল প্রেসারের কুকারের। পাঁঠার মাংসর মৃদু গন্ধও ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। মুহূর্তের জন্য তার ঘ্রাণ নিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বলতে থাকলেন — ‘কিন্তু আমার সে ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হল না। ঘণ্টাখানেক বাদেই হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি পাশ ফিরতেই দেখলাম বংশীরাম ঘরে নেই, আর দরজার পাল্লাটাও একটু ফাঁক করা। এত রাতে কোথায় গেল সে? সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলাম আমি। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে জানলা দিয়ে ঢোকা চাঁদের আলোতে আমি দেখলাম আমার থলেটা ঘরের মধ্যে নেই। আঁতকে উঠলাম আমি — এ বংশীরামের কাজ! থলের মধ্যে যে আমার সর্বস্ব আছে! আমার টাকাপয়সা, সব থেকে বড় কথা‌ — যা দিয়ে আমি খেলা দেখাই, সেসব জিনিসগুলো! আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তোতাপুরী পাঁঠাটাকে দেখতে না পেলেও কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমি বংশীরামকে দেখতে পেলাম। ঘাটের দিক থেকে আসছে সে। আমি আর কালবিলম্ব না করে উঠে পড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। তারপর বারান্দা থেকে জমিতে নেমে এলাম আমি। দেখতে পেলাম ছাগীগুলোকে যে নতুন ঘরে রাখা রয়েছে সেদিকে এগোচ্ছে বংশীরাম। তার হাতে একটা দড়ি। মুহূর্তর মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। বংশীরাম তার ভাবনা থেকে সরেনি। সে ছাগলগুলোকে চুরি করে পালাবার কাজ শুরু করেছে। আর তার সাথে আমার থলেটাও! ছাগলগুলো নিয়ে যাবার আগে সে সম্ভবত থলেগুলো নৌকোয় বা ঘাটে রেখে এসেছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে তাকিয়ে রইলাম বংশীরামের দিকে।

বংশীরাম এখন ছাগীগুলোর ঘরের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে। ঠিক সেই সময় আমি আরও একজনকে দেখতে পেলাম। বাড়ির পিছন দিক থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই তোতাপুরী পাঁঠাটা! সেও তাকিয়ে দেখছে বংশীরামকে। আর এর পরেই পাঁঠাটা তির বেগে ছুটতে শুরু করল বংশীরামের দিকে। বংশীরাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে তার কাছে পৌঁছে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে গুঁতো মারল বংশীরামের পিছনে। বংশীরাম একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল সাত-আট হাত দূরে! হয়তো বংশীরাম সেই প্রচণ্ড আঘাতের পরও উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু নবাব তাকে সে সুযোগ দিল না। সে আপাতত ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে গুঁতো দিল বংশীরামের মাথায়। সেই আঘাতেই সম্ভবত জ্ঞান হারাল বংশীরাম। আমি হতভম্বের মতো দেখতে থাকলাম বংশীরামের মাথা লক্ষ করে কখনও মাথা দিয়ে কখনও খুর দিয়ে আঘাত করে চলেছে বিরাট পাঁঠাটা। এরপর থামল পাঁঠাটা। বংশীরামের শরীর তখন সম্পূর্ণ স্থির। আকাশের চাঁদের দিকে মাথা তুলে একবার অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল নবাব। যেন সে এক অপার্থিব ক্ষিপ্র ডাক! তারপর সে মাথা নীচু করে চাটতে থাকল নিস্পন্দ বংশীরামের চূর্ণ বিচূর্ণ মাথাটা।

এবার আমার হুঁশ ফিরল। ওভাবে চেটে নবাব কী খাচ্ছে? বংশীরামের রক্ত, ঘিলু…? আমার মনে পড়ে গেল চৌধুরীসাহেবের ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো। আর তো সত্যিই দেখছি যে দেষন টগরের মূল খাওয়ালে নিরামিষ ভোজী প্রাণীর মধ্যেও সত্যিই রক্তের বাসনা জেগে ওঠে। চৌধুরীসাহেব তার ডায়েরিতে লিখেছেন, নিরীহ প্রাণীর মধ্যেও ওই শিকড় দ্বেষ অর্থাৎ বিদ্বেষের জন্ম যে বলে ওই গাছের নাম — ‘দেষন টগর।’ যা নবাবকে খাইয়ে তিনি নবাবকে মানুষের থেকে নিজেকে বাঁচাবার উপযোগী করে তুলেছেন। তাকে হিংস্র করে তুলেছেন। ক্ষিপ্ত করে তুলেছেন! খোঁয়াড় থেকে বাইরে বেরিয়ে ইতিপূরে এক গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে নবাব। তার রক্ত ঘিলুখেয়েছে নবাব! আর এখন চেটে খাচ্ছে বংশীরামের মাথা।। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একটা হিমেল রক্ত স্রোত। নেমে আসতে লাগল আমার মেরুদন্ড বেয়ে! আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল- ‘পালাও। পালাও।

সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে আমি সোজা ছুটতে শুরু করলাম ঘাটের দিকে। আর সেই অবস্থাতেই আমি বুঝতে। পারলাম আমাকে দেখে ফেলেছে সেই মাংসাশী পাঁঠাটাও। সেও ছুটে আসছে আমার পিছনে! এক ছুটে ঘাটে পৌঁছে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। ঘাটের শেষ ধাপে দেখলাম থলে দুটো রাখা আছে। আমার থলেটা কোনোরকমে তুলে নিয়ে নৌকোতে উঠে বসে তার কাছিটা খুলতে খুলতে তাকালাম ঘাটের দিকে। দেখতে পেলাম ঘাটের ঠিক ওপরের ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে সেই দানব পাঁঠা। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রাণীটার মুখ-দাড়ি সব লাল রক্তে মাখামাখি। তার ধবধবে সাদা শরীরের নানা জায়গাতে লাল রক্তর ছিটে। প্রাণীটা যেন আদিম জিঘাংসার প্রতিমূর্তি। হিংসা, রক্ত জল করা চাহনিতে সে চেয়ে আছে আমার দিকে। আর এরপরই চাঁদনী রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে পর পর দুটো গুলির শব্দ শোনা গেল! আমার নৌকোর কয়েক হাত তফাতে নদীর জল ছিটকে উঠল। দোতালার বারান্দা থেকে গুলি ছুঁড়ছেন চৌধুরীসাব এবং সম্ভবত আমাকে লক্ষ্য করেই। গুলির শব্দ হওয়া মাত্রই সেই দানব পাঁঠাটা মুহূর্তের মধ্যে পিছন ফিরে এক ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার নৌকোর দড়িও খুলে গেল সেই সময়। বৈঠা খুলে নিলাম আমি। তার আঘাতে আর স্রোতের টানে ছুটে চলল নৌকো। আমার পিছনে পড়ে রইল সেই বাড়িটা, বংশীরামের মৃতদেহ, চৌধুরীসাব আর তাঁর রক্তখেকো তোতাপুরী পাঁঠা — নবাব। পরদিন সকালে পাটনার কাছে এক ঘাটে গিয়ে ভিড়ল আমার নৌকো। পাটনা থেকে ট্রেন ধরে সোজা কলকাতার দিকে রওনা দিলাম আমি।’

গল্প শেষ করলেন জাদুকর সত্যচরণ। তারপর চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন কেন এরপর আমি বেশ কিছু বছর পাঁঠার মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম? আর পাঁঠার মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা বন্ধ করেছিলাম? আমার খালি মনে হত, দেষন শিকড়ের গুণাবলী নবাবের সন্তানদের রক্তে ছড়িয়ে পড়েনি তো! যে পাঁঠাগুলো কসাইয়ের দাকানে বাঁধা আছে, যাদের মাংস আমি খাব তারা কেউ নবাবের বংশধর নয় তো! কে বলতে পারে কোনও ভাবে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েনি?’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, বুঝলাম, সত্যিই ভয়ঙ্কর গল্প। যদি এমন কোনও দিন ঘটে যে যাদের আমরা কেটে খাই তারা একদিন মাংসাশী হয়ে আমাদের ওপর চড়াও হল তা ভয়ানক হবে।’

সত্যচরণ বললেন, ‘আজ এত বছর পরও যেন আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলে দেখতে পাই চাঁদের আলোতে রক্তমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তোতাপুরী পাঁঠাটাকে! — যেন সে প্রেতলোকের জীব!’

বার বার প্রেসার কুকারের সিটি জানান দিচ্ছে মাংস রান্না হয়ে গেছে। চন্দন বলল, ‘আমার যেন এখন মনে হচ্ছে মাংস কেনার সময় দোকানদার বলেছিল পাঁঠাটা তোতাপুরী! আপনার খেতে কোনও অসুবিধা হবেনা তো? নইলে আমি অন্য ব্যবস্থা করছি।’

চন্দনের প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থেকে জাদুকর সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘আপনি যখন খাওয়াতে চাচ্ছেন তখন খেয়েইনি। আমার এখন মনে হয় ওরা আমাদের খেয়ে ফেলার আগেই আমাদেরই ওদের খেয়ে ফেলা ভালো। তোতাপুরী পাঁঠা হোক বা না হোক গন্ধতেই মনে হচ্ছে ভালো রান্না হয়েছে। তাছাড়া এই করোনা আবহাওয়াতে মাংস খেলে শুনেছি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *