জাদুকর সত্যচরণ ও ইলিশবাবা

জাদুকর সত্যচরণ ও ইলিশবাবা

|| ১ ||

রবিবার সাধারণত বাজার সেরে বাড়িতে ফেরার পর আর বাড়ির বাইরে বেরোয় না চন্দন। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে সে। সারা সপ্তাহ তাকে টই টই করে কলকাতা শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর কাটতে হয়, কখনও বা কলকাতার বাইরে কাজের সূত্রে কাছে-দূরেও যেতে হয়। এই একটি দিনই তার ছুটি। কাজেই সে এই দিনটা ভালো মন্দ রান্না করে খেয়ে, বই পড়ে, ঘুমিয়ে নিয়ে আরাম-আয়েশে কাটাবার চেষ্টা করে। তাই এ রবিবারও ব্যাপারটার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। তার ওপর সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাজেই বাইরে যাবার আর প্রশ্নই ওঠে না চন্দনের। তবে সকালবেলা তাকে বাজার যেতে হয়েছিল বর্ষার মধ্যেই। না গেলেও চলত। কিন্তু চন্দনের মনটা আনচান করছিল ইলিশ মাছের জন্য। এবার বর্ষার শুরু থেকেই বাজারে প্রচুর ইলিশ উঠতে শুরু করেছে আর তা দামেও বেশ সস্তা। তা দিয়ে রসনাতৃপ্তির জন্য বাজারে গেছিল সে। কেজিখানেক ওজনের একটা ইলিশ কিনেও এনেছে সে। চন্দন একা মানুষ। তা দিয়ে তার সারাটা সপ্তাহ চলে যাবে । মাছ কিনে আনার পর কাঁচা মাছ একটা থালাতে সাজিয়ে রেখে রান্না বসাবার আগে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল চন্দন। জানলাটা খোলাই ছিল। তা দিয়ে আলো আসছিল চন্দনের পড়ার টেবিলে। হঠাৎই সে আলো বেশ কমে এল। চন্দন কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখল হঠাৎই প্রকাণ্ড একটা কালো মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিতে চলেছে। অর্থাৎ বৃষ্টি আরও জোরে নামবে! ঠিক এই সময় তার বাসা বাড়ির দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। এ সময় আবার কে এল? চন্দন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার মন। দরজার বাইরে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন জাদুকর সত্যচরণ! যিনি নিজেকে বলেন, ‘হুডিনি অব ইন্ডিয়া।’ যদিও তাঁর ছাতাটা পৃথিবী বিখ্যাত জাদুকর হুডিনির মতো বৈভব-সচ্ছলতার সাক্ষ্য দিচ্ছে না। সত্যচরণের ছাতার শিকগুলো ভেঙ্গে জীর্ণ ছাতাটা কেমন যেন একটা অষ্টাবক্র, কিম্ভূত আকার ধারণ করেছে। তা দেখে বোঝাই যায় যে ভারী বর্ষণে ও ছাতা কোন কাজেই আসবে না।

চন্দনকে দেখে ছুঁচালো গোঁফের তলায় হাসি ফুটিয়ে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘যাক আপনি ঘরেই আছেন। কাছেই একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ফেরার সময় মনে হল, এত কাছেই যখন এলাম তখন একবার দেখা করে যাই আপনার সঙ্গে। তাই চলে এলাম।’

সত্যচরণের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। চন্দন বলল, ‘এসেছেন বেশ করেছেন। আগে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর ঢুকুন। নইলে ভিজে যাবেন।’

তার কথা শুনে ছাতাটাকে ভাঁজ করে উঠানে দরজার এক কোণে নামিয়ে রেখে ঘরে ঢুকলেন সত্যচরণ। এ বাড়িতে আগেও এসেছেন সত্যচরণ, ঠিক যেমন চন্দনও গিয়েছে আমহার্স্ট স্ট্রিট অঞ্চলে সত্যচরণের চিলেকোঠার ভাড়া ঘরে। সেই যে উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা ফেরার পথে রেলগাড়ির কম্পার্টমেন্টে চন্দনের সঙ্গে জাদুকর সত্যচরণের প্রথম আলাপ হয়েছিল, তারপর দেখতে দেখতে তাদের দুজনের পরিচয়ের – বন্ধুত্বের পাঁচটা বছর কেটে গেছে। তবে এ পাঁচ বছরে সত্যচরণের বিশেষ একটা অবনতি বা উন্নতি হয়নি। অতি সাধারণভাবে, হয়তো বা কখনও কিছুটা কষ্ট করেই জীবন চালিয়ে নেন ছোট জাদুকর সত্যচরণ। তবে তাঁর গল্পের ঝুলি, যাকে তিনি নিজের বহুদর্শী জীবনের অভিজ্ঞতা বলে থাকেন তা এখনও অফুরন্ত। চন্দনের সঙ্গে যখনই তার সাক্ষাৎ হয় তখনই তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে ভয়ঙ্কর, অবিশ্বাস্য নানান ধরনের লৌকিক-অলৌকিক গল্প শোনান চন্দনকে। সে সব গল্প চন্দন পুরোপুরি বিশ্বাস করুক বা না করুক সত্যচরণের সে সব কাহিনীর প্রতি চন্দন যে একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে তা চন্দন অস্বীকার করতে পারে না। তাই জাদুকর সত্যচরণের আবির্ভাবে চন্দনের মনটা নতুন কোন গল্প শোনার প্রত্যাশায় নেচে উঠল। টেবিলের গায়ে চেয়ারে সত্যচরণকে বসিয়ে চন্দন বলল, ‘দাঁড়ান আগে আপনার জন্য এক কাপ চা করে আনি। তারপর আড্ডা হবে। আপনার ফেরার তাড়া নেই তো? তাছাড়া বৃষ্টি না পড়লে বেরোবেনই বা কী করে?’ সত্যচরণ একটা রুমাল বার করে তা দিয়ে তাঁর ভিজা মুখ-হাত মুছতে মুছতে বললেন, ‘না, এখন আমার কোন তাড়া নেই। এমনিতেই আজকাল আমার কাজ-কর্ম কমে আসছে তার ওপর এই বর্ষাকালে প্রায় সম্পূর্ণ ঘরে বসেই কাটাতে হয় পাড়ার ছোটখাটো ফাংশন-গুলোও বন্ধ থাকে বলে।’ সত্যচরণের এ কথা শুনে চন্দন বুঝতে পারল জাদুকর সত্যচরণের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে ভালো যাচ্ছে না।

ঘরের এক কোণে রাখা মাইক্রোওভেনে তিন মিনিটের মধ্যেই চা বানিয়ে এনে সত্যচরণের হাতে তা তুলে দিয়ে চন্দন তার মুখোমুখি চেয়ারে বসল। বেশ কয়েকবার তৃপ্তি সহকারে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘বাঃ, বেশ চা!’

চন্দন জানতে চাইল, ‘কী কাজে এসেছিলেন এদিকে?’

সত্যচরণ জবাব দিলেন, ‘শিয়ালদার কাছে এক ভদ্রলোক থাকেন, তিনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা করেন। অর্থাৎ পয়সার বিনিময় নানান ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজনের দায়িত্ব নেন। সময়ের অভাবে পুজো, বিয়েবাড়ি, জন্মদিন ইত্যাদি নানান অনুষ্ঠানের দায়িত্ব আজকাল অনেকেই ইভেন্ট ম্যানেজারদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। তাই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম যদি কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে খেলা দেখাবার সুযোগ মেলে সেজন্য। লোকটা অবশ্য এখনই কোন কথা দিতে পারল না। ফোন নম্বর দিয়ে যেতে বলল, প্রয়োজনে যোগাযোগ করে নেবে বলে জানালো।’- একটানা কথাগুলো বলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার খবর কী?’

চন্দন হেসে বলল, ‘আমি একলা মানুষ। মোটামুটি ভালোই কেটে যাচ্ছে। তবে বেসরকারি চাকরিতে কাজের চাপ বেড়েই চলেছে। মাঝেমাঝেই মনে হয় আপনার বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসি, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। আপনি আসাতে সত্যিই ভালো লাগছে।’

চন্দনের কথা শুনে সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘আপনি যে আমার মতো সাধারণ মানুষকে মাঝে মাঝে ফোন করে কুশল জিজ্ঞেস করেন সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। এই ব্যস্ত পৃথিবীতে এটুকু খোঁজখবরই বা বিনা স্বার্থে কয়জন নেয়?’

চায়ের কাপে বেশ কয়েকবার লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করে এরপর সত্যচরণ কাপটা নামিয়ে রাখলেন।

চন্দন এরপর তাঁকে কিছু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তিনি বাতাসে নাকটা টেনে বললেন, ‘কাঁচা ইলিশের গন্ধ পাচ্ছি বলে মনে হয়!’

জাদুকর সত্যচরণ মিথ্যা বলেননি। চন্দনের ছোট্ট কিচেনটা এ ঘর সংলগ্নই। সেখানেই একটা থালার ওপর সাজানো আছে বাজার থেকে সদ্য কাটিয়ে আনা মাছ । রান্না ঘরের দরজাটা খোলাই আছে। তা দিয়ে ইলিশ মাছের মৃদু আঁশটে গন্ধ এ ঘরেও প্রবেশ করছে। সত্যচরণের কথা শুনে চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, ইলিশ। আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন ভালোই হলো। দুটো ইলিশ মাছ ভাজা আর তার তেল দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে যাবেন।

চন্দনের প্রস্তাব শুনেই জাদুকর সত্যচরণের চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘আপনি যখন বলছেন তখন খাব। সত্যি কথা বলতে কী ইলিশ ভাজার তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খেতে যেন অমৃত মনে হয়!’

এ কথা বলার পর তিনি তাঁর টিকালো নাক দিয়ে বাতাসে শ্বাস টেনে বললেন, ‘দীঘা? না! কোলাঘাট? না! মনে হচ্ছে মাছটা ডায়মন্ড হারবারের।’

জাদুকর সত্যচরণের কথাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল কিনা তা চন্দনের জানা নেই। তবে সে তাঁর কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আপনার তো অদ্ভুত নাক মশাই! কাঁচা ইলিশের গন্ধ শুঁকেই বলে দিলেন কোথাকার মাছ! মাছঅলা বলছিল এ মাছ ডায়মন্ড হারবারেরই ইলিশ!’

চন্দনের তারিফ শুনে হাসি ফুটে উঠল জাদুকর সত্যচরণের মুখে। তিনি বললেন, ‘আমি যখন পথে পথে ঘুরে আমার জাদুর খেলা দেখিয়ে বেড়াতাম তখন বেশ কয়েকবার কয়েক জায়গাতে ইলিশ ধরার নৌকাতে উঠেছি। তাই জানি এক এক জায়গার ইলিশের শুধু স্বাদের পার্থক্য থাকে না, কাঁচা মাছের গন্ধরও পার্থক্য থাকে। তাই সাধারণ মানুষ না চিনলেও আমি কাঁচা ইলিশের গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারি কোথাকার ইলিশ। যদি অবশ্য তা কোল্ড স্টোরেজের পুরানো ইলিশ না হয়। তাছাড়া..।’ এই বলে থেমে গেলেন তিনি।

চন্দন জিজ্ঞেস করল, ‘তাছাড়া কী?’

সত্যচরণ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘এই ইলিশের ব্যাপার নিয়ে আমার একটা আশ্চর্য, অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আছে। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাও বলতে পারেন। ইলিশের গন্ধ নাকে এলেই আমার সে ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়।’

জাদুকরের কথা শুনে চন্দন বুঝতে পারল তিনি নতুন কোন কাহিনী বলতে চলেছেন। এটাই চন্দন মনে মনে চাইছিল। সে বলল, ‘পাঁচটা মিনিট আমাকে সময় দিন। ইলিশে একটু হলুদ নুন মাখিয়ে রাখি আর ভাতটা চাপিয়ে দেই। তারপর জমিয়ে আপনার গল্প শুনতে বসব।’

সত্যচরণ বললেন, ‘ঠিক আছে তবে তাই হোক এই বলে তিনি পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই বার করলেন।

|| ২ ||

চন্দন অতি দ্রুত তার কাজ মিটিয়ে সত্যচরণের মুখোমুখি এসে বসল। সত্যচরণ শেষ একটা লম্বা টান দিলেন বিড়িতে। তারপর সেটা টুসকি দিয়ে জানলার গরাদের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বেশ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন বাইরের প্রবল বর্ষণের দিকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা —

‘আমি যা আপনাকে শোনাতে যাচ্ছি তা গল্পর মতো মনে হলেও একদম সত্যি ঘটনা। তবে আপনি তা বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। আপনি তো জানেনই আমি প্রথম জীবনে বাজিকর ছিলাম। অর্থাৎ পথে পথে নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে হাতসাফাই বা জাদুর খেলা দেখিয়ে বেড়াতাম। এ ঘটনা ঠিক সে সময়েরই। আমার গুরু বিখ্যাত বাজিকর হংসরাজের থেকে ভোজবাজির কিছু কলাকৌশল রপ্ত করার পর তখন আমি তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে পথে নেমেছি আমার জীবিকা নির্বাহর জন্য। একলা মানুষ, পথে ঘাটে, বাজারে মেলায় খেলা দেখিয়ে যে দু-চার পয়সা রোজগার হয় তখন তাতেই চলে যায় আমার। থাকার জায়গা বলতে রেল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডের ছাউনি, স্কুল-বাড়ির বারান্দা বা নাটমন্দির। আর সম্পত্তি বলতে পিঠের থলেতে কটা পুরানো জামা-কাপড় আর জাদু দেখাবার সরঞ্জাম । তবে এ সময়ের মতো সে সময়ও বর্ষাকালে আমাদের কাজকর্মে ভাঁটা থাকত। গ্রাম বাংলা প্রায়শ‍ই জলমগ্ন থাকত সে সময়, তখন কে আর বৃষ্টিতে ভিজে আমার জাদুর খেলা দেখবে? সে প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের বর্ষাকালের ঘটনা। আমি তখন সদ্য যুবক। খেলা দেখাবার জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরের এক মফস্বলে। আর তারপরই বর্ষা নামল। আমার আর বেশ কিছুদিন অন্য কোন জায়গায় যাওয়া হল না । একটা পুরানো স্কুলবাড়ির এক কোণে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল কিছু মানুষ। সেখানেই আমি থাকি আর কোনক্রমে দুটো চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে দিন যাপন করি । সময় সুযোগ পেলে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে মন্দিরের চাতালে বসে গল্প গুজব করি। অল্প বয়স হলেও ততদিনে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা জমা হয়ে গেছিল আমার ঝুলিতে। সে সব গল্পই আমি শোনাতাম তাদের। বলতে গেলে সেই গল্প শোনার লোভেই তারা আমাকে থাকতে দিয়েছিল সে জায়গায়। যাই হোক, একদিন আমি তাদের মুখ থেকেই শুনতে পেলাম আরও কিছু গঞ্জ পেরিয়ে খানিকটা দূরে এক জায়গাতে নাকি শ্রাবণী পূর্ণিমার মেলা বসতে চলেছে। জায়গাটা একদম নদীর পাড়ে। সে জায়গা থেকে মোহনা নাকি বেশি দূরে নয়। মেলার কথা শুনে আমার মনটা নেচে উঠল। বেশ অনেকটা দিন হয়ে গেল আমি তখন আয়হীন অবস্থায় বসে আছি। মেলায় গেলে সামান্য হলেও কিছু পয়সা জুটে যাবে আমার। তাছাড়া সে জায়গা সম্পর্কে আমি আরও একটা খবর শুনতে পেলাম লোক মুখে। বর্ষার মরশুমে নাকি ইলিশ ওঠে সেই নদীতে। বেশ কয়েকটা মাছের আড়তও আছে সে জায়গাতে। অনেক সময় নাকি বর্ষাকালে কর্মঠ লোকও কাজে নেওয়া হয় আড়তগুলোতে। আমার এখন জোয়ান বয়স। বর্ষাকালে তো আর খেলা দেখাবার জন্য পথে নামা যাবে না। আড়তে যদি কোন কাজ পাওয়া যায়, দুটো পয়সা পাওয়া যায়, বাকি বর্ষাকালটুকুতে একটু মাথা গোঁজার ছাউনি পাওয়া যায় তবে মন্দ কি? জায়গাটা সম্পর্কে শোনার পর এসব কথা বিবেচনা করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ও জায়গায় যাব। আর সেই সিদ্ধান্ত মতোই আমি কয়েক দিনের মধ্যেই সেই স্কুলবাড়ির বারান্দা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে একদিন গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই শ্রাবণী পূর্ণিমার মেলাতে।’

কথাগুলো একটানা বলে একটু থামলেন সত্যচরণ। তারপর চন্দনের উদ্দেশে বললেন, ‘তবে সে জায়গার নাম আমি কাউকে কোনদিন বলিনি, আর আজও আপনাকে বলব না। তার কারণটা আমার কাহিনী শেষ হলে আপনি বুঝতে পারবেন, অথবা আমি বলে দেব আপনাকে। ‘

জাদুকর সত্যচরণের কথা শুনে চন্দন হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, সে জায়গার আসল নাম আমাকে বলার দরকার নেই। আপনি গল্পটা বলুন?’

চন্দনের কথার পর সত্যচরণ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তবে এ জায়গার একটা নাম তো বলতে হবে। নইলে গল্পটা এগোবে কীভাবে। তাই ধরা যাক ও জায়গার নাম ছিল, ‘ইলিশমারি।’ ইলিশ মারা হয় বা ধরা হয় যেখানে। ছোট্ট একটা জায়গায় ইলিশমারি। কয়েক ঘর মাত্র মানুষের বাস সেখানে। কয়েকটা মাছের আড়ত সেখানে আছে ঠিকই তবে তাদের কর্মব্যস্ততা থাকে শুধু বর্ষাকালেই ইলিশ ধরার মরশুমে। ওই কয়েকটা আড়ত ঘরবাড়ি, নদীর পাড়, নদী আর নদীর বুকে জেগে থাকা একটা চর, এ নিয়েই ওই ইলিশমারি জায়গাটা। আর হ্যাঁ, একটা ছোট গ্রামীণ শ্মশানও আছে সেখানে নদীর ধারে। নদীর পাড়ে একটা বুড়ো শিবের মন্দিরও আছে। আর তাকে কেন্দ্র করেই শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মেলাটা বসে। আশেপাশের গ্রামের লোকজন নদী থেকে জল তুলে শিবের মাথায় ঢালে। মেলা চলে তিন দিন। পূর্ণিমার দিন সকাল সকালই আমি পৌঁছে গেছিলাম ওই ইলিশমারির মেলাতে। মেলা উপলক্ষে বেশ কয়েকটা চাটাইয়ের ছাউনি বানানো হয়েছিল নদীর পাড়ে। তারই একটাতে আমার আশ্রয় জুটে গেল। বেলা যত বাড়তে লাগল তত জনসমাগম বাড়তে লাগল সেখানে। ও জায়গা সম্পর্কে একটা কথা সে সময় প্রচলিত ছিল। দেবতার মাথায় যারা জল ঢালতে আসেন যাতে তাদের কষ্ট না হয় সেজন্য বুড়ো শিব নাকি ও দিন সে স্থানে বৃষ্টি হতে দেন না। আমি দেখলাম কাকতালীয় হলেও ব্যাপারটা সত্যি। বর্ষাকাল হলেও কোন বৃষ্টি সেদিন সেখানে হল না । আর আমিও নদীর পাড়ে একটা সুবিধা মতো জায়গা বেছে নিয়ে খেলা দেখাতে বসে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কী খেলা দেখিয়ে আমার আয় মন্দ হল না। পরপর তিনদিনই খেলা দেখালাম আমি। তবে তিনটে দিন যে দেখতে দেখতে কীভাবে কেটে গেল তা আমি বুঝতেই পারলাম না। পূর্ণিমার পর দুদিন মাঝে মাঝে ছিট ছিট বৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই তবে তাতে মেলার বা খেলা দেখাতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু তিনদিন পর মেলা ভেঙ্গে গেল। মেলায় ঘুরতে আসা, মন্দিরে পুজো দিতে আসা লোকজন, অস্থায়ী দোকানদাররা, যে যার ঘরে ফেরার জন্য রওনা হল। কিন্তু আমি তখন কোথায় যাই? আমার তো কোন ঘরবাড়ি নেই। যে স্কুলবাড়িতে আমি ছিলাম সেখানে আবার ফিরে যাওয়া যায় বটে। কিন্তু ফেলে আসা জায়গাতে আমি আর ফিরে যাই না। আমার গুরুদেবেরও নিষেধ ছিল এ ব্যাপারে। ফেলে আসা জায়গাতে দ্বিতীয়বার ফিরে গেলে মর্যাদাহানি হয়। গুরুর সে নির্দেশ আমি মেনে চলি। তাহলে কোথায় যাব? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হল একবার এখানকার মাছের আড়তগুলোতে ঢু মেরে দেখা যেতে পারে। শুনেছিলাম তো তারা বর্ষাকালে কখনও কখনও কাজের লোক নেয়। তেমন একটা কাজ পাওয়া গেলে মন্দ কি? নিদেনপক্ষে একটা মাথা গোঁজার আশ্রয়ও যদি পাওয়া যায় তবে বর্ষার বাকি কটা দিন এই ইলিশমারিতেই মাথা গুঁজে কাটিয়ে দেব। নদীর পাড় থেকে কিছুটা তফাতেই উঁচু জায়গাতে লোকজনের বাসস্থান আর মাছের আড়তগুলো। নদীর পাড় থেকেই তা দেখা যায়। সেখানে কাজের সম্ভাবনার কথা ভেবে নিয়ে মেলা যেদিন ভাঙল সেদিন আমি আমার থলে নিয়ে চললাম আড়তের দিকে আমার কাজের সন্ধানে ।

ইলিশমারির মাছের আড়ত বলতে ইটের দেওয়াল আর অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া বেশ কয়েকটা ঘর সার সার দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একটা ঘর বেশ বড়, বাকিগুলো ছোটখাটো। এখন যেমন বড় বড় মাছের আড়তে মাছ ভালো রাখার জন্য বড় বড় ফ্রিজের ব্যবস্থা থাকে তখন সেখানে সে ব্যবস্থা ছিল না। আড়তগুলোর কোণে চৌবাচ্চার মতো জায়গাতে বরফ দিয়ে মাছ রাখা হত — সে আড়তগুলো ছিল তেমনই। শুনলাম বর্ষার সময় মাত্র দু-তিন মাস নাকি খোলা থাকে মাছের আড়তগুলো। বাকি সময় বন্ধ থাকে। যাই হোক আমি কাজের সন্ধানে আড়তগুলোতে ঢু মারতে শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম ‘মা মনসা’ নামের সব থেকে বড় মাছের আড়তটাতে। এমনিতেই অনেক লোকজন কাজ করে সেখানে। তারা জানিয়ে দিল লোকের দরকার নেই। এরপর আমি আরও কয়েকটা আড়তে কাজের সন্ধানে গেলাম। আমার মাছের আড়তে কাজের অভিজ্ঞতা নেই বলে অথবা আমি তাদের কাজে অপরিচিত উটকো লোক বলে সেসব জায়গাতে আমি তেমন একটা সুবিধা করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত আমি গিয়ে হাজির হলাম ‘মা লক্ষ্মী’ নামের শেষ আড়তটাতে। নামে ‘মা লক্ষ্মী’ হলেও মা লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি সে আড়তের ওপর খুব একটা বর্ষিত হয় না তা দেখেই বোঝা যায়। ঘরের মাথার ওপরের সাইনবোর্ডটা বিবর্ণ হয়ে একদিকে হেলে পড়েছে। অ্যাসবেস্টসের ছাদেরও একদিকে ফাটল ধরে সূর্যের আলো ঢুকছে ভিতরে। আড়তের টিনের ঝাঁপটাও রঙহীন, মরচে পড়া। আড়তের ভিতর কড়িকাঠ থেকে ঝুলন্ত দাঁড়িপাল্লার একপাশে সিমেন্টের তৈরি বেদী মতো একটা জায়গাতে বসেছিল একজন কালো শীর্ণ চেহারার লোক। সেই ছিল আড়তদার বা আড়তের-এর মালিক।

সে লোকের নাম পরান বিশ্বাস। আমি তার কাছে গিয়ে আমার আর্জি পেশ করলাম। লোকটা ভালো ছিল। সব কথা শুনে সে বলল, ‘দ্যাখো, আমার সময় এবার ভালো যাচ্ছে না। যে মাঝিদের কাজে লাগিয়েছি তারা দুএকটার বেশি ইলিশ আনতে পারছে না কোনদিন। নৌকা ভাড়া, জাল ভাড়া, আর তাদের মজুরি দিতেই নাভিশ্বাস উঠছে আমার। আর কদিন এভাবে চললে আড়ত বন্ধ করে দেব। পয়সা দিয়ে তোমাকে কাজে নেবার সামর্থ্য আমার নেই। তবে যদি এখানে তুমি থাকতে পারো তবে বর্ষার কটা দিন অথবা আমার আড়ত যে কটা দিন খোলা থাকবে সে কটা দিন থেকে যেতে পারো।’

লোকটার কথা শুনে আমার মনে হল বর্ষার রাতে মাথা গোঁজার জায়গা পাওয়াও কম কথা নয়। তাই তার কথা শুনে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমাকে এখানে থাকতে দিলেই হবে। আর তার জন্য যদি কোন কাজ করে দিতে হয় সেটাও বলবেন।’

পরান বিশ্বাস বলল, ‘কাজ তেমন বিশেষ কিছু করতে হবে না। এখানে একটা বারোয়ারি কুয়ো আছে। সেখান থেকে জল তুলে রোজ সকালে একবার মেঝেটা ধুয়ে দিলেই হবে। আর কুলুঙ্গিতে রাখা লক্ষ্মী-গণেশের সামনে সন্ধ্যাবেলা একবার ধূপ জ্বালালেই হবে। কিন্তু তোমার ভূতের ভয় নেই তো?

আমি বললাম, ‘না, ওসবের ভয় আমার তেমন নেই । কিন্তু এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

আড়ত মালিক একদিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওদিকে নদীর পাড়ে একটা শ্মশান আছে। রাতবিরাতে হরিধ্বনি দিতে দিতে এ পথ দিয়েই লোকে ওখানে মড়া নিয়ে যায়। একবার তোমার মতোই একজনকে এখানে রাতে থাকার জন্য আশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই হরিধ্বনি শুনে তিনদিন পর এ জায়গা ছেড়ে পালাল।’

কথাটা শুনে আমি হেসে বললাম, ‘না, আমি ও সবে ভয় পাই না। আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই। বহুবার আমি নানান জায়গায় শ্মশানকালীর মন্দির চত্বরে রাতও কাটিয়েছি।’ পরান বিশ্বাস এরপর টুকটাক নানা কথার পর হঠাৎই শ্মশানটা যেদিকে সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ রাতেই তো ইলিশবাবার আসার কথা। দেখি তাঁর আশীর্বাদ যদি পাই? যদি ইলিশ পাই? আমার কপাল ফেরে।’

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ইলিশবাবা কে?’

পরান বিশ্বাস সম্ভবত সেই ইলিশবাবার উদ্দেশে প্রণামের ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘তিনি হলেন এক বাকসিদ্ধ তান্ত্রিক। অনেক অলৌকিক ক্ষমতা আছে তাঁর। তিনি ইলিশের ঝাঁককে ডেকে আনতে পারেন। তারপর যে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে তাকে বলে দেন কোথায় জাল ফেললে ইলিশ মিলবে। প্রতি বছর বর্ষাকালে শ্রাবণী মেলা যেদিন শেষ হয় সেদিন রাতে তিনি তাঁর নৌকা নিয়ে এখানে উপস্থিত হন। কোথা থেকে তিনি আসেন তা কারো জানা নেই। তারপর কটা দিন তিনি এখানে থেকে যাদের প্রতি তিনি প্রসন্ন হন তাদেরকে ইলিশের খোঁজ পাইয়ে দিয়ে আবার ফিরে যান। তিনি ইলিশের সন্ধান দেন বলে সবাই তাকে ‘ইলিশবাবা’ নামে ডাকে।’

আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, ‘ওই ইলিশের ঝাঁক ডেকে আনতে পারেন! তার খোঁজ পারেন জেলেদের! এখানে এসে কোথায় থাকেন ?’

পরান বিশ্বাস বেশ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, পারেন । মাঝে যে চর আছে সেখানে ইলিশের ঝাঁককে টেনে আনেন তিনি। জাল ফেললেই তখন সেখানে ইলিশ ওঠে।’ এ কথা বলার পর সে বলল, ‘শ্মশানের দিকে যেতে নদীর পাড়ে একটা বিরাট অশ্বথ গাছ আছে। তার গায়ে ওঁর থাকার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে আড়তদাররা। সেখানেই উনি থাকেন। কাল ভোরবেলা আমি আড়ত হয়ে সাধুবাবার ডেরায় যাব সামান্য কিছু ভেট নিয়ে— যদি তিনি আমার প্রতি সদয় হন, আমাকে ইলিশের সন্ধান দেন সেজন্য। তাঁকে দেখার ইচ্ছে থাকলে তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারো।’

ব্যাপারটা শুনে আমি বেশ উৎসাহিত বোধ করে বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব।’

আমার সঙ্গে এরপর আর কিছুক্ষণ কথা বলে আমার হাতে আড়ত ঘরের ভার দিয়ে কিছু দূরে নিজের গ্রামে ফিরে গেল পরান বিশ্বাস। বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। আমি আর সে জায়গা ছেড়ে বেরোলাম না। অন্ধকার নামতেই ঝাঁপ ফেলে চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম নেমে এল চোখে। তবে মাঝ রাতের দিকে একবার আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছিল কয়েক মিনিটের জন্য। কারা যেন আড়তের সামনে দিয়ে হরিধ্বনি দিতে দিতে মড়া নিয়ে যাচ্ছিল সে সময়।

|| ৩ ||

পরদিন ভোর রাতেই কিছু দূরের কুয়ো থেকে জল তুলে এনে আড়ত ঘরের মেঝেটা সাফসুতরো করে দিলাম। ধূপও জ্বালিয়ে দিলাম লক্ষ্মী গণেশের মূর্তির সামনে। অন্য আড়তগুলোও ভোররাতেই খুলে গেছে। জেলে নৌকা থেকে কিছু মাছও এসে পৌঁছেছে সে সব জায়গায়। বিশেষত ‘মা মনসা’ নামে বড় আড়তের সামনে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। মাছ ওজন করা হচ্ছে পাল্লাতে। কিছু ইলিশও আছে তার মধ্যে ।

আমার কাজ মেটার পর পরই সেই কাক ভোরে সাইকেল চেপে আড়তে এসে হাজির হল পরান বিশ্বাস । তার কথা মতো আমি কাজ সেরে রেখেছি দেখে সে খুশি হলেও একটু হতাশ ভাবে বলল, ‘আমার নৌকার মাঝিরা কাল রাতেও কোন ইলিশ পায়নি তবে। পেলে তো তা আড়তে নিয়ে আসত।

এ কথা বলার পর সে বলল, ‘ইলিশবাবার কাছে গিয়ে দেখি এখন। তিনি যদি দয়া করেন আমার ওপর।’

পরান বিশ্বাস ইলিশবাবাকে নজরানা দেবার জন্য একটা থলে এনেছিল। তাঁর দর্শনে যাবার আগে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য থলের মুখটা একবার খুলল। আমি দেখলাম তার মধ্যে রাখা আছে কিছু ফল আর একটা সন্দেশের বাক্স। পরান বিশ্বাস এরপর তার কোমরের গেঁজ থেকে দুটো দশ টাকার নোট বার করল। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ও টাকার কিন্তু অনেক দাম ছিল। নোট দুটোও সে থলের মধ্যে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আমার এটুকুই সামর্থ্য, দেখি এতে বাবার মন গলে কিনা?’

এরপর আমরা রওনা হয়ে গেলাম ইলিশবাবার দর্শনে। নদীর পাড়ে যেখানে মেলা বসে তার ঠিক উল্টোদিকে নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে লাগলাম আমরা । সকালের আলো ছড়িয়ে পড়েছে নদীর বুকে। দেখা যাচ্ছে নদীর বুকে কুমিরের পিঠের মতো লম্বা চরটা। পরাণ বিশ্বাস বলল, ‘ওই চরের কাছেই মাছের ঝাঁককে টেনে আনেন ইলিশবাবা।’

সাধুর ডেরা বেশি দূরে নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। নদীর একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া অশ্বথ গাছটা। তার শিকড়গুলো নেমে গেছে নদীর দিকে। তারই সঙ্গে বাঁধা আছে ছ‍ই অলা কালো একটা নৌকা। অনুমান করলাম ওটাই ইলিশবাবার নৌকা। অশ্বথ গাছের গুঁড়ির চারপাশে বসার জন্য ইট দিয়ে বাঁধানো। আর গাছটার কিছু তফাতে দরমার বেড়া আর টালির ছাউনি দেওয়া ঘর। দরমার গায়ে কালো রঙ বা আলকাতরা মাখানো। দেখলাম আমাদের মতো আরও বেশ কিছু মানুষ ইতিমধ্যে সেখানে জড়ো হয়েছে ইলিশবাবার দর্শনের জন্য। তারা সবাই জেলে বা মাঝি সম্প্রদায়ের মানুষ। সবাই চেয়ে আছে কালো রঙের ঘরটার বন্ধ দরজার দিকে। ইলিশবাবার ঘরের ঠিক পিছনেই বড় বড় এক সার গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলোর ওপাশে কী আছে তা এদিক থেকে বোঝা যাচ্ছে না। সেদিকে কী আছে আমি তা জিজ্ঞেস করতেই পরান মন্ডল বলল, ‘গাছগুলোর ওপারেই নদীর ধারের শ্মশানটা ।

সন্ন্যাসীর দর্শনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। ইতিমধ্যে আরও বেশ কিছু মানুষ উপস্থিত হল সেখানে। পরান মন্ডল জানাল, নবাগতদের মধ্যে কয়েকজন আড়তদার, নৌকা মালিকও আছে। তাদের হাতেও উপঢৌকনের থলে।

একসময় ঘরের ঝাঁপ খুলে গেল। বাইরে এসে দাঁড়ালেন সাধু বাবা। তাঁর পরনে কালো রঙের আলখাল্লার অতো পোশাক, কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা মাথার চুল ও বুক পর্যন্ত নেমে আসা দাড়িও কুচকুচে কালো বর্ণের। তাঁর গাত্রবর্ণও কৃষ্ণবর্ণর। সব মিলিয়ে হঠাৎ তাঁকে দেখলে একটা কালো পাথরের মূর্তি মনে হতে পারে। ছিপছিপে লম্বা তান্ত্রিক সাধুর কপালে লাল তিলক কাটা, গলায় ঝুলছে নানান রঙের পাথরের মালা । লোকটাকে দেখে আমার মধ্যবয়সী বলেই মনে হল। তিনি বাইরের সূর্যালোকে বেরিয়ে আসতেই উপস্থিত সকলে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম জানাল তাঁকে। তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাঁর ডান হাতটা তুলে ধরে লোকজনের প্রণাম গ্রহণ করলেন, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অশ্বথ গাছের নীচে শান বাঁধানো জায়গায় গিয়ে বসলেন। সেখানে বসার পর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর ভালো করে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা কেমন আছিস?’

কেউ কেউ উত্তর দিল, ‘ভালো আছি।’ কেউ বা আবার নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

তিনি এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘ইলিশ উঠছে সবার জালে?’

এ প্রশ্ন শুনে একজন আড়তদার জবাব দিল, ‘যারা শহরের বড় বড় মাছ ব্যবসায়ী, যারা ট্রলার নিয়ে মোহনায় যায় তাদের জালে ইলিশ উঠছে ঠিকই। কিন্তু আমরা যারা এখানকার বাসিন্দা, স্থানীয় ব্যবসায়ী, নৌকা নিয়ে নদীর আশেপাশে ইলিশ ধরি তাদের এখন পর্যন্ত তেমন উঠছে না। কারো জালে তো এখনও একটাও ইলিশ ওঠেনি।’

লোকটার কথা সমর্থন করল পরান মন্ডল সহ আর বেশ কয়েকজন লোক ।

লোকজনের জবাব শুনে ইলিশবাবা বললেন, ‘আমি যখন এসেছি তখন তোদের আর চিন্তা নেই।’

তাঁর এ কথা শুনে একজন আড়তদার বলল, ‘আপনি কৃপা করলেই ইলিশ উঠবে বাবা।’— এ কথা বলে লোকটা একটা থলে নিয়ে বাবার দিকে গিয়ে এগিয়ে সেটা তার হাতে দিল। তিনি থলের মুখটা একবার ফাঁক করে দেখে নিয়ে সেটা পাশে সরিয়ে রেখে লোকটার উদ্দেশে বললেন, ‘তুই যখন আমার জন্য উপহার আনলি তখন তোকেও আমার কিছু উপহার দেওয়া কর্তব্য।’

এই বলে ইলিশবাবা তাঁর ডান হাতটা শূন্যে একবার ঘোরালেন। তারপর তিনি হাতের মুঠি খুলতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল সাধুবাবার মুঠির মধ্যে একটা সন্দেশ! সেটা তিনি লোকটার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তিন দিন পর দেখা করতে আসিস। দেখি তোর জন্য ইলিশের ঝাঁক আনতে পারি কিনা?’

যারা উপঢৌকন এনেছিল এরপর তারা একে একে সে সব তুলে দিতে লাগল সাধুবাবার হাতে। আর তিনিও প্রতি-উপহার হিসাবে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে এনে দিতে লাগলেন ছোটখাটো মিষ্টি, ফল ইত্যাদি। পরান মন্ডল তাঁর হাতে তুলে দিতেই তিনি তাকে একটা বাতাসা তুলে দিলেন। পরান মন্ডল সেটা নিয়ে ভক্তিভরে কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘এ বছর আমাকে দেখবেন বাবা। একটাও ইলিশ তুলতে পারিনি এখনও। তাছাড়া পরিবারের সময়ও খারাপ যাচ্ছে।’

তার কথা শুনে ইলিশবাবা আলগোছে বললেন, ‘কদিন পর আসিস একবার। দেখি কী করতে পারি?’ সাধুবাবার সঙ্গে উপস্থিত লোকজনের দেওয়া নেওয়া পৰ্ব শেষ হল এক সময়। তারপর তিনি বললেন, ‘তোরা এখন ফিরে যা। যাদের যেমন যেমন আসতে বললাম, তেমন তেমন এসে দেখা করিস।’— এ কথা বলে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন ইলিশবাবা।

তিনি যখন এসেছেন তখন এবার জালে ইলিশ পড়তে পারে এই আশা নিয়ে এরপর ফেরার পথ ধরল সবাই। পরান মন্ডল ফিরতে ফিরতে আমাকে বলল, ‘দেখলে তো সাধু বাবার অলৌকিক ক্ষমতা? কেমন শূন্য থেকে ফল মিষ্টি টেনে আনে! ওরকমই ও ইলিশের ঝাঁকও টেনে আনতে পারে। দেখি উনি আমার জন্য কিছু করেন কিনা?’

আমি পৃথিবীর সেরা বাজিকর হংসরাজের শিষ্য । নিজেও ভোজবাজির খেলা দেখিয়ে বেড়াই, আমার চোখ সব সময় সজাগ থাকে। আমি কিন্তু ততক্ষণে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরে গেছি যে ইলিশবাবার শূন্যে হাত ঘুরিয়ে মিষ্টি ফল আনাটাকে সবাই যতই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ভাবুক না কেন, ওটা আসলে ভোজবাজির খেলা। অমন খেলা আমিও দেখাতে পারি। তবে এর সঙ্গে আমার এ কথাও মনে হল হাত ঘুরিয়ে সন্দেশ বাতাসা আনা আর নদীর বুকে ইলিশের ঝাঁককে ডেকে আনা তো একই ব্যাপার নয়। সত্যিই কি তিনি সেটা পারেন? ব্যাপারটা জানতে হবে আমাকে। তিনি যদি সেটা পারেন তবে সত্যিই তো তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। ইলিশবাবার ভোজবাজির খেলা প্রসঙ্গে আমি কোন কথা জানালাম না আমার আশ্রয়দাতা পরান মন্ডলকে। হয়তো সে সময় ও কথা বললে লোকটা বিশ্বাস করত না। সন্ন্যাসীর ওপর সবার যা ভক্তি শ্রদ্ধা আস্থা দেখলাম তাতে কথাটা জানালে হিতে বিপরীত হতে পারত । আমি রয়ে গেলাম ওই আড়তেই। যেদিন আমরা ইলিশবাবার দর্শনে গেলাম সেদিন থেকেই ভারী বর্ষাও নামল। ওই মাছের আড়ত থেকে আমি আর বাইরে যাই না। কখনও সেখানে বসেই রাস্তায় লোকজন চলাচল দেখি। দিনে রাতে শ্মশানের দিকে মড়া নিয়ে যেতে দেখি। সে সময় গ্রামবাংলায় বর্ষাকালে মৃত্যুর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। ডায়রিয়া, সাপে কাটা, ঝড়-বৃষ্টি নানান কারণে মরত লোকে। দিনে, রাতে তাই অনেক মড়াই নিয়ে যেতে দেখলাম ও কদিন।’- একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ।

টেবিলে জলের গ্লাস রাখা ছিল। চন্দন সেটা বাড়িয়ে দিল তাঁর দিকে। বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে, তার সঙ্গে জমে উঠতে শুরু করেছে জাদুকর সত্যচরণের কাহিনীও বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গ্লাসের পুরো জলটাই পান করলেন তিনি। তারপর বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করলেন তাঁর কথা।

|| ৪ ||

‘ঠিক এমনই বৃষ্টি হচ্ছিল সে সময় কদিন ধরে। আমি তো রয়ে গেলাম সেখানেই। তিনদিন পর হঠাৎ একদিন ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি। হঠাৎ বাইরে লোকজনের হাঁকডাক শুনতে পেলাম। সে শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি কাছেই একটা আড়তের সামনে বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। হ্যাজাকের আলো জ্বলছে সেখানে। একটা ভ্যান রিক্সো থেকে বড় বড় মাছের ঝুড়ি নামানো হচ্ছে সেখানে। কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে দেখি সেগুলো সব বড় বড় রূপালি ইলিশে ঠাসা। কিছুক্ষণ আগেই তাদের তোলা হয়েছে জল থেকে। আড়তের মালিককেও আমি চিনতে পারলাম। এ লোকটাই প্রথম নজরানা দিয়েছিল ইলিশবাবাকে। কদিন পর তিনি তাকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছিলেন। সেই আড়তের সামনেই লোকমুখে এরপর শুনতে পেলাম ব্যাপারটা — গতকাল বিকালে আড়ত মালিক নাকি সাধুবাবার ডেরাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছিল। তখন ইলিশবাবা তাকে বলে দেন যে নদীর বুকে যে চর আছে তার গায়ে এক জায়গাতে তিনি লাঠি পুঁতে এসেছেন। সেখানে তিনি ইলিশদের ডেকে আনবেন। ও জায়গাতে জাল ফেললেই নাকি উঠবে। তাঁর নির্দেশ মতোই সেখানে জাল ফেলাতে এত ইলিশ উঠেছে! উপস্থিত লোকজন সব ইলিশবাবার জয়গান করতে লাগল। আর আমি নিজের জায়গাতে ফিরে এসে ভাবতে লাগলাম; এ কীভাবে সম্ভব? এ তো ভোজবাজির খেলা নয়; এতগুলো লোক তো আর মিথ্যে বলবে না!

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটল। আমিও চটপট আমাদের শূন্য আড়তটা প্রতিদিনের মতো ধোয়ামোছা করে নিলাম। যে আড়তে মাছ উঠেছে ক্রেতারা তখন সেখানে এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। আমার আড়তের মালিক পরান মন্ডলও কিছু সময়ের মধ্যে আড়তে এসে হাজির হল। পাশের আড়তের ঘটনা দেখে শুনে সে আমাকে বলল, ‘তোমাকে বলেছিলাম না ইলিশবাবা ইলিশের ঝাঁক ডেকে আনতে পারেন! কী, এবার আমার কথা বিশ্বাস হল তো?’

আমি আর কী বলব? তার কথার জবাবে আমি চুপ করে রইলাম। তবে মনের সন্দেহ আমার গেল না; খালি মনে হতে লাগল, এ কী করে সম্ভব ?

সেদিন কিছু সময় পর পরান মন্ডল যে জেলেদের নিযুক্ত করেছিল তারা এসে জানাল কয়েকটা চ্যাঙ মাছ আর বোয়ালের একটা বাচ্চা ছাড়া এ কয়দিন তাদের জালে কোন মাছ ওঠেনি। সেগুলো তারা রান্না করে খেয়ে ফেলেছে। তাদের কথা শুনে পরান মন্ডল বলল, ‘দেখি ইলিশবাবা আমার প্রতি কবে সদয় হন। তিনি খবর দিলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে তোদের জানাব। তোরা নদীতেই অপেক্ষা কর।’

এরপর আরও দু-দিন কেটে গেল। শুনলাম সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে যাঁর নৌকায় মাছ উঠেছিল সে পাঁচ ঝুড়ি মাছ বেঁচে নাকি এক লন্ডে পাঁচশো টাকা লাভ করেছে। এক এক ঝুড়িতে মাছ ছিল চল্লিশ কেজি। সে আমলে পাঁচশো টাকা অনেক বড় ব্যাপার ছিল!

ইলিশবাবার কথা মতো মাছ পাবার ব্যাপারটা যে কাকতালীয় নয়, এরপর আর কদিনের মধ্যে আবারও তার প্রমাণ পেলাম। আবারও আমি একদিন হইচই হট্টগোলের শব্দে শেষ রাতে বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা আড়তের সামনে ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ নামছে! ইলিশ মাছ! আগের দিনের মতোই আমি সে জায়গায় গিয়ে জানতে পারলাম যে ইলিশবাবার বদান্যতাতেই এই বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছ আহরণ সম্ভব হয়েছে চরের গায়ের এক জায়গা থেকে। সেখানে সাধুবাবা তার চিহ্ন দিয়ে এসেছিলেন! আমার এই দ্বিতীয়বারের ঘটনা দেখে মনে হল, তবে কি সাধুবাবা সত্যিই কোন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী? নইলে কী ভাবে ব্যাপারটা সম্ভব হচ্ছে? তার সঙ্গে সঙ্গে পুরানো প্রশ্নটাও আমার মনে উকি দিতে

লাগল, সত্যিই কি ইলিশের ঝাঁককে ডেকে আনা সম্ভব? আমার আড়তের মালিক প্রতিদিন সকালে এসে কিছুক্ষণ আড়তে থেকে যায়। পরান মন্ডল সেদিনও এল। মাছ পাবার ঘটনাটা সেও দেখল, শুনল। জেলেরা তার সঙ্গে এদিন দেখা করতে এল। যথারীতি তারা জানাল যে জালে মাছ ওঠেনি। এদিন তারা খোরাকি বাবদ টাকা চাইল তাদের নিয়োগকর্তার কাছে। পরান মন্ডল তাদের আশ্বস্ত করে বলল, ‘কটা দিন কোনভাবে নিজেরা খাই খরচ চালিয়ে নে। আমি টাকা দিয়ে দেব।’- এ কথা শুনে এদিনের মতো চলে গেল জেলেরা। তারা চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর ভাবে বসে থাকার পর পরান মন্ডল আমার উদ্দেশে বলল, ‘বুঝলে, ক’দিন ধরে আমার বেশ খারাপ সময় যাচ্ছে। বাড়িতে ছেলেটার জ্বর। ডাক্তারবদ্যি-ওষুধের খরচ, এদিকে আমার হাতে টাকা পয়সা নেই বললেই চলে। দেখলে তো জেলেদের টাকা দিতে পারলাম না। আজ নাহয় ওরা আমার কথা শুনে ফিরে গেল, কিন্তু সামনের দিন কি ফিরবে? ওরাও তো গরিব মানুষ। এখন একমাত্র ইলিশবাবাই ভরসা। তিনিই আমার সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন । ‘

সে কথা শুনে আমি বললাম, ‘তিনি তো আপনাকে দেখা করতে বলেছিলেন। বেশ অনেক কটা দিন তো হল তিনি এসেছেন। যান না, একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসুন ।

আমার কথা শুনে পরান মন্ডল বলল, ‘হ্যাঁ, আজ বিকালেই ইলিশবাবার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবছি। ওখান থেকে ফেরার পথে তোমাকে জানিয়ে যাব তিনি কী বললেন?’ এ কথা বলার পর পর পরান মন্ডল আড়ত ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এ দিন বেলার দিক থেকে টিপটিপ করে নাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হল। তার আর বিরাম নেই। আমি যথারীতি একই জায়গায় রইলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল একসময়। দেখলাম বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে একদল লোক একটা মড়া নিয়ে গেল। সম্ভবত কোন বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের মড়া। আমি আড়তের ঝাঁপ খুলে বসে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম সাধুর ডেরা থেকে পরান মন্ডল খবর নিয়ে আসবে বলে।

পরান মন্ডল এল যখন তখন সূর্য ডুবে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। সাইকেল থেকে নেমে, ভাঙা ছাতাটাকে ঘরের এক কোণে নামিয়ে রেখে নিজের চেয়ারে বসল সে। আমি দেখলাম তার মুখে হতাশা জেগে আছে। আমি পরান মন্ডলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধুর কাছে গেছিলেন? তিনি কী বললেন?’

পরান মন্ডল বলল, ‘গেছিলাম। তবে তিনি আমাকে ইলিশের খোঁজ দেবেন বলে মনে হয় না।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কেন দেবেন না?’

পরান মন্ডল চাপা স্বরে বলল, ‘তোমাকেই কথাটা বলছি, আর কাউকে কথাটা জানিও না। কথাটা কারো কানে গেলে ইলিশবাবার অভিশাপে আমার ক্ষতি হবে। তিনি তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন।’—এ কথা বলে মুহূর্তের জন্য থামল পরান মন্ডল। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আপনি যা বলবেন তা কাকপক্ষীও জানবে না।’

পরান মন্ডল এরপর বিমর্ষভাবে বলল, ‘ইলিশবাবা বললেন, ‘কুড়ি টাকার নজরানাতে নাকি তিনি ইলিশের ঝাঁক ডাকতে পারবেন না। তার জন্য একশো টাকা দিতে হবে তাঁকে। আর এ কথাও তিনি বলেছেন যতবার আমি তাঁকে একশো টাকা দেব ততবার তিনি আমার জন্য ইলিশ ডেকে আনবেন। কিন্তু আমার তাঁকে এখন পঞ্চাশ টাকা দেবার ক্ষমতাও নেই। কাজেই ইলিশ মনে হচ্ছে আমার ভাগ্যে নেই।’

এ কথা শুনে আমি বিস্মিত ভাবে বললাম, ‘তবে কি যারা ইলিশবাবার কথা শুনে ইলিশ পেয়েছে তারা তাঁকে একশো টাকা করে দক্ষিণা দিয়েছে?’

পরান মন্ডল বলল, ‘ইলিশবাবার কথা শুনে আমার তাইতো মনে হল।’

পরান মন্ডল এরপর আরও বেশ কিছুক্ষণ বিমর্ষভাবে আড়তে বসে রইল। তারপর অন্ধকার নামলে সাইকেল আর ছাতা নিয়ে রওনা হল বাড়ি ফেরার জন্য। সে চলে যাবার পর বেশ জোরে বৃষ্টি নামল। আড়তের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে আমি লম্ফ জ্বালিয়ে খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুম এল না আমার চোখে। আমি শুয়ে শুয়ে পরান মন্ডলের থেকে শোনা কথাগুলো ভাবতে লাগলাম । আমার মনে হতে লাগল যদি ইলিশবাবার মধ্যে কোন অলৌকিক ক্ষমতা থেকে থাকে তবে তিনি এত লোভী কেন? আমার গুরু হংসরাজের সাহচর্যে থেকে আমি বহু সাধু সন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনেছি। সাধারণত তাঁরা জাগতিক সব লোভ আকাঙ্ক্ষাকে অতিক্রম করেই সাধনার উচ্চমার্গে উন্নীত হয়ে অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করেন। আর সে ক্ষমতা তাঁরা কোনও সময় টাকা পয়সা অর্জনের জন্য ব্যবহার করেন না। তবে এ ক্ষেত্রে ইলিশবাবার আচরণ এমন কেন? তাঁর হাত ঘুরিয়ে শূন্য থেকে খাবার আনার ব্যাপারটা যে নেহাতই ম্যাজিক খেলা তা আমি ধরতে পেরেছি। তাঁর ইলিশ ডেকে আনার মধ্যেও কোন কৌশল নেই তো?— এসব কথা আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম। এর সঙ্গে সঙ্গে রাতও বেড়ে চলল।

তখন বেশ রাত। চালের ওপর জলের শব্দ না পেয়ে বুঝতে পারলাম বাইরে বৃষ্টি ধরেছে। কিন্তু তখনও আমার ঘুম আসেনি। বাইরে বৃষ্টি থামার পর জানলাহীন আড়ত ঘরটাতে হঠাৎই কেমন যেন গুমোট ভাব অনুভব হল আমার। তাছাড়া আমার মনে হল বাইরে থেকে একটু হেঁটে এলে হয়তো ঘুম আসবে আমার। কাজেই একটু দোনামনা করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম আমি। ঝাঁপ খুলে বাইরে বেরিয়ে আবার ঝাপের তালা লাগিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।

|| ৫ ||

আড়তগুলো যেখানে সেখান থেকে নদীর পাড় পাঁচ মিনিটের পথ। আমি হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে গিয়ে উপস্থিত হলাম নদীর পাড়ে বুড়ো শিবের মন্দিরের কাছে যেখানে মেলাটা বসে সেখানে। কোন লোক নেই সে জায়গায় । তবে মন্দির সংলগ্ন যে ঘাটটা আছে সেখানে বেশ কয়েকটা জেলে নৌকা আছে। মধ্যরাতে বা শেষ রাতের দিকে এই নৌকাগুলোই বেরিয়ে পড়বে ইলিশের সন্ধানে। সারাদিন থেকে রাত পর্যন্ত বর্ষণের পর আকাশে মেঘ কেটে গেছে । পূর্ণিমা চলে গেলেও চাঁদের আলোতে তখনও বেশ জোর আছে। সে আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নদীর বুকে জেগে থাকা চরটা। বেশ বড় চর। অন্তত আধমাইল লম্বা হবে সেটা। কিছু গাছগাছালিও আছে চরে। চাঁদের আলোতে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা। ওই চরের গায়েই ইলিশের ঝাঁক ডেকে আনে সাধুবাবা। কিছুক্ষণ সেই চরটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আমি পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। নদী থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাসে হাঁটতে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। চাঁদের আলোতে হাঁটতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না।

নিজের মনে নানান কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম। খেয়ালই করিনি কোন দিকে যাচ্ছি। আমার সম্বিত ফিরল সামনে একটা বড় গাছ দেখে। সেই অশ্বথ গাছ! আমি দেখলাম আমি সাধু বাবার ডেরার কাছে পৌঁছে গেছি। চাঁদের আলোতে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের ঘরটা। দরজা বন্ধ তার। কয়েক মুহূর্ত সে ঘরটার দিকে তাকিয়ে আমি আবার ফেরার জন্য পিছু ফিরতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একপাল শিয়াল ডেকে উঠল ঘরটার পিছন দিক থেকে। হঠাৎ সে ডাক শুনে আমি চমকে উঠে তাকালাম সে দিকে। অন্য কারো চোখ হলে হয়তো ব্যাপারটা ধরাই পড়ত না, কিন্তু আমার জাদুকরের চোখ। তাই সেদিকে তাকিয়ে একটা জিনিস আমার চোখে ধরা পড়ল। সাধু বাবার ঘরের পিছন দিকে যে গাছগুলো ওপাশের শ্মশান আর.এ পাশে সাধুবাবার ডেরার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছে, সেই গাছগুলোর আড়াল থেকে, অর্থাৎ শ্মশানের দিক থেকে বাইরে বেরিয়ে এল একজন লোক। কে ও? লোকটা যেন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকাল। আমিও অমনি মট করে গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। কারণ, লোকটাকে দেখতে হবে। সে কৌতূহল জাগাচ্ছে আমার মনে।

লোকটা এরপর ধীরে ধীরে সে জায়গা ছেড়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কী যেন একটা টেনে আনছে সে। সে আর একটু এগিয়ে আসতেই আমি চিনতে পারলাম তাকে। আরে এ যে স্বয়ং ইলিশবাবা! মাটির ওপর দিয়ে ঘষটে ঘষটে একটা বস্তা টেনে আনছেন তিনি! কী আছে ওই থলেতে? আমি কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখতে লাগলাম। সাধুবাবা তাঁর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন, আবারও তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন কেউ কোথাও আছে কিনা। বলাই বাহুল্য। তাঁর আচরণ বেশ সন্দেহজনক! এরপর তিনি এগিয়ে আসতে লাগলেন গাছটার দিকে। আমি কোনোক্রমে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিশে। তবে তিনি গাছের কাছে এসে দাঁড়ালেন না। আমার কয়েক হাত তফাত দিয়ে বস্তাটাকে টানতে টানতে ঢাল বেয়ে নদীর কিনারে নেমে পড়লেন। বস্তাটাকে প্রথমে তিনি উঠিয়ে ফেললেন তাঁর নৌকাতে। তারপর নৌকার কাছি খুলে নৌকাতে উঠে পড়ে বৈঠা চালাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে এগোতে লাগল তাঁর নৌকা। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম তাঁর গম্ভব্য নদীর বুকে জেগে থাকা চরটা। আমি দেখতে লাগলাম তাঁকে। এ নদী গঙ্গা বা পদ্মার মতো চওড়া নয়। সাধারণ নদী। গ্রীষ্মকালে এসব নদী শীর্ণ থাকে আর বর্ষায় ফুলে ওঠে। কার মুখে যেন শুনছিলাম যে গ্রীষ্মকালে নাকি ওই চরে লোকে গরু মোষ চরাতে যায়। পাড় থেকে চরের দূরত্ব খুব বেশি স্পষ্ট নয় । চাঁদের আলোতে মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে চরটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইলিশবাবার নৌকা গিয়ে ভিড়ল সেই চরে। আমার মনে হল ইলিশবাবা চরে নেমে প্রথমে কিছু একটা করলেন। ও জায়গাতে একটা ডালপালাহীন মরা গাছ আকাশের দিকে স্তম্ভর মতো গুঁড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর তিনি আবার নৌকাতে উঠে সেটা পাড় থেকে কিছুটা সরিয়ে এনে সম্ভবত জলের মধ্যে কিছু ফেললেন! আমি যেন অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম তার। এরপর সেই সন্ন্যাসী নৌকা নিয়ে সোজা ফেরার পথ ধরলেন। আবার গাছটার কাছে তিনি ফিরে এলেন। গাছের শিকড়ের সঙ্গে নৌকা বেঁধে পাড়ে উঠে পড়লেন। আমি খেয়াল করলাম সেই বস্তাটা আর নৌকাতে নেই। ইলিশবাবা এরপর তাঁর ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। আমি যখন বুঝতে পারলাম তিনি আর বাইরে বেরোবেন না, তখন আমি সে জায়গা ছেড়ে ফেরার পথ ধরলাম। তবে ব্যাপারটা আমার মনে প্রচন্ড কৌতূহলের জন্ম দিল। অন্ধকার রাতে সাধুবাবা কিছু কি ছেড়ে রেখে এলেন চরের পাড়ে? কেন? কী সে জিনিস?’

আমার সে রাতের সম্পর্কে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল একদিন পরের আবারও এক ঘটনাতে। সেদিন ভোরে এক নৌকো মাছ নিয়ে উপস্থিত হল এক আড়তের লোকজন। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পারলাম সাধুবাবার আশীর্বাদেই তাদেরও মৎস্য প্রাপ্তি। সন্ন্যাসীই বলে দিয়েছিলেন কোথায় জাল ফেলতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি আরও জানতে পারলাম তারা নদীর চরে দাঁড়িয়ে থাকা মরা গাছের গুঁড়ির সামনেই জাল ফেলেছিল! লোকগুলোর এই কথা আমার মনে ইলিশবাবা ও সেই রাতে দেখা ঘটনার সম্পর্কে আরও কৌতূহল বাড়িয়ে দিল। আমার মন বলতে লাগল কোন অলৌকিক ক্ষমতার বলে নয়, কোন কৌশলে ইলিশের ঝাঁককে টেনে আনছেন সাধুবাবা। আর সেটা আমাকে জানতে হবে। নজরদারি করতে হবে তাঁর ওপর।

আর সেদিন থেকেই সে কাজ শুরু করলাম আমি। বর্ষাকাল, বৃষ্টির বিরাম নেই। তার মধ্যেই সে রাতে ভিজতে ভিজতে গিয়ে আত্মগোপন করলাম সাধুবাবার ডেরার কাছে যদি কিছু দেখা যায় তার সন্ধানে। পরপর দুই রাত ভেজাই সার হল আমার। কিন্তু তৃতীয় রাতে আমি আবার দেখলাম সাধু প্রথমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গাছের আড়ালে গেলেন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি একটা থলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে চড়ে বসলেন তাঁর নৌকায়। এরপর আগের দিনের ঘটনার এই পুনরাবৃত্তি হল। তিনি চরের এক জায়গাতে গিয়ে নৌকা ভিড়ালেন। জায়গাটা খেয়াল করে রাখলাম আমি। সেখানে চরের গায়ে একটা খাঁজের মতো আছে। তিনি প্রথমে সেখানে নামলেন। তারপর নৌকায় উঠে একটু সরে এসে থলেটা মনে হয় জলে ফেলে দিলেন। তারপরে এ পাড়ে ফিরে নৌকা বেঁধে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।’— এ পর্যন্ত বলে থামতে হল সত্যচরণকে। প্রেসার কুকারটা হুশ্ হুশ্ শব্দে সিটি মারছে! চন্দন বলল, ‘দাঁড়ান আমি ভাতটা নামাই, আর আপনিও পাঁচ মিনিট জিরিয়ে নিন। —

চন্দনের ভাত নামিয়ে ঠিক করে রাখতে যত সময় লাগল তার মধ্যে সত্যচরণ আরাম করে একটা বিড়ি টেনে প্রস্তুত হলেন তাঁর কাহিনীর অন্তিম অংশ বলার জন্য। চন্দন ভাত নামিয়ে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘যাক ভাতটা হয়ে গেল, আপনার গল্প শেষ হলেই ইলিশ ভেজে গরম গরম ইলিশ ভাজার তেল দিয়ে দুজনে ভাত খেতে বসে যাব।’

কথাটা শুনে হাসি ফুটে উঠল জাদুকর সত্যচরণের মুখে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা —

|| ৬ ||

সে রাতের ঠিক একদিনের মাথায় আবার ইলিশ উঠল সব থেকে বড় আড়তদার ‘মা মনসার’ ঘরে। প্রচুর ইলিশ। এবং যথারীতি এটাও ইলিশবাবার আশীর্বাদ। আমি কায়দা করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ইলিশ উঠেছে চরের গায়ে খাঁজের মতো জায়গা থেকেই। ব্যাপারটা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। আমার এবার দৃঢ় বিশ্বাস হল সাধুবাবা এমন কিছু কৌশল করছেন যার জন্য সেখানে ইলিশ এসে জড়ো হচ্ছে। কিন্তু কী সেটা?

এদিন একটু বেলার দিকে যথারীতি পরান মন্ডল আড়তে এসে উপস্থিত হল। বিমর্ষ মুখ তার। সবাই ইলিশ পাচ্ছে শুধু তার ভাগ্যেই ইলিশ নেই। সে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আড়তে এসে উপস্থিত হল জেলেরা। পরান মন্ডলের কাছে বকেয়া খোরাকি দাবি করল তারা। পরান মন্ডল তাদের জানাল, ‘ঘরে অসুখ। তোমাদের টাকা আমি জোগাড় করে উঠতে পারিনি।

তার কথাগুলো শুনে জেলেরা ফিরে গেল ঠিকই তবে যাবার আগে তারা অসন্তুষ্ট ভাবে বলে গেল, আর তিন দিনের মধ্যে টাকা না পেলে তারা ‘মা মনসা’ আড়তে কাজে লাগবে। লোকগুলো চলে যাবার পর পরান মন্ডল আমাকে বলল, ‘মা মনসার মালিক হরেন বিশ্বাস মনে হয় ভালোই খুশি করেছে ইলিশবাবাকে। তার নাকি আরও ইলিশ উঠবে। এখানে আসার পথে তার সঙ্গে দেখা হল ।’ সে আমাকে বলল, ‘তোমার আড়ত তো ফাঁকাই পড়ে আছে। আমাকে কিছুদিনের জন্য ভাড়া দাও। তাতে তুমি দুটো পয়সা পাবে।’

একথা বলার পর পরান মন্ডল একটু হতাশ ভাবে বলল, ‘বাড়িতে ছেলেটার অসুখ সারছে না। হয়তো বা তাকে শহরে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে হবে। জেলেরা কাজ করুক বা না করুক তাদের বকেয়া টাকাও মেটাতে হবে। অথচ হাতে টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত হয়তো আমার এই আড়ত ঘর মা মনসাকেই ভাড়া দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে তোমার মাথা গোঁজার আশ্রয়টাও যাবে।’— এ কথাগুলো বলে বিষণ্নভাবে আড়ত ছেড়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হল পরান মন্ডল।

লোকটার কথা শুনে আর তার অবস্থা দেখে বেশ কষ্ট হল আমার। আমার এখানে আশ্রয়ের ব্যাপারটা বড় কথা নয়। আমি পথে পথে ঘুরি। ঠিক অন্য কোথাও মাথা গোঁজার আশ্রয় জুটিয়ে নেব। কিন্তু পরান মন্ডল লোকটা খুব সরল সিধা আর ভালো মানুষ বলেই আমার মনে হয়েছে। নইলে আমার মতো অপরিচিত লোককে বিশ্বাস করে সে তার আড়তে থাকতে দিত না। আমি তাই ভাবতে লাগলাম কোনভাবে তার সংকটমোচন করা যায় কিনা। হঠাৎ আমার মনে হল, সরাসরি সাধুবাবার সঙ্গে গিয়েই তো একবার কথা বলা যেতে পারে? চেষ্টা করা যেতে পারে যদি তাঁর মাধ্যমে কোন সুরাহা করা যায়। আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি লোকটা লোভী এবং প্রকৃত অর্থে সাধু নয়। তাই প্রয়োজনে তাকে কৌশলে চাপ দিয়েও পরান মন্ডলের জন্য মাছের ব্যবস্থা করানো যেতে পারে। এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ইলিশবাবার সঙ্গে দেখা করব। প্রতিদিনের মতো এদিন সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও টিপটিপ করে আবার কখনও বা মুষলধারে। বিকালের দিকে কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি একটু থামতেই আমি রওনা হলাম সাধুবাবার ডেরার দিকে। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টির ফলে বেশ উত্তাল দেখাচ্ছে নদীটাকে। জলস্তরও বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। আমি পৌঁছে গেলাম সেই অশ্বথ গাছের কাছে। তারপর ‘সাধু বাবা’ বলে বেশ কয়েকবার হাঁক দিলাম। দরজা খুলে বেরোলেন ইলিশবাবা। তারপর এসে দাঁড়ালেন গাছের নীচে আমার সামনে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি প্রথমে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর মৃদু বিস্মিত ভাবে জানতে চাইলেন, ‘তুই কে? কোথায় থাকিস?’

আামি জবাব দিলাম, ‘আমার নাম সত্যচরণ। কাছেই থাকি। পরান মন্ডলের আড়তে।’

আমার জবাব শুনে ইলিশবাবা বললেন, ‘সে তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছে? সে কি কিছু পাঠিয়েছে তোকে দিয়ে?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘না সে আমাকে পাঠায়নি। সে কিছু পাঠায়ওনি। তবে লোকটা বড় কষ্টে আছে। আপনি যদি কিছু সুরাহা করার ব্যবস্থা করেন তার জন্য এসেছি।’

কথাটা শুনে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে পরিচিত ইলিশবাবা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। সে কাজটা না করলে তার জন্য ইলিশ ডেকে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।

এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘তবে তুই যখন এসেছিস তখন তোকে শুধু মুখে ফেরাবো না।’ একথা বলে ইলিশবাবা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য শূন্যে হাত ঘুরিয়ে এক মুঠো বাতাসা মেলে ধরলেন আমার সামনে!

তন্ত্রসিদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই গেছিলাম। তিনি কাজটা করতেই আমিও শূন্যে হাত ঘুরিয়ে হাতের পাতা মেলে ধরলাম তার দিকে। বললাম, ‘আপনিও এটা নিন মাছবাবা ।

আমার হাতের পাতায় তখন বেশ বড় আকারের একটা সন্দেশ!

সন্ন্যাসী আবারও হাত ঘুরিয়ে একটা দানাদার মিষ্টি আনলেন আমার জন্য। আর আমিও সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্য হাতটা ঘুরিয়ে একটা মিষ্টি লেবু আনলাম তাঁর জন্য। তারপর সে হাতটাও মেলে ধরলাম সন্ন্যাসীর দিকে।

এবার স্পষ্টতই বিস্ময় ফুটে উঠল সেই অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ইলিশবাবার মুখে। তিনি বললেন, ‘তুই কে? কীভাবে এই জিনিসগুলো আনছিস?’

আমি হেসে বললাম, ‘আপনি যেভাবে জিনিসগুলো আনছেন, আমিও ঠিক সেভাবেই আনছি। আমি একজন বাজিকর।’

আমার কথা শুনে সন্ন্যাসীর মুখমন্ডলে একটা পরিবর্তন ঘটল। আর তা দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে তান্ত্রিক সন্ন্যাসী বুঝতে পেরেছেন তিনি আমার কাছে ধরা পড়ে গেছেন। বিস্মিত ভাবে তিনি চেয়ে রইলেন আমার দিকে।

আমি এরপর তাঁকে বললাম, আপনিও যে আমার মতো ভোজবাজির খেলা দেখিয়ে সন্দেশ আনেন সেটা আমি কাউকে এখনও বলিনি। আর আপনি যে বস্তা নিয়ে রাতের বেলা নদীর চরে যান সেটাও আমি এখনও কাউকে জানাইনি।’

আমার শেষ কথা শুনে সন্ন্যাসী চমকে উঠলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘তুই কী চাস আমার কাছে?

আমি জবাব দিলাম, ‘খুব বেশি কিছু চাই না। আপনি কীভাবে ইলিশ ডেকে আনেন সেটা দেখতে চাই। আর চাই আপনি পরান মন্ডলের জন্য এক ঝুড়ি ইলিশের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন সাধুবাবা। আমার মনে হল তিনি যে ফাঁদে পড়েছেন তা তিনি বুঝতে পারলেন। এরপর তিনি আমার উদ্দেশে বললেন, ‘ঠিক আছে, আজ ঠিক রাত বারোটার সময় তুই এখানে আয়। আমি তোর দাবি মতো সব ব্যবস্থা করব। তবে একলা আসবি। তুই যখন বাজিকর তখন নিশ্চয়ই জানিস গুহ্য বিদ্যা সবার সামনে প্রকাশ করতে নেই ।

আমি বললাম, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আমি একলাই আসব।’

ইলিশবাবা আর কোন কথা বললেন না। গম্ভীর মুখে তিনি তাঁর কুঁড়ের দিকে এগোলেন। আর আমিও আমার আস্তানার দিকে রওনা হলাম।’- এ পর্যন্ত বলে থামলেন – জাদুকর সত্যচরণ। তারপর চন্দনকে বললেন, ‘বাইরে বৃষ্টি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে মনে হয়। বেলা বারোটা বাজে। আপনি বরং ইলিশ মাছটা হালকা আঁচে বসিয়ে ফেলুন। আমার গল্পও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।’ সত্যচরণের কথা মতোই কাজ করল চন্দন। নুন-হলুদ মাখানো ইলিশ মাছের টুকরো গুলোকে হালকা আঁচে কড়াইয়ের তেলে ছেড়ে দিল। তারপর রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মাছগুলো নাড়তে হবে। আপনি গল্পের শেষ অংশটা বলুন। আমি এখানে দাঁড়িয়ে শুনছি। বেশ উত্তেজনা বোধ করছি গল্পের শেষ অংশটা শোনার জন্য।’ সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা বেশ রোমহর্ষক, সেটাই এবার আপনাকে বলি – ‘

|| ৭ ||

‘বর্ষার মেঘ! কখন আসে কখন যায় তার ঠিক নেই। ইলিশবাবার ডেরা থেকে ফেরার পথেই দেখলাম আকাশে মেঘ জমেছে। আমি আড়তে ফিরে আসার পরই বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নামল, আর তার সঙ্গে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। আসন্ন অভিযানের কথা ভেবে আমি মনে মনে প্রবল উত্তেজনা বোধ করতে লাগলাম। আমাকে জানতেই হবে ইলিশবাবা কোন মন্ত্রবলে ইলিশের ঝাঁক ডেকে আনেন। বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সময় এগিয়ে চলল। একসময় রাতের খাওয়া ছেড়ে আমি বাইরে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হলাম। যখন বাইরে বেরোলাম, বৃষ্টি তখন একটু কমলেও থামেনি। তবু তারই মধ্যে আমি রওনা হলাম সাধুবাবার ডেরার দিকে ।

নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেলাম আমি। তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। কারণ আমি অশ্বথ গাছের তলাতে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রহর গোনা শিয়ালের ডাক ভেসে এল নদীর মধ্যের চর থেকে। আর তার প্রত্যুত্তর জানাতে সাধুবাবার কুঁড়ের পিছন থেকে ডেকে উঠল শিয়ালরা। সাধুবাবাও একই সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে নদীর দিকে তাকালেন। নদী বেশ উত্তাল, বর্ষার জলপুষ্ট হয়ে সে ভরা যৌবনা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। নদীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তিনি বললেন, ‘এ বৃষ্টির নাম ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এ সময় মোহনার দিক থেকে নদীর বুকে ইলিশের ঝাঁক আসে। তাদের কীভাবে আমি এক জায়গায় ডেকে আনি, চল সেটা দেখবি।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আমি ইলিশবাবার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে নেমে পড়লাম। গাছের শিকড়ের সঙ্গে বাঁধা আছে নৌকার কাছিটা। নৌকাটা জলের ধাক্কায় দুলছে। ইলিশবাবা প্রথমে আমাকে বললেন ‘নৌকায় উঠে পড়।’

তাঁর নির্দেশ পালন করে হাঁটুজল ভেঙে নৌকায় উঠে পড়লাম। তিনিও এরপর নৌকার কাছিটা খুলে নৌকায় চড়ে বসে বৈঠাটা হাতে তুলে নিয়ে আমায় বললেন, ‘তুই ছইয়ের ভিতর গিয়ে বোস। আমি নৌকা বাইছি। যে সব জেলে ডিঙি রাতে মাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, আমি চাইনা তাদের কেউ তোকে আমার নৌকায় দেখুক । তারপর হয়তো কেউ আমার নৌকা চড়ার আবদার করবে। যা ভিতরে যা ।

ইলিশবাবার কথা অমান্য না করে আমি পর্দা ঠেলে ছইয়ের ভিতর ঢুকতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় একটা গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। এ কীসের গন্ধ? পরক্ষণেই একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে লাগল আমার মাথার পিছনে। মুখ থুবড়ে পড়লাম আমি।’ — এ পর্যন্ত বলে থামলেন সত্যচরণ।

গরম তেলে ইলিশ মাছ ছেড়ে দিয়েছে চন্দন। ভাজা শুরু হয়েছে। ইলিশ ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গল্প থামিয়ে জাদুকর জোরে শ্বাস টেনে বললেন, ‘আঃ কী সুবাস! মনে হয় শুধু এই গন্ধ দিয়েই এক থালা ভাত মেখে খাওয়া যায়! এ জন্যই ইলিশকে বলে মাছের রাজা!’

খুন্তি দিয়ে মাছ নাড়তে নাড়তে চন্দন বলে উঠল, ‘তারপর? তারপর?’ সে মাছ ভাজতে শুরু করলেও তার কান ছিল সত্যচরণের কথার দিকে।

সত্যচরণ বুঝতে পারলেন চন্দনের আগ্রহের ব্যাপারটা। তিনি এরপর শুরু করলেন‌ —

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। নৌকায় উঠে যে গন্ধটা পেয়েছিলাম সেটা কিন্তু ইলিশের গন্ধ নয়, অন্যরকম গন্ধ। আর তারপরই আঘাত পেয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। তবে আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখনও প্রথমেই সেই তীব্র গন্ধটা আমার নাকে এল। স্মেলিং সল্ট যেমন জ্ঞান ফেরাতে সাহায্য করে ঠিক তেমনই হয়তো বা সেই তীব্র গন্ধের জন্যই দ্রুত আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। চোখ মেলতেই আমি দেখলাম আমি ছইয়ের ঠিক সামনেই নৌকার ওপর পড়ে আছি হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। আমার কিছুটা তফাতে নৌকার মুখের কাছে আমার দিকে পিছন ফিরে বসে দাঁড় টানছেন ইলিশবাবা। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না যে পিছন থেকে বৈঠা দিয়ে আঘাত করে তিনিই আমাকে অজ্ঞান করে বেঁধে ফেলেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ভালো নয়। আর এরপরই আমি দেখলাম, আমাকে যে দড়িটা দিয়ে বাঁধা হয়েছে তার প্রান্তদেশটা নৌকার একপাশের কিনারে রাখা একখণ্ড ভারী পাথরের সঙ্গে বাঁধা। সম্ভবত তিনি আমাকে জলে ডুবিয়ে মারার তালে আছেন। আমি বুঝতে পারলাম বাঁচতে হলে এখন সাহস আর কৌশলই আমার সম্বল। আমি নিশ্চুপভাবে দেখতে লাগলাম তিনি কী করেন। বৃষ্টিটা বাড়ছে। তারই মধ্যে ভিজতে ভিজতে নৌকা চালাচ্ছেন তিনি। বৃষ্টির মধ্যে বর্ষার জলস্রোতে বেশ ভালোই দুলছে নৌকাটা। আমি দেখলাম নৌকাটা চরের কাছে চলে এসেছে। চরটাকে বেড় দিয়ে চরের অন্যপাশে এগোচ্ছেন ইলিশবাবা ।

এক সময় চরের অন্য পাশে পৌঁছে গেল নৌকা। কিছুটা এগিয়ে চরের এক জায়গায় নৌকা ভেড়ালেন তিনি। আমার দিকে একবার তাকালেন। আমি তখন একেবারে মড়ার মতো পড়ে। কে বলবে আমার জ্ঞান আছে! আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখার পর তিনি নিশ্চিত হয়ে একটা ছোট নোঙর জলে ফেললেন। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে আটকে গেল নৌকা। ইলিশবাবা এরপর একটা ছোট লাঠি হাতে নৌকা থেকে নামলেন। পাড়ে উঠে একটু উঁচু জায়গায় লাঠিটা পুঁতে তার মাথায় একটা কালো কাপড়ের টুকরো ঝুলিয়ে দিলেন। ইলিশবাবার নিশান, যা ইলিশের সন্ধান বলে দেয় অন্যদের।

কাজটা শেষ করে তিনি আবার নৌকায় ফিরে এলেন। নোঙরটা তুলে বৈঠা মেরে কিছুটা সরে এলেন নদীর ভিতর। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগোতে এলেন আমাকে নৌকা থেকে পাথর বেঁধে জলে ফেলে দেবার জন্য। ঠিক তখনই আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। মানুষ সাধারণত আট রকম ভাবে দড়ির বন্ধন দেয় বা দড়ি বাঁধে। তার থেকে কীভাবে মুক্ত হওয়া যায় তা হল ভোজবাজি শিক্ষার একটা অঙ্গ। সে শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম আমার গুরু হংসরাজের কাছ থেকে। ইলিশবাবা যখন মাটিতে নেমে কাজ করছিলেন তখন গুরুদেবের শেখানো সে বিদ্যার ফলে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছি আমি। আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে মৃদু বিস্মিত হলেও তিনি কিন্তু ঘাবড়ালেন না। খোলের মধ্যে তাঁর পায়ের কাছে একটা মাছ ধরার কোঁচ বা বল্লম রাখা ছিল। তিনি সেটা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি কীভাবে ইলিশ ডাকি সেটা তোর দেখার খুব শখ তাই না? সেটাই দেখাব তোকে।’ বৃষ্টির মধ্যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইলিশবাবার মুখ মন্ডলে একটা হিংস্র হাসি ফুটে উঠল। আর এরপরই তিনি মাছ ধরার বল্লমটা সোজা ছুঁড়ে মারলেন আমার দিকে। আমি ঠিক তার আগের মুহূর্তেই বল্লমের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য এক পাশে লাফালাম । গুরুদেবের অসীম কৃপা যে সন্ন্যাসী আমাকে বল্লম দিয়ে বিদ্ধ করতে পারলেন না। অস্ত্রটা আমার গা ঘেঁষে ছুটে গিয়ে ছিটকে পড়ল জলে। আর একই সঙ্গে একটা কাণ্ড ঘটল। আমি নৌকার কিনারে লাফিয়ে পড়াতে নৌকাটা একপাশে কাত হয়ে গেল। আর নৌকার কিনারে দড়ি বাঁধা পাথরটা ঝপ করে জলে পড়ে গেল। কিন্তু একেই হয়তো বা বলে নিয়তি। পাথরের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা — যা দিয়ে আমাকে বাঁধা হয়েছিল, সেটার সঙ্গে ঠিক সেই মুহূর্তে কীভাবে যেন জড়িয়ে গেল ইলিশবাবার পা। দড়ির টানে তিনিও ছিটকে পড়লেন ভরা নদীতে! জলে পড়ে যাবার পর তিনি বার কয়েক জলের নীচ থেকে লাফিয়ে উঠে নৌকাতে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমিও তো মানুষ। সাধু বাবা আমাকে খুন করার চেষ্টা করলেও আমি তো তাঁকে এভাবে মরতে দিতে পারি না। তাই আমিও নৌকার কিনারে বসে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম তাঁকে টেনে তোলার জন্য। আর তখনই একটা ঘটনা ঘটল! আমি আজও জানিনা সেটা আমার চোখের ভুল কিনা। আমি দেখলাম ইলিশবাবার চারপাশে কালো ঘোলা জলের ভিতর থেকে যেন উত্থিত হল বেশ কয়েকটা নানান আকৃতির হাত। একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল ইলিশবাবার কণ্ঠ থেকে। ঠিক সেই সময় চরের বুক থেকে একপাল শিয়ালও ডেকে উঠল। সন্ন্যাসীর আর্ত চিৎকার হারিয়ে গেল শিয়ালের ডাকের আড়ালে। আর হাতগুলো যেন তাঁকে টেনে নিল জলের গভীরে। হারিয়ে গেলেন ইলিশবাবা। আমি বুঝতে পারলাম এরপর সেখানে থাকলে আমার বিপদ হতে পারে। তাই বৈঠা উঠিয়ে নিয়ে আমি ফেরার পথ ধরলাম। আমি বুঝতে পারলাম পায়ে পাথর বাঁধা ইলিশবাবা আর কোনদিন জল থেকে উঠে আসবেন না।

গুরুদেবকে স্মরণ করতে করতে বৈঠা বেয়ে একসময় চরের এপারে নদীর পাড়ে সেই অশ্বথ গাছের কাছে ফিরে এলাম আমি। নৌকা থেকে নেমে আমি সেটাকে আবার ঠেলে দিলাম। জলস্রোতে ভাসতে ভাসতে অজানার উদ্দেশে এগিয়ে চলল নৌকা। শেষ রাতে আমি আবার আড়তে ফিরে এলাম।

|| ৮ ||

চন্দনের মাছ ভাজা শেষ। ভাজা মাছের থালাটা এনে টেবিলে রাখল সে। সদ্য ভাজা, সুগন্ধ উত্থিত চাকা ঢাকা ইলিশ মাছের দিকে তাকিয়ে একটু থেমে জাদুকর সত্যচরণ বলতে থাকলেন।

‘পর দিন একটু বেলার দিকে আমার আড়তের মালিক পরান মন্ডল এসে হতাশ ভাবে বললেন, ‘এবারও আমার কপাল মন্দ। ইলিশবাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য, একবার তাঁকে শেষ অনুরোধ জানাবার জন্য আমি তাঁর ডেরায় গেছিলাম। কিন্তু তিনি নেই, তাঁর নৌকাও নেই। ওভাবেই তিনি না বলে আসেন আবার না বলেই ফিরে যান। তোমার হয়তো আর এখানে থাকা হবে না। মা মনসাকে আড়তটা ভাড়া দিয়ে দেব। ইলিশবাবা না থাকলেও ওরা ট্রলার ভাড়া করে মোহনার ইলিশ ধরতে যাবে। এ জায়গা ওদের দরকার।’

আমি যে সে জায়গাতে এক রাতের বেশি থাকব না, ইতিমধ্যে আমি সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। পরান মন্ডলের কথা শুনে আমি বললাম, ‘ইলিশবাবা যাবার আগে আপনার খোঁজে এখানে দেখা করতে এসেছিলেন। আপনার উদ্দেশে বার্তা দিয়ে গেছেন তিনি। ‘

পরান মন্ডল বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন, ‘কী বার্তা?’

আমি বললাম, ‘তিনি বলে গেছেন, চরের উল্টোদিকে এক জায়গায় তিনি নিশান পুঁতে যাচ্ছেন। সেখানে জাল ফেললেই আপনার ইলিশ পাবার সম্ভাবনা। কথাটা পাঁচ কান করবেন না। আজ রাতেই সেখানে জাল ফেলুন।’

আমার কথা মতোই কাজ করেছিল পরান মন্ডল। পরদিন পরান মন্ডলের আড়তের সামনে ঝুড়ি ঝুড়ি ইলিশ মাছ নিয়ে হাজির হল জেলেরা। সবাই যখন সেই আনন্দে মাতোয়ারা তখন সেই সুযোগে সবার অলক্ষে আমি সে জায়গা ছেড়ে রওনা হয়ে গেছিলাম অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য। — এই হল আমার জীবনের একটা গল্প।’

চন্দন বলল, ‘কিন্তু আসল কথাটাই তো বললেন না! ইলিশবাবা ইলিশের জমায়েত করতেন কীভাবে? আপনিও বা কীভাবে জেনেছিলেন যে পরান মন্ডল ওই জায়গাতে গেলে ইলিশ পাবে?’

প্রশ্ন শুনে সত্যচরণ বললেন, ‘আগে খেয়ে নেই, তারপর সে কথা বলব।’

চন্দন ভাত বাড়ল দুটো থালায়। ইলিশ মাছ ভাজা, তার তেল দিয়ে, কাঁচা লঙ্কা ডলে গরম ভাত খাওয়া শুরু করল তারা দুজন। পরপর দুটো ইলিশ ভাজা খেলেন সত্যচরণ। চন্দন যখন তাঁর পাতে তিন নম্বর ইলিশ ভাজাটা দিল তখন সম্ভবত তিনি চন্দনের মুখ দেখে অনুমান করলেন, চন্দন যতক্ষণ না তার প্রশ্নের জবাব পাচ্ছে ততক্ষণ সে স্বস্তি পাচ্ছে না। তাই তৃতীয় মাছটা হাতে তুলে তিনি বললেন, ‘ইলিশবাবার ইলিশ মাছের ঝাঁক এক জায়গায় টেনে আনার কৌশলটা এবার বলেই ফেলি। পাছে আপনি ঘেন্না পান তাই এতক্ষণ আমি বলছিলাম না। ইলিশ মাছের প্রিয় খাদ্য কী জানেন? মড়া, বিশেষত মানুষের মড়া। বর্ষাকালে অনেকেই সেই গ্রামের শ্মশানে মৃতদেহ ভালো করে না পুড়িয়ে চলে যেত। দেহের যে সব না পোড়া অংশ, শিশুদের মাটিতে পোঁতা মৃতদেহ — সে সব সংগ্রহ করতেন ইলিশবাবা । তাঁর নৌকায় সেই পচা গন্ধ পেয়েই আমার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেছিল। সন্ন্যাসী সেগুলো সংগ্রহ করে বস্তাবন্দি করে নিয়ে গিয়ে পাথর বেঁধে জলে ফেলতেন। আর তার টানেই ছুটে আসত ইলিশের ঝাঁক। ঠিক যেমন তাঁর দেহের জন্যও ছুটে এসেছিল ইলিশের ঝাঁক। যাদের ধরেছিল পরান মন্ডলের জেলেরা। তবে ওই যে বললাম, একটা ব্যাপার আমার কাছে আজও স্পষ্ট নয়। যে হাতগুলো নদীর বুক থেকে উঠে এসেছিল সেগুলো কি মৃত মানুষের প্রেতাত্মার হাত? যাদের দেহ দিয়ে ইলিশ ডেকে আনতেন ইলিশবাবা? নাকি আমার উত্তেজনার বশে দৃষ্টি বিভ্রম হয়েছিল? সেগুলো ছিল নদীর ছোট ছোট ঢেউ, জলতরঙ্গ — যেগুলো অনেক সময় দেখতে হাতের পাতার মতো লাগে? ব্যস আমার সব কথা বলা শেষ।’

এ কথা বলে ইলিশের তৃতীয় টুকরোটা মুখে তুলে তাতে কামড় বসিয়ে জাদুকর সত্যচরণ চন্দনকে বললেন, ‘যাই বলুন, মরা মানুষ খাক আর যাই খাক, ইলিশের মতো স্বাদ কোন মাছের হয় না। ঠিক যেন অমৃত! আপনিও আর কটা মাছ চটপট খেয়ে ফেলুন।’

চন্দন তাঁর কথা শুনে একটা গরম ইলিশ ভাজা তুলে নিয়ে বলল, ‘আরো একটা মাছ দেই আপনাকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *