জাদুকর সত্যচরণের পাগড়ি

জাদুকর সত্যচরণের পাগড়ি

|| ১ ||

চন্দনদের অক্রুর দত্ত লেনের এই মেস বাড়িটা রবিবার প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। আবাসিকরা সব শনিবার দুপুরে মেস বাড়ি ফাঁকা করে ট্রেনে, বাসে কলকাতা ছেড়ে নিজেদের বাড়ি যায়। তারা আবার এখানে ফিরে আসে সোমবার সকালে। রবিবার মেস বাড়িতে বোর্ডার হিসাবে থাকে শুধু চন্দন আর এ-বাড়ির বোর্ডারদের রান্না-বাজার থেকে শুরু করে যাবতীয় ঝক্কি যে সামলায় সেই ওড়িয়াঠাকুর জগন্নাথ। মেসবাড়ি হলেও এ-বাড়ির বোর্ডাররা আলাদা আলাদাভাবে নিরুপদ্রবে থাকে। তিনি টেলিফোনে চন্দনকে জানিয়েছিলেন বিকাল পাঁচটা নাগাদই আসবেন। কাজেই গলির ভিতর চন্দনদের মেসের সামনে ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াতেই তার শব্দ শুনে জগন্নাথকে নিয়ে সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, ট্যাক্সি থেকে একগাল হাসি মুখে নামলেন সেই আদি অকৃত্রিম জাদুকর সত্যচরণ পুতিতুন্ডি। যাঁর কার্ডে লেখা থাকে ‘দ্য গ্রেট মাজিশিয়ান, হুডিনি অফ ইন্ডিয়া’। তার পরনে আছে চোস্ত পাজামা আর লম্বা ঝুলের ঝলমলে পাঞ্জাবি, পায়ে গুঁড় তোলা নাগরা। ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ির ডিকিটা খুলতেই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল চন্দনের পরিচিত কালো রঙের ওপর মড়ার হাড়-খুলি আঁকা জাদুকর সত্যচরণের সেই বিখ্যাত বাক্সটা, যার সাধারণ জিনিসগুলো এক একটা সম্পদ ভাণ্ডার। চন্দন, তাঁকে ‘আসুন, আসুন’ বলে আমন্ত্রণ জানাল। জগন্নাথ তুলে নিল সেই কালো রঙের বাক্সটা। বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে সত্যচরণকে নিয়ে ঘরে ঢুকল চন্দন। তার ঘরটা বেশ বড়োই বলা  যায়। ঘরটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে চন্দন। ইংলিশ খাট, আলমারি, টেলিভিশন সবই আছে এ
-ঘরে। এমনকী একটা ওষুধের স্যাম্পল, ব্যাগ ইত্যাদি। জগন্নাথ সেই বাক্সটা টেবিলের পাশের মেঝেতে যত্ন করে নামিয়ে রেখে চলে যাবার পর জাদুকর সত্যচরণ ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘বাঃ বেশ ঘরখানা, মেসবাড়ি বলে যেন মনেই হয় না।’

চন্দন হেসে বলল, ‘পাঁচ বছর ধরে এখানে আছি। এ ঘরটাকে তাই নিজের ঘরের মতোই গুছিয়ে নিয়েছি।

সত্যচরণ সোফাতে বসে বললেন, ‘যখনই আপনার পাড়াতে ম্যাজিক দেখানোর জন্য ডাক পেলাম তখনই মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, শো-এর আগে আপনার সাথে একবার আড্ডা দিয়ে যাব। তাই ফোন করলাম আপনাকে। জানি না আপনাকে অসুবিধায় ফেললাম কি না?’

চন্দন বলল, ‘একদমই নয়। বরং আপনি এসেছেন বলে আমি খুব খুশি হলাম। আপনার যাদু প্রদর্শনী-তো সন্ধ্যা-ছ’টায়। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিল। ঘণ্টাখানেক আনন্দে গল্প করা যাবে।’ একথা বলে টেবিলে রাখা রাজভোগের প্লেট আর জলের গ্লাসটা সত্যচরণের দিকে একটু এগিয়ে দিয়ে চন্দন তার পাশে সোফায় বসল।

জাদুকর সত্যচরণ খুশি হলেন চন্দনের কথাতে আর তার সামনে রাখা মিষ্টির প্লেটটা দেখে। আর ম্যাজিশিয়ান মার্কা ছুঁচোলো গোঁফের তলায় হাসি ফুটে উঠল। মনে হয় তাঁর একটু খিদে পেয়েছিল। টপাটপ দুটো বড়ো আকারের রাজভোগ গলাধঃকরণের পর এক গ্লাস জল খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন, ‘অনেকদিন পর এমন ভালো মিষ্টি খেলাম। আপনার পাড়াতে আসার ফলে দেখছি এদিকেও লাভবান হলাম। ক্লাবের ছেলেরা বলেছে শো-এর টাকা তো দেবেই, তার সাথে সম্বর্ধনা মানপত্র দেবে।’

চন্দন বলল, ‘দারুণ ব্যাপার। আপনার পোশাকটাও বেশ মানিয়েছে।’

সত্যচরণ বললেন, ‘আমাদের পেশাতে পোশাকের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমি যখন গ্রামে খেলা দেখাতে যাই তখন কোট-প্যান্ট পরি সাহেবদের মতো, আর শহরের শো-তে এই রাজাদের মতো। স্থান ভেদে যে পোশাক দর্শকদের ভালো লাগে। তবে আসল জিনিসটা আমার এখনও পরা বাকি আছে।’

চন্দন জানতে চাইল, ‘সেটা কী?’

প্রশ্ন শুনে জাদুকর সত্যচরণ সোফা থেকে উঠে তার বাক্সটা খুললেন। তারপর বাক্সের ভিতর থেকে বার করে আনলেন একটা পাগড়ি। নীল রঙের পাগড়িটার কাপড়ে সোনালি জরি বসানো। আর তার মাঝখানে একটা ধাতব চাকতির মধ্যে কয়েকটা রঙিন পালক বসানো। জাদুকর সত্যচরণ পাগড়িটা তার মাথায় পরে জানতে চাইলেন, ‘আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?’

চন্দন জবাব দিল, ‘একদম রাজার মতো।’

সত্যচরণ আবার এসে সোফায় বসলেন। তারপর মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে সামনের টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘যদিও আমি সাধারণত অন্য পাগড়ি পরি। আজ শো-এর পর সম্বর্ধনার ব্যাপারটা আছে বলে এই পাগড়িটা পরব। জীবনে রাজা হওয়াতো হল না, তবে এই রাজার পাগড়ি পরলে মনের ভিতর কেমন যেন একটা রাজা রাজা ভাব আসে। সত্যিকারের রাজার পাগড়ি বলে কথা!’

চন্দন বলল, ‘সত্যিকারের রাজার পাগড়ি, মানে?’ জাদুকর সত্যচরণ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, সত্যিকারের রাজার পাগড়ি। এ-পাগড়ি পরে কোনও রাজামশায় এক সময় দরবারে বসতেন, যুদ্ধে যেতেন, শিকারে যেতেন। আপনি রাজা নওলকিশোরের নাম শুনেছেন? মনে হয় শোনেননি। এ-পাগড়ি তাঁরই পাগড়ি।’

চন্দন কথাটা শুনে ভালো করে তাকাল সামনের টেবিলে রাখা পাগড়িটার দিকে। কাছ থেকে যেটা দেখে চন্দনের মনে হল পাগড়িটা বেশ পুরোনো। তার কাপড়ের গায়ে মাঝে মাঝে পোকায় কাটার চিহ্ন, নীল রং, জায়গায় জায়গায় বিবর্ণ হয়ে এসেছে। পালক বসানোর গোল চাকতিটার ওপর এক সময় মনে হয় সোনার জল করা ছিল। তা এখন কালচে হয়ে গেছে। পালক আর জরির সুতোগুলোও খয়ে গেছে। ভালো করে পাগড়িটাকে দেখার পর চন্দন বলল, ‘না, রাজা নওলকিশোরের নাম আমি শুনিনি। কিন্তু তাঁর পাগড়ি আপনার কাছে এল কী ভাবে?’

চন্দনের প্রশ্ন শুনে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘ঠিকই আন্দাজ করেছি। ওই নাম আপনার না শোনারই কথা। সব রাজার নাম কি খবরের কাগজে ছাপা হয়? তাছাড়া সে জায়গাটাও তো এখানে নয়, মধ্যভারতের বুন্দেলখন্ডের একটা জায়গা।’

একথা বলে তিনি তাঁর পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে জ্বালালেন। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে পাগড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ পাগড়ি আমার কাছে কীভাবে এল তা যখন আপনি জানতে চাইছেন তবে সে কথা আপনাকে বলি —

এ কথা বলে একটু। চুপ করে থেকে জাদুকর সত্যচরণ বলতে শুরু করলেন তার কথা:

|| ২ ||

‘আপনি তো জানেনই, অল্প বয়সে আমি ঘর ছেড়েছিলাম। তারপর স্ট্রিট-ম্যাজিশিয়ান বা বাজিকর হংসরাজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিন বছর ধরে তাঁর সঙ্গে এ-দেশের নানা জায়গা ঘুরে বেড়িয়ে তাঁর কাছ থেকে হাত-সাফাই আর জাদুর খেলা শিখেছিলাম। সব শেষে গুরু হংসরাজের আশীর্বাদ নিয়ে তাঁর নির্দেশ মতো জাদুবিদ্যাকেই জীবিকা করে পথে নেমেছিলাম। খেলা দেখাবার জন্য সে সময় এ-দেশের নানা জায়গাতে আমি ঘুরে বেড়াতাম। এ-ঘটনা যখনকার, তখন আমি বছর চারেক হল একলাই খেলা দেখিয়ে বেড়াই। মধ্যভারতে ‘ছাওলা’ নামে একটা ছোটো শহর আছে। যার নাম আপনি হয়তো শুনেছেন। এই ছাওলা হয়েই লোকে খাজুরাহো দেখতে যায়। সেবার আমি খেলা দেখাতে গিয়েছিলম জব্বলপুর। তারপর সেখান থেকে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ছাওলাতে। ছাওলা শহর আর তার আশেপাশে যে সব জায়গাতে জন সমাগম হয় সেখানেই রাস্তাতে বা বাজারের মধ্যে খেলা দেখাচ্ছিলাম আমি। রাতে কেউ আশ্রয় দিলে আমি সেখানেই থাকতাম। নচেৎ আমি আশ্রয় নিতাম মন্দির-মসজিদের চাতালে বা এই ধরনের কোনো বারোয়ারি জায়গায়। একদিন আমি দুপুরবেলা খেলা দেখাচ্ছিলাম ছাওলা শহরের পাশেই একটা হাটে। খেলা শেষ হবার পর আমি যখন খেলার সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে বাক্সে ভরছি, এমন সময় আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন মাঝ বয়সী লোক। তার চেহারা আর পোশাক দেখে আমি বুঝতে পারলাম লোকটা এ-জায়গার ভূমিপুত্র, অর্থাৎ স্থানীয় মানুষ। তার পরনে হাঁটুর ওপর পরা ধুতি, গায়ে হাতকাটা ধরনের ফতুয়া। লোকটার মাথার চুল ছোটোছোটো করে ছাঁটা। গোঁফ-দাড়ি মাথার চুল কাঁচাপাকা। কানের লতিতে পিতলের তৈরি দুল বা স্থানীয় লোকরা যে কর্ণকুণ্ডল পরে তা পরা আছে।

লোকটাকে আমি আগে আমাকে ঘিরে যারা খেলা দেখছিল সেই ভিড়ের মধ্যে ঠিক খেয়াল করিনি। কিন্তু লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ভোজবাজির খেলা দেখছিলাম। বেশ খেলা দেখাও তুমি। আমার সঙ্গে ভেলকির খেলা দেখাতে যাবে?’

আমি লোকটাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কোথায় যেতে হবে?’

লোকটা বলল, ‘তুমি রাজা নওলকিশোরের নাম জানো? তিনি এক সময় এই বুন্দেলখণ্ডের মহারাজা ছিলেন। সেই মহারাজা ছত্রশালের বংশধর। তাঁর প্রাসাদে তোমাকে খেলা দেখাতে যেতে হবে।’

রাজা নওলকিশোরের নাম না শুনলেও আমি মহাভারতে ইতিমধ্যে বেশ কিছুদিন ঘোরার সুবাদে মহারাজা ছত্রশালের নাম শুনেছি। আড়াই-তিনশো বছর আগে বুন্দেলখণ্ড শাসন করতেন। তাঁর নামে রেলস্টেশনও আমি দেখেছি। আমি লোকটাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কে? সেই প্রাসাদ কোথায়?’

লোকটা তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমার নাম আত্মারাম। মহারাজা নওলকিশোরের খাস চাকর আমি। তাঁর হুকুম পালন করি আমি। ঘোড়ার গাড়িতে প্রসাদে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আমার সঙ্গে গাড়ি এনেছি। কাল মহারাজের জন্মদিন। তাই তিনি তাঁর জন্য আনন্দের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। আমার সঙ্গে এখন তুমি সেখানে যাবে। কাল সেখানে তুমি মহারাজাকে ভোজবাজির খেলা দেখাবে। পরশু আবার আমি তোমাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাব। তুমি যাবে আমার সাথে? রাজপ্রাসাদে থাকার জায়গা পাবে, খাবার পাবে, মহারাজ তোমার খেলা দেখে বকশিস দেবেন।’

রাজা শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে, সাধারণ মানুষের মনে। আর আমাদের মতো দিন আনি দিন খাই, মানুষের কাছে তো বটেই। স্বাধীনতার আগেও যখন রাজাদের সত্যিকারের রাজত্ব ছিল তখন তাঁদের দরবারে খেলা দেখিয়ে সোনারুপোর মেডেল পেতেন জাদুকররা। তেমন মেডেল আমি অনেক জাদুকরের বুকে ঝুলতে দেখেছি। তাছাড়া টাকাপয়সা ইত্যাদি তো তারা পেতেনই রাজা-মহারাজাদের কাছ থেকে। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাদের রাজত্ব চলে গিয়েছে। কিন্তু তাঁদের ঠাটবাট যে কিছুই কমেনি তা আমি মধ্যভারতে যাবার বছর খানেক আগেই জয়পুরের এক মেলায় যাবার সুবাদে দেখেছি। টিকিট কেটে জয়পুরের রাজপ্রাসাদ দেখতে ঢুকেছিলাম-কী বিশাল সেই প্রাসাদা। রাজার দর্শন না পেলেও আমি সে প্রাসাদের চমক দেখেছি। কত দামি দামি গাড়িঘোড়া, সেপাই, মন্ত্রী সেখানে। এই লোকটার মুখে রাজা আর রাজপ্রাসাদের কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল আমার দেখা সেই জয়পুরের কথা। আমি মনে মনে ভাবলাম, রাজা নওলকিশোর যদি জয়পুরের রাজার মতো অত বড়ো রাজা নাও হন, যদি চার ভাগের একভাগ ঐশ্বর্যবানও হন, তাও বিরাট ব্যাপার। সোনার মেডেল না দিলেও তো একশোটা টাকা তিনি নিশ্চয়ই দেবেন। এমনকী ভাগ্য ভালো থাকলে আরও বেশি পেয়ে যেতে পারি। আমার এখন পথে পথে খেলা দেখিয়ে দৈনিক আট-দশ টাকার বেশি আয় হয় না। কাজেই এসুযোগ হাতছাড়া করা আমার উচিত হবে না- বুঝতে পেরে আমি আর টাকা পয়সার ব্যাপারে কোনও কথা না বলে আত্মারামকে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি খেলা দেখাতে যেতে রাজি।’ চটপট আমার জিনিসপত্র বাক্সতে গুছিয়ে নিলাম।

আত্মারাম সিংহ আমাকে নিয়ে চলল হাটের বাইরে একটা গাছের নীচে, যেখানে তার গাড়িটা আছে। গাড়িটার কাছে পৌঁছে সেটা দেখে আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগল-অনেকটা ছ্যাকরা গাড়ির মতো দেখতে কালো রংচটা একটা ঘোড়ার গাড়ি। বসার আসন ছিঁড়ে ছোবড়া বেরিয়ে এসেছে। একটা হাড় জিরজিরে সাদা ঘোড়া জোড়া আছে গাড়িটার সাথে। মহারাজের খাস চাকরের গাড়ির দশা এমন কেন? আত্মারাম মনে হয় গাড়িটা দেখে আমার মনের ভাব বুঝতে পারল। সে ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশে বলল, ‘আমাদের এই পক্ষীরাজের বয়স হলেও এর শরীরে এখনও তাকত আছে। আমাদের প্রাসাদে ঠিক পৌঁছে দেবে। গাড়িতে উঠে পড়ো।’

গাড়িটাতে একটা বস্তাতে কী সব মালপত্র। পক্ষীরাজের খাবারের খড়ের আঁটি এসব রাখা ছিল। তারই মধ্যে কোনোরকমে আমার বাক্সটা নিয়ে চড়ে বসলাম। আত্মারামও উঠে বসল চালকের আসনে। সেই হাট ছেড়ে পক্ষীরাজ আমাদের নিয়ে রওনা হল মহারাজ নওলকিশোরের রাজপ্রাসাদের দিকে।

|| ৩ ||

ওসব জায়গাতে শহর-গঞ্জ এসব ছাড়ালেই অনাবাদী ফাঁকা জমি, জঙ্গল এই সব। কখনও দু-চার ঘর গরীব মানুষের বাস। সে জায়গাগুলোকে ঠিক গ্রাম বলা চলে না। পক্ষীরাজের টানা গাড়িতে কাঁচা রাস্তা চলতে চলতে জানতে পারলাম, মহারাজ নওলকিশোরের প্রাসাদটা নাকি জঙ্গল লাগোয়া। রাস্তা কোথাও বাঁক নেয়নি। সেই গঞ্জর হাট থেকে ঘোড়া এগিয়েছে সেদিকে। মধ্যভারতে দুপুরবেলা প্রচণ্ড গরম, তার ওপর বাতাসও শুকনো। ঘণ্টাখানেক চলার পর ধীরে ধীরে দূরে ফুটে উঠল একটা কালো রেখা-জঙ্গল। আর তারপর চোখ পড়ল প্রাসাদটা। আর কিছু সময়ের পর তার সামনে এসে থামলাম আমরা। কিন্তু সে প্রাসাদ দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি! বাড়িটা প্রকাণ্ড তাতে সন্দেহ নেই এবং এক সময় যে বাড়ির মালিক বিত্তশালী ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখন বাড়িটা যেন খণ্ডহর! বিরাট বিরাট থাম, দেয়ালের গা থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে ইট দাঁত বার করে আছে। দো-তলার বারান্দার রেলিং-এর আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাইরের দিকের দরজা-জানলাগুলো সব কপাটহীন। কঙ্কালের শূন্য অস্থি কোটরের মতো দেখাচ্ছে সেগুলোকে। সদর দরজার মাথার একটা বাঘ বা সিংহের মূর্তি বসানো আছে ঠিকই কিন্তু তার মুণ্ডুটা ঘসে যাওয়াতে সেটা বাঘ না সিংহ তা চেনার উপায় নেই। এই বাড়ি বা হাভেলিটার দেখে আমার মনে হল, তার বয়স অন্তত দু-তিন’শ বছর হবে। আমি বিস্মিত ভাবে বলেই ফেললাম, ‘এটাই মহারাজার প্রাসাদ? তিনি এখানেই থাকেন?’

আত্মারাম বলল, ‘হ্যাঁ, গাড়ি থেকে নামো এবার।’ খন্ডহর প্রাসাদের বাইরে কোন লোকজন নেই। গাড়ি থেকে নেমে বাঙ্গটা নিজেই ঘাড়ে নিলাম আমি। তারপর আত্মারামের সঙ্গে প্রাসাদের ভিতর প্রবেশ করলাম। ভিতরে বিরাট বিরাট সব ঘর, লম্বা অলিন্দ, উঠোন। কিন্তু সবকিছুই অন্ধকার, ধুলোময়, জনশূন্য। মহলগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা মহলের বারান্দা থেকে এক ঝাঁক বাদুড় বেরিয়ে অন্যদিকের অন্ধকারে উড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একটা মহলে উঠে এসে দাঁড়ালাম আমরা।

আত্মারাম আমাকে বলল, ‘এটাই প্রাসাদের খাস মহল। এখানেই মহারাজ থাকেন।’ এ কথা বলার পর সামনেই একটা দরজার দিকে তাকিয়ে সে হাঁক দিল ‘মহারাজ, আমি ফিরে এসেছি।’

বার কয়েক সে হাঁক দেবার পর ধীরে ধীরে লাঠির ভর দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। লোল চর্ম, মাথার চুল, গোঁফ-দাড়ি সব সাদা। তবে তাঁর শরীরের কাঠামো দেখে বোঝা যায়, এক সময় তিনি বেশ লম্বা স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। তাকে দেখে আত্মারাম মাথা ঝুঁকিয়ে বলল ‘প্রণাম মহারাজ।’

আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম, এ কেমন মহারাজ। এঁর শরীরে কোনো হীরা-জহরত-মুক্তমালা নেই। নিদেনপক্ষে একটা সোনার আংটিও নয়। মহারাজার পরনে শুধু অনেকটা হাউস কোটের মতো লম্বা ঝুলের পুরোনো রেশমের পোশাক। সব থেকে বড়ো কথা, মহারাজ নওলকিশোরের পায়ে নাগরার বদলে একটা সাধারণ হাওয়াই চপ্পল! আত্মারাম আসার পথে আমার নাম জেনে নিয়েছিল। সে এরপর আমাকে দেখিয়ে মহারাজকে বলল, ‘মহারাজ, এ হল বাজিকর সত্যচরণ। কাল আপনার জন্মদিনে ভোজবাজি দেখাবে।’ মহারাজ নওলকিশোর এবার তার বার্ধক্য জনিত কিছুটা ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানালাম তাঁকে।

আমাকে নিরীক্ষণ করার পর কেমন যেন শিশুসুলভ হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি বলে উঠলেন, ‘বেশ বেশ। কতদিন ভোজবাজির খেলা দেখিনি। এক সময় এ বাড়িতে লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, কলকাতা থেকে কত মানুষ আসত। তারা কেউ নাচ দেখাত, কেউ গান, কেউ ভেলকির খেলা -দেখাত। একবার এক বাজিকর এসেছিল, তার নাম হংসরাজ। মাটি থেকে একটা দড়িকে সোজা লাঠির মতো দাঁড় করিয়ে তা বেয়ে ওপরে উঠত সে। কী অদ্ভুত খেলা। আমি তাকে একটা সোনার মোহর দিয়েছিলাম।

রাজা নওলকিশোরের কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি। আরে ইনি তো আমার গুরুদেব বিখ্যাত স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান হংসরাজের কথাই বলছেন! ওই দড়ির খেলাটার জন্যই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি গুরুদেবের উদ্দেশ্যে নিজের মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বললাম, আমার গুরুদেব ছিলেন তিনি।’

কথাটা শুনে মহারাজ বললেন, ‘তবে তো তুমি খুব ভালো বাজির খেলা দেখাতে পারবে।’

এ-কথা বলার পর তিনি তাঁর খাস চাকর আত্মারামকে নির্দেশ দিলেন, ‘একে রাজ অতিথিশালায় নিয়ে যাও। বিকালে আমার কাছে নিয়ে আসবে।’

মহারাজের নির্দেশ মতো আত্মারাম আমাকে নিয়ে হাজির হল রাজ অতিথিশালাতে। সেখানে ঢুকেই আমি বুঝতে পারলাম, এখানে রাজভোগ খাওয়া সম্ভবত আমার হবে না। রাজ অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য শুধু একটা দড়ির খাটিয়া আর মাটির তৈরি জল রাখার কুঁজো ছাড়া কিছুই নেই। আমি আত্মারামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই রাজপ্রাসাদে কে কে থাকে?’

‘আমি আর মহারাজা। আর কেউ থাকে না। আমি খাবার দিয়ে যাব।’ একথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

স্বাভাবিক কারণেই আমি এই অতিথিশালা, রাজপ্রাসাদ, সর্বোপরি মহারাজের অবস্থা দেখে হতাশ হলাম। মহারাজার থেকে যে কী প্রাপ্তিযোগ হবে কে জানে! তবে এতদূর যখন এসেছি, তখন তো আর ফেরা যাবে না। কাজেই এই বলে মনকে প্রবোধ দিলাম যে, আর কিছু না হোক, এই দু-দিন তো একটা মাথা গোঁজার জায়গা আর বিনা পয়সাতে খাবার পাওয়া যাবে।’

কিছুক্ষণ পর আত্মারাম ফিরে এসে রাজঅতিথিকে রাজকীয় খাবার দিয়ে গেল। একটা থালাতে মোটামোটা কয়েকটা হাতরুটি আর অড়হরের ডাল। যাইহোক খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম আমি।

|| ৪ ||

বিকাল পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভাঙল আমার। এ-সব অঞ্চলে অন্ধকার নামতে বেশ সময় লাগে। ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর আত্মারাম হাজির হয়ে বলল, ‘মহারাজ তোমাকে দরবারে ডাকছেন।’

আত্মারামের সঙ্গে দরবারের দিকে এগোলাম আমি। তার সঙ্গে আমি মহারাজ নওলকিশোরের দরবারকক্ষে পা রাখলাম। বেশ বড়ো লম্বাটে ‘ধরনের একটা ঘর, মেঝেটা এক সময় শ্বেত পাথরে মোড়া ছিল, এখন তার অবস্থা ফুটিফাটা। ঘরের মাঝখানে ডাঁই করা ভাঙা ভাঙা চেয়ার, যা সম্ভবত একসময় রাজার সভাসদদের বসার জন্য ব্যবহৃত হত। দরবার কক্ষের ঠিক মাঝখানে মাথার ওপর একটা কাচের ঝাড়বাতি আছে ঠিকই, কিন্তু তার ডালপালাগুলো ভেঙে খসে পড়েছে। এই ঝাড়বাতি আর কোনোদিন জ্বলবে বলে মনে হয় না। ঘরের শেষ প্রান্তে একটা বেদি মতন জায়গাতে গদির ছোবড়া বের করা একটা হাতলঅলা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন মহারাজ নওলকিশোর সিংহ। প্রথম দর্শনের সাথে তাঁর এখন ফারাক শুধু এইটকই যে তার মাথায় তখন একট পাগড়ি আছে, আর কোলের কাছে রাখা আছে একটা ভোঁতা তলোয়ার। রাজ দরবারে বসলে তো এই দুটা জিনিস প্রথা মাফিক সঙ্গে রাখতেই হয়। হাজার হোক তিনি মহারাজ বলে কথা!

আমরা দু-জন তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে কুর্ণিশ জানালাম। মহারাজ নওলকিশোর প্রথমে কাঁপাকাঁপা ভাবে তাঁর ডান হাতটা তুললেন আশীর্বাদের ভঙ্গিতে। তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি তো সেই বাজিকর হংসরাজের শিষ্য, তাই বললে না?’

আমি জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি তাঁরই শিষ্য। তাঁর থেকেই খেলা শিখে খেলা দেখিয়ে বেড়াই।’

মহারাজ নওলকিশোর বললেন, ‘আগামীকাল আমার পঁচাশিতম জন্মদিন। আর সেটা ছিল আমার পঁচিশতম জন্মদিন। কত নাচনেওয়ালী, গাইয়ে, বাজিয়ে, মাদারীওয়ালা, বাজিকর এসেছিল এখানে! এই দরবার কক্ষে তিনদিন ধরে তারা নাচ, গান, খেলা দেখিয়েছিল। কত লোকজন তা দেখতে এসেছিলা-সারা প্রাসাদ আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। আমাদের প্রজাদের অত দিন ধরে খাওয়ানো হয়েছিল। আর হবে নাই বা কেন, আমরা যে মহারাজ ছত্রশালের বংশধর। খাঁটি রাজরক্ত বইছে আমার শরীরে। আমার মাথাতে এই যে পাগড়ি দেখছ, এটা পরে আমার পূর্বপুরুষ রাজারা একসময় শিকারে গেছেন, যুদ্ধে গেছেন, রাজদরবার আলো করে রয়েছেন। এই বলে তিনি আত্মশ্লাঘার সাথে মাথার পাগড়িটা স্পর্শ করলেন। কপাট হীন জানলা দিয়ে বাইরের বিকালের নরম রোদের একফালি আলো পড়েছে তাঁর মুখে। আমি দেখলাম, ফেলে আসা অতীতের কথা ভাবতে ভাবেতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বৃদ্ধ নওলকিশোরের মুখমণ্ডল। তারপর তিনি আত্মারামকে বললেন, ‘বন্দুকে তেল দিয়ে রেখেছিস তো? কাল জঙ্গলে লোক পাঠাবি হরিণ শিকারের জন্য। জন্মদিনে হরিণের মাংস খাব আমি।’

আত্মারাম কথাটা শুনে বলল, ‘বন্দুক তো কবেই সরকারের ঘরে জমা পড়ে গেছে লাইসেন্সের টাকা দিতে না পারায়। তাছাড়া হরিণ শিকার এখন নিষিদ্ধ। ছাওলার হট থেকে একটা মুরগী কিনে এনেছি। তার ঝোল রেঁধে দেব।’

হরিণের মাংস খাওয়ার ইচ্ছা দমন করলেও মুরগীর রোলের কথাটা শুনে শিশুসুলভ আনন্দে ঝলমল করে উঠল বৃদ্ধর মুখ। তিনি বললেন, ‘বাঃ, বেশ বেশ! মুরগীর রোলেও চলবে। কতদিন হয়ে গেল মাংস খাইনি। শুধু ডাল-রুটি-সবজি খেয়েই আছি।’

মহারাজের কথা শুনে তাঁর বর্তমান অবস্থা বুঝতে অসুবিধা হল না আমার। ঠিক এই সময় আমার যেন মনে হল প্রাসাদের বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শুনলাম। ঘোড়ার গাড়ি নয়, মোটর গাড়ি ধরণের কোনো গাড়ির শব্দ। মহারাজ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি সেই দড়ির খেলাটা জানো? তবে আমাকে কালকে সেই খেলাটা দেখাবে।’

বললাম, ‘আমাকে মাফ করবেন হুজুর। ও খেলা আমার গুরুদেবই দেখাতে পারতেন। আমি আপনাকে অন্য খেলা দেখাব।’

‘কী খেলা?’ জানতে চাইলেন মহারাজা।

আমি জবাব দিলাম, ‘আমি আপনাকে হাত সাফাইয়ের খেলা, ভোজবাজির খেলা, আরও অন্য সব খেলা দেখাব। তা দেখে আনন্দ পাবেন আপনি।’

বৃদ্ধ বয়সে নওলকিশোর মনে হয় অল্পেতেই সন্তুষ্ট হল। তিনি বললেন, ‘আনন্দ পেলেই হবে। আর ক-দিন বাঁচি ঠিক নেই। মরার আগে তোমার ভোজবাজির খেলাটা দেখে নেই।’

তাঁর কথা শুনে আত্মারাম বলে উঠল, ‘আপনি এ কী বলছেন মালিক? সবে তো পঁচাশি! আপনি অন্তত একশ বছর বাঁচবেন।’

এ কথা বলার পর আত্মারাম হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল। ভারী জুতো পরা বেশ কয়েক জোড়া পা যেন নিস্তব্ধ মহলে শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে দরবার কক্ষের দিকে। আত্মারাম সে শব্দ শুনে থেমে গিয়ে তাকাল দরজার দিকে।

জুতোর খটমট শব্দ তুলে ঘরে ঢুকে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তিনজন লোক। তার মধ্যে যে লোকটা প্রথমেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে লোকটা কপালে লাল তিলক কাটা মাঝবয়সী শক্তপোক্ত চেহারার একটা লোক। তার পায়ে হাই হিল বুট জুতো। ধুতি- শার্টের ওপর একটা কোটের মতো পরা। চেহারাতে একটা কঠিন ভাব আছে, গোঁফ জোড়া দু-পাশে পাকানো। লোকটার পিঠে একটা দো-নলা বন্দুক আছে। বন্দুক অবশ্য এখানকার অনেক পয়সাঅলা মানুষেরই থাকে। লোকটার সঙ্গী দু-জনের পরনে ধুতি-ফতুয়া আর বুট জুতো, কদম ছাঁট চুল, শক্তপোক্ত চেহারা তাদেরও।

লোকগুলো আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবার পর তিলকধারী, বন্দুকধারী লোকটা আমার দিকে সন্দিগ্ধ ভাবে তাকিয়ে আত্মারামকে প্রশ্ন করল, ‘এ লোকটা কে? দেখে তো এখানকার লোক বলে মনে হচ্ছেনা! কোথা থেকে এল?’

আত্মারাম জবাব দিল, ‘ও জাদুকর, দূরদেশে থাকে। কাল মহারাজের জন্মদিন। তাই প্রাসাদে খেলা দেখাতে ডেকে এনেছি ছাওলার হাট থেকে।’

‘ও, ভেলকিঅলা!’ এ কথা বলে লোকটা আমার প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করে, এরপর তাকাল মহারাজ নওলকিশোরের দিকে।

মহারাজ মৃদু বিস্মিত ভাবে সেই বন্দুকধারী লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘দুর্জন সিংহ তুমি? কী ব্যাপার?’ বন্দুকধারী লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি আমার টাকাটা নিতে এলাম।’

নওলকিশোর বলল, ‘কীসের টাকা? আমি তো তোমার থেকে যে একলাখ টাকা ধার নিয়েছিলাম তার পাই-পয়সা পাঁচ শতাংশ সুদ সহ ফিরিয়ে দিয়েছি।’

দুর্জন সিংহ বলল, ‘ওটা পাঁচ নয়, পঞ্চাশ শতাংশ সুদ। কাগজে তোমার নাম সই আছে। যার সাক্ষী হিসাবে তাতে আত্মারামের টিপছাপও আছে।’

কথাটা শুনেই নওলকিশোর বলে উঠলেন, ‘এ কি বলছ তুমি? আমিতো কাগজে দেখেছিলাম ‘পাঁচ’ লেখা আছে। পঞ্চাশ হল কীভাবে?’

দুর্জন সিংহ দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘পাঁচ’ নয় ওর পিঠে একটা শূন্য বসানো ছিল। বুড়ো বয়সে চোখে  চালশে পড়েছে, তাই খেয়াল করেননি।’

এ কথা শুনেই আত্মারাম দুর্জন সিংহকে বলল ‘আপনি তো নিজের মুখেই পাঁচ শতাংশ সুদ বলেছিলেন। সেটা পঞ্চাশ হলো কীভাবে?’

কথাটা শুনেই দুর্জন সিংহ তার কাঁধ থেকে ঝট করে বন্দুকটা খুলে নিয়ে আত্মারামের বুকে ঠেকিয়ে বলল, ‘জানিস না, যখন রাজপরিবারের লোকেরা নিজেদের মধ্যে। কথা বলে তখন তার মাঝে চাকরদের কথা বলতে নেই। আর একটা কথা বললে তোকে শেষ করে দেব। শুনেছিস নিশ্চয়ই এমন খুন-জখম আমি বেশ কয়েকটা করেছি?’

আত্মারাম আর কোনো কথা না বলে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমাকে পাত্তা দেবার মতো কোনো ব্যাপার নেই দুর্জন সিংহর। তবে লোকটা যে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির তা আমি বুঝতে পারলাম। নির্বাক দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে- এরপর আমি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম তার পরের দৃশ্যগুলো।

দুর্জন সিংহ এরপর আবার মহারাজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার কাজের কথাতে আসি। আমি হিসাব করে দেখেছি সুদ হিসাবে বর্তমানে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপরে পাই। টাকাটা আমার এখন দরকার। দিয়ে দিন, চলে যাব।’ এ পর্যন্ত তাঁর কাহিনি বলে আসছেন জাদুকর সত্যচরণ। তখন মেসের জগন্নাথ ঘরে ঢুকে টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে চলে গেল। সাময়িক বিরতি নিয়ে বেশ আয়েশ করে চায়ের কাপে বেশ কয়েকবার লম্বা চুমুক দিয়ে আবার কথা শুরু করলেন জাদুকর সত্যচরণ।

দুর্জন সিংহর কথা শুনে মহারাজ নওলকিশোর বললেন, ‘তুমি এ কী বলছ দুর্জন? অতো টাকা আমি পাব কোথায়? তাছাড়া এটাতো অন্যায়। পাঁচ’কে তুমি পঞ্চাশ বানিয়েছ।’

দুর্জন সিংহ বলল, ‘এসব কথা আমি জানি না। কাগজে যা লেখা আছে সেটাই ঠিক। হিসাব দেখে নিন। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দিন। আমি চলে যাব। নইলে…’

‘নইলে কী?’ জানতে চাইলেন বৃদ্ধ মহারাজা নওলকিশোর।

দুর্জন সিংহ হেসে বলল, ‘না, তেমন কিছু নয়। শুধু আপনার মাথার থেকে এই মহারাজের পাগড়িটা খুলে নিয়ে যাব আমি। তারপর সেটা আমার ধোপার গাধার মাথায় পরিয়ে সেটাকে শহরে-গ্রামে ঘোরাব। লোকে বাপারটা জানতে চাইলে বলব, ‘মহারাজ ছত্রশালের বংশধর মহারাজ নওলকিশোর এখন ভিখারী হয়ে গেছেন। আমার টাকা শোধ করতে না পারায় আমি তার পাগড়ি খুলে এনেছি। আমি কিন্তু যা বলি তাই করি। হয় টাকা, নাহয় পাগড়িটা দিন।’

দুর্জন সিংহর কথা শুনে নওলকিশোর আঁতকে উঠে দুহাতে মাথার পাগড়িটা চেপে ধরে কাতর স্বরে বলে ছালেন, ‘না, না, এ পাগড়ি নিওনা তুমি। আমি সারাজীবন সর্বস্ব খরচ করে, মামলা করে এই মহারাজের খেতাব আর পাগড়িটা সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছি। পূর্বপুরুষদের এই পাগড়িটা মাথায় দেব বলে সব কিছু ত্যাগ করেছি আমি। প্রাণ থাকতে এই পাগড়ি আমি কাউকে দিতে পারব না।’

কথাটা শুনে কেমন যেন অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল দুর্জন সিংহর মুখে। সে বলল, ‘আমি জানতাম আপনি টাকা দিতে পারবেন না। আর পাগড়ি তো দিতে চাইলেনই না। তাই আমি অন্য একটা ব্যবস্থা করে এসেছি। আশাকরি তাতে আপনার আপত্তি হবে না।’

‘কী ব্যবস্থা?’ কাঁপা কাঁপা গলাতে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ মহারাজা।

দুর্জন সিংহ প্রথমে তার বন্দুকটা একজন অনুচরের হাতে দিয়ে পোশাকের ভিতর থেকে দলিলের মতো একতাড়া কাগজ বার করল। দুর্জনের বুক পকেটে একটা লাল রঙের ঝর্ণা কলম ছিল। সেটা পকেট থেকে বার করে তার ক্যাপটা খুলে কাগজ আর কলমটাকে এরপর মহারাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নিন, এ কাগজটাতে সই করে দিন। ভালো করে পড়েও নিতে পারেন কাগজটা’

কাগজগুলো হাতে না নিয়ে মহারাজ জানতে মাইলেন, ‘কী লেখা আছে এই কাগজে?’

দুর্জন সিংহ বলল, ‘আপনি তো জীবিত অবস্থায় ওই পাগড়িটা দিতে চাইছেন না। তবে না হয় মরার পরই দেবেন। এই কাগজে লেখা আছে, আপনি আমাকে দত্তক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছেন। আপনার মৃত্যুর পর আমি উত্তরাধিকার সূত্রে ওই ‘মহারাজা’ খেতাব আর আপনার পাগড়িটা পাব। তখন আমার নাম হবে ‘মহারাজ দুর্জন সিংহ। আমার পয়সার অভাব নেই, শুধু খেতাবের অভাব। খেতাব কে না চায় বলুন। এই খেতাবের পিছনেই তো আপনিও সারাজীবন ছুটে বেড়ালেন। আমি আমার হাভেলিতে একটা সিংহাসন বানাব। ওই পাগড়ি পরে সিংহাসনে বসব। আপনার ওই পাগড়ি অনেকেই চেনে তারা পাগড়িটা দেখে বুঝতে পারবে আমি সত্যিই মহারাজা।’

দুর্জন সিংহর কথা শুনে আমি এবার বুঝতে পারলাম যে লোকটা প্রচণ্ড ধূর্তও বটে!

মহারাজ হতভম্বর মতো নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে আছেন, তার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া কাগজ আর কলমটার দিকে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দুর্জন বলল, ‘কী ভাবছেন? সই করে দিন। টাকা যে আপনি ফেরাতে পারবেন না তা জানি। কাগজটাতে যদি সই না করেন তবে পাগড়িটা এখনই খুলে নেব।’

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্জনের সঙ্গীর বন্দুকের নল ঘুরে গেল মহারাজের দিকে। আমি আর আত্মারাম নীরব দর্শক মাত্র। এ লোকগুলোকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে মহারাজ নওলকিশোর এবার মুখ খুললেন। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে এ-কাগজটাতে আমি সই করে দেব। তবে এখন নয়। কাল আমার জন্মদিন। রাতে আমি এই দরবারে বসে ভোজবাজির খেলা দেখব, তারপর তোমার কাগজে সই করে দেব। দোহাই তোমাদের। ওই সময়টুকু পর্যন্ত আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।’

দুর্জন সিংহ এবার যেন একটু থেমে গেল মহারাজের কথা শুনে। মনে হয় সে ভাবল, এখন জোর করে সই করানোর থেকে সেটাই ভালো হবে। সে মহারাজকে বলল, ‘কাল বাজির খেলা হলে সই করবেন তো?’

নওলকিশোর বললেন, ‘হ্যাঁ, করব, করব।’ দুর্জন সিংহ বলল, ‘ঠিক আছে, কাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি। তবে আমি এ জায়গা ছেড়ে যাচ্ছি না। এ-বাড়িতেই রইলাম। এ-বাড়ি ছাড়ার চেষ্টা করলে বা কোনো চালাকি করলে কিন্তু বিপদ হবে।’ এই শেষ বাক্যটা আত্মারামের উদ্দেশ্যে বলল লোকটা। তারপর জুতোর শব্দ তুলে দরবার ঘর থেকে তার সঙ্গীদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরটাতে। মাথা নীচু করে অসহায় ভাবে বসে আছেন বৃদ্ধ মহারাজ নওলকিশোর। জানলার বাইরে আলো নরম হতে শুরু করেছে। আত্মারাম এক সময় তাঁর উদ্দেশ্যে বলল, ‘এবার ঘরে চলুন মহারাজ। এভাবে বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে।’

তার কথা শুনে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন মহারাজ। দরবার কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে আত্মারাম মহারাজকে নিয়ে চলল তাঁর ঘরের দিকে। তারা ঘরে ঢুকে যাবার পর আমিও নিজের ঘরে ফিরে এলাম। কিছু সময় পর অন্ধকার নামতে শুরু করল বাইরে।

রাত আটটা নাগাদ ডাল-রুটি নিয়ে এল আত্মারাম। আমি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই লোকগুলো কোথায়?’

সে জবাব দিল, ‘বাইরের দিকের একটা ঘরে আছে। যে ঘরের পাশ দিয়ে বাইরে বেরোতে হয়।’

আমি আত্মারামকে বললাম, ‘যা বুঝেছি ব্যাপারটা তো অন্যায়। থানা-পুলিশে খবর দিলে হয় না?’

আত্মারাম বলল, ‘না, তাতে লাভ নেই। পুলিশ কোতোয়াল সবই ওর হাতে। লোকটা ভয়ঙ্কর। টাকা দিয়ে আর ভয় দেখিয়ে সবাইকে কিনে রেখেছে। ওর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এ তল্লাট ছেড়ে পালানো। রাজা সাহেবের একটা ছোটো বাড়ি আছে ভূপালে। সেখানে চলে যেতে পারলে হয়তো বাঁচা যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে তা আর সম্ভব নয়।’

একথা বলার পর একটু থেমে সে বলল, ‘ওই পাগড়ি আর খেতাব পাবার জন্যই মহারাজের সব গেল। সরকার আর জ্ঞাতিদের সাথে কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে কি মামলা চালানো মুখের কথা। যা টাকা ছিল তা প্রথমে শেষ হল, তারপর জিনিসপত্র বেচা হল। তারপর মামলা চালাবার জন্য দুর্জন সিংহর থেকে কর্জ করে তার কাছে ফাঁসলেন তিনি। দুর্জন সম্পর্কে ওর জ্ঞাতি হয়। বিয়ে-থাও তো করলেন না মহারাজা। আইবুড়ো থেকে গেলেন। শেষ বয়সে মামলা জিতে কী পেলেন? মহারাজ খেতাব পাওয়া একটা সরকারী কাগজ আর সরকারী মহাখানাতে রাখা ওই পুরোনো পাগডিটা। সবাই মহারাজাকে রেখে চলে গেছে, আমিই শুধু তাঁকে ভালোবেসে ছাড়তে পারলাম না।’ কথাটা বলে হতাশ ভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল আত্মারাম। সে চলে যাবার পর আমি খাওয়া সেরে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।

|| ৫ ||

শুয়ে তো পড়লাম ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে চাইল না আমার। প্রচণ্ড মশা। বহুদিন পর এখানে কোনো মানুষকে পেয়ে সাধ মিটিয়ে রক্ত খেতে ছুটে আসছে। তার ওপর একটা ব্যাপারও বুঝতে পারলাম। দুর্জন সিংহের ঘটনাটা দেখার পর আমার মনের মধ্যেও একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। অন্ধকার ঘরে খাটিয়াতে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম আমি। সত্যি রাজকীয় অতিথিশালাই বটে। রাত বেড়ে চলল।

তখন মধ্যরাত। যথারীতি জেগে আছি আমি। আমার চোখ-কান বরাবরই খুব সজাগ। হঠাৎ যেন আমার মনে হল, বাইরে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম। আর সেটা শুনেই আমি দরজার দিকে ফিরে শুলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা লঘু শব্দ এগিয়ে এল, আমার ঘরের দিকে। আর এরপরই আমি দেখলাম, আমার দরজা অতিক্রম করে একটা ছায়ামূর্তি চলে গেল বারান্দা দিয়ে। এত রাতে কে লোকটা? কৌতূহল চাপতে না পেরে আমি খাটিয়া ছেড়ে উঠে দরজার বাইরে প্রথমে উঁকি দিলাম। বাইরের চাঁদের আলো ঢুকছে, সেই আলোতে আমি দেখতে পেলাম মহারাজ নওলকিশোরকে। কিছুটা যেন সন্তর্পণে চারপাশে তাকাতে তাকাতে ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে চলেছেন। তাঁর পরনে সেই একই পোশাক, মাথায় পাগড়িটাও আছে। এত রাতে কোথায় চলেছেন মহারাজ? তার চলার ভঙ্গীও যেন কেমন সন্দেহজনক। একটা তীর কৌতূহল যেন পেয়ে বসল আমাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি নিঃশব্দে অনুসরণ করলাম তাঁকে। নিজের মহল অতিক্রম করে নওলকিশোর প্রবেশ করলে একটা জীর্ণ মহলে। আমিও তার পিছন পিছন এগোলাম। এ-মহলের অলিন্দগুলোর গায়ে কাঠের জাফরির কিছু চিহ্ন বিদ্যমান। আমি অনুমান করলাম, সম্ভবত ওইস্থানে কোনো এক সময় রাণী মহল বা নারীদের মহল ছিল, তাই কাঠের জাফরি দিয়ে আব্রুর ব্যবস্থা করা ছিল। সেই মহলেরই একটা উঠোনের মতো জায়গাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন মহারাজ। জায়গার মাথাটা ছাদহীন। চাঁদের আলো ফটফট করছে। আমি দেখলাম উঠোনের ঠিক মাঝখানে বেশ বড়ো একটা কুয়ো বা ইঁদারা আছে। চারপাশে আরও একবার তাকিয়ে নিয়ে তিনি এগোতে লাগলেন সেই কুয়োর দিকে। কুয়োর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। কোমর সমান উঁচু পাথরের রেলিং দিয়ে ঘেরা কুয়োটা। মহারাজ একবার রেলিং-এর ভিতর ঝুঁকে কুয়োটা দেখে নিয়ে দু- হাত দিয়ে নিজের পাগড়িটা মাথার ওপর ঠিক করে বসালেন। আর এরপরই আমি দেখলাম তিনি কুয়োর রেলিং-এর ওপর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম, তিনি কী করতে চলেছেন। তিনি আত্মহত্যা করতে চলেছেন কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে। আমি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে উঠোন থেকে ছুটে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরলাম মহারাজাকে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমাকে ছাড়ো, আমি ঝাঁপ দেব। আমি কিছুতেই আমার পাগড়িটা কাউকে দেব না! একটা ধস্তাধস্তি গুরু হল আমাদের দু-জনের মধ্যে। মাথা থেকে তাঁর পাগড়ি মাটিতে খসে পড়ল। কিন্তু আমার তখন জোয়ান বয়স, বৃদ্ধ মহারাজা আমার সঙ্গে শক্তিতে পারবেন কেন? আর এরপরই মহারাজকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে উপস্থিত হল আত্মারাম। সে-ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ছুটে এসে জাপটে ধরল মহারাজকে। এরপর আত্মারাম কোনোরকমে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে চলল তাঁর ঘরের দিকে। মাটিতে পড়ে থাকা মহারাজের পাগড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে আমিও তার সঙ্গে চললাম। আমার ঘরটা পেরিয়েই মহারাজের মহলে যেতে হয়। আমার ঘরের কাছে এসেই হাঁপাতে লাগলেন বৃদ্ধ নওলকিশোর। তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। কাজেই আমি আর আত্মারাম তাঁকে ধরাধরি করে আমার ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে খাটিয়াতে বসালাম। আমি পাগড়িটা খাটিয়ায় রেখে মোমবাতি জ্বালালাম। কুয়ো থেকে জল এনে মহারাজকে দিলাম। জলপান করে একটু বিশ্রাম করে নেবার পর নওলকিশোরের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হল। তিনি প্রথমে করুণ স্বরে বললেন, ‘তোমরা আমাকে কেন মরতে দিলে না? ওই শয়তানের হাতে খেতাব আর পাগড়ি তুলে দেওয়ার চেয়ে আমার মরাই ভালো।’

আমি আর আত্মারাম নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম তাঁর কথা শুনে।

এরপর তিনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি তো বাজিকর। তার ওপর আবার সেই হংসরাজের শিষ্য। শুনেছি বাজিকরদের অনেক অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। তারা মানুষকে অদৃশ্য করতে পারে, গরু, গাধা বানিয়ে দিতে পারে। তুমি কিছু করতে পার না আমার জন্য? বাঁচাতে পার না আমাকে এই অপমানের হাত থেকে? ওই শয়তান দুর্জনকে মন্ত্র দিয়ে একটা গাধা বানিয়ে দিতে পার না?’

মহারাজ নওলকিশোর অনেকটা শিশুসুলভ ভঙ্গীতেই কথাগুলো বললেন। জাদুকররা মুখে অনেক সময় মন্ত্র-তন্ত্রের কথা বললেও আসলে তার খেলার মধ্যে কৌশল বা বিজ্ঞান লুকিয়ে থাকে। মন্ত্র দিয়ে কাউকে গাধা বানাবার কৌশল আমার জানা নেই। আমি তাই অসহায় বৃদ্ধর কথা শুনে মাথা নীচু করে রইলাম। তিনি এরপর হতাশ ভাবে বললেন, ‘বুঝলাম তুমি পারবে না। হংসরাজ উপস্থিত থাকলে…’

আমার গুরুর নাম কানে যাওয়াতেই কিনা জানি না, ঠিক সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে একটা ভাবনার উদয় হল। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি কিছু করা যায় কি না? কাল পক্ষীরাজের গাড়িটা আমার লাগবে। ওটা নিয়ে আমি শহরে  যাব। দুর্জন সিংহ আমাকে মনে হয় আটকাবে না।’

আত্মারাম কথাটা শুনে বলল, ‘তা পাওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশ বা লোকজন ডেকে এনে কোন লাভ হবে না।’

আমি বললাম, ‘না, আমি অন্য কাজে শহরে যাব।’ মহারাজ কথাটা শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে যেও। দ্যাখো, যদি কিছু করতে পার।’

আত্মারাম এরপর মহারাজকে নিয়ে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হল। তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর আমি খেয়াল করলাম মহারাজের পাগড়িটা খাটিয়ার ওপরই পড়ে আছে। আত্মারাম অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে পাগড়িটা নিয়ে গেল। আমিও আবার মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠে আমি তৈরী হলাম বাইরে যাবার জন্য। আত্মারাম আমার ঘরে এল আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যাবার জন্য। তার সঙ্গে আমি এগোলাম বাড়ির বাইরে যাবার জন্য। সদর দরজার কাছে পৌঁছতেই আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দুর্জন সিংহ আর তার সঙ্গীদের। দুর্জন সিংহর পরনে সেই একই পোশাক। কালো কোটের বুক পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল কলমটা। আমাদের দেখেই পথ আগলে দাঁড়াল দুর্জনের এক সঙ্গী। দুর্জন আমাদের দিকে সন্দিগ্ধ ভাবে তাকিয়ে বলল, ‘এই, তোরা কোথায় যাবি?’

আত্মারাম জবাব দিল, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না। এই বাজিকর শহরে যাবে। আমি গাড়িটা দিতে যাচ্ছি।’

কথাটা শুনে দুর্জন সিংহ আমাকে বলল, ‘তুই শহরে যাচ্ছিস কেন?’

আমি বললাম, ‘সন্ধ্যাবেলাতে খেলা দেখাবার জন্য কিছু জিনিসের প্রয়োজন। সে সব কিনতে যাচ্ছি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যেতে চাইলে যেতে পারেন। দুপুরের মধ্যে আবার ফিরে আসব।’

আমার কথা শুনে একটু ভেবে নিয়ে দুর্জন সিংহ বলল, ‘ঠিক আছে, তুই যা।’

দুর্জনের এক সঙ্গী আমাদের সঙ্গে প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াল। কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে দুর্জন সিংহের জিপ গাড়ি। প্রাসাদের দেউড়ির গায়ের একটা ছাউনি থেকে আত্মারাম পক্ষীরাজকে গাড়ি সমেত বাইরে বার করে আনল। আমি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ছাওলা শহরের দিকে। আমার কপাল খুব ভালো যে, যা খুঁজছিলাম তা কিনতে পারলাম। কাজ মিটিয়ে দুপুরের মধ্যেই আমি আবার মহারাজ নওলকিশোরের রাজপ্রাসাদে ফিরে এলাম। প্রাসাদে প্রবেশ করার পরই আবার আমার দেখা হল দুর্জন সিংহের সঙ্গে। তার জালে ধরা পড়েছেন মহারাজ। তাই সে খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছিল তার সঙ্গীদের সাথে। আমাকে দেখে সে বলল ‘জিনিস কিনে এনেছিস? যদি ভালো খেলা দেখাস তবে আমি তোকে দশটাকা বখশিশ দেব।’

আমি তাকে খুশি করার জন্য বললাম, ‘হ্যাঁ, মালিক জব্বর খেলা দেখাব আমি। ভেলকির খেলা।’

এরপর আমি ঘরে ফিরে আসার পর কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হলো আত্মারাম। আমি তাকে বললাম। ‘মহারাজ যেন আর কাগজে সই করতে আপত্তি না করেন। খেলার পর কাগজে সই করে দেন। তাতেই তাঁর মঙ্গল। আমার কথা শুনে হতাশ ভাবে ফিরে গেল আত্মারাম। সে ভাবল আমার দ্বারা কিছু আর হবার নেই।

|| ৬ ||

আত্মারাম চলে যাবার পর আমার খেলার সাজ- সরঞ্জাম নিয়ে দরজা বন্ধ করে কাজে বসলাম আমি। দুপুরের দিকে একবার এসে খাবার দিয়ে গেল আত্মারাম। ডাল-রুটির সঙ্গে এদিন মহারাজের জন্মদিন উপলক্ষে একটুকরো মুরগীর মাংস আর পোলাও জুটল আমার কপালে। খাবার দিতে এসে আমার সঙ্গে বেশি কথা বলল না আত্মারাম। আমার প্রতি ভরসা হারিয়েছে সে। খাবার নামিয়ে রেখে সে গম্ভীর ভারাক্রান্ত ভাবে শুধু বলে গেল, ‘অন্ধকার নামলে তোমার খেলার জিনিসপত্র নিয়ে দরবারে চলে যেয়ো। মহারাজ তোমার খেলা দেখবেন।’

দুপুরের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নিলাম। উঠলাম শেষ বিকেলে। তারপর অন্ধকার নামতে শুরু করলে খেলার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তৈরী হলাম আমি। তারপর যখন একেবারে পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গেল তখন খেলার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে দরবারে হাজির হলাম। কোথা থেকে যেন একটা হ্যাজাক জোগাড় করে সেটা দরবারে এনে জ্বালিয়েছে আত্মারাম। বেদির ওপর বসে আছেন মহারাজা নওলকিশোর। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর পরনে এদিন একটা নীল রঙের জোব্বা। মাথায় সেই পাগড়িটা। তবে স্পষ্ট হতাশার ছাপ তাঁর চোখে। তা কাছেই বেদির একপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আত্মারাম। দুর্জন সিংহও তার অনুচরদের নিয়ে হাজির সেখানে। কয়েকটা ভাঙা চেয়ার জোগাড় করে এনে বেদির সামনে কিছুটা তফাতে বসেছে তারা। দুর্জনের ঠোঁটের কোণে ধূর্ততার হাসি। তার কোলের ওপর রাখা দলিলের কাগজটা। দুর্জনকে দেখে সে বেশ খোশ মেজাজে আছে বলেই মনে হল। আর খোশ মেজাজে হবেনাই বা কেন? ভোজবাজির খেলা শেষ হলেই তো সে কেল্লা ফতে করবে। ভবিষ্যতে সে পাগড়ি মাথায় মহারাজা হবে।

যাইহোক আমি আমার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলাম মহারাজের বেদির সামনে। মাটিতে আমার খেলার জিনিস গুছিয়ে নিয়ে, মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করলাম। ভোজবাজির খেলা, রুমালের খেলা, তাসের খেলা, আরও নানারকম খেলা, যা সাধারণত বাজিকররা দেখিয়ে থাকে। খেলা দেখাতে দেখাতে কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম দুর্জন আর তার সঙ্গী দু-জনও আমার খেলা দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাদের মুখ থেকে তারিফের শব্দ বেরোচ্ছে। শুধু মহারাজ 
নওলকিশোরের মুখে কোনো হাসি নেই। গভীর হতাশা – গ্রাস করেছে তাঁকে। এরপর আমি দুর্জনের সঙ্গীদেরও – খেলা দেখাবার সাহায্য করার জন্য মাঝে মাঝে ডাকতে শুরু করলাম। কখনও তাদের পেট থেকে ডিম বার করলাম, কান থেকে পয়সা বার করলাম, কখনও বা তারা আমার চোখে কাপড় বেঁধে দিল বা হাত বেঁধে দিল। জমে 
উঠল আমার খেলা। একবার আমি দুর্জন সিংহর কাছে গিয়ে খেলা দেখাবার জন্য তার কলমটা চাইলাম। একটু ইতস্তত করে সে কলমটা দিল। আমি যখন কলমটা নিয়ে – হামালদিস্তাতে গুঁড়ো করলাম, তখন চমকে উঠে কাঁধ – থেকে বন্দুকটা খুলে নিতে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই আমি দুর্জন সিংহের এক অনুচরের পোশাক থেকে সেই ঝর্ণা কলমটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে সেটা ফিরিয়ে দিলাম দুর্জনের হাতে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। কলমটা নেড়েচেড়ে দেখে কলমটা আবার পকেটে পুরল সে। খেলা চলতে লাগল, বেড়ে চলল রাত। প্রায় তিন ঘণ্টা খেলা চলার পর আমি শূন্য হাত ঘুরিয়ে একটা গোলাপ ফুল এনে সেটা মহারাজের পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে খেলা শেষ করলাম। তালি দিয়ে উঠল দুর্জন আর তার সঙ্গীরা। কিন্তু মহারাজ কোনও উল্লাস প্রকাশ করলেন না।

এবার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। দুর্জন কাগজের তাড়াটা আর কলমটা খুলে মহারাজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার মুখে তখন যুদ্ধজয়ের ধূর্ত হাসি। কাগজ খুলে একটা নির্দিষ্ট জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দুর্জন মহারাজকে বলল, ‘নিন, এবার এখানে সই করে দিন।’

কয়েক মুহূর্তর জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। মহারাজ কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর দুর্জনের হাত থেকে কাগজ আর কলমটা নিয়ে তাতে গোটা গোটা হরফে সাক্ষর করলেন — ‘মহারাজা নওলকিশোর সিংহ।’

তাঁর সাক্ষর হবার সঙ্গে সঙ্গেই কাগজ, কলম তাঁর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শয়তান দুর্জন সিংহ, আত্মারামকে বলল, ‘মহারাজ মরলে খবর দিস। আর পাগড়িটা সাবধানে রাখবি, নইলে তোর কপালে দুঃখ আছে।’

তাকে একথা বলার পর ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে লোকটা আমার দিকে একটা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘এদেশে এরপর কখনও এলে মহারাজ দুর্জন সিংহর প্রাসাদে খেলা দেখাতে যাস। ভালো বখশিশ পাবি।’

দুর্জনের কথা শুনে হেসে উঠল তার সঙ্গীরা। তাদের নিয়ে এরপর ঘর ছাড়ল দুর্জন। মাথা নীচু করে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকল মহারাজ ছত্রশালের বংশধর মহারাজ নওলকিশোর সিংহ। একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে হতাশ আত্মারামও।

এক সময় বাইরে দুর্জন সিংহর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। যুদ্ধ জয় করে ফিরে যাচ্ছে শয়তান দুর্জন সিংহ। গাড়ির শব্দ একসময় মিলিয়ে গেল। তারা চলে গেছে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আমি মহারাজকে বললাম, ‘চলুন, আমাদের এখনই এ-প্রাসাদ ছেড়ে শহর ছেড়ে দূরে পালাতে হবে।’

কথাটা শুনে বৃদ্ধ মহারাজ নওলকিশোর হতাশার সুরে বললেন, ‘এখন আর কোথাও গিয়ে কী লাভ? আমি কাগজে সই করে দিলাম। আর তার সাথে সাথেই আমি সব হারালাম।’

আমি তাকে বললাম, ‘না মহারাজ, আপনি এখনও কিছুই হারাননি। আমার গুরুদেব হংসরাজের আশীর্বাদে এযাত্রায় আমি আপনাকে রক্ষা করতে পেরেছি। কিন্তু দুর্জন সিংহ আবার ফিরে এলে তখন আর আপনি বাঁচবেনা।’

মহারাজ আমার কথা শুনে বললেন, ‘তুমি কী বলছ? আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

আমি এরপর আসল ব্যাপারটা খুলে বললাম তাঁকে কথাটা শুনেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহারাজ আর আত্মারামের চোখ মুখ। বিস্মিত মহারাজ আমাকে বললেন, ‘তুমি সত্যি বলছ? আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, একদম সত্যি। কিন্তু দেরি করা যাবে না। কাল সকালেই সম্ভবত দুর্জন ফিরে আসবে।

মহারাজ এরপর আর সত্যি দেরি করলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা সবাই নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পক্ষীরাজের গাড়িতে রওনা হলাম ছাওলা শহরের দিকে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কলকাতার ট্রেন ধরব। কারণ, এ-তল্লাটে থাকলে দুর্জন সিংহ নিশ্চিত খুন করবে আমাকে। অবশেষে মধ্যরাতে আমরা পৌঁছে গেলাম ছাওলা রেল স্টেশনে। বেঁচে গেলেন মহারাজ নওলকিশোর। বেঁচে গেল তার পাগড়ি আর ‘মহারাজা’ খেতাব।

এপর্যন্ত তার কাহিনি বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ। মেস বাড়ির বাইরে অন্ধকার নেমেছে। আর সাথে সাথে পাড়ার ফাংশানের মাইকও বাজতে শুরু করেছে। সেই শব্দ শুনেই থামলেন সত্যচরণ। চন্দন আর তার উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে বলল, ‘কিন্তু আপনি মহারাজকে বাঁচালেন কীভাবে?’

সত্যচরণ হেসে নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘গুরুদেব হংসরাজের আশীর্বাদে আমার দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। দুর্জন সিংহ প্রথম দিন উপস্থিত হয়ে যখন কাগজে সই করার জন্য মহারাজের দিকে তার লাল রঙের ঝর্ণা কলমটা বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন আমি সেটা দেখেছিলাম। পরদিন ছাওলার বাজার থেকে হুবহু অমন একটা কলম কিনে এনেছিলাম আমি। খেলার দেখাবার সময় আমি দুর্জনের থেকে তার কলমটা নিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তাকে ফেরত দিয়েছিলাম আমার কেনা কলমটা। বাপারটা সে বুঝতে পারেনি।’

চন্দন বলল, ‘তাতে কী হল?’

মহারাজ তো সেই কলম দিয়েও সই করেছিলেন। এইটাতো মিথ্যা ছিল না।’

জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘না, সইটা মিথ্যা ছিল না। ‘ভ্যানিশ কালি’ বলে একধরণের কালি আছে তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। যে কালিতে লিখলে কিছুক্ষণ পর সে লেখা উধাও হয়ে যায়? জাদুরখেলা দেখাবার জন্য সে কালি আমার কাছে ছিল। আমি সেটা ভরে দিয়েছিলাম আমার কলমে। মহারাজ সই করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সাক্ষর নিশ্চয়ই ভ্যানিশ হয়ে গেছিল ওই কাগজ থেকে। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন দুর্জন সিংহকে গাধা বানাতে। মন্তর নয়, বুদ্ধি আর হাতসাফাইয়ের জোরে দুর্জনকে গাধা বানিয়েছিলাম আমি।’

চন্দন বলল, ‘এবার বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা।’

জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘এ গল্পের আর সামান্য একটু বাকি আছে। ছাওলা স্টেশনে পৌঁছে আমি মহারাজার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম একটা জিনিস। আর সেটা পেয়ে আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের পাগড়িটা খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজা নওলকিশোর সিংহ। এই সেই পাগড়ি। খাঁটি মহারাজার পাগড়ি।’

চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনি কি তুলে দিয়েছিলেন মহারাজার হাতে?’

সত্যচরণ বললেন, ‘এই পুরোনো পাগড়িটার প্রতি মহারাজের প্রবল আকর্ষণ দেখে আমার মনে কেমন একটা সন্দেহ জন্মেছিল। সারাজীবন ধরে নিজের সর্বস্ব খুইয়ে মহারাজ এই পাগড়ির দখল নিলেন কেন? সেটা কি শুধুই তার জাত্যাভিমান বা তাঁর আত্মশ্লাঘা পুরণের জন্য? না কি তার পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে? আমার কথার মধ্যে আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই যে আমার গল্পের মধ্যে বলেছি যে, সেই রাতে যখন আমি মহারাজকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়ে ছিলাম, তারপর যখন তিনি আমার ঘরে ঢুকেছিলেন সে কথা? মহারাজ আমার ঘর থেকে ফিরে যাবার সময় কিছুক্ষণের জন্য তার পাগড়িটা আমার ঘরে ফেলে গেছিলেন সে কথাও বলেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আত্মারাম পাগড়িটা ফেরত নিয়ে গেছিল। আর তার মধ্যবর্তী সময়ে আমার কৌতূহল আমাকে সেই পাগড়িটা পরীক্ষা করতে বাধ্য করেছিল।

আর আমি পাগড়িটার ভিতর থেকে উদ্ধার করেছিলাম একটা জিনিস। সম্ভবত ওই গোপন জিনিসটার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে সর্বস্ব ত্যাগ করে মামলা করে পাগড়িটা সরকারের ঘর থেকে উদ্ধার করেছিলেন মহারাজ নওলকিশোর। সেটা আমি দেখা মাত্রই নিজের কাছে সরিয়ে ফেলেছিলাম। যাতে দুর্জন সিংহ যদি জোর করে পাগড়িটা মহারাজের কাছ থেকে ছিনিয়েও নেয়, তবে সেটা যাতে খোয়া না যায় সে জন্য। আমি অনায়াসে সেটা চুরি করে পালিয়ে আসতে পারতাম। তাহলে আর আমার খাওয়া পরার অভাব থাকত না। কিন্তু আমার গুরুদেব হংসরাজ আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন‌ — আমরা বাজিকর হতে পারি, প্রয়োজনে ভিক্ষা করবে, কিন্তু কোনদিন অসৎ কাজ করবে না। সে শিক্ষা আজও মেনে চলি আমি। যাই হোক আমি সেটা মহারাজ নওলকিশোরের হাতে তুলে দেবার পর তিনি সেই দুর্মূল্য জিনিসটার আসল পরিচয় দান করেছিলেন। জিনিসটা ছিল, মধ্যভারতের বিখ্যাত মহারাজ ছত্রশালের কণ্ঠে ধারণ করা একটা হিরকখণ্ড। যা লুকোনো ছিল আপনার সামনে রাখা এই পুরোনো পাগড়ির মধ্যে।

জাদুকর সত্যচরণের কাহিনি শেষ হবার পর চঞ্চল বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইল সেই পাগড়িটার দিকে। বাড়ির বাইরে থেকে ভেসে আসা মাইকের শব্দে এবার ঘোষণা শোনা গেল, ‘আপনারা ধৈর্য্য ধরে আসন গ্রহণ করুন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মধ্যে উপস্থিত হবেন বিখ্যাত জাদুকর শ্রী সত্যচরণ পুতিতুন্ডি, হুডিনি অফ ইন্ডিয়া।’

ঘোষণাটা কানে যাবার পর জাদুকর সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘এবার আমার ফাংশানে যাবার সময় হয়ে গেছে।

কথাটা বলে টেবিল থেকে পাগড়িটা তুলে মাথায় দিয়ে জাদুকর সত্যচরণ আরও একবার চন্দনকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’

চন্দন উঠে দাঁড়িয়ে জাদুকর সত্যচরণের উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে জবাব দিল, ‘ঠিক মহারাজের মতন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *