জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্পাপ প্রাণগুলো
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ ও পাঠদানের মান নিয়ে খুবই হতাশা প্রকাশ করেন। শিক্ষকদের অবহেলা নিয়ে দুঃখ করেন। তারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আসতে চান। তাদেরও ইচ্ছা হয় বাইরে পড়াশোনা করবে, গবেষণা করবে। কিন্তু সেটার বুনিয়াদ তাঁরা পান না। সামান্যতম দিকনির্দেশনা সেখানে নেই। তদুপরি, সেশনজটের দুঃসহ বোঝায় তারা প্রাণশক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেন। বছরে পর বছর ছেলেমেয়েগুলোর এই যে হতাশা, সেটা কত যন্ত্রণাময়, আমরা কি উপলব্ধি করি কখনো?
দেশের সবচেয়ে হতভাগ্য শিক্ষার্থী হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। রাষ্ট্র তাদেরকে বহুভাবে অবহেলায় রেখেছে। সমাজও তাঁদের হীনম্মন্যতায় ভুগতে বাধ্য করে। সমাজ ধরেই নেয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের সব কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার পরের অবস্থান নেবেন। বাস্তবে এমন হওয়ার কথা ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই তারা সব সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য দাবি রাখেন।
ভেবে দেখলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যদি আরও উন্নত শিক্ষা দেওয়া যেত, তাহলে সমাজটা আধুনিক হতো আরও তাড়াতাড়ি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্দিষ্ট জেলা শহরে। শিক্ষার্থীরা সেসব শহরে থেকেই পড়াশোনা করেন। গ্রাম থেকে বহু ছেলেমেয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানে পড়তে গেলেও, গ্রামের সঙ্গে তাদের নিত্য যোগাযোগ ক্রমে কমে আসে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় তা নয়। এর অধীন কলেজগুলো গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর ছেলেমেয়ে প্রতিদিন বাড়ি থেকে কলেজে-আসা যাওয়া করেন। এই ছেলেমেয়েদের যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উন্নত এ আধুনিক শিক্ষা দেওয়া যেত, তাহলে এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব। গ্রামগুলোতে পড়ত। গ্রামগুলোতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুন্দর আভা ছড়িয়ে পড়ত। সমাজ আরও তাড়াতাড়ি আলোকিত হতো।
দেশের প্রচুর সম্ভাবনাময়ী ছেলেমেয়ে শুধু পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেকেরই মেধার তারতম্য খুবই কম। একটু সুবিধা পেলে তারা অনেক ভালো করতেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয় রাজনীতি দিয়ে। ধ্বংস করা হয় তাদের অবমূল্যায়ন করে। ধ্বংস করা হয় সেশনজট দিয়ে, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং আধুনিক শিক্ষা না দিয়ে। এই নিষ্পাপ ছেলেমেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠানে ডেকে নিয়ে এই যে। অবহেলায় রাখা, এটা অন্যায়। এটা পাপ। একটি দেশ যখন তার সম্ভাবনাকে খুঁড়তে জানে না, বরং সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অবহেলায়, তখন সে দেশ বহুদিক দিয়ে ব্যাধিগ্রস্ত হয়।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি প্রফেসর হান্স এডলফসন। ছিলেন আমার শিক্ষক। অর্গানিক কেমেস্ট্রির প্রফেসর। তার সঙ্গে কথা হলেই শিক্ষার বিষয় ওঠে আসত। একবার জিজ্ঞেস করলাম, সুইডেন এত ছোট্ট একটি দেশ অথচ এতও” বিশ্ববিদ্যালয় তোমরা করে রেখেছ!–এত সুষম শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য কী? স্বল্প উত্তরে সে বলেছিল, একটি সম্ভাবনাও যেন ঝরে না যায়, সেটাই তাদের মূল লক্ষ্য। আমরা সম্ভাবনাকে গলা টিপে মারি। মারার আগে ক্রমাগত বলি, তোকে দিয়ে কিছু হবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ও পাঠদানব্যবস্থা যদি যুগোপযোগী করা যায়, যদি সেখানে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যায়, তাহলে ভেবে দেখুন কতগুলো শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে যাবে। মানুষের সম্ভাবনাকে বের করে আনতে হয়। এর জন্য লাগে নিবিড় পরিচর্যা। আমরা ভুলে যাই, উত্তম বীজতলায় খারাপ বীজও গাছ দেয়। উষর বীজতলায়, ভালো বীজও নষ্ট হয়। স্বপ্ন দেখি, একদিন এই নিষ্পাপ প্রাণগুলো প্রত্যেকে একেকটি প্রদীপ হয়ে জ্বলবে আপন ভুবনে। আর সে জন্য ওদের পরিচর্যা করতে হবে। ওদের সুযোগ দিতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে ওদের স্বপ্নগুলো।