জাতীয়তা
০১.
দার্শনিক পরিভাষায় প্রতিটি মানুষ হচ্ছে বিশিষ্ট দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা। সামান্য তাৎপর্যে, দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি ও আদর্শের অভিন্নতা যেমন বিশেষ দেশ, ধর্ম ও রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষকে অদ্বৈত বর্ণে ও গুণে প্রতীয়মান করে; তেমনি আবার ঘরের, দেশের, সমাজের, ধর্মের কিংবা আদর্শের প্রভাব প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র রাখে। বর্ণে ও অবয়বে, চলনে ও বলনে কিংবা স্বভাবে ও আচরণে যেমন প্রতিটি মানুষ অনন্য, তেমনি আবার আপাত অভিন্ন জীবন-রীতি মানুষকে করেছে সমষ্টির নিরূপ অংশ। প্রথমটির নাম ব্যক্তিত্ব (Personality) এবং দ্বিতীয়টি জাতিত্ব (Nationality)। এভাবে ব্যষ্টি (individual) নিয়ে গড়ে উঠে সমষ্টি (Nation)। অতএব, প্রতি মানুষের রয়েছে এই দ্বৈতসত্তা। একটি ব্যক্তিসত্তা, অপরটি জাতি-পরিচয়। একটির জন্যে অপরটি অস্বীকার বা অবলুপ্ত করবার প্রয়োজন হয় না। একাধারে এই দ্বৈতসত্তার নির্দ্বন্দ্ব সহাবস্থান বা সংস্থিতি সম্ভব। এ জাতীয়তা অবশ্যই অভিন্ন দেশ, ধর্ম, ভাষা ও সমাজ ভিত্তিক।
.
০২.
আধুনিককালে অভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ, ধর্ম ও ভৌগোলিক সংস্থান নিয়ে যেসব রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেখানকার সমস্যা ভিন্নতর। সেখানে দ্বন্দ্ব জনকল্যাণ সম্পর্কিত আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগত। আর বিভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ ধর্ম ও ভৌগোলিক-চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা মূলত রাষ্ট্রিক-চেতনাজাত অভিন্ন জাতির পরিচয়, বিশ্বাস ও সংস্কার দৃঢ়মূল করার উপায় ও প্রয়াস পদ্ধতির। আজকের পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ও এ অসমাধ্য সমস্যায় পীড়িত। বস্তুত এ সমস্যা এ যুগেরই। আগের কালে রাজা-প্রজার সম্পর্ক ছিল শাসক ও শাসিতের, প্রবলের ও দুর্বলের, শোষক ও শোষিতের, সেজন্যে সে-যুগে এ সমস্যা ছিল না। শাসকের শক্তির তারতম্যে রাজ্য-সাম্রাজ্যের স্থিতি ও ভাঙা-গড়া চলত। এ যুগ গণতন্ত্রের ও জাতীয়তার এবং রাজ্যের নয়–রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রে প্রতি মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের স্বীকৃতিতে জাতি-চেতনা ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও স্থিতি। অনেকাংশে এ এক সমবায় সংস্থা। এজন্যেই একক অভিন্ন জাতি-চেতনায় জাতীয়তাবোধ না জন্মালে, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় বাস করা ও স্বাভাবিক আনুগত্য রাখা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই রাষ্ট্রমাত্রেই হবে mono-national state-এক জাতি এক রাষ্ট্র।
উনিশ শতকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কৃত্রিম জাতীয়তা সৃষ্টির প্রয়াসে য়ুরোপ-আমেরিকায় বহু রক্তারক্তি হয়ে গেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ প্রয়াস নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ শতকে আবার তার পুনরাবৃত্তি চলছে আফ্রো-এশিয়ায়। হয়তো কেবল পরিণামে ব্যর্থ হবার জন্যেই।
আবার এর উল্টো সাধনাও লক্ষ্য করি– দেশ ভাগ করে জাতি-চেতনাকে খণ্ডিত করার অভিনব অপপ্রয়াস-সিরিয়া, কোরিয়া, জার্মানী, ইন্দোচীন প্রভৃতি স্মর্তব্য।
এই উভয়বিধ অপপ্রয়াস চলছে রক্তের অভিন্নতার প্রমাণে, ভৌগোলিক অবিচ্ছেদ্যতার যুক্তিতে অথবা আদর্শের ধ্বনি তুলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কিংবা আর্থনীতিক প্রয়োজনের গুরুত্ব দেখিয়ে। আসল কারণ শাসন-শোষণের লোভ। নইলে বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজনে এক প্রকারের যুক্তি, আর সংহতির-বাঞ্ছয় বিপরীত যুক্তি একই কালে একই মুখ দিয়ে বের হতে পারত না। তাই কোথাও রক্ত, কোথাও ভাষা, কোথাও ধর্ম, আবার কোথাও আদর্শ কিংবা অর্থনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে। দুষ্টবুদ্ধি প্রসূত না হলে নীতির ও যুক্তির এ অসঙ্গতি থাকত না।
.
০৩.
আমাদের পাকিস্তানও এ সমস্যার স্বীকার। বৃটিশ আমলে হিন্দুর পীড়নজাত প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারতে মুসলমানেরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এর ফলে গড়ে উঠে পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিবেশে আগের আবেগ ও স্বপ্ন অবলুপ্ত। তাই নতুন করে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবোধ সুষ্ঠু করার প্রয়োজন।
ধর্মীয় অভিন্নতাই পাকিস্তানী জাতীয়তার একমাত্র ভিত্তি। শাসন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিষম নীতি অনুসৃতির ফলে কেবল ধর্মীয় বন্ধন জাতীয়তার ভিত দৃঢ় রাখতে পারছে না। প্রবল পক্ষের প্রতি দুর্বল পক্ষের বর্ধিষ্ণু বিরূপতা রোধ করবার প্রয়াসে তাই সমাজ-সংস্কৃতির অভিন্নতা প্রমাণের অপচেষ্টা শুরু করেছেন সবল পক্ষ।
রাজনীতিক স্বার্থে গড়ে উঠেছে স্ব-ধর্মভিত্তিক এ জাতীয়তা। প্রীতিপ্রসূত নয় বলেই আত্মরতি হয়েছে প্রবল। শাসক-শাসিত তথা পীড়ক-পীড়িত সম্পর্কের উচ্ছেদ সাধন করে সাম্য ও সমদর্শিতার ভিত্তি রচনায় তাই আগ্রহ নেই তাদের। শোষণ কায়েম রাখবার কুমতলবে তারা শোষণ ও সম্প্রীতির ভারসাম্য স্থাপনে প্রয়াসী। এজন্যে তাঁরা এককালে একক ভাষার ফজলিয়ত বয়ান করেছেন, তারপর চালু করতে চেয়েছেন অভিন্ন হরফ, তারও পরে শুরু করেছেন আরবি ফারসি শব্দের মহিমা প্রচার। এ সঙ্গে রয়েছে বর্ণ ও বানান সংস্কারের জিকির। নায়ক রয়েছেন নেপথ্যে। ছদ্মনায়ক সেজেছেন যাঁরা, তাঁরা সব আমাদের ঘরের লোক। তাই যন্ত্রী ও যন্ত্র-চালিতের পার্থক্য বোঝা কঠিন। বিড়ম্বনাও বাড়ছে এজন্যেই। শিক্ষিত সরলজনেরা তাই বিভ্রান্ত কিংবা বিমূঢ়।
তবু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব যে বর্ণে-অবয়বে, মনে মেজাজে, বিশ্বাসে-সংস্কারে, আহার্যে-পোশাকে, আচার-আচরণে, ভাষায়-সংস্কৃতিতে–এককথায় জীবন-চর্যার সর্বক্ষেত্রে যে পার্থক্য ঘটায় তা ঢাকা দেবার জন্যে তাই এবার সেই পুরোনো জিকির আবার শুরু হয়েছে পাকিস্তান হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানের জন্যেই, ইসলাম দেশ-কাল-জাত জন্মের পার্থক্য স্বীকার করে না। অতএব, সারা পাকিস্তানে মুসলমানের জীবন-চর্যা হবে অভিন্ন। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানে যা নেই, পূর্ব পাকিস্তানে তা চলবে না–চলা উচিত হবে না। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানীরা হচ্ছে আদমের আমল থেকেই মুসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানীরা হচ্ছে ইসলামোত্তর যুগের দীক্ষিত মুসলমান! কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানীর অভিভাবকত্বে চলবে পূর্ব পাকিস্তানীর মুসলমানী জীবন। পশ্চিম পাকিস্তানের পাকা মুসলমানেরা যা কিছু করে, তা-ই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অনুকরণীয়–কেননা এই কাঁচা মুসলমানের জন্যে তা-ই শ্রেয়। অতএব, রবীন্দ্ৰতিথি, বসন্তোৎসব কিংবা নববর্ষ বেদাৎ বলেই মুমীনের পরিহার্য। বাঙলাদেশ, বাঙলা ভাষা, বাঙালি প্রভৃতি আমল-ই-জাহিলিয়তের নামগুলো ভুলে যেতে হবে। সত্যের আলোক প্রাপ্ত মুমীন বলবে–পাকিস্তান, পাকজবান, পাকিস্তানী। মুসলমান হওয়া কি যেমন-তেমন কথা! মুসলমান করার ও মুমীন রাখার মহান ব্রত ও দায়িত্ব নিয়েই পাক সরজমিনে গড়ে উঠেছে ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামের অছি-সরকার। এ-ই যদি না হল তাহলে যে সবই বৃথা!
কথাগুলো শুনতে বিদ্রুপাত্মক বটে, কিন্তু এসব হাস্যকর যুক্তিই অত্যন্ত গুরু-গম্ভীর ভাষায় উচ্চারিত হয়। অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও সরল লোকেরা শুনে মুগ্ধ হয়, চরিত্রবান অক্ষম দেশহিতৈষীরা বেদনাবোধ করে, আর বিষয়ীরা এর থেকে ফায়দা উঠায়।
কিন্তু এ যুগে এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ানোর কোনো কারণ ছিল না। কেননা, সমস্বার্থে মিলিত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সহ-অবস্থান করা এ যুগেই সম্ভব ও সহজ। বলতে গেলে এ যুগ কেবল জাতীয়তার নয়–আন্তর্জাতীয়তারও। ভৌগোলিক দূরত্ব, গোত্রীয় বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, ভাষার পার্থক্য ও ধর্মীয় প্রভেদ এ যুগে মিলনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সৌজন্য, সমদর্শিতা ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে আজকাল পৃথিবীর দুই বিপরীত প্রান্তের লোকও একরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় একক জাতি গড়ে তুলতে পারে। আবার দুষ্টবুদ্ধি যে একক দেশ ও জাতিকে সহজেই বিভক্ত করতে সমর্থ তা আগেই বলেছি।
.
০৪.
আবার এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ছিদ্রপথে আরো ক্ষতিকর বিভ্রান্তির প্রসার ঘটছে। আমাদের রাষ্ট্রবাসীরা সুযোগ-সুবিধে মতো কখনো ইসলামী জাতীয়তার, কখনো বা রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার অঙ্গীকারে চলে। এমনকি গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাও চেতনার গভীরে ক্রিয়াশীল। তাই প্রায় প্রতি নাগরিকই এই দ্বৈতসত্তার পীড়ায় অসুস্থ। ফলে পাঠান-বালুচ-সিন্ধি-পাঞ্জাবি বাঙালি সত্তার সঙ্গে কখনো মুসলিম-চেতনার কখনো বা পাকিস্তানী-চেতনার যোগে-বিয়োগে রাষ্ট্রিক জাতীয়তা দৃঢ়মূল হবার অবকাশ পাচ্ছে না। প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের মেল-বন্ধন না হলে সমস্যার সমাধান নেই।
মনকে চোখ ঠাওরিয়ে যদি গোঁজামিলে মিলনসেতু তৈরি করি, কিংবা ফাঁকি দিয়ে ফাঁক পূরণ করি, তাহলে না-ঘরকা না-ঘাটকা-চেতনা প্রশ্রয় পাবেই এবং তাতে রাষ্ট্রিক স্বার্থ ব্যাহত হবেই।
অজ্ঞতা, অন্ধতা ও ভাবাবেগ মানব-চৈতন্যের স্থায়ী অবস্থা নয়, কাজেই অবাস্তব-অযৌক্তিক কিছু বেশিদিন টেকে না। সে-যুগ আর নেই, যখন ইসলাম-বিদ্বেষী কামাল আতাতুর্ক ছিলেন পাক ভারতীয় মুসলমানের চোখে জাতীয় বীর ও ইসলামের ত্রাণকর্তা। তিনি কোরান, মসজিদ ও আরবি-অসহিষ্ণু হলেও তাকে নিয়ে স্বধর্মীর গৌরব-গর্বে ও এদেশের মুসলমানের মাতামাতির অন্ত ছিল না। প্যান-ইসলামী সে-আবেগ আজ বিলুপ্ত। তাই খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলো তো বটেই। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও–মিশর, মরোক্কো, সুদান, আলজিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতিও ধর্মীয় আবেগ থেকে মুক্ত। আজ দুনিয়ার সব রাষ্ট্রই–ধর্মভিত্তিক নয়-রাষ্ট্রসীমা ভিত্তিক জাতীয়তায় আস্থাবান এবং এ অঙ্গীকারেই সমৃদ্ধিকামী।
আমাদের ছাত্ররা দেশের ইতিহাস ও সাহিত্য-গ্রন্থে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার এই বিভ্রান্তিকর দ্বৈতবোধই লাভ করে। ফলে তাদের জাতীয়তাবোধ প্রয়োজনানুরূপ ঋজু, পষ্ট ও দৃঢ় হয় না। এ জাতীয়তাবোধের ভিত্তি চোরাবালি, ফলত রাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক।
ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখলে, ইরানী, আফগানী প্রভৃতি যে-কোন বিদেশী স্বধর্মীর শাসনে এ দেশের লোক নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করবে, যেমন তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমানরা শাসকের স্বাধৰ্ম গর্বে খুশি থাকত। আজকের জগতে এহেন নির্বোধ আত্মপ্রসাদ কাম্য কি! অতএব, তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমান স্বাধীন ছিল কি-না, গৌড়ের স্বাধীন সুলতানী আমল বাঙালিরও স্বাধীনতার যুগ কি-না, মুঘল সুবাদার আলীবর্দী-সিরাজদ্দৌলার শাসন বাঙলাদেশে বাঙালির স্বরাজের প্রতীক কি-না বিচার-বিবেচনা করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় এসেছে।
আরো একটি ভাববার কথা আছে। বিধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রিক যুদ্ধে যেহাদী-প্রেরণা-পন্থা গ্রহণ করলে স্বধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে কোন্ প্রেরণা কাজ করবে? মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধ দৃঢ়মূল হলেই মানুষ স্বদেশের স্বার্থে সর্বাবস্থায় সংগ্রামী প্রেরণা পায়। কাজেই আশুপ্রয়োজন মিটানোর জন্যে জাতীয়তাবোধের মতো অতি গুরুতর ধারণার সংকোচন-প্রসারণে যথেচ্ছ অপব্যবহার পরিণামে অহিতকর।