সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করলে নববর্ষের দিনটি অন্য যেকোনো দিন থেকে কোনোভাবেই আলাদা কোনো দিন নয় (আনন্দের উচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাঝেমধ্যে গভীর রাতে পুলিশ ডাকতে হয়, তবে সেটা অন্য ব্যাপার!)। অন্য বছরের কথা জানি না, কিন্তু আমরা চাইলে এ বছরটাকে আলাদাভাবে পালন করতে পারি, আমরা সবাই মিলে ঘোষণা করতে পারি, ২০১০ সালটি হবে গ্লানিমুক্তির বছর, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বছর।
নতুন প্রজন্মের যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা কখনো ভালো করে দিতে পারিনি, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল এ প্রশ্নটি—পৃথিবীর সব দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়, আমরা কেন আমাদের যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে পারি না? এ দেশে তারা কেন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়? কেন তারা বড় গলায় কথা বলে?
ব্যাপারটি আমরা যতভাবেই ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ করি, প্রশ্নটি কিন্তু থেকে যায়। যুক্তিতর্ক, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এ প্রশ্নটিকেই অর্থহীন করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। সে অঙ্গীকার করে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে এবং আমরা আবার নতুন প্রজন্মের চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, কে বলেছে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় না। এই দেখো, আমরা তাদের বিচার শেষ করেছি, সেই মুহূর্তটির জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।
আমরা শুনতে পাচ্ছি কি না জানি না, কিন্তু এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা কিন্তু তাদের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছে। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা ঠিক সেভাবে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য শেষ আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরেছে। নিজের কানে শুনে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না যে এ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ, শেষ সহায় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১-এ যে মুক্তিযোদ্ধাদের তারা বলে এসেছে দুষ্কৃতকারী, ভারতের দালাল, ইসলামের দুশমন, বেইমান, গাদ্দার, যাদের তারা আক্ষরিক অর্থে এ দেশের মাটিতে জবাই করেছে; হঠাত্ করে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখাতে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যে মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হয়ে অস্ত্র হাতে এ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এখন তারা যে শুধু সেই যুদ্ধকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছে তা নয়, তারা দাবি করছে, সেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা সহায়তা করেছে! এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার এ দেশের মানুষ কি কখনো শুনেছে? কখনো শুনবে? যারা বলছে, তারা নিজেরাও তো সেই কথা একবারের জন্যও বিশ্বাস করে না। তাহলে তারা কেন সেটি বলছে?
আমরা সবাই জানি, তারা এই কথাগুলো বলছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য, সংগঠনটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তাদের নিজের দলের তরুণ প্রজন্মকে ধরে রাখার জন্য। যে রাজনৈতিক দল রাজাকার হয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদলেহন করে নিজের মা-বোনকে তাদের হাতে তুলে দেয়, বদর বাহিনী হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে, কোন তরুণ সেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে ছুটে যাবে? সত্যিকারের বিচারের আলো ঘৃণার আগুনে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকার কষ্ট থেকে তাদের মুক্তি নেই। বিচারে কী হবে, আমরা জানি না, কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না, সেই কথাটি যুদ্ধাপরাধীদের থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না!
আমার ধারণা, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিটুকু উচ্চারণ করেই আমরা এই নতুন বছরকে গ্রহণ করব। এ বছরেই আমরা সত্যিকার অর্থে গ্লানিমুক্ত হব।