জাতিস্মর

জাতিস্মর

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল সাম্য৷ পিঠের ব্যাগটা অন্তত কুড়ি কেজির কম হবে না৷ সকাল থেকে প্রায় না খাওয়া৷ গত দু-দিন শরীরের উপর ধকল কম যায়নি৷ তার উপর এই রাতবিরেতে গোটা শহর জুড়ে ছোটাছুটি৷

হরিদ্বার শহরের রাস্তায় লোকজন কমে এসেছে৷ রাত প্রায় এগারোটা৷ দু-ধারে মিষ্টি আর খাবার-দাবারের দোকানগুলো শাটার নামাচ্ছে একে একে৷ আলো নিভে অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে শহরটা৷ সেগুলো ওর উৎসাহের আলোটাকেও যেন নিভিয়ে দিচ্ছে৷

ছুটতে ছুটতে ফোন বেজে উঠতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে একটু দম নিয়ে সেটা রিসিভ করে সাম্য৷ ওপাশ থেকে বাবার রুগ্ন গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘কী রে কোথায় তুই? শুনলাম দাদাদের সঙ্গে খেতে যাসনি?’

‘না, আমার একটু কাজ আছে আসলে, আমি পরে খেয়ে নেব…’

‘সেকি! কী যেন বাঙালি হোটেল পেয়েছে বলল, তোকে বলেছিল তুই খাসনি!’

‘আমাকে আসলে… কিছু কেনাকাটা করতে হবে৷ ট্রেনে উঠে কিছু খেয়ে নেব…’

‘সারাটা দিন না খেয়ে আছিস, এখন খাওয়া ফেলে আবার কী কিনতে হবে তোকে?’

‘একটা কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তি৷ কখন থেকে খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না…’

ওপাশের মানুষটা একটু অবাক হয়, ‘বাবা! তোর আবার ধর্মে-কর্মে মতি হল কবে থেকে? যাক গে, কিনে নিয়ে তাড়াতাড়ি আয়৷ বারোটা কুড়িতে ট্রেন কিন্তু…’

ফোনটা রেখে একটু চিন্তিত হলেন ভদ্রলোক৷ মাসখানেক হল ছেলেটার জীবনে কিছুই ঠিক যাচ্ছে না৷ তিনমাস আগে ওর মা মারা গেল৷ সে শোক ভুলতে না ভুলতেই বাবার অসুখ ধরা পড়ল৷ একা হাতেই প্রায় সামলাতে হচ্ছে সংসারটা৷ একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করত, ক-দিন না যাওয়ায় সেখান থেকেও ছাঁটাই হয়েছে৷

আপাতত ক-টা টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছে বটে, কিন্তু তেমন করেই বা ক-দিন৷ পরপর এতগুলো আঘাতেই বোধহয় ছেলেটার মাথায় একটু গন্ডগোল দেখা দিয়েছে৷ মাসখানেক হল স্বভাবটাও কেমন পাগলাটে হয়ে গেছে৷ এই যেমন হরিদ্বারে নেমেই হঠাৎ খাওয়া ফেলে কেন যে বুদ্ধমূর্তি কিনতে ছুটেছে কে জানে৷

ছেলেকে একরকম জোর করেই পাহাড়ে ঘুরতে পাঠিয়েছেন৷ মা মারা যাওয়ার শোকটা তো অল্প কিছু নয়৷ অন্তত কিছুদিন আশপাশটা বদলে গেলে মন ভালো হলেও হতে পারে৷ তাই দিন কয়েকের জন্য নিজের খরচেই ডিসেম্বরের শেষে মাসতুতো দাদাদের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল৷ ফেরার পথে হরিদ্বার থেকে ট্রেন ধরার কথা৷

ফোন রেখেই আবার দৌড়াতে থাকে সাম্য৷ আর চল্লিশটা মিনিট, তারপরই একটা নতুন বছর শুরু হবে৷ বছরের শেষ একটা ঘণ্টা নিজের শহর থেকে বহু দূরে কাটবে৷

চারপাশের দোকানগুলোতে খুঁজতে থাকে ও৷ হঠাৎ মোড়ের শেষে একটা ছোট দোকানে চোখ আটকে যায়৷ হ্যাঁ, ওই তো চোখে পড়েছে একটা দোকান৷ নানান দেব-দেবীর মূর্তি রাখা আছে সাজিয়ে৷ ও ব্যাগটা ভালো করে পিঠে চাপিয়ে সেদিক লক্ষ্য করে দৌড় দেয়৷

দোকানদার বন্ধই করতে যাচ্ছিল দোকানটা৷ ওকে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাগ নিয়ে ছুটে আসতে দেখে থেমে যায়, ‘ক্যা চাহিয়ে বাবু?’

‘আপকে পাস বুদ্ধ কা মূর্তি হ্যায়, কালা পাত্থারওয়ালা?’

‘হ্যাঁ না, লেকিন কালা পাত্থর তো…’

‘কালো পাথরই লাগবে… প্লিজ দেখুন না একটু, আর কোনও দোকান খোলা নেই…’

দোকানদার একটুক্ষণ থম মেরে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ যেন কী একটা পড়ার চেষ্টা করছে লোকটা৷ কয়েক সেকেন্ড সেইভাবে তাকিয়ে থেকে আবার হাসল সে, তারপর একটা কাঠের সেলফ থেকে কাপড়ে মোড়া একটা ফুট খানেক উঁচু মূর্তি বের করতে করতে বলল, ‘আপ ইয়ে লে জাইয়ে…’

কাপড়টা সরাতেই সাম্যের মনটা খুশি হয়ে গেল৷ ঠিক এরকম একটা মূর্তিই সে চাইছিল৷ পদ্মাসনে বসে আছেন ধ্যানী বুদ্ধ৷ কাঁধ থেকে নেমে এসেছে একটা লাল উত্তরীয়৷ ঠোঁট এতটুকু কাঁপেনি, তাও মনে হচ্ছে মুখের কোণে স্মিত হাসি লেগে রয়েছে৷ গোটাটাই কালো পাথরের৷ নিরেট, মখমলের মতো মসৃণ৷

‘ইয়ে সাড়ে তিন হাজার মে আ জায়েগা…’

দ্রুত পকেট থেকে টাকাটা বের করে এগিয়ে দেয় সাম্য৷ তারপর আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ায় দোকানের বাইরে৷ পেছন থেকে দোকানদার কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, মৃদু কানে আসে সাম্যের, ‘লেকিন ইস মূর্তিকে সামনে…’

অত শোনার সময় নেই সাম্যের৷ পেটে চনচনে খিদে৷ তাছাড়া একটা ফোনও করতে হবে৷ সে মূর্তিটা হাতে ধরেই দোকান ছাড়িয়ে অনেকটা দূর চলে আসে৷

 এতক্ষণে রাত আরও গভীর হয়েছে৷ এ সময় হরিদ্বার শহর ফাঁকা হয়ে যায়৷ তার উপর এখন ডিসেম্বর মাসের শেষ৷ ঠান্ডার কনকনে কামড় রয়েছে৷ কিছুটা দূরে একটা বাড়ির সামনে এসে তার খোলা চাতালের উপর বসে পড়ল সাম্য৷ বুদ্ধমূর্তিটা নামিয়ে রাখল পাশে৷ হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নতুন বছর আসতে আর কুড়ি মিনিট বাকি৷

হাসিমুখে মোবাইল ফোনটা বের করে নাম্বার ডায়াল করল সাম্য৷ অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করল সেটা,

‘বলো…’ ধাতুর মতো শীতল গলার আওয়াজ৷

‘বারোটা কুড়িতে আমার ট্রেন৷’

‘জানি… সাবধানে ফিরো…’

‘শোনো না, একটা কথা বলার ছিল…’

‘বলো…’

‘দেখো জানি অনেক সমস্যা হয়েছে আমাদের মধ্যে৷ কিছুই আর আগের মতো নেই৷ এ ক-মাসে আমার জীবনটাও পালটে গেছে কতটা৷ মা চলে গেল, বাবার শরীরটা… তোমার সঙ্গেও সময়টা ভালো যাচ্ছে না৷ আমি এসব চাই না বিশ্বাস করো৷ দেখ…’ ঠোঁট চেটে নিজেকে শান্ত করে সাম্য, ‘এই বছরটা আর বেশিক্ষণ বাকি নেই৷ চলো সবটা ঠিক করে নিই…’

ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ এল না৷ সাম্য নিজেই আবার বলল, ‘আচ্ছা৷ তোমার জন্য একটা জিনিস কিনেছি জানো, তোমার কতদিনের শখ ছিল কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তি৷ হরিদ্বার শহরটা খুব পবিত্র জানো তো, এখান থেকে কেনা মূর্তিও জাগ্রত হয়…’

‘ওহ তাই নাকি? তুমি বিশ্বাস করো এসব?’

‘না, কিন্তু মনে হল বছরের বাকি সময়টায় তোমার ভালো লাগে এমন কিছু করা উচিত…’

‘তুমি চাও আমার এই বছরের শেষটা ভালো হোক?’

‘হ্যাঁ…’

‘তাহলে ফোনটা এক্ষুনি রেখে দাও… আর কল ব্যাক কোরো না কখনও এখানে…’

গলাটা ধরে আসে সাম্যর, ‘এরকম কোরো না প্লিজ৷ তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমাকে সামলানোর মতো, তুমি যদি এভাবে…’

ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে আবার কেঁপে ওঠে ফোনটা৷ অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন আসছে৷ নম্বরটা চিনতে পারে সাম্য৷ বকুল ফোন করছে ওকে৷ কে জানে ও যন্ত্রণা পেলেই কী করে বুঝে যায় মেয়েটা? এখন হয়তো নিউ ইয়ারে উইশ করতে ফোন করছে৷ কিন্তু সেটা ধরতে ইচ্ছা করল না সাম্যের৷

ফোনটা কেটে নামিয়ে রাখল পাশে৷ ওর দুটো চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে৷ সারা শরীর জুড়ে অসহ্য ক্লান্তি, খিদেটা কখন যেন মরে গেছে৷ বাড়িও ফিরতে ইচ্ছা করছে না৷ মাঝরাতে একটা ফাঁকা শহরের অচেনা বাড়ির রাস্তার ধারে বসে দু-চোখ ছাপিয়ে কাঁদতে লাগল সাম্য৷

ট্রেন যখন ছাড়ল তখন সাড়ে বারোটা বাজছে প্রায়৷ আপার বার্থে উলটে শুয়েছে সাম্য৷ পায়ের কাছে লাগেজের ব্যাগটা আর মাথার কাছে পাথরের বুদ্ধমূর্তিটা রাখা৷ ব্যাগের ভিতরে জায়গা হয়নি সেটার৷

একরাশ প্রশ্ন ভিড় করে আসছে ওর মনে৷ মায়ের মুখটা না চাইতেও মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার৷ বাবার শরীরটা কি আগের থেকে আরও খানিক খারাপ হল? এত রাত কি ফোন করে দেখবে একবার?

আবার কাঁপছে ফোনটা৷ আবার বকুলের ফোন৷ এত কিসের দরকার মেয়েটার৷ জোর করেই সেটা রিসিভ করে সাম্য৷ একহাতে নাকটা মুছে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘হ্যাঁ বল…’

বকুল অন্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, একটু থেমে বলে, ‘কী হয়েছে বল তো তোর? গলাটা এরকম কেন?’

‘জানি না, আমার ভালো লাগছে না কিছু… রাখছি…’

ওর নিচের বার্থে একটা মারোয়াড়ি শুয়েছে৷ সে মোবাইলে চটুল হিন্দি গান শুনছে৷ ওপাশে একটা বাচ্চা মেয়ে৷ চাদর মুড়ি দিয়ে সেও মোবাইলে মুখ রেখেছে৷ তার মা-বাপ মনে হয় নিচে শুয়েছে৷ বাইরে শনশন করে ছুটে চলা ট্রেনের আওয়াজ৷ ঘরের দিকে ফিরছে ও৷ কিন্তু কতদূর সে ঘর? অনন্ত সময় এই ট্রেনের ভিতরে শুয়ে থাকলেও ঘরে ফিরতে পারবে?

দু-আঙুলে চোখটা মুছে নিয়ে মাথার দিকে তাকায় সাম্য৷ কালো পাথরের মূর্তিটা হাল্কা আলোয় এখনও চোখে পড়ছে৷ আর কেউ নেই এখন কথা বলার মতো৷ ও আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে মূর্তিটার হাত তারপর ধরা গলাতেই বলে, ‘আমার কষ্ট কবে শেষ হবে বলুন তো?’

বাইরে ট্রেনের আওয়াজ বেড়ে ওঠে৷ জোরে কথা বললেও কামরার কেউ ওর কথা শুনতে পাবে না৷

‘আমার জন্য কি কষ্ট হয় না কারও? এত সহজে ছেড়ে চলে যেতে পারে সবাই? আপনিই তো বানিয়েছিলেন আমাকে, কেন এমন কিছু দিলেন না বলুন তো যাতে আমাকে ছেড়ে যাওয়া যেত না?’

হাসি হাসি পাথুরে মুখটার দিকে চেয়ে রাগ বেড়ে ওঠে সাম্যের৷ যেন ব্যঙ্গ করছে ওকে হাসিটা৷ মায়ের মরা মুখটা মনে পড়ছে, বাবার রুগ্ন গলার আওয়াজটা মনে পড়ছে, আর একটা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া স্পর্শ… মূর্তিটাকে একহাতে আঁকড়ে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যায় নিচে৷ পরমুহূর্তেই থেমে যায়৷

দু-হাতে মূর্তিটা বুকের মধ্যে আগলে রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে সাম্য৷ কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করতে থাকে৷

একসময় চোখের জল শুকিয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ে৷ সারারাত পাথুরে মূর্তিটা ওর বুকের কাছেই পড়ে থাকে৷

কালচে নিষ্প্রাণ অথচ হাস্যময় চোখে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকে আড়াই হাজার বছর আগে জন্মানো বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক৷ তার মুখের হাসি যেন ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়…

(২)

ট্রেনটা দুলে উঠতেই মাথায় কিসের আঘাতে ঘুমটা ভেঙে গেল সাম্যের৷ মুখ দিয়ে অজান্তেই আওয়াজ বেরিয়ে এল৷ কপালে হাত ঘষতে ঘষতে চোখ খুলল সে৷

ভোর হয়েছে৷ চারটে বাজতে যায়৷ ওদের কম্পার্টমেন্টের কারও এখনও ঘুম ভাঙেনি৷ তবে জানলা দিয়ে বাইরের আলো এসে ভরিয়ে দিয়েছে বগির ভেতরটা৷

মুখটা মুছে নিয়ে ও আবার পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পাশের বার্থের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল৷ কাল রাতে ও বার্থটা ফাঁকা ছিল৷ এখন সেখানে একটা লম্বাটে চেহারার লোক পাশ ফিরে শুয়ে আছে৷ লোকটার গায়ে একটা লালচে শাল গোছের কাপড় জড়ানো৷ মাথার চুল খোঁপার মতো বাঁধা৷

একবার উসখুস করে সোজা হয়ে শুলো লোকটা৷ শোয়ার ভঙিটা দেখেই চোখ আটকাল সাম্যের৷ মনে হল লোকটাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে ও আগেও দেখেছে৷ অন্য কোথাও৷ পেটটা হালকা উঁচু৷ খাঁড়া নাক, ঘুম ঘুম চোখ, সুঠাম অথচ নরম গড়ন৷ কোথায় দেখেছে একে?

লোকটা ঝিমোচ্ছে না ঘুমোচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না৷ চারদিকে চেয়ে কোনও লাগেজও দেখতে পেল না ও৷

ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে আবার পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের বার্থ থেকে একটা তুলতুলে গলার স্বর ভেসে গেল, ‘ওরকম ড্যাবড্যাব করে দেখার কী আছে? কাল রাতে অত কান্নাকাটি করে আজকে ভুলে গেলে?’

সাম্য বুঝল কথাটা ওকেই বলা হয়েছে৷ কিন্তু ও যে কাল রাতে কান্নাকাটি করেছে সে কথাটা লোকটা জানল কেমন করে? তখন তো বার্থটা ফাঁকাই ছিল৷ তাছাড়া ও কান্নাকাটি করলে আওয়াজ হয় না৷ ট্রেনের ঝমঝম শব্দে সেটা শোনা যাওয়া তো আরওই অসম্ভব!

‘এক্সকিউজ মি, আপনি কথাটা আমাকে বললেন?’

লোকটা কোনও উত্তর দিল না৷ তেমন নির্বিকারভাবে শুয়ে থাকতে থাকতেই হাতটা আড় করে চোখের উপর তুলে দিল৷

উত্তর না পেয়ে সাম্য গলা তুলল, ‘আমি কান্নাকাটি করেছি সেটা আপনাকে কে বলল?’

‘তুমি কান্নাকাটি না করলে আমাকে ঠেঙিয়ে এতদূর আসতে হত না… হতভাগা ছেলে কোথাকার…’ তেমন করে শুয়ে থাকতে থাকতেই কাটাকাটা গলায় কথাগুলো বলল লোকটা৷

এতক্ষণ সাম্যের আগ্রহ বেড়ে উঠেছে, সে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসে বলল, ‘এই আপনি কে বলুন তো?’

‘তথাগত…’

‘মানে বিজেপি করে ওই লোকটা…’

‘উঁহু, বুদ্ধ…’

‘সে তো সিপিএম করত!’ নিচু গলায় বিড়বিড় করে সাম্য, ‘শালা এই জন্যই আমার পিসি বলে, সব সিপিএমগুলো বিজেপি হয়ে গেছে…’

‘সারাদিন রাজনীতি নিয়ে কচকচ করো বলেই তোমার প্রেমটা টেকেনি হে ছোকরা…’ লোকটা তেমনই বাঁকা গলায় বলল৷

রেগে মেগে উঠে বসতে যায় সাম্য৷ সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঠক করে ঠুকে যায় বার্থের ছাদে৷ সেখানে একটা হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আপনার মতলবটা কী বলুন তো? হ্যাঁ? কাল রাতে কোথায় লুকিয়ে শুনেছেন আমার কথা?’

‘লুকাব কেন? তুমিই আমাকে ডাকছিলে, অগত্যা আসতেই হল…’

‘আপনাকে! সেতো আমি…’ মুখ ফিরিয়ে মাথার কাছে রাখা কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তিটার দিকে তাকায় সাম্য৷ এখনও একইরকম স্থির হয়ে মাথার কাছে পড়ে আছে সেটা৷ সেদিকে তাকাতেই একটা ছবি ভেসে ওঠে সাম্যের মাথায়৷ কয়েকটা সারিবদ্ধ পাহাড়ের ছবি৷ পাশাপাশি হিমশৈল৷ এই শৈলশ্রেণির ছবির একটা পোশাকি নাম আছে৷ একটু আগে ঘুমন্ত লোকটাকে দেখে ওই ছবিটাই মাথায় এসেছিল৷ অবিকল যেন একই আউটলাইন৷ নামটা বিড়বিড় করে বেরিয়ে আসে সাম্যের মুখ দিয়ে, ‘স্লিপিং বুদ্ধা…’

সাম্যের মুখ থেকে শব্দগুলো বেরিয়ে আসতেই ওপাশে লোকটা যেন ঘুম ভেঙে উঠে বসে৷ এক ঝটকায় সোজা হয়ে কোমরে ভর দিয়ে বাবু হয়ে বসে সে, সরু হাসি খেলে যায় তার টানাটানা চোখে…

‘মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি… আপনি…’

‘তো কাল রাতে অত করে আমাকে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে ডেকে আজকে কে আসবে ভেবেছিলে?’

কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তিটার দিকে আবার একঝলক তাকায় সাম্য৷ এখনও একই ভাবে বসে আছে সেটা৷ একটা হাত উপর দিকে তোলা৷ মধ্যমাকে স্পর্শ করে রয়েছে বুড়ো আঙুল৷ অন্য হাত পেটের কাছে ভাঁজ করা৷ মুখে সেই মৃদু হাসি৷ এই মুহূর্তে ওর সামনে বসা লোকটার মুখেও সেই একই হাসি খেলা করছে৷

মাথার ভিতর একটা ঝিমধরা ব্যথা শুরু হয়েছে ওর৷ লোকটা কি পাগল? নাকি ইয়ার্কি করছে ওর সঙ্গে?

মুখ ঘুরিয়ে দেখে সাম্য, ভালো করে লক্ষ করে লোকটাকে৷ চোখদুটো অবিকল কোরিয়ানদের মতো চেরাগোছের৷ চিতল হরিণের মতো টানাটানা৷ ঝট করে দেখলে মনে হয় ঝিমোচ্ছে৷ সরু পানপাতার মতো মুখ৷ তিরিশের আশপাশে বয়স৷ উত্তরীয় ছাড়া ঊর্ধ্বাঙ্গে পোশাক নেই৷ নিচে একটা লম্বাটে গোছের ধুতি৷ গায়ের রং টকটকে ফর্সা৷ হাত পা নাড়া দেখে আদৌ হাড়গোড় আছে বলে মনে হয় না৷

সে আবার ঢোঁক গেলে, ‘আপনি ইয়ার্কি মারছেন না তার প্রমাণ দিন…’

‘মহা মুশকিল তো, তুমি প্ল্যানচেট করে ভূত নামিয়েছ নাকি যে টেবিল নাড়িয়ে প্রমাণ দিতে হবে?’

‘তো ভূতের মতো ভগবানেরও তো একটা আইডেন্টিফিকেশন থাকবে, এমনি এমনিই বিশ্বাস করব কী করে?’

লোকটা আবার সেই বাঁকা হাসিটা হাসে, ‘তোমাকে কে বলেছে আমি ভগবান ছিলাম?’

‘ছিলেন না? তাহলে প্রফেট?’

‘ধুর…’

‘তাহলে?’

লোকটা হাত উল্টায়, তারপর মাথার খোঁপা ঠিক করতে করতে বলে, ‘আমি একটা সাধারণ মানুষ যে একটু দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাম… ব্যস…’

সাম্যের গলায় এবার আকুতি ঝরে পড়ে, ‘আমিও তাই চাই, বিশ্বাস করুন৷ আপনি যেই হোন আমার কিছু যায় আসে না৷ শুধু আমাকেও ওই বিদ্যাটা শিখিয়ে দিন… আমার আর দুঃখ পেতে ভালো লাগছে না…’

‘বয়ে গেছে…’ নির্বিকার গলায় কথাটা বলে লম্বা দুটো পা ঝুলিয়ে ছোট একটা লাফ মেরে নিচে নেমে আসে তথাগত৷ আড়মোড়া ভাঙে৷ পিঠ চুলকাতে চুলকাতে লোয়ার সাইড বার্থের দিকে এগিয়ে যায়৷

‘বয়ে গেছে মানে? মানে আমাকে সাহায্য করবেন না আপনি?’

‘আঃ তা কখন বললাম? বললাম আমার সব কথার মূলমন্ত্র ওইটাই, বয়ে গেছে…’

লোয়ার বার্থের জানালাটা দিয়ে ভোরের আলো আসছে ঝলকে ঝলকে৷ বার্থটা ফাঁকা৷ তারই এক পাশে গিয়ে বসে করে কী যেন গান ধরে লোকটা৷ অচেনা লাগে সাম্যের৷ সাতসকালে ও নিজেই ভুল দেখছে না তো? লোকটাকে সাধারণ মানুষের মতো মোটেই দেখতে নয়৷ বুকের ভেতরটা টিপটিপ করতে থাকে তার৷ কী করবে বুঝতে না পেরে শেষে সেও নিচে নেমে আসে৷

ট্রেনের ঝমঝম শব্দ আসছে৷ মিডল বার্থের মাড়োয়ারি লোকটা ঘুমাচ্ছে৷ ওপাশে বাচ্চা মেয়েটা চাদর মুড়ি দিয়েছে৷ সাম্যর মনে পড়ে লম্বা লোকটা নিচে নামার সময় বেশ জোরে আওয়াজ হয়েছিল৷ তাও কারও ঘুম ভাঙেনি কেন? তবে কি সত্যি লোকটা…

নিজের হাতে একবার চিমটি কাটে সাম্য, নাঃ স্বপ্ন দেখছে না৷ সত্যি একটা বিদঘুটে কিছু ঘটছে ওর সঙ্গে৷

বার্থের উল্টোদিকে এসে বসে সাম্য৷ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তথাগত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ব্যাপার কী বলো তো? এত ভগবান, এত ধর্ম থাকতে শেষে আমাকেই ডাকতে হল?’ মিহি মখমলের মতো গলার আওয়াজ৷ এত নরম স্বর এর আগে কোথাও শোনেনি সাম্য৷

‘আপনার মূর্তিটাই তো ছিল৷ তাছাড়া কাল রাতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ৷ কষ্ট পেলে কি অত ধর্মটর্ম মনে থাকে?’

তথাগত হাঁটুর উপর সরু আঙুল দিয়ে টুকটুক করে দুটো টোকা মারে, ‘তা ঠিকই বলেছ, একসময় মানুষের জীবনে রোগ, জরা, গ্লানি ছিল৷ যুদ্ধ ছিল, ঝড়ঝঞ্ঝা ছিল, পরিশ্রম ছিল, তাই ধর্ম নিয়ে অত মাতামাতি ছিল না৷ এখন আরাম আয়েসের জীবন… যাক গে, দরজাটা খোলো তাহলে…’

‘কেন দরজা খুলব কেন?’

‘এই ট্রেনের ভেতর ভাঙতে গেলে সবার ঘুম ভেঙে যাবে…’

‘কী আশ্চর্য! আমি মূর্তিটা ভাঙব কেন?’

‘যার জন্য ওটা কিনেছিলে সে ওটা নেবে না৷ কোনওদিনই নেবে না৷ তাছাড়া ওটা না ভাঙলে আমি বিদায় নেব কী করে?’

সাম্য কাঁধ ঝাঁকায়, অবাক হয়ে বলে, ‘বিদায়! কাল আমার প্রার্থনা শুনে হাজির হলেন আর আমাকে না ঠিক করেই চলে যাবেন!’

লোকটা যেন অবাক হয় একটু, ভুরু কুঁচকে বলে, ‘বটে? তুমি দুঃখ কমাতে চাও?’ তারপর কী যেন ভেবে একটু উদাস গলায় বলল, ‘অনেক বছর হয়ে গেল লোকে আর এসব নিয়ে ভাবে না… দুঃখ কী করে কমবে? মৃত্যুর শোক কী করে ভুলব? রোগের হাত থেকে নিস্তার কী করে পাব? এসব এখন আর কোন সমস্যাই না…’

‘যাচ্চলে, তাহলে এখন লোকে কী নিয়ে ভাবে?’

‘এই যেমন ধরো কে কী পরবে, কী খাবে, কাকে ভোট দেবে, কার সঙ্গে কার বিয়ে হবে… এগুলোই আসল সমস্যা…’

সাম্যর ভিতরের দুরুদুরু ভাবটা এতক্ষণে একটু কমেছে৷ লোকটা যাই হোক, কথাবার্তার মধ্যে একটা বন্ধুত্বের ভাব রয়েছে৷ নিশ্চিন্ত হয়ে সিটের উপর দুটো পা তুলে পিঠ এলিয়ে বসে সাম্য৷ তারপর বলে,

‘ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে বুদ্ধর কথা পড়েছিলাম জানেন, তখন মনে হয়েছিল জীবনের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে বেশি ফ্যানাতে গিয়েই আপনি ছড়িয়েছেন৷ অন্য ধর্মের যা পপুলারিটি সেই তুলনায় আপনি তো নস্যি৷ শুধু ওই পাহাড় ফাহাড়ে গেলে… ভালো কথা, পাহাড়ে আপনার পপুলারিটি বেশি কেন জানেন?’

‘কেন?’

‘পাহাড়ে এমনিও ভালো খাবারদাবার পাওয়া যায় না৷ ফলে ওদের এমনিতেও ঘাসপাতা খেয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না…’

‘বটে? তোমাকে কে বলেছে আমি ভালো খাবার খেতে বারণ করেছিলাম?’

‘করেননি? তাহলে কী বলেছিলেন?’

লোকটা টানাটানা হরিণচোখদুটো জানলা দিয়ে বাইরে মেলে দেয়৷ মখমলের মতো একটা হাত আর একটা হাতের উপর রেখে ঝিমঝিমে গলায় বলে, ‘আমি বলেছিলাম যতদিন তুমি ভালোমন্দ খেয়ে জীবনের সব দুঃখ ভুলে যাচ্ছ যাও, আমার আপত্তি নেই৷ কিন্তু জীবনে যদি এমন কোনও দুঃখ আসে যেখানে তোমার সেটাও খেতে ইচ্ছা করেছে না, তখন আমার কাছে এসো… মানে তোমার এখন যা অবস্থা আর কী…’

কী যেন আছে লোকটার মুখে৷ অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনটা শান্ত হয়ে যায়৷ কোনও উত্তেজনা নেই, নির্দেশ নেই, জ্ঞানী ভাব নেই৷ উলটে বেশ বন্ধুর মতো কথা বলছে৷ আশপাশে একটাও পরিচিত লোক নেই বলেই হয়তো তথাগতকে ভারি আপন মনে হল সাম্যের৷

‘আপনি জানেন যখন আমাকে দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় বলে দিন৷’ সাম্যর গলার আওয়াজ প্রার্থনার মতো শোনাল৷

তথাগতর একটা হাত উঠে আসে সাম্যের মাথায়, চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বলল, ‘বেঁচে থাকলে দুঃখ হবেই ভাই৷ যা তুমি আজ পাচ্ছ তার থেকে ঢের বেশি হবে৷ সব অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য৷’

‘আপনি যা বলবেন আমি করব, শুধু আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচতে শিখিয়ে দিন…’

শালটা গায়ের উপর ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তথাগত, কিছুটা ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘আমি যা বলব তাই করবে?’

‘হ্যাঁ… আপনি বলে দেখুন…’

‘তোমার বাবা বলেছিল এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে৷ ওতে স্কোপ বেশি, তাও অনার্স পড়লে কেন?’

‘আরে আপনি ওসব বুঝবেন না, বাবা অন্য জেনারেশনের লোক৷ আই মিন কেরিয়ার নিয়ে ওদের আইডিয়াটা তিরিশ বছর আগে পড়ে আছে…’

‘আর আমি আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের লোক৷ আমার কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে?’

‘তাহলে কী বিশ্বাস করব?’

তথাগত ধীরে ধীরে মাথা নাড়ায়, ‘বিশ্বাস করবে না, দেখবে…’

‘কী দেখব?’

লোকটা মাঝের বার্থগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখায়, ‘ওই যে মাড়োয়ারি লোকটা৷ আগের সপ্তাহে ওর মা মারা গেছে৷ ওই যে মেয়েটা ঘুমোচ্ছে ও রোজ বাড়িতে অকারণে মার খায়, মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দেয় ওর বাবা, ওই যে মহিলা নিচের বার্থে শুয়ে আছে…’

বিরক্ত হয়ে ওঠে সাম্য, ‘আঃ, আমি জানি পৃথিবীতে এইসব আছে, দুঃখ কষ্ট আছে…’

‘উঁহু, তুমি শুধু নিজেরটা জানো৷ বাকিদের কষ্ট তোমার মনে একটা কষ্টের প্রতিবিম্ব তৈরি করে, আয়নার মতো৷ সেইটার দিকে তাকিয়ে তুমি কষ্ট পাও৷ আমরা কেউ অন্যের দুঃখ অনুভব করতে পারি না৷ তাতে ক্ষতি নেই অবশ্য, তোমাকে শুধু এমন অনেক আয়না জোগাড় করতে হবে…’

‘তাতে কী লাভ হবে?’

লোকটা ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার দূরে তাকায়, ‘আমি ঊনত্রিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলাম৷ ছ-বছর পর মুক্তি পেয়েছিলাম৷ এখনকার দিনে লোকে সেটাকে নির্ভানা বলে…’

‘মানে কার্ট কোবেন? সে তো সুইসাইড করেছিল… আপনি আমাকে সুইসাইড করতে বলছেন…’

অল্প হেসে আবার ওর মাথায় হাত রাখে লোকটা, ‘বেঁচে থাকাটা একটা সুইসাইড ভাই… ও তুমি না চাইলেও তোমাকে করতে হবে…’

হঠাৎ দু-হাতে লোকটার হাত চেপে ধরে সাম্য, ‘আপনি তো ভগবান, আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, আমার মাকে ফিরিয়ে দিন তাহলে… মায়ের জন্য খুব মন খারাপ করে আমার…’

দু-দিকে মাথা নাড়ায় লোকটা, ‘আমি কাউকে সৃষ্টি করিনি, কাউকে ফিরিয়েও দিতে পারি না৷ বললাম না আমি সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছু ছিলাম না…’

‘তাহলে আমার বাবাকে সুস্থ করে দিন…’ ব্যাকুল গলায় বলে সাম্য৷

‘তা তো আমি পারব না, আমি ডাক্তার নই…’

‘তাহলে একটা চাকরি পাইয়ে দিন আমাকে৷ বিশ্বাস করুন আমার বাবার ভালো করে চিকিৎসা না হলে…’ এবার কাতর আর্তির মতো শোনায় সাম্যর গলাটা৷

‘এসব কিছুই পারব না আমি, বললাম যে তুমি ভুল লোককে ডেকে এনেছ…’

‘তাহলে কী পারবেন আপনি?’ জানলার উপরে একটা চাপড় মেরে উঠে পড়ে সাম্য, ওর মাথার ভিতরে জমাট দুঃখগুলো গনগনে রাগে পরিণত হয়েছে, হেঁটে বগির শেষপ্রান্তে দরজার কাছে এগিয়ে আসে ও, ‘দেখুন আপনি কে তাতে আমার কিছু যায়-আসে না৷ কিন্তু আপনার যদি কোনও অলৌকিক ক্ষমতা থাকে তাহলে এটুকু সাহায্য করতেই পারেন আমাকে… নাহলে…’

‘তাহলে তুমি ভুল লোককে ডেকে এনেছ৷ আমি এসব কিছুই পারি না৷’

সাম্যের মনের ভিতরে একটা উত্তেজনার পারদ বেড়ে উঠেছিল৷ দুঃখের থেকে ছুটি পাওয়ার নেশা বেপরোয়া ভাব এনে দেয় ওর শরীরে৷ উত্তেজনায় কী বলছে খেয়াল থাকে না৷ অলৌকিক সবার জীবনে ঘটে না৷ ওর জীবনে ঘটছে যখন, নাহয় চোখের ভুলই হল, সেই শান্তিটুকু ও পাবে না কেন?

‘বেশ, পারবেন না যখন…’ কথা শেষ করার আগেই ছুটে গিয়ে ট্রেনের দরজা খুলে ফেলে সাম্য৷ তারপর পা বাড়ায় বাইরের দিকে, ‘তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব৷ আমার আর কিছু যায়-আসে না…’

তথাগতও উঠে এসেছে ওর পেছন পেছনে৷ তার শান্ত গলা শুনতে পায় পেছন থেকে, ‘লাভ হবে না তাতে, তুমি আবার জন্মাবে৷ হয়তো বারোশো শতাব্দীর কোনও নাস্তিক মহিলার ছেলে হয়ে৷ তোমার মাকে ডাইনি সন্দেহে তোমার সামনেই পুড়িয়ে মারা হবে, কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তোমার বাবাকে ঢোকানো হবে গ্যাস চেম্বারে৷ অভাব থাকবে, বিচ্ছেদ থাকবে, রোগ থাকবে, মৃত্যু থাকবে, মুক্তি নেই…’

সাম্যের কানের ভিতরে যেন কেউ সীসা ঢেলে দেয়, সে চিৎকার করে ওঠে, ‘চুপ করুন, চুপ করুন, আপনার মতো পাগলের একটা কথাও বিশ্বাস করি না আমি… পারবেন আমার মাকে ফিরিয়ে দিতে? আমার বাবাকে আমার আশ্রয়টুকুকে আবার আগের মতো করে দিতে? না পারলে দূর হয়ে যান আমার সামনে থেকে…’

আবার লোকটার মুখে পুরনো নরম হাসিটা ফিরে আসে, ‘আমি তোমায় সারিয়ে দিতে পারি কেবল… মুক্তি দিতে পারি…’

‘চাই না…’ গর্জে ওঠে সাম্য, ‘দূর হয়ে যান এখান থেকে…’

পেছন থেকে আর কোনও আওয়াজ আসে না৷ বাইরের শনশনে হাওয়া সাম্যের মুখে এসে লাগে৷ ট্রেনের ভিতরের জমাট হাওয়াটাকে মুহূর্তে হালকা করে দেয় সেটা৷

ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টায় কয়েক সেকেন্ড পর হুট করেই মনটা শান্ত হয়ে যায় ওর৷ একটু বেশিই জোরে চিৎকার করে ফেলেছে৷

মুহূর্তে পেছন ঘোরে সাম্য, ‘না দাঁড়ান, আমাকে সারিয়ে দিতে পারবেন আপনি?’ কথাটা বলতে বলতেই ও ঢুকে আসে কামরার ভিতরে৷ মারোয়াড়ি লোকটা, বাচ্চা মেয়ে আর তার বাবা-মা ওর চিৎকারেই মনে হয় জেগে উঠেছে এতক্ষণে৷ তাছাড়া এ কম্পার্টমেন্টে আর কেউ নেই…

ও ছুটে গিয়ে নিজের বার্থে উঠে পড়ে৷ পাশের বার্থটা ফাঁকা৷ কেবল ওর সামনে রাখা আছে কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তিটা৷ তার একটা হাত এখনও আগের মতোই সোজা হয়ে আছে৷ মুখে লেগে আছে সেই অদৃশ্য হাসিটা৷

(৩)

সাম্যদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই একটা খাল পড়ে৷ একসময় সে খাল পেরোতে গেলে ছোট ডিঙি নৌকায় চড়তে হত৷ কয়েক বছর আগে খালের উপর ব্রিজ হয়ে গিয়ে নৌকার আর দরকার পড়ে না৷

মাঝিবিহীন নৌকাটা বহুদিন অদরকারে জলের ধারে ঠায় পড়েছিল৷ ঝড়-বৃষ্টি-রোদে ধীরে ধীরে তার কাঠ খইতে শুরু করে৷ ছইটা ভেঙে গেছে৷ ভিতরের বেশিরভাগটাই শ্যাওলায় ভরা, কেবল একদিকের একটা কোণ আইসক্রিমের মতো জেগে আছে মাটির উপরে৷ কে যেন সেই ভাঙা নৌকার গায়ে রোজ বিকেলে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে যায়৷

সেই নৌকার উপরেই বিকেলে এসে বসে সাম্য আর বকুল৷ জায়গাটা ওদের ভীষণ প্রিয়৷ ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় এ নৌকাটায় করে কতবার খাল পেরিয়েছে৷ আজ নৌকার মৃতদেহই হোক, তার উপরে এসে বসলে আবার আগের দিনগুলো মনে পড়ে যায়৷ মরা নৌকাটা যেন আবার ছোটবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় ওদের৷

পাহাড় থেকে ফিরে দু-দিন কেটে গেছে৷ এই দু-দিনে মূর্তিটা বেশ কয়েকবার উল্টে পাল্টে নানান সাধ্যসাধনা করে দেখেছে সাম্য৷ লাভ হয়নি৷ তথাগতর দেখা আর পায়নি ও৷ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে শেষ অবধি৷

আজও বিকেলের দিকে ভাঙা নৌকার উপর এসে বসেছিল দু-জনে৷ পিঠের ব্যাগটা এককোনায় ঝুলিয়ে রেখেছে বকুল৷ অন্যদিনের থেকে একটু বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে সাম্যকে৷ সেদিকে চেয়েই ও প্রশ্ন করে, ‘তুই হঠাৎ বুদ্ধদেবকে নিয়ে পড়লি কেন বলতো? মানে ধর্ম-কর্মে তো তোর কোনওদিনই তেমন মতি ছিল না…৷’

‘তাতে নতুন কী আছে? নিব্বা নিব্বি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝামেলা হলেই কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদার উপর বুদ্ধদেবের কোট শেয়ার করছে দেখিসনি?’ সাম্য একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে৷

‘সেসব আদৌ বুদ্ধ বলেইনি৷ সেদিন দেখলাম উনি ঢুলুঢুলু চোখে হাতে বরাভয় মুদ্রো ফুটিয়ে বলেছেন—তোমার বয়ফ্রেন্ড যদি তোমার সঙ্গে ফেসবুক ডিপি না দেয়, জানবে সে বারোভাতারি…’

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ভারীক্কি গলায় বলে সাম্য, ‘হুঁ, লোকটাকে দেখেই মনে হয় জীবনে অনেক ব্রেকআপ টেকআপ হয়েছে৷ কেমন কাঁচুমাচু টাইপ! মানে ধর থর কিংবা আনুবিশকে দেখে আদৌ মনে হয় ওরা তোকে রিলেশনশিপ অ্যাডভাইস দিতে পারবে? উল্টে ধুম করে একটা হাতুড়ি মেরে দিলে…’

বকুলকে চিন্তিত দেখায়, গালে হাত রেখে বলে, ‘কিন্তু বুদ্ধদেব ব্রেকআপ নিয়ে তেমন কিছু বলেননি যতদূর জানি…’

‘তাহলে কী বলেছে?’

‘ওনার মূল বক্তব্যটা ছিল—আকাঙ্ক্ষাই অনর্থের মূল৷ মানে লোকের ডিভোর্স হয় তার কারণ একদিন তার বিয়ে হয়েছিল৷ বিয়ে যদি না করিস তাহলে ডিভোর্সের প্রশ্ন আসছে না৷’

‘আজব তো! আমি কি সলমন খান নাকি?’

বকুল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে৷ তারপর বলে, ‘ব্রেকআপ হলে এক-একটা মানুষ এক-একরকম হয়ে যায়৷ কেউ জিমে গিয়ে ডোলেশোলে বানায়, কেউ প্রচুর পড়াশোনা করে…’

‘আমি তার কিছুই করছি না…’

‘কোথায় করছিস না? এই যে আমার সঙ্গে কথা বলছিস…’

কাঁধ ঝাঁকায় সাম্য, ‘সেটাই ভয় লাগে৷ মা বলত খারাপ সময়ে কেউ পাশে থাকলে তার উপর নির্ভরতা তৈরি হয়৷’

বকুল হেসে কপালের উপর এসে পড়া চুল কানের পাশে সরায়, জ্বলন্ত হ্যারিকেনের আলো ওর মুখে এসে পড়ে, ‘আমি পাঁচবছর বয়স থেকে তোর পাশে আছি৷ এতদিনে আর নির্ভরতা তৈরি হতে বাকি নেই…’

‘এতদিন তো খারাপ সময় চলছিল না…’

বকুলের মুখে আলো পড়ে, ‘তার মানে তুই-ই ভেবে দেখ, খারাপ সময়ের একটা শুরু আর একটা শেষ আছে৷ এটাও এসেছে, শেষ হয়ে যাবে…’

‘কিন্তু আমার মা তো ফিরে আসবে না…’ কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায় সাম্য৷ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘আমি সব কিছুর একটা স্থায়ী সমাধান চাই৷ আর চারপাশে তাকালে কোনও সমাধান দেখতে পাচ্ছি না…’

‘একটা মানুষ তো দেখতে পাচ্ছিস৷’ উঠে এসে ওর পিঠে একটা হাত রাখে বকুল, ‘একটা মানুষ কখনও সমাধান হতে পারে না, তাই না?’

ওর দিকে ফিরে তাকায় সাম্য৷ মেয়েটার চোখ ছলছল করছে কি? ওর নিজের মনটাও নরম হয়ে আসে৷ ছোট থেকে ওর জীবনে এমন কোনও খারাপ সময় আসেনি যখন বকুল ওর পাশে ছিল না৷ এমনকী সম্পর্কে গিয়ে টানা দু-বছর ওর ফোন অবধি রিসিভ করেনি৷ তাও একবারের জন্যও জবাবদিহি করতে হয়নি ওর কাছে৷ যখন সাম্য বলতে চেয়েছে ও মন দিয়ে সমস্তটা শুনেছে৷ তার বদলে সাম্য নিজে প্রায় কিছুই দিয়ে উঠতে পারেনি ওকে৷

মুখ ঘুরিয়ে চোখের জলটা মুছে আবার নৌকার উপর গিয়ে বসে বকুল, প্রসঙ্গটা জোর করেই ঘোরানোর চেষ্টা করে, ‘বেশ, তুই যখন বুধিজম নিয়ে জানতে চাইছিস আমি তখন বাড়ি গিয়ে একটু পড়াশোনা করব না হয়৷ তবে তাতে যে সমাধানের কথা বলা আছে তা এখনকার দিনে মনে হয় না আর সম্ভব…’

‘কেন?’

বকুল একটু দম নিয়ে বলে, ‘যতদূর মনে পড়ছে তাই বলছি, ভুলও হতে পারে৷ বুদ্ধদেব জন্মেছিলেন শাক্য বংশে৷ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ৷ জন্মের পরপরই মা মারা যায়৷ এক জ্যোতিষী সিদ্ধার্থকে দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেন এ ছেলে হয় জগৎজয়ী রাজা হবে৷ নাহয় সন্ন্যাসী হবে৷ তবে রাজা কবেই আর চেয়েছে যে ছেলে সন্ন্যাসী হোক৷ ফলে তিনি সিদ্ধার্থকে দুঃখকষ্টের কাছেই যেতে দিলেন না৷ সোনায় মুড়িয়ে বড় করতে লাগলেন তাকে৷ হাজার চাকর সর্বক্ষণ তার দেখাশোনা করে, যখন ছেলে যা চায় তাই এনে দেয়, মুখ ফুটে কেবল বলার অপেক্ষা৷ তো এমন করেই তেরো বছরের জন্মদিনে সিদ্ধার্থ বায়না ধরল সে বাইরের জগৎ দেখতে যাবে৷ চাকররা তাই নিয়ে গেল তাকে৷ রথে করে যেতে যেতে সিদ্ধার্থ রাস্তায় একজন বৃদ্ধ, একজন অসুস্থ লোক আর একজনের একটা মৃতদেহ দেখতে পেল…’

‘আক্কেল বলিহারি, সব ছেড়ে সরকারি হাসপাতালের সামনে দিয়েই নিয়ে যেতে হল?’

রসিকতায় পাত্তা দিল না বকুল, ‘তো এইসব দেখে সিদ্ধার্থর মাথা গেল ঘুরে৷ সে দেখল এতদিন যে ইউটোপিয়া সে দেখে এসেছে সেটা তো সত্যি না৷ সত্যিকারের দুনিয়ার রোগ আছে, বিচ্ছেদ আছে, মৃত্যু আছে৷ সে ভাবল, যাঃ, এসব তো আমাকেও ভোগ করতে হবে একদিন৷ আমার শরীর খারাপ হবে, প্রিয়জনের মৃত্যু দেখতে হবে, চুল পেকে যাবে, ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে হবে…’

‘এখনকার দিন হলে বাড়িতে এলআইসির লোক চলে আসত…’

‘ব্যস এই চিন্তায় সে পাগল হয়ে গেল৷ নানা সাধুসন্তের কাছে গিয়েও কোনও উপায় হল না৷ শেষে আর কোনও উপায়ন্তর না দেখে তিরিশ বছর বয়সে বোধিবৃক্ষের নিচে সাধনা করতে বসল… ছ-বছর একটানা সাধনার পর মুক্তি পেয়ে সিদ্ধার্থ হল বুদ্ধ…’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাম্য, ‘আমার সেই স্কুল লাইফের ক্রাশ ইতিকে মনে আছে তোর? শালা ছ-বছর তার পেছনে সাধনা করে গেলাম৷ পাত্তা দিল না, আর ইনি ছ-বছরে মুক্তি পেয়ে গেলেন…’

‘তুইও পাবি, চেষ্টা করে দেখ…’

‘ধ্যান করব?’

‘হ্যাঁ, শুধু একটা পিপুল গাছ খুঁজে নে৷ তারপর পদ্মাসনে বসে পড়৷’

ফিরেই আসতে যাচ্ছিল সাম্য৷ হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, ‘এই তুই কী গাছ বললি যেন, কোন গাছের নিচে সাধনা করেছিল…’

‘বোধিবৃক্ষ৷ আই মিন পিপুল গাছ… আরে তোদের বাড়ির পাশেই তো…’

‘রাতে ফোন করছি তোকে…’ কথাটা বলতে বলতেই ছুট লাগাল সাম্য৷ ওদের বাড়ির ঠিক লাগোয়া বিশাল পিপুল গাছটার কথা এই ক-দিন ওর মাথাতেই আসেনি৷

(৪)

গেট খুলে যখন পিপুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল সাম্য তখন রাত গভীর হয়েছে৷ মৃদু একটা হাওয়া খেলা করছে বাগানে৷ গেটের কাছে একটা কুকুর গুটিসুটি হয়ে শুয়েছিল৷ তাকে পাশ কাটিয়েই গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল সাম্য৷ ওর হাত থেকে ঝুলছে কালো পাথরের মূর্তিটা৷

নিচু গলাতেই ডাক দিল, ‘তথাদা, ও তথাদা…’

উপরের গাছগুলোর মধ্যে কী যেন একটা নড়ে উঠল, ‘ব্যাপার কী? রাত-বিরেতে আমাকে ডাকাডাকি কেন?’

উপরে তাকিয়ে সাম্য দেখল ঝাঁকড়া পিপুল গাছের উঁচু একটা ডালে পা তুলে বেশ আয়েস করে বসে আছে তথাগত৷ হুট করে দেখে একটু ভয়ই লাগল তার, ঢোঁক গিলে বলল, ‘ইয়ে… আপনি এইভাবে বসে?’

‘তো আমি সারাক্ষণ হাত তুলে পদ্মাসনে বসে গেঁটে বাত হয়ে মরব নাকি?’

‘আপনি আড়াই হাজার বছর আগেই মরে গেছেন৷ আর নতুন করে কী মরবেন?’ কথাটা বলতে বলতেই গাছ বেয়ে উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে সাম্য, ‘ভালো কথা, আপনার যত ছবি আর মূর্তি দেখেছি সব ওই তিরিশের আশপাশে৷ অথচ আপনি বেঁচেছিলেন আশি অবধি৷ মাঝে এমন সুচিত্রা সেন হয়েছিলেন কেন বলুন তো?’

ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওকে গাছের উপর টেনে নেয় তথাগত, ‘কারণ মানুষ সিদ্ধার্থকে আর কেউ মনে রাখেনি৷ যারা তোমাকে চেনে তারা আসলে কেবল তোমার কাজটাকেই চেনে৷ তাদেরকে তুমি যেভাবে স্পর্শ করেছ শুধু সেইটুকু চেনে…’

লোকটার উল্টোদিকের ডালে বসে কাঁধ ঝাকায় সাম্য, ‘হ্যাঁ, বকুল বলছিল আপনার কথা৷ স্যাড লাইফ…’

তথাগত ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবার, ‘আচ্ছা এই বকুল বলে মেয়েটা৷ এ তো তোমাকে ভালোবাসে, তাই না?’

‘তা বাসে… নইলে এতদিন…’

‘বাঃ, তাহলে তুমিও তাকে ভালোবাস, তাই না?’

সাম্য রেগে ওঠে, ‘আরে মুশকিল তো৷ বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি শুনেছিলাম৷ লুচ্চামি শুনিনি৷ এতদিন তো আমি অন্য কাউকে ভালোবাসতাম… ওর ফোনটা অবধি ধরিনি…’

তথাগত জিভ কাটে, ‘আসলে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়, ঊনত্রিশে ঘর ছাড়ি৷ প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা…’

‘আপনাদের কালে লোকে ঘর ছাড়লে সন্ন্যাসী হত, এখন প্রধানমন্ত্রী হয়… ভালো কথা, আপনি গাছ থেকে খুব একটা নেমে এদিক-ওদিক যাবেন না কিন্তু…’

‘কেন?’

‘আরে জাতে নেপালি৷ নেহাত ভগবান-টগবান হয়ে গেছেন বলে রক্ষে নাহলে এরকম হলদে রং আর টানাটানা চোখ দেখলে ছেলেপুলে মেড ইন চায়না বলে প্যাঁক দেবে…’

তথাগত হাত তুলে আশ্বস্ত করে ওকে, ‘আমাকে তুমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না…’

‘সেকি! মানে এখন এই গাছের ডালে বসে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলছি… এমনিতেই লোকে বলে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে… দেখুন, আপনি জলদি আমার একটা ব্যবস্থা করে বিদায় নিন…’

‘ব্যবস্থা?’

‘বলেছিলেন যে আমাকে সারিয়ে দেবেন? মুক্তি দেবেন… তার জন্য যা বলবেন করব, তবে হ্যাঁ, ওসব ধ্যান-ট্যান আমাকে দিয়ে হবে না…’

‘কেন?’

কাঁচুমাচু মুখে মাটির দিকে তাকায় সাম্য, ‘আর বলবেন না, সেই পিটি ক্লাসে জয়দেব স্যার মেডিটেশন করাত৷ আর ওরকম চোখ বন্ধ করে সোজা বসতে গেলেই আমার পিঠ চুলকাত, নাক সুড়সুড় করত, হাসির কথা মনে পড়ত…’

‘তোমাকে কে বলেছে তুমি এখন ধ্যান করছ না?’

‘সেকি! এখন!’

তথাগত ঘাড় নাড়ায়, ‘নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলাকেই ধ্যান বলে৷ তবে হ্যাঁ, সেই কথার মাঝে অন্য কাউকে আসতে দেওয়া যাবে না৷ একদম মন দিয়ে কথা বলতে হবে…’

‘কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম ধ্যান করলে লোকে ভগবানের সঙ্গে কথা বলে…’

তথাগত একটা আঙুল ওর বুকের উপরে স্পর্শ করে, তারপর বলে, ‘যা থাকার সব এখানে আছে, ভগবান, শয়তান, ভালোবাসা, ঘৃণা… এর বাইরে আর কোথাও কিচ্ছু নেই…’

‘মানে আপনি ছ-বছর ধরে গাছতলায় বসে নিজের সঙ্গে কথা বলেছিলেন?’

মূর্তির হাসিটা আবার খেলে যায় তথাগতর মুখে, চাঁদের আলোয় ওর মুখটা আরও চকচকে, মসৃণ দেখায়, ‘আবিষ্কার করেছিলাম৷ অনেক ঝগড়া, অনেক তর্ক, অনেক অপেক্ষার পর নিজের ভিতরে আবিষ্কার করেছিলাম… বুদ্ধকে…’

‘মানে আপনি বুদ্ধ নন?’

তেমন চকচকে মুখেই অদ্ভুত হাসি হাসে তথাগত, চাঁদের ফিকে আলো চারপাশ থেকে মুছে গিয়ে যেন তার মুখটাকেই আলো করে রেখেছে, ‘বুদ্ধ কোনও মানুষ না৷ মানুষের একটা অবস্থা৷ তোমার ভিতরেও বুদ্ধ আছে, যাকে শোক স্পর্শ করে না৷ নিজের ভিতরে তাকে খুঁজে নিতে হবে তোমাকে…’

‘কী করে?’

‘এই পিপুল গাছের তলায় বসে, এইভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলে৷ চাইলে নাক চুলকাতে পারো, পিঠ চুলকাতে পারো, এমনকী গানও গাইতে পারো৷ কেবল আর কাউকে আসতে দেওয়া যাবে না…’

কী যেন ভেবে মাথা নামিয়ে নেয় সাম্য, ‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে৷’

‘কী?’

‘চোখ বন্ধ করলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে…’

কয়েক সেকেন্ড আর কেউ কোনও কথা বলে না৷ তথাগত স্থির চোখে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ গাছের পাতায় সরসর করে আওয়াজ হয়, দূর থেকে অপরিচিত সুর ভেসে আসে যেন৷ হঠাৎ করেই তথাগত একটা টান দিল ওর হাত ধরে, ‘এসো, বাগানটা দেখতে দেখতে একটা গল্প বলি তোমাকে…’

‘গল্প?’

‘হ্যাঁ, গল্পের শেষে একটা প্রশ্ন থাকবে৷ উত্তর দিতে পারলেই আজকের মতো কাজ শেষ…’

ওকে প্রায় কোলে নিয়েই গাছ থেকে নেমে এল তথাগত৷ চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল ওরা৷ সাম্য দেখল লোকটার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে ঘাসের উপর৷ রোগাটে চেহারা, মাথায় মুকুট৷ পাশে ওর ছায়াটা ছোট…

সাম্যর কাঁধে হাত রেখে গল্প বলতে শুরু করল তথাগত, ‘একটা খুব অসুস্থ লোক ছিল জানো, ধরে নাও তার নাম মতি৷ তো সে কারও মুখে শুনল যে জঙ্গলে এক ওঝা আছে৷ সেই নাকি একমাত্র তার রোগ সারাতে পারবে৷ মতি ঠিক করল যেভাবেই হোক সে জঙ্গলে যেতেই হবে৷ কিন্তু সেখানেও হল সমস্যা৷ জঙ্গলে বাস করে এক হিংস্র বাঘ৷ সে একবার কাউকে দেখে ফেললেই আর রক্ষে নেই৷

তো মতি সেই ওঝাকে উপহার দেওয়ার জন্য কিছু মাংস ব্যাগে পুরে চলল সেই জঙ্গলের পথ দিয়ে৷ যেতে যেতে পেয়েও গেল ওঝাকে৷ সবে ওঝা রোগ সারানোর তোড়জোড় করেছে এমন সময় ঠিক পেছনেই শুনতে পেল এক গড়গড় চিৎকার… মতি পেছন ফিরে দেখল লাল ভাঁটার মতো চোখে ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই হিংস্র বাঘটা… এখন বলো তো মতি বাঁচবে কী করে?’

ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড ভাবল সাম্য, তারপর বলল, ‘উঁহু, বুঝতে পারছি না, কী করে?’

তথাগতর গলার স্বর এবার মিহি সুরের মতো শোনায়, আঙুল তুলে সামনে দেখিয়ে সে বলল, ‘ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করো তো, জানেন কি না উত্তরটা…’

সামনে মুখ তুলে তাকিয়ে থমকে গেল সাম্য৷ এতক্ষণ মাটির দিকে মুখ রাখায় সামনেটা দেখতে পায়নি৷ তার মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘মা…’

পাশের মানুষটাকে ভুলে গেল সাম্য, এক ছুটে এগিয়ে গেল সেদিকে, ‘মা… তুমি অসময়ে চলে গেলে কেন? আমার তো দরকার ছিল তোমাকে, বলো…’

হাসিভরা মুখ তুলে মা তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ সাম্যের চোখ ভরে যায় জলে, ‘আমার কত কষ্ট হয় তোমাকে ছেড়ে থাকতে জানো? তুমি…’

একটা অল্পবয়সি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশেই, তার দিকে ফেরে সাম্য, ‘তুমি… তুমি কেন চলে গেলে বলো তো, তুমি তো জানতে আমার থেকে বেশি কেউ বোঝেনি তোমাকে…’

ওরা কেউ কোনও কথা বলে না, নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে৷ দূরে একটা লোক ঘাসের উপর শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ—বাবা৷ সাম্য চিৎকার করে ওঠে, ‘বন্ধ করুন, বন্ধ করুন এসব… আমি…’

যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে মানুষটা৷ সামনের দুটো মানুষ নিশ্চল৷ অসহ্য যন্ত্রণায় সাম্যের বুকের ভিতরটা ডুকরে ওঠে৷ দু-হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, ‘ব্যাগ… ওই ব্যাগটা…’

মুহূর্তে আশপাশের মানুষগুলো মুছে যায়৷ ওর সামনে এসে দাঁড়ায় তথাগত, ‘ব্যাগটা… কী?’

‘বাঘটা মতিকে খেতে আসেনি৷ এসেছিল ওই ব্যাগের ভিতরে মাংসটার লোভে৷ ওঝা ব্যাগটা বাঘের দিকে ছুঁড়ে দিতে মতি বেঁচে যায়…’

ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে লোকটা, দু-কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, মৃত্যু আমাদের নিতে আসে না৷ আসে আমাদের হাতের জমাট বাঁধা স্মৃতির লোভে, আকাঙ্ক্ষার লোভে… যেদিন তুমি সেগুলো ওর দিকে ছুঁড়ে দেবে সেদিন আর তাকে ভয় পেতে হবে না৷’

‘কিন্তু কী করে হবে সেটা?’

হঠাৎ মানুষটার টানা টানা চোখের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে, মুখটা নিচের দিকে নামিয়ে সে বলে, ‘মেয়েটা ভালোবাসে তোমাকে৷ ওর কাছে আশ্রয় পাবে তুমি, নির্ভরতা পাবে৷ আশ্রয় আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে হোক বা এখন, সহজে পাওয়ার জিনিস ছিল না কোনওদিন…’

‘কী করব আমি?’

দূরে কুয়াশা জমাট বাঁধছে৷ সেদিকে হাঁটতে থাকে তথাগত৷ ঘন কুয়াশার চাদরে কেবল তার শরীরের বিমূর্ত আউটলাইন ফুটে ওঠে৷

‘অনেক বছর আগে বলে গেছি আমি৷ খুঁজে বার করো… নাহলে…’

তথাগতর বাকি কথাটা প্রতিধ্বনিত হয় ফাঁকা মাঠে, ‘নাহলে নিজের মধ্যে খোঁজো বুদ্ধকে…’

সাম্য লক্ষ করে কুয়াশার চাদর এখন আবার আগের মতো নিটোল হয়ে গেছে৷ ওর হাতে ধরা মূর্তিটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে…

(৫)

‘পৃথিবীতে আজ অবধি যত অবতার এসেছে গৌতম বুদ্ধ তাদের মধ্যে অন্যতম!’

‘সে কী? বডি তো নীল নয়…’

‘আঃ, জেমস ক্যামেরনের না, বিষ্ণুর অবতারের কথা বলছি… জন্ম পাঁচশো তেষট্টিতে…’

‘তাহলে যে শুনলাম আড়াই হাজার বছর আগে৷ পাঁচশো তেষট্টি মানে তো দেড় হাজার…’

‘ধুর বিসি…’

‘একী! তুই খিস্তি করছিস কেন?’

‘খিস্তি কই করলাম৷ বললাম আমি খ্রিস্টাব্দের কথা বলছি না৷ যিশুর জন্মের পাঁচশো বছর আগের কথা বলছি৷ বাবা শুদ্ধধন, মা মায়াদেবী, বুদ্ধের জন্ম বোঝানো হয় পদ্মফুল দিয়ে, যে কারণে বহু মূর্তি বা ছবিতে বুদ্ধের হাতে পদ্মফুল দেখা যায়…;

‘এখনকার দিনে লোকে হাতে পদ্মফুল দেখলে বিজেপি ভাবত…’

আজ একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল সাম্যের৷ দিতে যেতে পারেনি৷ বাবাকে নিয়ে হসপিটালে গেছিল একটা টেস্ট করাতে৷ বিদঘুটে টেস্ট৷ বলেছে তিনদিন পরে রিপোর্ট দেবে৷

সেসব শেষ হতে হতেই বিকেল হয়ে গেল৷ তারপর বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আর সময় হয়ে ওঠেনি৷ এই মাঝের ক-দিন বকুলের সঙ্গে কথা হয়নি তেমন৷ তবে জানত ও নাকি বুদ্ধিস্ট থিয়োরি নিয়ে ক-দিন খুব পড়াশোনা করছে৷ তবে অনেক খুঁজেখাঁজেও আশার কথা কিছু শোনাতে পারেনি৷ আজ সন্ধেবেলা ওর বাড়ি এসে হাজির৷

বাবা একটু দূরেই বিছানার উপরে ঘুমাচ্ছে৷ শরীরটা আগের থেকে বেশ কিছুটা ঝরে গেছে৷ মুখ-চোখেও দীর্ঘ রোগভোগের ছাপ৷ স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে শারীরিক দিক থেকেও যেন অর্ধেক হয়ে গেছে মানুষটা৷

বারান্দার চৌকাঠের উপর বসেছে ওরা৷ এ সময়ে বাইরের দিক থেকে একটা নরম হাওয়া জানলা বয়ে আসে৷ সেই সঙ্গে বাইরের বাগানের মৃদু আওয়াজ৷ কোলের উপর একটা মোটা গোছের বই রেখে সেটা দেখেই এটা সেটা মাঝে মাঝে বলছে বকুল৷ সাম্য আবার তাতে মন দেয়৷

‘মোটামুটি নথিপত্র বলছে সিদ্ধার্থ চেহারায় ছিল লম্বাটে, রাজার ছেলে বলে চেহারায় একটা আভিজাত্য, চোখে বুদ্ধির ছাপ…’

‘ব্যস ব্যস, এখনকার বাংলা সিনেমার ডিরেক্টররা দেখতে পেলে ফেলুদা বানিয়ে ছাড়ত…’

‘দেখ তুই যদি ইয়ার্কি মারতে থাকিস তাহলে আমি আর কিছু বলব না৷’

‘কিন্তু কেমন দেখতে ছিল সেটা জেনে কী করব আমি, মুক্তির উপায় নিয়ে কিছু বলেছে কি না দেখ…’

‘কিছু ছোট ছোট টোটকা আছে বটে, এই যেমন ধর মাথা ন্যাড়া করে ফেলতে হবে, কাম পরিত্যাগ করতে হবে…’

‘হেঃ…’ কাঁধ ঝাকিয়ে হাসে সাম্য, ‘ন্যাড়া মাথা নিয়ে লোকে কামের গুষ্টি চটকে দিচ্ছে… আর?’

‘মাঝে মাঝে উপোস করতে হবে…’

‘বুদ্ধদেব উপোস করতে বলছিল! তবে যে আমার পিসি একবার একুশ দিন উপোস করে বুদ্ধদেবকে গালাগাল করেছিল?’

ধপ করে বইটা বন্ধ করে দেয় বকুল, ‘তোর আদৌ কিছু জানার ইচ্ছা নেই৷ ফালতু ইয়ার্কি মারবি তো আমি বাড়ি যাই…’

ওকে একরকম জোর করেই বসিয়ে দেয় সাম্য, ‘আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা একটা কথা বল…’

‘কী কথা?’

‘ধর তুই এই ভগবান বুদ্ধকে সামনে থেকে দেখতে পেয়েছিস, তাহলে সবার আগে কী জিজ্ঞেস করবি?’

একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবে বকুল, তারপর বলে, ‘সবাই যা জিজ্ঞেস করে আমি তা জিজ্ঞেস করব না৷ আমি জানতে চাইব যশোধরাকে, নিজের ছেলেকে চিরকালের মতো ছেড়ে যেতে কেমন করে পেরেছিল? আমি হলে পারতাম না৷’

‘তুই আমাকেই ছাড়তে পারিস না তো ছেলে বউ…’

একটু যেন রেগে ওঠে বকুল, ঝাঁজালো গলায় বলে, ‘দিয়েছিলাম তো ছেড়ে, নিজের ইচ্ছায় প্রেম করে কেমন ছড়ালি দেখতে পেলাম তো… হয়েছে তো শিক্ষা? এবার আর এক পা এগিয়ে দেখ…’

‘কী করবি?’

‘ঠ্যং ভেঙে রেখে দেব শয়তান৷’

সাম্য হেসে মাথা নাড়ায়, ‘ওসব নিয়ে ভাবি না আর৷ একটা চাকরি জোগাড় করে বাবার চিকিৎসাটা ঠিকঠাক করতে পারলেই…’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই থেমে যায় সাম্য৷ একটা যন্ত্রণামাখা শব্দ বেরিয়ে এসেছে খাটের উপর শুয়ে থাকা মানুষটার মুখ থেকে৷ ওরা দু-জনেই উঠে ছুটে যায় সেদিকে৷

কাশতে কাশতে বিছানার উপরে উঠে বসেছে বাবা৷ সাম্য চেয়ে দেখে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত বুকের উপরে জমা হয়ে আছে৷

‘একটা কাপড় নিয়ে আয়…’ নির্দেশটা দিয়ে বাবার মাথাটা বুকের উপরে তুলে নেয় সাম্য, ‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বাবা?’

কোনওরকমে কাশির দমক সামলে হাতের উল্টোদিক দিয়ে মুখ মোছেন ভদ্রলোক৷ তারপর ধরা গলায় কষ্ট করে উচ্চারণ করেন, ‘তোকে একটা কথা বলি সোমু?’

‘হ্যাঁ, বলো না…’

‘তোর মা ছোট থেকে তোকে একটু বেশি আদর-যত্নে মানুষ করেছে৷ দুনিয়াদারি তেমন একটা শেখায়নি৷ আমি বলতাম অত আতুপুতু করে রেখো না… তাও… তুই পারবি তো?’

সাম্য হাসে, ‘এখন পারছি যখন পরেও চালিয়ে নেব৷ তুমি আছ তো, সুস্থ হয়ে গেলে বাপ-ব্যাটা দু-জনে মিলে…’

ওর কথার মাঝে খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন বাবা, ‘আমি আর ভালো হব না রে ব্যাটা… আমার শরীর বলে আমার সময় হয়ে গেছে…’

কাপড় আর ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে বকুল৷ সাম্যের শরীর জুড়ে একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে, ‘ধুর, তুমি কী সব বলো৷ রিপোর্ট আসুক তারপর দেখাচ্ছি মজা…’

‘বয়স হয়েছে, তোর মা চলে গেছে, আমার আর মরে যেতে ভয় করে না… শুধু খুব চিন্তা হয় তোকে নিয়ে…’ শীর্ণ হাতে ওর হাতটা চেপে ধরেন বাবা, ‘তুই পারবি তো সোমু?’

‘এই ওষুধটা খেয়ে নাও তো, ব্যথা কমে যাবে…’

মিনিটদশেকের মধ্যে ভদ্রলোকের শরীরটা ঝিমিয়ে আসে৷ মাথাটা আবার বিছানার উপরে রেখে পিছিয়ে এসে চৌকাঠে বসে পড়ে সাম্য৷ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে বাবার দিকে৷ ওর পিঠে হাত রাখে বকুল, ‘মন খারাপ করল তোর, না রে?’

‘বাবা অকারণে বলল কথাটা…’

বকুল জোর করেই হাসে, ‘অকারণে বলবে কেন? তোকে নিয়ে আমারও টেনশন হয়, তা বলে আমি কি চলে যাচ্ছি কোথাও?’

একটু নিশ্চিন্ত হয় সাম্য, চোখের কোণটা ঘষে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘ধুর, বাবাকে ছেড়ে থাকা যায়? আজ হোক, কাল হোক, একটা কেন, দশটা চাকরি পেলেও বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারব না৷’

‘কেন?’

হাসে সাম্য, ‘বাবা কলকাতা খুব ভালো চেনে৷ কোথায় কোন বাসে করে যাওয়া যাবে৷ কোন গলি দিয়ে গেলে শর্টকাট হবে বাবাকে জিজ্ঞেস না করলে জানব কী করে? বাবারা কি আর চিরকাল টাকাপয়সা দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে যত্ন নিতে পারে? কিন্তু ওই যে একটা মানুষ যে একটা মাংসের ডেলার মতো আমিকে এই আমিতে নিয়ে এসেছে সে শুধু বিছানার উপরে শুয়ে থাকলেও তার দিকে তাকিয়ে ঢের ঢের পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে যাওয়া যায়, অন্ধকার পার করে ফেলা যায়…’

বকুল বুঝতে পারে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসছে, সেটা হালকা করতেই ও বলে, ‘আর আমি? আমাকে ছাড়া থাকতে অসুবিধা হবে না?’

‘কেন হবে না? যতদিন না আর একটা সুন্দরী মেয়ে পটিয়ে ফেলছি ততদিন খানিক অসুবিধা হবে বইকী…’

দুম করে রেগে গিয়ে হাতের বইটা তুলে ওর মাথায় মেরে দেয় বকুল, ‘তবে রে হারামজাদা!’

সাম্য হাত তুলে বাধা দেয়, ‘এই দেখ, বুদ্ধদেব কিন্তু পুরো অহিংসার কথা বলেছিল৷ আর তার বই দিয়ে তুই আমায় মারলি?’

বইটা নামিয়ে রাখে বকুল, তারপর দু-হাতের মুটো দিয়ে ওর চুল খামচে ধরে বলে, ‘বেশ তোর সব ক-টা চুল তুলে আগে তোকে ন্যাড়া বানাই তারপর দেখছি বুদ্ধদেব কী বলে…’

দু-জনের চাপা চিৎকারে ঘর ভরে ওঠে৷

***

‘আচ্ছা তথাদা, আপনি সবাইকে মাথা ন্যাড়া করে ফেলতে বলেছিলেন কেন?’

‘যাতে টাক পড়ার ভয় আর না থাকে…’

‘যাঃ, ফালতু ইয়ার্কি মারছেন…’

‘সত্যি৷ আমার সব শিক্ষার মূলে ওইটাই৷ যেটার ভয় পাচ্ছ সেটাকে একেবারে গোড়া থেকে উড়িয়ে দাও…’

গাছের একটা পাতায় টোকা মারতে মারতে সাম্য বলে, ‘আপনার এই কিছু খিচকিল্লেপনার জন্য না আপনার ধর্মটা তেমন ফলোয়ার পেল না৷ মন্দির, মসজিদ, গির্জা, কত সুন্দর সুন্দর নাম ছিল, আপনি কী নাম রাখলেন? স্তূপ! শালা শুনলেই ধাপার মাঠের কথা মনে পড়ে… নাঃ ধর্ম প্রচারক হিসেবে সেই ইয়েটা আপনার মধ্যে নেই…’

‘বেশ, তাহলে কী করতাম বলো?’

লোকটার উপর থেকে নিচ একবার জরিপ করে সাম্য, তারপর বলে, ‘লুকস টুকস তো খারাপ ছিল না আপনার, চেরা চেরা টানা চোখ, মাখনের মতো স্কিন, ফিনফিনে গলার আওয়াজ… ধর্ম-টর্ম ছেড়ে যদি গান গাইতেন কলকাতার কে-পপ লাভাররা আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিটিএস ফিটিএস বলে লাফালাফি করত…’

লোকটা এবার ভুরু কুঁচকে ওর দিকে ঝুঁকে বলে, ‘আমাকে নিয়ে এত মাথাব্যথা করে কী হবে? সেদিন ট্রেনে প্রেমিকা নেই বলে তুমি কাঁদছিলে না ফলোয়ার নেই বলে আমি কাঁদছিলাম?’

সাম্য কাঁধ ঝাঁকায়, ‘আরে আপনি বকুলকে সব কষ্টের কথা খুলে বলতে বলেছিলেন৷ আমি চেষ্টাও করেছি, কিন্তু সবটা বলতে গেলেই কেমন ঘুলিয়ে ঘ হয়ে যাচ্ছে…’

‘আমি সংস্কৃত ছেড়ে পালি ভাষায় কেন ধর্মপ্রচার করেছিলাম জানো?’

‘কেন?’

‘ভাষাটা সহজ ছিল বলে৷ কাউকে সাহায্য করতে গেলে বা কারও থেকে পেতে গেলে আগে খুব সহজ ভাষায় সবটা খুললে বলতে হয়…’

একটা অদ্ভুত হাসি হেসে মাথা নাড়ে সাম্য, ‘উঁহু, কাউকে সবটা বলতে গেলে আগে নিজেকে বুঝতে হয় যে সবটা জেনেও সে পালিয়ে যাবে না৷ তবেই আমরা মুখ খুলতে পারি…’

‘তাই নাকি?’

‘এই যেমন ধরুন আপনাকে আমি সবটা বলতে পারি কারণ আমি জানি যতদিন মূর্তিটা আমার কাছে আছে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না, তাই নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি৷’

তথাগত মুখ ফিরিয়ে নেয়, বলে, ‘বেশ তাহলে এমন কিছু করো যাতে সে যেতে না পারে…’

সাম্য গাছের ডাল থেকে চোখ ফিরিয়ে চাঁদের দিকে তাকায়, ‘আমার প্রেমিকার সঙ্গে মাঝে মাঝে হেব্বি ক্যাচাল হত জানেন৷ আমি রেগে গিয়ে বলতাম, ‘যাও তুমি দূর হয়ে যাও আমার জীবন থেকে’, কিন্তু ততদিনই বলতে পারতাম যতদিন জানতাম ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না৷ যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ও সত্যি চলে যেতে পারে সেদিন আর বলতে পারিনি…’

‘যেমন তোমার বাবাকে আজ বলতে পারলে না৷’

এই কথাটা আশা করেনি সাম্য, মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মানে? কী বলতে পারিনি?’

‘বাবা চলে গেলে তুমি গুছিয়ে নিতে পারবে কি না, বাকি জীবনটা নিজের খেয়াল রাখতে পারবে কি না… বাবা-মাও কথাটা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে তোমার টানটা পরীক্ষা করতে, আজ কিন্তু অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করেছিলেন…’

‘কারণ আমি সত্যিটা বলতে পারব না বাবাকে…’

‘আমি তোমাকে সত্যি বলতে বলিনি…’

‘আপনি নাকি সারাজীবন সত্যের অন্বেষণ করেছেন—আর আমাকে মিথ্যে বলতে বলছেন?’

তথাগত লম্বা হাত রাখে সাম্যের মাথায়, ‘সত্যের খোঁজ করা আর সত্যি কথা বলা এক জিনিস নয় ভাই… মানুষকে তার যন্ত্রণার থেকে রেহাই দেওয়া হল সত্য…’ কথাটা বলে মুখ তোলে সে, ‘যাও বাড়ি যাও, তোমার বাবার আবার শরীর খারাপ করছে…’

মিনিট খানেক পরে ঘরে ঢোকে সাম্য৷ ওর ঢোকার সময় তেমন একটা আওয়াজ হয় না৷ তাও বিছানার দিক থেকে উসখুস আওয়াজ আসে৷ বাবার দিকে এগিয়ে যায় সাম্য—

‘বাবা…’

টেবিল ল্যাম্পের আলোটা কাঁপা কাঁপা হাতে জ্বেলে দেন ভদ্রলোক৷ চশমাটা চোখে গলিয়ে ওকে ভালো করে দেখে বলেন, ‘তুই এত রাতে কোথায় যাস বল তো?’

‘ধ্যান করতে, একটা কথা বলার ছিল তোমাকে৷’

‘বল…’

‘তুমি না থাকলে আমার কষ্ট হবে ভীষণ৷ কিন্তু আমি নিজের জীবনটা চালিয়ে নিতে পারব৷ চিন্তা কোরো না তুমি…’ ঠান্ডা কিন্তু দৃঢ় গলার আওয়াজ৷

মানুষটার কুঁচকে যাওয়া ভুরু আবার সোজা হয়ে যায়৷ হাত বাড়িয়ে ছেলের একটা হাত চেপে ধরেন তিনি, ‘কত বড় হয়ে গেছিস তুই…’

বাবার হাতের স্পর্শ সাম্যর শরীরে গাছের পাতার মতো আদুরে মনে হয়৷ রক্তের গন্ধ মেখে বাবার পাশেই শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে ও৷ শুতে শুতে ওর মনে হয় ওর মতো বাবাও এক্ষুনি মিথ্যে বলেছে৷ ও আসলে অনেক ছোট হয়ে গেছে… একেবারে ছোটবেলার মতো…

(৬)

‘তোর এখনও মায়ের জন্য মন কেমন করে, তাই না?’

ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সাম্য, ‘কে বলল তোকে?’

‘রাতবিরেতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাস শুনলাম৷ কোথায় যাস বলতো?’

‘তোকে বললে বিশ্বাস করবি না৷’

আজও সন্ধ্যায় ভাঙা নৌকাটার উপর এসে বসেছে দু-জনে৷ আজ দেখা হবার কথা ছিল না৷ কিন্তু কাল বকুল দু-দিনের জন্য মাসির বাড়ি যাচ্ছে ঘাটশিলা৷ সকালের ট্রেন৷ দিনতিনেক দেখা হবে না৷ তাছাড়া একটু পরেই সাম্যর বাবার রিপোর্টটা দেওয়ার কথা৷ যে কোনও সময় ফোন আসবে৷ টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সাম্যর৷ সে জন্যেই ছুটে এসেছে বকুল৷ একটু দূরে ফাঁকা মাঠের উপরে ধীরে ধীরে শীত সন্ধ্যার ধোঁয়া নামছে৷

একটা হাত দিয়ে ওর কম্পমান হাত চেপে ধরে বকুল, ‘এত চিন্তা করিস না৷ রিপোর্ট যাই আসুক, আমি আছি তো, একসঙ্গে লড়ে নেব৷ শুধু তোকে ঠিক থাকতে হবে…’

‘আমি ঠিকই আছি…’

‘কাকু বলল পাহাড় থেকে ফেরার পরই তোর মধ্যে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে৷ সবসময় কেমন অন্যমনস্ক থাকিস, খাওয়া-দাওয়া করিস না, বিশেষ কথা বলিস না, হাসিস না… এই তুই সত্যি বুদ্ধিস্ট-ফুদ্ধিস্ট হয়ে যাচ্ছিস নাকি?’

ওর দিকে ফিরে তাকায় সাম্য, একটু দূরে জ্বলন্ত হ্যারিকেনের ফিকে আলো এসে পড়েছে মেয়েটার চোখের উপর৷ দুশ্চিন্তা মাখামাখি হয়ে রয়েছে ওর সমস্ত মুখের চামড়ায়৷ মায়া লাগে সাম্যর, ‘বেকার এত কিছু করে গেলি আমার জন্য, বদলে কিছুই পেলি না কোনওদিন…’

‘ধার হয়ে গেছে তোর আমার কাছে অনেক৷ একেবারে দিতে পারবি না৷ ইএমআইতে উশুল করব৷’

‘আর যদি কিছুই না দিতে পারি?’

‘তাহলে লোক পাঠিয়ে একেবারে তুলে আনব বাড়ি থেকে…’

‘তাই নাকি? তারপর?’

‘একেবারে নিজের কাছে রেখে দেব৷’ কথাটা বলে ওর হাতটা দু-হাতে চেপে ধরে বকুল, ‘অনেক অযত্ন হতে দিয়েছি তোর, আর দেব না৷’

অদ্ভুত মায়ামাখা চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় সাম্য, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে সবকিছু খুব সহজ ভাষায় একেবারে জলের মতো বলে ফেলতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ওটাই একমাত্র সলিউশন সবকিছুর…’

‘তাহলে বল, আমি শুনছি তো…’

সাম্যর ঠোঁট কেঁপে যায়, ‘আমি জানি না কী করে বলতে হয়৷ খুব সহজ করে বলা সহজ নয়…’

‘বেশ, তাহলে আমি চেষ্টা করি?’

‘কর…’

সাম্য বুঝতে পারে ওর হাতের উপর নরম হাতের চাপ বাড়ছে৷ বকুলের চোখদুটো ওর চোখে স্থির হয়ে আছে৷ অস্বস্তি হচ্ছে কি? সন্ধ্যার হাওয়াটা আরও ঘন হয়ে গেল না? নাকি সব ওর মনের ভুল? বকুল কিছু বলছে না কেন?

সাম্যর খেয়াল হয় ওর ফোনটা বাজতে শুরু করেছে৷ দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ও ফোনটা রিসিভ করে৷ রিপোর্টের লোকটাই ফোন করেছে৷ ফোনটা কানে লাগিয়ে কাঁপা কাঁপা গলাতেই হ্যালো বলে ও৷ তারপর কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে ফোনটা কেটে দেয়…

‘হল কী? কী বলল রিপোর্ট?’ বকুল অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে৷

‘কিছু না৷ আমি পরে কথা বলছি…’ কথাটা বলে একরকম ছুটেই মাঠের উপর জমাট বাঁধা কুয়াশার ভিতর হারিয়ে যায় সাম্য৷ সেদিকে চেয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বকুল৷ হলটা কী ছেলেটার?

* * *

গাছের নিচে এসে আজ আর ডাকতে হল না৷ গাছের একটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসেছিল তথাগত৷ সাম্য নিঃশব্দে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে সে মুখ না ফিরিয়েই পাশের ঘাসের জমিটা দেখাল হাত দিয়ে, ‘এসো, বসো এখানে…’

যন্ত্রচালিতের মতো সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সাম্য৷ তারপর গাছের গুঁড়িতেই পিঠ এলিয়ে দিল৷ আজ চাঁদের দিকে পিঠ করে বসেছে তথাগত৷ ওর মাথার ঠিক পেছনে গোল পূণিমার চাঁদটা৷ একটা রুপোলি বলয় তৈরি করেছে যেন৷

তথাগত এক মনে চেয়েছিল আকাশের দিকে, বিড়বিড় করে বলল, ‘পূর্ণিমায় আকাশটা কী সুন্দর দেখায়, না? আমি পূর্ণিমাতে জন্মেছিলাম, আর পূর্ণিমাতেই…’

‘আমার বাবা আর বেশিদিন বাঁচবে না৷’ পাথরের মতো শীতল স্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করে সাম্য৷

‘জানি৷’ কথাটা বলে ওর দিকে ফিরে তাকায় তথাগত৷ তার টানাটানা দুটো চোখ আরও গভীর হয়েছে এখন৷ যেন গলিত কান্নার স্রোত অতল ছুঁয়েছে৷

‘আপনি আজ কিছু বলবেন না আমায়?’

তথাগত উত্তর দেয় না৷ ধীরে ধীরে হাতের চাপে সাম্যর মাথাটা কাছে টেনে নেয়৷ উত্তরীয়র স্পর্শ লাগে সাম্যর মাথায়৷ চোখ ঢেকে যায় অন্ধকারে৷ মায়ের কোলের মতো চেনা উষ্ণতা গলিয়ে দেয় সাম্যকে৷ সে উষ্ণতাতে মাথা রেখেই শান্ত হয়ে বসে থাকে ও৷ কান্না আসে না, ভয় আসে না, যন্ত্রণার ঢেউ ওকে স্পর্শ করে না৷

দু-হাতে তথাগতকে জড়িয়ে ধরে ও৷ পূর্ণিমার গোল চাঁদের দিকে চুপ করে সারারাত চেয়ে থাকে দু-জনে, রাত বাড়তে থাকে…

(৭)

ভোরবেলা ভাঙা নৌকাটার কাছে এসে একটু অবাকই হয় বকুল৷ এত সকালে সাধারণত দেখা করে না ওরা৷ কিন্তু আজ একেবারে ভোরে ফোন করে জরুরি তলব৷ একটু পরেই বকুলের ট্রেন, ট্রেনে ওঠার আগে একবার দেখা করে যেতেই হবে৷ কীসব নাকি বলার আছে সাম্যর৷

ভাঙা নৌকাটার সামনে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বকুল, ‘এই, ব্যাপার কী তোর? কাল রিপোর্টের কথা কিছু না জানিয়েই হুট করে চলে গেলি…’

‘বাবা ঠিক আছে, কিছু হবে না৷ আমার তোকে কিছু বলার ছিল…’ সাম্যের কথার মধ্যে কেমন যেন নেশার ঘোর আছে৷ মনে হয় ওর মধ্যে থেকে অন্য কেউ কথা বলছে৷ এখন সকাল বলে হ্যারিকেনটা জ্বলছে না৷ জায়গাটাকেও অন্যরকম লাগছে বকুলের৷

‘সেইটা শুনতেই তো এলাম, বল কী বলবি?’

সাম্য তেমনই শান্ত গলায় বলে, ‘ছোট থেকে এমন কোনও সময় ছিল না যখন তুই আমার পাশে ছিলিস না…’

‘হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?’ বকুল একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে৷

‘কেন?’

‘কারণ আমি তোকে ভালোবাসি…’

‘মানে?’

‘মানে আবার কী? ভালোবাসি মানে বাসি৷ তুই তো বলেছিলি সবকিছু সোজা কথায় সোজা ভাবে বলতে, বলে দিলাম…’

ওর দিক থেকে একবার পিছিয়ে আসে সাম্য৷ তারপর মুখ তুলে বলে, ‘আমি আসলে…’

হঠাৎ ওর মুখের সামনে নিজের মুখটা নিয়ে আসে বকুল, ‘কেন, তুই ভালোবাসিস না?’

কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল সাম্য৷ থেমে যায়৷ একটা অদ্ভুত স্রোত খেলে যায় ওর সমস্ত শরীর জুড়ে, ওর মনে হয় বুহু যুগ ধ্যানের পর যেন চোখ মেলে তাকিয়েছে ও৷ সমস্ত যন্ত্রণার উপশম ওর সামনে দাঁড়িয়ে৷ এই মুহূর্তটার জন্যেই তো অপেক্ষা করছিল এতদিন… অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়৷ সমাধান ওর হাতের কাছে ছিল এতদিন, আর ও পাগলের মতো খুঁজেছে, বুঝতে পারেনি…

‘না…’ দৃঢ় গলায় বলে সাম্য৷

হেসে ফেলে বকুল৷ ওর দুটো হাত গালে উঠে আসে সাম্যের গালে, আদুরে একটা চড় মেরে বলে, ‘এত সামনে থেকে মিথ্যে বলতে নেই জানিস না?’

‘আমি তোকে ভালোবাসি না বকুল…’ আগের মতোই কঠিন অথচ শান্ত গলা৷

নিজের মুখটা সরিয়ে আনে বকুল, ওর চোখে বিস্ময়ের চিহ্ন, ‘বাসিস না? সত্যি কোনওদিন বাসিসনি?

‘না সত্যি কথা বলতে আমি চাই না৷ তুই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রা…৷’

‘মানে! কী বলছিস এ সমস্ত?’

‘হ্যাঁ৷ আমার জীবন থেকে চিরকালের মতো তোকে চলে যেতে বলছি৷ কোনও যোগাযোগ না, মেসেজ, ফোন, কিছু না…’

‘কিন্তু তোর কী লাভ হবে তাতে?’

‘তা জানি না, কিন্তু আমার জীবনে তোর কোনও অস্তিত্ব আমি চাই না৷ তুই চলে যা…’

বকুলের চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে৷ সেটা কোনওমতে সামলে নেয় সে৷ গলা বুজে আসছিল, রুদ্ধকণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘তুই সত্যি বলছিস? এটাই চাস তুই?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ে সাম্য৷ বকুল বুঝতে পারে ও মজা করছে না৷ বরঞ্চ এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আগে দেখায়নি ওকে৷

‘বেশ, আমি চলে যাচ্ছি, আর কোনওদিন দেখা হবে না…’

কথাটা বলে পেছন ফিরে হাঁটতে যাচ্ছিল বকুল৷ হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে সাম্যের, ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই দাঁড়া, আমার কিছু দেওয়ার আছে তোকে…’

নিজের ব্যাগটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা কালো পাথরের বুদ্ধমূর্তি বের করে আনে সে৷ তারপর সেটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা নিজের কাছে রাখিস, সবসময়…’

বকুল আর কিছু বলে না৷ দু-হাতে বুদ্ধমূর্তিটা ধরে সেটা কোলের কাছে টেনে নেয়৷ তারপর রুদ্ধকণ্ঠেই বলে, ‘বেশ, এবার আসছি…’

আর কথা না বাড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দ্রুত পা চালায় বকুল৷ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে না একবারও৷

সাম্য সেভাবেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে৷ ওর ঠোঁট কাঁপে না, কিন্তু ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে ওঠে মুখে৷ বকুলের চলে যাওয়া পথের দিকে একটানা চেয়ে থাকে ও৷ ও জানে মেয়েটা আজ ট্রেনে উঠে সারারাত কাঁদবে৷ ঘুম হবে না, জলের ধারা ওর মুখ ভিজিয়ে দেবে৷ আর সারা রাত বুদ্ধমূর্তিটা থাকবে ওর মাথার কাছে৷ কাল সকালবেলা উঠে ওর পাশের বার্থে খুঁজে পাবে একটা লম্বাটে চেহারার বছর ত্রিশেকের যুবককে৷ যে ওকে সারিয়ে দিতে পারবে… সব যন্ত্রণার থেকে মুক্তি দিতে পারবে… চিরকালের মতো…

প্রিয়জনকে, ভালোবাসার মানুষকে, সারিয়ে তোলার থেকে বেশি সেরে ওঠা আর কিছুতে নেই…

ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে আসে সাম্যের৷ অথচ মনের সমস্ত ব্যথা একটু একটু করে পুড়ে ছাই হতে থাকে৷ একটা অপরিচিত নিরাপত্তা, জ্বর ছাড়ার অনুভূতি ঘিরে ধরে ওকে…

ওর কাঁধে কি কারও নিশ্বাস পড়ছে? না, সাম্য জানে আশপাশে কেউ নেই৷ তাও ওর মন বলে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে ওর মতোই দূরের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে একটা লম্বাটে চেহারার বছর ত্রিশেকের যুবক৷

দূরে এতক্ষণে বকুলের ছোট হয়ে আসা শরীরের পাশে জড়ো হয়েছে আরও কয়েকটা ছায়া, মায়ের ছায়া, বাবার ছায়া, একটা অল্পবয়সি মেয়ের ছায়া, তারা সবাই হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরে… আরও দূরে… মিলিয়ে এল একসময়…

নিজেকে এক অন্ধ জাতিস্মর মনে হয় সাম্যর৷ হাজার বছর ধরে যেন হেঁটেই চলেছে সময়ের পথে৷ কত স্মৃতি-রাজরাজড়াদের, যুদ্ধের, দুর্ভিক্ষের, প্রেমের, যন্ত্রণার, একাকিত্বের, সভ্যতার… দৃশ্যগুলো ভুলে গেছে, কেবল অনুভূতিগুলো রয়ে গেছে এ জন্মে…

দূরে জমাট কুয়াশার দিকে চেয়েই ও বিড়বিড় করে বলে, ‘ওদের সারিয়ে দিলাম, বলো তথাদা?’

‘তার বেশি আর কী করতে পারি আমরা?’

পেছন ফেরে সাম্য৷ না, কেউ নেই ওর আশপাশে৷ মিহি রোদ খেলা করছে সমস্ত জায়গাটায়৷ সেই রোদেই ফেলে আসা রাস্তার উপরে ওর নিজের ছায়াটা পড়েছে৷ একটা দীর্ঘ, শান্ত, পরিচিত ছায়া…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *