জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় : ইহুদি জালিয়াতি

জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় : ইহুদি জালিয়াতি

ঐতিহাসিক নানা কারণে আমেরিকা এ পর্যন্ত বহুবার অভিবাসী গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়া, জার্মানি ও পোল্যান্ডের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা এতটা প্রকট ছিল, সে দেশের একজন সাধারণ মানুষও আমেরিকায় অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পায়নি। তারপরও লাখো ইহুদি ওই দেশগুলো থেকে আমেরিকায় প্রবেশ করে। সেইসঙ্গে নিউইয়র্কের এলসা দ্বীপে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করে।

সে সময় ইউরোপের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে আমেরিকায় ইহুদিদের অভিবাসন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, আমেরিকা থেকে একদল প্রশিক্ষিত ছদ্মবেশী এজেন্ট পাসপোর্ট অফিসগুলোতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে তারা এতটা দক্ষ, তাদের কোনোভাবেই শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। কখনো যদি কেউ তাদের প্রতি ন্যূনতম সন্দেহের চোখে তাকায়, তৎক্ষণাৎ তাকে বদলি করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পুরো এই চক্রটিকে শক্তিধর কোনো হাত নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে সেই চক্রের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ একটি জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন করাই এদের মূল উদ্দেশ্য। প্রথমে তাদের বিশেষ অতিথি কোটায় আমেরিকা পাঠানো হয়। তারপর বাকি কাজ সে দেশের অভিবাসন মন্ত্রণালয় সহজ করে দেয়। তাদের কোনো রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা জবানবন্দি পর্যন্ত দিতে হয় না।

এমন প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো আমেরিকার অভিবাসন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। তবে শুরু থেকে কিছু কংগ্রেস সদস্য ও পত্রিকা প্রতিষ্ঠান তদন্ত কাজে অসহযোগিতার মনোভাব দেখায়। বিশেষত এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রতিনিয়ত ওয়াশিংটন থেকে বাধা দেওয়া এবং ভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা হয়। ফলে তদন্ত কাজ দীর্ঘায়িত হয়। দেখা যায়, এই পুরো চক্রটি ইহুদি গোত্রের সদস্য। সাথে সাথে তাদের পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচার করতে শুরু করে— ‘অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে, সামান্য একটু আশ্রয়ের আশায় যে ইহুদিরা আমেরিকার পথে পালিয়ে আসছে, তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভ কেন?’

বিষয়টি আরও মর্মস্পর্শী করতে তারা একদল ক্ষুধার্ত শিশু-মহিলার করুণ চিত্র ছাপিয়ে বড়ো বড়ো কলাম প্রকাশ করতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারেনি, এই ছবিগুলো ইহুদিদের ভাড়া করা ফটোগ্রাফার দিয়ে তোলা! আর যে ক্ষুধার্ত মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তা ছিল পুরোদস্তুর বানানো নাটক। কিন্তু বোকা আমেরিকানরা সবকিছু সত্য মনে করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আশ্রয় প্রদান করেছে; ঠিক যেমনটা ঘটেছে রাশিয়ান ও জার্মানদের ভাগ্যে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে জনসংখ্যা গণনা নিয়ে আমেরিকায় একটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়। কারণ, স্বাধীনতার পর হতে বিভিন্ন দেশের নাগরিক অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করেছে। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে পৃথক জাতীয়তা যেমন : জার্মান, রাশিয়ান, আইরিশ ইত্যাদি। তাই জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে একটি আদমশুমারি করার প্রস্তাব ওঠে। ৮০’র পূর্বে যদি কোনো অভিবাসী আয়ারল্যান্ড থেকে আসে, তবে তাকে আইরিশ, নরওয়ে বা সুইডেন থেকে এলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, রাশিয়া থেকে এলে রাশিয়ান এবং জার্মানি থেকে এলে জার্মান বলে ডাকা হতো।

এভাবে পরবর্তী দশ বছরের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৬৬৬৫৬১ জন ‘রাশিয়ান ইহুদি’-কে আমেরিকায় নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু নব্বই দশকের দিকে অভিবাসন মন্ত্রণালয় ভিন্ন কথা জানাতে থাকে। তারা যাদের এই নথিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাদের অধিকাংশই পোলিশ, সুইডিশ, জার্মান ও লিথুনিয়ান। কারণ, জন্মসূত্রে তারা এসব দেশের নাগরিক। হয়তো রাশিয়া থেকে তারা সরাসরি আমেরিকায় প্রবেশ করেছে বলে গণনা কাজে ভুল হয়েছে।

সমস্যার সমাধানে কংগ্রেস সদস্যগণ ‘জাতি ও জন্মভূমি’ বিষয় দুটিকে মানদণ্ড ধরে আদমশুমারি করার প্রস্তাব করে। এটা কিছুটা হলেও যুক্তিসংগত। কিন্তু Senator Simson Guggenheim এ বিষয়ে জোরালো আপত্তি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন- ‘ইহুদি শব্দটি কেবলই একট ধর্মীয় উপাধি। এর সাথে আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জড়িত। জাতি ও ধর্ম কখনো এক বিষয় নয়। তাই এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের কখনো আলাদা জাতি বলা যাবে না।’ Senator La Follette ছিলেন এই আলোচনা সভার চেয়ারম্যান। এবার তাদের আলোচনা লক্ষ করুন-

লা ফোলেত্তি : একটি জাতির সঠিক ইতিহাস জানতে তারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের শরীরে কার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তাদের পূর্বপুরুষগণ কোথাকার অধিবাসী ইত্যাদি জানা প্রয়োজন।

গুগেনহিম : তাহলে ধর্মের কথা কেন আসছে?

(Senator McCumber ও Bailey আলোচনার সময় Senator Guggenheim-কে সমর্থন করেন)।

লা ফোলেত্তি : আমি আপনার আপত্তির কারণ বুঝতে পারছি না। প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের সমন্বয় করতে সমস্যা কোথায়?

গুগেনহিম : কারণ, আপনি আবারও তাদের একটি জাতি বলছেন, কিন্তু তারা তো পৃথক কোনো জাতি নয়!

(এবার Senator Bailey-কে সমর্থন করে Senator Cummins আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন)।

সিনেটর বেইলি : মনে করুন, আমি একজন হিব্রু এবং এ দেশে আমার জন্ম। এরপরও যদি আমেরিকান ব্যতীত অন্য কোনো নামে কেউ আমাকে সংজ্ঞায়িত করে, তাহলে আমি অবশ্যই এর বিরোধিতা করব।

সিনেটর কামিন্স : আমার পূর্বপুরুষরা কোথাকার অধিবাসী এবং আমার শরীরে কাদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তা বলতে কোনো সমস্যা নেই।

সিনেটর বেইলি : এতে আমারও কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এখানে ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

সিনেটর কামিন্স : সত্যিই তো! এখানে ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

এরপর ১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসে এই বিতর্কের ওপর আরও একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। Simon Wolf ছিলেন এ সম্মেলনের চাক্ষুষ সাক্ষী। Abraham Lincoln থেকে Woodrow Wilson পর্যন্ত প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের সময়কালে Simon Wolf ইহুদিদের একজন সক্রিয় এজেন্ট হয়ে কাজ করেছেন। যেকোনো প্রশাসনিক ইস্যুতে তিনি ইহুদিদের পক্ষে কথা বলেছেন। Senator Dillingham উক্ত সম্মেলনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি তাদের জাতিতাত্ত্বিক বিতর্কের ওপর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। নিচে তা উপস্থাপন করা হলো—

মি.উলফস : আমরা একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই—যদি কোনো ইহুদি রাশিয়া হতে আসে, তবে সে রাশিয়ান। যদি রোমানিয়া হতে আসে, তবে রোমানিয়ান। যদি ফ্রান্স হতে আসে, তবে ফরাসি। যদি কেউ ইংল্যান্ড হতে আসে, তাহলে ইংরেজ। জার্মানি থেকে এলে জার্মান। তবে তাকে হিব্রু বা ইহুদি বলে সম্বোধন করা যাবে না।

সিনেটর লডস : এর মধ্য দিয়ে কি আপনি স্বীকার করছেন, আপনাদের কোনো জাতীয় পরিচয় নেই?

মি.উলফস : কীভাবে?

সিনেটর লডস : আপনি কি বলেননি—ইহুদি শব্দটি কোনো জাতীয়তার পরিচয় বহন করে না?

মি.উলফস : আমি গত ৩০ বছর Union of American Hebrew Congregations-এর মুখপাত্র হয়ে কাজ করছি। এই জাতিতাত্ত্বিক বিতর্ক নিয়ে আমি এ পর্যন্ত ইহুদিদের প্রভাবশালী বহু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন Dr. Cyrus Adler। তিনিও বলেছেন—এই শব্দটি কোনো জাতিতত্ত্বের পরিচয় বহন করে না।

সিনেটর লডস—Cyrus Adler-এর কথা উল্লেখ করে ভালো করেছেন। আমি নিজেও Jewish Encyclopedia-এর প্রারম্ভিক বিবৃতিতে তার স্বাক্ষর দেখেছি। সেখানে অন্যান্য অনেক বিবৃতির মধ্যে এটাও উল্লেখ ছিল—

‘সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন থেকে, যখন ইহুদিরা নিজেদের জাতিগত পরিচয় পরিত্যাগ করতে শুরু করেছে। ইহুদি হিসেবে জন্ম নিয়েও আজ তারা জাতিগতভাবে নিজেদের এই পরিচয় দিতে নারাজ। কিন্তু বিতর্ক যখন জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে, তখন কোনোভাবেই ইহুদিদের এই পরিচয় মুছে দেওয়া সম্ভব নয়।’

এরপর Joseph Jacobs আরও উল্লেখ করেন—

‘প্রাচীনকাল থেকে তারা এক ও অভিন্ন জাতি হিসেবে বসবাস করে আসছে। তাদের সমানে যে বিপর্যয়ই আসুক না কেন, তারা নিজেদের অভিন্ন জাতিসত্তা টিকিয়ে রেখেছে।’ এরপরও আপনি কীভাবে বলছেন, এটি ইহুদিদের জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় বহন করে না?’

মি.উলফস : আমি আমার বক্তব্য পরিষ্কার করেছি। আমি যা বলতে চাই, তার সবই Jewish Encyclopedia-তে আছে।

সিনেটর লডস : তাহলে Benjamin Disraeli সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

মি.উলফস : জন্মসূত্রে তিনি একজন ইহুদি।

সিনেটর লডস : কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরও কি তিনি ইহুদি ছিলেন?

মি.উলফস : না, ধর্মীয়ভাবে তার ইহুদিত্ব শেষ হয়ে গেছে।

সিনেটর লডস : আহ! ধর্মীয়ভাবে একজন ইহুদি হিসেবে তিনি নিজেকে নিয়ে অনেক গর্ব করতেন এবং সবাইকে তা বলে বেড়াতেন, কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করার কারণে কি তার জাতীয় পরিচয় বদলে যাবে?

মি.উলফস : আমি বলছি না—ধর্ম পরিবর্তন করার দরুন তার জন্মগত পরিচয় বদলে গেছে। জন্মসূত্রে তিনি একজন ইহুদি এবং সবাই তাকে Heine ও Borne বলে সম্বোধন করে, কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার এই পরিচয় শেষ।’

সিনেটর লডস : তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হলো—ইহুদি বা হিব্রু কোনোটাই আপনাদের জাতীয়তার সঠিক পরিচয় বহন করে না।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে করা আদমশুমারিতে আমেরিকার জনসংখ্যাকে ৪৬টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। ফলে প্রতিটি জাতিকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যেমন : উত্তরাঞ্চলীয় ইতালিয়ানদের আলাদা করা হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় ইতালিয়ানদের থেকে। মরাভিয়ানদের (Moravians) আলাদা করা হয়েছে বহেমিয়ানদের (Bohemians) থেকে। স্প্যানিশ-আমেরিকানদের আলাদা করা হয়েছে স্প্যানিশ ইউরোপিয়ানদের থেকে, কিন্তু ইহুদিদের কোনোভাবে আলাদা করা সম্ভব হয়নি। কারণ, তাদের জন্য পৃথক কোনো শ্রেণি করা হয়নি। তারা ব্যতীত আর কেউ এই আদমশুমারিতে আপত্তি জানায়নি। রিপোর্ট প্রকাশকালে উল্লেখ করা হয়—

‘জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে আদমশুমারি করা হয়েছে, তা আমেরিকায় বসবাসরত প্রতিটি অধিবাসী আনন্দচিত্তে মেনে নিয়েছে; শুধু একটি জাতি ছাড়া।’

জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে ইহুদিদের মন্তব্য

‘আজ আপনাদের এমন এক রাষ্ট্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, বর্তমানে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে তা দ্রুতই বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক নানা কারণে এই রাষ্ট্রের বংশধরদের অসংখ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়েছে। চাইলে রাষ্ট্রটির পূর্বে বিশেষণ হিসেবে “ইহুদি” যোগ করতে পারেন। তাহলে বুঝতেই পারছেন— এ রাষ্ট্রটির পূর্ণরূপ কী হতে পারে!’ —THEODOR HERZL

‘আসুন আমরা সবাই এ সিদ্ধান্তে একমত হই, ইহুদিবাদ একটি পৃথক জাতিসত্তা। দেশ, পেশা, অবস্থান ও পদমর্যাদা যা-ই হোক না কেন, সবাই তার সদস্য’। —LOUIS D. BRANDEIS ( Justice of the United States of Supreme Court.)

Louis D. Brandeis হলেন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এবং জায়োনিস্ট আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। তার ভাষ্য অনুযায়ী—

‘রাবাই পরিষদ এবং গণ্যমান্য আরও অনেকের ভাষ্য অনুযায়ী—যারা প্রকাশ্যে নিজেদের ইহুদি বলে স্বীকৃতি দেয় এবং ধর্মীয় সব অনুশাসনের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, কেবল তারাই এই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। তবে কাউকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, যা দ্বারা নিজেদের পছন্দসই একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে নেবে। একটি সঠিক ও কার্যকর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন কাজ।

শরীরে “ইহুদি রক্ত” প্রবাহিত হচ্ছে—এমন প্রতিটি ব্যক্তি এই সমস্যার সম্মুখীন। কিছু ধর্মীয় বয়ান দিয়ে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনের কথা বললেই এই সমস্যার সমাধান হবে না।’ (Zionism and the American Jews)

Rev. Morris Joseph 6-West London Synagogue of British Jews- একজন সদস্য। এবার তার ভাষ্য অনুযায়ী — .

‘নিঃসন্দেহে ইজরাইল একটি মহান জাতি। রাষ্ট্র হিসেবে এটি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা এর নাম থেকেই বোঝা যায়। যেনতেন কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের পক্ষে এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ নাম বহন করা কখনো সম্ভব নয়। ইজরাইল এমন একটি জাতির পরিচয় বহন করে, যারা নিজ স্বার্থে সামান্য ভুলটুকুও করতে রাজি নয়। সুতরাং ইহুদিদের জাতীয়তা অস্বীকার করার অর্থ হলো, ইজরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।’ (Israel a Nation)

Aurther D. Lewis হলেন West London Zionist Association-এর একজন সদস্য। তার ভাষ্য অনুযায়ী—

‘অনেকে এমন মন্তব্য করেন, রোমান ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের মতো ইহুদিরাও একটি স্বতন্ত্র ধর্মের অনুসারী। তাদের ব্যাপারে বলছি— কীভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে হয়, তা আপনারা এখনও শেখেননি। যদি কোনো ইহুদি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে অনেকেই বলবে ধর্ম পরিত্যাগ করার দরুন সে আর এই গোত্রের সদস্য নয়। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব—যখন তার রুচিধারা ও চিন্তা- চেতনায় এখনও ইহুদিবাদত্ব বিদ্যমান!’ (The Jew a Nation)

Bertram B. Benas একজন বিখ্যাত অ্যাডভোকেট। তার ভাষ্য অনুযায়ী-

‘ইহুদি সত্তা দ্বারা মূলত একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হচ্ছে। Israelites, Jews, Hebrews প্রতিটি পদবি এই স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীটির ঐতিহাসিক পরিচয় বোঝানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো যে তাদের ধর্মীয় পরিচয় বহন করছে, তা কিন্তু নয়।’ (Zionism: The National Jewish Movement)

Leon Simon একই গোত্রের একজন বিখ্যাত লেখক ও পণ্ডিত। ধর্ম ও জাতীয়তা নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসানকল্পে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি গবেষণা চালান। পরবর্তী সময়ে এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনি ‘Religion and Nationality’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং ‘Studies in Jewish Nationalism’ খণ্ডে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। তিনি একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলেন—’ধর্মই তাদের জাতীয়তার পরিচয় বহন করে এবং জাতীয়তা হলো ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’

Simon বলেন—’অন্যান্য সব ধর্মের মতো আমাদেরও স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও অনুশাসন আছে, যা আমাদের মেনে চলা উচিত।’ এবার তার প্রকাশিত প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা হলো-

‘মসিহের যুগে ইহুদিরা বিশ্বজুড়ে শুধু শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধই প্রতিষ্ঠা করবে না; তারা স্বীয় ঈশ্বর এবং নিজ ধর্মের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যও প্রকাশ করবে। এর মাধ্যমে আমাদের জাতির শাশ্বত অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে। এই ধর্মীয় বিশ্বাস সামান্য কিছু ধর্মীয় বই ও গির্জায় যাওয়ার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়; এজন্য অতীত ও ভবিষ্যতের প্রতিটি বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ অধ্যয়ন ও বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন।’ (p. 14 )

‘ব্যক্তিগত পাপ মোচন এবং আত্মার পরিশুদ্ধি লাভের উপায় হিসেবে আমাদের তেমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, যেমনটা খ্রিষ্টানদের দেওয়া হয়েছে। ইহুদিতন্ত্র বোঝায় জাতীয় ঐক্য ও একাত্মতা, যার ওপর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সুতরাং যেকোনো মূল্যেই হোক— আমাদের এ জাতীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে হবে।’ (p. 20)

‘ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মতো আমরাও যে একই শ্রেণির স্বতন্ত্র সম্প্রদায়, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন।’ (p. 34)

Gratez একজন বিখ্যাত ইহুদি ঐতিহাসিক। তার ভাষ্য অনুযায়ী—

‘নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েও আজ পর্যন্ত আমরা নিজেদের ইতিহাস- ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছি। কেবল ধর্মমত ও সিনাগগের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে থাকলে এই ঐক্য এতদিন পর্যন্ত টিকত না। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য যেনতেন কিছু ধর্মীয় অনুশাসন ও সিনাগগের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি।’

Moses Hess তাদেরই একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, যার কল্যাণে ইহুদিদের বহু প্রাচীন ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়েছে। ‘Rome and Jerusalem’ শিরোনামে তিনি একটি বই লিখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন—

‘ইহুদিবাদের অর্থ হলো—এ ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।’ (p. 61 )

‘যদি সত্যিই আমরা একটি নির্দিষ্ট ধর্মমতের অনুসারী হতাম, তবে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে নিজেদের জড়িত করার অনুমতি পেতাম না। এ জাতীয় কাজে অংশগ্রহণ করার কারণে আমাদের সাম্প্রদায়িকভাবে বহিষ্কার করা হতো। এ সমস্যার সমাধানকল্পে বলতে চাই—আমরা যেমন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের একটি অংশ, তেমনি একটি স্বতন্ত্র জাতিও।’ (p. 71)

‘এই ধর্মে পরিত্যাগের কিছু নেই। যদি কোনো ব্যক্তি অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তবুও সে একজন ইহুদি এবং সমাজ থেকে তাকে বর্জন করা হয়নি। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে সে নাহয় তার ধর্মীয় পরিচয় পালটে ফেলেছে, কিন্তু জাতীয় পরিচয় কীভাবে পালটাবে?’ (p. 97-98)

১৯২০ সালে Zionist Organization of America ইহুদিতন্ত্র ও জায়োনিজমের ওপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এ গ্রন্থের একজন উল্লেখযোগ্য রচয়িতা E. Sampter-এর ভাষ্য অনুযায়ী—

‘ইহুদিতন্ত্র নামকরণ হয়েছে জাতিসত্তার ইতিপরিচয় থেকে। একজন ধার্মিক ব্যক্তির ন্যায় অধার্মিক ব্যক্তিও এই গোত্রের সদস্য হবেন। হয়তো সে ধর্মীয় কাজগুলো নিয়মিত পালন করছে না, কিন্তু তার জাতীয় পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকবে।’ (Guide to Zionism, p. 5 )

ইহুদিদের জাতীয় পরিচয়ের মূলভিত্তি সম্পর্কে Louis D. Brandeis বলেন—

‘এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি—আমাদের জাতীয়তা কলুষিত হয়েছে এবং রক্তে জ্যান্টাইলদের ধারা প্রবেশ করেছে। গত তিন হাজার বছরের পরিক্রমায় হয়তো জ্যান্টাইলদের কিছু পরিমাণ রক্ত আমাদের সম্প্রদায়ে প্রবেশ করেছে। যাযাবর জাতি হওয়ার দরুন আমরা কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এরপরও আমাদের মাঝে জ্যান্টাইলদের রক্ত খুব কমই প্রবেশ করেছে। এমন কোনো ইউরোপীয় জাতি নেই, যারা আমাদের মতো জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।’

Aurther D. Lewis তার লেখা বই The Jews a Nation-এ ইহুদিদের জাতীয়তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-

‘জাতীয়তাবোধের জন্য আমাদের খুব সহজেই অন্য যেকোনো জাতি থেকে আলাদা করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একজন ইহুদির দিকে তাকালেই আপনি তার পরিচয় বুঝে ফেলবেন, কিন্তু একজন ইংরেজের দিকে তাকালে নাও বুঝতে পারেন, আদৌ সে ইংরেজ না ফরাসি।’

Moses Hess জাতীয়তার পরিচয় প্রদানে ইহুদিদের শারীরিক গঠন তুলে ধরেছেন—

‘ইহুদিরা বংশ পরম্পরায় যে শারীরিক গঠন পেয়ে এসেছে, চাইলেও তা কখনো অস্বীকার করতে পারবে না। যেমন : ইহুদিদের কেউ তার নাকের গঠন পরিবর্তন করতে পারবে না অথবা কালো কোঁকড়ানো চুলের গঠন থেকেও বেরিয়ে আসতে পারবে না। হাজারবার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালেও তা সোজা করা সম্ভব নয়। আমাদের শারীরিক গঠন অন্য যেকোনো জাতি- গোষ্ঠী থেকে আলাদা। আমরা যেভাবে জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রেখেছি, তা আর অন্য কোনো জাতি বজায় রাখতে পারেনি।’

আশা করি এ পর্যন্ত যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা পাঠকদের নিকট যথেষ্ট বলে গণ্য হবে। ইহুদিদের জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম যে দুটি পৃথক বিষয়, তার আরও একটি উদাহরণ দিচ্ছি। Benjamin Disrael ছিলেন একজন বিখ্যাত ইহুদি রাজনীতিবিদ। আঠারোশো শতাব্দীতে তিনি দুইবারের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিশেষ কিছু দক্ষতার জন্য রানি ভিক্টোরিয়া তাকে ‘1st Earl of Beaconsfield’ উপাধিতে ভূষিত করেন। জীবনের একপর্যায়ে তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপরও তিনি নিজেকে ইহুদি বলে পরিচয় দিতেন এবং এ নিয়ে বেশ গর্বও করতেন।

অনুরূপ আরও একজন হলেন Otto Hermann Kahn। তিনিও খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপরও তার সমগোত্রীয় জ্ঞাতি ভাইয়েরা তাকে ইহুদি ব্যতীত অন্য কিছু বলতে নারাজ। উপরন্তু ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের অন্যতম পরিকল্পনাকারী Jacob H. Schiff-এর চোখে তিনি হলেন ‘প্রিন্স অব ইজরাইল’।

এ ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, ইহুদিবাদ নিছক কোনো ধর্মীয় উপাধি নয়, যা পূর্বের অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোনো ইহুদি সদস্য কেবল ইজরাইল জাতির স্বার্থে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে, তবে তার জাতিগত পরিচয় পরিবর্তিত হবে না।

১৮৬২ সালে, Rome and Jerusalem বইটির প্রারম্ভিক অংশে লেখক Moses Hess উল্লেখ করেন—

‘কোনো বিচক্ষণ জাতি এই সত্যটি অস্বীকার করবে না যে, সামনের দিনগুলোতে ইউরোপকে চরম রাজনৈতিক ভগ্নাবস্থার সম্মুখীন হতে হবে এবং নিজেদের স্বাধীনতার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।’

এ কথার দ্বারা তিনি মূলত ইউরোপকে সতর্ক করে দিয়েছেন। সংখ্যায় কম হওয়ায় ইহুদিদের দুর্বল জাতি বলে মনে করা যে কতটা মারাত্মক ভুল হতে পারে, তিনি সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে Dr. J. Abelson বলেন—

‘আকারে ছোটো হলেও ইহুদিরা অন্য সব জাতির মতো যেকোনো বিষয়ে সমান অধিকার রাখে; যেমনটা রাখে পোলিশ, রোমানিয়ান এবং সার্বিয়ানরা।’

একই সুরে Justice Brandies বলেন—

‘প্রতিটি জাতি আজ নিজেদের পুনর্বাসন নিয়ে ব্যস্ত। একটি ছোটো জাতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা শেষ বিশ্বযুদ্ধ পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য সব জাতি নিজেদের জন্য যে অধিকার দাবি করে, আমরাও তা . সমানভাবে দাবি করার যোগ্যতা রাখি।’

Moses Hess বলেন—

‘প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের দেশগুলোতে যেমন : রাশিয়া, পোল্যান্ড, প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়াতে এখনও লাখ লাখ ইহুদি বসবাস করছে, যারা প্রতিদিন বিভিন্ন কাজের ফাঁকে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। তাদের এই প্রার্থনা কখনো বিফলে যাবে না।’

তাদের জাতি, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে বিতর্ক আগের অধ্যায়ে জন্ম নিয়েছে, তা পরিষ্কার করা সম্ভব হতো না—যদি না এসব উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা হতো। তবে তাদের ধর্ম ও জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে জ্যান্টাইলদের মাঝে যে বিভ্রান্তি, তার সুরাহা কিন্তু এখনও হয়নি। কীভাবে একজন ইহুদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করার পরও ইহুদি থাকতে পারে, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর না মেলা পর্যন্ত এই বিভ্রান্তির কোনো সুরাহা হবে না। মূলত ইহুদিদের দুমুখো নীতির কারণে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, সত্যই তা বোঝা কঠিন

ইহুদিদের ধর্ম ও জাতিতত্ত্বের প্রকৃত পরিচয়

অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মনে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে—প্রাচীন যে বনি ইসরাইল জাতির কথা বিভিন্ন পুরানে পাওয়া যায়, তাদের অপর নাম ইহুদি। বিভ্রান্তির সূচনা আসলে এখান থেকেই। প্রকৃতপক্ষে সকল ইহুদি ইজরাইলি হলেও, সকল ইজরাইলিকে ইহুদি বলা যাবে না।

বইটির প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে—’পয়গম্বর আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের ১২ জন পুত্র ছিল। একত্রে তাদের বলা হতো বনি ইসরাইল। তাদের নাম রুবেন, সাইমন, লেভি, দান, নাফতালি, গাদ, আশের, ইসাখার, জেবুলন, জোসেফ, জুদাহ (Judah) ও বেনজামিন। তাদের সবাইকে বনি ইসরাইল ছাড়া আরও একটি নামে সংজ্ঞায়িত করা হতো—হিব্রু।

তারা ছিল সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদপূর্ণ একটি জাতি। ফলে তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এসেছে অসংখ্য পয়গম্বর। বাইবেল ও অন্যান্য পুরাণে উল্লিখিত গল্পসমূহ যেমন : তাদের মিশরে গমন, ফেরাউন কর্তৃক নির্যাতন, মোজেসের জন্মগ্রহণ, লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে সিনাই পর্বতে অবস্থান ইত্যাদি ঐতিহাসিক গল্প আমরা সবাই জানি।

১৯৯৪ সালে লেখক Israel Shahk ইহুদি জাতির ইতিহাস নিয়ে একটি বই রচনা করেন, যার নাম Jewish History, Jewish Religion: The Weight of Three Thousand Years। নিচের আলোচিত অংশটুকু বইটি থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো—

‘বাইবেলের হিসাব অনুযায়ী মিশরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তারা সিনাই উপত্যকা পাড়ি দিয়ে প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করে। এর প্রায় ৪৫০/৫০০ বছর পর রাজা ডেভিড প্রথমবারের মতো জেরুজালেমকে শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পরলোক গমনের পর তার পুত্র সলোমন ইজরাইলকে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র হিসেব প্রতিষ্ঠিত করেন। বনি ইজরাইলের ১২ পুত্রের নাম অনুযায়ী সেই রাষ্ট্রে ১২টি প্রদেশ করা হয়। রাজা সলোমনের শাসনামলে এই রাষ্ট্র বেশ ভালোভাবেই চলছিল। তবে তার পরলোক গমনের পর এই রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তর দিকের ১০টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় ‘Kingdom of Israel’ এবং দক্ষিণের অবশিষ্ট দুটি প্রদেশ (জুদাহ ও বেনজামিন) নিয়ে গঠিত হয় Kingdom of Judah।

উত্তরাঞ্চলীয় ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে প্রথমে নির্ধারিত হয় শিখিম (Shechem) এবং পরে সামারিয়া (Samaria)। অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলীয় জুদাহের রাজধানী নির্ধারিত হয় জেরুজালেম। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে (আনুমানিক ৭২২ খ্রিষ্টপূর্ব) অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্য উত্তরাঞ্চলীয় ইজরাইল সম্পূর্ণ দখল করে নেয় এবং সেখানে থাকা ১০টি গোত্রের সবাইকে নির্বাসিত করে। তারা সেই যে হারিয়ে গেছে, আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে (৫৮৬ সালে) ব্যাবিলনিয়ানরা জুদাহ আক্রমণ করে প্রথম টেম্পল ধ্বংস এবং সেখানে থাকা দুটি গোত্রের বহুসংখ্যক অধিবাসীকে বন্দি করে।’

আশা করি পাঠকদের মনে আছে, শুরুর দিকে কয়েকটি অধ্যায়ে বলা হয়েছিল— ব্যাবিলনের বন্দি থাকা অবস্থায় এই জাতিগোষ্ঠীটি নিজেদের মধ্য হতে একজন ধর্মীয় গুরু নির্বাচন করে, যার অনুশাসন মেনে চলা তাদের সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। পরবর্তী সময়ে রোমানদের দ্বারা নির্বাসিত হলে তিনি রাজার স্বীকৃতি পান, যাকে বলা হতো Exilarch। তিনি বন্দিদের মানসিক বন্ধন মজবুত করার জন্য এক ধর্মীয় চেতনার জন্ম দেন, যা ছিল আব্রাহাম-জ্যাকব-মোজেসদের ধর্মীয় চেতনা থেকে অনেকটা ভিন্ন। এর কয়েক দশক পর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৮ সালে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য আখেমেনিডদের দ্বারা পরাজিত হলে জুদাহের অধিবাসীরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়।

তারা আবারও জেরুজালেমে ফেরে এবং দ্বিতীয় টেম্পল নির্মাণের কাজ শুরু করে। একই সঙ্গে নতুন জন্ম নেওয়া ধর্মীয় চেতনাকে নিজেদের মাঝে জিইয়ে রাখে। ধীরে ধীরে এই অনুশাসন তাদের রাষ্ট্রীয় ধর্মে রূপ লাভ করে, যাকে তাদের জাতিগত নাম অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করা হয়। অর্থাৎ জুদাহ (Judah) থেকে জুদাইজম (Judaism)।

তবে নতুন এই ধর্মের সাথে আব্রাহাম-জ্যাকব-মোজেসদের ধর্মীয় চেতনার কিছু কিছু অংশের সাথে যথেষ্ট মিল আছে। তারা উভয়ে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তথাপি ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুশাসন তাদের জীবনধারায় কতটুকু গুরুত্ব বহন করে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, ওল্ড টেস্টামেন্ট না এসেছে জুদাইজমের জন্য, আর না সৃষ্টিকর্তা তাদের জন্য পৃথক কোনো ঐশী গ্রন্থ পাঠিয়েছেন।

২০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে জুদাহ রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে নতুন এক ধর্মীয় গ্রন্থের প্রচার শুরু হয়। তার নাম তালমুদ (Talmud)। তালমুদের রয়েছে দুটি অংশ : একটি মিশনা (Mishna), অপরটি গ্যামারা (Gemara)। বিভিন্ন রাবাইয়ের অসংখ্য মৌখিক বাণীর লিখিত রূপ হলো মিশনা এবং তার ব্যাখ্যাসমূহ রয়েছে গ্যামারাতে। আদৌ কি এই তালমুদ সৃষ্টিকর্তা কোনো পয়গম্বরের মাধ্যমে জুদাহবাসীদের নিকট পাঠিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু ইতিহাসবিদ, যেমন—Benjamin Freedman বলেছেন—

‘এই তালমুদ কখনো সৃষ্টিকর্তার বাণী হতে পারে না। এই তালমুদ যেকোনো পাঠক নিজ উদ্যোগে পাঠ করতে শুরু করলেই বুঝবেন, এটা কেন সৃষ্টিকর্তার বাণী হতে পারে না।’

ইহুদিদের ধর্ম ও জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে পূর্বের অধ্যায়ে যে বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে, এবার সে প্রসঙ্গে আশা যাক। ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, পোলিশ, রুশ ইত্যাদি যেমন ব্রিটেন, পর্তুগাল, পোল্যান্ড ও রাশিয়ার অধিবাসীদের জাতীয় পরিচয় বহন করে, তেমনি ‘ইহুদি’ শব্দটি জুদাহ রাজ্যের (Kingdom of Judah) অধিবাসীদের জাতীয় পরিচয় বহন করে। তবে ৭০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে যেহেতু এই রাজ্যের আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তাই তারা বংশ পরম্পরায় এই জাতীয়তাকে টিকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ইহুদি পিতা-মাতার ঔরসজাত সন্তানরা সবাই জুদাহ রাজ্যের উত্তরাধিকারী। এই জাতীয়তা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া; সম্পত্তির ভিত্তিতে নেয়। এখন ব্রিটেন বা পর্তুগালে বসবাসরত কোনো অধিবাসী খ্রিষ্টান ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরও যেমন তার জাতিগত পরিচয় ব্রিটিশ বা পর্তুগিজ মুছে যাবে না, ঠিক তেমনি জুদাহ রাজ্যের কোনো অধিবাসী জুদাইজম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে তার জাতিগত পরিচয় ‘ইহুদি’ মুছে যাবে না। ঠিক এ কারণে আগের অধ্যায়ে বলা হয়েছে—Benjamin Disraeli ও Otto Hermann Kahn জীবনের একটা পর্যায়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তারা নিজেদের ইহুদি বলে দাবি করতেন।

তাহলে এই অংশে প্রমাণিত হলো—জাতীয়তার ভিত্তিতে আমেরিকায় যে আদমশুমারি করার প্রস্তাবনা উঠেছিল, তাতে ইহুদিদের একটি জাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু তারা ধর্মকে সেখানে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছে।

(বি.দ্র. তবে ইসলাম ধর্ম মতে, পয়গম্বর মূসা -এর অনুসারী সবাইকে বলা হয় ইহুদি। এর সূচনা হয়েছিল পয়গম্বর ইয়াকূব -এর বনি ইসরাইল জাতির মধ্য দিয়ে।)

অ্যান্টি-সেমিটিজম কী? শুরুর দিকে একটি অধ্যায়ে এ বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। জেনে রাখা উচিত, সেমেটিক দ্বারা একগুচ্ছ ভাষাকে বোঝানো হয়। যেমন : হিব্রু, আমহারিক, তিগরিনিয়া, আরবি, আরামাইক ইত্যাদি। যারা এ সকল ভাষায় কথা বলে, তাদের বলা হয় সেমাইট। অর্থাৎ যারা এ সকল ভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে থাকে, তাদের বলা হয় অ্যান্টি-সেমাইট; এখানে ধর্ম কোনো মুখ্য বিষয় নয়।

মুসলিম ও খ্রিষ্টানরাও নিজেদের সেমাইট বলে পরিচয় দিতে পারে, যদি তাদের ব্যবহৃত মুখের ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠীর যেকোনো একটি হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে পুনঃগঠিত ইজরাইল বিষয়টিকে সম্পূর্ণ নিজেদের সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। যদি কোনো ব্যক্তি ইহুদিদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে; হোক তা সত্য বা মিথ্যা, তবে তার ওপর অ্যান্টি-সেমাইট লেবেল চাপিয়ে দেওয়া হয়।

আজকের পৃথিবীতে যে এত মিলিয়ন মিলিয়ন ইহুদির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তারা কি আদৌ জুদাহ রাজ্যের প্রকৃত ঔরসজাত সন্তান? এ নতুন এক বিতর্কের জন্ম দেয়।

বলে রাখা উচিত, বর্তমান পৃথিবীতে যারা নিজেদের আদিম জুদাহ রাজ্যের উত্তরসূরি বলে দাবি করছে, তাদের অধিকাংশই সেই ঐতিহাসিক রাজ্যের প্রকৃত উত্তরসূরি নয়। তাদের অনেকের পূর্বপুরুষ প্রাচীন জেরুজালেমে কখনো পা পর্যন্ত রাখেনি। তাহলে তারা কীভাবে এই ভূমিকে নিজেদের বলে দাবি করছে? আর তারা যদি নকল ইহুদি হয়, তাহলে প্রকৃত ইহুদিরা কোথায়?

বিষয়টি যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি রহস্যময়। ১৯৭৬ সালে Arthur Koestler-এর প্রকাশিত বই The Thirteenth Tribe হতে নিচের অংশটুকু তুলে ধরা হলো—

‘আপনাদের অনেকেই আছেন যারা খাজারিয়ান (Khazarian) সাম্রাজ্যের কথা জানেন না। মধ্যযুগের শুরু থেকে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা ককেশাস পর্বতমালার অববাহিকায় বসবাস করত। কৃষ্ণসাগর থেকে কাস্পিয়ান হ্রদ পর্যন্ত সরু অঞ্চলটি এবং উত্তরের বিশাল সীমানাজুড়ে ছিল তাদের সাম্রাজ্য। তারা ছিল মধ্যযুগের অতীব শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্য, কিন্তু তারপরও তাদের নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না।

টার্কিশ, হান, পেশেনেগ এবং আরও অনেক জাতির সমন্বয়ে এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম খুব দ্রুত পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরলেও এই অংশে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়। রুশ ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সেকালে প্রচণ্ড প্রতাপশালী হওয়ার পরও খাজারিয়ানদের কর দিয়ে পারস্পরিক বাণিজ্য করত। শুরুতে তারা জাতি হিসেবে পেগান হলেও দশম শতাব্দীর শেষের দিকে রাজনৈতিক কিছু কারণে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে। সবশেষে মোঙ্গলদের আক্রমণে তারা সাম্রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয়। এরপর তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আজকের পৃথিবীতে তারা আস্কেনাজি ইহুদি নামে পরিচিত এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে প্রাচীন জুদাহ রাজ্যের ইহুদিদের বহু আগেই অতিক্রম করেছে।

প্যালেস্টাইন পুনর্দখলের লক্ষ্যে জায়োনিস্টদের যে আগ্রাসন, তার প্রথম আহ্বান তাদের মধ্য থেকেই আসে। নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় যে ইজরাইলিদের নাম দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই এই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে তারা কীভাবে এতটা ধূর্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে, তা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু গবেষণা হয়েছে।

জুদাইজম (Judaism) যেভাবে ইহুদিবাদে (Jews) রূপ নিল

পূর্বের অধ্যায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে—জুদাহ রাজ্যের অধিবাসীরা নিজেদের মাঝে যে ধর্মীয় চেতনার জন্ম দিয়েছে, পরবর্তী সময়ে তা-ই জুদাইজমে (Judaism) রূপ লাভ করেছে। কিন্তু তা কীভাবে ‘ইহুদিবাদ’ (Jew) শব্দে রূপায়িত হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। বিষয়টি অনেক জটিল, তবে এই জটিলতার অনুসন্ধান করা অতীব জরুরি। কারণ, এর পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্যময় ধাঁধার সমাধান।

১৯৫৪ সালে প্রকাশিত Benjamin H. Freedman-এর লেখা বই Facts Are Facts এই পুরো অনুসন্ধানে আমাদের বিশেষভাবে সহযোগিতা করবে। নিচের পুরো আলোচনা এ বইটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো—

যীশুর জীবদ্দশায় Pontius Pilate ছিলেন প্যালেস্টাইনে নিযুক্ত রোমান সাম্রাজ্যের একজন গভর্নর। তার কাজ ছিল কর সংগ্রহ করা এবং তা রোমান রাজার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া। স্থানীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো তার কাজের অংশ ছিল না। তারপরও যীশুর ক্রুশবিদ্ধের কাজটি তার তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন হয়। তাকে যে ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল, তার ওপর ল্যাটিন ভাষায় লিখা ছিল——Iesus Nazarenus Rex Iudeorum’

‘Jesus of Nazarene Ruler of the Judeans’ I

‘যীশুর জীবদ্দশায় আধুনিক প্যালেস্টাইনকে তখন বলা হতো ‘Iudaea’। অর্থাৎ সে অঞ্চলের সকল অধিবাসীকে বলা হতো ‘Iudaeus’, যার বহুবচন হলো ‘Iudaeorum’। ইংরেজি ভাষায় রূপান্তর করলে এর অর্থ দাঁড়ায়— ‘Judeans’।

‘গসপেল অব জন’ সর্বপ্রথম গ্রিক ভাষায় লেখা হয়। চতুর্থ শতাব্দীতে St. Jerome সর্বপ্রথম নিউ টেস্টামেন্টকে গ্রিক থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন, তবে তিনি সব বাক্য ও শব্দের ল্যাটিন অনুবাদ করেননি। অনূদিত ভার্সনটিতে তখনও অনেক গ্রিক শব্দের উপস্থিতি ছিল। কারণ, সেই শব্দগুলোর সঠিক ল্যাটিন ভাষান্তর করা সম্ভব হচ্ছিল না।

পঞ্চম শতাব্দী থেকে বাইবেল শ’খানেক ভাষায় অনূদিত হয়। তবে ল্যাটিন ভার্সনটি ছিল খুবই প্রভাবশালী। এরপর বিভিন্ন ভাষায় পূর্বে প্রকাশিত অনূদিত টেস্টামেন্টের পরিমার্জিত ও সংশোধিতরূপ প্রকাশ হতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজি ভাষায় যে টেস্টামেন্ট প্রকাশিত হয়, তা ছিল ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত Douai-Rheims এবং ১৬১১ সালে প্রকাশিত King James ভার্সন দুটির অনূদিত রূপ

তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে (১৭৭৫ সালে) প্রকাশিত ইংরেজি ভার্সনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব আছে। বাইবেলের ইতিহাসে ইহুদি (Jew) শব্দটি প্রথমবারের মতো এই ভার্সনটিতে সংযোজন করা হয়। এর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত বাইবেল বা টেস্টামেন্টের ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে, তার একটিতেও ইহুদি (Jew) শব্দের উল্লেখ ছিল না। (পাঠকদের এ অংশটি বোঝার জন্য বাংলা ‘ইহুদি’ শব্দটির পরিবর্তে ইংরেজি Jew শব্দটি বেছে নিতে হবে।)

এমনকী পূর্বেকার প্রকাশিত সাহিত্যিক রচনাগুলোতেও Jew শব্দটির উল্লেখ ছিল না। যেমন : শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ উল্লেখ ছিল- ‘What is the reason? I am a lewe (Jew); hath not lewe (Jews) eyes?”

ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরেজিতে প্রকাশিত গসপেলের ১৯ : ২১ শ্লোকটি হলো—’Do not inscribe- the noarch of the Judeans (Ioudaios), but that He himself said I am monarch of the Judeans (Ioudaios)।’ অর্থাৎ এখানে জুদানদের ধর্মযাজকরা পিলাতকে বলেন—’এখানে জুদানদের (আইওডেওস) রাজা না লিখে তার পরিবর্তে লেখ—এই লোক বলেছে, আমিই জুদানদের (আইওডেওস) রাজা।’

কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে প্রতিটি ‘Judeans’ শব্দকে পালটে ‘Jews’ করে দেওয়া হয়। ল্যাটিন শব্দ ‘Iudaeus’ থেকে যেভাবে ‘Jew’ শব্দের বিবর্তন হলো, তার একটি ধারা উপস্থান করা যাক : Gyu> Giu> Iu> luu> luw> leuu> Ieuy> Iwe> low> lewe> Ieue> Iue> Ive> Iew> Jew.

ভাষাবিদরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ইংরেজি একটি মিশ্র ভাষা। এর প্রাচীন অ্যাংলো- সেক্সন ভাষাটি বহুজাতিক ভাষার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অ্যাংলো-সেক্সনরা ব্রিটেনে অনুপ্রবেশ করলে স্থানীয়দের মাঝে বহুবিধ মিশ্র ভাষা ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করে। সে ধারা আজও অব্যাহত আছে। ভাষা শিক্ষার্থীরা স্বীকার করবে—ল্যাটিন বৰ্ণ ‘I’ যখন কোনো শব্দের প্রথমে ব্যবহৃত হয়, তখন তার উচ্চারণ ইংরেজি বর্ণ ‘y’-এর মতো হয়। যেমন : Yes ও Youth ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ইংরেজি বর্ণ ‘J’ যদি কোনো শব্দের শুরুতে ব্যবহৃত হতো, তখন তার উচ্চারণ হতো ঠিক ‘Y’-এর মতো। অর্থাৎ ‘J’-এর উচ্চারণগত বিবর্তন খুব সমসাময়িক একটি ঘটনা। অপরদিকে, জার্মান ভাষায় আজও ল্যাটিন উচ্চারণরীতি বজায় রয়েছে। জার্মান ভাষায় ‘J’ বর্ণটি ইংরেজি বর্ণ ‘Y’-এর মতো উচ্চারিত হয়। তাহলে জার্মান ভাষায় ‘Jude’ শব্দটির উচ্চারণ অবিকল ল্যাটিন শব্দ ‘Iudae’-এর মতো হয়। এই ‘Jude’ শব্দটির ধ্বনিগত পরিবর্তন পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়ে হয় ‘Jew’। তথাপি জার্মান ভাষায় আজও এর উচ্চারণ ল্যাটিন শব্দ ‘Iudae’-এর মতো। কিন্তু ইংরেজি বর্ণ ‘J’ যেহেতু ধ্বনিগত পরিবর্তিত হয়ে ‘জ্য’-তে রূপ নিয়েছে, সেহেতু ইংরেজি ভাষায় তার উচ্চারণ পালটে গিয়ে হয়েছে ‘Jew (জু)’ ও ‘Judea’ পালটে হয় ‘Judaism (জুদাইজম)’।

অষ্টাদশ শতাব্দীর আরেকটি বিশেষত্ব হলো—সে বছর প্রিন্টিং মেশিনের বহুমুখী ব্যবহার শুরু হয়। ফলে প্রচুরসংখ্যক বাইবেল প্রিন্ট করা শুরু হয় এবং তা অল্পমূল্যে প্রত্যেক গির্জা ও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে শুরু করে। যারা এতদিন খরচের ভয়ে বাইবেল ক্রয়ের সাহস করত না, তখন তারাও স্বল্পমূল্যে ক্রয় করার সুযোগ পায়। খ্রিষ্টানদের প্রতিটি গির্জা ও ঘরে ঘরে উচ্চারিত হতে শুরু হলো—Jesus is a Jew; Jews are god choosen people; Get blessings from Israel এবং আরও অনেক।

ধীরে ধীরে নিউ টেস্টামেন্ট রূপান্তরিত হলো ইহুদিদের প্রশংসাবাণীতে। তবে কিছু বিষয় না বললেই নয়। ইংরেজি ডিকশনারিগুলো খুললে হয়তো Jews ও Iudaeus শব্দ দুটির অর্থ প্রায় একই দেখাবে—একদল হিব্রু জনগোষ্ঠী, যারা পয়গম্বর আব্রাহামের বংশধর হিসেবে একসময় জেরুজালেমে থাকত। তবে শাব্দিক অর্থ এক হলেও Jews ও Iudaeus জাতি দুটির মাঝে বড়ো ধরনের ফারাক রয়েছে।

Iudaeus দ্বারা যেখানে বোঝানো হতো যীশুখ্রিষ্টের জীবদ্দশায় প্যালেস্টাইনে বসবাসরত সকল অধিবাসীদের, সেখানে Jews দ্বারা বোঝানো হয় জুদাহ রাজ্যের সকল উত্তরাধীদের। মাঝ থেকে বাদ পড়ে গেল ইজরাইলের বাকি ১০টি গোত্র, যারাও কিনা বনি ইজরাইলের অংশ। তাই বর্তমান যুগের বাইবেল পাঠ করলে মনে হবে, কেবল Jews-রাই প্রাচীন ইজরাইলের প্রতিনিধিত্বকারী এবং এটিই বনি ইজরাইলের অপর একটি নাম। ঠিক এ কারণে বিশেষ এই ধারণাটি অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মনে বধ্যমূল হয়ে চেপে বসেছে।

এরপরও একটি গল্প বাকি থেকে যায়। প্রাচীন যে খাজারিয়ান সাম্রাজ্যের কথা পূর্বের অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তারা মধ্যযুগের কোনো একটি সময়ে রাজনৈতিক কারণে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে। আর এরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে জুদাহ রাষ্ট্রের অধিবাসীদের বহু আগেই অতিক্রম করে ফেলেছে। আজ ইজরাইল, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে যে পরিমাণ ইহুদি দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই প্রাচীন জুদাহ রাজ্যের উত্তরসূরি নয়; বরং তারা মধ্যযুগে ধর্মান্তরিত হওয়া খাজারিয়ান রাজ্যের উত্তরসূরি।

তা ছাড়া ১৯১৭ সালের পর থেকে যে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনিদের উচ্ছেদ করে তাদের ভূমি দখল করে চলেছে, তাদের অধিকাংশেরই পূর্বপুরুষ কস্মিনকালেও এই ভূমিতে পা রাখেনি, তবুও তারা এই ভূমিকে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ভূমি এবং বাপ-দাদার আদি ভূমি বলে দাবি করে আসছে।’

মজার বিষয় হলো—তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই, খাজারিয়ানরা ধর্মান্তরিত হওয়ার দরুন জুদাহ রাজ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে, তবুও বেলফোর ঘোষণার মধ্যদিয়ে নবগঠিত ইজরাইল রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ইহুদিদের রাষ্ট্র বলা যাবে না। কারণ, প্রাচীন ইজরাইল গড়ে উঠেছিল ১২টি গোত্রের ভিত্তিতে। যদি ধরে নিই, আধুনিক ইহুদিদের মাঝে প্রাচীন জুদাহ ও বেনজামিনের উত্তরসূরিরা নিহিত রয়েছে, তাহলে বাকি ১০টি গোত্রের সদস্যরা কোথায়?

ইহুদিদের সমাজে আনুগত্যহীনতার চূড়ান্ত পরিণতি

আশা করি পূর্বের অধ্যায়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, ‘ইহুদিবাদ’ কেবল ধর্মীয় পরিচয় নয়; এটা একই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়, যা ইজরাইলের প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি কোনো ব্যক্তি হাজার বছরের জাতীয় ঐতিহ্য ও সমাজব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়; হোক তা খ্রিষ্ট বা ইসলাম, তারপরও সে ইহুদি থাকবে।

Jewish Encyclopedia অনুযায়ী—এই সমাজব্যবস্থার নাম হলো ‘কাহাল’। এর আরও একটি নাম আছে ‘সোভিয়েত’। ধর্মের প্রতি কে কতটুকু অনুগত, তা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি কোনো ব্যক্তি কাহালকে অস্বীকার করে, তবে তার ইহুদিবাদত্ব শেষ হয়ে যাবে এবং তাকে সমাজ থেকে বর্জন করা হবে। সে অন্য ধর্ম গ্রহণ না করলেও কেবল ‘কাহাল’-কে অস্বীকার করার কারণে ইহুদি থেকে খারিজ হয়ে যাবে। ১৭তম প্রটোকলে বলা হয়েছে—

‘আমাদের প্রতিটি ভাইয়ের উচিত তাদের সেই সব পারিবারিক সদস্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, যারা কাহালকে অস্বীকার করে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে এই অনুশাসন মেনে চলা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। ‘

কাহাল অস্বীকার করার কারণে যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা মামুলি কোনো ঘটনা নয়। নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে রক্ত বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে তারা বহু শতাব্দী যাবৎ আন্তঃবিবাহের সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে।

একটা সময় ছিল, যখন ইহুদিদের কোনো সদস্য নিজ সম্প্রদায়ের বাহিরে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতো এবং পুরো সমাজ তাকে বয়কট করত। এটি ছিল কাহালভিত্তিক সমাজব্যবস্থার একটি অংশ, তবে বিংশ শতাব্দীতে আন্তঃবিবাহের প্রতি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও হ্রাস পাওয়া শুরু করে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব লাভ, ব্যবসায় সম্প্রসারণ, গুপ্তচর হিসেবে অনুপ্রবেশ এবং রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে তারা বহির্বিবাহকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে।

কাহাল অস্বীকার করার কারণে যে কঠিন শাস্তি ভোগের কথা বলা হয়েছে, তা আলোচনা না করলেই নয়। উদাহরণ হিসেবে Spinoza-কে সামনে নিয়ে আসা যায়। তিনি ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক, কিন্তু তিনি ইহুদি ধর্মের কঠোর সমালোচক ছিলেন। কারণ, তিনি স্বাধীন চেতনায় বিশ্বাস করতেন। তার জ্ঞান-দর্শন একসময় এই সম্প্রদায়টির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে নিউ টেস্টামেন্টে উল্লিখিত ‘Commandments of Men’ সম্পর্কে তিনি যা বলতেন, তা তৎকালীন ধর্মযাজকদের সাথে মতপার্থক্যের জন্ম দেয়। তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে অনেক মানুষ তার অনুসারী হতে শুরু করে। তিনি যেন মুখ বন্ধ রাখেন, এজন্য তার নিকট বড়ো অঙ্কের আর্থিক উপঢৌকনের প্রস্তাব করা হয়।

অতি প্রাচীনকাল থেকে তারা আর্থিক উপঢৌকনকে একপ্রকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তাদের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে এ বিষয়টি হরহামেশাই দেখা যায়। Jacob Israel De Haan হলেন একজন বিখ্যাত ইহুদি লেখক ও ডাচ আইনবিদ। প্যালেস্টাইন ইস্যুতে আরব-ইজরাইল যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনের জন্য তিনি আর্থিক উপঢৌকনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন—

‘জায়োনিস্টদের ধ্বংস করতে আরব দেশগুলো আজ উত্তেজিত। তবে তাদের পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক উপঢৌকনের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে। এই দুর্বলতা তাদের পরাজয় ও দীর্ঘ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

তারা Spinoza-কে বাৎসরিক ১ হাজার ফ্লোরিন (Florins) উপঢৌকন প্রদানের প্রস্তাব করে। শর্ত হলো—তিনি ইহুদি ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ধরে রাখবেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত হাজিরা দেবেন, কিন্তু তিনি ঘৃণার সাথে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রয়োজনে পশমি পোশাক তৈরি করে জীবন পার করবেন, তবুও এমন কু-প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

সমাজে জনপ্রিয়তা বেশি থাকার কারণে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করার সাহস কারোরই ছিল না। তাই বড়ো এক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তাকে একঘরে এবং সর্ব সাধারণের সাথে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়। অনুষ্ঠানটির অংশবিশেষ নিচে উপস্থাপন করা হলো :

‘অবশেষে নির্ধারিত দিনটি চলে এলো। এই ঘটনার সাক্ষী হতে প্রচুর মানুষ চারদিক থেকে জমায়েত হলো। হঠাৎ এক নির্দেশে সবাই চুপ হয়ে গেল। চারপাশ নীরব করে জ্বালানো হলো কালো রঙের মোম। তারপর উপাসনালয়ের পবিত্র স্থান থেকে “Law of Moses” গ্রন্থ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো ঘটনার মূল আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান ধর্মীয় গুরু, যিনি একসময় Spinoza সাহেবের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, আজ তিনিই মূল কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। বন্ধুর জন্য হৃদয়ে মায়া অনুভব করলেও আজ তাকে কঠিন রূপ ধারণ করতে হচ্ছে। উৎসাহী চোখগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ অজস্র শোকার্ত কণ্ঠে অভিসম্পাতের কীর্তন বেজে উঠল। সাথে সাথে চারদিক থেকে বেজে উঠল বাঁশের ভেঁপুর করুণ সুর, যা পুরো পরিবেশকে আরও মর্মস্পর্শী করে তুলল। এবার কালো মোমগুলো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্তে পূর্ণ একটি জারের ভেতর পড়তে শুরু করল।’ (Lewes : Biographical History of Philosophy)

এরপর শুরু হলো চূড়ান্ত ধাপ। আদেশনামা পাঠ—

‘উপস্থিত সকল ঋষি, দেবদূত ও গুরুজনের সম্মতিক্রমে কার্যবিধি ৬১৩ ধারা অনুযায়ী—যেখানে Joshua অভিসম্পাত করেছেন Jericho-কে এবং Elisha অভিসম্পাত করেছেন তার সন্তানদের, তার ভিত্তিতে আমরা সবাই Baruch de Spinoza-কে অভিসম্পাত করছি এবং তার সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করছি। তাকে অভিসম্পাত করছি দিনে ও রাতে, তার জাগ্রত ও নিদ্রিত অবস্থার ওপর এবং তার যাবতীয় সব কাজের ওপর। স্রষ্টাও যেন তাকে ক্ষমা না করেন। স্রষ্টার ক্রোধ ও উন্মত্ততার আগুন যেন তার ওপর প্রজ্বলিত হয়। সকল অভিসম্পাতবাণী যেন তার ওপর শায়িত হয়। প্রস্ফুটিত দেবকরের উপস্থিতিতে আমরা তার ধ্বংস কামনা করছি। তার ধ্বংস হোক ইজরাইলের প্রতি পৃষ্ঠতা প্রদর্শনের জন্য। মহাজগতের সকল অভিসম্পাৎ তার ওপর পতিত হোক, যেমনটা এই গ্রন্থে লেখা আছে। সতর্ক করে দিচ্ছি, কেউ যেন তার সাথে বাক্য বিনিময় না করে। কেউ যেন তার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন না করে। কেউ যেন তার সাথে এক ছাদের নিচে না থাকে এবং কেউ যেন তার লেখা পাণ্ডুলিপি পাঠ না করে।’ (Pollock: Life of Spinoza)

‘শেষ বাক্যগুলো পাঠের সময় মোম রাখার পাত্রগুলো রক্তে পূর্ণ হয়ে গেল এবং চারদিকে মর্মস্পর্শী কান্নার রোল পড়ে গেল। আবারও কীর্তন বেজে উঠল 1 রহস্যময় অন্ধকার ভেদ করে সবার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো—আমেন! আমেন!’

(Professor J. K. Hosmer: The Jews)

এভাবে Spinoza-কে তাদের সম্প্রদায় হতে বহিষ্কার করা হয়। অধ্যায়ের শুরুতে কাহালের অপর নাম সোভিয়েত দেখে অনেকে হয়তো বিষয় দুটিকে এক করে ফেলছেন, তাই বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার।

মূলত, কাহাল আর সোভিয়েত এক বিষয় নয়; এদের মাঝে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। সোভিয়েত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কমিউনিজমকে সামনে রেখে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সকল সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র নিজেই। আর জনগণ একটি নির্ধারিত পরিমাণের বেশি সম্পদ মজুত করতে পারবে না। রাষ্ট্র জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সেই সম্পদ বণ্টন করবে। অন্যদিকে কাহাল বলে, জনগণ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ সংরক্ষণ করতে পারবে। এর সাথে কিছুটা পুঁজিবাদের মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ মুখে সাম্যবাদের (কমিউনিজম) কথা বললেও অন্তরে পুঁজিবাদ। তারা সাম্যবাদের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখল করবে, কিন্তু সম্পদ বণ্টন করবে পুঁজিবাদের মতো। তাদের এই সমাজব্যবস্থা ইতোমধ্যে রোম, ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ডেনমার্ক, ইতালি, রোমানিয়া, তুরস্ক ও ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকাতেও এর যথেষ্ট অস্তিত্ব চোখে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *