জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক

জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক

পুলিশের চাকরিতে শান্তি নেই। চাকরিতে ঢোকার আগে যদি ঘুণাক্ষরেও এটা টের পেতেন, তাহলে শান্তিবাবু কখনোই এই চাকরিতে ঢুকতেন না। মুখেভাত দেওয়ার আগে বড়ো সাধ করে বাবা-মা নাম রেখেছিলেন শান্তিময়। কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পর তাঁর গোটা জীবনটাই হয়ে উঠেছে অশান্তিময়। একবার ভেবেছিলেন, কোর্টে গিয়ে নামটা আইনসম্মতভাবে পালটে নেবেন। মনের এই ইচ্ছে স্ত্রীর কাছে প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘নাম বদলালেই কি তোমার জীবনে শান্তি আসবে?’

স্ত্রীর যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তা ছাড়া শান্তিময় নিজের স্ত্রীকে মান্যও করেন। কারণ, তাঁর শ্বশুরমশাই হলেন মিলিটারির লোক। পুলিশের লোক যেমন মিলিটারির লোককে সমীহ করে, তেমনই পুলিশের বউ মিলিটারির একমাত্র মেয়ে হলে, তাঁকেও সমীহ করতে হয়। তাঁর শ্বশুরমশাই সাধারণ লোক নন। শুধু যে মিলিটারি তাই নন, মেজাজও তাঁর পেশার মতো। সেই যে কথায় বলে না, মিলিটারি মেজাজ, ঠিক তেমনই। বিয়ের সময় যখন কন্যা সম্প্রদান করছিলেন, তখনও ট্যাঁকে নস্যির ডিবে গোঁজার মতো করে একখানা রিভলভার গোঁজা ছিল। পুরোহিতমশাই বিয়ের মন্ত্র বলছিলেন ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপাকাঁপা গলায়। বরযাত্রীদের খাওয়ার সময় যখন আপ্যায়ন করছিলেন, তখনও তাঁর গলায় ঝুলছিল একটা বেঁটে বন্দুক। ওইরকম বেঁটে বন্দুক পুলিশি চাকরিতে তখনও শান্তিময় দেখেননি।

যখন বিয়ে করেছিলেন, তখন থানার দারোগা হননি। এখন দারোগা হয়েছেন। পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অশান্তিও বেড়েছে। চুন থেকে পান খসলেই লোকে তাঁর নামে গালাগাল দেয়। স্থানীয় পত্রিকা, টেনেটুনে পাঁচশো কপিও বিক্রি হয় না, কিন্তু সেও হয়-কথায় নয়-কথায় তাঁকে কাগজে-কলমে তুলোধনা করে। একটা আধা শহরে একটা-দুটো চুরি, এক-আধটু ছিনতাই, মারদাঙ্গা এসব তো হয়েই থাকে। কোন দেশে না-হয় ! তাঁর এলাকাতেও হত। ওই এলাকায় বলরাম নামে একজন লোক থাকত। তার কিছু দলবল ছিল। ফলে তার চালচলনই আলাদা। শান্তিদারোগা, ওই নামেই সকলে তাঁকে জানত, বলরামও বলত ‘শান্তিদারোগা’। একদিন সন্ধেয় শান্তিদারোগার কাছে বলরামের ফোন এল। ফোনেই ধমক দিয়ে বলরাম বলল, ‘শান্তিবাবু, আপনি ভেবেছেন কী? আমার দলের ছেলেকে অ্যারেস্ট করেছেন?’

ফোনে বলরামের গলা শুনেই মনে মনে কেঁপে উঠলেন শান্তিদারোগা। তিনি জানেন, বেশি বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে গঙ্গাপুরের দারোগাবাবুর গঙ্গাযাত্রা হয়ে গিয়েছে।

পরে উপরতলার পুলিশ এসে যত তদারকিই করুন, গঙ্গাপুরের দারোগা তো আর ফিরে আসেননি। অতএব তিনি যথোচিত বিনয় দেখিয়ে বললেন, ‘ভাই বলু, আমি তো জেনেশুনে ওকে অ্যারেস্ট করিনি। কী করে জানব বাবা, ওই গালকাটা বিল্টে তোমার লোক। তুমি এসে ওকে নিয়ে যাও। ওকে এখনও কোনো কেস দিইনি।’

বলু আসে। শান্তিদারোগার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে। দারোগার নির্দেশ দেওয়া ছিল, তাই একজন সেপাই একখানা বড়ো প্লেটে দু-টো রাজভোগ, দু-খানা গরম শিঙাড়া, আর কিছু কুচো নিমকি এনে দেয়। বলরাম অর্থাৎ বলু বলল, ‘এসব আবার কেন!’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘বেশি কিছু নয়, সামান্য একটু জলখাবার। থানার দারোগা বলে তো আর আলাদা জগতের লোক নই। আতিথেয়তা, ভদ্রতা, এসব তো আমাদেরও আছে।’

বলরাম রাজভোগ মুখে তোলে। মুখে রাজভোগ থাকায় কথা বলতে পারে না। ততক্ষণে বলুর লোক গালকাটা বিল্টে এসে গিয়েছে। বলু সামনের প্লেটটা হাতের ইশারায় বিল্টেকে দেখিয়ে, খেতে ইঙ্গিত করে। বিল্টে কোনো রকম দ্বিধা না-করে প্লেট থেকে একটা রাজভোগ মুখে দিয়ে শান্তিদারোগার দিকে তাকায়।

এইরকমভাবে সকলকে খোশামোদ করে, খাতির করে শান্তিদারোগা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্য জায়গায় গুন্ডা-বদমাইশরা পুলিশকে ঘুষ দেয়। অর্থাৎ পুলিশ তাদের কাছ থেকে নাকি তোলা তোলে। কিন্তু শান্তিদারোগা তাঁর এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে উলটো পদ্ধতি নিয়েছেন। তিনি নিজেই মাসের তিন তারিখ থেকে সাত তারিখের মধ্যে পাঁচজনকে তোলা দেন। অর্থাৎ টাকা দেন। কারণ, বলরাম, হারু মণ্ডল, কানকাটা শিবে, ল্যাংড়া কানাই, টেকো কার্তিক, এই পাঁচজন হলে এই গ্রামের পয়লা নম্বর গুন্ডা। খুন, ডাকাতি, ছিনতাই সবই এরা করে। শান্তিদারোগা যখন বুঝলেন, এদের প্রত্যেকেরই বড়ো গাছে নৌকো বাঁধা আছে এবং শান্তিদারোগার সাধ্যি নেই এদের কাউকে ধরে তাঁর থানার লকআপে দু-ঘন্টার বেশি আটকে রাখেন। এই দু-ঘন্টার মধ্যে ফোনাফুনি চলবে এবং শেষপর্যন্ত তাঁর কাছে ফোনে যে অর্ডারটি আসবে, তা হল, ওদের ছেড়ে দিন। তার চেয়ে সরাসরি ওদের সঙ্গে রফা করে নেওয়াই ভালো। মাসে-মাসে টাকা নাও, কিন্তু আমার এলাকায় কোনো ঝামেলা কোরো না। খাল পেরোলেই তো অন্য থানার এলাকা। যা খুশি ওখানে করো। আমি বরং তোমাদের খাল পেরোবার জন্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দেব। জনগণ ভাববে তাদের সুবিধের জন্য হল।

এই রকম ব্যবস্থা করে শান্তিদারোগা মোটামুটি ভালোই ছিলেন। কিন্তু ভালো থাকা তাঁর কপালে নেই। অশান্তি যেন কিছুতেই তাঁর পিছু ছাড়ে না। ওই পাঁচজনের সঙ্গে রফা হওয়ার পর এই এলাকায় সবে শান্তি আসছে, ঠিক তখনই নতুন বিপদ দেখা দিল। যা ঘটল সেটা খুন, ডাকাতি, লুটপাট বা মারদাঙ্গা, এইসব শ্রেণিতে পড়ে না। এই নতুন বিপদের নাম ‘অপহরণ’। হালদার পাড়ার যোগেন হালদারকে অপহরণ করা হল। ফোনে বলা হল, ‘তিন দিনের মধ্যে তিন লাখ টাকা না-পেলে, আপনারা যোগেন হালদারের লাশ পাবেন।’

হালদার পাড়ার লোক এবং যোগেন হালদারের স্ত্রী এসে শান্তিদারোগাকে ধরলেন। শান্তিদারোগা তো এসব ব্যাপারের কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি বাধ্য হয়ে বলরামসহ পঞ্চগুন্ডাকে খবর দিলেন, তাদের সাহায্য চাইলেন। টেকো কার্তিক, তার টাক মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘এসব ছ্যাঁচড়ামো তো আমাদের গাঁয়ে ছিল না। হিম্মত থাকে তো খুন করো। বোম মেরে বাড়ি উড়িয়ে দে। সেসব না-করে একটা বুড়োকে আটকে রেখে টাকা চাইছে! ছিঃ ছিঃ, এটাকে কি ভদ্রভাবে উপার্জন বলে?’

সবাই ভাবছিল। ভেবে যাচ্ছিল। শান্তিদারোগা বললেন, ‘আমি কিন্তু বাবা তোমাদের ভরসায় হালদারবাবুর বাড়ির লোককে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছি।’

বলরাম বলল, ‘একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে। ওদের ফোনের কাছে আমি গিয়ে বসব। আপনি শুধু বলবেন, এসব আপনার প্ল্যান।’

শান্তিদারোগা আশা এবং আশঙ্কায় দুলতে-দুলতে বললেন, ‘কোনো অঘটন হবে না তো বাবা?’

বলরাম বলল, ‘না।’

বলরাম গিয়ে যখন ফোনের সামনে বসল, তখন যোগেন হালদারের স্ত্রীকে বলরাম বলল, ‘মাসিমা, আমি আপনাকে যা শিখিয়ে দেব, তাই বলবেন। তারপর ফোনটা আমাকে দেবেন।’

বলরাম পাশের ঘরে গিয়ে যোগেন হালদারের স্ত্রীকে বোঝাতে-বোঝাতেই একটা ফোন এল। স্ত্রী ফোন ধরলেন। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন অপহরণকারীদের ফোন। বলরামের শেখানো মতো স্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘টাকাপয়সা কিছু নেই। কিছুই দিতে পারব না। তাতে যদি ওকে খুন করে দাও, তাহলে বেঁচে যাই। রাতদিন ওই বুড়োর খিটখিটানি শুনতে আর ভালো লাগছে না। খুন করার পর লাশ পাঠাবার দরকার নেই। শুধু খবরটা দিলেই হবে। আমাকে বিধবার সাজ কিনতে হবে তো? কী বললে? ব্যাবসার টাকা? সবই তো ব্যাংক থেকে ধার করা। ধার শোধ হয়নি বলে ব্যাংক সব ক্রোক করে নিচ্ছে। কোর্টের নোটিশও এসে গিয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে এই নাও বাবা, ব্যাঙ্কের লোক বসে আছে। তার সঙ্গে কথা বলো।’

হালদারগিন্নি ফোনটা বলরামকে দিলেন। বলরাম ফোন ধরে বলল, ‘নমস্কার স্যার, শুনুন, যোগেন হালদারকে আপনারা মেরে ফেললেও আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। কোর্ট থেকে অর্ডার বেরিয়ে গিয়েছে। উনি বেঁচেই থাকুন আর মারাই যান, তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনাদের একটা লাভের সন্ধান দিতে পারি। আপনি মিনিটপাঁচেক পরে আমার মোবাইলে ফোন করুন। নম্বরটা হচ্ছে…’

বলরাম যখন নম্বরটা বলছিল, তখন ঘরে ঢুকলেন শান্তিদারোগা। বলরাম ফোনটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘এইবার খেলাটা দেখুন। টেকোরা এসে গিয়েছে?’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘হ্যাঁ। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।’

সকলেই অপেক্ষা করছিল বলরামের মোবাইলে কখন ফোনটা আসে। শান্তিদারোগা বললেন, ‘ভাই বলু, ফোনটা আসবে তো?’

বলরাম উত্তর দেওয়ার আগেই তার মোবাইলে ফোন এল। বলরাম বলল, ‘স্যার, তখন ফোনে কথাটা বলতে পারিনি। কারণ, আমি ছিলাম মিস্টার হালদারের স্ত্রীর সামনে। এখন? এখন আমার গাড়িতে। আপনারা তো তিন লাখ চেয়েছেন, আমি আপনাদের পাঁচ লাখ দেব, হালদারবাবুকে আমাকে দিন।’

ওদিক থেকে প্রশ্ন এল, ‘আপনি নিয়ে কী করবেন?’

বলরাম উত্তর দিল, ‘আমি বিদেশে লোক পাচার করি। হালদারবাবুর জন্য ডলারে আমি যা পাব, ভারতীয় মুদ্রায় তার মূল্য আট লাখ। শুধু-শুধু পুলিশের ঝামেলায় পড়বেন কেন? নিরাপদে বিজনেস করুন। বাঁ-হাতে হালদারবাবুকে নেব, ডান হাতে আপনাকে পাঁচ লাখ দেব।’

ওদিক থেকে আবার একটা প্রশ্ন আসতেই বলরাম বলল, ‘আমি যত লোক বিদেশে পাচার করি, তাঁরা সকলেই নানা ব্যাপারে প্রশিক্ষণ পান। কিছুদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্য আমরা পালটা একটা জঙ্গি সংগঠন তৈরি করছি। হালদারবাবুর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। এটা পরীক্ষায় প্রমাণিত। মানবদেহে মোট 206টি হাড় ও 520টি মাংসপেশি আছে। তার মধ্যে 140টি হাড়ে এবং 320টি মাংসপেশিতে এমন কয়েকটি বিস্ফোরক পদার্থ বিশেষ এক ধরনের ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ঢোকানো আছে, তাতে কলকাতার মতো একটা শহরের অন্তত তিন ভাগ ধবংস হয়ে যাবে। এমন মানুষকে খুন করতে গেলে খুনিরা শুকনো পাতার মতো জ্বলতে থাকবে। কোনো একটি জঙ্গি সংগঠনের কাছে হালদারবাবুর দাম কত জানেন? এক কোটি টাকা।’

ওদিক থেকে আবার একটা প্রশ্ন আসতেই বলরাম বলল, ‘সেই জঙ্গি সংগঠনের ঠিকানা আমি জানি না। আমার ঠিকানা খুব সহজ। আপনারা যেখানে আছেন তার একশো গজের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে ব্যাবসা করলে তিন থেকে পাঁচ লাখ করে পাবেন। মাল জোগাবেন আপনারা, টাকা দেব আমরা।’

তারপর নীচু স্বরে কিছু কথা হল, ফোন ছেড়ে দিয়ে বলরাম বলল, ‘ওদের হদিশ পেয়ে গিয়েছি। আমার সঙ্গে টেকো কার্তিক যাবে। আর যা-যা করতে হবে সেটা আজ রাতেই সকলে মিলে ঠিক করে ফেলব।’

হালদারবাবুর অপহরণকারীরা সম্ভবত পেশাদার ছিল না। বলরামের কথায় রাজি হয়ে নিউ টাউনের নির্জন রাস্তায় নবাবপুরের মোড়ে একটা ভাড়া করা গাড়িতে অপেক্ষা করছিল। বলরাম আর টেকো কার্তিক গিয়ে হাজির হল সন্ধের পর। জায়গাটা নির্জন। মোড়ে একটা চায়ের দোকান ছিল, তাও বন্ধ। বলরাম গাড়ি থেকে নামতেই অপহরণকারীদের মধ্যে থেকে একজন নেমে এসে বলল, ‘পাঁচ লাখ এনেছেন তো?’

বলরাম বলল, ‘অবশ্যই। এসব কাজে কথার দামটাই আসল। হালদারবাবু কোথায়?’

ওরা উত্তর দিল, ‘গাড়িতে।’

বলরাম বলল, ‘ওঁকে গাড়ি থেকে নামতে বলুন। আমাদের গাড়িতে ওঁকে বসিয়ে দিন।’

ওরা বলল, ‘কিন্তু তার আগে টাকা চাই। টাকা কই?’

বলরাম বলল, ‘এসব কাজে ধারবাকি চলে না তা জানি। আমাদের তো সারা দেশেই এজেন্সি আছে। সেখানে অবশ্য ক্রেডিট কার্ড চলে। আপনাদের চলে কি?’

ওরা বিরক্ত গলায় বলল, ‘না। এখানে দাঁড়িয়ে ন্যাকামি করার সময় নেই। টাকা বের করুন।’

বললাম তার অ্যাটাচি বের করে ডালা খুলে ব্যাগভর্তি টাকা দেখাল। সব হাজার টাকার নোটের বান্ডিল।

ওদের যে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে কথা বলছিল, এবার তার ইশারায় হালদারবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। টেকো কার্তিক গিয়ে হালদারবাবুকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে এল। হালদারবাবু বলুদের গাড়িতে উঠে যাওয়ার পরই ওদের আরও দুজন লোক তাদের গাড়ি থেকে নেমে কর্কশ গলায় বলল, ‘টাকা দিন।’

বলু অ্যাটাচিটা ওদের একজনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে ব্যাবসা করলে এক বছরের মধ্যেই কোটিপতি হয়ে যাবেন। যদি রাজি থাকেন, তাহলে আপনাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর এই ডায়েরিতে লিখে দিন। এই নিন কলম।’

ওরা কাগজের প্যাড আর কলমটা নিয়ে লিখতে লাগল। বলুদের গাড়িটা হালদারবাবুকে নিয়ে ব্যাক করে একটু পিছিয়ে গেল। টেকো কার্তিক তার মোবাইলটা নিয়ে বলল, ‘আমাদের এজেন্টকে ফোন করি।’

টেকো কার্তিক একটু সরে গিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে কী যে করল কে জানে, হঠাৎ করে ওদের গাড়িটা রাস্তা থেকে দু-হাত উপরে উঠে বিকট শব্দ করে নীচে আছড়ে পড়ে জ্বলতে আরম্ভ করল। বলুদের গাড়ি যখন স্টার্ট দিচ্ছে তখন ওরা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে।

বলু বলল, ‘ওই অ্যাটাচির সবক-টা নোট জাল। একটু অপেক্ষা করুন। আপনাদের সেবার জন্য শান্তিদারোগার বড়ো গাড়ি আসছে।’

ওরা দেখল কালো রঙের পুলিশভ্যানটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অন্য দিক থেকে বন্দুক উঁচিয়ে আসছে একটা বড়ো জিপগাড়ি। ওরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। দৌড়ে পালাবার উপায় নেই। দু-দিক থেকে পুলিশের গাড়ি ধেয়ে এসে কাছে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের দল লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। তাদের ভারী বুটের আওয়াজে যেন বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছিল।

এই ঘটনার পর শান্তিদারোগার খুব খ্যাতি হল। সকলের মুখে-মুখেই শান্তিদারোগার জয়গান। স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়ে তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের সকলেই খুশি। হালদার পরিবার থেকে বলুকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হল। সেই টাকা দিয়ে ওরা পাঁচজনে মিলে পিকনিক করল। অবশ্য পিকনিকের অনেক জিনিসই ওদের কিনতে হল না। মাঠে চরছিল হরি দত্তের পাঁঠা। সামনে দুর্গাপুজো, তার পরেই কালীপুজো। কালীপুজোর সময় কালো পাঁঠার খুব দর হয়। সেই ভেবেই পাঁঠাটা বড়ো করছিল। গালকাটা বিল্টে ওটাকে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে এল। মাছ এল ছিদামের আড়ত থেকে। বলুর কথায়, এগুলো সবই ভালোবাসার দান। এই ভালোবাসার দানগুলো কাউকে যেচে এসে দান করতে হল না। বলু আর টেকো কার্তিকের ছেলেরা গিয়েই দান নিয়ে এল।

শান্তিদারোগা অনেক দিন পর প্রাণ খুলে একটু হাসবার অবকাশ পেলেন। জিপগাড়ি করে যাতায়াতের সময় তিনি টের পেতেন, তাঁর দিকে অনেকেই বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু এই সুখও বেশি দিন ভোগ করতে পারলেন না। পঞ্চমীর সন্ধেয় দুঃসংবাদটি এল। এমন একটা সংবাদের জন্য শান্তিদারোগা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। পঞ্চমীর সন্ধে সবে উত্তীর্ণ হয়েছে। রাস্তায়-রাস্তায় রংবেরঙের আলো জ্বলছে। কোথাও বাজছে ঢাক, কোথাও বা মাইক। এমন সময় বলরাম তার ছেলেদের নিয়ে এসে উপস্থিত। বলরাম রীতিমতো উত্তেজিত। শান্তিদারোগা বলরামের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে বাবা বলু?’

বলরাম বলল, ‘সবেবানাশ হয়ে গিয়েছে শান্তিদা।’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘কেমন সবেবানাশ?’

বলরাম বলল, ‘ঘন্টাতিনেক আগে প্যান্ডেলে ঠাকুর এসেছে। জনাতিনেক ছেলে প্যান্ডেলে ডেকরেশনের কাজ করছিল। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়, আর সেই সময় দুটো ছেলে রিভলভার দেখিয়ে আমাদের প্যান্ডেল থেকে অসুরটাকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়।’

শান্তিদারোগা যতটা না দুঃখিত তার চেয়ে অবাক হলেন বেশি। জগৎসংসারে কত রকমের জিনিস চুরি-ছিনতাই হয়। কিন্তু প্যান্ডেল থেকে অসুর ছিনতাই তিনি তো বটেই, তাঁর চোদ্দো পুরুষও কখনও শোনেননি। তিনি চোখ কপালে তোলার ভঙ্গি করে বললেন, ‘বলো কী? প্যান্ডেল থেকে অসুর ছিনতাই?’

বলুর দলের একজন ছেলে বলে উঠল, ‘সেই জন্যই বলেছিলাম বলুদা, একচালার ঠাকুর অর্ডার দিন। একচালার ঠাকুর হলে অসুরটাকে ছিনতাই করতে পারত না।’

 বলু বলল, ‘এবার চমক দেওয়ার জন্য ঠাকুরের ডিজাইন অন্য রকম করেছিলাম। অসুর তো মা-র ত্রিশূলে বিদ্ধ ছিল না। সকলেই যেমন আলাদা-আলাদা, তেমনই অসুরও আলাদা। হাতে একটা তলোয়ার নিয়ে মা-র দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। বেচারি একা ছিল, তাই তুলে নিয়ে গিয়েছে। এখন অসুর ছাড়া কেমন করে পুজো হবে?’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘কুমোরটুলি গিয়ে একটা সিঙ্গল অসুরের খোঁজ করো না।’

বলু বলল, ‘সে কী আর করিনি ভেবেছেন! সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কিন্তু কারও কাছে খুচরো অসুর নেই। অর্ডার দেওয়া অসুর সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এখন অসুর পাই কোথায়? আগামীকাল মহাষষ্ঠী।’

এই রকম সমস্যার কথা শান্তিদারোগা তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনও শোনেননি। তিনি ভাবতে লাগলেন। যদিও ভেবে এই সমস্যার কোনো কুলকিনারা হবে না, তবুও তিনি বলুদের সামনে ভাবনার ভাব করতে লাগলেন।

এই সময় মোটরবাইকে করে টেকো কার্তিক এসে উপস্থিত। সে বলল, ‘বলু, আমার মনে হচ্ছে এটা ওদের দলের কাজ!’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘কাদের দলের?’

টেকো কার্তিক বলল, ‘ওই যে, যারা হালদারবাবুকে অপহরণ করেছিল। বলু আর আমি এবার একসঙ্গে দুর্গাপুজো করছি তো! তাই আমাদের শায়েস্তা করার জন্য বদলা নিল। আমার কালীপুজোতেও একটা কিছু করবে।’

বলু বলল, ‘আগে থেকে আঁচ পেলে তো ব্যবস্থা নিতাম। ব্যাটারা বদমাশ। বুড়ো, মাটির অসুর, এইসব ছিনতাই করে। সাহস থাকলে আমাকে ছিনতাই করো না?’

শান্তিদারোগা ঘনঘন টেকো কার্তিকের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এবার তিনি বললেন, ‘হাতে তো সময় বেশি নেই। আগামীকালই তো বোধন। রাত পোয়ালেই পুজোর ক্রিয়াকর্ম শুরু হবে। এখন পঞ্চমী থেকেই ঠাকুর দেখা শুরু হয়।’

বলু বলল, ‘শুরু হয় কী বলছেন, শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা তো পরদা ফেলে ঠাকুর ঢেকে রেখেছি। কিন্তু এভাবে ক-দিন ঢেকে রাখব?’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘তাই বলছি কী, এই ক-টা দিনের জন্য যদি আমার প্রস্তাব মতো কাউকে, ধরো টেকো কার্তিককে অসুর সাজিয়ে কাঠামোয় বসিয়ে দাও, তাহলে কোনোমতে পুজোটা উতরে দেওয়া যায় । ওকে খারাপ মানাবে না।’

সকলেই টেকো কার্তিকের দিকে তাকাল। কিন্তু টেকো কার্তিক প্রবল আপত্তি তুলে বলল, ‘এসব হয় নাকি! অসুর সেজে ষষ্ঠী থেকে দশমীর সন্ধে পর্যন্ত একভাবে থাকা যায়? অসম্ভব ব্যাপার।’

শান্তিদারোগা চেয়ার থেকে উঠে এসে টেকো কার্তিকের হাতটা ধরে অনুনয় করে বললেন, ‘বাবা কার্তিক, তুমিই পারো মায়ের পুজো রক্ষা করতে। নইলে সিঙ্গল এক পিস অসুরের জন্য পুজো বন্ধ হয়ে যাবে?’

এবার বলুর দলের ছেলেরা সকলেই বলতে লাগল। গালকাটা বিল্টে কার্তিকের পায়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বলল, ‘কেতোদা, তুমি আমাদের বাঁচাও। তুমি আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবে।’

বলুও এবার কার্তিকের হাত দুটো ধরে বলল, ‘কেতো, এটা তো তোরও পুজো। রাজি হয়ে যা ভাই। আমার মান, পাড়ার মান, দেশের মান, এমনকি মা-দুর্গার মান রক্ষার দায়িত্বও তোর হাতে।’

কার্তিক নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এই টাক মাথায় আমাকে অসুর মানাবে কেন?’

বলু বলল, ‘টাক ঢাকার ব্যবস্থা আমি করব। এমন করে দেব যে, পাবলিক তোকে চিনতেই পারবে না।’

অনেক সাধাসাধির পর কার্তিককে রাজি করানো গেল। শর্ত হল, এক ঘন্টা পরপর পরদা টেনে দিতে হবে। তখন কার্তিক একটু বিশ্রাম করবে।’

সেই শর্তে সকলেই রাজি। খানদশেক ছবি দেখে কার্তিক অসুরের ভঙ্গি নকল করল। মহাষষ্ঠীর দুপুরের আগেই কোঁকড়ানো চুল নিয়ে এল বলু। মাথায় পরবার আগে কার্তিক বলল, ‘এটা কি কিনলি নাকি?’

বলু বলল, ‘এখন চিৎপুরে গিয়ে রেডিমেড চুল পাওয়া কঠিন। বাজারের মধ্যে যে ‘গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার’, তার বড়ো ছেলের মাথায় এটা ছিল। ওর টাকমাথা। ওর উইগটাই নিয়ে এলাম। দিনে সত্তর টাকা ভাড়া। মহাজন টাকার জন্য লোক পাঠাচ্ছে। তাই পুজোর ক-টা দিন পরচুলা খুলে দোকানে বসলে মহাজনের লোক আর চিনতেও পারবে না, তাগাদাও করবে না।’

মহাষষ্ঠীর সন্ধে থেকেই সামনের কালো পরদা সরে গেল। দিব্যি মানিয়েছে টেকো কার্তিককে! মাথায় পরচুল, লম্বা জুলফি আর মোটা গোঁফ থাকায় কেউ আর চিনতে পারছে না। মহাষষ্ঠীর রাত কোনো মতে কাটল। সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই প্যান্ডেলে বেশ ভিড়। প্রথমে পুরোহিত দেখলেন, মহিষাসুর দিব্যি হাত বাড়িয়ে একখানা জলভরা সন্দেশ মুখে দিল। এও কি সম্ভব? মাতৃমন্ত্রে মা না-জেগে অসুর জাগ্রত হয়ে উঠল নাকি? মনেমনে ভীত হলেন পুরোহিত। এর একটু পরেই বাজারের চায়ের দোকানের ভুতো বলে উঠল, ‘এই, অসুরটা আমাকে চোখ মারছে!’

ক্রমেক্রমে যা প্রচার হল, তা হচ্ছে, বলুদের শক্তি সঙেঘর অসুর জাগ্রত হয়ে গিয়েছে। সে হাত বাড়িয়ে সন্দেশ খাচ্ছে, ভুতোকে চোখ মারছে, এমনকি দক্ষিণা ও প্রণামী বাবদ দেওয়া টাকা আর বস্ত্র তুলে নেওয়ার সময় শক্তি সঙেঘর অসুর হাত বাড়িয়ে পুরোহিতের কাছা ধরে টেনেছে। শুধু তাই নয়, পুরোহিতের হাত থেকে টাকাপয়সা সব কেড়ে নিয়েছে।

বলু এতে অবাক হল না। কেতোর শর্তের মধ্যে ছিল, মায়ের সামনে যা টাকাপয়সা পড়বে, সব কেতো নেবে। অসুরকে ধুতি না-দিয়ে জিনসের প্যান্টসিস দিতে হবে। যেহেতু কেউ কখনও অসুর কেন, কোনো দেবতাকেই প্যান্টের পিস দেয়নি, তাই বলুর শক্তি সঙেঘর পুজোয় প্যান্টের পিসটা একটা প্যাকেটে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। পুরোহিতমশাই ওটি হাতে নিতেই অসুররূপী কেতো সবেগে কেড়ে নিয়েছে।

কিন্তু এসব কথা সাধারণ মানুষ জানবে কেমন করে। তারা জানল এবং প্রবলভাবে বিশ্বাসও করল যে, শক্তি সঙেঘর অসুর জাগ্রত হয়ে গিয়েছে। পাড়ার পণ্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞানী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা বলেছেন, ‘ঘোর কলি। এবার কলির অবসান হবে। ওদিকে গণেশ দুধ খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করবেন। সমুদ্রের জল মিঠে হয়ে যাচ্ছে এবং অসুর জাগ্রত হচ্ছে। কলির অবসান হবে মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়ে।’

পাশবালিশের মতো মোটা একটা মটন রোল খেতে-খেতে প্রোমোটার রণজিৎ সরকার বলল, ‘মহাপ্রলয়টা ঠিক কবে থেকে শুরু হবে? আমার দুটো বিল্ডিং এখনও হাফ ডান। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে হলে ওটা আর কমপ্লিট করব না।’

গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডারের বড়ো ছেলের নাম গুরুপদ। সে রোজ দু-বার করে এসে তার উইগটা দেখে যায়। অষ্টমীর রাতে সন্ধিপুজোর সময় বিশ্রী একটা ঘটনা ঘটে গেল। পুরোহিত টের পেলেন ধূপ, চন্দন, ফুল ইত্যাদির গন্ধ ছাপিয়ে কীসের একটা উৎকট গন্ধ আসছে। পুরোহিতমশাই এদিক-ওদিক তাকালেন। পরে বললেন, ‘কীসের একটা গন্ধ আসছে?’

ঢাকির সঙ্গে কাঁসি বাজাতে যে ছেলেটি এসেছিল, সে জবাব দিল, ‘অসুর বিড়ি খাচ্ছে।’

পুরোহিতমশাই অসুরের দিকে তাকালেন। অসুরের ঘাড়টা ঘোরানো। মানে অন্য দিকে মুখ করে বিড়ি টেনে যাচ্ছে। পুরোহিতমশাই পুজো ছেড়ে উঠে আসতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। স্বয়ং অসুর তাঁকে একটা হ্যাঁচকা টানে আসনে বসিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলল, ‘কেটে পড়ছেন কেন? দশমীর আগে কেটে পড়লে আপনার লাশ গঙ্গায় ভাসবে।’

পুরোহিতমশাই কাঁপতে-কাঁপতে বসে পড়লেন। তিনি ভেবে পেলেন না এমন কোন মন্ত্র তিনি এখানে পাঠ করেছেন যে, অসুর জাগ্রত হয়ে উঠেছে। শুধু কি জাগ্রত? কাছা ধরে টানাটানি, হাত ধরে হ্যাঁচকা মারা, এখন আবার হুমকি। এটা কি তাঁর পুণ্যের ফল না পাপের ফল?

এরকম অঘটন একটুআধটু যে ঘটবে সে-কথা বলু ও তার ছেলেরা জানত। তাই তারা খুব চিন্তিত হল না। গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডারের বড়ো ছেলে গুরুপদ প্যান্ডেলে এসে শুধু অসুর দ্যাখে আর বলুকে বলে, ‘ভাই, দশমীর দিন আমার কথাটা মনে রেখো।’

নবমীর রাতে শান্তিদারোগা সস্ত্রীক ঠাকুর দেখতে এলেন। অসুরের ব্যাপারটা তো তাঁর জানা, কিন্তু তাঁর স্ত্রী জানেন না। শান্তিদারোগাকে দেখেই অসুর হেসে উঠল। শান্তিদারোগা মনেমনে বিব্রত হলেও অবাক হলেন না। তাঁর স্ত্রী যেই অসুরের দিকে তাকালেন, অমনি টেকো কার্তিক নিজেই একটা হাত তুলে নমস্কার করার ভঙ্গিতে কপালে ঠেকাল। দারোগার বউ বিস্ময়ে, ভয়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনায় স্বামীর হাত জাপটে ধরে বললেন, ‘লোকেরা তো ঠিকই বলছে। অসুর তো জেগে উঠেছে। কিন্তু অসুর তোমাকে আর আমাকে চিনল কেমন করে?’

শান্তিদারোগা বললেন, ‘আমাকে তো মর্ত্যে অসুরদের নিয়েই চলতে হয়। তাই পুরাণের অসুররাও আমাকে আর তোমাকে চেনে। স্বজাতি তো! স্বর্গে আর মর্ত্যে তাই তফাত নেই।’

দশমীর দিন ঠাকুর যখন লরিতে উঠছে, তখন অসুর নিজেই লরির পাল্লা ধরে উঠে পড়ল। গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডারের বড়ো ছেলে গুরুপদ নিজের গরজেই প্রতিমা ভাসানে গঙ্গার ঘাটে এল। ওর মুখে একই কথা, ‘বলুদা, মনে করে কার্তিকদার মাথা থেকে আমার উইগটা খুলে নিও।’

বলু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘একই কথা তো সপ্তমীর সকাল থেকে বলে যাচ্ছিস। বলছি তো, ভয় নেই।’

পুলিশ, ক্লাবের ছেলেরা এবং অন্য বারোয়ারি পুজোর লোকজন মিলে এমন তাড়া দিতে শুরু করলে যে, থাকতে না-পেরে বলু হাত চালাল। ব্যস, মারামারি লেগে গেল। টেকো কার্তিকের পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। হাতে ছিল টিনের পাতলা তরোয়াল। তাই নিয়ে লরির উপর থেকে শক্তি সঙেঘর অসুর রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশের উপর। কাঠামো ছেড়ে অসুর পুলিশ পেটাচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে সকলেই স্তম্ভিত। এরই মধ্যে ঠাকুর কোনো মতে ভাসান হল। টাক মাথা নিয়ে কার্তিক যখন জল থেকে উঠে এল, গুরুপদ তখন বলল, ‘কেতোদা, আমার চুল কোথায়?’

কার্তিক একধমকে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখছিস মারদাঙ্গা লেগে গিয়েছে, এখন চুল কোথায় গিয়েছে কে জানে।’

পুজো মিটে গিয়েছে কবে। গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডারের বড়ো ছেলে চুলের জন্য থানায় ‘চুল অপহরণের’ ডায়েরি করলেও, রোজ গিয়ে বাবুঘাটে বসে থাকে। যদি জোয়ারের জলে তার সাধের উইগটি ভেসে আসে। এখনও সে বসেই আছে। তার প্রতীক্ষা শেষ হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *