জাগার বেলা হলো
‘আমি এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখি না, লোকটা বলল। এমনভাবে বলল, যেন অভূতপূর্ব কোনো কথা শোনাচ্ছে।
কথাটা বলে একটু দম নিল লোকটা। গভীর আর্তিভরা চোখে তাকাল আমার দিকে। আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।
আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। বললাম, এ যুগে স্বপ্ন দেখা কঠিন। আমাদের কোনো স্বপ্নই তো আর অবশিষ্ট নেই।’ বলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।
লোকটা আমাকে হতাশ করেছে। আমি আরও চমকপ্রদ কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খুব গুপ্ত, গূঢ় কোনো কথা। এমন কিছু, যা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে যাবে। কৌতূহল জাগবে। অন্তত আমার সামনে বসার পর লোকটা শুরুতে এ রকমই তো আভাস দিয়েছিল। বলেছিল, অত্যন্ত জটিল আর বিস্ময়কর একটা সমস্যা নিয়ে সে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এখন দেখছি, সে অযুত-সহস্র হতাশাগ্রস্ত মধ্যবয়সীদের একজন। আমিও সে কারণেই তাকে একটা বাজারচলতি কিন্তু অর্থহীন সান্ত্বনাবাক্য বললাম।
‘আমি কিন্তু সে কথা বলিনি। স্বপ্ন দেখি না বলতে আমি বোঝাচ্ছি, আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না। ঘুমের মধ্যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না।’
‘স্বপ্ন দেখেন। ঘুম ভেঙে মনে থাকে না যে আপনি স্বপ্ন দেখেছেন।’
‘আমি স্বপ্ন দেখি না,’ লোকটা জোর দিয়ে বলল। খুব জেদি আর গোঁয়ার ভঙ্গি তার গলায়।
‘সেই অর্থে আমরা কিন্তু কেউই স্বপ্ন দেখি না। ঘুম ভাঙার পর স্বপ্ন দেখার একটা ধোয়াটে স্মৃতি কেবল থাকে আমাদের। মানে বলতে চাচ্ছি, স্বপ্ন দেখাটা আসলে স্বপ্ন দেখার একটা স্মৃতিমাত্র, একটা অসম্পূর্ণ ক্ষয়িষ্ণু অপভ্রংশ স্মৃতি।’
আমি খুব দার্শনিক ভঙ্গি করে কথাটা বললাম। লক্ষ রাখলাম, বলার সময় যাতে আমার জ্ঞান আর প্রজ্ঞার ওজন প্রকাশ পায়।
লোকটা একটু বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমি স্বপ্ন দেখি না, কেননা আমি ঘুমাই না।’
‘ও, আপনি তাহলে স্লিপ ডিজঅর্ডার নিয়ে এসেছেন! প্যারাসমনিয়া!’’
‘হতে পারে। আমি তো আর এসব শব্দ জানি না।’
কবে থেকে এই সমস্যা?
‘দুই বছর।’
‘মানে কি দুই বছর ধরে আপনি ঘুমান না?’
লোকটা মাথা নাড়ে। সে এবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে।
‘আপনি শব্দটা কী বললেন যেন, প্যারাসমনিয়া?”
‘হুম।’
‘আমি ইনসমনিয়া শব্দটা শুনেছি। এটা শুনিনি।’
‘শব্দ জানা জরুরি নয়। আপনি দুই বছর ধরে ঘুমান না?’
‘হ্যাঁ।’
‘সর্বনাশ। আপনি মারা যাবেন তো!’
লোকটা চুপ করে থাকে। ‘সমস্যা হয় না? ক্লান্তি?’
‘না, হয় না।’
হওয়ার কথা। ঘুমের ঘাটতি হলে প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স আর টেমপোরাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মগজের কতগুলো এলাকা। তখন যুক্তিশৃঙ্খল এলোমেলো হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি কমে। যায়, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়ে যায়।’
লোকটা মাথা নিচু করে থাকে। যেন বাধ্য ছাত্র, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া নিচ্ছে।
‘আপনি কোনো নিউরোলজিস্টের কাছে গেলে ভালো করবেন। এটা একটা নিউরোলজিক্যাল সমস্যা। আমি একজন সাইকোলজিস্ট। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি আমার বিদ্যা। আমার কারবার মন নিয়ে। আপনি আমার কাছে খামোখা এসেছেন।’
‘যাব,’ লোকটা অলসভাবে বলে।
মনে হলো, লোকটা এবার উঠবে। উঠুক। আমারও তাড়া আছে। অ্যাসিসট্যান্ট ছেলেটাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আমিও এখনই উঠব। তার আগে ড্রাইভারকে ফোন দিতে হবে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই।
আমার এই ভঙ্গি দেখে লোকটা উঠে দাঁড়ায়।
আমি বলি, ‘আচ্ছা, একটা কথা। আপনি ঘুমের সমস্যা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু শুরুটা করলেন স্বপ্নের কথা বলে। কেন?’
‘মানে?’
‘মানে আপনি “ঘুমান না” না-বলে বললেন, আপনি “স্বপ্ন দেখেন না”। কেন?’
লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন একটা ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে সে আবার বসে পড়ে। এই সেরেছে, রে।
‘আমি তো সেই কথাটাই বলতে এসেছি। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে আমার কথাটা শুনুন। প্লিজ।’
‘শুনব। কথা শোনাই আমাদের কাজ। কিন্তু আপনি কি সংক্ষেপে বলতে পারবেন? মানে আমার একটু তাড়া আছে।’
‘আমি খুবই সংক্ষেপে বলব। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।’
লোকটা নড়েচড়ে বসে। আমি তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখি না। এ লোক সংক্ষেপে বলবে না।
‘আপনি একটু আগে বললেন না নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে?’
‘বলেছি।’
‘ইনফ্যাক্ট ঢাকা শহরে এমন কোনো নিউরোলজিস্ট নেই, আমি যার কাছে যাইনি। গত দুই বছর ধরে এমন কোনো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা নেই, আমাকে করানো হয়নি। কিছুই ধরা পড়েনি। কত রকম যে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘আমি নিজে অনেক চিন্তা করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, সমস্যাটা কোথায়। অনেক ভেবে…অনেক ভেবে…বুঝেছেন… অনেক চিন্তাভাবনা করে অবশেষে আমি বের করে ফেলেছি, কেন আমার ঘুম হয় না।’
এটুকু বলে লোকটা থামে। থেমেই থাকে।
লোকটা আমার কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন আশা করছে।
আমি বলি, “তা, কেন ঘুম হয় না?’
লোকটা সামনে ঝুঁকে আসে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভারি নিশ্বাস পড়ছে। অত্যন্ত নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে লোকটা বলে, ‘আমার ঘুম হয় না, কারণ আমি আসলে ঘুমিয়ে আছি।’
বলেই লোকটা সোজা হয়ে বসে। পায়ের ভর পরিবর্তন করে। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে।
আমি কিছু বলি না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ঘড়ির ডায়ালের দিকে। সেকেন্ডের কাটাটা টিকটিক করে এগোচ্ছে।
‘আপনি কি কাল আবার আসতে পারবেন?’
‘আমি আর সামান্য কয়েকটা মিনিট সময় নেব। প্লিজ, আমাকে পুরোটা বলতে দিন।’
‘বলুন।’
‘আমি অনেক ভেবে দেখলাম, যে লোক ঘুমিয়ে আছে, সে আর ঘুমাবে কী করে! তার পক্ষে তো আর ঘুমানো সম্ভব নয়।’
‘ঠিক কথা। তাহলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘ঘুমিয়ে কথা বলছি না। আমি আসলে কথাই বলছি না। আমি স্বপ্ন দেখছি।’
‘দুর্দান্ত বলেছেন! আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি আসলে একটা দীর্ঘ স্বপ্নের ভেতর আছি।’
‘আর এ কারণেই আপনি কোনো স্বপ্ন দেখেন না?’
‘ইয়েস।’
‘দারুণ! দারুণ!’ আমি এবার ঘর কাঁপিয়ে হো-হো করে হেসে উঠি।
আমার এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রতিক্রিয়া দেখে লোকটা অপ্রতিভ ভঙ্গিতে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি এই মুহূর্তে এই ঘরে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
লোকটা চুপ করে থাকে।
‘তার মানে এই ঘরটা, এই যে টেবিল, এই যে ফুলদানি, ওই যে জানালা, জানালার পর্দা…দেয়ালে ক্যালেন্ডার, ক্যালেন্ডারের পাশে টিকটিকি…এগুলো…এই পুরা জগৎটা আপনার স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার মানে আপনার সামনে এই যে আমি বসে আছি, আমার কোনো অস্তিত্ব নাই? আমিও আপনার স্বপ্ন?’
লোকটা মাথা নিচু করে। যেন আমাকে স্বপ্নে পর্যবসিত করায় সে কিছুটা বিব্রত, লজ্জিত।
আমি বলি, ‘হুম। ইন্টারেস্টিং। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। কিন্তু দয়া করে বলবেন কি, ঠিক কী কারণে আপনার এই কথা মনে হলো? মানে আপনি কীভাবে এই সিদ্ধান্তে এলেন?
‘আমি পুরোটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেব। আপনি একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন আমার কথা।’
‘অবশ্যই শুনব। আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। আপনি সময় নিয়ে বলুন।’
‘আমাকে পাগল মনে হচ্ছে আপনার, তাই না?’’
‘মোটেই না। এক্কেবারে না। আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনছি। আপনার প্রতিটি কথা আমি বিবেচনা করছি, আমার মতো করে।’
আমি উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। কাঁচের ওপারে নিচে রাতের শহর। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো কেমন ঝাপসা, ল্যাপটানো। গাড়ির হেডলাইটের আলো পিছলে যাচ্ছে রাস্তার পিচে।
‘আপনি কি কিছু খাবেন, চা, কফি?’
‘কফি দিতে পারেন।’
আমি কফি বানাই। মগটা তার হাতে দিয়ে আমার চেয়ারে বসি।
‘আপনি ম্যাট্রিক্স দেখেছেন?’
লোকটা কী যেন ভাবছিল। আমার প্রশ্নে চমক ভাঙে।
‘না। কী সেটা?’
‘একটা সিনেমা।’
‘ওহ।’
আমি আয়েশ করে বসে কফিতে চুমুক দিই, ‘এবার বলুন।’
‘কী বলব?’
‘বলুন, কীভাবে এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে এলেন যে, আপনি আসলে স্বপ্ন দেখছেন, দীর্ঘ একটা স্বপ্ন?’
‘বলছি,’ লোকটাও আয়েশ করে বসে। আমি ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি, ফার্স্ট অফিসার পদে। ছোট পোষ্ট। কাজ বেশি। থাকি পলাশীতে স্টাফ কোয়ার্টারে। বছর দুয়েক কি তারও বেশি আগের ঘটনা। আমার অফিসে একটা আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। অনেক হইচই। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক যেটা, তদন্তে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অথচ এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ নেই আমার। ব্যাপারটা আমার জন্য বিপর্যয়কর। আমি প্রচণ্ড মানসিক শক পাই। আমার শোবার ঘরের ড্রয়ারে দু-পাতা ইনকটিন ছিল।’
‘ঘুমের ওষুধ?
‘হুম। আমি চল্লিশটা হাই পাওয়ার্ড ঘুমের বড়ি একসঙ্গে খেয়ে ফেলি।’
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘আমি বেঁচে যাই। অচেতন অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওয়াশ-টোয়াশ করানো হয়। সতেরো দিন পর আমার ঘুম ভাঙে। মানে এগুলো পরে জেনেছি আমি। আমাকে বলা হয়েছে।’
‘ও, আচ্ছা।’
‘বেশ কিছুদিন খুব দুর্বল কাটে। হরলিক্স, ফলমূল খাওয়ানো হয়। ধীরে ধীরে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। অফিসও শুরু করি। কিন্তু অফিসে গিয়ে দেখি, কেউ আর ওই কেলেঙ্কারি বা তদন্তের কথাটা বলে না। আমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। আমি একটু অবাক হই। ভাবি, আমার আত্মহত্যার চেষ্টার কারণে সবাই এখন এগুলো লুকানোর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়ে শুনি যে এ রকম কোনো তদন্তই নাকি কখনো হয়নি। একটু খটকা লাগে। তবে ভাবি, এটাও আমাকে বিব্রত না করার একটা কৌশলমাত্র। আমি আর এটা নিয়ে ভাবব না বলে ঠিক করি। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। কোথাও কোনো ঘাপলা নেই, কোনো গড়বড় নেই। শুধু একটাই সমস্যা। ইনসমনিয়া। আমার ঘুম হয় না। কিছুতেই না। এক ফোঁটা ঘুম হয় না। ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার প্রথমে বলে, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার রিঅ্যাকশন। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয় না। আমি সারাক্ষণ জেগে থাকি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে বারান্দায় পায়চারি করে কাটাই। ঘুম নেই, ঘুমহীনতার কোনো ক্লান্তিও নেই। ফলে খুব বেশি চিন্তিত হই না। সপ্তাহ দুয়েক পরে একটা ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়।’
লোকটা আবারও চুপ করে আমার কাছ থেকে একটা প্রশ্ন আশা করতে থাকে।
‘কী সেটা?’
‘আমি বাসা থেকে অফিসে যাতায়াত করি পাবলিক বাসে। আমাদের অফিসের একটা পিক-ড্রপ বাস আছে বটে। কিন্তু সেটা আমার রুটে পড়ে না। ফলে আমি পলাশী মোড় থেকে একুশ নম্বর বাসে চড়ি। সেটা মৎস্য ভবনে আমার অফিসের সামনেই আমাকে নামিয়ে দেয়। যে দিনকার ঘটনার কথা বলছি, সেটা ছিল রবিবার। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছি। মাঝখানের আইলে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বাসে ঠাসাঠাসি ভিড়। বাস কোন দিকে যাচ্ছে, বোঝা যায় না। তবে কন্ডাক্টরের ঘোষণা আর বাসের মোচড় নেওয়া গুনে বলে দেওয়া যায়, কখন কোন রাস্তায় আছি। একসময় আমার গন্তব্য চলে আসে। আমি খুব কষ্টে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। “স্যার বাম পা আগে ফেইলেন,” কন্ডাক্টর সতর্ক করে দেয়। আমি বাম পা আগে ফেলে নামি। কিন্তু নেমেই থ হয়ে যাই। কোথায় মৎস্য ভবন, কোথায় কী! আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। যে বাহনটা থেকে নামলাম, সেটা একটা ট্রেন, সবুজ রঙের বগি। আর সেটা এখনো প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছে। একটা ভোজবাজির মতো আমার চারপাশের জগৎটাকে কেউ বদলে ফেলেছে, বদলে মৎস্য ভবনের জায়গায় একটা রেলস্টেশন বসিয়ে দিয়েছে। আমার পাশ ঘেঁষে লোকজন ট্রেনে উঠছে, নামছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম। আমার হাতে একটা নীল ট্রাভেল ব্যাগ। আমার পাশে আমার স্ত্রী। সে ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। “কী ব্যাপার?” স্ত্রী জিজ্ঞেস করে। আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলি না। যখন ঘোরটা একটু কাটে, তখন জিজ্ঞেস করি, “এটা কোথায়?” স্ত্রী অবাক হয়। “কী ব্যাপার, তোমার কি অসুস্থ লাগছে?” আমি প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চে বসে পড়ি। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এটা ঢাকা-নাটোর রেললাইনের একটা ছোট্ট স্টেশন, নাম ইদ্রিসপুর। আমরা এসেছি আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে। আমি তাকিয়ে দেখলাম, এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল, কেন ঘটল–আমি কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না।’
‘খুব সহজ। মেমোরি লস।’
‘আমিও সেটাই ভাবি। মানে, ব্যাপারটা এমন যে রবিবার সকালে আমার অফিসের উদ্দেশে বেরোনো আর সেই অচেনা প্ল্যাটফর্মে নামার মধ্যবর্তী পুরো সময়ের স্মৃতি মুছে গেছে আমার মাথা থেকে। তা-ই তো?”
‘হ্যাঁ। তা-ই।’
‘মেমোরি লস। ইনসমনিয়ার সাইড-এফেক্ট। সেটাই হওয়ার কথা। আর কীই-বা ব্যাখ্যা হতে পারে। এরপর নিয়মিতই এইসব টুকটাক মেমোরি লসের ঘটনা ঘটতে থাকল। ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর। জানেন, মাঝে মাঝে তো খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে হয়। তবে আমি এই পরিস্থিতির সঙ্গেও মানিয়ে নিতে শুরু করলাম একসময়। চিকিৎসকেরাও সে রকমই পরামর্শ দিল। তবে মুশকিল কী জানেন, ওর মধ্যেও আমি আরেকটা খটকার ব্যাপার খুঁজে পেলাম। যতই মেমোরি লসের ঘটনা ঘটুক, ক্যালেন্ডারের পাতা তো ঠিক থাকবে, তাই না? সময় তো একমুখী এগোবে। মানে, প্রতিবার মেমোরি লস করলে আমি নিজেকে ওই সময়ের পরের সময়ে আবিষ্কার করব। মানে ধরুন, রোববার মেমোরি লস করে আমি নিজেকে সোমবার বা মঙ্গলবারে গিয়ে আবিষ্কার করব। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, সব সময় এটা ঘটছে না। মাঝে মাঝে সময় উল্টো দিকে যাচ্ছে। মানে ধরুন, রোববারের পরমুহূর্তে আমি নিজেকে আগের দিন শনিবার বা তার আগের দিন শুক্রবারে আবিষ্কার করছি। এটা হওয়ার কথা না।’
এগুলোও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ থেকে কোনোভাবেই এমন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে….মানে ওই যে, যে-সিদ্ধান্তে আপনি। এসেছেন আরকি…..
‘আমি জানি। এগুলো থেকে কোনোভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু আমি সবটা তো বলিনি এখনো। এরপর আমার জীবনে আরও গভীর কিছু জটিলতা দেখা দিতে শুরু করল। এমন কিছু জটিলতা, যেগুলো একেবারে হতবুদ্ধি করে দেয়।’
‘যেমন?’
যেমন ধরুন, মাসুদ এসে একদিন উপস্থিত হলো আমাদের বাসায়।’ বলে লোকটা চুপ করে গেল। যেন এটুকু বললেই আমি বুঝে যাব ঘটনার জটিলতা। )
‘মাসুদ কে?’
‘মাসুদ আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট। কলেজ জীবন শেষে সে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। সেখানেই বসবাস করে। মাঝে মাঝে ফোন দেয়।’
‘তো মাসুদ এলে সমস্যাটা কী?’
‘সমস্যাটা হলো, আমাদের বাসায় এসে উঠল প্রাইমারি স্কুলের মাসুদ। ক্লাস ফোরে পড়া মাসুদ। হাফপ্যান্ট পরা। বয়স নয় কী দশ বছর।’
‘মাই গড।’
‘সে এসে আমার সঙ্গে থাকছে। আমার সঙ্গে এক টেবিলে খাচ্ছে। গল্পগুজব করছে। যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে অস্ট্রেলিয়ার মাসুদ ফোন করে। চিন্তা করুন দৃশ্যটা। আমি কথা বলছি আমার সমবয়সী ক্লাসমেট মাসুদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। ঠিক সে সময় দশ-বারো বছরের ওই মাসুদই আমার সামনে দুষ্টুমি করছে। এ রকম একের পর এক জটিল সব ঘটনা আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিতে শুরু করল। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। কিন্তু এগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু পাই না।’
আমার কফি শেষ হয়ে গেছে। মগটা নামিয়ে রাখলাম।
‘তবু বলব, এ থেকে প্রমাণ হয় না আপনি স্বপ্ন দেখছেন।’
‘সারা রাত আলো নিভিয়ে আমি বারান্দায় পায়চারি করি। ওখানে একটা বেতের সোফা আছে। তাতে বসে থাকি। মাঝে মাঝে আমি কান পাতলে কিছু কথোপকথন শুনি। অস্পষ্ট। তবে ভালো করে শুনলে বোঝা যায়। একদল লোক কথা বলছে। আমার মাথার ভেতরেই যেন কথা বলছে তারা।’
‘কী বলছে?’
‘সব কথা বুঝতে পারি না। দুয়েকটা শব্দ বা বাক্যের খণ্ডাংশ কানে আসে। “ঘুম” “স্বপ্ন”–এই সব শব্দ কানে আসে। মনে হয়, লোকগুলো আমাকে ঘিরে আছে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। একদিন একটা লোক আরেকটা লোককে জিজ্ঞেস করল, ‘এভাবে কত দিন ঘুমাবে?’ আমি টের পাই..কীভাবে টের পাই–জানি না, তবে টের পাই, এরা কেউ কেউ চিকিৎসক। আমি কোনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। এবং ঘুমিয়ে আছি। গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নটা পাতলা হয়ে গেলে, মানে ঘুমটা পাতলা হয়ে গেলে আমি চারপাশের সত্যিকার জগতের কিছু শব্দ শুনতে পাই। মানে, ওই যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কোমায় চলে গেছি, এরপর আর ঘুম ভাঙেনি আমার। আমি হাসপাতালে অথবা নিজের বাসার বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। এইটাই সবকিছুর একমাত্র ব্যাখ্যা।’
লোকটা দম নেয়। কফির মগ রেখে পেছনে গা এলিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে সে যেন কিছুটা ক্লান্ত। প্রশ্নবোধক দষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি গলা খাঁকারি দিই। চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নিচে রাতের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। এই জগক্টা ইস্যুশন নয়। খুব সহজ কয়েকটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন।
লোকটা অপেক্ষা করে।
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া।’
‘মানে?’
‘আপনিই বলুন, কী মানে শব্দটার।’
‘আমি জানি না।’
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া হলো এক বিশেষ ধরনের কালার ব্লাইন্ডনেস। এটা হলে লোকে কিছু বিশেষ কালার বা রং পিরসিভ করতে পারে না।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’
‘সম্পর্ক নেই। আমি সেটাই তো বলছি। সম্পর্ক নেই। কথা হলো অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া শব্দটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটা জটিল। জারগন। আপনার এই শব্দ জানার কিংবা এর আগে শোনার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। তাহলে যে স্বপ্ন আপনি দেখছেন, সেই স্বপ্নের ভেতর এই শব্দটা উচ্চারিত হবে না, তাই না? অথচ দেখুন আপনার সামনে এই শব্দটা আমি উচ্চারণ করছি, করেই যাচ্ছি–অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া…’
আমি তোতাপাখির মতো শব্দটা বলতে থাকি।
লোকটা চুপ করে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন মানেই হলো আমি আপনার স্বপ্নের একটা উপাদানমাত্র। মানে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি এই ঘরে আসার আগে আমার অস্তিত্ব ছিল না। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তাহলে আমার কোনো স্মৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, গত ৪২ বছরের প্রায় পুরোটা স্মৃতি আমার মনে আছে। আমার এই মোবাইল ফোনে প্রায় সাড়ে চারশ নম্বর সেভ করা আছে। তারা আমার বন্ধু, পরিচিত। আপনি তাদের কারও নাম জানেন না, শোনেননি। আমার স্ত্রী এ মুহূর্তে এখান থেকে দেড় মাইল দূরে একটা সিনেমা হলের সামনে দুটি টিকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনি। এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র তারা সবাই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না।’
‘যাবে,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটা একরোখার মতো বলল।
‘আচ্ছা, আমি আপনাকে আরেকটা ব্যাখ্যা দিই। খুব সহজ, সাধারণ ব্যাখ্যা। ধরে নিলাম এই জগৎটা আসলে আপনার একটা কল্পনামাত্র, একটা ইস্যুশন, একটা কল্পলোক। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, কী ভীষণ ডিটেইল এই জগৎটা। এখানকার প্রতিটি জিনিস, প্রতিটা বস্তু অসম্ভব পুঙ্খানুপুঙ্খ। এই যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। লক্ষ-কোটি বৃষ্টির ফোঁটা আলাদা-আলাদাভাবে পড়ছে, তার প্রতিটি আপনাকে আলাদাভাবে কল্পনা করতে হচ্ছে। সম্ভব? এই জানালার পর্দাটার দিকে তাকান। প্রতিটি সুতা আলাদাভাবে বোনা। সম্ভব?’
লোকটা চুপ করে থাকে।
আমার একটু একটু করে জেদ চাপছে।
‘আচ্ছা, চিন্তা করে দেখেছেন, আপনার এই কল্পজগৎ সব সময় পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম নিখুঁতভাবে মেনে চলছে। নিউটনের বলবিদ্যা মানছে, থার্মোডাইনামিক্সের সব নিয়ম মানছে, ম্যাক্সওয়েল মানছে, আপনি যেসব নিয়ম-সূত্র এখনো জানেন না, সেগুলোও সবই মানছে। কেন মানছে?’
‘জানি না কেন মানছে।’
‘এই যে এখানে এই কাঠের পেপার ওয়েট। এটা আমি গত বৈশাখি মেলায় কিনেছি। এটা এই যে হাতে তুলে নিলাম। এখন আমি যদি এটা ছেড়ে দিই, এটা ভেসে থাকবে না। মাটিতে পড়ে যাবে। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানবে এটা। আপনার কথা অনুযায়ী, এটা তো বস্তু নয়, একটা স্বপ্নের উপাদান। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানার কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই এটার। আছে? এই যে দেখুন। লক্ষ করুন।’
আমি পেপার ওয়েটটা ছেড়ে দিলাম। ঠকাস শব্দে সেটা মেঝেতে পড়ে গেল।
লোকটা চমকে উঠল। আমিও একটু চমকালাম। টের পেলাম আমি কিছুটা বেপরোয়া আচরণ করছি। পেপার ওয়েট তুলে আমি টেবিলে রেখে দিলাম।
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আমি কি এখন উঠব?’
‘হ্যাঁ। উঠবেন। আমার আসলেই তাড়া আছে। তবে আপনি কাল আবার আসবেন। আমার মনে হয়, আমাকে দরকার হবে আপনার।
‘নিউরোলজিস্টের কাছে যাব না?’ লোকটার কণ্ঠে কোথায় যেন একটা কৌতুক।
‘না, যাবেন না। আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন।’
লোকটা ওঠে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা হ্যান্ডশেক করি।
‘আমি অপেক্ষা করব। সিরিয়াল দিতে হবে না। আমি বলে রাখব। আসবেন, কেননা আপনি চলে গেলেও কিন্তু এই ঘরটা এ রকমই থাকবে।’
লোকটা দরজার দিকে পা বাড়ায়।
‘আপনি ছাতা এনেছেন?’
‘না।’
‘বাইরে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘আমি ভিজব না,’ বলল লোকটা, ঠোঁটে এমন এক লুকানো কৌতুক নিয়ে বলল, যেন কথাটার মধ্যে গভীর কোনো তাৎপর্য আছে।
লোকটা দরজার হাতলে হাত রেখেছে।
একবার, সেকেন্ডের একটা ভগ্নাংশের তরে মনে হলো আমার মনের কোথাও কেউ যেন খুব করে চাইছে, লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে না যাক। লোকটা যাওয়ামাত্র কোথাও কিছু একটা বদলে যাবে।
লোকটা চলে গেল।
এতক্ষণে সিনেমা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আমি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ড্রাইভারকে ফোন দিচ্ছি। ধরে না। গাড়ির ভেতর। ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়।
আমি দ্রুত ব্যাগটা কাঁধে নাই।
দরজার দিকে পা বাড়াই।
এ সময় একটা ঘটনা ঘটে।
আমার ব্যাগের একটা প্রান্ত গিয়ে লাগে টেবিলের ওপর রাখা পেপার ওয়েটের গায়ে। পেপার ওয়েটটা টেবিল থেকে গড়িয়ে যায়।
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
টেবিলের প্রান্ত পেরিয়ে গেলেও পেপার ওয়েটটা মেঝেতে পড়েনি।
কোনো অবলম্বন ছাড়া সেটা শূন্যে ভেসে আছে।