নয়
মাঠের ধার দিয়া চলন-পথ বরাবর বরাট গ্রামে গিয়ে পৌঁছিয়াছে, কাহাকেও জিজ্ঞাসা না করিয়াও ইন্দু সোজা গিয়া গ্রামের তেমাথায় উপস্থিত হইল। বিরাট একটা বটবৃক্ষের ছায়ায় অমরনাথের চতুষ্পাঠী, দশ-বারোজন ছাত্রপরিবৃত হইয়া তিনি ন্যায়ের অধ্যাপনায় নিযুক্ত, এমনি সময় ইন্দু গিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল। অতি বিস্ময়ে প্রথমে অমরনাথের বাক্যস্ফূর্তি হইল না, কিন্তু পরক্ষণে সশিষ্য গাত্রোত্থান করিয়া বহুমানে সংবর্ধনা করিয়া কহিলেন—একি আমার পরম ভাগ্য! আর সকলে কোথায়?
একজন ছাত্র আসন আনিয়া দিল। অনভ্যাসবশতঃ ইন্দুর প্রথমে মনে পড়ে নাই, সে আর একবার নীচে নামিয়া গিয়া, জুতা খুলিয়া রাখিয়া আসনে আসিয়া উপবেশন করিয়া কহিল—আমি একাই এসেছি, আমার সঙ্গে কেউ নেই।
কথাটা বোধ হয় অমরনাথ ঠিক প্রত্যয় করিতে পারিলেন না, স্মিতমুখে নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন।
ইন্দু কহিল—কাকাবাবুর সঙ্গে আমি বেড়াতে বার হয়েছিলাম। তিনি তাঁর এক পীড়িত বন্ধুকে দেখতে গেলেন। আমাকে বললেন, আপনাকে খবর দিতে, যদি পারেন, কাল একবার দেখা করবেন।
অমরনাথ কহিলেন—খবর দেবার জন্য ত জমিদারের লোকের অভাব নেই। কিন্তু এই যদি যথার্থ হয় ত বলতেই হবে এ আমার কোন্ অজানা পুণ্যের ফল। কিন্তু কার বাড়িতে রায়-মশায় এসেছেন শুনি?
ইন্দু কহিল—আমি ত তাঁর নাম জানিনে, শুধু বাড়িটা চিনি। কিন্তু আপনার নিজের বাড়ি এখান থেকে কতদূরে অমরনাথবাবু?
অমরনাথ কহিলেন—মিনিট দুয়ের পথ।
—আমাকে তা হলে একটু খাবার জল আনিয়ে দিন।
একজন ছাত্র ছুটিয়া চলিয়া গেল এবং ক্ষণকাল পরেই সাদা পাথরের রেকাবিতে করিয়া খানিকটা ছানা এবং গুড় এবং তেমনি শুভ্র পাথরের পাত্রে শীতল জল আনিয়া উপস্থিত করিল। প্রয়োজন নাই বলিয়া ইন্দু প্রত্যাখ্যান করিল না, ছানা ও গুড় নিঃশেষ করিয়া আহার করিল এবং জলপান করিয়া কহিল—এখন তা হলে আমি উঠি?
অমরনাথ এই শিক্ষিতা মেয়েটির নিরভিমান সরলতায় মনে মনে অত্যন্ত প্রীত হইয়া কহিলেন—অনাহূত আমার পাঠশালায় এসেই কিন্তু চলে যেতে আপনি পাবেন না। দরিদ্র ব্রাহ্মণের কুটীরেও একবার আপনাকে যেতে হবে। সেখানে আমার মা আছেন, দিদি আছেন, ছোটবোন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছেন। তাঁদের দেখা না দিয়ে আপনি যাবেন কি করে? চলুন।
ইন্দু তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া কহিল—চলুন। কিন্তু সন্ধ্যা হতে ত দেরি নেই, কাকাবাবু যে ব্যস্ত হবেন?
অমরনাথ সহাস্যে কহিলেন—ব্যস্ত হবেন না। কারণ, তাঁকে খবর দিতে লোক গেছে।
টোল-ঘরের পিছন হইতেই বাগান শুরু হইয়াছে। একটা মস্ত বড় পুকুর, তাহার চারিধারে কত যে ফুলগাছ এবং কত যে ফুল ফুটিয়া আছে, তাহার সংখ্যা নাই। অমরনাথের পিছনে সদর-বাটীতে প্রবেশ করিয়া ইন্দু দেখিল, প্রশস্ত চণ্ডীমণ্ডপের একধারে দিনান্তের শেষ আলোকে বসিয়া জন-দুই ছাত্র তখনও পুঁথি লিখিতেছে, অন্যধারে পাঁচ-সাতটি চিক্কণ পরিপুষ্ট সবৎসা গাভী ভূরিভোজনে নিযুক্ত, একটা মস্ত বড় কালো কুকুর একমনে তাহাই নিরীক্ষণ করিতেছিল, অভ্যাগত দেখিয়া সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ল্যাজ নাড়িয়া অভ্যর্থনা করিল। সমস্ত পূর্বদিকটা বড় বড় ধানের মরাই গৃহস্থের সৌভাগ্য সূচিত করিতেছে; একটা জবার গাছ ফুলে ফুলে একেবারে রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে। ইন্দু ভাল করিয়া সমস্ত পর্যবেক্ষণ করিয়া অন্দরে প্রবেশ করিল।
মাটির বাড়ি। আট-দশটি উচ্চ প্রশস্ত ঘর। প্রাঙ্গণ এমন করিয়াই নিকানো যে, জুতা পায়ে দিয়া প্রবেশ করিতে ইন্দুর যেন গায়ে লাগিল। সেইমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে, ধূপধুনা ও গুগ্গুলের গন্ধে সমস্ত গৃহ যেন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।
অমরনাথের বিধবা দিদি ঠাকুরঘরে ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু খবর পাইয়া তাহার মা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ছোটবোন ছেলে কোলে করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। ইন্দু অমরনাথের জননীকে প্রণাম করিল। তিনি হাত দিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন এবং যে দুই-চারিটি কথা উচ্চারণ করিলেন, তাহাতে ইন্দুর মনে হইল, এত বড় আদর ইহজীবনে আর কখনও সে পায় নাই। দাওয়ার উপরে বসিতে তিনি স্বহস্তে আসন পাতিয়া দিলেন।
ইন্দু উপবেশন করিলে অমরের জননী কহিলেন—গরীবের ঘরে ঠিক সন্ধ্যার সময় আজ মা কমলা এলেন।
ইন্দু শিক্ষিতা মেয়ে, কিন্তু মুখে তাহার হঠাৎ কথা যোগাইল না। শিক্ষা, সংস্কার ও অভ্যাসবশতঃ জাতির কথা তাহাদের মনেও হয় না, কিন্তু আজ এই শুদ্ধাচারিণী বিধবা জননীর সম্মুখে কেমন যেন তাহার সঙ্কোচ বোধ হইল। কহিল—মা, আপনারা ব্রাহ্মণ, কিন্তু আমি কায়স্থের মেয়ে। আপনি আসন পেতে দিলেন?
গৃহিণী স্নিগ্ধহাস্যে কহিলেন—তুমি যে সন্ধ্যার সময়ে আমার ঘরে লক্ষ্মী এলে। দেবতার কি জাত থাকে, মা? তুমি সকল জাতের বড়।
অমরের ছোটবোন বোধ হয় ইন্দুর সমবয়সী। সে কাছে আসিয়া বসিতেই ইন্দু তাহার ছেলেকে কোলে টানিয়া লইল।
মা জিজ্ঞাসা করিলেন—তোমার নামটি কি মা?
ইন্দু কহিল—মা, আমার নাম ইন্দু।
মা কহিলেন—তাই ত বলি মা, নইলে কি কখনও এমন মুখের শ্রী হয়!
ইন্দু অত্যন্ত লজ্জা পাইয়া মুচকিয়া হাসিয়া কহিল—কিন্তু আর একদিন এলে যে তখন কি বলবেন, আমি তাই শুধু ভাবি।
মাও হাসিয়া কহিলেন—ভাবতে হবে না মা, আমিই ভেবে রেখেছি, সেদিন তোমাকে কি বলবো। কিন্তু আসতে হবে।
ইন্দু স্বীকার করিল। অমরের দিদি ঠাকুরঘর হইতে ছুটি পাইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন; কহিলেন—ঠাকুরের আরতি হতে বেশী দেরি নেই ইন্দু, তোমাকে কিছু-একটু মুখে দিয়ে যেতে হবে।
ইন্দু তাঁহার পরিচয় অনুমান করিয়া লইয়া বলিল, খাওয়া আমার আগেই হয়ে গেছে দিদি, আর একদিন এসে ঠাকুরের প্রসাদ পেয়ে যাবো, আজ আর আমার পেটে জায়গা নেই।—এই বলিয়া সে পুনঃ পুনঃ প্রতিজ্ঞা করিল যে, এ স্থান ত্যাগ করিবার পূর্বে আর একদিন আসিয়া সে ঠাকুরের প্রসাদ ও মায়ের পায়ের ধূলা গ্রহণ করিয়া যাইবে।
ইন্দু বাটী হইতে যখন বাহির হইল, তখন সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার গাঢ় হইয়া আসিতেছিল। অমরনাথের হাতে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। ইন্দু কহিল—আলোটা আর কাউকে দিন আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
অমরনাথ কহিলেন—পৌঁছে দেবার লোক আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
তার মানে?
তার মানে আপনি অনাহূত আমার ঘরে এসেছিলেন। এখন পৌঁছে দিতে যদি আর কেউ যায় ত আমার অধর্ম হবে।
কিন্তু ফিরতে যে আপনার রাত্রি হয়ে যাবে, অমরনাথবাবু?
তার আর উপায় কি? পাপ অর্জন করার চেয়ে সে বরঞ্চ ঢের ভাল।
ইন্দু কহিল—তবে চলুন। কিন্তু আজ আমার একটা ভুল ভেঙ্গে গেল। আমরা সবাই আপনাকে বড় দরিদ্র ভাবতাম।
অমরনাথ মৌন হইয়া রহিলেন।
ইন্দু কহিল—আপনাদের বাড়ি ছেড়ে আমার আসতে ইচ্ছে করছিল না। আমার ভারী সাধ হয় আলোদের বাড়ি ছেড়ে আমি দিন-কতক মায়ের কাছে এসে থাকি।
অমরনাথ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন—অত বড় সৌভাগ্যের কল্পনা করতেও আমাদের সাহস হয় না। (‘মাসিক বসুমতী’, বৈশাখ, ১৩৩২)
[—অসমাপ্ত]