জাঁহাবাজ জিন

জাঁহাবাজ জিন

আষাঢ় মাসের সকাল। গত রাত্রে সন্ধ্যার দিকে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজকের সকাল তাই ভারি পরিষ্কার আর ঝক্‌ঝকে লাগছে। টুনি আর মোনা সাতসকালেই উঠে দৌড়িয়েছে জামতলার দিকে। টুসটুসে পাকা জামে তলাটা ছেয়ে রয়েছে। ওরা দু-বোনে খুশিতে ডগমগ করতে করতে জাম কুড়োতে লেগে যায়। টুনি

ওর লাল শাড়ির আঁচলে জাম রাখতেই মোনা হা হা করে ওঠে, ‘করিস্ কী? মা বলে দিয়েছে না, আঁচলে কক্ষনো জাম নিবি না! কালো কষ লেগে গেলে আর উঠবে না।’ টুনি সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে আঁচল থেকে জামগুলো ফেলে দিল, কাঁচুমাচু করে বলল, ‘দুর ছাই, কিছুতেই মনে থাকে না; কিন্তু এখন নেব কিসে করে জাম?’

—আসার সময় একটা গামলা কি টুকরি নিয়ে এলে ভালো হত।

-–তাত হত, কিন্তু আনা যখন হয়নি, তখন আর কী করা!

ওরা দু-বোন এ-দিক ও-দিক তাকাতে লাগল। যদি একটা-কিছু পাওয়া যায়, কলার খোল কি তালের ডোঙো—তাহলে তাইতে করে জামগুলো বাড়ি নিয়ে যবে।

হঠাৎ টুনি চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও আপা, দেখ দেখ, কদমগাছতলায় ওটা কী নড়ছে?’ মোনাও কদমগাছতলার দিকে তাকাতেই চমকে গেল—রাশিরাশি ঝরা-কদমের ওপর শুয়ে হাত-পা নাড়ছে একটা ছোট্ট বাচ্চা। যেই-না দেখা, অমনি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল মোনা। টুনিও হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে ওর পেছুপেছু দৌড়তে দৌড়তে চ্যাচাতে লাগল, ‘এই আপা, ছুটছিস্ কেন অত? কী হল?’ মোনা একছুটে একদম বাড়ির ভেতরের দরদালানে এসে থেমেছে। চোখ বড় করে বলল, ‘বাপরে, ওটা মানুষের বাচ্চা না, জিনজিন। ওদের কাছে যেতে নেই। ‘

টুনি অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘হ্যাঁঃ, বলেছে তোকে জিন। ও তো একদম মানুষের বাচ্চা। আহা, কারা ফেলে গেছে গো—তুলে না আনলে মরে যাবে।’

—খবরদার যাবিনে বলছি ও-দিকে, গেলেই ভয়ানক ক্ষতি হবে আমাদের। ও কক্ষনো মানুষের বাচ্চা না। আমাদের ভুলোবার জন্য জিনে অমনি করে রেখে যায়—

ওদের বাবিতণ্ডা শুনে মা আর দাদী দুজনেই বেড়িয়ে এলেন ঘর থেকে, ‘কিরে, সাত-সকালে উঠে ঝগড়া লাগিয়েছিস্ কেন?

টুনি, মোনা দুজনেই একসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। মোনা বলতে চায় কদমতলায় ও একটা জিনের বাচ্চা দেখেছে, টুনি বলে, ‘কখনো না, ওটা মানুষেরই বাচ্চা।’

ওদের দুজনকে থামিয়ে এক-এক করে দুজনের কথা শুনে মা আর দাদী তক্ষুনি রমজান পেয়াদা আর রহিমন্নেসা ঝিকে পাঠিয়ে দিলেন, কদমগাছতলায় গিয়ে দেখে আসতে—কী ব্যাপার।

একটু পরেই ওরা ফিরে এল। রহিমন্নেসার কোলে একটা ছোট্ট বাচ্চা—এতক্ষণে ওঁয়াওঁয়া করে কান্না শুরু করেছে। কান্নার শব্দে বাড়ির যেখানে যে ছিল, সবাই ছুটে এল। টুনি-মোনার বড় দুটো ভাই বাবুল আর টুটুল, রহিমন্নেসার মেয়ে করিমন্নেসা, ছোক্রা চাকর ফয়েজদ্দি আর মঈনদ্দি, গরুর রাখাল আইনদ্দি— সবাই এসে চারধারে ভিড় করল; এমনকি খামারবাড়ির মুনিষ দুজনও খিড়কির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। কেবল এল না রাঁধুনি হীরামন্নেসা। সে রান্নাঘরের দাওয়াতে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে বলতে লাগল, ‘ও জিনের কারসাজি, জিনের ধোঁকাবাজি। ওকে বাড়ি ঢুকোলে বালা-মুসিবত আসবে—’

মা ধমকে উঠলেন— ‘কী যা-তা বকছ, পাকোয়ানি বুড়ি? একদম হুবহু মানুষের বাচ্চা, ছোট্ট একটা বাচ্চা—আহা রে কোন্ পাষাণ মায়ে এমন করে ফেলে গেছে। রহিমন্নেসা তুই ওকে গোসল করিয়ে আমার ঘরে নিয়ে যা, আমি একটা পুরনো শাড়ি দিচ্ছি, তাই দিয়ে এখন জড়িয়ে রাখ্। পরে জামা-কাপড় বানিয়ে দেওয়া যাবে। মইনদ্দি, তুই খানিকটা দুধ জ্বাল দিয়ে নিয়ে রহিমাকে এনে দে, ও বাচ্চাটাকে খাওয়াক। আর রমজান মিয়া, তুমি গ্রামে বেরিয়ে খোঁজ করো তো এর বাপ-মার হদিস পাও নাকি।

এই বলে মা গম্ভীরভাবে নিজের ঘরে চলে গেলেন। চাকর-দাসিরাও ভয়ে মুখ বন্ধ করে যে-যার কাজে চলে গেল।

টুনি, মোনা দুজনে দাদীআম্মার দু-হাত ধরে ওঁর ঘরের মধ্যে গেল। টুনি বলে উঠল, ‘দেখলি আপা, ওটা মানুষেরই বাচ্চা।’

মোনা দাদীআম্মাকে সাক্ষী মানল, ‘তাহলে যে জিনদের এত গল্প শুনি, জিনেরা এই করে, সেই করে—জিন কি তাহলে মিথ্যে?

দাদীআম্মা ফাঁপরে পড়লেন, আন্তা আমতা করে বললেন, ‘ঠিক মিথ্যে বলা যায় না। হয়তো জিন বলে কিছু আছে। তবে আমরা চোখে দেখে প্রমাণ পাইনি কিছু।’

মোনা প্রতিবাদ করে বলল, ‘তবে যে পাকোয়ানি বুড়িআম্মা বলে জিনেরা যখন-তখন মানুষ, ছাগল, গরু— সবকিছুর চেহারা ধরতে পারে। ওদের ইচ্ছে হলে ওরা মানুষের চোহারা ধরে যে কারো বাড়িতে এসে থাকতে পারে। ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে ওরা মানুষের খুব উপকার করে, আবার খারাপ ব্যবহার করলে ওরা রেগে মানুষের সর্বনাশ করে দেয়। ওদের অবিশ্বেস করলেও নাকি ওরা রেগে যায়?’

দাদীআম্মার তো ওইখানেই গোল। জিন মানতেও মন সায় দেয় না, আবার না মানতেও যে ভয়! যদি ওরা….তার চেয়ে কাজ কি বাপু ও-সব নিয়ে মাথা ধরিয়ে? তাই তাড়াতাড়ি করে বললেন, ‘শোন মোনা, পাকোয়ানি বুড়ি যে-সব গল্প বলে, সেগুলো গল্পই। রূপকথার মতোই ছেলে-ভূলানো গল্প। তবে জিন যদি থাকেই, তো থাকুক না ওরা নিজের মনে। আমাদের বাপু কী দরকার ওদের ঘাঁটাবার!’

জিনের প্রসঙ্গে এইখানেই ইতি পড়ল। টুনি, মোনা চলল মা-র ঘরের দিকে। বাচ্চাটার ততক্ষণে গোসল-খাওয়া শেষ হয়েছে। মনের খুশিতে হাত-পা ছুড়ছে এখন। কী নাদুস-নুদুস বাচ্চাটা!

কিন্তু এমন চমৎকার বাচ্চাটার বাপ-মা, কি তিনিকুলে কোনো আত্মীয়-স্বজনেরও খোঁজ পাওয়া গেল না! টুনির আম্মা কী আর করেন, ফেলে তো আর দিতে পারেন না বাচ্চাটাকে, তাই ওঁদের বাড়িতেই মানুষ হতে লাগল বাচ্চাটা।

টুনির আব্বা গ্রামের জমিদার। টাকা-পয়সার তো আর অভাব নেই, তাই বাড়তি একটা ছেলে মানুষ করতে গায়েই লাগে না ওঁদের। রহিমন্নেসা ঝি-ই নাওয়ানো-খাওয়ানো, দেখাশোনা করে। ওর বারো বছরের মেয়ে করিমন্নেসাই বেশির ভাগ সময় কোলে নিয়ে থাকে বাচ্চাটাকে। মাঝে মাঝে টুনি-মোনা, দাদী এঁরাও কোলে নিয়ে আদর করেন ছেলেটাকে।

ছেলেটার একটা নাম দেওয়া দরকার। ওর নাম-রাখা নিয়ে টুনি-মোনাদের মধ্যে কয়েকদিন ধরে জল্পনা-কল্পনা, বাক্‌বিতণ্ডা হয়ে হাতাহাতি হবারও উপক্রম হয়েছে। শেষমেষ দাদীআম্মাই ঠিক করে দিলেন, ওর নাম রাখা হোক্ কদম আলী—কদমগাছতলায় পাওয়া গেছে, তাই কদম।

কদম আলী বড় হতে থাকে, কিন্তু যা চঞ্চল আর অস্থির হয়ে উঠেছে ছেলেটা! ওর দুষ্টুমির জ্বালায় বাড়িসুদ্ধ সবাই অস্থির। কত যে বাসন-গেলাস ভাঙছে ও দৈনিক, তার হিসেব কষতে গেলে চোখ কপালে উঠবে। ওর ছুটোছুটির চোটে চেয়ার উলটে পড়ছে, বদনা ছিটকে পড়ছে, ধাক্কা খেয়ে কখনো কখনো টুনি-মোনাও উলটে পড়ে।

স্কুলে যাবার বয়স হলে টুনির আব্বা কদম আলীকে গ্রামের পাঠশালাতে পড়তে পাঠালেন। সেখানে গিয়েও কদম আলীর বিশেষ কোনো উন্নতি হল না, বই ছিঁড়ে ফেলবে, পড়া করবে না, রোজই মাস্টার সাহেবের বেত খেয়ে গাধার টুপি মাথায় দিয়ে বসে থাকবে। কারো কথাই শোনে না ও, এমনকি টুনির বাবার বকুনিতেও ভয় নেই ওর।

কিন্তু একটা জায়গায় কদম আলী একদম বশ- —সে হল পাকোয়ানি বুড়ির গল্পের কাছে। পাকোয়ানি বুড়ির মুখে মজার মজার গল্প শুনতে পেলে ও নাওয়া-খাওয়া, দুষ্টুমি সব ভুলে যায়।

হীরামন্নেসা পাকোয়ানির এখনো ধারণা কদম আলী জিনদের ছেলে। যখনই কদম বাসন-গেলাস ভাঙে বা টেবিল চেয়ার উলটোয়, হীরামন্নেসা গজ্‌জ্ করে, ‘আমার কথায় কেউ কানই দেবে না—হাজার বার করে বলছি ও জিনের ছেলে, তা গরিবের কথায় কারো তোয়াক্কাই নেই। কে জানে বাবা ও কী করতে এসেছে এ বাড়িতে। ভালাই করবে, না বুরাই করবে ওই জানে আর আল্লাই জানে।’ কিন্তু বুড়ি যতই গজ্‌জ্‌ করুক না কেন, কদম আলী সামনে এলেই ও ভালোমানুষ। কদম যখনই গল্প শোনার জন্য আব্দার ধরে, ও তক্ষুনি গল্প বলতে বসে যায়। কে জানে বাবা জিনেদের ছেলে, যদি রেগে গিয়ে কোনো ক্ষতি করে বসে। তার চেয়ে যা চাইছে, তাই করি না কেন!

কত রকম গল্পই যে জানে পাকোয়ানি বুড়ি, ব্যাঙমা-ব্যাঙমীর গল্প, মধুমালতীর গল্প, কাজলরেখার গল্প! কিন্তু কদম আলীর সবচেয়ে ভালো লাগে জাঁহাবাজ জিনের গল্পটা। সারাদিন দৌড়-ঝাঁপ, দুরন্তপনা করে কাটিয়ে সন্ধে হলেই কদম আলী এসে বসবে হীরামনের আঁচল ধরে, ‘সেই জাঁহাবাজ জিনের গল্পটা বলো।’ হীরামন পাকোয়ানির তখন রাতের রান্নার সময়, বড়ই ব্যস্ত, তবুও কদম আলীকে ‘না’ বলে না। হাতা-খুন্তির ঠনঠন, তেল-মশলার ছ্যাঁকছোঁক কাজের মধ্যেই সে গল্প বলে যায় :

জিনের দেশে একবার একটা ছেলে হয়ে উঠল বড়ই দুষ্টু। কারো কথা শোনে না, লেখাপড়া করে না, অন্য কিছু কাজকর্ম করতে বললেও তার আলিস্যি। শেষে ওর বাপ-মা না পেরে ওদের বাদশার কাছে ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে নালিশ করল। জিনের বাদশা মহারেগে বললেন, ‘তুমি যদি ভালো না হয়ে চল, বাপ-মার কথা না শোন, তাহলে তোমাকে মানুষের রাজ্যে তাড়িয়ে দেব। সেখানে গিয়ে পড়লে ভয়ানক কষ্ট পাবে।’ ছেলেটা এতে ভয় তো পেলই না, উলটে তার খুব আগ্রহ হলো মানুষের রাজ্যে আসবার জন্য। সে বাদশার কথার জবাবে বলল, ‘থোড়াই কেয়ার করি কষ্টকে। মানুষের রাজ্যে গিয়ে দেখি কী হয়।’ জিনের বাদশা রেগে তক্ষুনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন তাঁর রাজ্য থেকে। ছেলেটা মানুষের রাজ্যে এসে পড়ে প্রথম ক’দিন তো একটু ভড়কে গেল। তারপর এক গেরস্ত বাড়িতে গিয়ে বলল, ‘তোমরা আমাকে খেতে পরতে আর থাকতে দাও। আমি তোমাদের চারজনের কাজ একলা করে দেব।’ তারা তো ভয়েই অস্থির! বাপ্‌রে জিন! না জানি কখন কী করে বসে। তারা ওকে থাকতে দিতে কিছুতেই রাজি হল না। জিন ছেলেটা নিজের দেশে দুষ্টুমি করলেও ওর মনটা আসলে ছিল ভালোই। তাই ওই গেরস্তর কোনো ক্ষতি না করেই আরেক গেরস্তর বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই ওদের অনেক কাজ করে দিয়ে তারপর খেতে চাইল। ওরা তো ওর কাজ করার বহর দেখেই বুঝে নিয়েছে এ নিশ্চয়ই জিন, নইলে এত কাজ একসঙ্গে কোনো মানুষ তো পারবে না। ওরাও ভয়ে ওকে ঠাঁই দিতে রাজি হল না। জাঁহাবাজ জিন এইবার পড়ল মুশকিলে। ও তখন একটা মাঠে একলা একলা বসে অনেক ভাবল, কী করে মানুষকে ভয় না খাইয়ে খাওয়া-পরা আদায় করা যায়। শেষে এক ফন্দি বার করল। এক জমিদারবাড়িতে দুপুর-রাত্রে ও চুপিচুপি ঢুকল। সবাই ঘুমে অচেতন, জাঁহাবাজ জিন আস্তে আস্তে গোয়ালঘরে ঢুকে গোয়াল পরিষ্কার করে খড় কেটে খইল আর মাড় দিয়ে মাখিয়ে ওদের গরুর দোনাতে রেখে দিল, খামারবাড়ি ঝাঁট দিয়ে সাফ করল। রান্নাঘরে গিয়ে সমস্ত হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন মেজে চুলো সাফ করে একবোঝা কাঠ কেটে রাখল। তারপর জমিদার-গিন্নির ভাঁড়ারঘরে ঢুকে দেখে হাঁড়িতে পায়েস রান্না করা আছে। ও একটা বড়বাটি ভর্তি করে পায়েস নিয়ে পেটপুরে খেয়ে কাঠ-রাখা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে রইল।

সকালবেলায় সবাই ঘুম থেকে উঠে অবাক! রাখাল গোয়ালে গিয়ে দেখে তার কাজ কে যেন করে রেখেছে, মুনিষ খামারে গিয়ে দেখে তার কাজ শেষ। রাঁধুনি রান্নাঘরে এসে হাউমাউ জুড়ে দিল, জমিদার-গিন্নি ভাঁড়ার খুলে থ। তালাবদ্ধ করা ভাঁড়ারের মধ্যে থেকে পায়েস উধাও, আর সারাবাড়ির কাজও—এ দেখেই তিনি বুঝে গেছেন এ জিনের কাজ। যাই হোক, উনি খুব দয়াবতী ছিলেন। ভাবলেন, আহা চাট্টি খাওয়ার জন্য বেচারা এত কষ্ট করেছে, খাক্। আর কাজগুলোও তো হচ্ছে। সেই থেকে জিনটা সেই জমিদারবাড়িতে রয়ে গেল। সারারাত ধরে ও কাজ করে আর ভোরবেলায় পেটপুরে একথালা খাবার খায়। জমিদার-গিন্নিই রোজ রাতে ওর জন্যে থালা ভর্তি করে খাবার রেখে দেন ভাঁড়ারে। কাজকাম সেরে জিন খেয়ে তারপর কাঠ-রাখার ঘরে ঘুমোয়। এটা ঘটেছিল কোন্ জমিদার বাড়িতে জানো?’

কদমের বহুবার শোনা এ গল্প, তবুও সে প্রথমবারের মতোই চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘কোন্ বাড়িতে?’

এই বাড়িতেই। এই জমিদার সাহেবের দাদার দাদার দাদার দাদার আমলে ঘটেছিল এই ঘটনা। এত কাজ করে দিত জাঁহাবাজ জিনটা—সারারাত কাজ করত, আর তারপর একথালা খাবার খেয়ে কাঠ-রাখা ঘরটাতে—হ্যাঁগো, এখন যে ঘরটাতে কাঠ রাখা হয়—ওই ঘরটাতেই ও ঘুমোত।’ বলেই হীরামন্নেসা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল, ‘সে কতকাল আগের কথা। এখন আর ও-রকম কেউ করে না।’ হীরামনের দুঃখ হবার যথেষ্ট কারণ আছে, বাসন-মাজা ছোকরা বা ঝি কারো অসুখ হলে হীরামনকেই এই বুড়ো বয়সে হাঁড়ি-বাসন মেজে তুলতে হয়!

সব গল্প ছেড়ে এই গল্পটাই শুনতে কদম সবচেয়ে ভালোবাসে। প্রায়ই মনে মনে জাঁহাবাজ জিনের কথা ভাবে সে, কিন্তু নিজে ওর মতো কাজের ছেলে হবার কথা স্বপ্নেও কখনো ভাবে না। দিনে দিনে কদম আরো দুষ্টু, আরো আলসে হয়ে উঠছে। কাজ করার কথা ভাবতেই যেন ওর গায়ে জ্বর আসে।

ইদানীং রমজান পেয়াদা কদম আলীর পেছনে লেগেছে। কদমকে দেখলেই ও গজগজ শুরু করে, ‘এত বড় ধাড়ি হয়েছ, খালি বসে বসে গিলতে লজ্জা করে না? বাপের সম্পত্তি পেয়েছ? লেখাপড়া তো কিচ্ছু হল না – এবার একটু কাজকাম দেখার চেষ্টা কর, নইলে কপালে অনেক দুঃখ আছে বলে দিচ্ছি।’

কদম আলীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রমজান পেয়াদার অত্যাচারে। কথায় কথায় গালমন্দ, আর খোঁটা। আর ওকে দিয়ে রাখালের, মুনিষের কাজ করিয়ে নেবার চেষ্টা। কেন, ও কি রাখাল না মুনিষ যে ওইসব কাজ করবে? কিন্তু আজকাল আম্মা, দাদীআম্মাও যেন আগের মতো আদর করেন না, বরং উলটে গালমন্দই করেন। টুটুল, বাবুলও মাঝে মাঝে খোঁটা দিয়ে কথা বলে। টুনি-মোনা বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে, নইলে ওরাও কী বলত, কে জানে!

কদম ভাবে, ওকে কেউ দেখতে পারছে না আজকাল ও আর থাকবে না এ বাড়িতে।

হলও তাই একদিন। হঠাৎ কদম আলী উধাও বাড়ি থেকে। কোথা গেল, খোঁজ খোঁজ খোঁজ! আম্মার দুই চোখ পানিতে ভরে গেল, রহিমন্নেসা আর করিমন্নেসা কেঁদে-কেটে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করল। দাদীআম্মারও খুব মন-খারাপ হল, এমনকি হীরামন পাকোয়ানিও যেন ‘জিনের’ বিদেয় হওয়াতে খুব খুশি হতে পারল না। রোজ সন্ধের গল্পবলার সময়টা ওর বড়ই ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল।

কিছুদিন পর খবর পাওয়া গেল, কদম আলী জাহাজের খালাসী হয়ে সমুদ্রে চলে গেছে।

খালাসী হয়ে প্রথম ক’দিন কদম আলীর বেশ ভালোই লাগল। তারপরই ও টের পেতে লাগল, জীবনে কষ্ট অনেক বেশি। জমিদারবাড়ির খাওয়া-দাওয়া, ওখানকার আরাম, মা-দাদীর স্নেহ, রহিমন্নেসা করিমন্নেসার আদর-যত্ন, পাকোয়ানি বুড়ির গল্প —এ-সব কথা মনে পড়ে তার কষ্ট আরো বেড়েই চলল।

ও-দিকে জমিদারবাড়িতেও কদম আলীর কথা ভেবে সবারই মনে কষ্ট। চৌদ্দ বছর ধরে ছেলেটা এই বাড়িতেই ছিল। তার মায়াটা কাটানো কি এতই সহজ! কিন্তু ও তো চলেই গেছে, আর কি আসবে! এমনি করে দিন, সপ্তাহ, মাস গিয়ে বছর ঘুরে এল।

আবার আষাঢ় মাসে কদমগাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠল, সেইদিকে চেয়ে জমিদারবাড়ির সবারই চোখ পানিতে ভরে ওঠে। সবাই বলল, এবার যেন কদমগাছটায় বড্ড বেশি করে ফুল এসেছে।

আর তারপরই ঘটল ব্যাপারটা। সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়ে সকালবেলাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আইনদ্দি রাখালের ঘুম ভাঙতে আজ একটু দেরি হয়েছে। চোখ মুছতে মুছতে গোয়ালের সামনে এসেই রাখালের দু-চোখ ছানাবড়া! সমস্ত গোয়ালটা পরিষ্কার ততক্ করছে, গরুগুলোর দোনায় জাবনা দেওয়া। আইনদ্দি দৌড়ে রান্নাঘরে আসতেই দেখে হীরামন্নেসা দু-চোখ গোল করে রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওরও গতরাতের সমস্ত হাঁড়িকুড়ি বাসন-পেয়ালা ধোয়া-মাজা পরিষ্কার। আইনদ্দিকে দেখেই পাকোয়ানি বুড়ি চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এ সেই জাঁহাবাজ জিনের কাজ। নিশ্চয় এতকাল পরে সেই জিন ফিরে এসেছে। শোন, এই নে একথালা খাবার। কাঠ-রাখা ঘরটায় গিয়ে রেখে আয়—জিনটার খাবার। দেখিস্, সাবধানে যাস্। জিনটা এখন ঘুমুচ্ছে নিশ্চয়ই, আবার ঘুম ভাঙিয়ে দিনে যেন, তাহলে রেগে অনর্থ ঘটাবে।’

ততক্ষণে সারাবাড়ি জেগে গেছে। আইনদ্দি একথালা ভর্তি খাবার নিয়ে কাঠ-রাখা ঘরের দিকে এগোতে লাগল। ভয়ে ওর বুক টিটিস্ করছে, আবার কৌতূহলও হচ্ছে জাঁহাবাজ জিনকে দেখবার জন্য। পেচুপেছু বাড়ির সবাইও পা টিপে টিপে চলছে। সবাই জাঁহাবাজ জিনকে দেখবে।

কাঠের ঘরের দরজাটার কাছে এসে আইনদ্দি থেমে গেল। প্রথমে গলা বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখল। তারপর ফিফিসিয়ে বলল, ‘ওই যে ও-দিকে মুখ করে ঘুমোচ্ছে। বাপরে কী তাগড়া জোয়ান।‘

আইনদ্দির পেছনেই বাবুল, টুটুল। তারপর ফয়েজদ্দি, রমজান পেয়াদা, করিমুন্নেসা। তারও পেছনে হীরামন্নেসা পাকোয়ানি, সবগুলো দাঁত বের করে। এমনকি আম্মা, দাদীআম্মাও তাঁদের ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আইনদ্দি পা টিপে টিপে ঘরের চৌকাঠ পার হয়ে ভেতরে গেল। ইচ্ছে, খাবারের থালাখানা মেঝেতে রেখেই পালিয়ে আসবে, কিন্তু ওর পেছনে পেছনে সবাই চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে এসে ভিড় জমিয়েছে। আইনদ্দি আর এগোচ্ছে না – এরাও পিছোতে নারাজ। ফলে ভিড়ের চাপটা দিয়ে পড়ল আইনদ্দির পিঠে। আইনদ্দি হেঁট হয়ে থালাটা মেঝেয় রাখতে গিয়েই হঠাৎ হুড়মুড় করে উপুড় হয়ে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে পেছনের সবাইও টাল সামলাতে না-পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ল আইনদ্দির ওপর। সবারই গলা থেকে একই সঙ্গে যে আর্তস্বরগুলো বেরুল, সেগুলো একত্র হয়ে ভয়ানক বদখত বিটকেল একটা আওয়াজ উঠল, আর জিনটাও চমকে জেগে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ওরে বাবারে খেলোরে’—বলে সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওদের প্রথম চিৎকারটা শুনেই আম্মা দৌড়ে জমিদার সাহেবের ঘরে গিয়ে ওঁকে খবর দিয়েছেন। জমিদার সাহেব বন্দুক হাতে দৌড়ে এসেই দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘এ-কী! কদম আলী? তুই? কোত্থেকে এলি? এসেই কি ভয় দেখাচ্ছিস্ সবাইকে?’

অমনি সবাই চিৎকার থামিয়ে মুখ তুলে দ্যাখে কাঁদ-কাঁদ মুখে জোড়হাত করে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে জাঁহাবাজ জিন নয়— তাদেরই অতি চেনা কদম আলী। কদম আলী ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বলে উঠল, ‘আ-আমি ভয় দেখাইনি আব্বাজান। আ-আ-আমাকেই এরা ভয় দেখাচ্ছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *