জল বনাম (?) পানি

জল বনাম (?) পানি

নদীতে, সাগরে কিংবা পুকুরে, অথবা পাতকুয়ো অথবা পাতকুয়ো-নলকূপে বা বাথরুমের চৌবাচ্চায় আমরা যে তরল পদার্থটি পাই তার নাম কী?—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বাংলা বাচকগোষ্ঠী (Speech community)-র সকলেই প্রায় সমস্বরে বলে উঠবে ‘জল, জল’। কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই তা-ই? বাংলা বাচকগোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্যই কি ওই তরল পদার্থটিকে ‘জল’ শব্দে অভিহিত করে? আমাদের অভিজ্ঞতায় এর বিপরীতটাই সত্য বলে মনে হয়। বাংলা বেসরকারি হিসেবে এই জনসংখ্যা প্রায় সতেরো কোটি—ভারতে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি, আর ‘বাংলাদেশে’ প্রায় সাড়ে এগারো কোটি। এই সতেরো কোটির মধ্যে গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান ধর্মাবলম্বী—এঁরা ভারত ও ‘বাংলাদেশ’ উভয়েই বিরাজমান। বাংলা বাচকগোষ্ঠীর এই সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ উক্ত তরল পদার্থটিকে ‘জল’ বলে না, বলে ‘পানি’। বস্তুত বাংলা বাচকগোষ্ঠীর হিন্দু অংশের কাছে ‘পানি’ শব্দটি অচেনা না-হলেও তারা সকলেই ‘জল’ শব্দটি ব্যবহার করে, আবার মুসলমান অংশ ‘জল’ শব্দের কথা জানলেও তা ব্যবহার না-করে ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করে। অর্থাৎ পৌনঃপুন্য বা frequency-র বিচারে হিন্দুদের কাছে জলবাচক প্রথম শব্দটি হচ্ছে ‘জল’ আর মুসলমানদের কাছে জলবাচক প্রথম শব্দটি হচ্ছে ‘পানি’।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একই বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রভেদ হবার কারণ কী? কেউ কেউ বলতে পারেন, প্রশ্নটা যত না ভাষাতাত্ত্বিক তার চেয়েও বেশি সমাজতাত্ত্বিক। ভারতীয় বা বাংলাদেশি মুসলমানেরা বাঙালি হলেও তাঁরা ধর্মের দিক থেকে এমন একটা ভাষিক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্বিত যার সঙ্গে আরবি ফারসি তথা উর্দু ভাষার যোগ বিদ্যমান। ‘পানি’ শব্দটি তদ্ভব হলেও আসলে হিন্দি তদ্ভব, এটি হয়ত হিন্দি থেকে হিন্দুস্থানীতে এবং হিন্দুস্থানি থেকে উর্দুতে গিয়ে থাকবে এবং সেখান থেকে বাঙালি মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে গিয়ে এই শব্দটি হিন্দি থেকে ঋণ নিয়েছেন, অর্থাৎ ‘পানি’ একটি ধার-করা শব্দ (loan word)। এই সমাধান আপাতস্বস্তিদায়ক, কিন্তু অনৈতিহাসিক। কারণ ভাষার ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে।

বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা চর্যাপদ থেকেই ধরা যাক। চর্যাপদে জলবাচক শব্দ এই ক-টি: পানী (চর্যা ১৪,৪৫,৪৭), পাণিআ (চর্যা ৪৩), পণিআঁ (চর্যা ৩৫), জল (চর্যা ১৩, ৩৯, ৪৩), অপ (চর্যা ৪১), উদক (চর্যা ২৯)—এর মধ্যে পৌনঃপুন্যের দিক থেকে ‘পানী’ শব্দ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত, ‘জল’ এককভাবে মাত্র একবার, অন্যত্র সমাসবদ্ধ পদের সমস্যমান পদ হিসেবে ব্যবহৃত, ‘উদক’-ও সমস্যমান পদ; ‘পাণিআ’, ‘পণিআঁ’ এবং ‘অপ’ একক শব্দ হিসেবে একবার করে ব্যবহৃত। তাহলে কি ধরে নেব যে প্রাচীন বাংলায় জলবাচক প্রথম শব্দটি ছিল ‘পানী’ বা ‘পানীয়’-জাত ওইরকম কোনো তদ্ভব শব্দ? এতটা চরমপন্থী মত গ্রহণ না-করেও আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, ওই যুগে ‘পাণী’ শব্দটি ছিল অতিপ্রচলিত এবং তার পাশাপাশি ‘জল’ শব্দও নিতান্ত অচল ছিল না। তুলনায় ‘অপ’ ও ‘উদক’ শব্দদুটি নিছক প্রতিশব্দ মাত্র, যা কবিরা অনেকসময় ছন্দের টানে কিংবা অলংকারের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে বাধ্য হন, অথচ যা বাচকগোষ্ঠীর নিত্যব্যবহৃত প্রথম শব্দের তালিকায় পড়ে না। যাই হোক, এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয় : [এক] ‘পানী’/‘পানি’ বাংলায় ধারকরা শব্দ নয়, ভাষার গোড়া থেকেই এটি বাংলা শব্দ; [দুই] প্রাচীন বাংলার বাচকগোষ্ঠীর কাছে ‘পানী’ ও ‘জল’ শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো সামাজিক ভেদ-সংস্কার ছিল না। ৪৩নং চর্যার কবি ভুসুকু একই পঙক্তিতে ‘জল’ ও ‘পাণিআ’ পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন: ‘জিম জলে পাণিআ টলিআ ভেঊ না জাঅ’।

অনেকে ভুসুকুর বাঙালিয়ানায় সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন, কিংবা বলতে পারেন যে, ভুসুকু বাংলা বাচকগোষ্ঠীর অন্তর্গত হলেও তিনি যে সময়কার বাংলা বাচকগোষ্ঠীর সদস্য, সেই সময়ের পর এই বাচকগোষ্ঠীর অনেক রূপান্তর হয়েছে, কাজেই ভুসুকুর পদ উদ্ধার করলে কোনো সংগত মীমাংসা হওয়া সম্ভব নয়। ঠিক কথা, ভুসুকু অনেকদিন আগেকার লোক, তাঁর সময়ে ভারতের এই এলাকায় মুসলমানদের অভ্যাগম হয়নি, কাজেই তাঁর রচনায় বা প্রাক-ইসলাম যুগের রচনা হিসেবে সাধারণভাবে সমস্ত চর্যাতেই ‘জল’-এর পাশে ‘পানী’ বা ‘পানী’-র পাশে ‘জল’ ব্যবহৃত হতে পারত অর্থাৎ ওই যুগের বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে ‘জল’ বা ‘পানী’-র ব্যবহার সম্পর্কে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদ থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাংলা দেশে মুসলমান আবির্ভাব, উপনিবেশ স্থাপন, ব্যাপক ধর্মান্তরীকরণ ও স্বাঙ্গীকরণের পর, যখন হিন্দু কবিরাও অনায়াসে এবং অজ্ঞাতসারেই নিজেদের রচনায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার শুরু করেছিলেন, তখনও কি অবস্থাটা একই রকম ছিল না? চর্যাপদের পর যে বই খানিকে বাংলা ভাষার ঐতিহাসিকেরা সবচেয়ে কালানুক্রমিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সেই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটিতে আমরা যখন একাধিক ফারসি শব্দ পাই তখন বুঝতে পারি যে ওই সময়ের মধ্যে বাংলা বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামি ভাষিক সংস্কৃতি সহজভাবে সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অথচ ওই সময়েও ‘জল’ ও ‘পানী’ ব্যবহারে কোন সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি প্রবর্তিত হয়নি, কারণ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ ‘জল’-এর সঙ্গে ‘পানী’ কিংবা ‘পানী’-র সঙ্গে ‘জল’ প্রায় সমান গুরুত্ব পেয়েছে। কোথাও ‘জল’, কোথাও ‘পানী’-র ব্যবহার করে কবি অবশ্য খানিকটা ছান্দসিক চাহিদা পূরণ করেছেন, যেমন:

তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি

না বহিব পাণী।

উচিত নিফল হৈব তোর জল

ভাবি বুঝ চক্রপাণী।।  [যমুনা খন্ড]

এখানে ‘জল’ ও ‘পাণী’-র ব্যবহার অন্ত্যানুপ্রাসের দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই কাব্যে ‘জল’ ও ‘পাণী’-র ব্যবহারে অন্ত্যানুপ্রাসই নিয়ামক শক্তি নয়, কবির ইচ্ছাও এক্ষেত্রে অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করেছে, যেমন, পূর্বোক্ত যমুনাখন্ডেই:

আবাল গোপাল নাকর জঞ্জাল

পাণি নেউ সখিগণে।। ৭।।

নাগরী রাধা কান পাতিআঁ

সুণিআঁ এক বচনে।।

সব সখিগণে পাণী ভরায়িআঁ

নগর যাহা আপণে।।

পাণি ভরায়িআঁ ঘাটত উঠিআঁ

নিচল পাতিআঁ কাণে।….

এখানে ‘পাণি’ শব্দ অন্ত্যানুপ্রাসের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়নি, এখানে ‘জল’ শব্দও অনায়াসে ব্যবহৃত হতে পারত,, কাজেই ‘পাণি/পাণী’-র ব্যবহার এখানে একক ও স্বাধীন। আবার ওই অনুচ্ছেদেরই শেষের দিকে পাই:

করিল সকল গোপ যুবতীক

জল নিতে আনুমতী।। ১০।।

পাণি তুলিআঁ কাহ্নের পাশে

রাধা পাতিল কানে।….

এখানে ‘পাণি’-র জায়গায় ‘জল’ ও ‘জল’-এর জায়গায় ‘পাণি’-র ব্যবহার করলেও ক্ষতি হয় না। এক্ষেত্রে পৌনঃপুন্যের দিক থেকে ‘জল’ ও পাণী’-র গুরুত্ব সমানসমান। পক্ষান্তরে, ওই যমুনাখন্ডেই (এমনকি সারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও) আর একটি শব্দ পাই : ‘নীর’, কিন্তু পৌনঃপুন্যের দিক থেকে সেটি ‘জল’ বা ‘পাণী’-র কাছাকাছি আসতে পারে না, কারণ এটি শব্দ নয়, প্রতিশব্দ মাত্র, ছন্দের অনুরোধে কবি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন, যেমন :

১. হরিষেঁ আইলা রাধা তোহ্মে এহা তীরে। আজ সফল হৈব যমুনার নীরে।।

২. কেহ্নে রাধা হেন কাম করে। বিবসিনী ণাম্বএ নীরে।। ল, ধ্রু।।

কাজেই বোঝা যাচ্ছে, আদি-মধ্য বাংলায় (আঃ ১৪৫০) বাংলা বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে ‘জল’ ও ‘পাণী’ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ভেদসংস্কার গড়ে ওঠেনি, পৌণঃপুন্যের দিক থেকে দুই-ই ছিল তুল্যমূল্য। ‘শ্রীকৃষ্ণকীতন’-এর কাছাকাছি সময়ের আর একখানি বই কৃত্তিবাসের রামায়ণেও প্রায় একই অবস্থা। কৃত্তিবাসের রচনার প্রক্ষেপবাহুল্যের জন্য কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক হলেও, দেখা যায় ‘জল’ শব্দের আপেক্ষিক প্রাচুর্য (আপেক্ষিক প্রাচুর্যের পেছনে পরবর্তী কালের প্রক্ষেপ থাকা অসম্ভব নয়) সত্ত্বেও সেখানে ‘পাণী’ শব্দের স্বাধীন ও ছন্দ-নিরপেক্ষ ব্যবহার আছে:

১. যমুনার জল গভীর পাতাল প্রমাণ। রাম দেখিয়া জল হইল হাটুর সমান।।

না জানিয়া ভেলা তায় বাঁধিয়া লক্ষ্মণ। হাটুপানি পার হৈয়া গেলা তিন জন।।

(অযোধ্যাকান্ড / ভারবি সংস্করণ)

২. কোলে করিয়া শ্রীরাম লক্ষ্মণে নাহি এড়ে। মুকুতা গাঁথনি যেন চক্ষুর পানি পড়ে।।

(লঙ্কাকান্ড / ভারবি সংস্করণ)

৩. পানির ভিতর থাকে তারা পানির মৎস্য ভোকে। মানুষ ধরিয়া খায় যাহা পায় সমুখে।।

(কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড / ভারবি সংস্করণ)

‘পানি’ শব্দের এই ধরনের ছন্দ-নিরপেক্ষ স্বাধীন ব্যবহার দেখে মনে হয় কবি যেখানে চরণপ্রান্তে ‘পাণি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেখানে সর্বত্রই ছান্দসিক প্রয়োজনে করেননি, ‘পানি’ শব্দের প্রয়োগবাহুল্যেই ‘পানি’ তাঁর রচনায় নিজের স্থান করে নিয়েছে। অর্থাৎ কৃত্তিবাসেও ‘পানি’ ও ‘জল’ শব্দের পৌনঃপুন্য প্রায় সমান সমান।

সুতরাং, এ কথা মনে করা যেতে পারে যে, মোটামুটি পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বাংলা বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে ‘জল’ ও ‘পানি’ শব্দের পৌনঃপুন্য প্রায় সমান সমান ছিল, এবং এই দুই শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে এই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ভেদসংস্কার গড়ে ওঠেনি। তবে মোটামুটি ষোড়শ শতক থেকে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। কারণ, এই সময় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন রচনায় ‘জল’ শব্দের পৌনঃপুন্য আপেক্ষিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তুলনামূলকভাবে ‘পানি’ শব্দের স্বাধীন ব্যবহার দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ ‘পানি’ ও ‘জল’ শব্দের পৌনঃপুন্য তুল্যমুল্য হলেও ষোড়শ শতক এবং পরবর্তী বৈষ্ণব পদাবলিতে কবিরা কদাচিৎ ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদকাব্যের মতো আখ্যানধর্মী রচনায় যেখানে শব্দসম্ভার বৈষ্ণব পদাবলির চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত, সেখানেও কবিরা ছন্দের প্রয়োজন ছাড়া ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করেননি। তাহলে, এই সময়েই কি বাংলা বাচকগোষ্ঠীর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই দুটি শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ভেদসংস্কার গড়ে উঠেছিল? অর্থাৎ হিন্দুরা ঝুঁকলেন ‘জল’ শব্দের দিকে, আর মুসলমানেরা ‘পানি’ শব্দের দিকে? না, তা-ও না। কারণ, মধ্যযুগের একাধিক মুসলমান কবি যদিও কাব্যের সূচনায় আরবি-ফারসির বদলে বাংলা ভাষাচর্চার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন (অনুরূপভাবে কৃত্তিবাস ওঝা বা মালাধর বসুর মতো হিন্দু কবিও সংস্কৃতের বদলে বাংলায় কাব্যরচনার জন্য কৈফিয়ত দিয়েছেন), তথাপি মধ্যযুগের অধিকাংশ মুসলমান কবির রচনাতেই ‘পানি’র চেয়ে ‘জল’ শব্দের পৌনঃপুন্য অত্যন্ত বেশি, যেমন:

সৈয়দ সুলতানের নবীবংশে (১৫৮২-৮৪):

জলমধ্যে বিম্ব যেন ভাসে কতক্ষণ। পশ্চাতে জলের বিম্ব জলেত মিশন।।

দৌলত উজির বাহরাম খান-এর লায়লী মজনু (১৫৪৫-৫৩):

অবশেষে মাতাবরে গোলাবের জলে। কন্যাকে গোসল দিল বিরল সুস্থালে।।

দৌলত উজির আর একটি কাব্য ইমাম বিজয়ে:

জল দেখিবারে জাএ আলির নন্দন।।

ধুড়িআ পাইল জল অধিক নির্মল।

বৃক্ষের আশ্রএ জল সমীর শীতল।।

ধীরে ২ গেল তবে জলের সম্পাশ।

জল পান করিতে মনেত হইল আশ।।

ততক্ষণে নিজমনে হইল সোঅরণ (?)।

ভাতিজা তনএ কিবা দাস পরিজন।।

এ সকলে জল বিনে তেজিল পরাণ।

ধিক মোর কিসেরে কবির জল পান।।

জল পান করিতে ভাবিআ মহাশএ।

তৃষ্ণাযুক্ত হইআ জল তেজিল নিশ্চএ।।…

দৌলত কাজীর সতী ময়না লোর চন্দ্রানীতে (১৬৩৫-৩৮) :

১. ভৃঙ্গারের জল দিয়া বিচিয়া চামরে।…. ২. সার জলে নহে যেন বিন্দু জলধর।।….

৩. অনুতাপে চরানী/মীন যেন জল বিনি/সুমন্দিরে চিত্ত নহে স্থিত/….

৪. জল স্থল রাজ্য বন সব মোর বশ।…. ৫. জলবিম্ব দেহ যেন জলে উপস্থিত।….

মুহম্মদ খানের সত্যকলি বিবাদবিসম্বাদে (১৬৩৫) :

১. সর্বস্থানে জল যেন বরিখএ ঘন।….

২. ভেককুল গর্বএ কর্দম জল খাই।….

৩. চক্ষেত দিবেক জল কর্ণে তৈল দিব।….

৪. পতি সঙ্গে সতীর কলহ চিরদিন।

না রহএ জলে জল নহে যেন ভিন।।….

[তুলনীয় : জিম জলে পাণিআ টলিআ ভেউ ন জাঅ—চর্যা]

আলাওলের তোহফায় (১৬৬৪) :

১. জল বিন্দু জীআএন্ত মৃতকল্প তরু।….

২. কিবা জল দূরে থাকে কিবা পন্থে ভয়।

কিবা জল পরশনে ব্যাধি উপজএ।।

৩. জল দরশনে তয়ম্মুম না রহিব।….

৪. তপ্ত জলে অঙ্গ পাখালিবা ভাল মতে।….

৫. কিবা মক্কা গেলে কূপ জমজমের জল।….

৬. তিল ব্যাজ করি জল ভক্ষিবা তখন।।….

৭. অশ্ব আদি চতুষ্পদ করিলে পোষণ।

জল ভক্ষ্য তারে জোগাইঅ সর্বক্ষণ।।

নসরুল্লা খন্দকারের শরীয়তনামায় (১৭৪৯):

১. বদরীর পত্র দিবা জলের উপর। তাতল করিও জল অগ্নির অন্তর।

২. গোসলের স্থানে যদি বেড়াদি থাকএ। ভান্ড করি জল রাখি চাঁদোয়া টাঙএ।।

৩. ঘট জলে দামাদকে সেনান করাইবার। ৪. স্নান করান্ত কেনে কলসীর জলে।

এই উদ্ধৃতিসমুচ্চয় থেকে বোঝা যায় মধ্যযুগে অন্তত ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান কবিদের কাছেও ‘জল’ শব্দের পৌনঃপুন্য বৃদ্ধি পেয়েছিল অর্থাৎ বাংলা বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে ‘জল’ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ভেদসংস্কার দানা বেঁধে ওঠেনি। কাজেই তদানীন্তন বাংলা লেখ্য ভাষায় ‘জল’ ও ‘পানি’-র পৌনঃপুন্যের ক্ষেত্রে তারতম্যের প্রশ্নটি সাম্প্রদায়িক নয়, ভাষাতাত্ত্বিক। ষোড়শ শতক থেকে তদ্ভব শব্দ ‘পানি’-র বদলে তৎসম শব্দ ‘জল’-এর প্রতি ক্রমবর্ধমান পক্ষপাতের দুটি কারণ অনুমান করা যেতে পারে: [এক] ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর, সংস্কৃতজ্ঞ বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে মার্জিত ভাষা ব্যবহারের যে প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তার প্রভাব অবৈষ্ণব কবিদের রচনাতেও অল্পবিস্তর সংক্রমিত হতে থাকে কিংবা বলা যেতে পারে, সংস্কৃত-জানা অভিজাত মহলে লেখাপড়ার ব্যাপারে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার সম্পর্কে দীর্ঘদিনের যে জুগুপ্সা জমা হয়েছিল, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর তা দ্রুত অর্ন্তহিত হতে থাকে, কেন-না তখন দেখা গেল বাংলা ভাষাতেও চৈতন্যজীবনী ও বৈষ্ণব পদ লিখে কবিরা সামাজিক কৌলীন্য হারাননি, বরং জনগণের কাছে শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। এইজন্য চৈতন্যোত্তর কালে অনেক উচ্চবর্ণের সংস্কৃতজ্ঞ ব্যক্তি বাংলা ভাষাচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন, হয়ত তারই একটি পরোক্ষ পরিণাম হিসেবে ষোড়শ শতক থেকে বাংলা লেখ্য ভাষায় তদ্ভব ‘পানি’-র পরিবর্তে তৎসম ‘জল’ অগ্রাধিকার পেয়েছে। [দুই] ষোড়শ শতক থেকে বাংলা লেখা ভাষা যে রূপ গ্রহণ করেছিল তার মূল ভিত্তি ছিল তৎকালীন রাঢ়ি উপভাষা (প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগের ছোটো-বড়ো অধিকাংশ কবিই পশ্চিমবঙ্গের লোক)। এই রাঢ়ি উপভাষা যে-এলাকায় বলা হয় সেই এলাকা, বিশেষত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ওই সময় থেকেই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ওই এলাকার উপভাষা দ্রুত বাংলার অন্য এলাকার উপভাষা থকে পৃথক হয়ে পড়ছিল এবং এলাকাগত গুরুত্বের জন্য এই এলাকারউপভাষাও ক্রমশ কেন্দ্রীয় গুরুত্ব লাভ করছিল। কেন্দ্রীয় উপভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নব নব উন্মেষ ও উদ্ভাবন এবং দ্রুত গ্রহণবর্জন, এইজন্য কেন্দ্রীয় উপভাষায় অন্যান্য উপভাষার চেয়ে একটা সামগ্রিক গতিময়তা দেখা দেয়। এই গতিময়তার অন্যতম পরিণাম হিসেবে মধ্যযুগের বাংলায় দেখা দিয়েছিল মধ্যস্বর ও অন্ত্যস্বরের লোপের দ্বারা শব্দের অক্ষর (syllable)-সংকোচ। ‘জল’ ও ‘পানি’ উভয়েই মূলে দ্ব্যক্ষর (disyllabic) হলেও, ‘জল’ অন্ত্যস্বরলোপের দ্বারা শীঘ্রই একাক্ষর শব্দে পরিণত হয়ে কেন্দ্রীয় উপভাষার গতিমত্তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছিল, কিন্তু ‘পানি’ পূর্বাপর দ্ব্যক্ষর হওয়ায় তার উচ্চারণে যে আপেক্ষিক মন্থরতা বজায় রইল তার জন্য তাকে কেন্দ্রীয় উপভাষায় পৌনঃপুন্যের দিক থেকে একাক্ষর ও দ্রুতোচ্চার ‘জল’ শব্দের চেয়ে পিছিয়ে থাকতে হলো, এবং এই কারণেই ‘পানি’ শব্দের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সব শব্দ যখন কেন্দ্রীয় উপভাষায় বহাল রইল, তখন তা রইল ‘পানি’ শব্দের-ই ধ্বনি বর্জন করে, অর্থাৎ স্বাক্ষর ‘পানি’-কে একাক্ষর ‘পান’-এ পরিণত করে, যেমন: পানতা, পানসে, পানকৌড়ি, পানবসন্ত, পানশিউলি, পানফল, পান্তুয়া, পানডুবি (harrier), পানশাঁখ, পানমরিচ (polygonum serrulatum) ইত্যাদি। তবে ‘জল’-এর সঙ্গে পৌনঃপুন্যের প্রতিযোগিতায় ‘পানি’ পিছিয়ে পড়লেও একেবারে হারিয়ে গেল না; নিজে পিছিয়ে-পড়া বলেই সেবাংলা বাচকগোষ্ঠীর সেইসব অংশে নিজের স্থান খুঁজে নিল যেসব অংশ নিজেরাই পিছিয়ে-পড়া। এইজন্য ‘পানি’ শব্দ অব্যাহত রয়ে গেল পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রক্ষণশীল প্রান্তিক এলাকায় এবং কেন্দ্রীয় উপভাষার সেইসব সামাজিক অংশে যা শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির থেকে অনেকখানি অনগ্রসর ও রক্ষণশীল। এইজন্য বাংলা প্রবাদ, প্রবাদমূলক বাক্যাংশ, ইডিয়ম ইত্যাদি লোকোক্তিতে, মেয়েলি ভাষায়, বস্তুনাম, বৃক্ষনাম, জন্তুনাম ও স্থাননামে পানি / পান-এর পৌনঃপুন্য অব্যাহত। কারণ ভাষার এইসব উপকরণ লোকায়ত ঐতিহ্যনির্ভর এবং সেই কারণে রক্ষণশীল।

লোকোক্তি :

১. ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ২. হালে পানি পাওয়া।

৩. পানি-পান্তা ভক্ষণ, ওই তো পুরুষের লক্ষণ।

আমি অভাগী তপ্ত খাই, কোন দিন বা মরে যাই।

৪. পানির তপৎ, নারীর শপথ।

৫. পানি ফেলিয়া পানিকে যায়, আন পুরুষে আড়ে চায়।

তারে না বলিহ সতী, স্বরূপে সেদুষ্টমতি।

৬. গেল সব হিঁদুয়ানি, বিচার নাই আর পানি-পানি।

৭. ঢেঁকিতে বারা পুকুরে পানি, জামাইয়ের বেটার ভাত-ছোঁয়ানি।

৮. আপনি রইলেন ডর-পানিতে পোলারে পাঠাইছেন চর।

৯. গোদেরে কয়ো না গোদ, পিরীতে কয়ো পানিফোট।

১০. জোয়ারের পানি নারীর যৌবন।

মেয়েলি ভাষা :

পানিভাঙ্গা (প্রসবের আগে জলস্রাব), পানিভসকা, পানিভেসকা, পানিতোলা (গামছা) ইত্যাদি।

বস্তুনাম / উদ্ভিদ / জন্তুনাম :

পানিশাঁখ, পানিতরাস/ পানিআমলা, পানিশ্যাওলা, পানিফল, পানিশিউলি, পানিলাজুক / পানকৌড়ি, পানিডুবি-পানডুবি।

স্থাননাম :

পানিত্রাস, পানিহাটি, পানিশিয়লি, পানিয়াড়া, পানিশিলা, পানিখ্যা, পানিয়াট।

যাইহোক, গোড়ার কথায় ফিরে আসি। মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা যেখানে অসংকোচে ‘পানি’-র চেয়ে ‘জল’-এর পৌনঃপুন্যকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন, সেখানে একালের মুসলমান সমাজে ‘পানি’-র প্রাধান্য কেন? আসলে মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা জলবাচক শব্দ ব্যবহারে কোনো সাম্প্রদায়িক সংস্কারে আচ্ছন্ন হননি, হিন্দু কবিরা যে কারণে ঐ সময়ে ‘পানি’-র চেয়ে ‘জল’-কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন মুসলমান কবিরাও সেই একই কারণে ‘জল’-কে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সেকালে সমীক্ষা চালালে দেখা যেত বাংলা বাচকগোষ্ঠীর অগ্রসরঅংশ হিন্দুমুসলমান-নির্বিশেষে ‘পানি’র চেয়ে ‘জল’ বেশি ব্যবহার করছে, আর অনগ্রসর অংশে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে তৎসম ‘জল’-এর চেয়ে তদ্ভব ‘পানি’-র পৌনঃপুন্য বেশি। পরে ব্রিটিশ আমলে যখন বঙ্গবিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলায় জনশিক্ষাবিস্তারের আয়োজন হয় তখন তার সুযোগ নিয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাই বেশি, মুসলমানদের মধ্যে প্রচার ও সংগঠনের অভাবে এই শিক্ষা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। ফলে, পাঠপুস্তকের মাধ্যমে তৎসম ‘জল’ হিন্দুসমাজের বিভিন্ন কিনারায় ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু মুসলমান সমাজ নিজেদের আপেক্ষিক অনগ্রসরতার জন্য ‘পানি’ নিয়েই ব্যাপৃত রইল। তবে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষার আলো পেয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই ‘জল’ ব্যবহার করেছেন, এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ মীর মশাররফ হোসেন। তবে উনিশ শতকের নবজাগরণের উদ্দীপনা হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিকেই জীতীয়তাবোধে উদ্দীপিত করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালির সেই উদবোধন পূর্ণাঙ্গ ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ ভাবে হয়নি। সেই উদ্দীপনা হিন্দুকে নিয়ে গিয়েছিল প্রাক-ইসলাম বা কখনো কখনো ইসলামবিরোধী সংকীর্ণ ঐতিহ্যচেতনায়, ফলত বাঙালি মুসলমানকেও আত্মরক্ষার তাগিদে কট্টর ঐস্লামিক ঐতিহ্যের আত্মকেন্দ্রিক দুর্গে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আর সেই কারণেই হয়ত ‘জল’ শব্দ হিন্দুসমাজে এবং ‘পানি’ শব্দ মুসলমান সমাজে সমধিক পৌনঃপুন্য লাভ করেছে। এই প্রসঙ্গে একখানি কাব্যগ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, বইখানির নাম ‘ছয়ফলমুল্লুক বদিওজ্জামাল’, গ্রন্থকার ‘সায়ের মুনশী মালে মোহাম্মদ’, বইটির রচনাকাল ‘বার শত পঁয়ত্রিশ সাল’, প্রকাশকাল ‘সন ১৩৫৪ সাল’। বইটি আরবি / উর্দু কেতাবের ধরনে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে বিন্যস্ত অর্থাৎ বাংলা বই অথচ তার গ্রন্থনভঙ্গি সনাতন ঐস্লামিক ঐতিহ্যের অনুগামী। এই বইতে জলবাচক শব্দ হিসেবে প্রায় সর্বত্রই ‘পানি’ ব্যবহৃত এবং ‘জল’ উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে এই ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’-এর কাহিনী নিয়ে সপ্তদশ শতকে দোনাগাজি চৌধুরী প্রমুখ কবিরা কাব্য রচনা করেন, অথচ সেখানে জলবাচক শব্দ হিসেবে ‘জল’ শব্দেরই প্রাধান্য। এর কারণ, আগেই বলা হয়েছে যে, ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত কোনো মুসলমান কবিই ‘জল’ বা ‘পানি’ সম্পর্কে কোনো সাম্প্রদায়িক সংস্কারে আচ্ছন্ন হননি, সামাজিক দিক থেকে তার প্রায়োজনও ছিল না। কিন্তু দীর্ঘদিন একই পরিবেশে বাস করেও উনিশ শতকে যখন নবজাগরণের সূত্রে উন্নতির নানা নতুন পথ খুলে গেল তখন হিন্দুরা এতদিনকার প্রতিবেশী মুসলমান-সমাজকে বঞ্চিত করে উন্নতির সিংহভাগ নিজেরা আত্মসাৎ করল এবং তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিল মুসলমানদের মধে রক্ষণশীল ঐস্লামিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, উনিশশো সাতচল্লিশের বঙ্গভঙ্গ, পূর্বপাকিস্তান-সৃষ্টি এবং সবশেষে ‘বাংলাদেশে’-র অভ্যুদয় এবং এই একই সূত্র ধরে এখন পৌনঃপুন্যের বিচারে বাংলাদেশি বাংলায় জলবাচক সংখ্যাগুরু প্রথম শব্দ ‘পানি’ আর পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায় জলবাচক সংখ্যাগুরু প্রথম শব্দ ‘জল’।

__________________________________________________

এই প্রবন্ধ লেখার সময় আমার ছাত্র শ্রীমান অক্কাশ আলি হালদার (ক্যানিং, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা) ও ছাত্রী আনোয়ারা খাতুনের (হরিপাল, হুগলি) সঙ্গে আলোচনা করে উপকৃত হয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *