জলের তলার রাজপুরী
বাবা শহরে গেছেন একটা টেলিগ্রাম করবার জন্য। মা শুয়ে একটা মোটা উপন্যাস পড়ছেন, এই সময় চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো পুপলু।
একেবারে চুপচাপ দুপুর। নাগিন লেকের ওপরে ভাসছে দশ—বারোটি হাউসবোট। কয়েকটা হাউসবোটের ছাদে শুয়ে শুয়ে সাহেব—মেমরা রোদ পোহাচ্ছে।
আজকের দিনটা খুব সুন্দর। ঝকঝক করছে রোদ। দূরে দেখা যাচ্ছে বরফের মুকুট—পরা পাহাড়ের সারি। এক ঝাঁক হাঁস ডানা দুলিয়ে উড়ে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের দিকে।
পুপলুদের হাউসবোটটা বেশ বড়। ঠিক যেন একটা বাড়িরই মতন। দু’খানা ঘরে রয়েছে দু’দল জার্মান আর আমেরিকান, আর একটা ঘরে বাবা—মা’র সঙ্গে পুপলু। এ ছাড়া একটা বেশ বড় ডাইনিং রুম, তারপর একটা বসবার ঘর, বেশ সোফা—টোফা আর রেডিও দিয়ে সাজানো। তার সামনে একটা ছোট্ট ঘেরা বারান্দা।
পুপল সেই ঘেরা বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালো।
শ্রীনগর থেকে এই নাগিন লেকটা খানিকটা দূরে। এখানকার জল নীল রঙের আর বেশ পরিষ্কার, ডাল লেকের মতন নোংরা নয়। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই জলের তলার অনেকখানি দেখা যায়। জলের তলায় অনেক রকমের গাছ, ঠিক মনে হয় একটা জঙ্গল। তার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় এক—একটা রুপোলি মাছের ঝিলিক।
একটু দূরে ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকোয় বসে মাছ ধরছে সেলিম।
এই সেলিম পুপলুর চেয়ে বেশি বড় নয়। পুপলুর বয়েস আট, আর সেলিমের বয়েস বড় জোর দশ বছর। কিন্তু ওইটুকু বয়েসেই সেলিম কী সুন্দর নৌকো চালাতে পারে আর বঁড়শি দিয়ে টপাটপ মাছ ধরে। তা ছাড়াও সেলিম চা বানাতে জানে, তরকারি কুটতে জানে।
সেলিম একবার এদিকে তাকাতেই পুপলু হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকলো।
সেলিম ডিঙ্গি নৌকোটা নিয়ে চলে এলো হাউসবোটটার কাছে।
সেলিম কথা বলে কাশ্মীরী ভাষায়। তা ছাড়া সে হিন্দি—উর্দুও জানে। আর কয়েকটা ইংরেজি শব্দ শুধু বলতে পারে। পুপলু কাশ্মীরী বা হিন্দি—উর্দু কিছুই জানে না, তবু তার কথা সেলিম ঠিক বুঝে যায়।
পুপলু জিজ্ঞেস করলে, সেলিম, ক’টা ফিস ধরলে?
সেলিম একটা ঝুড়ি তুলে দেখালো। এর মধ্যেই সে দশ—বারোটা মাছ ধরে ফেলেছে। মাছগুলো কৈ মাছের চেয়েও খানিকটা বড়, অনেকটা তেলাপিয়া মাছের মতন দেখতে। এখনো লাফাচ্ছে।
পুপলু বললে, আমিও মাছ ধরবো! আমায় তোমার নৌকোতে নেবে?
সেলিম বললো, কেয়া?
পুপলু বললে, আই ক্যাচ ফিস। তোমার বোটে আমায় টেক করবে?
সেলিম বললো, আও।
সব হাউসবোটের সঙ্গেই একটা ছোট্ট সিঁড়ি লাগানো থাকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে সাবধানে পুপলু উঠলো ডিঙ্গি নৌকোটায়।
ছোট্ট নৌকো, দু’জনের ভারেই একটু জল উঠলো।
সেলিম নৌকোটাকে খানিক দূরে নিয়ে গিয়ে ছিপ ফেললো জলে।
পুপলু বললো, আমায় দাও। আমি কোনো দিন মাছ ধরিনি।
সেলিম ছিপটা তুলে দিল পুপলুর হাতে।
তারপর দু’জনেই এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো জলের দিকে। স্বচ্ছ জলের মধ্যে দেখা যায়, মাঝে মাঝে ঝাঁঝির জঙ্গল থেকে দু’—একটা মাছ বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক একটু ঘুরে আবার সাঁৎ করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
একবার একটা মাছ বঁড়শির টোপটার কাছে এসে ঘুরে ঘুরে কয়েকবার গন্ধ নেবার পর একবার ঠোকরাতেই সেলিম বললো, খিঁচো, খিঁচো।
পুপলু খিঁচো কথাটার মানে জানে না। সে তো আগে কখনো ছিপ হাতে নেয়নি, কখন টান মারতে হয় সে জানবেই বা কী করে।
সেলিম তখন পুপলুর হাতে—ধরা ছিপটাই নিজে ধরে মারল এক টান। অমনি, কী আশ্চর্য ব্যাপার, সত্যিই উঠে এলো একটা মাছ। ছটফট ছটফট করছে। পুপলুর জীবনে এই প্রথম মাছ ধরা। টানটা সেলিম মারলেও ছিপটা তো ছিল তার হাতে।
পুপলুর কী আনন্দ। ইচ্ছে হলো সেই নৌকোর ওপর লাফাতে। লাফালেই কিন্তু ডুবে যাবে নৌকোটা, আর পুপলু সাঁতারও জানে না।
সেলিম মাছটা খুলে নিয়ে আবার ছিপ ফেললো জলে। এই সময় সরু রিনরিনে গলায় একজন চেঁচিয়ে উঠলো, হেই, কাম হিয়ার; কাম হিয়ার; টেক মী।
ওরা তাকিয়ে দেখলো, ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’ নামের হাউসবোট থেকে ওদেরই বয়েসী একটা মেয়ে হাতছানি দিয়ে ওদের ডাকছে।
ওই মেয়েটিকে চেনে পুপলু। ওর নাম অ্যালিস, ওরা আমেরিকান। অ্যালিসের চুলের রং একদম সোনালি। আর মেমের মেয়ে যখন গায়ের রং তো ফর্সা হবেই। চোখ—দুটো নীল। ঠিক যেন একটা পুতুল।
পুপলু ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ নামে গল্পের বইটা পড়েছে। এই মেয়েটিকে দেখে তার মনে হয়েছিল সেই গল্পের অ্যালিস। কিন্তু এই মেয়েটা বেশ রাগী।
অ্যালিস কথা বলে বেশ রাগী সুরে আর ইংরেজিটাও খুব জড়ানো ধরনের। তপু পুপলু আর সেলিম ওর কথা মোটামুটি বুঝে যায়।
অ্যালিস ওদের সঙ্গে নৌকোয় উঠতে চাইছে। পুপলু সেলিমকে বললো, ওকেও নিয়ে নাও না।
সেলিম জানালো যে এইটুকু নৌকোতে তিনজনের জায়গা হবে না। নৌকো ডুবে যেতে পারে।
অ্যালিস আবার চিৎকার করে বললো, টেক মী উইথ ইউ।
পুপলু বললো, তিনজন হবে না। স্মল বোট, নো থ্রি।
অ্যালিস হুকুম করে রাগী গলায় বললো, আই ওয়ান না নাও—ও।
মেয়েটাকে বেশি রাগাতে চায় না ওরা। সেলিম তার ডিঙ্গি নৌকোটা নিয়ে গেল ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’ হাউসবোটটার কাছে। অ্যালিস তাড়াহুড়ো করে এমনভাবে লাফিয়ে নামলো যে তক্ষুণি ডুবে যেত ছোট্ট নৌকোটা। সেলিম আরে আরে করে উঠলো।
পুপলু অ্যালিসকে বাংলায় বললো, একদম চুপ করে বসো, নড়াচড়া করবে না।
অ্যালিস তার কথা অগ্রাহ্য করে ঠোঁট উল্টে বললো, আই নো সুইমিং।
সেলিম আবার ডিঙ্গি নৌকোটা সরিয়ে নিয়ে গেল দূরে। আবার ছিপ ফেললো।
আর একটা মাছ উঠতেই অ্যালিস বললো, ও, হাউ লাভলি! আ রিয়াল ফিস! স্টিল অ্যালাইভ! লেট মী, লেট মী—
এবার অ্যালিস নিজে মাছ ধরতে চায়।
পুপলু তাকে বিজ্ঞের মতন উপদেশ দিল, কখন টান মারতে হয় তুমি জানো? ঠিক মাছটা এসে যখন ঠোকরাবে…
অ্যালিস জিজ্ঞেস করলো, হোয়াট?
পুপলু বললো, হোয়েন ফিস আস্তে আস্তে ঠোকরাবে, ইয়ে ঠোকরাবে মানে হচ্ছে বাইট…তুমি ঠিক এমনি করে টানবে।
হাত তুলে হ্যাঁচকা টান মারা দেখিয়ে দিল পুপলু। মুচকি মুচকি হাসছে।
কিন্তু অ্যালিস ছিপ ফেলায় আর মাছ ঠোকরায় না। একটুক্ষণের মধ্যে তার ধৈর্য ফুরিয়ে যায়। সে বলে, হোয়াট হ্যাপনড! হোয়্যার দি ফিসেজ গন?
হাওয়ায় দুলতে দুলতে নৌকোটা বেশি দূরে চলে যাচ্ছে।
এদিকে পুপলুর মা গল্পের বইটা পড়তে পড়তে হঠাৎ এক সময় চমকে উঠলেন। হাউসবোটটায় কোনো শব্দ নেই কেন? পুপলু যেখানেই খেলা করুক, খুটখাট—দুপদাপ শব্দ তো কিছু না কিছু হবেই! সাধারণত বসবার ঘরটায় তার খেলনাগুলো ছড়িয়ে বসে।
মা বইটা মুড়ে রেখে চলে এলেন বসবার ঘরে। অন্য ঘরের সাহেব—মেমরা সবাই পহলগাঁও বেড়াতে গেছে, তাই পুরো হাউসবোটটাই এখন ফাঁকা।
বসবার ঘরেও পুপলুকে না পেয়ে তিনি চলে এলেন সামনের বারান্দায়। তারপর বেশ খানিকটা দূরে তিনি ডিঙ্গি নৌকোটা দেখতে পেয়েই ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
ওইটুকু তিনটি ছেলেমেয়ে এক ডিঙ্গি নৌকায়, এক্ষুণি যদি নৌকোটা ডুবে যায়, তা হলে কী হবে? মা ভাবলেন, ওরা আর ফিরতে পারবে না।
তিনি পাগলের মতন চিৎকার করে বলতে লাগলেন, সিন্দিকী, রহমান, তুমলোক দৌড়ে আও; শিগগির দেখকে যাও। সর্বনাশ হো গিয়া—
সিন্দিকী আর রহমান এই হাউসবোটের সব কিছু দেখাশুনো করে। ওরা থাকে পাশের একটা ছোট হাউসবোটে। চ্যাঁচামেচি শুনে ওরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো।
মা—কে এত ভয় পেতে দেখে ওরা সেলিমকে ডেকে বললো, তক্ষুণি ডিঙ্গি নৌকো এদিকে নিয়ে আসতে।
মা বললেন, ওরা আসতে পারবে না। তোমরা একটা শিকারা নিয়ে যাও, ওঃ উল্টে গেলে কী হবে? আমি ভাবতে পারছি না—
শিকারা মানে জলের ট্যাক্সি। অনেক দূর দিয়ে এটা শিকারা যাচ্ছে, মা হাত তুলে ডাকতে লাগলেন সেটাকে। কিন্তু সেই শিকারাটা আসবার আগেই সেলিমের ডিঙ্গি পৌঁছে গেল।
পুপলু একগাল হাসিমুখে বললো, মা, জানো, আমি একটা মাছ ধরেছি। সত্যি, সেলিমকে জিজ্ঞেস করো—। অ্যালিস কিন্তু ধরতে পারেনি!
মা বললেন, উঠে এসো আগে। তারপর তোমায় দেখাচ্ছি মজা!
অ্যালিস পুপলুর মাকে বললো, হেই। হোয়াই ইউ ওয়্যার শাউটিং লাইক দ্যাট?
ওইটুকু মেয়ের মুখে বকুনির সুর শুনে মা—ও তাকে এক ধমক দিয়ে বললেন, ইউ কিডস আর ভেরি নটি। হোয়াই ডিউ ইউ গো ইন সাচ এ স্মল বোট?
অ্যালিস এমন দুষ্টু, এই কথা শুনে হেসে উঠলো। তাতে আরও রাগ হয়ে গেল পুপলুর মা’র।
পুপলু উঠে এসে বললো, আমার মাছটা? আমরা মাছটা আমি নেবো মা।
মা বললেন, না! মাছ নিতে হবে না!
পুপলুকে নিজেদের ঘরে নিয়ে এসে মা বললেন, দুষ্টু ছেলে, তুই কেন আমাকে না বলে নৌকোয় উঠেছিলি?
পুপলু কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে, মা যখন খুব রেগে যান তখন কথা বলে বেশি লাভ নেই। মাকে জব্দ করারও একটা ভালো উপায় পুপলু জানে। সে নিজে কাঁদতে শুরু করলেই মা’র রাগ সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
বাবা ফিরে আসতেই সবিস্তারে সব ঘটনাটা শোনালেন মা। বাবার ভুরু কুঁচকে গেল। সত্যি চিন্তারই কথা। পুপলু সাঁতার জানে না। হাউসবোটে ছোট ছেলে—মেয়েদের নিয়ে থাকার এই একটা ভয়, যদি হঠাৎ ওদের কেউ জলে পড়ে যায়।
বাবা বললেন, চলো তাহলে এই হাউসবোটটা ছেড়ে কালই পহলগাঁও চলে যাই।
প্রথম দিন এসেই বাবার এই হাউসবোটটা পছন্দ হয়নি। প্রথমবার খাবার ঘরে ঢুকতে গিয়েই বাবা ‘ওরে বাপরে’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন দারুণ ভয় পেয়ে।
আসলে হয়েছিল কী, একটা ঘরে যে জার্মান ছেলে দুটি আছে, তাদের সঙ্গে রয়েছে একটা কুকুর। কুকুরটা ডোবারম্যান জাতের, প্রায় বাঘের মতন চেহারা, চোখ দুটি খুব হিংস্র। সেই কুকুরটা একেবারে বাবার বুকের ওপর দুটো থাবা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
বাবা এমনিতেই কুকুর পছন্দ করেন না, তার ওপর অত বড় কুকুরকে বুকের ওপর থাবা তুলতে দেখলে তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবেই। বাবাকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা লেগেছিল পুপলুর। সে কিন্তু অতবড় কুকুর দেখেও একটুও ভয় পায়নি। কুকুরটার গায়ে—মাথায় হাত দিয়ে পুপলু খেলাও করেছে।
কুকুরটার মালিক জার্মান ছেলেটি এসে বাবাকে সেদিন উদ্ধার করে বলেছিল, তোমার কোনো ভয় নেই। আমার এই কুকুর দেড় বছর ট্রেনিং স্কুলে পড়েছে, আমার হুকুম ছাড়া কাউকে কামড়ায় না।
বাবা কিন্তু তবুও কুকুরটাকে দেখলেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।
সেইজন্যই বাবার এই হাউসবোটে থাকার বিশেষ ইচ্ছে নেই।
মা বললেন, কিন্তু এখানে যে আরও তিনদিনের টাকা জমা দেওয়া আছে, তা কি ওরা ফেরত দেবে?
বাবা একটু চিন্তা করলেন। টাকা বোধহয় এরা ফেরত দেয় না। তাছাড়া পহলগাঁও যেতে হলে আগে থেকে বাসের টিকিট কিনতে হবে। তার জন্য দু’একদিন সময় লাগবে।
বাবা বললেন, টাকা ফেরত না দেয় না দিক। চলো, আমরা কয়েকটা দিন কোনো হোটেলে থাকি।
পুপলুর কিন্তু এই হাউসবোটটাই বেশি পছন্দ। সেলিম আর অ্যালিসের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাছাড়া এখান থেকে কতদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সারাদিন ধরে দূরের পাহাড়ের রং বদলায় বারবার। সন্ধেবেলা বরফের ওপর রোদ পড়লে ঠিক মনে হয় সোনার মুকুট।
পুপলু বললো, না, আমরা এখানেই থাকবো।
বাবা বললেন, শোনো পুপলু, তুমি এখনো সাঁতার শেখোনি। সাঁতার না জেনে জলের কাছে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক! সামনের বছরই তুমি সাঁতার শিখে নেবে।
মা বললেন, কী রে। বল, আমাদের না জিজ্ঞেস করে তুই আর জলের কাছে যাবি না!
লক্ষ্মী ছেলের মতন ঘাড় নেড়ে পুপলু বললো, যাবো না।
মা বললেন, উফ, ভাবলেও এখনো বুক কাঁপছে। যদি নৌকোটা উল্টে যেত?
সেদিন রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে বাবা আবার বললেন, জানো পুপলু, কাশ্মীরে এই যে এখন এত হ্রদ দেখছো, অনেকদিন আগে কিন্তু এখানে এত হ্রদ ছিল না। এই যে ডাল লেক, উলার লেক—এসব কিছুই ছিল না। কার জন্য এই সব হ্রদগুলো হয়েছে জানো!
পুপলু বললো, কার জন্য!
বাবা বললেন, দেবতাদের রাজা ইন্দ্র এইসব করেছেন। এখানে আগে অনেক দৈত্য থাকতো। বাইরে থেকে ভারতবর্ষে ঢোকাই যেত না। দৈত্যদের জয় করবার জন্য ইন্দ্র পাহাড় ফাটিয়ে এখানে এসেছিলেন। ইন্দ্র যুদ্ধে সেই দৈত্যদের হারিয়ে দিলেন, আর সেই যে পাহাড় ফাটিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সব জায়গাতেই এই সব হ্রদ তৈরি হলো। কী পুপলু, ঘুমিয়ে পড়োনি তো?
পুপলু বললো, না।
বাবা বললেন, সেই দ্যৈতরা হেরে গেলেও সবাই কিন্তু মরে যায়নি। এখনো জলের তলায় লুকিয়ে আছে। এই হ্রদের নিচে আছে দৈত্যদের পাথরের বাড়ি। এক—একটা বাড়ি রাজপ্রাসাদের মতন!
পুপলু বললো, সেই বাড়িগুলো তো আমরা দেখতে পাই না।
বাবা বললেন, দেখবে কী করে? জলের তলায় কত গাছ, সেই গাছের জন্যে বাড়িগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। তুমি যদি একবার জলে পড়ে যাও, অমনি দৈত্যরা তোমার পা ধরে টেনে নিয়ে যাবে, আর তোমাকে উদ্ধার করা যাবে না। বুঝলে?
পুপলু চুপ।
বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ঘুমিয়ে পড়েছো?
পুপলু শুকনো গলায় বললো, না!
বাবা বললেন, তাহলে বুঝলে তো? খবরদার, একা একা জলের কাছে কক্ষনো যেও না। একবার দৈত্যদের হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই।
পরের দিন দুপুরে মা ইংরেজি উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পুপলুকে শুইয়ে রাখলেন নিজের পাশে। ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঠ্যালা! এই দুপুরটাই সবচেয়ে ভয়ের।
আজও বাবা দুপুরে বেরিয়েছিলেন পহলগাঁও—এর বাসের টিকিট কেটে আনতে। ফিরলেন বিকেলবেলা। পুপলু একটুও দুষ্টুমি করেনি শুনে বাবা খুব খুশি।
বিকেলবেলা হাউসবোটের কাছে বসে বাবা আর মা চা খান। পুপলুও ওর খাবার—টাবার ছাদে বসেই খেয়ে নেয়।
এই সময় অনেক ফেরিওয়ালা আসে শিকারায় চেপে। কেউ আনে শাল, কেউ আনে কাঠের নানারকম জিনিসপত্র, কেউ আনে ফুল।
এত ফেরিওয়ালা যে তাদের তাড়ানোই খুব শক্ত ব্যাপার। তারা প্রত্যেকেই একেবারে নাছোড়বান্দা। অথচ ওদের কাছে জিনিস কিনলেই ঠকতে হয়।
সন্ধের একটু আগে একজন ফেরিওয়ালা একেবারে এলো হাউসবোটের ছাদে।
তার হাতে ছোট্ট একটা বাক্স। সে বেশ বাংলাও জানে। কাশ্মীরে অনেক বাঙালি বেড়াতে যায় তো তাই এরা কাজ—চালানো গোছের বাংলাও শিখে নেয়।
বাবা কিছু বলবার আগেই সে বললো, কিনতে হবে না। শুধু দেখে নিন। আমার কাছে ভালো জাতের স্টোন আছে।
বাবা বললেন, স্টোন নিয়ে আমরা কী করবো? দরকার নেই।
ফেরিওয়ালাটি তবু সামনে বসে পড়ে একটা বাক্স খুললো। তারপর একটা ছোট্ট পাথর তুলে নিয়ে বললো, এই দেখুন দিদি, এটা মরকতমণি।
মা অবাক হয়ে বললেন, মরকতমণি? নামই শুনেছি শুধু। চোখে দেখিনি কখনো। এ রকম দেখতে হয় বুঝি?
ফেরিওয়ালাটি বললো, হাঁ, হাতে নিয়ে দেখে নিন না। আর এইটা আছে পদ্মরাগ।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুঝলেন যে এই ফেরিওয়ালাটিকে তাড়ানো যাবে না।
মা সেই পাথরটা হাতে নিয়ে বললেন, ভারী সুন্দর তো! এর দাম কত?
ফেরিওয়ালাটি বললে, আগে দেখে নিন না পছন্দ হয় কিনা? দামের জন্যে কী আছে! আপনার ইচ্ছা করলে বিনা পয়সায় নিয়ে যাবেন!
বাবাকেও খুশি করবার জন্য সে বললো, এই দেখুন, সাহেব, কস্তুরী! একদম সাচ্চা জিনিস! হাতে ঘষে দিলে গন্ধ হবে। দিন, আপনার হাতটা দিন—
ফেরিওয়ালাটি কথাবার্তায় এমন ওস্তাদ যে বাবা আর মা একেবারে মগ্ন হয়ে পড়লেন।
হঠাৎ অনেকগুলো হাউসবোট থেকে অনেক লোক এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো!
মা অমনি ভয় পেয়ে বললেন, পুপলু কোথায়? পুপলু কোথায় গেল?
বাবা তক্ষুণি উঠে দাঁড়ালেন।
এদিকে হয়েছে কি, পাথরের ফেরিওয়ালাটি আসবার পরই পুপলু নেমে গেছে নিচে। হঠাৎ তার ক্যাম্বিস বলটা দেখবার ইচ্ছে হলো।
বলটা দু’দিন আগেই কেনা হয়েছে। বাবা বলেছেন, পহলগাঁও গিয়ে বরফের ওপর এই বলটা দিয়ে খেলা হবে। তার আগে, এখানে জলের মধ্যে বলটা বার করবার দরকার নেই।
পুপল তবু বলটা মাঝে মাঝে দেখে। দু’একবার ড্রপ খাওয়ায়। বলটা সাদা ধপধপে।
হাউসবোটের ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে পুপলু বলটা দু’একবার ড্রপ খাওয়াতেই সেটা বড্ড বেশি লাফিয়ে একেবারে জলে গিয়ে পড়লো।
পুপলু ভয় পেয়ে গেল খুব। বলটা হারিয়ে ফেললে বাবা বকবেন নিশ্চয়ই।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পুপলু ফিসফিস করে ডাকলো, সেলিম! সেলিম!
সেলিমকে পাওয়া গেল না। সেলিম থাকলে বলটা উদ্ধার করে দিতে পারতো।
‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’ হাউসবোটের বারান্দা থেকে অ্যালিস বললো, হেই, পুপলু, ইয়োর বল…ওভার দেয়ার…পুপলু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো, চুপ।
সেলিমের ডিঙ্গি নৌকোটা পাশেই বাঁধা আছে। ওই নৌকোটায় উঠে হাত বাড়ালেই বলটা পাওয়া যাবে।
পুপলু ভাবলো টক করে একবার নৌকোটায় উঠে বলটা তুলে আনলেই বাবা—মা কিছুই বুঝতে পারবেন না। নৌকোটা তো বাঁধা আছেই।
বেশি সময় নষ্ট হলে বলটা বেশি দূরে চলে যাবে। পুপলু সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠে পড়লো ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোটায়!
নৌকোটা আসলে বাঁধা ছিল না। একটা দড়ি শুধু জড়ানো ছিল একটা কাঠের সঙ্গে। পুপলু নামতেই তো দড়িটা খুলে গেল।
এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল পুপলু। বলটা ধরবার জন্য হাত বাড়াতেই সেটা চলে গেল আর একটু দূরে। নৌকোটাও দুলে উঠলো।
এখন কী হবে? নৌকো তো সে চালাতে পারবে না! ইস, সেলিমটা যে গেল কোথায়!
অ্যালিস চেঁচিয়ে বললো, হেই, ইউ আর টেকিং দা বোট..অল বাই ইয়োরসেলফ? কাম হিয়ার…
নৌকোটা আর একটু দূরে সরে যেতেই সিন্দিকী ও আরও কয়েকজন দেখতে পেয়ে গেল তাকে। বিপদটা বুঝতে পেরেই তারা চেঁচিয়ে উঠেছে।
হাউসবোটের ছাদের ওপর থেকে বাবা দেখতে পেলেন পুপলুকে। পুপলুও দেখতে পেয়েছে বাবাকে।
ঘাবড়ে গিয়ে বাবা বলে ডেকে উঠে পুপলু যেই বসে পড়তে গেল, অমনি উল্টে গেল নৌকোটা।
পুপলুকে আর দেখা গেল না।
বাবা এক ঝটকায় কোটটা খুলে ফেলতে গেলেন। তিনি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বেন বলে।
ফেরিওয়ালাটি সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!
ফেরিওয়ালাটি বললো, বাবুজী, কী করছেন! এখান থেকে লাফালে আপনি বাঁচবেন না! দাঁড়ান!
মা ভয়ে—বিস্ময়ে এতই অবাক হয়ে গেছেন যে কোনো কথা বলতে পারছেন না।
সিন্দিকী এবং আরও দু’জন ততক্ষণে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু তারই আগে একটা শিকারা খুব জোরে ছুটে এলো উল্টোনো ডিঙ্গি নৌকোটার কাছে।
মাছরাঙা পাখি যেমন জলের মধ্যে ছোঁ মেরে মাছ ধরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম ভাবেই শিকারা থেকে একজন লোক জলে লাফিয়ে পড়ে প্রায় চোখের নিমেষেই তুলে আনলো পুপলুকে।
ঠাণ্ডা জলে ডুবে যাওয়ায় পুপলুর মুখখানা নীল হয়ে গেছে। চোখ—দুটি বোজা। যে লোকটি পুপলুকে উদ্ধার করে এনেছে সে বললো, ও কই ডর নেই, বাবুসাব। ঠিক হো জায়গা।
মা পুপলুকে কোলে নিয়ে বসে রইলেন। বাবা তাড়াতাড়ি খানিকটা ব্র্যান্ডি জোগাড় করে ঢেলে দিলেন পুপলুর মুখে।
একটু বাদেই পুপলুর জ্ঞান ফিরলো।
তাতেও মা আর বাবা নিশ্চিন্ত হলেন না। অত ঠাণ্ডা জলে ডুবে গিয়েছিল। যদি কঠিন কোনো অসুখ হয়!
সাহেবদের মধ্যে একজন ডাক্তার। তিনি পুপলুকে দেখে বললেন, না, কোনো ভয়ের কারণ নেই।
কাছাকাছি অনেকগুলো হাউসবোট থেকে অনেকে এল পুপলুকে দেখতে। কিন্তু সন্ধের পরই পুপলু একেবারে ভালো হয়ে গেল। লাফালাফি করে খেলতে গেল অ্যালিসদের হাউসবোটে।
সেদিন রাতে শুয়ে পড়বার পর তার বাবা কিছুক্ষণ আলো জ্বেলে বই পড়লেন। মা আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক রাত, চারিদিক নিস্তব্ধ।
এর মধ্যে পুপলু বললো, বাবা, জানো তো জলের তলায় কী দেখলুম?
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কী?
পুপলু বললো, সেই দৈত্যদের বাড়ি দেখলুম। গাছপালার আড়ালে মস্ত বড় বাড়ি!
বাবা বললেন, তাই নাকি?
পুপলু বললো, হ্যাঁ। সেই দৈত্যগুলো মোটেই খারাপ নয়, বেশ ভালো। আমায় দেখে বললো, এই যে এসো, এসো! সেখানে একজন রাজকন্যাও রয়েছে, ঠিক আমার সমান। বাংলায় কথা বলতে পারে…আমায় দেখে বললো, তুমি কলকাতার পুপল না? তুমি থাকবে আমাদের বাড়িতে? বাবা, তোমরা তো কেউ দেখোনি। আমি কী রকম জলের তলায় দৈত্যদের দেশ দেখে এলুম। বাবা, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে?
বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন।