জলের উপর ভাসে লহর

জলের উপর ভাসে লহর

আজহার ফকিরের আশ্রম ও গিয়াসউদ্দিন

আরমান ফকির সবে তখন শাহজালাল বাবার উরস সেরে ফিরেছেন গোরডাঙা। ওঁর চক্ষে হাওরের আফাল। এ আফাল আমার খুব চিনা। স্বজনেরা সব ভরা বর্ষায় দেশ থিকা তাড়া খাইয়া দমদমের উদ্বাস্তু কলোনিতে তখন। পলিথিনের আড়ালের ঘরবাড়ি পানিতে ভিজায়া দেয়।

কলোনির ভিতরে থিকথিকা কাদা। কাছের মাঠে থইথই জল। সেই জলের দিকে চাইয়া দিদিমার মায়ে বরষার উত্তাল আফাল খুঁইজা পাইতে চাইতেন।

আফাল হইল ঢেউ। তাঁর তখন বৃদ্ধা বয়েস। চোখ দিয়া ভাটির আফালের পানি বাইর হয়। আর কণ্ঠ থিকা গান।

তাই আরমান ফকিরের এই চক্ষের আফাল আমার তো চিনা ঠেকে। নতুন মনে হয় না। যেটা নতুন সেটা হল গান। একতারায় সুর তুইলা আরমানের গাওয়া হাওরের ফকিরের মুখ—বাহিত এক গান :

সিলেট পরথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে

তোরা শোন সেই আজান ধ্বনি আইজো হইতেছে

যেন ধ্বনিতে পাথর গইলা পানি হইয়াছে।।

ছয় মাস পানি আর ছয় মাস শুকনা থাকে ভাটির দ্যাশ। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবেড়িয়া—এই সাত জেলার চল্লিশটি উপজেলা জুড়ে সুতার মতন জড়ানি হাওর—বিল—নদী—নালা। সাজানি খোলা প্রকৃতির ঝলমলানি। আমি আরমানের সেই জালাল বন্দনায় সিলেটের চেরাগ খুঁইজা পাই। দেখি, আমারই মায়ের দিদিমা কালনী নদীর পানিতে প্রদীপ ভাসায়া দেন।

ফকির বাউলের তো দ্যাশ নাই। কাঁটাতার নাই। যত জ্বালা গৃহস্থগো। আমার ঠাকুরদাদার সারা গায়ে কাঁটাতারের আঁচড় লাইগা থাকে। আর লাইগা থাকে গান।

নেত্রকোনার মুর্শেদের গান। গানের তো কুন দ্যাশ নাই। হিন্দু মুসলমান নাই। জাতাজাতি নাই। কাজিয়া নাই কুন। গান গাইলে জোড়া লাগে আমাগো অখণ্ড সত্ত্বা। আমরা এক। না দেখা না চিনা। সৃষ্টিকাজ আমাদের এক করে। ফকির বাউল য্যামনে নিজের মুর্শেদের মাজার আখড়া ছাইড়া আইয়া পড়ে আরেক মুর্শেদের দরবারে।

গুরু মুর্শেদে ভেদজ্ঞান নাই। মারফতি মত তাই তো কয়। আরমান ফকির তাই নদিয়া টপকাইয়া সিলেটে যান সুফি পির শাহজালাল বাবার মাজারে ভক্ত—আশেকানের মাঝে। আইলে পরে নদিয়ায় হেই জায়গাও ভাটির গানবাড়ি হইয়া পড়ে।

আমি জিজ্ঞেস করি, আরমান ভাই, কী আনলেন শুনি ভাটিবাড়ি থিকা?

আরমান ফকিরের মুখে যেন শাহজালাল বাবার মাজারের চেরাগ জ্বলে। কণ্ঠ থিকা উপচাইয়া পড়ে আফালের মতন গান।

ফকির কয়, একখান গান পাইছি রে খ্যাপা। তুই টুইকা ল আমার কণ্ঠ থিকা। রাইখা দে। কাজে লাগব।

আরমান ফকির গাইতে থাকেন,

শেষ বিয়ার সানাই বাজিল ডাকছে কাল শমনে

আমার বাসরঘর হবে গো

সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে প্রাণবন্ধুর সনে।

এই গানটা আমার চিনা গান, তয় কুন মরমিয়ার মুখে নয়। পুববাংলার কুন শিল্পীর মুখে। বোধহয় সাবিনা ইয়াসমিন। ঠিক মনে নাই আমার।

এ বাংলায় গীয়াসগীতি খুব প্রচলিত নয়। হাওর পারের রাধারমণ এইখানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নদিয়ার সহজিয়া বৈষ্ণবদের আখড়ায় তিনি ভাব ছড়ান। তারপর হাসন রাজা। হালে প্রচারিত আরকুম শাহের কিছু গান। আরাকুমের ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে’ ফুলে পাইলা ভ্রমরা। /ময়ূর বেশেতে সাইজন রাধিকা’ গানখানি টালিগঞ্জ ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির বাংলা সিনেমায় ব্যবহৃত হয় বিসদৃশ বিকৃতি নিয়ে। ঠিক যেমন হাওরের মরমিয়া গিয়াসউদ্দিনের একখানি গান আমি শুনে এসেছি এতকাল আশ্চর্য বিকৃতি নিয়ে।

পশ্চিমবঙ্গের অনেক লোকশিল্পী এই গানখানি গেয়েছেন গিয়াসউদ্দিনের ভণিতা উঠিয়ে দিয়ে। গানখানি আমাদের এখানে প্রচলিত গান হিসেবে কিছু এদিক ওদিক করে গাওয়া হয়। যা এক মারাত্মক অপরাধ।

দুই বাংলাতেই লোকশিল্পীরা ফকির বাউল মরমিয়াদের গান কথার লয় বিলয় ঘটিয়ে গেয়ে বিখ্যাত হন। তবে সকলে তো আর এরকম করেন না। কথার শুদ্ধতা বজায় রেখে মরমিয়াদের অনুভূত পদ গেয়ে থাকেন আবার দুই বাংলার অনেক লোকশিল্পীরা। এও আশার দিক।

ফকির সুফি মরমিয়ারা যা ভাবেন চিন্তা করেন সেই অনুভূত সত্যই তিনি যে লেখেন মধুস্রাবী সংগীতে। লোকশিল্পীরা অনেক সময় সাধক মরমিয়ার গান গাইতে গিয়ে এটা মাথাতে রাখতে পারেন না। নিজের মতো করে কারসাজি ভরে পরিবেশন করেন। এ এক মস্ত অন্যায়।

গিয়াসউদ্দিন আহমদ হাওর পারের মরমিয়া। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক শিবনগরে ওঁর জন্ম। ছোটখাটো চেহারার স্বপ্লাহারী মানুষ ছিলেন তিনি। বিপুল জমিজিরাতের অধিকারী হয়েও তিনি তো ছিলেন বিষয়সম্পত্তির প্রতি একেবারেই উদাসীন। বাহির বাড়ির টঙ্গিঘরে তিনি বাস করতেন। রাত্তিরে মশারি পর্যন্ত টাঙাতেন না। বলতেন, মশা—মাছি তাঁকে বিরক্ত তো করে না। শীতের রাতে স্বপ্ল বসনে জিকির—আজগার করে ঘেমে উঠতেন। ওঁর ছেলে বলছেন, সকালবেলা রোজ ঘুম ভাঙত আব্বার ব্যাঞ্জোর সুরে। এই ব্যাঞ্জোটি এক পাকিস্তানি বায়েত আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের আখড়ায় আখড়ায় গিয়াসউদ্দিনের গান স্বপ্লশ্রুত। তাও কয়েকটি এখন প্রচলিত ফকির বাউলের বিহঙ্গ হয়ে কাঁটাতার উপেক্ষা করার কারণে।

সদ্য হাতে পেলাম গিয়াসউদ্দিন আহমদের ‘গীতি সমগ্র’। পাতা উল্টোলুম। উল্টোতে উল্টোতে চোখ গেল সেই গানেই,

প্রাণ কান্দে মনো কান্দে রে কান্দে আমার হিয়া

দেশের বন্ধু বিদেশ গেল আমায় পাশরিয়া রে।।

বেমালুম গিয়াসের ভণিতা চেপে গাওয়া হয় এ গান আমাদের এখানে। গানগুলো পড়ছি আর ভাবছি কোন অতীন্দ্রিয় রাজ্যের বাসিন্দা মরমিয়া গিয়াসউদ্দিন! তাঁকে আমার দেখার সৌভাগ্য তো হয় নাই। ওঁর সুযোগ্য পুত্র আনোয়ার হোসেন রনি ভাই সিলেট থেকে পাঠিয়েছেন এই বইখানি। সঙ্গে এসেছে মরমি সাধকের মুখ—অঙ্কিত একখানি টি—শার্ট। শার্টের বুকের বাঁ দিকে, ঠিক গিয়াসউদ্দিন আহমদের মুখের পাশেই লেখা, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানখানির কলি।

মরমিয়া গিয়াসউদ্দিনকে দেখিনি। কিন্তু ইচ্ছে যে হয় ওঁর ছেলের মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে লেখা নাটক ‘মনুয়ার পালা’ দেখতে একবার সিলেট ছুটে যাই।

সিলেট আমার মাতামহীর দেশবাড়ি। ময়মনসিংহ আমাদের ভিটাবাড়ি। সব জোড়া লাগুক আমাদের সুর কথা সৃষ্টির আত্মীয়তায়।

আমি বিশ্বাস করি বাউল ফকিরগো মতোই কথাকার মরমিয়াগো কুন দ্যাশ নাই।

গোরভাঙা ও জালালি গান

গোরভাঙার মনসুর ফকিরের মুখেই শুনি প্রথম শাহ আবদুল করিমের জালালি গান। ফাল্গুনেই হয় ফুরফুরা শরিফে ইসালে—সওয়ার উৎসব। সুফি পিরেরা বলেন, ফুরফুরার বছরকার উৎসব হল সওয়াল হাসিন।

মনসুরই এর মানে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমায়। বলেছিলেন, সওয়াল হাসিন অর্থাৎ কি না পুণ্যার্জনের উৎসব।

সেইজন্যই ফুরফুরায় ২১, ২২, ২৩শে ফাল্গুন দাদাপির সাহেবের মাজারে বিপুল জনসমাবেশ ঘটে। বাংলাদেশ থেকেও বিশেষ ট্রেন আসে এসময় শিয়ালদহে। দুই বাংলার সুফি পির মরমিয়ারা জড়ো হন হুগলির ফুরফুরায়।

সুফি সাধক হজরত দাদাপির পশ্চিমবঙ্গের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ পির ছিলেন। জীবিতকালেই তাঁর জীবনী রচিত হয়েছিল। ফুরফুরা শরিফের ইতিহাস লিখেছিলেন গোলাম মোহাম্মদ ইয়াছিন। ২১০ পাতার এই বইটি বেরিয়েছিল রবীন্দ্রসরণী কলকাতার মদিনা বুক ডিপো থেকে।

এই বইটির লেখক হজরত রুহুল আমিনের লেখা ফুরফুরার হজরত দাদাপির সাহেবের ওপর আধারিত বইখানিরও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। দুষ্প্রাপ্য এই বইটি আমার সংগ্রহে আসে মনসুর ফকিরের দৌলতেই। এই বইটি মনসুর আমাকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন আজাহার ফকিরের ডেরা থেকে। আজাহার ফকিরকে আমি চোখে দেখিনি। গোরভাঙার তিনি এক শ্রদ্ধেয় নাম।

ভক্ত—আশেকানের উপস্থিতিতে এখন গমগম করছে সুফি পির হজরত আবু বকর সিদ্দিকীর মাজার। ফুরফুরা শরিফের মিঞা সাহেব মহল্লায় তাঁর জন্ম। হজরত মোহাম্মদ মোস্তাফার প্রথম খলিফার একত্রিশতম পুরুষ তিনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ছিল ইংরেজি ভাষার প্রতি তীব্র অনীহা। আরবি, ফারসি, উর্দু জানতেন। তাঁর শিষ্য সংখ্যাও প্রচুর।

ফাল্গুনের সেই সওয়াল হাসিল অনুষ্ঠানে সারা বাংলার পির ফকির সুফি সাধকেরা সব এক হন। রাতভর মাজারে চলে গান—সুফি, ফকিরালি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, মরমি, আত্মতত্ত্ব। এমনই আসরে বেশ রাতের দিকে মনসুর ধরলেন সেই গান :

ফকির যার নাম ধরেছে অন্য এক ভাবে পড়েছে

কেউ গায় কেউ নাচে কেউ জিকির পড়ে।

আরেক দল ফকিরের ধারা গান করেন যন্ত্র ছাড়া

পাক—পবিত্র হয়ে তাঁরা বসেন উপরে।।

আমি সবার কাছে যাই, আমি সবার করিম ভাই

আমার কোনও বিভেদ নাই আমার বিচারে।

হাওরে জালালি গান রচনার ইতিহাসটা অবশ্য খুব প্রাচীন তো নয়। প্রতি বছর জিলকদের চাঁদের ১৯ ও ২০ তারিখ শাহজালাল মাজারে উরস হয়।

মনসুর ফকিরের মুখে শুনেছি সেই উরস উৎসবে বারকয়েক গিয়েছিলেন গোরভাঙার ফকিরেরা—আজাহার ফকির, খইবর ফকির দলবল নিয়ে ভক্ত—আশেকানসহ পৌঁছতেন সিলেট শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত শাহজালাল বাবার দরবারে। শেষবার গিয়েছিলেন মনসুর, আরমান, গোলাম একটি টিলার উপর অবস্থিত শাহজালালের দরগাহে। আদতে জায়গাটি ছিল ওঁর বাসস্থান। পরবর্তীতে এখানেই কবর হয়। দরগাহ টিলার উত্তর দিকে পাঁচিল ঘেরা শাহজালালের সমাধি। চার কোণে চারটি উঁচু মিনারের সুদৃশ্য কারুকাজ। সমাধির পশ্চিম ধারের একেবারেই শেষদিকটায় রয়েছে ছোট্ট একখানি মসজিদ। দরগাহে আছে ঘড়িঘর। বলা হয়, সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মী ফরহাদ খান এটি তৈয়ারি করে দেন।

গোরভাঙার ফকিরি আসরে হাওরের ফকির সুফি পিরদের মুখ—বাহিত জালালি গানের চল আছে। এসব হল শাহজালাল শানে। দুর্বিন শাহের জালালি এখন অসাধারণভাবে পরিবেশন করেন গোলাম ফকির।

জিজ্ঞাসা করলাম, গোলাম ভাই, কই পাইলেন দুর্বিন শাহের জালালি?

গোলাম বললেন, মাজারে কত গান গো। হামদ—নাতে রসুল, আউলিয়া শানে, দেহতত্ত্ব, পারাঘাটা, নিগূঢ়ি, শরিয়ত, সৃষ্টিতত্ত্ব। তারপরই জালালি গান দিয়া হজরত শাহজালাল বাবারে ভক্তি দেওয়া হয়। কত দরবেশ, পির, ফকির, সুফিদের আনাগোনা। কত জালালির রূপ—হাসন, আরকুম শাহ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ। ভক্ত—অনুসারীরা গাইতেই থাকে রাইতভর। দুর্বিনের গানে মন মজল। তাই তুইলা নিলাম সুনামগঞ্জের এক সুফি পিরের থিকা,

কী সুন্দর এক নূরের বাতি হইয়াছে প্রচার

বঙ্গদেশের পূর্বাংশে শাহজালাল নামটি যার

বাতির রৌশনি এমন, আকাশে চন্দ্র তারার যেমন কিরণ

এই আলোতে ঘুচল তখন সিলেটের অন্ধকার।

রাত্রের গোরভাঙা। আরমান ফকিরের ভক্ত—আশেকানেরা সব বসে। নরম হাওয়া বয়। হ্যারিকেনের কাচে হাওয়া গিয়ে আছাড় দেয়। কালি জমে খানিক চিমনির কাচে। তারই ভেতর আরমান নীচু স্বরে বলে চলেন সুফি সাধকদের কিংবদন্তি গাঁথা আর ইতিহাসের ধারা।

ভারতে মুসলিম শাসন। চট্টোগ্রাম, নোয়াখালিতে আরবের বণিকদের গতায়ত। কুতুবউদ্দিন আইবক, বখতিয়ার খিলজিরা দিল্লি, নদিয়া সব জয় করেটরে মুসলিম আধিপত্য বাড়াচ্ছেন। এসময় পারস্য থেকে বণিকদের মতো সুফি পির দরবেশরাও আসছেন তাঁদের তসাউওফ প্রচার করতে। সত্য বস্তুসমূহের উপলব্ধি নিয়ে পবিত্র পশম বস্ত্র পরে তাঁরা বাংলা ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন। সেই পরম্পরাতেই ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে সিলেট এসে পৌঁছান সুফি সাধক হজরত শাহজালাল। এন্তেকালের সাতশো বছর এখন অতিক্রান্ত এই সুফি সাধকের।

এখনও মাজারে চেরাগ জ্বলে। ভক্ত—আশেকানদের ভিড় হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার ভাটির ফকির সুফি পির বাউল মতাবলম্বীরা একযোগে করতে থাকেন গান। যে গানে ধরা থাকে শাহজালাল বাবার অপার মহিমা।

পাইয়া বাবার জালালি পরশ

ব্যাধিমুক্তি পায় আর দেহ হয় সরস

কফিলউদ্দিন নামেরই বশ এই সারা জিন্দেগানি।

সিলেট ও বিচ্ছেদী

সিলেটের লোকগানের দুই কিংবদন্তি সুষমা দাশ ও চন্দ্রাবতী রায়বর্মণকে সামনাসামনি প্রথম দেখি যাদবপুরের বাউল ফকির উৎসবে। সে বছর চন্দ্রাবতী রায়বর্মণকে বাউল ফকির উৎসব সম্মাননাও প্রদান করা হয়েছিল। চন্দ্রাবতী গানজমি বিস্তৃত ভাটির যে অঞ্চলে জন্মেছিলেন সেই জগন্নাথপুরই ছিল উনিশ শতকের সাধক গায়ক রাধারমণের এলাকা।

বিশ শতকের ভাটির প্রসিদ্ধ বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গান তো আমাদের ভাটি এলাকায় প্রায় সব মানুষই জানে। যারা গান গায় না, তারাও রাধারমণের গান মনের আনন্দে গায়। বিয়েবাড়িতে, কীর্তনের আসরে রাধারমণের গানের প্রচলন আছে।

চন্দ্রাবতী করিমের থেকে পনেরো বছরের ছোট ছিলেন। করিমের শেষ জীবনে; জীবদ্দশায় চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ রাধারমণের গানের একজন গুণী শিল্পী হিসেবে ভাটি পেরিয়ে গোটা বাংলাদেশেই সমাদৃতা। কলকাতাতেও বেশ কয়েকবার তিনি রাধারমণের গান পরিবেশন করে গেছেন।

২০১৪ সাল। জুন মাসে তোপখানাতে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু লোকসংগীত সংগ্রাহক ও গবেষক সুমনকুমার দাশ। সেটি সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ পত্রিকার ইদ সংখ্যাতেই বের হয়েছিল। জুন কাটিয়ে জুলাই। আগস্টেই চন্দ্রাবতী চলে গেলেন। সিলেট থেকে ওঁর মৃত্যু সংবাদ সুমনই আমাকে দিয়েছিল। এরপর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সেই সাক্ষাৎকারখানা সিলেটের একুশে বাংলা প্রকাশন পুস্তিকা হিসেবে বের করে।

যাদবপুরের মেলায় একটা সাদা খোলের জামদানি শাড়ি পরে একমাথা ঘোমটা টেনে একটু রাতের দিকে গাইতে উঠেছিলেন চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ। বেশ মনে আছে শুরুটা করেছিলেন রাধারমণের গুরু বন্দনার গান দিয়েই,

পতিতপাবন নাম শুনিয়া, দাঁড়াইয়া রহিয়াছি কূলে

দয়াল গুরু পার করো দীনহীন কাঙালে।

এরপর তিনি ধরলেন ধামাইল, পদ্মপুরাণ, কীর্তন, মাঘমাস বিবাহতিথি—গান গিয়ে পৌঁছলো পানখিলি, জলভরা, সোহাগ মাগাতে। বিবাহের আচারে পদে পদে গান। গৃহস্থ ঘরের মা জেঠি কাকি বউদি দাদিরা এসব গানগুলো গাইতেন। হিন্দু ছাড়া মুসলমান বাড়িতেও বিয়ের গীত হত। সেসব চল এখন উঠে যাচ্ছে আমাদের এখানে।

ভাবি, সিলেট শহরের সেনপাড়াতে সুমনের বিয়ের আগের রাতে হলদির অনুষ্ঠান চলছে। সেখানে জলভরা গান গাইছেন ভাটির বিস্ময় নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছানো বাংলাদেশের লোকগানের জীবন্ত কিংবদন্তি সুষমা দাস।

সুষমা দাসের কোনও গানের খাতাটাতা নেই। সমস্ত গানই ধরা রয়েছে ওঁর স্মৃতিতে। দু—হাজার প্রাচীন গানের ঝুলি নিয়ে বসে আছেন তিনি। যার কোনও লিখিত রূপ নেই।

তিনি বলেন, বাবা শাহজালালের দোয়ায় কখনো কোনও অনুষ্ঠানে গান ভুলে গিয়ে গাইতে পারিনি ওই অবস্থা হয়নি। আমি যখন গান গাইতে শুরু করি তখন চোখের সামনেই এক লাইনের পর অন্য লাইনখানা দেখতে পাই।

বয়সের ভারে সুষমা নুইয়ে গেলেও কণ্ঠ তাঁর এখনও প্রাণবন্ত। গায়কিতে কী অসামান্য ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলছেন রাধারানির বিচ্ছেদী। যাদবপুরে একমুখ পান নিয়েও তিনি যেন তুলে ধরছিলেন উতলা রাধার উন্মাদিনী দশা। মনোচোরা কৃষ্ণ যেন বা তখন সুর তুলছে কৃষ্ণচূড়ার হিমেল বাতাসে। সুষমা গাইছেন,

বাজাইয়া মোহন বাঁশি একবার ব্রজের খেলা খেলো আসি

আমার দেহ হউক ব্রজের ধুলা প্রাণ হউক ব্রজাঙ্গনা।

শ্যামকলঙ্কের অলংকারে রমন চাহে সাজিবারে

আমি ধর্ম যুক্তি ছেড়ে করব তোমার নাম সাধনা।

সাধনার সেই লিলুয়া বাতাস যেন যাদবপুরের বাউল ফকির মেলায়। জয়দেবের গুণী বাউল তারক দাসও তখন মগ্ন চন্দ্রাবতীর জলভরা পর্বের অন্তর জ্বালায়। বাঁশির জাদুতে ওঁর গলা যেন রাধারানির অন্তর। কৃষ্ণকে পরম মমতায় আগলাতে গিয়ে চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ গাইছেন,

এগো পাইতাম যদি শ্যাম রসময়

রাখিতাম হৃদয় পিঞ্জিরায়

রাধা চলছেন কলসি কাঁখে যমুনা—গঙ্গা—সুরধনী—কালিন্দী নদীর তীরে। সেখানেও বাঁশির ডাক বনবিহারী, কানু, কালোশশী, চিকন কালার। এই সুরের মায়াবী আকর্ষণই রাধারমণের জলভরা গানের বিশেষত্ব। রাধাকৃষ্ণের প্রেম—বিচ্ছেদকে উপজীব্য করেই জলভরা গান। রাধার শ্রীকৃষ্ণ অদর্শনের খেদোক্তি, আক্ষেপ, বিরহ—দগ্ধ অনুযোগ সবই যেন মূর্ত করে দিতে পারেন চন্দ্রাবতী, সুষমারা।

রাধারমণের গানের মূল অস্তিত্ব নারীর হৃদয়। এই মরমিয়া তাঁর পুরুষ সত্তার লয়—বিলয় খসিয়ে দিয়ে নারীভাবে আত্মহারা। ওঁর রাধারানির হৃদয়ই হাওরের দিগন্ত পাগল করা বাতাসের গায়ে হাহাকার তোলে,

ভ্রমর কইও গিয়া

শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে

অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে

আর চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ সেই শক্তিগড় যাদবপুরে তখন কণ্ঠমাধুর্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অষ্টআঙ্গুলা বাঁশির ভেতর সাধক—গায়কের নারীবেশী বিরহকাতর মনোবেদনা। জল ভরতে চলেছেন বিয়ে উপলক্ষে, স্ত্রী আচারে কাকিমা—মায়েরা। চন্দ্রাবতী তখন গাইছেন জলভরা গান। রাধারমণেরই নারী—হৃদয়ের অমল বিচ্ছেদী,

শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে

বন্ধু নিরলে তোমারে পাইলাম না।

ঢিলাইচণ্ডী, হালিশহর

ঢিলাইচণ্ডীতে আজ কালীপুজোর আগের রাত। পরিতোষ বাবা চোদ্দোটি প্রদীপ সন্ধ্যা হতে না হতেই জ্বেলে দিয়েছেন ঢিলাইচণ্ডীর থানে। এখানে মায়ের কোনও মূর্তি নেই। বটগাছের নীচে মাটির ঢিপি তৈরি করে চারকোণে কেবল চারখানি হাত প্রতিষ্ঠা করে রাখা হয়েছে। যার দু—টিতে বর ও অভয় মুদ্রা ধরা। বাকি দুটোর একটিতে খড়্গ আর একটিতে ধরা রয়েছে নরমুণ্ড।

ঢিপির সামনের দিকটার মাটি এমন করে সমান্তরালে নামানো হয়েছে যে, যা দেখলে মনে হবে মায়ের জিহ্বা। সেই অংশের মাটি একেবারে জবজবে সিঁদুরে চর্চিত। তার সামনেই একটি সিঁদুররঞ্জিত ত্রিশূল পোঁতা। যার সারা গায়ে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো। ত্রিকোণের মাঝের ফাঁকগুলোতে সব সারি সারি শাঁখা—পলা—নোয়া ঢোকানো।

বটগাছের কাণ্ড লালশালুতে মোড়া। যথেষ্টই প্রাচীন গাছ। নানা তার ফেঁকড়ি বেরিয়েছে। যেগুলোতে সব ঢিল বাঁধা। ভক্তরা মানতের উদ্দেশ্যে যা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছেন। কালকের বিশেষ পুজোর আয়োজন আজ অনেকখানিই সারা। গাছটাকে বৃত্ত করে চারধারের ফাঁকা জমিতে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ভক্ত—শিষ্যদের বসবার জন্য কিছু চেয়ার আজই পেতে দেওয়া হয়েছে।

একপাশে চাঁদোয়া টাঙানো। ভোগ রান্নার জায়গা। ডাঁই করা আছে ডেকরেটারসের বাসন—কোসন। একধারের গামলায় সার সার সবজির স্তূপ। আরেকটি গামলাও ভক্ত—শিষ্যদের আনা সব ফল—মূল, সন্দেশের প্যাকেটে ভরে আছে।

আজ সন্ধ্যারতির পর জনসমাগম কমে এলে বাবাকে কিছুটা ফাঁকা পাওয়া গেল। থানের ধারে তখনও তিনি বসে। একেবারে রোগা—পাতলা বেশ ফরসা গোছের লম্বা মানুষ। যেন একবার ফুঁ দিলে উড়ে যাওয়ার দশা ছিল কিন্তু সেই টাল সামলে দিয়েছে বাবার ইঁয়া বড় জটা। হাত ভর্তি তাঁর শাঁখা—পলা। গলায় রুদ্রাক্ষ সহ এটা—ওটা নিয়ে প্রায় আট—দশটা মালা। কপালে সিঁদুরের লেপটালেপটি।

বললেন, তুই একটু ওঠ তো। দ্যাখ ওখানে সব কাপড়চোপড়ের প্যাকেট। শাড়ি—ধুতি যাবতীয়। একটা ধুতি এনে বাবার গায়ে জড়িয়ে দে দিকি।

আমি ধুতি এনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। দেখি পরিতোষ বাবা সলতে পাঁকাচ্ছেন। গাছা প্রদীপ সাজাচ্ছেন। তেলে তুলো ভিজিয়ে জ্বালবার দশায় তৈরি হয়ে উঠছে প্রদীপ।

বললেন, ভোররাতে অমাবস্যা লেগে যাচ্ছে এবার। দেবী—জাগরণের সময়ই একপ্রস্ত আরতি করে নেবো। কী হল! এখনও তুই দাঁড়িয়ে। পরিয়ে দে ধুতি, বাবার গায়ে।

ধুতিটার ভাঁজ ভেঙে আমি এখন একেবারে দিশেহারা। কোথায় পরাব ধুতিটা! এখানে তো ভোলে বাবার কোনও মূর্তি নেই। আছে কেবল ত্রিশূল। আগে যতবারই এসেছি সেটাতে কখনো কাপড় জড়ানো দেখিনি। বাবা তখনও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রস্তুতিতে চূড়ান্ত ব্যস্ত। ধুতিটা নিয়ে আমি সবে ত্রিশূলের গায়ে জড়াতে যাব, একেবারে রে রে করে উঠলেন বাবা।

এটা কী হচ্ছে! ওরে বাবার গায়ে দে। ন্যাংটা বাবাকে আজ কাপড় দে।

বললাম, কোথায় জড়াব বলে দিন?

ওরে শালা! এত জানিস এ জানিস না এখানে কোথায় বাবা, দ্যাখো দ্যাখো বাবা খুঁজে পায় না ছেলে। দে দে তবে শ্যালা আমার গায়েই জড়িয়ে দে। আমি শিব হয়ে যাই।

আমি তখন একেবারে হতভম্ব। বুঝতে পারছি না কার গায়ে পরাব এমন পাটভাঙা ধবধবে ধুতিটা! ধুতি তখনও আমার হাতে। ভোলে বাবা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।

বাবা তখন সমানে হাসছেন।

বললেন, ওরে বস। আমি খন সময়মতো পরিয়ে দেব। তখন বুঝবি বাবা কে। এতদিন তুই আমাকে প্রশ্ন করে এসেছিস, আজ তোকে আমি করব। দেখি তার কী উত্তর দিস তুই!

বললাম, বলুন। তবে আমি কী আর উত্তর দিতে পারব!

কেন পারবি না শুনি? যখন আমি বলি, যুক্তি সাজাস, ব্যাখ্যা দিয়ে নানা কথা লিখিস। সাধনাকে নস্যাৎ করিস। সত্যকে বিশ্বাসের পর্যায়ে নিয়ে চলে যাস একেবারে আর এখন মায়ের থানে মায়ের উত্তর দিতে পারবি না?

বললাম, পুরাণকাহিনিগুলোকে সব কী যথার্থ যুক্তিতে আনা যায়, বাবা?

মানে পৌরাণিক কাহিনিগুলো সব অবিশ্বাস্য বলতে চাচ্ছিস তুই। এত তোর যুক্তিবোধ। বলছিস, কাহিনির কোনও প্রমাণ নেই?

না না, আমি কিন্তু তা বলছি না। বলছি সব পৌরাণিকীগুলোকে বিজ্ঞানের কেন্দ্রিকতায় আনা তো যায় না।

খেপে উঠলেন বাবা।

সাধারণ কথা বলার থেকে একটু জোর গলায় বলতে থাকলেন। হাতে তখন তাঁর ধরা পাটভাঙা ধুতি। সেটা নিয়ে তিনি সটান গিয়ে আগে জড়িয়ে দিলেন মাটির ঢিপিটার সারা গায়ে। তবে মাঝখানটা, সিঁদুরে জবজবে জিভের কাছটা ফাঁকা রেখে পেছনে বেড় দিয়ে ধুতিটাকে তিনি পরিয়ে দিলেন। বুঝলাম মাটির ঢিপিটা হল গিয়ে পরিতোষ বাবার শিব।

বললেন, শালা, এবার বুঝলি তো শিবরূপ।

বললাম, এও সেই অবিশ্বাসের জায়গাই যে হল! অবিশ্বাসকে চিহ্ন দিয়ে সামনে আনা হল।

কোনওটাই অবিশ্বাস নয় এর। অধ্যাত্মরাজ্যে এতদিন ঘুরছিস এখানে অবিশ্বাসের জায়গা পেয়েছিস কিছু? মানছি বিশ্বাস আছে। কিন্তু প্রতিটি বিশ্বাসেরই যে অন্তর্নিহিত অর্থ আছে।

আপনি বলতে চাইছেন যে এগুলো সব আসলে হল গিয়ে রূপকআশ্রিত শক্তিরই বাস্তবিক কাহিনি?

প্রতিটি শক্তিরই তো অন্তর্নিহিত অর্থ আছে রে। তা সে তাপশক্তিই হোক, প্রেমশক্তি বা কামশক্তি। সেই শক্তিকেই আমরা পুজো করি। বলি যে শক্তিপুজোর দুটো ধারা।

সে তো বহুবারই বহুজনের মুখেই শুনেছি। বামাচারী আর দক্ষিণাচারী।

আচার মানে কী মনে হয় তোর?

বললাম, অনুষ্ঠান।

একেবারেই ভুল মত। কোনও যুক্তিতেই আসে না এ।

তা হলে আচার কী?

আচার হল বিকাশ।

কীসের? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বিকাশ তো আসলে শক্তির। নারীশক্তির। তন্ত্রে কোনও নারীই কখনও কুমারী নন। নারী ততক্ষণই নারী, যতক্ষণ সে কুমারী। সেটাই হল নারীর বিকাশের পূর্বাবস্থা।

বললাম, আপনার আচার।

আচার কোথায়? নারীকে যখন শক্তিরূপে কল্পনা করা হল তখনই নারী আচার। আমি বামাচারী মতের তান্ত্রিক। আমাদের আচার সব দেহগত। বামাচারীর শক্তিপুজো পঞ্চমকারের পুজো।

বামাচার তাহলে কী?

স্থূল অর্থে নারী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আচার।

জিজ্ঞাসা করলাম, আর সূক্ষ্ম অর্থে?

মানবদেহস্থিত কুল বা শক্তির আচার। এক অর্থে ঢিপির মহাদেব স্থূল অর্থে যিনি তাঁকে স্থূল মনে করে দেখছেন তাঁরই শক্তিজাগরণেরই শক্তিমত্তার সূক্ষ্মতা। এই যে আজ চতুর্দশীতে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হল এ তো আসলে আমাদের শরীরেরই স্থূলতা।

কীরকম!

চোদ্দোকে যদি চোদ্দোবাতি না বলে চোদ্দোটি পাপড়ি বলি তা হলে কী মনে আসবে?

অবশ্যই মূলাধার। শরীরের প্রথম পদ্মচক্র।

এই মূলাধারেই প্রথম তাপ সৃষ্টি করতে হয়। তা হলেই শক্তি জাগে। জ্বলে। আজ চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হল সেই স্থূল অর্থে চতুর্দশীর রাতে। কারণ কাল অমাবস্যাতে শক্তির আরাধনা হবে। এ হল স্থূল প্রস্তুতি শক্তিপুজোর। বুঝলি?

পরিতোষ বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তা হলে কালী কী আপনার চোখে?

বললেন, শরীরে বিশৃঙ্খল শক্তি হলেন কালী। যাকে বলা যায় মহাশক্তি। তা যে কালী হতে হবে তার কী মানে আছে?

তবে?

তিনি তো দুর্গাও হতে পারেন। হতে পারেন লক্ষ্মী, সরস্বতী। তিনি গণেশ, কার্তিকও হতে পারেন। হতে পারেন বিষ্ণু। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা।

বললাম, শেষে যা বললেন সবই তো পুরুষ—অবয়ব। সেখানে শক্তি আসছে কোথা থেকে?

শক্তিকে ধরেন কে?

শূন্যতা।

শূন্যতা আমরা বলছি দেহের। শরীরের। শরীরকে শিব বলছি। শরীর শিব না হলে শক্তি আসবে কোথা থেকে?

বললাম, ব্রহ্মাকে সৃষ্টিকর্তা বলার শরীরে যৌক্তিকতা কোথায়?

ব্রহ্মাকে দেশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

দেশ কী? কী বলতে চাইছেন আপনি?

দেশ হল শরীরের অবস্থান।

জিজ্ঞাসা করলাম, কীরকম!

শরীর হল দেশ। সেখানে কাল এসে মিশছেন। যুগ্মতায় যা স্থূল হল। দেশ কাল আমাদের।

তা হলে সূক্ষ্ম অর্থে?

কাল ঘূর্ণায়মান। চক্রবৎ। বিষ্ণু চক্র দিয়েই তো সতীর দেহ ছিন্ন করেছিলেন। সতী হল কাল।

বললাম, ঠিক পরিষ্কার নয় ব্যাপারটা।

বললেন, কেন নয়? সতী কী?

আপনি বলুন কী? আপনার ব্যাখ্যা শুনব বলেই তো এসেছি।

সতী হলেন সাধকের অতিশূন্যতার শক্তি। যে শক্তিকে সাধক ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছেন। বিষ্ণু হচ্ছেন সাধক। কখন বিষ্ণু হচ্ছেন সাধক?

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে।

কখন?

যখন প্রলয় আসছে শরীরে। প্রলয় হল দক্ষ। সাধক তাকেই নাশ করছেন বলে যজ্ঞের, কর্মানুষ্ঠানের আয়োজন।

শিব তা হলে এখানে কী?

শিব সৃষ্টির স্রোত। ধাবমানতা। বিষ্ণু চক্র দিয়ে সতীকে ছিন্ন করছেন মানে প্রলয়কে চারধারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।

এই চারধার কোথায়?

শরীরের চক্রগুলোর ধারপাশ।

এই বলে বাবা হাসলেন।

বললেন, এবার বল সতীদেহ এখন কী হল? সতীদেহ হল সাধকের চক্রস্থ শক্তিরই একেক দশা। এর অন্তর্নিহিত অর্থ তো তাই। একান্ন পীঠের পুরাণকে সাধক যে ভাবেই শরীরে ধরে আছে।

রাত বাড়ছে। মায়ের থান ফাঁকা শুনশান হয়ে উঠছে এবার। চারধারে আলোর মালা। প্রদীপগুলো সব কখনোই নিভে গেছে। দু—একটা শেয়াল ডাকছে। আমি আর বাবা তখন ছমছমে কাল নিয়ে বসে আছি।

মিলনগড়, হুগলি

মিলনগড়, হুগলিতে থাকেন বুড়া বাবা। গঙ্গা পেরিয়ে মাঝে মাঝেই আমি ওঁর কাছে চলে যাই। অনেক সহজিয়া পুথি বুড়া বাবা আগলে রেখেছেন।

গেলেই বলেন, একলা থেকো। নিজেকে গভীর করে পাও। একলা থাকলেই নিজেকে পাওয়া যায়। গভীরতার সত্তায় ভগবান ধরা দেন।

মধ্যে মধ্যে কথার স্রোতে আরও আমি উসকে তুলি বুড়া বাবাকে। তা হলেই তাঁর ভাবনগরে টোকা পড়ে। তিনি নগর খোলেন। তাঁর স্বরাট, অমিতাভ রূপটি তখনই বোঝা যায়।

এই যেমন কথার পিঠে সেদিনই বললাম, ভগবান কী?

জানি ভাবনগরে টোকা পড়ে গিয়েছে। অর্থ, বুৎপত্তি এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না।

বললেন, দারুব্রহ্ম ভগবান।

বললাম, আখড়ার জগন্নাথদেবের কথা বলছেন? ও তো আপনার হাতের কারুকাজ।

বুড়া বাবা একসময় মূর্তিশিল্পী ছিলেন। নতুনগ্রামে বসে নিমকাঠ, গামারিকাঠ, পিটুলিকাঠের মূর্তি বানাতেন। পিটুলিকাঠ কি আর টেঁকে! ওতে ঘুণ লেগে যায়। তাই দারুব্রহ্ম ও কাঠে তো হয় না। গামারিতেও নয়। ওসবে হয় পেঁচা, মেলায় বিক্রির ছোট ছোট নিতাই—গৌর। নবদ্বীপ, কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ, দাঁইহাটে মঠ—আখড়ার শেষ নেই। অগ্রদ্বীপে স্টেশনের বাঁ হাতের গ্রামটাই নতুনগ্রাম—একসময় বাবার বাস ছিল। আর গঙ্গার পার ধরে কুলীনগ্রাম, কালনা, পূর্বস্থলী, পাটুলি, কাটোয়া, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, কুলাই, শ্রীখণ্ডের আখড়া—পাটবাড়ি—হরিসভার জন্য মূর্তি বানিয়েছেন সমানে।

পূর্বস্থলীতে দারুব্রহ্ম বানাতে গিয়েই গুরু পেলেন বাবা। সেই থেকে সাধনভজন। সাধনসঙ্গিনী বুড়ি মা। মিলনগড় আখড়ার দারুব্রহ্ম জগন্নাথও ওঁর হাতেই তৈরি। আশি পেরিয়ে এখন আর পারেন না। চোখে ভালো দেখেন না। আমি গেলে বিকেলের আখড়ায় ভাগবতখানা পড়ে শোনাতে বলেন।

বুড়ি মা সাজিয়ে দেন তখন। পাটভাঙা ধুতি, চাদর, তুলসির মালা, রসকলি। মায়ের হাতের সজ্জায় বৈষ্ণব বাবাজি। বুড়িমা কীর্তন করেন। সত্তর পেরোনো বয়সেও তাঁর গলা রীতিমতো সুরে খেলে, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস—একে একে গাইতে থাকেন বুড়িমা।

ভাগবতপাঠ শুরু হয়। সন্ধ্যারতি। বুড়া বাবা দারুব্রহ্ম জগন্নাথকে আরতি করেন। বুড়া বাবাকে উসকে তুলি এর পর পরই তো আমি।

বলেন, শরীরটাকে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ করতে হবে। সেটাই সাধনা। শরীরেই তিনি জ্যোতির্ময় হয়ে আছেন।

বললাম, কীভাবে?

বললেন, নিমের রস কামকে দমন করে বুঝলি। পুরোনো নিমগাছ থেকে সময় সময় মধুর নিঃস্রাব হয়। মূর্তি বানানোর জন্য পুরোনো নিমগাছ কাটতে গিয়ে এ তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি। নিমগাছ হল বৈরাগ্যের তিক্ততা। মদন জয় হয় ওতে বুঝলি। মদনের মধুর রসোল্লাসে থাকাটাই ভগবানের সাধনা। নিজে ভগবান হয়ে ওঠা।

বললাম, রামকৃষ্ণময় অভেদানন্দের শিষ্য সত্যানন্দদেবের লেখাতে পড়েছি তিনি নিমপাতা সেদ্ধ করে খেতেন খালি।

বুড়া বাবা বললেন, কৃচ্ছতাই সাধনা। জগন্নাথের মূর্তি সেই কৃচ্ছতার কথাই বলে রে।

বললাম, কী বলে আপনার জগন্নাথ?

বুড়া বাবা বললেন, দারুব্রহ্ম জগন্নাথ হল গিয়ে কামজিৎ বুঝলি। দেহটা তাঁর কাষ্ঠ হয়ে গেছে।

বললাম, কীভাবে হল কাঠ?

বললেন, কেন রে, বুঝলি না! জগন্নাথ কী আর মূর্তিরে।

বললাম, জগন্নাথ তবে কী?

বুড়া বাবা বললেন, জগন্নাথ হল গিয়ে তোর জিজ্ঞাসার শরীর ভগবান। শরীরটাকে দারুব্রহ্ম নিমকাঠ করতে হবে। ভগবানের মূর্তি তাই তো ও কাঠেই হয়। কামজিৎ জগন্নাথ। নিমের রস পান করে সাধককেও সেই কামজিৎ ভগবান হতে হবে। আর শরীরটা কামনাহীন কাঠ হলেই তো শক্তি তখন ভগিনী সুভদ্রা হয়ে ওঠে। বোনের সঙ্গে তো আর কাম চলে না। তোর বুড়িমায়ের সঙ্গেও তো আমার সুভদ্রার সম্পর্ক।

বুড়ি মা তখন অন্ন পাক করছেন। ভগবানের সেবা দেবেন। আমি ভাবছি তো বাবার কথা। ভাবছি বেদে রুদ্র ভগবানের বোন হলেন অম্বিকা। জগন্নাথ, সুভদ্রার এই ভাবটি তো তা হলে যজুর্বেদীয় সাধনাই বটে। বেদ তো শাস্ত্র নয়, সাধনপন্থা। সাধনেই তো জগন্নাথের শক্তি রুক্মিণী ভগিনী সুভদ্রা হয়ে ওঠেন। যেমন বুড়া বাবা ও বুড়ি মায়ের সম্পর্ক। সেখানে কোনও কাম নেই। তাই কামনার বীজের সন্তানও তাঁদের তো নেই। কামজিৎ, কামজিতা ওঁরা চল্লিশ বছরের একত্র সাধনায়—জগন্নাথ, সুভদ্রা। সাধনস্থলে নিম, অশ্বত্থ পাশাপাশি লাগানো থাকে।

বুড়া বাবা বলেন, ও অশ্বত্থা। শক্তিরূপিণী। আর নিম ব্রহ্মবৃক্ষ। ব্রহ্মের এক থেকে বহু হবার বাসনারই প্রতীক ওরা বুঝলি।

জগন্নাথের ত্রিমূর্তিও যে আদতে বৌদ্ধ ত্রিরত্নের ছদ্মবেশে এতে কোনও সন্দেহ নেই। বৌদ্ধ শাস্ত্রে আছে, জগজ্যোতিঃ।

জগন্নাথই বুদ্ধ। বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ—এই ত্রিরত্ন আমাদের জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম।

বলরাম বুদ্ধ সংঘের যোগশক্তি। আর বুদ্ধ জগন্নাথ, যোগশক্তি বলরামের মাঝে সুভদ্রা হলেন বৌদ্ধ দেবী প্রজ্ঞাপারমিতা।

বোনকে মাঝে বসিয়ে এই ত্রিমূর্তির কল্পনা আসলে যোগশক্তিতে কামজয়েরই সাধনা। আর সেই সাধনাটাই করতে জানলে বুড়া বাবার মতো শক্তি ভগিনী হয়ে ওঠেন।

শক্তি তখন ভগিনী বুড়ি মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *