জলার ধারে আস্তানায় – সমরেশ মজুমদার

জলার ধারে আস্তানায় – সমরেশ মজুমদার

আমাদের প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন জীবিত। অনবদ্য কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন তিনি। একদিন তাঁর লেখা বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বিষয়ক বই হাতে পেয়ে পড়ে ফেললাম। অনেক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কাহিনি থাকলেও, টেবো পাহাড়ের বর্ণনা পড়ে আমাকে খুব টানল। তখন আমি সবে চাকরিতে ঢুকেছি। ভবতোষ এবং বিপ্লব আমার বন্ধু। একসঙ্গে চাকরি করি। ওদের বললাম, ‘চল, টেবো পাহাড় থেকে ঘুরে আসি!’ বই পড়ে ওরাও রাজি হল।

হাওড়া স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে চেপে যখন চক্রধরপুরে নামলাম, তখনও ভোর হয়নি। স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম, নিমের দাঁতন বিক্রি হচ্ছে। ওই দিয়ে দাঁত ব্রাশ সেরে মুখ ধুয়ে চা খাওয়ার প্ল্যান করে সবে দাঁতন দুবার দাঁতে ঘষেছি, একটা বাস এসে দাঁড়াল। কণ্ডাক্টর চেঁচিয়ে ঘোষণা করল, ‘লাস্ট বাস, লাস্ট বাস।’

শেষ রাতে লাস্ট বাস হয় কী করে? কণ্ডাক্টর জানাল, আজ এখানে বাস ধর্মঘট। এটা যেহেতু গতকালের শেষ বাস, তাই ছাড় পেয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই বাস টেবো পাহাড় যাবে?’

‘যাবে, যাবে। উঠে পড়ুন।’

তড়িঘড়ি করে দাঁতন ফেলে ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠলাম। বেজায় ভিড়। যাত্রীরা ওই অঞ্চলের আদিবাসী। বসার জায়গা না পেয়ে হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়াতেই বাস ছাড়ল। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বইয়ে লেখা আছে, ‘টেবো একটা পাহাড়ি টিলার উপর নির্জন জায়গা। প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। যেদিকে তাকাবেন চোখ জুড়িয়ে যাবে। একটা পাহাড়ি ঝরনা নেচে-নেচে নীচে চলে যাচ্ছে। তার জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়। ঝরনা ধরে একটু এগোলে বনদপ্তরের অতিথি নিবাস। ‘কলকাতা থেকে আসছি’ বললেই চৌকিদার দরজা খুলে দেবে। লোকটার হাতের মুরগির মাংস খেলে সারাজীবন মনে রাখবেন। আর-একটা বাংলো আছে একেবারে বড়ো রাস্তার ধারে। সেটা পি ডব্লিউ ডি দেখাশোনা করে।’

ভাবলাম, বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কষ্ট বড়োজোর দু-ঘণ্টা, তারপর তো স্বপ্নের মতো দেশে নামব। এটুকু সহ্য করা অবশ্যই যায়।

এক-একটা জায়গায় বাস থামছে আর কণ্ডাক্টর তার নাম বলছে। শেষ পর্যন্ত কণ্ডাক্টর হাঁকল, ‘টেবো, টেবো’।

ভাড়া মিটিয়ে আমরা তিনজন নামতেই বাস চলে গেল সরু পিচের রাস্তা দিয়ে চোখের আড়ালে! চারপাশে তাকালাম। চড়াই-উতরাই। সবুজ গাছগাছালি। ভবতোষ বলল, ‘চল, আগে পি ডব্লিউ ডি’র বাংলোয় যাই। নিমের দাঁতনের কষে মুখ বিচ্ছিরি হয়ে আছে।’

আমার আর বিপ্লবেরও একই অবস্থা। আশপাশে কোনও ঘরবাড়ি নেই। দূরে একটা খড়ের একচালা দেখা যাচ্ছে। একটা গাছের নীচে কয়েকজন দেহাতি মানুষ বসেছিল। কাছে গিয়ে বাংলোর কথা জিজ্ঞেস করতে, ওরা আঙুল তুলে খড়ের বাড়িটাকে দেখিয়ে দিল। লোকগুলোর উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, পায়ে মারাত্মক গোদ প্রত্যেকের।

বিপ্লব বলল, ‘এসব অঞ্চলে মানুষের বোধহয় খুব গোদ হয়।’

হেঁটে খড়ের চালের সামনে পৌঁছে আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। ছাদ থেকে খড় নেমে এসেছে প্রায় মাটি পর্যন্ত। ফলে দেয়াল এবং দরজা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ওপাশে ‘পি ডব্লিউ ডি’ লেখা একটা ফলক মাটিতে পোঁতা রয়েছে। কোনও লোকজন চোখে পড়ছে না। আমরা প্রায় হামা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম, একটা বলদ করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভেবেছে, ওকে তাড়িয়ে ঘরের দখল নেব। ঘরময় নোংরা, পশুর মলমূত্র ছড়ান। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।

বিপ্লব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক পড়েছিলাম তো? এই বাংলোর কথা বইয়ে লেখা ছিল? এটা বাংলো?’

ভবতোষ বলল, ‘আমরা বোধহয় ভুল জায়গায় এসেছি।’

আমরা আবার গাছের নীচে বসে থাকা লোকগুলোর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই জায়গার নাম কি টেবো? আমরা ভুল জায়গায় নেমে পড়িনি তো?’

লোকগুলো একসঙ্গে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি।

বিপ্লব জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে যে ঝরনাটা আছে, সেখানে কীভাবে যাব?’

একজন হাত বাড়িয়ে দিকটা দেখিয়ে দিল।

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বাসের রাস্তা ছেড়ে পায়ে-হাঁটা পথ ধরলাম। মিনিটদশেক পর দৃশ্যটা দেখতে পেলাম, একটা সরু খালের মতো জায়গায় জল চিকচিক করছে। উপর থেকে নেমে এসে স্রোত না থাকায় স্থির হয়ে আছে।

বিপ্লব বলল, ‘এই সেই পাহাড়ি ঝরনা, যে নেচে-নেচে চলে যায়?’

ভবতোষ বলল, ‘এখন বর্ষা নেই বলে জল কমে গিয়েছে। চল, মুখটা ধুয়ে নিই।’

কিন্তু ঝরনার পাশে গিয়ে শরীর গুলিয়ে গেল। বড়োজোর এক ইঞ্চি আটকে থাকা জলে ব্যাঙাচি থিকথিক করছে। এক আঁজলা জল তুলতে গেলেই ব্যাঙাচি হাতে নিতে হবে। মাঝখানে জল নেই। সেখানে ব্যাঙেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মুখ ধোয়া হল না। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর আমরা একটা কাঠের বাংলো দেখতে পেলাম। বাংলোর লনের চারপাশে কাঁটার বেড়া, একটা গেটও রয়েছে। কিন্তু গেটের তালা বন্ধ। অনেক চেঁচামেচি করলাম যাতে চৌকিদার এসে খুলে দেয়। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলোটাকে দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম। বইয়ের বর্ণনার সঙ্গে বেশ মিল পাচ্ছি। এখন ‘কলকাতা থেকে আসছি’ বললেই চৌকিদার গেট খুলে দেবে।

আমাদের চেঁচামেচি শুনেই বোধহয় ওপাশের গাছগাছালির আড়াল থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। খালি গা, পরনে খাটো ধুতি, দাঁত বোধহয় নেই।

বৃদ্ধ দেহাতি হিন্দিতে বলল, ‘চৌকিদার নেই। ও চক্রধরপুরে গিয়েছে।’

‘সর্বনাশ! আর কেউ নেই যে দরজা খুলে দিতে পারে?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘না বাবু, এর আগের চৌকিদার পয়সা নিয়ে গেট খুলে দিত বলে চাকরি চলে গিয়েছে। নতুন চৌকিদার দপ্তরের কাগজ না দেখালে গেট খোলে না।’ বৃদ্ধ বলল।

 আমরা তিনজন মহাফাঁপরে পড়লাম। বিপ্লব বইটাকে গালাগাল দিচ্ছিল। আমি আর ভবতোষ বলছিলাম, ‘শক্তিদা যখন দেখেছিলেন তখন নিশ্চয়ই ওরকম ছিল। এখন পালটে গিয়েছে।’

বিপ্লব বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে থাকার জায়গা আছে? হোটেল, বাংলো?’

বৃদ্ধ দু-দিকে মাথা নাড়ল, ‘না বাবু। এখানে তো শহরের লোকজন আসে না।’

বিপ্লব দু-পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমরা বহুদূর, সেই কলকাতা থেকে এসেছি। আজ যে ফিরে যাব তার উপায় নেই। আজ নাকি বাস স্ট্রাইক। তুমি ভাই আমাদের সাহায্য করো। একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দাও। তার জন্য যে টাকা লাগবে আমরা দেব।’

বৃদ্ধ একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।’

বৃদ্ধের বয়স কত বুঝতে পারছি না কিন্তু বেশ দ্রুত হাঁটছিল। ঘন গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে ওর পিছন-পিছন চলে এলাম একটা টিলার গায়ে জলার পাশে। পুকুর বা দিঘি নয়, কয়েক বিঘে ঢালু জমিতে হাঁটুর উপর পর্যন্ত জল জমে আছে। সেই জলার ধারে একটা কাঠের বাড়ি। বাড়িটা ছ-টা শক্ত খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশে একটা ঘেরা জায়গা। অনুমান করলাম, এটাই এই বাড়ির টয়লেট।

বৃদ্ধ বলল, ‘আপনারা দেখুন, এখানে থাকতে পারবেন কিনা।’

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে ঘর দেখলাম। পরিষ্কার। দুটো ঘরে দুটো করে খাটিয়া পাতা। বিপ্লব সেই খাটিয়ার একটাকে নাড়াচাড়া করে বলল, ‘না:, ছারপোকা নেই।’

বললাম, ‘খুব ভালো ব্যবস্থা। শুধু খাওয়ার জল আর খাবার দরকার। এখানে যা পাওয়া যায়, তাই পেলে চলবে।’

শুনে বৃদ্ধ যেন খুশি হল। বলল, ‘চিন্তা করবেন না, আমি এখনই জল এনে দিচ্ছি।’

বৃদ্ধ চলে গেলে জানলা খুলল ভবতোষ। নীচে জলার জলে ঢেউ তুলছে বাতাস। ওই ঢেউটুকু উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কোথাও এগোচ্ছে না। ভবতোষ বলল, ‘এরকম একটা জলার ধারে থাকার শখ ছিল আমার। আজ সেটা মিটল।’

বিপ্লব বলল, ‘দয়া করে জানলা বন্ধ কর। নইলে ওই জলা থেকে উঠে মশা আমাদের তুলে নিয়ে যাবে।’

‘তোর মেজাজ এখনও ভালো হল না!’ ভবতোষ বলল।

‘কী করে হবে? সেই কোন ভোরে দাঁতন চিবিয়েছি, এখনও মুখ ধোয়া গেল না। মনে হচ্ছে ভিতরটা কষে গিয়েছে। হাইওয়ের পাশে বাংলো, নেচে-যাওয়া পাহাড়ি ঝরনা তো চোখ ভরে দেখলাম। যাক, লোকটা আসছে।’ বিপ্লব থামল।

বৃদ্ধ এক হাতে কলসি অন্য হাতে জলভরা বালতি নিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে বলল, ‘মিঠা জল। নলকূপের। খুব ভালো।’

বিপ্লব সঙ্গে-সঙ্গে কুড়িটা টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এটা জলের জন্য। আর এখানে নিশ্চয়ই চা পাওয়া যাবে না?’

‘যাবে।’

‘যাবে? আরেব্বাস! এই নাও কুড়ি টাকা।’

‘চা আর মুড়ি।’

‘চমৎকার!’ বিপ্লব খুশি হল, ‘একটু ভাত, আলুসেদ্ধ, একটু ডাল?’

‘পাবেন। সঙ্গে ডিমের ঝোল।’

‘কুড়িটা টাকা ফেরত দাও। তুমি একশো টাকা নিয়ে যাও।’

বৃদ্ধ চলে গেলে বিপ্লব বলল, ‘এ তো লটারিতে টাকা পাওয়া হয়ে গেল রে! ও যা এনে দিচ্ছে এখানে, তার বেশি কী চাই!’

আমরাও একমত হলাম।

বৃদ্ধ চা এবং মুড়ি দিয়ে গেল। মুখ ধুয়ে সেটা যতই খারাপ হোক, খেয়ে নিলাম। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ভবতোষ আবিষ্কার করল, পাশের ঘরে একটা বড়ো ছিপ রয়েছে। তার সুতোয় বঁড়শি পরানো। আমরা বেশ কয়েকটা ফড়িং ধরে ফেললাম। তাদের একটাকে বঁড়শিতে গেঁথে জলার ধারে বারান্দায় গিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম। এই সুতোয় ফাতনা লাগানো নেই। মাঝে-মাঝে সুতো নড়ে উঠছিল। জল থেকে বঁড়শি উপরে তুলতেই দেখতে পেলাম, ফড়িং নেই। চতুর মাছেরা সেটাকে খেয়ে গিয়েছে। সারাটা দুপুর এরকম লুকোচুরি খেলা চলল। আমরা যখন একদম হতাশ, তখন ছিপটা প্রবলভাবে নড়ে উঠল। তারপর সুতো টানটান হয়ে ছিপটাকে টানতে লাগল জলের দিকে। বিপ্লব চেঁচাল, ‘বড়ো মাছ গেঁথে গিয়েছে। ছিপ ধরে টানিস না, সুতো ছিঁড়ে যাবে।’

তার বলার মধ্যেই ভবতোষের হাত থেকে ছিপ ছিটকে বেরিয়ে জলে পড়ল। তারপর বঁাই বঁাই করে ছুটে বেড়াতে লাগল জলার চারধারে। আমরা আফশোস করতে লাগলাম। নিশ্চয়ই বড়ো রুই বা কাতলা। ধরতে পারলে খাওয়ার সমস্যা থাকত না। কিন্তু ছিপটা ডুবে যাচ্ছে না। চরকির মতো ঘুরে-ঘুরে মাঝে-মাঝে স্থির হয়ে যাচ্ছে। এর মানে মাছটা এখনও বঁড়শি গিলে আছে এবং সুতো ছিঁড়ে যায়নি। একসময় ছিপটা চলে এল বারান্দার নীচে। বিপ্লব একটা লাঠি দিয়ে সেটাকে উপরে তুলতেই পিছন থেকে বৃদ্ধের গলা ভেসে এল, ‘ওটা আর তুলবেন না বাবু। ওকে ছেড়ে দিন।’

‘মাছটাকে তুলব না?’ বিপ্লব অবাক।

‘ওটা মাছ নয়।’

‘তা হলে?’

‘নাই বা জানলেন। শুধু শুনুন, ওকে জল থেকে তোলার চেষ্টা করলে আপনাদের অমঙ্গল হবে। ও এখানে আছে বলে কখনও জল শুকোয় না। কেউ মাছ ধরতে আসে না। ওই ছিপ যার ছিল, সেওকে ধরতে চেষ্টা করেছিল। বোধহয় জলের উপর তুলেছিল, তারপর সেঅন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে গাছতলায় বসে থাকে। পায়ে গোদ হয়ে গিয়েছে।’

মনে পড়ল লোকগুলোর কথা। তাদের কেউ অন্ধ কি না তখন ঠাহর করিনি। বললাম, ‘বড়শিটা যে মুখে গেঁথে আছে?’

‘থাকবে না। রাত নামলে অন্য মাছেরা এসে ওটা ছাড়িয়ে দেবে।’

‘ওটা কি মেছোভূত?’ বিপ্লব হাসল।

 ‘এসব কথা না বলাই ভালো বাবু,’ লোকটা বলল, ‘একটু পরেই রাত নামবে। এখানে কেরোসিন পাওয়া যায় না। তাই আলো দিতে পারলাম না।’

ভবতোষ বলল, ‘তা ঠিক আছে। রাতে কী খাওয়াবে?’

‘রুটি, তরকারি আর ডাল।’

বিপ্লব আবার পঞ্চাশ টাকা বের করে বৃদ্ধকে দিয়ে দিল। সন্ধের মুখে বৃদ্ধ এসে তিনটে পাত্র দিয়ে গেল। বলল, ‘রাতে নীচে নামবেন না। শরীরের প্রয়োজন হলে এখান থেকেই সেরে নেবেন।’

‘কেন?’ বিপ্লব তাকাল।

‘অচেনা জায়গায় এসেছেন, কী দরকার?’ বৃদ্ধ চলে গেল।

রাত নামতেই কীরকম গা ছমছম করতে লাগল। জলার উপর হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। ক্রমশ সেটা ঝড়ের আওয়াজ তুলল। আমরা তিনজন বঁড়শিতে কী গেঁথে ছিল, তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। লোকটা খামোকা ভয় দেখিয়ে গেল না তো? হঠাৎ কাঠের বাড়িটা প্রবলভাবে নড়তে লাগল। জলের তলায় কাঠের থামে কেউ জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। ভবতোষ বলল, ‘অসম্ভব। এভাবে এখানে থাকা যায় না। ঘর দু-টো যদি উলটে জলে পড়ে?’

যেভাবে নড়ছে তাতে আমিও ওর কথায় সায় দিলাম। বিপ্লব জিজ্ঞেস করল, ‘যাব কোথায়?’

‘চল হাইওয়েতে যাই। বাস না চলুক, লরি বা প্রাইভেট গাড়ি তো পেতে পারি।’

আমরা তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম। অন্ধকারে হোঁচট খাচ্ছি বারে বারে। চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অনেকটা হাঁটার পর দূরে আলো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে বুঝলাম, ওটা সেই ফরেস্ট বাংলো। গেট দিয়ে একটা জিপ হেডলাইটের আলো জ্বেলে ঢুকছে। আমরা কাছে যেতে-যেতে বাংলোর বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, পরে জেনেছি, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসার, গাড়ি থেকে নামলেন। হ্যারিকেন জ্বালিয়েছে চৌকিদার। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে আমরা কোথা থেকে এসেছি? সংক্ষেপে সব বললাম। চৌকিদার মন দিয়ে শুনছিল। বলে উঠল, ‘এখানে তো কোনও জলা নেই, কাঠের বাড়িও নেই। পিছনে জঙ্গলও নেই। কোনও বুড়ো মানুষ ওদিকে থাকে না। এঁরা ঠিক বলছেন না সাহেব।’

ফরেস্টের অফিসার আমাদের জেরা করলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আপনাদের বিশ্বাস করছি। আজকের রাতটা এই বাংলোয় কাটিয়ে দিন। কাল ভোরে চলে যাবেন।’

হঠাৎ বমির আওয়াজ পেয়ে দেখলাম, বিপ্লব বমি করছে। কোনও রকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমরা ওখানে যা খেয়েছি সেগুলো কী ছিল?’

হ্যারিকেনের আলোয় দেখলাম, বিপ্লবের মুখ থেকে বমি করার আওয়াজ বেরিয়েছে। কিন্তু কোনও খাদ্যদ্রব্য বেরিয়ে মাটিতে পড়েনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *