জলসা
দু’তিনদিন ধরে কয়েকটা কালো হেলিকপ্টার ঈগলের মতো শিকারের খোঁজে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝড় উঠছে; অশুভ সংকেতের মতো! সুনসান বাজারে সশস্ত্র পুলিশের বুটের আওয়াজ চারিদিককে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। বাজারটা ক’দিন আগে পর্যন্ত লোকজনে গমগম করত। এখন নিস্তব্ধ।
পুরো শহরটার উপর ভয় যেন থাবা বসিয়েছে!
খালিদ তার বাড়ির অস্বাভাবিক পরিবেশে ঘাবড়ে গিয়ে তার বাবার কাছে বসে জিগ্যেস করল, ‘আব্বা, আমায় স্কুলে যেতে দিচ্ছ না কেন?’
‘আজ স্কুল ছুটি, বাবা!’
‘মাস্টারজি কাল কিছু বললেন না তো!…উনি তো কাল বলছিলেন আজ সবার খাতা দেখবেন! ওনার দেওয়া কাজ যে আজ শেষ না করে যাবে, তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে!’
‘উনি বলতে ভুলে গেছেন বোধহয়।’
‘তোমার দপ্তরেও আজ ছুটি?’
‘হ্যাঁ…আমারও আজ ছুটি।’
‘ঠিক আছে। আজ তাহলে তোমার কাছ থেকে একটা ভালো গল্প শুনব।’
কথাবার্তা চলতে চলতেই উপর দিয়ে জোরে আওয়াজ করতে করতে তিন-চারটে হেলিকপ্টার উড়ে গেল। খালিদ ওগুলো দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সে গত কয়েকদিন ধরেই ওগুলোকে উড়তে দেখছিল। কিন্তু তার মাথায় ঢুকছিল না ওদের ওড়ার কারণ কী? রোজ রোজ কেন ওরা রোদের মধ্যে শহর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে!
শেষে এই ঘড়ঘড় আওয়াজে অধৈর্য হয়ে সে বাবাকে বলল,’আব্বা! আমার ভয় করছে!…এই জাহাজওয়ালাদের বলে দাও না যাতে আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে না ঘোরাঘুরি করে!’
‘ধুর বোকা! ভয় কীসের?’
‘আব্বা, খুব বাজে এই জাহাজগুলো।…যদি কোনওদিন আমাদের বাড়ির উপর বোম ফেলে দেয়!’
‘এসব কথা কে বলেছে?’
‘কালকেই তো মামা আম্মিজানকে বলছিল যে এদের কাছে অনেক বোম আছে! আমি শুনেছি!…এরা যদি ওরকম কিছু করে, আমার কাছেও বন্দুক আছে। দেখবে না কেমন মজাটা দেখাই!’
খালিদের বাবা ছেলের সাহস দেখে অল্প হেসে বললেন, ‘মামা একদম পাগল। আমি বারণ করে দেব যেন এসব উল্টোপাল্টা কথা আর না বলে…কোনো চিন্তা নেই। মামা আর এসব বলবে না।’
বাবার সঙ্গে কথা বলে খালিদ নিজের ঘরে চলে গেল। আগের ঈদে বাবা যে এয়ারগান দিয়েছিল, সেটা নিয়ে নেট-প্র্যাক্টিস শুরু করল। যখন ওই বিচ্ছিরি জাহাজগুলো বোম ফেলবে, তখন যাতে বন্দুকের নিশানায় ভুলচুক না হয়!…হায়! সবার প্রতিশোধই যদি এত নিরীহ আর নিষ্পাপ হত!
যখন বাড়ির এক কোণে ছোট্ট একটা ছেলে নিজের সরল প্রতিশোধের ছক কষছিল, তখন অন্যদিকে তার বাবা কড়া নির্দেশ দিচ্ছিলেন মা এবং মামাকে, যাতে ছেলের সামনে এই ধরনের কোনো কথা দ্বিতীয়দিন না হয়! সেই নির্দেশের পালা শেষ হতে না হতেই বাড়ির কাজের লোক খবর আনল, শহরের লোকজন বাদশাহের বিরুদ্ধে গিয়ে সন্ধেবেলায় একটা জলসার আয়োজন করছে।
খালিদের বাবার বুক কেঁপে উঠল। তাহলে এই নিস্তব্ধতা, হেলিকপ্টার, সশস্ত্র পুলিশের দল, ভয়াবহ ঝড়, মানুষজনের শুকনো মুখ—সবই অর্থবহ!
কিন্তু কী হতে চলেছে?
তাঁর মতোই কেউ কিছু জানত না। সবাই শুধু এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপছিল। বাইরে বেরোনোর ইচ্ছা মুলতুবি রেখে তিনি জামাকাপড় বদলাতে শুরু করলেন। এমন সময় বাড়ির ঠিক উপর দিয়ে হেলিকপ্টারের তীব্র আওয়াজ ভেসে এল। যেন অনেক লোক একসঙ্গে ব্যথায় চিৎকার করছে।
খালিদ সেটা শুনেই নিজের বন্দুক নিয়ে ছুটে এল আর ভালো করে হেলিকপ্টারগুলোকে দেখতে লাগল। তারা বোম মারলেই সে বন্দুক তেগে ওদের নামিয়ে দেবে।
সাত বছরের বাচ্চার চোখেমুখে তখন যে সাহস আর দৃঢ়তা ফুটে উঠেছিল, তা দেখলে আসল বন্দুকধারী সিপাইরাও লজ্জা পেত! বহুদিনের ভয়কে উপড়ে ফেলতে খালিদ তখন বদ্ধপরিকর।
দেখতে দেখতে হেলিকপ্টার থেকে কাগজের টুকরোর মতো কীসব যেন ফেলা শুরু হল। টুকরোগুলো হাওয়ায় ঘুড়ির মতো উড়ে উড়ে এদিকে- ওদিকে পড়তে লাগল। খালিদদের বাড়ির ছাদেও একটা উড়ে এসে পড়ল।
খালিদ দৌড়ে দৌড়ে ছাদে উঠল। কাগজের টুকরোটা তুলে নিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে নীচে এসে ঘোষণা করল, ‘আব্বা, মামা সত্যিই ভুলভাল বলে!…জাহাজওয়ালারা তো শুধু কাগজ ফেলেছে!’
খালিদের বাবা কাগজটা তুলে পড়তে শুরু করলেন। ঠিক কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তার সম্যক ধারণা হতেই তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
ইস্তেহারে লেখা ছিল, বাদশাহ কোনওরকম জলসার অনুমতি দেননি। তাঁর মতের বিরুদ্ধে জলসা হলে যে পরিণাম হবে, তার দায়িত্ব জনগণের!
ইস্তেহার পড়ে আব্বাকে এত চিন্তিত হতে দেখে খালিদ ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, ‘এতে কী লেখা, আব্বা? আমাদের বাড়িতে বোম ফেলা হবে?’
‘খালিদ, তুমি এখন যাও বাবা…নিজের বন্দুক নিয়ে খেলা কর।’
‘কিন্তু এই কাগজটাতে কী লেখা?’
‘লেখা যে সন্ধেয় জলসা হবে…’, তার বাবা পরিবেশ হালকা করার জন্য বললেন।
‘জলসা হবে!…তাহলে তো আমরাও যাব!’
‘কী!’
‘তুমি আমায় জলসা দেখতে নিয়ে যাবে না?’
‘সে হবে নাহয়…এখন যাও, খেলো।’
‘কোথায় খেলব?…তুমি বাজারে যেতে দিচ্ছ না…মামা তো আমার সঙ্গে খেলে না!…তুফেইলও আজকাল এখানে আমার সঙ্গে খেলতে আসে না!…কার সঙ্গে খেলব তাহলে…আব্বা, সন্ধেবেলা ঠিক জলসা দেখাতে নিয়ে যাবে তো?’
উত্তরের অপেক্ষা না করে খালিদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিভিন্ন ঘরে ঘুরে ঘুরে শেষে সে তার বাবার বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকল। সেই ঘরের জানলা দিয়ে বাজার দেখা যেত।
জানলার কাছে বসে সে বাজারের দিকে তাকিয়ে রইল।
বাজারের দোকানপাট বন্ধ, কিন্তু লোকজন চলাচল করছে। সে অবাক হয়ে ভাবছিল যে দোকান কেন খোলেনি! ছোট্ট মাথায় অনেক ভেবেও সে বিশেষ কিছু ঠাহর করতে পারল না। শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে জলসার জন্যই দোকান বন্ধ। নিশ্চয়ই খুব বড় জলসা, যখন উড়োজাহাজে করে তার ইস্তেহার দিচ্ছে! খালিদ অস্থির হয়ে উঠল, আব্বা কখন তাকে দেখাতে নিয়ে যাবে!
সময় এগিয়ে চলল…অবশেষে সন্ধেও এসে পড়ল।
খালিদ ও তার বাবা-মা চুপচাপ বসে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। হাওয়াও যেন গোঙাচ্ছিল।
তড় তড় তড় তড়…।—শব্দ শুনে খালিদের বাবার মুখ শুকিয়ে গেল।
শুকনো গলায় ফিসফিস করে তিনি কোনওরকমে বললেন, ‘গুলি…!’
শুনে খালিদের মা ভয়ে পাথর হয়ে গেলেন, যেন গুলি তাঁর বুকে লেগেছে!
খালিদ শব্দ শুনে বাবার আঙুল ধরে বলল, ‘আব্বা, চলো চলো! জলসা শুরু হয়ে গেছে!’
‘কোন জলসা?’ তার বাবা ভয় লুকোতে জোর করে উত্তর দিলেন।
‘ওই তো! যেটার ইস্তেহার দিচ্ছিল সকালবেলায়! ওই জাহাজগুলো থেকে পড়ল, মনে নেই!…শুরু হয়ে গেছে আব্বা! বাজিও ফাটাচ্ছে, শুনলে না? চলো না আব্বা!’
‘এখনো শুরু হতে অনেক দেরি আছে। তুমি ততক্ষণ মামার সঙ্গে খেলো।’
এই শুনে খালিদ রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল। কিন্তু মামা সেখানে ছিল না। তাই সে বেরিয়ে আবার বাবার বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকল। জানলার কাছে বসে বাজারের দিকে চেয়ে রইল।
বাজার খাঁ-খাঁ করছে। দূরে কুকুরের আর্তনাদের সঙ্গে মানুষের চিৎকার মিলেমিশে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনাচ্ছে!
খালিদ সেই আওয়াজটা শুনে চমকে গেল। কীসের আওয়াজ বোঝার চেষ্টা করতে না করতেই সে হঠাৎ দেখতে পেল, একটা ছেলে মোড়ের দিক থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে।
খালিদের বাড়ির ঠিক সামনেটায় এসে সে টলতে টলতে পড়ে গেল। পড়েই বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল। তার পায়ে একটা গভীর ক্ষত। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।
খালিদ ভয়ে ছুটে তার বাবা-মা’র কাছে গেল, ‘আব্বা! আব্বা! বাজারে একটা ছেলে পড়ে গেছে…পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছে!’
খালিদের বাবা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। একটা অল্পবয়েসি ছেলে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। বাদশাহের ভয়ে কারোর সাহস হল না যে রাস্তা থেকে ছেলেটাকে তুলে আনবে।
উদ্বাস্তুদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাদশাহ লোহার গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরই আদেশে নিহত বাচ্চা ছেলেটার জন্য কোনো ব্যবস্থা করার কথা বোধহয় তাঁর মনে ছিল না। হুকুমতের আগুনে ঝলসে যাওয়া ছোট্ট চারাগাছটা বাদশাহেরই তৈরি রাস্তার উপর পড়ে রইল!…মৃত্যুর চেয়ে বোধ করি অত্যাচার অনেক বেশি ভয়ানক!!
‘আব্বা, ছেলেটার কী হয়েছে? ওকে কেউ মেরেছে?’
খালিদের বাবা মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
একা একা ঘরে দাঁড়িয়ে খালিদ ভাবতে লাগল, ছেলেটার খুব ব্যথা লেগেছে নিশ্চয়ই! একবার একটা ছোট্ট ছুরিতে একটুখানি কেটে যাওয়ায় তার এত ব্যথা হয়েছিল যে সারারাত ঘুমোতে পারেনি! বাবা-মা কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বহুকষ্টে তাকে ঘুম পাড়িয়েছিলেন। মনে পড়তেই ছেলেটার ব্যথার কথা ভেবে সে ডুকরে কেঁদে উঠল।
তার কান্না শুনে মা ছুটে এলেন। তাকে কোলে নিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কাঁদছিস কেন সোনা?’
‘আম্মি, ওই ছেলেটাকে কেউ মেরেছে?’
খালিদের মা স্বামীর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে নিয়েছিলেন। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ‘দুষ্টুমি করেছিল নিশ্চয়ই…।’
‘স্কুলে তো দুষ্টুমি করলে লাঠি দিয়ে মারে! রক্ত তো বেরোয় না!..’
‘লাঠি একটু বেশি জোরে লেগে গেছে। তাই রক্ত বেরোচ্ছে।’
‘ওর আব্বা স্কুলে গিয়ে মাস্টারকে বকবে না? এরকমভাবে মেরেছে!… মাস্টারজি একবার যখন আমার কান মলে লাল করে দিলেন, আব্বা তো গিয়ে হেডমাস্টারের কাছে নালিশ করে দিয়েছিল!’
‘ওই ছেলেটার মাস্টার খুব বড় একজন মানুষ…’
‘আল্লাহ মিঞার থেকেও বড়?!’
‘না, তাঁর চেয়ে ছোট…।’
‘তাহলে ওর আব্বা আল্লাহ মিঞার কাছে তো নালিশ করতেই পারে!’
‘খালিদ, বাবা, অনেক রাত হল…এবার শুয়ে পড়!’
শুয়ে শুয়ে খালিদ প্রার্থনা করতে লাগল, ‘আল্লাহ মিঞা! ওই ছেলেটাকে যে মেরেছে, সেই মাস্টারকে খুব শাস্তি দাও! যে লাঠি দিয়ে মারলে রক্ত বেরোয়, সেটাকেও ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেল!…আমি না নামতাটা মুখস্ত করিনি! আমার মাস্টারের হাতে ওই লাঠিটা যেন কক্ষনো না আসে!…তুমি যদি আমার কথা না শোনো, আমি কিন্তু আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব না!…’