জলসাঘর – সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য
কাহিনি: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায
১
পুরোনো জমিদার বাড়ির ঝাড়বাতি জ্বলছে। ঝাড়বাতিটা ধীরে ধরে সামনে এগিয়ে আসে। তার উপর ছবির টাইটেল পড়ে। টাইটেল শেষ হলে পর ছবি শুরু হয়।
ভোর। রায়বাড়ির ছাদ।
ছাদে চেয়ারে একাকী বসে আছেন জমিদার বিশ্বম্ভর রায়। ছাদের ঘরের দরজা দিয়ে গড়গড়া হাতে ঢোকে খানসামা অনন্ত। বিশ্বম্ভরের পাশেই গড়গড়াটিকে মাটিতে রেখে নলটা মনিবের দিকে এগিয়ে দেয়।
অনন্ত || হুজুর! হুজুর!
বিশ্বম্ভর হাত বাড়িয়ে নলটি নিলে অনন্ত ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে বিশ্বম্ভরের ‘অনন্ত’ ডাক শুনে সে দাঁড়িয়ে যায়।
অনন্ত || হুজুর!
বিশ্বম্ভর || এটা কি মাস রে?
অনন্ত || ফাগুন মাস, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || বসন্তকাল?
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। মুচকুন্দ ফুটেছে, আপনার সরবতে দেব, হুজুর?
বিশ্বম্ভর কথার উত্তর দেন না। মুখ ঘুরিয়ে নেন অন্যদিকে। অনন্তর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
বিশ্বম্ভর চেয়ারে বসা অবস্থায় গড়গড়া টানতে থাকেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পান দূর থেকে ভেসে আসা সানাইয়ের সুর। উৎকর্ণ হয়ে সানাই শুনতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। চারদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন কোত্থেকে আসছে সানাইয়ের সুর। বুঝতে না পেরে ছাদের কার্নিশের কাছ থেকে নিচে উঠোনের দিকে তাকিয়ে ডাকেন—
বিশ্বম্ভর || অনন্ত!
অনন্ত নিচের উঠোন দিয়ে যেতে যেতে ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গিয়ে উপরের দিকে তাকায়।
অনন্ত || হুজুর!
বিশ্বম্ভর || সানাই বাজছে কোথায়?
অনন্ত || গাঙ্গুলিবাবুদের বাড়িতে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কোথায়?
অনন্ত || গাঙ্গুলিবাবুদের বাড়িতে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || নায়েবকে পাঠিয়ে দে।
অনন্ত || যে আজ্ঞে হুজুর।
অনন্ত নায়েবকে ডাকতে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর ছাদে পায়চারি করতে থাকেন।
নায়েব তারাপ্রসন্ন নিজের ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। অনন্ত তাঁকে ডেকে তোলে।
অনন্ত || পেসন্নবাবু, পেসন্নবাবু। রায় হুজুর ডাকছেন।
অনন্তর ডাকে চমকে উঠে পড়েন তারাপ্রসন্ন।
তারাপ্রসন্ন || অ্যাঁ, কে?
অনন্ত || রায় হুজুর ছাতে রয়েছেন। যান যান যান—
ছাদ। তারাপ্রসন্ন আসেন।
বিশ্বম্ভর || মহিমের বাড়ি সানাই বাজছে কেন?
তারাপ্রসন্ন || ওর ছেলের উপনয়ন, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || বন্দে আলীর সানাই, না?
তারাপ্রসন্ন || হ্যাঁ, হুজুর!
বিশ্বম্ভর || আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে?
তারাপ্রসন্ন || করেছে।
বিশ্বম্ভর || নিজে এসেছিল?
তারাপ্রসন্ন || না, হুজুর। চিঠি পাঠিয়েছে।
বিশ্বম্ভর || ও!
তারাপ্রসন্ন || আপনি কি যাবেন?
বিশ্বম্ভর || আমি যাই কোথাও?
তারাপ্রসন্ন || না, হুজুর!
বিশ্বম্ভর || তবে।
তারাপ্রসন্ন একমুহূর্ত বিশ্বম্ভরের দিকে তাকিয়ে চলে যান। অনন্ত সরবত নিয়ে আসে।
অনন্ত || সরবত এনেছি, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || রেখে যা।
বিশ্বম্ভর মুখ ঘুরিয়ে নহবতখানার দিকে তাকান। নহবৎখানা সামনে, দূরে দেখা যায় গঙ্গার চর। কিছুক্ষণের জন্যে নহবতখানার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি, পরে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন।
বিশ্বম্ভরকে চিন্তিত দেখায়। তাঁর গালে হাত। কি যেন ভাবছেন তিনি!
বিশ্বম্ভর (স্বগত) উ-প-ন-য়-ন!
মনে পড়ে যায় তাঁর নিজের ছেলের উপনয়নের কথা।
ফ্ল্যাশ ব্যাক।
নহবৎখানার সানাইবাদক সানাই বাজাচ্ছে। নহবৎখানার ফাঁক দিয়ে দূরে দেখা যায় গঙ্গার চর। দূর থেকে বিশ্বম্ভরকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখা যায়। ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ির ভাঙা গেট দিয়ে ঢুকে এসে দাঁড়ালেন মূল বাড়ির সামনে। পিছনে সহিসকে ছুটে আসতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর ঘোড়ার পিঠে আদরের চাপড় মেরে ফটক দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যান। তাঁর পরনে জমিদারি পোশাক, মাথায় পাগড়ি।
রায়বাড়ির ভিতরের বারান্দা।
উপনয়ন উপলক্ষে বাড়ি সাজানো হচ্ছে। একজনকে দেখা যায় দেওয়ালগিরির চিমনি লাগাতে।
বিশ্বম্ভর ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে দ্রুত এগিয়ে আসেন। পিছনে সেরেস্তা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তারাপ্রসন্ন। তাঁর হাতে চিঠি। বিশ্বম্ভরের দিকে এগিয়ে গিয়ে তিনি ডাক দেন।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর!
বিশ্বম্ভর ততক্ষণে দোতলায় যাবার সিঁড়ির দিকে উঠতে আরম্ভ করেছেন। তারাপ্রসন্নর ডাক তাঁর কানে যায় না। তারাপ্রসন্ন এগিয়ে এসে আবার ডাকেন।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর!
বিশ্বম্ভর থামেন। কয়েক ধাপ উঠে আসেন তারাপ্রসন্ন।
তারাপ্রসন্ন || ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি এসেছে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কি লিখেছে?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে—!
তারাপ্রসন্নর মধ্যে একটু ইতস্তত ভাব দেখা যায়।
তারাপ্রসন্ন || লিখছে— With reference to your proposal for further loan against the security already pledged by you with us, the Board of Directors regrets…
বিশ্বম্ভর || দেবে না।
তারাপ্রসন্ন || না, হুজুর! লিখছে— the cover has already exceeded the margin limit set forth under the Banking Rules…
বিশ্বম্ভর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর, মহিম এসেছে, একবার দেখা করবেন?
বিশ্বম্ভর ভ্রূকুটি করে মহিমকে মনে করার চেষ্টা করেন।
বিশ্বম্ভর || মহিম…?
তারাপ্রসন্ন || জনার্দন গাঙ্গুলির ছেলে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || হুঁ। সে সুদখোরের ব্যাটা আবার কেন?
বিশ্বম্ভর কথাটা বলেই আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন। তারাপ্রসন্ন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে, সামনের চরটা ইজারা নিতে চায়, হুজুর। বালির ব্যবসা করবে।
কথা শুনে বিশ্বম্ভর আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
বিশ্বম্ভর || জনার্দন গাঙ্গুলির ছেলে?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। পয়সা হয়েছে হুজুর। সদরে ব্যবসা আছে, গাঁয়ে বাড়ি তুলছে।
বিশ্বম্ভর || বটে?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে, একবার কথা বলবেন হুজুর? নইলে তহবিলে যা আছে তাতে অনুষ্ঠানের ব্যয় সংকুলান—
বিশ্বম্ভর || আচ্ছা, তাকে পাঠিয়ে দাও। আমি জলসাঘরে আছি।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে।
তারাপ্রসন্ন নেমে যান। বিশ্বম্ভর উঠতে থাকেন।
.
জলসাঘর
দরজা দিয়ে ঢুকে এগিয়ে আসেন বিশ্বম্ভর। আসবাবপাত্র ছড়ানো। জলসাঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে। কর্মরত লোকগুলোর দিকে তিনি তাকালেন। তাঁর মুখে মৃদু হাসি দেখা যায়। ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বিশ্বম্ভর এগিয়ে যান বড়ো ঝাড়বাতিটার দিকে। ঝাড়বাতিটাকে কয়েকজন লোক পরিষ্কার করছে। হাসিমুখে তিনি দেয়ালে টাঙানো তাঁর পূর্বপুরুষের ছবিগুলোর দিকে দেখেন। তারপর এগিয়ে যান প্রকাণ্ড আয়নার দিকে। এবার আয়নার দিকে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। পাশ ফিরে পেটে হাত দিয়ে দেখলেন তাঁর উদর স্ফীত হয়েছে কিনা। কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আয়নায় অনন্তকে সরবত আনতে দেখা যায়। দেখা যায় তারাপ্রসন্নকেও, মহিমকে সঙ্গে নিয়ে আসতে।
বিশ্বম্ভর || এসো।
মহিম এগিয়ে এসে বিশ্বম্ভরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
অনন্ত এই সময় বিশ্বম্ভরের হাতে দেয় সরবতের গ্লাস এবং ছুটে গিয়ে ছোটো টেবিলটা নিয়ে আসে। বিশ্বম্ভর সরবতে চুমুক দেন।
বিশ্বম্ভর || জনার্দন গাঙ্গুলির ছেলে তুমি?
মহিম || আজ্ঞে হ্যাঁ।
মহিম উত্তর দেয় বিনীতভাবে।
বিশ্বম্ভর || সরবতে কি দিয়েছিস রে?
অনন্ত || আজ্ঞে, মুচকন্দ ফুলের গোটাকতক পাপড়ি মেড়ে দিইচি।
বিশ্বম্ভর || অ! বেশ হয়েছে।
অনন্ত খুশি হয়ে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর || বাপের ব্যবসা ধরেছ?
মহিম বিনয়ে গলে পড়ে।
মহিম || হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ—
বিশ্বম্ভর || সুদ নাও কত?
মহিমের থতমত ভাব।
মহিম || আজ্ঞে—
বিশ্বম্ভর || রায়বাড়ির এলাকায় মহাজনী করতে হলে কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হয়, জানো বোধ হয়।
আয়নার ভেতর দিয়ে দেখা যায় তারাপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে আছেন।
মহিম || আজ্ঞে হ্যাঁ, তা— হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ
বিশ্বম্ভর || মাসে শতকরা এক টাকার বেশি সুদ নেই। বাকি খাজনায় সুদ নেই। খাজনায় তামাদি নেই। নালিশ নেই, জানো বোধ হয়।
মহিম || আজ্ঞে হ্যাঁ, তা জানি বইকি। হুজুরের খেয়েই তো মানুষ।
বিশ্বম্ভর || অ্যাদ্দিন দেখিনি যে?
মহিম || পশ্চিমে ছিলুম— প্রায় বিশ বছর। এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্নৌ—
বিশ্বম্ভর || অ!
সরবতে চুমুক দেন বিশ্বম্ভর।
মহিম || গান বাজনার শখ আমারো একটু আধটু আছে। পশ্চিমে থাকতে আমিও অনেক শুনেছি। দরকার হলে তবলার ঠেকা ঠেকা একটু আধটু— হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ
বিশ্বম্ভর সরবৎ শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে পড়েন।
বিশ্বম্ভর || তুমি তাহলে এসো।
মহিম || আসবো?
বিশ্বম্ভর এগিয়ে যান, তাঁর পিছনে পিছনে আসেন তারাপ্রসন্ন।
বিশ্বম্ভর || দুর্গাবাঈ আসছেন?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে?
তারাপ্রসন্ন || সে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
বিশ্বম্ভর || মহিমকেও বলে দিও।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে! কিন্তু—
বিশ্বম্ভর || সুদখোরের টাকায় আমার একমাত্র ছেলের উপনয়ন হতে পারে না, তারাপ্রসন্ন!
তারাপ্রসন্ন || কিন্তু সে ছাড়া যে—
বিশ্বম্ভর || উপায় আছে। সিন্দুকে আগের আমলের রায়গিন্নিদের গহনা আছে।
বিশ্বম্ভর চলে যান। তারাপ্রসন্ন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
২
নহবৎখানায় সানাই বাজছে।
নাটমন্দির।
পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। বিশ্বম্ভর আর তাঁর পুত্র বীরেশ্বর, পুরোহিতের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করেন।
পুরোহিত || আচার্য দেবতা আমন্ত্রণে বিনিয়োগ ভো অধি ভো সাবিত্রে—
রাত।
রায়বাড়িতে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। আকাশে নানা ধরনের বাজির সমারোহ। বাজির ফুলকিগুলো উপরদিকে উঠে ছিটকে পড়ছে।
বিশ্বম্ভর ও জনৈক আমন্ত্রিত ব্যক্তিকে বাজি পোড়ানো দেখতে দেখা যায়। তাঁরা আনন্দে হাততালি দেন।
আলোকসজ্জিত রায়বাড়ির সামনে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজাচ্ছে। ব্যান্ডে দেশাত্মবোধক সংগীতের সুর।
দোতলার বারান্দায় লোকের ভিড়।
আলোকসজ্জিত রায়বাড়ির দোতলার বারান্দা ফাঁকা। লোক নেই নিচেও। দুর্গাবাঈয়ের গান ভেসে আসে।
জলসাঘরে ঝুলছে ঝাড়বাতি।
নিচে ফরাসপাতা মেঝেতে বসে দুর্গাবাঈ গাইছেন, আয়না দিয়ে দেখা যায়। বিশ্বম্ভর ও অন্যান্য অতিথিরা তাঁর গান শুনছেন তন্ময় হয়ে। পিলু রাগে ঠুংরি গাইছেন দুর্গাবাঈ—
ভর ভর আঈ মেরি আঁখিয়া পিয়া বিন
ঘিরি ঘিরি আঈ কারি বদরিয়া,
বিশ্বম্ভর ও অন্যান্য অতিথিরা তন্ময় হয়ে গান শুনছেন। দুর্গাবাঈ গেয়ে চলেছেন—
ক্যাসে কহু মিঠি বাতিয়াঁ।
সজিয়া সুনি রয়ন আঁধেরি,
ধড়কন লাগি মেরি ছাতিয়াঁ।।
বিশ্বম্ভরের শোবার ঘর।
বড়ো টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। খাটে বসে সেলাই করছেন বিশ্বম্ভরের স্ত্রী মহামায়া। তাঁর চোখে জল। দূর থেকে ভেসে আসে ঘড়িতে তিনটে বাজার শব্দ। বিশ্বম্ভরকে বারান্দা দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তিনি ঘরে ঢুকে দাঁড়ালেন খাটের অন্যদিকে। তাঁর হাতে জড়ানো রয়েছে মালা। বিশ্বম্ভরের আসার শব্দ পেয়ে মহামায়া আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলেন। সেলাইয়ের সরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে তিনি উঠে চলে যান। বিশ্বম্ভর তাঁর দিকে তাকালেন।
বিশ্বম্ভর || কি হল? অভিমান?
বিশ্বম্ভর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বিছানার উপর বসে পড়েন।
বিশ্বম্ভর || সব তো শেষ হয়ে গেছে, গিন্নি।
মহামায়া আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্ব। তিনি বিশ্বম্ভরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকান।
মহামায়া || আমার গয়নাগুলো আছে এখনো?
বিশ্বম্ভর || গহনা? ও হো-হো-হো-হো। সে তো বাঁধা দিয়েছি, ছাড়াতে কতক্ষণ?
আয়নার সামনেই মহামায়া দাঁড়িয়ে আছেন।
মহামায়া || কি করে বলছ তুমি? এবারে কত খরচ হয়েছে তার হিসেব আছে?
বিশ্বম্ভর || খরচ! তা খরচ করব না গিন্নি? খোকা আমার একমাত্র বংশধর, শিবরাত্রির সলতে। তার উপনয়নে খরচ করব না— কী বলছ গিন্নি? নইলে যে মান থাকে না।
মহামায়া || তাই বলে গয়না বাঁধা দিয়ে বাঈজি?
মহামায়া রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে নেন আয়নার দিকে।
বিশ্বম্ভরের চোখে অস্বস্তি ভাব, তিনি চোখ দুটো রগড়ে নেন।
বিশ্বম্ভর || এই বাইজি সেই বাইজি নয় গিন্নি! এর রূপ, এর গানে। আঃ তুমি যদি শুনতে তো বুঝতে—?
মহামায়া || আমার শুনে কাজ নেই।
মহামায়া রাগ করে আয়নার কাছ থেকে সরে যান।
বিশ্বম্ভর || ‘ভর ভর আঈ’ মেরি আঁখিয়া’— হায়-হায়-হায়!
বিশ্বম্ভর মুখ ঘুরিয়ে মহামায়ার দিকে তাকালেন।
বিশ্বম্ভর || যাচ্ছ কোথায়?
মহামায়া দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ান।
মহামায়া || তিনটে বেজে গেছে। আমি খোকার কাছে শোব।
বিশ্বম্ভর || শোনো না।
মহামায়া || কী, বলো।
বিশ্বম্ভর হাত থেকে ফুলের মালাটা খুলে মহামায়ার হাতে দেন।
বিশ্বম্ভর || কিসের ভাবনা এত?
মহামায়া || জলসাঘরটা বন্ধ করে দাও।
বিশ্বম্ভর || কেন? গান শুনবো না।
মহামায়া || ওই তোমার এক সর্বনেশে নেশা। খোকাও তোমার সব গুণগুলো পেয়েছে। পড়াশোনার মন নেই, গান গান করে পাগল। আবার কদিন ধরে আবদার ধরেছে ঘোড়ায় চড়বে।
বিশ্বম্ভর || সে তো ভালো কথা গিন্নি। তুফানের পিঠে সওয়ার হবে, মতির পিঠে চড়ে মৃগয়ায় যাবে— এই না হলে রায়বংশের জমিদার—?
মহামায়া || জমিদার? জমিদারের আর আছে কী? সব তো ভেসে গেছে।
বিশ্বম্ভর মহামায়ার দিকে তাকান।
মহামায়া || নদী কি রকম এগিয়ে আসছে দেখছো না? অমন সুন্দর বাগান বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
বিশ্বম্ভর || বন্যা?
মহামায়া || ভুলে গেছো?
বিশ্বম্ভর বিছানায় শোয়া। তাঁর চোখ আধবোজা।
বিশ্বম্ভর || রায়বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলাম, হাজার লোক আশ্রয় পেয়েছিল। আমার পুণ্যের বোঝাও কিছু কম নয় গিন্নি!
মহামায়া || জানি, তবু ভয় করে— কাল যা দুঃস্বপ্ন দেখেছি—
বিশ্বম্ভর || আর আমি কি দেখেছি জানো? দেবরাজ ইন্দ্রের জলসাঘরে মাইফেল হচ্ছে— রম্ভা গাইছে, উর্বশী নাচছে, আর মেনকা— মেনকা—
কথা শেষ হয় না, বিশ্বম্ভর ঘুমিয়ে পড়েন।
মহামায়া কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
৩
বীরেশ্বর ঘোড়ায় চড়া শিখছে। ঘোড়ার পিঠে বীরেশ্বর, তার গায়ে জরির কাজ করা পাঞ্জাবি, মাথায় জরির টুপি। সহিস লাগাম ধরে ঘোড়াকে হাঁটাচ্ছে।
বীরেশ্বর ঘোড়ার পিঠে, লাগাম ধরে সহিস, এবারে ঘোড়ার চলার ছন্দ একটু দ্রুত।
নদীতে হাতিকে স্নান করাচ্ছে মাহুত। বীরেশ্বর হাসিমুখে হাতির স্নান করানো দেখছে।
হাতি স্নান করতে করতে শুঁড় দিয়ে জল ছুঁড়ে দেয়। বীরেশ্বর তাই দেখে মজা পায়, তার মুখে হাসি।
বীরেশ্বর আর মাহুতকে দেখা যায় হাতির পিঠে চড়ে নদীর চর দিয়ে যেতে।
দূরে রায়বাড়ি।
বিশ্বম্ভর চেয়ারে বসে, তাঁর হাতে গড়গড়ার নল। বিশ্বম্ভরের প্রতিকৃতি আঁকছেন এক চিত্রকর। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকা দেখছে বীরেশ্বর।
বিশ্বম্ভরের শোবার ঘর।
বিশ্বম্ভর এস্রাজ বাজাচ্ছেন। বিছানায় বসে বীরেশ্বর ঝিঁঝিট রাগে স-র-গ-ম সাধছে। তাঁর সামনে খোলা রয়েছে গানের খাতা।
মহামায়া ঘরে ঢুকে খাটের পাশে এসে দাঁড়ান। হাসিমুখে ছেলের গান শুনতে থাকেন।
বীরেশ্বরের গান সাধা শেষ হল।
মহামায়া বীরেশ্বরের দিকে এগিয়ে আসেন।
মহামায়া || খুব হয়েছে, এবার উঠে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে, শুতে যা। বীরেশ্বর হাই তুলে বিছানায় শুড়ে পড়ে।
মহামায়া || একি শুয়ে পড়লি যে? ওঠ! ওঠ-ওঠ, উঠে পড়— যা—
বীরেশ্বর || না—। মা, আমরা নারায়ণপুর যাব না?
মহামায়া || সে হবে ‘খন। তুই এখন যা তো!
বীরেশ্বর খাট থেকে নেমে দরজার কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে এসে বিছানা থেকে গানের খাতাটা নিয়ে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর || কোথায় যাবে?
মহামায়া গ মা চিঠি দিয়েছেন—
বিশ্বম্ভর || অ—। নারায়ণপুর।
মহামায়া || বাবার খুব অসুখ। মা যেতে লিখেছেন।
বিশ্বম্ভর একটা পান মুখে দিয়ে চিবোতে থাকেন।
বিশ্বম্ভর || তা বেশ তো, যাও না।
মহামায়া || ভাবছি খোকাকেও নিয়ে যাবো।
বিশ্বম্ভর || যেও।
মহামায়া || তুমিও যাবে।
বিশ্বম্ভর || আমি কেন?
মহামায়া || তোমায় একা ফেলে রেখে যেতে ভয় করে। কখন যে কি করে বসবে তার ঠিক নেই।
বিশ্বম্ভর স্ত্রীর কথা শুনে হেসে ফেলেন। তিনি এস্রাজের ছড়টা তুলে নিয়ে রজন লাগাতে থাকেন।
মহামায়া || সত্যি বলছি, চলো না গো! তোমার তো হাতে এমন কোনো কাজ নেই, চলো—
বিশ্বম্ভর || কি যে বলছ গিন্নি, জমিদারি সামলাবে কে?
মহামায়া || কি—?
বিশ্বম্ভরের কথা শুনে হেসে ফেলেন মহামায়া।
মহামায়া || কি বললে, তুমি সামলাবে জমিদারি? ঠাট্টা নয়, সত্যি বলছি, চলো না গো! চলো—। বল না, যাবে?
বিশ্বম্ভর ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানান।
মহামায়া || বেশ! তা হলে আমি খোকাকে নিয়ে চলে যাই, কি বলো? যাবো?
বিশ্বম্ভর এস্রাজটা হাতে তুলে নেন।
বিশ্বম্ভর || সে কথা পরে হবে। এখন রসভঙ্গ কোরো না।
মহামায়া || উঁ, ঢঙ দেখে বাঁচি না।
মহামায়া ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
বিশ্বম্ভর আবার এস্রাজে স-র-গ-ম তুলতে শুরু করেন।
.
কুলিদের মাথায় বাক্স, বিছানা প্রভৃতি সরঞ্জাম তোলা হচ্ছে।
বিশ্বম্ভরকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
বীরেশ্বর ঘরে ঢোকে। তার হাতে চাবুক। সে ঘরে ঢুকে বিশ্বম্ভরকে প্রণাম করে।
বীরেশ্বর || বাবা—
বিশ্বম্ভর || আয়!
বীরেশ্বর || যাচ্ছি—
বিশ্বম্ভর || যাচ্ছি বলতে নেই, বলতে হয় আসি।
বীরেশ্বর ছুটে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলেন—
বিশ্বম্ভর || লক্ষ্মী হয়ে থেকো, দুষ্টুমি কোরো না।
বীরেশ্বর বারান্দা দিয়ে ছুটে চলে যায়।
মহামায়াকে আসতে দেখা যায়। কাছে এসে তিনি বিশ্বম্ভরকে প্রণাম করে স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকান।
মহামায়া || আসি?
বিশ্বম্ভর || এসো।
মহামায়া দরজার কাছাকাছি গিয়ে আবার বিশ্বম্ভরের কাছে ফিরে আসেন।
মহামায়া || দুষ্টুমি কোরো না।
বিশ্বম্ভরের মুখে মৃদু হাসি।
চরের রাস্তা।
পাইক পেয়াদা নিয়ে মহামায়ার পালকি চলেছে।
বীরেশ্বরকে দেখা যায় ঘোড়ার পিঠে করে পালকির পিছনে পিছনে যেতে।
বিশ্বম্ভর বাড়ি থেকে তাঁদের যাওয়া দেখছেন।
৪
রায়বাড়ি। সময় সন্ধে।
শোনা যায় সুরবাহারের আওয়াজ।
রায়বাড়ির দোতলার বারান্দা।
ওস্তাদজি সুরবাহার বাজাচ্ছেন।
সামান্য দূরে বসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বিশ্বম্ভর তন্ময় হয়ে বাজনা শুনছেন।
তাঁর হাতে গড়গড়ার নল।
ওস্তাদজিকে সুরবাহার বাজাতে দেখা যায়।
গড়গড়া টানতে টানতে বাজনা শুনছেন বিশ্বম্ভর। একবার মুখ তুলে ওস্তাদজির দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে তৃপ্তির আভাস।
বিশ্বম্ভর || আহা!
হঠাৎই কোনো কিছুর আওয়াজ শুনে বিরক্ত হন বিশ্বম্ভর। ডাক দেন তিনি।
বিশ্বম্ভর || অনন্ত?
বাজনা বন্ধ করে দেন ওস্তাদজি। হাত তুলে কুর্নিশ করেন বিশ্বম্ভরকে। পর্দা সরিয়ে অনন্ত ঘরে ঢোকে।
বিশ্বম্ভর || কিসের আওয়াজ হচ্ছে দেখ তো?
অনন্ত || ইলেকট্রিকের কল বসিয়েছে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || ইলেকট্রিকের কল?
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কে বসিয়েছে? কোথায়?
অনন্ত || গাঙ্গুলিবাবুদের নতুন বাড়িতে, হুজুর। ছাদে উঠলে আলোর রোশনি দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর গ মহিমের বাড়ি?
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
উত্তর শুনে গম্ভীর হয়ে যান বিশ্বম্ভর। তাঁর চোখে ভ্রূকুটি। গড়গড়ার নলটা তুলে মুখে দেন তিনি।
ডায়নামোর শব্দ ভেসে আসে।
অনন্ত || আবার শুনছি, কলকাতার সাহেবদের দোকান থেকে তেনার সব আসবাবপত্তর আসছে।
ওস্তাদজি বাজনা থামিয়ে বসেছিলেন।
ওস্তাদজি || হুজুর কো হুকুম হো তো বাজাউঁ, ইয়া বাস করু?
বিশ্বম্ভর চেয়ার থেকে উঠে চলে যান।
ডায়নামোর শব্দটা আরও জোরে শোনা যায়।
.
রায়বাড়ির ছাদ। সময় সন্ধে।
দূর থেকে ভেসে আসছে ডায়নামোর শব্দ।
ছাদের ছোটো ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় বিশ্বম্ভরকে।
আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে সেটা জানতে তিনি এগিয়ে যান ছাদের রেলিংয়ের ধারে।
বিশ্বম্ভর বুঝতে পারেন আওয়াজটা আসছে মহিমের বাড়ি থেকে।
দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মহিমের বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি। বিশ্বম্ভরের চোখে ভ্রূকুটি। মুখ ঘুরিয়ে তিনি নিজের বাড়ির বারান্দার দিকে চোখ রাখলেন। দেখা যায় অনন্তকে বাতি হাতে দোতলার বারান্দা দিয়ে চলে যেতে। বিশ্বম্ভর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে নেন।
.
চরের রাস্তা দিয়ে পরপর চারখানা গোরুর গাড়ি যাচ্ছে। গাড়িতে আসবাবপত্র বোঝাই। দূরে দেখা যায় রায়বাড়ি।
.
বিশ্বম্ভর দোতলার বারান্দা থেকে গোরুর গাড়িগুলোকে দেখছেন।
মহিমের বাড়িতে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। আকাশে বাজির ফুলকিগুলো নিচের দিকে মুখ করে ছিটকে পড়ে।
বিশ্বম্ভর শোবার ঘরের জানলা থেকে বাজি পোড়ানো দেখছেন। জানলা থেকে সরে এসে তাঁকে টেবিলের সামনে দাঁড়াতে দেখা যায়। এতক্ষণে বোঝা যায় ঘরে অনন্তও আছে, সে বিছানা করছে। বিশ্বম্ভর টেবিল থেকে মদের গ্লাসটা হাতে তুলে নেন।
বিশ্বম্ভর || গাঙ্গুলিদের নতুন বাড়ি তুই দেখেছিস নাকি রে?
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কেমন দেখলি? কেমন বাড়ি?
অনন্ত || হালফ্যাশানের বাড়ি, হুজুর। আমাদের রাজবাড়ির মতো শোভা নেই। নহবৎখানা নেই, ফোয়ারা নেই, বাগান নেই, নাটমন্দির নেই— এই যেমন ধারা হয় আর কি!
বিশ্বম্ভর মদের গ্লাস হাতে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে চলে আসেন ঘরের মধ্যে। ভেসে আসে ডায়নামোর শব্দ।
৫
জনৈক ঘোষক ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করে—
ঘোষক || আসছে সোমবার গাঙ্গুলিবাবুদের নতুন বাড়িতে কাঙালি ভোজন হবে—
বিশ্বম্ভর সেরেস্তায় বসে আছেন অন্যমনস্কভাবে।
দূর থেকে অস্পষ্ট ঢ্যাঁড়ার শব্দ ভেসে আসে।
শোনা যায় তারাপ্রসন্নর ডাক— ‘হুজুর!’
শুনে চমকে ওঠেন বিশ্বম্ভর।
তারাপ্রসন্ন || মহিম একবার দেখা করতে এয়েছে— মহিম গাঙ্গুলি।
বিশ্বম্ভর || নিয়ে এসো।
বিশ্বম্ভর প্যাঁসনে চশমাটা চোখে দিয়ে কাগজপত্র দেখতে থাকেন।
সেরেস্তার দরজা দিয়ে মহিমকে নিয়ে ঘরে ঢোকেন তারাপ্রসন্ন। দূরে অফিসঘরে কয়েকজনকে কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় তক্তপোষের উপর বসে থাকতে।
বিশ্বম্ভর || এসো হে মহিম।
মহিম এগিয়ে এসে প্রণাম করে বিশ্বম্ভরকে।
বিশ্বম্ভর || থাক— থাক।
মহিম প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে ইতস্তত ভাব।
মহিম || একবার অনুগ্রহ করে আমার ওখানে যে একটু পায়ের ধুলো দিতে হবে, হুজুর।
বিশ্বম্ভর কোনো উত্তর না দিয়ে কাগজপত্র দেখায় মনোযোগী হয়ে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাকান।
বিশ্বম্ভর || অ্যাঁ—?
মহিম || বলছিলুম কি, আমার ওখানে একবার পায়ের ধুলো দিতে হবে—
বিশ্বম্ভর || কেন হে? কী ব্যাপার?
মহিম || আপনাদের আশীর্বাদে একখানা বাড়ি করেছি। আগামী সোমবার পয়লা বৈশেখ গৃহপ্রবেশ—
বিশ্বম্ভর একটু ভেবে নিয়ে বলেন—
বিশ্বম্ভর || পয়লা বৈশাখ— পয়লা বৈশাখ আমার এই পুরোনো বাড়িতেই যে উৎসব হে!
মহিম একটু অবাক হয়।
মহিম || পয়লা?
বিশ্বম্ভর || হ্যাঁ, পুণ্যাহ।
মহিম || পুণ্যাহ?
বিশ্বম্ভর || হ্যাঁ।
মহিম || কই আমি তো— তেমন কিছু—
বিশ্বম্ভর || তা তুমি যদি বলো, তো না হয় আমার কাজটা পেছিয়ে দিই—
বিশ্বম্ভর মহিমের দিকে তাকিয়ে গড়গড়ায় টান দিতে থাকেন।
মহিম কথাটা শুনে কি বলবে ভেবে পায় না।
দূর থেকে ঢ্যাঁড়ার আওয়াজ আর ঘোষণা ভেসে আসে।
বিশ্বম্ভর || তাতে কি তোমার বিশেষ সুবিধা হবে?
মহিম || না, না, এটা কি একটা কথা হোল। আপনি হলেন রাজা, আর আমরা— না, না, আপনার কাজ সকলের আগে।
বিশ্বম্ভর || তা কি করা যায় বলো? আমার তো এদিকে সব ব্যবস্থা তৈরি।
কথাটা বলেই বিশ্বম্ভর তারাপ্রসন্নর দিকে তাকান। মহিম অবাক হয়ে তারাপ্রসন্ন ও বিশ্বম্ভরের দিকে দৃষ্টি দেয়।
মহিম || আচ্ছা দেখি, আমি কি করতে পারি? তাহলে এখন আমি চলি।
মহিম বিশ্বম্ভরকে প্রণাম করে।
বিশ্বম্ভর || এসো এসো— থাক।
মহিম দরজার দিকে পা বাড়ায়।
বিশ্বম্ভর চশমা খুলে মহিমের চলে যাওয়া লক্ষ করেন। পরে তারাপ্রসন্নর দিকে দেখেন।
বিশ্বম্ভর || শুনলে তো—
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || গহনা আর আছে?
তারাপ্রসন্ন || আর এক সিন্দুক আছে, হুজুর। এই শেষ।
বিশ্বম্ভর এতক্ষণ হেলান দিয়েছিলেন। তারাপ্রসন্নর কথা শুনে উঠে বসেন।
বিশ্বম্ভর || শেষ?
বিশ্বম্ভর উঠে দাঁড়ান। তাঁর মাথার কাছে পূর্বপুরুষের ছবি।
বিশ্বম্ভর || ‘শেষ’ কথাটা তুমি এত সহজে উচ্চারণ করলে কি করে তারাপ্রসন্ন? শেষ নেই—
বিশ্বম্ভর দরজার দিকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে তারাপ্রসন্নর দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
বিশ্বম্ভর || সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলো, যেন কোনো কার্পণ্য না হয়।
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || আর সেই বুড়ো মুসলমান ওস্তাদ, কি নাম যেন? মুর্শিদাবাদে থাকেন—
তারাপ্রসন্ন || উজির খাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || হ্যাঁ, তাঁকে খবর দিয়ে আনাও। জলসা হবে।
বিশ্বম্ভর ঘুরে তাকালেন।
তারাপ্রসন্ন ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করেছেন উলটোদিকে।
বিশ্বম্ভর || আর শোনো—
তারাপ্রসন্ন ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন।
বিশ্বম্ভর || নারায়ণপুরে লোক পাঠাও। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি— যেন রানিমা আর খোকা পয়লা বৈশাখ সকালবেলায় এখানে এসে পৌঁছে যান। যাও।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে, হুজুর।
দরজার দিকে এগিয়ে যান।
বিশ্বম্ভর ‘হাঃ হাঃ’ করে হাসতে হাসতে খাটের উপর বসে পড়েন। তার হাসির শব্দের মধ্যেই শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ।
৬
নাটমন্দিরের সামনে ঢাকিরা ঢাক বাজাচ্ছে। পুণ্যাহের বাজনা।
পুণ্যাহ উৎসব উপলক্ষে টাকায় সিঁদুর মাখিয়ে খাতায় ছাপ দেওয়া হল। পরে রাখা হল ধানদুর্বা। খাতায় লেখা হল— শুভ পুণ্যাহ।
বিশ্বম্ভরকে উদবিগ্ন হয়ে তাঁর শোবার ঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারাপ্রসন্নর গলা শোনা যায়।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর!
বিশ্বম্ভর ফিরে তাকান।
তারাপ্রসন্ন || পুণ্যাহের সব আয়োজন হয়ে গেছে, হুজুর। প্রজারা সব আসতে আরম্ভ করেছে।
বিশ্বম্ভর জানলার কাছ থেকে ধীরে ধীরে তারাপ্রসন্নর দিকে এগিয়ে আসেন।
তারাপ্রসন্ন খাটের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন।
বিশ্বম্ভর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তারাপ্রসন্নর দিকে তাকান।
তারাপ্রসন্ন || বজরা এখনো ফেরে নি।
বিশ্বম্ভরের মুখে কোনো কথা নেই।
তারাপ্রসন্ন || দুটো ছিপ পাঠিয়ে দেব? বৈশাখ মাস…
বিশ্বম্ভর || দাও। আর আমি এখুনি আসছি, তুমি যাও।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে, হুজুর।
তারাপ্রসন্ন চলে যান।
বিশ্বম্ভর পায়চারি শুরু করেন। ধীরে ধীরে আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ান।
তাঁর মুখে উদবিগ্ন ভাব।
.
দূরে দেখা যায় নদী আর চর। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। শোনা যায় ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ।
বিশ্বম্ভর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
হাওয়ায় পর্দাগুলোকে দুলতে দেখা যায়। হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে বিশ্বম্ভর পিছন ফিরে তাকান। হাতির দাঁতের তৈরি বজরাটা উলটে পড়ে আছে। বিশ্বম্ভর সেটা তুলে যথাস্থানে রেখে দেন। তাঁকে চিন্তিত দেখায়।
.
নহবৎখানায় বসে সানাইবাদকদের সানাই বাজাতে দেখা যায়।
রায়বাড়ির সামনে কাঙালি ভোজন হচ্ছে।
.
ওস্তাদ উজির খাঁ সাহেব গাইছেন মিঞা-কি-মলহার। আশেপাশে অতিথি অভ্যাগতগণ বসে গান শুনছেন।
যন্ত্রীদেরও দেখা যায়। ওস্তাদ গাইছেন—
জলরস বুঁদন বরসে
পিয়া মিলনকো জিয়ারা তরসে।
ইঁউ ইঁউ আওয়তঁ ঘোর বদরিয়া,
মেরি আখিয়াঁ বরসে।।
দোতলা বারান্দায় বেশ উদবিগ্ন মুখে পায়চারি করতে দেখা যায় বিশ্বম্ভরকে।
ঝাড়বাতি, দেওয়ালগিরি সব জ্বলছে।
বিশ্বম্ভর একবার চরের দিকে উদবিগ্ন হয়ে তাকালেন।
উজির খাঁ-র গান ভেসে আসছে।
.
চরের দৃশ্য। সময় রাত্রি।
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। থমথমে ভাব। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকে উঠেছে।
বিশ্বম্ভর দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।
ভেসে আসছে জলসার গান।
৭
জলসাঘরে গান গাইছেন ওস্তাদজি।
অতিথি অভ্যাগতগণ গান শুনছেন।
তন্ময় হয়ে গান গাইছেন ওস্তাদজি।
বিশ্বম্ভরকে জলসাঘরে ঢুকতে দেখা যায়। তাঁকে দেখে অনন্ত সেলাম করে।
অনন্তর পরনে খানসামার পোশাক। কয়েকজন অতিথিও অভিবাদন জানান।
তিনি অভিবাদন গ্রহণ করে আসনে গিয়ে বসেন।
ওস্তাদজি গাইছেন। তাঁর পাশে বসে আছেন যন্ত্রীরা।
গান শুনে সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী তারিফ করে ওঠেন— বাঃ! বেশ, বেশ!
বিশ্বম্ভর মশগুল হয়ে গান শুনছেন। তাঁর মুখে গড়গড়ার নল। কিছুক্ষণ পর তাঁকে গ্লাসে মদ ঢালতে দেখা যায়।
ওস্তাদজি গান গাইছেন।
শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রশংসা শোনা যায়।
বিশ্বম্ভর মদের গ্লাসে মুখ দিতে যাবেন, এমন সময় তাঁর চোখে পড়ে জলসাঘরের জানলা। সেখান দিয়ে বাইরের বিদ্যুৎ চমকানো দেখা যায়। তিনি চিন্তিত মুখে গ্লাসটা নামিয়ে রাখেন। গড়গড়ার নলটা তুলে নেন হাতে। মনোযোগী হবার চেষ্টা করেন গানে।
সম্পূর্ণ জলসাঘর দেখা যায়। ওস্তাদজি গান গাইছেন।
বিশ্বম্ভর চেষ্টা করেও গানে মন বসাতে পারেন না।
তাঁর চোখ চলে যায় উপরের দিকে।
হাওয়ায় ঝাড়বাতিটা দুলছে।
বিশ্বম্ভর চোখ নামিয়ে নেন। গানে মন বসাবার চেষ্টা করেন।
ওস্তাদজিকে গাইতে দেখা যায়। যন্ত্রীরা পাশে বসে সঙ্গত করে যাচ্ছেন।
বিশ্বম্ভর গড়গড়ার নলটা মুখে দিতে যান। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে মদের গ্লাসে।
গ্লাসের মদে একটা পোকা। পোকাটা পাখার ঝাপট দিয়ে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।
বিশ্বম্ভর পোকাটাকে দেখে একটু আতঙ্কিত হন। কিছুক্ষণ পোকাটার দিকে তাকিয়ে আবার গানে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করেন।
ওস্তাদজি গাইছেন, এবার দ্রুতলয়ে।
বিশ্বম্ভরের দৃষ্টি আবার গ্লাসের দিকে। পোকাটা মৃত। নিষ্পন্দ হয়ে গ্লাসের মদে ভেসে আছে।
বিশ্বম্ভর চোখ তুলে ওস্তাদজির দিকে তাকালেন। তাঁর মুখ-চোখে আতঙ্কের ভাব।
ওস্তাদজি দ্রুতলয়ে গাইছেন। পাশের যন্ত্রীরা সংগত করে যাচ্ছেন।
বিশ্বম্ভর ও অন্যান্য অতিথিদের দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর হাতে জড়ানো মালাটা খুলে রেখে আসন ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যান।
অন্যান্য অতিথিরা তন্ময় হয়ে গান শুনছেন।
বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে।
বিশ্বম্ভর সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ান।
.
কিছুক্ষণ ভেবে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যান।
রায়বাড়ি।
বাড়ির সামনে ফোয়ারা। দূরে দেখা যাচ্ছে নদীর চর।
তারাপ্রসন্নকে পথ দিয়ে আসতে দেখা যায়। তাঁর চোখ-মুখে শোকের চিহ্ন।
বিশ্বম্ভর তারাপ্রসন্নকে দেখতে পান। তারাপ্রসন্নর মুখ-চোখে তাঁর চাহনিতে আশঙ্কা ফুটে ওঠে।
বিশ্বম্ভর || বজরা ফিরেছে?
তারাপ্রসন্ন নিরুত্তর। তাঁর চোখ-মুখে শোকের চিহ্ন স্পষ্ট। বিশ্বম্ভর আবার জিজ্ঞাসা করেন—
বিশ্বম্ভর || কি হল?
তারাপ্রসন্ন || ঘূর্ণিতে পড়েছিল, হুজুর!
বিশ্বম্ভর || (ভয়ে চিৎকার করে) কী বললে? ঘূর্ণিতে পড়েছিল? কে বললে তোমায়?
তারাপ্রসন্ন || কালী ফিরেছে হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কালী? আর কেউ? আর কেউ? চুপ করে আছ কেন? বল না, আর কেউ ফিরেছে কি না?
তারাপ্রসন্ন || ছোটো রাজকুমার।
বিশ্বম্ভর || খোকা ফিরেছে। খোকা, খোকা—
বিশ্বম্ভর প্রায় পাগলের মতো ছুটে এগিয়ে যান। কিছুটা এগিয়ে এসে তিনি থমকে দাঁড়ান। তাঁর চোখে ভয় ও বিস্ময় মাখানো।
কালী বাগদি দাঁড়িয়ে আছে দু-হাতে মৃত বীরেশ্বরকে ধরে।
বিশ্বম্ভর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন। তিনি হতবাক। পরে দ্রুত এগিয়ে আসেন।
বিশ্বম্ভর || খোকা! খোকা! খোকা!
বিশ্বম্ভরের গলার আওয়াজে ক্রন্দন মিশে যায়। তিনি কালীর হাত থেকে বীরেশ্বরের মৃতদেহ নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
কালীও আর পারে না, অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
বিশ্বম্ভর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
৮
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।
রায়বাড়ির সামনের ফোয়ারায় তিনটে নারী মূর্তি দেখা যায়। বৃষ্টির জলে উপছে পড়ছে ফোয়ারার পাত্র। জল পড়ছে মূর্তির চিবুক বেয়ে।
রায়বাড়ির সামনে দেখা যায় নদীর জল এগিয়ে এসেছে।
.
বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায় নদীর চর অদৃশ্য, সেখানেও জল।
নহবৎখানার সামনে যে চর ছিল, জল সেখানেও।
.
বিশ্বম্ভরের শোবার ঘর।
বিশ্বম্ভর চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর চেহারার মধ্যে হতাশা ও বিষাদ প্রকাশ পাচ্ছে।
বিশ্বম্ভরের পিছনের দেওয়ালে জলের ছায়া।
তারাপ্রসন্নকে ঘরে ঢুকতে দেখা যায়।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর!
বিশ্বম্ভর নিরুত্তর। তারাপ্রসন্ন আবার ডাকেন।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর!
বিশ্বম্ভর || কে?
তারাপ্রসন্ন || আমি তারাপ্রসন্ন, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || তুমি আছো এখনো?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর!
বিশ্বম্ভর || কেন?
তারাপ্রসন্ন || সবাই গেলে চলবে কি করে, হুজুর!
বিশ্বম্ভর || না-ই বা চলল। সবই তো গেছে।
তারাপ্রসন্ন || সব যেত না হুজুর, আপনি যদি একটু নজর দিতেন তাহলে জমিদারি—
বিশ্বম্ভর || জমি—? কোথায় জমি? সবই তো জল। সব অতলে তলিয়ে গেছে। সব ভেসে গেছে, সব ভেসে গেছে।
তারাপ্রসন্ন || হুজুর, প্রিভি কাউন্সিলের রায় বেরিয়েছে, দেবোত্তর ছাড়া আর সবই গেছে, আপনি যদি একবারটি নিচে আসতেন, হুজুর। জিনিসপত্র সব নিলাম হবে—।
বিশ্বম্ভর || না, আমাকে আর ডেকো না। আমি নিচে যাব না।
তারাপ্রসন্ন খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
বিশ্বম্ভর || তুমি যা ভালো বোঝো, তাই করো।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে, হুজুর!
তারাপ্রসন্ন চলে যেতে উদ্যত হয়। বিশ্বম্ভর ডাকেন তাঁকে।
বিশ্বম্ভর || শোনো। মতি আর তুফান গেছে, না আছে?
তারাপ্রসন্ন || আছে হুজুর। সুন্দর রাজবাড়ি থেকে লোক এসেছিল। দর দিয়ে গেছে। কিন্তু, আপনার হুকুম ছাড়া তো কিছু বলতে পারি না—
বিশ্বম্ভর || ওরা যাবে না, থাকবে। খোকার বড়ো প্রিয় ছিল।
তারাপ্রসন্ন || যে আজ্ঞে, হুজুর। ওস্তাদজি নিচে রয়েছেন, তাঁকে পাঠিয়ে দেব? গান বাজনা শুনবেন?
বিশ্বম্ভর || না, ওকে যেতে বলো। সংগীতের আর প্রয়োজন নেই।
বিশ্বম্ভর মুখটা ঘুরিয়ে নেন।
ফ্ল্যাশ ব্যাক শেষ হয়।
রায়বাড়ির ছাদে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন বিশ্বম্ভর।
অনন্তর ডাক শোনা যায়।
অনন্ত || হুজুর!
বিশ্বম্ভর আনমনে বসে ছিলেন। অনন্তর ডাক তাঁর কানে যায়।
বিশ্বম্ভর || উঁ!
অনন্তকে দেখা যায় দাঁড়িয়ে থাকতে।
বিশ্বম্ভর আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান।
অনন্ত || সরবতটা খান নি হুজুর?
বিশ্বম্ভর অনন্তকে উদ্দেশ করে বলেন—
বিশ্বম্ভর || আজ একবার নিচে যাবো।
কথা শুনে অনন্ত বিস্ময় বোধ করে।
অনন্ত || নিচে?
বিশ্বম্ভর || তুফানকে দেখবো। মতিকে দেখবো।
অনন্ত || এক্ষুনি যাবেন, হুজুর?
বিশ্বম্ভর || তুই একবার খবর দিগে যা।
অনন্ত ছুটে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে আসেন।
রায়বাড়ির একতলার ভিতরের থামওয়ালা বারান্দা। একটা কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। অনন্ত ছুটে যেতে যেতে কুকুরটাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বম্ভরকে দেখা যায়। বারান্দা দিয়ে আসতে আসতে দাঁড়িয়ে যান। চারিদিকে তাকালেন একবার। আবার লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে যান। আবার একবার দাঁড়িয়ে পড়েন। নাটমন্দিরটাকে লক্ষ করেন। এগিয়ে যান আবার।
.
রায়বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণ।
ফোয়ারাটা দেখা যাচ্ছে।
সদর দরজা দিয়ে বিশ্বম্ভরকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর এগিয়ে আসেন।
অনন্তকে সরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সহিস রহমতের সেলাম শোনা যায়।
রহমৎ || সালাম হুজুর।
বিশ্বম্ভর হাসি মুখে প্রত্যুত্তর দিয়ে এগিয়ে আসেন।
সহিস রহমৎকে দেখা যায়। পাশে ঘোড়া, তুফান।
বিশ্বম্ভর || তুফান, ভালো আছিস?
ঘোড়াটা মুখ ঘুরিয়ে বিশ্বম্ভরের দিকে তাকায়।
রহমৎ || হুজুর, ঘোড়েকে তবিয়ৎ খারাপ নেহি, বহৎ রোজ সে আপকো সোয়ারি নেহি মিলা, ইস লিয়ে দিল খারাপ।
বিশ্বম্ভর || দানা ঠিক পাচ্ছে তো?
তারাপ্রসন্ন || জী হাঁ, হুজুর।
অনন্ত কিছুক্ষণ হাসিমুখে তাকিয়ে ছুটে চলে যায়। বিশ্বম্ভর অনন্তকে অনুসরণ করেন।
.
রায়বাড়ির সামনের ভাঙা গেট।
অনন্ত ছুটে এগিয়ে যায়। তার পিছনে বিশ্বম্ভর লাঠিতে ভর দিয়ে অনন্তকে অনুসরণ করেন।
অনন্ত চরের পথ দিয়ে নেমে যায়।
বিশ্বম্ভরও সেই পথ দিয়ে নেমে যান।
বিশ্বম্ভর চরে নেমে দাঁড়িয়ে যান।
দূরে, চরে দেখা যায় হাতিকে।
বিশ্বম্ভর হাসিমুখে হাতিটার দিকে চেয়ে থাকেন।
অনন্তরও দৃষ্টি হাতিটার দিকে।
এমন সময় শোনা যায় লরির গর্জন।
একটা লরিকে দেখা যায় চরের রাস্তা দিয়ে যেতে।
লরির গায়ে লেখা Ganguli & Co.
লরিটা ধুলো উড়িয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বম্ভর হাতি আর লরি দুটোই দেখছেন।
ধুলো হাতিটাকে ছেয়ে ফেলে।
বিশ্বম্ভর মুখটাকে ঘুরিয়ে নেন।
বিশ্বম্ভর || ছোটো গিন্নির জাজিম-টাজিমগুলো সব আছে তো?
অনন্ত || আহম্মদকে শুধুচ্ছি হুজুর!
বিশ্বম্ভর || তাকে বলো, ছোটো গিন্নিকে খুব ভালো করে সাজিয়ে দিতে। গাঙ্গুলি বাড়িতে যাবে।
অনন্ত || যে আজ্ঞে, হুজুর!
অনন্ত ছুটে চলে যায়। বিশ্বম্ভর আবার অনন্তকে ডেকে বললেন—
বিশ্বম্ভর || আর নায়েবকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।
একটা হাত এসে চাবি দিয়ে সিন্দুকের দরজা খোলে। বোঝা যায় হাতটা বিশ্বম্ভরের। সিন্দুকের ভেতর থেকে তিনি একটা থলি বার করেন। থলিতে মোহরের আওয়াজ। তা থেকে একটা মোহর বার করে এগিয়ে দেন।
মোহরটা তিনি তারাপ্রসন্নর হাতে দিয়ে থলিটা রেখে দেন সিন্দুকে।
বিশ্বম্ভর || মতিকে সাজাতে বলেছি। একখানা চাঁদির রেকাবির ওপর মোহরখানা রেখে মহিমের বাড়ি দিয়ে এসো। আগে যেমন দিয়ে আসতে।
বিশ্বম্ভর চাবি দিয়ে সিন্দুকটা বন্ধ করে দেন।
তারাপ্রসন্ন তখনো দাঁড়িয়ে আছেন।
বিশ্বম্ভর তাঁর দিকে তাকান, মুখে বিরক্তির চিহ্ন।
বিশ্বম্ভর || দাঁড়িয়ে কেন?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে চাঁদির রেকাবি নেই হুজুর।
কথা শুনে বিশ্বম্ভর সামান্য চমকে ওঠেন।
বিশ্বম্ভর || কাঁসার আছে তো?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে, তা আছে।
বিশ্বম্ভর || তাই নিয়ে যাও।
তারাপ্রসন্ন চলে যান।
ব্যথিত মুখে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসেন বিশ্বম্ভর।
হঠাৎ তাঁর কানে আসে ইংরেজি ব্যান্ডের আওয়াজ। বোঝা যায় আওয়াজটা আসছে মহিমের বাড়ি থেকে। তিনি বিরক্ত সেই আওয়াজে। প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে তিনি কানে হাত চাপা দেন। বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ডাক দেন—
বিশ্বম্ভর || অনন্ত।
অনন্তর গলা শোনা যায়।
অনন্ত || হুজুর!
বিশ্বম্ভর || জানলাগুলো সব বন্ধ করে দে।
রায়বাড়ির দেউরির সামনে সুসজ্জিত হাতি হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
তারাপ্রসন্ন হাতির পিঠে উঠে বসেন।
হাতি দাঁড়িয়ে উঠতে থাকে। শোনা যায় হাতির গলার ঘণ্টার আওয়াজ।
রায়বাড়ির সামনে দিয়ে হাতিকে চলে যেতে দেখা যায়। হাতির পিঠে মাহুত, আহাম্মদ আর তারাপ্রসন্ন। তারাপ্রসন্ন মাথায় ছাতাটা খুলে ধরেন। হাতিটা এগিয়ে চলে।
তার চলার ছন্দে ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়।
.
বিশ্বম্ভর প্যাঁসনে চশমা পরে শোবার ঘরে চেয়ারে বসে বই পড়ছেন।
তাঁর কানে আসে হাতির ঘণ্টার শব্দ।
তিনি হাসিমুখে জানলার দিকে তাকান। কিছুক্ষণ সেই শব্দ শুনে আবার বই পড়ার দিকে মন দেন।
৯
রায়বাড়ির ভেতরে একতলার বারান্দা।
অনন্তকে দেখা যায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। তার হাতে ডাব আর কাটারি।
মুখে শ্যামাসংগীতের সুর।
অনন্তকে ডাব কাটতে দেখা যায়।
হঠাৎ শোনা যায় মোটরের আওয়াজ।
বারান্দায় শুয়ে থাকা কুকুরটা মোটরের আওয়াজে চমকে উঠে পড়ে।
অনন্ত আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়।
রায়বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণ।
দেখা যায় মহিমের মোটরগাড়িটা আসছে।
সদর দরজা দিয়ে অনন্ত উঁকি মেরে গাড়িটা আসতে দেখে। তারপর ভেতরে চলে যায়।
দেউড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামে। মহিম গাড়ি থেকে মুখ বার করে হাঁক দেয়।
মহিম || দারোয়ান! দারোয়ান!
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মহিম গাড়ি থেকে নেমে আসে। তার হাতে সিগারেট। শোনা যায় ইংরেজি ব্যান্ডের শব্দ।
মহিম || বেয়ারা! দারোয়ান!
সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়।
দেউড়ির সামনের বারান্দা।
তারাপ্রসন্ন সেরেস্তা-ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। মহিম তাঁকে দেখতে পায়।
মহিম || এই যে!
তারাপ্রসন্ন মহিমের দিকে এগিয়ে যান।
মহিম || লোকজন কি সব বিদায় করিয়ে দিয়েছেন না কি? বলি এত্তেলা পাঠাবার দু-একজন লোক আছে তো? না, তাও গেছে?
তারাপ্রসন্ন || এত্তেলা?
মহিম || হ্যাঁ, একবার দেখা করবো যে!
তারাপ্রসন্ন || প্রয়োজন?
মহিম || সেটা না হয় তাঁর কাছেই বলবো। আপনি খবরটা পাঠিয়ে দিন।
তারাপ্রসন্ন মহিমের দিকে তাকান। তাঁর চোখে ভ্রূকুটি। তারাপ্রসন্ন খবর দিতে যান বিশ্বম্ভরকে।
যেতে গিয়ে বারান্দার বেঞ্চটা পরনের কাপড়ের কোঁচা দিয়ে ঝেড়ে দেন।
তারাপ্রসন্ন || বোসো।
মহিম এক টিপ নস্যি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে।
তারাপ্রসন্নকে চলে যেতে দেখা যায়।
মহিম চারিদিক দেখতে থাকে। তার মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। তার নজর পড়ে ওপরের দিকে।
থামের কার্নিশে দুটো পায়রা বসে আছে।
মহিম পায়রা দেখে একটু সরে দাঁড়ায়।
তারাপ্রসন্নকে ফিরে আসতে দেখা যায়।
তারাপ্রসন্নকে দেখে মহিমের তাচ্ছিল্য ভাবটা আরও প্রকট হয়।
তারাপ্রসন্ন || একটু অপেক্ষা করতে হবে।
মহিম || কি ছিল এই রায়বাড়ি, আর কি ছিরিই না হয়েছে।
তারাপ্রসন্ন বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেন।
মহিম || কিন্তু, হলে কি হবে, ও হাতি মরেও লাখ টাকা— কি বলেন নায়েব মশাই— অ্যাঁ।
সামনে তারাপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে, মহিমকে দেখা যায় সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে।
মহিম || হেঁ হেঁ হেঁ—! আজ সকালে যখন আপনি আপনাদের ওই বুড়ো হাতিটা চড়ে গেলেন আমাদের বাড়িতে, রাস্তার সব লোকেরা সেলাম ঠুকলো তো— কিন্তু, আমার এই নতুন গাড়িটার কি করল জানেন? ঢিল মেরে মাডগার্ডের রং চটিয়ে দিলে। বেটাদের রকম দেখেছেন? আমি নিজে গাড়িতে বসে—
অনন্ত আসে।
অনন্ত || আপনাকে হুজুর ডাকছেন।
অনন্ত খবর দিয়েই চলে যায়। মহিম তার বলা থামায় না।
মহিম || কিন্তু এসব কেন জানেন, আমি self-made man, no pedigree– হাঃ হাঃ হাঃ
মহিম হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়।
দোতলা বারান্দায় বিশ্বম্ভর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছেন। মুছতে মুছতে একবার পাশে তাকালেন। মহিমকে আসতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর বসে আছেন। মহিম এগিয়ে আসে।
মহিম || কই ঠাকুরদা, আপনি তো এলেন না খেতে?
মহিম প্রণাম করে বিশ্বম্ভরকে।
বিশ্বম্ভর || আর ভাই— বসো বসো।
মহিম সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
মহিম || অবিশ্যি আমারই কসুর হয়ে গেছে। নানান ঝঞ্ঝাটে আমি আর নিজে এসে বলতে পারি নি।
বিশ্বম্ভর || না ব্যাপারটা কি জানো, বুড়ো বয়সে নিয়মের ব্যতিক্রম হলে আর সহ্য হয় না।
মহিম || সেকি ঠাকুরদা, আপনি আবার বুড়ো হলেন কবে? এই সেদিনও তো ঘোড়ার পিঠে দেখলুম।
বিশ্বম্ভর || সেদিন আর নেই মহিম। এই চার বছরে বুড়ো হয়ে গিয়েছি।
মহিম || ও, তাই বুঝি হাতে লাঠি? হাঃ হাঃ হাঃ—। তা সেই যাই হোক, আজকে ওবেলা একবারটি যে পায়ের ধুলো দিতেই হবে আমার বাড়িতে।
বিশ্বম্ভরকে চিন্তিত দেখায়।
বিশ্বম্ভর || ওবেলায়—?
মহিম || হ্যাঁ, আমার ওই নতুন জলসাঘর খুলবো আর কি— কৃষ্ণাবাঈয়ের নাম শুনেছেন? লক্ষ্নৌয়ের কৃষ্ণাবাঈ।
বিশ্বম্ভর || কৃষ্ণা—?
মহিম || শোনেন নি? এদিকে তাঁকে নিয়ে যে হইচই পড়ে গেছে! লোকে বলছে, এই বয়সে ওইরকম ইয়ে— কি বলে— কথক নাচ, এর আগে কেউ কখনো দেখে নি।
বিশ্বম্ভর || বটে?
মহিম || হ্যাঁ, কৃষ্ণাবাঈজির নাচ আর কাশীর সেরা তবলচির সংগত— এর কদর তো— আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না ঠাকুরদা—। তাহলে সন্ধেবেলায় আমার নতুন গাড়িটা পাঠিয়ে দেব— এই আটটা নাগাদ।
বিশ্বম্ভর || না ভাই।
মহিম || কেন?
অনন্ত সামনের টেবিলে এক গ্লাস সরবত রেখে নিয়ে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর || আর বেরোই না কোথাও। ভালো লাগে না।
মহিম || সে কি, গানেও অরুচি?
বিশ্বম্ভরের মুখে হাসি।
মহিম || তা হলে নেহাতই যাবেন না?
বিশ্বম্ভর || না ভাই।
মহিম || আচ্ছা, তাহলে উঠি।
মহিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
বিশ্বম্ভর || সরবতটা?
মহিম || সরবত? ও, আচ্ছা।
মহিম সরবতের গ্লাসটা তুলে মুখে দেয়।
চুমুক দেওয়ার শব্দ করে সরবতটা খেয়ে নেয় মহিম। খাওয়া হলে গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দেয়।
মহিম || আচ্ছা, তাহলে আমি চলি। এখুনি আবার সদরে ছুটতে হবে। সব সাহেব-সুবোরা আসবেন। হেঃ হেঃ হেঃ— আচ্ছা—
বিশ্বম্ভর নিরুত্তর, চেয়ারে নিশ্চুপ হয়ে তাঁকে বসে থাকতে দেখা যায়।
সময় সন্ধে।
চর দিয়ে তিনটে লরি চলে যায় হেডলাইট জ্বালিয়ে।
দৃষ্টিকোণ বদলে এবার রায়বাড়িটাও দেখা যায়।
.
রায়বাড়ির ছাদ।
চাঁদনি রাত। ছাদ থেকে চাঁদ দেখা যায়।
শোনা যায় কুকুরের ডাক।
অন্ধকার দোতলার বারান্দায় একাকী বসে থাকতে দেখা যায় বিশ্বম্ভরকে।
মহিমের বাড়ি থেকে ভেসে আসে ডায়নামোর শব্দ আর ঘুঙুরের আওয়াজ।
ঘুঙুরের আওয়াজে বিশ্বম্ভর একবার আঙুলে তাল ঠোকেন।
অনন্তকে আসতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর || অনন্ত!
অনন্ত || হুজুর!
বিশ্বম্ভর || জলসাঘরটা বন্ধ, না রে?
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, সে তো সেদিন থেকেই—
বিশ্বম্ভর || চাবি কোথায়?
অনন্ত || নায়েববাবুর কাছে।
বিশ্বম্ভর || জলসাঘরটা একবার খুলে দে তো।
অনন্তর মুখে হাসি। সে ছুটে চলে যায় চাবি আনতে!
.
রায়বাড়ি।
চারদিকে থমথমে ভাব।
শোনা যায় কুকুরের ডাক।
বিশ্বম্ভরের হাত দেখা যায়। হাতে লাঠি। লাঠিতে আঙুল দিয়ে অসহিষ্ণুভাবে টোকা মারছেন তিনি।
অনন্ত ছুটে আসে চাবি নিয়ে।
তাকে দেখে বিশ্বম্ভরও দ্রুত এগিয়ে যান।
অনন্ত জলসাঘরের চাবি খুলে দেয়।
অনন্ত || আমি একটা বাতি নিয়ে আসি।
অনন্ত আবার ছুটে চলে যায়।
বিশ্বম্ভরের আর তর সয় না। একটু ইতস্তত করে জলসাঘরের দিকে এগিয়ে যান।
জলসাঘরের ভেতর থেকে দেখা যায় বিশ্বম্ভরকে ঢুকতে। বিশ্বম্ভর ঘরে ঢুকে বিমর্ষ দৃষ্টিতে চারিদিক তাকালেন। লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরের ভেতরে এগিয়ে আসেন।
তাঁর দৃষ্টি যায় ঘরের ওপরদিকে— ঝাড়টা মাকড়শার জালে ঢাকা।
বিশ্বম্ভর তাঁর লাঠিটা দিয়ে আস্তে করে ঝাড়ে টোকা দেন। ঝাড়ের টুং-টাং শব্দে তাঁর মুখে হাসি দেখা যায়। মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের স্মৃতি।
.
জলসাঘর।
দেখা যায় জলসাঘরের আয়না।
জলসাঘরটায় অদ্ভুত থমথমে ভাব।
মেঝেতে কার্পেট। তাকিয়া, মদের গ্লাস সব এদিক ওদিক ছড়ানো। সবেতেই ধুলোর আস্তরণ।
বিশ্বম্ভরের মনে ভেসে আসে জলসাঘরের পুরোনো স্মৃতি। ভেসে অসে গানবাজনা।
বিশ্বম্ভরকে লাঠি হাতে মাটিতে বসে থাকতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর আয়নার দিকে তাকালেন। পরে মাথা নামিয়ে নেন। বাইরে থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসে।
অনন্তকে দেখা যায়। বাতি হাতে সে অবাক হয়ে বিশ্বম্ভরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বিশ্বম্ভর মাথা হেঁট করে বসে আছেন।
ভেসে আসে দুর্গাবাঈয়ের গান।
.
বিশ্বম্ভর লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান।
বিশ্বম্ভর এগিয়ে যান, আয়নার দিকে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বিমর্ষ দৃষ্টি মেলে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকান। হাত দিয়ে মুছে ফেলেন আয়নার ধুলো। পরিষ্কার আয়নায় দেখতে থাকেন নিজের প্রতিবিম্ব।
নিজের গালে হাত বুলিয়ে একবার স্পর্শ করলেন নিজের বার্ধক্যের রেখাগুলো।
তারাপ্রসন্ন সবিস্ময়ে দেখছেন।
বিশ্বম্ভর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি কি একটা যেন ভাবলেন। তারপর মন স্থির করে ওদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিশ্বম্ভর || কৃষ্ণাবাঈ কত নিচ্ছে? মহিমের বাড়ি কৃষ্ণাবাঈ কত নিচ্ছে?
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে দু-শো, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || তোমার তহবিলে আছে কত?
তারাপ্রসন্ন কোনো উত্তর দেন না।
বিশ্বম্ভর রেগে প্রশ্নটা আবার করেন।
বিশ্বম্ভর || কত আছে?
তারাপ্রসন্ন || দেবোত্তরের তহবিলে তিন-শোর বেশি নেই হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কাল এখানে জলসা হবে। কৃষ্ণাবাঈকে চাই।
তিনি বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে থাকেন। আয়নায় দেখা গেল তাঁকে চলে যেতে।
বিশ্বম্ভরের কথা শুনে চমকে ওঠেন তারাপ্রসন্ন।
তারাপ্রসন্ন || কিন্তু, এ তো সম্ভব নয়, হুজুর। তারাপ্রসন্নর কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর।
তারাপ্রসন্নর কথা শুনে বিশ্বম্ভর চমকে ওঠেন। যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান তিনি।
বিশ্বম্ভর || কি বললে?
বিরক্তি আর রাগে তিনি তারাপ্রসন্নর দিকে এগিয়ে আসেন। কাছে এসে প্রশ্ন করেন—
বিশ্বম্ভর || কী বললে?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে তারাপ্রসন্ন উত্তর দেন।
তারাপ্রসন্ন || মাপ করবেন হুজুর, মাপ করবেন!
বিশ্বম্ভর তাঁর প্রতি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।
অনন্ত বাতি হাতে এগিয়ে আসে। সে হাসিমুখে একবার তারাপ্রসন্নর দিকে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
.
অনন্তকে হাসিমুখে জলসাঘরের গুটোনো কার্পেট খুলতে দেখা যায়। কার্পেটটা গড়াতে গড়াতে খুলে যায়।
অনন্ত গামছা দিয়ে ধুড়ো পড়া আয়নাটা পরিষ্কার করছে। তার মুখে হাসি।
আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
অনন্ত দেওয়ালগিরিতে চিমনি লাগাচ্ছে। আয়নায় অনন্তকে চিমনি লাগাতে দেখা যায়।
খুব মনোযোগ দিয়ে অনন্তকে তকমা পরিষ্কার করতে দেখা যায়।
তকমায় লেখা আছে, Kirtipur Raj Estate, Kirtipur
অনন্ত মুখের কাছে তকমাটা নিয়ে এসে ভাপ দেয়। তার মুখে হাসি। তকমাটা সে গামছা দিয়ে পরিষ্কার করে।
.
বিশ্বম্ভরের শোবার ঘর।
হাসিমুখে তিনি পায়চারি করছেন। তবুও বোঝা যায় তাঁর মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনা রয়েছে।
তারাপ্রসন্নকে ঘরে ঢুকতে দেখা যায়।
তারাপ্রসন্নকে দেখে বিশ্বম্ভর তাঁর দিকে এগিয়ে যান।
বিশ্বম্ভর || সব ব্যবস্থা হয়েছে?
তারাপ্রসন্ন || শহরে একবার লোক পাঠাতে হবে হুজুর।
বিশ্বম্ভর || কেন?
তারাপ্রসন্ন || আতর ফুরিয়েছে, মোমবাতিও নেই— আর তাছাড়া জলসায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের আদর আপ্যায়নের জন্যে—
বিশ্বম্ভর || মদ!
তারাপ্রসন্ন || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
বিশ্বম্ভর || রহমৎকে পাঠিয়ে দাও। এক্ষুনি তুফানকে নিয়ে চলে যাক।
তারাপ্রসন্ন চলে যান।
বিশ্বম্ভর আবার পায়চারি শুরু করেন।
.
অনন্ত হাসিমুখে মদের বাক্স থেকে মদের বোতল বার করছে।
বোতল থেকে মদের পাত্রে অনন্ত মদ ঢালে।
ঝাড়ের কয়েকটা চিমনিতে মোমবাতি জ্বলতে দেখা যায়।
কয়েকটাতে জ্বলছে না।
মোমবাতি জ্বালানোর লাঠিটার জ্বলন্ত সলতে এসে একটা চিমনির মোমবাতি জ্বেলে দিতে দেখা যায়।
অনন্তকে দেখা যায় মোমবাতি জ্বালাচ্ছে।
১০
বিশ্বম্ভরের শোবার ঘর।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে।
বিশ্বম্ভর জলসাঘরে যাবার পোশাকে সজ্জিত হয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এই সময়ে মহিমের মোটরগাড়ির হর্ন শোনা যায়। বিশ্বম্ভর শোনেন।
এগিয়ে এসে টেবিল থেকে ফুলের মালাটা হাতে জড়িয়ে নেন।
অনন্তকে দেখা যায়। এগিয়ে এসে তার হাতের মদের ট্রে-টা টেবিলে রাখে।
অনন্ত || গাঙ্গুলিবাবু এইমাত্র পৌঁছলেন।
অনন্ত চলে যায়।
বিশ্বম্ভর কোনো কথা না বলে হাতে মালাটা জড়াতে থাকেন।
.
জলসাঘর।
দু-একজন অতিথিকে দেখা যায়। সবে তাঁরা আসতে শুরু করেছেন।
মহিম গাঙ্গুলিকে আসতে দেখা যায়। সে জুতো খুলতে খুলতে পকেট থেকে বার করে সিগারেট কেস। একটা সিগারেট মুখে দিয়ে এগিয়ে আসে বসবার আসনের দিকে। মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে জলসাঘরের চারিদিক দেখতে থাকে। তাকে দেখতে পায় এক অতিথি।
অতিথি || বোসো মহিম।
মহিম || হ্যাঁ বসবো তো— কিন্তু, ব্যাপারটা কিরকম হবে বলুন তো?
অতিথি || কেন হে—?
মহিম || না, আমার কাছে যেন— হেঃ হেঃ— একটু কি রকম, কি রকম ঠেকছে—
মহিম আসনে বসে পড়ে।
অনন্তর হাতে মদের ট্রে। সে এগিয়ে ট্রে-টা অতিথিদের সামনে নামিয়ে রাখে।
মহিম দেখে টিপ্পনি কাটে—
মহিম || ওঁ বাবা।
অনন্ত ট্রে থেকে আতরদানিটা নিয়ে অতিথিদের গায়ে আতর ছিটিয়ে দেয়।
মহিমের গায়েও দেয়। মহিম বিরক্ত হয়। নড়ে চড়ে ওঠে।
মহিম || অ্যাঁ অ্যাঁ আরে—
অনন্ত কোনো কথা না বলে এদিকে ওদিকে আতর ছিটিয়ে আবার মহিমের গায়ে দেয়। আতর দেওয়া হয়ে গেলে সে বিরক্তভাবে একবার মহিমকে দেখে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
.
বিশ্বম্ভর রায়কে দেখা যায় শোবার ঘরে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
তিনি কিছু একটা ভাবছেন যেন।
জলসাঘর থেকে ভেসে আসে সুর বাঁধার আওয়াজ।
দেওয়ালে ঝোলানো স্ত্রী আর ছেলের ছবির দিকে এগিয়ে যান বিশ্বম্ভর। ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার এগিয়ে আসেন টেবিলের দিকে।
বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় পাত্র থেকে মদের গ্লাসে মদ ঢালতে।
.
জলসাঘর।
মহিম ও অন্যান্য অতিথিদের দেখা যায়।
মহিম মদ খেয়ে গ্লাসটা রেখে এদিক ওদিক তাকায়।
মহিম || কই হে, কেউ আছে নাকি? একটু হাওয়া টাওয়া করো—
মহিম মুখ মোছবার জন্য পকেট থেকে রুমাল বার করে। রুমালের সঙ্গে কয়েকটা মোহর পড়ে যায়।
মহিম সেগুলো কুড়িয়ে নেয়।
বিশ্বম্ভর সিন্দুক খুলে মোহরের থলে বার করলেন। তাঁর হাতে জড়ানো রয়েছে মালা।
সিন্দুকটা বন্ধ করে তিনি চলে যান।
.
জলসাঘরে অতিথিদের সমাগম হয়েছে। মহিমকেও দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বম্ভরকে ঘরে ঢুকতে দেখা যায়। তাঁকে দেখে কয়েকজন অভিবাদন জানালেন।
বিশ্বম্ভর এগিয়ে এসে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন।
মহিম || এই যে ঠাকুরদা—। আসুন— আসুন— আসুন— আসুন। বসুন। তারপর—? শরীরটা ভালো তো আজকে?
মহিমকে হাতের ইঙ্গিতে চুপ করতে বলেন বিশ্বম্ভর।
একজন ওস্তাদজি গৌড় মলহারে আলাপ শুরু করেন।
পাশে আর একজন যন্ত্রী সেতারে সঙ্গত করে যাচ্ছেন।
তবলচি আর পাখোয়াজ-বাদক সঙ্গত দিতে শুরু করেন।
দেখা যায় কৃষ্ণাবাঈয়ের ঘুঙুর পরা পা। তেহাইয়ের জন্যে সেই পা অপেক্ষা করছে।
কৃষ্ণাবাঈ নাচ শুরু করেন।
বিশ্বম্ভর, মহিম ও অন্যান্য অতিথিদের বসে থাকতে দেখা যায়।
কৃষ্ণাবাঈ নাচছেন। পাশে যন্ত্রীদের দেখা যাচ্ছে সঙ্গত করতে।
কৃষ্ণাবাঈ বোলের সঙ্গে সঙ্গে নাচছেন।
বিশ্বম্ভর, মহিম ও অন্যান্য অতিথিরা তন্ময় হয়ে নাচ দেখছেন। মুখ খোলে মহিম।
মহিম || কেমন বুঝছেন ঠাকুরদা?
গড়গড়ার নল টানতে টানতে বিশ্বম্ভর নাচ দেখছেন।
পাশে কয়েকজন অতিথিকেও দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর আর মহিমকে দেখা যায়।
কৃষ্ণাবাঈ নেচে চলেছেন বোলের সাথে।
তবলচি আর সারেঙ্গি-বাদক বাজিয়ে যাচ্ছেন।
এবার তবলার বোলের সাথে নাচছেন কৃষ্ণাবাঈ।
বিশ্বম্ভরের মুখে গড়গড়ার নল। নলটা সরিয়ে রেখে তিনি তন্ময় হয়ে নাচ দেখছেন। পাশে কয়েকজন অতিথিকেও দেখা যায়।
কৃষ্ণাবাঈ নানারকম তাল, লয় ও ছন্দে নেচে যাচ্ছেন।
.
তারাপ্রসন্নকে দেখা যায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নাচ দেখতে।
অনন্ত তাল ঠুকে নাচতে নাচতে গিয়ে দাঁড়াল তারাপ্রসন্নর পাশে।
তারাপ্রসন্ন অনন্তকে দেখে বিরক্ত হয়ে চলে যান।
অনন্ত হাসতে হাসতে তারাপ্রসন্নকে অনুসরণ করে।
কৃষ্ণাবাঈ নেচে চলেছেন।
.
মহিম নাচ দেখে তারিফ করে ওঠে।
কৃষ্ণাবাঈকে দ্রুতলয়ে নাচতে দেখা যায়।
তবলচিও দ্রুত বাজাচ্ছেন।
মহিম অবাক হয়ে নাচ দেখছেন।
কৃষ্ণাবাঈয়ের পা। দ্রুতলয়ে নাচছেন।
দেখা যায় কৃষ্ণাবাঈয়ের শরীর।
কৃষ্ণাবাঈয়ের পা দ্রুতলয়ে নাচছে।
বিশ্বম্ভর অবাক হয়ে নাচ দেখথেন।
কৃষ্ণাবাঈয়ের পা ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে।
কৃষ্ণাবাঈ নাচছেন।
পায়ের কাজ আরও দ্রুততর হচ্ছে।
বিশ্বম্ভর অবাক হয়ে দেখছেন।
পায়ের কাজ আরও দ্রুত।
কৃষ্ণাবাঈয়ের চেহারা দেখা যায়।
মহিম অবাক হয়ে দেখছে।
বিশ্বম্ভর তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক দৃষ্টিতে।
পায়ের কাজ আরও দ্রুত।
বিশ্বম্ভর দেখছেন।
মহিম তাকিয়ে আছে।
পায়ের কাজ আরও দ্রুত।
তবলার ওপর তবলচির হাত চলছে দ্রুতলয়ে।
পায়ের কাজ অসম্ভব দ্রুত।
তবলচির হাতও সমান লয়ে।
বিশ্বম্ভর দেখছেন অবাক হয়ে।
পায়ের কাজ দ্রুত। তেহাই পড়ে।
তেহাইয়ের সঙ্গে নেচে কৃষ্ণাবাঈ শেষ করেন তাঁর নাচ।
মহিম হাত তুলে নাচের তারিফ করে।
মহিম || বহুৎ খুব! বহুৎ খুব! জিতি রহো বাঈজি, জিতি রহো।
মহিম পকেট থেকে মোহর বার করে দিতে যায়। বিশ্বম্ভরের লাঠির ডগাটা এসে মহিমের হাত আটকে ধরে।
মহিমের হাতে মোহর। বিশ্বম্ভরের লাঠি তার হাতটা ধরে থাকে। মহিমের দৃষ্টিতে বিস্ময় ও অপমানবোধ।
বিশ্বম্ভর || প্রথম ইনাম দেওয়ার অধিকার গৃহস্বামীর।
বিশ্বম্ভর লাঠিটা সরিয়ে নিয়ে নিজের মোহরের থলিটা উঁচু করে তুলে ধরেন।
কৃষ্ণাবাঈ কুর্নিশ করে এগিয়ে এসে থলিটা নেন।
থলিটা নিয়ে কৃষ্ণাবাঈ কুর্নিশ করতে করতে আবার পিছিয়ে যান।
মহিম হতভম্ব। অপমানিত হয়ে সে মোহরগুলো কৃষ্ণাবাঈয়ের দিকে ছুঁড়ে দেয়, তারপর মুখ ঘুরিয়ে বিশ্বম্ভরের দিকে তাকায়।
১১
জলসাঘর।
জলসা শেষ হয়ে গিয়েছে।
বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় মদের গ্লাস হাতে জলসাঘরের একটা থামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বিশ্বম্ভর || পারে নি— পারে নি—
মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে মদ শেষ করেন তিনি।
বিশ্বম্ভরের হাতে খালি গ্লাস।
বিশ্বম্ভর || অনন্ত।
অনন্ত জলসাঘরের সামনের দরজায় চৌকাঠে বসে ঝিমুচ্ছে। বিশ্বম্ভরের ডাক তার কানে যায়। সাড়া দিয়ে সে ছুটে যায়।
অনন্ত || হুজুর।
অনন্তকে দেখে বিশ্বম্ভর ইশারায় খালি গ্লাসটা দেখিয়ে দেন।
অনন্ত গ্লাসে মদ ঢালে। বিশ্বম্ভর ইশারায় আরও ঢালতে বলেন। অনন্ত ঢেলে দেয়।
বিশ্বম্ভর || পারে নি। সুদখোরের ব্যাটা পাহাড়ের চুড়ো ভাঙতে গিয়েছিল— এতবড়ো আস্পর্ধা, অ্যাঁ— কতবড়ো আস্পর্ধা!— বামন হয়ে চাঁদে হাত? পারে নি— পারে নি—
উত্তেজনায় বিশ্বম্ভর হো হো করে হেসে ওঠেন।
বিশ্বম্ভর || কেন পারে নি জানিস? রক্ত।
অনন্ত || রক্ত?
বিশ্বম্ভর || Blood. The blood in my veins– জানিস কার রক্ত বইছে আমার শিরায়?
অনন্ত || কার হুজুর?
বিশ্বম্ভর || দেখবি— দেখবি— আয়— আয়।
বিশ্বম্ভর এগিয়ে যান দেওয়ালের দিকে।
অনন্ত তাঁর পিছনে পিছনে যায়।
বিশ্বম্ভর তাঁর পূর্বপুরুষদের ছবির সামনে দাঁড়ান।
বিশ্বম্ভর || দেখ, আমার পিতৃদেব, ঈশ্বর রামেশ্বর— My grandfather. ঈশ্বর ভুবনেশ্বর, my great grandfather ঈশ্বর তারকেশ্বর, My great great grandfather ঈশ্বর রাবণেশ্বর—।
ছবিগুলো দেখানো হলে বিশ্বম্ভর পিছিয়ে আসেন।
অনন্তকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর তাঁর হাতের গ্লাসটা উঁচু করে তুলে ছবিগুলোর উদ্দেশে বলে ওঠেন—
বিশ্বম্ভর || To you– to you, to you, my noble ancestors– to you.
বিশ্বম্ভর মদের গ্লাসে চুমুক দেন।
মদটা শেষ করে তিনি গ্লাসটা আবার অনন্তর সামনে ধরেন।
অনন্ত বোতলের বাকি মদটা ঢেলে দেয় গ্লাসে।
বিশ্বম্ভর ইশারায় অনন্তকে আরও একটা বোতল আনতে বলেন।
অনন্ত ছুটে চলে যায়।
বিশ্বম্ভর এগিয়ে এসে তাঁর নিজের ছবির সামনে দাঁড়ান। গ্লাসটা তুলে ধরেন ছবির দিকে।
বিশ্বম্ভর || And to you, my noble self!
কথাটা বলেই তিনি ভয়ে চমকে উঠলেন। দেখা যায় বিশ্বম্ভরের ছবিতে একটা প্রকাণ্ড মাকড়শা। লাঠিটা উঁচিয়ে তিনি মাকড়শাটাকে তাড়াতে এগিয়ে আসেন।
ছবিটার ওপর মাকড়শাটাকে দেখা যায়।
লাঠিটা ছবিটাকে আঘাত করে।
মাকড়শা পালিয়ে যায়।
বিশ্বম্ভর মাকড়শাটাকে লক্ষ করেন। পরে হাসিমুখে লাঠিটা নামিয়ে নেন।
বিশ্বম্ভর গ্লাসে মুখ দিতে যান। হঠাৎ গ্লাসের ভিতর কিছু একটা দেখে থমকে থেমে যান।
দেখা যায় মদের গ্লাসের ভিতর ঝাড়বাতির প্রতিবিম্ব।
বিশ্বম্ভর হাসিমুখে ওপরের দিকে তাকালেন।
ঝাড়ের সব বাতিগুলোকে জ্বলতে দেখা যায়।
সব মোমবাতিগুলোই ছোটো হয়ে এসেছে।
বিশ্বম্ভর হাসিমুখে ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ চমকে ওঠেন তিনি।
ঝাড়ের একটা বাতি নিভে যেতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর ভয়ে পিছিয়ে আসেন। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তিনি এদিকে ওদিকে লক্ষ করেন।
এবার বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় দেওয়ালগিরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।
দেয়ালগিরির আলোটা ধীরে ধীরে নিবে যায়।
বিশ্বম্ভর অবিশ্বাস্য দৃষ্টি মেলে পাগলের মতো ছুটে আসেন। এগিয়ে এসে, চমকে আর একটা দেওয়ালগিরির সামনে দাঁড়িয়ে যান।
সেই দেওয়ালগিরির আলোটাও নিবে যায়।
বিশ্বম্ভর আবার ছুটে আসেন। তাঁর মুখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। তিনি দাঁড়িয়ে যান।
দেখা গেল আর একটা দেওয়ালগিরি নিবে যেতে।
বিশ্বম্ভর আবার ছুটে যান। তাঁকে জলসাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর আবার ছুটে যান পাগলের মতো।
বাতিগুলো প্রায় নিবে যাওয়ার মুখে। বিশ্বম্ভর ওপরের দিকে তাকিয়ে আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে, ভেঙে পড়লেন। পরক্ষণেই চিৎকার করে ডাকলেন—
বিশ্বম্ভর || অনন্ত— অনন্ত— অনন্ত।
অনন্তর গলা শোনা যায়।
অনন্ত || হুজুর!
অনন্ত ছুটে আসে।
বিশ্বম্ভর তখনো চেঁচিয়ে ডাকছেন—
বিশ্বম্ভর || অনন্ত—
অনন্ত || কি হয়েছে হুজুর?
বিশ্বম্ভর ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
অনন্ত মদের বোতল হাতে ছুটে আসে, বিশ্বম্ভরের দেখাদেখি সেও ঝাড়ের দিকে লক্ষ করে।
ঝাড়ের শেষ বাতিটাকেও নিভে যেতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর মর্মাহত হয়ে বসে পড়েন।
বিশ্বম্ভর || নিভে গেলো— সব বাতি নিভে গেলো।
বিশ্বম্ভর আসনে বসে পড়েন।
অনন্তও বসে পড়ে।
অনন্ত || বাতি?
বিশ্বম্ভর || সব বাতি নিভে গেল?
অনন্ত || বাতি তো নিববেই হুজুর।
বিশ্বম্ভর গ সব বাতি নিভে গেল।
অনন্ত || বাতি শেষ হয়ে গেছে, হুজুর। ভোর হয়ে এসেছে, হুজুর। এক্ষুনি সূয্যি উঠবে—
বিশ্বম্ভর || সুয্যি উঠবে।
অনন্ত || আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর— আমি জানলার পর্দাগুলো সব সরিয়ে দিচ্ছি—
অনন্ত ছুটে চলে যায়। জানলার কাছে গিয়ে সে মদের বোতলটা রেখে পর্দা সরিয়ে দেয়।
বিশ্বম্ভর বসে আছেন। পর্দা সরাতে তাঁর মুখে আলো এসে পড়ে।
আলোকিত হয় বিশ্বম্ভরের প্রতিকৃতিটাও।
বিশ্বম্ভর নিজের ছবিটা দেখে আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান।
বিশ্বম্ভর || সূর্য উঠবে।
বিশ্বম্ভরের প্রতিকৃতি।
বিশ্বম্ভর প্রতিকৃতির সামনে এসে দাঁড়ান।
হঠাৎ তাঁর কানে আসে তুফানের ডাক। তাঁর দৃষ্টি বিস্ফারিত— তিনি অনন্তর দিকে ফিরে বলেন—
বিশ্বম্ভর || তুফান— তুফান ডাকছে— তুফান ডাকছে—
অনন্ত || আপনি পারবেন না হুজুর, আপনি পারবেন না।
বিশ্বম্ভর || আমার সোওয়ারের পোশাক?
অনন্ত || আপনি পারবেন না, হুজুর—
অনন্ত ভয়ে দু-পা পিছিয়ে আসে।
বিশ্বম্ভর তাঁর হাতের লাঠিটা উঁচু করে ধরেন। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন— আমার চাবুক?
বিশ্বম্ভর লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
ঘোড়া ছুটিয়ে বিশ্বম্ভর চরের রাস্তা দিয়ে দূরে চলে যান।
তারাপ্রসন্ন ছুটে এসে রায়বাড়ির সামনে দাঁড়ান। তিনি হতবাক।
অনন্তও অবাক। হতভম্ব হয়ে চরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
তারাপ্রসন্ন || তুমি ওঁকে যেতে দিলে?
অনন্ত || মানা তো করলুম, কিন্তু শুনলেন না।
তারাপ্রসন্ন || সর্বনাশ।
তারাপ্রসন্ন ছুটে চলে যান। অনন্তও তাঁকে অনুসরণ করে।
বিশ্বম্ভরকে চরের রাস্তা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরে চলে যেতে দেখা যায়।
অনন্ত আর তারাপ্রসন্ন ব্যগ্রভাবে ছুটে আসছেন। পিছনে দেখা যায় রায়বাড়ি।
বিশ্বম্ভর ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন।
অনন্ত আর তারাপ্রসন্ন দেখছেন বিশ্বম্ভরকে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে।
বিশ্বম্ভর আরও দূরে চলে যান।
অনন্ত আর তারাপ্রসন্ন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছুটে আসার পরিশ্রমে তাঁদের দুজনকেই হাঁফাতে দেখা যায়।
বিশ্বম্ভর চরের রাস্তা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছেন।
ঘোড়ার পিঠে বিশ্বম্ভর, তাঁর হাতে লাগাম।
বিশ্বম্ভর ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন।
ঘোড়াটা এগিয়ে যাচ্ছে চরের উপর পড়ে থাকা একটা ভাঙা নৌকোর দিকে।
ঘোড়াটা ছুটে চলেছে।
বিশ্বম্ভর ঘোড়ার পিঠে।
নৌকোটা সামনে এগিয়ে আসছে।
.
অনন্ত হাঁফাচ্ছে।
হাঁফাচ্ছেন তারাপ্রসন্নও।
.
নৌকোটা যেন দ্রুত এগিয়ে আসছে সামনে।
তুফান সামনের দু-পা তুলে লাফিয়ে ওঠে।
বিশ্বম্ভর ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান।
.
তারাপ্রসন্ন ছুটে এগিয়ে যান। অনন্তও ছুটে যায়।
বিশ্বম্ভরকে দেখা যায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে। তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বালির উপর পড়েছে।
বিশ্বম্ভর মাথাটা তোলবার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পড়ে যান।
অনন্ত এগিয়ে আসে মনিবের দিকে।
বিশ্বম্ভর মাটিতে পড়ে আছেন।
তারাপ্রসন্ন এগিয়ে এসে সেখানে বসে পড়েন।
অনন্ত বিশ্বম্ভরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে জল।
বিশ্বম্ভর মৃতাবস্থায় পড়ে আছেন।
অনন্ত বিশ্বম্ভরকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
অনন্ত এতক্ষণে বিশ্বম্ভরের মুখের দিকে লক্ষ করে—
অনন্তর গলা শোনা যায়।
অনন্ত || রক্ত।
দূরে তুফানকে দেখা যায়।
চর দিয়ে কয়েকজন মাঝিমাল্লা ছুটে আসে নৌকোটার পাশ দিয়ে।
বিশ্বম্ভরের কাছ থেকে ক্যামেরা পাশে সরে এসে বালিতে পড়ে থাকা তাঁর পাগড়িটাকে দেখায়।
পিছনে সূর্য উঠছে।
ঝাড়বাতিটা দুলছে।
সমাপ্ত
.
চিত্রনাট্য যে সাহিত্যের একটা অঙ্গ এ বিষয়ে আজ আর কারও দ্বিমত নেই— বরং বলা যায় রীতিমতো জটিল সাহিত্য। সব সাহিত্যিক চিত্রনাট্য লিখতে পারেন না। এর একটা বাঁধাধরা নিয়ম আছে, হাত পাকাবার ব্যাপারও আছে। ‘জলসাঘর’ চিত্রনাট্য সত্যজিৎ রায়ের অনন্য সাহিত্য প্রতিভার আরেকটি নিদর্শন।
—লেখক
.
জলসাঘর প্রসঙ্গে [৩৯]
সত্যজিৎ রায়
.
আমি ‘জলসাঘর’ ছবি করি ‘অপরাজিত’-র পরেই। ‘পথের পাঁচালী’ ভালো চলেছিল; ভেবেছিলাম অপু-কাহিনির দ্বিতীয় পর্বও লোকের কাছে আকর্ষণীয় হবে। কিন্তু তা হল না। ‘অপরাজিত’ চলল না। ফলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হল। তখন আমি বিজ্ঞাপনের চাকরি ছেড়ে কায়েমিভাবে ছবি তৈরি করব বলে মনস্থ করেছি, কাজেই একের পর এক ছবি আমাকে করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল— এবারে কেমন ধরনের গল্প করা উচিত? অন্য লোকের টাকায় ছবি করব, সে লোক যাতে সে টাকা ফিরে পায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সুতরাং এমন ছবি করা চাই যা লোকে নেবে। গ্রামের গল্প, জীবনসংগ্রামের গল্প, আর চলবে না। মনে হল বাঙালি দর্শক চিরকালই ছবিতে নাচ গান পছন্দ করেছে— সেই উপাদান বজায় রেখে গল্প খোঁজা শুরু হল। অচিরেই তারাশঙ্করের বিখ্যাত গল্প ‘জলসাঘর’-এর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হল। পড়তি অবস্থার জমিদারের গল্প। তহবিল প্রায় শূন্য, কিন্তু জলসার প্রতি লোভ সংবরণ করতে পারেন না বিশ্বম্ভর রায়। এ গল্প থেকে ছবি করলে তাতে নাচ গানের সুযোগ স্বভাবতই আসবে। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে ‘জলসাঘর’ করাই স্থির করলাম। টালায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে তারাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করলাম, তাঁকে জানালাম আমাদের ইচ্ছা। ভদ্রলোক খুশি। বললেন, ‘আমার গল্প থেকে এযাবৎ যত ছবি হয়েছে সবগুলোই পয়সা দিয়েছে। ”জলসাঘর”ও হিট করা চাই।’
তখনও চিত্রনাট্য রচনায় হাত পাকে নি। তাই তারাশঙ্করকে প্রস্তাব করলাম তাঁর গল্পের ভিত্তিতে একটি চিত্রনাট্য রচনা করার জন্য। ভদ্রলোক রাজি হলেন। বললেন, ‘আমি কাজ শুরু করে দিচ্ছি। আপনি এক সপ্তাহ পরে এসে একবার খোঁজ করবেন।’
আমি তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী যথাসময়ে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তারাশঙ্কর বাঘছালের উপর বসে ডেস্কে খাতা রেখে লেখেন। ডেস্কের ডালাটা তুলে একটি খাতা বার করে তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘পড়ে দেখুন কেমন হয়েছে, তারপর বাকিটা লিখব।’
বাড়ি এসে লেখা পড়ে দেখি তারাশঙ্কর একটি আনকোরা নতুন গল্প ফাঁদতে বসেছেন যার সঙ্গে মূল গল্পের মিল সামান্যই। আমাকে আবার টালা গিয়ে বাধ্য হয়ে বলতে হল যে তাঁর প্রকাশিত গল্পটি ভালো লেগেছে বলেই আমি তার থেকে ছবি করা স্থির করেছি। চিত্রনাট্যে মূলের অনুসরণ না করলে আমার পক্ষে মুশকিল হবে। ‘তাহলে আপনি নিজেই লিখুন,’ বললেন ভদ্রলোক। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
শেষ পর্যন্ত ছবি যা দাঁড়িয়েছিল তাতে নাচ গান ছিল ঠিকই, কিন্তু সাধারণ বাংলা ছবির উপাদানের সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। তখনকার সেরা গাইয়ে-বাজিয়েদের ব্যবহার করেছিলাম আমরা। তার ফলে সংগীত হয়েছিল একেবারে খানদানি। বিশ্বম্ভরের ভূমিকায় স্বভাবতই ছবি বিশ্বাসকে নির্বাচন করা হয়েছিল। তিনি গোড়াতেই বলেছিলেন, ‘দুটো জিনিস আপনাকে বলা দরকার, মিস্টার রায়। এক— আমি ঘোড়া চড়তে পারি না এবং দুই— গানবাজনায় আমার আদৌ রুচি নেই।’
সত্যি বলতে কি— এমন tone-deaf মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি; কিন্তু অভিনয়ের গুণে তাঁকে গানের সমঝদার হিসাবে মেনে নিতে কারুর অসুবিধা হয় নি।
একটা তথ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘জলসাঘর’ শুটিং-এর মাঝামাঝি ‘কাবুলিওয়ালা’র ছবির প্রধান অভিনেতা হিসাবে ছবিবাবু বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত হন। ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, ‘আমি ভাবছি বার্লিন যাব। আর তার পরে ইউরোপটা একটু ঘুরে আসব। কাজেই কদিন বাদে ফিরব তা বলতে পারছি না।’ ভদ্রলোকের যাবার একান্ত আগ্রহ দেখে আমি তাঁকে অনুমতি দিলাম। যথাসময়ে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু এইভাবে কাজ না করে অনির্দিষ্টকাল বসে থাকার ইচ্ছা আমার একেবারেই ছিল না। তাই এই ফাঁকে খুব অল্পসময়ে এবং অল্প খরচে আমি আরেকটি ছবি করি। সেটা হল ‘পরশপাথর’। ‘পরশপাথর’ শেষ হবার পর ‘জলসাঘর’-এর বাকি কাজটা হয়।
‘জলসাঘর’ হিট করে নি, তবে অল্প খরচের ছবি বলে লোকসানও হয় নি।
—
টীকা
৩৯. জলসাঘর প্রসঙ্গে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘জলসাঘর’ (১৯৫৮) ছবিটি নির্মাণের আগে আউটডোরের জায়গা বাছাই করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় সন্ধান পান নিমতিতা রাজবাড়ির। এ বাড়ির বেশ কিছু বিশেষত্ব শুনে চমৎকৃত হন সত্যজিৎ রায়, প্রথমত সেই বাড়িরই এক জমিদারের ছায়া অবলম্বনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বম্ভর রায় চরিত্রটি। এবং দ্বিতীয়ত প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ নিমতিতা রাজবাড়ির একটি ঘরে বসেই রচনা করেছিলেন তাঁর ‘আলিবাবা’ নাটক। কাকতালীয় হলেও সেই ঘরটিতেই শুটিং চলাকালীন বাস করছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং।
‘জলসাঘর’ ছবিটি প্রথমবার মুক্তিলাভে জনগণের তেমন সমাদর লাভ করেনি, কিন্তু পরবর্তীতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ফরাসি ভাষাগোষ্ঠীর কাছে ‘জলসাঘর’ ভারতবর্ষকে নতুন করে চেনবার ও তার সংস্কৃতি, সাংগীতিক উত্তরাধিকারকে জানবার আগ্রহকে প্রবলভাবে বাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল।
ছবিটিতে বেগম আখতার, রোশন কুমারী এবং ওস্তাদ ওয়াহেদ খাঁর মতো স্বনামধন্য সংগীতশিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ।
২০১১ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সংস্থা ক্রাইটেরিয়ন কালেকশন, প্রযোজিকা অ্যাবি লস্টগার্টেনের তত্ত্বাবধানে ‘জলসাঘর’ ছবিটিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে ডিভিডি ও ব্লু-রে ডিস্কের আকারে ফিরিয়ে আনেন। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছ এই শ্রমসাধ্য পুনরুদ্ধার অচিরেই সাদর সংবর্ধনা লাভ করে। এই সাফল্যের সূত্র ধরে সত্যজিৎ রায়ের আরও বেশ কিছু ছবি, যথা ‘অপু ত্রয়ী’ (‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’), মহানগর, চারুলতা, ঘরে বাইরে, গনশত্রু এবং আগন্তুক-এর restored version প্রকাশিত হয় ক্রাইটেরিয়ন থেকে।