জলসাঘর

জলসাঘর

ভোর তিনটার সময় নিয়মিত শয্যাত্যাগ করিয়া বিশ্বম্ভর রায় ছাদে পায়চারি করিতেছিলেন। পুরাতন খানসামা অনন্ত গালিচার আসন ও তাকিয়া পাতিয়া ফরসি ও তামাক আনিবার জন্য নিচে চলিয়া গেল। বিশ্বম্ভর চাহিয়া একবার দেখিলেন, কিন্তু বসিলেন না। নতশিরে যেমন পদচারণা করিতেছিলেন, তেমনই করিতে থাকিলেন। অদূরে রায়বাড়ির কালীমন্দিরের তলদেশে শুভ্র স্বচ্ছসলিলা গঙ্গা ক্ষীণ ধারায় বহিয়া চলিয়াছে।

আকাশের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শুকতারা ধকধক করিয়া জ্বলিতেছিল। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে ওই তারাটির সহিত যেন দীপ্তির প্রতিযোগিতা করিয়াই এ অঞ্চলের হালে বড়লোক গাঙ্গুলীবাবুদের প্রাসাদশিখরে বহুশক্তিবিশিষ্ট একটি বিজলী-বাতি অকল্পিতভাবে জ্বলিতেছিল। ঢং-ঢং-ঢং করিয়া গাঙ্গুলীবাবুদের ছাদে তিনটার ঘড়ি এতক্ষণে পেটা হইল। পূর্বে দুই শত বৎসর ধরিয়ে এ অঞ্চলে ঘড়ি বাজিত রায়বাবুর বাড়িতে; এখন আর বাজে না। এখন বিশ্বম্ভরবাবুর ঘুম ভাঙ্গে অভ্যাসের বশে আর পারাবতের গুঞ্জনে। শুকতারা আকাশে দেখা দিলেই উহাদের কলরব শুরু হয়। ভোরের বাতাসের সঙ্গে একটি অতি মিষ্ট গন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে। বসন্ত সমারোহ করিয়া রায়বাড়িতে আর আসে না। তাহার পাদ্য-অর্ঘ্য দিবার মতো শক্তিও রায়বংশের নাই। মালির অভাবে ফুলের বাগান শুকাইয়া গিয়াছে। আছে মাত্র কয়টা বড় গাছ মুচকুন্দ, বকুল, নাগেশ্বর, চাঁপা। সেগুলিও এই বংশেরই মতো শাখা প্রশাখাহীন, এই প্রকাণ্ড ফাটল ধরা প্রাসাদখানার মতোই জীর্ণ। সত্য সত্যই কয়টা গাছের কাণ্ডের মধ্যে গহ্বরও দেখা দিয়াছে। সেই জীর্ণ শাখার প্রান্তে বসন্ত দেখা দেয়, না গাছগুলিই বসন্তকে ধরিবার চেষ্টা করে, কে জানে।

আস্তাবল হইতে একটা ঘোড়া ডাকিয়া উঠিল।

ফরসির মাথার কলিকা বসাইয়া নলটি হাতে ধরিয়া অনন্ত খানসামা ডাকিল, হুজুর।

বিশ্বম্ভরবাবুর চমক ভাঙ্গিল, বলিলেন, হুঁ।

ধীরে ধীরে গালিচায় বসিতেই অনন্ত নলটি তাঁহার হাতে আগাইয়া দিল। নিচে ঘোড়াটা আবার ডাকিয়া উঠিল।

নলে দুই-একটা মৃদু টান দিয়া বিশ্বম্ভরবাবু বলিলেন, মুচকুন্দ ফুল ফুটতে আরম্ভ হয়েছে, শরবতের সঙ্গে দিবি আজ থেকে।

মাথা চুলকাইয়া অনন্ত বলিল, আজ্ঞে, পাকেনি এখনও পাপড়িগুলো।

ওদিকে আস্তাবলে ঘোড়াটা অসহিষ্ণুভাবে ডাকিয়া উঠিতেছিল।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রায় ঈষৎ বিরক্তিভরেই বলিলেন, নিতে বেটার কি বুড়ো বয়সে ঘুম বেড়েছে নাকি। যা দেখি, নিতেকে ডেকে দে। তুফান ছটফট করছে। ডাকছে; শুনছিস না?

তুফান ওই ঘোড়ার নাম। রায়বাড়ির নয়টি আস্তাবলের মধ্যে এই একটা ঘোড়া, অবশিষ্ট আছে। বৃদ্ধ তুফান পঁচিশ বৎসর পূর্বের অসমসাহসী জোয়ান বিশ্বম্ভর রায়ের দুর্দান্ত বাহন। সেকালে, সেকালে কেন, দুই বৎসর পূর্বেও দেশদেশান্তরের পথচারী বাদশাহ-সড়কের উপর প্রকাণ্ড সাদা ঘোড়ার পিঠে মাথায় পাগড়ি-বাঁধা গৌরবর্ণ বীরবপু আরোহীকে দেখিয়া এ দেশের লোককে জিজ্ঞাসা করিত, কে হে উনি?

লোক বলিত, আমাদের রাজা উনি—বিশ্বম্ভর রায়। বড়দরের শিকারী, বাঘ মারা ওঁর খেলা।

অপরিচিত পথিক সসম্ভ্রমে চোখ তুলিয়া দেখিত, সাদা ঘোড়া তাহার আরোহীকে লইয়া দূরান্তরে মিলাইয়া গিয়াছে। দূরে উড়িতেছে শুধু ধূলার এক কুন্ডলী, একটা প্রক্ষিপ্ত ঘূর্ণি যেন পাক দিতে দিতে দিগন্তে মিশিবার জন্য ছুটিয়াছে।

নিত্যনিয়মিত দুর্দান্ত তুফান বিশ্বম্ভর রায়কে লইয়া ভোরে বাহির হইত। দুই বৎসর পূর্বে যেদিন মহাজন গাঙ্গুলীরা সমারোহ করিয়া গ্রামে গ্রামে ঢোল-শোহরত দ্বারা দখল ঘোষণা করিল, সেই দিন হইতে দেখা গেল—তুফানের পিঠে সওয়ারশূন্য, নিতাই সহিস লাগাম ধরিয়া তুফানকে টহল দিয়া ঘুরাইয়া আনিতেছে।

নায়েব তারাপ্রসন্ন বলিয়াছিল, আপনার এতদিনের অভ্যেস ছাড়লে শরীর—

বিশ্বম্ভরের দৃষ্টি দেখিয়া তারাপ্রসন্ন কথা শেষ করিতে পারে নাই।

রায় উত্তর দিয়াছিলেন দুইটি কথায়, ছি, তারাপ্রসন্ন!

অনন্ত নিচে যাইতেছিল। বিশ্বম্ভর আবার ডাকিলেন, শোন!

অনন্ত ফিরিল।

বাবু বলিলেন, নিতাই কাল বলছিল, তুফান নাকি দানা পুরো পাচ্ছে না!

অনন্ত বলিল, ছোলা এবার ভাল হয় নি, তাই নায়েববাবু বললেন—

হুঁ।

আবার ফরসিতে গোটাকয় টান মারিয়া বলিলেন, তুফান কি খুব রোগা হয়ে গেছে?

অনন্ত মৃদুস্বরে বলিল, না। তেমন কই?

হুঁ।

কিছুক্ষণ পরে আবার বলিলেন, দানা পুরোই দিবি, বুঝলি? নায়েবকে আমার নাম করে বলবি! যা তুই, নিতাইকে ডেকে দে।

অনন্ত চলিয়া গেল। তাকিয়ার উপরে ঠেস দিয়া ঊর্ধ্ব মুখে বিশ্বম্ভরবাবু আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন! নলটা পাশে পড়িয়া আছে। আকাশের তারাগুলি একের পর এক নিবিয়া আসিতেছিল। বিশ্বম্ভর অন্যমনস্কভাবে বোধ করি আপনার প্রশস্ত বুকে হাত বুলাইতে আরম্ভ করিলেন—এক-দুই। প্রথম দিন তুফানের পিঠে সওয়ার হইতে গেলে এই পাঁজরখানাতেই ধাক্কা লাগিয়াছিল, সে কী রূপ তুফানের! সে কী দুর্দান্তপনা! শান্ত হইত সে শুধু বাজনার শব্দে। বাজনা বাজিলে সে কখনও বেতালা পা ফেলে নাই। ঘাড় বাঁকাইয়া সে কী নৃত্য তাহার!

বিশ্বম্ভরবাবু উঠিয়া পড়িলেন। অতীতের স্মৃতি তারকারাজির মতো বুকের আকাশে রায়বংশের মর্যাদার ভাস্কর-প্রভায় ঢাকা পড়িয়া থাকে। আজ মমতার ছায়ায় সে ভাস্করে অকস্মাৎ সর্বগ্রাসী গ্রহণ লাগিয়া গেল। স্মৃতির উজ্জ্বলতম তারকা—তুফান, সে আকাশে সর্বাগ্রে জ্বলজ্বল করিয়া ফুটিয়া উঠিল। আজ দুই বৎসর তিনি নিচে নামেন নাই। দুই বৎসর পরে তুফানকে দেখিতে ইচ্ছা হইল। খড়ম জোড়াটা পায়ে দিয়া রায় দোতলায় নামিলেন। চকমিলানো বাড়ির সুপরিসর সুদীর্ঘ বারান্দা রায়ের বলিষ্ঠ পদের খড়মের শব্দে মুখরিত হইয়া উঠিল। বারান্দায় সারি সারি থামের মাথায় খড়খড়ি হইতে কতকগুলো চামচিকা ফরফর করিয়া উড়িয়া গেল। এ পাশে অন্ধকার তালাবন্ধ ঘরগুলোর ভিতরেও চামচিকার শব্দ পাওয়া যাইতে ছিল। ছাদের সিঁড়ির পাশেই বিছানাঘর। তুলার টুকরা বারান্দায় পড়িয়া আছে! তাহার পরই একটা দুর্গন্ধ। এটা ফরাসঘর। জামিজ, শতরঞ্চি, গালিচা থাকে। বোধহয় কিছু পচিয়া থাকিবে। পরের ঘরটায় চামচিকার পক্ষতাড়নের শব্দের সঙ্গে ঝুনঝান উঠিতেছে। বাতি ঘর এটা। বেলোয়ারী ঝাড়ের কলমগুলি বোধ হয় দুলিতেছে। ইহার পরই এ পাশের কোণের ঘরটা ছিল ফরাশ-বরদারের। এই সমস্ত জিনিসের ভার ছিল তাহার উপর। ঘরখানা শূন্য পড়িয়া আছে।

পূর্বমুখে রায় মোড় ফিরিলেন। পত্তনীদার মহল এটা। রায়দের দপ্তরে বিভিন্ন জেলার বড় বড় ধনী পত্তনীদার ছিল। পাঁচ শত হইতে পাঁচ হাজার টাকা খাজনা রাখিত, এমন পত্তনীদারের অভাব ছিল না। তাঁহারা আসিলে এইখানে তাঁহাদের বাসস্থান দেওয়া হইত। বারান্দার দেওয়ালে বড় বড় ছবি টাঙানো রহিয়াছে। মুখ তুলিয়া রায় একবার চাহিলেন। প্রথমখানার ছবি নাই, কাচ নাই, শুধু ফ্রেমখানা ঝুলিতেছে। দ্বিতীয়খানার কাচ নাই। তৃতীয়খানার স্থান শূন্য। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রায় আবার আবার নতমুখে চলিলেন। উপরে কড়ির মাথায় পায়রাগুলি অবিরাম গুঞ্জন করিতেছে। পূর্বমুখে বারান্দার প্রান্তেই সিঁড়ি। সিঁড়ি বাহিয়া রায় নিচে আসিয়া নামিলেন। দুই বৎসর পর আজ আবার তিনি নিচে নামিলেন। সেরেস্তাখানার সারি সারি ঘরে রায়-বংশের রাশি রাশি কাগজ বোঝাই হইয়া আছে।

সাত রায়ের ইতিহাস। বিশ্বম্ভর রায় জমিদার রায়বংশের সপ্তম পুরুষ। অন্ধকারের মধ্যে রায় ঈষৎ হাসিলেন। তাঁহার মনে পড়িল—রায়বংশের আদি পুরুষের কথা। তিনি নাকি বলিতেন, মা-লক্ষ্মীকে বাঁধতে হলে মা-সরস্বতীর দয়া চাই। কাগজের ওপর কালির গুটির শেকল—ও বড় কঠিন শেকল। হিসেব-নিকেশের শেকল ঠিক রেখো—চঞ্চলার আর নড়বার ক্ষমতা থাকবে না। তিনি ছিলেন নবাব দরবারের কানুনগো।

কাগজ, কলম, কালি—সবই ছিল, কিন্তু মা লক্ষ্মী চলিয়া গিয়াছেন।

বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা কুকুর কোথায় অন্ধকারে শুইয়া ছিল, সেটা ঘেউ-ঘেউ শব্দে চীৎকার করিয়া উঠিল। রায় গ্রাহ্য করিলেন না, অগ্রসর হইয়া চলিলেন। কুকুরটার ঘেউ-ঘেউ থামিয়া গেল। সে লেজ নাড়িয়া বার বার ঘুরিয়া ঘুরিয়া রায়কে প্রদক্ষিণ করিতে করিতে তাঁহার সহিত চলিতে আরম্ভ করিল। কুকুরটা শখ করিয়া কেহ পোষে নাই। রায়বাড়ির উচ্ছিষ্টভোজী কুকুরের সন্ততি কেহ।

কাছারীর দেউড়ি পার হইয়া দক্ষিণে গোশালা, বামে আস্তাবল।

তাহার ওদিকে দেবতাদের মন্দির।

রায় ডাকিলেন, নিতাই!

সসম্ভ্রম কণ্ঠের জবাব আসিল, হুজুর!

তুফানের উচ্চ হ্রেষারবে জবাব ঢাকা পড়িয়া গেল। ওদিক হইতে একটা হাতির গর্জন শোনা গেল।

রায় অগ্রসর হইয়া তুফানের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। অস্থিরভাবে পা ঠুকিয়া ডাক দিয়া বৃদ্ধ তুফান শিশুর মতো চঞ্চল হইয়া উঠিল। তাহার মুখে হাত বুলাইয়া রায় বলিলেন, বেটা!

তুফান মাথাটা মনিবের হাতে ঘষিতে লাগিল। ওদিকে হাতিটা অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। ক্রমাগত ডাকিয়া ডাকিয়া সে পায়ের শেকল ছিঁড়িবার চেষ্টা করিতেছিল। মাহুত রহমত প্রভুর সাড়া পাইয়া উঠিয়া আসিয়া আপনার হাতির নিকট দাঁড়াইয়া ছিল। সে অতি অনুযোগের সুরে বলিল, হুজুর ছোটগিন্নী শিকল ছিঁড়ে ফেলবে।

হস্তিনীটির নাম ছোটগিন্নী; বিশ্বম্ভরবাবুর মায়ের বিবাহের যৌতুক এই ছোটগিন্নী। তখন নাম ছিল মতি। কিন্তু কর্তা ধনেশ্বর রায় শিকার করিয়া ফিরিয়া মতি বলিতে পাগল হইয়া উঠিলেন। মতি একটা চিতা-বাঘকে শুঁড়ে ধরিয়া পদদলিত করিয়াছিল। মতির প্রতি যত্নের আধিক্য দেখিয়া বিশ্বম্ভরের মা তাহার নাম দিয়াছিলেন সতীন। কর্তা বলিয়াছিলেন, সেই ভাল রায়-গিন্নী, ওর নামও থাকুক—গিন্নী।

বিশ্বম্ভরবাবুর মা বলিয়াছিলেন, শুধু গিন্নী নয়, ছোটগিন্নী। ও তোমার দ্বিতীয় পক্ষ।

রহমতের কথায় বিশ্বম্ভরবাবু তুফানকে ছাড়িয়া ছোটগিন্নীর সম্মুখে গেলেন। পিছনে তুফানের অসন্তুষ্ট হ্রেষারব ধ্বনিত হইয়া উঠিল। রায় ছোটগিন্নীকে বলিলেন, কী গো মা লক্ষ্মী? ছোটগিন্নী আপনার শুঁড়খানি বাঁকাইয়া রায়ের সম্মুখে ধরিল। এটুকু তাঁহাকে সওয়ার হইবার জন্য অনুরোধ : রায় হাতিতে উঠিতেন শুঁড় বাহিয়া।

রায় তাহার শুঁড়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, এখন নয় মা।

ছোটগিন্নী কথা বুঝিল। সে শুঁড়খানি রায়ের কাঁধের উপর রাখিয়া লক্ষ্মী মেয়েটির মতোই শান্তভাবে দাঁড়ইয়া রহিল। রায় কহিলেন, নিতাই তুফানকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।

একান্ত সঙ্কোচভরে নিতাই বলিল, তুফান আর যাবে না আজ হুজুর। আপনাকে দেখেছে, আপনি সওয়ার না হলে—

রায় এ কথার কোনো জবাব দিলেন না। ছোটগিন্নীর শুঁড়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, লক্ষ্মী মেয়ে, মা আমার লক্ষ্মী মেয়ে।

অকস্মাৎ নিস্তব্ধ প্রত্যুষের স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া বিচিত্র সঙ্গীতে কোথায় ব্যান্ড বাজিয়া উঠিল। সচকিত রায় ছোটগিন্নীর শুঁড়খানি নামাইয়া দিয়া সরিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যান্ড বাজে কোথায় রে?

নিতাই মৃদুস্বরে জবাব দিলে, গাঙ্গুলীবাড়ির বাবুর ছেলের ভাত।

অভ্যাসমতো রায় বলিলেন, হুঁ।

তুফান তখন ঘাড় বাঁকাইয়া তালে তালে নাচিতে শুরু করিয়াছে। রায় মৃদু হাসিয়া তাহার নিকট গিয়া দাঁড়াইলেন। পিছনে ছোট-গিন্নীর পায়ের শিকলও তালে তালে নূপুরের মতো বাজিতেছিল, ঝুম—ঝুম—ঝুম।

রায় দেউড়ি পার হইয়া অন্ধকার পুরীর মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিলেন। তাঁহার মনে পড়িল, এককালে ভোরের নহবতের সঙ্গে এমন করিয়া নিত্য নাচিত—এক দিকে তুফান, অন্যদিকে ছোটগিন্নী।

দোতলায় উঠিয়া তিনি ডাকিলেন, অনন্ত।

হুজুর?

নারেবকে ডেকে দে।

রায় ছাদে গিয়া বসিলেন। প্রৌঢ় নায়েব তারাপ্রসন্ন আসিয়া নীরবে সম্মুখে দাঁড়াইতেই তিনি বলিলেন, মহিম গাঙ্গুলীর ছেলের অন্নপ্রাশন?

আজ্ঞে, হ্যাঁ।

নিমন্ত্রণ পত্র করেছে বোধ হয়?

কুণ্ঠিতভাবে তারাপ্রসন্ন বলিল, হ্যাঁ।

একখানা গিনি আর থালা—একখানা কাঁসার থালাই পাঠিয়ে দেবে।

তারাপ্রসন্ন নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। প্রতিবাদ করিবার সাহস তাহার ছিল না। কিন্তু ব্যবস্থাও বেশ মনঃপুত হয় নাই।

রায় বলিলেন, মোহর একখানা আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও।

নায়েব চলিয়া গেল। রায় নীরবে বসিয়া রহিলেন। অনন্ত আসিয়া কলিকা পালটাইয়া দিয়া নলটি ধরিয়া বলিল, হুজুর!

রায় অভ্যাসমতো হাতটি বাড়াইয়া দিলেন। তারপর বলিলেন, ছোট-গিন্নীর পিঠের গদি, জাজিম, ঘণ্টা বের করে দিবি। নায়েব যাবেন গাঙ্গুলী বাড়ি লৌকঁতা দিতে।

তিন পুরুষ ধরিয়া রায়েরা করিয়াছিলেন সঞ্চয়। চতুর্থ পুরুষ করিয়াছিলেন রাজত্ব। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুরুষ করিলেন ভোগ ও ঋণ। সপ্তম পুরুষ বিশ্বম্ভরের আমলেই রায়বাড়ির লক্ষ্মী সে ঋণ সমুদ্রে তলাইয়া গেলেন। বিশ্বম্ভর লক্ষ্মীহীন দেবরাজের মতো শুধু বসিয়া বসিয়া দেখিলেন। শুধু এই মাত্র নয়, রায়বংশ এই সপ্তম পুরুষে নির্বংশও হইয়া গেল। জেলার জর্জকোট ও হাইকোর্টের বিচারের নির্দেশমতো রায়বংশের লক্ষ্মী তখন ঝাঁপি হাতে দুয়ারে দাঁড়াইয়াছেন। অপেক্ষা মাত্র প্রিভি কাউন্সিলের আদেশের।

পুত্রের উপনয়ন উপলক্ষে বিপুল উৎসবে রায়বাড়ি মুখরিত হইয়া উঠিল। দানভোজন বিলাসব্যাসন চলিয়াছিল পূর্ণিমার জোয়ারের মতো। তারপরই পড়িল ভাঁটা। ভাঁটার টানে রায়বংশের সমস্ত প্রবাহটুকু নিঃশেষ হইয়া গেল। সাত দিনের দিন বিলাস হইয়া উঠিল বিষ। বাড়িতে কলেরা দেখা দিল। তাহার পর সাত দিনের মধ্যে রায়-গিন্নী, দুই পুত্র কন্যা, কয়েকজন আত্মীয়, সব শেষ হইয়া গেল। শুধু বিশ্বম্ভর রায় বিন্ধ্যগিরির অগস্ত্ব্য প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষার মতো নতশিরে মৃত্যুর অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলেন।

ভুল বলা হইল। মৃত্যুর প্রতীক্ষা সেই দিন হইতে করিয়াছিলেন কিনা কে জানে,কিন্তু নতশির সেদিনও তিনি হন নাই। নতশির হইলেন আরও দুই বৎসর পরে। প্রিভি কাউন্সিলের রায় যেদিন বাহির হইল, সেই দিন। নতুবা স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মৃত্যুর পরও এ বাড়িতে জলসাঘরে বাতি জ্বলিয়াছে, সেতার সারেঙ ঘুঙুর বাজিয়াছে। বিপুল হাস্যধ্বনিতে নিশীথরাত্রি চকিত-চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। ছোটগিন্নীর পিঠে শিকারে হাওদা চড়িয়াছে। তুফান সেদিনও রোষে ক্ষোভে দড়াদড়ি ছিঁড়িয়াছে।

যাক, প্রিভি কাউন্সিলের বিচারে রায়বংশের ভূসম্পত্তি সব চলিয়া গেল। রহিল বাড়িঘর ও লাখরাজের কায়েমী বন্দোবস্তটুকু। রায়বংশের আদি পুরুষ এইটুকু কাগজের উপর কালির শিকলে এমন করিয়া বাঁধিয়া ছিলেন যে, সেইটুকুতে হাত দিবার ক্ষমতা কাহারও হইল না। ওই বন্দোবস্তেই দেবসেবা চলে, ছোটগিন্নীর বরাদ্দ চাল আসে, রহমতের বেতন হয়; মোট কথা, এখনও যেটুকু আছে, সে সেই বন্দোবস্তেরই কল্যাণে। এখন মাসের প্রথমেই চাল আসে—মাসবরাদ্দ বাদশাভোগ চাল, নিত্য প্রাতে লাখরাজ বিল বন্দোবস্তের দরুণ আসে মাছ, ওই বিল হতেই জলচল পাখির বন্দোবস্তের ফলে আসে—পাখি। এ সমস্ত অতীত, কিন্তু স্মরণাতীত নয়। তাই এই জীর্ণ ফাটল ধরা রায়বাড়ির নাম এখনও রাজবাড়ি, শ্রীভ্রষ্ট বিশ্বম্ভর রায়ের নামই এ অঞ্চলে রায়-হুজুর।

সেইটুকুই নূতন ধনী গাঙ্গুলীবাবুদের ক্ষোভের কারণ, তাহারা সোনার দেউল তুলিয়াছে মরা-পাহাড়ের আড়ালে। পৃথিবী দেখে তাই মরা-পাহাড়, সোনার দেউলের দিকে কেউ চায় না। তাঁহাদের দামী মোটরের চেয়ে বৃদ্ধ হস্তিনীর খাতির বেশি।

মহিম গাঙ্গুলী ভাবে, মরা পাহাড়ের চুড়ো ভাঙতেই হবে আমায়।

ছোটগিন্নীর পিঠে ঘণ্টা উঠিতেই, সে গরবিনির মতো গা দোলাইতে আরম্ভ করিল। ঘণ্টা বাজিতে লাগিল ঢং—ঢং—ঢং।

নায়েব তারাপ্রসন্ন আসিয়া বিশ্বম্ভরবাবুর সম্মুখে দাঁড়াইল। বিশ্বম্ভরবাবু বসিয়াছিলেন অন্দরের হল ঘরে। এখন এই একখানি ঘরই তিনি ব্যবহার করেন। দেয়ালে রায়বংশের কর্তা-গিন্নীদের ছবি টাঙানো। সকলেরই প্রৌঢ় বয়সের প্রতিকৃতি। সকলেরই গায়ে কালী-নামাবলী, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে জপমালা। বিশ্বম্ভরবাবু সেই ছবির দিকে চাহিয়া ছিলেন। নায়েবকে দেখিয়া ধীরে ধীরে চোখ ফিরাইয়া ডাকিলেন, অনন্ত, হাত-বাক্সটা দে তো।

হাত-বাক্স হইতে লোহার সিন্দুকের চাবি লইয়া সিন্দুকটা খুলিয়া ফেলিলেন। সিন্দুকের উপরের থাকে রায়বাড়ির ঝাঁপি শোভা পাইতেছিল। নিচের থাকে দুই-তিনটি বাক্স! রায় টানিয়া বাহির করিলেন অতি সুদৃশ্য বাক্স! এটি তাঁহার মৃতা পত্নীর গহনার বাক্স। রায় বাক্সটি খুলিলেন। বাক্সটির গর্ভ প্রায় শূন্য! অলঙ্কারের মধ্যে একটি সিঁথি রহিয়াছে। এই সিঁথিটি সাতপুরুষের বধূবরণের মাঙ্গলিক সামগ্রী। ওইটা ছাড়া সব গিয়াছে। পাশের একটি খোপে কয়খানি মোহর।

এগুলি কয়খানি রায়-গিন্নীর আশীর্বাদের মোহর, কয়খানি যুবক বিশ্বম্ভরের পত্নীকে প্রথম উপহার। বিবাহের বৎসরই তিনি মহালে যান। নজরানার মোহর হইতে কয়খানা তিনি পত্নীকে উপহার দিয়াছিলেন। তাহারই একখানা লইয়া নায়েবের হাতে নিঃশব্দে তিনি তুলিয়া দিলেন। নায়েব চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরই ছোটগিন্নীর শব্দ সুউচ্চ হইয়া উঠিল। রায় আসিয়া জানালায় দাঁড়াইলেন।

ছোটগিন্নীর মাথায় তেল দেওয়া হইয়াছে—ললাটের তৈলসিক্ত অংশটুকু ঘিরিয়া সিন্দুরের রেখা আঁকা। ছোটগিন্নী হেলিয়া দুলিয়া চলিয়াছে।

অপরাহ্নে গাঙ্গুলীদের ঝকঝকে মোটরখানা আসিয়া লাগিল রায়বাড়ির ভাঙা দেউড়িতে। গাড়ি হইতে নামিলেন মহিম গাঙ্গুলী নিজে। নায়েব তারাপ্রসন্ন তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া সাদরে অভ্যর্থনা করিয়া কহিল, আসুন, আসুন।

অনন্তও দোতলা হইতে ঘটনাটা দেখিয়াছিল। সে তাড়াতাড়ি নিচে আসিয়া রায় বাড়ির খাস বৈঠকখানার দরজাটা খুলিয়া চলিয়া গেল।

মহিম কহিল, ঠাকুরদা কোথায়, দেখা করব যে।

গাঙ্গুলীবংশ চিরদিন রায়-দপ্তরের এলাকায় মহাজনি করিয়াছে। মহিমের পিতা জনার্দন পর্যন্ত রায়বাড়ির কর্তাকে বলিয়াছে, হুজুর। তারাপ্রসন্ন মহিমের কথার ভঙ্গীতে অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু মুখে মিষ্টভাবে বলিল, হুজুর এখনও ওঠেননি। খেয়ে শুয়েছেন।

মহিম বলিল, ডেকে তুলতে বলে দিন।

তারাপ্রসন্ন শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিল, সে সাহস আমাদের কারও নেই। আপনি বরং বলে যান আমাকে কী বলতে হবে, আমি বলব!

অসহিষ্ণুভাবে মহিম বলিল, না, আমাকে দেখা করতেই হবে।

অনন্ত আসিয়া রূপার গ্লাসে গাঙ্গুলীর সম্মুখে শরবত ধরিল।

গ্লাসটি লইয়া মহিম অনন্তকে প্রশ্ন করিল, ঠাকুরদা উঠেছেন রে?

উঠেছেন। আপনার খবর দিয়েছি। ডাকছেন আপনাকে তিনি।

শরবত পান করিয়া মহিম উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বাঃ চমৎকার গন্ধটুকু তো। কীসের শরবত রে?

অনন্ত মিথ্যা কথা বলিল, আজ্ঞে কাশীর মশলা, আমি জানি না ঠিক।

দোতলার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, কই ঠাকুরদা, আপনি যে খেতে গেলেন না?

বিশ্বম্ভর হাসিয়া বলিলেন, এসো এসো, বসো ভাই।

মহিম বলিল, আমার ভারী দুঃখ হয়েছে ঠাকুরদা।

তেমন হাসিয়া বিশ্বম্ভর বলিলেন, বুড়ো ঠাকুরদা বলে ভুলে যাও ভাই। বুড়ো মানুষ, নিয়মের ব্যতিক্রম দেহে সহ্য হয় না।

মহিম বলিল, সে দুঃখ ভুলব কিন্তু রাত্রে পায়ের ধুলো দিতেই হবে।

বিশ্বম্ভর ফরসি টানার ভানে নীরব রহিলেন।

মহিম বলিয়া গেল, সখ করে লক্ষ্ণৌ থেকে বাঈজী আনিয়াছি! তাদের গানের কদর আপনি ভিন্ন আমরা বুঝব না।

কিছুক্ষণ নীরবে তামাক টানিয়া রায় নলটি রাখিয়া দিলেন। তারপর বলিলেন, শরীর আমার বড় খারাপ ভাই মহিম, বুকে একটা ব্যথা হয়েছে, ইদানীং সেটা মাঝে মাঝে বড় কাতর করে আমাকে।

মহিম কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া উঠিয়া বলিল, আচ্ছা, তা হলে উঠি ঠাকুরদা, আমায় যেতে হবে একবার সদরে। সাহেব-সুবোদের নিয়ে আসতে হবে আবার, তাঁরা সব আসবেন কিনা।

বিশ্বম্ভর শুধু বলিলেন, দুঃখ কোরো না ভাই।

মহিম ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। বারান্দায় একবার দাঁড়াইয়া সহসা বলিয়া উঠিল, বাড়িটা করে রেখেছেন কী ঠাকুরদা, মেরামত করানো দরকার যে!

সে কথায় কেহ জবাব দিল না।

অনন্ত শুধু বলিল, আসুন হুজুর।

গাঙ্গুলী বাড়িতে নাচের আসর আলোর ঐশ্বর্যে ঝকঝক করিতেছিল। চাঁদোয়ার চারিপাশে নানা রঙের আলো। গাঙ্গুলীদের নিজেদের ‘ডায়ানামো’। ইলেকট্রিক তারের লাইন বাড়াইয়া আলোর ব্যবস্থা হইয়াছে। খুঁটিগুলি গাছের পাতা ও ফুল দিয়া সাজানো। রঙিন কাগজের মালা চারিপাশ বেড়িয়া ঝুলিতেছে। নিচের শতরঞ্চির উপর চাদর বিছাইয়া আসর পড়িয়াছে! একদিকে সারি-সারি চেয়ার, অন্যদিকে ঢালা বিছানায় সাধারণ শ্রোতাদের বসিবার স্থান। খানিক দূরে মেয়েদের আসর।

রাত্রি আটটার মধ্যেই আসর বসিয়া গেল। তবলচী সারেঙ্গাদার আপন আপন যন্ত্রের সুর বাঁধিতেছিল! দুইজন পশ্চিমা নর্তকী পেশোয়াজ-ওড়নায়-অলঙ্কারে সজ্জিত হইয়া আসরে আসিয়া বসিল! আসরের কোলাহল মুহূর্তে নীরব হইয়া গেল। হাঁ, রূপ বটে!

গান আরম্ভ হইল। ওদিকে চেয়ারে বিশিষ্ট শ্রোতাদের মধ্যে মহিম গাঙ্গুলী বসিয়া।

দুইজন নর্তকীর মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠা উঠিয়া গান ধরিয়াছিল। দীর্ঘ সুরে রাগিনীর আলাপে আলাপে আসরখানা যেন ঝিমাইয়া আসিল। শ্রোতাদের মধ্যে মৃদু কথাবার্তা শুরু হইয়া গেল। বিশিষ্ট শ্রোতামহলে কী একটা হাস্যপরিহাস চলিতেছিল। গাঙ্গুলীবাড়ির চাপরাশির দল সাধারণ শ্রোতাদের পিছনে দাঁড়াইয়া হাঁকিয়া উঠিল,—চুপ—চুপ।

গান শেষ হইবার মুখে মহিম ভদ্রতা করিয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ—বাঃ! নর্তকীর নৃত্যগীত ঈষৎ ক্ষুণ্ণ হইয়া গেল। গান শেষ করিয়া সে বসিয়া পড়িল। তরুণীটির সহিত মৃদু হাসিয়া কী কয়টা কথা বলিয়া এবার তাহাকে উঠিতে ইঙ্গিত করিল। দেখিতে দেখিতে আসর জমিয়া উঠিল। চপল গতির কণ্ঠসঙ্গীতে ও চুটুল নৃত্যভঙ্গীতে যেন একটা পাহাড়ী ঝরনা আসরের বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িল। তারিফে তারিফে আসরের মধ্যে একটা কলরোল উঠিল। বিশিষ্ট শ্রোতামহল হইতে টাকা নোট বকশিস আসিল।

তারপর আবার—আবার—আবার। আর আসর অলস মন্থর হয় নাই। আসর ভাঙ্গিলে মহিম ডাকিয়া বলিল, সকলে খুব খুশি হয়েছেন।

সেলাম করিয়া বয়োজ্যেষ্ঠা কহিল, আপনাদের মেহেরবানি।

সত্যিই মহিমের মেহেরবানির অন্ত ছিল না। তিন দিন বায়নার স্থলে পাঁচ দিন গাওনা হইয়া তবে শেষ হইল।

বিদায়ের দিন আরও মেহেরবানি সে করিল। বিদায় করিয়া বলিয়া দিল এখানে আমাদের রায়বাড়ি আছে, একবার ঘুরে যেও। বিশ্বম্ভর রায় সমঝদার আমীর লোক। গাওনা হয়তো হতে পারে।

বয়োজ্যেষ্ঠা সম্ভ্রমস্বরে বলিল, ওঁর কথা আমরা শুনেছি হুজুর। জরুর যাব রায়বাহাদুরের দরবারে। সে মতলব আমার প্রথম থেকেই আছে।

তারাপ্রসন্ন মনে মনে আগুন হইয়া উঠিল! সে বেশ বুঝিয়াছিল এ ওই কুটিল মহিম গাঙ্গুলীর কূট চাল! অবশেষে একটা বেশ্যাকে দিয়া অপমানের চেষ্টা করিয়াছে। সে গম্ভীরভাবে বলিল, বাবুর তবিয়ৎ আচ্ছা নেহি—নাচগান এখন হবে না।

বয়োজ্যেষ্ঠা বাঈজীটি বলিল, মেহেরবানি করকে—

বাধা দিয়া তারাপ্রসন্ন বলিল, সে হয় না।

বাঈজী দুঃখিতভাবে বলিল, মেরে নসীব।

তাহারা উঠিবার উদ্যোগ করিতেছিল।

এমন সময় দোতলা হইতে হাঁক আসিল, তারাপ্রসন্ন।

তারাপ্রসন্ন আসিতেই বিশ্বম্ভর বলিলেন, কে ওরা?

নতমুখে তারাপ্রসন্ন উত্তর দিল, গাঙ্গুলীদের বাড়ি ওরাই এসেছিল মুজরো করতে।

হুঁ। তারপর একটু থামিয়া বলিলেন, শুধু হাতে ফিরিয়ে দিলে।

সেলাম পৌঁছে হুজুরকো পাশ। মুসলমানী কায়দার আভূমিনত অভিবাদন করিয়া বাঈজী আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।

কাছারিঘর হইতে এদিকে বারান্দা ও ঘরের খানিকটা দেখা যায়। বিশ্বম্ভরের কণ্ঠস্বর শুনিয়া বাঈজী তাঁহাকে দেখিয়া উঠিয়া আসিয়াছে।

এত্তালা না দিয়া উপরে উঠিয়া আসার জন্য বিশ্বম্ভর রুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহার সে রাগ রহিল না। বাঈজীর রূপ তাঁহার চিত্ত কোমল করিয়া দিল।

বাঈজী আবার অভিবাদন করিয়া বলিল, কসুর মাপ করতে হুকুম হয় মেহেরবান; এত্তালা না দিয়ে এসে পড়েছি।

বিশ্বম্ভর দেখিতেছিলেন বাঈজীর রূপ। ডালিমের দানার মতো রঙ, সুর্মা আঁকা টানা টানা দুইটি চোখ—মাদকতা ভরা চাহনি, গোলাপের পাপড়ির মতো দুই ঠোঁট, ঈষৎ-দীর্ঘ দেহখানি, ক্ষীণ কটি, মৃত্যু যেন আলস্যভরে দেহখানিতে বিরাম লইতেছে। এ চঞ্চল হইলেই সে মুখর হইয়া উঠিবে।

বিশ্বম্ভর প্রসন্ন হাস্যে বলিলেন, বৈঠিয়ে।

অদূরবর্তী গালিচার উপর বাঈজী সসম্ভ্রমে বসিয়া বলিল, হুজুর বাহাদুরের দরবারে বাঁদী গান শোনাবার জন্য হাজির।

বিশ্বম্ভর বলিতে গেলেন, তাহার তবিয়ত খারাপ। কিন্তু কেমন লজ্জা হইল, একটা তওয়াইফের সম্মুখে মিথ্যা বলিতে বুঝি ঘৃণা হইল।

বাঈজী বলিল, সবার মুখে শুনেছি, এখানকার বড় ভারি সমঝদার হুজুর বাহাদুর। গাঙ্গুলীবাবুও বললেন, আমীর—এখানকার রাজা আপনি।

রায়ের নলের ডাক বন্ধ হইয়া গেল। মৃদু হাসিয়া বাঈজীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, হবে মজলিস সন্ধ্যের সময়। তারপর ডাকিলেন, অনন্ত।

অনন্ত বাহিরেই ছিল। সম্মুখে আসিতে বলিলেন, এঁদের বাসা দিয়ে দে। নিচে তালুকদারের ঘর একখানা খুলে দে।

অনন্ত বলিল, আসুন।

বাংলা বলিতে না পারিলেও বাংলা বুঝিতে বাঈজীর কষ্ট হইল না। উঠিয়া অভিবাদন করিয়া সে কহিল—বহুত নসীব মেরে—বহুত মেহেরবানি হুজুরকো।

অনন্তকে অনুসরণ করিয়া সে চলিয়া গেল।

নায়েব তারাপ্রসন্ন দাঁড়াইয়া ছিল—নির্বাক হইয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর সে কহিল, গাঙ্গুলীদের বাড়ি একশো টাকা রাত্রে নিয়েছে ওরা।

হুঁ।

কয়বার নলে টান দিয়া রায় বলিলেন, তোমার তহবিলে কি—

কথা অসমাপ্ত রাখিয়া তিনি আবার নলে টান দিতে আরম্ভ করিলেন। তারাপ্রসন্ন বলিল, দেবোত্তরের তহবিলে শ-দেড়েক টাকা আছে।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া রায় উঠিয়া লোহার সিন্দুক খুলিয়া বাহির করিলেন সেই বাক্সটি। বাক্সের মধ্য হইতে রায় বংশের মাঙ্গলিক সিঁথিখানি তুলিয়া তারাপ্রসন্নের হাত দিয়া বলিলেন, দেবোত্তরের খাতায় খরচা লেখ—আনন্দময়ীর জন্যে জড়োয়া সিঁথি খরিদ, দাম ওই দেড়শো টাকা।

আনন্দময়ী রায়বংশের ইষ্টদেবী পাষাণময়ী কালী।

বহুদিন পর নিস্তব্ধ রায়বাড়ি তালা-খোলার শব্দে প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। জলসাঘরের দরজা-জানলা খুলিয়া গেল। বাতিঘরের তালা খুলিল। ফরাশঘরে আলোক প্রবেশ করিল।

অনন্ত ঘর-দুয়ার ঝাড়িতেছিল। সাহায্য করিতেছিল নিতাই ও রহমত। ঠাকুরবাড়ির পুরানো ঝি মাজিতেছিল—আসাসোঁটা গড়গড়া, বড় বড় পরাত, গোলাপপাশ, আতরদান। নায়েব তারাপ্রসন্ন দাঁড়াইয়া সমস্ত দিকের তদারক করিতেছিল।

অনন্ত বলিল, সদরে লোক পাঠাতে হবে নায়েববাবু।

নায়েব বলিল, ফর্দ করেছি আমি। শোন দেখি, কিছু ভুল হল কি না।

ফর্দ শুনিয়া অনন্ত কহিল, সবই হয়েছে, বাদ পড়েছে দুটো জিনিষ। ভরি দুই আতর আর বিলিতী বোতল কটা।

নায়েব বলিল, ছিল তো একটা।

তাতে খানিকটা আছে। মাঝে মাঝে একটু একটু এক এক দিন খান তো। তবে আজ যদি চান। একটা বোতলে হবে না নায়েববাবু।

নায়েববাবু বলিলেন, কিন্তু পাঠাই কাকে? পায়ে হেঁটে সন্ধ্যের আগে কে ফিরবে?

অনন্ত দ্বিধাভরে বলিল, তুফানকে নিয়ে নিতাই-ই নয় যাক।

নিতাই বলিল, হজুর হুকুম না করলে—

নায়েব বলিল, আচ্ছা আমি বলে আসছি।

বিশ্বম্ভরবাবু শুইয়া ছিলেন। নায়েব গিয়া দাঁড়াইতেই তিনি বলিলেন, তোমাকে ডাকব ভাবছিলাম। একবার গাঙ্গুলীবাড়িতে যাও, মহিমকে নিমন্ত্রণ করে এস। আর গ্রামে ভদ্রলোক বেছে নিমন্ত্রণ করতে হবে। গাঙ্গুলীবাড়ি যাও তুমি নিজে।

নায়েব বলিল, তাই যাব।

রায় বলিলেন, ছোটগিন্নীর পিঠে গদি দিতে বল।

নায়েব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বলিল, তুফানকে নিয়ে নিতাইকে পাঠানো দরকার সদরে।

হুঁ।

কিছুক্ষণ পর রায় বলিলেন, তাই যাক।

আর কিছুক্ষণ পর তুফানের হ্রেস্বা শুনিয়া রায় সম্মুখের জানালাটা খুলিয়া দিলেন। বাড়ির পিছন দিয়া দেবদারু ছায়াচ্ছন্ন রায়দের নিজস্ব পথখানি পরিষ্কার দেখা যায়। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ সে পথে বাজিয়া উঠিল। রায় দেখিলেন, ঘাড় বাঁকাইয়া দীপ্ত পদক্ষেপে তুফান দুর্দান্তপনা করিতে করিতে চলিয়াছে। তেমনই বাঁকানো ঘাড়, তেমনই পদক্ষেপ।

আর কিছুক্ষণ পর ছোটগিন্নীর পিঠের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল।

রায় উঠিয়া বসিলেন। জানালা দিয়া দেখিলেন, গরবিনী ছোটগিন্নী চলিয়াছে। রায় বিছানা ছাড়িয়া ঘরের মেঝের উপর পদচারণা আরম্ভ করিলেন। দেহ-মন কেমন তাঁহার চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে।

সমারোহ। রায়াবাড়িতে বহুদিন পর সমারোহ।

ওদিকের জলসাঘর হইতেই বোধকরি শব্দ আসিতেছিল—ঠুং-ঠাং-ঠুং-ঠাং। বেলোয়ারী ঝাড়ের শব্দ। রায় ঘর ছাড়িয়া বারান্দায় বাহির হইয়া পড়িলেন। অনন্ত ঝাড় দেওয়ালগিরি হুকে হুকে টাঙাইতেছিল। পদশব্দে দুয়ারের দিকে চাহিয়া দেখিল, দুয়ারে দাঁড়াইয়া বিশ্বম্ভর রায়। তিনি চাহিয়া আছেন—দেওয়ালের ছবিগুলির দিকে। প্রকাণ্ড হলের চারদিকের প্রাচীরবিলম্বিত রায়বংশের মালিকদের যুবা বয়সে প্রতিকৃতি। আদি পুরুষ ভুবনেশ্বর রায় হইতে তাঁহার নিজের পর্যন্ত সকলেরই বিলাস ব্যসনে মত্ত প্রতিকৃতি। পিতামহ রাবণেশ্বর রায় দাঁড়াইয়া আছেন—শিকার করা বাঘের উপর পা রাখিয়া—হাতে সড়কি-বল্লম, পিঠে ঢাল। পিতা ধনেশ্বর বসিয়া আছেন গদির উপর, পাশে ছোটগিন্নী। যুবক বিশ্বম্ভর তুফানের উপর আরূঢ়।

রায়বংশ এই ঘরে ঝড়ের খেলা খেলিয়া গিয়াছে। রায়ের মনে পড়িল কত কথা। দুর্দান্ত রাবণেশ্বর এ বংশের প্রথম ভোগী পুরুষ। তিনি এই জলসাঘর তৈয়ারী করাইয়াছিলেন। কিন্তু ভোগ করিবার সাহস তাঁহার হয় নাই। প্রথম যে দিন এই জলসাঘরে তিনি মজলিস করিয়াছিলেন, সেই দিনই রাবণেশ্বরের স্ত্রী-পুত্র সব শেষ হইয়াছিল। বাতিদানের বাতি অর্ধদগ্ধ অবস্থাতেই নিভিয়াছিল। তারপর আর তিনি সাহস করিয়া জলসাঘরের দুয়ার খোলেন নাই।

সেই দিন রায়বংশের শেষ হইলেই যেন ভাল হইত। কিন্তু রাবণেশ্বর রায়বংশের মমতায় পুনরায় শ্যালিকাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, তাঁহার আনন্দময়ীর আদেশ। তাঁহারই পুত্র তারকেশ্বর এই জলসাঘরের দুয়ার খুলিয়া আবার বাতি জ্বালিয়াছিলেন। তিনি এক রাত্রে এই ঘরে এক আমীর বন্ধুর সহিত প্রতিযোগীতা করিয়া পাঁচ শত মোহর এক বাইজীকে বকশিশ দিয়া গিয়াছেন। তাহার নিজের কথা মনে পড়িল—চন্দ্রা, চন্দ্রাবাই! আসর ভাঙার পর বন্ধুদের লুকাইয়া চন্দ্রার সহিত আলাপ বুকের মধ্যে অক্ষয় হইয়া আছে। ফুলের স্তবকের মতো চন্দ্রা।

অনন্তের হাতের কাজ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। মনিবের মুখের দিকে চাহিয়া তাহার হাত আর সরিতেছিল না। রায়ের মুখখানা থমথমে রাঙা—যেন কোন রুদ্ধমুখ শিরা খুলিয়া আবদ্ধ রক্তধারা সে মুখে উৎসের মতো আজ উথলিয়া উঠিয়াছে।

সন্ধ্যার পূর্বে অনন্ত পরাতের উপর রূপার গ্লাসে শরবত বসাইয়া রায়ের সম্মুখে নিঃশব্দে ধরিয়া দিল। রায় চাহিয়া দেখিলেন অনন্তের অঙ্গে জমিদার চোপদারের উর্দি, কোমরে পেটি, মাথায় পাগড়ি, বুকে রায়বাড়ির তকমা। তিনি নিঃশব্দে গ্লাসটি উঠাইয়া লইলেন। অনন্ত চলিয়া গেল! কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া সম্মুখে কোঁচনো ধুতি, শুভ্র ফিনফিনে মুসলমান ঢঙের পাঞ্জাবি, রেশনের চাদর নামাইয়া রাখিল; রায় চিনিলেন, পাঁচ বছর পূর্বে মুরশিদাবাদে জমিদার বন্ধুর বাড়ি যাইবার সময় এই পোষাক তৈয়ারী হইয়াছিল।

প্রশ্ন করিলেন, সব ঠিক আছে?

মৃদুস্বরে অনন্ত বলিল, বাতি জ্বালা হচ্ছে।

লোকজন?

অনন্ত বলিল, নাখরাজদার ভাণ্ডারীরা বাপ বেটায় এসেছে। দেবোত্তরে নাখরাজদার পাইক এসেছে চারজন, তারা দেউড়িতে আছে।

নিচে মোটরের হর্ন বাজিয়া উঠিল।

অন্তত ত্রস্তপদে নিচে চলিয়া গেল। মহিম গাঙ্গুলী আসিয়াছে। সিঁড়ির বুকে চলা-ফেরার শব্দ শোনা যায়। নিচের তলায় অতিথি অভ্যর্থনার সাদর সম্ভাষণ, পরস্পরের সহিত আলাপের গুঞ্জন উঠিয়াছে। ক্রমে জলসাঘরে তাদের যন্ত্রের মৃদু সুর জাগিয়া উঠিল। তবলার ধ্বনিও শোনা গেল। সুর বাঁধা হইতেছে।

অনন্ত আসিয়া দরজায় দাঁড়াইয়া ডাকিল, হুজুর!

বিশ্বম্ভর বেশ পরিবর্তন করিয়া ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতেছিলেন। উত্তর দিলেন, হুঁ?

আসর বসতে পারছে না।

হুঁ।

কয়েক মুহূর্ত পরে তিনি বলিলেন, জুতো দে।

অনন্ত ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া একটু ইতস্তত করিয়া নীরবে কোণের টেবিলের দেরাজ খুলিয়া বোতল ও গ্লাস বাহির করিল। দেরাজের উপরে সেগুলি নামাইয়া দিয়া জুতা বাহির করিয়া ঝাড়িতে বসিল। রায় একবার থমকিয়া দাঁড়াইলেন। আবার পায়চারি শুরু করিলেন। নিচের যন্ত্র সঙ্গীতের সুর ক্রমশ উচ্চ হইয়া উঠিতেছিল।

অনন্ত ডাকিল, হুজুর!

রায় শুধু বলিলেন, হুঁ।

আবার কয়বার তিনি ঘুরিলেন। সে গতি যেন ঈষৎ দ্রুত। অনন্ত প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল। ঘুরতে ঘুরতে রায় টেবিলের ধারে দাঁড়াইয়া বলিলেন, সোডা।

প্রকাণ্ড বড় হলটার দিকে লম্বা ফালির মতো গদি পাতিয়া তাহার উপরে জাজিম বিছাইয়া শ্রোতাদের বসিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। পিছনে সারি সারি তাকিয়া, হলের ছাদে পাশাপাশি তিনটি বেলোয়াড়ী ঝাড়ে বাতি জ্বলিতেছিল। দেওয়ালে দেওয়ালগিরিতে বাতির আলো বাতাসে ঈষৎ কাঁপিয়া উঠিতেছে।

ঝাড় ও দেওয়ালগিরির কতকগুলিতে শেজ না থাকায় বাতাসে বাতিগুলি নিবিয়া গিয়াছে। দেওয়ালের গায়ে তাই মধ্যে মধ্যে স্বল্পম্লান ছায়ারেখা দীর্ঘাকারে জাগিয়া উঠিয়াছে প্রচ্ছন্ন বিষণ্ণতার মতো।

আসর বসিয়াছে—কিন্তু গতি এখনও অতি মৃদু। যন্ত্রবাদ্যের ঝঙ্কার অঙ্কুরের মতো সবে দেখা দিয়েছে। চারিপাশের আসরে বসিয়া ত্রিশ চল্লিশজন ভদ্রলোক মৃদু গুঞ্জনে আলাপ করিতেছেন। চার-পাঁচটা গড়গড়া ফরসিতে তামাক চলিতেছে। তওয়াইফ দুজনে নীরবে বসিয়া আছে। মাঝে মাঝে কেবল মহিম গাঙ্গুলীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সিগারেট টান দিয়া সে নিবন্ত বাতিগুলোর দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, কটা বাতি নিবে গেল যে হে। কেহ এ কথার জবাব দিল না। সে ডাকিল, নায়েববাবু! তারাপ্রসন্ন দরজার সম্মুখে দাঁড়াইতেই সে বলিল, দেখুন, আলো বেশ খোলে নি। আমার ড্রাইভারকে বলে দিন, দুটো পেট্রোম্যাক্স নিয়ে আসুক।

নায়েব চুপ করিয়া রহিল। বয়োজ্যেষ্ঠা নর্তকীটি কেবল উর্দুতে বলিল—যেন স্বগতোক্তি করিল, এ ঘরে সে আলো মানায় কি?

বাহিরে ভারী পায়ের জুতোর আওয়াজে নায়েব পিছনে চাহিয়া দেখিয়া সসম্ভ্রমে সরিয়া দাঁড়াইল। মুহূর্ত পরেই অনন্তের পিছনে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন বিশ্বম্ভর রায়। বাইজী দুজন সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল। মজলিসের সকলেও উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। মহিমও আপনার অজ্ঞাতসারে অর্ধোত্থিত হইয়া হঠাৎ আবার বসিয়া পড়িল।

রায় স্বল্প হাসিয়া বলিলেন, আমার একটু দেরী হয়ে গেল। তারপর তিনি আসন গ্রহণ করিলেন। তাকিয়াটা টানিয়া লইয়া মহিম সেটাকে সরাইয়া দিল। পকেট হইতে রুমাল বার করিয়া তাকিয়াটাকে কয়বার ঝাড়িয়া লইয়া বিরক্তিভরে সে বলিল, বাপ রে বাপ কী ধুলো! তারাপ্রসন্ন আতর বিলি করিয়া গেল! সমস্ত গড়গড়া-ফরসির কলিকা বদল করিয়া রায়ের সম্মুখে তাঁহার নিজের ফরাসি নামাইয়া অনন্ত হাতে নল তুলিয়া দিল।

বয়:জ্যেষ্ঠা বাইজী কুর্নিশ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। সঙ্গীত আরম্ভ হইয়াছে। সেই দীর্ঘ মন্থর গতিতে রাগিনীর আলাপ। কিন্তু একটু বৈচিত্র্য ছিল। আসর আজ নিস্তব্ধ। রায় চোখ মুদিয়া গম্ভীরভাবে বসিয়া আছেন। গানের দীর্ঘমন্থর গতির সমতায় বিশাল দেহ তাঁহার ঈষৎ দুলিতেছে। থাকিতে থাকিতে তাঁহার বাম হাতখানি উদ্যত হইয়া পাশের তাকিয়াটির উপর একটি মৃদু আঘাত করিল। ঠিক ওই সঙ্গে তবলচীর চর্মবাদ্য ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। রায় চোখ মেলিলেন বাইজীর পায়ের ঘুঙুর সাড়া দিয়েছে। নৃত্য আরম্ভ হইল। কলাপীর নৃত্য। আকাশে মেঘ দেখিয়া উতলা ময়ূরীর নৃত্যভঙ্গী। গ্রীবা ঈষৎ বাঁকিয়াছে, দুই হাতে পেশায়াজের দুই প্রান্ত আবদ্ধ, পেখমের মতো তালে তালে নাচিতেছে। চরণে ঘুঙুর বাজিয়া উঠিল।

রায় বলিয়া উঠিলেন, বাঃ!

সঙ্গে সঙ্গে নর্তকীর নৃত্য মুখর চরণচাপল্য স্থির হইয়া গেল। ওদিকে তবলায় পড়িল সমাপ্তির আঘাত।

মহিম সরিয়া আসিয়া রায়ের কানে বলিল, ঠাকুরদা আসর যে জমছে না, গলা শুকিয়ে এল। কৃষ্ণাবাই সব ঠাণ্ডা করে দিল যে!

কৃষ্ণাবাই ঈষৎ হাসিল, বোধ করি সে বুঝিল। অনন্ত সরবৎ আনিয়া মহিমের সম্মুখে ধরিয়াছিল। মহিম কহিল, থাক, কদিন রাত্রি জেগে সর্দি করে আছে আবার।

রায় ঈষৎ হাসিয়া অনন্তকে ইঙ্গিত করিলেন।

অনন্ত ফিরিয়া গিয়া বড় পরাতের উপর হুইস্কি, সোডার বোতল, গ্লাস লইয়া দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল।

পানীয় প্রস্তুত করিয়া অনন্ত মহিমকে দিয়া দ্বিতীয় গ্লাস তুলিয়া আসরের দিকে চাহিল। সকলে নতশির হইয়া বসিয়াছিল। সে বিশ্বম্ভরবাবুর সম্মুখে সসম্ভ্রমে পানীয় অগ্রসর করিয়া ধরিল। নীরবে রায় গ্লাসটি ধরিলেন। মহিম অনেকক্ষণ ধরিয়া তরুণী বাইজীটিকে লক্ষ্য করিতেছিল, একটু নড়িয়া বসিয়া বলিল, পিয়ারীবাই এবার তুমি একবার আগুন ছড়িয়ে দাও দেখি! পিয়ারী গান ধরিল। জলদ গতি, রায় চোখ মুদিয়া ছিলেন, একবার কেবল ফাঁকের ঘরে বলিলেন, জেরা ধীরসে।

কিন্তু অভ্যাসের বসে পিয়ারী চটুল নৃত্যে চপল সঙ্গীতে মজলিসের মধ্যে যেন অজস্র লঘু ফেনার ফানুস উড়াইয়া দিল। মহিম মুহুর্মুহু হাঁকিতে লাগিল, বহুত আচ্ছা!

রায় কর্তার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। মহিমের সঙ্গতি ছাড়া উচ্ছ্বাস তাহাকে পীড়া দিতেছিল।

কিন্তু তবু তিনি দুলিতেছিলেন সঙ্গীতমুগ্ধ অজগরের মতো। দেহের মধ্যে শোণিতের ধারা—রায়বংশের শোণিতের অত্যন্ত উগ্রতায় বেগবতী হইয়া উঠিয়াছে। পিয়ারী নাচিতেছে বিচিত্রবর্ণা প্রজাপতির মতো। পিয়ারিকে দেখিয়া মনে পড়ে লক্ষ্ণৌয়ের জোহরার কথা। কৃষ্ণার সঙ্গে সাদৃশ্যে দিল্লীওয়ালী চন্দ্রাবাইয়ের। চন্দ্রাবাই তাঁহার জীবনের একটা অধ্যায়। পিয়ারীর নৃত্য শেষ হইল। রায় ভাবিতেছিলেন অতীতের কথা। চিন্তা ভাঙিয়া গেল টাকার শব্দে। মহিম পিয়ারীকে বকশিশ দিল। মহিম নিয়ম ভঙ্গ করিয়াছে। প্রথম ইনাম দেবার অধিকার গৃহস্বামীর। চকিত হইয়া রায় সম্মুখে পাশে চাহিলেন। নাই—সম্মুখে রূপার পরাত নাই—আধারও নাই। মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া রহিলেন। কৃষ্ণাবাই তখন গান ধরিয়াছে। আসরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তরঙ্গের মতো তাহা উচ্ছ্বসিত হইয়া ফিরিতেছিল। তাহার গতি-তাড়িত বায়ু তরঙ্গ শ্রোতাদের বুকে আঘাত করিতেছে। সে গাহিতেছিল—কানাইয়ের বাঁশী বাজিয়াছে; উচ্ছ্বসিত যমুনা উজানে ফিরিল; তরঙ্গের পর তরঙ্গাঘাতে তটভূমি ভাঙিয়া কানাইয়াকে সে বুকে টানিয়া লইতে চায়। সে সঙ্গীত ও নৃত্যের উচ্ছ্বাস অপূর্ব! রায় সব ভুলিয়া গিয়াছিলেন? সঙ্গীত শেষ হইল। রায় বলিয়া উঠিলেন, বহুত আচ্ছা চন্দ্রা।

কৃষ্ণা সেলাম করিয়া কহিল, বাঁদীর নাম কৃষ্ণাবাই।

ওদিক হইতে মহিম ডাকিল, কৃষ্ণাবাই, থোড়া ইনাম ইধার।

রায় উঠিয়া পড়িয়াছিলেন। ধীর পদক্ষেপে মজলিশ অতিক্রম করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। বারান্দার বুকে পাদুকা শূন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল।

মহিম বলিলেন, পিয়ারীবাই, এবার তোমার আর একখানা।

কৃষ্ণা কহিল, হুজুর-বাহাদুরকে আনে দিজিয়ে।

মহিম বলিল, আসছেন তিনি, তার আর কী! ওই—ওই বোধহয় আসছেন তিনি?

রায় নয়—প্রবেশ করিল নায়েব মশাই তারাপ্রসন্ন। একটি রূপার রেকাব আসরে সে নামাইয়া দিল। রেকাবের উপর দুইখানি মোহর।

নায়েব বলিল, বাবু ইনাম দিলেন।

মহিম অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, তিনি কই?

তাঁর বুকে ব্যথা ধরেছে। তিনি আর আসতে পারবেন না। আপনারা গান শুনুন। তিনি মাফ চেয়েছেন সকলের কাছে।

মজলিসের মধ্যে অস্ফুট একটা গুঞ্জন উঠিল।

মহিম উঠিয়া তাচ্ছিল্যময় আলস্যভরে একটা আড়মোড়া ভাঙিয়া বলিল, উঠি তারাপ্রসন্ন। কাল আবার সাহেব আসবেন।

তারাপ্রসন্ন আপত্তি করিল না। অপর সকলেও উঠিয়া পড়িল। মজলিস ভাঙিয়া গেল।

ঘরের মেঝের উপর রায় গিন্নীর হাতবাক্সটা খোলা পড়িয়া ছিল। গর্ভ তাহার শূন্য। রায় নিজে ভ্রূক্ষেপহীনভাবে ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন উন্নত শিরে। রায় বাড়ির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় নাই। উত্তেজনায়, সুরার উগ্রতায় দেহের রক্ত যেন ফুটিতেছিল। স্থান কাল আজ সব উলট-পালট হইয়া গিয়াছে। অন্যমনস্ক ভাবে তিনি ঘরের বাহির হইয়া পড়িলেন। জলসাঘরের আলোকের দীপ্তি তাঁহাকে আকর্ষণ করিল। আবার আসিয়া তিনি জলসাঘরে প্রবেশ করিলেন। শূন্য আসর। দেওয়ালের বুকে শুধু জাগিয়া আছেন রায়বংশধরগণ। বিশ্বম্ভর খোলা জানলার দিকে চাহিলেন। জ্যোৎস্নায় ভুবন ভরিয়া গিয়াছে। বসন্তের বাতাসে সর্বাঙ্গে মুচকুন্দ ফুলের গন্ধ মাখা। কোথায় কোন গাছে বসিয়া একটা পাপিয়া অশ্রান্ত ঝঙ্কার তুলিয়া ডাকিতেছে, পিউ-কাঁ-হা—পিউ-কা-হাঁ। রায়ের মনের মধ্যে সঙ্গীত গুঞ্জন উঠিল। বহুদিনকার ভুলিয়া যাওয়া চন্দ্রার মুখের বেহাগ—শুনু যা শুনু যা পিয়া—। মাথার উপরে দেখিলেন চাঁদ মধ্য-গগনে। পদশব্দে পিছনে ফিরিলেন। অনন্ত বাতি নিভাইবার উদ্যোগ করিতেছে।

রায় নিষেধ করিলেন, বলিলেন, থাক!

অনন্ত চলিয়া যাইতেছিল। রায় ডাকিলেন, এস্রাজটা এনে দে আমার।

অনন্ত এস্রাজ লইয়া আসিল! জানালার সম্মুখে এস্রাজ-কোলে রায় বসিয়া বলিলেন, ঢাল।

পরাতের উপর খোলা বোতল পড়িয়াছিল—রায় ইঙ্গিত করিয়া দেখাইয়া দিলেন। পানীয় দিয়া অনন্ত চলিয়া গেল।

এস্রাজের তারের বুকে ছড়ির টান পড়িল। নিস্তব্ধ পুরীর মধ্যে সুর জাগিয়া উঠল। বিভোর হইয়া রায় এস্রাজ বাজাইয়া চলিয়াছেন। এস্রাজ কি কথা কহিয়া উঠিল? মৃদু ভাষা যে স্পষ্ট শোনা যায়।

গানের কথাগুলি রায়ের কানে বাজিতেছিল—নিশীথরাত্রের হতভাগিনী বন্দিনী, দুয়ারের পাশে প্রহরায় জাগিয়া বিষাক্ত ননদিনী, নয়নে আমার নিদ্রা আসে না, নিদ্রার ভানে আমি তোমারই রূপ ধ্যান করি; হে প্রিয়, এ সময়ে কেন বাঁশী বাজাইলে?

রায় এস্রাজ ঠেলিয়া দাঁড়াইলেন।

মৃদুস্বরে তিনি ডাকিতেছেন, চন্দ্রা—চন্দ্রা।

তাঁহার চন্দ্রা। এ গানও যে চন্দ্রার। বাহির হইতে মিঠা গলায় কে ডাকিল, জনাব।

রায় ব্যগ্রভাবে ডাকিলেন,—চন্দ্রা—চন্দ্রা, আও ইধার আও। দোস্ত চল গিয়া। চন্দ্রা!

কৃষ্ণা স্মিত সলজ্জ মুখে আসিয়া অভিবাদন করিয়া অতি মধুর করিয়া যে গানটি তিনি এস্রাজে বাজাইতেছিলেন, তাহার শেষ চরণ গাহিল—হে প্রিয়, এ সময়ে কেন তুমি বাঁশী বাজাইলে? হাসিয়া রায় তাঁহার মোটা গলা যথাসম্ভব চাপিয়া গান ধরিলেন, ওগো প্রিয়া, এমন রাত্রি, বুকে আমার বিজয়োল্লাস, একা কি আজ থাকা যায়?

রায় বোতলের ছিপি খুলিতেছিলেন। হাত বাড়াইয়া কৃষ্ণাবাই বলিল, জনাবকে হুকুম হোয়ে তো বাঁদী দে শক্তে হেঁ! মৃদু হাসিয়া বোতল ছাড়িয়া দিলেন। কৃষ্ণা বোতল খুলিয়া দিল। মদ ঢালিয়া গ্লাস রায়-বাবুর হাতে তুলিয়া দিল।

আবার এস্রাজের সুর উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা মৃদুস্বরে গান ধরিল। কৃষ্ণা গাহিতে গাহিতে নাচিতে আরম্ভ করিল। সে গাহিল—হে প্রিয়, ঝরা ফুলের মালা গাঁথি না; উচ্চ শাখায় ঐ যে ফুলের স্তবক, ওই আমায় দাও; আমায় তুমি তুলিয়া ধর, আমি নিজে চয়ন করিব তোমার জন্য। ঊর্ধ্বমুখে হাত দুইটি তুলিয়া সে নাচিতেছিল। রায় এস্রাজ ফেলিয়া টপ করিয়া হাতের মুঠোতে কৃষ্ণার পা দুইটি ধরিয়া উচ্চে তুলিয়া তালে তালে তাহাকে নাচাইয়া দিলেন। গান শেষ হইল। কৃষ্ণা পড়িয়া যাইবার ভানে চীৎকার করিয়া উঠিল। পরমুহূর্তে সে নামিয়া পড়িল। সুরামত্ত রায় আদর করিয়া ডাকিলেন, চন্দ্রা—চন্দ্রা পিয়ারী!

গানের পর গান চলিল। সঙ্গে সঙ্গে সুরা। একটা বোতল শেষ হইয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় বোতলটাও শেষ হয় হয়! একটু পরেই বাইজীর অবশ দেহ এলাইয়া পড়িল—ফরাসের উপর। বিশ্বম্ভর তখনও বসিয়া—মত্ত নীলকণ্ঠের মতো। বাইজীর অবস্থা দেখিয়া ঈষৎ হাসিলেন। একটা তাকিয়া সযত্নে তাহার মাথায় দিয়া ভাল করিয়া তাহাকে শোয়াইয়া দিলেন। তারপর এস্রাজ লইয়া টানিয়া বাজাইতে আরম্ভ করিলেন। দ্বিতীয় বোতলটা শেষ হইতে চলিল। কিন্তু রাত্রি শেষ হইল না। এমন সময় গাঙ্গুলী বাড়ির ঘড়ি বাজিয়া উঠিল, ঢং-ঢং-ঢং।

রায়বাড়ির খিলানে খিলানে পারাবতের গুঞ্জন উঠিল। রায়ের চমক ভাঙিল। নিত্য এই শব্দে নিদ্রা ভাঙে—তিনি উঠিয়া পড়িলেন। একবার শুধু নিদ্রিত কৃষ্ণাকে আদর করিলেন, চন্দ্রা—চন্দ্রা—পিয়ারী! তারপর বারান্দার বাহিরে আসিয়া তিনি ডাকিলেন, অনন্ত!

অনন্ত গিয়াছিল ছাদের প্রভুর জন্য তাকিয়া-গালিচা পাতিতে। নিচে নামিয়া আসিতেই রায় তাহাকে বলিলেন, পাগড়ির চাদর, সওয়ারের পোশাক দে। নিতাইকে বলে দে তুফানের পিঠে জিন দিতে—জলদি।

সবিস্ময়ে অনন্ত প্রভুর মুখের দিকে চাহিল, দেখিল, রায় গোঁফে চাড়া দিতেছেন। এ মূর্তি তাহার অপরিচিত নয়, কিন্তু বহুদিন, দেখে নাই। সে মৃদুস্বরে বলিল, মুখে হাতে জল দিন।

কিছুক্ষণ পরেই তুফানের হ্রর্ষপূর্ণ হ্রেষায় শেষ রাত্রির বুক ভরিয়া উঠিল। তারাপ্রসন্নের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। জানালা হইতে সে দেখিল তুফানের পিঠে বিশ্বম্ভর রায়। পরণে চোস্ত পায়জামা, গায়ে আচকান, মাথায় সাদা পাগড়ী। অন্ধকারে সম্পূর্ণ না দেখিলেও তারাপ্রসন্ন কল্পনা করিল, পায়ে জরিদার নাগরা, হাতে চামর-দেওয়া চাবুক। তুফান নাচিতে নাচিতে বাহির হইয়া গেল।

মাঠের পর মাঠ অতিক্রম করিয়া ধূলার ঘূর্ণি উড়াইয়া তুফান তুফানের বেগে ছুটিতেছিল। শেষরাত্রির শীতল বায়ু হু হু করিয়া রায়ের উত্তপ্ত ললাট স্পর্শ করিতেছিল। সুরার উগ্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হইয়া আসিতেছিল। প্রান্তর শেষ হইয়া গ্রাম—গ্রামখানার নাম কুসুমডিহি। পাশ দিয়া তরকারি-বোঝাই একখানা গাড়ি চলিয়াছে। আরোহী তাহাতে দুইজন। বোধহয় তাহারা হাটে চলিয়াছিল। কয়টা কথা তাঁহার কানে আসিয়া পৌঁছাইল, গাঙ্গুলীবাবুরা কিনে থেকে—

রায় সজোরে লাগাম টানিয়া তুফানের গতিরোধ করিলেন।

তখনও গাড়ির আরোহী বলিতেছিল, খাজনা দিয়ে লাভ কিছু আর থাকে না। সুখ ছিল রায়-রাজাদের আমলে—

চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া রায় চমকিয়া উঠিলেন।

তুফানের পিঠের উপর! কোথায়!—এ তিনি কোথায়? ক্রমে চিনিলেন, হারানো লাট কীর্তিহাট সম্মুখে। মুহূর্তে সোজা হইয়া লাগাম টানিয়া তুফানকে ফিরাইয়া সজোরে তাহাকে কশাঘাত করিলেন, আবার কশাঘাত, তুফান বিপুল বেগে ছুটিল। আস্তাবলের সম্মুখে আসিয়া রায় চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, পূর্বদিকে আলোর রেশ ফুটিতেছে। রজনী এখনও যায় নাই।

রায় ডাকিলেন, নিতাই!

তিনি হাঁপাইতেছিলেন। অনুভব করিলেন, তুফানও থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। রায় নামিয়া পড়িলেন। দেখিলেন, লাগামের টানে তুফানের মুখ কাটিয়া গিয়াছে। তাহার সমস্ত মুখটা রক্তাক্ত। শ্রান্ত তুফান কাঁপিতেছিল। রায় তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, বেটা—বেটা!

তুফান মুখ তুলিতে পারিল না। সুরার মোহ বোধ করি তখনও তাঁহার সম্পূর্ণ যায় নাই। বলিলেন, ভুল বেটা, তোরও ভুল, আমারও ভুল। লজ্জা কী, বেটা তুফান! ওঠ ওঠ।

নিতাই পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল। সে বলিল, বড় হাঁপিয়ে পড়েছে, ঠাণ্ডা হলেই উঠবে।

চকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া রায় দেখিলেন, নিতাই। নিতাইয়ের হাতে তুফানকে দিয়া ত্বরিতপদে রায় বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দ্বিতলে উঠিয়া দেখিলেন, জলসাঘর তখনও খোলা। উঁকি মারিয়া দেখিলেন, ঘর শূন্য, অভিসারিকা চলিয়া গিয়াছে। সুরার শূন্য বোতল আসরে গড়াগড়ি যাইতেছে। ঝাড়-দেওয়ালগিরির বাতি তখনও শেষ হয় নাই। এখনও আলো জ্বলিতেছে। দেওয়ালের গায়ে দৃপ্ত রায়বংশধরগণ, মুখে মত্ত হাসি। সভয়ে রায় পিছাইয়া আসিলেন। সহসা মনে হইল, দর্পণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিয়াছেন—মোহ! কেবল তাঁহার নহে, সাত রায়ের মোহ ওই ঘরে জমিয়া আছে।

দরজা হইতেই তিনি ফিরিলেন। রেলিঙে ভর দিয়া ভীতার্তের মতো তিনি ডাকিলেন, অনন্ত—অনন্ত!

অনন্ত সাড়া দিয়া ছুটিয়া আসিল। প্রভুর এমন কণ্ঠস্বর সে কখনও শোনে নাই। সে আসিয়া দাঁড়াইতেই রায় বলিয়া উঠিলেন, বাতি নিবিয়ে দে, বাতি নিবিয়ে দে—জলসাঘরের দরজা বন্ধ কর—জলসাঘরের—

আর কথা শোনা গেল না। হাতের চাবুকটা শুধু সশব্দে আসিয়া জলসাঘরের দরজায় আছড়াইয়া পড়িল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *