জলছবি

জলছবি

আমরা তখন সকলে সবিস্ময়ে সেই উঁচু ঢিবির দিকে তাকিয়ে রইলুম। দিগন্তে তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। সারা আকাশ তামাটে লাল। সেই সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে ওরা দু-জনে বসে আছে। মেয়েটির মাথা রয়েছে ছেলেটির কাঁধে। ছেলেটির হাত মেয়েটির কোমর জড়িয়ে রয়েছে। আমরা যারা ছুটি কাটাবার জন্যে সেই প্রান্তরে সমবেত হয়েছিলাম, কাঁধে জলের ফ্লাস্ক, হাতে খাবারের বাস্কেট নিয়ে, তারা এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যথেষ্ট রোমান্টিক অথচ একেবারে নির্লজ্জ সেই দৃশ্য দেখে মুখে খুব ছি ছি করলেও মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আমরা অনেকেই সেই মুহূর্তে কল্পনায়, ছেলেটিকে মেয়েটির পাশ থেকে সরিয়ে নিজেদের পাশে বসবার চেষ্টা করছিলাম।

আমরা যারা সেই প্রান্তরে শুধুমাত্র সূর্যাস্ত দেখবার জন্যে সমবেত হয়েছিলাম তারা সকলেই প্রথামত সূর্যাস্তের দিকে চোখ রাখলেও বস্তুত সেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ের ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ জড়াজড়ি ইত্যাদি দেখছিলাম। এমনও হতে পারে তখন সেই শেষবেলায় আমরা সারাদিনের ক্লান্তির লাভ খতিয়ান নিতে নিতে শুধুমাত্র সূর্যাস্তই, শুধুমাত্র আকাশে চাপা আগুন অথবা রঙের ছড়াছড়িই যখন যথেষ্ট নয় ভাবতে শুরু করেছিলাম তখন ওই অদূরে একটি রোমাঞ্চকর দৃশ্যকে আজকের লাভের খতিয়ানে ধরে একটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলাম।

পলিথিনের পাতলা জাজিমে আমরা পাশাপাশি কয়েকজন। হাতে প্লাস্টিকের কাপে প্রায় ঠাণ্ডা সরপড়া কফি, ফ্লাস্কের শেষ তলানি, দাঁতের আগায় দিন-শেষের স্যাণ্ডউইচ। এইরকম সব ছোটো বড়ো মাঝারি জটলা সেই সবুজ প্রান্তরের এখানে সেখানে। দূরে দূরে নানা রঙের অচল মোটরগাড়ি আর একটু পরেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের চেনা পরিবেশে।

তারপর সেই নির্জন অথবা প্রায় নির্জন প্রান্তরে কাগজের কাপ, ডোরাকাটা স্ন্যাকসের প্যাকেট, হয়তো একটি দু-টি চুলের কাঁটা অথবা দলিত গোলাপ কিংবা কোনো দলাপাকানো সুগন্ধী রুমাল, এখানে-ওখানে পড়ে থাকবে রাতের আকাশের তলায়। তারপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির নেমে আসবে ঘাসের ডগায়।

কিন্তু যাই বলুন মশাই, এটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে নাকি?

এগজ্যাক্টলি, আরও তো অনেকেই এসেছেন জোড়ায় জোড়ায়, কিন্তু কই এমন ঢঙে বসে বেলেল্লাপানা তো আর কেউ করছে না। কীরকম একটা বেপরোয়া ভাব দেখেছেন, ডোন্ট কেয়ার? গাঢ় লাল আকাশের পটভূমিকায় দুটি সিল্যুয়েট আমরা বেশ দেখতে পাচ্ছি। দু-টি মুখ কত কাছাকাছি, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকে যাচ্ছে নাকি?

বুঝলেন আসলে ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়। কিছুতেই নয়। এসব ঘটনা প্রকৃতপক্ষে শোবার ঘরে চাপা আলোতে অলক্ষ্যেই হওয়া উচিত।

আর একটা কী, মানে সত্যি কথা বলতে কী, আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীতে কোনো মিল থাকে না। আমার পেটে মশাই কোনো কথা থাকে না, আমি এসব ব্যাপারে ভীষণ ফ্র্যাঙ্ক। জানেন আমরা দু-জনে আজ দশ বছর ধরে আলাদা শুচ্ছি। ঠোঁট কোথায় পাই বলুন যে চুম্বন ইত্যাদি ইচ্ছে হলেই করব।

মশাই ওসব পারিবারিক ব্যাপার আর নাই বা তুললেন অন্তত আজকের দিনে এই জায়গায়।

সে আপনি যাই বলুন মশাই কিন্তু কেন, পারিবারিক বলছেন কেন? এসব ঘটনা তো আমার পরিবারেই শুধু নয়, সব পরিবারেই প্রায় ছড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটাকে এখন একটা যাকে বলে ইউনিভার্সাল ব্যাপার বলা যায়।

আমার অবশ্য কথার মাঝে কথা বলা উচিত নয়, তবে ফ্র্যাঙ্কলি বলুন তো আমরা ক-জন সস্ত্রীক এসেছি?

আমি আসতাম, আমার স্ত্রী প্রায় সাজগোজ করেই ফেলেছিলেন এমন সময় না, সেই কোলের মেয়েটা যেটা এই সবে বছর খানেক হয়েছে ককিয়ে কেঁদে উঠল।

ইস কোলে মেয়ে। কোলে মেয়ে থাকলে স্ত্রীদের গ্ল্যামার নষ্ট হয়ে যায়। সেসব স্ত্রী নিয়ে আর বেড়ানো চলে না।

বেশ বললেন যা হোক। যাঁরা সস্ত্রীক এসেছেন তাঁদের স্ত্রীরা কী সব বাঁজা?

যাক গে যাক গে। ওদিকে দেখো। অবস্থা একেবারে ঘনীভূত। আমার কিন্তু জানেন, ব্যক্তিগতভাবে বলছি এই দৃশ্য দেখে মনটা ভীষণ সন্তুষ্ট হচ্ছে। আমি জানেন এই কফির কাপ ছুঁয়ে দিব্যি করছি—আজ থেকে আমার স্ত্রীকে আমি খুব ভালোবাসব। খাটের পাশে আজ রাতে দু-জনে ঠিক অমনি করে বসব। মিথ্যে বলব না বাইরে খোলা জায়গায় সকলের চোখের সামনে পারব না, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করবে। আমার শোবার ঘরে আমার স্ত্রীকে আমি অমনিভাবে বেষ্টন করে থাকব।

কেন মিথ্যে বলছেন? নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ওই সব ঢং করতে গেলে, সোজা তার কাছ থেকে জুতোই খাবেন। স্ত্রীদের মুখ যখন ছোটে না তাদের দিগবিদিক জ্ঞান থাকে না!

তাহলে ওসব পরস্ত্রীর জন্যেই তোলা থাক বলছেন।

ও মেয়েটা মশাই বেশ্যা। দেখছেন না কীরকম আম্রপালীর মতো চেহারা?

কারেক্ট, স্ত্রীদের চেহারায় মশাই এত শ্রী থাকে না। সংসার রূপ কটাহে পড়ে, আমাদের স্নেহের অত্যাচারে, তারপর কিনা ওই সব পারিবারিক উৎপাতে একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে যায়।

মানে বলতে চাইছেন, কাছে এলে, চোখ বুজিয়ে আগে ভেবে নিতে হয় যেন কোনো পরস্ত্রী এসেছে, তবেই একটু উৎসাহ পাওয়া যায়।

দেখবেন ওরা যা আরম্ভ করেছে একটু পরেই না একটা পুলিশ এসে ওদের অ্যারেস্ট করবে, পেনালাইজ করে দেবে, পাবলিক প্লেসে এই সব নুইসেন্স, অ্যাঁ।

পুলিশ! হা: হা:। মশাই ঝট করে এতখানি একটা নোট ছেড়ে দেবে ব্যাস সব অন্যায় ন্যায় হয়ে যাবে। টাকায় কী না হয় মশাই, গাড়ি হয়, বাড়ি হয়, ভালোবাসা হয়, নাম হয়, যশ হয়, গোরুও মানুষ হয়।

কেবল একটা জিনিস হয় না, আধ্যাত্মিক উন্মেষ।

আধ্যাত্মিক! কোথা থেকে কোথায় চলে এলেন। শোবার ঘর থেকে মন্দিরে।

দেখো না হে বাস্কেটে আর স্যাণ্ডউইচ আছে কিনা?

এখানে সব ছোট ছোট ছেলেরা দৌড়োদৌড়ি করছে, তাদের চোখের সামনে এই সব নারকীয় দৃশ্য। দেশটা কী হয়ে গেল বলুন তো?

ওরা মশাই ও সব বোঝে না। আপনার চোখ তো ওখানেই আটকে আছে কারণ আপনি ওই রসের রসিক।

কী বলছেন কী? আজকালকার ছেলেরা সব বিচ্ছু। আমার বড়ো ছেলেটা হার্ডলি দশ বছর। কী বলেছে জানেন একদিন তার মাকে—তোমাদের খাটে একটু তেল দিও, রাত্তিরে আওয়াজে আমার ঘুমের অসুবিধে হয়।

হ্যা হ্যা হ্যা শালা কী কান্ড!

তবে কী জানেন এ ভালো হচ্ছে, ভালোই। সেক্স সম্বন্ধে আগেভাগেই জ্ঞান হয়ে গেলে অনেক ঝামেলা কমে যায়।

কী জানি মশাই! আমার তো বিয়ের আগে পর্যন্ত প্রজনন সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই ছিল না। আমি মনে করতুম, ছি, ছি, এখন এই দু-ছেলের বাপ হয়ে বলতে লজ্জাই করে—মুখ দিয়ে কিছু খেলে তবেই বোধ হয়?

থাক থাক আর বলতে হবে না। পশ্চিম আকাশের রং বদলাচ্ছে, ক-টা বাজল বলুন তো?

আর কী? হয়ে গেল। এইবার ফেরার পালা। এইবার আমরা সব চলে যাব।

আচ্ছা কী ব্যাপার বলুন তো, ওই ভদ্রলোক তখন থেকে ক্রমান্বয়ে ওদের ছবি তুলে যাচ্ছেন নানা দিক থেকে!

কী করে বলব বলুন। আমিও তো আপনার মতোই এখানে আউটিং-এ এসেছি।

দিস ইজ ভেরি অবজেকসানেবল—কী বলেন? ওরা না হয় মশগুল হয়ে আছে, কিন্তু টের পেলে ক্যামেরা-ফ্যামেরা ভেঙে বারোটা বাজিয়ে দেবে। কেসও করতে পারে।

ওই দেখুন ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে। আরেব্বাস—এবার একেবারে ম্যাকসিমাম। ওই দেখুন, ওই দেখুন মেয়েটা কেমন বর্ষার উন্মুক্ত ফুলের মতো মুখ তুলেছে আর ছেলেটা যেন বৃষ্টির জলের মত ওর মুখের দিকে ঠোঁট নামিয়ে আনছে।

ইস দৃশ্যটা যা হয়েছে যেন ছবি! মশাই জীবনে যে এমন ঘটনা ঘটে, কারুর জীবনে ঘটে এ ধারণা আমার ছিল না।

এইবার দেখছেন, ক্যামেরা-ভদ্রলোক যেন ক্ষেপে গেছেন। ওরা যেমন জমিয়ে জড়াজড়ি করছে ইনিও তেমনি, জমিয়ে ছবি তুলছেন।

দাঁড়ান ভদ্রলোককে একটু চেক করে দি।

কী মশাই—এত ছবি তোলার কী আছে অ্যাঁ।

এই সব ব্যাপার কী এনকারেজ করার জিনিস! বয়স থাকলে মশাই ওই দুটোকে পিটিয়ে ওই ঢিবি ছাড়া করতুম। মশাই ছেলে-মেয়ে নিয়ে এলুম একটা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখব বলে। মশাই তাকানো যায় না।

ইয়ে ইয়েস, আর একটু…একটু ফাইন স্ন্যাপ। যা এল না, মারভালাস। আরে থামুন মশাই কানের কাছে বকবক করবেন না। এইবার, বাআআস, কমপ্লিট। হ্যাঁ বলুন—কী বলছিলেন?

বলছিলাম, ছবি তুলছিলেন, মানে ছবি তুলছিলেন কেন?

সে কি মশাই? হা: হা: সিগারেট চলবে? সারাদিন যা পরিশ্রম গেল, বাপস। এইটা হল লাস্ট শট—ফাইন এসেছে মশাই। পেছনে ব্রোঞ্জ রঙের আকাশ, আর সামনে সিল্যুয়েটে হিরো হিরোইন এমনি করে দাঁড়িয়ে টেরিফিক! যেমন ডিরেকশান, তেমনি ক্যামেরা ইস্টম্যান কালার।

মানে এটা নিয়ে কী বলে সিনেমা হবে?

তবে কী? জলছবি, ছায়াছবি, ছায়াছবি, হুঁ-হুঁ। প্যাক আপ কল্যাণ। স্ট্রেট টু হোটেল। একটু সরে দাঁড়ান স্যার—অ্যা অ্যা দ্যাটস ফাইন।

আরে মশাই দেখেছেন! জীবন সার্থক। অতবড় হিরো-হিরোইনকে চোখের সামনে এতক্ষণ দেখলুম। ছি ছি, আমরা এতক্ষণ কি যা তা বলছিলুম অ্যাঁ!

আমি আগেই বলেছিলাম—এসব সাধারণ লোক নয়। আরে ভাই দেশ এখনও অত অনাচারী হয়ে ওঠেনি। কী জেনুইন অভিনয়, তাই না, যেন রিয়েল লাইফ ড্রামা।

আমার স্ত্রী ওদিকে ছিলেন তা না হলে দেখতেন, ও ভীষণ ফ্যান, একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। সত্যিকথা বলতে কী আমার একটু জেলাসিই আছে। আমি ওই নায়কের বই সাধারণত দেখতে চাই না।

আমার ছেলে মশাই বাচ্চা, খুব বড়ো নয়। একদিন দেখি কী মশাই ওর জামার পকেট থেকে বেরোলো একটা ছবি, সে ছবি মশাই ওই হিরোইনের।

ওই দেখুন সাদা বিরাট বড়ো গাড়িতে ওরা চলে গেল। যেন একটা সাদা হাঁস। কী জীবন তাই না!

কিন্তু দেখছেন জীবনটা ভীষণ ‘হল’। এই অভিনয় করছে, হাসছে, কাঁদছে, কিন্তু কোনোটাই রিয়েল নয়, যেন আলুনি তরকারি।

মানে অনেকটা এই যখন আমরা সব একে একে চলে যাব তখন যেমন এই বিশাল প্রান্তর শূন্য পড়ে থাকবে, তেমনি ওদের মন—একেবারে ফাঁকা কেউ কোথাও নেই।

তাহলে আমরা এবার উঠতে পারি। এই পলিথিন-মলিথিন সব গুটিয়ে ফেলা যাক। আবার কোনোদিন আসব আমরা এইখানে সূর্যাস্ত দেখতে।

একটি দু-টি করে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে গেল। কাঁধে ক্যামেরা, বাইনাকিউলার অথবা ফ্লাস্ক কিংবা সাইডব্যাগ ঝোলানো কিছু মেয়ে-পুরুষ সেই ঝাপসা অন্ধকারে অস্পষ্ট গুঞ্জন তুলে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *