জলকন্যা

ভলিউম ১৩ – জলকন্যা – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : ৪ আগস্ট, ১৯৯১

০১.

গেল-রে, গেল, আবার হারালো! চিৎকার করে চত্বর ধরে ছুটে এলো মহিলা। কিটুটা আবার গায়েব! মহিলার বয়েস অল্প। সুন্দরী। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। মিস্টার ডেজার, ওকে খুঁজে পাচ্ছি না!

বেঞ্চে বসে তিন কিশোরের সঙ্গে গল্প করছেন মিস্টার ডেজার। বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন। দুত্তোর! একটা মুহূর্তের জন্যে কি স্থির থাকতে পারে না ছেলেটা!

 উঠে এগিয়ে গেল মহিলার দিকে। এতে অস্থির হচ্ছো কেন, নিনা? ডব তো সঙ্গেই রয়েছে তার। ও-ই দেখবে।

ডব যায়নি, ঘুমোচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে চোখ সরিয়েছিলাম কিটুর ওপর থেকে, অমনি পালালো!

পরস্পরের দিকে তাকালো বেঞ্চে বসা তিন কিশোর।

আপনার ছেলে? মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো একজন। তার মাথা ভর্তি কোকড়া চুল। সুন্দর দুই চোখে বুদ্ধির ছটা। বয়েস কতো?

পাঁচ, জবাব দিলো নিনা। একা একা গেল, কোথায় যে হারায়…

বেশি দূরে যায়নি, বাধা দিয়ে বললেন ডেজার। দেখি, ওশন ফ্রন্টের দিকটায় খুঁজে। তুমি ওদিকে যাও, আমি মেরিনার দিকে যাচ্ছি। পেয়ে যাবো।

দুজন দুদিকে খুঁজতে চলে গেল।

পাঁচ বছর, বললো তিনজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক কিশোরটি। হালকা-পাতলা রোগা শরীর তার। কিশোর, কাণ্ডটা দেখেছো! আজব চরিত্র এখানে। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে একা ছাড়লো কিভাবে?

অজান্তে পালালে কি করবে? চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কিশোর পাশা।

তিন বন্ধু মিলে ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনিস শহরটা দেখতে এসেছে ওরা। শুধু দেখতে এসেছে বললে ভুল হবে, কাজও আছে এই উপকূলীয় শহরে। বাজারের পার্কিং লটে সাইকেল রেখে হেঁটে এসেছে চওড়া সৈকতের কিনারে। দেখার অনেক কিছু আছে এখানে। কারনিভল চলছে। খোলা জায়গায় দড়াবাজির খেলা চলছে। সাইকেলের খেলা থেকে শুরু করে সার্কাসের আরও নানা রকম খেলা শেখ কয়েকটা মেয়ে। বাঁশি বাজাচ্ছে স্ট্রীট মিউজিশিয়ান। তার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক আইসক্রীমওয়ালা। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকজন ভাঁড়। একধারে গম্ভীর মুখে বসে লোকের ভাগ্য গণনা করছে এক জ্যোতিষ।

উৎসব চলছে ভেনিসের পথে। খেলা যেমন চলছে, তেমনি চলছে মদ আর জুয়ার আড্ডা। এক জায়গায় বসে একটা বোতল থেকেই পালা করে মদ খাচ্ছে তিন ভবঘুরে। হই চই শোনা গেল। কি ব্যাপার? একটা লোককে পুলিশে ধরেছে, বেআইনী ড্রাগ বিক্রি করছিলো সে। আরেক দিকে বগলে একটা বাক্স নিয়ে দৌড় দিলো একটা লোক। তার পেছনে চোর! চোর! ধরো! ধরো! বলে চিৎকার করে ছুটলো আরেকজন। নিশ্চয় কোনো দোকানের মালিক।

ভেনিসের মজার উৎসব সম্পর্কে যেমন শুনেছে কিশোর, তেমনি এর বদনামও অনেক শুনেছে সে। সৈকতের কাছে পিয়ারের নিচে বাস করে অনেক না-খেতে পাওয়া মানুষ। চোর, গুণ্ডা, বদমাশের স্বর্গ হয়ে উঠেছে জায়গাটা। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে এখানে ঘুরতে দেয়া নিতান্তই বিপজ্জনক।

বন্ধুদের দিকে তাকালে কিশোর। একটা কিছু সিদ্ধান্ত নেবে সে, এই আশায়ই তার দিকে চেয়ে রয়েছে রবিন আর মুসা। নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছে।

হাসি ফুটলো অবশেষে গোয়েন্দা প্রধানের মুখে। বললো, মনে হচ্ছে, আরেকটা কেস এসে গেল হাতে। চলো, আমরাও খুঁজি।

ওশন ফ্রন্ট ধরে এগোলো তিনজনে। বৃদ্ধ মিস্টার ডেজার কিংবা কিটুর মায়ের চেয়ে খোঁজার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা তাদের অনেক বেশি, ফলে ওদের কাজটাও হলো। অনেক নিখুঁত। খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো। তাকালো স্তূপ হয়ে থাকা ময়লার ওপাশে। খালিপায়ে সৈকতে হাঁটাহাঁটি করছে অনেক ছেলেমেয়ে, ওদের। সঙ্গে কথা বললো। ওশন ফ্রন্টে এসে পড়া সমস্ত গুলি উপগলিতে খুঁজলো। এমনকি স্পীডওয়ে আর প্যাসিফিক অ্যাভেনিউও বাদ দিলো না।

ওরকম একটা নিরালা পথেই এক বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে দেখা গেল ছেলেটাকে। একটা বাদামী রঙের বেড়ালের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। আলোচনাটা চলছে একতরফা। বকবক করে যাচ্ছে ছেলেটা, আর বেড়ালটা চোখ মুদে আদির খাচ্ছে। ছেলেটার চুল আর চোখ দুইই কালো, নিনার মতো।

এগিয়ে গেল কিশোর। এই, তোমার নাম কিটু?

জবাব দিলো না ছেলেটা। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো।

 তুমি এখানে, আবার বললো কিশোর। আর তোমার মা ওদিকে খুঁজে মরছে। চলো।

আরেক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো, আচ্ছা।

কিটুর হাত ধরে তাকে নিয়ে চললো কিশোর। সাথে চললো রবিন আর মুসা। চত্বরে আসতেই প্রথম দেখা হলো মিস্টার ডেজারের সঙ্গে। চোখেমুখে দারুণ। উত্তেজনা আর উল্কণ্ঠার ছাপ। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে কিটুর হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, এই দুষ্টু ছেলে, কোথায় গিয়েছিলি! তোর মা ওদিকে পাগল হয়ে গেছে!

পাগল মা-ও এসে হাজির হলো। প্রথমে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো, তারপর গেল রেগে। কাধ ধরে জোড়ে জোড়ে ঝুঁকি দিয়ে বললো, এই, কোথায় গিয়েছিলি! বল, কোথায়! না বলে আবার যদি যাস…! কি করবে কথাটা উহ্য রাখলো নিনা।

এই হুমকি মোটেও গায়ে মাখলো না কিটু। তবে তর্ক না করার মতো বুদ্ধি তার আছে। চুপ করে রইলো।

নিজেদের পরিচয়, অর্থাৎ নাম বললো তিন গোয়েন্দা। কিটুর মা-ও তার পরিচয় জানালো। পুরো নাম নিনা হারকার। ছেলেকে ফিরে পেয়ে উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেছে। হঠাৎ তাই হালকা হয়ে গেল মেজাজ। ছেলেদেরকে নিয়ে চলে এলো সেই চত্বরে, যেখানে খানিক আগে গল্প করছিলো তিন গোয়েন্দা। চত্বর দিয়ে ঘিরে ইংরেজী U অক্ষরের মতো করে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো পাকা বাড়ি। ইউ-র দুই প্রান্তে বেশ কিছু দোকানপাট। বয়ের প্রথম দোকানটার দিকে এগোলো নিনা। বইয়ের দোকান ওটা, নাম রীডারস হেভেন।

ভেতরে খরচের খাতা দেখছেন বছর ষাটেকের এক বৃদ্ধ। নাম হেনরি বোরম্যান। পরিচয় করিয়ে দিলো নিনা। ভদ্রলোক তার বাবা। দুজনে মিলে বইয়ের দোকানটা চালায়।

মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে শুয়ে থাকা একটা বিশাল কুকুরের দিকে এগিয়ে গেল কিটু। ওটার নামই ডব, বুঝতে অসুবিধে হলো না গোয়েন্দাদের। ডবের ধমনীতে বইছে মিশ্র রক্ত। বাবার জাত গ্রেট ডেন, মা লাব্রাডর। কিটুকে এগোতে দেখে নড়েচড়ে উঠে বসলো, থুতনি রাখলো ছেলেটার কাঁধে।

দেখছিস কি রকম করছে! নিনা বললো। ওকে ফেলে যেতে লজ্জা করে না তোর?

ও ঘুমোচ্ছিলো। কারো ঘুম ভাঙানো কি ঠিক?

বড় বড় কথা শিখেছে! আরেক দিন ওরকম করে কোথাও যাবি তো বুঝবি মজা।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার ডেজার। কাঁধ দিয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো মাঝবয়েসী একজন লোক। চেহারাটা ভালোই, কিন্তু পাথরের মতো কঠিন করে রেখেছে। চোখ গরম করে কিটুর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো, টুথপেস্ট দিয়ে আমার জানালায় তুমি ছবি এঁকেছো?

জবাব না দিয়ে ডবের পেছনে সরে গেল কিটু।

কিটু! ভীষণ রেগে গেল নিনা। এতো শয়তান হয়েছিস তুই।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন বোরম্যান। তাই তো বলি, আমার টুথপেস্টের কি হলো! ৬-জলকন্যা

আবার যদি এরকম করো, পুলিশের কাছে যাবো বলে দিলাম, হ্যাঁ! হুমকি দিলো আগন্তুক।

সরি, মিস্টার ক্যাম্পার, ছেলের হয়ে মাপ চাইলো মা, আর ওরকম হবে না…

না হলেই ভালো। এতো লাই দিলে ছেলে মাথায় উঠবেই। একটু-আধটু শাসন দরকার।

তার খুদে মনিবকেই গালমন্দ করা হচ্ছে, এটা বুঝে গেল ডব। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না তার। চাপা গরগর করে উঠলো।

এই কুত্তা, চুপ! ধমক দিয়েই বুঝলো ক্যাম্পার, ভুল করে ফেলেছে। জ্বলে। উঠেছে বিশাল কুকুরটার চোখ। দোকান থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।

মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসি মুছে গেল কিটুর। মা হাসছে না। এমনকি নানাও না। কুকুরটার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে।

হয়েছে, আর মুখ ওরকম করতে হবে না! খেঁকিয়ে উঠলো নিনা। দেখো না, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না! লোক আর পাসনি, বাড়িওলার জানালায় গেছিস ছবি আঁকতে। ঘাড়টি ধরে যখন বের করে দেবে তখন বুঝবি।

চুপ করে রইলো কিটু। তারপর উঠে রওনা দিলো দোকানের পেছন দিকে। একটা টেবিলের নিচে কিছু খেলনা পড়ে আছে, সেদিকে। সঙ্গী হলো ডব।

সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করলো নিনা, মিনিট পনেরো শান্ত থাকলে হয়। কি ছেলেরে বাবা!

কিটুকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে আরেকবার তিন গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ দিলো নিনা। তার বাবা এক বোতল করে সোডা খেয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। খুশি হয়েই তাতে সায় দিলো ছেলেরা। কারণ এই অঞ্চলে কাজ আছে ওদের। আমেরিকান সভ্যতার ওপর গবেষণা করতে এসেছে রবিন, ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখবে। তাকে সাহায্য করছে কিশোর আর মুসা।

শহর এলাকার কথাই বেশি লিখবো, বোরম্যানকে জানালো রবিন। যেসব জায়গার পরিবর্তন খুব বেশি হচ্ছে। ভাবছি ভেনিস থেকেই শুরু করবো।

মাথা ঝাঁকালেন বোরম্যান।

আনন্দে টেবিলে থাবা মারলেন ডেজার। ঠিক জায়গায় এসেছে! কেবলই বদলাচ্ছে ভেনিস, সেই গড়ে ওঠার পর থেকেই। এতো বিভিন্ন ধরনের লোকের আনাগোনা এখানে পরিবর্তনটা হচ্ছেই সে-কারণে।

কালকে প্যারেড দেখতে আসছো তো? নিনা জিজ্ঞেস করলো।

নিশ্চয়ই, রবিন বললো। ফোর্থ অভ জুলাই প্যারেডের কথা অনেক শুনেছি। সুযোগ যখন পেলাম, না দেখে কি আর ছাড়ি।

হ্যাঁ, দেখারই মতো, বোরম্যান বললেন। এরকম প্যারেড আর কোথাও হয় না। তবে গণ্ডগোল হয় ভীষণ। যাচ্ছে তাই কাণ্ড ঘটে যায়।

চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকালো রবিন। জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। লাল স্কার্ট পরা এক তরূণী হেঁটে যাচ্ছে, তাকেই দেখছে গোয়েন্দা সহকারী। তরুণীকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছে এক বখাটে ছোকরা। চোখের পলকে ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটা। সোজা গিয়ে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিলো ছোকরার গালে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গোলমাল। দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা ছেলে এসে দাঁড়ালো সেখানে। দল হয়ে গেল দুটো। তর্ক শুরু হলো দুই দলে। অবস্থা দেখে মুসার মনে হলো, হাতাহাতিতেও গড়াতে পারে ব্যাপারটা।

মেয়েটার নাম মিস লিয়ারি গুন, ডেজার বললেন। প্রায়ই আসে সৈকতে। এলেই একটা না একটা গোলমাল বাধায়।

খাইছে! এই রকম কাণ্ড হয় এখানে! হরহামেশাই যদি এই অবস্থা হয়, প্যারেডের সময় না জানি কি ঘটে! নাহ, প্যারেডটা না দেখলেই নয়। আবা, কাল অবশ্যই আসবো।

আমিও আসবো, ঘোষণা করলো কিশোর পাশা।

.

০২.

পরদিন সকালে সৈকতের কাছে পৌঁছতেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে এলো।

চমকে উঠলো মুসা, গুলি নাকি?

না, বাজি, বললো কিশোর।

 গুলির মতোই লাগলো। প্যারেডের হট্টগোল শুরু হয়ে গেল তাহলে।

কংক্রীটের চত্বরটা লোকে বোঝাই। নানা রকম মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছেলেমেয়ের দল। অসংখ্য ছাতার নিচে গিয়ে ঠাই নিয়েছে। বুড়োরা। আইসক্রীম খাচ্ছে। ছোট ঠেলাগাড়িতে করে শিশুদের ঠেলে নিয়ে চলেছে মায়েরা। তাদের কারো কারো পায়ে পায়ে রয়েছে কুকুর-এক কিংবা একাধিক। বাজনা বাজিয়ে লোকের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে স্ট্রীট মিউজিশিয়ানরা। একটা ভ্যানের পেছন থেকে কাপড়ে তৈরি বিচিত্র সব জিনিস নামাচ্ছে কয়েকজন বিচিত্র পোশাক পরা মানুষ।

 সঙ্গে ক্যামেরা এনেছে রবিন। একের পর এক ছবি তুলছে। লাল গাউন পরা। মিস লিয়ারি গুনকে দেখে তার ছবি তুললো। অ্যাকর্ডিয়ন বাজাচ্ছে একটা লোক। দুই কাঁধে বসে আছে উজ্জ্বল রঙের দুটো কাকাতুয়া। আর বাজনার তালে তালে নাচছে মেয়েটা।

পানির দিক থেকে ঠেলাগাড়ি ঠেলে আনছে একজন লোক। গাড়িটাতে বোঝাই বোতল আর ক্যান। তার পেছন পেছন আসছে দুটো নেড়ি কুকুর। যেখানে সেখানে। কোকাকোলা আর লেমোনেডের খালি বোতল ছুঁড়ে ফেলছে লোকে। লোকটা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবর্জনা ফেলার জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে। গাড়ি থামিয়ে বোতল বা ক্যান তোলার জন্যে লোকটা থামলেই বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কুকুর দুটো।

ওর নাম বরগু, ছেলেদের পেছন থেকে বলে উঠলো একটা কণ্ঠ। ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওরা, মিস্টার ডেজার কথা বলছেন। খুব ভালো মানুষ। এরকম কমই দেখা যায়। কারো সাতেপাচে নেই, নিজের মতো থাকে। কষ্ট করে যা রোজগার করে, কুকুর দুটোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। ভালো, সত্যি ভালো লোক, শেষের বাক্যটা মাথা নেড়ে বললেন তিনি।

বরগুকে দেখতে লাগলো ছেলেরা। গাড়িটা ঠেলে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় রাখলো লোকটা। তারপর সৈকতের একটা কাফের সামনে পাতা একটা বেঞ্চিতে বসলো। পকেট থেকে বের করলো একটা হারমোনিকা। তার দিকে মুখ করে কুকুর দুটো বসলো পায়ের কাছে। বাজনা শোনার আশায় খাড়া করে ফেলেছে কান।

বাজাতে আরম্ভ করলো বরগু। শুরুটা হলো খুব নিচু খাদ থেকে। মোলায়েম সুর, চড়তে লাগল ধীরে ধীরে। তারপর অবাক কাণ্ড! একটা দুটো করে ছেলে মেয়েরা আসতে লাগলো। ঘিরে বসলো তাকে।

অপরিচিত সুর। ভারি মিষ্টি। কান পেতে শুনছে তিন গোয়েন্দা। ভালো লাগছে ওদের। বাচ্চাদেরও লাগবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মাত্র কয়েক মিনিট বাজিয়েই উঠে পড়লো বরগু। হারমোনিকা পকেটে ভরে আবার চললো তার ঠেলাগাড়ির দিকে। কুকুর দুটো চুলোে তার পেছনে। নিতান্ত নিরাশ হয়েই যেন উঠে পড়ে আবার যার যার মতো চলে গেল ছেলেমেয়েরা।

সব সময়ই এরকম হয়? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। বাচ্চারা ছুটে আসে?

সব সময়, জবাব দিলেন ডেজার। বরগুর নাম রেখেছি আমরা ভেনিসের বংশীবাদক। হ্যাঁমিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতোই বাঁশি বাজিয়ে বাচ্চাদের টেনে নিয়ে আসার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার।

হাঁটতে শুরু করলো আবার তিন গোয়েন্দা। ওদের সঙ্গী হলেন ডেজার। প্রচুর বাজি-পটকা পোড়ানো হচ্ছে সৈকতের ধারে। চত্বরের ওপরে উড়ে এসেও ফাটছে দু-একটা। ওরা বইয়ের দোকানের কাছাকাছি হতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। কিটু। নজর সামনের চত্বরে জনতার ভিড়ের দিকে। ডবও রয়েছে তার সঙ্গে। পা বাড়ালো ছেলেটা। কুকুরটা ছায়ার মতো সেঁটে রইলো তার সঙ্গে। হাঁটার আড়ষ্টতা দেখেই বোঝা যায় অনেক বয়েস। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

আবার দেখি একা একা বেরোলো ছেলেটা, মুসা বললো।

অসুবিধে নেই, ডেজার বললো। ডব রয়েছে সঙ্গে…

বাধা দিয়ে রবিন বললো, ছেলেটা এরকমই করে নাকি…কালকের মতো…

করে। একদণ্ড স্থির থাকতে পারে না। বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছে তার মা। কিছুতেই কথা শোনাতে পারে না। দোকানে থাকতেই চায় না কিটু। বেরিয়ে যায় কুকুরটাকে নিয়ে। সারা সৈকতে ছোটাছুটি করে। খেলে বেড়ায়। তবে হারিয়ে যায় না। ডব সঙ্গে থাকলে কোনো ভয় নেই। ওর মা বলেছে, এই সেপ্টেম্বরেই ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। দুষ্টুমি অনেক কমবে তখন।

 হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো মুসা। সময়ই পাবে না দুষ্টুমি করার।

সব ব্যাপারেই যেন দ্রুত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। প্যারেডের কোন কিছুই তাকে ধরে রাখতে পারলো না। ভিড় থেকে সরে গিয়ে চত্বরের একধারে। একটা বাড়ির দেয়ালের গায়ে বল ছুঁড়ে খুঁড়ে খেলতে শুরু করলো। বাড়িটা অনেক পুরানো। তিনতলা। দুই পাশে নতুন গড়ে ওঠা দোকানপাটগুলো ওই প্রাচীনতার সঙ্গে কেমন যেন বেমানান।

বেশ পুরানো, রবিন বললো। ডেজারকে জিজ্ঞেস করলো, ইতিহাস টিতিহাস আছে নাকি এটার?

নিশ্চয় আছে। ওটার নাম মারমেড ইন..।

জলকন্যা! বাংলায় বিড়বিড় করলো কিশোর।

অ্যাঁ! কি বললে?

না, কিছু না।

আবার আগের কথার খেই প্রলেন ডেজার, ওটার নামেই চত্বরটার নাম রাখা হয়েছে, মারমেড কোর্ট। আগে বাড়িটা সরাইখানা ছিলো। ভেনিস সম্পর্কে লিখতে গেলে ওটার কথা অবশ্যই লিখতে হবে তোমাকে। ছবি তুলে নাও।

ছবি তুলতে লাগলো রবিন। কিশোর আর মুসা ভালো করে দেখতে লাগলো চত্বরটা, আগের দিন দেখার সুযোগ পায়নি। পশ্চিম দিকে খোলা, পুরানো হোটেলটা থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে সাগর। কোর্টের উত্তরে লম্বা একটা দোতলা বাড়ি, নিচতলায় দোকানপাট। এটাতেই রয়েছে রীডারস হেভেন। একটা ঘুড়ির দোকান। আছে, নাম ব্লু স্কাই। ওটার পাশে আরেকটা ছোট দোকানের নাম হ্যাপি বাইইং। জানালার কাছে শো কেসে সাজানো রয়েছে নানা রকম রঙিন পাথর, খনিজ দ্রব্য আর রুপার তৈরি নানা রকম অলঙ্কার। হোটেল আর এই দোকানটার মাঝের কোণ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে আরেকটা দোকানের প্রবেশপথের কাছে। ওটার নাম। মারমেড গ্যালারি, ঠিক হ্যাপি বাইইঙের ওপরে।

মিস্টার ক্যাম্পার ওটার মালিক, ডেজার জানালেন। মারমেড কোর্ট আর হোটেলটাও তারই। গ্যালারির পাশে ওই যে, বইয়ের দোকানের ওপরের অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকেন।

চত্বরের অন্যান্য বাড়িগুলোর দিকে নজর ফেরালো এবার ওরা। চত্বরের পুরো পুব প্রান্ত জুড়ে রয়েছে মারমেড ইন। দক্ষিণে রয়েছে আরও কিছু দোতলা বাড়ি। নিচতলায় দোকান, ওপরতলায় বাসা। হোটেলের গাঁ ঘেষে রয়েছে বড় একটা কাফে, নাম ওশন ফ্রন্ট স্ন্যাকস। আর সৈকতের শেষে পানির একেবারে ধার ঘেঁষে। রয়েছে আরেকটা দোকান। উয়েয়ার সামথিং এটার নাম। সুতা, উল থেকে শুরু করে সেলাই আর বোনার যাবতীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায় এখানে।

খোয়া বিছানো রাস্তা, ফোয়ারা, ঘাসের চাপড়া আর ফুলের টব দিয়ে সুদৃশ্য করে সাজানো হয়েছে চত্বরটা। কাফের সামনে সিমেন্টে বাঁধানো এক বিশাল বেদির মতো উঁচু জায়গা, ছোটখাটো চত্বরই বলা চলে ওটাকে। তাতে চেয়ার-টেবিল সাজানো। শুকনো, রোগা, কালো চুলওয়ালা একজন মানুষ ঘুরে ঘুরে টেবিল থেকে এঁটো বাসন-পেয়ালাগুলো তুলে নিয়ে রাখছে একটা ট্রেতে। দেখে মনে হয়, বহুদিন ঘুম কিংবা গোসল কপালে জোটেনি তার। ওখানেই দেখা গেল কিটুকে। বেদির ওপর উঠে কিনারে গিয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছে। আবার উঠছে, আবার পড়ছে। কাছে বসে খুদে বন্ধুর খেলা দেখছে ডব, আর নীরব ভাষায় বাহবা দিচ্ছে যেন।

এই ছেলে! হঠাৎ ধমক দিয়ে বললো রোগাটে লোকটা, অনেক হয়েছে! থামো এবার!

 মন খারাপ হয়ে গেল কিটুর। বেদি থেকে নেমে বইয়ের দোকানের দিকে রওনা। হলো।

অতোটুকুন একটা ছেলের সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করলো! লোকটার আচরণ ভালো লাগেনি মুসার। কি এমন ক্ষতি করে দিচ্ছিলো?

ভদ্রতা এখনও শেখেনি, ডেজার বললেন। ওর নাম রাগবি ডিগার। লোকটোক না পেয়ে শেষে ওকেই রেখেছে হেনরি আর শেলি লিসটার। কাফেটা ওদেরই।

ওই বাড়িটাও কি মিস্টার ক্যাম্পারের? রবিন জানতে চাইলো।

হ্যাঁ। দেখছো না দুপাশের বাড়িগুলো নতুন। শুধু মাঝের সরাইখানাটা। পুরানো। উনিশশো বিশ সালে যখন এখানে সবে বসতি শুরু হয়েছিলো তখনকার তৈরি। শহরটার নাম যে ভেনিস রাখা হয়েছে তার কারণও আছে। ইটালির ভেনিসের মতোই এখানেও রয়েছে প্রচুর খাল। আর এগুলো দেখতেই আগে অনেক লোক আসতো এখানে। ছুটির দিনে দলে দলে আসতো হলিউড থেকে। মারমেড ইনে উঠতো তারা, খাল দেখতো, সাগরে সাঁতার কাটতো। তারপর ধীরে ধীরে এখানকার আকর্ষণ কমে গেল লোকের কাছে। পয়সাওয়ালারা চলে যেতে লাগলো মালিবুতে। শেষে লোকজন আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল একসময়। লালবাতি জ্বললো সরাইখানাটার। জায়গাটা তখন ব্রড ক্যাম্পার কিনে নিয়ে দুপাশে নতুন বাড়ি তুললো। আমরা ভেবেছিলাম পুরানো বাড়িটারও সংস্কার করবে। কিন্তু কিছুই করলো না। হাতই দিলো না ওটাতে।

ব্রড ক্যাম্পার! হঠাৎ তুড়ি বাজালো কিশোর। চিনেছি! কাল দেখেই চেনা। চেনা লেগেছিলো, মনে করতে পারছিলাম না। এখন মনে পড়েছে। অভিনেতা।

কই, নামও তো শুনিনি কখনও, মুসা বললো।

হ্যাঁ, অভিনেতাই ছিলো ক্যাম্পার, কিশোরের কথায় সায় জানিয়ে বললেন ডেজার। অনেকদিন হলো অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে, তোমাদের জন্মেরও আগে থেকে। কিশোর, তুমি চিনলে কি করে? টেলিভিশনে দেখেছো?

সিনেমার পোকা ও, হেসে বললো রবিন। হলিউডের ছোট থিয়েটারগুলোতে। পুরানো ছবি দেখতে যায় মাঝে মাঝেই।

মুচকি হাসলো মুসা। ও নিজেও অভিনয় করেছে এক সময়। মোটুরাম।

চোখ কপালে উঠলো ডেজারের। মাই গুডনেস! তুমিই মোটুরাম! ভালো, ভালো, খুব ভালো! ইউ আর আ জিনিয়াস!

রক্ত জমলো কিশোরের মুখে। অতীতের এই নামটা শুনতে একটুও ভালো লাগে না তার। টিভি সিরিয়াল পাগল সংঘ-তে ওই নামে অভিনয় করেছিলো, এই স্মৃতি মনে পড়লেই তেতো হয়ে যায় মন। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে। বললো, গ্যালারিটা তাহলে ব্রড ক্যাম্পারই চালায়?

হ্যাঁ। ছবি, চীনামাটি আর রুপার তৈরি নানা রকম জিনিস, এসব বিক্রি করে।

 কাফে আর উয়েয়ার সামথিঙের ওপরে একটা ব্যালকনি দেখালেন ডেজার। দুটো অ্যাপার্টমেন্ট আছে ওখানে। একটাতে আমি থাকি। আর ওই যে সাগরের দিকে মুখ করা, ওটাতে থাকে মিস জেলড এমিনার। খুব ভালো মহিলা।

মিস্টার ডেজারের পড়শীর বয়েস সত্তর। ব্যালকনি থেকে সিঁড়ির রেলিং বেয়ে। আস্তে আস্তে নেমে আসতে লাগলেন। পরনের গাউনটা বর্তমান ফ্যাশনের তুলনায় অনেক বেশি ঢোলা। ঝুলও বেশি। হ্যাঁটের চারপাশে বসানো কাপড়ের তৈরি লাল গোলাপ।

গুড মরনিং মিস এমিনার, ডেজার বললেন। আসুন। এরা আমার ইয়াং ফ্রেণ্ড। একে একে নাম বলে বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি।

কিশোর পাশা! উচ্চারণটা ঠিকমতো করতে পারলেন না মহিলা। চমৎকার। নাম তো! ওরকম শুনিনি।

ও বাংলাদেশী। বুঝিয়ে বললেন ডেজার, একটা কাজে এসেছে এখানে। রিসার্চ ওঅর্ক। ভেনিস সম্পর্কে লিখবে ইস্কুলের ম্যাগাজিনে।

ভেনিস? নাকি শুধু মারমেড কোর্ট?

অবাক হলো রবিন। মারমেড কোর্টেই এতো কিছু জানার আছে নাকি?

অনেক, অনেক, মিস এমিনার বললেন। এই মারমেড ইন থেকেই নিরমা। হল্যাণ্ড নিখোঁজ হয়েছিলো।

শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো রবিন আর মুসা।

অনেক দিন আগের কথা, তাই না? ডেজারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন মিস এমিনার। জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, তখন ভেনিসের খুব জমজমাট অবস্থা। এখানে প্রায়ই থাকার জন্যে আসতো নিরমা। এক রোববারে সকালে উঠে সাঁতার কাটতে বেরিয়েছিলো। তারপর থেকে গায়েব, আর দেখা যায়নি।

ভুরু কোঁচকালো কিশোর। গল্পটা আমিও শুনেছি।

তা তো শুনবেই। হলিউডের অনেকেই জানে এই গল্প। নিরমার লাশ পাওয়া যায়নি। ফলে রঙ চড়িয়ে নানা গল্প বলতে লাগলো লোকে। কেউ বললো ভাসতে ভাসতে উপকূলের দিকে চলে গিয়েছিল ও। অ্যারিজোনার ফিনিক্সে গিয়ে উঠে ছিলো। তারপর থেকে বাস করছে ওখানকার এক পোলট্রি ফার্মে। কেউ বা বললো সাগর থেকে উঠে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে আবার মারডেম ইনে ঢুকেছিলো নিরমা। একটা ঘরে আটকে রেখেছিলো নিজেকে। কারণ হঠাৎ জানতে পেরেছিলো, এক ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। যে রোগের কথা জানলে আঁতকে উঠবে লোকে। মানুষের সামনে বেরিয়ে তাদের ঘৃণার পাত্র হতে চায়নি।

মিস এমিনার থামতেই ডেজার বললেন, লোকে বলে হোটেলে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। আর ভূতটা হলো নিরমা হল্যাণ্ডের। কথাটা আমিও বিশ্বাস করি।

দুর, কিসের ভূতটুত! হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন যেন মিস এমিনার।

কিছু একটা আছেই! জোর দিয়ে বললেন ডেজার। রাতে জানালায় আলো দেখেছি। কাউকে ঢুকতেও দেখা যায় না, বেরোতেও না। তারমানে ভেতরেই থাকে কেউ। ব্রড ক্যাম্পার হয়তো জানে ব্যাপারটা। সে জন্যেই তেমনি রেখে দিয়েছে হোটেলটা। মেরামত করে ঠিকঠাক কছে না।

কেন, ভূতের ভয়ে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

না, বিরক্তি দেখা দিলো মিস এমিনারের চোখে। হয়তো পাবলিসিটি চাইছে। যাও না, গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করো না। গ্যালারিতে আছে।

 ক্যাম্পারের রাগ দেখেছে রবিন। আমতা আমতা করে বললো, যাবো এখন?…তিনি হয়তো এখন ব্যস্ত।

কথা বলার সময় পাবে না, এতোখানি ব্যস্ত সে কোনো কালেই থাকে না, হঠাৎ রেগে গেলেন মিস এমিনার। লোকটাকে যে দুচোখে দেখতে পারেন না, বোঝা গেল। নিজের ঢাকঢোল পেটানোর সুযোগ পেলে আর কিছুই চায় না। গিয়ে খালি বলে দেখো না, ইস্কুলের ম্যাগাজিনে তার নাম ছাপবে। লাফিয়ে উঠবে। সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে।

ক্যাফের দিকে এগোলেন মিস এমিনার।

ডেজার হাসলেন। প্যারেড শুরু হতে দেরি আছে এখনও। কথা বলতে ইচ্ছে করলে যেতে পারো।

কোর্টের উত্তরে সিঁড়ির দিকে এগোলো ছেলেরা। একবার দ্বিধা করে লম্বা একটা দম নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলো রবিন। বদমেজাজী লোকটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছেও করছে, আবার সাহসও পাচ্ছে না। সমস্যাই বটে!

.

০৩.

মারমেড গ্যালারির উঁচু ছাত, সাদা দেয়াল। ছেলেরা ঢুকতেই কোথাও একটা ঘণ্টা বাজলো। চারপাশে তাকালো ওরা। উজ্জ্বল রঙের পর্দা। আবলুস আর রোজউড কাঠ কুঁদে তৈরি নানারকম চমৎকার ভাস্কর্য রয়েছে। আর আছে দেয়ালে ঝোলানো ছবি এবং কাঁচের সুদৃশ্য বাক্সে রাখা চীনামাটির তৈরি নানারকম সুন্দর সুন্দর জিনিস। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে রুপা কিংবা রঙিন কাঁচে তৈরি অনেক ধরনের ফুলদানী।

দরজার পাশে বিরাট জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চীনামাটির তৈরি একটা তরুণী জলকন্যার মূর্তি। ফুট দুয়েক লম্বা। অর্ধেক-মানুষ-অর্ধেক-মাছ ওই কল্পিত জীবটি হাসছে। বেশ একটা খেলা খেলা ভাব। মাছের লেজের ওপর ভর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুহাতে ধরে রেখেছে একটা সাগরের ঝিনুক।

কি চাই? তপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ব্রড ক্যাম্পার। কোমর সমান উঁচু একটা। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট একটা ভাড়ার ঘরমতো করা হয়েছে ওখানটায়। একটা সিংক আছে, ক্যাবিনেট আছে। ব্রাশ আর ঝাড়ু রাখার আলমারিটা রাখা হয়েছে ঘরের ডান কোণ ঘেঁষে।

আবার দ্বিধা করলো রবিন, একবার ভাবলো বেরিয়েই যায়। লোকটার গোমড়া মুখ দেখেই বুকের মধ্যে কেমন করছে তার।

কিন্তু কিশোর এগিয়ে গেল ভারিক্কি চালে। পরিচয় দিলো, আমি কিশোর পাশা। কাল দেখা হয়েছিলো আমাদের। কিটুদের বইয়ের দোকানে আপনার কথা অনেক শুনেছি, তাই দেখা করতে এলাম।

তার শেষ কথাটায় অনেকখানি নরম হলো ক্যাম্পার। সেটা বুঝতে পেরে ভরসা পেলো কিশোর। রবিনকে দেখিয়ে বললো, আমার বন্ধু রবিন মিলফোর্ড। ইস্কুলের ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লিখবে। তথ্য দরকার। আমরা শুনলাম, ভেনিসের একজন বিশিষ্ট লোক আপনি।

অ্যাঁ! হ্যাঁ, তা ঠিক, দেয়ালের ধারে রাখা কয়েকটা চেয়ার দেখালো ক্যাস্পার। তা বসো না তোমরা, দাঁড়িয়ে কেন? একেবারে বদলে গেছে। নিজেও একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, খুব সতর্কভাবে শব্দ চয়ন করে ভেনিস সম্পর্কে বলতে শুরু করলো, বহুদিন থেকেই মারমেড কোর্টের ব্যাপারে ইনটারেস্টেড ছিলাম আমি। ভেনিসে সাঁতার কাটতে আসতাম। সাইকেল চালানোর রাস্তাও তখন ছিলো না এখানে। সৈকতের ধারে ছোট ছোট কয়েকটা বীচ হাউস ছিলো, প্রায় ধসে গিয়েছিলো ওগুলো। খালের পাড় আগাছায় ভর্তি।

এই সময় একদিন শুনলাম মারমেড ইন বিক্রি হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দাম। খুব বেশি না, আমার সামর্থ্যের মধ্যেই। সামনের জায়গাটা সহ কিনে ফেললাম হোটেলটা। ছোটবেলায় নিরমা হল্যাণ্ডের ভক্ত ছিলাম আমি। হোটেলটা কিনে খুব ভালো লাগলো। মনে মনে গর্ব হতে লাগলো-আমার প্রিয় অভিনেত্রী যেখানে তার শেষ রাতটা কাটিয়েছেন, সেটার মালিক হতে পেরেছি আমি।

এক এক করে তিন কিশোরের মুখের দিকে তাকালো ক্যাম্পার। নিরমা হল্যাণ্ডের কথা নিশ্চয় জানো?

জানি, মাথা ঝাঁকালো রবিন।

জায়গাটা যখন কিনেছিলাম, ক্যাম্পার বললো, শুধু সরাইখানা আর সামনে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া একটা চত্বর ছাড়া আর কিছু ছিলো না এখানে। দুপাশের নতুন বিল্ডিং দুটো আমি বানিয়েছি। সামনের জায়গাটা আমি সাজিয়েছি। থাকবোই যখন ঠিক করেছি, একটু গোছগাছ করে না নিলে কি চলে। আর করেছি বলেই তো। আবার লোকজন আসতে আরম্ভ করেছে। অনেক গণ্যমান্য লোক আছে তাদের মধ্যে।

নিজের বক্তৃতায় নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে হাসলো ক্যাম্পার। দেখে নিও, একদিন এই ভেনিস একটা শহরের মতো শহর হবে। সবার মুখে মুখে ফিরবে এর নাম। পতিত জায়গাগুলো সব ঠিকঠাক হবে। গড়ে উঠবে নতুন নতুন বড়িঘর। দাম অনেক বেড়ে যাবে এই মারমেড কোর্টের।

ক্যাম্পার থামতেই কিশোর বলে উঠলো, সরাইখানাটার কি হবে? মেরামত করবেন?

এখনো মনস্থির করিনি। একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো পুরোটাই ভেঙে। ফেলে নতুন করে গড়তে হবে। কিন্তু এটা একটা ইতিহাস, ভাঙতে মন চায় না।

খোলা দরজার দিকে তাকালো ক্যাম্পার। প্যারেড আসছে। ছেলেদের দিকে ফিরলো আবার। তা আর কিছু জানার আছে?

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো ওরা। বেরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে ওদের। ক্যাম্পারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো।

শূন্য চত্বর। সবাই গিয়ে ভিড় করেছে প্যারেড যেখানে হচ্ছে সেখানটায়। জোরে জোরে বাজছে এখন বাজনা। বাজনা না বলে হর্ন, ড্রাম আর বাঁশির কান ঝালাপালা করা মিশ্র শব্দ বললেই বোধহয় মানায় ভালো।

তিন গোয়েন্দাও এগোলো সেদিকে। সৈকতে বাজি পুড়ছে এখনও। ফাটছে। পটকা। শুরু হলো প্যারেড। আসলেই, ওরকম প্যারেড আর কখনো দেখেনি ওরা। ড্রাম বাজার তালে তালে ইস্কুলে দল বেঁধে যে রকম প্যারেড করে ওরা সে রকম। নয়। লোকে মার্চ করছে ঠিকই, তবে যার যার মতো করে। কেউ নির্দেশ দেয়ার নেই, নির্দেশ মানারও কেউ নেই। পোশাকও ইচ্ছে মতো পরেছে সবাই। শার্ট প্যান্ট তো বটেই, বেদিং স্যুট এমনকি শাড়িও পরেছে কেউ কেউ। কেউ পরেছে বিচিত্র আলখেল্লা, বুকের কাছে গোল গোল আয়না সেলাই করে লাগিয়ে নিয়ে। মোট কথা, যার যা পরনে আছে, তাই নিয়ে নেমে পড়া যায় ওই প্যারেডে।

খাইছে! বিড়বিড় করে বললো মুসা, কাণ্ড দেখেছো! মনে হয় ন্যাংটো হয়ে নেমে গেলেও কেউ কিছু মনে করবে না!

তার কথার জবাব দিলো না কেউ। রবিন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে কিটুর দিকে। কয়েক ফুট দূরে মায়ের কাঁধে চড়ে প্যারেড় দেখছে। সেদিক থেকে মুখ ফেরাতে চোখে পড়লো, ওশন ফ্রন্টে তার প্রিয় বেঞ্চটায় গিয়ে। বসেছেন মিস্টার ডেজার।

বেশিক্ষণ কাঁধে থাকতে ভালো লাগলো না কিটুর। জোর করে নেমে পড়লো। মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিলো চত্বরের দিকে। এই, এই কোথায় যাচ্ছিস! চেঁচিয়ে ডাকলো নিনা। খদার, ক্যাম্পারের বাড়ির ধারেকাছেও যাবি না!

আচ্ছা। ফিরে তাকালো না কিটু। দৌড়ে চলে গেল। পেছনে গেল ডব।

প্যারেড চলছে। শুধু আজকের দিনের জন্যে ওশন ফ্রন্টে গাড়ি ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছে।– আরও কিছুক্ষণ পর, কিশোরের কানে এলো নিনা বলছে, কিটুটা গেল কোথায়?

মারমেড কোর্টের দিকে গেল নিনা। ফিরে এলো একটু পরেই। বাবা? ডাকলো সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে।

বাবা, কোথায় তুমি?

বেরিয়ে এলেন হেনরি বোরম্যান।

 বাবা, কিটুকে খুঁজে পাচ্ছি না!

আছে কোথাও, মেয়ের হাত চাপড়ে দিয়ে বললেন বৃদ্ধ। ডব আছে তো সঙ্গে?…কিছু হবে না।

কিন্তু মায়ের উদ্বেগ কাটলো না। শেষে মেয়েকে নিয়ে কোর্টের দিকে এগোলেন বোরম্যান, নাতিকে খোঁজার জন্যে।

ডেকে ডেকে সারা হয়ে গেল দুজনে, কিন্তু না মিললো কিটুর সাড়া, না দৌড়ে এলো ডব।

কোর্টের নিচতলার দোকানগুলোতে খুঁজলেন বোরম্যান। ব্যালকনিতে বেরিয়ে। এলো ক্যাম্পার। কাফের মালিক বেরিয়ে এলো তার দোকানের সামনের বেদিতে। কিটুর কথা জিজ্ঞেস করতে ঘাড় নাড়লো দুজনেই। দেখেনি।

এইবার ভয় ফুটলো নিনার চোখে। বাবা, আবার হারিয়েছে! হারিয়ে গেছে!

আহ, এতো অস্থির হোস কেন? সান্ত্বনা দিলেন বাবা। পাওয়া যাবেই।

আরেকবার কিটুকে খুঁজতে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। আগের দিনের মতো করেই খুঁজতে শুরু করলো। তবে এদিন ভিড়ের কারণে খোঁজাটা ততো সহজ হলো না। মারমেড কোর্ট থেকে পাঁচ কি ছয় ব্লক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ধসে পড়া পুরানো একটা অ্যাপার্টমেন্টের ভাঙা সিঁড়িতে জিরিয়ে নিতে বসলো।

পেলাম না তো, রবিন বললো। হয়তো ফিরে গেছে। বইয়ের দোকানে, মায়ের কাছে। গিয়ে দেখা যাক, কি বলে?

চলো, উঠে দাঁড়ালো মুসা। খামোকাই বোধহয় প্যারেডটা মিস করলাম।

কিশোর কথা বলছে না। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্থির।

কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো রবিন। এগিয়ে গেল বাড়িটার একপাশে। বড় একটা রাবিশ বিন দেখে উঁকি দিলো তার ভেতরে। চেঁচিয়ে উঠলো পরক্ষণেই, এই, জলদি দেখে যাও!

কি, কি হয়েছে! ছুটে গেল মুসা।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবিনের মুখ। একটা কুকুর..ডব..মনে হয় মরে গেছে!

.

০৪.

বিকেল বেলা পুলিশ এলো কিটুকে খুঁজতে। সমস্ত ওশন ফ্রন্ট চষে ফেলা হলো, কিন্তু ছেলেটাকে পাওয়া গেল না।

পুলিশ যখন খুঁজছে, তখন মারমেড কোর্টে ক্যাফের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা। ওদের সঙ্গে রয়েছেন ডেজার। শেষ বিকেলে মিস এমিনার এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন। বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড!

মহিলার কথায় শঙ্কা ফুটলো মুসার চোখে। বোধহয় ভূতের কথা মনে পড়ে গেছে। বিড়বিড় করে বললো, কিসে যে মারলো কুকুরটাকে! তবে আমার মনে হয় কিটু ভালোই আছে।

জোর দিয়ে বলা যায় না। সব সময় একসঙ্গে থাকতো দুজনে। ডবকে যে। মেরেছে তাকে নিশ্চয় দেখেছে কিটু। চিৎকার করেছে। হয়তো বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেছে। আর সেটা করে থাকলে… কথাটা শেষ করলেন না তিনি, শুধু মাথা নাড়লেন।

আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন, একমত হলো কিশোর। কিটুকে কেউ কিছু করতে এলে ডবের তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা নয়। আর সেটা করতে গিয়েই নিশ্চয়। খুন হয়েছে বেচারা।

পুলিশের ধারণা, রবিন বললো, গাড়ি চাপা পড়েছে কুকুরটা। সাধারণ অ্যাক্সিডেন্ট। মরে যাওয়ার পর তোক জানাজানি করে আর ঝামেলা করেনি ড্রাইভার। চুপচাপ রাবিশ বিনে লাশটা ফেলে দিয়ে পালিয়েছে।

তাহলে কিটু বাড়ি ফিরলো না কেন? প্রশ্ন তুললো কিশোর।

এই সময় বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন বোরম্যান। পিছে পিছে এলো। নিনা। শুকনো, ফ্যাকাসে চেহারা। দুজনেরই চোখ ওশন ফ্রন্টের দিকে। সৈকতে এখন লোকের ভিড় নেই। পাশের একটা রাস্তা থেকে এসে চত্বরে ঢুকলো একটা গাড়ি। মারমেড কোর্টের ঠিক সামনে এসে থামলো। দুজন লোক নামলো, একজনের হাতে ভিডিও ক্যামেরা।

টেলিভিশনের লোক, ডেজার বললেন। নিনার সাক্ষাৎকার নেবে মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, তাই তো।

নিনার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে আছে একটা লোক।

এই সময় বেরোলো ব্রড ক্যাম্পার। গ্যালারি থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালো নিনার পাশে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে কাঁধে হাত রাখলো।  

 হায়রে কপাল! কপাল চাপড়ালেন মিস এমিনার। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর লোভটাও ছাড়তে পারলো না। বেহায়ার হাড্ডি।

ওকে আপনি দেখতে পারেন না, কিশোর বললো।

না, পারি না। ওরকম একটা ছোটলোককে কেউ দেখতে পারে নাকি?

আমার কিন্তু অতোটা খারাপ মনে হয় না, ডেজার বললেন।

আপনি লোক চেনেন না, মিস্টার ডেজার, তাই একথা বলছেন। ওটা একটা পাজীর পা ঝাড়া!

যাকে নিয়ে এতো সমালোচনা সে ওদিকে বেশ জমিয়ে ফেলেছে রিপোর্টারদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটা এখন মূলতঃ সে-ই দিয়ে চলেছে।

বেশরম কোথাকার! ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন মিস এমিনার।

টেলিভিশনের লোকেরা চলে গেলে তিন গোয়েন্দাও উঠলো। বাড়ি যাবে। বইয়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিনা। কাঁদছে। কি মনে হলো তিন কিশোরের, কাছে এগিয়ে গেল। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিয়ে বললো, এটা রাখুন। আমাদের ঠিকানা। সাহায্যের প্রয়োজন হলে ডাকবেন।

কার্ডটা পড়লো নিনা। তোমরা গোয়েন্দা?

 হ্যাঁ, মুসা বললো। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি। বিশ্বাস হলে রকি বীচের পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

না না, বিশ্বাস করছি। পুলিশ খুঁজছে তো এখন, খুঁজুক। আশা করি বের করে ফেলবে। বললো বটে, কিন্তু নিনার কণ্ঠ শুনে মনে হলো না খুব একটা ভরসা। রাখতে পারছে পুলিশের ওপর।

গোধূলির ম্লান আলোয় সাইকেল চালিয়ে রকি বীচে ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা। মনে ভাবনা। হারানো ছেলেটার কথাই ভাবছে।

আস্ত শয়তান! সাইকেল চালাতে চালাতে বললো মুসা। নইলে ওরকম একটা কুকুরকে মারে!

আমার মনে হয় অ্যাক্সিডেন্টই, রবিন বললো। কিশোর, তোমার কি মনে। হয়?

বুঝতে পারছি না, জবাব দিয়ে আবার চিন্তায় ডুবে গেল গোয়েন্দাপ্রধান।

রাত দশটায় টিভির খবরে নিখোঁজ সংবাদটা দেখলো সে। ড্রইং রুমে বসে আছে। রাশেদ পাশা আর মেরিচাচীও আছেন ওখানে।

নিনাকে একলা দেখা গেল কিছুক্ষণের জন্যে। তার পরেই এসে উদয় হলো ব্রড ক্যাম্পার। বললো, আমরা সবাই দোয়া করি, ভালো ভাবে ফিরে আসুক ছেলেটা। খুব লক্ষ্মী ছেলে। মারমেড কোর্টের সবাই তাকে ভালোবাসে।

আশ্চির্য! টেলিভিশনের পর্দায় স্থির হয়ে আছে মেরিচাচীর দৃষ্টি। বয়েস এতো কম লাগছে কেন ক্যাম্পারের? শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে কড়া নজর রেখেছে দেখছি!

কিছু মানুষের শরীরই থাকে ওরকম, রাশেদ চাচা মন্তব্য করলেন। সহজে ভাঙে না।

পর্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাম্পার। ঘোষককে দেখা গেল। বললো সে, এখনও কিটু আরকারের খোঁজ মেলেনি। তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে পারলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে জানাতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কিটুর বয়েস পাঁচ, তিন ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, কালো চুল, পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে লাল-নীল ডোরাকাটা টি শার্ট।

কিটুর একটা ফটোগ্রাফ দেখানো হলো। ছবিটা তেমন স্পষ্ট নয়। ভালো ওঠেনি, কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর অন্য কথায় চলে গেল ঘোষক।

আহারে, বেচারি, নিনার জন্যে আফসোস করলেন মেরিচাচী। কতো না। জানি কান্নাকাটি করছে এখন!

রাত হয়েছে। উঠে ঘুমাতে চলে গেলেন চাচা-চাচী। কিশোর একা বসে বসে ভাবতে লাগলো। এভাবে গায়েব হয়ে গেল কি করে ছেলেটা? লোকজন তো কম ছিলো না তখন। নিশ্চয় কারো না কারো নজরে পড়েছে।

পরদিন সকালেও নিখোঁজ রইলো কিটু। নাস্তার পর রান্নাঘরের কাজে চাচীকে সাহায্য করলো কিশোর। তারপর বেরিয়ে এলো বাইরে। ঢুকলে এসে হেডকোয়ার্টারে। ঢুকতেই টেলিফোন বাজলো। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো। ভেসে এলো নিনা হারকারের কণ্ঠ, হালো, কিশোর পাশা?

বলুন?

কিশোর, কান্না জড়ানো গলায় বললো নিনা, সারা রাত বাবা খোঁজাখুঁজি করেছে। পুলিশও অনেক খুঁজেছে। পায়নি… ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে।

কাঁদবেন না। পাওয়া যাবেই। আমরাও খুঁজবো।

সে জন্যেই ফোন করেছি। প্লীজ, যদি আসো!…তোমাদের অনেক প্রশংসা করেছেন ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার।

কিশোর বুঝতে পারলো, রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে খবর নিয়েছে নিনা। বললো, আপনি ভাববেন না। রবিন আর মুসাকে নিয়ে এখনই আসছি।

.

০৫.

বইয়ের দোকানে একা বসে আছে নিনা হারকার। চোখের কোণে কালি পড়েছে। হাত কাঁপছে অল্প অল্প। তিন গোয়েন্দাকে দেখেই বলে উঠলো, নাহ, কোনো খোঁজ নেই! কিচ্ছু না! পুলিশ এখনও খুঁজছে। ডবের পোস্ট মর্টেম করেছে। খোদাই জানে, কেন!

কিভাবে মরেছে বোঝার জন্যে, কিশোর বললো।

বুঝলে কি হবে?

মৃত্যুটা কি করে হয়েছে জানা থাকলে অনেক সময় হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সুবিধা হয়। তদন্ত করতে যাচ্ছি আমরা। মারমেড কোর্ট থেকেই শুরু করবো, যেখানে ডবের লাশটা পাওয়া গেছে।

কি লাভ? পুলিশ কোনো জায়গাই বাদ রাখেনি। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

তবু চেষ্টা করবো। সব কথা আমাদেরও জানতে হবে। এমন কিছু জানাতে পারে আমাদেরকে কেউ, যা পুলিশকে বলতে ভুলে গেছে। হয় ওরকম। কিটুর ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেবো যতোটা পারা যায়। কাল তাকে আমরা কোটে দেখেছি। নিশ্চয় কেউ না কেউ বেরোতে দেখেছে। ঠিক না?

তা দেখতে পারে।

তদন্ত করতে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। প্রথমে কথা বললো ঘুড়ির দোকানের লম্বা, রোগাটে লোকটার সঙ্গে। তার নাম জনি মিউরো। মারমেড কোর্ট থেকে কিটুকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে সে। তারপর কোথায় গেছে বলতে পারলো না।

দোকান থেকে বেরিয়ে কোর্টের সামনে গিয়েছিলাম, মিউরো বললো, প্যারেড দেখতে। মিনিটখানেকের বেশি থাকিনি। কিটুকে দেখলাম বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে ডব। কুত্তাটা সব সময় তার সঙ্গে থাকতো।

আপনার দোকানের দরজা খোলা ছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। এমনও তো হতে পারে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে ও?

মাথা নাড়লো মিউরো। পেছনের দরজায় ডেড-বোল্ট লক লাগানো, দেখছো।? বেরোতে হলে ওটা খুলতে হতো তাকে। নাগাল পেতে হলে উঠতে হতো। চেয়ারে। খুলে বেরিয়ে গেলে খোলা থাকতো দরজাটা। আমার চোখে অবশ্যই পড়তো। চালাকি করে চেয়ার সরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে হয়তো বেরিয়ে যেতে পারতো, তাহলে সহজে আমার চোখে পড়তো না ব্যাপারটা। কিন্তু কোনো জিনিস একবার সরিয়ে আবার আগের জায়গায় নিয়ে রাখবে কিটু? অসম্ভব! যেখানে যা নিয়ে। যাবে সেখানেই ফেলে রেখে যাবে।

রক স্টোরের মালিক মিস জারগনও একই রকম কথা বললো। প্যারেডের সময় দোকান ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলো, কিন্তু কিটু বা অন্য কাউকেই দোকানে ঢুকতে দেখেনি। তাছাড়া দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়েছিলো। এখানে দরজা খোলা রেখে বেরোবো! মাথা খারাপ! বললো সে। চোরের যা উৎপাত! এক মিনিটে ফাঁকা করে দেবে দোকান।

কিটু কথা আর কি বলবো? কিভাবে পালিয়েছে ও-কি একটা বলার ব্যাপার হলো? ও ওভাবেই পালায়। চোখের পলকে। এই আছে তো এই নেই। নিশ্চয়। ভিড়ের ভেতর থেকে মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়েই বেরিয়ে চলে এসেছিলো।

আসলে, কোন দিকে গেছে ও বোঝার চেষ্টা করছি। কেউ না কেউ হয়তো দেখেছে। কুকুরটা সঙ্গে ছিলো তো, চোখে না পড়ার কথা নয়।

কুকুরের কথায় কেঁপে উঠলো মিস জারগন। বোলো না, বোলো না, লোকটা একটা পিশাচ! নইলে ওরকম একটা বুড়ো জানোয়ারকে ওভাবে মারতে পারে!

ডবকে কে মেরেছে এখনো জানি না আমরা। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড রে করে দিলো কিশোর, আমাদের ফোন নম্বর। যদি কিছু মনে পড়ে আপনার, দয়া করে জানাবেন।

রুক স্টোর থেকে বেরিয়ে সুতোর দোকানে চললো ওরা।

মিসেস কেলান শান্ত, ভদ্র। সুন্দর চুল। সুতোর দোকানটার মালিক। কিটুকে তিনি দেখেছেন আগের দিন। তবে তখনো দোকান থেকে বেরোননি। জানালা দিয়েই প্যারেড দেখছিলাম, বললেন তিনি। ছেলেটা যে কোথায় গেল, দেখিনি। নিনা বেচারির জন্যে কষ্ট লাগছে। ছেলে হারালে মায়ের কি কষ্ট হয় বুঝি তো।

 এরপর ক্যাফেতে এসে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা। কফি আর পেস্ট্রি খাচ্ছে কয়েকজন লোক। খাবার সরবরাহ করছে হেনরি লিটার। ছেলেরা ঢুকে তাকে প্রশ্ন শুরু করতেই ওদেরকে রান্নাঘরে স্ত্রীর কাছে এনে রেখে গেল সে। যা জবাব দেয়ার শেলিই দিক।

কাল এখানে আসেনি কিটু, শেলি জানালো। মাঝে মাঝে আসতো আমাদের এখানে। মায়ের নাম করে ফাঁকি দিয়ে কেকটেক নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। কয়েক দিন দিয়েছি। পরে যখন বুঝে গেলাম, আর দিতাম না।

প্যারেড শুরু হওয়ার পর আর ওকে দেখেননি, না? জিজ্ঞেস করলো। কিশোর।

না। ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের রেগুলার ওয়েইটার রাগবিটা তখন বেরিয়ে গেছে। না জানিয়ে মাঝে মাঝেই গায়েব হয়ে যায় ও।

শেলি লিসটারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। চত্বর পেরিয়ে এসে মারমেড গ্যালারির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। ভেতরেই পাওয়া। গেল মালিককে।

কিটুর কথা জানতে এসেছো কেন? কিশোরের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করলো ব্রড ক্যাম্পার। তোমরা তো ইস্কুলের ম্যাগাজিনের তথ্য সংগ্রহ করছিলে। হঠাৎ এই নতুন কৌতূহল কেন?

রবিন জবাব দিলো, আজ আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি না। মিসেস হারকারকে সাহায্য করতে এসেছি।

তোমরা আর কি সাহায্য করবে? যা করার পুলিশই তো করছে। এসব কাজে ওরা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ।

তবু মিসেস হারকার আমাদের সাহায্য চেয়েছেন, কিশোর বললো। একটা কার্ড বের করে দেখালো ক্যাম্পারকে।

বাহ! গোয়েন্দা! কিছুটা টিটকারির সুরেই বললো ক্যাম্পার।

হ্যাঁ, মুসা বললো। অনেক রহস্যের সমাধান আমরা করেছি।

তাই? ভালো। তা কি জানতে চাও?

জানতে চাই, কাল কিটু কি কি করেছে, কিশোর বললো। ও কোনদিকে গেছে জানতে পারলে সুবিধে হতো। প্যারেড শুরু হওয়ার পর কোথায় গেছে, বলতে পারবেন?

না। তবে যেদিকেই যাক, যা-ই ঘটুক তার, এখানে কিছু ঘটেনি। কুত্তাটা গাড়ির নিচে পড়ে মরেছে, শুনেছো তো? মারমেড কোর্টে তো গাড়িই নেই, এখানে মরে কিভাবে?

তা ঠিক। আমি একথা বলতে চাইছি না। আমার কথা, কোর্টে দেখা গেছে। কিটুকে। অনেকেই দেখেছে। তারপর হঠাৎ করে একেবারে লাপাত্তা, কারো। চোখেই পড়লো না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। পেছনের একটা দরজা দেখিয়ে বললো কিশোর, সামনে দিয়ে ঢুকে ওখান দিয়ে বেরিয়ে যায়নি তো?

বলতে বলতে গিয়ে ঠেলা দিলো পাল্লায়। তার হাতের ছোঁয়া লাগতেই খুলে। গেল ওটা। দেখা গেল সিঁড়ি নেমে গেছে বাড়ির পেছন দিকে। পাশের বাড়ির সামনে। গাড়ি পার্কিডের জায়গা। একটা রাস্তা চলে গেছে ওশন ফ্রন্টের সমান্তরালে, ওটারই নাম স্পীডওয়ে। খোয়া বিছানো, সরু, এবড়ো-খেবড়ো পথ। পার্কিং লটে ঢোকার জন্যে গুতোগুতি করছে ড্রাইভাররা।

পাল্লাটা ভেজিয়ে দিলো কিশোর। দরজার ছিটকানি লাগান না?

ঘর বন্ধ করে বেরোনোর আগে লাগিয়ে যাই। দিনের বেলা খোলাই রাখি। গ্যারেজে যেতে হয়, ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে যেতে হয়। কতোবার খুলবো ছিটকানি?

মাথা ঝাঁকিয়ে সামনের দরজার কাছে ফিরে এলো কিশোর। ছোট একটা ঘণ্টা। আছে। ইলেকট্রিক বীমের সাহায্যে সুইচ অন হয়। কিশোরের শরীরে ওই বীম বাধা। পেতেই বেজে উঠলো ঘণ্টাটা। কোমর সমান, বিড়বিড় করলো সে। বেল না। বাজিয়ে সহজেই বীমের নিচে দিয়ে চলে যেতে পারে কিটু। আপনি ক্ষণিকের জন্যে এখান থেকে সরলেও চলে যেতে পারে, পলকে।

শূন্য দৃষ্টিতে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যাম্পার। তারপর হাসলো। ও, গত হপ্তায় এভাবেই ঢুকেছিল তাহলে! তাই তো বলি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ফেলে রেখে গেল, ঘণ্টা বাজলো না কেন?

বীম এড়িয়ে যে ওটুকু একটা বাচ্চা ছেলে ঢুকতে পারে, খেয়ালই করেননি। কখনও? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।

নাহ্!

ওরা যখন কথা বলছে, মুসা তখন ঘুরে ঘুরে দেখছে গ্যালারিটা। বড় ডিসপ্লে উইণ্ডোর সামনে রাখা বেদিটার কাছে এসে হতাশ হলো সে। শূন্য বেদি। ক্যাম্পারকে জিজ্ঞেস করলো, জলকন্যাটা কি বেচে দিয়েছেন?

না… দ্বিধা করলো ক্যাম্পার। কাল চুরি হয়ে গেছে। একজন খদ্দেরকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন। ওটা কেন চুরি করলো বুঝলাম না। এর চেয়ে অনেক দামী জিনিস আছে এখানে।

হু, আনমনে বললো কিশোর।

দুনিয়ার যতো আজেবাজে লোক এসে হাজির হয় এই বীচে, বিরক্ত কণ্ঠে বললো ক্যাম্পার। কুত্তাটার কথাই ধরো। অহেতুক মেরে রেখে গেল ওটাকে।

সত্যিই গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে কিনা তাই বা কে জানে, রবিন বললো। পুলিশ নাকি জানার জন্যে পোস্ট মর্টেম করতে নিয়ে গেছে।

তাই?

দীর্ঘ নীরবতা। ছেলেদের কথা শোনার অপেক্ষা করলো, যেন ক্যাম্পার। শেষে বললো, যদি তা-ই হয়…

বাধা দিয়ে কিশোর বললো, আচ্ছা, হোটেলে ঢোকেনি তো কিটু? জানালা খোলা ছিলো হয়তো, কিংবা দরজার তালা ভাঙা…

না, জোর দিয়ে বললো ক্যাম্পার। ভালোমতো আটকে রাখি আমি, যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে। কখন কি নষ্ট করে ফেলে, না আগুনই লাগিয়ে দেয়, ঠিক আছে কিছু?

কাল পুলিশ ওখানে খুঁজেছিলো?

নিশ্চয়ই। তালা খুলে দিয়েছিলাম। ওরাও দেখেছে, বহুদিন ওখানে কেউ ঢোকেনি।

ভালোমতো খুঁজেছো তো?

রেগে গেল ক্যাম্পার। অনেক হয়েছে! কাজ আছে আমার। তোমাদের প্রশ্ন শেষ হয়ে থাকলে…

বেরিয়ে এলো ছেলেরা। কিন্তু ওরা অর্ধেক সিঁড়ি নামতেই পেছন থেকে ডাকলো ক্যাম্পার। রাগ পড়ে গেছে। দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে এখন কেমন বয়স্ক আর বিধ্বস্ত লাগছে।

সরি, বললো সে, মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। ছোটবেলায় আমার একজন বন্ধু হারিয়ে গিয়েছিলো। লাঞ্চের পরেও ক্লাসে এলো না। ওকে খুঁজতে বেরোলাম। আমিই খুঁজে পেয়েছিলাম। তখন আইওয়াতে থাকি। ওখানেই জন্মেছি আমি। ভালোমতো চিনি শহরটা। শহরের বাইরে পুরানো একটা গর্ত ছিলো। বৃষ্টির পানিতে ভরে গিয়েছিলো সেটা। দেখলাম, তাতে ভাসছে লাশটা।

বেচারা! জিভ দিয়ে চুকচুক করে দুঃখ প্রকাশ করলো কিশোর।

চত্বর ধরে এগোলো, ওরা। ক্যাফের বারান্দায় দেখা গেল মিস জেলড়া এমিনারকে। কফি খাচ্ছেন। ওদেরকে দেখেই বলে উঠলেন, এতো দেরি করলে! তোমাদের জন্যেই বসে আছি। এসো, একটা জিনিস দেখাবো।

০৬.

হেনরি লিসটারকে ডেকে আনলেন মিস এমিনার। বললেন, দুপুর হয়ে আসছে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওদের। আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে। চিকেন স্যাণ্ডউইচই দাও। আমাকে বাদ দিয়ে। আজকাল আর হজম করতে পারি না। বয়েস হয়ে গেছে। আর কি খাওয়ার মজা আছে!

স্যাণ্ডউইচ নিয়ে আসছি, বলে চলে গেল লিটার।

তোমাদের বয়েসে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস এমিনার, লোহা খেয়ে হজম করে ফেলেছি। টন কে টন পেনি ক্যাণ্ডি গিলেছি। লিকোরাইস হুইপ, টুটসি রোলস, কিছু বাদ দিতাম না। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে দুঃখটা ঝেড়ে ফেললেন যেন তিনি। ভালো কথা, ক্যাম্পার কি বললো?

হঠাৎ এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে কিশোরও সোজা হয়ে বসলো।

নিনাকে সাহায্য করতে এসেছো তোমরা, তাই না? আবার বললেন মিস এমিনার। তোমাদেরকে যে ফোন করেছে, একথা সকালেই বলেছে আমাকে। আমারও অনুরোধ, ওর জন্যে কিছু করো। মেয়েটা খুব ভালো। এখানে ভালো লোকের বড় অভাব। বেশির ভাগই তো অসভ্য!

পেছন ফিরে তাকালেন মিস এমিনার। ভেজা কাপড় নিয়ে এসে টেবিল মুছতে লাগলো রাগবি ডিগার। উজ্জ্বল রোদে আরো বেশি রোগা লাগছে তাকে। গালে লাল লাল দাগ, সেগুলোর মধ্যে থেকে নারকেল গাছের জটলার মতো চুল গজিয়েছে খাড়া হয়ে। কনুয়ের কাছে আঠা আঠা কি যেন লেগে রয়েছে। অ্যাপ্রনের নিচে টি শার্টটা ময়লা।

স্বাস্থ্য বিভাগ ওর খবর জানে কিনা ভাবি মাঝে মাঝে! নাক কুঁচকালেন মিস এমিনার। সে-ও ওদের একজন!

কাদের একজন? জানতে চাইলো রবিন।

অসভ্যদের! রবিনের দিকে ঝুঁকে খাটো গলায় বললেন মিস এমিনার। স্পীডওয়ের ওধারে ভাঙাচোরা বাড়ি আছে কয়েকটা, একটাতে থাকে ও। চোর ডাকাত, ফকির-টকিরের আজ্ঞা ওখানে। ওদেরকে দিয়ে সবই সম্ভব। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে থাকে…

থেমে গেলেন মিস এমিনার। শক্ত হয়ে গেছে ঠোঁট। ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন, অসভ্যের একশেষ একেকটা! বাপ-মা যে কোথায় ওদের, খোদাই জানে! কোথায় জন্ম, কোথায় বড় হয়, কে জানে! তারপর আর কোনো জায়গা না পেয়ে এসে ঢোকে এই ভেনিসে!

কাফে থেকে বেরিয়ে এলো হেনরি লিসটার। হাতে ট্রে। তাতে স্যাণ্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর কোকা কোলা। টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল। তার পেছনে গেল রাগবি ডিগার।

ডিগারকে, নিচু গলায় বললেন মিস এমিনার, দেখতে পারতো না কিটু।

কিশোর বললো, অনেকেই তো কিটুকে দেখতে পারে না, তার দুষ্টুমির জন্যে।

না না, আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না, তাড়াতাড়ি বললেন মিস এমিনার। চত্বরে যে কটা দোকান মালিক আছে, কিটুর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তাদের কারোই হাত নেই। প্যারেড শুরু হওয়ার সময় আমার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিস্টার মিউরোকে দেখেছি। রক মিউজিক পছন্দ করে যে মহিলা, মিস জারগন, তাকে দেখেছি। প্যারেড দেখতে চত্বরের দিকে এগোচ্ছিল ওরা। ব্রড ক্যাম্পারকেও দেখেছি। তার অ্যাপার্টমেন্ট আর গ্যালারির মাঝখানে পায়চারি করেছে কয়েকবার। তারপর কিটু আর ডবকে দৌড়ে ঢুকতে দেখলাম।

ও! হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলো গোয়েন্দাপ্রধান। ওশন ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে। যাওয়ার পর তাহলে দেখেছেন! গুড! কি কি দেখেছেন?

বেশি কিছু না। ঠিক ওই সময় আমার চুলার টাইমারটা অফ হয়ে গেল। চুলায় কেক ছিলো। তাড়াতাড়ি নামাতে গেলাম। আবার জানালার কাছে ফিরে এসে কিটু বা ডব কাউকেই দেখলাম না। অন্তত চত্বরে ছিলো না তখন, এটা ঠিক। তবে রাগবি ডিগার ছিলো।

আবার বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে ডিগার। মিস এমিনারের শেষ কথাটা কানে গেল। তাঁর দিকে তাকিয়ে কুঁচকে গেল ভুরু। কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ালো। আমি কি করেছি? তার এক হাতে ব্যাণ্ডেজ, কব্জির ঠিক ওপরে।

সামান্যতম চমকালেন না মিস এমিনার, নরম হলেন না। জবাব দিলেন, গতকাল প্যারেডের সময় দেখলাম মিস্টার মিউরোর দোকান থেকে বেরোচ্ছো। আমার কাছে সেটা অদ্ভুত লেগেছে। খেলনা কিংবা ঘুড়ির ব্যাপারে কোনোদিন। কোনো আগ্রহ দেখিনি তোমার। অবাক লেগেছে সে কারণেই। এরা কিটুকে খুঁজতে সাহায্য করছে, তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে বললেন তিনি। ভাবলাম…

কি ভাবলেন! কি ভাবলেন? চেঁচিয়ে উঠলো ডিগার। আমি কিছু করিনি! আপনার কি মনে হয়, খেলনার লোভ দেখিয়ে ওকে ধরে নিয়ে গেছি? পাগল হয়ে গেছেন আপনি!

বারান্দায় বেরিয়ে এলো লিসটার। শুনে ফেলেছে কথা। কাল তুমি ঘুড়ির দোকানে ঢুকেছিলে?

ঢুকেছিলাম। একটা চীনা ঘুড়ির দাম, দেখতে। জানালার কাছে যেটা রেখেছিলো।

শুধু এ জন্যেই?

তাহলে আর কি জন্যে? আবার রেগে উঠলো ডিগার।

কড়া চোখে তার হাতের ব্যাণ্ডেজের দিকে তাকিয়ে মিস এমিনার বললেন, হাতে কি হলো? কুকুরে কামড়ে দিয়েছে, তাই না? আজ সকালে শেলির সঙ্গে বলছিলে, আমি শুনেছি। তোমার নিজের কুকুরে কামড়েছে?

আপনি….আপনি… রাগে কথা আটকে গেল ডিগারের।

আমি কি? নাক গলাচ্ছি? বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি? হা, দেখাচ্ছি। দেখাবো, সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে মিস এমিনারকে।

দেখুন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। ভালো হবে না…

এই, চুপ করো! ধমকে উঠলো লিসটার। আর একটা কথাও বলবে না!

আহ্, কি আরম্ভ করলে তোমরা! শেলিও ধমক লাগালো। লোকে শুনলে কি বলবে! একটানে গা থেকে অ্যাপ্রনটা খুলে টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটমট করে চত্বরে নেমে পড়লো সে। চলে যাবে।

 অ্যাপ্রনটা তুলে নিয়ে লিসটার বললো, মিস এমিনার, মাঝে মাঝে আপনি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেন। আমিও করি। খেলনার দোকানে না হয় কাল ঢুকেইছে রাগবি, তাতে কি হয়েছে? অন্যায় তো কিছু করেনি।

দুজনেই বাড়াবাড়ি করি, তাই না? মুখ কালো করে বললেন মিস এমিনার। কোর্টের আশেপাশে যারা থাকে, সবারই জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে, তোমারও ক্যাশবাক্স থেকে টাকা চুরি হচ্ছে। এর পরও ডিগারকে ভালো বলবে?

ইয়ে…আমার আমতা আমতা করতে লাগলো লিসটার। মাথা ঝাঁকালো। তারপর কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে গিয়ে আবার ঢুকলো কাফের ভেতরে।

বিজেতার হাসি হাসলেন মিস এমিনার। স্বভাব কি আর সহজে বদলায় মানুষের। ডিগারই বা কি করে বদলাবে। যাকগে, কুকুরের কামড়ের কথায় আসা যাক। রাস্তার কয়েকটা নেড়ি কুত্তা গিয়ে বাস করে ওর সঙ্গে।

নেড়ি কুত্তা! মহিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো মুসা। তাহলে কামড়ে দিতেও পারে।

তা পারে। তবে সে সত্যি কথা বলছে কিনা কে জানে?

 চুপ করে মিস এমিনারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

ধরা যাক, নেড়ি কুত্তায় কামড়ায়নি, বলতে লাগলেন তিনি। হয়তো অন্য কোনো কুকুর, যেটার খুদে মনিবের ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো ডিগার। ব্যস, মনিবকে বাঁচাতে কুকুরটা দিয়েছে ওকে কামড়ে। একটা কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে ডিগারের খুব ভাব। কি করে যেন চোখের পলকে খাতির করে ফেলে। কুকুর-বেড়াল সব কিছু। আগে কখনও তাকে কোনো কিছুতে কামড়েছে বলে শুনিনি।

এটাই আমাদের দেখাবেন বলেছিলেন? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। ডিগারের ব্যাণ্ডেজ?

মাথা ঝাঁকালেন মিস এমিনার।

হু, কিশোর বললো। বড় বেশি কাকতালীয়!

 কফির কাপে চুমুক দিলেন মহিলা। কাপটা নামিয়ে রেখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তা ক্যাম্পারের সঙ্গে কেমন কাটলো?

আরও কিছু বলার আছে তার, বুঝতে পেরে চুপ করে রইলো কিশোর।

নিশ্চয় নিজের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা দিতে চেয়েছে, মিস এমিনার। বললেন। তা-ই করে সব সময়। কাল টেলিভিশনের লোকের সামনে কি রকম বেহায়ার মতো গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, দেখোনি?

দেখেছি। হয়তো সত্যিই সাহায্য করতে চাইছে। এই ঘটনাটা ছেলেবেলার আরেকটা দুর্ঘটনার কথা নাকি মনে পড়িয়ে দিয়েছে তার। আপনি জানেন, ছেলেবেলায় তার এক বন্ধু হারিয়েছিলো? তারপর গর্তের পানিতে ভাসতে দেখা যায় ছেলেটার লাশ?

ওর বন্ধু? ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছলেন মিস এমিনার। আমি তো শুনেছি ওর ছোট ভাই। এখন আবার বন্ধু হয়ে গেল কিভাবে? কি জানি, ভুলও শুনে থাকতে পারি। আর কিছু জানার আছে তোমাদের?

মাথা নাড়লো ছেলেরা। নেই। লাঞ্চ খাওয়ানোর জন্যে ধন্যবাদ জানালো। বারান্দা থেকে নেমে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলেন তিনি।

মৃদু শিস দিয়ে উঠলো মুসা। বাপরে বাপ, মহিলা বটে!

চত্বরে ঢুকলো একজন লোক। মলিন চেহারা। পরনের পোশাকটা বেটপ রকমের ঢলঢলে, বেমানান। একটা ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আসছে। পেছনে আসছে একজোড়া মাংরল কুকুর। কাফের বারান্দার কাছে পৌঁছে কুকুর দুটোকে বসতে বললো লোকটা। বাধ্য ছেলের মতো সিঁড়ির গোড়ায় বসে পড়লো জানোয়ার দুটো। ঠেলাটা ওখানে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো লোকটা।

কয়েক মিনিট পরে কাফে থেকে বেরোলো সে। হাতে একটা বড় ঠোঙা। তার পেছনে বেরোলো হেনরি লিসটার। ঠেলা নিয়ে লোকটা সরে যাওয়ার পর বললো, জঞ্জালের মধ্যে নিশ্চয় কিছু কুড়িয়ে পেয়েছে বরগু। আট ডলারের পেস্ট্রি কিনে নিয়ে গেল। কল্পনাই করা যায় না!

মিস এমিনারের ঘরের দিকে তাকালো সে। গলা নামিয়ে বললো, ওই মহিলার ব্যাপারে সাবধান। যদি পছন্দ করে তোমাদের, ভালো। না করলে সর্বনাশ করে দেবে। সাংঘাতিক মহিলা!

লিসটার কাফেতে গিয়ে ঢুকলো।

মুসা বললো বিড়বিড় করে, সেটা আমরাও বুঝেছি। ডিগারকে যেভাবে। আক্রমণ করলো! জবাবই দিতে পারলো না বেচারা!

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। আনমনে চিমটি কাটলো নিচের ঠোঁটে। কুকুরের দেখছি ছড়াছড়ি এখানে। বরগুর সঙ্গে কুকুর। ডিগারের সঙ্গে কুকুর। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে তার এতো ভাব, তা-ও কামড় খেলো কুকুরের? কিটুর ছিলো। কুকুর। সেটা নিয়ে বেরোলো, তারপর গায়েব। কুকুরটাকে পাওয়া গেল। ডাস্টবিনে…।

বাধা দিয়ে বললো মুসা, ডিগারের ওপর চোখ রাখা দরকার, কি বলো?

অন্তত ওর ব্যাপারে আরেকটু খোঁজখবর নেয়া তো অবশ্যই দরকার, মুসার কথার পিঠে বললো রবিন। স্পীডওয়ের ওধারে ভাঙা বাড়িতে থাকে।…এসো, যাই।

.

০৭.

বাড়িটা খুঁজে বের করতে একটুও অসুবিধে হলো না। সামনের সিঁড়ির ওপর বসে। ঝিমোচ্ছে তখন ডিগার। মারমেড ইনের পেছনে এসে দাঁড়ানো ছেলেদের দেখতে পেলো না সে। চট করে একটা গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ওরা।

 চুপ করে দেখছে তিন গোয়েন্দা। বেশ কিছুক্ষণ কিছুই ঘটলো না। নীরব হয়ে আছে ভাঙা বাড়িটা। তারপর স্পীডওয়ে ধরে এগিয়ে এলো একজন মানুষ। সঙ্গে একটা কুকুর। ওটার গলায় বাঁধা দড়ির এক মাথা ধরে রেখেছে। ডিগারের ঘরের পেছনে বেড়ার কাছ থেকে একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঘাউ ঘাউ করে উঠলো কয়েকটা

লাফ দিয়ে উঠলো ডিগার। চিৎকার করে বললো, এই চুপ চুপ! থাম! .

এক মুহূর্ত থমকালো আগন্তুক। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে উঠে গেল ডিগারের বারান্দায়।

কী? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ডিগার।

কুকুর নিয়ে এসেছে যে লোকটা সে মাঝবয়েসী। ভদ্র। মাথা জুড়ে টাক। চোখে। ভারি পাওয়ারের চশমা। ডিগারের কর্কশ কণ্ঠ শুনে পিছিয়ে গেল এক পা। অস্বস্তি। জড়ানো কণ্ঠে বললো, শুনলাম, কুত্তা পছন্দ করো তুমি। তাই নিয়ে এসেছি। বীচফ্রন্ট মার্কেটের সামনে রাবিশ বিনে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। ধরে নিয়ে এসেছি। নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে এটার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুকুরটাকে দেখলো ডিগার। দো-আঁশলা।

 কয় আঁশলা জানি না। তবে তুমি…

আমাকে দেখে কি মনে হয়? খেঁকিয়ে উঠলো ডিগার। কুত্তার দালাল? নাকি এতিম জানোয়ারের জন্যে এতিমখানা খুলেছি?

অবাক হয়ে গেল লোকটা। কিন্তু… ওরা যে বললো, কু-কুকুর পছন্দ করো। তুমি…

তাহলে ওদের কাছেই যাও! গজগজ করতে লাগলো ডিগার। কুত্তা আর কুত্তা!, এমন জানলে কে পালতো! যাও, যে চুলো থেকে এনেছো, সেখানেই নিয়ে ফেলে দাও! যাও!

ধমক খেয়ে পিছিয়ে এলো লোকটা। কুকুরটাকে নিয়ে আবার নামলো পথে। টেনে নিয়ে চললো।

হঠাৎ পুরানো বাড়ির বারান্দা থেকে ডাক শোনা গেল, এই রাগবি, কি হয়েছে?

কিছু না।

একটা মেয়ে বেরিয়ে এসেছে। বয়েস বিশ-বাইশ হবে। কালো চুল। পরনে স্কেটারদের পোশাক। স্কেটিং করতে যাচ্ছে বোধহয়। কিছু না মানে কি? শুনলাম তো চেঁচামেচি করছো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কি যেন। নাহ, তোমাকে। নিয়ে আর পারা যায় না। কতো আর মিথ্যে বলবে?

এই চুপ, চুপ, আস্তে! দ্রুত চারপাশে চোখ বোলালো ডিগার।

ছেলেটার খোঁজ নিতে পুলিশ এসেছিলো। তোমার কুত্তাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলো। মিথ্যে বললাম। এখন দুর্ব্যবহার করে লোকটাকে তাড়ালে। সে কি ভাববে? রেখে দিলে কি এমন হতো?

কি হতো না হতো সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে মাতব্বরি করতে বলেছে।

দেখো, ধমক দিয়ে কথা বলবে না আমার সঙ্গে! মেয়েটাও রেগে গেল। আর আমি থাকছি না এখানে। মিথ্যে কথা বলার দায়ে শেষে আমাকেও নিয়ে গিয়ে গারদে ভরবে পুলিশ।

দুপদাপ করে গিয়ে ঘরে ঢুকলো মেয়েটা। জানালা দিয়ে শব্দ আসছে। তিন গোয়েন্দার কানে এলো, কাঠের সিঁড়িতে পা ফেলার মচমচ আওয়াজ। দুড়ুম-দাডুম আওয়াজ হলো এরপর। নিশ্চয় ড্রয়ার টানাটানি করছে। খানিক পরেই আবার বেরিয়ে এলো মেয়েটা। আঁটো পোশাকের ওপর ঢেলা, লম্বা হাতাওয়ালা গাউনের মতো পোশাক চাপিয়েছে।

এই, নরিনা… বলতে গিয়ে বাধা পেলো ডিগার।

আমি আর এসবের মধ্যে নেই, হাতে একটা বেতের ঝুড়ি নরিনার। সেটাতে জিনিসপত্র উপচে পড়ছে। তার মানে যথাসর্বস্ব যা ছিলো, সব নিয়ে চলে যাচ্ছে সে। সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে রাস্তায় নামলো।

মেয়েটাকে চলে যেতে দেখলো ডিগার। পার্কিং লটের দিকে ফিরতে চোখ। পড়লো ছেলেদের ওপর। এই, এই কি চাও তোমরা?

আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। বেরিয়ে এলো কিশোর। স্পীডওয়ে পেরিয়ে এগোলো বাড়িটার দিকে। তাকে অনুসরণ করলো রবিন আর মুসা। ভাবছি, আমা দেরকে সাহায্য করতে পারবেন, কিশোর বললো। আপনি হয়তো জানেন..

ছুঁচোগিরি করতে এসেছো! জলদি ভাগো! নইলে কুত্তা লেলিয়ে দেবো। যত্তোসব! রাগে গরগর করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ডিগার। কিশোরের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটা যেদিকে গেছে সেদিকে।

পিছু নেবো নাকি? নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো কিশোর।

নেয়া উচিত, মুসা বললো। মেয়েটার কথা শুনলে তো? পুলিশের ভয়েই পালাচ্ছে। তারমানে কিছু একটা অন্যায় করেছে।

শোনো, শোনো, ওদেরকে থামালো রবিন। বাড়িটায় আরও কেউ আছে।

কান পাতলো তিনজনেই। একটা লোকের গলা শোনা গেল। কথা বললো, থামলো, তারপর আবার বলতে লাগলো।

নিশ্চয় টেলিফোন, রবিন বললে আবার। এক কাজ করো। তোমরা। ডিগারের পিছু নাও। আমি থাকি। দেখি, কে বেরোয়?

 কথাটা পছন্দ হলো কিশোরের। মুসাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা হলো। প্যাসিফিক অ্যাভেনিউর দিকে। দক্ষিণে অনেকখানি এগিয়ে গেছে ততোক্ষণে ডিগার। নতুন কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর একটা বোট ম্যারিনা আছে ওদিকে। দূর থেকে তাকে অনুসরণ করলো কিশোর আর মুসা।

মারমেড কোর্ট থেকে আধমাইল দূরে ছোট একটা মার্কেটে ঢুকলো ডিগার।

দুর, লাভ হলো না, মুসা বললো। খাবার-টাবার কিনবে বোধহয়।

হয়তো। দেখা যাক।

মার্কেটের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। কাঁচের পাল্লার ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ডিগারকে। গোশতের বাক্স থেকে কিছু নিয়ে সোজা স্ট্যাণ্ডের কাছে। চলে গেল সে।

চট করে একটা গাড়ির আড়ালে বসে পড়লো দুজনে। বেরিয়ে এলো ডিগার। আবার দক্ষিণে এগোলো, ম্যারিনার দিকে। কিছু দূর এগিয়ে মোড় নিয়ে একটা গলিতে ঢুকলো। এগোলো একটা রেস্টুরেন্টের দিকে।

রেস্টুরেন্টটার নাম মুনশাইন। বেশ উঁচু দরেরই মনে হচ্ছে। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল মার্সিডিজ, ক্যাডিলাক আর জাগুয়ার গাড়ি। ওগুলোর। মাঝখান দিয়ে এগোলে ডিগার। মাঝে মাঝে থেমে লাথি মারে গাড়ির টায়ারে।

ব্যাটা টায়ার চোর! মন্তব্য করলো মুসা। ভালো চাকা খুঁজছে।

আমার মনে হয় না। দেখো।

একটা হুডখোলা কনভারটিবলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ডিগার। সীটের ওপর একটা সেইন্ট বার্নার্ড কুকুর বসে আছে। গলার শেকলটা স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে বাধা। কুকুরটার চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ডিগার। তারপর কথা বলতে আরম্ভ করলো।

উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগলো কুকুরটা।

হাতের ব্যাগ থেকে গোশত বের করে ওটার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ডিগার। গোশত শুঁকল সেইন্ট বার্নার্ড। চাটলো। তারপর খেতে শুরু করলো।

কুত্তা চোর! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

চুপ করে রইলো কিশোর। দেখছে।

দেখতে দেখতে কুকুরটার সঙ্গে খাতির করে ফেললো ডিগার। গাড়ির দরজা খুলে শেকল খুলতে শুরু করলো।

আর চুপ করে থাকতে পারলো না মুসা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঢুকে পড়লো রেস্টুরেন্টের ভেতর। প্রথমে আবছা অন্ধকার একটা হলওয়ে। তারপরে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ডাইনিং রুম। দরজার ভেতরে। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো সে, এই যে শুনছেন? বার্নার্ড কুকুরটা কার? চুরি করে। নিয়ে যাচ্ছে তত!

ঘরের একধারে চেয়ারে বসা একজন লালমুখো মানুষ লাফ দিয়ে উঠে এলো। মুসার পাশ কাটিয়ে দমকা হাওয়ার মতো বেরিয়ে চলে গেল।

রাস্তায় নেমে পড়েছে তখন ডিগার। ব্যাগের গোশতের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে খুশিমনে তার পাশে পাশে চলেছে কুকুরটা।

 পিছু নেয়ার চেষ্টাও করলো না কুকুরের মালিক। দুই আঙুল মুখে পুরে সিটি বাজালো।

থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালো বিশাল কুকুরটা।

আবার সিটি বাজালো লোকটা।

হঠাৎই ডিগারের ব্যাপারে সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে ফেললো যেন সেইন্ট বার্নার্ড। দৌড় দিলো মনিবের দিকে।

হাত থেকে শেকলটা খুলে ফেলার চেষ্টা করলো ডিগার। পারলো না। শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়েছিলো শেকলের এক মাথা, টান লেগে আরও শক্ত হয়ে এঁটে গেল। হ্যাঁচকা টানে পেছনে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর। চিৎকার করে সামলানোর চেষ্টা করলো কুকুরটাকে। পারলো না। রাস্তায় চিত হয়ে পড়ে গেল সে। তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চললো সেইন্ট বার্নার্ড।

এই থাম! চেঁচিয়ে চলেছে ডিগার, এই থাম…

অবশেষে কব্জির প্যাঁচ খুলে গেল। গড়িয়ে গিয়ে একটা ল্যাম্প পোস্টে বাড়ি লেগে থেমে গেল ডিগারের দেহটা।

বড় বড় কয়েক লাফে পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়ে মনিবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা। তার হাত চাটতে শুরু করলো।

 কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো ডিগার। সারা গায়ে ধুলো আর মাটি। কাপড় ছিঁড়েছে। কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে চামড়া। শাই করে রাস্তার মোড় ঘুরে তার পাশে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো একটা পেট্রোল কার। লাফ দিয়ে নেমে এলো একজন পুলিশ অফিসার। এই, কি হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছো?

দৌড় দিলো ডিগার। পার্কিং লট থেকে চলে গেল পানির ধারে। একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো না। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো পানিতে। অফিসারকে বোকা বানিয়ে সাঁতরে চললো খোলা সাগরের দিকে।

কুকুরের মনিবের পাশ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এলো মুসা। কিশোরের দিকে এগোলো। একটা মার্সিডিজের গায়ে হেলান দিয়ে হো হো করে হাসছে গোয়েন্দা প্রধান। হাসতে হাসতে পানি বেরিয়ে গেছে চোখ দিয়ে। তার হাসিটা সংক্রমিত হলো মুসার মধ্যে। বললো, দারুণ একটা খেল দেখালো! একেবারে পানিতে ফেলে ছেড়েছে। কদ্দিন পর গোসল করলো কে জানে!

হাসি কমে এলো অবশেষে কিশোরের। জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, এসো, যাই। রবিন কি করছে দেখিগে। বলেই আবার হা হা করে হেসে উঠলো।

.

০৮.

 পার্কিং লটে একটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে রবিন। খোলা জানালা দিয়ে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু এগিয়ে যাবে? বাড়ির সামনের সিঁড়িতে গিয়ে বসবে? নাকি পেছনের বেড়ার ভেতরে চলে যাবে?

ঠিক এই সময় একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুরগুলো। নাহ্, ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। কিছু একটা দেখে চিৎকার করছে ওগুলো।

সামান্য সরতেই ট্রাকটা, চোখে পড়লো রবিনের। বাড়ির পাশের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা, বেড়ার বাইরে, একটা খোলা জায়গার ঠিক নিচে।

ট্রাকের পেছনে বস্তা আর বিছানার পুরানো গদি ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটা। নিশ্চয় কাঁচের জিনিসপত্র বহন করে ট্রাকটা। গদি আর বস্তার ওপর সাজিয়ে রাখা হয় যাতে না ভাঙে। নোঙরা, ময়লা গদিগুলো। কিন্তু দ্বিধা করার সময় নেই। একছুটে চলে এলো ট্রাকের পেছনে। উঠে পড়লো। লুকিয়ে পড়লো একটা গদির তলায়।

হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরের লোকটার কথা এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে রবিন। লোকটা উন্মাদ। কি যে করে বসবে ঠিক নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবে তখন। সে। জন্যেই আরেকটা জায়গা খুঁজছি। এরই মধ্যে দুবার ঘুরে গেছে পুলিশ। জেনে যাবেই।

একটু বিরতি দিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো লোকটা, বড় ব্যাপার নয় মানে! অনেক বড় ব্যাপার! রাবিশ বিনে ফেলে রাখা কুত্তাটার কথা শোনোনি?

শক্ত হয়ে গেল রবিন। ডবের কথা বলছে।

আরে ঠিকই আছি আমি, ঠিকই আছি, বলে যাচ্ছে লোকটা। পাগল হইনি। যা-ই বলো, আমি থাকছি না। এখন যাচ্ছি, কিছু টাকা জোগাড় করতে পারি কিনা, দেখি। দরকার আছে।

আবার নীরবতা। তারপর লোকটা বললো, ঠিক আছে। যা হয় হবে। স্লেভ মার্কেট তো আছেই।

অবাক হলো রবিন। স্লেভ মার্কেট?

রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো। শুয়েই আছে রবিন। দরজা লাগানোর আওয়াজ হলো। তারপর বারান্দায় পদশব্দ।

শঙ্কিত হলো রবিন। লোকটা পেছনে আসবে না তো? না, এলো না। ট্রাকের দরজা খুলে উঠে বসলো একজন। গর্জে উঠলো ইঞ্জিন। ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করলো ট্রাক। ড্রাইভওয়ে থেকে রাস্তায় এসে উঠলো, বোঝা গেল।

অস্থির ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। একবার ভাবলো লাফিয়ে পড়ে। পরে ভাবলো, দেখাই যাক না কোথায় যায়? লোকটা কে? ডিগারের রুমমেট? বিপদের আশঙ্কা করছে লোকটা, টেলিফোনে তার আলাপ থেকেই বোঝা গেছে। কার কাছ থেকে বিপদ? ডিগার? কিটুর ব্যাপারে কি কিছু জানে? তার আচরণ নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক।

নিশ্চয় এখন রহস্যময় স্লেভ মার্কেটে চলেছে লোকটা। হয়তো ওখানে কিটুর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সূত্র পাওয়া যাবে।

ট্রাক চলেছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে মুখ বের করে দেখছে রবিন। শহরের রাস্তা, দোকান-পাট চোখে পড়ছে। সব অপরিচিত।

অবশেষে থামলো ট্রাক। ইজ্ঞিন বন্ধ হলো। ড্রাইভার বেরিয়ে যাওয়ার সময় মচমচ শব্দ উঠলো ট্রাকের সামনের অংশে।

লোকটা কি পেছনে আসবে? লাফিয়ে উঠে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ার জন্যে তৈরি হলো রবিন।

কিন্তু এবারেও পেছনে এলো না লোকটা। তার পদশব্দ সরে যেতে লাগলো। যানবাহনের আওয়াজ কানে আসছে। বেশ ভিড়। আস্তে মাথা তুলে ট্রাকের পাশ দিয়ে উঁকি দিলো রবিন। চওড়া একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে অনবরত আসছে যাচ্ছে। নানারকম গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি দোকানপাট। পথের পাশে এক জায়গায় জটলা করছে কিছু লোক। প্রায় সবাই বিশাল দেহী, পরনে কাজের পোশাক। কারো কারো পায়ে ভারি বুট, কারো মাথায় শক্ত হ্যাট। কালো চামড়ার লোক আছে, বাদামী চামড়ার আছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ ওরা।

পথের মোড়ে একটা গাড়ি এসে থামলো। দ্রুত কয়েকজন লোক গিয়ে। ড্রাইভারকে ঘিরে দাঁড়ালো, কথা শুরু করে দিলো একসঙ্গে। এই সুযোগে টুক করে নেমে পড়লো রবিন। সরে গেল ট্রাকের কাছ থেকে।

শখানেক গজ দূরে একটা নিচু দেয়াল দেখে তার ওপর উঠে বসলো। কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগলো লোকগুলোকে।

একটু পর পরই এসে মোড়ের কাছে গাড়ি থামছে। জটলার মধ্যে থেকে কিছু লোক যাচ্ছে বসা লোকের সঙ্গে কথা বলতে। কোনো কিছু নিয়ে মনে হয় দর কষাকষি করছে। কথায় বলে উঠে বসছে গাড়িতে, না বলে সরে আসছে।

একজন লোক এসে রবিনের পাশে বসলো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আপনমনেই মাথা নাড়লো। তারপর তাকালো রবিনের দিকে, এই ছেলে, কি চাই তোমার এখানে? কাজ?

বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো রবিন। আমি এই হাঁটতে হাঁটতে…ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। আপনি কি কাজ খুঁজতে এসেছেন?

মাথা ঝাঁকালো লোকটা। আমরা সবাই সে জন্যেই এসেছি। এটা স্লেভ মার্কেট। নাম শোনোনি?

 না। সাংঘাতিক কাণ্ড! দাস ব্যবসা কি এখনও হয় নাকি?

 হাসলো লোকটা। আরে না না, ওরকম কিছু না। শ্রমিকরা আসে এখানে। কাজের জন্যে। দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের কাজ করানো দরকার, তারাও আসে, দামদর করে লোক নিয়ে যায়। হয়তো দেয়াল ধোয়ানোর দরকার পড়লো তোমার, বাগানের ঘাস সাফ করানো দরকার পড়লো, চলে আসবে স্লেভ মার্কেট। লোক পেয়ে যাবে।

 ডেনিম শার্ট আর রঙচটা জিনস পরা মোটা একজন লোক জটলা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেল ট্রাকটার কাছে। সামনের দরজা খুলে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো। ভেতর থেকে। তারপর আবার গিয়ে দাঁড়ালো জটলায়। রবিন আন্দাজ করলো, এই লোকটাই ডিগারের রুমমেট।

মোড়ের কাছে এসে থামলো একটা নীল বুইক। বেরিয়ে এলো একজন লোক। বেশ ভালো স্বাস্থ্য, ধূসর পুরু গোঁফ। পরনে হালকা রঙের স্ন্যাকস, গায়ে গাঢ় রঙের শার্ট। মাথায় নাবিকের টুপি। চোখে কালো চশমা।

দেখলে? রবিনকে বললো তার পাশে বসা লোকটা। এখানে প্রায়ই আসে ও। এমন শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যায়, যার ট্রাক আছে।

ডিগারের রুমমেটের কাছে এগিয়ে গেল টুপিওয়ালা। কথা বলতে লাগলো– দুজনে। অবশেষে মাথা ঝাঁকালো রুমমেট। নিজের ট্রাকে গিয়ে উঠলো। নীল গাড়ির পেছনে পেছনে চালিয়ে চলে গেল।

নিয়ে গেল, বললো রবিনের সঙ্গী।

আনমনে মাথা ঝাঁকালো রবিন। খুব হতাশ হয়েছে। ভেবেছিলো এখানে এসে কোনো জরুরী সূত্র পেয়ে যাবে। ওসব কিছুই পায়নি, শুধু জানলো স্লেভ মার্কেটে শ্রম বেচাকেনা হয়। আর বসে থেকে লাভ নেই। দেয়াল থেকে নেমে রাস্তা ধরে এগোলো। সৈকত থেকে কয়েক মাইল দূরে এই জায়গা, মোড়ের একটা সাইন বোর্ড দেখে বুঝলো। জায়গাটার নাম ল্যাব্রিয়া।

.

০৯.

 কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

মারমেড কোর্টে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে সে আর কিশোর।

সব খুলে বললো রবিন।

হু, কিশোর বললো, স্লেভ মার্কেটের কথা আমিও শুনেছি। আমাদের কেসের সাথে বোধহয় সম্পর্ক নেই এর। একটা ব্যাপার বোঝা গেল, ডিগারের ঘরে আরও লোক থাকে। কিটুর হারানোর পেছনে ওদের কোনো হাত না থাকলেও হয়তো। ডিগারের আছে।

আচ্ছা, মুসা বললো, ওই পুরানো বাড়িটাতে আটকে রাখেনি তো কিটুকে?

মাথা নাড়লো রবিন। মনে হয় না। পুলিশকে ভীষণ ভয় পায় ডিগারের রুমমেটরা। কিটুকে ওখানে নিয়ে গেলে বহু আগেই পালাতো ওরা। নাহ্, কিটু নেই ওখানে। তবে আমার মনে হচ্ছে কুকুরগুলো সাধারণ কুকুর নয়।

হতেও পারে, কিশোর বললো। সেইন্ট বানার্ডটা চুরি করতে গিয়ে কি রকম হেনস্তা হয়েছে ডিগার, রবিনকে বললো সে। আবার হাসতে আরম্ভ করেছে।

হাসলো মুসাও। বললো, লোকটার অবস্থা যদি তখন দেখতে!

হাসি মুছতে পারছে না কিশোরও। বললো, যথেষ্ট হয়েছে, চলো বাড়ি যাই। হেডকোয়ার্টারে কাজ আছে।

বুকশপের সামনে থেকে পার্ক করা সাইকেলের তালা খুলছে ওরা, এই সময় সৈকতের দিক থেকে এলো ব্রড ক্যাম্পার। তিন গোয়েন্দাকে দেখেই ভারিক্কি করে তুললো চেহারা। জিজ্ঞেস করলো, খবর আছে?

না, এখনও কিছু পাইনি, জবাব দিলো কিশোর।

দরজায় এসে দাঁড়ালো নিনা হারকার।

সহানুভূতি দেখিয়ে তাকে বললো ক্যাম্পার, এতো ভয় পেও না। ছেলেটা দুষ্টুমি বেশি করে তো, হয়তো তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যেই এখন কোথাও গিয়ে লুকিয়েছে। নির্জন দ্বীপে বন্দি লং জন সিলভার। বইটা পড়েছে নিশ্চয়?

না, পড়িনি, মাথা নাড়লো নিনা।

তাই? তাহলে হয়তো পু সেজেছে, চলে গেছে উত্তর মেরুতে। কিংবা বাক রোজার সেজে উড়ে গেছে অন্য কোনো গ্রহে। যা উল্টোপাল্টা কল্পনা না তোমার ছেলের। অবশ্য যদি কোথাও চিত হয়ে… চুপ হয়ে গেল ক্যাম্পার।

বুঝে ফেলেছে ছেলেরা। ও বলতে চেয়েছে কোথাও চিত হয়ে যদি পানিতে না ভাসে।

রক্ত সরে গেল নিনার মুখ থেকে। তাকিয়ে রয়েছে ক্যাম্পারের দিকে।

ওহহো, তাড়াতাড়ি বললো ক্যাম্পার, দেখো, কি বলতে কি বলে ফেললাম। কখন যে মুখ ফসকে যায়। আসলে..আসলে..ছোটবেলায় দেখেছি তো ভুলতে পারি না। আমার ছোট ভাইটা খেলতে খেলকে গিয়ে…এরপর থেকে বাচ্চা ছেলে হারালেই আমার ওই এক ভয়। কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে, কিছু মনে করো না।

চুপ করে রইলো নিনা। দুচোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে আসছে পানি।

আর কিছু বললো না ক্যাম্পার। গ্যালারির দিকে রওনা হলো।

.

সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

রবিন আর মুসা ঢুকে দেখলো, ট্রেলারের বুক শেলফ বই ঘটছে কিশোর ওদেরকে দেখে মুখ ফেরালো।

রেফারেন্স বই খুঁজছি পুরানো সিনেমার ওপর।

কিশোরের সিনেমা-প্রীতির কথা জানা আছে অন্যদের। চুপ করে রইলো।

গত বসন্তে হলিউডের সানডাউন থিয়েটারে পুরানো কিছু ব্যারি ব্রীম ছবি দেখিয়েছিলো, কিশোর বললো। ব্রীমের কথা মনে আছে? হেনরী হকিনস সিরিজে গোয়েন্দার অভিনয় করেছিলো।

মুখ বাঁকালো মুসা। কি যে বলো। তখন তো জন্মই হয়নি আমাদের, দেখবো কি করে?

জন্মের আগের ছবি জন্মের পরে দেখতে অসুবিধে হয় না। যাকগে, ব্রীমের কিছু ছবিকে এখন ক্লাসিক হিসেবে ধরা হয়। চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ওই ছবি। একটা ছবির কাহিনী ছিলো একটা ছেলেকে নিয়ে, যে দশ লাখ ডলারের মালিক। হয়েছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে। তার পর পরই একটা ডোবায় তার লাশ ভাসতে দেখা যায়। এরপর একের পর এক খুন হতে থাকে মানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে ওই টাকা যার হাতেই যায় সে-ই খুন হয়ে যায়।

ডোবায় ভাসছিলো? ভুরু কোঁচকালো মুসা।

ব্রড ক্যাম্পারের ভাইয়ের মতো! বললো রবিন।

কিংবা তার বন্ধুর মতো, কিশোর বললো। কোনটা সত্যি সে-ই জানে। বই ঘাটছি সে জন্যেই। ব্রীমের ছবির কোনো স্টিল মেলে কিনা দেখছি।

শেলফ থেকে পুরানো একটা বই নামিয়ে আনলো কিশোর। ডেস্কের ওপর রেখে পাতা ওল্টাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর থেমে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, এই তো, পেয়েছি!

ছবিটার নাম স্ক্রীম ইন দা ডার্ক। একটা রহস্য কাহিনী নিয়ে করা। বইয়ের। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ডোবায় ভাসছে একটা বাচ্চা ছেলের লাশ। পাড়ে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে সেটা দেখছে একজন আর্দালী।

দেখার জন্যে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এলো মুসা আর রবিন।

আরেকটা ছবিতে দেখা গেল, ডোবার পাড়ে এসে ভিড় করেছে অনেক লোক। পানির একেবারে ধারে বসে লাশটাকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়েছে আৰ্দালী। ধরতে তাকে বাধা দিচ্ছে ডিটেকটিভ হেনরী হকিনস, অর্থাৎ ব্যারি ব্রীম। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ। একজনের বয়েস খুবই কম-কিশোরই বলা চলে। মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়েছে সে। বেশ সুন্দর চেহারা।

খাইছে! এ তো ব্রড ক্যাম্পার!

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমার মনে হচ্ছিলো, এই ছবিতেই ক্যাম্পারকে দেখেছি। তাই বই বের করলাম, শিওর হওয়ার জন্যে।

লোকটা মিথ্যুক! বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ররিনের নাক। না ছিলো ছোট ভাই। তার, না ছিলো বন্ধু। গল্পটা বলেছে ও, কারণ-কারণ… বলতে না পেরে থেমে গেল সে।

রহস্যটা এখানেই, আনমনে বললো কিশোর। এরকম গল্প কেন বলতে গেল। ক্যাম্পার? তার নিজের জীবনে সত্যি সত্যি ঘটেনি তো ও রকম কিছু?

 আল্লাহই জানে, হাত ওল্টালো মুসা। কিন্তু বেশি কাকতালীয় হয়ে যাবে না?

তা হবে। যদি মিথ্যেই বলে, তাহলে পুরানো একটা ছবির গল্প চুরি করে বলতে যাবে কেন?

রহস্যই! মাথা দোলালো রবিন। একটা কারণ হতে পারে। ছবির ওই দৃশ্যটা বোধহয় তার খুব মনে ধরেছিলো। কিটুর ওপর সেটা চালিয়ে দিয়ে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছে। ওরকম স্বভাবের লোক আছে।

কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিশোর, এই সময় টেলিফোন বাজলো। রিসিভার তুলে নিলো কিশোর, বলুন?

কিশোর পাশা?

মিস এমিনার! প্রায় চিৎকার করে বললো কিশোর। অবাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফোনের লাইনের সঙ্গে লাগানো স্পীকারের সুইচ অন করে দিলো। যাতে রবিন আর মুসাও শুনতে পারে।

নিনার কাছে তোমাদের ফোন নম্বর পেয়েছি। ইন্টারেসটিং নিউজ আছে। পুলিশকে বলতে পারতাম, কিন্তু ওরা গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। তাই তোমাদেরকেই ধরলাম।

কি হয়েছে?

ওশন ফ্রন্টে হাঁটতে গিয়েছিলাম। ব্রড ক্যাম্পারকে দেখলাম গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আসছে, হাতে একটা কাগজের লম্বা প্যাকেট।

বলুন বলুন!

তার আচরণ ভালো লাগেনি আমার। উসখুস করছিলো, আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। দেখেও না দেখার ভান করলাম। মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলাম সাগরের দিকে।

তারপর?

ভেনিস পিয়ারের দিকে চলে গেল সে। পিছু নিলাম।

তারপর?

কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। এমন ভান করলো, যেন সূর্যাস্ত দেখছে। তারপর আরেকটু এগিয়ে পিয়ারের আড়ালে চলে গেল। আবার যখন বেরিয়ে এলো, দেখি হাতের প্যাকেটটা নেই।

কি ধরনের প্যাকেট? কতো ভারি হবে? কি রকম…

কিটুর লাশ ছিলো ভাবছো তো? না, তা নয়। বেশি বড় না, ভেতরে অন্য কিছু ছিলো।

কি ছিলো?

সেটা জানতে হবে তোমাদের।

নিনাকে কিছু বলেছেন?

মাথা খারাপ! বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা এখনও ভালোই করতে পারি।

আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারেন, কি ছিলো ভেতরে?

নাহ!… ঠিক আছে, রাখলাম।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস এমিনার।

লাইন কেটে গেল।

যাক, খুশি হয়ে বললো মুসা, স্কুবা ডাইভিঙের একটা সুযোগ বোধহয় মিললো। বস্তাটা নিশ্চয় পানিতে ফেলেছে ব্যাটা।

.

১০.

পরদিন সকালে সৈকতে পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা। রোলস রয়েসে করে ওদেরকে নিয়ে এসেছে হ্যানসন। ধূসর, কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। লোকজন বেশি নেই ওশন ফ্রন্টে।

পরে ভিড় হবে, হ্যানসনকে বললো কিশোর। এখন অল্প আছে। সুবিধেই হয়েছে আমাদের।

পিয়ারের পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকালো হ্যানসন। পেছনের সীটে হেলান দিয়ে আছে মুসা। গাড়ি থামতেই ডুবুরির পোশাক পরতে আরম্ভ করলো। বেরোলো গাড়ি থেকে। তার পিঠে এয়ার ট্যাংক বাঁধতে সাহায্য করলো রবিন আর কিশোর। পরে মুখে মাউথপীস লাগিয়ে পানিতে নেমে গেল মুসা।

ও কয়েক ফুট যেতে না যেতেই কনুই দিয়ে কিশোরের গায়ে গুতো দিলো রবিন। হাত তুলে দেখালো।

ওশন ফ্রন্টে এসে হাজির হয়েছে ডিগারের রুমমেট। সৈকতের পিজা স্ট্যাণ্ডের। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। পিজা আর সফট ড্রিংক দিয়ে নাস্তা করছে।

আশ্চর্য! অবাক হয়ে বললো হ্যানসন। এই সময়ে পিজা!

আরেক দিক থেকে ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে এসে উদয় হলো বরগু। পেছনে আসছে নিতান্ত বাধ্য ছেলের মতো কুকুর দুটো। পিজা স্ট্যাণ্ডের কাছে এসে? কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো সেলসম্যানকে ইশারা করলো সে।

পিজা শেষ করে কাউন্টারের কাছ থেকে সরে এলো রুমমেট। স্পীডওয়ের দিকে চললো।

এই, মূসার ওপর চোখ রাখার দরকার নেই, রবিন বললো। আমি যাচ্ছি ওর পিছে। দেখি কোথায় যায়?

সাগরের দিকে তাকালো আবার কিশোর। ডুব দিচ্ছে মুসা। মুহূর্তে তলিয়ে গেল মাথাটা।

ঠিক আছে, রবিনকে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, যাও। হুশিয়ার থাকবে। ওরা কতোটা খারাপ লোক জানি না এখনও। সাবধান!

থাকবো। এগিয়ে গেল রবিন। পিজা স্ট্যাণ্ডের পাশ কাটাচ্ছে সে, এই সময় বেরিয়ে এলো বরগু। হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। ঠেলা গাড়িতে ঠোঙাটা রেখে। গাড়ি ঠেলে নিয়ে এগোলো আবার যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে।

রবিনের সাহায্য লাগবে? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো হ্যানসন। যাবো নাকি ওর পেছনে?

হাসলো কিশোর। গোয়েন্দাগিরি করে হ্যানসনও আনন্দ পায়, সেজন্যেই যেতে চাইছে। বললো, লাগবে না।

হতাশ মনে হলো শোফারকে। মারমেড কোর্টের ওধারে হারিয়ে গেল রবিন। মুসার দিকে নজর ফেরালে কিশোর আর হ্যানসন। পানির ওপরে দেখা যাচ্ছে একসারি বুদবুদ, মুসা কোন দিকে চলছে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

.

ধীরে ধীরে সাঁতরে চলছে মুসা, তলদেশের সামান্য ওপর দিয়ে। পানি তেমন পরিষ্কার না। ঘোলা। ক্যাম্পারের ছুঁড়ে দেয়া প্যাকেটটা এই পানিতে খুঁজে বের করতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো তার। তাছাড়া পরিত্যক্ত জিনিসের অভাব নেই। এখানে। বোতল, ক্যানেস্তারা, আরও হাজারো রকম জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে সাগরের তলদেশ। একটা চটের পোটলা দেখে সেটা ধরে টান দিলো সে। বেরিয়ে। পড়লো বাতিল একটা ডুবুরির পোশাক। সেটা ছেড়ে আবার আগে বাড়লো সে।

পিয়ার বায়ে রেখে এগোচ্ছে মুসা।

হঠাৎ একটা নড়াচড়া টের পেয়ে মাথা ঘোরালো। ডানে নড়ছে কিছু। তলদেশ ধরে যেন ঠেলে এগিয়ে এলো কিছুদূর ওটা, তারপর ওপরে উঠলো। —

হাঙর।

বিশাল হাঙরের হাঁ করা মুখে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি দেখতে পেলো মুসা। অলস ভঙ্গিতে সঁতরাচ্ছে, কোনো তাড়া নেই। থেমে গেছে মুসা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে। ফেলেছে। একেবারে স্থির হয়ে ভাসছে। হাঙর সম্পর্কে নানারকম তথ্য ভিড় করে। আসছে মনে।–

কোনো কোনো হাঙর মানুষ দেখলেই আক্রমণ করে। তবে বেশির ভাগই করে। এটা কি করবে? অনেক সময় জোর শব্দ কিংবা চিৎকার শুনলে ঘাবড়ে গিয়ে। সরে যায় হাঙর।

জোর শব্দ? এমন শব্দ বলতে একমাত্র মুসার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি। দশ ফুট পানির তলায় কি করে জোরালো আওয়াজ করবে? চিৎকার করতে পারবে না। পানির ওপরে যেমন হাত নেড়ে দাপাদাপি করে শব্দ করা যায়, নিচে সেটাও পারা যায় না।

একটা পাথরের দিকে আস্তে হাত বাড়ালো মুসা। তুলে নিলো। আরেকটা লাগবে। দুটো ঠোকাঠুকি করলে শব্দ হবে, কিন্তু তাতে কি পালাবে হাঙর?

 আওয়াজ না করলে কিছু বোঝা যাবে না। কে জানে, ওই আওয়াজে না পালিয়ে রং রেগে গিয়ে এসে আক্রমণ করে বসবে!

কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখতে হবে। আবার হাত বাড়ালো মুসা। হাতে। লাগলো গোল, শক্ত একটা জিনিস।

দুঃস্বপ্ন দেখছে যেন মুসা।

হঠাৎ আতঙ্কের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে।

এগিয়ে আসছে হাঙরটা!

১১.

ডিগারের রুমমেটকে অনুসরণ করে চলছে রবিন।

পুরানো বাড়ির সিঁড়িতে লোকটা পা রাখতেই পেছনের বেড়ার ভেতর থেকে কুকুরের চিত্তার শোনা গেল। পার্কিং লটে একটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কি ঘটে দেখতে লাগলো রবিন।

পেছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। ফিরে তাকালো সে।

গ্যালারির পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে ব্রড ক্যাম্পার। পরনে একটা হালকা নীল রঙের স্ন্যাকস। গায়ে একই রঙের শার্ট। নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।

লোকটার অলক্ষ্যে থেকে তার ওপর নজর রাখলো রবিন।

স্পীডওয়ে পেরিয়ে ওশন ফ্রন্টের দিকে চললো ক্যাম্পার।

ডিগারের বাড়িতে কিছু ঘটছে না। বোধহয় ঘটবেও না, ভেবে, ক্যাম্পারের পিছু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো রবিন। লোকটা বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর আড়াল থেকে বেরোলো সে। পিছু নিলো।

বেশ কিছুটা আগে রয়েছে ক্যাম্পার। উত্তরে চলেছে দ্রুত পায়ে। মারমেড কোর্টের পরে আরও পাঁচ ব্লক এগোলো, তারপর ঢুকে পড়লো একটা গলিতে।

পিছে লেগে রইলো রবিন। গলিটার নাম ইভলিন স্ট্রীট। পথের পাশে পুরানো বাড়িঘর। কোথাও কোথাও গাড়ি আছে। পুরানো মডেলের পুরানো গাড়ি। বারান্দায় খেলছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। পথে আর বাড়িঘরের ফাঁকে যত্রতত্র। ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর।

পুরানো একটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলো ক্যাম্পার।

রবিন ভাবছে, এখানে কেন এসেছে লোকটা? এরকম জায়গায় তার বন্ধু-বান্ধব আছে?

বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাধার ভান করলো। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে বাড়ির ভেতরে কি আছে। খোলা দরজা দিয়ে একটা ছোট চত্বর চোখে পড়লো। কোনো মানুষ দেখা গেল না।

আবার সোজা হয়ে রাস্তা পেরিয়ে এলো রবিন। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখার। জন্যে একটা সুবিধেমতো জায়গা খুঁজছে। একটা উঁচু বারান্দায় খেলছে দুটো ছেলে। ওটার সিঁড়িতে এসে বসলো সে। যেন ওদেরই একজন।

বসে আছে তো আছেই। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কি যে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একেবারে শূন্য, নির্জন। জানালার ভারি পর্দাগুলোর কোনোটাই সরা তো দূরের কথা, সামান্য কাঁপছেও না।

মিনিটের পর মিনিট কাটছে।

পনেরো মিনিট পর একটা গাড়ি বেরিয়ে এলো বাড়িটার পাশ থেকে। নীল বুইক। তীক্ষ্ণ হলো রবিনের দৃষ্টি। চেনা চেনা লাগছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সীটে বসা আরোহীকেও চেনা লাগছে।

ঠিক! স্লেভ মার্কেটে দেখেছিলো আগের দিন! এই লোকটাই ডিগারের রুমমেটকে ট্রাকসহ ভাড়া করেছিলো। সেই একই টুপি মাথায়। চোখে কালো চশমা। পুরু গোফ।

রাস্তায় উঠে পুব দিকে মোড় নিলো গাড়িটা। গতি বাড়িয়ে চলে গেল।

নোটবুক বের করে নম্বর প্লেটের নম্বর আর বাড়িটার নম্বর লিখে ফেললো রবিন। নোটবুক বন্ধ করে ভাবতে লাগলো-বুইকের ওই আরোহীর সঙ্গেই দেখা করতে। এসেছে নাকি ক্যাম্পার? লোকটার সঙ্গে ডিগারের কোনো রকম যোগাযোগ আছে? নাকি যোগাযোগটা ডিগারের রুমমেটের সঙ্গে। স্লেভ মার্কেটে রুমমেটকে ভাড়া করার ব্যাপারটা কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা?

এভাবে এখানে বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ক্যাম্পার বেরিয়ে তাকে দেখলেই বুঝে যাবে, নজর রাখছে রবিন।

উঠে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার জন্যে জায়গা খুঁজলো সে। পেলো না। পায়ে। পায়ে আবার এগিয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটার কাছে। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। কোনো নড়া নেই চড়া নেই শব্দ নেই। যেন ভূতের বাড়ি, মানুষ বাস করে না এখানে।

কয়েকবার দ্বিধা করে শেষে বাড়িটার আরও কাছে চলে এলো রবিন। দরজার বেল বাজালো। কেউ এলো না।

আরকটা দরজার আরেকটা বেল বাজলো। জবাব নেই। তৃতীয় আরেকটা বাজিয়েও সাড়া পাওয়া গেল না।

একটা জানালার কাছে এসে নাক চেপে ধরলো কাঁচের গায়ে। কাঠের মেঝে চোখে পড়লো। নির্জন। ধুলোয় ঢাকা। কয়েকটা খালি বাক্স পড়ে রয়েছে। বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হয় না। আলো জ্বলছে না। নিশ্চয় বিদ্যুৎ নেই। আর সে কারণেই হয়তো বেলের সুইচ টিপেও লাভ হয়নি, ঘণ্টা বাজেনি।

কিন্তু ক্যাম্পার গেল কোথায়?

সদর দরজা দিয়েই তো ঢুকেছিল..

হঠাৎ দম বন্ধ করে ফেললো রবিন। বুঝে ফেলেছে! সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে বটে, কিন্তু বাড়ির ভেতরে নেই ক্যাম্পার, বেরিয়ে গেছে পেছনের কোন দরজা দিয়ে। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছে। নীল বুইক! আলগা গোঁফ লাগিয়ে নিয়েছে। মাথায় নাবিকের টুপি। চোখে কালো চশমা।

পেছনে ভারি বুটের শব্দ হলো। ঝট করে ফিরে তাকালো সে। চমকে গেল।

বিশালদেহী একজন মানুষ। মাঝবয়েসী। টাকা মাথা। খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরে বললো, এই ছেলে, এখানে কি?

শুকনো গলায় জানালো রবিন, ইস্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে রিসার্চ করছি, তথ্য সংগ্রহ করছি। নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো কথাটা।

লোকটাও বিশ্বাস করলো না। ধমক দিয়ে বললো, মিছে কথা বলার আর জায়গা পাওনি! ওই সিঁড়িতে বসে বসে চোখ রাখছিলে, দেখেছি আমি। তারপর উঠে এসেছে চুপি চুপি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছে। নিশ্চয় চুরির মতলব?

না না, আপনি ভুল করছেন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। আমি চোর নই! লোকের সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি। বেলপুশ টিপলাম। কেউ এলো না।

হাতের চাপ সামান্য ঢিল হলো।

 এই সুযোগে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিলো রবিন।

এই থামো! থামো বলছি! চিৎকার শুরু করলো লোকটা। নইলে ভালো হবে না… 

রবিন কি আর দাঁড়ায়? ঝেড়ে দৌড়াতে লাগলো।

.

১২.

 মুসার মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে হাঙর।

হুমকির ভঙ্গিতে নামলো একবার। সঙ্গে করে ছুরি আনা উচিত ছিলো, আফসোস করলো মুসা। যখন ভাবলো, এইবার হামলা চালাবে, ঠিক তখনই হঠাৎ নাক উঁচু করে উঠে গেল ওটা। কয়েক ফুট উঠে দ্রুতগতিতে চলে গেল গভীর পানির দিকে।

যাক, বাঁচা গেল। আবার দম নিতে আরম্ভ করলো মুসা।

শক্ত কি যেন ধরে রয়েছে, মনে পড়লো এখন। পাথর নয় জিনিসটা। শক্ত, গোল, পিচ্ছিল কি যেন। ঘোলাটে পানিতেও চিনতে অসুবিধে হলো না তার। একটা জলকন্যার মাথা। চীনামাটির তৈরি। নিশ্চয় ব্রড় ক্যাম্পারের হারানো জলকন্যা! টুকরো টুকরো হয়ে সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে মূর্তিটার অন্যান্য অংশ। এখনো কোনো কোনোটাতে জড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া বাদামী কাগজ।

এই তাহলে ব্যাপার! মূর্তিটাকেই এনে পানিতে ফেলে গেছে ক্যাম্পার! কিন্তু। কেন?

কয়েকটা টুকরো তুলে নিয়ে যাবে কিনা ভাবছে সে, এই সময় চোখের কোণে আবার দেখলো নড়াচড়া। কি ওটা, ভালো করে দেখার জন্যে থামলো না। প্রয়োজনও মনে করলো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, হাঙরটাই ফিরে এসেছে।

তীরের দিকে পাগলের মতো সাঁতরে চললো সে। অল্প পানিতে পৌঁছে উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ানোর চেষ্টা করলো। ঝুপঝুপ, থপথপ, নানা রকম শব্দ করতে করতে কোনোমতে এসে উঠলে কিনারে। ধপ করে বসে পড়লো বালিতে। তারপর একেবারে চিৎপাত।

কি হয়েছে? কানের কাছে বেজে উঠলো হ্যাঁনসনের কণ্ঠ।

হাঙর! মাস্ক খুলে ফেলেছে মুসা, হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলো।

শিস দিতে দিতে খোশমেজাজে এগিয়ে এলো একজন লাইফগার্ড। চিত হয়ে থাকা মুসর ওপর কিশোর আর হ্যানসনকে উপুড় হয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার?

উঠে বসলো মুসা। হাঙর!

 তাই নাকি? ঠিক আছে, রিপোর্ট করবো। খবরদার, আর নামবে না।

পাগল! আরও নামি!

মুসাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো কিশোর। এখনও জলকন্যার মাথা ধরে  রেখেছে গোয়েন্দা সহকারী। সেটা কিশোরের হাতে দিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো পোশাক বদলানোর জন্যে। কাপড় বদলে ফিরে এসে দেখলো পিয়ারের একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে রয়েছে কিশোর। মূর্তির মাথাটা দেখছে। এটাই তাহলে পানিতে ফেলেছিলো ক্যাম্পার?

তাই তো মনে হয়, মুসা বললে। বাকি টুকরোগুলোও আছে।

কেন করলো একাজ?

আল্লাহই জানে! হাত ওল্টালো মুসা। মিছে কথা বলার ওস্তাদ লোকটা। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, ফেললোই যখন, পানিতে কেন? রাবিশ বিন কি করেছিলো?

নিশ্চয় তার ভয়, কেউ দেখে ফেলবে।

কি হতে দেখলে? কার এতো ঠেকা পড়েছে একটা ভাঙা মূর্তি নিয়ে মাথা। ঘামানোর?

পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো হ্যানসন। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললো, মিস্টার ক্যাম্পারকে কয়েকবার এখানে ওখানে নিয়ে গেছি গাড়ি চালিয়ে। হলিউডের অনেক পাটিটাটিতে যায়। অদ্ভুত আচরণ করে তখন। সিনেমার ডায়লগ নকল করে কথা বলে। বিখ্যাত অভিনেতাদের ভাবভঙ্গি নকল করে। আস্ত একটা ভীড়। পানিতে মূর্তি ছুঁড়ে ফেলাটাও তেমন একটা অভিনয়ের নকল কিনা কে জানে।

লোকটার স্বভাব-চরিত্র আসলেই যেন কেমন! মুসা বললো। কেমন মেকি মেকি!

ঠিক বলেছেন!

 কিশোর, বলতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। ওশন ফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। মুসাও তাকালো। দেখলো, ছুটে আসছে রবিন।

কাছে এসে ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়লো সে। যা জেনে এসেছে, কলার জন্যে আর তর সইছে না। বললো, ডিগার, তার রুমমেট আর ক্যাম্পারের মধ্যে একটা যোগাযোগ রয়েছে।

ইভলিন স্ট্রীটে কি ঘটেছে, খুলে বললো সব রবিন। সব শেষে আবার বললো, আমি শিওর, ও ব্রড ক্যাম্পারই।

খাইছে! মুসা বললো, ছদ্মবেশ নিয়েছে ব্যাটা!

স্তব্ধ হয়ে গেছে কিশোর। আরও কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললো, তুমি বলছো নির্জন বাড়িতে ঢুকে ছদ্মবেশ নিয়ে নীল বুইক চালিয়ে চলে গেছে? গোপন কোনো উদ্দেশ্যে? কাল একই রূপ ধরে গিয়েছিলো স্লেভ মার্কেটে?

আমি শিওর।

হুম! ওই বুইকটার মালিককে বের করা দরকার।

নম্বর নিয়েছি আমি, নোটবুক বের করলো রবিন।

 সেটা নিতে নিতে কিশোর বললো, নির্জন বাড়ি, না?

হ্যাঁ

ক্যাপ্টেন ফ্লেচারকে বলতে হবে। গাড়িটা কার বের করে দেবেন।

ফোন করবে?

 না। নিজে যাবো।

লাঞ্চ সেরে কিশোর আর হ্যানসন রওনা হয়ে গেল। রবিন আবার ফিরে গেল। মারমেড কোটে। গ্যালারিতে ক্যাম্পার ফিরেছে কিনা দেখতে। মুসা গেল ডিগারের ওপর চোখ রাখতে। তার বাড়ির কাছে গিয়ে পথের পাশের একটা ঝোপে লুকিয়ে বসে রইল।

কোস্ট হাইওয়ে ধরে উত্তরে চলেছে রোলস রয়েস। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে। জরুরী কাজে ব্যস্ত ইয়ান ফ্লেচার। কিশোরকে দেখে মুখ তুললেন। আরে কিশোর? কি ব্যাপার?

একটা বুইক সেডানের মালিক কে জানতে চাই। নম্বর নিয়ে এসেছি। ভেনিস বীচের একটা গ্যারেজে রাখা হয় ওটা।

ভেনিস বীচ? চোখ সরু হয়ে এলো ফ্লেচারের। ওই বাচ্চা ছেলেটা…কি যেন নাম…হারিয়ে গেছে। তার কেসে জড়াওনি তো?

হ্যাঁ, স্যার, ওই কেসই। ছেলেটার নাম কিটু। তার মায়ের অনুরোধেই তদন্ত করছি।

কেন, লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারছে না তার মা?

না স্যরি, তা নয়। নিনা হারকার মনে করছে, আমরা অন্য ভাবে সাহায্য করতে পারবো…

বাধা দিয়ে বললেন চীফ, দেখো, কিশোর, খুব সাবধান। একটা ছেলের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, ভুল যাতে না হয়। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

জানি, স্যার। নিজে নিজে কিছুই করতে যাবো না। তেমন বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেবো, কথা দিচ্ছি।

কিশোরের কাছ থেকে গাড়ির নম্বরটা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন চীফ। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলেন। হাতে এক টুকরো কাগজ। ব্রড ক্যাম্পার নামে এক লোকের নামে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন। ঠিকানা, ফোর এইটি এইট, ওশন ফ্রন্ট, ভেনিস।

হুমম! মাথা দোলালো কিশোর।

এরকমই কিছু আশা করেছিলে, তাই না?

আবার মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

বেশ, এবার ক্যাম্পারের সম্পর্কে সব বলো তো।

এখনও সময় হয়নি, স্যার।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন চীফ। হাসলেন। ঠিক আছে, চাপাচাপি করবো না। তবে মনে রেখো, কোনো রকম ঝুঁকি নেবে না। কিছু দেখলেই পুলিশকে খবর দেবে।

দেবো, স্যার।

আবার ভেনিসে ফিরে এলো ওরা। মারমেড কোর্টের পেছনে কিশোরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল হ্যানসন। বলে গেল ঘণ্টাখানেক পর ফিরবে। কাফের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা গেল রবিনকে। হাতে একটা খালি গেলাস। কোকা কোলা খেয়েছে।

আধ ঘন্টা আগে গ্যালারি খুলেছে ক্যাম্পার, জানালো সে।

ইভলিন স্ট্রীটে ওর গাড়িটাই দেখেছিলে, বললো কিশোর।

আমারও তাই মনে হয়েছিলো। নিনা হারকারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললো, একটা জাগুয়ার চালায় ক্যাম্পার। তার বাড়ির পেছনের গ্যারেজে রাখে গাড়িটা। আরেকটা গাড়ি আর ছদ্মবেশ নেয়ার তার দরকার হলো কেন?

জবাব দিতে পারলো না কিশোর। বসে পড়লো বারান্দায়।

একটু পর ফিরে এলো মুসা। বললো, ডিগারের পিছু নিয়েছিলাম। কুকুরের। রহস্য জেনেছি। মুক্তিপণ দাবি করে না সে, পুরস্কার আদায় করে। দেখলাম, একটা সান্তা মনিকার কপি কিনলো। শুধু বিজ্ঞাপনগুলো দেখে ফেলে দিলো কাগজটা। সুযোগ করে ওটাও দেখলাম। একটা বিজ্ঞাপনের ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া। সাদা-কালো একটা স্প্যানিয়েল কুকুরের জন্যে একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা। হয়েছে। কিছুদিন আগে হারিয়ে গেছে কুকুরটা। কাগজটা ফেলে দিয়ে বাড়ির পেছন। থেকে একটা সাদা-কালো স্যানিয়েল বের করে আনলো ডিগার, নিয়ে গেল ওশন পার্কের একটা বাড়িতে। বেল টিপতে দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। তাকে দেখে। দৌড়ে গিয়ে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা, চেটেচুটে অস্থির করে দিলো। ডিগারকে কিছু টাকা এনে দিলো মহিলা। প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলো ডিগার।

থেমে দম নিলো মুসা। তারপর বললো, কিন্তু এর সঙ্গে কিটুর নিখোঁজের সম্পর্ক কি বুঝতে পারছি না। ডবকে নিশ্চয় আটকাতে চায়নি ডিগার, ওই কুত্তা আটকে কোনো লাভ হতো না।

জবাব দিলো না কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায়। ডুবে গেছে। হঠাৎ মুখ তুললো। হতে পারে, অন্য দিকে সরে যাচ্ছি আমরা। হয়তো কিটুর হারানোর সঙ্গে ক্যাম্পারের কোনো হাতও নেই। ডিগার হয়তো এতে জড়িত নয়। ছেলেটা ভীষণ দুষ্ট, হয়তো নিজে নিজেই গিয়ে কোথাও আটকা পড়েছে।

সরাইখানাটা দেখিয়ে বললো সে, কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে মাটির তলার ঘরে ঢুকে যেতে পারে। খোলা জানালা দিয়ে গিয়ে সেলারে ঢুকে বসে থাকতে পারে। পুলিশ অবশ্য খোঁজ করেছে, কিন্তু ওরা কি সমস্ত জায়গা তন্ন তন্ন করে। খুঁজতে পেরেছে? হোটেলটা ছাড়াও এখানে অসংখ্য জায়গা আছে, যেখানে একটা বাচ্চা ছেলে আটকা পড়তে পারে।

সোজা হয়ে বসলো রবিন। কি করতে বলো?

গ্যালারিতে রয়েছে এখন ক্যাম্পার। মারমেড ইনে খুঁজতে ঢুকবো আমরা। দেখি ক্যাম্পার কি বলে।

.

১৩.

 পুরানো সরাইখানাটা খুলতে প্রথমে রাজি হতে চাইলো না ক্যাম্পার। অনেক বছর। ধরে তালা দেয়া রয়েছে। জানালা আটকানো। ছেলেটার ঢোকার পথ নেই।

কিটুর বয়সে, একটা গল্প শোনালো মুসা, একটা নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। জানালা দরজা বন্ধ ছিলো, কিন্তু আমার ঢোকা তো বন্ধ করতে পারেনি। চিলে কোঠার জানালাটা ছিলো খোলা। গাছ বেয়ে উঠে ওই পথে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেছি তো সহজেই, কিন্তু বেরোতে গিয়ে জান বেরিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তবে বেরিয়েছি।

মারমেড ইনের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যাম্পার। একতলা আর দোতলার জানালা বন্ধ, কিন্তু তিনতলার কিছু কিছু ভোলা। অসম্ভব! ওপথে ঢুকতে পারবে না কিটু। ঢুকতে হলে এই গ্যালারি কিংবা মিস্টার ডেজারের ছাতের ওপর দিয়ে গিয়ে উঠতে হবে। = আমরা বলছি না যে কিটুও ওরকম করেছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। কলছি, বাচ্চারা এমন অনেক কাজ করে বসে, বয়স্করা যা কল্পনাও করতে পারে না। খুঁজলে কি কোনো অসুবিধা হবে? হয়তো আটকা পড়ে আছে কোথাও, বেরোতে পারছে না। হয়তো জখম হয়েছে, কিংবা বেহুশ হয়ে আছে।

আর কিছু বলার থাকলো না ক্যাম্পারের। একগোছা চাবি বের করে CLOSED লেখা একটা দরজার দিকে এগোলো। সরাইতে কিটু আটকা পড়লে ডব বেরোলো কিভাবে?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

দেখতে চাইছো, দেখাচ্ছি। তবে অযথা সময় নষ্ট করছে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ওরা, মারমেড ইনের মস্ত দরজার কাছে। দরজার তালা খুলে ঠেলে পাল্লা খুললো ক্যাম্পার। ছোট একটা হলওয়ে দেখা গেল, আবছা অন্ধকার আর প্রচুর ধুলো। হলওয়ে পেরিয়ে লবি, সেখানে বেশ কিছু সোফা আর চেয়ার অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। পুরু হয়ে ধুলো জমে থাকা জানালার কাঁচের। ভেতর দিয়ে আলো ঠিকমতো আসতে পারছে না। পচে টুকরো টুকরো হয়ে আছে কার্পেট। ফুলের টবে মরা গাছের শুকনো উঁটি খাড়া হয়ে রয়েছে এখনো। মেঝের ধুলোয় জুতোর ছাপ, পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি করে গেছে সেই চিহ্ন।

লবি বেরিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকলো ওরা। টেবিলের ওপরে স্তূপ করে রাখা। হয়েছে চেয়ার। ডাইনিং রুমের পরে অনেক গলিপথ, অফিস রান্নাঘর, স্টোররুম। সব জায়গায়ই খোঁজা হলো, কিন্তু কিটুকে পাওয়া গেল না।

রান্নাঘরে মাকড়সার রাজত্ব, জালের অভাব নেই। তাক আর আলমারি গুলোতে বাসা বেঁধেছে নেংটি ইঁদুর। এখানে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা, হঠাৎ পায়ের নিচে কোনোখান থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এলো।

ঝট করে সেদিকে তাকালো কিশোর ও মুসা।

 কে! কে! বলে চিৎকার করে উঠলো মুসা।

এমনকি ক্যাম্পারের মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রান্নাঘরের একধারের একটা দরজা খুললো গিয়ে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিলো কিশোর। অন্ধকার একটা সিঁড়ি চোখে পড়ছে। কেমন যেন ভেজা ভেজা আর টক গন্ধ বাতাসে।

সেলার, ক্যাস্পার কললো। ওটা আগেও ব্যবহার হতো না খুব একটা। আর এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোয়ার বেশি হলে পানি ঢুকে যায় ওখানে।

ডাইনিংরুম থেকে গিয়ে খুঁজে পেতে মোমবাতি বের করে আনলো রবিন। আস্ত নয়, মোমের একটা গোড়া।

মোম জ্বেলে আগে আগে চললো ক্যাম্পার, পেছনে তিন গোয়েন্দা।

সিঁড়ি বেয়ে নামছে ওরা, এই সময় আবার শোনা গেল গোঙানি। এবার আরও কাছে, আরও ভয়াবহ। পাথর হয়ে গেল যেন ওরা। হাত তুলে দেখালো মুসা, সেলারের ওপর দিকে দেয়ালে একটা জানালা। ম্লান একফালি আলো এসে ঢুকছে সে পথে। যানবাহনের আওয়াজও আসছে সেদিক দিয়ে। ধাতব একটা খটাখট, ঘটাং ঘটাং, তারপর আবার সেই ভয়ানক গোঙানি।

রাস্তায় হচ্ছে শব্দটা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা। জানালা ঢেকে রাখা তক্তায় ঠেলা দিলো। বড় হলো ফাঁক। সেখান দিয়ে তাকাতে চোখে পড়লো সরু একটুকরো চত্বর, স্পীডওয়ের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। সরাইখানার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একটা লরি। ময়লা ফেলার গাড়ি ওটা। বিরাট একটা ইস্পাতের দাঁড়া নেমে আসছে চাবি টিপলেই, রাবিশ বিনকে চেপে উপরে তুলে নিয়ে গিয়ে খোলা মুখটা কাত করে ধরছে, ময়লা-জজ্ঞাল সমস্ত ট্রাকের পেছনে তুলে নিয়ে আবার মাটিতে নামিয়ে রাখছে বিনটা। বিন ওপরে ভোলার সময়ই বিকট গোঙানির মতো শব্দ করছে মেশিন।

দূর! হতাশ হয়েছে কিশোর। ময়লা ফেলার গাড়ি!

মাথা ঝাঁকালো ক্যাম্পার। পুরানো আর বদ্ধ জায়গা বলেই শব্দটা বেশি। হচ্ছে।

সেলরিটা খুঁজে দেখতে বেশিক্ষণ লাগলো না। নিরাশ হয়ে আবার রান্নাঘরে ফিরে এলো তিন গোয়েন্দা।

নিচতলায় কিটু নেই। দোতলায় উঠলো ওরা। ঘরে ঘরে সেই একই রকম শূন্যতা, ধুলো মাকড়সার জাল আর ইঁদুর।

একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ক্যাম্পার। ঘরটার নাম রাজকন্যের। স্যুইট। অনেকবার ঢোকার চেষ্টা করেছি। চাবিও আছে, কিন্তু কিছুতেই তালা, খুলতে পারিনি। মরচে পড়ে বোধহয় আটকে গেছে তালাটা। দরজা না ভেঙে আর ঢোকা যাবে না। সাধারণ দরজা হলে ভেঙে ফেলতাম, কিন্তু সুন্দর পাল্লাটা ভাঙতে। মন চায় না।

সত্যিই সুন্দর। নানারকম সামুদ্রিক জীব আঁকা রয়েছে, চারপাশে জলজ আগাছা এঁকে করা হয়েছে অলঙ্করণ। ঠিক মাঝখানে আঁকা একটা জলকন্যার হাসিমুখ।

গ্যালারিতে যে মারমেডটা ছিলো, ক্যাম্পার জানালো, ওটা আগে ছিলো। নিচতলার লবিতে। ইস, এটাকেও যদি নষ্ট না করে খুলে নিয়ে যেতে পারতাম!

চেষ্টা করলে পারতেও পারেন, কিশোর বললো। সত্যিই কি এই ঘরটায় কখনও ঢোকেননি?

না। ভেনিসে এলে এটাতেই থাকতো নিরমা হল্যাণ্ড।

এখানেই ভূত দেখা যায়? মুসার প্রশ্ন।

হাসলো ক্যাম্পার। ওসব গালগল্প বিশ্বাস করো নাকি? আমি করি না। লোকে কতো কিছুই তো বানিয়ে বলে। সব ফালতু।

এরপর তিনতলায় উঠলো ওরা। জানালা দরজা বেশির ভাগই খোলা। ক্যাম্পার বললো, মাটি থেকে তিরিশ ফুট ওপরে। এখানে উঠতে পারবে না। ও। অসম্ভব।

চিলেকোঠা আছে? কিশোর জানতে চাইলো।

না।

আশা নেই তবু খুঁজলো গোয়েন্দারা। কিটুর কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না। এককোণ থেকে একটা শ্যাফট নেমে গেছে নিচের ভাড়ার ঘরে।

এটাকে বলে ডামবওয়েইটার শ্যাফট, বুঝিয়ে বললো ক্যাম্পার। রান্নাঘর থেকে এটা দিয়ে খাবার সরাসরি ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

শ্যাফটটা শূন্য। ক্যাম্পার জানালো, টর্চ দিয়ে ভালমতো এটার ভেতরে খুঁজে দেখছে পুলিশ।

নিচতলায় নেমে এলো আবার ওরা। গ্যালারিতে ঢুকলো। ক্যাম্পারকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে, রোদে। চত্বরে দেখা গেল নিনা হারকারকে। চোখ বসে গেছে, রোগা হয়ে গেছে শরীর। গোয়েন্দাদের দেখে বললো, ওখানে খুঁজতে গিয়েছিলে তো? নেই আমি জানি। এ-ও জানি, ওর কি হয়েছে। স্পীডওয়েতে চলে– গিয়েছিলো, কিংবা আরও দূরে। গাড়ি এসে চাপা দিয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলে। বকা শোনার ভয়ে আরও দূরে চলে গিয়েছে কিটু, তারপর আর পথ চিনে ফিরে আসতে পারেনি। এটাই হয়েছে। থামলো একটু, তারপর বললো, টেলিভিশন দেখে কিংবা বই পড়ে সে অনেক কিছু করতে চাইতো। গত হপ্তায় কি ছবি দেখেছে জানো? পুরানো একটা সিনেমা, দ্য লিটল ফিউজিটিভ।

 হু? বলে উঠলো ক্যাম্পার। ছেলেদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কানে গেছে নিনার কথা।

হ্যাঁ। একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে গল্প। ছেলেটার মনে হয়েছে, তার ভাইকে সে খুন করেছে। ফলে কনি আইল্যাণ্ডে পালিয়েছে সে। কিটুও ওরকম করেই পালিয়েছে। ভেনিস পিয়ারে খুঁজেছে পুলিশ। পায়নি। তারমানে অন্য কোথাও লুকিয়েছে।

 ঠিক বলেছো, নিনা, জোর গলায় বললো ক্যাম্পার। যাবে কোথায়? না। খেয়ে কদিন থাকবে? খিদে সহ্য করতে না পেরে সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসবে।

গ্যালারিতে ফিরে গেল ক্যাম্পার।

কিন্তু খিদে আর কতো সহ্য করবে? কাদো কাদো গলায় বললো নিনা, দুদিন তো হয়ে গেল। চোখের পানি মুছে ঘুরলো। পা টেনে টেনে এগোলো বুকশপের দিকে।

মারমেড় গ্যালারির দিকে ফিরলো মুসা। গ্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে ক্যাম্পার, দরজায় ঝুলিয়ে দিয়েছে CLOSED লেখা সাইনবোর্ড।

গেছে কোথাও, মুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো কিশোর। নিনার গল্পটা নাড়া দিয়েছে তাকে। ওর মুখ দেখেছিলে, কি রকম বদলে গিয়েছিলো?

 বেশি দূর যেতে পারেনি নিশ্চয়, রবিন বললো। দৌড় দিলো ওশন ফ্রন্টের দিকে। চত্বরের উত্তর দিকটা দেখে ফিরে এলো একটু পরেই। গ্যালারির পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামছে। জলদি এসো।

ঘুরে মারমেড ইনের পেছনে চলে এলো ওরা। গ্যারেজ থেকে জাগুয়ারটা বের। করে ফেলেছে ক্যাম্পার।

খাইছে! গাড়ি! ফলো করবো কি করে? হাত নাড়লো মুসা।

এসো, পারবো, বলে অল্পীডওয়ের দিকে ছুটলো কিশোর। রোলস রয়েসটা। এসে গেছে। ওদের পাশে এসে ব্রেক কষলো হ্যানসন। বললো, যাবেন কোথাও…

তার কথা শেষ হলো না। একটানে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিশোর। জাগুয়ারটা দেখিয়ে বললো, ওটাকে ফলো করুন।

রবিন আর মুসাও উঠে বসেছে।

 গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে জাগুয়ারের পেছনে লাগলো হ্যানসন।

 প্রথমে পুবে গেল জাগুয়ার। ব্লকখানেক এগিয়ে উত্তরে মোড় নিয়ে চললো সান্তা মনিকার দিকে।

সান্তা মনিকায় গিয়ে সৈকতের দিকে মুখ ঘোরালো জাগুয়ার। থামলো না। থামলো সান্তা মনিকা পিয়ারের সিকি মাইল দূরে। হ্যানসন থামলো না। জাগুয়ারের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে পরের পার্কিং এরিয়ায় ঢুকলো।

গাড়ি থেকে বেরোলো না গোয়েন্দারা। এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে জাগুয়ারটা। ক্যাম্পার বেরোলো।

হেঁটে চললো পিয়ারের দিকে।

হু, আনমনে বললো কিশোর, এখানকার পিয়ারের নিচেই তাহলে লুকিয়েছে ছেলেটা। পুলিশ ভেনিস পিয়ারে খুঁজেছে, সান্তা মনিকায় আসেনি। নিনার কাছে শুনেই ক্যাম্পার অনুমান করে নিয়েছে এখানে থাকতে পারে।

ভেনিস থেকে তো বেশ দূরে জায়গাটা, ক্যাম্পারকে পিয়ারের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখছে রবিন। দু-মাইল তো হবেই।

কিটুর মতো একটা ছেলের জন্যে কি এটা বেশি দূর?

ক্যাম্পার যদি দেখে ফেলে? মুসার গলায় উদ্বেগ। লোকটা সুবিধের না। কি করে বসবে…

থেমে গেল সে। পিয়ারের নিচ থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে ক্যাম্পার। রোগা, লালমুখো, ছেঁড়া পোশাক পরা এক লোক তাড়া করেছে তাকে। হাতে একটা খালি মদের বোতল। বাড়ি মারার ভঙ্গিতে নাড়ছে ওটা।

অলিম্পিক জেতার বাজি রেখেছে যেন ক্যাম্পার। লোকটার আগেই চলে। এলো গাড়ির কাছে। এক ঝটকায় দরজা খুলে উঠে বসলো ড্রাইভিং সীটে। মুহূর্ত পরেই হাইওয়ের দিকে চলতে আরম্ভ করলো জাগুয়ার।

নীরবে হাসছে হ্যানসন। কিশোর তার দিকে তাকাতেই বললো, প্রায়ই কানে আসে সান্তা মনিকা পিয়ারের নিচে বিশেষ ভদ্রলোকদের আড্ডা। আজ বুঝলাম ঠিকই শুনেছি। ক্যাম্পার সাহেবের বোধহয় খবরটা জানা ছিলো না।

হ্যানসনের কথা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে মুসা। এগোলো লোকটার দিকে। মাতালের মতো দুলছে লালমুখে, নিজে নিজেই কথা বলছে।

তার কাছে গিয়ে মুসা খুব বিনয় করে বললো, শুনছেন?

জ্বলন্ত চোখে মুসার দিকে তাকালো লোকটা।

ছোট্ট একটা ছেলেকে খুঁজছি আমরা, আবার বললো মুসা। হাত দিয়ে উচ্চতা দেখিয়ে বললো, এই এত্তোটুকু হবে লম্বা। দুদিন ধরে নিখোঁজ।

না, দেখিনি। বাচ্চাদের ঢুকতে দিই না এখানে। দেখলেই ভাগিয়ে দিই।

আর কিছু বলে লাভ হবে না বুঝে ফিরে এলো মুসা। নাহ, কাজ হলো না।

একেবারেই হয়নি, তা নয়, কিশোর বললো, একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছি। ক্যাম্পারও জানে না কিটু কোথায় আছে। এবং সে-ই ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে চায় সবার আগে। অবাক লাগছে না? তার এতো মাথাব্যথা কিসের? একটু থেমে বললো, বুঝতে পারছি, কিটুকে খুঁজে বের করতে হলে আগে ব্রড ক্যাম্পার রহস্যের সমাধান করতে হবে।

.

১৪.

পরদিন সকালে আবার ভেনিসে গেল তিন গোয়েন্দা। নিনাকে পাওয়া গেল না। বুকশপের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন তার বাবা।

বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকতে বলেছি, বোরম্যান বললেন। না খেয়ে না ঘুমিয়ে একেবারে কাহিল হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তিনটে দিন হয়ে গেল, এখনও এলো না! কি যে হলো ছেলেটার!

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো কিশোর। মিস্টার বোরম্যান, কুকুরটার পোস্ট মর্টেম করার কথা ছিলো। কিছু বোঝা গেছে?

নাহ, গাড়ি চাপা পড়েছে বলে মনে হয় না। মাথায় আর ঘাড়ে খুব সামান্য আঘাত। ডাক্তারদের ধারণা, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। বুড়ো হয়ে গিয়েছিলো, শক পেয়েছিলো হয়তো, সইতে পারেনি।

দোকানে ঢুকে গেলেন বোরম্যান। ছেলেরা চললো তাদের কাজে।

একটা পরিকল্পনা করে তৈরি হয়ে এসেছে ওরা আজ। সঙ্গে করে ওয়াকি-টকি এনেছে। রবিন আর মুসাকে একটা করে দিয়ে তৃতীয়টা নিজে রাখলো কিশোর। ডিগারের বাড়ির কাছে ঝোঁপের ভেতর গিয়ে নজর রাখার জন্যে লুকিয়ে বসলো রবিন।

 কাফের বারান্দায় একটা টেবিলের কাছে বসলো মুসা আর কিশোর। ব্রড ক্যাম্পারের বাড়ির ওপর চোখ রাখবে ওরা। একটু পরেই সরে গেল জানালার পর্দা। উঁকি দিলো ক্যাম্পার। কিশোর আর মুসার ওপর চোখ পড়তে দ্বিধা করলো একবার, তারপর হাত নাড়লো।

হাত নেড়ে জবাব দিলো দুই গোয়েন্দা।

 এখানে বসে সুবিধে করতে পারবো না, মুসা বললো। দেখে ফেলেছে।

তবু এখানেই বসতে হবে। আগেও বসেছি, কাজেই সন্দেহ করবে না।

কাফে থেকে বেরিয়ে এলো লিসটার। জিজ্ঞেস করলো, কি লাগবে?

ঠিক এই সময় ওয়াকি-টকিতে ভেসে এলো রবিনের কণ্ঠ, কিশোর, এইমাত্র বেরিয়ে গেল ডিগার। তার রুমমেট গেছে দশ মিনিট আগে। বাড়িতে কেউ নেই এখন।

শুনলো লিসটার। ভুরু কোঁচকালো। কিন্তু কিছু বললো না।

মুসাকে বললো কিশোর, তুমি এখানে থাকো। খিদে পেলে খাও। আমি আসছি। গ

লিসটার কিংবা মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চলে এলো মারমেড কোর্টের পেছনে, রবিন যেখানে বসে আছে।

হেঁটে গেছে ডিগার, রবিন জানালো। একবার ভাবলাম পিছু নিই, ভাবলাম দেখিই না, এখানেও কিছু ঘটতে পারে।

ভালো করেছে। বসে থাকো, আমি যাচ্ছি।

দরজায় তালা আটকে দিয়েছে ডিগার।

ঢোকার নিশ্চয় আরও পথ আছে।

ঠিকই আন্দাজ করেছে কিশোর। বাড়ির পুবধারে একটা জানালা খোলা পাওয়া গেল। আস্তে করে চৌকাঠে উঠে বসে ভেতরে লাফিয়ে নামলো সে।

ঘরটা বোধহয় একসময় ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার হতো। ছাত থেকে ঝুলছে অনেক পুরানো একটা ঝাড়বাতি। একধারের দেয়ালে একটা সাইডর্বোড় তৈরি করা হয়েছে, রুপালি রঙ করা। কাঠের মেঝেতে এক জায়গায় পড়ে রয়েছে। কতগুলো ছেঁড়া ম্যাগাজিন। আর কিছু নেই, একটা চেয়ারও না।

রান্নাঘরে ঢুকলো কিশোর। একটা টেবিলে পড়ে আছে এঁটো প্লেট। সিংকে। রয়েছে আরও কয়েকটা। টেবিলের এক কোণে জড়ো করে রাখা হয়েছে কুকুরের খাবার। বাজে গন্ধ বেরোচ্ছে সব কিছু থেকেই। পেছনে যাবার দরজাটা ভাঙা, বেঁকে রয়েছে।

সামনের ঘরে একটা চামড়ার সোফা, বয়েস কতো অনুমান করাই মুশকিল। কাঁচের টপওয়ালা গোল একটা টেবিল, তাতে কয়েকটা কুকুরের কলার, আর সান্তা মনিকা পত্রিকার একটা কপি পড়ে আছে। কুকুর হারানো বিজ্ঞাপনে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা। বাদামী রঙের ম্যানিলা খাম আছে কয়েকটা। সরকারী খাম। ডাকবাক্স থেকে এসব চুরি করে আনে নাকি?–ভাবলো কিশোর।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো সে। শোবার ঘর আর গোসলখানা দেখতে বেশি সময় লাগলো না। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই, বাথরুমে কিছু অধধায়া পুরানো কাপড় ছাড়া।

তিনতলা নেই বাড়িটায়, বেসমেন্টও নেই, নেই কিটুর কোনো চিহ্ন।

হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসতে যাবে কিশোর, এই সময় ওয়াকি-টকিতে শোনা গেল রবিনের গলা। কিশোর ডিগার আসছে!

এক দৌড়ে ডাইনিং রুমে চলে এলো কিশোর। জানালা দিয়ে দেখলো, প্যাসিফিক অ্যাভেনর দিক থেকে আসছে ডিগার।

রান্নাঘরে ঢুকলো কিশোর। সামনের বারান্দায় পদশব্দ শোনা গেল। ভাঙা দরজাটা খুলে পিছনের বারান্দায় চলে এলো সে। একসঙ্গে ফেটে পড়লো যেন কুকুরগুলো। প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো।

এই, অমন করছিস কেন? সামনের বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ডিগার।

চট করে পেছনের আঙিনাটায় চোখ বুলিয়ে নিলো কিশোর। তক্তার উঁচু বেড়ায় ঘেরা জায়গাটা। ওটা ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না। একমাত্র যে গেটটা আছে, ওটা দিয়ে বেরোতে গেলে ডিগারের চোখে পড়ে যাবে।

একটা কাজই করতে পারে, এবং সেটাই করলো কিশোর। দৌড় দিলো। কুকুরের খোয়াড়ের দিকে।

এই, এই! দেখে ফেলেছে ডিগার। বাড়ির ধার ঘুরে দেখতে আসছিলো চেঁচামেচি করছে কেন কুকুরগুলো।

ফিরেও তাকালো না কিশোর। সব চেয়ে কাছে যে খোয়াড়টা পেলো, খুলে দিলো ওটার দরজার হুড়কো। খোলা পেয়ে চোখের পলকে বেরিয়ে পড়লো জার্মান শেফার্ড।

এই, এই কুত্তা, ঢোক, ভেতরে ঢোক! চেঁচিয়ে আদেশ দিলো ডিগার।

কি হলো দেখার জন্যে দাঁড়ালো না কিশোর। খুলে দিলো আরেকটা খোয়াড়ের হুড়কো। ঘাউ করে উঠে বেরিয়ে এলো আরেকটা কুকুর। শেফার্ডের ওপর চোখ পড়তেই গেল রেগে। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লো ওটার ঘাড়ে। বেধে গেল মারামারি। থামানোর জন্যে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলো ডিগার। বৃথা চেষ্টা।

আরেকটা খোয়াড়ের হুড়কো খুলে দিলো কিশোর, তারপর আরও একটা।

কুকুরগুলোকে ছাড়াতে গিয়ে ইতিমধ্যেই দু-জায়গায় কামড় খেলো ডিগার।

 বেড়ার ফাঁক দিয়ে এসব দেখলো রবিন। তাড়াতাড়ি খুলে দিলো চত্বর আর ড্রাইভওয়ের মাঝের গেট। খোলা দেখে চোখের পলকে ঝগড়া থামিয়ে দিলো কুকুরগুলো। দৌড় দিলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।

ডিগারের অবস্থা দেখার মতো। চেঁচাতে চেঁচাতে গলার রগ ফুলে গেছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন, দুহাত তুলে উন্মাদ নৃত্য শুরু করেছে। কে শোনে কার। কথা। প্রথমেই খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল শেফার্ডটা।

একে একে চারটে কুকুর স্পীডওয়েতে বেরিয়ে চার দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ওদের পেছনে ছুটলো ডিগার। শিস দিয়ে এবং আরও যতো রকমে কুকুরকে ডাকা। স, ডেকে ডেকে ফেরানোর চেষ্টা করলো।

 রাস্তার মোড়ে বসে পড়েছে রবিন। বেদম হাসছে।

এই সময় স্পীডওয়ে ধরে আসতে দেখা গেল রুমমেটের ট্রাক।

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়ালো ট্রাকটা। লাফিয়ে নামলো রুমমেট। একটা কুকুরকে ধরার জন্যে ছুটলো। কয়েক পা গিয়েই থেমে গেল যেন দেয়ালে হোঁচট খেয়ে। রাস্তার মাথায় দেখা দিয়েছে দুটো পুলিশের গাড়ি।

 দেখেই আরেক দিকে দৌড় দিলো ডিগার। বেড়ার পাশের কয়েকটা ঝোঁপের দিকে। রুমমেট ছুটলো তার উল্টোদিকে।

চেঁচামেচি শুনে অন্যান্য বাড়ির কয়েকজন লোক বেরিয়ে এসেছে।

 গাড়ি থামিয়ে নামলো পুলিশ।

সবার চোখ এড়িয়ে সরে পড়লো দুই গোয়েন্দা। সন্তুষ্ট হয়েছে কিশোর। একটা কাজ অন্তত সমাধা করতে পেরেছে। বন্ধ করে দিয়েছে ডিগারের কুকুর চুরির ব্যবসা।

.

১৫.

 মারমেড কোর্টের উত্তর ধারে রবিনকে রেখে, ক্যাম্পারের গ্যালারির দিকে এগোলো কিশোর। ঘুরে এসে দেখলো, কাফের বারান্দায় বসে রয়েছে মুসা।

সুতোর দোকানের ওপরে একটা দরজা খুলে গেল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন মিস এমিনার। ডেকে বললেন, এই, তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।

চট করে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো মুসা আর কিশোর।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো দুজনে। দরজায় অপেক্ষা করছেন মিস এমিনার। ডেকে নিয়ে এলেন ভেতরে।

বসার ঘরে বসে আছেন মিস্টার ডেজার। ব্রড ক্যাম্পারের জানালার দিকে চোখ।  

ডিগারকে তো ফাঁসিয়ে দিয়েছো দেখলাম, মিস এমিনার বললেন হাসিমুখে। ক্যাম্পারকেই বা ছাড়বে কেন?

আবার চোখে চোখে তাকালো দুই গোয়েন্দা। ক্যাম্পারকে একেবারেই দেখতে পারেন না মহিলা।

ওকে আপনি দেখতে পারেন না, বলেই ফেললো মুসা।

 ভালো লোক হলে তো পারবো? ডেজার বললেন।

জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। গ্যালারিতেই রয়েছে ক্যাম্পার। কফির কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়েছে রান্নাঘর থেকে।

 পুরানো সরাইখানাটার পেছনের অংশে চোখ পড়লো কিশোরের। ডেজারকে জিজ্ঞেস করলো, ওটা সম্পর্কে তার কি ধারণা।

লোকে বলে ভূত আছে বাড়িটাতে, আগেও বলেছেন, আবার বললেন ডেজার। ভূতের কাছাকাছি বাস করতে পেরে যেন খুব খুশি তিনি। ওটা নাকি নিরম হল্যাণ্ডের প্রেতাত্মা।

একেবারে কাঠির মতো শুকনো তার শরীর, যোগ করলেন এমিনার। ভূতের কাছ থেকে নিশ্চয় ভাড়া পায় না ক্যাম্পার। অথচ তার মতো একটা লোক টাকা উপার্জনের চেষ্টা করছে না হোটেলটা থেকে, এটা বিশ্বাস হয় না। না ভাঙার নিশ্চয়। কোনো কারণ আছে।

কিন্তু কারণটা কি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো কিশোর। দামী জায়গা এখন এটা। সাগরের দিকে মুখ করা। চমৎকার হোটেল বানিয়ে প্রচুর টাকা ইনকাম করা যায়।

আসলে ক্যাম্পারটাকে বোঝাই মুশকিল, জোরে মাথা আঁকালেন মিস এমিনার। আজব লোক!

ওপর তলার জানালায় শিক নেই, কিশোর বললো। ভাবছি, ঢোকা যাবে। কিনা! এই বাড়িটার ছাতের ওপর দিয়ে যাওয়া যায়, চেষ্টা করলে।

অবাক হলো মুসা। কেন? দেখেই তো এলাম একবার।

নিরমা হল্যাণ্ডের ঘরটাতে ঢুকতে পারিনি, ভুলে গেছো?

ওটাতেই তো থাকে ভূত, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ডেজার। ওই জানালী গুলো দেখছো, উত্তর ধারে? ওটা নিরমা হল্যাণ্ডের ঘর। রাতের বেলা ওখানেই আলো দেখি মাঝে মাঝে।

ঘরের ভেতরের আলো না। যুক্তি দেখালেন মিস এমিনার, হয়তো বাইরের আলো এসে পড়ে জানালার কাঁচে, আপনার মনে হয়েছে ভেতরে জ্বলছে।

জবাব দিলেন না ডেজার, এড়িয়ে গেলেন। কিশোরকে বললেন, তোমরা যেতে চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি। ক্যাম্পারের সঙ্গে কথা বলার ছুতোয় তাকে আটকে রাখবো, এই সুযোগে তোমরা গিয়ে ঢুকে দেখে আসতে পারো।

থ্যাংক ইউ, মিস্টার ডেজার।

আমি এখান থেকে চোখ রাখছি, মিস এমিনার বললেন। যদি এক ঘণ্টার মধ্যে না ফেরো তোমরা, মিস্টার ডেজার আর মিস্টার বোরম্যানকে পাঠাবো তোমাদের খুঁজতে।

উঠে বেরিয়ে গেলেন ডেজার। গ্যালারিতে গিয়ে ঢুকলেন। কথা বলতে শুরু করলেন ক্যাম্পারের সঙ্গে। চত্বরের দিকে পেছন ফিরে আছে ক্যাম্পার।

এসো, যাই, মুসাকে বললো কিশোর।

কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। যদি…যদি সত্যিই ভূত থেকে থাকে?

থাকবে না, কারণ, ভূত বলে কিছু নেই। এসো।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলো না মুসা। তবে আর প্রতিবাদও করলো না। মিস এমিনারের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে এলো। ছাতে উঠে পেরিয়ে এলো মিস্টার ডেজারের ঘরের ছাত। সামনেই সরাইখানার দেয়াল। মাথা নিচু করে রইলো ওরা, যাতে গ্যালারি থেকে ক্যাম্পারের চোখে না পড়ে।

হাত থেকে উঁচুতে তিনতলার জানালা। তবে বেশি উঁচু নয়। উঁকি দিয়ে একবার দেখলো কিশোর, ক্যাম্পার আর ডেজার কথা বলছেন।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা জানালার পাল্লায় ঠেলা দিলো মুসা। খুলে গেল ওটা। জানালা গলে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর।

তিনতলার সমস্ত ঘরই একবার দেখে গেছে। আজ আর দেখার প্রয়োজন মনে। করলো না। সোজা এগোলো সিঁড়ির দিকে। নেমে এসে দাঁড়ালো প্রিন্সেস স্যুইটের। সামনে। নব ধরে মোচড় দিলো মুসা। ঘুরলো না। জানে লাভ হবে না, তবু কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো পাল্লায়।

আমরা রান্নাঘরের ওপরে রয়েছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর। কিংবা ভাঁড়ারের ওপর। আর তিনতলার কোণের ঘরের নিচে রয়েছি, যেটা থেকে ডামব ওয়েইটার নেমে গেছে। হাসি ফুটলো মুখে। শ্যাফটটা নিশ্চয় প্রিন্সেস স্যুইটের ভেতর দিয়ে নেমেছে। এই দেয়ালটার ঠিক ওপাশে। ঘরে খাবার পাঠানোর জন্যে তৈরি হয়েছে ডামবওয়েইটার, নিশ্চয় বন্ধ থাকার কথা নয় সব জায়গায়। প্রতি তলাতেই ওটা থেকে বেরোনোর জায়গা আছে।

খাইছে! তাই তো!

তাড়াতাড়ি আবার তিনতলায় উঠে এলো ওরা। শ্যাফটের ছোট দরজাটা খুলে ভেতরে উঁকি দিলো কিশোর। অন্ধকার। বাড়িটা তৈরি করতে কাঠ লেগেছে, ওগুলোর মাথা অনেক জায়গায় বেরিয়ে রয়েছে শ্যাফটের ভেতর।

ধরে ধরে সহজেই নেমে যেতে পারবো, বললো মুসা। মইয়ের মতো।

নেমে যেতে আরম্ভ করলো সে।

ওপর থেকে দেখছে কিশোর।  

বেশিক্ষণ লাগলো না, দোতলায় দরজাটা পেয়ে গেল মুসা। পা দিয়ে ঠেলতেই খুলে গেল পাল্লা। শূন্য একটা ঘরে ঢুকলো মুসা। ধুলোর ছড়াছড়ি সবখানে। দরজা। দিয়ে আবার মুখ বের করে ওপরে তাকিয়ে ডাকলো সে, এসো।

কিশোরও নেমে এলো। ঢুকলো নিমা হল্যাণ্ডের ঘরে।

ছোট একটা অ্যান্টিরুমে ঢুকেছে ওরা। পুরানো ধাচের একটা সুইং ডোরের। গায়ে বসানো ছোট কাঁচের ভেতর দিয়ে আলো আসছে।

বাকি ঘরগুলো ওপাশে আছে, ফিসফিসিয়ে কথা বলছে মুসা, ভয়ে ভয়ে। তাকালো এদিক ওদিক। যেন ভয় করছে এখুনি বেরিয়ে আসবে ভূতটা।

সুইং ডোরে ঠেলা দিলে কিশোর। ওপাশে তাকিয়েই হাঁ হয়ে গেল।

ধুলোর নামগন্ধও নেই ঘরটায়। অনেকদিন বদ্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ থাকে বাতাসে, তেমন গন্ধও নেই। লুকানো কোনো ভেন্টিলেটর দিয়ে বাতাস এসে থিরথির করে কাঁপছে জানালার পর্দা। ভারি, সুন্দর পর্দা, দামী। ঘরে আলো খুব কম তবে কি আছে না আছে দেখতে অসুবিধে হয় না। সাইডবোর্ড আছে কয়েকটা। তাতে রয়েছে রুপার মোমদানী, রুপার নানারকম পানপাত্র। দেয়ালে ঝোলানো অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ছবি।

এই যে,বললো একটা চাপা কণ্ঠ, এটা কেমন?

ভীষণ চমকে গেল মুসা। ধক করে উঠলো বুক। কিশোরের হাত আঁকড়ে প্রলো। ব্রড ক্যাম্পারের গলা।

বাহ সুন্দর তো, মিস্টার ডেজার বললেন। মডার্ন আর্ট বুঝি না আমি, তবে দেখতে ভালোই লাগছে।

শব্দ করলে শোনা যাবে, বুঝে গেছে গোয়েন্দারা, তাই শব্দ করলো না। ঘরে কি আছে দেখতে লাগলো। দামী দামী অনেক জিনিস আছে। কার্পেট, চেয়ার, বাক্স, আর আরও অনেক জিনিস।

ক্যাম্পার আর ডেজার কথা বলছেন। কিন্তু তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না।

দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে শব্দ, অনুমান করলো কিশোর। সেটার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। পুরানো একটা কাঠের বাক্স দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তার। ডালায় আর গায়ে খোদাই করা রয়েছে নানারকম পৌরাণিক দানরে ছবি। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো বাক্সটার কাছে। ডালা ধরে টান দিলো।

ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠলো মুসা। বিস্ময়ে।

বাক্সটা টাকায় বোঝাই। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশো ডলার নোটের বাণ্ডিল থরে থরে সাজানো। ব্যাংকে যেমন থাকে।

আপনার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালোই লাগলো মিস্টার ডেজার, ক্যাম্পার বলছে। তার ইচ্ছে, ডেজার এবার চলে যাক। এতো কাছাকাছি থাকি, অথচ কথা বলারই সুযোগ হয় না। এসে খুব ভালো করেছেন।

ঠেলে চেয়ার সরানোর শব্দ হলো। দেয়ালের ওপাশে পায়ের আওয়াজ এগিয়ে গেল গ্যালারির দরজা পর্যন্ত।

আস্তে ডালাটা আবার নামিয়ে দিলো কিশোর।

গ্যালারির দরজার ঘণ্টাটা বাজলো। তারমানে বেরিয়ে গেছেন ডেজার। আগের জায়গায় ফিরে এলো ক্যাম্পার। চেয়ারটা জায়গামতো নিয়ে গিয়ে রাখলো, আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

দেয়ালের কাছ থেকে সরে এলো কিশোর। মুসাকে ইশারা করলো পাশের ঘরে চলে আসতে। তারপর এগোলো, যেখান দিয়ে ঢুকেছে, সেখান দিয়েই বেরিয়ে যাবে আবার।

 কতো টাকা, দেখলে! ফিসফিস করে বললো মুসা।

আনমনে মাথা দোলালো শুধু কিশোর।

কিন্তু এখনো পড়ে আছে কেন? আবার বললো মুসা। নিরমা হল্যাও তো সেই কবেই মরে গেছে।

আমার মনে হয় না টাকাটা তার। ক্যাম্পার কিছু একটা করছে। ও আমাকে বলেছিলো, সরাইটা যখন কেনে তখন একেবারে খালি ছিলো এটা… থমকে গেল। কিশোর। পাশের ঘরে হুড়কো খুলেছে বোধহয় কেউ।

আসছে! বলেই শ্যাফটের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো মুসা।

তাকে কয়েক ফুট ওঠার সময় দিলো কিশোর, তারপর নিজেও ঢুকে পড়লো। সাবধানে লাগিয়ে দিলো দরজা।

আরেকটা দরজা খোলার আওয়াজ হলো। নিশ্চয় সুইং ডোরটা-ভাবলো। কিশোর। ক্যাম্পার ঢুকেছে। ও কি বুঝতে পারবে ঘরে লোক ঢুকেছিলো? দরজা খুলে শ্যাফটে দেখতে আসবে?

কিচ করে আরেকবার শব্দ হলো। ধড়াস করে উঠলো কিশোরের বুক। তবে না, শ্যাফটের দরজা নয়, সুইং ডোরটাই বন্ধ হলো আবার।

আওয়াজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে থেমে গিয়েছিলো মুসা, কিশোরের মতোই সে-ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। উঠতে আরম্ভ করলো ওপরে।

১৬.

তিনতলায় উঠে মুসা বেরিয়ে গেল, কিশোর শ্যাফটের ভেতরেই রইলো।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলো মুসা! বললো, হল, গ্যালারি সব দেখে এসেছি। কেউ নেই। এসো।

কি যেন ভাবছে কিশোর। জবাব দিলো না। এই কিশোর, কি ভাবছো?

উ! ভাবছি, টাকার বাক্সটা কোনোভাবে বের করে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা?

নিয়ে গিয়ে কি হবে, একথাটা আর জিজ্ঞেস করলো না মুসা।

এক কাজ করো, কিশোর বললো। ওয়াকি-টকিতে রবিনের সঙ্গে কথা বলে। ক্যামেরা নিয়ে আসতে বলো।

কথা বললো মুসা। ক্যামেরা সাথেই আছে রবিনের। কিভাবে কিভাবে আসতে হবে, তা-ও বললো।

কিছুক্ষণ পর এলো রবিন। উত্তেজিত।

সংক্ষেপে সমস্ত কথা বলে তার বিস্ময় কিছুটা ঘোচালো মুসা। আবার ফিরে যেতে হবে অ্যান্টিরুমে, কিশোর বললো।

কেন? রবিনের প্রশ্ন।

 ক্যামেরা আনতে বলেছি কিসের জন্যে।

 হাসলো রবিন। বুঝে ফেলেছে। ঘরের জিনিসপত্রের ছবি তুলবে।

হ্যাঁ, তুলবো। বিশেষ করে পেইন্টিংগুলোর। ওগুলোর মধ্যে একটার ছবি দেখেছি খবরের কাগজে, পরিষ্কার মনে পড়ছে। কারো কাছ থেকে চুরি করে আনা হয়েছে ওটা।

হাঁ করে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো দুই সহকারী। মুসা বললো অব শেষে, ক্যাম্পার চোর?

জানি না। এক বাক্স বোঝাই টাকা, চোর হলে কি ওভাবে ফেলে রাখে ওরকম একটা জায়গায়? তবে, চোরাই মালের ব্যবসা যারা করে, তাদের প্রচুর নগদ টাকার দরকার হয়।

হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। জিজ্ঞেস করলো, যাবো ছবি তুলতে?

একলা পারবে?

কেন পারবো না। এই কয়েক মিনিট লাগবে। আসছি।

নেমে গেল রবিন।

দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে ভাবতে লাগলো কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। পায়চারি করছে মুসা। হঠাৎ কিশোর বললো, হু, বুঝেছি!

থেমে গেল মুসা। কি বুঝলে?

 ফিরে তাকালো না কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে দেয়ালের দিকে। যেন সেখানে প্রোজেক্টরে ছবি চলছে, তাই দেখেই বলতে লাগলো, ধরো আজকে জুলাইয়ের চার তারিখ। তোমার বয়েস পাঁচ। কিটুর মতো। প্যারেড চলছে। সবাই ব্যস্ত, সবাই উত্তেজিত। তুমি এখন কি করবে?

ভ্রুকুটি করলো মুসা। এমন কিছু, যেটা করা উচিত নয়।

ঠিক। মারমেড গ্যালারিতে ঢোকার চেষ্টা করবে না তুমি, ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে? কারণ ওটা দেখার প্রচণ্ড কৌতূহল আছে তোমার। নিঃশব্দে সবার চোখ এড়িয়ে চলে আসবে সিঁড়ির কাছে, উঁকি দিয়ে দেখবে ক্যাম্পার আছে কিনা।

দেখলে আন্দাজ করবে, আর সবার মতোই সে-ও বেরিয়ে গেছে প্যারেড দেখতে। এই সুযোগে ঢুকে পড়বে তুমি গ্যালারিতে, যেহেতু তোমার উচ্চতা কম, ঘণ্টার ইলেকট্রিক বীমে বাধা আসবে না। খুব সহজেই ঢুকে পড়তে পারবে তুমি, ডবকে নিয়ে।

গ্যালারিতে ঢুকে দারুণ সব জিনিস দেখবে তুমি। একটা দরজা চোখে পড়বে, ভাঁড়ারে ঢোকার। কাউন্টারের ওপারে দরজাটা। ওর ওপাশে কি আছে জানো না তুমি, দেখার কৌতূহল হবেই। ঢুকে পড়বে।

এক এক করে দেখতে দেখতে এভাবেই চলে যাবে প্রিন্সেস স্যুইটের কাছে। থেমে দম নিলো কিশোর। তারপর বললো, আমার বিশ্বাস, সেদিন সকালে নিরমা। হল্যাণ্ডের ঘরে ছিলো ক্যাম্পার।

 কিন্তু দরজা তো বন্ধ, ঢুকলো কিভাবে? প্রশ্ন তুললো মুসা। নিশ্চয় শ্যাফট দিয়ে নয়?

না। অবশ্যই আরেকটা গোপন দরজা আছে, যেখান দিয়ে ক্যাম্পার ঢোকে। সেটা দেখে ফেলেছিলো কিটু। সবাই তখন প্যারেড দেখায় ব্যস্ত, তাই হয়তো ভেতরে ঢুকে দরজাটা আর লাগিয়ে দেয়ার কথা মনে হয়নি ক্যাম্পারের। ভেবেছে, কে আর আসবে দেখতে?

তারপর কোনো কারণে চোখ তুলে কিটুকে দেখে ফেলেছে। কিংবা এমনও হতে পারে, দরজাটা খোলা ফেলে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলো ক্যাম্পার, ফিরে এসে দেখে ট্রেজার রুমে ঢুকে বসে আছে কিটু। কি করবে তখন সে? ভয়। পাবে? রেগে যাবে?

ধরার চেষ্টা করবে কিটুকে, মুসা বললো।

হ্যাঁ। আর কিটু পালানোর চেষ্টা করবে। বেরিয়ে চলে এসেছিলো হয়তো গ্যালারিতে। লুকানোর চেষ্টা করেছিলো জলকন্যার বেদির আড়ালে। তাতে নাড়া লেগে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায় জলকন্যা। ডব ছিলো কিটুর সাথে। মূর্তিটা সরাসরি মাটিতে পড়েনি, পড়েছিলো কুকুরটার ওপর। ব্যথা যা পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি পেয়েছিলো শক। সহ্য করতে পারেনি জানোয়ারটার বুড়ো, নষ্ট হয়ে যাওয়া। হৃৎপিণ্ড। মারা যায় ওটা।

ততোক্ষণে পেছনের দরজার কাছে চলে যায় কিটু। দরজার ছিটকানি খুলে রাখে ক্যাম্পার, যখন সে ওঘরে থাকে, ফলে কিটুর বেরিয়ে যেতে অসুবিধে হওয়ার। কথা নয়। কিন্তু, বেরোনোর আগেই মুর্তিটা পড়ে যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, তাহলে শব্দ হয়েছে। নিশ্চয় ফিরে তাকিয়েছে কিটু। কি দেখবে, এবং তখন কি করবে?

ফিরে আসবে কুকুরটাকে তোলার জন্যে।

কিংবা মূর্তি ভেঙেছে দেখে এতো ভয় পেয়ে যাবে, ডবের কথা আর ভাববে না। সোজা বেরিয়ে যাবে। ভাববে, তার দোষেই এতো কিছু ঘটেছে। মায়ের শাস্তির ভয়ে লুকিয়ে পড়বে কোথাও গিয়ে।

হ্যাঁ, ঠিকই, একমত হলো মুসা। ওর বয়েসে আমি হলেও ওরকমই ভয়। পেতাম। কিন্তু কোথায় লুকাতাম? এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে পুলিশও খুঁজে বের করতে পারছে না? নাকি অন্য ব্যাপার হয়েছে। ক্যাম্পার ধরে ফেলেছে কিটুকে…

না। ও কোথায় আছে ক্যাম্পার জানেই না। সান্তা মনিকা পিয়ারে খুঁজতে গিয়েছিলো, মনে নেই?

তাই তো! কিন্তু কেন খুঁজতে গেল। ছেলেটাকে খুঁজে বের করে মানে, মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্যে, যাতে সে ট্রেজার রুমের কথা বলতে না পারে?

জবাব দিলো না কিশোর। দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। তারপর রবিনের নড়াচড়ার শব্দ শুনে শ্যাফটের কাছে এগিয়ে গেল। তাকে উঠতে সাহায্য করার জন্যে।

অদ্ভুত! বেরিয়েই বলে উঠলো রবিন। মনে হলো আরব্য রজনীর কোনো গল্পের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছিলাম..।

বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, ছবি তুলেছো?

নিশ্চয়ই। পেইন্টিং, টাকা, সব কিছুর। এখন কি করব? পুলিশের কাছে যাবো?

হয়তো। তবে তার আগে জরুরী আরও কাজ আছে। আর একটা, সূত্র পেলেই কিছু নিখোঁজ রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারবো।

.

১৭.

বুকশপেই পাওয়া গেল নিনা হারকারকে। ছেলেদের দেখে বলে উঠলো, কিছুতেই বাড়ি বসে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, দোকানেই চলে আসি…।

ছেলে নিখোঁজ হয়েছে তিনদিন, একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে মহিলাকে হলদে হয়ে এসেছে চামড়া, ভারি ভাঁজ পড়েছে কপালের চামড়ায়।

যতোটা সম্ভঘ কম শব্দ করে একটা ঝাড়ন দিয়ে ধুলো ঝাড়ছেন বোরম্যান। বইয়ের তাকের ফাঁক দিয়ে এমনভাবে ঝাড়নটা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন?

কিশোর জিজ্ঞের করলো, মিসেস হারকার, এখানে কিটুর এমন কোনো বন্ধু আছে, যাকে সে খুব বিশ্বাস করে?

হাসলো নিনা। কান্নার মতো দেখালো হাসিটা। বললো, ছিলো, শুধু ডব। তাকেই বিশ্বাস করতো কিটু।

মিসেস হারকার, আমি শিওর, কিটুকে সাহায্য করছে কেউ। পালিয়েই গেছে সে। কেউ একজন তাকে লুকিয়ে রেখেছে, খাওয়াচ্ছে, থাকার জায়গা দিয়েছে। নিশ্চয় আরেকটা বাচ্চা। তেমন কাউকে চেনে হয়তো কিটু, আপনারা জানেন না।

তেমন কে আছে, মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো নিনা।

জানালা দিয়ে সৈকতের দিকে তাকালো কিশোর। বরগু চলেছে। সাদা একটা পেটফোলা ব্যাগ তার হাতে। ব্যাগের গায়ে, মুরগীর মাংসে তৈরি খাবারের বিজ্ঞাপন। হু! আনমনে বললো কিশোর।

জানালার পাশ দিয়ে ওশন ফ্রন্টের দিকে চলে গেল বরগু। হাসলো কিশোর। মিসেস হারকার, আসুন আমার সঙ্গে।

কিশোরের কণ্ঠস্বরের হঠাৎ পরিবর্তনে ঝট করে মুখ তুলে তাকালো নিনা। কী? কি ব্যাপার?।

একটা ব্যাপার পুরোপুরি চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো আমাদের, হাত তুলে ওশন ফ্রন্টের দিকে দেখালো কিশোর।

তিন গোয়েন্দা আর নিনা বেরিয়ে গেল।

নিনা? পেছন থেকে ডাকলেন বোরম্যান।

জবাব দিলো না নিনা। ওশন ফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। বরগুকে দেখছে।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন বোরম্যান। ছেলেদের সঙ্গে চললেন তিনি আর নিনা। সামনে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে বরগু। আজ তার সাথে কুকুর দুটো নেই। ঠেলাটাও নেই। শুধু খাবারের ব্যাগটা হাতে।

ওর একশো গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে অনুসরণকারীরা, এই সময় ঘুরলো বরগু। ঢুকে পড়লো একটা ছোট গলিতে। ওশন ফ্রন্ট আর স্পীডওয়েকে যুক্ত। করেছে এই গলি।

মুসা, জলদি যাও! চেঁচিয়ে বললো কিশোর। চোখের আড়াল না হয়!

যাচ্ছি, বলেই দৌড় দিলো মুসা।

যেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে বরগু, সেখানে পৌঁছে ঘুরে তাকালো স্পীডওয়ের দিকে। কিশোর আর রবিনের উদ্দেশ্যে একবার হাত নেড়ে ঢুকে পড়লো গলিতে।

চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর।

বরগু! নিনা বললো, তাই, না? বরগুই!

কিশোরের পেছনে প্রায় ছুটতে আরম্ভ করলো সে।

নিনা, হয়েছে কি? জিজ্ঞেস করলেন উত্তেজিত বোরম্যান। কিছু তো বুঝতে পারছি না!

বরগু! ইস, আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিলো আমার!

গলির মুখে পৌঁছে গেল ওরা। দুটো বাড়ির মাঝে সরু পথ, কোণের কাছে সাইনবোর্ড ফেয়ার আইলস ওয়ে।

স্পীডওয়ের ধারে অপেক্ষা করছে মুসা। ওদেরকে দেখে হাত নেড়ে আবার। হাঁটতে শুরু করলো, প্যাসিফিক অ্যাভেনিউর দিকে।

দৌড় দিলো নিনা। অ্যাভেনিউর অর্ধেক যেতে না যেতেই মুসাকে ধরে ফেললো।

পুরানো একটা ভাঙা বাড়ির ঘাস-জন্মানো ড্রাইভওয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুসা। ও বাড়িতে ঢুকেছে, হাত তুলে বললো সে। কুত্তার ডাক শুনেছি।

বারান্দায় বেরিয়ে এলো একজন বৃদ্ধ। দুজনকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?

ড্রাইভওয়ের দিকে এগোলো নিনা।

দাঁড়াও! চেঁচিয়ে উঠলো বৃদ্ধ। একটা দাঁতও নেই, ফলে উচ্চারণ অস্পষ্ট, কেমন জড়িয়ে যায় কথা। অন্যায় ভাবে ঢুকেছো! পুলিশ ডাকবো বলে দিলাম!

পরোয়াই করলো না নিনা। কিশোর আর বোরম্যানও তার পিছু নিলেন।

আবার ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুর।

এই, শুনছো! চিৎকার করে বললো বৃদ্ধ। এটা আমার জায়গা, জোর করে ঢুকছো তোমরা! বেরোও!

কিটু-উ! চেঁচিয়ে ডাকলো নিনা। কিটু-উ, কোথায় তুই?

পেছনের উঠানে আগাছার ছড়াছড়ি। একপাশে কাত হয়ে গেছে পুরানো। গ্যারেজটী। ওটার দরজার হাতল ধরে টান মারলো নিনা। মাটিতে ঘষা খেতে। খেতে তার দিকে যেন ছুটে এলো পাল্লাটা।

ভেতরে আবছা অন্ধকার। অনেক শরীরের নড়াচড়া। খেক কে করে নিনার দিকে তেড়ে আসতে চাইলো দুটো কুকুর। কিন্তু আটকালো বরও। পেছনের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ছোট্ট শরীর। ফ্যাকাসে মুখ, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

কিটু-উ! বলে চেঁচিয়ে উঠে ছুটে গেল মা।

মুরগীর পা চিবোচ্ছিলো কিটু। ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে ছুটে এলো। মায়ের দিকে। জড়িয়ে ধরলো একে অন্যকে।

ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে আরেক দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন বোরম্যান।

কুকুরগুলোকে শান্ত করলো বরগু। নিয়ে গেল গ্যারেজের কোণে। একটা দড়ির খাঁটিয়া রয়েছে ওখানে, তার ওপর বসে পড়লো সে। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মা-ছেলের দিকে। দিন কয়েকের জন্যে একটা বাচ্চাকে আপন করে পেয়েছিলো সে। একা হয়ে গেল আবার। তার মতো একজন মানুষকে বিষণ্ণ করে দেয়ার জন্যে এটা যথেষ্ট।

.

১৮.

 খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। ভিড় জমে গেল পথে। পুলিশ এলো। গুর হাতে হাতকড়া দিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল তারা।

এবার কি করবো? রবিনের প্রশ্ন। কিটু ট্রেজার রুমটা দেখে থাকলে বলে দেবেই।

তার আগেই হুঁশিয়ার হয়ে যাবে ক্যাম্পার। মালপত্র সব সরিয়ে ফেলবে অন্য কোথাও বন্ধ ঘরে বাক্স ভর্তি টাকা আর দামী দামী জিনিসের কথা কে বিশ্বাস করবে তখন?

করবে না, মাথা নাড়লো মুসা।

কাজেই সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব আমাদের, ঘোষণা করলো কিশোর। সান্তা মনিকায় একটা ছবি তোলার দোকান আছে, এক ঘণ্টার মধ্যেই ফটো ডেভেলপ করে দেবে। রবিন, ক্যামেরাটা নিয়ে চলে যাও, ট্রেজার রুমে তোলা ছবিগুলো করিয়ে আনো। আমি আর মুসা যাচ্ছি ভেনিস লাইব্রেরিতে। ছবিগুলো। নিয়ে ওখানে চলে এসো।

রবিন রওনা হয়ে গেল উত্তরে ফটোর দোকানের দিকে। কিশোর আর মুসা চললো মেইন স্ট্রীটে, যেখানে রয়েছে ছোট লাইব্রেরিটা। যাওয়ার সময় একটা মস্ত বেলুন দেখে দাঁড়ালো দুজনে। নতুন একটা সুপার মার্কেট করা হয়েছে, ওটার পার্কিং লটে বেঁধে রাখা হয়েছে বেলুনটা, আজ মার্কেটের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান। বিজ্ঞাপন। লেখা রয়েছেঃ

প্রতি একশো জন খরিদ্দারের মধ্যে
লটারি করে যে কোনো একজনকে
বেলুনে করে বিনে পয়সায়
আকাশে ওড়ার সুযোগ দেয়া হবে।

 বাহ, দারুণ তো! হেসে মুসা বললো। বেলুনের গনডোলায় গিয়ে উঠছে। কয়েকজন লোক, সেটা দেখছে সে।

চলো, আমাদের কাজে যাই, খানিকটা অসহিষ্ণু হয়েই হাত নাড়লো কিশোর।

লাইব্রেরিতে ঢুকেই পত্রিকা ঘাটতে বসলে সে, মুসা তাকে সাহায্য করলো। গত দুই হপ্তার কাগজ বের করলো ওরা, তখনও যেগুলোর মাইক্রোফিল্ম করা হয়নি।

কি খুঁজছো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

একটা চোরাই ছবির কথা পড়েছিলাম, কোন সংখ্যায় ঠিক মনে নেই। সেটাই খুঁজছি।

 লম্বা একটা রীডিং টেবিলে পত্রিকাগুলো এনে ফেললো ওরা। তারপর ছড়িয়ে নিয়ে দেখতে আরম্ভ করলো।

মুসার চোখে পড়লো প্রথমে। বলে উঠলো, এই তো! কাগজটা কিশোরের দিকে ঠেলে দিলো সে।

পেইন্টিংটার একটা পরিষ্কার ফটোগ্রাফে দেখা যাচ্ছে-তৃণভূমিতে খেলছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মারমেড ইনে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবিতে এই দৃশ্য দেখেছে ওরা।

ছবিটা দেখেই চেনা চেনা লাগছিলো তখন, সন্তুষ্ট হয়ে বললো কিশোর।

ঘণ্টাখানেক পরে এসে মুসা আর কিশোরকে লাইব্রেরিতেই পেলো রবিন। ছবি আর প্রতিবেদনটার ফটোকপি করে নিয়েছে কিশোর। প্রতিবেদন পড়ে জানা গেল বিখ্যাত চিত্রকর ডেগার আঁকা পেইন্টিং ওটা। তাঁর বিখ্যাত ছবি নয় এটা, তবু। যথেষ্ট দামী। দিন কয়েক আগে আরও কিছু মূল্যবান জিনিস সহ ছবিটা চুরি গেছে। একজন ধনী লোকের বাড়ি থেকে।

হাতের খাম থেকে ছবিগুলো টেবিলে ঢাললো রবিন। বেছে বেছে বের করলো একটা ছবি, পত্রিকার ছবিটার সঙ্গে অবিকল মিলে যায়।

 হুবহু এক, মুসা বললো। কিন্তু ডেগার ছবির নকলও হতে পারে এটা। সব পেইন্টিঙেরই নকল পাওয়া যায়, তাই না?

যায়, বিখ্যাতগুলোর, জবাব দিলো কিশোর। তবে আমি শিওর মারমেড ইনের ছবিটা আসল। ঘরের অন্যান্য জিনিসগুলোও চোরাই মাল। এইবার পুলিশকে। জানানো যায়।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। বাইরে তখন শেষ বিকেলের রোদ। আপনমনে শিস দিতে দিতে চললো কিশোর।

ভেনিস পুলিশ স্টেশনে এসে ঢুকলো ওরা। একজন অফিসারকে দেখে তার। সঙ্গে কথা বলতে গেল কিশোর। অন্য দুজন দাঁড়িয়ে রইলো পেছনে।

ভূমিকা না করে কিশোর বললো, চোরাই একটা ছবির খবর দিতে পারি, ডেগার ছবি। কোথায় আছে ওটা জানি। কে চুরি করেছে, তা-ও আন্দাজ করতে পারি।

ফটোকপি করে আনা পত্রিকার প্রতিবেদনটা দেখালো কিশোর, তারপর দেখালো রবিনের তুলে আনা ছবিটা। আজ বিকেলে তোলা হয়েছে এটা, বললো সে।

 দুটো ছবি ভালোমতো মিলিয়ে দেখলো অফিসার। মন্তব্য করলো না। ছেলেদেরকে নিয়ে এলো আরেকটা ছোট ঘরে, ওখানে একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার সাজানো রয়েছে। ওদেরকে ওখানে বসতে বলে চলে গেল।

খানিক পরেই এসে হাজির হলো একজন সাদা পোশাক পরা পুলিশের গোয়েন্দা। হাতে ফটোকপির কাগজ আর রবিনের তুলে আনা ছবিটা। অফিসার নিয়ে গিয়েছিলো ওগুলো।

ইনটারেসটিং, দুটোই দেখিয়ে এমনভাবে বললো ডিটেকটিভ, যেন মোটেও ইনটারেসটিং নয় ব্যাপারটা। দেখতে দুটো ছবি একই রকম। তবে তোমরা যেটা তুলে এনেছো, সেটা আসল না-ও হতে পারে। কোত্থেকে আনলে? বলেই চোখ। পড়লো রবিনের কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার ওপর। তুমি তুলেছে, না?

হ্যাঁ, স্যার। মারমেড ইনের একটা ঘর থেকে।

 মারমেড ইন? ওটা তো বহু বছর ধরে তালা দেয়।

কথা বললো কিশোর, সবাই তাই জানে বটে, কারণ মালিকের তা-ই ইচ্ছে। হোটেলের একটা সুইট এখনও নিয়মিত ব্যবহার হয়। নানারকম দামী দামী জিনিসে বোঝাই ওটা, চোরাই মাল। আমার বিশ্বাস, হোটেলটার বর্তমান মালিক ব্রড ক্যাম্পার এর সঙ্গে জড়িত। মনে হয় চোরাই মালের ডিলার সে, কারণ ওই ঘরে এক বাক্স ভর্তি টাকা দেখেছি।

খামটা খুলে আরেকটা টেবিলে ছবিগুলো ঢেলে দিলো রবিন। তার মধ্যে একটা ছবিতে স্পষ্ট উঠেছে টাকার বাণ্ডিলের ছবি।

 হুমম! বলে মাথা দুলিয়ে, ছেলেদের আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চাইলো। ডিটেকটিভ। স্টুডেন্ট কার্ড বের করে দেখালো ওরা। তারপর কি মনে করে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিলো কিশোর।

গুঙিয়ে উঠলো ডিটেকটিভ। শখের গোয়েন্দা! আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিলো আমার। এই বয়েসে অনেক ছেলেই গোয়েন্দা হতে চায়। অন্তত ভাবে, যে তারা গোয়েন্দা।

ভাবাভাবির মধ্যে নেই আমরা, ভারিক্কি চালে বললো কিশোর। আমরা। সত্যিই গোয়েন্দা। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছি। অনেক বড় বড় চোর ডাকাতের কোমরে দড়ি পরিয়েছি…

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো ডিটেকটিভ। উঠে দাঁড়ালো। বসো এখানে। আসছি।

প্রতিবেদনের ফটোকপি আর ছবিগুলো নিয়ে চলে গেল লোকটা।

 কি করতে গেল? মুসার প্রশ্ন।

চোরাই মালের লিস্ট থাকে থানায়। ছবিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেছে। হয়তোঁ। ফোন-টোন করে খোঁজ-খবরও নিতে পারে।

ক্যাম্পারকে না আবার করে বসে! রবিন বললো।

 ক্যাম্পারকে? উদ্বিগ্ন হয়ে বললো মুসা। কেন, তাকে করবে কেন?

কারণ তার হোটেলে চুরি করে ঢুকেছি আমরা, সেটা একটা অপরাধ। ইচ্ছে করলেই আটকে দিতে পারে আমাদেরকে পুলিশ। যদি হোটেলের কামরা থেকে জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলে থাকে ক্যাম্পার, আর চোরাই মালের লিস্টের সঙ্গে না মেলে, তাহলে মরেছি!

রবিনের কথার মানে বুঝে চুপ হয়ে গেল মুসা।

দীর্ঘ নীরবতার পর মুখ খুললো কিশোর, যেন মনের ভাবনাগুলোই মুখে উচ্চারণ করলো, যদি ক্যাম্পারকে ফোন করেই, তো কি করবে ক্যাম্পার? কিটু যদি ঘরটা দেখে থাকে…

বাধা দিয়ে রবিন বললো, কিটু যে দেখেছেই, তার নিশ্চয়তা কি? নিশ্চয়তা? আছে। এতো দামী দামী খাবার কেনার টাকা কোথায় পেলো গু? পেসট্রি, পিজা, চিকেন। আমার বিশ্বাস বাক্স থেকে কিছু টাকা তুলে নিয়ে এসেছিলো কিটু। কড়কড়ে নোট দেখেছে, ছেলেমানুষ, তুলে নিয়ে পকেটে ভরে ফেলেছে। টাকা দেখলে অনেক ছেলেই ওরকম করে। ওই টাকা দিয়েই তাকে খাবার কিনে এনে দিয়েছে ব্রগু।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার ক্যাম্পারের কথায় ফিরে গেল কিশোর, হ্যাঁ, যা। বলছিলাম, ক্যাম্পার কি করবে? আমার ধারণা, ও পালানোর চেষ্টা করবে। কারণ অপরাধীর মন সব সময়ই দুর্বল থাকে। ওর ব্যাপারেই একটা সহজ উদাহরণ ধরো-জলকন্যার মূর্তিটা ভাঙার পর আমরা হলে, কিংবা অপরাধী না হয়ে অন্য কেউ হলে কি করতো? ভাঙা টুকরোগুলো তুলে নিয়ে জাস্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতো। সে করলো কি? অনেক সাবধানে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেললো। সাগরের পানিতে, যাতে কারও চোখে না পড়ে। কি দরকারটা ছিলো? সব কিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছে এখন। কিটু যদি মুখ খোলে, এই ভয়ে ওর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে পারে এখন ক্যাম্পার।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিন আর মুর্সার।

রবিন বললো, তার আগেই আমাদের কিছু করা দরকার!

 এখুনি চলো! বলেই দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল মুসা।

কিশোর আর রবিনও তার পিছু নিলো। ডিটেকটিভের ফিরে আসার অপেক্ষা করলো না আর ওরা।

.

১৯.

ওশন ফ্রন্টে যখন পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা, সাতটা বেজে গেছে। দিনের বেলা যে রকম ভিড় থাকে ভেনিসে, সেটা কমে এসেছে। স্পীডওয়েতে গাড়ি খুব কম। ওশন। ফ্রন্টে ঘোরাঘুরি করছে অল্প কয়েকজন মানুষ।

বইয়ের দোকানের বাইরে গলিতে দাঁড়িয়ে আছে টেলিভিশনের একজন। রিপোর্টার। কিটু আর নিনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। কিছু লোক ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে।

সেদিকে গেল না গোয়েন্দারা। ওদের একমাত্র ভাবনা, কিটুকে বাঁচাতে হবে। বিপদের খাড়া ঝুলছে ছেলেটার মাথার ওপর।

মারমেড ইনের কাছে চলে এলো ওরা। গ্যালারি বন্ধ। তবে কি ক্যাম্পার পালালো? অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় পর্দা টানা। ভেতরে লোক আছে কিনা বোঝার উপায় নেই।

হঠাৎ করেই সামনের দিকের একটা পর্দা নড়ে উঠলো। ওশন ফ্রন্টের দিকে উঁকি দিলো বোধহয় কেউ।

আছে! আছে! বলে উঠলো মুসা।

মনে হয় পালানোর তাল করছে, কিশোর বললো। সিঁড়ি দিয়ে পেছনে গ্যারেজের কাছে নেমে যাবে।

তাহলে দাঁড়িয়ে আছি কেন? তাগাদা দিলো রবিন।

চত্বরের উত্তর পাশ ঘুরে পেছনে চলে এলো ওরা। ঠিকই বলেছে কিশোর। বেরিয়ে এসেছে ক্যাম্পার। পেছনের সিঁড়ির মাথায় রয়েছে এখনও। হাতে একটা। স্যুটকেস। ওখানেই দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালো সে, তারপর আস্তে লাগিয়ে দিলো পাল্লাটা। তিন গোয়েন্দা আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে, ওদেরকে দেখতে পেলো না।

 পেছনের গ্যারেজের দিকে এগোলো ক্যাম্পার। হাতে ঝুলছে চাবি। কিন্তু। দরজার তালা খোলার আগেই বড় করে দম নিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। বললো, চলে যাচ্ছেন, মিস্টার ক্যাম্পার? খুব খারাপ কথা। আমরা ভাবছি এই কেসের। একটা কিনারা করে দেবো।

পাই করে ঘুরলো ক্যাম্পার। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার সুন্দর চেহারা। কেসের কিনারা তো করেই ফেলেছো। ছেলেটা ফিরে এসেছে। খুব চালাক তোমরা। কংগ্রাচুলেশন।

কিছু কথা বলার আছে আপনাকে, শুনবেন? নাকি কি বলবো বুঝে ফেলেছেন? পানিতে যখন মূর্তির টুকরোগুলো ফেলেছিলেন, অবাক লেগেছিলো। তারপর হোটেলের ভেতরে যখন ট্রেজার রুমটা আবিষ্কার করলাম, বুঝে ফেললাম সব।

ঢোক গিললো ক্যাম্পার। জিভ বোলালো শুকনো ঠোঁটের ওপর। ঠোঁটের কোণ কাঁপছে। কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি তালা খোলার চেষ্টা করলো।

না! বলেই লাফ দিলো মুসা। প্রায় উড়ে গিয়ে পড়লো ক্যাম্পারের গায়ের। ওপর। মাথা দিয়ে তো মেরে ফেলে দিলো লোকটাকে। হাতের চাবি গিয়ে ঝনঝন করে পড়লো স্পীডওয়েতে। চোখের পলকে ক্যাম্পারের পাশে চলে এলো। কিশোর। রবিন চলে গেল রাস্তার ওপর। চাবিটা তুলে নিলো।

স্পীডওয়ে ধরে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। কাছে এসে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো চালক। জিজ্ঞেস করলো, এই যে ভাই, কি হয়েছে?

প্রশ্নটা ক্যাম্পারকে করেছে, কিন্তু জবাবটা দিলো কিশোর, জলদি গিয়ে পুলিশে খবর দিন! কুইক!,

এক সেকেণ্ড দ্বিধা করলো লোকটা। তারপর গাড়ির গতি বাড়িয়ে গিয়ে মোড় নিয়ে উঠে গেল আরেকটা রাস্তায়।

বিচ্ছুর দল! উঠে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্পার। গলা কাঁপছে তার।

কি হয়েছে কিছুই জানে না লোকটা, গাড়ির চালকের কথা বললো কিশোর। কিন্তু পুলিশকে খবর দিতেও পারে। আসার আগে পুলিশকে ট্রেজার রুমের কথা। জানিয়ে এসেছি আমরা। লোকটার কাছে খবর পেলে চোখের পলকে এসে হাজির। হবে। আপনার হাতে টাকা ভর্তি স্যুটকেস দেখলে কি ভাববে ওরা বলুন তো?

ক্ষণিকের জন্যে ঝুলে পড়লো ক্যাম্পারের মাথা। যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারপর আচমকা সোজা হলো আবার। হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা পিস্তল। বেশ, তোমরাও আসছো আমার সঙ্গে। পুলিশ এখানে এসে কাউকে পাবে না।

পিস্তল আশা করেনি কিশোর, তৈরি ছিলো না। থমকে গেল তিনজনেই। আদেশ পালন না করে উপায় নেই। মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্যাম্পার। পিস্তলটার কুৎসিত নলের দিকে তাকিয়ে একবার দ্বিধা করলো ওরা, তারপর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো।

আগে বাড়ো! পিস্তল নাচিয়ে নির্দেশ দিলো ক্যাম্পার।

গুলি আপনি করতে পারছেন না, কিশোর বললো। যে কোনো মুহূর্তে পুলিশ এসে যেতে পারে।

আসুক। এখানে আমি আর থাকতে পারছি না কিছুতেই। কাজেই দেখে ফেললেও কিছু এসে যায় না। তোমাদের জিম্মি করে ওদের নাকের ওপর দিয়েই চলে যাবো। হাঁটো। প্যাসিফিক এভেনুতে যাবো আমরা। আমি থাকবো পেছনে। টু শব্দ করলে খুলি উড়িয়ে দেবে।

আর কিছু বললো না ছেলেরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। পরের সরু গলিটা দিয়ে যাবে প্যাসিফিক এভেনিউতে।

এই, নিগ্রো! পেছন থেকে ধমকের সুরে বললো ক্যাম্পার, স্যুটকেসটা নাও। গায়ে তো মেলা জোর, কুলিগিরি একটু করো।

সুটকেসটা হাতে নিলো মুসা। ক্যাম্পারের হাত এখন পকেটে। নিশ্চয় পিস্তলটা ধরে আছে। নলের মুখও যে ওদেরই দিকে, বুঝতে অসুবিধে হলো না তিন গোয়েন্দার।

পালাতে আপনি পারবেন না, কিশোর বললো। ইভলিন স্ট্রীটের বাড়িটার কথাও পুলিশকে বলে দিয়েছি আমরা।

কথাটা মিথ্যে, কিন্তু বিশ্বাস করলো ক্যাম্পার। গাল দিয়ে উঠলো তিন গোয়েন্দাকে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে বললো। প্যাসিফিক পেরিয়ে গিয়ে মেইন স্ট্রীটে উঠতে বললো।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ডুবন্ত সূর্যের সোনালি আলো এসে পড়েছে মেইন স্ট্রীটের বাড়িগুলোর জানালায়। এমনভাবে চমকাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন আগুন লেগেছে ওগুলোয়। সুপার মার্কেটের পার্কিং লটে বেলুনটাকে বাধছে বেলুন-চালক, আজকের মতো ওড়ানো শেষ।

ছেলেদেরকে সেদিকে এগোতে বললো ক্যাম্পার।

আজ আর উড়ছি না, বুঝলেন, ক্যাম্পারের উদ্দেশ্য বুঝে বললো বেলুন চালক। কাল আসবেন। বেঁধে ফেলেছি, আর খুলতে পারবো না। রাতের বেলা। হবে না।

পিস্তলটা বের করে দেখালো ক্যাম্পার।

ভীত হাসি হাসলো চালক। না না, একেবারেই ওড়াতে পারবো না, তা বলিনি। বেশি জরুরী হলে…

জলদি করো! কড়া গলায় ধমক দিলো ক্যাম্পার। চালাকির চেষ্টা করবে না। দ্বিতীয়বার আর হুঁশিয়ার করবো না আমি! তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বললো, যাও, ওঠো!

নীরবে একে একে গনডোলায় চড়লো কিশোর, মুসা, রবিন। বেলুনের নিচে ঝুলছে বিশাল ঝুড়ি। ওটাকে গনডোল বলে। সব শেষে উঠলো ক্যাম্পার। বেলুন বাধা দড়িগুলো দেখিয়ে চালককে নির্দেশ দিলো, কাটো ওগুলো! জলদি!

আপনার ইচ্ছেটা বুঝতে পারছি না, আমতা আমতা করে বললো চালক। অন্তত একটা দড়ি তো রাখতেই হবে। নইলে নামবো কি করে? আপনার ইচ্ছে মতো চলবে না এটা।

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লো ক্যাম্পার। কড়া গলায় বললো, বেশি কথা বলো তুমি! যা বলছি করো। শেষ দড়িটা কেটে দিয়েই লাফিয়ে উঠে পড়বে। নইলে গুলি খাবে বলে দিলাম।

এসব না করলেও পারতেন, পরামর্শ দিলো মুসা। ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্ট কিংবা বাস স্টেশনে চলে যেতে পারেন…

 চুপ! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো ক্যাম্পার।

চুপ হয়ে গেল মুসা। এক এক করে দড়ি কেটে দিতে লাগলো চালক। শেষ। দড়িটা কেটে দিলে ওপরে উঠতে শুরু করলো বেলুন। নাগালের বাইরে চলে। যাওয়ার আগেই লাফ দিয়ে গনডোলায় চড়লো সে।

বেশি দূর কিন্তু যাবে না, উঠেই বললো। ওরকম করে তৈরি হয়নি। যদি সাগরের ওপর চলে যায়…।

যাবে না। বাতাস উল্টোদিকে বইছে, ক্যাম্পার বললো।

এখনো দেখা যাচ্ছে সূর্যটাকে, সাগরের দিগন্ত রেখার আড়ালে নেমে যাচ্ছে। লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে বাড়িঘরের আশপাশে। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। হেডলাইট জ্বেলে দিয়েছে রাস্তায় চলমান গাড়িগুলো।

উঠছে…উঠছে…উঠছে বেলুন। গনডোলার কিনারের দড়ি আঁকড়ে ধরে রেখেছে ওরা। তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে। বেয়াড়া ভাবে দুলছে গনডোলা, মোচড় দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। বেলুনে চড়া যতোটা আরামদায়ক ভাবতো মুসা, ততোটা আর মনে হলো না এখন।

নিচের দিকে তাকালো না ক্যাম্পার। কঠিন দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছে তিন গোয়েন্দা আর চালকের দিকে।

কয়েক শো ফুট ওপরে উঠে এসেছে বেলুন। উত্তর-পূবে ওটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে বাতাস। নিচে তাকালো কিশোর। ঠিক ওদের নিচেই দেখা যাচ্ছে একটা গাড়ি। সাদা ছাত দেখেই বোঝা গেল পুলিশের গাড়ি।

স্যুটকেসটা নামিয়ে রেখেছে মুসা। পা দিয়ে সেটাকে ঠেলে দেখলো কিশোর। পুরানো ধাচের জিনিস। আলগী তালা লাগিয়ে বন্ধ করার ব্যবস্থা। তালা নেই, তারমানে খোলা। ক্যাম্পারের অলক্ষ্যে জুতোর ডগা দিয়ে আস্তে আস্তে তুলে। ফেললো হুড়কোটা। তারপর হঠাৎ ঝুঁকে একটানে তুলে নিলো স্যুটকেস। ঝটকা লেগে আপনাআপনি খুলে গেল ডালা। ওই অবস্থায়ই ওটাকে গনডোলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে।

 এই, কি করছো ক্যাম্পার বলতে বলতেই কাজটা সেরে ফেললো কিশোর।

বাতাসে উড়তে লাগলো নোটের বাণ্ডিল দশ-বিশ…পঞ্চাশ.. একশো ডলারের নোট। কোনো কোনোটার রবার ব্যাও খুলে ছড়িয়ে পড়লো।

নেমে যাচ্ছে টাকা!

রাস্তায় গিয়ে পড়তে লাগলো।

লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো পুলিশ। রাস্তার অন্যান্য গাড়িগুলোও থেমে গেল। বেরিয়ে আসতে লাগল লোকে।

সাইরেন বেজে উঠল। আরেকটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো প্রথমটার কাছে। সবাই এখন তাকিয়ে আছে ওপর দিকে, বেলুনটাকে দেখছে।

মিস করবে না পুলিশ, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। দেখতে পাবেই আমাদের। বেলুন থেকে টাকা ছিটানোর বিরুদ্ধে অবশ্য কোনো আইন নেই। তবে প্রশ্ন জাগবেই ওদের মনে। নজর রাখবে পুলিশ। বেলুনটা নামলেই এসে হেঁকে ধরবে, যেখানেই নামুক। শেষ বাক্যটা বললো নাটকীয় ভঙ্গিতে, আর নামবেই এটা, মিস্টার ক্যাম্পার। কারণ মানুষের তৈরি কোন কিছুই চিরকাল আকাশে ওড়ে না।

কিছুই বললো না ক্যাম্পার।

অনেক পেছনে পড়েছে এখন পুলিশের গাড়ি দুটো। রাস্তায় আরও পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সাইরেন বাজিয়ে, ছাতে বসানো ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে ওগুলো প্রথম দুটোর কাছে।

শোনা গেল একটা নতুন শব্দ। ওপর থেকে বেলুনের ওপর এসে পড়লো। উজ্জ্বল সার্চ লাইটের আলো।

পুলিশের হেলিকপ্টার, হাসি হাসি গলায় বললো কিশোর, বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা।

কথা নেই ক্যাম্পারের মুখে। হাঁপাচ্ছে এমন ভাবে, যেন বহুদূর দৌড়ে এসেছে।

বলতে থাকল কিশোর, পিছু লেগে থাকবে পুলিশ। রেডিওতে যোগাযোগ রাখবে হাইওয়ে পেট্রোলের সঙ্গে। শহর থেকে বেলুনটা বেরিয়ে গেলেও অসুবিধে নেই। শেরিফের কাছে খবর চলে যাবে। মোট কথা, কিছুতেই আর পিছু ছাড়ছে না আইনের লোকেরা।

ঠিকই বলেছে ও, মিস্টার, ক্যাম্পারকে বললো চালক। অহেতুক দেরি করে। লাভ নেই। নামিয়ে ফেলি, সে-ই ভালো।

জবাব দিলো না ক্যাম্পার। তবে পিস্তলটা নামিয়ে ফেললো। ওটা তার হাত থেকে নিয়ে নিলো চালক, বাধা দিলো না অভিনেতা।

উইলশায়ার বুলভারের উত্তরে একটা গোরস্থানের মধ্যে নামলো বেলুন। গনডোলা মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই ঘিরে ফেললে পুলিশ।

হেসে বললো রবিন, টেলিভিশনের লোকে খবর পায়নি। তাহলে শেষবারের মতো একবার টিভির পর্দায় চেহারা দেখানোর সুযোগ পেতেন মিস্টার ক্যাম্পার।

হেসেই জবাব দিলো কিশোর, সেটা পারবেন। সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ঠিকই হাজির হয়ে যাবে টিভির রিপোর্টার।

.

২০.

 চারদিন পর। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে এলো তিন গোয়েন্দা, তাদের জলকন্যা কেসের রিপোর্ট দিতে।

ফাইলটা আগাগোড়া মন দিয়ে পড়লেন পরিচালক। তারপর মুখ তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, খুবই দুঃখজনক! একটা বাচ্চার জন্যে নিজের জীবনের ওপর এতোবড় ঝুঁকি নিলো মানুষটা! ভালোবাসা এমনই জিনিস! আর আরেকজনের হলো লোভ। লোভের জন্যে, কিছু জিনিস বাঁচানোর জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠলো। বাচ্চাটার কাছে। টেবিলের ওপর দুই হাত বিছিয়ে তালুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ তিনি। আবার মুখ তুললেন। চোরাই জিনিসগুলো কি মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে?

কিছু কিছু হয়েছে, রবিন বললো। যেগুলোর মালিককে পাওয়া গেছে। অনেক ধন্যবাদ পেয়েছি আমরা, হাসলো সে। মালিকদের কাছ থেকে তো বটেই, পুলিশের কাছ থেকেও।

পাবোই, মুসা বললো। আমাদের দেয়া তথ্য অনেক কাজে লেগেছে। পুলিশের। ইভলিন স্ট্রীটের বাড়িটায় তল্লাশি চালিয়েছে ওরা। একটা পেশাদার চোরকে বমাল গ্রেপ্তার করেছে ওখান থেকে।

সব বলে দিয়েছে সে, মুসার কথার পিঠে বললো রবিন। পুলিশ জেনেছে, হলিউডের বড় বড় পার্টিতে দাওয়াত পড়তো ক্যাম্পারের। অভিনয় ছেড়ে দিলেও চিত্ৰজগৎ ছেড়ে আসেনি সে। যোগাযোগ ছিলো। ওসব দাওয়াতে গিয়েই লোকের বাড়ির জিনিসপত্র দেখে আসতো। খোঁজখবর করে আসতো কোথায় আছে বার্গলার। অ্যালার্ম, চোর ঠেকানোর আর কি কৌশল করা হয়েছে। কারা কখন বাড়ি থাকবে, কারা বেড়াতে যাবে, বাড়িতে কতোজন লোক আছে, কে কখন থাকে, সব জেনে আসতো। পেশাদার চোরদেরকে এসব তথ্য সরবরাহ করতো সে। এমনকি এ-ও বলে দিতো, কোন কোন জিনিস চুরি করতে হবে।

যেসব জিনিস তার প্রয়োজন, সেসব কিনে নিতে চোরদের কাছ থেকে। বেশি। দামী আর কিছুটা দুর্লভ জিনিস ছাড়া নিতো না। চোরকে কাছ থেকে জিনিস কিনতে নগদ টাকার দরকার হয়, চেকফেক নিতে চায় না চোর। কাজেই বাক্স বোঝাই করে নগদ টাকা রেখেছে ক্যাম্পার। ইভলিন স্ট্রীটের বাড়িটা চোরের আড্ডা, চোরাই মালের গুদামও ওটা। ওখানে জিনিস কিনতে যেতো সে। তারপর শহরে গিয়ে চড়া। দামে ওগুলো আবার বিক্রি করতো। বিক্রি করে দেয়ার জন্যে দালালও রেখে ছিলো। কিছু কিছু জিনিস নিজেই বিক্রি করে ফেলতো তার গ্যালারিতে রেখে।

ঝুঁকিটা খুব বেশি নিয়ে ফেলেছিলো না? মিস্টার ক্রিস্টোফার বললেন। চোরেরা জানলেই তো ব্ল্যাকমেল শুরু করে দিতো।

আসলে ওরা জানতোই না ক্যাম্পার তাদের জিনিস কেনে, অনেকক্ষণ পর,— মুখ খুললো কিশোর। ছদ্মবেশ নিয়ে তারপর ওদের কাছে যেতো সে। আর নিজে গিয়ে দেখা করতো ওদের সঙ্গে, কখনোই তার কাছে কাউকে আসতে দিতো না। কোথায় থাকে, ঠিকানাও দিতো না।

হু, চালাক লোক। কিটু গিয়ে ট্রেজার রুমে ঢুকেই দিলো তার সর্বনাশ করে।

হ্যাঁ। কিটু সব বলে দিয়েছে। প্যারেডের দিন প্রিন্সেস স্যুইটে ঢুকেছিলো সে। জিনিসগুলা দেখেছে। বাক্সের ডালা খুলে একটা বাণ্ডিল সবে তুলেছে, এই সময়। ঢুকেছে ক্যাম্পার। ভয় পেয়ে ডবকে নিয়ে দৌড় দেয় কিটু। তার পেছনে ছোটে ক্যাম্পার। গ্যালারিতে এসে জলকন্যার পেছনে লুকায় কিটু। কুকুরটাও লুকাতে এসে দেয় ঘাপলী বাধিয়ে। ধাক্কা দিয়ে মূর্তিটা ফেলে দেয়। তার গায়ের ওপ্র পড়ে ভেঙে যায় জলকন্যা। আঘাত অল্পই লাগে কুকুরটার শরীরে। কিন্তু শক সইতে পারেনি তার দুর্বল হার্ট। মারা পড়ে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে আরম্ভ করে কিটু, ক্যাম্পারের ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে লুকায় পিয়ারে। বরগু তাকে দেখে বাড়ি নিয়ে যায়। অভয় দেয়, লুকিয়ে রাখে।

বেচারা! আফসোস করলেন পরিচালক।

ট্রেজার রুমটা যদি কিটু দেখে না ফেলতো, অসুবিধে হতো না ক্যাম্পারের। নিনা হারকারকে বলে শাসন করাতে পারতো ছেলেটা। কিটু হারিয়ে যাওয়ায় ভয়ে ভয়ে ছিলো সে, কখন ফিরে এসে সব কিছু বলে দেয় ছেলেটা।

অপরাধ কোনো সময় চাপা থাকে না। হ্যাঁ, ডিগার আর তার রুমমেটের খবর কি? ওরাও কি কোনোভাবে জড়িত ছিলো ক্যাম্পারের সঙ্গে?

না। ডিগারটা একটা ছিঁচকে চোর। তার রুমমেটটা সাধারণ শ্রমিক, স্লেভ মার্কেটে গিয়ে কাজ জোগাড় করে। বড় জিনিস, কিংবা বেশি মাল সরানোর প্রয়ো জন পড়লে স্লেভ মার্কেটে চলে যেতো ক্যাম্পার, ট্রাকসহ শ্রমিক ভাড়া করতো।

হুম! তো, বরগুর খবর কি? পুলিশ কি এখনও আটকে রেখেছে তাকে?

না। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি নিনা হারকার। বরং পুলিশকে অনুরোধ করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে, কিশোর বললো। আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে বরগু। জজ্ঞাল সাফ করে, কুকুরদুটোকে সঙ্গে নিয়ে। কিটুও। ভালো আছে। আসছে সেপ্টেম্বরেই তাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেয়া হবে।

এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে তার মা, মৃদু হাসলেন পরিচালক। কোথায়। গেল, কোথায় গেল, ভেবে আর সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হবে না।

না, হবে না, একমত হলো তিন গোয়েন্দা।

এবার তোমাদের জন্যে আইসক্রীম দিতে বলি, কি বলো? মুহূর্ত দ্বিধা না করে একমত হলো মুসা। দুই কানের গোড়ায় গিয়ে ঠেকেছে তার হাসি।

1 Comment
Collapse Comments
শরিফুল May 3, 2021 at 8:30 pm

তিন গোয়েন্দা নতুন গল্প পাচ্ছি না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জলকন্যা

জলকন্যা

জলকন্যা

রাত আটটার দিকে বীনুর মনে হল সে একটা ভুল করেছে। ছোটখাটো ভুল না, বড় ধরনের ভুল–-মনিকার জন্মদিনে তার আসা ঠিক হয়নি। মনিকা তার এমন কেউ না যে তার জন্মদিনে আসতেই হবে। তাছাড়া মনিকা তাকে সেভাবে দাওয়াতও করেনি। ভদ্রতা করে বলেছে। মনিকা তার জন্মদিনের কথা নীতুকে বলছিল, সেই সময় বীনুর দিকে তাকিয়ে বলল, বীনু তুমিও এসো। বীনু তৎক্ষণাৎ হ্যাংলার মত বলেছে—আচ্ছা। এটা যে নিতান্তই কথার কথা তাও বুঝেনি।

মনিকা বলেছে, পার্টিতে যারা আসবে তাদের কিন্তু সারারাত থাকতে হবে। সারারাত আমরা হৈ চৈ করব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?

বীনু বলল, না, অসুবিধা হবে না।

অথচ তার ভয়ঙ্কর অসুবিধা হবে। তাদের বাসা এরকম না যে ঊনিশ বছর বয়েসী মেয়েকে রাতে অন্য বাড়িতে থাকতে দেবে। তার নামে বাসায় কোন চিঠিপত্র এলে তার হাতে দেয়া হয় না, আগে বীনুর মা মনোয়ারা খুলে পড়েন। পড়ার পর যদি মনে হয় সাধারণ চিঠি তবেই তার হাতে দেয়া হয়। সাধারণ চিঠিতেও সমস্যা আছে। তার এক বান্ধবী সুরমা, ক্লাস টেনে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সে তার স্বামীর সঙ্গে চলে গিয়েছিল সেতাবগঞ্জ নামের একটা জায়গায়। সেখান থেকে সে মাসে দু’টা তিনটা করে চিঠি লিখতো। মনোয়ারা একদিন বললেন, মেয়েটা এত চিঠি লেখে কেন? ঘন ঘন চিঠি লেখার দরকার কি?

বীনু অবাক হয়ে বলল, চিঠি লিখলে অসুবিধা কি মা?

মনোয়ারা থমথমে গলায় বললেন, অসুবিধা আছে, তোর বাবা রাগ হয়। বাবা রাগ হয়–এর উপর কথা চলে না। বীনুদের সংসার তার বাবা ইদ্রিস আলির চোখের ইশারায় চলে। ইদ্রিস আলি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। রোগা পটকা মানুষ, থুতনীতে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটার মত দাড়ি আছে। নিতান্তই সাধারণ চেহারার একজন মানুষ। অথচ সেই সাধারণ চেহারার মানুষের চোখের ইশারার বাইরে যাবার সাহস কারো নেই। বীনুর ছোট ভাই জহির কলেজে ভর্তি হবার পর একবার সাহস দেখালো, বাসায় ফিরল রাত সাড়ে এগারোটায়। তার এক বন্ধুর বাসায় নাকি দাওয়াত ছিল। বাসায় ফিরেই সে নিজের ঘরে ঢুকে তাড়াহুড়া করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। তখন ইদ্রিস সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। কোমল গলায় বললেন, জহির ওঠ (ইদ্রিস সাহেবের গলার স্বর খুবই কোমল)। জহির ধড়মড় করে উঠে বসলো। জহির সাহেব বললেন, কোথায় ছিলি?

বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল।

খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করেছিস?

জ্বি।

কি খাওয়ালো?

পোলাও আর খাসির রেজালা।

বোরহানি ছিল না?

জ্বি না।

গরমের মধ্যে বোরহানি দেয়া তো উচিত ছিল। রিচ ফুড বোরহানি ছাড়া হজম হবার কথা না। খাওয়া-দাওয়ার পর মিষ্টি পান খাস নাই?

জ্বি খেয়েছি।

সিগারেট খাস নাই? মিষ্টি পানের সাথে তো সবাই সিগারেট খায়। তুই খাস নাই?

জ্বি না।

আমিতো গন্ধ পাচ্ছি। দেখি হা করতো, বড় করে হা কর। আরো বড়। এখন নিঃশ্বাস ফেল।

জহির নিঃশ্বাস ফেলল এবং কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আর কোনদিন খাব না বাবা। ইদ্রিস সাহেব মধুর গলায় বললেন–খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। বন্ধুবান্ধব আগ্রহ করে দেয়, না খেলে ওরা মনে কষ্ট পাবে। কারো মনে কষ্ট দেয়া ঠিক না। আচ্ছা এখন নাম বিছানা থেকে।

জহির বিছানা থেকে কাঁপতে কাঁপতে নামলো।

সার্ট গায়ে দে।

জহির সার্ট গায়ে দিল।

ইদ্রিস সাহেব বললেন, যা এখন বাসা থেকে চলে যা। তোকে আর পুষব না। তুই আমাকে বাপ ডাকবি তার জন্যে তোকে পোষার দরকার দেখি না। ঢাকা শহরে শত শত লোক আছে যাদের তিনবেলা ভাত খাওয়ালে খুশি মনে আমাকে বাপ ডাকবে।

.

জহিরকে অবশ্যই সে রাতে বাসা ছাড়তে হত যদি না ইদ্রিস সাহেবের মা ভাগ্যক্রমে বাসায় থাকতেন। এই ভদ্রমহিলার বয়স সত্তরের উপর। চোখে দেখতে পান না। কিন্তু কান খুব পরিষ্কার। হাঁটা চলা করতে পারেন। হৈ চৈ শুনে তিনি দেয়াল ধরে ধরে বের হয়ে এলেন এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আবু কি হইছে?

ইদ্রিস সাহেব বললেন, কিছু না মা, ঘুমান।

বাসাত থাইক্যা কারে বাইর করতাছস?

আম্মা আপনে ঘুমান।

আমি জীবিত থাকতে তুই আমার নাতিরে রাস্তায় বাইর কইরা দিবি, তোর সাহসতো কম না। সাহস বেশি হইছে?

কাউরে বাইর করতেছি না।

এইটা ভাল কথা।

থুরথুরি বুড়ি বিছানায় শুতে গেলেন। তবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণই কথা বলতে লাগলেন–সিগারেট খাইছে তো কি হইছে? তার বয়সে তুই বিড়ি খাইচস। নিজের বাপের মাইর তোর মনে নাই। বাপগিরি ফলাস। অত বাপগিরি ভাল না।

.

বীনুর ভরসা তার দাদীজান। দাদীজান এখন তাদের বাসায় আছেন। তিনি পালা করে তার চার ছেলের বাসায় তিন মাস করে থাকেন। রোজার ঈদ পর্যন্ত বীনুদের সঙ্গে থাকার তারিখ পড়েছে। দাদীজানকে দিয়ে বাবার অনুমতি বের করে নেয়া খুব সমস্যা হবে না বলেই বীনুর ধারণা। বীনুর খুব শখ মনিকার সঙ্গে একটা রাত কাটায়। এত সুন্দর একটা মেয়ে আর এত বড়লোক। ওদের বাড়িটাও নিশ্চয়ই দেখার মত হবে। বীণুর ক্ষীণ আশা একটা রাত থাকলে মনিকার সঙ্গে তার ভাব হতে পারে। এরকম। একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব হওয়াও ভাগ্যের কথা। মনিকা যাদের সঙ্গে ঘুরে বীনু দূর থেকে তাদের দেখে, তাদের চালচলন কথাবার্তা সবই অন্য রকম। সেদিন মনিকারা চারজন (ওরা চারজন সব সময় এক সঙ্গে থাকে। সেই জন্যে ওদের নাম হয়েছে চতুর্ভুজ)। ওয়াদুদ স্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল। মনিকা তখন স্যারের রুমে। সে গেছে তার। পার্সেন্টেজ দিতে। দেরিতে ক্লাসে এসেছিল বলে পার্সেন্টেজ দিতে পারেনি।

ওয়াদুদ স্যার বললেন, কি ব্যাপার, চতুর্ভুজ এক সঙ্গে? মনিকা হাসি মুখে বলল, আপনি স্যার কফি বানিয়ে খান। রোজ এত সুন্দর গন্ধ পাই। আজ আমাদের কফি খাওয়াতে হবে।

বেশতো, কফি খাও।

ওয়াদুদ স্যার বেয়ারাকে কফি বানাতে বললেন। বীনু মুগ্ধ হয়ে গেল মেয়ে চারটার সাহস দেখে।

আরেকবার বীনু সাবসিডিয়ারী ক্লাসের শেষে বেরুচ্ছে। একটা বদ ছেলে ভিড়ের অজুহাতের সুযোগে বীনুর বুকে হাত দিল। বীনু লজ্জা এবং ভয়ে প্রায় জমে গেল। মনিকা ছিল তার পেছনে। সে ছেলেটার সার্ট খামছে ধরে বলল, তুমি ওর গায়ে হাত দিলে কেন? চারদিকে ভিড় জমে গেল। বীনু প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি। মনিকা, ওকে ছেড়ে দাও।

মনিকা শীতল চোখে কিছুক্ষণ বীনুর দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। মনে মনে সে নিশ্চয়ই বীনুর মুখে থু থু দিয়েছে। বীনুর দিকে তাকাতেও নিশ্চয়ই তার

ঘেন্না করছিল। করাটা স্বাভাবিক। বীনু যদি তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করতে পারতো তাহলে হয়তো মনিকা তাকে এতটা ঘৃণা করতো না। তাদের বাসা অন্য সব বাসার মত না। তার বাবা-মা অন্য সব বাবা-মা’র মত না। তারা আলাদা। কি রকম যে আলাদা তা মনিকা বা মনিকার মত বান্ধবীরা জানে না।

.

বীনু যখন কলেজে পড়ে তখন হঠাৎ দেখা গেল একটা ছেলে প্রায়ই তাদের বাসার। সামনে হাটাহাটি করে। জানালার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকে। বীনু ব্যাপারটা শুরুতে লক্ষ্যই করেনি। লক্ষ্য করলেন বীনুর মা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বীনুর বাবাকে জানালেন। ইদ্রিস আলী ঐ ছেলেকে কিছু বললেন না। তিনি ঝিম ধরে সারা দুপুর বসে রইলেন (অফিসে গেলেন না, অফিস কামাই করলেন)। মাগরেবের নামাজের পর মিষ্টি গলায় ডাকলেন–বীনু কইরে?

বীনু সামনে এসে দাঁড়াল।

বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করে ছেলেটা কে?

বীনু অবাক এবং খানিকটা ভীত গলায় বলল, কোন ছেলে?

ইদ্রিস সাহেব আরো শান্ত গলায় বললেন, কোকরা চুলের একটা ছেলে, গলাটা লম্বা।

জানি নাতো বাবা।

জান না?

জ্বি না।

তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি তাকে চেন না জান না, এম্নি সে তোমার ঘরের সামনে ঘুরাঘুরি করে?

বীনু এই পর্যায়ে ভয়ে অস্থির হল। কারণ দাদীজান বাসায় নেই। তিনি তাঁর ছোট ছেলের বাসায়। জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে থাকবেন। বীনুকে রক্ষা করার এখন আর কেউ নেই।

ইদ্রিস সাহেব শান্ত গলায় বললেন, শরীরে বিষ ঢুকে গেলে মন্ত্র পড়ে বিষ নামাতে হয়। সেই মন্ত্র আমি জানি। যাও–ঘরে যাও, আমি আসছি। তোমার মাকে বল উপস্থিত থাকতে।

বীনুর খুব ইচ্ছা হল দরজা খুলে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার দু পাশে যদি কোন বাড়ি থাকে এবং তার দরজা খোলা থাকে তাহলে সে সেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়বে এবং বাড়ির মালিককে বলবে—-আপনাদের কোন কাজের বুয়া লাগবে?

যাই হোক বীনু সেই সব কিছুই করল না। সে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে শোবার ঘরে খাটের উপর বসে রইল। বাতি জ্বালালো না। যথাসময়ে ইদ্রিস সাহেব এলেন এবং মেয়ের চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টান দিলেন। মেয়ে বড় হয়েছে তার গায়ে হাত দেয়া যায় না। তাকে শাস্তি দিতে হলে চুলের মুঠি ধরেই দিতে হয়। পরবর্তী আধঘন্টা ইদ্রিস সাহেব শাস্তি দিলেন। তার হাত ভর্তি মুঠো মুঠো চুল উঠে আসতে লাগলো। বীনুর মা পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না। দেখা গেলে দেখা যেত। শাস্তি প্রক্রিয়ায় তাঁর অনুমোদন আছে। শাস্তির শেষে বীনু মরার মত মেঝেতে পড়ে রইলো। ইদ্রিস সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন–যন্ত্রণা ঘরে রেখে লাভ নেই। বিয়ে দিয়ে দাও। আমার দায়িত্ব শেষ হোক। হাতে ছেলে একটা আছে, বয়স সামান্য বেশি। পুরুষ মানুষের জন্যে বয়স কোন বড় ব্যাপার না। বীনুর মা বললেন–তুমি যা ভাল বোঝ কর।

সেই ছেলেটির সঙ্গে বীনুর বিয়ে হয়ে যেত। ঠেকালেন বীনুর দাদীজান। বীনু তার কাছে কেঁদে গিয়ে পড়েছিল। তিনি ছেলেকে ডেকে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, বীনুর নাকি বিবাহের কথা চলতেছে?

ইদ্রিস বললেন, জ্বী।

আলহামদুল্লিাহ। ছেলে কি করে?

ছোটখাট ব্যবসা আছে। মুগদা পাড়ায় নিজের বাড়ি আছে।

বয়স কত?

বয়স সামান্য বেশি।

অনুমান কত।

সঠিক জানি না, ত্রিশ বত্রিশ হতে পারে, কিছু বেশিও হতে পারে। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না।

গাধার মত কথা কচ ক্যান। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না তরে কে শিখাইছে? মেয়েটা ভাল লেখাপড়া করতেছে। তারে ঘাটের মরার সাথে বিয়া দিবি? তুই তিনবারে মেট্রিক পাস করছস। তোর মেয়ে মেট্রিকে বৃত্তি পাইছে। আমরার পরিবার থাইক্যা একটা মেয়ে এমএ পাস করব। এইটা দেখনের জন্যে এখনো বাঁইচ্যা আছি। বুঝছস?

লেখাপড়াতো বিয়ের পরেও হয়।

বিয়ার পর প্রত্যেক বছরে একটা কইরা বাচ্চা হয়। আর কিছু হয় না। তুইতো আইএ পাস বউ বিয়া করছিলি। বিয়ার পরে হে কি বিএ পাস দিছে? আমারে চেতাইস না। খবর্দার কইলাম। খবর্দার।

.

বিয়ে হয়নি। এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার বীর্ন ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে গেল। তার দাদীজান তাকে সেদিন দুহাজার টাকা দিয়ে বললেন, যা–ভাল ভাল জামা কাপড় কিন্যা আন। যেটা পছন্দ সেটা কিনবি। আইজ-কাইলের মেয়েরা যেগুলি পরে। বুজচস?

বীনু দুটো সালোয়ার কামিজ কিনেছে। নিজে একা একা গিয়েই কিনেছে। একটা শাদার উপর গোলাপী কাজ, অন্যটা লালের উপর লাল সূতার কাজ। কামিজ দুটোর কোনটাই সে পরতে পারেনি। ইউনিভার্সিটিতে যাবার প্রথম দিন সে লাল কামিজটা পরল। বীনুর মা বললেন, প্রথম ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিস তোর বাবাকে সালাম করে তার দোয়া নিয়ে যা। বীনু তার বাবাকে সালাম করল। ইদ্রিস সাহেব বললেন, প্রথম ক্লাসতো এগারোটায়, এখন বাজে নটা চল্লিশ। এখন কোথায় যাচ্ছিস। বীনুর মা বললেন, প্রথম দিন একটু আগে আগে যাবে। কোন রুমে ক্লাস খুঁজে পাবে না।

 ইদ্রিস সাহেব বললেন, খুঁজে না পাওয়ার কি আছে? তাছাড়া আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি।

বীনুর মুখ শুকিয়ে গেল। বাবা সঙ্গে যাবেন। তার সঙ্গে ক্লাস রুম খুঁজে বের করবেন। কে জানে ক্লাস চলাকালীন সময়ে হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। সবাই। হাসাহাসি করবে।

ইদ্রিস সাহেব বীনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, তুই অপেক্ষা কর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না। সামনে থেকে যা। বলেই কঠিন গলায় ডাকলেন, সুরমা-সুরমা।

সুরমা মাছ কাটছিলেন, হাতে মাছের রক্ত নিয়েই ছুটে গেলেন। ইদ্রিস সাহেব থমথমে গলায় বললেন, মেয়ে যে জামাটা পরেছে সেই জামাটা দেখেছ? গলার কাটা কত বড় দেখেছ?

সুরমা ক্ষীণ গলায় বললেন, আজকালতো সবাই এইসবই পরে।

ইদ্রিস সাহেব বললেন, ন্যুড ক্লাবে আজকালতো অনেকে ন্যাংটাও ঘুরে বেড়ায়। তোমার মেয়েতো পড়াশোনা করার জন্যে যাচ্ছে। সেকি তার বুক দেখানোর জন্যে যাচ্ছে? সে দেখাতে চায় যে তার বুক বড়?

ইদ্রিস সাহেব কথাগুলো চাপা গলায় বললেও বিনু বারান্দা থেকে শুনে ফেলল। তার ইচ্ছা করল ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। সে লাফ দিয়ে পড়ল না। যথাসময়ে সাধারণ একটা শাড়ি পড়ে বাবার সঙ্গে রিকশা করে রওনা হল। রিকশায় ইদ্রিস সাহেব মেয়েকে কয়েকটা উপদেশ দিলেন। কখনো কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলবে না। মেয়েদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারেও সাবধান। বেশি মেশামেশিরও দরকার নেই। ইউনিভার্সিটি কোন আড্ডাখানা না। ক্লাস করবে, ক্লাস শেষ হবে বাসায় চলে আসবে। ব্যাস।

কোন পরিবেশে বীনু বড় হচ্ছে তা মনিকা বা মনিকার বান্ধবীরা জানে না। জানলে বুঝতো একটা বদ ছেলে তার গায়ে হাত দেয়ার পরেও সে কেন বলছে–কেউ গায়ে হাত দেয়নি। এই নিয়ে কোন সমস্যা হলে বাবার কানে চলে যাবে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে আর না। পড়াশোনার দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা মিটাও। কবুল কবুল কবুল–ঝামেলা শেষ।

মনিকার চোখে বীনু খুব ছোট হয়ে আছে। বীনু ভেবে রেখেছে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলে সে মনিকাকে তার কথাগুলো বলবে। তারা যেহেতু সারারাত থাকবে সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সমস্যা একটাই বাবার অনুমতি। বীনু ঠিক করল সে কেঁদে দাদীজানের পায়ে পড়ে যাবে। তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। অবশ্যই করবেন।

.

তিনি ব্যবস্থা করলেন। কিভাবে করলেন বীনু জানে না। জানতেও চায় না। সে বিস্ময়ের সঙ্গে তার বাবাকে বলতে শুনলো–ওরা থাকে যেন কোথায়?

গুলশানে।

ওদের টেলিফোন নাম্বার জান?

জ্বি জানি।

ঐ বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার একটা কাগজে লিখে যাও। জহির তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে, বাসাটাও চিনে আসবে। আমি রাতে তোমার খালার বাসা থেকে একবার টেলিফোনে খোঁজ নেব।

তার দরকার নেই বাবা।

অবশ্যই দরকার আছে। আরেকটা কথা তোমাকে বলি, তুমি আজ যা করছ তা ঠিক না। অন্যায়। আমার মা মৃত্যুশয্যায়–তিনি একটা কথা বললেন, ফেলতে পারলাম না। মায়ের আদেশ আমি কোনদিনই অগ্রাহ্য করি নি। যতদিন বাঁচবেন অগ্রাহ্য করবো না। এখন যাও, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা সুন্দর করে কাগজে লিখে ফেল।

বাবা তাকে তুই তুই করে বলেন, এখন তুমি করে বলছেন। বাবার মনটন যে অসম্ভব খারাপ সেটা বোঝা যাচ্ছে।

বন্ধুর জন্মদিন খালি হাতে যাওয়া ঠিক না। আমি উপহার কিনে নিয়ে আসছি। সাথে করে নিয়ে যাও।

জ্বি আচ্ছা।

ইদ্রিস সাহেব চারটা গ্লাসের একটা সস্তা সেট নিয়ে এলেন। এই উপহার মনিকার হাতে দিলে বীনা নিজেই লজ্জায় মরে যাবে এবং চারদিকে হাসাহাসি পড়ে যাবে।

.

সন্ধ্যা সাতটার সময় যাওয়ার কথা বীনু ঘড়ি ধরে ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময়ই উপস্থিত হল। বড়লোকের বাড়ি সবই নিশ্চয়ই নিয়ম মত হবে। গিয়ে দেখে সে ছাড়া আর কেউ আসেনি। মনিকা নিজেও সাজগোজ কিছু করেনি। গোসল করার জন্যে বাথরুমে শুধু ঢুকতে যাচ্ছে। সে বীনুকে দেখে বলল, ও আচ্ছা, তুমি চলে এসেছ। অন্যরাতত কেউ আসেনি। সারারাত থাকবে তো ধীরে সুস্থে আসছে। তুমি কি সারা। রাত থাকবে না চলে যাবে?

থাকব।

বাসায় অসুবিধা থাকলে রাত দশটা এগারোটার দিকে চলে যেতে পার। গাড়ি আছে, গাড়ি দিয়ে আসবে।

না, অসুবিধা হবে না।

অসুবিধা না হলে খুব ভাল। আমরা সারারাত ফান করব। তুমি এখন টিভি দেখ বা বই টই পড়। মজু আঙ্কেল টেলিফোন করেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারবে।

উনি কে?

বাবার বন্ধু। আমাদেরও বন্ধু। ম্যাজিক টেজিক অনেক কিছু জানেন। ফান করার আইডিয়াতে তার মাথা একেবারে ভর্তি।

বীনু বলল, তোমাদের বাড়িটা কি একবার ঘুরে দেখব? এত সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে দেখিনি।

দেখ, ঘুরে ঘুরে দেখ। রহিমাকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবে। কি খাবে? চা, কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু?

 না।

আমাদের ডিনারের কিন্তু দেরি হবে। আজকে আমাদের ডিনার খাওয়াচ্ছেন মজু আঙ্কেল। বিশেষ একটা খাবার তৈরি হচ্ছে। সেটা আসবে রাত এগারোটার দিকে। ভাল কথা, তুমি কি সুইমিং কস্টিউম এনেছ? ও আচ্ছা, তোমাকে বোধ হয় বলা হয়নি আমাদের বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল আছে। গভীর রাতে আমরা সবাই সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতে গান শুনব। তুমি কি সাঁতার জান?

বীনু সাঁতার জানে। তার নানার বাড়ির পুকুরে দাপাদাপি করে ছোটবেলাতেই সাঁতার শিখেছে। তারপরেও বলল,–সাঁতার জানি না। তার এতগুলো মেয়ের সঙ্গে পানিতে নামতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে পানিতে মজু আংকেল নামের ভদ্রলোকও নামবেন।

.

রহিমা মধ্যবয়স্ক হাসি খুশি একজন মহিলা। তার পরনের শাড়িটা পরিষ্কার, পায়ে সুন্দর চামড়ার স্যান্ডেল। মনিকা আগে বলে না দিলে বীনা তাকে মনিকার মা বা তার কোন আত্মীয় ভেবে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতো। রহিমা’র মা বীনাকে খুব খুশি মনেই ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখালো। লাইব্রেরী ঘর, কম্পিউটার ঘর, বার, হল ঘর, গ্যালারি, লন্ড্রি রুম। মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা। রহিমা’র কাছ থেকেই বীনা জানতে পারল মনিকার বাবা মা দেশে নেই। মনিকার মা’র হার্টে স্পেসমেকার লাগানো আছে। সেখানে কি যেন সমস্যা হচ্ছে। লন্ডনে ডাক্তার দেখাতে গেছেন। মনিকার বাবাও গেছেন সঙ্গে। আজকের জন্মদিনে মনিকার আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। আজ শুধু তার বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। মজু আংকেল থাকবেন কারণ ফান আইডিয়া সব তার মাথাতেই আসে।

মনিকার বান্ধবীরা এখনো আসেনি। তবে মজু আংকেল এসে গেছেন। লম্বা একজন মানুষ। গায়ের রং সাহেবদের মত দুধে আলতায়। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সর্বক্ষণ পাইপ টানছেন। তাকে ঘিরে আছে তামাকের গন্ধ। তবে সেই গন্ধ খারাপ লাগছে না। ভদ্রলোক গরমের মধ্যেও হলুদ একটা কোট পরে আছেন। কোটটা অন্য সব কোটের মত না। পাঞ্জাবির মত লম্বা। মনিকা তাকে বীনুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

মজু আংকু, এর নাম বীনু। আমার সঙ্গে পড়ে। কেউতো এখনো আসেনি, তার বোধ হয় একা একা লাগছে। আপনি তাকে একটু কোম্পানী দিন। আমার সাজগোজ কিছুই এখনো হয়নি। আর বীনু শোন, মজু আংকেলের কথাতো তোমাকে আগেই বলেছি। আর্কিটেক্ট। কনফারমড ব্যাচেলার। তার যে কি পরিমাণ টাকা আছে তিনি তা নিজেও জানেন না। দারুন ক্লোজআপ ম্যাজিক দেখাতে পারেন। আজও দেখাবেন, সেই জন্যেই হলুদ কোট পরে আছেন। তাঁর যাবতীয় ম্যাজিক কোটের ভেতরে।

মজু আংকেল মনিকার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি সব কথাই ঠিক বলেছ তবে কনফারমড ব্যাচেলার কথাটা ঠিক বলোনি। পছন্দসই মেয়ে পাইনি বলেই ব্যাচেলার। আমি সারাক্ষণই পছন্দের মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। যখন কোন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় তখন প্রথমেই যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে–এই কি সে? তোমার বান্ধবীকে দেখেও সেই কথাই মনে হচ্ছে এবং আমার মনে হচ্ছে এই হল সে।

মনিকা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে তো আপনার সমস্যা সমাধান হয়েই গেল।

বীনু বুঝতেই পারছে না এসব কি ধরনের কথাবার্তা। বয়স্ক একজন মানুষ কি এই ধরনের কথা বলতে পারেন? না বলা উচিত? কি করে তিনি বললেন, এই হল সেই মেয়ে। ছিঃ ছিঃ।

মনিকা চলে যাচ্ছে। যাবার আগে বলল, মজু আংকেল আপনি কিন্তু বীনুর সঙ্গে সিরিয়াস কোন রসিকতা করবেন না। সে আপনাকে প্রথম দেখছে। আপনার রসিকতা বুঝতে পারবে না। ঘাবড়ে যাবে। আপনি বরং ওকে ম্যাজিক টেজিক দেখান।

.

মনিকা চলে গেছে। একা একা এই ভদ্রলোকের পাশে বসে থাকতে বীনুর প্রচন্ড ভয় লাগছে। তার শুধুই মনে হচ্ছে তিনি বলবেন,–দেখি তোমার হাত দেখি। আমি হাত দেখতেও জানি। বীনুর ফুপাতো বোন সুরমা আপার বাসায় এরকম হল। বীনু সুরমা আপার ছেলের আকিকায় গিয়েছিল। সেখানে দেখা গেল আসর জমিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। ইঞ্জিনিয়ার। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল সবই পাকা। তিনি নাকি খুব ভাল পামিস্ট, হাত দেখে সব বলে দিতে পারেন। সবাই হাত দেখাচ্ছে। সুরমা আপা বলল, বীনু তোর হাত দেখা না। বীনু বলল, না। ভদ্রলোক খপ করে বীনুর হাত টেনে নিলেন। তারপর হাত আর ছাড়েনই না। এইভাবে ধরেন ঐভাবে ধরেন। রীতিমত কচলানো। মজু আংকেলও কি এই রকম কিছু করবেন? বীনু ঘড়ি দেখলো, আটটা বাজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার মনে হল ভুল হয়েছে। মনিকার জন্মদিনে আসা ভুল হয়েছে।

মজু আংকেল বোধহয় বীনুর ভয় বুঝতে পারছেন। তাঁর পাইপ নিভে গেছে। তিনি পাইপ ধরাতে ব্যস্ত। দেয়াশলাইয়ের আগুন বারবার নিভে যাচ্ছে। বীনু প্রায় মূর্তির মতই বসে আছে। ভদ্রলোকের পাশে বসেছে বলে সে ভদ্রলোকের মুখ পরিষ্কার দেখতে পারছে না। বীনুর মনে হল ভদ্রলোক হাসছেন। মজু আংকেল পাইপে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার নাম হচ্ছে বীনু তাই না? বীনা থেকে বীনু।

বীনু মাথা নাড়াল। তার নাম বীনু ঠিকই তবে বীনা থেকে কি না তা জানে না।

তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?

জ্বি না।

তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছ। ভয় পাবার কিছু নেই।

আমি ভয় পাচ্ছি না।

তুমি থাক কোথায়?

কলা বাগানের পেছনে ভূতের গলি নামে একটা জায়গায়।

ভূতের গলি নাম কি জন্যে? ভূত আছে?

বীনু জবাব দিল না। সে আবার ঘড়ি দেখল। আশ্চর্য এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটা কি বন্ধ হয়ে গেছে?

তোমার বাবা কি করেন?

ব্যাংকে চাকরি করেন।

কোন ব্যাংকে?

সোনালী ব্যাংকে।

কোন ব্রাঞ্চ?

নীলক্ষেত ব্রাঞ্চ।

উনার পোস্ট কি?

ক্যাশিয়ার।

উনার কাজ তাহলে পরের টাকা গোনা?

বীনু জবাব দিল না। তার মনে হল তার বাবা ক্যাশিয়ার এটা শোনার পর মজু আংকেলের উৎসাহ কমে গেছে। এবং তিনি বোধ হয় একটু বিরক্তও বোধ করছেন। কেমন যেন সরু চোখে তার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের পাইপ আবার নিভে গেছে। তিনি আবারো পাইপ ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাইপ ধরাবার পর লম্বা করে ধোয়া ছেড়ে বীনুর দিকে তাকিয়ে কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না–উঠে হল ঘরের দিকে গেলেন। বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটাকি নষ্ট হয়ে গেছে? মজু আংকেল ফিরে আসছেন। তার হাতে পেটমোটা লম্বা একটা গ্লাস। গ্লাসে লেবুর টুকরা ভাসছে। বীনু শিউরে উঠল। ভদ্রলোকের হাতে কি মদের গ্লাস? মদ খেলে মানুষ অদ্ভুত কাণ্ড করে বলে সে শুনেছে। মদ খাবার এক পর্যায়ে সবাই বমি করে। ইনিও নিশ্চয়ই করবেন। উনি কি করবেন কে জানে। এত কাছ থেকে সে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখেওনি। ভদ্রলোক একবারে তার সামনে বসে আছেন।

বীনু?

জ্বি।

মনিকার সব জন্মদিনে আমি থাকি। তোমাকে এই প্রথম দেখলাম।

বীনু কিছু বলল না। ভদ্রলোক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গ্লাস ভর্তি জিনিসটা খাচ্ছে। খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার খেতে ভাল লাগছে না। মজু আংকেল এবার পুরোপুরি তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, মনিকার সব জন্মদিনে আমাকে নতুন নতুন ফান আইডিয়া বার করতে হয়। আই এম রানিং আউট অব আইডিয়াস। আমি মনিকাকে বলেছি–এই শেষ, আর আমার কাছে আইডিয়ার জন্যে আসবে না। এবারের ফান আইডিয়াটা কি তুমি জান?

বীনু ক্ষীণস্বরে বলল, না।

তোমাকে দেখে আমারো মনে হচ্ছে তুমি জান না–সুইমিং পুলে গোসলের কথা তোমাকে বলেনি?

জ্বি বলেছে।

ও, তাহলেতো তুমি জান। আইডিয়া আমার দেয়া, আমি নিম্ফ সাজার আইডিয়া দিয়েছি। নিম্ফ কি জান?

জ্বি না।

নিম্ফ হচ্ছে পরী যারা জলকেলি করতে ভালবাসে—জলকন্যা। আমি বলেছি আজ পূর্ণিমা’র রাত আছে। গভীর রাতে তোমরা সব বান্ধবীরা মিলে সুইমিং পুলে নেমে যাবে। ছাদের সব বাতি থাকবে নেভাননা। চাঁদের আলো পড়বে সুইমিং পুলের পানিতে। দূরে বাজবে সিম্ফনী –মুনলিট সোনাটা। পানিতে ভেসে বেড়াবে একদল জলকন্যা। এ ওর গায়ে পানি ছিটাবে, খিলখিল করে হাসবে। তাদের গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। কারণ জল কন্যাদের গায়ে কাপড় থাকে না। তাদের নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। অসাধারণ একটা দৃশ্য, তাই না?

বীনু কিছু বলল না। মজু আংকেল খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, কবিতা শুনবে? বীনু না বলার আগেই ভদ্রলোক ভারী গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন

ঘুমে চোখ চায়না জড়াতে,
বসন্তের রাতে।
বিছানায় শুয়ে আছি
একন সে কত রাত
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর।
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।

বীনু কাঠ হয়ে বসে রইলো। মদ খেয়ে ভদ্রলোক কি মাতাল হয়ে গেছেন? বীনু এত কাছে থেকে কাউকে মদ খেতে দেখেনি। অনেক দূর থেকে একবার দেখেছে। যশোহরে মঞ্জু খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাত এগারোটার দিকে শুনে ছাদে হৈ চৈ হচ্ছে। মঞ্জু খালা কার সঙ্গে যেন খুব রাগারাগি করছেন, কান্নাকাটিও করছেন। সে মঞ্জু খালার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, কি হচ্ছেরে? সে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা মদ খাচ্ছে তাই মা চেঁচামেচি করছে। বীনু আঁৎকে উঠলো। কি সর্বনাশ। সে কৌতূহল সামলাতে পারেনি। চুপিচুপি ছাদে দেখতে গিয়েছিল। ছাদে তখন খালা ছিলেন না। মেজো খালু সাহেব একা একা গ্লাস আর সবুজ রঙের একটা বোতল নিয়ে বসেছিলেন। বোতলটার রঙ কালোও হতে পারে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে ভেবেছিল আড়াল থেকে এক নজর দেখে চলে আসবে। কিন্তু খালু সাহেব তাকে দেখে ফেললেন, এবং অত্যন্ত মিষ্টি গলায় ডাকলেন, কে বীনু মা? আয় আয়। ছাদে খুব সুন্দর গোলাপের বাগান করেছি, বাগান দেখে যা। তোর মুখটা এমন শুকনো কেনরে মা? খালু সাহেবের কথাবার্তা এত সুন্দর এত স্বাভাবিক। কথা জড়ানো না কিছু না।

মজু আংকেলও খুব সুন্দর করে কথা বলছেন। মদ খেলে লোকজন হয়তো সুন্দর করে কথা বলে। তবে ভয়ংকর কথা বলে। এই ভদ্রলোক হয়তো জানেনও না তিনি কি ভয়ংকর কথা বলছেন। নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। কি ভয়ংকর কথা!

মজু আংকেল হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। তিনি পাইপে টান দিতে দিতে বললেন, একদল রূপবতী তরুণী নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটবে ভাবতেই ভাল লাগছে। ভিডিও করে রাখলে ভাল হত। এটাতে মনিকা রাজি হচ্ছে না। দেখি রাজি করানো যায় কি না। আজ থেকে কুড়ি বছর পর যখন তোমরা লোলচর্ম বুড়ি হয়ে যাবে তখন এই ভিডিও দেখে খুব ভাল লাগবে।

মজু আংকেলের গ্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার গ্লাস ভরতি করতে গেলেন।

মনিকার বন্ধুরা আসতে শুরু করেছে। এদের কাউকে বীনু চিনতে পারছে না। বীনু যেমন ওদের অবাক হয়ে দেখছে ওরাও বীনুকে অবাক হয়েই দেখছে। একটা অদ্ভুত পোশাক পরা মেয়ে ঘরে ঢুকেই বলল, আমাদের জলকন্যা সাজার প্রোগ্রাম ঠিক আছে তো? বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। আটটা বাজে। তার ঘড়ি কি নষ্ট? এই প্রথম তার মনে হল সে ভুল করেছে। খুব বড় ভুল করেছে।

.

রাত কত বীনু জানে না। তার ঘড়িতে আটটা বেজে আছে। তবে রাত যে অনেক এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে এখন মনিকাদের ছাদের একটা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে এত সুন্দর বাথরুম সে দেখেনি। কোনদিন হয়তো দেখবেও না। ধবধবে শাদা বিশাল একটা ঘর। সেই ঘরে নীল বাথটাব, নীল কমোড, নীল বেসিন। বাথরুমে নানান মাপের তোয়ালে। সেগুলোর রঙও নীল। আর কি বিশাল একটা আয়না। নিজেকে পুরোপুরি দেখতে হলে এরকম একটা আয়না লাগে।

মনিকার সব বান্ধবী সুইমিং পুলে নেমে গেছে। সুইমিং পুলে নামা’র আগে নাকি খুব ভাল করে গায়ে সাবান মেখে গোসল করে নিতে হয়। অন্যরা তাই করেছে। সে শুধু বাকি। সেওকি অন্যদের মত করবে? না দরজা বন্ধ করে বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদবে? মনিকা তাকে বলেছে, আমাদের জলকন্যা সাজার ব্যাপারটা যদি তোমার ভাল না লাগে তোমাকে জলকন্যা সাজতে হবে না। তুমি আমার ঘরে বসে ভিসিআরে ছবি। দেখ কিংবা গল্পের বই পড়। মজু আংকেল থাকবেন। তার সঙ্গে গল্পও করতে পার। আর তুমি যদি বাসায় চলে যেতে চাও তাও করতে পার। আমাদের ড্রাইভার আছে। ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। রাত অবশ্যি অনেক বেশি হয়ে গেছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এনজয় করছ না। তোমাকে কি নামিয়ে দিয়ে আসবে?

বীনু বলল, না। অথচ সে হ্যাঁ বলতে গিয়েছিল। তার মাথা বোধহয় এলোমেলো হয়ে গেছে।

সে জলকন্যা সাজতে চায় না। অথচ সে বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাজনা বাজছে। বাজনাটা কি সুন্দর। কি আশ্চর্য সুন্দর। মনিকার বান্ধবীদের খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। এরা বোধ হয় একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। এদের এই আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। এই বাড়ির ছাদে যে চাঁদ উঠেছে সেই চাঁদ তাদের বাড়ির ছাদে কখনো ওঠে না। মনিকাদের ছাদে পা দিয়েই চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কি যে অদ্ভুত অন্য রকম লাগলো।

বীনু কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে তার গায়ের কাপড় খুলছে। সে জলকন্যা সাজছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *