জলই পাষাণ হয়ে আছে (রচনা ২০০১-০৩। প্রকাশ ২০০৪)
জলই পাষাণ হয়ে আছে
তবে কি আমারও চোখে জল নেই? আমাদের চোখে?
তবে কি কেবলই এই সমুদ্ৰবাতাস ফিরে যায়
আমাদের বধিরতা নিয়ে?
আমাদের উদাসীন বধিরতা নিয়ে?
আমরা ততটা দেখে খুশি থাকি যতটুকু দেখে এ সময়
তার বেশি নয়।
ভালোবাসা শেখায় গণিত
সে শুধু বিশ্বাস করে অবিশ্বাস ছাড়া কিছু নেই
সকলেরই মাঝখানে বসে খুব অনায়াসে
সকলকে গ্রাস করা চলে–
এত শিলাপাথরের ঘেরে কালো হেসে
তুমি বলেছিলে চোখে জল নেই, আমাদের চোখে।
কখনো দুপুররাতে যখন পৃথিবী শবাসীনা
পাশেও ঘুমন্ত মুখে কোনো আভা যখন দেখি না
যখন শোকের মধ্যে মিশে থাকে এতখানি ঘৃণা
তখন সেকথা মনে পড়ে।
মনে পড়ে অলৌকিক তারারা জমেছে কোণে কোণে
বাজনা উঠেছে বেজে- কে কোথায় শোনে বা না-শোনে–
সত্য আর মিথ্যা এসে বিবাহে বসেছে একাসনে
আকাশপাতালজোড়া ঘরে।
তবে কি আমারও বুকে এতটা পাথরজমা ভার?
ঠিক। ঠিকই বলেছিলে তুমি, আজ
চোখে কোনো জল নেই, বুকের উপরে শুধু সেই
জলই পাষাণ হয়ে আছে।
*
সে অনেক শতাব্দীর কাজ
শিখর থেকে একে একে খসে পড়ছে তারা।
গহ্বরের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো, কেন
কেন অসময়ে আমাদের এই বিনাশ?’
জানতে চাইছে শিলায় শিলায় ঝলসে-ওঠা স্বর :
‘আমরা কি তবে সত্য ছিলাম না আমাদের শব্দে?
আমরা কি স্থির ছিলাম না আমাদের স্পন্দে?
আমরা কি অনুগত ছিলাম না আমাদের স্বপ্নে?
তবে কেন, কেন, আমাদের এই—’
পায়ে পায়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন পাহাড়ের কিনারে। বললেন, ‘শোনো,
ছোটা ছোটো সফলতায় অন্ধ
তোমরা সকলেই ছিলে নিজের ভিতরে রুদ্ধ।’
সকলের দিকে একে একে আঙুল তুলে তিনি বললেন, ‘তুমি ভেবেছিলে
তুমি যতটুকু জানো তার চেয়ে বেশি কোনো জ্ঞান নেই আর
তুমিই পরম আর সমস্ত পূর্ণতা এসে তোমাতেই মেশে ভেবেছিলে
ভেবেছিলে নিমেষেই জিতে নেবে ধনধান্যে অবোধ পৃথিবী
কখনোবা ভুলে গেছ গ্রাসে ভুলেছ সংসারসীমা
আর তুমি
যদিও তোমাকে আমরা আমাদের সকলেরই জানি
লালন করেছ তবু গোপন গোপন অতিগোপন তত-কিছু-গোপনও-না লোল পক্ষপাত
আর আমি, তোমাকে বাঁচাব বলে অতর্কিতে মিথ্যাচারী, বুঝি
তোমরা কেউ জানোনি যে বহুদিন আগে তোমরা মৃত।’
গহ্বরে মিলিয়ে যায় স্বর। স্তব্ধ শ্বাস। তার পর
তিনি ফিরে তাকালেন আমাদের দিকে। বললেন, ‘এবার
আসুন, এক শতাব্দী আমরা নীরব হয়ে দাঁড়াই।’
*
জাতক
তখন সন্ধে হয়ে এসেছে কিন্তু আলো জ্বলেনি কোথাও
বটমূলের আবছায়ায় বসে আছেন শাস্তা
আমরা তাঁকে ঘিরে আছি মুখে ত্রাস শিরদাঁড়া ভাঙা
স্খলিত স্বরে আমরা বলছি কী দেখেছি কী শুনেছি
কীভাবে তিনি ভেঙে যাচ্ছেন ঊর্ধ্বতন পাহাড়শিলায়
এক-একটা পাথরে কীভাবে উড়ে যাচ্ছে এক-একটা শতক
সে-উৎক্ষেপ ঘিরে ঘিরে নেচে উঠছে ধর্ষকাম গোলন্দাজদের দল
আর কীভাবে তাকিয়ে দেখছি আমরা যেন কিছু আর করবার নেই
আমরা তাঁকে বলছি।
তিনি চোখ মেললেন আকাশে, সে-চোখে নির্বেদ
বাসায়-ফেরা পাখিদেরও আর শব্দ নেই কোথাও
তিনি বললেন : শোনো, আরেক জন্মের কথা বলি আমি।
একদিন, মধ্যরাত, তখন সবাই ঘুমের মধ্যে অচেতন
সোর উঠল বাতাসে
অন্ধকার জ্বলে উঠল হাজার হাজার মশালের শিখায়
শিখা হাতে ছুটে আসছে রক্তপায়ী তরুণেরা
তাদের কপালে উলকি, বুকে শুদ্ধশোণিতের উন্মাদনা
বিদ্যাপ্রাঙ্গণের দিকে ছুটে আসছে তারা, দশ মে উনিশশো তেত্রিশ,
ধুলোয় নামিয়ে আনছে ৎসাইগ মান আইনস্টাইন রেমার্ক
ধুলোয় নামিয়ে আনছে জোলা জিদ প্রুস্ত ওয়েলস সিনক্লেয়ার বা হেলেন কেলার
খাণ্ডবদাহনে পুড়ছে সব, পুড়ে যাচ্ছে সমস্ত মনন
এক-একটা অক্ষর জুড়ে পুড়ে যাচ্ছে এক-এক শতক।
তখন
গোলন্দাজরাই ছিল উলকিপরা এই মশালধারী, আমিই ছিলাম বই,
আর তোমরা ছিলে সেই যারা
ঘুমের মধ্যে অচেতন।
রাত্রি তখন স্রোতস্বিনী। কোলের কাছে তীরবেঁধা হাঁস।
শাদা বুক থেকে শেষ রক্তবিন্দু হাতের পাতায় মেখে নিয়ে তিনি বললেন :
তারও পরে
জন্ম নিই আমি, জন্ম নিতে থাকি,
এ-জন্মের কথা আমি অন্য কোনো জন্মে বলে যাব।
*
দ
তোমার উদাসীনতায় প্রতিহত হতে হতে
যখন ধ্বংস করতে থাকি চারপাশ
আর তার এক-একটা পিণ্ডের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে
গড়াতে থাকি দিগবিদিকে
ঠিক তখনই
আমারই এক টুকরোর সামনে এসে দাঁড়ায় অনাথ একদঙ্গল শিশু
তাদের কেউ-বা চোখে দেখতে পায় না
কারো হাতের আঙুলগুলি বাঁকা
কোনো মুখ-বা ধ্বনিহীন
খোঁড়া পায়ে ঘুঙুরের শব্দ তুলে তারা এগিয়ে আসে আমার দিকে
আর দেখায় কতটা তারা শিখেছে এই প্রতিবন্ধী স্কুলে
ত্রিভঙ্গ শরীর দিয়ে আরতি করতে করতে
চকখড়ি দিয়ে আমার বুকের উপর তারা লিখে দেয় এক
একাক্ষর শব্দ : দ।
সেই মুহূর্তে ভেঙে পড়ে বাজ
সেই মুহূর্তে ঘূর্ণিত হতে থাকে সমস্ত পৃথিবী
সেই মুহূর্তে ঘুঙুরের শব্দ তুলে নেচে ওঠে একাক্ষর দ
আমার বুকের উপর নেচে ওঠে যেন ওই তিনজোড়া পা
দ-দ- দ
দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম, দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম্
শব্দ হয়ে যায় শিশু, শিশুরাও শব্দ হয়ে যায় :
দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম্।
তুমি?
তুমি কি দিয়েছ কিছু? কাউকে কি দিয়েছ কখনো?
*
দেশান্তর
তার পর, সমস্ত পথ একটাও কোনো কথা না বলে
আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি
এক দেশ থেকে অন্য দেশে
এক ধর্ষণের থেকে আরো এক ধর্ষণের দিকে।
পৃথিবী তো এ-রকমই।
এরই মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, ভাবি।
বটের ঝুরির মতো আমাদের-আমার-শরীর ঘিরে
কত কত অভিজ্ঞতা নেমে এল
সম্বলবিহীন। ইতিহাসহীন।
তার পর, ভোরের সামান্য আগে
সীমান্তসান্ত্রির গুলি বুকে এসে লাগে–
মরণের আগে ঠিক বুঝতেও পারি না আমি শরীর লুটাব কোন্ দেশে।
*
যেদিন
যেদিন নদীর জলে ভেসেছিল দু-হাজার শব
যেদিন পাড়ার সব দুয়োরে কুলুপ আঁটা ছিল
যেদিন শহরজোড়া গাছে গাছে ঝোলা কাটা হাত
অসাড় ইশারাভরে ডেকেছিল হৃৎপিণ্ডগুলি
যেদিন মাটির থেকে উঠেছিল শুধু কচি হাড়
বুভুক্ষু সমস্ত মুখ ভরে দিয়েছিল হুতাশনে
রাজপথে ছুটেছিল যেদিন উলঙ্গ নারীদল
এবং স্তনের শীর্ষে গাঁথা ছিল হাজার ত্রিশূল
যেদিন কবন্ধগুলি মদভাণ্ড রেখে ডানপাশে
নিজেরই মুণ্ডের চোখ খুঁজেছিল টেবিলের নীচে
যেদিন পৃথিবী তার সম্বিৎ হারিয়ে ছিল চুপ
ঝর্ঝর ঝরার শব্দে ঝরে পড়েছিল সব ধী
মুখেরা ফসিল আর যেদিন ফসিলই হলো মুখ
সেদিনও কি জানতে চাও তাহলে কবির ধর্ম কী?
*
দায়
যতদূর দেখা যায় সারি সারি সেলাইকরা মানুষ
স্থির দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য।
সে অবশ্য এখন একটু ব্যস্ত, তার অনেকরকম দায়।
পৃথিবীটা একটুখানি ঠিকঠাক করে দেবার দায়
তোমার বসতবাড়িতে ঘুঘু চরাবার দায়
তোমার সবটুকু নিশ্বাস শুষে নেবার দায়
তোমার মুখে রক্ত তুলে দিয়ে সে-রক্ত আবার মুছে নেবার দায়
আর, সত্যি বলতে কী,
তার নিজের গোর খুঁড়বারও দায়।
ক্ৰমমুক্তি? এভাবেই হবে।
সারি সারি সেলাইকরা মানুষ
প্রতীক্ষায় আছে।
*
কাগজ
প্রতিদিন ভোরের কাগজে
বর্বরতা শব্দ তার সনাতন অভিধার নিত্যনব প্রসারণ খোঁজে।
*
কবি
আমারই জন্য কথা বলতে যে
সেকথা কখনো বুঝিনি আমি–
কেননা আমি যে কোন্ আমি, সেটা
এ পাকচক্রে গুলিয়ে গেছে।
দিন আনি আর দিন খাই, তাই
আগামীর কথা ভাবি না কিছু
হাতে তুলে নিই সেটুকু তন্ত্র
হাটেবাজারে যা নিত্য বেচে।
তুমি ভেঙে গেছ তত্ত্বকাঠামো
দাখিল করেছ স্বাধীন মতি
সংশয়ে শুধু প্রশ্ন করেছ
হাজারো নালিশ করেছ দায়ের,
গঞ্জে বা গাঁয়ে ডাইনে বা বাঁয়ে
একা-য় অথবা নানা সমবায়ে
চেয়েছ হরেক মানুষকে ছুঁতে
দ্বন্দ্ব খুঁজেছ হাঁ-এর না-এর।
আমি কি তোমার দৃষ্টি চেয়েছি?
চেয়েছি কি কোনো জীবনছবি?
তোমার কাছে যা চেয়েছি সে শুধু
হও স্লোগানের জোগানদাতা।
তা যদি না হও আমিও নাচার
কোনো পথ নেই তোমার বাঁচার–
তাকে আজ আর কীভাবে নামাব
ঘাড়ে চেপে আছে যে-মান্ধাতা।
*
সেতু
অনেকদিন তেমন কোনো কথাও বলছি না
কেন তা তুমি ভালোই জানো। অতিথি সৎকারে
কথারা বড়ো ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া তোমারও তো
ছিল নিপাট নির্দয়তা- মুখফেরানো ব্রত।
অনেকদিন তুমি তোমার গোপন সংসারে
ডাক দাওনি সাহস করে, ছিলাম দিশেহারা।
চকঝমকে ঝলসানো মন ভুলেও গিয়েছিল
বেঁচে যখন ছিলাম আমার সঙ্গী ছিল কারা।
তাকাও না আর চোখের দিকে, আমিও চাই না।
না-তাকাবার অজুহাত তো আছেও হাজার হাজার।
একটা কথাই ঘুরতে থাকে অন্দরে-কন্দরে
তোমার আমার মধ্যে এখন সেতু কেবল বাজার।
*
দোষ
দোষী খুঁজতে খুঁজতে এতদূর আসা গেল।
সবাই সবাইকে পরখ করে দেখছে
এ না ও।
ধরা যে শেষ পর্যন্ত যাবে না তাও অবশ্য জানতাম।
এদিকে, ভিতরে তাকিয়ে দেখি
ঘর আলো করে বসে আছে চামুণ্ডা
তার দুকষ বেয়ে গড়িয়ে নামছে অবিরল
পানের পিক।
*
খেলা
যারা আমাকে অপমান করেছে
যারা আমাকে ভুল বুঝেছে
এমনকী যারা আমাকে ভুল বুঝিয়েছে
সবাই আজ একসঙ্গে এসে বসেছে গ্যালারিতে
কোন্ খেলা এবার খেলব তারা দেখবে।
কিন্তু
মাঠের ঠিক মাঝখানে
হঠাৎ আমার খুব ঘুম পেয়ে যায়
রেফারির বাঁশিবাজানো আর ওদের হো হো শব্দের মধ্য দিয়ে
যেন একটা সরু নদীর ওপর
হালকা হয়ে ভাসতে থাকে আমার শরীর।
*
আরো কয়েক পা
দিন চলে যায় ভয়ের জঠরে, জন্মায় তার থেকে
আরো এক দিন- পঙ্গু, আতুর- ভয় ছাড়া তার আর
কেউ নেই কিছু নেই কোনোখানে- বুকে হেঁটে যায় দিন-
এ-রকমই এক পথের দুধারে দুচোখ অন্তরিন।
শতাব্দী পায় উপঢৌকন কাটামুণ্ডের লাফ
আর সে-মুণ্ড যার কোলে পড়ে সে-মাথাও যায় খসে
কবন্ধসারি এড়িয়ে পেরিয়ে বুকে হেঁটে যায় দিন
মনে হয় যেন বেঁচে আছি শুধু বেঁচে থাকবার দোষে।
তারই মাঝখানে যদি বলি এসো হাত রাখো ভালোবাসো
আরো কয়েক পা সামনে যাবার স্বপ্ন দেখেছি কাল-
ফুৎকারে দাও উড়িয়ে সেসব, তোমার সে-উপহাসও
গাঁথা হয়ে যায় স্থিতির ভিতরে, স্মৃতি আজ উত্তাল।
বুকে হেঁটে যায় দিন আর তার শিয়রে চলেছি আমি
ভুল হয় যদি তবু বলি আজও- মাপ করো গোস্তাকি-
প্রতিটি লহমা উপড়ে নিচ্ছে সব পথ, তবু জেনো
স্বপ্নের থেকে স্বপ্নকে নিলে স্বপ্নই থাকে বাকি।
*
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি
আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমনই ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।