জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথা
এক দেশে একজন সওদাগর আর একজন বেনে বাস করত। সওদাগরের সাত ছেলে, মেয়ে একটিও হয়নি; বেনের সাত মেয়ে, ছেলে হয়নি। ‘একদিন মা মঙ্গলচন্ডী বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশধরে ছলতে গেলেন। আগে গেলেন বেনের বাড়ি; গিয়ে বললেন, ‘ওমা! দুটি ভিক্ষা দাও গো।’ বেনেবউ তাড়াতাড়ি ভিক্ষা নিয়ে এল। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তোমার কটি ছেলে, ক-টি মেয়ে মা?’ ‘আমার সাতটি মেয়ে, ছেলে হয়নি বাছা!’ ‘ছেলে হয়নি! আমি ছেলে-আঁটকুড়ার মুখ দেখি না, মেয়ে-আঁটকুড়ার ভিক্ষা লই না।’ এই বলে ব্রাহ্মণী যেমনি চলে যাবে, অমনি বেনেবউ পায়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণী একটি ফুল দিয়ে বললেন, ‘এইটে ধুয়ে খেলে তোমার ছেলে হবে, তার নাম রেখো জয়দেব।’ এই বলে সেখান থেকে সওদাগরের বাড়ি চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে বললেন, ‘ওমা! দুটি ভিক্ষা দাও গো।’ সওদাগরের বউ সোনার থালে সিধে সাজিয়ে দিতে গেলেন। তাকেও ব্রাহ্মণী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ছেলে-মেয়ে ক-টি বাছা?’ তিনি বললেন, ‘আমার ষেটের সাতটি ছেলে, মেয়ে হয়নি।’ মা মঙ্গলচন্ডী বললেন, ‘বাছা, আমি ছেলে-আঁটকুড়ার মুখ দেখি না, মেয়ে-আঁটকুড়ার দান লই না। তা বাছা, এই ফুলটি রেখে দাও, ধুয়ে জল খেও। তাহলে তোমার একটি মেয়ে হবে, তার নাম রেখো জয়াবতী।’ এই কথা বলে তিনি অন্তর্ধান হলেন। তারা সেই ফুল ধুয়ে খেতে দুজনেই অন্তঃসত্ত্বা হল। সওদাগরের মেয়ে হল, বেনের ছেলে হল। ছেলের নাম হল জয়দেব, মেয়ের নাম হল জয়াবতী। দুজনে দিন দিন বড়ো হতে লাগল। জয়াবতী ফুল তোলে, পুজো করে, মঙ্গলবার করে—কথা শোনে। একদিন জয়দেব বললে, ‘মা! আমি জয়াবতীকে বিয়ে করব।’ মা বললেন, ‘সে কি বাবা! তুমি গরিবের ছেলে—বড়ো মানুষের মেয়ে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেবে কেন?’ তারপর মা মঙ্গলচন্ডী একদিন সওদাগরের বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘ওগো বাছা! তোমাদের মেয়েটি বড়ো হয়েছে, বিয়ের কী করছ? আমার কথা শোনো, অমুক বেনের ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দাও, নইলে মেয়ে বাঁচবে না।’ এই বলে মা মঙ্গলচন্ডী অন্তর্ধান হলেন। সওদাগর ভয়ে আকুল হয়ে, সেই পাত্রে জয়াবতীর বিয়ে দিলেন।
সোনা, দানা, হার, বাউটি দিয়ে, হাওদা বেঁধে হাতিতে বর-কনে পাঠিয়ে দিলেন। পথে যেতে যেতে জয়াবতীর মনে পড়ল আজ মঙ্গলবার। তখন জয়াবতী গুনগুন করে কথা বলতে লাগল। জয়দেব বললে, ‘ও-কি জয়াবতী? কী গুনগুন করছ, বিড় বিড় করে বকছ কেন?’ জয়াবতী বললে, ‘গুণগান কিছুই করিনি, আজ মঙ্গলবার, তাই মা মঙ্গলচন্ডীর কথা শুনছি।’ জয়দেব বললে, ‘মঙ্গলবার করলে কী হয়?’ জয়াবতী বললে, ‘হারালে পায়, স্বামী-পুত্র জলে ডোবে না, আগুনে পোড়ে না, মরলে বাঁচে?’ খানিক পথে গিয়ে জয়দেব বললে, ‘জয়াবতী! এখানে বড়ো ডাকাতের ভয়! ওই যে নদী দেখছ, ওইখান থেকে ডাকাতরা এসে সব লুটপাট করে নিয়ে যায়; তোমার গায়ের সব গয়না আমায় খুলে দাও।’ জয়দেব গয়না কাপড় খুলে নিয়ে একটি পুঁটুলি করে ঝপাং করে জলে ফেলে দিলে। জয়াবতী চুপ করে রইল, কিছু বললে না; বর-কনে ঘরে গেল। জয়দেবের মা আর সাত বোন বরণ করে বর-কনে ঘরে তুললে। পাড়ার সব মেয়েরা বউ দেখতে এল। যে দেখে সেই নিন্দে করে, বলে, ‘ওমা! বড়ো মানুষের মেয়ে-যে গো? গায়ে একটু রাঙরত্তি দেয়নি। একখানি ভালো কাপড় পর্যন্ত দেয়নি।’ বেনেগিন্নি বললে, ‘চুপ করো বোন, কিছু বোলো না, আমার যেমন বরাত!’
আজ বউভাত হবে, মা মঙ্গলচন্ডী দেশের সবমাছ হরণ করলেন, কোথাও মাছ পাওয়া গেল না। সাতখানা গাঁয়ের বেনে কুটুম খেতে বলা হয়েছে; কী হবে? নদীতে জাল ফেলে একটা প্রকান্ড রাঘব বোয়াল পাওয়া গেল। সে মাছ কেউ কুটতে পারলে না। কুড়ুল ভেঙে গেল, তবু মাছ কেউ কুটতে পারলে না। জয়দেব বললে, ‘মা! জয়াবতীকে মাছ কুটতে দাও।’ জয়দেবের মা বললে, ‘তুই কি ক্ষেপেছিস? ও ছেলেমানুষ, ও কি মাছ কুটতে পারে?’ ‘হাঁ পারবে’ বলে জয়দেব বঁটি এগিয়ে দিলে। জয়াবতী ঘোমটা দিয়ে, মা মঙ্গলচন্ডীর নাম স্মরণ করে, যেমন মাছটি তুলে বঁটিতে লাগিয়েছে, অমনি মাছটি দু-খান হয়ে গেল। মাছের পেটের ভেতর থেকে জয়াবতীর সেই গয়নার পুঁটুলি, জয়াবতীর কোলের কাছে পড়ে গেল। জয়াবতী মাছ ফেলে রেখে পুঁটুলিটি নিয়ে চলে গেল। খানিক পরে ভালো কাপড় পরে, সঙ্গে হিরা-জড়োয়ার গয়না পরে, ঝম ঝম করে বাইরে এসে মাছ কুটতে বসল। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইল, জয়দেব হাসতে লাগল। তারপর সকলে ভেবে অস্থির, এত লোকের রান্না কে রাঁধবে? জয়দেব বললে, ‘কেন, জয়াবতী রাঁধবে।’ জয়াবতী মাথা নেড়ে স্বীকার করলে, মা মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করে, রান্নাঘরে যেতেই এক দন্ডের মধ্যে পাঁচশো লোকের রান্না হয়ে গেল। লোকজন সব খেয়ে বলতে লাগল—‘এমন খাওয়া আমরা কখনো খাইনি। কী চমৎকার রান্না।’—বলে ধন্যি ধন্যি করে চলে গেল। কিছুদিন পরে জয়াবতীর একটি ছেলে হল। নাতির মুখ দেখে জয়াবতীর শ্বশুর-শাশুড়ি স্বর্গে গেলেন। জয়াবতী ছেলেটিকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে কাজকর্ম করছে, এমন সময় জয়দেব ছেলেটিকে তুলে নিয়ে কুমোরদের পনের মধ্যে গুঁজে রেখে এল। তারা যতই পনে আগুন দেয়, ততই নিবে যায়। কুমোরদের গিন্নি গিয়ে দেখে, জয়াবতীর ছেলে পনের ভেতর শুয়ে খেলা করছে। সে তখন তাড়াতাড়ি ছেলে নিয়ে জয়াবতীকে দিয়ে এল। আর একদিন জয়দেব ছেলেটিকে নিয়ে নদীর জলে ফেলে দিয়ে এল। জয়াবতী যেমন জল আনতে গেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উঠে এল। জয়দেব দেখে আশ্চর্য হল, কিন্তু ভ্রম গেল না। তারপর জয়াবতীর আর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হল। একদিন জয়াবতীর ছোটো ছেলেটি দোতালায় শুয়ে আছে, ছেলে-মেয়ে দুটি সেইখানে খেলা করছে, জয়দেব একখানি কাতান নিয়ে ছোটো ছেলেটির গায়ে কোপ মারছে, কিন্তু ছেলে কাটা যাচ্ছে না। জয়াবতী তাড়াতাড়ি জয়দেবের হাত ধরে বললেন, ‘তুমি ও কী করছ! এতবার এত পরীক্ষা করলে, তবু কী বিশ্বাস হল না! আমি তো বলছি যে, মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় আমার কোনও অমঙ্গল ঘটবে না।’ তখন জয়দেব বললে, ‘তুমি যখন এমন ব্রত জানো, তা হলে আমরা মর্ত্যে থাকি কেন, চল স্বর্গে যাই।’ জয়াবতী বললে, ‘আগে ছেলে-মেয়ের বিয়ে হোক, বউ হোক, জামাই হোক, তারপর স্বর্গে যাব।’ দিন কতক পরে জয়াবতীর ছেলে-মেয়ের বিয়ে হল। মনের সুখে দিন কতক সংসার করে, জয়াবতী বউ-ঝিয়েদের ঘরকন্না বুঝিয়ে দিলে। স্বর্গ থেকে পুষ্পক রথ এল, চুয়া চন্দনের ছড়া পড়তে লাগল, ঝি-বউকে জয় মঙ্গলবারের ব্রত করতে বলে, জয়দেব ও জয়াবতী স্বর্গে চলে গেল। সেই অবধি জয় মঙ্গলবার পৃথিবীতে প্রচার হল।
জ্যৈষ্ঠ মাসের জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথা সমাপ্ত।