জয় পরাজয় – ২০

বিংশ পরিচ্ছেদ –

কুঞ্জ সঙ্গে যন্ত্র আনিয়াছিল। সে কোন কথা না কহিয়া সৰ্ব্বাগ্রে আমার পায়ের শৃঙ্খল কাটিতে লাগিল। শৃঙ্খল কাটিবার যন্ত্রই সে আনিয়াছিল; সুতরাং নিমেষমধ্যে সে শৃঙ্খল কাটিয়া ফেলিল, আমি মুক্ত হইলাম। তখন সে আমার হাত ধরিয়া অনুচ্চকন্ঠে বলিল, “এস, আর এক লহমাও এখানে নয়।”

আমি তাহার সঙ্গে উপরে আসিলাম। বেদিনী চীৎকার করিয়া বলিল, “কুঞ্জ, আমায় খুলে দিয়ে যা—”

আমরা উভয়ে কেহই তাহার কথায় কান দিলাম না। একখানা পালীতে কুঞ্জ আসিয়াছিল, নৌকায় একটিমাত্র লোক ছিল, সে গাধা বোটের দড়ী ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। আমরা উভয়েই লাফাইয়া তাহার নৌকায় পড়িলাম। তৎক্ষণাৎ সে নৌকা ঠেলিয়া দিল।

তবে কি সত্যসত্যই আমি আবার স্বাধীন হইয়াছি? যাহা আশা করিয়াছিলাম, তাহাই হইয়াছে কুঞ্জই আমাকে উদ্ধার করিয়াছে। আমার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। মৃত্যুমুখে পড়িয়া যিনি রক্ষা পাইয়াছেন, তিনিই কেবল আমার সে সময়ের মনের অবস্থা বুঝিতে পারিবেন, অন্য কেহ নহে।

আমি কিয়ৎক্ষণ কোন কথা কহিতে পারিলাম না–কুঞ্জও নীরবে আমার পাশে বসিয়াছিল। আমি সস্নেহে তাহার হাত ধরিয়া বলিলাম, “কুঞ্জ, তুমি আর একবার আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলে, আজও করিলে, কি দিয়া তোমার ঋণ পরিশোধ করিব?”

কুঞ্জ কেবলমাত্র বলিল, “এখনও আমরা নিরাপদ নই।”

আমি সোৎসাহে বলিলাম, “আর ভয় নাই — যখন আমি খোলা পাইয়াছি, তখন দু-দশটায় আমার কিছু করিতে পারিবে না।”

কুঞ্জ কথা কহিল না, সে ব্যকুলভাবে বারংবার তটের দিকে চাহিতে লাগিল; আমি বুঝিলাম, যতক্ষণ আমরা তীরে না পৌঁছিতেছি, ততক্ষণ সে নিরাপদ মনে করিতেছে না। আমি দেখিলাম, আমি যে গাধাবোটের ভিতরে আবদ্ধ ছিলাম, তাহা খিদিরপুরের ঘাটের নিকটে নঙ্গর করা ছিল, আমাদের নৌকাও খিদিরপুরের ঘাটের দিকে যাইতেছিল। সে সময়ে খিদিরপুরের ঘাটে এখনকার মত অনেক জাহাজ লাগিত। ইহাদের মধ্যে অনেকগুলিই আরব দেশের লাখোদার জাহাজ।

সেগুলি দেখিয়া আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল; ভাবিলাম, “কুঞ্জ আসিয়া আমাকে উদ্ধার না করিলে আমাকে এই সকল জাহাজের মধ্যে কোনখানায় আরবদেশে যাইতে হইত। হয়ত ইহ-জীবনে আর কখনও ফিরিতে পারিতাম না।”

নৌকা আসিয়া ঘাটে লাগিল। কুঞ্জ মাঝিকে ভাড়া দিল; ঘাটের উপরেই একখানা গাড়ী দাঁড়াইয়াছিল; কুঞ্জ আমাকে লইয়া সেই গাড়ীতে উঠিল। সে এই গাড়ীতেই কলিকাতা হইতে আসিয়াছিল।

গাড়ী চলিল। কুঞ্জ একটা আশ্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “আর তাহারা কিছু করিতে পারিবে না।”

আমি বলিলাম, “আমি জানিতাম, তুমি খবর পাইলে নিশ্চয়ই আসিবে, তবে সে ছোঁড়াটা যে তোমাকে চিঠী দিবে, এ আশা আমার ছিল না।”

“হাঁ, সে আমাকে চিঠী দিয়াছিল, তাহাকে আমি দশটাকা দিব, বলিয়াছি।”

“আমি বাড়ী গিয়াই তোমাকে টাকা দিব।”

“তাড়াতাড়ি নাই।”

“সে তোমাকে আমার যাহা যাহা হইয়াছিল, সব বলিয়াছিল?”

“নিজে ইচ্ছা করিয়া কিছু বলে নাই। আমি তাহাকে নানা রকমে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইয়াছিলাম।”

“গাধাবোটখানা কোথায় ছিল, তাহাও অবশ্য সে বলিয়াছিল—কিন্তু সে যেদিন চলিয়া যায়, সেইদিনই এরা নৌকাখানা খুলিয়া খিদিরপুরে আনে—আমি ভাবিয়াছিলাম যে, হয় ত তুমি বোট খুঁজিয়া পাইবে না।”

“খিদিরপুরে যে বোট আসিবে, তাহা সে জানিত তাহাই আমি কলিকাতায় আসিয়াই এই গাড়ীখানা ভাড়া করিয়া একেবারে খিদিরপুরে আসিয়াছিলাম। বোটখানা কি রকম তাহাও তাহার কাছে জানিয়া লইয়াছিলাম, সেজন্য আর খুঁজিতে কষ্ট হয় নাই।”

“আমাকে ইহারা আরবী জাহাজে আরবদেশে পাঠাইতেছিল, তাহাও সে নিশ্চয় তোমায় বলিয়াছে।” কুঞ্জ বিস্মিত হইয়া বলিল, “না, এ কথা সে জানে না, কেন তোমাকে আট্‌কাইয়া রাখিয়াছে, তাহাও সে জানে না।”

আমি বলিলাম, “হাঁ লোচন ও ভিকরাজ দুইজনেই আমার সঙ্গে দেখা করিয়াছিল। তাহাদের মতলব ছিল, আমাকে আরবদেশে চালান করিয়া দিয়া মনের সুখে ডাকাতি চালাইবে।”

“তাহা আর হইতেছে না!”

“এখন ইহারা জানিবে যে, তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়াছ; তুমি এবার তাহাদের মধ্যে গেলে বিপদে পড়িবে। অমূল্যবাবুর বাড়ী দিনকতক থাক, তারপর—“

কুঞ্জ বিষণ্ণ হাস্যের সহিত নিজ বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একখানা শাণিত ছুরিকা বাহির করিল; বলিল “আমি বেদিনী, আমাকে উৎপীড়ন করা লোচনের কাজ নয়।”

আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “তুমি ত বেদিনী নও।”

কুঞ্জ সেইরূপ ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, “এখন বেদিনী—বেদিনী না হইলে তোমাকে উদ্ধার করিতে পারিতাম না।”

আমি ব্যাকুলভাবে বলিলাম, “আমি তোমাকে কিছুতেই তাহাদের মধ্যে যাইতে দিব না।” কুঞ্জ অতি গম্ভীরভাবে বলিল, “আমার জন্য ভয় নাই, আমার কেহ কিছু করিতে পারিবে না, আমি এখন আমাদের দলপতি—লোচন পলাইয়াছে।”

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “পলাইয়াছে, কেন?”

“সে আজ দশদিন নিরুদ্দেশ হইয়াছে। যদিও ফিরিত, আর ফিরিবে না।”

“কেন?”

“তুমি তাহাদের হাত হইতে উদ্ধার হইয়াছ, পুলিসে খবর দিয়াছ, আর কোন্ সাহসে সে আসিবে? ভিকরাজ ও লোচন দুইজনেই এ দেশ ছাড়িয়া পলাইবে।”

গাড়ী অমূল্যের দ্বারে লাগিল। আমি নামিলাম—কিন্তু ফিরিয়া দেখি, কুঞ্জ গাড়ীর অন্য দরজা দিয়া কখন্ বাহির হইয়া অন্ধকারে অন্তর্হিত হইয়াছে।

একবিংশ পরিচ্ছেদ

প্রায় রাত্রি বারটার সময়ে আমি অমূল্যের বাড়ীতে পৌঁছিলাম। কুঞ্জ এইরূপভাবে চলিয়া যাওয়ায় আমার প্রাণে আঘাত লাগিল। কিন্তু কি করিব, উপায় নাই, তাহার জন্য ভয় ও ভাবনা হইল। আমি জানিতাম, বেদের দলে সে আর নিরাপদ নহে—লোচন ও ভিকরাজ উভয়েই তাহাকে জব্দ করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিবে। যাহাতে তাহারা তার কোন অনিষ্ট করিতে না পারে, আমি প্রাতে উঠিয়াই তাহার বন্দোবস্ত করিবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলাম।

আমার গাড়ী আসিবার শব্দ শুনিয়া দুই ব্যক্তি অমূল্যের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া আসিলেন — আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া দেখিলাম অমূল্য ও ফতে আলি।

অমূল্য আমাকে দেখিয়া ছুটিয়া আসিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “কি লোক বাপু তুমি! তোমার জন্য আমাদের কাহারও আহার নিদ্রা নাই। দারোগা সাহেব আর আমি এই তোমার সন্ধান থেকে ফিরিয়া আসিতেছি।”

ফতে আলি বলিলেন, “তুমি অনেক কষ্ট দিয়াছ।”

আমি বলিলাম, “ইচ্ছা করিয়া দিই নাই—আসুন, সকলই শুনিবেন।”

আমরা সকলে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম, আমার যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, সমস্তই বলিলাম। শুনিয়া দারোগা সাহেব বলিলেন, “গাধাবোটে আটক করিয়া রাখিয়াছিল, কাজেই আমরা কোন সন্ধান পাই নাই—বরাহনগরের গলি পর্যন্ত সন্ধান পাইয়াছিলাম।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিরূপে?”

দারোগা সাহেব হাসিয়া বলিলেন, “ভায়া হে, গোয়েন্দাগিরি বড় কঠিন ব্যাপার, তুমি যে গাড়ীখানায় ছিলে, সেই গাড়ীর কোম্যানকে বাহির করিয়াছিলাম। সে বলিল, ‘এই গলির ভিতরে বাবু, ছোক্রার সঙ্গে নেমে গেছেন। আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি সকাল পৰ্য্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম; কিন্তু তিনি আর ফিরেন নাই।’ এ সন্ধান ফতে আলি দারোগা ভিন্ন আর কেহ করিতে পারিত না।”

অমূল্য বলিল, “কুঞ্জ তোমার উদ্ধারে না গেলে কি যে হইত, বলা যায় না।”

দারোগাসাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে অমর বাবুকে নিশ্চয় মক্কা দেখিতে হইত—বড় মন্দ হইত না!”

অমূল্য। দারোগা সাহেব, কালই এই দু-বেটাকে গ্রেপ্তার করুন।

দারোগা। শক্ত—দু-বেটাই নিরুদ্দেশ।

আমি। দারোগা সাহেবকে আমি আগেই বলিয়াছি—এখনও বলি, অমার জন্য এই দু’জনকে ধরিলে ইহাদের দল ধরা যাইবে না। আমাদের অপেক্ষা করিতে হইবে। এইবার ইহারা অন্ততঃ একবার শেষ ডাকাতি করিবে—তাহা হইলে তখন যাহাতে সমস্ত দলটা ধরা যায়, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। বিশেষতঃ যে ডাকাতি করে, সে-ই সর্দ্দার—তাহাকেই ধরা আগে দরকার।

দারোগা সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, “এ কথা ঠিক।”

অমূল্য। এ লোকটা কে?

ফতে। কোন্ লোকটা?

অমূল্য। যে এই ডাকাতি করে।

ফতে। নিশ্চয় আগে ফৌজে ঘোড়সওয়ার ছিল।

অমূল্য। সে যে ভদ্রসমাজে ঘুরে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, নতুবা সেদিন নীলরতন বাবুর বাড়ীতে নাচের মজলিসে সে যাইতে পারিত না।

ফতে। ধরা পড়িলেই জানা যাইবে।

আমি দারোগা সাহেবের কথায় মনে মনে হাসিলাম। বলিলাম, “ভিকরাজ কি আর তাহার দোকানে নাই?”

ফতে। না, লম্বা দিয়াছে; দোকান পাঠ তুলিয়া দিয়া কোথায় পলাইয়াছে। আমি গিয়া দেখি, সে বাড়ী খালি পড়িয়া আছে।

আমি। লোচনের সন্ধান লইয়াছিলেন?

ফতে। হাঁ, তাহাদের দল চন্দননগরের মাঠে ডেরা ফেলিয়াছে। সে দলে লোচন নাই। কয়েকদিন সে কোথায় গিয়াছে কেহ কিছুই বলিতে পারে না।

আমি। তাহারা এ দেশ ছাড়িয়া যায় নাই, নিশ্চয়ই এইখানে কোনখানে লুকাইয়া আছে।

ফতে। সম্ভব, তবে আর ডাকাতি করে কি না বলা যায় না।

অমূল্য বলিল, “তবে অমর, তোমার মতে এখন অপেক্ষা করাই উচিত।”

আমি বলিলাম, “বরাবরই আমার এই মত।”

অমূল্য। যাহা হউক্, তোমার কুঞ্জকে প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না দুই-দুইবার তোমার প্রাণ বাঁচাইল।

আমি। সে না থাকিলে আমি প্রথমবারেই প্রাণ হারাইতাম

ফতে। মেয়েটা খুব শক্ত আছে, পুলিসে কাজ করিতে চাহে ত, আমি লইতে পারি।

ফতে আলি কুঞ্জ-সম্বন্ধে এরূপ কথা বলায় আমি রাগত হইলাম; কিন্তু কোন কথা কহিলাম না। অমূল্য বলিল, “আমার বিবাহের পূর্ব্বে হইলে আমি ইহাকেই বিবাহ করিতাম।”

ফতে আলি হাসিয়া বলিলেন, “এখন দেখুন, আমাদের শাস্ত্র কেমন? আপনারা বেদের মেয়ে বে করতে পারেন না, জাত যাবে—আমাদের কেমন বন্দোবস্ত দেখুন, নিজের ধর্ম্মের সকলকে ইচ্ছামত বে করতে পারি—আবার ইচ্ছা হইল, তাল্লাক দিলাম।”

দারোগা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। মনে মনে ভাবিলেন, না জানি কি রসিকতা হইল। আমি অনেক কষ্টে ক্রোধ ও হাস্য সম্বরণ করিলাম।

দারোগা সাহেব হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “অমর বাবু বড় মুস্কিলে পড়িবেন।”

অমূল্য ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”

“এই কুঞ্জকে লইয়া।”

“কেন, কি হইয়াছে?”

আমি নীরব।

ফতে আলি বলিলেন, “বেদে হইয়াই যত গোল, বে করা মুস্কিল।”

আবার উচ্চহাস্য। শেষে দারোগা প্রভু রহস্যটা খুলিয়া বলিলেন, “অমূল্য বাবু, দেখিতেছ না, আমাদের অমর বাবু কুঞ্জকে ভালবাসে।”

এই সময়ে একজন পাহারাওয়ালা হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল, “হুজুর, ডাকাতি— হাবড়ার মাঠে—ঘোড়সওয়ার ডাকাত।”

আমারা এই কথা শুনিয়া তিনজনেই স্তম্ভিত হইলাম। সত্যসত্যই তাহা হইলে আবার ডাকাতি হইয়াছে।

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

শেষেরটা লইয়া এইরূপ ছয়টি ডাকাতি হইল, ডাকাত যে ক্রমে দিন দিন অধিকতর সাহসী হইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। নতুবা সে সাহস করিয়া কলিকাতার নিকটে হাবড়ার মাঠে এরূপ ডাকাতি করিতে পারিত না।

এবারও সেইরূপ ব্যাপার; আন্দুলের জমিদার অনেক টাকার জহরত লইয়া কলিকাতা হইতে আন্দুল যাইতেছিলেন। আহারাদির পর কলিকাতা হইতে রওনা হন। প্রায় বারটা রাত্রে পাল্কী হাবড়ার মাঠের উপর দিয়া যাইতেছিল, এমন সময়ে একটা বড়: কালো ঘোড়ায় চড়িয়া এক ব্যক্তি পাল্কী আটক করে; তাহার মুখে মুখস ছিল, হাতে পিস্তল। ভয়ে জমিদার বাবু বাক্সশুদ্ধ সমস্ত জহরত তাহাকে দিয়া নিজের প্রাণরক্ষা করেন। তখন অশ্বারোহী অশ্ব ছুটাইয়া কোন্‌দিকে চলিয়া যায়—আর কেহ তাহাকে দেখিতে পায় নাই।

সে চলিয়া যাইবামাত্র জমিদার মহাশয় হাবড়ার থানায় সংবাদ দেন; তাহারা আবার কলিকাতার পুলিসে খবর দেয়; কলিকাতার পুলিস খবর পাইবামাত্র ফতে আলি দারোগাকে সংবাদ পাঠায়।

আমরা আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া হাবড়ার দিকে ছুটিলাম। অমূল্যও আমাদের সঙ্গে যাইতে চাহিল, কিন্তু ফতে আলি বলিলেন, “অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট অমর বাবু একা গেলেই চলিবে।”

অগত্যা অমূল্যও বাড়ীতে থাকিতে বাধ্য হইল।

আমরা দুইজনে এই ডাকাতির আলোচনা করিতে করিতে চলিলাম। ফতে আলি বিরক্তভাবে বলিলেন, “যখন আমরা গিয়া পৌঁছিব, তখন ডাকাত তাহার ঘোড়ায় চড়িয়া বিশ ক্রোশ দূরে গিয়া পড়িবে।”

“খুব সম্ভব, তবে তাহাকে ধরিতে না পরিলেও সম্ভবতঃ এবার আমরা ভিকরাজকে ধরিতে পারিব।”

“কি রকমে? আমার মাথায় ত কিছুই আসিতেছে না।”

“তাহারা এবারও তাহাদের নিয়মমত কাজ করিবে। ডাকাত ডাকাতি করিয়া জহরত কোনখানে পুতিয়া রাখিয়া যাইবে। তাহার পর কোনখানে গিয়া কোন সঙ্কেত লিখিয়া রাখিয়া যাইবে।”

“এবার আর ঘটীর নীচে লিখিতেছে না।

“সম্ভব, একটা নূতন মতলব বাহির করিয়াছে। যাহা হউক, এটাও স্থির, আর প্রত্যেকবারেই এরূপ করিয়াছে ডাকাত জহরত কোন স্থানে নিকটেই পুতিয়া রাখিয়া গিয়াছে। সে যে ঘোড়ায় চড়িয়া অনেক দূর যায় না, তাহা নিশ্চয়, না হইলে এতদিনে কেহ-না-কেহ তাহাকে দেখিতে পাইত; সে ডাকাতি করিয়া একটু দূরে গিয়াই ঘোড়া ছাড়িয়া দেয়। তাহার পর জহরত পুতিয়া রাখিয়া ভদ্রলোক হইয়া চলিয়া যায়।”

“এ কথা ঠিক।”

“তাহা হইলে নিশ্চয় ভিকরাজ সেই জহরত লইতে আসিবে।”

“সে যে আর এতটা সাহস করে এমন বোধ হইতেছে না।”

“সে না আসে, অন্য কেহও আসিতে পারে। কি এবার সে ছদ্মবেশেও আসিতে পারে।”

“এখন তবে কি পরামর্শ?”

হাবড়ার মাঠের চারিদিকে পাহারা রাখিতে হইবে।

“সেটা কি সহজ মাঠ—বালির খাল পর্য্যন্ত।”

“যতই হউক, চারিদিকে সব রাস্তায় লোক রাখিতে হইবে।”

“তাহা যেন রাখা গেল, কিন্তু কিছু যে হইয়া উঠে বলিয়া বোধ হয় না।”

“হতাশ হইবেন না—এবার নিশ্চয়ই আমরা ধরিব। অন্ততঃ ঘোড়াটা যে কাছেই কোনখানে আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”

“ঘোড়াটা কোথায় সংগ্রহ করে, সেটাও একটা কথা।”

“আমার বিশ্বাস, ঘোড়া লোচন যোগায়। আমি তাহাদের ডেরায় মুর্শিদাবাদে দেখিয়াছিলাম যে, লোচনের একটা খুব ভাল বড় সাদা ঘোড়া ছিল।”

“ডাকাত আসে কালো ঘোড়ায়।”

“কোন রকম রং দিয়ে সাদা ঘোড়া কাল করা শক্ত নয়।”

“এ কথাও ঠিক—আমার আর একটা কথা বড় গোলমেলে বলিয়া বোধ হইতেছে।”

“কি বলুন।”

“ভিকরাজ গহনা থেকে জহরতগুলা খুলিয়া লইয়া যায় কেন? গহনা শুদ্ধ লইয়া যাইতে পারে।”

“গহনাশুদ্ধ লইয়া গেলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা আছে—কিন্তু সে যে ভাবে লইয়া যায়, তাহাতে ধরা পড়িবার কোন সম্ভাবনা নাই।”

“কেন?”

“তাহার দোকানে গিয়া সে কথা প্রথমে আমার মনে হয়। তাহার দোকানে একগাছা মোটা লাঠী ছিল; বোধ হয়, আপনি তত লক্ষ্য করেন নাই।”

“দেখি না, অতনাই।”

“আমার বিশ্বাস, এই লাঠীটা ফাঁপা। ঐ লাঠীর ভিতরে জহরতগুলা পুরিয়া নির্বিঘ্নে লইয়া আসে।”

“তোমার খুব বুদ্ধি আছে, কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ পাগ্‌লামীর কথা, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“কিন্তু আপনি পরে দেখিবেন যে, আমার কথাই ঠিক হইবে।”

“তাহা হইলে ভিকরাজ আসিবে।”

“নিশ্চয় আসিবে।”

এইরূপ কথা কহিতে কহিতে আমরা হাবড়ার থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তথা হইতে লোকজন লইয়া হাবড়ার মাঠের দিকে চলিলাম।

আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন হাবড়া সহর হয় নাই, গঙ্গার ধারে লোকের বসতি ছিল—তাহার পর বিস্তৃত মাঠ, যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবলই মাঠ—লোকালয়ের সম্পর্ক নাই। মাঠের ভিতর দিয়া একটা পথ বরাবর আন্দুলের দিকে গিয়াছে; একটা উত্তর দিকে চলিয়া গিয়াছে। মাঠের মাঝে একটা বড় বটগাছ; এই গাছের নীচে ডাকাতি হইয়াছে; কিন্তু যখন আমরা সেখানে পৌঁছিলাম তখন মাঠের মধ্যে কোন দিকে কেহ নাই।

আমরা মাঠের চারিদিকে পাহারায় লোক রাখিলাম। তাহারা খানা, ডোবা, ঝোপের মধ্যে লুকাইয়া রহিল। এ সকল করিতে সমস্ত রাত্রিটি কাটিয়া গেল; প্রায় ভোরের সময়ে আমি ও ফতে আলি থানায় ফিরিলাম। তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছিলেন; আসিয়াই শুইয়া পড়িলেন। দুই মিনিট যাইতে- না-যাইতে তাঁহার ভীষণ নাসিকা-গৰ্জ্জন আরম্ভ হইল।

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

আমার ঘুম হইল না, কেবল তাঁহার নাসিকা গর্জ্জনের জন্য নহে, আমার মাথাটাও গরম হইয়া গিয়াছিল। মাথায় একটু ঠান্ডা হাওয়া লাগাইবার জন্য আমি বাহিরের রাস্তায় বাহির হইলাম। তখন বেশ ফরসা হইয়াছে — সূর্য্যোদয় হইতেছে।

সহসা পশ্চাতে একখানা পাল্কীর শব্দ শুনিয়া আমি ফিরিয়া দূরে গিয়া দাঁড়াইলাম। পাল্কীখানা আমার পাশ দিয়া চলে গেল; কিন্তু একটু দুরে দাঁড়াইল; পল্কীর দ্বার রুদ্ধ ছিল, তাহাতেই আমি ভাবিলাম যে, কোন স্ত্রীলোক পাল্কীতে যাইতেছেন; কিন্তু পাল্কীখানা সহসা দাঁড়াইল। পরক্ষণে বেহারারা পাল্কী মাটীতে নামাইল দেখিয়া আমি একটু বিস্মিত হইলাম। একজন বেহারা ছুটিয়া আমার নিকটে আসিয়া বলিল, “আপনাকে ডাকিতেছেন।”

আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে?”

বেহারা বলিল, “যিনি পাল্কীতে আছেন।”

আমি অগ্রসর হইলাম; দেখিলাম, আরোহী পাল্কীর দরজা খুলিয়া হাত নাড়িয়া আমাকে ডাকিতেছেন। হাতখানি বলয়সংযুক্ত, সুতরাং যিনি ডাকিতেছেন, তিনি স্ত্রীলোক। হাতখানি যেমন কোমল, সুন্দর ও সুগঠিত, তাহাতে বলয়সংযুক্ত না হইলেও আমি সহজে বুঝিতে পারিতাম, যিনি ডাকিতেছেন তিনি স্ত্রীলোক ও সুন্দরী।

স্ত্রীলোক পাল্কী হইতে আমাকে ডাকিতেছে দেখিয়া আমি আরও আশ্চর্যান্বিত হইলাম। ধীরে ধীরে পাল্কীর নিকটে আসিলাম। আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া দেখিলাম—পাল্কীর ভিতরে মনিয়া বাইজী!

আমি বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি এখানে যে?”

সে তাহার সেই চিরাভ্যস্ত মধুর হাসি হাসিয়া বলিল, “আমরা কোথায় নই? এখন কলিকাতায় আসিয়াছি; কাল আন্দুলে রাজবাড়ী মজরো ছিল। আপনি এখানে কেন? আপনাকে দেখিয়া আমি পাল্কী নামাইলাম।”

কাল যে ডাকাতি হইয়াছে, আমি তাকে সে কথা বলিলাম। বাইজী শুনিয়া শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, “তবে সে ডাকাত এখনও ধরা পড়ে নাই; কি সর্বনাশ; ভাগ্যে আমি রাত্রে আসি নাই, নতুবা আমাকে মারিয়া আমার সমস্ত গহনা কাড়িয়া লইত!”

আমি বলিলাম, “কাল রাত্রে ফিরিলে তাহাই ঘটিত।”

“ভগবান আমাকে রক্ষা করিয়াছেন। তাহা হইলে আপনি এখনও সেই ডাকাতের পিছনে লাগিয়া আছেন?”

“এ ডাকাত ধরিব—প্রতিজ্ঞা করিয়াছি।”

“একদিন আমাদের বাড়ী যাইবেন, আমি বড়বাজারে থাকি। আমার নাম করিলে সকলেই বাড়ী দেখাইয়া দিবে।”

এই বলিয়া সে বেহারাদিগকে পাল্কী উঠাইতে বলিল। পাল্কী উঠিলে সে হাসিয়া বলিল, “দেখিতেছি, আপনিই বাজী হারিলেন।”

“কেন?”

“মনে নাই, আমি নীলরতন বাবুর বাড়ীতে বাজী রাখিয়াছিলাম যে, আপনি এ ডাকাত ধরিতে পারিবেন না।”

“এখনও হার মানি নাই।”

“হারিবেন,” বলিয়া সে হাসিয়া পাল্কীর দরজা বন্ধ করিল। পাল্কী চলিয়া গেল। আমি বেড়াইবার জন্য গঙ্গার দিকে চলিলাম।

রৌদ্র উঠিলে আমি থানার দিকে ফিরিতেছিলাম, এমন সময়ে দেখিলাম, কুঞ্জ ছুটিয়া আমার দিকে আসিতেছে। আমি তাহাকে হঠাৎ এরূপভাবে দেখিয়া বিশেষ বিস্মিত হইলাম; সে নিকটস্থ হইলে বলিলাম, “কুঞ্জ, তুমি এখানে? কি হয়েছে?”

কুঞ্জ বলিল, “আমি আপনার সন্ধানে আসিয়াছি। আমি অমূল্য বাবুর বাড়ীতে গিয়া শুনিলাম, আপনি এখানে আসিয়াছেন।”

“কেন, কি হইয়াছে?”

“কাল এখানে ডাকাতি হইয়াছে।”

“হাঁ, ঠিক সেই রকম ডাকাতি।”

“আমি সেইজন্যই আসিয়াছি। আমি এখন সব জানিয়াছি।”

“কি জানিয়াছ, শীঘ্র বল।”

“ডাকাতি কে করে জানি না তবে লোচন নিজের সাদা ঘোড়াটা রং দিয়া কালো করে তাহাকে কাল রাত্রে চন্দননগরের জঙ্গলে ঘোড়া রং করিতে দেখিয়াছিলাম। ক’দিন থেকে লোচন নিরুদ্দেশ হইয়াছিল। তাহাই রাত্রে তাহার ঘোড়া ডাইনী মাগীকে লইয়া যাইতে দেখিয়া আমি লুকাইয়া তাহার পিছনে পিছনে যাই। সে জঙ্গলের মধ্যে লোচনকে ঘোড়াটা দিয়া ডেরায় ফিরিয়া যায়; আমি সেইখানে লুকাইয়া থাকি; দেখি, লোচন ঘোড়াকে রং মাখাইয়া কাল করিল, তাহার পর ঘোড়াটা লইয়া জঙ্গলের বাহির হইয়া গেল।”

“তবে লোচনই ডাকাতি করে?”

“না, সে ঘোড়াটা কাহাকে দিয়া তখনই আবার ফিরিয়া আসিল।”

“তবে সে এখনও সেই জঙ্গলে লুকাইয়া আছে?”

“না, সেখান থেকে চলিয়া গেলে আমি ডেরায় ফিরিয়া আসি—কাল সমস্ত রাত্রি ঘুমাইতে পারি নাই।”

“তবে ত তোমার ভারি কষ্ট হইয়াছে?”

“না, তারপর সকালে ভিকরাজ আমাদের ডেরায় আসিয়াছিল।”

“তাহাকে ধরাইয়া দাও নাই, কেন?”

“সে ছদ্মবেশে আসিয়াছিল, কেবল আমিই তাহার কপালে দাগ দেখিয়া চিনিয়াছিলাম। সে বুড়ী সাজিয়াছিল।”

“সে কোথায় গেল?”

“সে সেই ডাইনী মাগীর সন্ধানে আসিয়াছিল। কিন্তু সে রাত্রে ডেরায় ছিল না, কোথায় গিয়াছিল; তারপর সে ফিরিয়া আসিলে দুইজনে কথা হইল। আমি তাহাদের কথা শুনিবার জন্য নিকটে লুকাইয়াছিলাম, কিন্তু কিছুই শুনিতে পাইলাম না। কেবল এইটুকু শুনিলাম ভিকরাজ বলিল, “এখন মাঠে যাচ্ছি, রাত্রে―তার পর খবর পাইবে।”

আমি সোৎসাহে বলিলাম, “তবে ঠিক হইয়াছে। নিশ্চয়ই ভিকরাজ বুড়ী সাজিয়া জহরত লইতে আসিবে, আজ আর পলাইতে পারিবে না।”

“কেন, কিরূপে ধরিবেন?”

“তুমি খবর না দিলে ধরা শক্ত হইত, এখন আর কোথায় যায়; বুড়ী দেখিয়া কেহই বোধ হয় সন্দেহ করিত না।”

“এখন আমি চলিলাম, এই খবর দিবার জন্য আসিয়াছিলাম।”

“খুব ভাল করিয়াছ, না হইলে হয় ত আমরা এই বদমাইসকে ধরিতে পারিতাম না।”

“এখন আমি যাই।”

“কুঞ্জ, আবার কবে দেখা হইবে? তোমাকে আমার এই বেদের দলে থাকিতে দিতে ইচ্ছা নাই।”

“ইহারা ধরা পড়িলে দেখা করিব।”

এই বলিয়া কুঞ্জ সত্বরপদে তথা হইতে চলিয়া গেল। আমি ফতে আলিকে সংবাদ দিতে থানার দিকে চলিলাম।

চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

আমার সকল কথা শুনিয়া ফতে আলি বলিলেন, “কুঞ্জকে পুলিসে লইলে উপকার আছে। দুইদিনে সে পাকা গোয়েন্দা হইয়া উঠিতে পারে।”

আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়া বলিলাম, “আমাদের আর দেরী করা কর্ত্তব্য নয়—এখনই রওনা হওয়া উচিত, এখনই চারিদিকে লোক রাখা উচিত।”

ফতে আলি বলিলেন, “এত ব্যস্ত হওয়া কেন হে? সে ত রাত্রে আসিবে।”

আমি বলিলাম, “ঐটি আপনি ভুল করিতেছেন; সে রাত্রে আসিবে না, দিনেই আসিবে— যতক্ষণ তাহার হাবড়ায় পৌঁছিতে দেরী; নৌকায় আসিতেছে, এখন ভাঁটা, সে দুঘন্টার মধ্যেই এখানে পৌঁছিবে।”

“বাপু, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারি না, এই বলিলে সে রাত্রে আসিবে।”

“বুঝিলেন না, চোখে ধুলা দিবার জন্য সে এই কথা বলিয়াছে। নতুবা সব কথা এত চুপি চুপি বলিল যে, কুঞ্জ তাহার কিছুই শুনিতে পাইল না, কেবল এই কথাটাই গলা তুলিয়া বলিল। সে জানিত যে, কুঞ্জ হয় ত তাহাদের কথা শুনিতেছে, তাহাই এইরূপভাবে রাত্রের কথা বলিয়াছিল। তাহা হইলে আমরা জানিব, সে রাত্রে জহরতের জন্য আসিবে, আমরা রাত্রেই তাহাকে ধরিবার চেষ্টা পাইব, সে ইতিমধ্যে দিনের বেলায় আসিয়া কাজ উদ্ধার করিয়া সরিয়া পড়িবে।”

“কথাটা আমার মনে লাগে বটে, তবে বাপু, বোধ হয়, তুমি ভুল বুঝিতেছ।”

“সাবধানে মার নাই, দারোগা সাহেব, সে যদি দিনে না আসে, আবার রাত্রে তাহার পাহারায় থাকা যাইবে। এখন একবার দেখিলে কোন ক্ষতি নাই ত।”

“সে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু শরীরটা ত নিজের, প্রাণটা যে যায়-যায় হইয়া উঠিয়াছে, ক্রমাগত হাই উঠিতেছে।”

“এত বড় ডাকাতি ধরিতে পারিলে প্রশংসা আপনারই হইবে।”

“তাহা ত হইবারই কথা, আমি ভিন্ন এ ডাকাতি ধরে এমন লোক কে আছে?”

আমি মৃদুহাস্য করিয়া বলিলাম, “এ কথা নিশ্চয়ই—পুরস্কারও আপনি পাইবেন।”

ফতে আলি গৰ্ব্বিতমুখে বলিলেন, “বটেও ত, এত বড় ডাকাতি ধরে কে? প্রাণটি হাতে করিয়া ডাকাতের পিছনে ঘুরিতেছি।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “এখন চলুন, দেরী করিবেন না।”

“চল—চল,” বলিয়া ফতে আলি শঙ্কার নল ফেলিয়া উঠিলেন। পুলিসের লোক চারিদিকেই পাহারায় ছিল, আমরা গিয়া তাহাদের আরও সতর্ক থাকিতে বলিয়া উভয়ে একটা ঝোপের মধ্যে লুকাইলাম।

এইরূপে প্রায় দুই ঘন্টা কাটিয়া গেল। ক্রমে ফতে আলি বিরক্ত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। নিজের মনে অস্পষ্টকন্ঠে কত কি বকিতে লাগিলেন, “ঢের ঢের মামলার তদন্ত করিয়াছি, এমন উৎপাতে মালায় আর কখনও পড়ি নাই, মশাতে সৰ্ব্বাঙ্গ খেয়ে ফেলিল।” দুঃসাধ্য হইলেও আমি অতি কষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া রহিলাম; আমি জানিতাম, এ সময়ে কথা কহিলে দারোগাসাহেব একদম মহা গরম হইয়া উঠিবেন।

তিনি বলিতে লাগিলেন, “একবার বেটাকে ধরিতে পারি, তাহা হইলে গোটা কতক জুতাশুদ্ধ লাথী মেরে রাগটা মেটাই, বেটা মাড়োয়ারী——বজ্জাত-বদমাইস, আমাকে এমনই করে ভোগান -পাজী” তাহার পর আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বাপু, অনেক অনেক বদমাইসকে এ বয়সে ধরিলাম, এবার তোমার বুদ্ধি শুনেই এ লাঞ্ছনা হইল—অদৃষ্টে আরও কি আছে, তা আল্লা জানেন্— ওঃ! মশাতে মুখখানা ফুলাইয়া দিল।”

এই সময়ে আমি দেখিলাম, একটি অতি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক লাঠীতে ভর দিয়া মাঠের ভিতরে আসিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, “ঐ—ঐ নিশ্চয়ই ঐ।”

ফতে আলি তাহাকে দেখিয়া বলিলেন, “বাপু, তোমার বুদ্ধি লোপ হইয়াছে। আগে ভাবিয়াছিলাম যে, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, এই জন্যই তোমায় সঙ্গে লইয়াছিলাম, এমন জানিলে তফাৎ হইতাম।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “দারোগা সাহেব, আমি এমন কি অপরাধ করিলাম?”

“অপরাধ? ঐ একশো বছরের থুথুরে বুড়ীটাকে বল কিনা যে, সেই গাট্টাগোট্টা সন্ডা মাড়োয়ারী বদমাইস— ভিকরাজ?”

“আপনি পরে দেখিবেন, কুঞ্জ বলিয়া গিয়াছে, ভিকরাজ বুড়ী সাজিয়াছে। কুঞ্জ না বলিলে আমরা কিছুতেই ইহাকে ভিকরাজ বলিয়া চিনিতে পারিতাম না। কুঞ্জ তাহার চোখ আর কপালের দাগ দেখিয়াই চিনিতে পারিয়াছিল; আসুন, আমরা এই বুড়ীকে একটু ভাল করিয়া দেখি।”

“দেখ—যত ভাল করিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয় দেখ।”

“আপনি যাইবেন না?”

“যখন তোমার মত পাপকে সঙ্গে লইয়াছি, তখন আর কি করি?”

আমি মনে মনে হাসিলাম, আমরা খানা-ডোবার ভিতরে লুকাইয়া লুকাইয়া চলিলাম, বুড়ী আমাদের দেখিতে পাইল না।

বুড়ীটা একবার চারিদিকে চাহিল, মাঠের কোনদিকে কাহাকে না দেখিয়া একটা ছোট গাছের তলায় বসিল; স্পষ্ট বোধ হইল, যেন সে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া বসিয়া পড়িল। তাহার ভাব দেখিয়া আমার মনে হইল ‘যে, হয় ত আমারই ভুল হইয়াছে। যথার্থ এ কোন বুড়ীই হইবে।

আমরা ঐ গাছের নিকটস্থ একটা খানার ভিতরে লুকাইয়াছিলাম। সে আমাদের দেখিতে পায় নাই, কিন্তু আমরা তাহাকে দেখিতে পাইতেছিলাম। দেখিলাম, সে আঁচলখানা সম্মুখে মাটীর উপরে পাতিল, আমি মৃদুস্বরে দারোগাকে বলিলাম, “কাপড়ের নীচে গর্ত খুঁড়িতেছে।”

তিনি বিরক্তভাবে বলিলেন, “না গো না, সে সব নয়, এই দেখ না, বুড়ীটা আঁচল পাতিয়াছে, এইবার শুইয়া বিশ্রাম করিবে।”

আমি কথা কহিলাম না, একদৃষ্টে বৃদ্ধার দিকে চাহিয়া রহিলাম; তখন আমরা দেখিলাম, বৃদ্ধা নিজের লাঠীর মুখটা খুলিয়া ফেলিল, তাহার পর এক এক করিয়া লাঠীর ভিতরে কি ফেলিতে লাগিল। আমি সোৎসাহে ফতে আলিকে বলিয়া উঠিলাম, “এখন কি বলেন?”

তিনি আমার কথায় কান না দিয়া একেবারে লাফাইয়া উঠিলেন; চীৎকার করিয়া বলিলেন, “বাইস, ফতে আলির চোখে ধূলো দেওয়া!”

ফতে আলিকে দেখিয়া বৃদ্ধা সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তখন ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিল। আমরাও প্রাণপণে তাহার পশ্চাতে ছুটিলাম। দারোগা রাসভারি-নিন্দিতস্বরে তাঁহার নিজের লোকজনকে ডাকিতেছেন। তাহারা খানা-ডোবা-ঝোপ হইতে বাহির হইয়া আমাদের সঙ্গে ছুটিল।

আর পলাতকের পলাইবার উপায় নাই। চারিদিক্ হইতে আক্রান্ত হইয়াছে। অনন্যোপায় হইয়া সে ফিরিয়া ফতে আলির ঘাড়ে আসিয়া পড়িল। দুইজনেই ভূপতিত হইল। পরমুহূর্ত্তে আমি গিয়া না পড়িলে হয় ত ভিকরাজ সেইখানেই ফতে আলির লীলা শেষ করিয়া দিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *