জয় পরাজয় – ১৫

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

কুঞ্জ ভীত ও বিস্মিত হইয়া দারোগার মুখের দিকে চাহিল; ফতে আলি বলিলেন, “এই লোচন বদমাইসের দলে আছে—আমরা এই বদমাইসের দল ধরিতে চাই। আমাদের বিশ্বাস, তোমার দ্বারা আমাদের সাহায্য হইবে।”

কুঞ্জ কথা কহিল না। আমি বলিলাম, “কুঞ্জ, আমি জানি, তুমি আমাদের সাহায্য করিবে।” দারোগা বলিলেন, “হাঁ নিশ্চয়, সেইজন্য তোমাকে বেদেদের কাছে থাকিতে বলিতেছি—না হইলে তাহাদের সন্ধান পাওয়া যাইবে না।”

এবার কুঞ্জ কথা কহিল; বলিল, “আমি কিছুই জানি না, আমি কি করিব?”

ফতে। অনেক—এই প্রথম, তুমি ভিকরাজ কাঁইয়াকে চেন?

কুঞ্জ। চিনি, এই কাঁইয়াই মুর্শিদাবাদে আমাদের ডেরায় গিয়াছিল। ফতে। এর সঙ্গে লোচনের কি ভারি ভাব?

কুঞ্জ। মুর্শিদাবাদে ঝগড়া হইয়াছিল।

ফতে। যাহাই হউক, এই মাদুলী চুরি আর অমর বাবুকে হত্যা করিবার চেষ্টা করার জন্য তাহাকে প্রথমে গ্রেপ্তার ত করা যাক্; পরে ডাকাতির বিষয় দেখা যাইবে। তোমার এক সাক্ষ্যেই তাহার দশ বৎসর হইবে।

কুঞ্জ ব্যাকুলভাবে বলিল, “আমি—আমি সাক্ষ্য দিতে পারিব না।”

ফতে। একবার বাছাধন ফতে আলির কবলে পড়িলে পেটের নাড়ীর কথা বলিতে পথ পাইবে না।

আমি বলিলাম, “দারোগাসাহেব, আগেও যেরূপ বলিয়াছিলাম, এখনও সেইরূপ বলি, ব্যস্ত হইয়া এই দলের একজনকে ধরিলে আর সকলে পলাইবে।”

“সে কথা ঠিক, তুমি কি করিতে বল?”

“সন্ধান নিয়ে বেটাদের সকলকে এক সঙ্গে গ্রেপ্তার করিতে হইবে।”

“বেশ কথা, এ মাম্‌লায় তুমি অনেক করিতেছ। মূলসূত্র তুমিই বাহির করিয়াছ, স্বীকার করি; কাজেই তোমার কথামত কাজ করিব।

[কুঞ্জের প্রতি] “এখন তুমি যাইতে পার।”

আমি বলিয়া উঠিলাম, “সে মাদুলী কই?”

দারোগা বলিলেন, “আমার কাছে—যেখানে থাকা উচিত, সেইখানেই আছে—চোরাই মাল।”

“কি মুস্কিল! সেটা ওকে দিন্।”

“কেন? চোরাই মাল যে?”

“হউক চোরাই মাল, দেখিতেছেন না, উনি হার ও মাদুলী ফেরৎ লইয়া না গেলে লোচন সন্দেহ করিবে, আমাদের সব কাজ পণ্ড হইবে। সে জিজ্ঞাসা করিবে, ‘মাদুলী খালাস করিতে পাঠাইলাম, সে মাদুলী কই?’ তখন এ কি জবাব দিবে?”

“কথাটা যুক্তিসঙ্গত বটে

“এ মাদুলী ফিরাইয়া পাইলে ভাবিবে, হয় আমি চিঠী পাই নাই, অথবা আমি এই বেনামী চিঠীর কথা অগ্রাহ্য করিয়া বেনের দোকানে যাই নাই। কুঞ্জও বলিবে, কাহারও সঙ্গে এর দেখা হয় নাই।”

“ঠিক কথা অমর বাবু, এ কথাটা আমার মাথায় আসে নাই।”

আমি মনে মনে বলিলাম, “তোমার মাথা গোময়পূর্ণ, কোথা হইতে আসিবে?” প্রকাশ্যে বলিলাম, “এখন মাদুলীটা ইহাকে দিন।”

ফতে আলি পকেট হইতে মাদুলী বাহির করিয়া কুঞ্জের হাতে দিলেন। সে যাইতে উদ্যত হইলে আমি বলিলাম, “কুঞ্জ তুমি একদিন আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছ; যখন কোন দরকার হইবে, আমায় জানাইয়ো—বল জানাইবে?”

কুঞ্জ নতমুখে “জানাইব”, বলিয়া চলিয়া গেল। ফতে আলিও উঠিলেন। আমার মনটা কেমন খারাপ হইয়া গেল।

আরও চার-পাঁচদিন কাটিয়া গেল একদিন আমি গৃহমধ্যে বসিয়া ঘুঞ্জের কথা ভাবিতেছি, এমন সময়ে অমূল্যের ভৃত্য আসিয়া আমার হাতে একখানি পত্র দিল।

আবার পত্র! আমি সত্বর তাহা খুলিলাম। এবার পত্রখানি বেনামী নহে –কুঞ্জ লিখিয়াছে,—

“অমর বাবু,

লোচন সমস্ত জানিতে পারিয়াছে। আমাকে আঙ্কাইয়া রাখিয়াছে। কি করিবে কিছুই জানি না, আমার সংসারে কেহ নাই। আপনি আমাকে উদ্ধার বা রক্ষা না করিলে আমার কি হইবে জানি না। এই লোকের সঙ্গে আসিলে আমি যেখানে আছি, সে সেখানে লইয়া আসিবে।”

কুঞ্জ।”

আমি পত্রখানি পাঠ করিয়া ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পত্র কে আনিয়াছে?”

সে উত্তর করিল, “একটা ছোঁড়া।”

“তাকে এখানে নিয়ে এস, তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”

“যে আজ্ঞা, আনিতেছি।”

সে চলিয়া গেল, তৎপরে একটা বালককে সেইখানে আনিল। তাহাকে দেখিয়াই আমি চিনিলাম যে, সে বেদে। বোধ হয়, তাহাকে মুর্শিদাবাদে দেখিয়াই থাকিব, মুখ চেনা-চেনা বলিয়া বোধ হইল।

আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ চিঠী তোকে কে দিল?”

“কুঞ্জ।”

“কুঞ্জ কোথায়?”

“তাকে লোচন বরাহনগরে গঙ্গার ধারে একটা বাড়ীতে লুকিয়ে রেখেছে।”

“তবে তুই এই চিঠী কেমন ক’রে পেলি?”

“আমাকে কুঞ্জ ভালবাসে, তাই সে এই চিঠী তোমাকে দিতে ব’লেছিল। সে তোমার বাড়ীর ঠিকানা আমায় ব’লে দিয়েছিল।”

“তাই তুই এসেছিস্। লোচন কোথায়?”

“সে হুগলী গেছে—সেখানে আমাদের ডেরা আছে।”

“তবে তুই এখানে কেন?”

“আমাকে কুঞ্জের কাছে রেখে গেছে।”

“আর কে আছে?”

“এক বজ্জাত বুড়ী আছে।”

“সে কে?”

“আমাদের দলের বেদে।”

“আর কেউ আছে?”

“না, এখন আর কেউ নাই।”

“তবে কুঞ্জ পালাতে পারছে না কেন?”

“সেই বুড়ী মাগীটা তাকে চাবী দিয়ে রেখেছে। তুমি ডাইনী বুড়ীটাকে ধ’রে রেখো, আমি কুঞ্জকে খুলে দিব।”

“কখন্ যাব?”

“রাত্রি না হ’লে কাজ হবে না।”

“তবে তাই, ঠিক সন্ধ্যার পর তুই এখানে আসিস্।”

“তাই আস্ব।”

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

অমূল্য আসিলে আমি কুঞ্জের পত্র তাহাকে দেখাইলাম। সে পত্র দেখিয়া বলিল, “আবার জাল পেতেছে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “তুমি ত সব সময়েই জাল দেখিতেছ।”

“সেবার কি বড় মিথ্যা বলিয়াছিলাম?”

সে জাল আমার জন্য পাতে নাই—কুঞ্জের জন্য।”

“এবার তোমার জন্য।”

“পাগল! যে ছোঁড়া পত্র আনিয়াছিল, তাহাকে আমি অনেক জেরা করিয়াছিলাম। না, এ পত্ৰ নিশ্চয়ই কুঞ্জ লিখিয়াছে।”

“তা হয় ভালই, আমার আজ অন্য কাজ আছে, না হ’লে আমি তোমার সঙ্গে যাইতাম।”

“ভয় নাই, আমার কেহ কিছু করিতে পারিবে না।”

“তবুও আমার পরামর্শ যদি শোন, রিভল্বারটা সঙ্গে লইয়ো।”

আমি হাসিলাম। অমূল্য গম্ভীরমুখে বলিলেন, “ভায়া, যে কাজে লাগিয়াছ, বড় সহজ কাজ নহে—এতে পদে পদে বিপদ আছে।”

আমি আবার হাসিয়া বলিলাম, “আমিও খুব সাবধান আছি।”

“থাকিলেই ভাল”, বলিয়া অমূল্য অন্য কাজে চলিয়া গেল। আমি ব্যগ্রভাবে বালকের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।

প্রায় রাত্রি নয়টার সময়ে সেই ছোক্রা আসিয়া উপস্থিত হইল, বলিল, “পথ ভুলিয়া গিয়াছিলাম; এস, আর দেরি নয়।”

আমিও প্রস্তুত ছিলাম, তাহার সঙ্গে রওনা হইলাম। একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া বরাহনগরে চলিলাম।

একটা ছোট গলির মুখে ছোক্ররা গাড়ী থামাইতে বলিল। গাড়ী থামিলে আমরা উভয়ে নামিলাম সে বলিল, “এই গলির ভিতরে সেই বাড়ী।”

আমি বালকের পিছনে পিছনে চলিলাম। ছোট গলি–কোন আলো নাই– ঘোর অন্ধকার—কিছু দেখা যায় না। আমি বালকের পায়ের শব্দ শুনিয়া চলিতেছিলাম।

সহসা দেখিলাম, আমি গঙ্গার ধারে আসিয়াছি। তখন সহসা আমার মনে সন্দেহ জন্মিল, অমূল্যের কথা মনে হইল, আমি পকেট হইতে নিমেষ মধ্যে পিস্তল বাহির করিয়া বলিলাম, “তুই আমাকে কোথায় এনেছিস্?”

সে আমার কথার কোন উত্তর না দিয়া সবলে আমার পেটে ঢুঁ মারিল; অমনি পশ্চাৎ হইতে কে আমার মুখে কাপড় বাঁধিয়া ফেলিল। শেষে একজন আমার হাত হইতে পিস্তল কাড়িয়া লইল।

আমি চীৎকার করিতে পারিলাম না। আমার মুখ চোখ কাপড়ে সবলে বাঁধিয়া ফেলিয়াছিল; পরে পাঁচ-সাতজনে তখন আমাকে মাটীতে ফেলিয়া হাত-পা বাঁধিয়া ফেলিল। আমি হাত পা ছাড়াইবার অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহা পারিলাম না।

তখন আমি বুঝিলাম, তাহারা ধরাধরি করিয়া আমাকে একখানা নৌকায় তুলিল; তুলিয়াই নৌকা চালাইয়া দিল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত নৌকা চলিল। অনেকক্ষণ পরে নৌকা থামিল; বুঝিলাম, নৌকাখানা আর একখানা বড় নৌকার পাশে লাগিয়াছে।

তখন কয়জনে ধরাধরি করিয়া আমাকে সেই বড় নৌকায় তুলিল, তাহার পর একটা অন্ধকারময় স্থানে ঠেলিয়া দিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

আমি অনুমানে কতকটা বুঝিলাম, এটা একখানা গাধাবোট, এবং অনেক জলে নঙ্গর করা আছে। ইহারা আমাকে গাধাবোটের হালের সম্মুখস্থ ক্ষুদ্র গৃহে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছে; কেবল ইহাই নহে, নঙ্গরের শিলীর একদিক্ দিয়া আমার পা বাঁধিয়া দিয়াছে; সুতরাং এখন আমার হাত পা মুখ খুলিয়া দিলেও আমার পালাইবার উপায় নাই। সুকঠিন লৌহ-শৃঙ্খলে আমাকে বাঁধিয়াছে, সে শৃঙ্খল ছিন্ন করা সহজ নহে।

আমি তখন মনে করিলাম, “অমূল্যের কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিয়া ভাল করি নাই — যথার্থই আমাকে এইরূপে ধরিবার জন্য উহারা জাল পাতিয়াছিল।”

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

প্রায় অৰ্দ্ধ ঘন্টা পড়িয়া রহিলাম, কোনদিকে কোন শব্দ শুনিতে পাইলাম না। আমি আগেই জানিতে পারিয়াছিলাম যে, যাহারা আমাকে ধরিয়া নৌকায় আনিয়াছিল, তাহারা আমাকে এখানে রাখিয়া আবার সেই নৌকায় ফিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। তবে কি এই নৌকায় কেহ নাই। আমি কোথায়—এই নৌকাই বা কোথায়, অমূল্য পুলিসে খবর দিলেও পুলিস কি আমার সন্ধান পাইবে? ইহাদের মতলব কি—ইহারা কি আমাকে খুন করিবে?

এইরূপ নানা চিন্তায় আমার মন অত্যন্ত ব্যকুল হইয়া উঠিল; কিন্তু উপায় নাই, আমি নীরবে পড়িয়া রহিলাম।

অর্দ্ধ ঘন্টা পরে কে আলো লইয়া দরজা খুলিল; আমি বুঝিলাম, সে আলো লইয়া ভিতরে আসিল। আমি উঠিয়া বসিবার চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু পারিলাম না।

সে আলোটা রাখিয়া আমার নিকটে আসিয়া প্রথমে আমার চোখ ও মুখ খুলিয়া দিল। আমি দেখিলাম, একজন বেদিনী—ইহাকে আমি মুর্শিদাবাদে দেখিয়াছিলাম। সে আমার হাত খুলিয়া দিল; আমি কোন কথা বলিলাম না।

হাত খুলিয়া দিলেও আমার পলাইবার উপায় নাই। লোহার শিকলে আমার পা বাঁধা। আমি রুষ্ট হইয়া বলিলাম, “এ সব কি জান, জেলে যাবে?”

দেখিলেই বেশ বুঝিতে পারা যায়, সেই বেদিনী মাগীটার দেহে বল আছে; বয়স হইলেও এখনও সম্মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে নাই, মুখখানা অত্যন্ত কদাকার—সে তার কৃষ্ণমুখে শ্বেত দন্তপাতি বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, “কে পুলিস—পুলিস আমাদের সব করবে—সে সব লোচন বুঝবে।”

“তবে এ সব লোচনের কাজ?”

“সে শীঘ্রই তোমার সঙ্গে দেখা করবে তখন সব জানতে পারবে।”

“কবে সে আসবে?”

“কাল—কাল—বন্ধু, কাল।”

“তোমরা কি মনে করেছ যে, আমি আগে থেকে সাবধান না হ’য়ে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি— এতক্ষণ পুলিস সন্ধান আরম্ভ করেছে।”

“পুলিসের ভয় আমাদের নাই,” বলিয়া বেদিনী মাগী আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া গেল। আমি আবার অন্ধকারের মধ্যে একা হইলাম। কি করি, কিছুই ভাবিয়া পাইলাম না, শুইয়া পড়িলাম।

সমস্ত রাত্রি নিদ্রা হইল না—এ অবস্থায় কাহারই বা নিদ্রা হয়? আমি চোরের ন্যায় বন্দী অবস্থায় রহিয়াছি—পলাইবার উপায় নাই। শিকলটায় হাত দিয়া দেখিলাম, কোন যন্ত্র না হইলে সে শিকল ভাঙ্গিবার কোন উপায় নাই।

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। সেই ঘরের ভিতর হইতেও আমি বুঝিলাম সকাল হইল। কিন্তু কোনদিকে কোন শব্দ না শুনিয়া আমি ইহাই বুঝিলাম যে, নিশ্চয় এ গাধাবোট কোন নিৰ্জ্জন স্থানে বাঁধা আছে; সুতরাং চীৎকার করিলেও কেহই শুনিতে পাইবে না, অথচ অনর্থক ইহাদিগকে উত্তেজিত করা হইবে। এখন বুদ্ধিভ্রংশ হইলে আর উদ্ধারের কোন আশা নাই।

অনেক বেলা হইলে দ্বার খুলিল; যাহা হউক, এবার এই জঘন্য ঘরটার মধ্যে আলো দেখা দিল। সেই দুঃখের মধ্যে আলো দেখিয়া আমার মনে কেমন এক অপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল। দেখিলাম, সেই ছোঁড়া একথালা ভাত লইয়া আসিয়াছে। সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া আমার এ দশা করিয়াছে, তাহাকে দেখিয়া আমি রাগে উন্মত্ত হইলাম। ভাবিলাম, কাছে আসিলেই ইহার মাথাটা নৌকার গায়ে ঠুকিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করিব। কিন্তু পরেই ভাবিলাম, “না, বরং ইহাকে হাত করিবার চেষ্টা করা উচিত, হয় ত ইহার দ্বারা কাজ উদ্ধার হইতে পারে।”

তবে আমি নিজ মনোভাব গোপন করিয়া তাহার দিকে কট্‌ট্ করিয়া চাহিয়া রহিলাম। সে ভয় পাইল; কম্পিতস্বরে বলিল, “লোচন বলে গেছে তোমায় খাবার দিতে ডাইনী বুড়ি রেঁধেছে, খাও।”

আমি বলিলাম, “এদিকে নিয়ে আয়।”

সে ভয়ে বলিল, “মারবে না?”

আমি বলিলাম, “তোকে মেরে কি হবে? আয় নিয়ে, কিছু বলব না।”

সে ধীরে ধীরে ভাতের থালা সম্মুখে রাখিল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

সে দ্বারের নিকট অপেক্ষা করিতেছে দেখিয়া আমি বলিলাম, “তুই যাচ্ছিস না কেন?” সে বলিল, “তুমি খাও কি না, আমি দেখব।”

“কেন?”

লোচন দেখতে বলেছে।”

“খাচ্ছি, তুই এরকম না করলে তোকে দশটা টাকা দিব মনে করেছিলাম।”

“হাঁ, তুমি তা খুব দিতে!”

“নিশ্চয়ই দিতাম—-এখনও একটা কাজ করলে দিই।”

“কি শুনি।”

“যদি আমার একখানা চিঠী নিয়ে যাস্।”

“কোথায় পুলিসে?”

“না, সে ভয় নাই, আমি পুলিসে খবর দিব না। কুঞ্জের কাছে।”

বালক কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিতে লাগিল; তৎপরে বলিল, “লোচন জানতে পারলে আমায় খুন করবে।”

আমি বলিলাম, “যদি দশ টাকা না নিস্, সে তোর মজি।”

বালক আবার কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া, “দশ টাকা দেবে?”

আমি বলিলাম, “আমি কি মিথ্যাকথা বলছি?”

“কবে দেবে—দাও।”

“ও কথায় হচ্ছে না, যদি তুই কুঞ্জের কাছে আমার চিঠী নিয়ে যাস্, আর জবাব নিয়ে আসিস্, তা হ’লে তখনই দশ টাকা দেবো। আমি আগে দিই, আর তুই আমার চিঠীখানা ছুঁড়ে জলে ফেলে দে।”

বালক আবার কি ভাবিল; তৎপরে চিন্তিতমনে বলিল, “কুঞ্জ আমাদের লোক, তকে চিঠী দিলে কোন ক্ষতি হবে না—সে আর কি করবে। সত্যি সত্যি দশ টাকা দেবে ত!”

“না দিই, তার চিঠী আমায় দিস্ না—টাকা পেলে দিস্।”

‘তোমার কাছে কিছু নাই, কেমন ক’রে টাকা পাব?”

“কুঞ্জের কাছে আমার টাকা আছে, সে তোকে দেবে।”

“আচ্ছা, চিঠী দাও; কুঞ্জ যদি বলে যে টাকা দেবে, তা হ’লে তাকে চিঠী দেবোনা হ’লে ছিঁড়ে ফেলে দেবো।”

“বেশ, এ ভালো কথা।”

আমার পকেটে কাগজ পেন্সিল ছিল। আমি কুঞ্জকে লিখিলাম;—

“আমাকে নৌকায় বন্দী করে রাখিয়াছে। বোধ হয়, কোথায় আছি, পত্রবাহক বালক বলিতে পারে।”

সে পত্র লইয়া চলিয়া গেল। আমার প্রাণে একটু আশার সঞ্চার হইল। আমার প্রতি কুঞ্জের টান্ আছে, সে নিশ্চয়ই আমাকে উদ্ধার করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিবে; এই একমাত্র আশা, তা ছাড়া উদ্ধারের আর কোন আশাই দেখি না। আমার হৃদয়ের অবস্থা বর্ণন করিয়া অনর্থক সময় নষ্ট করিব না; যাহা ঘটিয়াছিল তাহাই বলি।

পরদিন দ্বিপ্রহরের সময়ে স্বয়ং লোচন আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি কোন কথা কহিলাম না। আমি যে ভয় পাইয়াছি বা কোনরূপ বিচলিত হইয়াছি, ইহা তাহাকে কোনরূপে বুঝিতে দিতে আমার ইচ্ছা ছিল না। সে আমার সন্মুখে বসিয়া খানিকক্ষণ কোন কথা কহিল না; তৎপরে বলিল, “তুমি খুব চালাক লোক, স্বীকার করি।”

আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম, “তুমি যে একটি প্রকান্ড বদমাইস, তাহাও আমি স্বীকার করি।”

“এ সব কথায় এখন কাজ হবে না।”

“তবে কাজের কথা হোক্‌।”

“এখন তুমি ধরা পড়েছ।”

“আজ—কাল নয়।”

“এখান থেকে শীঘ্র যাওয়া হচ্ছে না।”

“পুলিস এলেই হবে।”

“পুলিস আসবে না—তারা হাজার খুঁজলেও সন্ধান পাবে না।”

“তা দেখা যাবে, এখন তোমরা আমাকে নিয়ে কি করতে চাও?”

“সেটা কাঁইয়া নিজেই বলবে।”

“বটে, সেই বদমাইসটাই তা হ’লে তোমাদের দলপতি?”

“এই রকম ত—”

“আচ্ছা, তোদের যদি ঠিক করতে না পারি, আমার নাম মিথ্যা।”

“আর সে আশা নাই।”

“কেন, আমাকে তোরা খুন করতে চাস্?”

“না, খুন করব না—তবে এমন কিছু হবে, যাতে তুমি আমাদের কাজে ব্যঘাত দিতে পারবে না।”

দেখা যাবে।”

লোচন উঠিল; বলিল, “কাঁইয়া এখনই আসবে– সে এসেই সব বলবে। আমি কেবল দেখতে এলেম, তুমি কেমন আছ।”

আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া বলিলাম, “পাজী– বদমাইস।”

সে বাহির হইয়া গেল। শিকলে টান পড়ায় আমার পায়ে দারুণ আঘাত লাগিল। আমি বসিয়া পড়িলাম।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ –

লোচন চলিয়া গেল। আমি বুঝিলাম, নৌকার উপরে অনেক লোক উঠিয়াছে, তাহাদের পদশব্দ স্পষ্ট শুনিতে লাগিলাম। তার পর নৌকাও নড়িয়া উঠিল, তাহারা নঙ্গর টানিয়া তুলিতে লাগিল; ক্রমে আমি বুঝিলাম, নৌকা চলিয়াছে; ইহারা কোথায় আমাকে লইয়া যাইতেছে, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।

সন্ধ্যার সময়ে নৌকা আবার নঙ্গর করিল। বোধ হয়, সেখান হইতে সকলে অন্য কোন নৌকায় চলিয়া গেল, কারণ আর কাহারও পদশব্দ শুনিতে পাইলাম না। ক্রমে রাত্রি হইল। আমি একাকী অন্ধকারে বসিয়া রহিলাম।

যেটুকু উদ্ধারের আশা হইয়াছিল, তাহা গেল। কুঞ্জ যদিও আমাকে উদ্ধারের চেষ্টা পায়, তাহা হইলেও আমার সন্ধান পাইবে না। বদমাইগণ নৌকা আবার কোথায় আনিয়া নঙ্গর করিল, সে নিশ্চয়ই তাহার কোন সন্ধান পাইবে না। ক্রমে আমার মন বড়ই দমিয়া যাইতে লাগিল।

সন্ধ্যার পর ভিকরাজ আসিল। আমি তাহাকে দেখিবামাত্র ক্রুব্ধভাবে বলিলাম, “এ সব কি? জান না, ইহার জন্য তোমাকে জেলে যাইতে হইবে?”

পাপিষ্ঠ হাসিয়া বলিল, “অমর বাবু, চোখ রাঙাইলে আমি ভয় পাই না। এখন মহাশয় আমার হাতে, মহাশয় আমাদের যে ক্ষতি করিয়াছেন তাহার জন্য কিছু সাজা পাইকে বৈ কি।”

আমি সেইরূপ ক্রুদ্ধভাবে বলিলাম, “আমি তোমাদের কি ক্ষতি করিয়াছি

“মহাশয় কি জানেন না? আপনি ত পুলিসকে আমার দোকানে আনিয়াছিলে, সেইজন্য আমাকে দোকান ছাড়িয়া অন্যত্রে যাইতে হইয়াছে।”

“যে কোন দোষ করে নাই, পুলিসকে তাহার ভয় কি?”

“এখন তোমায় বলিতে কি, তোমার এ দেশের লীলাখেলা শেষ হইয়াছে—তুমি ঘটীর ব্যপার না বাহির করিলে পুলিসের বাবার সাধ্য ছিল না যে, এ ডাকাতির কিছু করে।”

“তাহা হইলে তুমিও এ ডাকাতের দলের একজন।”

“হাঁ, গরীবেরই এটা মতলব সন্দেহ নাই। তবে ডাকাতি করিবার অন্য লোক আছে।”

“কে সে?”

সেটা আপনি না-ই শুনিলেন। আমাদের এ ব্যবসা বন্ধ হইবে না—মহাশয়কে সরাইয়া আবার পূর্ব্বের মত আমরা ব্যবসা চালাইব।”

আমি এখন বুঝিলাম, আমাকে খুন করাই ইহাদের মতলব। কোন নিৰ্জ্জন স্থানে নৌকা লইয়া গিয়া ইহারা আমাকে খুন করিয়া তাহার পর আমার দেহটা জলে ভাসাইয়া দিবে; তবে এখনও আশা ছাড়ি কেন? আমার শরীরে অসীম বল—বেটারা কেহই আমার হাতের নিকট আসিবে না। যতদূর আমি আমার পায়ের শিকল টানিয়া যাইতে পারি, তত দূরের মধ্যে কেহ আসে না; নতুবা অন্ততঃ একটাকেও উত্তম-মধ্যম দিতে পারিতাম। দুই রাত্রি অবিশ্রান্ত শিকলে ঘা মারিয়া মারিয়া অনেকটা জখম করিয়াছি—আর এক রাত্রি সময় পাইলে বোধ হয়, শিকল ভাঙিতে পারিব। একবার পা খোলা পাইলে আমি অনায়াসেই পলাইতে পারিব। হাতাহাতিতে আমাকে দুই-দশটা লোকে কিছুই করিতে পারিবে না। আমি ভিক্রাজের কথার কোন উত্তর না দিয়া এই সকল ভাবিতেছিলাম।

বোধ হয়, ভিকরাজ আমার মনের ভাব বুঝিল; বলিল, “দেখ অমর বাবু, তোমায় আমরা খুন করিব না—তুমি যাহা করিয়াছ, তাহাতে তোমাকে খুন করিলেও দোষ হয় না—তোমাকে আরবদেশে আরবী জাহাজে পাঠাইয়া দিতেছি। তাহারা তোমায় মদিনায় পৌঁছাইয়া দিবে। তাহার পর তুমি যতদিনে পার—দেশে ফিরিয়ো, আমাদের তাহাতে কোন আপত্তি নাই।”

এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে দুরাত্মা চলিয়া গেল। আমি ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া তাহাকে ধরিতে গেলাম, আমার পায়ে গুরুতররূপে আঘাত লাগিল। দুরাত্মাদের বদমাইসী মতলবে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু উপায় নাই — আমি কিছুই করিতে পারিতেছি না; যদি একবার ছাড়া পাই, তবে এই বদমাইসদের দেখিয়া লইব, মনে মনে এইরূপ প্রতিজ্ঞা শতবার করিতে লাগিলাম; কিন্তু কিরূপে যে উদ্ধার হইব, তাহার উপায় কিছুই ভাবিয়া পাইলাম না। ভাবিলাম, যেমন করিয়া হয়, আজ রাত্রে শিকল ভাঙ্গিতেই হইবে।

প্রায় তিনদিন হইল, আমি নিরুদ্দেশ হইয়াছি, নিশ্চয়ই অমূল্য পুলিসে সংবাদ দিয়াছে। ফতে আলি প্রভৃতি সকলেই নিশ্চয়ই আমার অনুসন্ধান করিতেছেন; তিনদিনেও যখন তাঁহারা আমার সন্ধান পাইলেন না, তখন যে আর পাইবেন, এ আশা আমার নাই।

রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইতেছিল। ভাবিলাম, আজ যেমন করিয়া হোক্ বেদিনী মাগীটাকে উত্তম মধ্যম দিব, তাহা হইলেও কতক রাগের শান্তি হইবে। সে প্রত্যহ আমার আহার লইয়া আসিত; সে ছোঁড়াটা সেই পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হইয়াছে; তাহাতে আমার কতক আশা হইয়াছে; আমি ভাবিতেছি যে, নিশ্চয়ই সে আমার চিঠী লইয়া কুঞ্জের কাছে গিয়াছে।

আজ বেদিনী মাগীটাকে ধরিবই ধরিব, মনে করিয়া ঘরের অপর দিকে খুব ঘেঁসিয়া বসিয়া রহিলাম। সে খাবার লইয়া আসিল। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল। সে অন্ধকারে ভাল না দেখিতে পাইয়া ভাবিল, আমি প্রত্যহ যেখানে বসিয়া থাকি, সেখানেই বসিয়া আছি। তাহাই সে পূর্ব্বাপেক্ষা আরও অগ্রবর্ত্তী হইয়া আসিল; অমনি ক্ষিপ্ত সিংহের ন্যায় আমি তাহার উপরে পড়িলাম, সে এই ব্যাপারে স্তম্ভিত হইল, রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “দোহাই তোমায়, আমার প্রাণে মেরো না।”

আমি তাহাকে সেইখানে ফেলিয়া তাহার গলাটা চাপিয়া ধরিলাম। তখন তাহারই কাপড় কাড়িয়া লইয়া তাহাতে তাহার হাত পা কঠিনরূপে বাঁধিলাম। ইহাদের উপরে মায়া-দয়া আমার ছিল না। রাগে তাহার চুল ধরিয়া সবলে তাহার মাথা ঠুকিয়া দিলাম, স্ত্রীলোক বলিয়া মানিলাম না। সে ভয়ে মৃতপ্রায় হইল, একটা কথাও কহিল না।

এই সময়ে আমার বোধ হইল, কে নৌকার উপর দিয়া ছুটিয়া আসিতেছে; পর মুহূর্ত্তেই কে আসিয়া দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইল। বেদিনী তাহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিল, “কুঞ্জ আমায় বাঁচা, দিদি।” যথার্থই কুঞ্জ আসিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া আনন্দে, উৎসাহে, উদ্বেগে আমার কন্ঠরোধ হইয়া গিয়াছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *