জয় পরাজয় – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ

আমি ডিটেক্‌টিভ উপন্যাস লিখিতে বসি নাই। এখন আমার বয়স প্রায় আশী বৎসর হইয়াছে; যে ঘটনার উল্লেখ করিতে যাইতেছি, তখন আমার বয়স পঁচিশ বৎসর। এখনকার মত তখন এ দেশ এমন সুশাসিত হয় নাই; চুরি ডাকাতিটা দৈনন্দিন ব্যাপারের মধ্যে ছিল। আমি একটি অদ্ভুত ডাকাতির বিষয় লিখিতে যাইতেছি; যাঁহার বিশ্বাস হয়, তিনি বিশ্বাস করিবেন, না হয়, তিনি না করিবেন। তবে আমি যাহা বলিতে যাইতেছি, তাহা উপন্যাস নহে, একটি প্রকৃত ঘটনা।

সে সময়ে মুর্শিদাবাদে মহরমের সময়ে বড় ধূম হইত; বাজী বাজানা, নাচ গাওনার সীমা থাকিত না; হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায় জাতিভেদ ভুলিয়া মহরমের আমোদে মত্ত হইতেন।

আমি যে বৎসরের কথা বলিতেছি, সে বৎসরে এই আমোদ-প্রমোদে একটা বড়ই বিঘ্ন ঘটিল। এই সময়ে আমন্ত্রিত হইয়া দূরস্থ অনেক বড়লোক মুর্শিদাবাদে আসিতেন; নাচ বা ভোজের সভায় উপস্থিত হইবেন বলিয়া সকলেই মূল্যবান্ অলঙ্কার-জহরতাদি সঙ্গে লইয়া আসিতেন।

সে সময়ে রেল ছিল না; সুতরাং কেহ পাল্কীতে আসিতেন, কেহ নৌকায় আসিতেন, কেহ ঘোড়ায়, কেহ বা হাতীতে আসিতেন। কিন্তু যে বৎসরের কথা বলিতেছি, সে বৎসর উপর্যুপরি তিন- চারিটি ডাকাতি হইল।

অন্যান্য ডাকাতির ন্যায় এ সেরূপ ডাকাতি নহে। প্রত্যেক ডাকাতিই মুর্শিদাবাদ হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে, পথের কোন নির্জ্জন স্থানে সমাধা হয়। এই ডাকাতিতে ডাকাতের দল নাই, কেবল একজনমাত্র অশ্বারোহী আসিয়া গভীর রাত্রে মুর্শিদাবাদ যাত্রী বড়লোক-পথিকের পাল্কী, ঘোড়া বা হাতী দাঁড় করাইয়া দুই হাতে দুইটা পিস্তল লক্ষ্য করে। তখন প্রাণভয়ে সেই পথিক জহরতাদি সেই অশ্বারোহীকে প্রদান করিতে বাধ্য হয়, আর অশ্বারোহী নিমেষমধ্যে অদৃশ্য হইয়া যায়।

এই ব্যাপার লইয়া মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এক ঘোরতর আন্দোলন চলিয়াছে—সকলের মুখেই সেই এক ডাকাতের কথা; কিন্তু এ পর্য্যন্ত কেহই ডাকাত ধরিতে পারিল না। ডাকাতিও বন্ধ হইল না। এই সময়ে আমি মুর্শিদাবাদে একটী আত্মীয়ের বাড়ীতে ছিলাম। আমাদের মধ্যেও সর্ব্বদা এই ডাকাতি সম্বন্ধে কথাবার্তা হইত। এক মাসের মধ্যে চারিবার এইরূপ ডাকাতি হইয়াছে; প্ৰথম জঙ্গীপুরের জমিদারের, তাহার পর কাদিরের, তাহার পর মালদহের এক জমিদারের; তাহার পর এক সপ্তাহ হইল, কাটোয়ার এক জমিদারের উপর এইরূপ রাহাজানী হইয়াছে। প্রতিবারেই সেই পিস্তল— অশ্বারোহী—সেই নির্জ্জন পথ—এবং সঙ্গের লোকজন কিছু পিছনে পড়িয়াছে।

যখন মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এই ডাকাতির জন্য তোলপাড় হয়, সেই সময়ে নলহাটী হইতে রণেন্দ্রপ্রসাদ নামে এক ধনী যুবক তার আত্মীয়কে পত্র লিখিল যে, তিনি মহরমের আমোদ দেখিবার জন্য দুই একদিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদে পৌঁছিবেন। পাছে ইনি পথেই এই ভয়ানক ডাকাতের হাতে মজা দেখেন ভাবিয়া, আমরা সকলেই বিশেষ চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। আমার আত্মীয় মুর্শিদাবাদের মধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যহ সন্ধ্যার সময়ে তাঁহার বাড়ীতে মুর্শিদাবাদের বহুতর গণ্যমান্য ব্যক্তির আগমন হইত। অদ্যও অনেক লোকের সমাগম হইয়াছিল। আজই আবার রণেন্দ্রপ্রসাদের পৌঁছিবার কথা—সকলেই তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, সকলে উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন, এবং কেবল ডাকাতের বিষয়ই আলোচনা হইতেছিল।

অপরাপর দিন সকলে রাত্রি নয়টা না বাজিতেই নিজ নিজ গৃহে যাইতেন, আজ আর কেহই উঠিতেছেন না; সকলেই বলিতেছিলেন, “দেখি আর একটু—রণেন্দ্র বাবুর এতক্ষণ আসা উচিত ছিল।”

যত রাত্রি হইতে লাগিল, ততই সকলে আরও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতেছিলেন। এই সময়ে নিকটে পাল্কীর শব্দ হইল; সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “এইবার নিশ্চয় তিনি আসিতেছেন।”

“হাঁ, যথার্থই তিনি আসিয়াছেন পাল্কী আমাদের বাড়ীর সম্মুখে লাগিল। ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া রণেন্দ্র বাবু পাল্কী হইতে নামিলেন। নামিয়াই বলিলেন, “ভাই, সর্ব্বনাশ হইয়াছে—আমার যথাসর্বস্ব গিয়াছে!”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রণেন্দ্রপ্রসাদের কথা শুনিয়া ও ভাবভঙ্গী দেখিয়া ঝাঁৎ করিয়া সকলের মনে সেই ডাকাতের কথা উদিত হইল; কিন্তু কাহারও মুখে কথা ফুটিল না—সকলেই অবাক্। তখন আমার আত্মীয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি! কি হইয়াছে?”

রণেন্দ্রপ্রসাদ গৃহমধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িলেন। মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, “আর ব্যাপার কি! সব কেড়ে নিয়ে গেছে!”

এবার সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কে—কে?”

রণেন্দ্রপ্রসাদ বলিলেন, “আমি পাল্কী করিয়া আসিতেছি, পাল্কীর ভিতরে আমার টাকা-কড়ি জহরতের বাক্স ছিল, লোকজন আমার একটু পিছনে পড়িয়াছিল; এমন সময়ে একজন মুখসপরা ঘোড়সওয়ার দুই হাতে দুইটা পিস্তল, একেবারে পাল্কীর সম্মুখে—গুলি করে আর কি! প্রাণের ভয়ে বাক্সটী দিয়া প্রাণে বাঁচিয়া আসিয়াছি—কিন্তু সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছি—যথাসৰ্ব্বস্ব গিয়াছে।”

আমরা সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিলাম, “সেই ডাকাত!”

তখন রণেন্দ্রপ্রসাদ ব্যাকুলভাবে সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “মহাশয়, পুলিসে সংবাদ দিন।”

কেহ কোন কথা কহিলেন না। আমরা সকলেই জানিতাম, পুলিস কিছুই করিতে পারিবে না। পূর্ব্বে যে কয়েকবার এইরূপ ডাকাতি হইয়াছিল, পুলিস প্রাণপণ চেষ্টায় এ পর্যন্ত তাহার কিছু কিনারা করিতে পারে নাই। আমি কিন্তু মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করিলাম—বোধ হয়, পুলিসের উপর রাগ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিলাম। তখন আমার উষ্ণ রক্ত, হৃদয়ে অসীম উৎসাহ, আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম, যেমন করিয়া হউক, এই ডাকাতটাকে ধরিব।

এই শেষ ডাকাতিতে মুর্শিদাবাদ আরও আলোড়িত হইয়া উঠিল—মহরমের আমোদ প্রায় ভাঙ্গিয়া যায়। রাত্রিতে সাহস করিয়া কেহ পথ চলে না; যে সকল বড় লোকের আসিবার কথা ছিল, তাঁহারা মুর্শিদাবাদে আসা বন্ধ করিলেন। অনেকে কিরূপে দেশে ফিরিবেন, তাহাই ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। এই অশ্বারোহী ডাকাতের ভয়ে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের লোকের কায়মনোবাক্যে নিদারুণ উদ্বেগের সঞ্চার হইল।

তখন নবাব নাজিম সাহ বিচলিত হইয়া একজন সুদক্ষ গোয়েন্দার জন্য কলিকাতায় লিখিলেন। তথা হইতে সুবিখ্যাত গোয়েন্দা ফতে আলি প্রেরিত হইলেন। তিনি যথাসময়ে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইয়া তদন্ত আরম্ভ করিয়া দিলেন।

তাঁহার গোয়েন্দাগিরিতে যে বিশেষ দক্ষতা ছিল, তাহা বলিয়া বোধ হয় না; তবে ভাগ্যবলে তিনি কয়েকটা বড় মামলার কিনারা করিয়াছিলেন, ইহাতেই তাঁহার এত নাম হইয়াছিল এবং নামের সঙ্গে অহঙ্কারও ষোল আনা দেখা দিয়াছিল। আমি বুঝিয়াছিলাম, ইঁহার দ্বারা বিশেষ কোন কাজ হইবে না।

আমি এ ডাকাত ধরিব, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। সুতরাং অনেক চেষ্টা করিয়া ইঁহার সহিত আলাপ করিলাম। ইনি কতদূর কি সন্ধান পাইয়াছেন, তাহাই অবগত হওয়া আমার প্রধান উদ্দেশ্য—আর ইনি যদি আমাকে সঙ্গে লয়েন, তবে আরও ভাল।

আমার আত্মীয়ের অনুগ্রহে ফতে আলির সঙ্গে আমার আলাপ হইল। ফতে আলি, আমার গোয়েন্দাগিরি করিবার সাধ হইয়াছে শুনিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। আমার রাগ হইল, কিন্তু রাগ প্রকাশ করিলাম না।

আমার গাম্ভীর্য্য দেখিয়াই হউক, বা যে কোন কারণেই হউক, তিনি হাসি বন্ধ করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; আমিও তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম, চোখ নামাইলাম না। ক্ষণপরে তাঁহার স্থূল মস্তিষ্কের ভিতর প্রবেশ করিল যে, আমি সহজ ছেলে নই।

কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া তিনি বলিলেন, “হাঁ, তুমি পারিবে, তোমাকে সঙ্গে লইব, তবে বলিতে কি অমর বাবু, ইহার মাথা মুণ্ডু আমি কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। কোথা হইতে যে আরম্ভ করি, কিছুই বুঝিতেছি না।”

আমি বলিলাম, “সাধারণভাবেই আরম্ভ করুন, দারোগা সহেব।”

“অসম্ভব—এই মনে কর একটা যদি খুন হয়, তবে যেখানে খুন হইয়াছে, সেইখান হইতে সুরু করিতে পারি। এই ডাকাতির কোন নিশ্চিত স্থান নাই। হঠাৎ কোন্‌খানে আসিয়া আক্রমণ করে, জহরত টাকা-কড়ি লইয়া ঘোড়ায় চড়িয়া নিরুদ্দেশ হইয়া আজ এখানে—কাল সেখানে——আজ উত্তরে—কাল দক্ষিণে। ঘোড়ায় চড়িয়া বিশ-পঁচিশ ক্রোশ দূরে রাত্রের মধ্যে চলিয়া যাওয়া কম আশ্চৰ্য্য নয়!”

আমি অতি বিনম্রভাবে বলিলাম, “ঘোড়া ধরিয়াই সন্ধান করুন না কেন।”

ফতে আলি বলিলেন, “যাঁহাদের নিকট হইতে এইরূপে টাকা-কড়ি কাড়িয়া লইয়াছে, তাঁহাদের সকলকেই জিজ্ঞাসা করিয়াছি—সকলেই বলেন, লোকটার মুখে মুখস, ঘোড়াটা কাল রঙের—বড় ঘোড়া—এই পৰ্য্যন্ত—ব্যস্। আর কেহই লোকটার বিষয় কিছু ভাল করিয়া বলিতে পারে না! ইহাতে ঘোড়া ধরিয়া মাথা মুণ্ডু কি জানিব! সংসারে হাজার হাজার কাল ঘোড়া আছে—সকলে ভয়েই আড়ষ্ট, তাহার উপর অন্ধকার, লোকটাকে কেহই ভাল করিয়া দেখে নাই।”

“তবে এটা স্থির, ডাকাত যাহাকে তাহাকে আক্রমণ করে না। যাহার নিকটে অনেক টাকার জহরত থাকে, তাহাকেই আক্রমণ করে।”

ফতে আলি আনন্দে আমার পিঠ চাপাড়াইয়া বলিলেন, “হাঁ, এই কথাই ঠিক! ডাকাত একা নয়, দলে আরও লোক আছে।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে আপনি মনে করেন যে, ইহারা একটা ডাকাতের দল? ফতে আলি উৎসাহের সহিত বলিলেন, “নিশ্চয়—নিশ্চয়—অমর বাবু একজন সন্ধান দেয়, কোন্ পাল্কীতে বেশি জহরত আছে—আর একজন ডাকাতি করে—এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন লোকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কাজের ভার আছে। একটার সন্ধান পাইলে যে হয়!”

“তাহা হইলে আপনি কি স্থির করিয়াছেন, আমাকে বলিলে অনুগৃহীত হই।”

“ভাল, তবে শোন। যে জহরতের খবর দেয়, সে একজন ভদ্রলোক—সম্ভবতঃ সম্ভ্রান্ত লোক।”

“আপনি এরূপ স্থির করিতেছেন কেন?”

সম্ভ্রান্ত লোক না হইলে কোন্ বড়লোক কোন্ দিন বেশি দামী গয়না পরিয়া মুর্শিদাবাদে আসিতেছেন, তাহা অপরের জানিবার উপায় ছিল না। সেই দ্বিতীয়কে সংবাদ দেয়। সে বড়লোকের মত ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়াইতে বাহির হয়, কোন নির্জ্জন স্থানে আসিয়া মুখস পরে, তাহার পর ডাকাতি ক’রে কাজ শেষ করিয়া, ঘোড়ায় চড়িয়া দূরে কোন স্থানে গিয়া তৃতীয়কে জহরত দেয়, সে আবার কোন দূরদেশে গিয়া উহা বিক্রয় করে।”

“আপনি যে বলিলেন, প্রথম লোক যে সন্ধান দেয়, সে ভদ্রলোক না হইতেও পারে। কোন বড়লোকের বাড়ীর চাকর, মনিবদের মধ্যে কথাবার্তা শুনিয়াও জানিতে পারে যে, কোন্ বড়লোক কখন্ কোন্ পথে মুর্শিদাবাদে আসিতেছেন।”

ফতে আলি মাথা চুল্কাইতে চুল্কাইতে বলিলেন, “আমি যাহা বলিলাম, তাহাই ঠিক।”

আমি বলিলাম, “এখন এই ডাকাতির কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছে—কোন লোক এমন করিয়া ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়াইয়া বেড়াইলে তাহার উপর লোকের সন্দেহ হইত, কেহ-না-কেহ তাহাকে দেখিতে পাইত।”

“সে কথাও ঠিক—এখানকার পুলিস কিছুই করিতে পারে নাই।”

“তাহাদের অপরাধ নাই; আপনার মত লোকেই যখন হতাশ হইলেন!”

“আমি হতাশ হই নাই।”

“তাহা হইলে এখন কি করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?”

“তুমি কি করিতে চাও?”

“আমি এখনও কিছুই স্থির করিতে পারি নাই।”

“মুর্শিদাবাদের চারিদিকে অনুসন্ধান করিব!”

“এখানকার পুলিস তাহাও করিয়াছেন, কিন্তু কোন সন্ধান পান্ নাই।”

“তবে কি করা যায়? দেখিতেছি, এখন উল্টাদিক্ হইতে সন্ধান করিতে হইবে।”

“সে কি?”

“যেখানে ইহারা জহরত বিক্রয় করে, সেইখানে অনুসন্ধান করিতে হইবে। দামী জহরত যেখানে- সেখানে বিক্রয় হয় না। খুব সম্ভব ইহারা কলিকাতায় এই সকল জহরত বিক্রয় করে—সেইখানেই সন্ধান করিব।”

“আর এখানে এইরূপ নির্বিঘ্নে ডাকাতি হইতে থাক্।”

“আমরা ত আর জগৎ-জুড়ে পাহারা রাখিতে পারি না। এই ডাকাত উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারিদিকে ডাকাতি করে—কখন্ কোথায় ডাকাতি করিবে, কিছুই স্থির নাই। আজ এখানে করিল, দুইদিন পরে বিশ ক্রোশ দূরে করিল, কোন্ দিক্‌ সাম্‌লাইব।”

“যাঁহাদের জহরত গিয়াছে, সকলেই হাজার টাকা করিয়া পুরস্কার দিতে চাহিয়াছেন।”

ফতে আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “সবই বুঝিলাম, কিন্তু এ যে বড় বিষম ব্যাপার! অনেক অনেক মামলা কিনারা করিলাম, এটার লেজে হাতও দিতে পারিতেছি না। যাহাই হউক, আশা ছাড়ি নাই—একটা হেস্ত-নেস্ত করিবই। তুমি কি করিবে?”

“আমি এখন কি করিব-না-করিব কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আমি নূতন, আপনি বহুদর্শী লোক—আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই আমি করিব।”

“সন্ধান কর।”

“কি ধরিয়া সন্ধান করিব, সূত্র কি?”

“আমার মাথা!”

অগত্যা আমি ফতে আলি দারোগার বাসা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম। কি সন্ধান করিব, কিরূপে সন্ধান করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, আর একটা ডাকাতি না হইলে কিছুই সন্ধান করিতে পারিব না।

এই ব্যাপারের কোন কিনারা না হওয়ায় সকলেই প্রতিদিন ভাবিতেছিল, আজ কাহার আবার সৰ্ব্বনাশ হয়—ডাকাতি নিশ্চয়ই থামিবে না। তবে কোথায় কোন্খানে কখন্ কে ডাকাতের হাতে পড়িবে, তাহাও কেহই স্থির করিতে পারিতেছিল না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আর পনের দিন ডাকাতি না হওয়ায় আবার মহরমের আমোদ কতক পরিমাণে উদ্দীপিত হইল। আজ আমার আত্মীয়ও মহরমের জন্য নাচ দিলেন। দুইজন বিখ্যাত বাইজী নিমন্ত্রিত হইল। বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমাদের বাড়ীতে সমাগত হইলেন। আজ মহা ধূম।

খুব উৎসাহে ও আনন্দে নাচ-গাওনা চলিতে লাগিল। আমি এক পার্শ্বে বসিয়া নাচ দেখিতেছিলাম একটী নৰ্ত্তকী উঠিয়া নাচ-গান করিতেছিল, অপর নর্তকী এক পার্শ্বে বসিয়াছিল।

যে বসিয়াছিল, তাহার নাম মনিয়া বাইজী। সম্প্রতি পশ্চিম হইতে মুর্শিদাবাদে আসিয়াছে। রূপে, গুণে সৰ্ব্বতোভাবে সে শ্রেষ্ঠ। এরূপ বাইজী মুর্শিদাবাদে আর কখনও আসে নাই। পূর্ব্বে ইহারই গান হইয়াছে, সকলেই ইহার নাচে ও গানে একবারে বিমুগ্ধ হইয়া গিয়াছেন।

সহসা মনিয়া উঠিয়া আমার নিকটে আসিয়া বসিল। আমি সরিয়া বসিলাম। সে তখন তাহার সেই চিরাভ্যস্ত মধুর হাসি হাসিয়া বীণা-বিনিন্দ্রিস্বরে বলিল, “আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে, মশাই।”

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “আমার সঙ্গে!”

মনিয়া বলিল, “হাঁ, আপনার সঙ্গে। শুনিলাম, আপনি নাকি এই ডাকাতের সন্ধান করিতেছেন— আমার অনেক জহরত আছে—তা দেখছেনইত।” বলিয়া তাহার সুগোল বাহু উত্তোলিত করিল।

এরূপ সুন্দর বাহু আমি আর কখনও দেখি নাই। আমি কি বলিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। আমার এই প্রথম অপর স্ত্রীলোকের সহিত কথোপকথন। বুকের স্পন্দনও তখন দ্রুতবেগে চলিতেছিল, এবং আমার মনে হইতেছিল, যেন সেই শব্দ বাহিরেও স্পষ্ট ধ্বনিত হইতেছে। আমি কেবলমাত্র বলিলাম, “তা দেখিতেছি।”

মনিয়া মিষ্টস্বরে কহিল “আপনি এ সম্বন্ধে কি জানিয়াছেন, আমাকে অনুগ্রহ করিয়া বলুন। আমার বড় ভয় হইয়াছে।”

আমি তখন মস্তক কণ্ডুয়ন আরম্ভ করিয়াছি। বলিলাম, “আপনি বোধহয়, সবই শুনিয়াছেন।”

“অনেককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু কেহ কিছু ভাল বলিতে পারে না। আপনি এ বিষয়ের সন্ধান করিতেছেন—”

“আমি ঠিক নই—ফতে আলি গোয়েন্দা।”

“তা শুনিয়াছি, লোকে বলে তিনি নির্বোধের একশেষ। তিনি এ ডাকাতির কিছুই করিতে পারিবেন না।”

“আমি যে সন্ধান করিতেছি, এ কথা আপনাকে কে বলিল?”

মনিয়া মধুর হাসি হাসিয়া বলিল, “কথা কি গোপন থাকে? লোকেই আপনাকে আমায় চিনাইয়া দিতেছে। এখন এই ডাকাতের বিষয় আমায় বলুন—ডাকাতের কোন সন্ধান পাইয়াছেন?”

“না, পাওয়া যে যাইবে, সে বিষয়েও আশা খুব কম।”

“দেখিতেছি, লোকটা যে-সে নয়। এখানে এমন কেউ আছেন, সেই ডাকাত যাঁহার কিছু আত্মসাৎ করিয়াছে?”

আমি রণেন্দ্র বাবুকে দেখাইয়া দিলাম। বলিলাম, “আপনি কি উহার সহিত আলাপ করিবেন?” মনিয়া অসম্মতভাবে ঘাড় নাড়িল। বলিল, “আজ ত কাহাকেও ধরিবে না—সহরে সে একবারও ডাকাতি করে নাই?”

আমি বলিলাম, “না, তবে যদি তাহার কেহ কিছু করিতে না পারে, তাহা হইলে তাহার নিশ্চয়ই সাহস বাড়িয়া যাইবে—তখন সে এ সহরেও ডাকাতি করিবে।”

মনিয়া শিহরিয়া উঠিল বলিল, “বলেন কি! আজ ত করিবে না?

আমি একটু হাসিয়া বলিলাম “সকল লোকেই সাবধান হইয়াছে। এখন কাহাকেও আক্রমণ করিলে, হয় সে ধরা পড়িবে—নতুবা গুলি খাইবে।”

“কেন?”

“এখন রাত্রে যাইতে হইলে সকলের কাছেই পিস্তল থাকে।”

“আমার কাছে ত নাই।”

“আপনার ভয় নাই, আপনার সঙ্গে অনেক লোক থাকিবে, বিশেষতঃ সে সাহস করিয়া সহরে আসিবে না।”

“আপনি কি মনে করেন যে, তাহাকে কেহ ধরিতে পারিবে না?”

“এইরূপ আরও দুই-চারিবার ডাকাতি করিয়াও সে এড়াইয়া যাইতে পারে; কিন্তু এটা নিশ্চিত, শেষে সে ধরা পড়িবে।”

“আমার সঙ্গে বাজি রাখুন—সে ধরা পড়িবে না।”

আমি মনিয়ার এই কথায় বিশেষ বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। কিন্তু তাহার মুখের ভাব দেখিয়া তাহার মনের ভাব কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। বলিলাম, “বাজি রাখিলে আপনাকে হারিতে হইবে।”

“হারিতে রাজি আছি”, বলিয়া সে আমার নিকট হইতে উঠিয়া অন্য দিকে চলিয়া গেল। তখন অনেক রাত্রি হইয়াছিল, অনেকেই চলিয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, অনেকে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, বাইজীও গান বন্ধ করিয়াছিল। গোলযোগের মধ্যে মনিয়াকে আমি আর দেখিতে পাইলাম না।

সহসা একটা গোল উঠিল। রণেন্দ্রপ্রসাদ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ডাকাত— ডাকাত—”

সকলে চারিদিক্ হইতে সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, “সে কি! ডাকাত—কোথায়?”

আমরা সকলে ছুটিয়া রণেন্দ্রপ্রসাদের নিকটে আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কি বলিতেছেন—ডাকাত কি?”

তখন রণেন্দ্রপ্রসাদ বলিলেন, “আমি এইমাত্র এখানে সেই ডাকাতের গলার আওয়াজ শুনিয়াছি।” এই কথা শুনিয়া আমরা সকলে স্তম্ভিত হইলাম। মুহূর্ত্ত পরে গৃহ মধ্যে আর কোন শব্দ নাই— নীরব—নিস্তব্ধ—সূচিপাতের শব্দও সুস্পষ্ট শুনিতে পাওয়া যায়।

কিন্তু কোনদিকে কোন শব্দ নাই। আমরা সকলেই বিস্মিতভাবে রণেন্দ্রপ্রসাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম।

তিনি বলিলেন, “আমি নিশ্চয়ই তাহার গলার আওয়াজ শুনিয়াছি, সে নিশ্চয়ই এই ভিড়ের মধ্যে আছে।”

সকলেই পরস্পর মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। সহসা কে ভিড়ের মধ্য হইতে বলিয়া উঠিল, তোমরা তাহাকে কিছুতেই ধরিতে পারিবে না।”

রণেন্দ্রপ্রসাদ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ঐ—ঐ—”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *