জয়হিন্দ – ধীরেন্দ্রলাল ধর
মণিপুরের পথ-স্বাধীনতার পথ৷ ভারতীয় সৈন্য রাত্রির অন্ধকারে পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে৷ মুখে কারুর কথা নেই, জঙ্গলের বুকে শুধু এলোমেলো ছায়া নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে৷ পাহাড়ের মাথায় চলন্ত মানুষগুলোকে চাঁদের আলোয় দেখলে মনে হয়, গোটা পাহাড়টাই বুঝি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, দুলছে!
আজাদ হিন্দ ফৌজ এগিয়ে চলেছে মণিপুরের দিকে৷
মাথার উপর শত্রু বিমান ঘুরছে পাহাড়ের গায় গায়৷ গাছপালার আড়াল ডিঙিয়ে যেখানে যতটুকু নজর যায় শত্রুপক্ষ সজাগ চোখ রেখেছে, সন্দেহ হলেই ছোঁ মেরে নেমে আসে, মেশিন-গানের গুলিবৃষ্টি হয়-কট কট কট কট!
বনানীর অন্তরাল থেকে কোনো সাড়া উঠে না৷ দু-একজন যারা আহত হয় দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে৷ আর্তনাদ করে সে আর পাঁচজনের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে না৷ মাতৃভূমির স্বাধীনতার লড়াই নিজের দুঃখ-কষ্টের অভিব্যক্তি দিয়ে প্রতিহত করা চলে না৷ বলে-তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা ঠিক আছি!
পিছনে তাকাবার অবসর নেই, বন্ধুত্ব প্রীতি অহংকারের কোনো মূল্য নেই৷ পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাই সবার উপর৷ হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু!
কয়েক হাজার নির্ভীক ভারতীয় জীবন পণ করে এগিয়ে চলে৷ পাথরে পা পিছলে যায়৷ শুকনো ডাল এলে বেঁধে কাঁটার মতো৷ দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়৷ অনেকের গায়ের জামা ফালি ফালি হয়ে কাঁধ থেকে ঝুলতে থাকে শুধু৷ এক হাতে তারা কপালের ঘাম মোছে, আর এক হাতে গাছপালা ধরে পাথরের পর পাথরে এগিয়ে চলে৷ রাত্রির অন্ধকার তাদের চোখে সহে গেছে৷ রাতের পর রাত পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে৷ বনবিড়ালের মতো তারা এগিয়ে চলেছে৷ অপ্রতিহত গতি তাদের চরণে, অদম্য আশা তাদের বুকে৷
সবার আগে পথ দেখিয়ে চলেছে ওখা সর্দার৷ একত্রিশ জনের একটি ছোটো দল তার পিছনে৷ নাগা জাতের মানুষ সে৷ অর্থনীতি রাজনীতির বড়ো বড়ো কথা সে বোঝে না৷ সে শুধু বুঝেছে-এই লড়াই জিতলে গান্ধী-রাজ হবে৷ খাওয়া-পরার দুঃখ থাকবে না-স্বরাজ আসবে!
স্বরাজ কথাটা সে অনেক আগে শুনেছে রানি-গুইদালোর মুখে৷ কথায় কথায় সে বলে, ‘হ্যাঁ, ওই একটা মেয়ে জন্মেছিল আমাদের জঙ্গলে-বাঘের বেটি! নাগাদের মধ্যে ওই বেটিই ছিল মানুষ আর আমরা তো সব জানোয়ার! রানি যখন কথা বলত, ধক ধক করে জ্বলত তার দু-চোখ৷ দেখলে বোঝা যেত, তার ভিতরে আগুন আছে৷ তোদের নেতাজির চোখ অন্ধকারে জ্বলে, না সিপাহিজি?
রহমন বলল, ‘নেতাজি আমাদের নয়, নেতাজি তোমাদেরও,৷ নেতাজি সারা হিন্দুস্থানের নেতাজি৷’
-‘নেতাজির মা নেতাজিকে বাঘের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছিলেন, না সিপাহিজি? আমাদের গাঁয়ের লোকদের মুখে শুনেছি৷ তাই নেতাজির অত সাহস, অমন তেজ!’
রহমন চুপ করে থাকে৷ সরল নাগার সহজ বিশ্বাসে আঘাত করতে তার মন চায় না৷
পনেরো বছরের ছেলে নির্মল ছিল সঙ্গে, বলল, ‘তুমি একেবারে জংলি মানুষ ওখা সর্দার! বাঘের দুধ না খেলে বুঝি মানুষের সাহস হয় না? মান্দালয়ে যেদিন বোমা পড়ল! . . .’
ওখা সর্দার বলল, ‘থাক আর বলতে হবে না ভাইজি, বোমা পড়ার সময় তোদের সাহস আমি খুব দেখেছি, পাগলের মতো সব ছুটেছিলি হাঁটা পথে! বোমায় তোদের ক-টা মানুষ মরেছে? তার চেয়ে ঢের বেশি মরেছে ওই পথে . . .’
-‘আচ্ছা, দেখবে একদিন আমার সাহস আছে কি না! নেতাজি আমার দেশেরই মানুষ ওখা সর্দার, ভুলে যেয়ো না৷’
-‘ঠিক হ্যায় ভাইজি, ঠিক হ্যায়!’-ওখা সর্দার নির্মলের পিঠে স্নেহের এক চাপড় মেরে বলে-‘সামনে সামালো!’
এক পা এগোতেই এক ঝলক জল এসে পড়ে নির্মলের গায়৷ অন্যমনস্ক নির্মল চমকে উঠল-সাপে ছোবল মারল নাকি? নির্মল থমকে দাঁড়াল৷ ওখা সর্দার তার একখানি হাত চেপে ধরে দৃঢ় পদক্ষেপে কয়েকখানি পাথর পার করে দিল৷ ঝরঝরে ঝরনার জল মাথার উপর রামধনুর সেতু তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে পড়ে, চাঁদের আলোয় একটি হিরের পুলের মতো দেখায়৷ নির্মলের ভারি ইচ্ছা হয় ওই জলের সঙ্গে পিছলে যায়, নীচে তলিয়ে যায়, হারিয়ে যায় অনেক দূরে৷
ওখা সর্দার একে একে একত্রিশ জনকে পার করে দেয় ঝরনার নীচে পিছল পাথরগুলো, তারপর বলে, ‘ঠিক হ্যায়!’
ছোটো দলটির পৃষ্ঠরক্ষী সুখন সিং ছিল সবার পিছনে, সে সাড়া দিল, ‘ঠিক হ্যায়, সর্দার, জয় হিন্দ!’
একত্রিশজন চাপা গলায় বাঘের মতো গর্জে উঠল, ‘জয় হিন্দ!’
সামনেই খাড়া পাহাড়, ওখা বলল, ‘সেজো গিয়ে উঠতে হবে ওর উপর৷ ওর মাথায় না উঠতে পারলে আমাদের সুবিধা হবে না৷’
ওখা সর্দার পথ দেখাল, ত্রিশজন যুবক আর একজন বালক তার অনুসরণ করে চলল৷ সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না, তার উপর কিটব্যাগ, বন্দুক আর ব্রেনগানের টুকরো পিঠের উপর বাঁধা৷ হামা দিয়ে উপরে উঠতে হয়৷ পাথরের কুচোয় হাত ছড়ে যায়, পুরোনো ক্ষতগুলি নতুন ব্যথায় টাটিয়ে ওঠে৷ কিন্তু স্বাধীনতার সৈনিক, এগিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, তাদের জন্মভূমি তাদের ডাকছে৷
বুকে হেঁটে দুর্গম পাহাড়ি বন্ধুরতা ঠেলে তারা উপরে উঠছে৷ এলোমেলো উঠছে৷ কোথাও আলগা পাথর গড় গড় করে পড়ছে৷ কোথাও বা গাছ-আগাছা সামনে পড়ছে৷ প্রথম দু-একদিন খুব বিব্রত বোধ হয়েছিল৷ কিন্তু এখন তারা পায়ের পট্টি তুলে হাঁটুতে জড়িয়ে নিয়েছে৷ আর হাত দুটোর কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে৷ এমন অন্ধকারেও নীচের পাথর আর আশেপাশের ডাল ধরার আগেই সে কেমন করে চিনতে পারে৷ আগের চেয়ে তাই হাত কাটে কম, চলার গতি হয়েছে অনেকটা স্বচ্ছন্দতর৷ কিন্তু পরিশ্রম তাদের কম হয় না৷ হাঁপাতে হাঁপাতে যখন তারা পাহাড়ের মাথায় গিয়ে ওঠে তখন সটর্স আর সার্ট ঘামে গায়ের সঙ্গে লেপটে যায়৷
পাহাড়ের মাথায় উঠে সর্দার রহমনকে দেখায়, ‘ওই যে বাবু দূরে লাল আলোটা দেখছ, ওইটেই আমাদের গাঁ৷ ওইখানে ওরা ভূতুড়ে যন্তর বসিয়েছে, ওই যন্তর দিয়ে ওরা হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে, হাওয়ার কথা শোনে৷ ওর কি একটা নামও যেন শুনেছিলাম-‘দুরুদুরু’ বুঝি?
নির্মল হেসে বলল, ‘দ্যুৎ, তুমি একদম জংলি রেড়িয়ো জালে নয়৷’
-‘তা তুমি জংলি বলো আর যাই বলো, ওই যন্তরটাকে আমার মোটেই বিশ্বাস নেই ভাইজি৷ তুই দেখিস ওই যন্তর থেকেই একদিন মানুষ খুন হবে৷ আমি এই এখন থেকে বলে রাখলাম, হুঁ!’
সুখনের হাতে একটি ঘড়ি বাঁধা ছিল, টর্চ লাইটটা জ্বেলে একবার দেখে নিল রাত দুটো বেজে গেছে, বলল, ‘আর ঘণ্টাখানেক পরেই আমাদের কাজ শুরু হবে, এবার সবাই খানিকক্ষণ জিরিয়ে নাও৷’
পাহাড়ের মাথায় একত্রিশ জন লোক গোল হয়ে বসে৷ লাল আলোটা অনেকটা দূরে মিটমিট করে৷ ওখা বলল, ‘ওই লাল আলোটার নীচেই ওদের আড্ডা৷ আমাদের তাড়িয়ে ওরা ওইখানে ছাউনি ফেলেছে৷ ওই গাঁ থেকে আমি ওদের তাড়াব৷’
নির্মল বলল, ‘তুমি একা তাড়াবে তো সর্দার?’
-‘আমি যদি একাই যাব তাহলে তোদের ডেকে আনলুম কেন ভাইজি? তবে তোরা যদি এগোতে ভয় পাস আমি একাই যেতে পারব৷ তোদের ওই বুম বুম গোটাকতক আমাকে দিবি, ওদের সব ছাউনি উড়ে যাবে আকাশে৷’
-‘আমরা দিল্লি অবধি যাব সর্দার, লাল কিল্লা অবধি৷ তোমাদের ওই গাঁ আমরা দখল করে ফেলব আজ সকাল হবার আগে৷’
মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে গেল, এলোমেলো ছুড়ে দিল সন্ধানী আলো৷ একত্রিশ জন মানুষ পাহাড়ের বুকে শুয়ে পড়ল৷ রাত্রির অন্ধকারে পোশাকের রং আর পাথরের রং এক হয়ে গেল৷
প্লেন চলে গেল৷ সুখন ঘড়ি দেখে বলল, ‘অনেকক্ষণ জিরুনো হয়েছে, এবার এগোই৷ কমরেড, সব ঠিক হ্যায়?’
কার্তুজ আর বোমাভরা কিট-ব্যাগটার উপর হাত বুলিয়ে সবাই সাড়া দিল, ‘ঠিক হ্যায়!’
এবার শুরু হল উতরাই৷ এবার আর আগের মতো অত পরিশ্রম হয় না৷ তবে এবার আগের চেয়ে সাবধান হতে হয় বেশি৷ প্রত্যেকটি পা ঠিকমতো ফেলতে হয়৷ হুড়মুড় করে খানিকটা নেমে গেলে, কি একখানা বড়ো পাথর খসে পড়লে আর রক্ষা নেই! সামনে শত্রুর কান খাড়া আছে৷ অতি সন্তর্পণে এক-পা করে তারা এগোচ্ছে৷
খানিকটা নেমে আসার পর একটা শাল বন৷ শালগাছগুলির নীচে সবাই এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ ওখা সর্দার বলল, ‘এই বন পার হলেই পাহাড়ি নদী, তার পরেই আমাদের গাঁ৷’
শাল বনের ভিতর দিয়ে চলতে বিশেষ ভয় থাকে না৷ সহজ পদক্ষেপে তারা এগোতে থাকে৷
বনের শেষ প্রান্তে নদীর কিনারা দিয়ে শত্রুদের ঘাঁটি৷ বনের ভিতরে কীসের যেন একটা শব্দ পেয়ে তারা চমকে ওঠে, আচমকা কয়েকটি মেশিনগান গর্জে ওঠে-টাচ টাচ টাচ!
আগুনের ঝিলিক ঠিকরে যায়, শাল গাছের গায়, পাহাড়ের পাথরে৷ রহমনের দল চমকে ওঠে, গাছের আড়ালে আশ্রয় নেয়৷
খানিকক্ষণ এলোমেলো গোলাবৃষ্টির পর কামান চুপ করল৷ রহমন বলল, ‘ওদের ওই কামানগুলো আগে কেড়ে নিতে হবে!’
সুখন বলল, ‘একটা দল মুখোমুখি লড়বে আর কয়েকজন পিছন থেকে গিয়ে ওদের উড়িয়ে দেবে৷’
রহমন বলল, ‘পিছন দিক থেকে ওদের কামান কেড়ে নিতে যাবে কে কে?’
-‘আমি . . . আমি . . . আমি . . .’
সুখন হাসতে হাসতে বলল, ‘তাহলে ওদের সঙ্গে মুখোমুখি হবে কে, আমি আর রহমন?’
রহমন দেখে দেখে পাঁচজনকে বেছে নিল, বলল, ‘তোমরা পাঁচজন যাবে৷ সর্দার তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে৷ আমরা এদিক থেকে কামান চালানোর পর তোমরা ওদেরকে আক্রমণ করবে৷’
নির্মল বলল, ‘আমিও যাব ওদের সঙ্গে৷’
রহমন একটি চড়া কথা বলতে যাচ্ছিল, নির্মল তার একখানি হাত চেপে ধরল, বলল, ‘আমি যাব ক্যাপটেন, তুমি ‘না’ বোলো না৷ ওদের সঙ্গে একবার হাতাহাতি লড়াই করার ভারি ইচ্ছা৷’
সুখন হাসতে হাসতে বলল, ‘তাহলে তোমার আর দিল্লি অবধি যাওয়া হবে না ভাইজি৷’
নির্মল সোজা হয়ে ওঠে, বলে, ‘তার জন্য আমার কোনো দুঃখ থাকবে না! এই লড়াইয়ে জিতে যদি মরি, আসছে বারে আমি স্বাধীন হিন্দুস্থানে জন্মাব৷’ নেতাজি বলেছেন ‘তুম হামকো খুন দো, হাম তুমকো আজাদি দুংগা!’
সুখন বলে উঠল, ‘সাবাস!’
ওখা সর্দারের পিছু পিছু ছ-টি লোক শাল বনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
আরেকটু নীচে নেমে এসে বড়ো বড়ো কয়েকটি পাথরের আড়ালে রহমন আর সুখন স্থান নির্দেশ করে৷ দু-জনে দু-জনে করে শুয়ে পড়ে ব্রেনগান আর রাইফেল বাগিয়ে নিয়ে৷ পঁচিশ জন মানুষ এলোমেলোভাবে শালবনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে৷
রাত চারটে বাজল৷ ব্রিটিশ বাহিনী শাল বনের নীচে ঝরনার কিনারায় সজাগ দৃষ্টি রাখে৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ আচ্ছন্ন হয়ে আসে৷ কামানের গায় হেলান দিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নিতে ইচ্ছা করে৷ সহসা ঝরনার জলে কী যেন একটা পড়ার শব্দ হয়, রক্ষীরা সজাগ হয়ে ওঠে৷ আবার সেই শব্দ৷ চারটে সার্চ লাইট দপ দপ করে জ্বলে ওঠে৷ বহুদূর পর্যন্ত আলোর রেখা চলে যায়৷ ঝরনার জল রূপালি রেখার মতো ঝলমল করে ওঠে৷ বৈচিত্র্যহীন৷
ওদের আলো নিভে যায়, ওখা সর্দার বলে, ‘ওদিকে একটা বড়ো পাথর আছে, ওর আড়ালে দিয়ে আমরা পার হয়ে যাব, এসো-‘
একটি প্রকাণ্ড পাথরকে আড়ালে রেখে পায়ের বুট খুলে কোমর অবধি ভিজিয়ে ওরা ঝরনা পার হয়ে বায়৷ রক্ষীদল পিছনে পড়ে থাকে৷ ওরা গাঁয়ের ভিতরে গিয়ে ঢোকে৷
ওদিকে পাহাড়ের মাথায় রহমনের ব্রেনগান গর্জে ওঠে-টাট টাট টাট!
এদিকে ইংরাজ রক্ষীরা চমকে উঠল৷
কখনো বনের এপার থেকে গুলি ছুটে যায়, কখনো ওপাশ থেকে৷ রক্ষীরা মেশিন গান চালাতে শুরু করে অবিশ্রান্ত৷ ওদিক থেকে রহমনের দল তার জবাব দেয়৷
রীতিমতো লড়াই শুরু হয়ে যায়৷
ব্রিটিশ ফৌজের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়৷ আক্রমণ শুরু হয়েছে৷ ঘুম ভেঙে উঠে সবাই প্রস্তুত হয়৷ হুইসেল শোনা যায়৷ এক ছাউনি থেকে আর এক ছাউনিতে৷ গোলমালের মধ্যে দিয়ে ওখা সর্দার এগিয়ে চলে৷
গাঁয়ের শেষ দিকে এক ছাউনিতে সাময়িকভাবে একটি গাছের মাথায় একটি বাঁশ বেঁধে রেডিয়ো স্টেশন করা হয়েছে, এই গোলমালের মধ্যে সেখানে যেতে ওখা সর্দারের কোনো কষ্ট হল না৷ বেশি কাছাকাছি যাওয়া সমীচীন নয়, একটু তফাত থেকেই বোমা ছুড়ল- বুম বুম বুম৷ রেডিয়ো স্টেশন উড়ে গেল৷
ডাইনে ফিরতেই একটা জিপ গাড়ির আড্ডা৷ তার উপর কয়েকটা বোমা ফেলার লোভ তারা সামলাতে পারল না-বুম বুম বুম! কিন্তু ওইটাই তাদের ভুল হল৷ জিপ গাড়িগুলোয় আগুন ধরে উঠতেই চারিপাশ আলোয় আলো হয়ে গেল৷ এবার আর গা ঢাকা দেবার ফুরসত মিলল না৷ চ্যালেঞ্জ শোনা গেল-‘হুকুমদার?’
ছ-জন ছিটকে কয়েকটি গাছের আড়ালে সরে গেল৷ কিন্তু পালাবে কোথায়? সামনে-পিছনে চারিপাশেই ছাউনি, চারিপাশ থেকে চ্যালেঞ্জ আসে-‘হুকুমদার?’
নির্মল একবার চারিপাশে দেখে নেয়, বেয়োনেট হাতে নিয়ে ওরা ছুটে আসছে৷ সট সট করে কয়েকটি বোমা ছুড়ে দেয়, বিস্ফোরণের সঙ্গেসঙ্গে সৈনিক ক-জন ধরাশায়ী হয়৷ নির্মল বলে, ‘ব্রেনগান ফিট করো!’
কিন্তু ব্রেনগ্রান চালাবার অবসর মেলে না, তার আগেই কয়েকটা রাইফেলের গুলি ওদের আহত করে৷
নির্মলের বাঁ-কাঁধের ভিতর দিয়ে একটি গুলি বেরিয়ে যায়৷ পড়ে গিয়েই ও আবার ওঠে, একটার পর একটা বোমা বের করে আর ছোড়ে৷ নিজের বোমা ফুরিয়ে যায়৷ যারা পড়ে থাকে তাদের কিট-ব্যাগের মধ্যে সে তখন হাতড়ায়৷ একে একে সব বোমাগুলি শেষ করে সে লুটিয়ে পড়ল৷ বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘তুম হামকো খুন দো, হাম তুমকো আজাদি দুংগা!’
ব্রিটিশ বাহিনী প্রভাত হবার আগেই পিছু হটে গেল৷ নিম্নভূমিতে শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করার ইচ্ছা তাদের ছিল না৷
দুপুর অবধি এদিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে রহমন দলবল নিয়ে মরিয়া হয়ে নেমে এল গাঁয়ের মাঝে৷
ছোটো গাঁয়ে পরিত্যক্ত ছাউনির এক পাশে ওখা সর্দার ও দলের ছ-জনকে খুঁজে পেতে দেরি হল না৷ নির্মলের হাতে একখানি কাগজ দেখে রহমন তার মুঠোর ভিতর থেকে সেটি ছাড়িয়ে নিল৷ সেটি আজাদ হিন্দ ফৌজের সংবাদপত্র ‘জয়-হিন্দ’-এর একখানি পাতা৷ উপরেই একখানি ছবি, নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজকে নির্দেশ দিচ্ছেন-আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাব৷ মাতৃভূমির পরাধীনতার বেদনা ঘুচাতে হবে৷ হয় স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু . . .
রহমনের চোখে জল আসে, খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে৷ তারপর বলল, ‘আমরা এখানেই নিশান তুলব!’
সেখানেই একটি বাঁশের খুঁটির উপর তিনরঙা নিশান তুলে দেওয়া হল৷ রহমন আজাদ হিন্দের আদর্শ পত্র পাঠ করল-আমরা আজ এগিয়ে যাব, পিছন দিকে চাইব না৷ মনে রাখতে হবে, দিল্লি না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের এই চলার শেষ নেই৷ আমাদের মূলমন্ত্র হল-চলো! দিল্লির লাল কিল্লায় আমাদের জাতীয় পতাকা ওড়াতে হবে! জয় হিন্দ!
রহমনকে ঘিরে বাকি পঁচিশজন সিপাই সাড়া তুলল-জয় হিন্দ!