জয়বাবা শান্তিনাথ
সর্বানন্দের অফিসে তাঁর সঙ্গেই কাজ করেন শান্তিবাবু, শান্তিলাল চৌধুরী। বছর দুয়েক আগে পাটনা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন।
শান্তিবাবু বাংলা ভালভাবেই বলতে পারেন। কিন্তু তাঁর উচ্চারণে কেমন একটা দেহাতি, হিন্দি ঘেঁষা টান। শান্তিবাবু অবশ্য বলেন তিনি বিহারি নন, তবে কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা পাটনার বাসিন্দা।
সর্বানন্দ এবং শান্তিবাবু একই বিভাগে কাজ করেন। প্রায় কাছাকাছিই দু’জনে বসেন। অফিসের কাজকর্ম করতে করতে টুকটাক কথাবার্তা হয়, গল্পগুজব হয়। কখনও দু’জনে টিফিন এক সঙ্গে ভাগ করে খান। এই দু’বছরে দু’জনের মধ্যে একটা হালকা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
শান্তিলালের একটা বড় গুণ এই যে তিনি মদ খান না। মদের প্রসঙ্গ উঠলে এড়িয়ে চলেন। সৰ্বানন্দ কখনও-সখনও শান্তিবাবুকে তাঁর সঙ্গে নৈশ বিহারে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু শান্তিবাবু সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি এবং সরাসরি বলেছেন, ‘আমি ড্রিঙ্ক করা হেট করি। আপনার সব ভাল, কিন্তু এই একটা খারাপ দোষ। ভাবি টোলারেট করে কী করে?’
ফলে আজকাল সর্বানন্দ শান্তিলালের কাছে মদ্যপানের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। এই অফিসে আরও সাঙ্গপাঙ্গ আছেন তাঁরাই সঙ্গী হন।
সে যা হোক, এর মধ্যে একদিন শান্তিবাবু সৰ্বানন্দকে বললেন, ‘আজ আমার বাড়িতে সন্ধেবেলা চলুন। এমন জিনিস খাওয়াব, মদের নেশা ভুলে যাবেন।’
সর্বানন্দ অবাক। এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে গোছের মনের অবস্থা হল তাঁর। শান্তিবাবুকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার? আপনার বাড়িতে কি পার্টি-টার্টি আছে না কি আজকে?’
শান্তিলাল বললেন, ‘ওসব জিনিস আমাদের ঘরে চলে না। আজ আমাদের বাড়িতে শান্তিনাথের পুজো। চলুন বহুত মজা পাবেন।’
‘শান্তিনাথের পুজো?’ নিজের মনেই প্রশ্নটা করে ফেললেন সর্বানন্দ, ‘আপনার নামের গৃহদেবতা প্রতিষ্ঠা করেছেন নাকি নিজের বাড়িতে? আমি গিয়ে কী করব? ওসব পুজো-টুজো আমার সয় না।’
শান্তিবাবু বললেন, ‘আরে বাবা, আমার নাম তো শান্তিলাল আছে, আমাদের ঠাকুরের নাম আছে শান্তিনাথ। দেবাদিদেব মহাদেব আছেন উনি। চলুন, মজা পাবেন।’
আজও সর্বানন্দকে শান্তিলালের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে শান্তিনাথের পুজোয় যেতে হল। গিয়ে দেখলেন, পুজোর ছলে সেটা একটা গাঁজার আখড়া। শান্তিলালের বাড়ির লোকজন পাটনায়, তিনি জোড়াবাগানের একটা গলিতে একটা ঘরে একাই থাকেন। সেই ঘরে আরও পাঁচ-সাতজন দেশোয়ালি ভাই একত্র হয়েছে। তার মধ্যে একজন, কাঁধে পৈতে, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা ‘ব্যোম-ব্যোম’ করে পুজো করছেন, মাঝেমধ্যে ‘জয় বাবা শান্তিনাথ’ বলে হাঁক ছাড়ছেন, বাকিরা সবাই তখন তাঁর সঙ্গে কোরাসে ধুয়ো ধরছেন।
হাতে হাতে গাঁজার ছোট ছোট কলকে ঘুরছে। একজ্বনের টান দেওয়া হয়ে গেলে সে পাশের লোকের হাতে ছিলিম এগিয়ে দিচ্ছে। গাঁজার ধোঁয়ার ঘর পরিপূর্ণ। কটু ও. মাদক গন্ধ থই থই করছে।
ধাপে ধাপে একটা ছিলিম সর্বানন্দের হাতেও এসে গেল। ভদ্রতার খাতিরে সর্বানন্দকে টান দিতে হল। প্রথমে একটু ঝাঁঝ লেগেছিল, গলা থেকে বুক পর্যন্ত একটা ধাক্কা। ক্রমে সয়ে গেল। তখন সর্বানন্দ বুঝতে পারলেন এঁরা শুধু গাঁজাই টানছেন না, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছেন।
সেই গল্পগুজব শুনে সর্বানন্দ বুঝতে পারলেন গঞ্জিকা সেবনের মাহাত্ম্য। মদ খেয়ে চুরচুর হয়েও ও ধরনের আলাপ-আলোচনা সম্ভব নয়।
সর্বানন্দের বাঁ পাশের কালোয়ার ভদ্রলোক বললেন, ‘কী সাংঘাতিক গরম পড়েছে এবার।’
ডানপাশের হিন্দি হাইস্কুলের মাস্টারমশায় বললেন, ‘এ আর কী গরম। বাহাত্তর সালের গর্মিতে আমাদের ভাগলপুরের বাড়িতে হাঁসগুলো পেট থেকে সেদ্ধ ডিম পাড়ত।’
এই কথা শুনে সামনের দশাসই ভদ্রলোক বজরঙ্গবলী ব্যায়ামাগারের কুস্তির শিক্ষক হো হো করে হেসে উঠলেন বললেন, ‘আরে মুঙ্গেরে আমার মামার বাড়িতে গরমের দিনে গোরুর বাঁটে একা একাই দুধ জ্বাল হয়ে ঘন হয়ে যায়, গোরুর বাঁট ধরে দুইলে ঘন ক্ষীর বেরিয়ে আসে।’
ঝিম মেরে বসে ছিলেন শান্তিলাল, তিনি চোখ বোজা অবস্থাতেই বললেন, ‘আমি তো আজকাল আর চায়ের জল গরম করি না। কলের জলে চা পাতা ছেড়ে দিই, তাতেই চা হয়ে যায়।’
সর্বানন্দ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর নয়। কেউ খেয়াল করছে না। এবার কাটতে হবে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। ধোঁয়া ভরতি ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হতে তিনি শান্তিলালকে বললেন, ‘এই গরমে আমি ধোঁয়া হয়ে গেছি।’ এই বলে ধোঁয়া কাটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।