জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিং

জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিং

বুধবার দিন সন্ধ্যেবেলা একজন মানুষ ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে এলো। মানুষটা ছোটাচ্চুর বয়সী এবং একটা কালো টিশার্ট আর একটা জিন্সের প্যান্ট পরে আছে, পায়ে লাল রংয়ের স্লিপার। ছোটাচ্চু তাকে দেখে একই সাথে খুবই অবাক এবং খুবই খুশি হয়ে উঠল। তাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে জয়ন্ত, তুই? আমার বাসায়? সত্যি এসেছিস নাকি ভুল করে চলে এসেছিস?”

ছোটাচ্চুর বয়সী মানুষটা যার নাম জয়ন্ত সে বলল, “আগে কতবার এসেছি তখন তো কখনো জিজ্ঞেস করিসনি সত্যি এসেছি নাকি ভুল করে এসেছি।”

ছোটাচ্চু বলল, “তখন তুই ছিলি চিকন-চাকন জয়ন্ত! এখন তুই হচ্ছিস দ্য বিজনেস ম্যাগনেট জয়ন্ত!”

ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত বলল, “আমিও তো বলতে পারি তখন তুই ছিলি আধামাধা শাহরিয়ার এখন দি অরিজিনিয়াল ডিটেকটিভ শাহরিয়ার!”

ছোটাচ্চু তার বন্ধুকে সোফায় বসাতে বসাতে বলল, “আমি আর অরিজিনাল ডিটেকটিভ নাই। ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়েছি।”

জয়ন্ত বলল, “কিছু কিছু জিনিস ছাড়তে চাইলেই ছাড়া যায় না। চিনে জেঁকের মতো তোর সাথে লেগে থাকবে। একবার যখন ডিকেটটিভ হয়েছিস, সারা জীবন তুই ডিটেকটিভ হয়ে থাকবি।”

ছোটাচ্চু বলল, “তুই শুনিসনি, একজন দুই নম্বরি বাটপার আমার এজেন্সি দখল করে নিয়েছে?”

ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “আরে ধুর! এক এজেন্সি গেছে আরেক এজেন্সি আসবে। আসল জিনিস থাকে এইখানটায়–” বলে জয়ন্ত নিজের মাথায় টোকা দিল। বলল, “এইটা কোনো দুই নম্বরি বাটপার কোনোদিন দখল করতে পারবে না।”

এরকম সময় বাসার কয়েকটা বাচ্চা কোনো একটা কারণে একজন আরেকজনকে ধাওয়া করে বসার ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চুকে তার বন্ধুর সাথে গল্প করতে দেখে আবার হুটোপুটি করতে করতে চলে যাচ্ছিল। ছোটাচ্চু তাদেরকে থামাল, বলল, “এই, এক সেকেন্ড!”

বাচ্চাগুলো দাঁড়াল। ছোটাচ্চু বলল, “তোরা একটা কাজ করতে পারবি?”

“কী কাজ?”

“ঝুমুকে বলবি আমার খুবই ইম্পরট্যান্ট একজন বন্ধু এসেছে, তার জন্য ফার্স্ট ক্লাস চা বানিয়ে দিতে।”

বাচ্চাগুলো এবারে জয়ন্তকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, সবচেয়ে ছোটজন ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এই বন্ধু খুব ইম্পরট্যান্ট?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“দেখে ইম্পরট্যান্ট মনে হয় না।”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কেন ইম্পরট্যান্ট?”

ছোটাচ্চু বলল, “বন্ধুর সামনে বলা যাবে না। ও লজ্জা পেতে পারে। ও যখন চলে যাবে তখন বলব।”

বাচ্চারা কিছুক্ষণ জয়ন্তকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তারপর আবার হুটোপুটি করতে করতে ভেতরে চলে গেল। তারা ঝুমু খালাকে চা বানিয়ে দেওয়ার কথা বলল, সাথে সাথে বাসার অন্য সব ছেলেমেয়েকে বলে এল যে ছোটাচ্চুর খুব ইম্পরট্যান্ট একটা বন্ধু এসেছে। বন্ধুটা চলে যাবার পর ছোটাচ্চু সবাইকে বলবে কেন তার বন্ধুটা এত ইম্পরট্যান্ট।

কাজেই কিছুক্ষণের ভেতরেই বাসার অন্য বাচ্চারাও ছোটাচ্চুর এই ইম্পরট্যান্ট বন্ধুটাকে দেখতে চলে এলো এবং বসার ঘরের জানালার বাইরে থেকে তারা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। ছোটাচ্চু বাচ্চাদের ফিস ফিস কথা শুনতে পেয়ে তাদের ডাকল, “এই তোরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করছিস কেন? সামনে আয়।”

তখন বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বসার ঘরে এসে ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্তকে সামনাসামনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। জয়ন্ত কী করবে বুঝতে না পেরে মুখ হাসি হাসি করে রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইল।

ছোটাছুও হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোরা সবাই ভালো করে আমার এই বন্ধুটাকে দেখে নে। আমার এই বন্ধু খুবই ইম্পরট্যান্ট একজন মানুষ।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন ইম্পরট্যান্ট ছোটাচ্চু।”

“আমার বন্ধু চলে যাবার পর বলব। এখন বললে একটু লজ্জা পেতে পারে।”

শান্ত বলল, “কেন লজ্জা পাবে? তোমার এই বন্ধু কী লজ্জার কোনো কাজ করে?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না! লজ্জার কাজ কেন করবে।”

জয়ন্ত তখন খুবই ব্রিবত হয়ে বলল, “আরে শাহরিয়ার তুই এসব কী শুরু করেছিস? ইম্পরট্যান্ট আবার কী? তোর সবসময় একটা নাটক করার অভ্যাস। যেটা বলার সোজাসুজি বলে ফেল। আমিও শুনি তুই আমার সম্পর্কে কী বলিস।”

বাচ্চারা সবাই চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। বল ছোটাচ্চু, বল।”

“তাহলে বলি, শোন।” ছোটাচ্চু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলছে সেরকম ভান করে বলল, “আমার এই বন্ধুর নাম জয়ন্ত। আমাদের ব্যাচে দুজন জয়ন্ত ছিল তাই আমরা এই জয়ন্তকে ডাকতাম চিকন-চাকন জয়ন্ত।”

সবচেয়ে ছোটজন বলল, “এই জন্য ইম্পরট্যান্ট?”

“আরে না! এই জন্যে কেউ ইম্পরট্যান্ট হয় নাকি। ইম্পরট্যান্ট অন্য কারণে।”

প্রমি জিজ্ঞেস করল, “আরেকজন যে জয়ন্ত ছিল তাকে তোমরা কী ডাকতে?”

ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত বলল, “তাকে সবাই ডাকত নাদুসনুদুস জয়ন্ত।” নাম শুনে বাচ্চারা আনন্দে হি হি করে হাসল।

ছোটাচ্চু হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর আবার তার গল্প শুরু করল, “আমাদের ক্লাসে কিছু খুব সিরিয়াস ছেলে-মেয়ে ছিল আর কিছু ছিল ফাঁকিবাজ। ফাঁকিবাজদের মাঝে এক নম্বর ছিল আমাদের জয়ন্ত। চিকন-চাকন। জয়ন্ত।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “আর তুমি কয় নম্বর ছিলে?”

“দুই কিংবা তিন নম্বর। যাই হোক অনার্স পরীক্ষায় আমাদের জয়ন্ত ডাব্বা মারল–”

ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত আপত্তি করে বলল, “পুরা ডাব্বা মারি নাই। এক সাবজেক্টে শুধু রিপিট–

“যাই হোক পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে জয়ন্তের আব্বু রেগে ফায়ার। আংকেল খুবই কড়া মানুষ ছিলেন। তখন আংকেল কী করলেন জানিস?”

শান্ত বলল, “বাড়ি থেকে বের করে দিলেন?”

ছোটাচ্চু বলল, “একজাক্টলি। জয়ন্তকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। জয়ন্ত মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়। একদিন এর সাথে থাকে, আরেকদিন আরেকজনের সাথে থাকে। তখন একদিন যখন আংকেল বাসায় নাই সে গোপনে বাসায় গেছে। আন্টি তাকে ভাত খাওয়ালেন তারপর তার বিয়ের নেকলেসটা দিয়ে বললেন এটা বিক্রি করে কিছু একটা করতে।”

ছোটাচ্চু একটু থামল, জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, “কী দিন গিয়েছে! মনে আছে তোদের নিয়ে সেই নেকলেস বিক্রি করতে গেলাম, জুয়েলারির দোকান আমাদের বিশ্বাস করে না। মনে করে আমরা চুরি করে এনেছি। পারলে পুলিশে খবর দেয়।”

ছোটাচ্চু বলল, “মনে নাই আবার। যাই হোক জয়ন্ত আন্টির নেকলেস বিক্রির টাকা দিয়ে বিজনেস শুরু করল। প্রথম বিজনেসটা কীসের ছিল কে বলতে পারবে?

শান্ত বলল, “ইয়াবা। ড্রাগের বিজনেসে টাকা সবচেয়ে বেশি।”

প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “ইয়ারকি করবি না।”

ছোটাচ্চু বলল, “জয়ন্তের প্রথম বিজনেস ছিল বল্লরি।”

“সেইটা আবার কী?”

“একটা হিন্দি সিনেমার নায়িকার ড্রেস। ঈদের আগে এই সিনেমা খুব হিট। আমাদের জয়ন্ত কীভাবে কীভাবে জানি আন্দাজ করল ঈদে নায়িকার এই ড্রেস পপুলার হবে। হাজার খানেক ড্রেস বানিয়ে সে রেডি। আসলেই ঈদের আগে হঠাৎ করে সবার মুখে শুধু বল্লরী ড্রেসের কথা। আমাদের জয়ন্ত সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারে না–এক ধাক্কায় বড়লোক। এইভাবে শুরু। তারপর কত কী যে বিজনেস করেছে বলে শেষ করা যাবে না। সাইকেল থেকে শুরু করে সফটওয়্যার। হোটেল থেকে শুরু করে শিপিং। এখন জয়ন্ত কী পরিমাণে বড়লোক হয়েছে তোরা কেউ চিন্তাও করতে পারবি না।”

একজন জানতে চাইল, “কী রকম বড়লোক?”

ছোটাচ্চু এমনভাবে কথা বলতে লাগল যে জয়ন্ত না, সে নিজেই বুঝি বড়লোক। হাত নেড়ে বলল, “খালি একটা উদাহরণ দেই। গত সামারে জয়ন্তের হঠাৎ করে ব্রাসেলস যেতে হবে। সে কীভাবে গেছে বল দেখি?”

টুম্পা বলল, “প্লেনে।”

শান্ত বলল, “ধুর গাধা। প্লেনে তো যাবেই, হেঁটে যাবে নাকি?”

প্রমি বলল, “বিজনেস ক্লাসে।”

“হলো না।”

শান্ত বলল, “ফার্স্ট ক্লাসে!”

“উঁহু” ছোটাচ্চু বলল, জয়ন্ত প্লেনের টিকিট পায় না, তখন সে আস্ত একটা প্লেন চার্টার করে ফেলল। ছোট একটা পার্সোনাল জেট!”

সবগুলো বাচ্চা তখন একসাথে বিস্ময়ের শব্দ করল। শান্ত বলল, “আমরা যেরকম সিএনজি রিজার্ভ যাই সেইরকম প্লেন রিজার্ভ?”

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ। সেইরকম।”

জয়ন্ত বিব্রত হয়ে বলল, “দেখ শাহরিয়ার তুই এমনভাবে বলছিস যে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি সবসময় প্লেন চার্টার করি। একবার করতে হয়েছিল—“

ছোটাচ্চু জয়ন্তের কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। নিজের মতো করে বলতে থাকল, “বসন্ধুরায় তার একটা বাসা আছে। সেই বাসায় হাতে ম্যাপ না নিয়ে যদি যাস তাহলে হারিয়ে যাবি। সেই বাসায় কী নাই! ছাদের ওপর সুইমিং পুল।

বাচ্চারা সুইমিংপুলের কথা শুনে এক সাথে সবাই বিস্ময়ের শব্দ করল। ছোটাচ্চু বলল, “টাকা খরচ করে শেষ করতে পারে না। সেজন্যে জয়ন্ত কী করেছে জানিস?”

“কী করেছে?”

“তার বাসার নিচে একটা আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করেছে। বাংলাদেশের যত বড় বড় শিল্পী আছে তাদের সবার ছবি আছে।”

শাহানা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “জয়নুল আবেদীন?”

জয়ন্ত লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, “আছে।”

“কামরুল হাসান?”

“আছে।”

“সুলতান?”

“আছে।”

“শাহাবুদ্দিন? কিবরিয়া? আব্বুর রাজ্জাক?”

“আছে। মোটামুটি সবারই আছে!” জয়ন্ত শাহানার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, “তোমার পেইন্টিং ভালো লাগে?”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “জী। খুব ভালো লাগে।”

শান্ত বলল, “যদি ট্যারা-ব্যাকা ছবি হয় যেটা দেখে আগা-মাথা কিছু বোঝা যায় না সেইসব পেইন্টিং শাহানাপুর সবচেয়ে ভালো লাগে।”

শাহানা শান্তর মাথায় একা চাটি মেরে বলল, “যেটা বুঝিস না সেইটা নিয়ে কথা বলিস না।”

শান্ত বলল, “তা হলে আমার কথা বলাই বন্ধ হয়ে যাবে।”

প্রমি বলল, “তখন আমাদের সবার শান্তি হবে।”

জয়ন্ত শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার যদি পেইন্টিং ভালো লাগে তাহলে একদিন আমার বাসায় এসে আমার কালেকশনটা দেখে যেও। ভালো লাগবে।”

এক সাথে সব বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”

শাহানা বলল, “তোরা যাবি মানে? তোরা গিয়ে কী করবি? কোনোদিন গিয়েছিস কোনো আর্ট এক্সিবিশনে? কতবার আমি নিয়ে যেতে চেয়েছি। গিয়েছিস?”

সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল, তারা আসলে পেইন্টিং বুঝে না। তাই কখনো যায় নাই।

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা তো আমাকে কথাই শেষ করতে দিলি না, তোরা কী ভেবেছিস জয়ন্তের বাসায় শুধু সুইমিং পুল আর আর্ট মিউজিয়াম আছে?”

সবাই জানতে চাইল, “আর কী আছে ছোটাচ্চু?”

“রীতিমতো চিড়িয়াখানা। বাঘ-ভাল্লুক-হরিণ-ময়ূর কী নেই।”

“সত্যি?” বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “সত্যি সত্যি বাঘ-ভালুক আছে?”

জয়ন্ত বলল, “না, না, বাঘ-ভালুক নেই। কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণ আছে, বানর আছে, খরগোস আছে, ময়ূর আছে, অনেক রকম পাখি আছে। মাছ আছে। রেয়ার গাছ আছে।”

বাচ্চারা চিৎকার করতে থাকল, “দেখব। দেখব। আমরা দেখব।”

জয়ন্ত বলল, “সবাই মিলে চলে এসো। সুইমিংপুলে গোসল করবে, চিড়িয়াখানা দেখবে, পেইন্টিং দেখবে, দুপুরে খাবে”

শান্ত চিৎকার দিল, “খাব। খাব। আমরা খাব!”

জয়ন্ত হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিলে বলল, “তুই বাচ্চা কাচ্চাদের একদিন নিয়ে আয়। সারাদিন থাকবে ঘুরে বেড়াবে।”

বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু। হ্যাঁ। হ্যাঁ।”

টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের কোনদিন নিয়ে যাবে না। ছোটাচ্চুর কিছু মনে থাকে না।”

অনেকেই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ছোটাচ্চু সবকিছু ভুলে যায়।”

শান্ত বলল, “আমি মনে করিয়ে দেব।”

জয়ন্ত বলল, “ঠিক আছে, শাহরিয়ারকে নিতে হবে না। আমি আমার বড় ভ্যানটা পাঠিয়ে দেব, সাথে ম্যানেজার থাকবে। সে তোমাদের নিয়ে যাবে।”

সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “ইয়েস। ইয়েস। সেইটাই সবচেয়ে ভালো। ছোটাচ্চুকে কিছু করতে দিলেই ছোটাচ্চু সেটা মাখিয়ে ফেলে।”

জয়ন্ত বলল, “সেইটা আমিও বিশ্বাস করি। এই জন্যে আমরা তোমাদের ছোটাচ্চুকে ডাকতাম আধা মাধা শাহরিয়ার। মনে আছে শাহরিয়ার?”

ছোটাচ্চু মুখ বিকৃত করে বলল, “মনে নাই আবার?”

ঠিক তখন ঝুমু খালা প্লেট বোঝাই খাবার আর চা নিয়ে এলো বলে আলাপ থামিয়ে সবাই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

.

এক সপ্তাহ পরে ভোরবেলা জয়ন্ত একটা বড় ভ্যান পাঠিয়ে দিল। সাথে ভ্যানের ড্রাইভার আর একজন হাসিখুশি ম্যানেজার। বাসার সব বাচ্চা সেই ভ্যানটাতে গাদাগাদি করে উঠে বসল। ছোটাচ্চু ছাড়াই সবাই যাওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেল একেবার শেষ মুহূর্তে ছোটাচ্চুও ভ্যানে উঠে বসেছে।

ছুটির দিন, তাই রাস্তায় ভিড় নেই। সবাই দেখতে দেখতে জয়ন্তের বাসায় পৌঁছে গেল। ছোটাচ্চু ভুল বলে নাই বিশাল একটা জায়গা নিয়ে জয়ন্তের বাসা, বাইরে থেকেই বোঝা যায় না ভেতরে অনেক জায়গা। বড় একটা গেট খুলে গেল, তখন বিশাল ভ্যানটা ভেতরে ঢুকে পড়ে। ড্রাইভওয়েতে ভ্যানটা থামতেই সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়ির ওপর জয়ন্ত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়েছিল, সে নিচে নেমে এলো। শান্ত এগিয়ে গিয়ে বলল, “জয়ন্ত কাকু, আমরা সবাই এসে গেছি।”

“ভেরি গুড।”

“আমরা ছোটাচ্চুকে ছাড়াই আসতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ছোটাচ্চু জোর করে চলে এসেছে।”

জয়ন্ত হাসি মুখে বলল, “তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাদের ছোটাচ্চুকে ব্যস্ত রাখব যেন সে তোমাদের ডিস্টার্ব করতে না পারে।”

শান্ত বলল, “ভেরি গুড।”

জয়ন্ত ছোট কয়েকজনকে নামতে সাহায্য করল, তারপর বলল, “ডাইনিং টেবিলে তোমাদের জন্যে কিছু স্ন্যাকস্ রাখা আছে। আগে একটু খেয়ে নাও, তারপর যার যেটা পছন্দ সেটা দেখতে থাকো।

।সবাই বাসা থেকে নাশতা করে এসেছে কিন্তু খাবারের কথা শুনে আবার তাদের খিদে পেয়ে গেল। জয়ন্ত সবাইকে ভেতরে নিতে নিতে বলল, “সুইমিং পুলটা ছাদে। যারা সাঁতার জানো না তাদের জন্যে এক পাশে ছোট পুল আছে, পানি কম। তোমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আজকের জন্য আমি দুজন লাইফগার্ড নিয়ে এসেছি। তারা দেখবে।”

টুম্পা জানতে চাইল, “চিড়িয়াখানা কই?”

“বাসার পেছনে। কোনো হিংস্র প্রাণী নাই কিন্তু বানর থেকে একটু সাবধান। ছোট বাচ্চা দেখলে মাঝে মাঝে জ্বালাতন করে।”

মুনিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী রকম জ্বালাতন?”

“এই তো–মনে করো হাতে ললিপপ আছে, টান দিয়ে নিয়ে নেবে। হাজার হলেও বানর, তাই বাঁদরামি যায় না।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “আর পেইন্টিংগুলো?”

“সেটা বেসমেন্টে। কাউকে বললেই নিচে নিয়ে যাবে।”

সবাই প্রথমে ডাইনিং টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিল। তারপর বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই চিড়িয়াখানা দেখার জন্য ছুটল। সেটা দেখে শেষ করেই সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেখানে ঝাপাঝাপি করে যখন খিদেটা জাগিয়ে উঠবে তখন লাঞ্চ।

জয়ন্ত চা খেয়ে ছোটাচ্চুকে নিয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল কী একটা জরুরি কাজ আছে সেটা সেরে দুপুরের আগেই ফিরে আসবে।

সবাই যখন বাইরে হইচই চেঁচামেচি করছে তখন শাহানা বেসমেন্টে গেল। পেইন্টিংগুলো দেখার জন্য। অন্য কারো সেগুলো নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, শুধু টুনি শাহানার পিছু পিছু গেল। শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথায় যাস?”

“তোমার সাথে। পেইন্টিং দেখতে।”

“চিড়িয়াখানা দেখবি না?”

টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “চিড়িয়াখানা তো সব সময় দেখি। দাদি সবসময় বলে না আমাদের বাসা হচ্ছে একটা চিড়িয়াখানা! টিকিট লাগিয়ে দিলে মানুষজন টিকিট কেটে আমাদের দেখতে আসবে।

শাহানা হাসল, বলল, “তা ঠিক।”

বেসমেন্টটা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগাল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার পর একটা বড় হলঘর, ভেতরে কুসুম কুসুম ঠাণ্ডা। হলঘরের দেওয়ালে পেইন্টিংগুলো ঝোলানো। খুব সুন্দর করে ছোট ছোট আলো লাগানো আছে যেন পেইন্টিংগুলো ভালো করে দেখা যায়। দেখে মনে হয় একেবারে সত্যিকারের মিউজিয়াম।

শাহানা আর টুনি যখন মাত্র পেইন্টিংগুলো দেখা শুরু করেছে তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি একটা মানুষ এসে হাজির হলো। মানুষটার মাথায় চুল কম, যেটুকু চুল আছে মাঝখানে সিঁথি করে সেটা দুই ভাগ করে চাদিটা ঢেকে রেখেছে। পরনে একটা স্যুট এবং গলায় টাই। স্যুটটা মনে হয় ছোট হয়ে গেছে, শরীরের সাথে কেমন জানি টাইট করে লাগানো। গলায় লাল রংয়ের চিকন একটা টাই। মানুষটার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতরে। নাকের নিচে হিটলারের মতো গোঁফ, সেটা আবার চিকন হয়ে ঠোঁটের ওপর দিয়ে দুই পাশে নেমে গেছে। টুনি এর আগে কখনো কারো এরকম গোঁফ দেখেনি। একজন মানুষের চেহারা দেখে তাকে পছন্দ কিংবা অপছন্দ করা ঠিক না। কিন্তু এই মানুষটাকে দেখেই টুনির কেন জানি তাকে একেবারেই পছন্দ হলো না।

মানুষটা যখন মুখ খুলল তখন টুনি বুঝতে পারল তার ধারণাটা মনে হয় ঠিকই আছে। তার কারণ মানুষটা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা কে? এইখানে কী করছ?”

টুনির মনে হলো সে বলে, “আপনি কে? আপনি এইখানে কী করছেন?”

কিন্তু সে কিছু বলল না, সাথে শাহানা আছে। শাহানা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কথাবার্তা যা বলার সেই বলবে। শাহানা মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমরা পরিচয় দিলে মনে হয় চিনতে পারবেন না! জয়ন্ত কাকু আমাদের ফেমিলি ফ্রেন্ড। আমাদের এখানে ইনভাইট করেছেন। বিশেষ করে তার পেইন্টিং কালেকশন দেখার জন্য। সেজন্যে এসেছি।”

মানুষটা খুব বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল, “আমাকে কিছু বলল না–”

শাহানা বলল, “মনে হয় বুঝতে পারেন নাই যে আপনার পারমিশান নিতে হবে?”

এবারে মানুষটা একটু থতমত খেলে গেল, আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে পারমিশান না–মানে ইয়ে–” বলে কথা শেষ না করেই থেমে গেল।

শাহানা আর টুনি অপেক্ষা করছিল কখন মানুষটা সরে যাবে তখন তারা পেইন্টিংগুলো দেখা শুরু করবে। কিন্তু মানুষটা সরে গেল না, একেবারে তাদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

তখন শাহানা বাধ্য হয়ে আরেকটু কথা বলল, “আপনি বুঝি এখানে আছেন?”

“হ্যাঁ। স্যার আমাকে এই আর্ট কালেকশনের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি দেখে-শুনে রাখি।”

শাহানা বলল, “ও।”

মানুষটা বলল, “ঠিক আছে, পেইন্টিং দেখতে চাইলে দেখো, কিন্তু নো ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফি। হাত দিয়ে ছুবে না।”

শাহানা মাথা নাড়ল, “ছুবো না।”

“ঘরটা হিউমিনিডিটি এন্ড টেম্পারেচার কন্ট্রোলড। পেইন্টিংগুলো ওয়েল প্রোটেক্টেড। সিসি ক্যামেরা দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করা হয়। কাজেই উল্টাপাল্টা কিছু করো না।”

এবারে শাহানা আর টুনির একসাথে একটু মেজাজ গরম হলো। শাহানা শীতল গলায় বলল, “উল্টাপাল্টা বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?”

“উল্টাপাল্টা মানে উল্টাপাল্টা। ছোট ছেলেমেয়েরা পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব কী বুঝবে? তাদের কাছে একটা জয়নুল আর একটা রিকশার পেইন্টিংয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। কলম দিয়ে হয়তো একটা পেইন্টিংয়ের ওপর নিজের নাম লিখে ফেলল।”

শাহানা মুখ শক্ত করে বলল, “আমরা নিজের নাম লিখব না। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন কন্ট্রোল রুম থেকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পারেন।” কথা শেষ করে সে ঘুরে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “আর তোকে শিখাই কেমন করে একটা সুন্দর পেইন্টিং এনজয় করতে হয়।”

তারপর প্রথম পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে লোকটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “এই যে এইটা হচ্ছে জয়নুলের একটা ওয়াটার কালার। ময়মনসিংহের একটা জমিদারবাড়িতে ছিল তারপর হারিয়ে গেল। অনেকদিন কোনো খোঁজ ছিল না, তারপর হঠাৎ করে গুলশানের একটা আর্ট সাপ্লাইয়ের দোকানে হাজির হলো। এটা অরিজিনাল না ভুয়া সেইটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এক্সপার্টরা বলেছে এটা অরিজিনাল। তখন এটা নিলামে উঠেছিল, অনেক দামে জয়ন্ত কাকু কিনে নিয়েছেন।”

মাঝখানে সিঁথি করা এবং হিটলার ও সিরাজদৌলার মতো গোঁফের মানুষটা মুখটা হা করে শাহানার দিকে তাকিয়ে রইল। আমতা আমতা করে বলল, “তুমি এতসব কেমন করে জান?”

“আমার পেইন্টিং ভালো লাগে। জয়ন্ত কাকু যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমি এইখানে দিনের পর দিন পড়ে থাকব।”

ঠিক কী কারণ জানা নেই শাহানার কথা শুনে মানুষটার মুখটা কেমন জানি কালো হয়ে গেল। শাহানা অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, টুনি দেখল শাহানার চোখগুলো কেমন যেন ঢুলু ঢুলু হয়ে গেছে। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শাহানা পরের পেইন্টিংয়ের কাছে গেল। টুনিকে বলল, “এটা কামরুল হাসান। সবাই ওনাকে বলে পটুয়া কামরুল হাসান। শেষের দিকের আঁকা ছবি। শুধু তাকিয়ে দেখ, কী পাওয়ার ফুল ড্রয়িং, মাত্র কয়টা টান দিয়ে এঁকেছেন, লক্ষ্য কর। উজ্জ্বল রং–”

টাইট স্যুট এবং চিকন টাইয়ের মানুষটা শাহানার কথা শুনে কেমন জানি উশখুশ করতে লাগল, দেখে মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছে আবার ঠিক বলতে পারছে না কিছুক্ষণ ইতিউতি করে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোনো কথা না বলেই বিদায় নিল, শাহানা আর টুনি দুজনই তখন একেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

শাহানা বলল, “এখন শান্তিমতো পেইন্টিংগুলো দেখা যাবে।”

টুনি বলল, “হ্যাঁ। এই মানুষটার কিছু একটা সমস্যা আছে।”

“চেহারাটা ফানি। এইটা কী সমস্যা?”

“উঁহু।” টুনি মাথা নাড়ল, “চেহারা না। অন্যকিছু।”

শাহানা বলল, “বাদ দে। আয় পেইন্টিং দেখি।”

দুজন আবার ছবি দেখতে শুরু করে।

চার নম্বর পেইন্টিংটার সামনে এসে শাহানা হঠাৎ কেমন জানি চমকে উঠল। এক ধরনের আর্ত চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ।”

“কী হয়েছে?”

“ফেক পেইন্টিং।”

টুনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফেক? মানে ভুয়া?”

“হ্যাঁ।”

“কেমন করে বুঝলে?”

শাহানা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “কেমন করে বুঝলাম মানে? এইটা হওয়ার কথা একটা ওয়েল পেইন্টিং, ক্যানভাসের ওপর করা। ওয়েল পেইন্টিং হয় খসখসে, পেইন্টিং শুকিয়ে থাকে। আর এইটা হচ্ছে তার একটা ছবি, পিভিসিতে প্রিন্ট করে রেখেছে। চক চক করছে দেখছিস না?”

“কী আশ্চর্য! জয়ন্ত কাকু একটা ভুয়া পেইন্টিং কিনে সাজিয়ে রাখবেন?” টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হতেই পারে না।”

শাহানা প্রায় চিৎকার করে বলল, “হতেই পারে না মানে? নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করছিস না?”

টুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “শাহানাপু, আমার কী মনে হয় জান?”

“কী?”

“জয়ন্ত কাকু অরিজিনাল পেইন্টিংটাই কিনেছিলেন। কেউ একজন সেইটা চুরি করে ভুয়া এইটা এইখানে ঝুলিয়ে রেখেছে।”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “তুই ঠিকই বলেছিস। নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। আমাদের এক্ষুনি জয়ন্ত কাকুকে বলতে হবে।”

টুনি বলল, “দাঁড়াও শাহানাপু। নিশ্চয়ই ভেতর থেকে কেউ এইটা চুরি করেছে। আমরা বললেই সে সাবধান হয়ে যাবে। আমরা যে এইটা বুঝে ফেলেছি সেটা আগেই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। সত্যি কথা বলতে কী আমরা এখন কী করছি সেই চোর হয়তো সিসি টিভিতে সেটা দেখছে। তাই আমাদের ভান করতে হবে যেন আমরা কিছু বুঝি নাই। খুব নরমাল দেখাতে হবে।”

শাহানা বলল, “তোর কী মনে হয় টুনি? এই ফানি লুকিং লোকটাই চোর?”

“হতেও তো পারে। তারই তো চুরি করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখনো তো আমরা জানি না।”

শাহানা এদিক সেদিক তাকাল, “তারপর বলল, কে জানে এইটা ছাড়া আরও পেইন্টিং চুরি করেছে কি না কে জানে।”

“আগেই সেটা দেখতে যেও না শাহানাপু। আমরা একটা একটা করে দেখে যাই, তাহলে বের হয়ে যাবে।”

“এই ঘরটাতে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে, তাহলে চুরি করল কেমন করে?”

“সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে বোঝা যাবে। কে জানে কতদিন আগে চুরি করেছে।”

শাহানা রাগ রাগ মুখে বলল, “কত বড় সাহস। মদমাইশের বাচ্চা বদমাইশ।”

টুনি শাহানার দিকে তাকিলে বলল, “শাহানাপু তুমি এখনো রেগে আছ। আগে শান্ত হও। তোমার চেহারা দেখে যেন বুঝতে না পারে যে তুমি ধরে ফেলেছ এইটা ভুয়া পেইন্টিং।”

শাহানা বলল, “ঠিক আছে। আমি শান্ত ভাব দেখাই।”

শাহানা তখন শান্ত ভাব দেখিয়ে হয়ে নকল পেইন্টিংটা দেখার ভান করতে লাগল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “এত বড় ছবি চুরি করল কেমন করে?”

“কেন, বুঝতে পারছিস না? চাকু দিয়ে ফ্রেমের চারপাশে ক্যানভাসটা কেটে নেয়। তারপরে আগে থেকে প্রিন্ট করে আনা ভুয়া ছবিটা ফ্রেমের সাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়। চুরি করা পেইন্টিংটা ভাঁজ করে একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। খুবই সোজা।”

“তার মানে ছবির ফ্রেমটা ঘোয় না?”

“না। ছবির ফ্রেম তার জায়গাতেই থাকে।”

“কী আশ্চর্য।” টুনি মাথা নাড়ল, “চোরের কত বুদ্ধি দেখেছ?”

শাহানা হাসার চেষ্টা করল, “সেই জন্যেই তো গ্রামদেশে বাচ্চা হলে সবাই দোয়া করে বলত তোমার পিঁপড়ার মতো শক্তি হোক আর চোরের মতো বুদ্ধি হোক।”

“পিঁপড়ার অনেক শক্তি, তাই না?”

“তার সাইজের তুলনায় শক্তি বেশি না? নিজের ওজন থেকে কয়েকগুণ বেশি ওজন ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে পারে। তুই পারবি?”

টুনির স্বীকার করতে হলো যে সে পারবে না।

দুজন মোটামুটি শান্তভাবে পেইন্টিংটার সামনে সময় কাটিয়ে পরের পেইন্টিংটা দেখতে গেল। সেখান থেকে পরেরটা, এভাবে একটা একটা করে দেখে যেতে থাকে। অন্য যে কেউ হলে পেইন্টিংগুলো এক নজর দেখেই চলে যেত, শাহানা মোটেও সেই মানুষ না। সে প্রত্যেকটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, টুনির সাথে ছবির ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ করল। প্রায় শখানেক ছবি দেখে শেষ করতে তাদের দুই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। এর মাঝে চারটা ছবি ভুয়া। চোর যেই হোক সে জয়ন্ত কাকুর আর্ট মিউজিয়ামের চারটা পেইন্টিং চুরি করে ফেলেছে। কী আশ্চর্য।

বেসমেন্টের আর্ট মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ওপরে উঠে দুজন প্রথমে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে অনেক্ষণ বিশ্রাম নিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাদের হাটু ব্যথা হয়ে গেছে। তারপর উঠে ভেতরে যাবার সময় দেখল পাশে একটা ছোট ঘর সেখানে অনেকগুলো টেলিভিশন স্ক্রিনের সামনে একজন মোটাসোটা মানুষ বসে আছে। এটা নিশ্চয়ই এই বাসার সিকিউরিটি রুম, এখান থেকে সবগুলো সিসি টিভিকে দেখা যায়।

টুনি বলল, “শাহানাপু চল আমরা সিকিউরিটি রুমটা একটু দেখে আসি।”

“কী দেখবি?”

“সিসি টিভি থাকলেও পেইন্টিং কীভাবে চুরি করে সেইটা।”

“আয় যাই।”

সিকিউরিটি রুমে ঢুকতেই মোটাসোটা মানুষটা তাদের দিকে তাকিয়ে ভালো মানুষের মতো হাসল। টুনি আগেও লক্ষ করেছে শুকনো মানুষের মেজাজ হয় খিটখিটে আর মোটাসোটা মানুষের মেজাজ হয় হাসিখুশি। সিকিউরিটির মানুষটা বলল, “তোমাদের কী খবর? স্যারের আর্ট মিউজিয়াম কেমন দেখলে?”

শাহানা বলল, “অসাধারণ!”

মানুষটা বলল, “আমি সিসি ক্যামেরাতে দেখলাম তোমরা অনেক সময় নিয়ে ছবিগুলি দেখেছ!”

টুনি শাহানাকে দেখিয়ে বলল, “শাহানাপু পেইন্টিং খুব পছন্দ করে। সেই জন্যে!”

“তোমাদের আগে আর কেউ এত মনোযোগ দিয়ে এই ছবি দেখে নাই!”

শাহানা বলল, “আমি আবার দেখতে আসব।”

“এসো। স্যার খুশি হবেন। কেউ স্যারের পেইন্টিং দেখতে আসলে স্যার খুব খুশি হন।”

টুনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মানুষটার পেছনে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একসাথে সবগুলো স্ক্রিন দেখতে পারেন?”

“আসলে দেখতে হয় না। শুধু চোখ বুলাই। যদি এবনরমাল কিছু হয় তাহলে দেখি।”

“এবনরমাল?”

“হ্যাঁ।”

“সেটা কী রকম?”

“ধরা যাক হঠাৎ যদি দেখি কোনো অপরিচিত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে কিংবা পরিচিত মানুষ খুব সন্দেহের ভঙ্গিতে হাঁটছে–”

“কখনো কী হয়েছে এরকম?”

“না সেভাবে হয় নাই। যেমন মনে করো আজকে তোমরা যখন পেইন্টিংগুলো দেখছিলে তোমরা সারাক্ষণ নরমাল ভাবে দেখেছ। শুধু প্রথমদিকে একবার–”

টুনি আর শাহানা দুজনই এবারে মোটোসোটা মানুষটার দিকে তাকাল, “প্রথমদিকে কী?”

“প্রথম দিকে তোমরা যখন একটা পেইন্টিং দেখছিলে হঠাৎ করে খুব উত্তেজিত হয়ে গেলে, মনে হলো খুব আশ্চর্য কিছু দেখেছ।”

টুনি আর শাহানা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মানুষটা বলল, “কী ছিল ছবিটাতে, কী দেখে এত অবাক হয়েছিলে?”

শাহানা কী বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে”

টুনি তখন শাহানাকে রক্ষা করল, বলল, “ওয়েল পেইন্টিংটা অন্য স্টাইলে আঁকা ছিল, এরকম হয় না সাধারণত। তাই না শাহানাপু?”

“হ্যাঁ। একই সাথে ওয়েল আর প্যাস্টেল

মোটাসোটা মানুষটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম গিয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করি ছবিতে কোনো সমস্যা আছে কী না, কাদেরী বখস যেতে দিল না, বলল, কোনো সমস্যা নাই।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “কাদেরী বখস কে?”

“আমাদের আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “ঐ যে স্যুট পরে ছিলেন? লাল টাই?”

“হ্যাঁ।”

“চুলের মাঝখানে সিঁথি?”

“হ্যাঁ।“

“উনি কী অনেকদিক থেকে আছেন?”

“না। মাস খানেক হলো জয়েন করেছেন।”

মোটা মানুষটার সামনে রাখা স্ক্রিনগুলোর একটাতে হঠাৎ করে দেখা গেল মুনিয়া ছুটে একটা খরগোসের বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়েছে, আরেকটাতে দেখা গেল শান্ত একটা লাল হাফ প্যান্ট পরে সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। টুম্পাকে দেখা গেল খুব মনোযোগ দিয়ে একটা কাকাতুয়া পাখিকে পরীক্ষা করছে। একজন মানুষ যখন জানে না তাকে কেউ দেখছে তখন মানুষটাকে দেখতে অন্যরকম মনে হয়। কারণটা কী কে জানে!

শাহানা বলল, “আয় টুনি যাই। চিড়িয়াখানাটা দেখে আসি। মনে হচ্ছে সবাই মিলে অনেক মজা করছে।”

টুনি একটু ইতস্তত করে বলল, “তুমি যাও শাহানাপু। আমি এই আংকেলের সাথে বসে এই সিকিউরিটি সিস্টেমটা দেখে আসি। মনে হচ্ছে খুবই ফাটাফাটি সিস্টেম।”

শাহানা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিলে রইল। তারপর বলল, “ঠিক আছে দেখ। আমি গেলাম।”

টুনি তখন মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করল, “আমি একটু দেখি, আপনি কীভাবে কাজ করেন?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো! দেখার অবশ্য কিছু নাই। বসে থেকে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ বুলাই!”

“সেইটাই দেখি।”

মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড তখন টুনির জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার পাশে রাখে। টুনি সেখানে বসে স্ক্রিনগুলো দেখে। আর্ট মিউজিয়ামের ভেতর দুইটা ক্যামেরা, দুইপাশ থেকে হলঘরটা দেখা যায়। চারটা পেইন্টিং চুরি করে সেখানে সেই পেইন্টিংয়ের ছবি লাগানো হয়েছে। চুরি করার পুরো ব্যাপারটা কারো না কারো স্ক্রিনে দেখার কথা। সিকিউরিটি গার্ড কেন সেটা দেখতে পেল না?

টুনি কিছুক্ষণ স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “কেউ যদি পেইন্টিং চুরি করার চেষ্টা করে কিংবা নষ্ট করার চেষ্টা করে তাহলে আপনি এখানে বসে সেটা দেখে ফেলবেন, তাই না?”

“অবশ্যই। আমরা তিনজন আছি, আট ঘণ্টার শিফট। যার ডিউটি সে দেখে ফেলবে।”

“মনে করেন কেউ একটা পেইন্ট চুরি করতে চায় কিন্তু কোনো প্রমাণ রাখতে চায় না তাহলে?”

“সম্ভব না। প্রমাণ থেকেই যাবে। ক্যামেরায় সব রেকর্ড করা হতে থাকে। যদি দেখি একটা পেইন্টিং চুরি গেছে আমরা আমাদের রেকর্ড রিপ্লে করে সেটা বের করে ফেলব।”

টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “কেউ যদি ক্যামেরা দুইটা অচল করে দেয় তাহলে তো সেটা রেকর্ড হবে না?”

“না। ক্যামেরার কানেকশন খুলে ফেললে, তখন কিছু রেকর্ড হবে না। কিন্তু আমরা এখানে বসে দেখে ফেলব যে ক্যামেরা বন্ধ হয়ে আছে। তখন আমরা যাব দেখার জন্য ক্যামেরা বন্ধ হলো কেমন করে।”

টুনি বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “কখনো কী আর্ট মিউজিয়ামের হলঘরের ক্যামেরা বন্ধ হয়েছে?”

সিকিউরিটি গার্ড ঘুরে টুনির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। হঠাৎ করে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ? তোমরা কী স্যারের মিউজিয়ামে কিছু একটা দেখেছ যেটা দেখে তোমার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে?”

“আংকেল, আপনাকে আমি সেটা পরে বলব। আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন?”

সিকিউরিটি গার্ড বলল, “তুমি জান, আসলেই আর্ট মিউজিয়ামের ক্যামেরা দুইটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”

“কখন?”

“সপ্তাহ খানেক আগে।”

“তখন আপনি কী করেছেন?”

“আমি যখন ব্যাপারটা দেখার জন্য মিউজিয়ামে দৌড়ে যাব তখন ক্যামেরা দুইটা আবার চালু হয়ে গেল।”

“তার মানে কতক্ষণ ক্যামেরা বন্ধ ছিল?”

“খুবই কম সময়। খুব বেশি হলে দুই মিনিট হবে।”

“মাত্র দুই মিনিট?”

“হ্যাঁ। কিংবা আরো কম।”

টুনি একটু হতাশ হলো। দুই মিনিটের মাঝে চারটা পেইন্টিং তার ফ্রেম থেকে আলাদা করে, ভুয়া পেইন্টিংগুলো সেখানে আঠা দিয়ে লাগানো সম্ভব না। টুনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আর কখনো কী ক্যামেরা বন্ধ হয়েছিল?”

সিকিউরিটি গার্ড মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হয়েছিল।”

টুনি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কবে? কখন? কীভাবে? কতক্ষণ বন্ধ ছিল?”

“একই দিনে। প্রথমবার বন্ধ হবার ঘণ্টা খানেক পর।”

“কতক্ষণ বন্ধ ছিল?”

“একই রকমভাবে, আমি যখন দেখার জন্য মিউজিয়ামে যাব, তখন আবার ক্যামেরা অন হয়ে গেল। দুই মিনিটের ভেতর।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “ও। আচ্ছা। মাত্র দুই মিনিট?”

“হ্যাঁ। কিংবা আরো কম। রেকডিংটা রিপ্লে করলে তুমি একজাক্ট সময়টা পেয়ে যাবে। এত কম সময়ে কোনো কিছু করা সম্ভব না। তবু আমি তখন মিউজিয়ামে গিয়েছি সবগুলো পেইন্টিং দেখেছি। কোনো সমস্যা নাই। ভেতরে কাদেরী বক্স ছিল সেও আমার সাথে ঘুরে ঘুরে দেখেছে।”

টুনি ঘুরে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “উনি বলেছেন সব ঠিক আছে? কোনো সমস্যা নাই?”

সিকিউরিটি গার্ড টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। তাই বলেছেন। আর কী বলবেন? কী সমস্যা হতে পারে? দুই মিনিটের মাঝে তো আর কেউ কিছু করতে পারে না। পেইন্টিং এত বড় একটা জিনিস, কে নিয়ে কোথায় নেবে? পুরো বাসায় সিসি টিভি লাগানো ধরা পড়ে যাবে না!”

টুনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর বলল, “আংকেল আমি কি সিসি ক্যামেরার ভিডিওটা দেখতে পারি? যখন ওটা বন্ধ হয়েছিল?”

“অবশ্যই দেখতে পার। কিন্তু দেখার কিছু নাই; খালি একটা হলঘর। সেখানে কেউ নাই।”

“তবু একটু দেখি? প্লিজ।”

সিকিউরিটি গার্ড একটা কম্পিউটার চালু করল। সেটা চালু হতে একটু সময় নিল। তারপর সেই কম্পিউটারের বিভিন্ন ফাইলের ভেতর ঘাটাঘাটি করে একটা ফাইল বের করে সেটা চালু করল। টুনি দেখল কম্পিউটারের মনিটরে পেইন্টিং ঝোলানো হলঘরটা দেখা যাচ্ছে। সিকিউরিটি গার্ড ঠিকই বলেছে, যেহেতু ঘরে একটা মানুষও নাই ভিডিওটা খুবই বোরিং। সত্যিকথা বলতে ভিডিওটা কী চলছে নাকি বন্ধ হয়ে আছে সেটাও বোঝার উপায় নেই।

খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে টুনি বলল, “যখন ক্যামেরাটা বন্ধ হয়েছিল সেই অংশটা কোথায়?”

সিকিউরিটি গার্ড বলল, “ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে বের করতে হবে।”

তারপর মাউস দিয়ে এখানে সেখানে টোকা দিয়ে দ্রুত ভিডিওটা চালু করে জায়গাটা বের করে আনল। টুনি তখন ভিডিওটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। আর্ট মিউজিয়ামটা দেখা যাচ্ছে, ভেতরে কেউ নেই, শুধু ছবিগুলো ঝুলছে। হঠাৎ করে পুরোটা অন্ধকার হয়ে গেল। ওপরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ঠিক এক মিনিট একত্রিশ সেকেন্ড পর আবার ক্যামেরা চালু হয়ে স্ক্রিনে আর্ট মিউজিয়ামটা ভেসে উঠল। টুনি কিছুক্ষণ দেখে কেমন যেন একটু উত্তেজিত গলায় বলল, “এই জায়গাটা আবার দেখাবেন প্লিজ।”

“আবার?”

“হ্যাঁ। প্লিজ।”

সিকিউরিটি গার্ড অংশটা আবার দেখাল, দেখে টুনি এবারে আগের থেকে উত্তেজিত গলায় বলল, “আবার দেখাবেন প্লিজ? আবার। আবার!”

সিকিউরিটি গার্ড একটু অবাক হয়ে বলল, “আবার?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কী দেখছে বারবার?”

“আপনি ভালো করে দেখেন, তাহলে আপনিও দেখতে পাবেন।”

মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড আবার দেখাল। নিজেও দেখল কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেল না। হলঘরটা দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ ক্যামেরা বন্ধ হয়ে স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল, একটু পর আবার ক্যামেরা চালু হয়ে হলঘরটা দেখা যেতে শুরু করল।

টুনি উত্তেজিত হয়ে বলল, “দেখলেন? আপনি দেখলেন?”

সিকিউরিটি গার্ড মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি তো আজব কিছু দেখছি!”

টুনি বলল, “কেন দেখছেন না? প্রথমে আপনি দেখছেন সিসি ক্যামেরার ছবি। তারপর এটা এক-দুই মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে আবার যখন চালু হলো তখন সেই দৃশ্যটা আলাদা! সেটা অরিজিনাল সিসি ক্যামেরার ছবি না। সেটা সিসি ক্যামেরার সামনে ধরে রাখা এই ঘরটার একটা ছবি। তাকিয়ে দেখলে ছবিটা একটু খানি আলাদা।”

সিকিউরিটি গার্ড দেখল এবং চমকে উঠে বলল, “মাইয়াগো মাইয়া। কী সর্বনাশ!”

টুনি বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন কী করা হয়েছে? জয়ন্ত কাকুর এই মিউজিয়ামের একটা ছবি তুলে সেই ছবিটা সিসি ক্যামেরার সামনে ঝুলিয়ে রেখে ক্যামেরাটাকে ব্লক করেছে। সেই জন্যে ঘরের ভেতর কী হচ্ছে ক্যামেরাতে দেখা যাচ্ছে না! কিন্তু ঘরের ছবিটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে, তাই কেউ সন্দেহ করছে না।”

সিকিউরিটি গার্ড বলল, “এই ঘরে আরেকটা ক্যামেরা আছে।”

টুনি বলল, “সেই ক্যামেরটাতেও নিশ্চয়ই তাই করেছে।”

সিকিউরিটি গার্ড অন্য ক্যামেরার ভিডিওটাও খুঁজে বের করল এবং দেখা গেল সত্যি সত্যি ঐ ক্যামেরাও দেড় মিনিট বন্ধ ছিল তারপর যখন আবার চালু হলো তখন ক্যামেরায় যেরকম ছবি দেখার কথা সেরকম একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। তবে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ছবিটা ক্যামেরার সত্যিকারের ছবি না।

সিকিউরিটি গার্ড জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “কতক্ষণ এই ঘরটাকে ব্লক করে রেখেছে?”

“পুরো এক ঘণ্টার মতন! মনে নাই আপনি বলেছেন এক ঘণ্টা পর আবার ক্যামেরাগুলো এক দুই মিনিটের জন্য অচল হয়েছিল? তখন ছবিগুলো সরিয়ে আগের মতো করেছে। ততক্ষণে কাজ যা করার করা হয়ে গেছে।”

সিকিউরিটি গার্ড কেমন যেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী কাজ করেছে? তুমি বলেছিলে আমাকে বলবে। বল।”

টুনি বলল, “এই মিউজিয়ামের চারটা ওয়েল পেইন্টিং কেটে সেখানে পেইন্টিংটার একটা ছবি আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আসল পেইন্টিং নাই। যেটা আছে সেটা ভুয়া পেইন্টিং।”

সিকিউরিটি গার্ড চিৎকার করে বলল, “কী বলছ তুমি?”

“বিশ্বাস না করলে আপনি নিজে দেখে আসেন। তবে ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না।”

“কে এই কাজ করেছে?”

“আপনিই বলেন।”

“আমি কীভাবে বলব?”

“আপনি এই বাসায় থাকেন। সিকিউরিটির দায়িত্বে আছেন। আপনি না বললে, কে বলবে?”

“কিন্তু প্রমাণ ছাড়া একজনকে দোষ দিই কেমন করে?”

টুনি কিছু না বলে, উঠে দাঁড়াল। মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড বলল, “কই যাও?”

“বাইরে। দেখি অন্যরা কী করে?”

“কিন্তু পেইন্টিং চোরকে খুঁজে বের করবে না?”

টুনি বলল, “দেখি চিন্তা করে।”

“বেশি করে চিন্তা করো। আমি ভেবেছিলাম তোমার চাচা হচ্ছে। ডিটেকটিভ। তুমিও দেখি ডিটেকটিভ। আরো বড় ডিটেকটিভ।”

“কিন্তু আপনি কাউকে কিছু বলবেন না।”

“না, বলব না।”

টুনি কিছু বলল না, চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

.

দুপুরের খাবার সময় জয়ন্ত কাকু আর ছোটাচ্চু ফিরে এলেন। টুনি ছোটাচ্চুর কাছে গিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?”

“কী কাজ?”

“জয়ন্ত কাকুকে বলতে পারবে দুপুরে লাঞ্চের সময় যেন এই বাসার সবাইকে একটু ডেকে আনে।”

“সবাইকে? কেন?”

“আমি একটা জিনিস দেখেছি সেটা সবাইকে বলতে চাই।”

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, “কী দেখেছিস?”

“এখন বলব না। সবাইকে এক সাথে বলব।”

ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি নিচু গলায় বলল, “আরো একটা কথা।”

“কী কথা?”

“আমি যেসব কথা বলব তুমি সেগুলো চুপচাপ শুনে যাবে। আপত্তি করবে না।”

“কী বলবি?”

“যখন বলব, তখন শুনো।”

“কী আশ্চর্য।”

টুনি বলল, “কোনো আশ্চর্য না। তুমি দেখো।”

ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে পারল না, তবে টুনি যে শুধু শুধু একরম একটা নাটক করবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

.

দুপুরে খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে সব রকম খাবার দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে। খাওয়া শুরু করার আগে জয়ন্ত কাকু একটা খালি কাঁচের গ্লাস নিয়ে একটা চামুচ দিয়ে সেখানে টুং টুং শব্দ করে বলল, “ঘোষণা। জরুরি ঘোষণা।”

বাচ্চারা খাবার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে আছে। দৌড়াদৌড়ি করে সাঁতার কেটে পানিতে লাফঝাঁপ দিয়ে সবারই খিদেটা ভালো লেগেছে তাই ঘোষণাটা তাড়াতাড়ি শুনে শেষ করে দিতে চায়। জিজ্ঞেস করল, “কী ঘোষণা?”

জয়ন্ত কাকু বলল, “আসলে ঘোষণাটা দেবে তোমাদের টুনি। টুনি বলেছে বাসার সবার সামনে ঘোষণাটা দেবে। সেজন্য আমি বাসার সবাইকে ডেকেছি।” বলে জয়ন্ত কাকু গলা উঁচিয়ে বলল, “সবাই চলে এসো।”

তখন ডাইনিং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা সবাই একজন একজন করে ঢুকতে শুরু করলে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়াল। টুনি চোখের কোনা দিয়ে দেখল সবার মাঝে ছোটাচ্চুর আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর কাদেরী বশও আছে। কন্ট্রোল রুমের মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড আছে। সকাল বেলার হাসি খুশি ম্যানেজার, ভ্যানের ড্রাইভার, দুজন লাইফগার্ড, বাবুর্চি দারোয়ান সবাই আছে।”

জয়ন্ত কাকু জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের মাঝে টুনি কে?”

টুনি তার চশমাটা ঠিক করে এগিয়ে গেল, বলল, “আমি।”

জয়ন্ত কাকু টুনির সাইজ দেখে অবাক হয়ে বলল, “তুমি টুনি? তুমি ঘোষণা দেবে?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “জী জয়ন্ত কাকু।”

“ঠিক আছে তাহলে দাও।”

শান্ত বলল, “যা বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল। আমাদের অনেক খিদে পেয়েছে।”

শান্ত ভেবেছিল অন্য সবাই তার কথায় সায় দেবে কিন্তু দেখা গেল খিদে পেলেও সবাই ধৈর্য্য ধরে টুনির কথা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বুঝতে পেরেছে, টুনি নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা বলবে।

টুনি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “আজকে সকালে জয়ন্ত কাকুর বাসায় আসার সাথে সাথে শাহানাপু সবার আগে জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন দেখার জন্যে বেসমেন্টের বড় হলঘরটাতে গেছে। আমিও শাহানাপুর সাথে ছিলাম। শাহানাপু যেকোনো পেইন্টিং দেখে সেটা নিয়ে সবকিছু বলে ফেলতে পারে। সেখানে শাহানাপু কী দেখেছে সেটা এখন একটু বলবে।” তারপর টুনি শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহানাপু বল।”

শাহানা একটু থতমত খেয়ে বলল, “আমি? আমি কেন? তুইই বল।”

টুনি বলল, “না শাহানাপু। তুমি প্রথম লক্ষ করেছ তুমি বল। প্লিজ শাহানাপু।”

শাহানা তখন সবার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, “জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন অসাধারণ। মিউজিয়ামেও এরকম কালেকশান দেখা যায় না। কিন্তু—”

শাহানা একটু থামল এবং সবাই চোখ বড় বড় করে শাহানার দিকে তাকাল।

শাহানা বলল, “কিন্তু এই কালেকশানের চারটা ওয়েল পেইন্টিং চুরি করে সেই ফ্রেমে ভুয়া রিপ্রোডাকশান প্রিন্ট করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সোজা কথায় কোনো একজন পেইন্টিং চোর জয়ন্তাকাকুর চারটা পেইন্টিং চুরি করেছে।”

এবারে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। জয়ন্ত কাকু চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী? কোন চারটা?”

শাহানা বলল, “একটা শাহাবুদ্দিন। একটা কিবরিয়া। একটা আব্দুর রাজ্জাক। আরেকটা কনকচাপা।”

জয়ন্ত কাকু ঘুরে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল, “গার্ড! আর্ট কালেকশনের রুমে সিসি ক্যামেরা আছে না?”

টুনি হাত তুলে বলল, “জয়ন্ত কাকু আমি বলি। এই পেইন্টিং চোর অসাধারণ বুদ্ধিমান। সে এমনভাবে চুরি করেছে যে সিসি ক্যামেরাতে ধরা পড়েনি।”

জয়ন্ত কাকু বলল, “সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“ক্যামেরা দুইটাকে আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি দিয়ে ব্লক করেছে। তাই কন্ট্রোল রুমে আর্ট মিউজিয়াম পুরোটা সারাক্ষণ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু আসলে সেটা আসল আর্ট মিউজিয়াম ঘর না। সেটা আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি।”

“কী আশ্চর্য!”

“জয়ন্ত কাকু, আমি আসলে বলা শেষ করিনি।”

“বল, বল, শেষ করো।”

টুনি গলা পরিষ্কার করে বলল, “দেখতেই পাচ্ছেন, আপনি যেটা সন্দেহ করছিলেন সেটা সত্যি বের হয়েছে। আপনি আমাদের বাসায় এসে ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করেছিলেন, ছোটাচ্চু যেহেতু ডিটেকটিভ সেজন্য আপনি ছোটাচ্চুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন আর্ট গ্যালারির সিকিউরিটি কীভাবে দেওয়া যায়? ছোটাচ্চু আপনার কাছ থেকে সময় নিয়েছিল কমপ্লিট একটা প্ল্যান দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর মাঝে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনাকে একটা স্পাই পেন দিয়েছিল।”

কথাগুলো সত্যি না তাই জয়ন্তকাকু কিছু একটা বলতে চাইছিল, টুনি দেখল ছোটাচ্চু জয়ন্তকাকুর হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু বলেছিল এই স্পাই পেনটা আর্ট মিউজিয়ামের হলঘরের মাঝামাঝি কোনো একটা ফ্রেমের ওপর রেখে দিতে। আপনি সেটা রেখে দিয়েছিলেন। পেইন্টিং চোর সেটা জানত না। তাই সে সিসি ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়েছিল সত্যি কিন্তু ছোটাচ্চুর স্পাই পেনকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। স্পাই পেনে তার সব কাজকর্ম রেকর্ড হয়েছে। স্পাই পেনটা মুভমেন্ট না হলে রেকর্ড করে না সেইজন্য ব্যাটারি খরচ হয় না। কাজেই আমাদের কাছে পেইন্টিং চুরির পুরো ভিডিও আছে। সেটা সবাইকে দেখানোর জন্য আপনাদের সবাইকে ডেকে এনেছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে যিনি চুরি করেছেন তিনিও এইখানে আছেন।”

সবাই এবারে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে। টুনির চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখলে কাদেরী বকসের চেহারা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে। মানুষটা দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে সে তার চিকন লাল টাইটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল।

টুনি বলল, “ভিডিওটা দেখার জন্য আমার একটা ল্যাপটপ লাগবে। জয়ন্ত কাকু একটা ল্যাপটপ কী আনা যাবে?”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। অবশ্যই আনা যাবে বলে জয়ন্ত কাকু তার একজন কর্মচারীকে বললেন, “আমার অফিস ঘরের টেবিল থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে আসো দেখি।”

কর্মচারীটা সাথে সাথে অফিস ঘরের দিকে দৌড়াল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “স্পাই পেনটা কোথায়?”

টুনি বলল, “সিকিউরিটি গার্ড আংকেলের কাছে। গার্ড আংকেল দেবেন একটু?”

মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড খুবই গম্ভীর মুখে পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে দিল। টুনি সাবধানে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা কলম বের করল, বলল, “এই যে স্পাই পেন।”

শান্ত বলল, “হায় খোদা! এইটা তো দেখতে একেবারে কলমের মতো।”

“এই জন্যে এইটার নাম স্পাই পেন। এর ভেতরে ভিডিও ক্যামেরা আছে। ইউএসবি পোর্ট আছে। একটু আগে আমরা কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটারে দেখেছি। পুরো ভিডিওটা আছে, এখন সবাইকে দেখাব।”

টুনি কলমের মতো দেখতে স্পাই পেনটা সোজা করে ধরে সবাইকে দেখাতে দেখাতে বলে “এইটার সামনে ক্যামেরাটা। যখন রেকর্ড করে তখন পেছনে একটা সবুজ এলইডি জ্বলে-নেভে। ব্যাটারি কমে গেলে এলইডিটা লাল হয়ে জ্বলে, তখন চার্জ করতে হয়।”

টুনি যখন স্পাই পেনটা উঁচু করে ধরে রেখেছে তখন হঠাৎ যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। কাদেরী বখস হঠাৎ ছুটে এসে একটা লাফ দিয়ে স্পাই পেনটা ছিনিয়ে নিয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিল। সবাই এত হকচকিয়ে গেল যে প্রথমে কয়েক সেকেন্ড কেউ বুঝতেই পারল না কী হচ্ছে। যখন বুঝতে পারল তখন কয়েকজন কাদেরী বখসের পেছন পেছন ছুটল। বাসার বাইরে দৌড়ে গিয়ে কয়েকজন তাকে ধরে ফেলল। হাত থেকে স্পাই পেনটা কেড়ে নিল একজন। তারপর তাকে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে এলো, তাকে ধরে আনার জন্যে চিকন লাল টাইটা খুব কাজে লাগল।

সিকিউরিটি গার্ড তাকে পিছমোড়া করে ধরে রাখল। অতি উৎসাহী একজন একটা ঘুষি মারার চেষ্টা করছিল জয়ন্ত কাকু তখন প্রচণ্ড একটা ধমক দিল, “খবরদার কেউ গায়ে হাত দেবে না।”

কাদেরী বখসকে ধরে জয়ন্ত কাকুর সামনে আনা হলো। মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়েছিল, মাঝখানে সিঁথি করে যত্ন করে চুলকে দুইভাগ করে টাক মাথাটাকে ঢেকে রাখা হয়েছিল এখন সব ওলটপালট হয়ে টাক মাথা বের হয়ে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।

জয়ন্ত কাকু বলল, “কাদেরী সাহেব, আপনাকে আমি বিশ্বাস করে আমার এখানে চাকরি দিয়েছি আর আপনি এরকম একটা কাজ করতে পারলেন? আমার চার-চারটা পেইন্টিং চুরি করলেন। চুরি করতে গিয়ে পেইন্টিংগুলোর কত ডেমেজ করেছেন কে জানে–”

কাদেরী বখস নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে করতে বলল, “স্যার আমি চুরি করতে চাই নাই স্যার। আমি স্যার হাই ফেমিলির ছেলে–জীবনে এই কাজ করি নাই। আমাকে স্যার একজন বাধ্য করেছে। সেই মানুষ অনেক ভয় দেখিয়েছে।”

জয়ন্ত কাকু ধমক দিয়ে বলল, “এসব বাজে কথা বলবেন না। কেউ কাউকে ভয় দেখিয়ে চুরি করাতে পারে না।”

কাদেরী বকস দুই হাত জোর করে বলল, “স্যার, আমাকে পুলিশে দেবেন স্যার। আল্লাহর কসম লাগে স্যার, আমি সব পেইন্টিং ফেরত দেব স্যার। আমার ফেমিলি পথে বসবে স্যার।”

সবাই গোল হয়ে ঘিরে কথাবার্তা শুনেছিল। তখন একজন বলল, “ল্যাপটপ এসে গেছে। চুরির ভিডিওটা আগে দেখি আমরা।” সবাই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখি। স্পাই পেনটা কার কাছে?”

একজন স্পাই পেনটা টুনির হাতে দিল। টুনি সেটা হাতে নিয়ে একটু লাজুক মুখে হেসে বলল, “আসলে কোনো ভিডিও নাই।”

“ভিডিও নাই মানে?” শান্ত চিৎকার করে বলল, “স্পাই পেন ভিডিও রেকর্ড করে নাই?”

টুনি বলল, “এইটা স্পাই পেন না। এইটা শাহানাপুর বল পয়েন্ট কলম।” তারপর কলমটা শাহানাপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “নাও শাহানাপু তোমার কলম।”

শান্ত কেমন জানি রেগে উঠল, “তার মানে, তার মানে–”

টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “আমরা জানি চারটা পেইন্টিং চুরি গেছে। কিন্তু কে চুরি করেছে সেইটা তো জানি না। সেইটা ধরার জন্য এই নাটকটা করেছি।”

শান্ত তখনো রেগে আছে। চোখ মুখ লাল করে বলল, “তুই এইভাবে এতজন মানুষের সামনে এইভাবে মিথ্যা কথা বললি কেমন করে?”

যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেছে। প্রথম একজন-দুইজন, তারপর সবাই হাসতে শুরু করেছে। সবার শেষে ব্যাপারটা বুঝতে পারল কাদেরী বকস, তখন তার যা একটা চেহারা হলো সেটা আর বলার মতো না।

জয়ন্ত কাকু সিকিউরিটি গার্ডকে বলল, “আপনি একে নিয়ে যান। যদি আসলেই চারটা পেইন্টিং ফেরত দেয় একটা মুচলেকা লেখিয়ে ছেড়ে দেবেন। যদি না দেয় থানায় হ্যাঁন্ডওভার করেন।”

কাদেরী বকস নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে বলল, “দেব স্যার। ফেরত দেব। খোদার কসম।”

সিকিউরিটি গার্ড কাদেরী বখসের হাত ধরে নিয়ে যাবার আগে টুনির কাছে এসে বলল, “থ্যাংকু টুনি। তুমি চোরকে ধরে না দিলে খুব লজ্জার ব্যাপার হতো! আমাদের চাকরি থাকত না। আমার কোম্পানির বসকে আমি তোমার কথা বলব।”

টুনি বলল, “আপনাকেও থ্যাংকু, আমার সাথে একটিং করতে রাজি হওয়ার জন্য।”

শান্ত বলল, “চল, এখনই খাই।”

সবাই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ খাই। যা খিদে লেগেছে সেটা আর বলার মতো না।”

জয়ন্ত কাকু একটু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল, “তাহলে টুনি, শাহানা, তোমাদের আমি কী পুরস্কার দিতে পারি?”

শাহানা বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। আমাকে মাঝে মাঝে পেইন্টিংগুলো দেখতে দিলেই হবে।”

টুনি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাহলেই হবে।”

জয়ন্ত কাকু স্যান্ডউইচে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “সেটা তো আসতেই পার। যখন খুশি। সেটা তো পুরস্কার হলো না।”

টুনি বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। পেইন্টিং উদ্ধার হয়েছে সেইটাই পুরস্কার।”

জয়ন্ত কাকু বলল, “তোমাদের সবাইকে এক সপ্তাহের জন্যে রাঙামাটি কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনস বেড়াতে পাঠালে কেমন হয়?”

জয়ন্ত কাকুর কথা শুনে সবাই এত জোরে চিৎকার দিল যে কী হয়েছে সেটা দেখার জন্যে বাসার সবাই আবার ছুটে এলো। চিড়িয়াখানার বানরটা ভয় পেয়ে গাছের মগডালে উঠে জান দিয়ে চেঁচাতে লাগল।

এই বাচ্চাদের মতোই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *